অসমিয়া ভাষা এবং বাংলার সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্যের পারস্পরিক সম্পর্ক ৷৷ একটি কালানুক্রমিক এবং কালিক অনুসন্ধান ৷৷ উপসংহার



 

 (মূল গবেষণা  অভিসন্দর্ভে ‘উপভাষা’ শব্দটিই ছিল, ‘ভাষাবৈচিত্র্য’ ছিল না ।  

আগেকার অধ্যায়গুলোর জন্যে এখানে ক্লিক করুন। অথবা...)

 

।। সূচিপত্র ।।

 

(প্রতিটি অধ্যায় শিরোনামে ক্লিক করে নির্দিষ্ট অধ্যায়ে পৌঁছে  যাবেন)             


                                                                                                                      

১) প্রাককথন                                                               📘          

২) প্রথম অধ্যায়: 

    অসমিয়া ও বাংলা ভাষা অধ্যয়নের ইতিহাস: বিশ্ববীক্ষার বৈচিত্র্য ও

    মতপার্থক্যের রূপরেখা                                                📘            

৩) দ্বিতীয় অধ্যায়: 

    ভাষাবৈচিত্র্য তথা উপভাষা বিজ্ঞানের আলোকে অসমিয়া ও বাংলা ভাষার আঞ্চলিক

    রূপবৈচিত্র্য                                                              📘             

৪) তৃতীয় অধ্যায়: 

     অসমিয়া,মানবাংলা,সিলেটি এবং দুএকটি প্রতিবেশী ভাষা ও

    ভাষাবৈচিত্রের ধ্বনিতাত্ত্বিক তুলনা                                   📘         

৫) চতুর্থ অধ্যায়: 

    অসমিয়া,মান বাংলা,সিলেটি এবং দুএকটি প্রতিবেশী ভাষা ও

    ভাষাবৈচিত্রের রূপতাত্ত্বিক তুলনা                                  📘           

৬) পঞ্চম অধ্যায়: 

     অসমিয়া,মান বাংলা,সিলেটি এবং দুএকটি প্রতিবেশী ভাষা ও

    ভাষাবৈচিত্রের শব্দার্থতাত্ত্বিক তুলনা                              📘             

৭) ষষ্ঠ অধ্যায়: 

    অসমিয়া,মানবাংলা,সিলেটি এবং দুএকটি প্রতিবেশী ভাষা ও

   ভাষাবৈচিত্রের বাক্যতাত্ত্বিক তুলনা                               📘              

৮) সপ্তম অধ্যায়:  অসমিয়া-বাংলা- সিলেটি লিপি              📘              

৯)  উপসংহার                                                          📘          

 

 



 

 

ন্দর্ভের নির্দিষ্ট অধ্যায়গুলিতে আমরা যা কিছু আলোচনা করে এলাম,এখানে সেগুলোর একটি সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করছি শুরুতেই আমরা লিখেছিলাম,অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি বেণুধর রাজখোয়ার বই Notes on Sylheti Dialect১৯১৩তে প্রকাশিত হবার পর থেকেই বাণীকান্ত কাকতিকে বাদ দিয়ে অধিকাংশ অসমিয়া গবেষক এটা দাবি করে থাকেন যে অসমিয়ার সঙ্গে সিলেটির এত নিকট সম্পর্ক যে একে বাংলার না বলে অসমিয়ারই একটি উপভাষা তথা ভাষাবৈচিত্র্য হিসেবে দাবি বা বিবেচনা করা যায়।সিলেটিরা নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দেয়াতে তাদের আক্ষেপ করতেও দেখা যায়। অন্যদিকে বিলেতে এবং বাংলাদেশে কিছু সিলেটিরা মনে করেন এটি একটি স্বতন্ত্র ভাষা---বাংলাও নয়,অসমিয়াও নয়সম্প্রতি প্রকাশিত জগন্নাথ চক্রবর্তী এবং আবিদ রাজা মজুমদারের দুই অভিধানের কোনোটিতেই বরাক উপত্যকার বাংলাভাষাকে আর যাই হোক ‘সিলেটি’ নামে চিহ্নিত করা হয় নি। মূলত এরকম একটি সমস্যাকে সামনে রেখে আমাদের অধ্যয়ন শুরু হয়েছিল।

যদিও বা আমাদের অধ্যয়নের বিষয় হচ্ছে,‘অসমিয়া ভাষা এবং বাংলার সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্যের পারস্পরিক সম্পর্ক’ –শুরু থেকেই আমরা মান বাংলা ভাষা তথা সমগ্র বাংলাভাষাগুচ্ছকেও আমাদের অধ্যয়নের বিষয় করে নিয়েছি। তার কারণ, আমাদের মান বাংলার সঙ্গে সিলেটি এবং অসমিয়ার সম্পর্কটিকেও দেখতে হচ্ছিল।আরো স্পষ্ট করে লিখলে অসমিয়ার দাবিটিতো আছেই,আমাদের দেখতে হচ্ছিল সিলেটি  বাংলাভাষাগুচ্ছের সদস্য কি না। আর সেটি করতে গেলে মান বাংলা এবং বাংলার আরো কয়েকটি ভাষাবৈচিত্র্যের স্বরূপ না বুঝলে আমাদের চলছিল না। আর ভাষাচিন্তার জন্যে মান বাংলার কা্ছে আমাদের ঋণ তো কিছুতেই অস্বীকার করবার মতো নয়। বর্তমান অধ্যয়নে আমরা মান অসমিয়া ভাষাচিন্তার কাছেও অনেক ঋণী হলাম। ফলে কার্যত আমাদের অধ্যয়ন দাঁড়িয়েছে মান বাংলা এবং মান অসমিয়ার সঙ্গে সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্যের এবং আরো দুই একটি ভাষাবৈচিত্র্যের তুলনামূলক অধ্যয়ন। সিলেটি ভাষাচিন্তা বলে স্বতন্ত্র কিছু নেই,ফলে প্রথম অধ্যায়ে আমাদের বুঝে নিতে হচ্ছিল বাংলা এবং অসমিয়া ভাষাচিন্তার পরম্পরাটিকে। অধ্যায়টির শিরোনাম ‘অসমিয়া ও বাংলা ভাষা অধ্যয়নের ইতিহাস: বিশ্ববীক্ষার বৈচিত্র্য ও মতপার্থক্যের রূপরেখা

 মোটাদাগে যদিও বা ভাষা এবং ভূগোলকে এক করে ভাবা হয়, প্রথম অধ্যায়ে আমরা দেখিয়েছিলাম তাতে সমস্যা আছে।আজ যে ভূখণ্ডকে বাংলাদেশ,পশ্চিম বাংলা বা অসম বা সিলেট বলে জানি,চিরদিন তাই ছিল না দেশনাম।নামগুলো অতি সাম্প্রতিক।আর ভূখণ্ডেরও কোনো স্থৈর্য ছিল না।আমরা লিখেছিলাম,“অসমের ভাষা অসমিয়া, বাংলার ভাষা বাংলা --- একথা বললে একটা কাজ চালাবার গোছের ব্যাপার হয়,সত্যের অনেকটাই চাপা পড়ে।কথাগুলো বেশ জট পাকানো।আমাদের তাই ইতিহাসের এই জটগুলো খুলে খুলেই বুঝতে হবে ভাষা এবং জনগোষ্ঠী দুটো গড়ে উঠল কীভাবে,কবে,কোথায়”একই ভূখণ্ডে বহু ভাষাভাষীর বাস যেমন সত্য,সত্য তাদের মধ্যে আদান প্রদান,তেমনি কোনো এক ভাষাগোষ্ঠীর সব মানুষের অবস্থান সভ্যতা- বিকাশের সমস্তরে থাকে না।  নীহার রঞ্জন রায়ের এই সম্পর্কে একটি মন্তব্য আমরা উদ্ধার করেছি। ফলে আমাদের কাছে সমস্যা ছিল একই অধ্যায়ে বাংলা অসম ভূখণ্ড এবং বাংলা অসমিয়া ভাষার ইতিহাসের একটি স্পষ্ট ধারণা তুলে ধরা। সেই কাজ আমরা সমগ্র সন্দর্ভ জুড়ে করেছি, প্রাসঙ্গিক বিষয় ধরে ধরে। প্রথম অধ্যায়ে আমরা দুই ভাষাতেই ভাষা চিন্তার একটি সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত তুলে ধরবার চেষ্টা করেছি, যাতে আমাদের পরবর্তী যাত্রা সুগম হয়। সেই সুবাদে দুই ভাষাতেই ‘উপভাষা’ তথা ‘ভাষাবৈচিত্র্য’ অধ্যয়নের সূচনাকাল এবং স্বরূপটিকেও বুঝবার চেষ্টা করেছি। প্রাক-ঔপনিবেশিক কালে মুখের ভাষাতে সাহিত্য সৃষ্টি নিয়ে লেখকদের মধ্যে একটি দ্বিধা সবসময়েই ছিল। বাংলা বা অসমিয়াতে ভাষাচিন্তার সেরকম কোনো নজির নজরে পড়েনি। তবু সেসব সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব অতিক্রম করেও যেটুকু সাহিত্যচর্চা হয়েছিল, তাতে করে সারা বাংলার সাহিত্যের একটি আদর্শ ‘সাধু’ ভাষা গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ভাষাচর্চার ইতিহাস শুরু হয় নি সেই ‘সাধু’ ভাষাকে ধরে। ইতিহাসের বাঁকা পথের এ এক উজ্জ্বল সাক্ষর। বাংলা এবং অসমিয়া ভারতীয় উপমহাদেশের দুই গুরুত্বপূর্ণ আর্যভাষার প্রথম অভিধান লেখা হয়েছিল একই শতাব্দীতে কয়েক দশকের তফাতে মাত্র। আর দুটোই ছিল দ্বিভাষিক।পর্তুগিজ পাদ্রি মনোএল দ্য আসসুম্পসাউর অভিধান বেরোয় ১৭৪৩তে। র ভিত্তি ছিল ঢাকার বাংলা ভাষা। অন্যদিকে ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে আহোম পুরোহিত শ্রেণির প্রখ্যাত মহন পরিবারের টেঙাই পণ্ডিত বরঅম্র, লতিঅম্র’ নামে একটি আহোম-অসমিয়া দ্বিভাষিক অভিধান লিখেছিলেন,মতান্তরে সংগ্রহ করেছিলেন। সেখান থেকে শুরু করে পরবর্তী দুই শতকে বাংলা এবং অসমিয়াতে ভাষাচিন্তা এবং কাজের বিকাশের একটি রূপরেখা আমরা তুলে ধরেছি। বাংলাতে অসমিয়া নিয়ে এবং অসমিয়া ভাষাচিন্তাতে বাংলা প্রসঙ্গে অধ্যয়নের ইতিবৃত্তও বুঝবার চেষ্টা করেছি। বিশ শতকের শেষভাগে স্বতন্ত্ভাবে ‘উপভাষা’ তথা বিভিন্ন ভাষাবৈচিত্র্য অধ্যয়নের ইতিবৃত্তও বুঝবার  একটি প্রয়াস আছে সেখানে। পূর্বোত্তর ভারতে বাংলাতে সেই সব ভাষাবৈচিত্র্য নিয়ে আমাদের আগেকার কাজেরও একটি পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। সেই প্রসঙ্গে ‘সিলেটি’ নিয়ে দুই ভাষাতে অধ্যয়ন এবং বিতর্কের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে, যে পরিচয় আরো বিস্তৃত হয়েছে, পরবর্তী দ্বিতীয় অধ্যায়ে। 

দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম ভাষাবৈচিত্র্য তথা উপভাষা বিজ্ঞানের আলোকে অসমিয়া ও বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপবৈচিত্র্যএই অধ্যায়ের শুরু  হয়েছে ‘উপভাষার সংজ্ঞা দিয়ে,এসেছে মান ভাষার সংজ্ঞাও। সেই সঙ্গে মান ভাষা এবং উপভাষার ভেদরেখা টানবার সমস্যা নিয়েও বিস্তৃত আলোকপাত করা হয়েছে। হুমায়ুন আজাদের মতো আমরাও মনে করি ‘উপভাষা মাত্রেই ভাষা,কিন্তু ভাষা মাত্রেই উপভাষা নয়।’ তাই বলে  ‘উপভাষা’ পারিভাষিক নামটির সঙ্গে হীনতার,বিকৃতির তথা উপেক্ষার ভাব একটি জড়িয়ে থাকে বলে আমরা বিকল্পে পারিভাষিক নাম প্রস্তাব করেছি ‘ভাষাবৈচিত্র্য।’ একটি মান ভাষার থেকে ভাষাবৈচিত্র্যগুলো দেখা দেবার নিন্মমুখী গতি,এবং ভাষাবৈচিত্র্যগুলোর থেকে মান ভাষা গড়ে উঠবার ঊর্ধ্বমুখী গতির কথা যথাসাধ্য আলোচনার চেষ্টা করেছি প্রাসঙ্গিক অংশেনিম্নমুখী গতি অনেকটাই বংশবিস্তারের মতো,যার উপরে ভাষাবৈচিত্র্যগুলোর হস্তক্ষেপ করবার কোনো স্বাধীনতা থাকে না,কিন্তু ঊর্ধ্বমুখী গতিটি পরিবার গড়বার মতো বিষয়,একটি  ভাষাবৈচিত্র্য ব্যবহারকারী সমাজের সদস্যরা নিজেরাই ঠিক করেন,তারা কোন ভাষা-পরিবারের সদস্য হবেন।তাই এই নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবার চূড়ান্ত অধিকারীও তারাই। সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান সেই সিদ্ধান্তকে ব্যাখ্যা করতে পারে,হস্তক্ষেপ করতে পারে না। ফলে সিলেটি বাংলা না অসমিয়ার ভাষাবৈচিত্র্য সেই সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারী কেবল সিলেটিরাই। মান অসমিয়া কিংবা মান বাংলার কোনো ভাষাবিজ্ঞানী নন। অসমের প্রেক্ষিতে ‘কাছাড়ি’ বিভাষার একটি তর্ক স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে,সেই তর্কের ধারণা দেবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সিলেটির নিজস্ব  ছ’টি সম্ভাব্য ভাষাবৈচিত্র্য তথা বিভাষার  কথা উল্লেখ করেছি অধ্যায়ের দ্বিতীয় ভাগে। তৃতীয় ভাগে রয়েছে সিলেটিকে অসমিয়া বলে দাবি করবার প্রেক্ষিতটির পরিচিতি। যে বেণুধর রাজখোয়ার লেখা ‘Notes on Sylhetee Dialect’ এর উপরে ভিত্তি করে দাবিটি করা হয়,সেই নোটের তাত্ত্বিক ভিত্তির সঙ্গে একটি প্রাথমিক পরিচয় করাবার চেষ্টা রয়েছে। সেই সঙ্গে সিলেটি নিয়ে অতি সাম্প্রতিক গবেষক ডউপেন রাভা হাকাচামের ‘ভাষা-উপভাষা’ চিন্তা এবং সিলেটি নিয়ে কাজের প্রাথমিক পরিচয়টি এই অধ্যায়ে তুলে ধরে পরবর্তী অধ্যায়গুলোর একটি কাঠামো আমরা এই অধ্যায়ে স্থির করেছি। বিশেষ করে পরবর্তী চারটি অধ্যায়ের আলোচনা এই কাঠামো ধরেই এগিয়েছে,প্রতিটি অধ্যায়ের প্রথমার্ধে ক্রমে ধ্বনি,রূপ, শব্দ এবং বাক্যগঠন রীতি নিয়ে সাধারণ আলোচনা করা হয়েছে।দ্বিতীয়ার্ধে যেহেতু অসমিয়া তাত্ত্বিক,বিশেষ করে উপেন রাভা হাকাচামই বিষয়টি নিয়ে সবচাইতে বিস্তৃত অধ্যয়ন করেছেন,তাই তাঁর বক্তব্য তুলে ধরে একাধারে কালিক এবং কালানুক্রমিক তথা ঐতিহাসিক-তুলনামূলক পদ্ধতিতে  পর্যালোচনা উপস্থিত করা হয়েছে শেষ তথা সপ্তম অধ্যায়ে আলোচিত হবে লিপি সেই কথার উল্লেখও এখানেই ছিল। শুধু তার কাঠামোটি ভিন্ন কেননা,অধ্যাপক উপেন রাভা হাকাচামই শুধু নন, খুব কম ভাষাবিজ্ঞানীই এই বিষয়টি নিয়ে অধ্যয়ন করেছেন।অথচ,লিপিই ধরে রাখে বিগত কালের ভাষার লিখিত রূপ।ভাষার দ্বারা লিপি নিয়ন্ত্রিতও হয়,ভাষাকে লিপি নিয়ন্ত্রণও করে।এই পুরো অধ্যয়নে যে আমরা প্রতিবেশী আর্য-অনার্য ভাষা-এবং ভাষাবৈচিত্র্য তথা উপভাষাগুলোর সাহায্য নিয়েছি সেই কথাটিরও সেখানে উল্লেখ ছিল সেরকম কিছু ভাষা-নমুনা অধ্যায়ের শেষে উল্লেখ করে রাখবার সঙ্গে সঙ্গে  আমাদের ক্ষেত্র সমীক্ষারও একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরবার চেষ্টা করেছি। 

তৃতীয় অধ্যায় ‘অসমিয়া,মানবাংলা,সিলেটি এবং দুএকটি প্রতিবেশী ভাষা ও ভাষাবৈচিত্র্যের ধ্বনিতাত্ত্বিক তুলনাশুরুতেই আমরা স্বাধীনভাবে বাংলা,অসমিয়া,সিলেটি এবং চট্টগ্রামী এবং নোয়াখালি বাংলা ভাষা বৈচিত্র্যের ধ্বনি সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কটি বোঝার চেষ্টা করেছিএরই জন্যে সুবিধের জন্যে প্রথমে প্রথানুগ ব্যাকরণ অনুযায়ী ধ্বনির শ্রেণি বিভাগ,ধ্বনির পরিবর্তনের সূত্র এবং স্বরূপ আলোচনা করেছিসেখানে শুরুতেই বিভাজ্য ধ্বনিগুলোর উচ্চারণ-স্থান এবং প্রকৃতি অনুসারে শ্রেণি বিভাজনগুলো বোঝার চেষ্টা হয়েছে। স্বরধ্বনির আলোচনা স্বতন্ত্র ভাবে রয়েছে। এই ভাগের শেষে  কালিক ভাষাবিজ্ঞান ধরে বিভাজ্য এবং অবিভাজ্য ধ্বনিম বা স্বনিম (phoneme) বোঝার চেষ্টা করছি।একেবারে শেষে যথারীতি অধ্যাপক উপেন রাভা হাকাচামের সিদ্ধান্তগুলোকে পুনপরীক্ষা করা হয়েছে --‘সিলেটি ধ্বনিতত্ত্ব  এবং  বাংলা - অসমিয়া ভাষা বিতর্ক’—এই উপশিরোনামে।

চট্টগ্রামী নোয়াখালিই নয়,আমরা মাঝে মধ্যেই অন্যান্য বাংলা ভাষাবৈচিত্র্যেরও আশ্রয় নিয়েছি,এরই জন্যে যে এদের সঙ্গে অসমিয়া এবং সিলেটির সেরকম আত্মীয়তা না পেলেই শুধু দাবি করা যেতে পারত যে বৃহৎ বাংলাভাষা-পরিবারের সঙ্গে সিলেটির সেরকম কোনো সম্পর্ক নেই,যেমনটা রয়েছে অসমিয়ার সঙ্গে।আমরা দেখিয়েছি,ছবিটি বিপরীত দাবি করতে হলে পুব বাংলার এই সব ভাষাবৈচিত্র্যকেও অসমিয়ার ভাষাবৈচিত্র্য বলে দাবি জানাতে হয়। অসমিয়ার বিভিন্ন ভাষাবৈচিত্র্যের প্রসঙ্গ আলোচনাতে এলেও  কোনো অধ্যায়েই তেমন বিস্তৃতভাবে আসে নি, এর জন্যে যে সেগুলোর সঙ্গে সিলেটি বা বাংলার অন্যান্য ভাষাবৈচিত্র্যের স্বাভাবিক ঘনিষ্ঠতা অনেক থাকলেও সেসবের অসমিয়া পরিচয় নিয়ে কোনো তর্ক নেই।

এই অধ্যায়ে মান ভাষা দুটির এবং বাংলার আর যে ভাষাবৈচিত্র্য দু’টি নিয়ে আমরা অনুসন্ধান চালিয়েছি সেসবের ধ্বনিপরিচিতি নিয়ে পূর্বসূরিদের সিদ্ধান্তকে আমরা সেভাবে প্রশ্ন না করলেও সিলেটি সম্পর্কে আমাদের অনেক সিদ্ধান্তই আনকোরা নতুন,একথা সবিনয়ে নিবেদন করতে পারি বিশেষ করে ক,চ,প বর্গ নিয়ে। আমরা সিলেটিতে ‘ˀ’/ˀk,ˀt͡s,ˀp/ এমন বেশ কিছু রুদ্ধস্বরপথ ধ্বনির প্রস্তাব করেছি।‘ক’ ধ্বনি অবস্থান নির্বিশেষে সিলেটিতে অসমিয়া ষ/x/ হয়ে যায় বলে পূর্বসূরি অনেকে যেভাবে দাবি করেছিলেন আমরা তা খণ্ডন করেছি।সিলেটি স্বরধ্বনিও আমরা পাঁচটির বেশি পাই নি।

যদিও অসমিয়া উষ্মধ্বনি ষ/x/ এবং সিলেটি হ/ɦ/ এর উচ্চারণস্থান ভিন্ন,কিন্তু সে অতি সামান্যই।অসমিয়া শ,স,ষ একক উচ্চারণে /x/ হয়ে যাবার মতো সিলেটি শ,স,ষ সব সময় না হলেও  শব্দের আদিতে থাকলে স্বরতন্ত্রীয় ‘হ’/ɦ/হয়ে যায়।মূলে ‘হ’ থাকলে সেটি লোপ পেয়ে যায় অথবা স্বরতন্ত্রীয় রুদ্ধ ধ্বনিতে পরিণত হয়। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ওডিবিএল-এ একটি শাস্ত্রবাক্য উদ্ধার করেছিলেন,“আশীর্বাদম ন গৃহ্যিয়াত পূর্বদেশ নিবাসিনাম/ ‘শতায়ুর’ ইতি বক্তব্যে, ‘হতায়ুর’ ইতি ভাষিনাম।।” সেটির আশ্রয় নিয়ে আমাদের প্রস্তাব এই অধ্যায়ে,আদি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাকে যেমন কেন্তুম-সতম গোষ্ঠীতে ভাগ করেছিলেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়--তেমনি বাংলা ভাষাকেও মোটা দাগে এই শ্লোক অনুসরণ করে--- শতায়ু-হতায়ু ভাগে দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলা যায়। এই ‘হতায়ু’ ভাগে কেবল সিলেটিই নয়,চট্টগ্রামী,নোয়াখালি,ঢাকাই সহ ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার দক্ষিণ-পুব পাড়ের সব ক’টি বাংলা ভাষাবৈচিত্র্যকে ধরা সম্ভব।সংস্কৃত শ্লোকটিতে ‘পূর্বদেশবাসি’দের কথা রয়েছে। তাতে মোটাদাগে স্বতন্ত্র ভাষা হলেও আর্যভাষা-পরিবারের সদস্য হিসেবে অসমিয়াও রয়েছে।সুতরাং ‘শ,স,ষ’ ধ্বনি তিনটির আচরণ সাম্যের কথা মনে রেখে যেভাবে কেবল অসমিয়া এবং সিলেটিকেই স্বতন্ত্র করে ফেলবার প্রয়াস হয় সেই প্রয়াস অসম্পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপের পরিণাম।


রকম একটি ধারণা রয়েছে যে বর্গীয় প্রথম ধ্বনিগুলোর সিলেটিতে মহাপ্রাণীভবন ঘটে, চতুর্থ ধ্বনিগুলোর অল্পপ্রাণীভবন ঘটে। আমাদের প্রস্তাব মহাপ্রাণীভবন বা অল্পপ্রাণীভবন হয় না নয়,কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় এই মাঝামাঝি পরিবর্তনঅধ্যাপক আবিদ রাজা মজুমদারের অনুসরণে আমরা এর নাম ভেবেছি ‘মধ্যপ্রাণীভবন’এবং তার দুটি প্রভেদের কথাও উল্লেখ করেছি।বর্গের প্রথম অল্পপ্রাণ ধ্বনিগুলো মধ্যপ্রাণ হলে অগ্রমুখ মধ্যপ্রাণ (পথের পথিক/ʔpɔt̪’er ʔpɔt̪’ik/) এবং বর্গের চতুর্থ মহাপ্রাণ ধ্বনি মধ্যপ্রাণ হলে পশ্চমুখ মধ্যপ্রাণ (ভালা/ b’ɐla/) বলে চিহ্নিত করতে পারি। সিলেটি যেহেতু লেখার ভাষা নয়,‘আফনারে’/ɐfnɐre/ --শব্দের মতো যে শব্দগুলোতে পূর্ণমহাপ্রাণীভবন  বা  অন্য আরো কিছু শব্দে পূর্ণঅল্পপ্রাণীভবন হয়,সেরকম না হলে  সাধারণ সাহিত্যিক রচনায় ‘মধ্যপ্রাণীভূত’ শব্দে মানবাংলার ব্যবহৃত বর্ণ পাল্টাবার প্রস্তাব আমরা করি নি। অর্থাৎ পথের পথিকের বদলে ‘ফথের ফথিক’ বা ‘ভালা’র বদলে ‘বালা’ লেখবার পক্ষে আমরা নই।একই সূত্র ধরে আমাদের প্রস্তাব,যেহেতু সিলেটি সহ পুব বাংলার অধিকাংশ ভাষাতেই সঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনি প্রধান ধ্বনি হিসেবে নেই,তাই সেই ভাষাবৈচিত্র্যগুলোকে ‘সঘোষ মধ্যপ্রাণসহ’ ভাষাগুচ্ছের সদস্য ধরে নিয়ে বাংলার সমস্ত ভাষাবৈচিত্র্যগুলোকেই সঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনিসহ ভাষাগুচ্ছ এবং সঘোষ মধ্যপ্রাণসহ ভাষাগুচ্ছ এই দুই বড় ভাগে ভাগ করে ফেলতে পারি।বাংলার যে ভাষাবৈচিত্র্যগুলো ‘হতায়ু’ ভাষাগুচ্ছের সদস্য তারাই ‘সঘোষ মধ্যপ্রাণসহ ভাষাগুচ্ছ’-এর সদস্য হবে বলেই আমাদের ধারণা। তেমনি অভিশ্রুতি এবং অপিনিহিতি বাংলাকে মোটা দাগে পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলাতে ভাগ করে। আমরা লিখেছি, ‘সিলেটি সহ পূর্ববাংলার ভাষাগুলোতে অভিশ্রুতি হয় না বললেই চলে। পশ্চিমেও এই প্রবণতাটি একেবারেই নবীন। পঞ্চদশ শতক অব্দি সারা বাংলাতেই অপিনিহিতই ছিল মূল প্রবণতা

চতুর্থ অধ্যায়ের শিরোনাম ‘অসমিয়া,মান বাংলা,সিলেটি এবং দুএকটি প্রতিবেশী ভাষা ও ভাষাবৈচিত্র্যের রূপতাত্ত্বিক তুলনা’এখানে সরাসরি রূপিমে উপরূপের বিভাজন দিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। শব্দনির্মাতা রূপিমগুলো বাদ দিয়ে মূলত পদনির্মাতা রূপিমের নামপদ এবং ক্রিয়াপদে ব্যবহার- বৈচিত্র্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। নামপদের লিঙ্গ বচন কারক, এবং ক্রিয়াপদে ভাব,পক্ষ,কাল নির্মাতা পরসর্গগুলো-- অর্থাৎ কোনো  বিভক্তি কোনো পদের রূপনিয়ন্ত্রণে কীরকম ভূমিকা রাখে---সেসব বোঝার চেষ্টা হয়েছে। সেজন্যে আমরা অধ্যায়টির প্রথম ভাগকে ‘নামরূপ’ এবং ‘ক্রিয়ারূপ’ এই দুই উপশিরোনামে ভাগ করে নিয়েছি। প্রচলিত ভাষাবিজ্ঞানের ধারণার থেকে আমাদের এই সব পরসর্গ তথা বিভক্তি চিহ্নিত করতে গিয়ে অনেকটাই সরে আসতে হয়েছে। যেমন ‘বুড়া’ শব্দে ‘ই’ যোগ করলেই স্ত্রীলিঙ্গের ‘বুড়ি’ মেলে এমন বহু সহজ সিদ্ধান্তের থেকে আমাদের সরে আসতে হয়েছে। অসমিয়া এবং সিলেটি সহ পুব বাংলার বহু ভাষাবৈচিত্র্যে প্রথম পুরুষ তথা অন্যপক্ষের সর্বনামে এক বচনে লিঙ্গভেদ হয়। মান বাংলাতে বচন বোঝাতে বিশুদ্ধ পরসর্গ মূলত একটিই -রা’এর উপরূপ হিসেবে ‘~গুলো,~গুলি,~গুনো’ আছে মান অসমিয়াতে এমনই বহুবচনে ‘-বোৰ,~বিলাক̖,~হঁত̖’ এই বদ্ধ রূপিমগুলো যুক্ত হয় পরম্পরাগত ব্যাকরণে বচনে বস্তু বা বিষয়ের সংখ্যা বোঝায়,কিন্তু পরিমাণ বোঝাবার জন্যে যেসব পরসর্গ ভাষাতে ব্যবহৃত হয় সেগুলোকে ব্যাখ্যা করবার কোনো ব্যবস্থা নেই। আমরা তাই ‘গণনাসম্ভব’ এবং গণনাতীত বলে দু’রকম বিশেষ্যের প্রস্তাব করেছি এর একটি সংখ্যাতে গোনা যায় অর্থাৎ ‘গণনাসম্ভব’,আরটি গণনার সমস্ত সম্ভাবনাকে অতিক্রম করে,এই অর্থে –‘গণনাতীত’এই নামে দুই বিশেষ্যের কথা মনে রাখলে অন্তত ‘দুধটুকু-দুধগুলো’র সমস্যার সমাধান করতে পারিসিলেটিতে সরাসরি এরকম পরসর্গ জুড়ে না, সিলেটির একটি নিজস্ব প্রবণতার কথা আমরা লিখেছি সে হলো ক্লীব সর্বনামের সঙ্গে নিশ্চয়ার্থক পরসর্গ জুড়ে যে পদটি নির্মিত হয় তার পুরোটাই বিশেষ্যের পরে অনুপদের মতো জুড়ে সিলেটিতে একাধারে সুনির্দেশ করবার এবং বচন বোঝানোর রীতি যেমন আম ইতা, গরু ইগুইন। ‘-রা’ এবং ‘-গু’ এরকম সর্বনামের সঙ্গ ছাড়া সিলেটিতে টেকে না এছাড়াও দুই মান ভাষাতে এবং সিলেটি সহ ভাষাবৈচিত্র্যগুলোতে পূর্বপদ-পরপদ যোগ করে অথবা পদের দ্বিত্ব করে বচন বোঝাবার রীতি বিস্তৃত আলোচিত হয়েছে।কারকের আলোচনাতে আমরা মান বাংলাতে এবং সিলেটি সহ বাংলার অন্যান্য ভাষাবৈচিত্র্যে সম্প্রদান কারকের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকারের যুক্তি পাইনি,একে গৌণকর্মের সঙ্গে এক করে দেখেছি।অ সমিয়াতে যদিও এর জায়গাতে নিমিত্ত কারকের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হয়েছে। যে মূল পরসর্গ কয়টি মান বাংলাতে  কারকের রূপনিয়ন্ত্রণ করে সেগুলোকে আমরা ‘কেতের̖’ এই ধ্বনিগুচ্ছে স্বতন্ত্র চিহ্নিত করেছি। এগুলোই প্রধান,বাকিগুলো এদের উপরূপ।অসমিয়া পরসর্গগুলো সংখ্যাতে সামান্য বেশি,সেগুলোকে আমরা একত্রে এই ধ্বনিগুচ্ছে বোঝাবার চেষ্টা করেছি ‘অসমিয়া কারকের সবক’টি পরসর্গকে বেঁধে ফেলা যায় এই ধ্বনি গুচ্ছে-- ‘একদিলৈকৈরত̖স্বাভাবিভাবে আর যা কিছুই আছে,সবই উপরূপ। তেমনি সিলেটি কারকের পরসর্গগুলোকে আমরা এই সংক্ষিপ্ত ধ্বনিগুচ্ছটির  মধ্যে বেঁধেছি—‘এরেতর̖নোয়াখালি- চট্টগ্রামীতে করণে ‘-ত̖’ নেই,তাই ক্রম পালটে ধ্বনিগুচ্ছটি হবে—‘এরেরত̖বাকি যা কিছু আছে সবই এগুলোর উপরূপতবে কারকের পরসর্গ কোনো মান ভাষা কিংবা ভাষাবৈচিত্র্যেই সুনির্দিষ্ট নয়।এক কারকের পরসর্গ প্রায়ই অন্য কারকে ব্যবহৃত হয়,যাকে বলে তির্যক প্রয়োগ।তাই আমাদের সিদ্ধান্ত,বাংলা–অসমিয়া দুই ভাষাতেই পরসর্গ ঠিক কোথায় বসবে সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুসরণে তার সুনির্দিষ্ট নিয়ম সন্ধান বৃথাবাংলা কিংবা অসমিয়া পুরোপুরি ‘সংশ্লেষণাত্মক’ বা পুরোপুরি ‘বিশ্লেষণাত্মক’ নয়যিনি কথা বলছেন বা লিখছেন তিনি কোন জায়গায় জোর দিতে চাইছেন,অধিকাংশ পরসর্গের ব্যবহার তাতেই সুনিশ্চিত হয়।পরসর্গ ছাড়াও বেশ কিছু অনুপদের ব্যবহারও বাংলা অসমিয়া এবং সিলেটি সহ বাংলার অন্যান্য ভাষাবৈচিত্র্যে হয়ে থাকে,বিশেষ করে করণে, অধিকরণে,অপাদানে সেই সব অনুপদ অসমিয়াতে পূর্বপদের সঙ্গে জুড়ে যাবার প্রবণতাই অধিকএবং এই প্রবণতাটির জন্যেই সন্ধির এবং ধ্বনিপরিবর্তনের সূত্র মেনে পরপদগুলো মূলরূপ এমনটাই  হারিয়ে ফেলে যে চেনাই কঠিন হয়‘-কৈ,-লৈ,দি,-এদি,-ৰে,-এৰে’ বদ্ধ রূপিমগুলোতে তাই হয়েছেমান বাংলার থেকে মান অসমিয়ার এগুলো এক বড় তফাত চিহ্নযার জন্যে আমাদের অসমিয়াতে নিমিত্তার্থক কারকের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হয়েছে।বাংলাতে যখন গুয়াহাটির জন্যে,সিলেটিতে যখন গুয়াহাটির লাগি,অসমিয়াতে তখন গুয়াহাটিলৈঅসমিয়াতে কর্তাকে চেনার জন্যে যদি অন্য কারো সঙ্গে সম্বন্ধ নির্দেশ করা হয়,তবে সেই কর্তার রূপনিয়ন্ত্রণে ‘পুরুষ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে,যা মান বাংলা কিংবা সিলেটি সহ বাংলার কোনো ভাষাবৈচিত্র্যে নেই। সেসবও উদাহরণ সহ নামরূপ উপশিরোনামে আলোচিত হয়েছে। ক্রিয়াপদের ভাবরূপে আমরা মান বাংলা,মান অসমিয়া এবং সিলেটি সহ বাংলার ভাষাবৈচিত্র্যগুলোতে বিশেষ রকমফের  পাইনি। ভাব এই সব ক’টি ভাষা বা ভাষাবৈচিত্র্যে-- নির্দেশক এবং  অনুজ্ঞা পারিভাষিক নাম হিসেবে আমরা ‘পুরুষ’-এর বদলে ‘পক্ষ’ গ্রহণ করেছি। সেই প্রস্তাব বহু আগেই পবিত্র সরকার সহ অনেকেই দিয়েছিলেন।শুধু এর তিন প্রকার ভেদটি আমরা বাংলাদেশের স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণ থেকে নিয়ে উত্তম, মধ্যম এবং প্রথম পুরুষের বিকল্পে প্রস্তাব করেছি বক্তা,শ্রোতা এবং অন্য পক্ষ।  

‘পক্ষ’-এর আলোচনা ‘কাল’-এর আলোচনাতে সম্প্রসারিত হয়েছে। কালের আমরা মৌলিক-যৌগিক বিভাজন গ্রহণ করতে সমর্থ হই নি,যদিও যৌগিক,মৌলিক ক্রিয়াপদের বিভাজন মেনে নিতে অসুবিধে নেই।আমরা যদিও  রামেশ্বর শ’কে অনুসরণ করে মৌলিক-যৌগিক নির্বিশেষে ক্রিয়ার আরো দুই বিভাজনের কথা ভেবেছি---একপদী এবং বহুপদী।বহুপদী ক্রিয়াপদে পূর্বাংশ অসমাপিকা রূপে থেকে ক্রিয়াপদের মূল অর্থ বোঝায়,কিন্তু কাল পক্ষ কিংবা ভাব বোঝাবার পরসর্গগুলো শেষের সমাপিকা অংশে যুক্ত হয়ে ক্রিয়ার রূপ নিয়ন্ত্রণ করে।অসমিয়াতেও ভাষাবিদদের মধ্যে মতভিন্নতার বাস্তবতাতে কালরূপকে আমাদের স্বাধীনভাবে বুঝে নিয়ে হয়েছে। ফলে বর্তমান এবং অতীতে অসম্পন্ন কালের একপদী রূপের কথা অন্যেরা বলে এলেও আমরা বহুপদী ভিন্নরূপের প্রস্তাব রেখেছি সেই সঙ্গে ঘটমান তথা অসম্পন্ন ভবিষ্যতের কালের প্রস্তাব সংযোজন করেছি।বাংলাতে যেখানে একপদী এবং বহুপদী ক্রিয়ার কালরূপ যথাক্রমে দশ (১০) এবং আটটি (৮) অসমিয়াতে সেই সংখ্যা একটি করে বেশি,ক্রমে এগারো (১১) এবং নয়টি (৯)তদুপরি অসম্পন্ন অতীত এবং বর্তমানের দুই বহুপদী বিকল্প রূপ রয়েছে সেই নিয়ে এক এবং বহুপদী ক্রিয়ার কালরূপের সংখ্যা দাঁড়ায় সমান এগারোটি(১১) সব মিলিয়ে অসমিয়া কালের সংখ্যা বাইশ (২২)কিন্তু গঠনের দিক থেকে এতগুলো রূপ নেইআছে মাত্র চৌদ্দ (১৪)সিলেটিতে কালের সংখ্যা অনুসন্ধান করতে হয়েছে আমাদের সেই সঙ্গে কালরূপ-নিয়ন্ত্রক পরসর্গগুলোকে চিহ্নিত করতে হয়েছে,আমরা যা পেয়েছি সে এরকম: দুই অনুজ্ঞা নিয়ে সিলেটিতে একপদী ক্রিয়ার কালরূপ পাচ্ছি বারোটি (১২)বহুপদী ক্রিয়ার কালরূপ দশটি (১০) সব মিলিয়ে সিলেটিতে কালরূপ বাইশটিই (২২) কিন্তু গঠন বিচারে সিলেটিতে ক্রিয়ার কাল নির্ণয় করতে একপদী এবং বহুপদী ক্রিয়ার দ্বিতীয়াংশের সঙ্গে মাত্র এই এগারোটি রূপিমই যুক্ত হচ্ছে--+এ,+(-ই)র̖,+ছ̖,+ল̖,+ত̖,+ছ̖,+ইব̖(-ইম̖),[+উক̖],+(-ই)ল̖,+ইল̖,+ব̖(-ম̖)’ অসমিয়ার থেকে সংখ্যাটি চার বেশি,মান বাংলার থেকে এক মান বাংলা কিংবা অসমিয়াতে ক্রিয়ারূপ নিয়ন্ত্রণে লিঙ্গ কোনো ভূমিকা পালন করে না।এই সব অধ্যয়নের উপরে ভিত্তি করে অধ্যায়ের দ্বিতীয় ভাগে যথারীতি আমরা অধ্যাপক উপেন রাভা হাকাচামের সিদ্ধান্তগুলো পর্যালোচনা করেছি ‘সিলেটি রূপতত্ত্ব এবং বাংলা - অসমিয়া ভাষা বিতর্ক’ এই উপশিরোনামে

পঞ্চম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘অসমিয়া,মান বাংলা,সিলেটি এবং দুএকটি প্রতিবেশী ভাষা ও ভাষাবৈচিত্র্যের শব্দার্থতাত্ত্বিক তুলনা’ অধ্যায়ের শিরোনামে যদিও ‘শব্দার্থতত্ত্ব’ কথাটি রেখেছি ভাষাবিজ্ঞানে যাকে ‘Semantics’ আমরা ঠিক সেই পদ্ধতিটি অনুসরণ করে উঠতে পারিনি।ভূমিকা অংশে তার কারণটাই ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করে,যথাপ্রাপ্ত অবস্থাকে মেনে নিয়ে ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান যেভাবে বিষয়টির অধ্যয়ন করে আমরা সেই পথেই  অধ্যয়ন করে গেছি।শুরুতেই শব্দের অর্থপরিবর্তনের স্থূল-সূক্ষ্ম কারকগুলোকে বোঝার চেষ্টা করে গেছি। সেখানে ‘উপকরণগত’ যে কারণটির কথা বলা হয়ে থাকে তার বিকল্পে আমাদের প্রস্তাব  ‘উৎপাদন পদ্ধতির বিকাশ তথা অর্থনৈতিক’ কারণটি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা যায়। এই কারণটির পরিসর অনেক ব্যাপকতর বলে আমাদের ধারণা অর্থপরিবর্তনের প্রকৃতি,সাদৃশ্য ইত্যাদি প্রসঙ্গও ক্রমে আলোচিত হয়েছে। আমাদের সিদ্ধান্ত শব্দের গঠন পরিবর্তনে শব্দের অর্থ তথা সামাজিক অনুষঙ্গগুলোই নির্ধারক ভূমিকা পালন করে।বিষয়টিকে নিয়ে আমরা সংক্ষেপে ‘শব্দ,অর্থ এবং সামাজিক অনুশাসন’ উপশিরোনামে স্বতন্ত্র আলোচনা করেছি। প্রতিটি বিষয়ে আমরা অবশ্যই মান বাংলা, মান অসমিয়া, সিলেটি এবং অন্যান্য ভাষাবৈচিত্র্যের উদাহরণসহ বিষয়গুলো বুঝার চেষ্টা করে গেছি।‘ শব্দভাণ্ডার’ও সেই ভাবেই আলোচিত হয়েছে। পূর্বসূরি অনেকে যেখানে মান বাংলা এবং অসমিয়া শব্দভাণ্ডারকে মৌলিক এবং আগন্তুক বলে মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করেছেন,আমরা সেখানে ‘উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মৌলিক’ এবং ‘অন্য ভাষার থেকে আগন্তুক’ এই দুই নামে চিহ্নিত করবার চেষ্টা করেছি।এই অধ্যয়ন করতে গিয়ে  দেশি শব্দের উৎসের অনিশ্চয়তা আমাদের এতটাই ভাবিয়েছে যে বিষয়টি আমরা ‘দেশী শব্দ এবং উৎসের অনিশ্চয়তা’ উপশিরোনামে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনার চেষ্টা করেছি।অধ্যাপক উপেন রাভা হাকাচাম এই ক্রমে সিলেটি শব্দ নিয়ে আলোচনা করেন নি,বেশ কিছু শব্দের পাশাপাশি তালিকা দিয়ে মান বাংলার সঙ্গে দূরত্ব এবং মান অসমিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন।অধ্যায়ের শেষভাগে আমরা সেগুলোই পর্যালোচনা করেছি এই উপশিরোনামে--- ‘সিলেটি শব্দার্থতত্ত্ব এবং বাংলা - অসমিয়া ভাষা বিতর্ক’অধ্যায়ের প্রথমাংশের আলোচনায় বলতে গেলে আমরা অতি অল্প শব্দের সাহায্য নিয়েই সূত্রগুলো স্থির করছিলাম।এই শেষ অংশেই সেই সূত্রগুলো ধরে প্রচুর সিলেটি এবং মান অসমিয়া-বাংলা শব্দকে আমাদের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখতে হয়েছে।

ষষ্ঠ অধ্যায়ের শিরোনাম ‘অসমিয়া,মানবাংলা,সিলেটি এবং দুএকটি প্রতিবেশী ভাষা ও ভাষাবৈচিত্র্যের বাক্যতাত্ত্বিক তুলনাশব্দতত্ত্বের মতোই বাক্যতত্ত্বের আলোচনাতেও আমাদের তাত্ত্বিক অসুবিধে প্রচুর ছিল। এখন পর্যন্ত বাক্যতত্ত্বের যেটুকু অধ্যয়ন পরম্পরাগত ভাষাবিজ্ঞানে হয়ে এসেছে সেসব অনেকটাই সঠিক হওয়া সত্ত্বেও ভাষাবিদের বিষয়-ভাবনার বৈচিত্র্য আমাদের সমস্যাতে ফেলেছিল।আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান কিংবা রূপান্তরমূলক- সৃজনমূলক ব্যাকরণের আশ্রয় নিয়েও বাংলা এবং অসমিয়া ভাষাবিদ্যাতে আলোচনা বেশি হয় নি।ফলে আমাদের নিজেদের একটা পথ নির্মাণ এখানেও করে নিয়ে প্রথম ভাগে ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের পথ ধরেই শুরু করতে হয়েছে।কালিক ভাষাবিজ্ঞান এবং রূপান্তরমূলক সৃজনমূলক ব্যাকরণ সম্পর্কে একেবারেই প্রাথমিক একটি ধারণার অবতারণা মাত্র করা হয়েছে। ‘বাক্যের  গুণ’ উপশিরোনামে ‘আকাঙ্ক্ষা,যোগ্যতা,আসত্তি’-র ধারণা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে যেহেতু পূর্বসূরিরা প্রসঙ্গটি ছুঁয়েছিলেন। বিষয়টিকে আমাদের বাংলা অসমিয়া বাক্যতত্ত্ব বোঝার জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় নি,কেন সেই সব ব্যাখ্যা যথাসাধ্য করা হয়েছে। দ্বিতীয় উপশিরোনাম ‘বাক্যের পদক্রম’এই কথা হুমায়ুন আজাদের, যে বাংলা বাক্যতত্ত্বে দুটি পরস্পর বিরোধী ক্রমের কথা বলা হয়ে থাকে।এর একটি অন্যটিকে বাতিল করে।একটি উদ্দেশ্য-বিধেয় ক্রম। হুমায়ুন আজাদের অনুসরণে আমরাও কেন একে বাদ দেবার পক্ষে,সে কথা প্রথমে আলোচিত হয়েছে। আমাদেরও মনে হয়েছে দ্বিতীয়টি,অর্থাৎবাক্যের কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া তথা কারক ক্রম’ অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যমান বাংলাতেও,মান অসমিয়াতেও এবং সিলেটি সহ অন্য সব ভাষাবৈচিত্র্যে।এই পুরো অধ্যায়েই এই বিষয়টিকে আমরা নানা ভাবে বিচার করার চেষ্টা করেছি।কারক এবং বাচ্য বিষয়টি রূপতত্ত্ব এবং বাক্যতত্ত্বের যৌথ বিষয়---এই আমাদের সিদ্ধান্ত। রূপতত্ত্বের বিষয় ছিল কারকের পরসর্গ তথা বিভক্তি।বাক্যতত্ত্বের বিষয় হল কারকের ক্রম।বাংলা বাক্যের পদক্রম নিয়ে সুকুমার সেনের একটি সূত্র তুলে দিয়ে আমরা দেখেছি মান বাংলা,মান অসমিয়া এবং সিলেটি সহ অন্যান্য ভাষাবৈচিত্র্যগুলো মোটের উপরে এই ক্রম মেনে চললেও অধিকাংশ সময়েই কোনো স্থির শৃঙ্খলা অনুসরণ করে না। সেখানে অবিভাজ্য স্বনিমগুলো এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।অর্থাৎ বক্তার বা লেখকের অর্থ-নির্মাণ-ইচ্ছা অনুসারে শব্দগুলো সাজানো হয়।এর পরে ক্রমান্বয়ে ‘বাক্যের প্রকার ভেদ’ উপশিরোনামে ১) পদ বিন্যাস অনুসারে বাক্যের গঠন ভেদ;২) ভাব অনুসারে  বাক্যের গঠন ভেদ;৩) কথা উপস্থাপন অনুসারে  বাক্যের গঠনভেদ;৪) বাচ্য অনুসারে  বাক্যের গঠনভেদ আলোচনা করা হয়েছে।পদবিন্যাস অনুসারে আমাদের আলোচ্য ভাষা এবং ভাষাবৈচিত্র্যগুলোতে সরল,জটিল,যৌগিক বাক্যের গঠন নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে। ‘ভাব অনুসারে’তে সেই সব প্রকারভেদের কথাই আলোচিত হয়েছে পূর্বসূরিরা যেগুলোকে ‘অর্থ অনুযায়ী’ প্রকারভেদ বলে লিখেছিলেন। এখানে আমরা দেখিয়েছি ক্রিয়াপদের পরে ‘না’ বসাটি চট্টগ্রামী বাদে সিলেটি সহ বাংলার প্রায় সব আধুনিক ভাষাবৈচিত্র্যের নিজস্ব রীতি। অসমিয়াতে আগে বসে।এমন কি হিন্দিতেও এই নিষেধার্থক অব্যয়টি ক্রিয়ার আগে বসে,--नहीं मिली,नहीं जाऊंगी ইত্যাদি।বাক্যগঠন প্রক্রিয়াতে এই একটি বিষয়ে বাংলার সঙ্গে অসমীয়ার বড় প্রভেদ। সিলেটি এবং অসমিয়ারও প্রভেদবিন্দু এটিই। বরং চট্টগ্রামী এই প্রশ্নে অসমিয়ার সামান্য সহচর।কথা অনুসারে আমরা সেই সব প্রকারভেদের কথাই আলোচনা করেছি পূর্বসূরিরা যেগুলোকে লিখেছিলেন ‘উক্তি অনুসারে’ বাক্যের প্রকার ভেদ।বাংলাতে অধিকাংশ ভাষাবিদই বাচ্য প্রসঙ্গটি বাক্যতত্ত্বে আলোচনা করেন নি,অসমিয়াতে গোলোকচন্দ্র গোস্বামী করেছেন।আমরা একেও বাক্যতত্ত্বে আলোচনা করে দেখালাম,বাক্যের গঠনভেদে বাচ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু পরম্পরাগত ব্যাকরণে কর্তৃবাচ্য,কর্মবাচ্য,ভাববাচ্য ইত্যাদি প্রকারভেদের কথা আলোচনা করা হলেও অনেকেরই ভিন্ন মতের অধ্যয়ন আমরা করে এসে আমাদের সিদ্ধান্ত নিবেদন করেছি যে,বাচ্য মূলত দু’রকম কর্তৃবাচ্য এবং কর্মবাচ্য।বাকি প্রকারভেদের সবই কর্মবাচ্যের। আমাদের মতে ‘কর্মবাচ্য’ এবং ‘কর্তৃবাচ্য’-র মৌলিক তফাত এই নয় যে ক্রিয়া কর্তা-কর্মের মধ্যে  কাকে অনুসরণ করে তার রূপ বদলায়। তার বিপরীতে মৌলিক তফাত হল বাক্যে ‘কর্তা’র ভূমিকাটি কী? মুখ্য না গৌণ।কর্মবাচ্যে কর্তা গৌণ ভূমিকাতে চলে যায় বলেই বাচ্য অনুসারে বাক্যের প্রকারভেদ দেখা দেয় এই আমাদের সিদ্ধান্ত। সেই অনুসারে কর্মবাচ্যকে আমরা  ১) নৈর্ব্যক্তিক কর্মবাচ্য, ২) নৈর্ব্যক্তিক কর্ম-কর্তৃবাচ্য নামে দুই ভাগে চিহ্নিত করবার প্রস্তাব রেখেছি। সেই সঙ্গে কর্তৃবাচ্যের একটি গৌণ বিকল্প প্রকার ভেদনৈর্ব্যক্তিক কর্তৃবাচ্য’-এর প্রস্তাব রেখেছি।এরই সঙ্গে বাচ্য প্রসঙ্গে ভাষাবিজ্ঞানী পবিত্র সরকারের একটি প্রস্তাব নিয়ে স্বতন্ত্র আলোচনা করেছি এর জন্যে যে তিনিও ভেবেছিলেন বাংলা ভাষাবিদ্যাতে বেশ কিছু বিভ্রান্তি রয়েছে।তিনি বাচ্যকে কর্তৃবাচ্য এবং ভাববাচ্য এই দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন। আমরা তাঁর প্রস্তাব গ্রহণ করবার অসুবিধের কথা আলোচনা করেছি এই উপশিরোনামে-- ‘বাচ্য সম্পর্কে পবিত্র সরকারের বিকল্প ভাবনা’এর পরে আমরা ‘কালিক ভাষা বিজ্ঞান এবং বাংলা-অসমিয়া ভাষা ও সিলেটি সহ ভাষাবৈচিত্র্য গুলো’ এবং ‘রূপান্তরমূলক সৃজনমূলক ব্যাকরণ এবং বাংলা-অসমিয়া ভাষা ও সিলেটি সহ ভাষাবৈচিত্র্য গুলো’ তে বৈচারিক তত্ত্ব দুটির প্রাথমিক পরিচয় দিয়েছি মাত্র। কিছু উদাহরণ বাক্য ছাড়া এই অধ্যায়ে আপাত দৃষ্টিতে সিলেটি প্রসঙ্গ প্রায় নেইই। একে মনে হতে পারে,আমাদের বিচ্যুতি বলে।কিন্তু পুরো অধ্যায়ে আমাদের তাত্ত্বিক ভিত্তিটিই তৈরি করে যেতে হয়েছে। বহু ভিন্নমতের তর্কের মীমাংসা করে যেতে হয়েছে। যেহেতু সিলেটি তত্ত্ব বলে স্বতন্ত্র কিছু নেই,যা কিছু আলোচিত হয়েছে সবই হয়েছে মান বাংলা এবং মান অসমিয়া ভাষাতে,ফলে এই দুই ভাষাতে বাক্যতত্ত্ব অধ্যয়নে মত-ভিন্নতার মীমাংসা আমাদের করে যেতে হয়েছে। যে পর্যায়ে আমরাও মীমাংসাতে পৌঁছুই নি অথচ তর্কের স্বরূপ চেনাবার দরকার পড়ছিল সেখানে মান বাংলা কিংবা মান অসমিয়ার বাইরে সিলেটি বা অন্যান্য ভাষাবৈচিত্র্যের নজির দেয়াটা আমাদের কাছে মনে হয়েছে অহেতুক ভার বাড়ানো।কিন্তু যেখানেই আমরা একটা মীমাংসা সূত্রে পৌঁছেছি সেখানেই আমরা সিলেটি সহ আরো অনেক ভাষাবৈচিত্র্যের আশ্রয় নিয়ে আমাদের এই সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠা করেছি যে বাক্যতত্ত্বের ক্ষেত্রে এই দুই মান ভাষা এবং ভাষাবৈচিত্র্যগুলোতে বড়সড় মৌলিক কোনো প্রভেদ নেই।এই কথা আমরা স্পষ্ট করেই লিখেছি শেষভাগে। যেখানে অধ্যাপক উপেন রাভা হাকাচাম যেভাবে সিলেটি বাক্য প্রসঙ্গের আলোচনা করছিলেন সেগুলোর পর্যালোচনা করেছি ‘সিলেটি বাক্যতত্ত্ব   এবং  বাংলা - অসমিয়া ভাষা বিতর্ক’-- এই উপশিরোনামেআমাদের কাছে এও সমস্যা ছিল অধ্যাপক উপেন রাভা হাকাচামের বাক্য নিয়ে সিদ্ধান্তগুলো পর্যালোচনা করব কী ভাবে।তাই আমরা সেখানে লিখেছি, ‘এই অব্দি এসে আমরা বাক্যতাত্ত্বিক এমন কোনো কারণ পেলাম না যাতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে যে অসমিয়া এবং বাংলা বাক্য গঠন রীতিতে মৌলিক কিছু বড়সড় তফাত রয়েছেকিংবা  সিলেটি বাক্যরীতির সঙ্গে অসমিয়ার আলাদা করে কোনো ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।দুটিই মাত্র তফাত পাওয়া গেল,একটি নঞর্থক বাক্যের আরটি নৈর্ব্যক্তিক কর্মবাচ্যের ক্রিয়াপদের গঠনে,-- যেখানে বাংলার থেকে অসমিয়া আলাদা।নঞর্থক বাক্যের গঠনে ‘না’ পদটি ক্রিয়ার শেষে চলে যাওয়াটা আধুনিক বাংলার নিজস্ব,সেও আমরা দেখালামআর সিলেটিও দেখা গেল বাংলাকেই অনুসরণ করে,অসমিয়াকে নয়।বাচ্যে অতি সামান্যই বাংলার থেকে আলাদা তা গোলোকচন্দ্র গোস্বামী,বাণীকান্ত কাকতি লিখেছেন দেখালাম। সে ওই  যেখানে নৈর্ব্যক্তিক কর্মবাচ্যে ক্রিয়াপদের রূপ হচ্ছে,‘দেখি, শুনি,পাৰি’ ইত্যাদি।অন্যত্র বাংলার মতোই ‘যৌগিক ক্রিয়া’-র শেষ  পদ ‘যায়’ দিয়ে শেষ হয়এবং সিলেটি এখানে কিছুতেই অসমিয়াকে অনুসরণ করে না।সুতরাং এর পরে আর এই নিয়ে আলোচনা বাড়াবার কিছুই থাকে না’ ফলে সিলেটি এখানেও থেকেছে আমাদের অধ্যয়নের কেন্দ্রেই। এই অধ্যায় শেষ করেছি আমরা সিলেটিকে  স্বতন্ত্র ভাষা বলে যারা দাবি করছেন তাঁদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে।যার সম্প্রসারণ ঘটিয়েছি পরবর্তী সপ্তম অধ্যায়ে যেখানে সিলেটি নাগরি লিপি প্রসঙ্গ আলোচনা করেছি।

সপ্তম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘অসমিয়া-বাংলা- সিলেটি লিপি’অধ্যায়টির কাঠামো আগেকার চার অধ্যায় থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। এই অব্দি আমরা যা-ই আলোচনা করছিলাম, প্রশ্ন ছিল--একটি ভাষা কীভাবে বলা হয়! এবারে যে বিষয়টিকে বেছে নিয়েছি, সে হলো-- একটি ভাষা কীভাবে লেখা হয়! এই নিয়েও যে মান বাংলা এবং মান অসমিয়া এবং সিলেটির নিজস্ব অভ্যন্তরীণ তর্ক আছে,যার উপরে ভিত্তি করে অনেকেই সম্প্রতি সিলেটিকে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে দাবি করছেন সেই কথার উল্লেখ শুরুতেই করেছি।কিন্তু বিষয়টিকে আমরা শুধু এরই জন্যে বেছে নিইনি।আমাদের অভিমত লিপি এবং ছন্দ একটি ভাষার দ্বারা প্রভাবিতও হয়,ভাষাকেও প্রভাবিত করে। সেসব আমরা অধ্যায়টিতে সংক্ষেপে দেখিয়েছি।আমাদের পরিকল্পনা ছিল ছন্দ নিয়েও অধ্যয়ন করা, কিন্তু সেই অধ্যয়নের সমস্যাটি আমরা উল্লেখ করে বিষয়টি সেখানেই স্থগিত রেখেছি।লিপি নিয়ে ভাষাবিদেরা অধ্যয়ন করেছেন অল্প,অথচ সেই অধ্যয়নেও মতভেদ প্রচুর। ফলে এখানেও আমাদের কাছে সমস্যা দেখা দিল নিজেদের পথ তৈরি করে এগোবার। এই অধ্যায়কে আমরা মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করেছি বললে হয়।প্রথম ভাগে অসমিয়া বাংলা লিপি বিতর্ক এবং দ্বিতীয় ভাগে সিলেটি নাগরি এবং তাকে কেন্দ্র করে নানা বিতর্কের অবতারণা করে একটা মীমাংসা সূত্রে পৌঁছোবার প্রয়াস করেছি।ভাগ দুটি পরস্পরের পরিপূরক।একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি স্পষ্ট হবার ছিল না,বিশেষ করে দ্বিতীয় ভাগের অনেক কিছুই  প্রথম ভাগেই স্পষ্ট করে যাওয়া হয়েছে,অন্যথা পুনরুল্লেখের দরকার পড়ত।প্রথমেই আমরা অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীর আশ্রয় নিয়ে যে আলোচনাটি দিয়ে শুরু করেছি তার উপশিরোনাম ‘অসমিয়া বাংলা লিপি বিতর্কের স্বরূপ’ অসমিয়া এবং বাংলা লিপির উৎস কী? কুটিল না কামরূপী-- তর্কের এটাই মূল কথা। অসমিয়া এবং বাংলা লিপি কবে,কার থেকে আলাদা হয়ে গেল? অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীর বক্তব্য ছিল কামরূপী লিপি থেকেই পূর্বভারতের সব লিপি এসেছে বাংলা-অসমিয়া–মৈথেলি–ওড়িয়া ইত্যাদি। যেখানে আমাদের পরিচিত তত্ত্বটি হচ্ছে কুটিল থেকে এই লিপিগুলো এসেছে।ভাবনাটির সূচনা হয়েছিল বিশ শতকের প্রথম ভাগে অধ্যাপক ডিম্বেশ্বর নেওগের লেখালেখিতে। তাঁদের এমন দাবিও ছিল যে দুই লিপির মূল তফাত ‘ৰ,ৱ’ এই দুই বর্ণে। যেটি কিনা প্রাচীন কামরূপীতে ছিল।বাংলা সে দু’টি ছেড়ে  দ্বাদশ শতকেই অসমিয়ার থেকে আলাদা হয়ে যায়।ফলে শুধু কুটিল কামরূপীর তর্ক মীমাংসাতেই আমাদের কাজ সম্পূর্ণ হচ্ছিল না,এই দু’টি বর্ণ কবে কোন লিপিতে এল আর কোন লিপি থেকে গেল,সেটি দ্বাদশ শতকেই কি না অতি সম্প্রতি হল,আর কোনো বর্ণ নিয়ে সমস্যা ছিল বা আছে কিনা সেই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করা। সেটি করতে গিয়ে আমরা একাধারে দুই কাজ করেছি,লিপি নিয়ে বাঙালি ভাষাবিদেরা কে কী লিখছিলেন তার পরিচয় ক্রমান্বয়ে তুলে ধরেছি তাঁদের মতভেদগুলোরও যতটা সম্ভব মীমাংসা করে করে এগোতে হয়েছে।স্বাভাবিকভাবেই ধরা হয়েছে বাংলা লিপি চিন্তার ক্রমবিকাশের ধারটিকেও।উপশিরোনাম হলো ‘বাংলা-অসমিয়া লিপির কালক্রমিক স্বরূপএকেও আবার যে কয়টি উপবিভাগে ভাগ করেছি,সেগুলো এরকম: ১) রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম ভারতীয় প্রত্নলিপিবিদ;২) সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় এবং অসমিয়া-বাংলা লিপি;৩) নলিনী সান্যাল এবং অসমিয়া-বাংলা লিপি;৪) সুকুমার সেন এবং অসমিয়া-বাংলা লিপি;৫) রামেশ্বর শ’ এবং অসমিয়া-বাংলা লিপিএই পর্যন্ত আমাদের কাছে বাংলা-অসমিয়া লিপির ইতিবৃত্তের যে রূপরেখাটি পাওয়া গেল তাতে বহু কিছুই অস্পষ্ট রইল।প্রথমত ব্রাহ্মী দেশি কি বিদেশি উৎসের থেকে এসেছে? সে তর্ক ছেড়ে দিলেও ব্রাহ্মীর উত্তরা বৈচিত্র্যের পশ্চিমা উপধারা থেকে দেবনাগরী,না কি পূর্বী উপধারারই এক শাখা থেকে দেবনাগরী,কায়থি,গুরুমুখী ইত্যাদি  অন্যান্য বৈচিত্র্য এবং অপর শাখা থেকে বাংলা,অসমিয়া,মৈথেলি,ওড়িয়া লিপি এসেছে—সেই তর্কও অস্পষ্ট।কিন্তু শুরু থেকে যেটি স্পষ্ট---সে হল ব্রাহ্মী এক স্তরে এসে গুপ্ত,পরের স্তরে কুটিল কিংবা প্রত্ন-বাংলা-অসমিয়া ইত্যাদি রূপ পাচ্ছে। সেটির থেকে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে বাংলা-অসমিয়া-মৈথেলি-ওড়িয়া আলাদা হতে শুরু করেছেওড়িয়া আবার সেই পরিবার থেকে অনেকটাই বেরিয়ে যাচ্ছে পঞ্চদশ শতকে।ছাপা জমানাতে আসলে বাংলা-মৈথেলি—অসমিয়া লিপি পাকাপাকি তিন আলাদা রূপ পাচ্ছে।এই হচ্ছে আমাদের মোটামুটি বোধ। আমরা এও জেনেছি বাংলা লিখবার জন্যে মূলত বাংলা লিপিটি ব্যবহৃত হলেও আরো আটটি লিপি বাংলাতে নানা সময়ে নানা স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে।

 অসমিয়া তাত্ত্বিকেরা কে কী লিখছিলেন তাঁর কিছুটা আমরা উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীর চিন্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পাশাপাশি করে গেছি,বাকিগুলো করে গেছি পরবর্তী অংশগুলোতে।সুতরাং ‘‘বাংলা-অসমিয়া লিপির কালক্রমিক স্বরূপ’-এর ভেতরেই আমাদের পরবর্তী উপশিরোনাম ছিল ৬) উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী এবং অসমিয়া-বাংলা লিপি তথা কুটিল-কামরূপী বিতর্কতাঁর লিপিচিন্তা অধ্যয়ন করতে গিয়ে আমাদের কাছে যেটি স্পষ্ট হচ্ছিল তা আমরা লিখেছি এভাবে,‘দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের প্রত্ন-বাংলা-অসমিয়া স্তর অব্দি অন্তত ,নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তাহলে যেমন কুটিলে কামরূপীতে আমরা তফাত সেরকম পাচ্ছি না,কামরূপী বুঝতে গিয়ে কুটিলের দিকে তাকাতে হচ্ছে;সেরকমই  এই অব্দি অন্তত বাংলার অসমিয়া লিপির ইতিহাস থেকে বা অসমিয়াকে বাংলা লিপির ইতিহাস থেকে ফালরি কাটিযাবার কোনো প্রশ্নই আসছে না।এইটুকুন সিদ্ধান্ত তো নেওয়াই যায়।বরং যদিও  অন্তস্থ ’-এর  ব্যবহার বাংলাতে নেই,বর্ণমালাতে কিন্তু এখনো স্কুলপাঠ্য বইতে সেই দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের আগেকার কামরূপী-কুটিল রূপটিই রয়েছে।অসমিয়া পালটে গেছে।আর র/ৰপাল্টেছে দুই ভাষাতেই।’ আমাদের এভাবে লিখবার কারণ হল,দ্বাদশ শতকের আগে আমরা অসমিয়াতেও ‘ৱ’-এর ব্যবহার পাইনি,প্রাক-ঔপনিবেশিক কালে পেলেও পেয়েছি অর্বাচীন বাংলা ‘র’-এর মতো।বাংলা ব্রিটিশ আসবার শতক খানিক আগেই পশ্চিম বাংলার কোথাও কোথাও ব্যবহৃত হত,এছাড়াও ‘র’-এর আরো কয়েকটি বৈচিত্র্য ছিল‘ৰ’-এর ব্যবহার শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এবং পরবর্তী কালে দুই ভাষাতেই ব্যাপক ছিল।আর কুটিল কামরূপী লিপির প্রভেদ ঐতিহাসিকও নয়,রূপগতও নয়।ফলে আমাদের প্রস্তাব –‘এই লিপিটিকে ‘প্রত্ন-অসমিয়া’ তো বলাই চলে,আমরা লিখেছি ‘প্রত্ন-বাংলা’ কথাটির মধ্যেই এর স্বীকৃতি রয়েছে। কিন্তু যখন কুটিল প্রসঙ্গেও কথা হবে আর অসমিয়া লিপির কথা হবে তখন একে আমরা একত্রে ‘কামরূপী-কুটিল’ বললেও পারি।কামরূপীর থেকে কুটিল বাদ দিলে বিভ্রান্তি বাড়ে মাত্র।বহু সত্য ঢাকা পড়ে যায়।তাতে গ্রহণযোগ্যতা কমে মাত্র বাড়ে না।’ ,-এর প্রভেদটি পাকাপাকি হয় ছাপা-প্রযুক্তির সময়েই,যে সময়টি নিয়ে প্রত্যেকেই খুব কম আলোচনা করেছেন।স্বাভাবিক ভাবেই আমরা যখন অসমিয়া-বাংলা লিপি বিতর্ক নিয়ে তুলনামূলক অধ্যয়ন করছিলাম,সময়টি আমাদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান হয়ে পড়ে।আমাদের মনে হয়েছে, ‘লিপি প্রসঙ্গে অসমিয়া বাঙালি মনস্তত্ত্ব স্বতন্ত্র হতে শুরু করবার পক্ষে আত্মারাম শর্মার ধর্মপুস্তকএকটি মাইলফলক। যেখানে পাশাপাশি এবং ছিল।’এই মনস্তত্ত্ব স্বতন্ত্র হবার কারণ আমরা সেখানেই আলোচনা করে এসেছি,এখানে শুধু উল্লেখ করা ভালো অন্তস্থ-ব-এর ব্যবহার যদিও বা প্রাক-ঔপনিবেশিক অসমে বিশেষ করে আহোম রাজত্বে দেখা গেছিল,তার রূপটি ছিল ‘র’-এর মতোআজকের স্বরূপে এর প্রচলন ঘটাবার কৃতিত্ব উনিশ শতকের মাঝভাগে যখন শিবসাগরে ব্যাপটিস্ট মিশনারিরা অরুণোদয় প্রকাশ করেন,তখন হেমচন্দ্র বরুয়ারআমাদের পরবর্তী স্বতন্ত্র উপশিরোনাম ‘আধুনিক যন্ত্র প্রযুক্তি এবং অসমিয়া-বাংলা লিপি’এখানে আমরা আলোচনা করেছি কীভাবে এই সময়ে দুই ভাষাতেই লিপিগুলো বড়সড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে এবং এখনো যাচ্ছে।বাংলাতে ‘র’ প্রচলিত হয়েছে শুধু তাই নয়,নিচে বিন্দু দেয়া আরো কিছু  বর্ণ ‘ড়,ঢ়,য়’ বা ‘ং, ঁ, ৎ’ ইত্যাদিও এই সময়েই দুই ভাষাতেই এসে প্রবেশ করছে,এবং এগুলো বাংলার দেখা দেখি অসমিয়াতে হেমচন্দ্র বরুয়াই নিয়ে এসেছেন সে সম্পর্কে আমরা অসমিয়া ভাষাবিজ্ঞানী ভগবান চন্দ্র মরলের বক্তব্য তুলে ধরেছি। এছাড়াও দুই ভাষার দুই লিপিতেও একই রকম দেখতে যুগ্ম-বর্ণও কীভাবে গড়ে উঠেছে এবং এই সময়েই এসে পাকাপাকি হচ্ছে,এবং এখনো যখন সংস্কারের প্রস্তাব আসছে সেখানেও সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা এড়ানো মুশকিল হচ্ছে আমরা দেখিয়ে এসেছি।

এই অধ্যায়ে আমাদের দ্বিতীয় ভাগের উপশিরোনাম ‘বাংলা ভাষার তৃতীয় লিপি সিলেটি নাগরী’ ‘তৃতীয়’ এর জন্যে যে বাংলা এবং রোমান লিপির পরে পরিমাণের দিক থেকে এটিই তৃতীয় লিপি যা ছাপাখানা অব্দি এসেছিল। সিলেটি নাগরী নিয়ে বেশ কয়েকটি তর্ক রয়েছে—সেগুলো হলো এই লিপির উৎস কী দেবনাগরি,আরবি অথবা বাংলা? এই লিপিতে রচিত সাহিত্যের ভাষা কী? সে কি সিলেটি-বাংলা অথবা মান বাংলা? সিলেটিরা কী এই এক লিপিতেই অভ্যস্ত ছিলেন?এই লিপিতে কারা লিখতেন?শুধুই কি নিম্নশ্রেণি বর্ণের এবং মুসলমান মানুষ? এবং লিপিটি কতটা প্রাচীন? আমরা লিপিটির একটি পরিচয় তুলে ধরবার সঙ্গে প্রায় প্রতিটি প্রশ্নের জবাব সন্ধানের চেষ্টা করে গেছি।একে সিলেটের একমাত্র লিপি এবং এবং এই লিপিতে লেখা সাহিত্যের ভাষা সিলেটি-বাংলা এই সব অভিমত মূলত তাঁদের যারা এর উপরে ভিত্তি করে সিলেটিকে আলাদা ভাষা হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছিলেন।যদিও এই নিয়ে বেশি অনুসন্ধানের দরকার নেই।আমরা বাংলা লিপি নিয়ে আলোচনাতেই দেখিয়েছি,বাংলা লিখবার জন্যে আরো আটটি লিপি ব্যবহৃত হয়েছিল।সিলেটি তার মধ্যে একটি।এমন কি যে অধ্যাপক মুসাব্বির ভূঞা এর ভাষাকে সিলেটি –বাংলা বলে দাবি করেন,তিনিও লিখেছেন বাংলা লিপিটিও সিলেটে সমান্তরালে প্রচলিত ছিল।আমরা শুধু ‘সমান্তরাল’-এ বা একই কালে প্রচলিত লিপি কিনা সেই তর্কের বিস্তৃত অধ্যয়ন করে আহমেদ হাসান দানীর সিদ্ধান্তের পক্ষেই নিজেদের সিদ্ধান্ত দাঁড় করিয়েছি। তাঁর দাবি লিপিটি ষোড়শ শতকের বেশি প্রাচীন নয়। সেই সিদ্ধান্তের পক্ষে আমরা অধ্যাপক উষারঞ্জন ভট্টাচার্য,অধ্যাপিকা অনুরাধা চন্দ এবং মার্কিন ঐতিহাসিক রিচার্ড ঈটনের যুক্তি তথ্যের আশ্রয় নিয়েছি। মূলত নিম্নশ্রেণির মুসলমানেরা এই লিপিতে লিখলেও,কিছু হিন্দু লেখক থাকবার ইঙ্গিতও রয়েছে। কিন্তু লেখকদের সবাই নিম্নশ্রেণির স্বল্প-শিক্ষিত লোকজন ছিলেন না,উচ্চমার্গের সুফি সাধকেরা উন্নতমানের গীতিকাব্য এতে লিখেছেন,আর বিচিত্র বিষয়ে লেখা কাব্যগুলো জনপ্রিয় ছিল শ্রেণি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে।বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে।এই লিপি সাহিত্যের পাঠক সিলেট অতিক্রম করেও চট্টগ্রাম অব্দিও বিস্তৃত ছিলেন।এই লিপিতে লেখা সাহিত্যের ভাষাটিতে সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্যের ছাপ আছে যদিও তবু সেই ভাষা সিলেটি নয়,প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলা সাহিত্যের সাধারণ সাধু ভাষা।লিপিটি যে দেবনাগরীর রকমফের এই নিয়ে খুব বেশি তর্ক নেই। কেবল একজন দেওয়ান নুরুল আনোয়ার হুসেন চৌধুরী দাবি করেছিলেন এর উৎস  বাংলা লিপি।অন্য সবাই এর দেবনাগরী উৎস নিয়ে নিশ্চিতশুধু আহমদ হাসান দানী দাবি করেছিলেন তাতে কাইথিরও কিছু প্রভাব রয়েছে।আমাদেরও মনে হয়েছে তাঁর সেই দাবিটি সঠিক।লিপিতে আরবি লিপির প্রভাব সেরকম নেই,শুধু  পুথি পৃষ্ঠা আরবি পুথি বা গ্রন্থের মতো পেছন থেকে সাজানো হত দেশভাগ,বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন,মুক্তিযুদ্ধ এই পরিবেশে সিলেটি নাগরি সাহিত্যের জনপ্রিয়তা স্তিমিত হয়ে যায়।সম্প্রতি আবার বিলেত প্রবাসী কিছু সিলেটিরা সিলেটিকে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে দাঁড় করাবার প্রয়াসের অংশ হিসেবে লিপিটি ইউনিকোড কনসর্টিয়াম দ্বারাও স্বীকৃত হয়েছে।এবং সেই সব বিলেতি প্রয়াসের সম্প্রসারণ হিসেবেই বাংলাদেশে এবং অসমেও একই রকম প্রয়াস একটি শুরু হয়েছে।বাংলাদেশে কিছু কিছু বইপত্রও নতুন করে ছাপা শুরু হয়েছে।তাদের সাধারণ ভাষাবৈজ্ঞানিক যুক্তি খুব প্রবল বলে আমাদের মনে হয় নি,সেসব কথা আমরা লিখেছি।তাই বলে এর পেছনে কোনো ‘চক্রান্ত’-এর তত্ত্বেও আমাদের সমর্থন নেই।কিন্তু প্রেরণাটি ভাষা-রাজনৈতিক---এবং সেটি সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানের অধ্যয়নের বিষয় হতে পারে বলেই আমাদের অভিমত।

এই পর্যন্ত এসে আমাদের সিদ্ধান্ত সিলেটি স্বতন্ত্র ভাষাও নয়,অসমিয়া ভাষা পরিবারেরও সদস্য নয়। ঐতিহাসিক-ভৌগোলিক এবং সাধারণ ভাষাবৈজ্ঞানিক কারণে তো বটেই,সিলেটি জনসমাজ মনে করেন সিলেটি বাংলা ভাষা-পরিবারের সদস্য শুধু এই কারণটিই যথেষ্ট এই সিদ্ধান্তকে দাঁড় করাতে যে সিলেটি বাংলারই একটি ভাষাবৈচিত্র্য,অসমিয়ার নয়। সাতটি অধ্যায় জুড়ে প্রচুর মত এবং তর্ক আমরা তুলে ধরেছি,এবং কালিক, কালানুক্রমিক এবং তুনাত্মক অধ্যয়নের নিরিখে যথাসাধ্য বিচার বিশ্লেষণের সূত্রে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি।

 

~***~

 

 

 

 

 

 

 

 

Comments

Popular posts from this blog

।।রোমান হরফে বাংলা লেখার পুরাকথা । ।

।। অসমিয়া-বাংলা- সিলেটি লিপি ।। সপ্তম অধ্যায় ৷৷

।। অসমিয়া,মানবাংলা,সিলেটি এবং দু’একটি প্রতিবেশী ভাষা ও ভাষাবৈচিত্র্যের ধ্বনিতাত্ত্বিক তুলনা ।। তৃতীয় অধ্যায় ৷৷