।। অসমিয়া-বাংলা- সিলেটি লিপি ।। সপ্তম অধ্যায় ৷৷

 

৷৷ অসমিয়া ভাষা এবং বাংলার সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্যের পারস্পরিক সম্পর্ক ৷৷

 ৷৷ একটি কালানুক্রমিক এবং কালিক অনুসন্ধান ৷৷  সপ্তম অধ্যায় ৷৷ 

📚📚📚📚📚📚📚

 (মূল গবেষণা  অভিসন্দর্ভে উপভাষা শব্দটিই ছিল, ‘ভাষাবৈচিত্র্য ছিল না । আই পি এ (IPA) এবং সিলেটি হরফগুলো যদি বা এখানে নাও পড়তে পারেন এখানে ক্লিক করে বা  একেবারে নিচে গোগোল ড্রাইভে পিডিএফে পড়ুন। ছবিগুলো দুবার ক্লিক করলে বড় হয়ে যাবে। আগে পরের অধ্যায়গুলোরজন্যে এখানে ক্লিক করুন।)

 

 

        


  লিপি নিয়েও দুই ভাষাতে এবং সিলেটির একটি নিজস্ব তর্ক আছে।লিপিটির কী নাম? অসমিয়া না বাংলা। বাংলাই কেন,অসমিয়া নয় কেন?লিপি দুটো এসেছে কোত্থেকে? কুটিল লিপি না,কামরূপী লিপির থেকে? বাংলা লিপির থেকে অসমিয়া এসেছে,না কি অসমিয়ার থেকেই বাংলা? সিলেটির কি আলাদা লিপি আছে? সেই লিপি কি এরই জন্যে ছিল যে ভাষাটিই স্বতন্ত্র ভাষা ছিল।আর এখন কি বাংলা এই ভাষাগোষ্ঠীকে গ্রাস করে ফেলেছে বলেই স্বতন্ত্র লিপি নেই হয়ে গেছে?এই সব বিচিত্র প্রশ্নই মাঝে মধ্যে উঠে আসে।

ভাষাবিজ্ঞানের সবচাইতে সব চাইতে জটিল দুই শাখার একটি এই লিপিবিজ্ঞান(graphemics),আরেকটি ছন্দতত্ত্ব (prosody)অনেকের সম্ভবত সংশয়ও জাগে এ দুটো আবার ভাষাবিজ্ঞানের বিষয় হতে যাবে কেন? তাই, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিপি প্রসঙ্গ কিছু ছুঁয়ে গেলেও,সুকুমার সেন তার সঙ্গে ছন্দ কিছু স্পর্শ করে গেলেও অধিকাংশ ভাষাবিজ্ঞানীই প্রসঙ্গগুলো বাদ দিয়েই যান।সম্ভবত এই ভাবনা বাকি ভাবনাকে আটকে দেয় যে ১) লিপিবিজ্ঞান তো ঐতিহাসিকদের দরকার।তাই এর অন্য নাম প্রত্নলিপিবিজ্ঞানও,ইংরেজিতে palaeography;২) ছন্দতত্ত্ব তো কাব্যরস সন্ধান তথা সমালোচনার বিষয়,সুতরাং ভাষাবিজ্ঞানে এর কাজ কী? অথচ,একালের চেনা ভাষাগুলোরই সব উচ্চারণ তার চেনা লিপিতে স্পষ্ট হয় না বলেই আমাদের আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক লিপির আশ্রয় নিতে হয়।আর তখন লিপি নিয়ে এমনিতেই ভাবতে হয়,আমাদেরও ভাবতে হয়েছে। যে ভাষা লেখাতে ব্যবহৃত হয় না,যেমন সিলেটি--- সেগুলো চেনা হরফে লিখতে গেলেও গলদঘর্ম হতে হয়।কীভাবে লিখবো,সিলেটি ‘ঘর’ কিংবা ‘বাড়ি’?এরকম সমস্যার থেকেই এককালে সিলেটি লিখবার জন্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল সিলেটি নাগরী কিন্তু সেখানেও লিপির সমস্যার জন্যেই ‘প্রেম’ শব্দকে ভেঙে লিখতে হয় ‘পেরেম’---পড়লে পাঠক ভাবতেই পারেন,শব্দটি সিলেটি।চর্যা বা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পাঠগুলো এখনকার বাংলা-অসমিয়া লিপিতে মেলে বলে,আমাদের পড়তে এবং ব্যবহার করতে সমস্যা হয় নি।কিন্তু যারা পাঠোদ্ধার করেছিলেন,কিংবা করে থাকেন—তাঁদের লিপি নিয়ে একটি বর্ণও না ভেবে উপায় কী?

অনুরূপ “টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী/হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী”(চর্যা:৩৩)--চর্যার কবিরা যদি গেয়েছেন বা আবৃত্তি করেছেন কখনো,তবে কী ভাবে উচ্চারণ করেছেন? শুনে জানবার আজ আর কোনো উপায় নেই। নিশ্চয় তখনকার মানুষজন পদ্যেই কথা বলতেন না।কিন্তু গদ্যে কীভাবে বলতেন,সে শোনবার তো আরো উপায় নেই। যদি ধরে নিই,‘টালত̖,মোর̖,ঘর̖,হাড়ীত̖,ভাত̖’ শব্দগুলো এভাবেই হলন্ত উচ্চারণ করতেন আজকেরই মতো তবে আজকের বাংলা তো বটেই শব্দগুলো প্রায় অপরিবর্তিতরূপেই অসমিয়া বা সিলেটিতে এসে গেছে বলে সিদ্ধান্ত নেবার ভুল সহজেই করতে পারি।আমাদের মনে হয়েছে বাণীকান্ত কাকতিকেও সেরকম সমস্যাতে পড়তে হয়েছে, যখন তিনি ‘সঙ্কমত,বাটত,হাড়িত’ ইত্যাদি শব্দে অসমিয়া অধিকরণের পরসর্গ ‘-ত’ এর সন্ধান পান। উৎসটি নিশ্চয়ই তাই,কিন্তু সবগুলো হুবহু এক নয়।বাণীকান্ত কাকতি সংক্ষেপে সেরে গেছেন,নইলে তাঁর নজরেও পড়ত হয়ত বা।কিন্তু এসব বিস্তৃত আমাদের জানা দরকার,যখন আমরা সূক্ষ্মতার দিকে এগুচ্ছি।বরং যদি শব্দগুলো স্বরান্ত হয় ওড়িয়াতে এখনো সরাসরি বেশি পাওয়া সম্ভব।ছন্দ সেখানে আমাদের বলে দিতে পারে,এগুলো স্বরান্ত না হলন্ত উচ্চারিত হবে।তবেই অন্তত নিজের ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কবির ছন্দ-দক্ষতার প্রতি কোনো অবিচার করে ফেলব না। সেই সঙ্গে করে ফেলব না সেকালীন ভাষারূপটির প্রতি। তেমনি,ষষ্ঠ অধ্যায়ে আমরা অন্যপক্ষের পরসর্গ ‘-ই’,‘-এ’ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের এই পদটি নিয়ে কথা বলতে গেছিলাম,“এ বোল সুণিআ নাগরী রাধা/হাণএ সকল গাএ/যত নানা ফুল পান করপুর/সব পেলাইল পাএ/উঠিআ বড়ায়ি   রাধাক বুইল/হেন কাম না করিএ/নান্দের নন্দন  ভুবন বন্দন /তোর দরশনে জীএ ---তখন আমাদের মনে হচ্ছিল,‘গাএ,পাএ,করিএ,জীএ’ এই সব শব্দের শেষে ‘-এ’টি সেকালের ভাষাতে প্রচলিত ছিল বলেই এসেছে-- তা নাও হতে পারে।বিশেষ করে ‘করিএ’ মতো ক্রিয়াপদেকিছু তার ছন্দের এবং অনুপ্রাস অলঙ্কারের দরকারেও এসে থাকতে পারে,পরে পরসর্গটি ভাষাতে প্রচলিত হয়ে যেতে পারে।কৃত্তিবাসী রামায়ণে আছে,“ধর্মাধর্ম রাজধর্ম তোমাতে বিদিত/তব মুখে শুনিব কিঞ্চিৎ রাজনীত।।” শব্দটি কি ‘রাজনীত’?বাঙালিই জানেন,হওয়া উচিত ছিল ‘রাজনীতি’তাহলে ‘রাজনীত’ হলো কেন?ভাবলেই বোঝা যাবে,অনুপ্রাসের টানে।কিন্তু তারপরেও সংশয়,শব্দটি কি স্বরান্ত ‘রাজনীত’,না হলন্ত ‘রাজনীত̖’?‘কিঞ্চিৎ’ শব্দটি হলন্ত,‘বিদিত’ স্বরান্ত।এই সংশয়ের জবাব দিতে পারে,ছন্দসুতরাং ছন্দ আমাদের ভাষার বহু রহস্যেরও সন্ধান দেয়বিশেষ করে, প্রাক-ঔপনিবেশিক সাহিত্য,যেগুলোর অধিকাংশই পদ্যে লেখা,সেগুলোর।সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিপির আলোচনা করতে গিয়ে এক জায়গাতে একটি মন্তব্য করেছিলেন,যা ভাষা-বর্ণমালা-লিপির আলোচনাতে ছন্দ বোঝার গুরুত্বের দ্যোতক।তিনি লিখছেন,“The Indian alphabetical principle of akṣaras, i.e., of words being divided into syllables which were not closed by a consonant,was a result of the system of writing. This idea of akṣaras for a long time dominated the Bengali theory of versification.”

 কিন্তু ছন্দ যে একটি উপেক্ষিত বিদ্যা---সে যারাই প্রবোধ চন্দ্র সেন পড়েছেন,তাঁর হাহাকারও পড়েছেন।খুব বেশি বিদ্বান এই নিয়ে কথা বলেন নি।উচ্চ-মাধ্যমিক বা স্নাতক–স্নাতকোত্তর স্তরে পরীক্ষাতে নম্বর তুলবার দরকারে যেটুকু জানলে না হয়,আমাদের ছন্দ চর্চা সেটুকুতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।কবিতার সমালোচকেরাও খুব কম ছন্দ নিয়ে ভাবেন,সে সমালোচনা পাঠক মাত্রেই লক্ষ করে থাকবেন।স্বাভাবিক ভাবেই ছন্দতত্ত্বের এখনো বহু অন্ধকার দিক রয়েই গেছে।ছান্দসিক হিসেবে প্রবোধ চন্দ্র সেনের জীবনজোড়া কাজের শুধু বাংলাতেই নয়,বাংলার বাইরেও অসমিয়া ইত্যাদি ভাষাতেও খ্যাতি রয়েছে---তার পরেও আমাদের এই উপলব্ধি।ছন্দের যে নামগুলো আজ আমরা জানি তার অধিকাংশই তাঁরই প্রচলিত।আবার পরিভাষাগুলো তিনি এতবার পালটেছেন যে অনেকে তাঁর সে পাল্টানোকে এই ভেবে অনুসরণ করেন নি,পাছে আবারো পাল্টান।এই নিয়েও তিনি আক্ষেপ করেছেন,“আগের দেওয়া অক্ষরবৃত্ত  প্রভৃতি নামের চেয়ে ভালো কিনা তা তাঁরা ভেবে দেখতে চান না,শুধু আমি আবার নাম বদল করতে পারি এই আশঙ্কাতেই তাঁরা পরবর্তী নাম মেনে নিতে পারছেন না।কিন্তু তাতে যে আমার দেশের আধুনিক কবিদের চিন্তার জড়তা ও নিশ্চল রক্ষণপরায়ণতা প্রকাশ পায়,তাতে আমি গভীর লজ্জা ও বেদনা বোধ করি।রবীন্দ্র উত্তর কবিরা শুধু যে ছন্দশিল্পকে পরিহার করেছেন তা নয়, তাঁর ছন্দচিন্তাকেও উপেক্ষা করেছেন।” তিনি কবিদের কথা লিখেছেন,আমরা সাধারণভাবে শব্দটির অর্থ ‘ছান্দসিক’ বা ‘ভাষাবিজ্ঞানী’-ও করতে পারি।কবি ছন্দ মেপে লিখবেন না,এসব তিনিও অন্যত্রও লিখেছেন।কিন্তু কবি কী ছন্দে সাজালেন সেই রহস্য সন্ধান পাঠক তথা সমালোচকের কাজ।

যাই হোক,দেখা যাচ্ছে যে প্রবোধ চন্দ্রকে যদি বাংলা ছন্দচিন্তার পুরোধা ধরে নিই,তাহলে সেই চিন্তার বিকাশের ইতিবৃত্তের মধ্য দিয়ে এসে আমাদের একটি সারাৎসার করবার কাজে নামতে হচ্ছিল,এ হচ্ছে সমস্যার একটি দিকআরেকটি দিক হচ্ছে,তাঁর ছন্দচিন্তাটি একেবারেই বিরুদ্ধ সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়।মাত্রা গুণে বাংলা ছন্দের জাতি ভেদ হয় না,এই বিপরীত মেরুর তত্ত্ব রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতেই সামনে এনেছিলেন অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়।তাঁর তত্ত্বটির নাম ‘পর্ব-পর্বাঙ্গবাদ’মোদ্দা কথা পর্বের লয় বোঝে ছন্দের রীতি বুঝতে হবে,মাত্রা গুণবার কাজ আসে তার পরে। লয়বিচারে তিন রীতির ছন্দের তিনি অতিরিক্ত স্বভাব বিচার করে নাম দিয়েছিলেন ধীর, বিলম্বিত এবং দ্রুত লয়ের ছন্দ। সেগুলোরই অন্য নাম-- তান প্রধান,ধ্বনিপ্রধান,শ্বাসাঘাত প্রধান ইত্যাদি।পবিত্র সরকারের মতো ভাষাবিজ্ঞানী যখন,একে আংশিক Description বলে বাতিল করেন আমাদের তখন সমস্যাতে পড়তে হয়।অথচ অনুভব বলে, বাংলা বাক্যের অদেখা অবিভাজ্য স্বনিম যেভাবে বাক্যের অর্থ এবং পদবিন্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করে আমরা দেখে এলাম,পদ্যেওতো সেটাই হয় আরো বেশি এবং এরইতো ছন্দশাস্ত্রে সম্প্রসারিত নাম ‘লয়’কবিতায় লয়ের রীতিমত স্বনিমীয় তাৎপর্য রয়েছে।একে বাতিল করি কী করে? ধারণাগুলোর অনেকটাই তিনি নিয়েছেন,সঙ্গীতের থেকে।আজকাল বাংলা পদ্য গান করা হয় না বলে কোনোকালেই হতো না এমনতো নয়।সুতরাং সঙ্গীতের সঙ্গে পদ্যের অহিনকুল সম্পর্ক আমরা মানিই কী করে? স্কুলপাঠ্য ছান্দসিকেরা এই সব সমস্যার মধ্য দিয়ে যান নি,কাউকে গ্রহণ,কাউকে বর্জন করে কোনো ঝুঁকি নেন নি।তাঁরা অনেকেই এও থাক,ও-ও থাক গোছের একটা সমাধান দিয়ে ছাত্রদের পাশ করাবার ব্যবস্থা করে গেছেন।সুতরাং আমরা দেখলাম,বাংলা ছন্দচিন্তার পুরোটাকেই আবার পুনর্বিচার এবং পুনর্বিন্যাস না করে এগুতে পারি নাআমাদের মনে হলো না,অসমিয়া ছন্দবৈচিত্র্য খুব একটা স্বতন্ত্র কিছু।পরিভাষাগুলোও কিছু কিছু যদিও বা অসমিয়া ছান্দসিকদের নিজস্ব, কিছুবা প্রবোধ চন্দ্র সেন এবং অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে একও।বাংলা ছন্দচিন্তার প্রসঙ্গও তাঁদের আলোচনাতে আসছে।ভাষার কথা যদি ভুলে গিয়ে শুধু ছন্দচিন্তাকেই নিই,যদি ধরে নিই অসমিয়া ছান্দসিকেরা বাংলা ছন্দ নিয়েই কথা বলছেন,তবে মনে হবে কবি বুদ্ধদেব বসু,বা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সেরকম যে কারো ছন্দচিন্তার মতো এটিও আরেকটি দ্বিতীয়,তৃতীয় বা চতুর্থ অভিমত মাত্র।অনেকগুলোই প্রবোধ চন্দ্র বা অমুল্যধনের সঙ্গে একই,আবার বহু জায়গাতে তাদের অভিমত ভিন্ন।কবি ছান্দসিক মহেন্দ্র বরার একেবারেই সাম্প্রতিক একটি গ্রন্থ ‘অসমীয়া ছন্দর শিল্পতত্ত্ব’ পড়ে আমাদের সেরকমই মনে হলোতাঁর উপরে যারাই বাংলা এবং অসমিয়াতে ছন্দচিন্তা করেছেন তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই,‘রবীন্দ্রনাথ সহ’,কোথাও না কোথাও ভুল চিন্তা করছেনএই নিয়ে বাদানুবাদ তো রয়েইছেআমাদেরও সেই সব ভুল-শুদ্ধের পুনর্বিচারের সামনে পড়তে হচ্ছে।সেসব করবার পরেই শুধু আমাদের মূল কাজে নামা সম্ভব ছিল।অর্থাৎ বাংলা অসমিয়া ছন্দের ক্রমবিকাশের তুলনা করা যেতে পারতস্বাভাবিক ভাবেই সিলেটি বা অন্যান্য ভাষাবৈচিত্র্যের কথা  আসছে। সেটি হতে পারে এক সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র অধ্যয়নের বিষয়।সুতরাং বিষয়টি আমরা বাদ দিলাম,কিন্তু ভাবনাটি নথিবদ্ধ করবার দায়বোধ থেকে লিখেও রাখলাম।

 

।। অসমিয়া বাংলা লিপি বিতর্কের স্বরূপ।।

সেরকমই সমস্যা রয়েছে লিপি নিয়ে,এবং বিবাদও।এবং সেই বিবাদের চরিত্রটি অন্য সব বিবাদের থেকে আলাদা।হুমায়ুন আজাদ তাঁর বিশাল দুই খণ্ডের ‘বাংলা ভাষা’-তে সরাসরি লিপি নিয়ে দু’টিই নিবন্ধ সংকলিত করেছেন দ্বিতীয় খণ্ডে।যদিও বানান এবং বর্ণ সংস্কার নিয়ে প্রথম খণ্ডে বেশ কিছু রয়েছে যেগুলো পরিপূরকের কাজ করেআশ্চর্য রকম ভাবে তাঁর সংকলনে প্রথম ভারতীয় প্রত্নলিপিবিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনো রচনা নেই।অন্য কারো তো নেইই।তাতে বোঝা যায়,লিপিসমস্যা আমাদের ভাষাবৈজ্ঞানিক চিন্তাতে কতটুকু জায়গা পায়।যাই হোক যে দু’টি তিনি সংকলিত করেছেন সে দু’টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়একটি নলিনী সান্যালের ‘ভারতবর্ষে লিপিবিদ্যার বিকাশ’,আরটি সিলেটি নাগরী লিপির অন্যতম বিশেষজ্ঞ আহমদ হাসান দানীর ‘শ্রীহট্ট নাগরী লিপির উৎপত্তিও বিকাশ’নলিনী সান্যালের পরিচয় সংকলক জানেন না।মনে হয় সংকলিত প্রবন্ধটির পুরো পাঠও পাননি।এখানে ওখানে তাই ডট চিহ্ন,ছেড়ে যাওয়া।তাঁর এই নিবন্ধটিতে বহু পশ্চিমা লিপিবিদ যারা ব্রাহ্মী-খরোষ্ঠী নিয়ে কাজ করেছেন তাদের নাম রয়েছে‘হরপ্পা সীল’-এর কথা আছেসেই সভ্যতার আবিষ্কারক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাও আছেকিন্তু তাঁর ‘The origin of the Bengali script’বইটি কিংবা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ইত্যাদির কথা নেই।অথচ,বইটি ১৯১৯শের আর হরপ্পা আবিষ্কার ১৯২২এ হয়নিবন্ধের শেষে প্রাসঙ্গিক সূত্র হিসেবে ১৯২৫ এর ৫ এপ্রিলে স্টেটসম্যান কাগজে প্রকাশিত ডাঃ আর এন সাহার একটি  নিবন্ধের উল্লেখ থেকে বোঝা যায় ওই তারিখের পরে নিবন্ধটি লিখেছেনসেখানে এক জায়গাতে নলিনী সান্যাল লিখছেন,“বর্তমান বাঙ্গলালিপির প্রাচীন রূপ হইতেই আসামী লিপি উৎপন্ন হইয়াছে।”আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি নির্দোষ বাক্য।অসমিয়া লিপির কথা,সেই কালে যে তিনি স্মরণে রেখেছেন,সেই যথেষ্ট।তাঁর মূল তর্কের বিষয় ছিল না অসমিয়া-বাংলা বিতর্ক উস্কে দেওয়া বা তার সমাধান করা।কিছু বিদেশি পণ্ডিত দাবি করছিলেন পৃথিবীর সব লিপিই প্রাচীন মিশরীয় সিমেটিক লিপি থেকে এসেছে,মায় ব্রাহ্মী খরোষ্ঠী অব্দি।তিনি সেটি খণ্ডন করে দেখাচ্ছেন ব্রাহ্মী বিশুদ্ধ ভারতীয় লিপি।এবং এর পরে বাংলা অব্দি তার বিকাশ বেশ বিস্তৃত দেখাচ্ছেন।‘অসমিয়া লিপি’র বিকাশের ইতিহাস অধ্যয়নেও নিবন্ধটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতে পারে।কিন্তু যে বাক্যটি আমরা তুলে দিলাম,সেখান থেকে কোনো অমনোযোগী পাঠক পড়তেই পারেন, বাংলা লিপির থেকেই অসমিয়া লিপি এসেছেসেই পাঠক অসমিয়া হলেই তাঁর অভিমানও জাগতে পারে। বাংলার থেকে অসমিয়া আসতে যাবে কেন? মনোযোগ দিলেই দেখা যাবে, সেই উৎস লিপির তিনি কোনো নাম উল্লেখ করেন নি।এই নাম একটি সমস্যা।

            এ ধরনের অমনোযোগিতার সমস্যা যে শুধুই সাধারণ স্তরে হয় তাই নয়।বিদগ্ধ ভাষাবিজ্ঞানীর স্তরেও হয়।আর তখনই শুরু হয় ভাষাবৈজ্ঞানিক বিতর্কের।ডিম্বেশ্বর নেওগের একটি মন্তব্য উদ্ধার করেছেন উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী এরকম, “বঙলা লিপি আরু মৈথেলী আখরবোর প্রকৃততে এটা আরু পুরণি কামরূপ-লিপির সৈতে একে।কামরূপ- লিপিয়ে গতি রুদ্ধ নকরাকৈ আধুনিক অসমীয়া লিপির রূপত নিজর সম্বন্ধ রক্ষা করিলে;কিন্তু বঙলা আরু মৈথেলীয়ে ফালরি কাটি তথাকথিত স্বতন্ত্র জীবন-যাত্রা আরম্ভ করিলে।”এর পরেই এই মন্তব্যকে কোনো রকম যাচাই না করেই সাম্প্রতিক কালের ভাষাবিজ্ঞানী উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীর মন্তব্য,“এই কারণেই বোধ হয় বঙলা লিপির উৎপত্তির লেখক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ে আহোম রজা প্রমত্ত সিংহই(১৭৪৪খৃ:) নীলাচলর আম্রাতককেশ্বর-মন্দিরত লিখোয়া শিলালেখখনতহে বঙলা আখরর পূর্ণ বিকাশ বিচারি পালে।এই প্রসঙ্গতে উল্লেখ করিবলগীয়া যে তের শতিকালৈকে বিকাশ লাভ করা অসমীয়া আখরর বহুতো আখর তের শতিকার উড়িষ্যার ভুবনেশ্বর-শিলালিপির আখরর সৈতে একে রূপর।ইপিনে ডঃ সুকুমার সেনে উল্লেখ করা অনুযায়ী দ্বাদশ শতিকাত বাংলা বর্ণমালাই পূর্ণরূপ দেখা দিয়ে।এই সম্পর্কত লক্ষণ সেন তাম্র-পত্রখন বিশেষভাবে উল্লেখ করিবলগীয়া।এই ফলিখনর আখরর লগত কামরূপী লিপির যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে।বর্তমানর বঙলা আখরর ‘র’ আরু ‘ৱ’র বাহিরে বাকীবোর অসমীয়ারে সৈতে একে।শ্রীকৃষ্ণকীর্তনর হাতে লেখা পুথিত(সোতর-ওঠোরত শতিকাত নকল করা—ডঃ সেন) অসমীয়া ‘ৰ’ টোহে পোয়া যায়।” এই সব নানা তর্কের পরে উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীর সিদ্ধান্ত,“খৃষ্টীয় পঞ্চম শতিকার পরা খৃষ্টীয় ঊনবিংশ শতিকালৈকে অসমর তামর ফলি আরু শিলা-লেখবোররর প্রচলন চলি থাকে আরু সেইবোরর মাজেদি অসমীয়া লিপিয়ে আধুনিক অসমীয়ার সাজ গ্রহণ করে।”১০আশা করছি, আমরা বিতর্কের কেন্দ্রীয় বিষয়টিকেও এর মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছি।সেগুলো হলো প্রাচীন লিপিটি ‘কামরূপী’ ছিল কি না। এবং ‘র’ আর ‘ৱ’ কতটা প্রাচীন,কতটা অসমিয়া আর কতটা বাংলা।

 অসমিয়া লিপির সম্পর্কে তাঁর সিদ্ধান্তটি মোটের উপরে সঠিক।একই সিদ্ধান্ত তিনি ‘বাংলা’র তরফেও কোনো প্রতিবাদ সম্ভাবনা না রেখেই পৌঁছুতে পারতেন কেননা দুই ভাষার লিপিই উনিশ শতকেই ছাপাপ্রযুক্তির হাত ধরেই আসলে আধুনিক ‘সাজ গ্রহণ করে।’সেখানে রাখালদাস বা সুকুমার যদি কয়েক শতক পিছিয়ে কিছু লিখেছেন,তবে সে বাস্তব ইতিহাস স্বীকৃত হবে না।দুই লিপির আধুনিক নামগুলোও উনিশ শতকেই অর্জিত। যে চর্যার দাবি নিয়ে এত বিবাদ, তারই তো টীকাকার মুনিদত্ত লিখেছেন,পদগুলো ‘প্রাকৃত’-এ লেখা।অথচ,এখনকার ‘বাঙালি’,‘অসমিয়া’ কেউই সেই নামকে কোনো মর্যাদাই দিতে অস্বীকার করেন।অসমিয়া লিপির সঙ্গে বাংলা লিপির স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করা নিয়ে বাঙালি ভাষাবিদেরা বিশেষ ভাবনা চিন্তা করেন নি।সুতরাং ‘ফালরি কাটি তথাকথিত স্বতন্ত্র জীবন-যাত্রা আরম্ভ’ করবার ভাবনাটি বাঙালি পক্ষের নয়।সমস্যাটা এই নয় যে একই উৎস লিপি থেকে বেরিয়ে বাংলা স্বতন্ত্র হয়ে গেল বা হতে চাইল কিনা। সমস্যা এইখানেই যে সে অসমিয়া লিপিকে বিশেষ স্বতন্ত্র বলে ভাবলই না।প্রমত্ত সিংহের লিপিতেও তাই রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার লিপিরই বিকাশ সন্ধান করে পেলেন।আসলে ডিম্বেশ্বর নেওগের উপস্থাপনাতেই সঠিক কিছু উপলব্ধির সঙ্গে বেঠিক কিছু ভঙ্গী আছে। যেগুলোকে উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী প্রশ্ন করতে পারতেন ভাষাবিজ্ঞানীর দৃষ্টি থেকে।পুরোনো লিপিকে কামরূপী বলা না বলা নিয়ে মনে হয় না বড় কোনো সমস্যা হবে।বাঙালিরা কেউ আজ অব্দি সেভাবে ভেবে দেখেন নি,আমরা পরে এই নিয়ে লিখবএই নিয়েও কোনো দ্বিরুক্তি করা চলে না যে কামরূপ-লিপিয়ে গতি রুদ্ধ নকরাকৈ আধুনিক অসমীয়া লিপির রূপত নিজর সম্বন্ধ রক্ষা করিলে।”আমাদের প্রশ্ন হলো,বাংলা লিপির কী ‘গতিরূদ্ধ’ হয়েছিল কোথাও?একটি সজীব ভাষাতে কি সেটি সম্ভব?সত্যিই কি রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা সুকুমার সেন সেরকম লিখেছেন যে প্রমত্ত সিংহের দিনে অর্থাৎ আঠারো শতকেই বা লক্ষণ সিংহের দিনেই ‘বঙলা আখরর পূর্ণ বিকাশ বিচারি’ পেলেন?সেরকম হলে বাংলা নিয়েও তাঁদের সিদ্ধান্তের ভাষাবৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত নেবার যোগ্যতাকেই প্রশ্ন করা উচিত ছিল উপেন্দ্র নাথ গোস্বামীর।বাংলা অসমিয়া প্রশ্নে পশ্চিমা বিদেশিরা যদি প্রশ্ন তুলতে পারেন,তবে বাংলার প্রশ্নে উপেন্দ্রনাথ অসমিয়া ভাষাবিদ বলে প্রশ্ন তুলতে পারবেন না কেন?পারেননি,কারণ মূল প্রাচীনরূপটির সঙ্গে যাকে তাঁরা কামরূপী বলছেন,অসমিয়ার ‘অপরিবর্তিত’ সম্পর্ক দেখাবার দিকেই তাদের দৃষ্টি গেছে।যখন সত্য হলো অপরিবর্তিত কোনোভাষার কোনো লিপির পক্ষেই থাকা সম্ভব নয়।অপরিবর্তিত থাকবার মধ্যে কোনো গৌরব নেই। অসমিয়াও থাকে নি,এখনো পাল্টাবার প্রয়াস চলছে---অসমিয়াতেও,বাংলাতেও-- আমরা দেখাবো।কিন্তু সেই ‘গতি রুদ্ধ নকরাকৈ’ সম্বন্ধ দেখাতে গিয়ে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কেই তাঁরা দু’জনেই কীভাবে ভুল পড়লেন,প্রথম আমরা তাঁদের থেকে দেখাচ্ছি,পরে রাখাল দাসের দিকেই তাকাবডিম্বেশ্বর নেওগের‘New Light on the Development of the Asamiya Script’ বই থেকে একটি উদ্ধৃতি তুলে দিয়েছেন উপেন্দ্রনাথ এরকম “In a Sanskrit inscription written in Bengali characters of saka 1666 (1744 A.D.) found at Kāmākhyā in the Gauhati district,Assam, we find that though the wedge at the bottom has disappeared,the line between the curve and the top stroke is still present’---The Origin of Bengali Script, 1973.ch.IV:The Final Development of the Alphabets.১১ we find that’-এর পরের অংশগুলোতে কি মনে হয় রাখালদাস সমস্ত বাংলা লিপির সম্পর্কে কথা বলছেন?‘the wedge at the bottom has disappeared,the line between the curve and the top stroke is still present’ কথাগুলো কোনো একটি বর্ণের পক্ষেই লেখা সম্ভব।তাও এতে কোত্থাও ‘পূর্ণ রূপ’ পাবার বিষয়টি নেই। সেদিক থেকে অধ্যায় শিরোনামটি,---The Final Development of the Alphabets,ছাড়া আর কোনো কথাই তো আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে না।এবারে দেখা যাক,কী লিখেছিলেন আসলে রাখালদাস?অধ্যায়টিতে আসলে তিনি বাংলাতে প্রতিটি বর্ণ কীভাবে প্রত্ন-বাংলার থেকে বিবর্তিত হচ্ছে সেসব দেখাতে গিয়ে শুরুতেই ‘অ’ () বর্ণের বিবর্তনের বেশ কিছু ক্রম ব্যাখ্যা করছেন।এবং চতুর্থ তথা (d) ক্রমে এসে কথাগুলো শুরু করেছেন এইভাবে,“In the Cambridge Manuscript the wedge at the bottom and the line joining the comma-shaped curve are still present.These two were not dropped until the present time.১২ এর পরের কথাগুলোই উপেন্দ্রনাথ তুলে দিয়েছেন।তাও শেষে এরকম একটি নজির আছে ‘Cf. Āmrātakeśvarasya’১৩ তা হলে অধ্যায় নামটি এরকম কেন?এর কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা অধ্যায়টিতে নেই।কিন্তু সারা পূর্বভারতের বিচিত্র লিপির থেকে প্রতিটি বর্ণের বিচিত্র কালে এবং কালানুক্রমে ভিন্ন রূপের ব্যাখ্যা সহ যে কথাটি তিনি স্পষ্ট করছেন বলে বোঝা যাচ্ছে,সে হলো শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এবং তার আগেকার লিপিরূপকে তিনি ‘প্রত্ন-বাংলা’ তথা ‘Proto-Bengali’ ই লিখছেনঅধিকাংশ সময়ই ব্রাহ্মী-মৌর্য-গুপ্তলিপির পূর্বী বৈচিত্র্য (Eastern Variety) বলেই লিখছেন।ধারণাটি তিনি নিয়েছেন তাঁর পূর্বসূরি জর্জ ব্যুলর থেকে।১৪সেখান থেকে ছাপাযুগের আগে অব্দি যে রূপটিকে আমরা বাংলা বলে চিনে এসেছি সেইরূপ বা রূপটিকেই ‘final’ লিখছেন।তারমানে তো এই নয় যে ছাপাযুগে এর আর কোনো পরিবর্তন হয় নি। সেসব তিনি বিবেচনাতেই আনেন নি।অর্থাৎ কোনো এক বিশেষ দিনক্ষণ দেখে বাংলা লিপি কোনো এক রাজার দানপত্রতে এসে চূড়ান্ত পথ নিয়েছে সেরকম তাঁর বলবার কথাই নয়।শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে আর রাজা প্রমত্ত সিংহের ফলকেই পেট কাটা আজকের অসমিয়া ‘ৰ’ দেখা যায় সে কথাও তিনি গোপন করেন নি।‘র’ এর বিবর্তনের সপ্তম ক্রমে লিখছেন,

The modern form minus dot is to be found in the Cambridge Manuscripts.In later periods we find that a slanting cross bar in the interior of va denotes ra as in modern Assamese:-

1) Manuscript of Caṇḍīdāsa's Kṛṣṇa-Kīrttana, fol. 179, Mallārarāgah (L.1).

2) Niranta in L.4 of Kāmākhyā minor temple inscription of Śaka 1666=1744 A.D.১৫

 কিন্তু তারও মানে এই নয় যে এই ‘ৰ’-ই একমাত্র লিপিরূপ ছিল,যার থেকে নিচে বিন্দু দিয়ে বাংলা বেরিয়ে এসেছে প্রত্ন-বাংলাতে ‘র’-এর বিকল্প রূপের পেট কাটাও ছিল না,নিচে বিন্দুও ছিল না। সে অনেকটাই ‘ব’-এর মতোই দেখাতপাঠককে বুঝে নিতে হতচর্যাতেই সেরকম ব-এর কালিমাখা রূপটি ছিল।পরে আসে পেট-কাটা ‘ৰ’ এবং ডান পাশে বিন্দু ‘ব·তথ্য ঘাটলে দেখা যাবে নিচে বিন্দু দেয়া ‘র’-টিই আসলে অসমিয়া ‘ৱ’ ছিল।আমরা আহোম রাজা শিব সিংহ এবং প্রমত্ত সিংহের  দুটি মুদ্রা১৬ এখানে হাজির করছি চিত্র-০১ এবং ২-তেসেই সঙ্গে চিত্র-০৩ এবং ০৪-এ ক্রমান্বয়ে প্রমত্ত সিংহের ফলক১৭ এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের১৮ পাণ্ডুলিপির ছবিও।স্পষ্টই দেখা যাবে,এই দুই বর্ণতো বটেই আরো বেশ কিছু বর্ণেও অসমিয়াও সরেছে,বাংলাকেও তো সরতেই হতো।কারণ ‘র’ বোঝাবার হরফ সর্বত্র এই পেট কাটা ‘ৰ’ ছিল না। আমাদের উদ্ধৃতির শুরুতেই স্পষ্ট।পরে আমরা সুকুমার সেন থেকেও একটি ছবি দিচ্ছি চিত্র-০৫-এশিব সিংহের মুদ্রাতেও সেরকম একটা সংশয় জাগে,‘বেশ্বব’(ৰেশ্বৰ?) অংশে।যদিও এখানে মাঝের রেখাটি ক্ষয় পেয়েও যেতে পারে। সুতরাং এই ‘ফালরি কাটি’ যাবার বিষয়টি এক জীবন্ত ভাষা বলেই অসমিয়াতেও ঘটেছে,বাংলা একা কোনো অন্যায় করে নি।পাকাপাকি সরে যাবার ব্যাপারটি ঘটেছে দ্বাদশ শতকে নয়,উনিশ শতকে ছাপা প্রযুক্তির হাত ধরে –সে আমরা পরে আরো স্পষ্ট করবএরকম এক সিদ্ধান্তে বাংলা-অসমিয়া কোনটারই লিপি এবং ভাষার প্রাচীনতার কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয় না। তাহলে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ‘অ’ প্রসঙ্গে যদিও বা রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আলাদা করে ‘অসমিয়া’ ‘অ’-এর কথা লেখেননি ‘র’-এর প্রসঙ্গে লিখছেন এবং মনে করিয়ে দিচ্ছেন,যে এই রূপটি আধুনিক অসমিয়াতে রয়েছে।এক ভাষাবিদের পক্ষে কি সর্বত্র এটা উল্লেখ করে যাওয়া সম্ভব যে এই একই ‘অ’ বাংলাতেও আছে,অসমিয়াতেও আছে। সেসব অসমিয়া ভাষাবিদেরাও করেন না।আসলে ইতিহাস একই লিপির লেখেন।অসমিয়া লিখলে একে ‘অসমিয়া লিপি’ বলে লেখেন,বাঙালি লিখলে ‘বাংলা লিপি’ বলে লেখেন। যেখানে তফাতটি আছে,উল্লেখ করে যান। যৌথ সম্পদের এই এক বিড়ম্বনা।সামান্য অভিমান বিপদ হয়ে দেখা দেয়।তার উপর রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়,সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বেণীমাধব বরুয়া বা ডিম্বেশ্বর নেওগরা প্রথম যুগের তাত্ত্বিক ছিলেনতাঁরা স্ব স্ব ভাষা এবং লিপির স্বরূপ এবং মর্যাদা নিয়েই চিন্তিত থাকতেই পারেন।তাঁরা বিষয়গুলোকে বুঝতে শুরু করেছিলেন মাত্র।তাদের বহু সীমাবদ্ধতা থাকাটাই স্বাভাবিক।কিন্তু সেই সব সীমাবদ্ধতা যদি কালক্রমে আমরা দেখছি পরস্পরের জাত্যাভিমানের কারণ হয়েছে,আমাদের এখন সেসব স্থিতিকে পুনর্বিচার করে ‘জাত্যাভিমান’ মুক্ত ভাষাবিজ্ঞানকে দাঁড় করানোই হবে যথার্থ আধুনিকতাকে কতটা প্রাচীন --- যদি গৌরবের বিষয় হয়,কে কতটা নবীন এবং আধুনিক সেও কি কম গৌরবের? 



বাংলা কিংবা অসমিয়া দুই ভাষাচিন্তাই সেই গৌরবের অংশীদার হতে অস্বীকার করবে কেন?এই প্রসঙ্গে বাংলার  এক বিদগ্ধ পুথিলিপি বিশেষজ্ঞ তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্য তুলে ধরা অসমিচীন হবে না।মন্তব্যটির উল্লেখ করেছেন আরেক লিপি বিশেষজ্ঞ অণিমা মুখোপাধ্যায় তাঁর একটি লেখাতে এরকম, “...তুলনামূলক আলোচনায় অক্ষরের প্রাচীনত্ব আধুনিকত্ব স্থির করা যায় তখনই, যখন লিপির ইতিহাসে প্রতিটি স্তরের বৈশিষ্ট্য স্থির হয়ে গেছে।কিন্তু বাংলা লিপির ইতিহাসে সব তথ্যই কি আমাদের হস্তগত হয়েছে?আমরা কি নিশ্চিত ভাবে জানি,উ-র চৈতন কবে থেকে শুরু হয়েছে? ড/ড়,য/য়,ণ/ন/ল কবে থেকে পৃথক হয়েছ,ণ-এর দ্বিবিধ রূপ কতদিন চালু ছিল,পূর্ণ বাহু এবং অর্ধবাহু একই সঙ্গে দীর্ঘকাল চালু ছিল,না অর্ধ বাহু পরবর্তী কালে পূর্ণ হয়েছে,বিন্দু যুক্ত প্রাচীন না পেট-চেরা প্রাচীন, ি-কারের ছত্রাকার কবে যুক্ত হল,দাঁড়ি অংশ কবে থেকে সৃষ্টি হল,দাঁড়ির উপর ছত্রাকার ঊর্ধ্বাংশ নিয়ে আধুনিক ি-কারের জন্ম কবে,‘কু’-র আধুনিক রূপ প্রথমে কবে পাওয়া গেল,আমরা কি এমন প্রমাণ সংগ্রহ করেতে পেরেছি যে ’ ‘’ ‘প্রভৃতি অক্ষরের কোণযুক্তরূপ আধুনিক এবং কোণ-হীন অর্ধবৃত্তাকার রূপ প্রাচীন?বাঙ্গালা লিপির আঞ্চলিক ভেদ সম্পর্কে আমাদের ধারণা কতটুকু?আমরা জানি না,বাঙ্গালা অক্ষরের কোন̖ প্রত্যঙ্গটি প্রাচীন,কোন̖টি আধুনিক।লিপির ইতিহাস সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান যখন এতই সীমাবদ্ধ,তখন এ-অক্ষরটি প্রাচীন,ও অক্ষরের ঐ রেখাটি আধুনিক এমন স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়ার কোনো অধিকার আমাদের নেই।১৯ (বড় হরফ আমাদের-গবেষক) কিন্তু সেই অভিমানের কারণটিও একতরফা নয়।ভূমিকার এক জায়গাতে কিন্তু রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এরকম একটি শিথিল মন্তব্য করেছেন,“The Modern Cursive Odiya script was developed out of the Bengali after the 14th century A.D. like the modern Assamese.২০ এর পরে তিনি যদি নাগরী লিপির প্রভাব কিছু বাংলাতে আছে কিনা,সেই তর্ক তুলতেই পারেন;নলিনী সান্যাল যদি প্রাচীন সিমেটিক লিপির থেকে ভারতীয় ব্রাহ্মী এসেছে কিনা,সেই সব তর্ক তুলে অনুসন্ধানে নামেন;অসমিয়া ভাষাবিদেরাও স্বাভাবিক ভাবেই ‘বাংলার থেকে অসমিয়া এসেছে কিনা’ এই তর্ক তুলে অনুসন্ধানে নামতেই পারেন।এবং কামরূপী বৈচিত্র্যের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা দেবার কাজ করতেই পারেন।যদিও তাতে লিপি সম্পর্কে মূল সিদ্ধান্তগুলোর খুব বড় হেরফের ঘটে নাইতিহাসের এবং বর্তমান স্বরূপের বেশিটাই একইরকম, সামান্যই তার স্বতন্ত্র-- এই সত্যের খুব একটা হেরফের হয় না।আমরা জানিনা,এই মন্তব্যটি উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীর দৃষ্টি এড়িয়ে গেল কী করে? কিন্তু ডিম্বেশ্বর নেওগের ‘ফালরি কাটি’ কথাগুলোকে এর পরে ‘developed out of the Bengali’-র থেকে অনেক সবিনীত উপস্থাপন বলেই মনে হয়।দুটোই আসলে একই কথার বিপরীত উপস্থাপন।বাংলাটি আগে,অসমিয়াটি পরে। তারপরেও আমাদের ‘The Final Development of the Alphabets’ কথাটির মানে বোঝা দরকার।যদি সুকুমার সেন বুঝতে চাই।তার জন্যে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধ্যায় পরিকল্পনাটির দিকে তাকাতে হবে।এর ঠিক আগের অধ্যায়টির নাম ‘The Eastern Alphabet’ সেখানে তিনি শেষের দিকে লিখছেন,“In the twelfth century we come across a number of historical events.The Gaharwārs or Gāhaḍavālas made themselves secured at Kanauj.In the East,the power of the Pālas,declined gradually. Their dominions in Bengal were gradually acquired by the Senas,and in Bihār by the Gaharwārs.In this century we find the completion of the development of the modern Bengali script with exceptions of a few letters (1) ,(2) Ṛi,(3)ca,(4) cha,(5) ṭa,(6) ṇa, (7) bha,(8) Śa and (9) Ha.

    The final changes in which took place after the Muhamadan conquest of Northern India.In this century, it will not be necessary to consider these alphabets used in the different inscriptions, as our narrative of the development of the Bengali alphabet is almost complete.We shall, simply, note the changes in the forms of the letters as they pass through this period.২১

 প্রেক্ষিত বিচ্ছিন্ন করে এখানকার সব কথা স্পষ্ট করা কঠিন।কিন্তু দ্বাদশ শতক অব্দি আসতে আসতে ‘as our narrative of the development of  Bengali alphabet is almost complete’ এই কথাটি রয়েছে। আসল কথাটি কী?কোনটি বাক্যের কর্ম আর কোনটি তার সম্প্রসারক সেটি বোঝবার সমস্যা। ‘our narrative is almost complete’ এ ভাবে পড়াই সঠিক,‘the development of  Bengali alphabet is almost complete’ নয়। দ্বাদশ শতকই কেননা,এই সময় বাংলার রাজনৈতিক,সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ইতিহাসেও একটি বড়সড় পরিবর্তন ঘটছে।বাকি পূর্বভারত তথা অসমে এই ঘটনা ঘটবে কিছু পরে।অর্থাৎ একদিকে পশ্চিমে তুর্কি এবং পুব দিক দিয়ে আহোমরা প্রবেশ করবেন।স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে মোড় ফেরানোটা উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীরও নজরে পড়ছে ত্রয়োদশ শতকে,তার আগে নয়।‘গুপ্তলিপি’র পূর্বী রূপ থেকে বাংলার স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত হতে শুরু করেছে।অর্থাৎ এর পরে যা কিছুই বৈচিত্র্য দেখা যাক,তার সবকেই বাংলা লিপির রূপবৈচিত্র্য বলে গ্রহণ করা চলে।অসমিয়ার বলেও গ্রহণ করতে কারো অসুবিধে থাকবার কথা নয়।দিনপঞ্জির কালটিকে যদি ইতিহাসের ঘটনাক্রমের সঙ্গে জুড়ে দেখি,দেখব এই সময়টিকেই অসমিয়া লিপির জন্যেও একটি যুগবিভাজক সময় বলে উপেন্দ্রনাথও স্বীকার করেন।তাঁর ত্রয়োদশ শতকটিই আসলে ইতিহাসের বিচারে বাংলার দ্বাদশ শতক।তাই তিনিও অসমিয়া লিপির ইতিহাসকে তিনভাগে ভাগ করেছেন,“খৃষ্টীয় পঞ্চম শতিকার পরা ত্রয়োদশ শতিকালৈ পুরণি অসমিয়া লিপি বা কামরূপী লিপি,ত্রয়োদশ শতিকার পিছর পরা ঊনবিংশ শতিকার মাজভাগলৈ (‘অরুণোদয়’র জন্ম কাললৈ) মধ্য যুগীয় লিপি,আরু অরুণোদয়র জন্মকাল (১৮৮৬) র পরা বর্তমানলৈ আধুনিক অসমীয়া লিপি।”২২ মানে দাঁড়ালো এই যে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের আগেকার লিপিকে অসমিয়া লিপিবিদেরা ‘কামরূপী’ নাম দিচ্ছেন,বাংলা বা পশ্চিমা লিপিবিদেরা গুপ্ত বা নাগরী লিপির ‘পূর্বীবৈচিত্র্য’ বলছেন,‘কুটিল’ বলছেনঅথবা বলছেন ‘প্রত্ন-বাংলা’--- যেটি বললে ‘প্রত্ন-অসমিয়া’,‘প্রত্ন-মৈথেলি’ ইত্যাদি বলবার সুযোগটাও কিন্তু তৈরি থাকেএইটুকুন নামভেদ বাদ দিলে যুগবিভাগ মোটের উপর একই রকম।অরুণোদয়ের কালটাকে না হয় বাংলার জন্যে পিছিয়ে হ্যালহেড –পঞ্চানন কর্মকার অব্দি আঠারো শতকের শেষের দিকে নেওয়া যাবে। কিন্তু ওই যে তিনি ত্রয়োদশ শতক অব্দি একটা যুগ বিভাগ করলেন,সুকুমার সেন যখন লেখেন,“ খ্রীস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দেই বাঙ্গালা বর্ণমালা নিজস্ব রূপ গ্রহণ করিয়াছিল।”২৩ কথাটার অর্থ তাই দাঁড়ায়। বোঝা যায়,তাঁর কথাতে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিধ্বনিত হয়েছেন মাত্র।মাত্র সাড়ে তিন পাতাতে তিনি লিপির কথা সেরেছিলেন ‘ভাষার ইতিবৃত্তে’তার পুরোটাই লিপির উদ্ভব কাহিনিতে ভরাএকেবারে শেষের দিকে লিখেছেন,“গুপ্ত-শাসন কালে ব্রাহ্মী লিপি ভারতের পূর্বাঞ্চলে যে রূপ পাইয়াছিল তাহাকে কুটিল লিপি বলা হয়।এই কুটিল লিপি হইতে বাঙ্গালা লিপির উদ্ভব।”২৪এর পরে আমাদের আগে উল্লেখ করা তৃতীয় বাক্যটি দিয়েই তাঁর লিপির আলোচনা শেষ।সুতরাং এর মানে বের করতে হলে রাখাল দাসের মতো যারা আগে স্বতন্ত্র বিস্তৃত আলোচনা করেছেন,তাদের কাছেই পৌঁছুতে হয়। আমরা তাই করলাম।নিশ্চয় সুকুমার সেন বোঝাতে চান নি,এর পরে আর বাংলা লিপির কোনো পরিবর্তন হয় নি,তার গতিরুদ্ধ হয়ে গেছিলতিনি এর পরেই দ্বাদশ শতকের লিপির নজির দিয়েছেন এরকম চিত্র ০৫-এর মতো,যেখানে দেখা যাবে ‘র’-এর পেট কাটাও নেই,নিচে বিন্দুও দেয়া নেইঅন্য বর্ণগুলোও সব ক’টি আজকের মতো পরিণত নয়,বিসর্গটি বাংলা ৪ এর মতো।খানিক অনুমান করে পড়া যায় মাত্র।তাহলে বাংলা লিপি আজকের অর্থে পূর্ণ রূপ পায় কী করে? সুকুমার সেন কিন্তু অন্যত্র এরকমও লিখেছেন,“ একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দ পর্যন্ত বাংলা –মৈথিল-উড়িয়া এই তিন প্রদেশের লিপি একই ছিল।এই সময়ের পূর্ব ভারতীয় লিপিকে বলা হয় প্রাক বঙ্গীয় লিপি”২৫ বোঝা যাচ্ছে রাখাল দাসের ‘Proto Bengali’-র তিনি বাংলা অনুবাদ করছেন ‘প্রাক বঙ্গীয় লিপি’ বলে।আরো লিখেছেন,“বাংলা লিপির নিজস্ব ইতিহাস শুরু হলো দ্বাদশ শতাব্দ থেকে।কিন্তু তখনকার লিপি এখন আমাদের কাছে অপাঠ্যের পর্যায়েই রয়ে গেছে।‘ত’ ‘ব’ ইত্যাদি দুই একটি অক্ষর শুধু কষ্টেসৃষ্টে চেনা যায়।”২৬ তা হলে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে ইতিহাসের কোনো এক সুনির্দিষ্ট মুহূর্তে বাংলা  তার উৎস লিপি থেকে একবারই ‘ফালরি কাটি’ যায় নি,গেছে বহুবার এবং অসমিয়ার মতোই কোনো কালেই তার ‘গতিরুদ্ধ’ হয় নি।  

 

।। বাংলা-অসমিয়া লিপির কালক্রমিক স্বরূপ ।।

এই অব্দি আমরা বিতর্কটির একটি স্বরূপের সঙ্গে পরিচয় করালাম মাত্র। সে বিতর্কের দু তরফেই কিছু অভ্যন্তরীণ দুর্বলতারও মুখোমুখি হওয়া গেল।এবারে আমরা ক্রম মেনে প্রথমে বাংলাতে লিপি চিন্তার বিকাশধারার একটি রূপরেখা খানিক বিস্তৃত বুঝবার চেষ্টা করছি কেননা মূল তর্কটি বাংলা লিপিচিন্তার সঙ্গেই।লিপি দু’টি যে সহোদর-- এই নিয়ে অসমিয়া তাত্ত্বিকদের মধ্যেও বিবাদ নেইতাই এতে শুধু বাংলা নয়,অসমিয়া লিপির  ইতিবৃত্তও অনেকটা বোঝা যাবেশেষে আমরা তর্কের অসমিয়া পক্ষটিকে বুঝবার চেষ্টা করব।

           রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম ভারতীয় প্রত্নলিপিবিদ:

তাঁর নামটি মূলত ১৯২২শে  মহেঞ্জোদারো খনন কার্যের জন্যে বিখ্যাত হলেও দুই খণ্ডে ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ ছাড়াও বেশ কিছু ঐতিহাসিক,প্রত্নতাত্ত্বিক গ্রন্থেরও তিনি প্রণেতা।কিন্তু বোধ করি সবার আগে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের নেতৃত্বে গড়ে উঠা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আবহে বাংলা লিপির উৎস নিয়ে বাংলাতে একটি বই লিখে ফেলেন।বাংলা রচনার প্রেরণাটি পান,রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীর থেকে।পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে বলেন।অনুবাদ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিলে বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘জুবিলী রিসার্চ পুরস্কারে’ সম্মানিত করে। সেসব ১৯১৩তে হয়।পরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ই গবেষণা নিবন্ধটি ছেপে বের করে।তখন অব্দি যেসব প্রত্নলেখ পাওয়া গেছিল সেসবের উপরে ভিত্তি করেই তিনি তাঁর সন্দর্ভ প্রস্তুত করেন।গুয়াহাটির অতিরিক্ত সহযোগী আয়ুক্ত হেমচন্দ্র গোস্বামী তাঁকে কামাখ্যা-প্রত্নলেখটির ছবি দিয়ে সহযোগিতা করেনএসব হল বাহ্যিক প্রেরণার দিক।অন্তর্বস্তুর দিক থেকে বইটি আসলে জার্মান প্রত্নলিপিবিদ জর্জ ব্যুলর (Dr. George Bühler)-এর লেখা ‘Indische Palaeographie’ নিবন্ধটির বিস্তার তথা সমালোচনা বললেই চলে সেই নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল দশক দুই আগে ১৮৯৬তে একটি জার্মান সংকলন ‘Grundriss der Indo-Arishen Philologie and Alterumskunde.’ বইতে।নিবন্ধটি এখন স্বতন্ত্র বই হিসেবেই পাওয়া যায়। ব্যুলরের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা তিনি প্রকাশ করেছেন,ভূমিকা অংশে এই বিশেষণে ‘the father or the science of Indian Palaeography.২৭শুরুতেই লিখেছেন,ভারতীয় লিপির অনুসন্ধান করতে গেলে একজনকে অবশ্যই ব্যুলরের পথ ধরেই এগোতে হবে।কিন্তু ব্যুলরের রচনাতে দ্বাদশ শতক অব্দি ভারতীয় লিপির বিকাশ আলোচনা করলেও,রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ অব্দি তো তিনি ভালোই ব্যাখ্যা করেছেন।কিন্তু উপকরণের অভাবে এর পরের সময়ের ব্যাখ্যা খুবই অস্পষ্ট এবং বিচ্ছিন্ন।ইতিমধ্যে আরো কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার হয়ে গেছে। সেগুলোর আলোতে সেই অস্পষ্টতা ব্যাখ্যা করা চলে।রাখালদাস তাই করতে গিয়েছিলেন,তাও মূলত লিপিটির উত্তর-পূর্ব  ভারতের বৈচিত্র্য নিয়েইব্যুলর সম্ভবত ভারতে একটিই মূল লিপির কথা লিখেছেন -- সেটি ব্রাহ্মী লিপি।সংস্কৃত লিখবার জন্যে ব্রাহ্মণেরাই এই লিপি তৈরি করেন,“A script framed by learned Brāhmaṇs for writing Sanskrit.২৮ মৌর্যযুগের রূপান্তরটিকে মৌর্যলিপি বলে চিহ্নিত করেন। মৌর্য লিপির মোটা দাগে দুই ভাগ—উত্তরা এবং দক্ষিণী। এলাহাবাদ,রাধিয়া,মাথিয়া,রামপুরিয়া,সাঁচি,সারনাথ অশোক স্তম্ভের লিপিগুলো উত্তরা, এবং গীর্নার, ধৌলি ইত্যাদি স্তম্ভের লিপিগুলো দক্ষিণী। উত্তরা লিপিগুলোর ভেতরেও বিভিন্ন আঞ্চলিক বৈচিত্র্য তাঁর নজরে পড়েফলে সেগুলোকেও তিনি উত্তর-পূর্বী,উত্তর–মধ্য,এবং উত্তর পশ্চিমা এই তিন ভাগে ভাগ করেন।এগুলোর মধ্যে ‘উত্তর-পূর্বী’ শাখাটিতেই রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মনোনিবেশ করেন,এবং মৌর্য,কুশান,গুপ্ত, পাল সাম্রাজ্য হয়ে একেবারেই প্রাক-ঔপনিবেশিক সময় অব্দি বিভিন্ন সময়ের এবং স্তরের লিপি বিবর্তন প্রতিটি বর্ণ এবং সেগুলো যদি ভিন্ন ভিন্ন প্রত্নলেখে পাওয়া গেছে সেগুলোর বিবরণ সহ আলোচনা করেছেন।লিপিবৈচিত্র্যগুলো কোনোটি কখনো সিদ্ধিমাতৃকা,সারদা,নাগরী ইত্যাদি নামে চিহ্নিত হয়েছে।কিন্তু সবগুলোকে আর ওই মৌর্য বা গুপ্তলিপি বাদ দিলে একই নামে দেখা যাচ্ছে না।অন্যগুলো নিয়ে তিনি বিশেষ বিস্তৃত লেখেনও নি।শুধু এই লিখেছেন যে বাংলা লিপি নাগরী লিপির সঙ্গে সম্পর্ক শূন্য।নাগরীরূপটি নিয়েছিল পশ্চিমা বৈচিত্র্যহর্ষের কালে বা পরে গুজ্জর-প্রতিহারদের শাসন কালে পূর্বী বৈচিত্র্যের একটা অংশকে নাগরী নিজের ভেতরে টেনে নেয় (absorbed )কিন্তু বাকিটা একাদশ দ্বাদশ শতক অব্দি আসতে আসতে বাংলা বা প্রত্নবাংলা লিপি গড়ে তোলে।২৯সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিবরণগুলোর কথা বাদ দিলে তাঁর বাকি কথাগুলোর একটা ধারণা আমরা ইতিপূর্বে দিয়ে এসেছি।সিলেটের ঈশান দেবের লিপির কথা জানতেন।কিন্তু নিধনপুর লিপির বা সেরকম প্রাচীন লিপির সংবাদ তাঁর কাছে ছিল না।একই সময়ে প্রকাশিত অচ্যুত চরণ তত্ত্বনিধির ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ বইতেও দেবেদের ভাটেরা তাম্রলিপির কথা আছে,নিধনপুরের কথা নেই।৩০ সুতরাং কামরূপী বৈচিত্র্য বলে কোনো কিছুর অস্তিত্বের চিন্তা তাঁর মধ্যে আসা সম্ভব ছিল না,আসে নি।একজন বিশেষজ্ঞ কখন বসে কী সাধন নিয়ে অনুসন্ধান করছেন সেসব মনে রেখেই তাঁর বিচার করাই সৌজন্য, যেভাবে তিনি  করেছেন ব্যুলরের। দু’জনেই প্রত্নতাত্ত্বিক ছিলেন বলে উত্তরসুরি জানতেন  পূর্বসূরির সমস্যা এবং সীমা কোথায়।                                                                                    

সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় এবং অসমিয়া-বাংলা লিপি:

লিপির কথা সুনীতি কুমার আলোচনা করেছেন ভূমিকার পরিশিষ্টে ‘Bengali Orthography শিরোনামে।৩১ শুরুতেই তিনি রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাটির উল্লেখ করে লিখেছেন,“The history of the origin and development of the Bengali alphabet has been treated in detail in the ‘Origin of the Bengali Script’ by R.D. Banerji (Calcutta University)...”৩২ সেই সঙ্গে উল্লেখ করেছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘বাঙ্গালার প্রাচীন অক্ষর’ নিবন্ধটির কথা।নলিনী সান্যালের নিবন্ধটির কথা নেই। কেননা সেটি এবং ওডিবিএল-এর প্রকাশ সময় একই।তাঁর সিদ্ধান্তও তাঁদের অনুসরণ করেই এগোচ্ছে।তিনি লিখছেন,“The story of the development of the various letters in their present-day forms is a complicated one, but the general pedigree is clear.The Bengali alphabet is derived from an Eastern alphabet current in what is now Eastern United Province,Eastern Central Provinces, Bihar,Orissa,and Bengal and Assam,from the 6th century onwards.This Eastern Alphabet is a variety of the Gupta Script (400-550 A.C.),which is a sort of cursive development,through the intermediate Kuṣāṇa writing, of the primitive and monumental Brāhmī,the mother of all the national Indian alphabets.”৩৩ ক্রমটা তাহলে বোঝা যাচ্ছে ব্রাহ্মী-কুশান-গুপ্ত-থেকে এদিকে পূর্বী,ওদিকে পশ্চিমা বৈচিত্র্য।পশ্চিমা বৈচিত্র্যটি কাশ্মীর ছাড়া বাকি পশ্চিম ভারতে প্রচলিত ছিল,যার থেকে দেবনাগরী আসে।কালক্রম ভেঙে হলেও কিছুদিন এই পশ্চিমা বৈচিত্র্যের কিছু প্রভাব পূর্বী বৈচিত্র্যে দেখা যাচ্ছিল, এই কথা সুনীতিকুমারও লিখেছেন।তার একটি কারণ,শৌরসেনী অপভ্রংশের বিস্তার।বাংলাতে সবচাইতে প্রাচীন লিপি নিদর্শনটি তাঁর মতে এখনকার দক্ষিণ পশ্চিম বাংলার বাঁকুড়া জেলার শুশুনিয়া পাহাড়ের চতুর্থ শতকের পাথুরে ফলকে এবং পঞ্চম শতকের গুপ্ত ফলকে মেলেঅষ্টম শতক থেকে প্রচুর ফলক পাওয়া যাচ্ছে,সেগুলোতে পূর্বী-পশ্চিমা আলাদা চেনা যাচ্ছে।তিনি লিখছেন,“It seems that there was in Bengal a cursive hand which differed from the more formal and archaic inscriptional alphabet;the letter showing greater western influence.MSS written in this cursive form of the Eastern alphabet,dating from 7th century,the MSS. Preserved in the temple of Horzui in Japan, have been found.This cursive Eastern alphabet is the immediate source of 1) Bengali-Assamese,Maitheli and Ọriyā alphabets.(1) and (2) are practically identical:almost all the forms in (2) are found in Old MSS. written in (1).” ৩৪মিথিলার দক্ষিণে মগধেও এই লিপি ব্যবহৃত হত নেপালে সুরক্ষিত নালন্দা–বিক্রমশিলার পাণ্ডুলিপিগুলো সেই সাক্ষ্য দেয়।কিন্তু মৈথিল হরফগুলো যে হুবহু বাংলা ছিলনা সেই ইঙ্গিত সুনীতিকুমারে আছে।তিনি লিখছেন,“In fact,Sanskrit MSS. in Maithili characters used to be read quite easily by Bengali Pandits,to whom these characters were known as তিরুটে  « tiruṭē = tirahuṭiyā » letters ( Tirahuṭi =Tirabhukti= Mithilā ).”৩৫ স্বাতন্ত্র্যের স্বীকৃতি ছাড়া এই মন্তব্য বাহুল্যই শোনাতো। বিহারে সম্প্রতি কিছু কিছু স্কুলে মৈথেলি পড়ানো হয়। সেরকম একটি বর্ণমালার বইতেও দেখছি,অসমিয়া বাংলার থেকেও মৈথিলের স্বাতন্ত্র্য অনেক বেশি।আর যে দুই বর্ণ এখন বাংলা অসমিয়াকে স্বতন্ত্র চিহ্নিত করে,তার একটি ‘অন্তস্থ-ব’-কে মৈথিলে লেখা হচ্ছে বাংলা ‘র’-এর মতো নিচে বিন্দু দিয়ে,এবং মৈথিল ‘র’ বাংলা–অসমিয়া দুইয়ের থেকেই অনেকটি ভিন্ন। চিত্র-০৬এ৩৬ তারই নজির  রইল।সুনীতিকুমার লিখছেন তুর্কি আক্রমণে নালন্দা-বিক্রমশীলার দেশীয় বিদ্যাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেল।পরে যখন আবার শাসনে সুস্থিরতা এলো এবং পুরো এলাকা ‘হিন্দোস্তানে’র (Hindostan) প্রভাবাধীন হলো তখন মিথিলার পশ্চিমের ভোজপুর হয়ে উত্তর এবং পশ্চিম ভারতে প্রচলিত দেবনাগরী লিপি এই পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল। দেবনাগরীর এই  রূপবৈচিত্র্যকেই তিনি লিখছেন ‘কাইথি’ লিপি।মৈথিলি মূলত ব্যবহারে রইল ব্রাহ্মণ এবং অন্য কিচ্ছু উচ্চবর্ণের মধ্যেই।কখনোই ছাপার মুখ দেখেনি।হিন্দির জনপ্রিয়তার ফলে,সেই সঙ্গে সংস্কৃতের জন্যেও দেবনাগরী লিপি গৃহীত হয়ে যাওয়াতেই সেই লিপিতেই মৈথেলি লেখা এবং ছাপা হচ্ছে।এই তথ্য সুনীতিকুমারের বিশ শতকের প্রথম শিকিভাগে। শেষ শিকি ভাগে ১৯৭৬এ প্রকাশিত বই ‘A Survey of Maithili Literature’-তে এই তথ্যটি সমর্থন করছেন রাধাকৃষ্ণ চৌধুরী।তাঁর মতে মৈথিল ব্রাহ্মণ এবং করণ কায়স্থদের কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান বিধির বাইরে এই লিপির ব্যবহার নেইই। কেউ কেউ লিপির পুনপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেও সফল হন নি।কিন্তু একুশ শতকে সেই কথা আর বলা যাচ্ছে না।কিন্তু সে প্রসঙ্গ অন্যমোটা দাগে মৈথিল লিপির সম্পর্কে এই তথ্যগুলো সত্য।কিন্তু এখনকার দেবনাগরীই ‘কাইথি’ নয়। দেবনাগরী স্বাধীনতার আগে মৈথিল ছাপা সাহিত্যে প্রচলিত হয় নি বলেই রাধাকৃষ্ণ চৌধুরীর অভিমত।তাঁর পুরো কথাটি এই,“Three alphabets,Maithili,Kaithi and Devanagari,are in use in modern times for writing Maithili.The use of Mithilakshara is now limited to the Maithil Brahmanas and Karana Kayasthas who use this script on all ceremonial and religious occasions.After independence,the Kaithi script has been replaced by Devanagari character.... A movement for the revival of the old script is,no doubt,there but there is hardly any chance of replacing Devanagari script by Mithilakshara,which,is getting obsolete day by day.৩৭ তিন লিপির বোঝার সুবিধের জন্যে আমরা এখন প্রচলিত বর্ণমালার তিন নমুনা চিত্র ৭৩৮, ৩৯এবং ৯-এ৪০ উপস্থিত করছি।
 

 

তার মানে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় যে ছাপা দেবনাগরীর কথা লিখেছেন,সে আসলে দেবনাগরীর ‘কাইথি’ বৈচিত্র্যএই তিন লিপি নিয়ে মৈথেলির সমস্যা এখনো পুরো মিটেছে বলে মনে হয় না।প্রধান স্রোতটি দেবনাগরীর হলেও কাইথি এবং মিথিলাক্ষর নিয়ে টানাপোড়েন থেকে মৈথেলি এখনো পুরো বেরোতে পারে নি বললেই হয়।অবশ্য, তাদের মান ভাষাটি ‘হিন্দি’ কি না সেই নিয়েও আরেক বড় বিতর্ক রয়েছে। সেই সবে আপাতত আমাদের না ঢুকলেও চলছে।ওড়িয়া লিপি বাংলা-অসমিয়া-মৈথিল লিপি পরিবার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে পঞ্চদশ শতক থেকেএর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন সুনীতিকুমার এরকম,“The peculiar form of the Oṛiyā Letters, and their deviation from the Bengali-Maitheli norm,is due primarily to the writing materials used in Orissa,viz., palm-leaf and an iron stylus,whereas the reed pen and ink and paper have kept up the angular shapes in Bengal and Mithilā.It is probable that the Oṛiyā script has unconsciously followed the Model of the neighbouring Telegu alphabet,in which the absence of angular shapes is a noticeable feature: the culture of Andhra or the Telegu-land has influenced that of Orissa in Many ways.”৪১ এখানে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকাতে করা মন্তব্য থেকে বিপরীত মেরুতে সরে আসছেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। রাখালদাস যেখানে লিখেছিলেন,ওড়িয়া লিপি বাংলার থেকে বিকশিত হচ্ছে;সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় লিখছেন,বাংলার তথা প্রত্ন-বাংলার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।আমাদের আধুনিক চেনা ওড়িয়া অক্ষর দেখলে সহজেই সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কেই সঠিক বলে মনে হয়।ওড়িশা সরকার একটি কালানুক্রমিক বিবর্তন ছক তৈরি করেছেন,ওড়িয়া লিপিরআমরা তার আংশিক ছবিটি তুলে ধরছি চিত্র ১০-এ।৪২ দেখা যাবে এই সিদ্ধান্তে আপত্তি করবার বিশেষ কিছু নেই।এই ছবিতে একেবারে শেষের তিন সারির দিকে নজর ফেরালেই দেখা যাবে চতুর্দশ শতকেই এই বেরিয়ে যাবার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে,পঞ্চদশ শতকেও প্রত্ন-বাংলা-ওড়িয়ার  কিছু লক্ষণ দেখা যাবে।এর পরে আর বাংলা-মৈথেলি-অসমিয়ার সঙ্গে কিছুতেই মেলানো যাচ্ছে না।সপ্তম শতক অব্দি আসতে আসতে বিভিন্ন ফলক এবং অন্যান্য নথিতে বর্গীয় এবং অন্তস্থ-ব-তে বিভ্রান্তি দেখা যাচ্ছে।মাগধী অপভ্রংশে অষ্টম শতকেই,বা তার আগেও সম্ভবত শব্দের শুরুতে যেখানে অন্তস্থ-ব হবার কথা ছিল,বর্গীয় ব হচ্ছে।মাঝে অন্তস্থ ব শ্রুতিধ্বনি হয়ে থাকছে।পরবর্তী সময়ে মৈথেলি এবং অসমিয়াতে অন্তস্থ ব বোঝাতে স্বতন্ত্র চিহ্ন জুড়ে দেয়া হচ্ছে। সুনীতিকুমার  লিখছেন,“In later times, distinction between « b»  and « v,w » was sought to be indicated in Bihāri and Assamese by means of diacritical marks on the letters for « b » Kaithi = «b» , = « w »;Assamese = « b », and  =  « w »;but Maithili,র = « w » ,̌ = « b» ).”৪৩ বিহারি লিখে সম্ভবত ভোজপুরিকেই বুঝিয়েছেন।কারণ কাইথি ভোজপুরি লিখতেও ব্যবহৃত হততিনি যে কাইথি বর্গীয় এবং অন্থস্থ ব-এর নজির দিয়েছেন,সে দুটি এখনকার এর মতো ছিল না,যা আমরা টাইপ করেছিছিল অনেকটাই চিত্র ১১-তে দেখানো বর্ণের মতো,এবং মৈথেলি ব-এ র-এর উপরের অর্ধচন্দ্রটি বামে আরো সরানো ছিল,একেবারেই মাত্রার উপরে।উচ্চারণ ত্রুটির জন্যে সংস্কৃতের প্রায়ই দেশীয় উচ্চারণ হত,স্বাভাবিক ভাবেই বানান ভুল হতএই ভাবেই বাংলাতে দীর্ঘ ঋ তথা ৠ বিদেয় নেয়,তিন শ-এর ভেদ দূর হতে শুরু করে,খ-এর বানান বহু জায়গাতে হয় কস̖ ( use of  « kṣ»  for « kh »)৪৪ দ্বাদশ শতকের মদনপাল দেবের একটি ফলকে অন্তত লিখিত বানানে দেখা যাচ্ছে ‘লিখিত’ (« likhita ») লেখা হচ্ছে ‘লিকসিত’ (« likṣita »)তিনি লিখছেন,“and we are thankful for these mistakes.”৪৫ যদিও সেটি খ > কস̖-এর বেলা কেন,এখানে অন্তত স্পষ্ট নয়।পরে তিনি ব্যাখ্যা করছেন কী ভাবে মধ্য বাংলাতে এইভাবেই ‘ক্ষ’ এবং ‘জ্ঞ’ আসছে এবং স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনের মর্যাদা পাচ্ছে।৪৬এখানে বাহুল্য ভেবে সেসব জটিলতার আমরা বিবরণ দিচ্ছি নাকিন্তু এই তথ্যগুলো মনে রাখতে হবে যখন নিধনপুর লিপির উপরে নির্ভর করে ‘কামরূপী’ প্রাকৃত এবং লিপির পেছনের যুক্তিগুলো আমরা অধ্যয়ন করবতিনি আরো লিখছেন,“The occurrence of the anunasika (candra-bindu = ),as distinguished from the anusvara (o =  modern Bengali ),is an indication of a nasal pronunciation in the eastern languages at least from the end of the 11th century.৪৭ আমরা দেখবো,ডানে উপরে বৃত্তাকার অনুস্বার আহোম রাজাদের মুদ্রাতেও দেখা যাচ্ছে,আর চন্দ্রবিন্দু অনুস্বারের তফাত আধুনিক বাংলা অসমিয়াতে স্পষ্ট এবং একই রকম হলেও আধুনিক মৈথিলিতে নয়। সেখানে প্রায় দেবনাগরীর মতোই উপরে বিন্দু দিয়ে অনুনাসিক উচ্চারণ বোঝানো হচ্ছে।



 

কিন্তু এখানে একটি দ্বন্দ্ব আছে।তৎসম শব্দগুলোকে কীভাবে বাঙালি পণ্ডিতেরা ভুল উচ্চারণ করেন সুনীতিকুমার থেকেই আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে কিছু নজির দিয়ে এসেছি। সেসব ছিল।কিন্তু সম্ভবত তাঁরা ভাবতেন তারা সঠিক সংস্কৃত উচ্চারণই করে যাচ্ছেন,এবং লিখে যাচ্ছেন। সেভাবেই সঠিক লিখবার তথা শুদ্ধতার একটি প্রবণতা ব্যাপক ছিল,যা কিনা তদ্ভব শব্দের বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল।তিনি লিখছেন,“In Bengali,the spelling has been influenced by Sanskrit to a very great extent during the 12th century. In Middle Bengali, too, this influence was present, and it prevented a tradition and a system for the tadbhava words from growing up.Scribes were careless,and they were careless even with regard to the Sanskrit words.There was no uniformity,the same words being written differently in the same page and even in the same line.Under the tutelage of the Paṇḍits well acquainted with Sanskrit,whose influence was great at the beginning of the 19th century,when the modern literary style was established for prose (and when printing was introduced),a rigid adherence to the correct orthography for Sanskrit words naturally came in,and brought in a needed uniformity for tatsama words, in the place of the chaos which reigned before.But the scholastic tendency went beyond its legitimate area,and sought to model the spelling of vernacular tadbhavas on their Sanskrit prototypes and the theories of orthography: e.g. জে,জাহা,জিনি,জত,জাওয়া « jē, jāhā, jinni,jåtå,√ jāoā » etc. came to be written with «y» ,instead of « j» ,because of the Sanskrit «yad» and «√yā»;…”৪৮ সেরকম আরো কিছু নজির দিয়ে তিনি আরো লিখছেন, “ ...but in the matter of the writing the tadbhavas, especially the verbal and other forms which figure in the colloquial,Bengali orthography is still lamentably backward and ununiform.”৪৯

দেখা যাচ্ছে বানান,বর্ণমালা এবং লিপি পদ্ধতির বিকাশে প্রযুক্তির বিকাশ সব সময়েই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রধান ভূমিকা পালন করেছেজাতিপ্রীতি সেই সঙ্গে একটি গৌণভূমিকাতে অবতীর্ণ হচ্ছে। সেই জাতি ভাষার অর্থে গুরুত্ব পাচ্ছে সাম্প্রতিক কালেই। সেকালে একে বর্ণ এবং ধর্মপ্রীতির বিষয় হিসেবেই দেখা হতো।তদ্ভবকেও তৎসম ধাঁচে ঢেলে সাজাবার আগ্রহকে আর কী ভাবেই দেখা যাবে? যাইহোক প্রাক-ঔপনিবেশিক কাল জুড়েই একটা বিশৃঙ্খলা উচ্চারণে এবং বানানে ছিল। সেগুলোকে পাকাপাকি এক শৃঙ্খলাকে বাঁধবার আয়োজন শুধু ছাপা যুগেই আরম্ভ হতে পারত আর তাই হচ্ছে। কিন্তু সঙ্গে আরো নতুন কিছু  বিশৃঙ্খলা তৈরি করা হচ্ছে। সেই সব পশ্চাদপদতা এবং বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধেই লড়াইটা শুরু হয়েছিল জম বীমসের হাত ধরে।বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পতাকা তলাতে রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী,হরপ্রসাদ শাস্ত্রী,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের নেতৃত্বে ব্যাপক আকারে শুরু হয় বিশ শতকের গোড়াতে।যার অন্যতম প্রতিভূ সুনীতিকুমার এই উচ্চারণগুলো করছিলেন।লড়াইটি নিরন্তর এখনো চলছে,বিশেষ করে কম্প্যুটার এবং আন্তর্জাল প্রযুক্তি আসাতে নতুন ভাবনার দরকারও পড়ছে। সেই সব মনে না রাখলে অসমিয়া লিপি এবং বর্ণমালার সম্পর্কেও  বাঙালি তো বটেই,অসমিয়া বিদ্বজ্জনের সিদ্ধান্তও ভুল হতে বাধ্য।বস্তুত উনিশ শতকে বাংলার এই সব ভুলের প্রভাব অসমিয়া বর্ণমালা এবং বানান রীতিতেও পড়েছিল।সাম্প্রতিক কালে ‘অসমীয়া জাতীয় অভিধান’ গোষ্ঠী যখন অসমিয়া বর্ণমালা এবং বানান রীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন,তাঁরা তখন সংস্কৃত রীতিই নয়,অসমিয়াকে অসমিয়া ভাষাবিদদের হাতেই বাংলা করে ফেলবার প্রবণতার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছেন।সঠিক অসমিয়া বানান এবং উচ্চারণের সন্ধানে তারাও প্রাচীন পুঁথিগুলোর দিকে তাকাচ্ছেন।আমরা সেসব যথাস্থানে দেখাবসুনীতিকুমার যে কথা বহু আগেই লিখে রেখেছিলেন, “The old spelling of the MSS. are of very great help in tracing the history of the sounds, as they frankly phonetic, when the scribes were not troubled by the ghost of Sanskrit.” ৫০ সংস্কৃতের ভূতে উৎপাত করে নি!

সংস্কৃতে পঞ্চাশ না পঁয়ষট্টিটি বর্ণ আছে সেই নিয়ে যে দ্বন্দ্ব ছিল আমরা চতুর্থ অধ্যায়ে কিছু লিখে এসেছিলাম। এখানে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখছেন,“According to Middle Indian notions,which form the basis of the mystical treatment of the akṣaras in the Tantrik works,the number of primary letters or radical signs  ( « mātr̩ikâkṣara » ) in Sanskrit, and following that,in the vernaculars,is 50, ---16 vowels and 34 consonants.”৫১ প্রাচীন ভারতীয় আর্যে দীর্ঘ ৡ (সুনীতিকুমার এটি দেবনাগরী লিপিতে দেখিয়েছিলেন,আই পি এ-তে « l̩̄ ») ছিলনা,তন্ত্র সাহিত্যে একে স্বরবর্ণে জুড়ল। তেমনি জুড়ল অনুস্বার –বিসর্গকে।বিসর্গের টানেই সম্ভবত ক্ষ-কেও ঢোকানো হলো ব্যঞ্জনের তালিকাতে।প্রথম শতকে বৌদ্ধ সংস্কৃতে লেখা (mixed Sanskrit) ‘ললিত বিস্তর’-এ এই ‘ক্ষ’-এর দেখা মেলে।তিনি এরকম বেশ কিছু বর্ণের ইতিবৃত্ত বর্ণনা করছেন।কিন্তু আমাদের কাছে যেটি গুরুত্বপূর্ণ তা এই যে তন্ত্রের এই চৌত্রিশটি ব্যঞ্জন প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলাতে এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে ‘চৌতিশা’ বলে এক কাব্যরীতি দেখা দিয়েছিল,যা ধর্ম নির্বিশেষে কবিদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। সেই রীতিতে প্রতিটি চরণের শুরু হতো একটি ব্যঞ্জন দিয়ে।এবং ক থেকে ক্ষ চৌত্রিশটি ব্যঞ্জনের ক্রম মানা হতকখনো বা এক একটি স্তবকের প্রতিটি চরণের শুরু হত একই ব্যঞ্জন দিয়ে।সংস্কৃত ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’-এও চৌতিশা ছিল।মুকুন্দরামের কবিকঙ্কণ চণ্ডী,ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে চৌতিশা ছিল।বারোমাসি গানের মতো কখনো বা একক কাব্য হিসেবেও চৌতিশা লেখা হতো। শেখ ফয়জুল্লাহের ‘জয়নবের চৌতিশা’,বাহরাম খানের ‘লায়লীর চৌতিশা,সৈয়দ সুলতানের ‘জ্ঞানচৌতিশা’ সেরকম কিছু বিখ্যাত ‘চৌতিশা’স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে,অক্ষরক্রম বাদ দিয়ে ধ্বনিক্রমে পদ্য লিখতেন কী করে? লিখতেন, কারণ ধ্বনিতে অক্ষরে তফাত করতেন না বা করতে পারতেন নাসম্ভবত যুক্তাক্ষর এবং যুগ্মাক্ষরেও না। সে জন্যেই ‘ক্ষ’-কেও ব্যঞ্জনতালিকাতে ধরেছিলেন।সুনীতিকুমার লিখছেন,সেই যুক্তিতে ‘য’ «y» উপাদানের জন্যে যদি ‘ক্ষ’ স্বতন্ত্র ব্যঞ্জন বর্ণের মর্যাদা পায় তবে একই যুক্তিতে ‘জ্ঞ’-কেও পাওয়া উচিত ছিল।৫২ সেটি পায় নি।

   ব্রাহ্মী থেকে কালানুক্রমে আসা যে বাংলা-অসমিয়া-মৈথেলি লিপি ধারাটির সঙ্গে আমরা পরিচিত সেটিই বাংলার প্রধান লিপি,এই নিয়ে কোনো সংশয় নেইসংস্কৃত ভাষারও পূর্বভারতে এটিই প্রধান লিপি।সংস্কৃতের জন্যে দেবনাগরীর জনপ্রিয়তা তো একেবারেই সাম্প্রতিক।তারপরেও এখনো সংস্কৃতের জন্যে বাংলা অসমিয়া লিপির ব্যবহার সামান্যও কমে নি।বাঙালি বা অসমিয়া সংস্কৃত গ্রন্থাদি পড়তে গলে দেবনাগরীতে লেখা গ্রন্থের আশ্রয় নেন নাব্রাহ্মীর পশ্চিমা বৈচিত্র্য থেকে শুধু এই দেবনাগরীই আসে নিআমরা খোলা চোখেই গুজরাটি,গুরুমুখি লিপির সঙ্গে দেবনাগরী লিপির তফাত দেখতে পারি। সে সবই নাগরীর বিভিন্ন বৈচিত্র্য।সারা ভারতের বাকি সব লিপিকে সরিয়ে সংস্কৃতের জন্যে দেবনাগরী লিপিকে জনপ্রিয় করার পেছনে ব্রিটিশ শাসনের কেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থার প্রেরণা রয়েছে বলে  সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় অন্যত্র উল্লেখ করেছেন।৫৩ ১৭৯২তে ভারতে সংস্কৃতে ছাপা সবচাইতে প্রাচীন গ্রন্থের লিপি ছিল বাংলা। সেটি ছিল কালিদাসের ঋতুসংহার। দেবনাগরী প্রথম ব্যবহৃত হয়ে ১৮০৫এ প্রকাশিত কোলব্রুকের ইংরেজিতে লেখা সংস্কৃত ব্যাকরণে।সুনীতিকুমার লিখছেন বারানসীতে সারা ভারত থেকে সংস্কৃত পণ্ডিতদের সমাগম হতোতারা নিজের প্রদেশে নিজের লিপিই ব্যবহার করতেন,কিন্তু এখানে এলে কিছু কিছু দেবনাগরীও শিখে নিতেন।ফলে সংস্কৃতের পশ্চিমা শিক্ষক এবং ছাত্রদের মনো হলো নাগরীতে লিখলে সবাই বুঝতে পারবেন।ধীরে ধীরে এই লিপিতেই দেশে বিদেশে সংস্কৃত বই পত্র ছাপানো শুরু হয়।‘নাগরী’ কথাটির আগে ‘দেব’ জুড়ে দেয়াটাও এই সময়েই ঘটে।বিদ্যাসাগরও সংস্কৃতের বিকল্প লিপি হিসেবে দেবনাগরীর জন্যে তদ্বির করেন।১৮৫৭তে কলিকাতা,বোম্বাই,মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সংস্কৃতের লিপি হিসেবে নাগরীকে গ্রহণ করে।

যেখানে সংস্কৃতের মতো এক গুরুত্বপূর্ণ শাসকশ্রেণির ভাষার জন্যে এত এত লিপি ব্যবহৃত হত,কোনো স্থির লিপি ছিলই না,যেখানে বাংলারই সহোদরা মৈথেলির তিন লিপি নিয়ে এত বিড়ম্বনা,সেখানে বাংলার জন্যে চিরদিন একটিই লিপি থাকবে ভাবাটাই অস্বাভাবিক।চট্টগ্রামে  অষ্টাদশ শতক বা তার আগেই বেশ কিছু সুফি লেখক ফার্সি-আরবি লিপিতে বাংলা লেখেন। সেরকম বেশ কিছু বইয়ের সন্ধান প্রথম দেন মুন্সি আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ তাঁর ‘প্রাচীন বাঙ্গালা পুথির বিবরণ’ বইতে।সুনীতিকুমার তার উল্লেখ করেছিলেন। কোনো কবির নাম করেন নি,‘যোগ কলন্দর’ এবং ‘নসিয়ত নামা’র থেকে দুটি নজির দিয়েছেন।সুনীতিকুমার থেকেই  শেষেরটির একটি নজির ছবিতে এখানে চিত্র ১২-তে তুলে দিচ্ছি। কিন্তু সুনীতিকুমার যেভাবে লিখেছেন লিপিটি চট্টগ্রামেই প্রচলিত ছিল তা সম্ভবত সত্য নয়।‘যোগ কলন্দর’ একটি বিখ্যাত বই।সম্প্রতি বই হিসেবে প্রকাশিত কেইথ এডোয়ার্ড কান্টোর (Keith Edward Cantú) একটি বই ‘Theurgy and the Snake: The Yoga Kalandar and Bengali Sufism’ ঘেঁটে জানা গেল এই বইটি সারা বাংলাতেই প্রচলিত প্রায় সব লিপিতেই লিপ্ত্যন্তর হয়েছিল।৫৪ বাংলার সাধারণ লৌকিক বাউল ফকিরি ধর্মের এটি প্রায় বেদ-কোরানের মর্যাদাতেই পড়া হতো।মুন্সি আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদের ‘প্রাচীন বাঙ্গালা পুথির বিবরণ’ বইতেই সম্ভবত বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের বহু কবির রচনাও রয়েছেযতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্যের একটি লেখাতে আমরা সিলেটের হবিগঞ্জের কবি সৈয়দ সুলতানের একটি কাব্যের অংশও পেলাম,যেখানে  সিলেটি বাকরীতিটির ছাপও স্পষ্ট, বিশেষ করে ‘সক্কলে’ শব্দটিতে।চিত্র ১৩-তে তারই  নমুনা রইল।৫৫সেই সঙ্গে তৎসম,তদ্ভব,আরবি–ফারসি শব শব্দের সমাবেশ তো আছেই।প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলার সাহিত্যের সাধারণ সাধু বাংলা ভাষাই এর ভাষারীতি।ধ্বনি সজ্জা বিশ্লেষণ করে সুনীতিকুমার দেখিয়েছেন,সেগুলো উচ্চারণুনুগ।তিনি লিখেছেন,“The language of these Perso-Bengali MSS.is good Bengali,with special Mohammedan religious and other terms.The spelling of the Bengali and Sanskrit words is phonetic, so far as the Arabic script would allow it,but the Persian and Arabic words,naturally enough,follow their original spellings.”৫৬ এই ‘phonetic’ বানান রীতির জন্যেই  কিছু কিছু বর্ণের ব্যবহারে চট্টগ্রামী-সিলেটি উচ্চারণরীতিটিও ধরা পড়ে। সেরকম আরেকটি বই ‘মুক্তল হুসেন’-এর কথা লিখেছেন রিচার্ড ঈটন।তাঁর তথ্য থেকে বোঝা যায় আরবি লিপিতে বই খুব বেশি ছিল না।আরবি লিপিতে লেখার কারণ,এবং লিপিটি না টেকার কারণও তিনি ব্যাখ্যা করছেন।এই সব তথ্য আমাদের জানা যে ব্রাহ্মণ্যগ্রন্থগুলোর ‘ভাষা’তে অনুবাদ বা সাধারণভাবে ধর্মবিষয়ক বইগুলো বাংলাতে লেখা যেমন প্রায় ‘পাপ’ কর্মই ছিল,প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামেরও সেরকমই বিধি ছিল।আরবি গ্রন্থগুলোকে মাতৃভাষাতে অনুবাদ বা রূপান্তরের কথা অনেকেই ভাবতে পারতেন না অথচ,জনতার মধ্যে ভাষার ব্যবধান ঘুচাতে হবে।ফলে ইরানে পার্শি বা উত্তর ভারতে উর্দুতে ধর্মগ্রন্থাদির রূপান্তর ঘটানো হলেও বাংলাতে হলো আরবি লিপিতে।‘মুক্তল হুসেন’-এর মতো বই তাতেই দেখা দিয়েছিল,তাঁর পরের কথাগুলো ঈটনের জবানীতেই পড়া যাক,“In the seventeenth century,in fact, attempts were made to do the same for Bengali.The Dhaka Musum has a manuscript work composed in 1645 entitled Maqtul Husain---a tract treating the death of Hosain at Karbala---written in Bengali but using the Arabic,and not the Bengali script.Although subsequent writers made similar such literary attempts,it is significant that the efforts never took hold,with the result that Bengali Muslims remain today the world’s largest body of Muslims who, despite Islamization, have retained both their language and their script৫৭



 

তেমনি ষোড়শ শতকে পর্তুগীজরা বাংলাদেশে এলে মিশনারিরা কিছু ধর্মপ্রচার,কিছু বাংলা শেখার তাগিদ থেকে রোমান হরফে বাংলাতে লেখা পড়া শুরু করেন।পর্তুগীজ ছেলেমেয়েদের স্কুলেও পড়ানো শুরু করেছিলেন।বাংলা ভাষাতে প্রথম ভাষাচিন্তার বইটিই রোমান হরফে এক পর্তুগীজ পাদ্রি মনোএল দ্য আসসুম্পসাউর  ভোকাবুলারিও এম ইদিওমা বেনগল্লা, ই পোর্তুগিজঃ দিভিদিদো এম দুয়াস পার্তেস লেখা আমরা প্রথম অধ্যায়ে লিখে এসেছি।এ ছাড়াও এদেশে আসা ফরাসী,ইংরেজদের দুই একটি প্রয়াসের কথা সুনীতিকুমার উল্লেখ করলেও তিনি বেশি গ্রন্থের নাম নেন নি।তিনি ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডের ব্যাকরণে বাংলা শব্দের রোমান লিপ্যন্তরের কিছু পরিকল্পনার কথা  লিখেছেন। সেরকম আরো দুই একটি ফরাসী ইংরেজ প্রয়াসের কথা লিখেছেন।কিন্তু এই ধারাটি তত ক্ষীণ ছিল না।সুনীতি চট্টোপাধ্যায় শুধু এইটুকু স্বীকার করেছেন,“At subsequent periods,in the 19th century and in the 20th,there have been sporadic attempts at making the Roman alphabet come into current use in Bengal (as well as in other parts of India), but so far they have not been successful.”৫৮ আসলে হ্যালহেডের ব্যাকরণ প্রয়াসের পরেও বহুদিন রোমানেই বই পত্র ছাপা হত, যেহেতু বাংলাতে ছাপার জন্যে প্রযুক্তি সেভাবে দাঁড়াচ্ছিল না। যে শ্রীরামপুর মিশন প্রথম যুগের বাংলা বই পত্র ছাপানোর জন্যে খ্যাত,তারা নিজেরাও বহু বইপত্র দীর্ঘদিন রোমানেই ভারতীয় বিভিন্ন ভাষাতে বই ছেপেছেন,বাংলাতেও তাই করেছেন। সেসব দেখে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা এবং তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের জনক স্যর উইলিয়াম জোনস̖ স্বয়ং ১৭৮৮তে একবার রোমানকেই ভারতীয় ভাষাগুলোর লিপি হিসেবে চালু করবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।চার্লস ট্রিবিল্যান,পার্শ্ব,টামাস প্রমুখ অনেক সাহেব তাঁর সমর্থনে তখন দাঁড়িয়েওছিলেনতখন সেটি গুরুত্ব না পেলেও পুরো ব্রিটিশ শাসনে থেকে থেকেই এই রোমান লিপির প্রস্তাব উঠেছিল।বহুবার বেশ চাপাচাপিও হয়েছিল।ছাপা যুগে বাংলা লিপির সংস্কার এবং প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের সঙ্গে রোমান লিপি প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সংগ্রামেরও একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে। যেটি বাঙালিরাই ভালো রকম জানেন না,অসমিয়াদের জানা তো আরো কঠিন।কিন্তু সম্ভবত এই ইতিহাসের সঙ্গে অসমিয়া লিপির প্রতিষ্ঠাও অনেকটাই জড়িয়ে আছে।‘র,ৱ’ নিয়ে হয়ত তাঁরা মিশনারিদের সঙ্গে লড়াই করেছেন।কিন্তু আরো বহু কিছু সম্ভবত বিনা লড়াইতে গ্রহণও করে ফেলেছেন।কারণ,প্রথমত রোমান প্রচলনের সরকারী প্রয়াস সফল হলে সেটি অসমিয়ার বেলাও হয়ে যেত;দ্বিতীয়ত,ছাপা জমানার অসমিয়া লিপির ইতিহাসেও শ্রীরামপুর মিশন এবং ব্রিটিশ রাজধানী কলকাতা নগরের সাংস্কৃতিক আবহ অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে।আমরা সেই বিবরণে পরে আবার ফিরব আলাদা করেকিন্তু এই কথাটি মনে হয় উল্লেখ করাই উচিত যে বাংলা সহ সমস্ত ভারতীয় ভাষার জন্যে রোমান লিপি প্রচলনের প্রস্তাব সুনীতিকুমার নিজেই পরেও বেশ কবার রেখেছিলেনপ্রথম প্রস্তাবটি ওডিবিএল-এই দিয়ে রেখেছিলেন। তিনি যা লিখেছিলেন,তার প্রথম কিছু কথা এরকম,“While admitting and appreciating all the argument in favour of the Indian system of writing,I remain a believer in the Roman alphabet for all Indian languages,because of the simplicity of the symbols of which is consists, because of its true alphabetical nature is not subordinating the vowels,because of its manifold advantages in teaching, and in printing and because of its use in the civilised world.”৫৯শুধু তাই নয়,দেবনাগরীর প্রতিও তাঁর একটি আকর্ষণ ছিল। শেষে লিখছেন,“…I would strongly advocate the unity of our country in the matter of script through that truly national script of all India---the Dēva-nāgarī, as the next best thing.” ৬০

    চট্টগ্রামের চাকমাদের স্বতন্ত্র লিপি রয়েছে।সম্ভবত এটি প্রাচীন আহোম লিপির সঙ্গেও দূরগত সম্পর্কে সম্পর্কিত।সুনীতিকুমার ‘Chakma Dialect of Bengali’৬১বলে বিবেচনা করেছেন।তাই বাংলা লিপি প্রসঙ্গে লিখেছেন,তারা ‘a modification of the Khemer-Mon (Burmese) system of writing,based ultimately on an ancient South Indian alphabet’৬২চাকমা লেখার জন্যে ব্যবহার করেন।যদিও বা ভাষাটি পূর্ব ভারতীয় আর্য ভাষা,-- আমরা একে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরির মতোই স্বতন্ত্র ভাষা মনে করি বলেই,তাদের ব্যবহৃত লিপিকে বাংলার লিপি বৈচিত্র্যে বিবেচনা করতে প্রস্তুত নই।যদিও অবিভক্ত বাংলাদেশে প্রচলিত লিপিগুলোর মধ্যে এটিও একটি, সুতরাং তথ্য হিসেবে এটি গুরুত্বপূর্ণ।  

এগুলো ছাড়াও তিনি উল্লেখ করেছেন মেদিনীপুরে বাংলা লিখবার জন্যে ওড়িয়া লিপি,বাংলার পশ্চিম প্রান্তে কোথাও কোথাও দেবনাগরী এবং কাইথি লিপি,উত্তর বাংলাতে মৈথেলি লিপিও ব্যবহৃত হয়েছে।সব মিলিয়ে এই অব্দি সাতটি লিপির কথা পাচ্ছি।কিন্তু অষ্টম যে লিপিটি আমাদের জন্যে জরুরি সেটি হলো ‘সিলেটি নাগরী’এই নামে পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদের রচনাটির উল্লেখ করেছেন।গ্রিয়ার্সনের উল্লেখ না থাকলেও এই নিয়ে গ্রিয়ার্সনের কথার সঙ্গে তাঁর পরিচয় থাকাটিই স্বাভাবিক।খুবই প্রাথমিক ধরনের তথ্যের তিনি উল্লেখ করেছেনউত্তর ভারত থেকে যারা সিলেটে ইসলাম প্রচার করতে গিয়েছিলেন তাঁরা দেবনাগরীর এক বৈচিত্র্য ‘a kind of modified Dēva-nāgari,called ‘Silēt Nāgari’৬৩প্রচলন করেন।মূলত স্থানীয় মুসলমানদের জনপ্রিয় হয়,ছাপা প্রযুক্তিতে আসে এবং ওডিবিএল যখন লেখা হচ্ছে তখনও এর ছাপা প্রচলনটি রয়েছে।এর বেশি কিছু তথ্য নেই।

কিন্তু যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্যের থেকে জানা যাচ্ছে,বাংলা লিখবার আরেকটি লিপি ছিল ‘নেওয়ারী’৬৪এমনকি চর্যাপদের পুথিতেও নেওয়ারি হরফ রয়েছে কি না এই নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিবাদ আছে।অনেকেই এই দাবি নাকচ করলেও,নীলরতন সেনের দাবি অন্তত পৃষ্ঠা সংখ্যা তথা পত্রাঙ্কগুলো বাংলার সঙ্গে পাল্টাপাল্টি করে নেওরারিতে লেখা। অর্থাৎ একটি বাংলাতে হলে পরেরটি নেওয়ারি,এরকম।৬৫‘চর্যা এবং নবচর্যার পুথি’ নামে সম্প্রতি প্রকাশিত ‘অনুষ্টুপ’ কাগজের এক নিবন্ধের লেখক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদের দাবি তাঁর সংগ্রহে পুরোটাই নেওয়ারি এবং নাগরীতে লেখা চর্যার দুটি পাণ্ডুলিপি রয়েছে।৬৬নিবন্ধটি পড়লে বোঝা যায় চর্যাগীতিগুলো ‘যোগ কলন্দর’-এর মতো এমন বহু লিপিতেই লিপ্যন্তর হয়েছিল।যাই হোক যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য নেওরারি লিপিতে লেখা চারখানা নাটকের উল্লেখ করেছেন যেগুলো  ‘নেপালে বাঙলা নাটক’ নামে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ছেপেছিল।৬৭ তাহলে এই নিয়ে লিপি সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে নয়।পুরো আলোচনার থেকে একটি তথ্য সত্য যে বাংলা ভাষার নটি লিপি পদ্ধতির মধ্যে তিনটি পদ্ধতি অন্তত  ছাপা প্রযুক্তির মুখ দেখেছিল।তার মধ্যে বাংলাই প্রধান,কিন্তু  ‘রোমান’ এবং  ‘সিলেটি নাগরী’তে ছাপা গ্রন্থের সংখ্যা খুব কম নয়যতীন্দ্র মোহন কিন্তু উনিশ শতকের প্রথমার্ধে আরবিতে লেখা একটি অসমিয়া গদ্য গ্রন্থেরও উল্লেখ করেছেন।যদিও বই কিংবা লেখকের নাম উল্লেখ করেননি।৬৮     

 

নলিনী সান্যাল এবং অসমিয়া-বাংলা লিপি:

নলিনী সান্যালের ‘ভারত বর্ষে লিপিবিদ্যার বিকাশ’-এর উল্লেখ যেমন সুনীতিকুমারে নেই। তেমনি তাঁর নিবন্ধেও সুনীতিকুমার নেই।কারণ দু’টিই একই কালে লেখা।এর পরে আর তাঁর উল্লেখ কোথাও মিলছে না।বাংলা লিপির আলোচনা মাত্রতেই যে তিন বাঙালির কথা শুরুতেই আসে তাঁরা হলেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়,সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়,এবং সুকুমার সেন।অসমিয়া লিপির আলোচনাতেও তাঁদের প্রসঙ্গই ঘুরে ফিরে মেলে।প্রথম জন তো প্রত্নলিপিবিদ ছিলেনই। শেষ দুজনকেও সবাই প্রামাণিক বলে এর জন্যেও ধরে নেন,যে এদের ভাষাবিজ্ঞানী বলেও একটি খ্যাতি রয়েছে।তার উপরে সুকুমার সেন বাংলা সাহিত্যেরও এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক।কিন্তু নলিনী সান্যালের মতো বিস্তৃত আলোচনা সুনীতিকুমারও করেন নি,সুকুমার সেনও করেন নি।রাখালদাসকে বাদ দিলে করেছেন এই নলিনী সান্যালইরাখালদাসের মতো প্রামাণ্য কিনা সেই তর্ক হতেই পারে।কিন্তু তার পরিসর রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় থেকেও বিস্তৃত ছিল।তিনি শুরুই করেছেন মানব সভ্যতাতে লিপির উদ্ভব দিয়ে। সেরকম সুকুমার সেনও করেছেন।কিন্তু তিনি অতি সংক্ষিপ্ত।ব্রাহ্মী লিপির সারা ভারতের বৈচিত্র্যগুলোর সম্পর্কেও বেশ ভালো বিস্তৃত পরিচয় রয়েছে।আর রয়েছে অশোকের সময় থেকে প্রতিটি বর্ণ ধরে একাল অব্দি বিবর্তনের একটি ধারাবাহিক বিবর্তনের ছবি। যে আদলে উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী অসমিয়া লিপির বিবর্তন আলোচনা করেছেন অনেকটা সেরকমই।ভবিষ্যৎ লিপি অধ্যয়নেও নিবন্ধটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র হিসেবে বিবেচিত হতে পারে বলে আমাদের মনে হয়,তাই এই সংক্ষিপ্ত পরিচিতিটুকু তুলে ধরা।  একেবারে শেষ তৃতীয় পরিচ্ছেদে তিনি রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় যাকে বলেছেন ‘the father or the science of Indian Palaeography’ সেই জর্জ ব্যুলরের একটি সিদ্ধান্তকে প্রত্যাহ্বান জানিয়েছেন।ব্যুলর তাঁর সিদ্ধান্তগুলো হয়ত ব্যাখ্যা করেছিলেন ১৮৯৫তে প্রকাশিত ‘On the origin of the Brahmi Alphabet নামের ছোট পুস্তিকাতে।নলিনী সান্যাল যেভাবে ‘ব্রাহ্মী লিপির উৎপত্তি’ বলে লিখেছেন,তাতে মনে হতে পারে বইটি বুঝিবা বাংলাতে ছিল।যাই হোক,“বূলার ভারতবর্ষের ‘ব্রাহ্মী লিপির উৎপত্তি’ নামক পুস্তিকায় ওয়েবরের মতের সমর্থন করিয়া প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিয়াছেন যে ব্রাহ্মী লিপির ২২টি বর্ণ উত্তরী সিমেটিক লিপিসমূহ হইতে এবং অবশিষ্ট বর্ণগুলি প্রথমোক্ত বর্ণগুলির আদর্শে নির্ম্মিত হইয়াছে।”৬৯ ব্যুলর ছাড়াও আরো পশ্চিমাদের অনেকেই এহেন মত পোষণ করতেন।নলিনী সান্যালের মতে যারাই ব্রাহ্মী এবং খরোষ্ঠীর অভারতীয় উৎস প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছেন,“অসাধ্য সাধন করিতে গিয়া তাঁহারা পণ্ডশ্রম করিয়াছেন।”৭০এই নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারী আমরা নই।তবু পড়ে যা মনে হয়েছে,তিনি প্রচুর যুক্তি তুলে ধরেছেন,সেগুলোও নথি সমর্থিত নয়---কিছুটা ভাষাতাত্ত্বিক এবং অন্যান্য ইতিহাসের যুক্তি,কিছু তাঁর দেশীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য অহমিকা।তিনি নিজেও লিখছেন,“ভারতবর্ষের পুরাতত্ত্ব এখনো পর্য্যন্ত ঘোর তিমিরাবৃত।প্রাচীন ইতিহাসের সম্যক জ্ঞানের জন্য যে সকল উপকরণের প্রয়োজন তাহার অল্পমাত্রই এ পর্যন্ত হস্তগত হইয়াছে।খৃষ্ট পূর্ব পঞ্চম শতকের পূর্ব্বের কোনো শিলালিপি এ পর্য্যন্ত পাওয়া যায় নাই। যে পর্য্যন্ত যাহা পাওয়া গিয়াছে তাহা হইতেই বেশ বুঝিতে পারা যায় যে খৃষ্টের ৫০০ শত বৎসর পূর্বেও লিখন কলা ভারত বর্ষে সুবিদিত ছিল। লিপিবিদ্যার প্রচলন যে তাহার বহুপূর্ব্বে হইয়াছিল তাহা ভারতীয় সাহিত্যাদি হইতে অন্তত গৌণভাবে প্রমাণিত করা যাইতে পারে।ব্রাহ্মীলিপি অন্য কোন দেশ হইতে আমদানী করা মাল নহে ইহা স্বাধীন ভাবে ভারতবর্ষেই গঠিত হইয়াছিল।ইহা ব্রাহ্মণদিগের অসাধারণ বুদ্ধির পরিচায়ক।”৭১‘খৃষ্টের ৫০০ শত বৎসর পূর্বেও লিখন কলা ভারত বর্ষে সুবিদিত ছিল’ এই নিয়ে মনে হয় না কেউ তর্ক করবেন।তাঁর বিকাশের একটি স্তরে বিশেষ করে ব্যাকরণ রচনাতে ব্রাহ্মণদের ভূমিকার তর্কও মানা চলেকিন্তু তার উৎপত্তিটিই ‘ব্রাহ্মণদিগের অসাধারণ বুদ্ধির পরিচায়ক’ –অতিশয়োক্তি বলে সহজেই ধরে নেয়া যায়।বিশেষ করে লিপির ইতিহাসের শুরুতে চিত্রলিপি,ভাবলিপি ইত্যাদির কথা যদি মনে রাখি। যা নিয়ে নিজেও শুরুতে লিখেছেন।প্রথম যুক্তি হিসেবে তিনি যা তুলে ধরেছেন সে এক পরিণত ভাষার বর্ণমালার যুক্তি। যার একটি সমুন্নত ব্যাকরণও ততদিনে ছিল এই নিয়েও আজকাল কোনো পশ্চিমাই প্রশ্ন তোলেন না।তিনি লিখছেন,“ভারতীয় ভাষাতে যতগুলি বিভিন্ন ধ্বনি আছে তাহার প্রত্যেকটির জন্যে ভারতীয় বর্ণমালায় এক একটি বর্ণ আছে।২৫টি স্পর্শ বর্ণ,১টী জিহ্বামূলীয়,একটি উপাধ্মানীয়,৪টী অন্তস্থ,৪টী উষ্ম,অনুস্বার,বিসর্গ ও চন্দ্রবিন্দু।১৪টী স্বরবর্ণ ও তাহারা যখন ব্যঞ্জনে যুক্ত হয় তখন তাহাদের (অ,৯,ৡ বাদে) ১১টীর চিহ্ন মোট ৬৪টী রৈখিক সঙ্কেত আছে।বর্ণগুলি যে যে ধ্বনির প্রতিনিধি,পঠনের সময় ঠিক সেই ধ্বনিই উচ্চারিত হয়। কোনো ভ্রম বা ব্যতিক্রম হওয়ার সম্ভাবনা নাইপ্রত্যেক ধ্বনি জ্ঞাপক এক একটী বর্ণ থাকাতে ভারতীয় ভাষায় উচ্চারণের সহিত লিখনের বিভিন্নতা হয় না।উচ্চারণে ও লিখনে এরূপ অবিকল সামঞ্জস্য অন্য কোনো ভাষায় দৃষ্ট হয় না।”৭২ বোঝা যাচ্ছে, যে কথাগুলো হয়তো পাণিনি পরবর্তী ব্যাকরণ শাসিত ধ্রুপদী সংস্কৃত সম্পর্কেই বলা চলে,তিনি তাবৎ প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষাগুলোর বৈচিত্র্য সম্পর্কে লিখছেন।উচ্চারণে এবং হরফে যে কালান্তরে এবং স্থানান্তরে কী সব সমস্যা হচ্ছে সেসব আমরা সুনীতিকুমার  চট্টোপাধ্যায়ের লিপি প্রসঙ্গ আলোচনার সময়ে দেখেছিতাছাড়া সংস্কৃত বর্ণমালার হরফ পঞ্চাশ না চৌষট্টি সেই নিয়েও চিরদিন একটি বিবাদ ছিল---সেও আমরা দেখেছি। তিনি সামান্য অবাক হয়ে লিখছেন,“এই রূপ উচ্চ অঙ্গের বর্ণমালা আর্য্যদিগের সভ্যতার পরাকাষ্ঠা জ্ঞাপন করে।তথাপি ইহারাই সভ্যতায় হীনতর ফিনিসিয়দিগের নিকট নিজ বর্ণমালার জন্য ঋণী!কিমাশ্বর্য্যমতঃ পরম̖!ফিনিসীয় বর্ণমালায় ২২টীর অধিক বর্ণ ছিল না,তন্মধ্যে ৫টী মাত্র স্বর।এই  বর্ণমালা হইতে আর্য্য ঋষিরা ৬৪টি বর্ণাত্মক ব্রাহ্মী বর্ণমালা নির্ম্মাণ করিলেন।”৭৩যুক্তি হিসেবে এটিও খুব প্রবল নয়।এখনকার অসমিয়া--বাঙালি সভ্যতাও প্রাচীন পশ্চিম ভারতীয় আর্যদের থেকে উন্নত।তবু আমাদের লিপির জন্যে তাদের কাছে ঋণ স্বীকারে আপত্তি নেই।সুতরাং ফিনিসীয়রা সভ্যতায় হীনতর বলেই তাদের কাছে ভারতীয়রা লিপির জন্যে ঋণী হতে পারবেন না,এমন কোনো যুক্তি নেই।সহস্রাব্দ কাল আগের ফিনিসীয়দের সঙ্গে সহস্রাব্দকাল পরের আর্যদের সমানে রেখে তুলনা করলে চলবে কেন?দ্বিতীয়ত এক বর্ণ থেকে আর বর্ণ যে আসতে পারে,সেসব ব্রাহ্মী লিপির তার দেয়া তালিকা দেখলেও অনুভব হয়।কিন্তু সেসবে আমাদের দরকার নেই। কেন না আধুনিক বাংলা অসমিয়া বর্ণমালার হ্রস্ব দীর্ঘ ভেদে স্বরবর্ণগুলো দেখলেই তা বোঝা যায়।সিলেটি নাগরী হরফগুলোও একটি থেকে আরটি এসেছে বলে তত্ত্ব আছে।  সিলেটি নাগরীর প্রচলকরা বাংলা-সিলেটি ধ্বনির হ্রস্ব-দীর্ঘ ভেদ নেই জেনে পাঁচটি স্বর দিয়েই কাজ চালিয়ে দিয়েছিলেন।৫টি স্বরবর্ণ আর ২১টি ব্যঞ্জনবর্ণ নিয়ে ইংরেজদের অসুবিধে হয় নি,আমাদের থেকে উন্নততর সভ্যতাকে তথা সাহিত্যের ঐতিহ্যকে প্রতিষ্ঠা দিতে।তার উপরে সংস্কৃত বর্ণমালার যতই প্রশংসা করুন,বর্ণক্রমটি মোটেও আজকের মতো ছিল না। সেটি মনে হয় বিদ্যাসাগরের বাংলা ‘বর্ণপরিচয়ে’রই দান।সংস্কৃতেও।বাকি ভারতীয় আর্যভাষাগুলোতেও। আমরা কি তবে হীনতর ব্রাহ্মী উৎসের কথা অস্বীকার করব?তার মানে এই নয় যে আমরা ব্রাহ্মী লিপির ভারতীয় উৎসের তত্ত্বকে খারিজ করে দিলাম।আমরা শুধু প্রবলতর যুক্তি এবং তথ্য চাই—সে দিকে ইঙ্গিত দিলাম।আমাদের এই তর্কের গভীরে প্রবেশের আপাতত দরকারও নেই,অধিকার বা যোগ্যতাও নেই।ভারতীয় উৎসের পক্ষে অনেক পশ্চিমা তাত্ত্বিকও ছিলেন।প্রত্নতাত্ত্বিক কানিংহাম,অধ্যাপক লস̖ন প্রমুখ কারো কারো নাম নলিনী সান্যাল নিজেও নিয়েছেন,সুকুমার সেনও এই লিপির বহির্ভারতীয় উৎস সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন।

ব্রাহ্মী লিপির কালক্রমিক বিবর্তন এবং বৈচিত্র্য নিয়ে তিনি অনেকটাই বিস্তৃত।কিন্তু উত্তর ভারতীয় বৈচিত্র্য যেখানে আলোচনা করেছেন,তার অনেকখানিরই পাঠ নেই।হুমায়ুন আজাদ পাননি নিশ্চয়রকমফেরের পঞ্চম ক্রমে ‘বাঙ্গলা’ লিপির কথাটুকুন রয়েছে।দক্ষিণ ভারতীয় বৈচিত্র্যের অন্তত ছটি রকমফেরের পাঠ রয়েছে। সেসবে আপাতত আমাদের দরকার নেই।কিন্তু তিনি প্রত্ন-বাংলা লিপিকে ‘নাগরী’ লিখছেন।যা রাখালদাস বা সুনীতিকুমার খারিজ করেছেন।তিনি লিখছেন,“বাঙ্গলা লিপি- ইহা দশম শতকে প্রাচীন নাগরীর পূর্ব্বদেশীয় শাখা হইতে উৎপন্ন হইয়াছে বলিয়া অনেকে বিশ্বাস করেন।বঙ্গদেশের রাজা নারায়ণ পালের সময় পর্য্যন্ত অর্থাৎ দশম শতক পর্য্যন্ত বঙ্গদেশ বঙ্গদেশ, মিথিলা,নেপাল,আসাম ও উড়িষ্যায় এই নাগরী লিপি প্রচলিত ছিল।কিন্তু ঐ সময় হইতেই অক্ষরগুলিতে বাঙ্গলা অক্ষরের টান আরম্ভ হয়,এবং ক্রমশ: একটী স্বতন্ত্র বাঙ্গালা লিপি গঠিত হয়।প্রাচীন বাঙ্গলা লিপি হইতে নেপালের একাদশ শতকের একাদশ শতকের পরবর্তী লিপি,বর্ত্তমান বাঙ্গলা লিপি,মৈথিল লিপি,এবং উড়িয়া লিপি বাহির হইয়াছে। বর্ত্তমান বাঙ্গলালিপির প্রাচীন রূপ হইতে আসামী লিপি উৎপন্ন হইয়াছে।”৭৪

তবে নলিনী সান্যালের নিবন্ধে ‘ব্রাহ্মী’ নামের উৎসের সন্ধান মিলছে।জৈন ‘পঞাবাণসূত্ত’ এবং ‘সমবায়াসূত্ত’-এ ১৮ রকম লিপির মধ্যে ‘বম্ভী’ নামটি মিলছে।বুদ্ধ জীবন চরিত ‘ললিত বিস্তর’-এ ৬৪টি টি লিপির মধ্যে প্রথম স্পষ্টতই ‘ব্রাহ্মী’ শব্দটি পাওয়া যাচ্ছে।৭৫ কিন্তু তারপরেও এই প্রশ্নটি অমীমাংসিত যে ‘ব্রাহ্মী’ই কেন? কারো মতে ব্রহ্মার থেকে লিপিটি পাওয়া বলে ‘ব্রাহ্মী’এমন এক পৌরাণিক যুক্তি রয়েছে বটে।ভাষা তথা শব্দ মাত্রেই ব্রহ্মার মুখনিঃসৃত বলে একটি ব্রাহ্মণ্য বিশ্বাস রয়েছে,যার থেকে ‘শব্দব্রহ্ম’ কথাটি এসেছেআরেকটি মত ব্রাহ্মণদের লিপি বলে এই নাম।আমাদের মনে হয় না,এই দুই যুক্তিই একই সঙ্গে মেনে নিতে কোনো অসুবিধে আছে বলে।যদিও প্রথমটির কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি অসম্ভব।এবং দ্বিতীয়টিও এই অর্থেই সত্য হতে পারে যে ভারতে ব্যাকরণের পারিভাষিক নামগুলো দেবার যোগ্যতা ক্ষমতা যাই বলি ব্রাহ্মণেরাই প্রথম অর্জন করেছিলেন।তার মানে লিপিটিও তাদেরই উদ্ভাবনা—এমন তথ্য মেনে নেবার মধ্যেও সমাজবৈজ্ঞানিক যুক্তি সবল নয়।নিশ্চয় ভারতীয়েরা লিপির ব্যবহারের জন্যে শ্রেণি বা বর্ণ হিসেবে ‘ব্রাহ্মণ’দের উৎপত্তি অব্দি অপেক্ষা করেন নি।ভারতে তো বহু গুহাচিত্রও দেখা গেছে।ইতিহাসের যুক্তি বলে  ‘অব্রাহ্মণ্য’ জনজাতিদের স্তরেই লিপির ব্যবহার সম্ভব সুমেরীয়-মিশরীয় লিপির থেকে সেমীয় হয়ে পৃথিবীর অধিকাংশ লিপির উদ্ভবের কাহিনি সেভাবেই ব্যাখ্যা করেন লিপিবিদেরা।নলিনী সান্যাল অবশ্য উল্লেখ করেছেন, “কানিংহাম ইত্যাদির মতে ব্রাহ্মী ক কর্ত্তরিকার চিত্র হইতে, ধ ধনুর চিত্র হইতে, র রজ্জুর চিত্র হইতে, ব বারিবেষ্টিত ভূমণ্ডল হিতে, গ গগন হইতে, ত তালপত্র হইতে, চ চমসের চিত্র হইতে, ন নাসা হইতে, ব বীণা হইতে উৎপন্ন হইয়াছে।”৭৬

সুকুমার সেন এবং অসমিয়া-বাংলা লিপি:

সুকুমার সেনের ‘ভাষার ইতিবৃত্ত’ বইটি এর দেড় দশক পরে প্রকাশিত হয়।১৯৮৭র দ্বাদশ সংস্করণ অব্দি তিনি নিজেই বইটির সংযোজন সংশোধন করে গেছেন।অন্যত্রও কিছু ইংরেজি রচনাতেও তিনি বাংলা লিপি নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু অনুমান করতে পারি দ্বাদশ সংস্করণ অব্দি যেসব কথা থাকবে সেগুলোই তাঁর জীবন জোড়া অর্জন তথা সিদ্ধান্তআগেই লিখেছি আমরা তাঁর উপস্থাপনটি সংক্ষিপ্ততবু সার বুঝতে অসুবিধে নেইতিনি লিখছেন,“প্রাচীন ও আধুনিক সভ্যজগতের লিপিমালা এই চারটি সুপ্রাচীন লিপি পদ্ধতি হইতে উদ্ভূত:(১)সুমেরীয়-মিশরীয় চিত্রলিপি,(২)সম্ভাব্য ভারতীয় চিত্রলিপি,(৩) চীনীয় চিত্রলিপি এবং (৪) মেসোপটেমীয় বাণমুখ (cuneiform) চিত্রলিপি।”৭৭ এর মধ্যে শেষ লিপিটি খ্রিস্ট পূর্ব সহস্রাব্দেই বিলীন হয়ে যায়।সুমেরীয়-মিশরীয় চিত্রলিপির থেকে পরবর্তী কালে ইউরোপীয় বর্ণমালাগুলো ছাড়াও,আরামীয়,হিব্রু,আরবি ইত্যাদি সেমীয় বর্ণমালাগুলো এসেছেচীনীয় চিত্রলিপি থেকে আধুনিক চিনা, জাপানি লিপি এসেছেভারতের প্রাচীন লিপি দু’টি।তার মধ্যে খরোষ্ঠী ডান থেকে বামে লেখা হতো,এবং সেটি সেমীয় লিপি থেকে উৎপন্ন সুকুমার সেন মেনে নিচ্ছেন।৭৮কিন্তু,“ব্রাহ্মীর উৎপত্তি সম্বন্ধে মতভেদ আছে।ব্যুলার (Buehler) প্রভৃতি পণ্ডিতের মতে ইহা মূলত সেমীয়কিন্তু এই মতের বলবৎ প্রমাণ মিলে নাই।বর্তমান শতাব্দের তৃতীয় দশকের গোড়ায় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক আবিষ্কৃত সুপ্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নাবশেষের মধ্যে প্রাচীন লিপিচিত্র যুক্ত সীল পাওয়া গিয়াছে।যদি কখনো দ্বিভাষিক প্রত্নলিপি আবিষ্কৃত হয় তবেই তাহার সাহায্যে এই লিপিগুলির নিঃসংশয়িত পাঠোদ্ধার হইবে এবং তখনই প্রমাণিত হইবে ব্রাহ্মী লিপির বীজ ইহাতে আছে কিনা।”৭৯ কিন্তু খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের অশোকের কালের লিপিটিকেই যে ব্রাহ্মী বলা হচ্ছে,এই নিয়ে কোনো সংশয় নেই।তার থেকেই আধুনিক ভারতের প্রায় সমস্ত লিপি এবং পূর্ব এশিয়ারও চিনা লিপি বাদ দিলে বাকিগুলো এসেছে সে সুকুমার সেনেও বোঝা যাচ্ছে।এই লিপিই গুপ্ত রাজাদের আমলে ‘কুটিল’ নাম পাচ্ছে।তার থেকেই কালে বাংলা লিপি এসেছে--এইটুকুনই সুকুমার সেনের অভিমত।৮০  

লিপি নিয়ে অন্যত্র সুকুমার সেনের আরেকটি রচনা আমাদের পড়বার সুবিধে হয়েছে। সেখানে সিন্ধু সভ্যতার ‘দ্বিভাষিক প্রত্নলিপি’র কথা কেন লিখছেন,তার একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে,“সমস্ত বিলুপ্ত প্রাচীন লিপির পাঠোদ্ধার দ্বিভাষিক লেখের সাহায্যেই সম্ভব হয়েছে।এমনি করে রোজেটা স্টোনের সাহায্যে প্রাচীন মিশরীয় লিপির রহস্যভেদ হয়েছিল,এমনি করেই দ্বিভাষিক গ্রীক ও কুশান যুগের মুদ্রার সাহায্যে অশোকের অনুশাসন পড়া গিয়েছিল।”৮১এখানে ব্রাহ্মী থেকে বাংলা অব্দি যাত্রা পথের বিবরণ খানিকটা বিস্তৃত।গুপ্ত শাসনের শেষের দিকে উত্তরা ব্রাহ্মী লিপিতে দু’টি রূপভেদ দেখা দেয়–পশ্চিমা আর পূর্বী।এই অব্দি কথাগুলো রাখালদাস,সুনীতিকুমারও লিখেছেনসুকুমার সেন লিখছেন, উত্তরা ব্রাহ্মীর পশ্চিমা ছাঁদ থেকে উৎপন্ন হয় কাশ্মীরের প্রাচীন এবং নিজস্ব লিপি ‘শারদা’ এবং পশ্চিম পাঞ্জাবের নিজস্ব লিপি ‘লণ্ডা’৮২সেই উত্তরা ব্রাহ্মীর পূর্বী ছাঁদ যাকে অনেক সময় ‘কুটিল লিপি’ বলা হয় তার থেকে বাংলা,নাগরী,মৈথেলি ইত্যাদি এসেছেএই খানে তিনি সুনীতিকুমার,রাখালদাস থেকে সামান্য ভিন্ন।সুনীতিকুমার যেখানে কাশ্মীরি নিয়ে নীরব, তিনি ব্রাহ্মীর পশ্চিমা বৈচিত্র্যের থেকেই দেবনাগরী এসেছে লিখছেন,সেখানে সুকুমার সেন লিখছেন পশ্চিমা বৈচিত্র্য থেকে শারদা,লণ্ডা এসেছেপূর্বী বৈচিত্র্যটিই কুটিল এবং তার থেকে বাংলা-নাগরী ইত্যাদি লিপি আসছে।প্রত্ন-বাংলা কিংবা বাংলা লিপির নিদর্শন সম্পর্কে কিছু তথ্য এখানে সংক্ষেপে রয়েছে।তিনি লিখছেন,“যদি বাংলাদেশে পাওয়া লেখ অবলম্বনে বাংলা লিপির বিকাশ পর্যালোচনা করি তাহ’লে একটি ছাড়া প্রায় সব স্তরেরই নিদর্শন পাবপ্রথম স্তরে অর্থাৎ অশোক ব্রাহ্মীতে উৎকীর্ণ লেখ মিলেছে বগুড়ায় মহাস্থানগড়ে।দ্বিতীয় স্তরের অর্থাৎ অশোক-পরবর্তী ব্রাহ্মীতে লেখা কোনো প্রত্নলেখ আজও মেলেনি।তৃতীয় স্তরে অর্থাৎ আদি গুপ্তযুগে লেখা একটি মাত্র প্রত্নলেখ মিলেছে শুশুনিয়া পাহাড়ে  পুষ্করণাধিপতি চন্দ্রবর্মার ক্ষুদ্র লিপি।চতুর্থ স্তর অর্থাৎ শেষ-গুপ্তযুগে লেখা তাম্রপট্ট অনুশাসন অনেকগুলিই মিলেছে। তারপর দুই এক শতাব্দ বাদ দিলে অষ্টম শতাব্দ থেকে তাম্রপট্টানুশাসন প্রচুর মিলেছে ত্রয়োদশ শতকের গোঁড়ার দিক পর্যন্ত”৮৩ষোড়শ শতকের আগে তালপাতা বা কাগজে কালি দিয়ে লেখা প্রত্নলিপি বাংলাদেশে বিশেষ মেলে নি,নেপালে কিছু পাওয়া গেছে।সম্ভবত এরই মধ্যে তিনি চর্যার পুথিকেও ধরেছেন।কিন্তু “খাশ বাংলাদেশে ষোড়শ শতাব্দের আগে লেখা কোনো পুথিপত্রের সন্ধান পাওয়া যায় নি।অধিকাংশ পুরানো বাংলা পুথি অষ্টাদশ শতাব্দে লেখাসপ্তদশ শতাব্দে লেখা পুথির সংখ্যা বেশি নয়।”৮৪ অর্থাৎ তিনি সেই শতকেই সব চাইতে বেশি বাংলা পুথি পাওয়া যাচ্ছে লিখছেন,যে শতকে ছাপা যন্ত্র এসে গেছে।যা কিনা পরের শতকে পুথির উচ্ছেদ ঘটিয়ে দেবে।সপ্তদশ শতকে এসে বাংলা লিপিতে বাংলাদেশের ভেতরে আঞ্চলিক রূপভেদ দেখা দিচ্ছিল এই এক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তিনি দিচ্ছেনলিখছেন,“রূপভেদ মোটামোটি দুটো।একটা পশ্চিম বাংলায় আর একটা উত্তর ও পূর্ব বাংলায়উদাহরণ হিসাবে ‘র’ অক্ষরটা নিতে পারি।‘র’ পশ্চিম বাংলার পুথিতে ‘ব’-এ ফুটকি আর উত্তর ও পূর্ব বাংলার পুথিতে পেটকাটা ‘ব’—যেমন এখন অসমীয়ায়।স্মৃতি ও ন্যায় শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতের হাতের লেখাতেও কিছু বিশিষ্টতা ছিল।এঁরা ‘অ’ লিখতেন মৈথিল ছাঁদে---তা দেখতে ‘ত্থ’-এর মত। এ অক্ষর কিছুকাল বাংলাদেশে ছাপাতেও চলেছিল।”৮৫ এই ‘র’ উৎপত্তি সম্পর্কে অন্য সূত্রে মেলা একটি তথ্য এখানে উল্লেখ করে রাখা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। সেটি লিখেছেন অণিমা মুখোপাধ্যায়।৮৬ তাঁর বক্তব্য হচ্ছে এর সঙ্গে অনুস্বারের একটি সম্পর্ক রয়েছে।‘র’-কে ‘ব’ থেকে আলাদা করবার একটি প্রয়াস  শুরু হয় ডানে বিন্দু বসিয়ে এরকম ‘ব·কিন্তু অনুস্বারও লেখা হতো ডানে সামান্য উপরে একটু বড় বৃত্ত বসিয়েফলে বহু সময় এই ‘ব·’-র পরে বা শুধু ‘ব’-এর পরে অনুস্বার লিখতে গেলে (ব· বা বসি) একটা বিভ্রান্তি দেখা দিত।তিনি অবশ্য শুধু এই বিভ্রান্তির কথাটিই লিখেছেন, আমরা অনুমান করতে পারি,সেরকম সমস্যার থেকেই এই ডানের বিন্দু নিচে চলে যেতে পারে।এরকম একটি হরফের প্রভাবে আরটি পালটে যাবার কাহিনি বিশাল এবং চিত্তাকর্ষক। 

সুকুমার সেন এর পরে হ্যালহেডের ব্যাকরণ প্রসঙ্গে চার্লস উইলকিনসনের তৈরি ধাতুতে ঢালাই হরফের কথা পাড়েনআমরা এখন যে বাংলা লিপির সঙ্গে পরিচিত তা পশ্চিমবঙ্গের হাতের লেখা অনুসরণ করে তৈরি।কিন্তু সেই আদলটিও পরে দুই ধারাতে ভাগ হয়,“শ্রীরাম পুরের সাট আর কলকাতার সাট।শ্রীরামপুরের সাটে হাতের লেখার মতো অক্ষর গোলধরনের আর কলকাতার সাটে অক্ষরের ধরন সরল-রেখানুসারী।এখনকার অক্ষর এই রকমই।”৮৭ এই যে দুই সাটের কথা বাংলা-অসমিয়া লিপি প্রসঙ্গে কিন্তু তথ্যটি গুরুত্বপূর্ণ।অসমিয়া ছাপা হরফে যে বাংলার সঙ্গে ‘সাট’-এর কোনো তফাত দেখি না,তাতে অনুমান করতে অসুবিধে কই যে অসমিয়াও শ্রীরামপুর নয় শেষ অব্দি কলকাতা সাটই অনুসরণ করেছিল।‘ফুটকি’ শুধু ‘ব’ এর নিচেই যুক্ত হয়েই ‘র’ হয়নি,‘ড,ঢ,য’-এর নিচেও ফুটকি জুড়ে নতুন বর্ণ তৈরি হয়েছিল।এগুলোও অসমিয়াতে রয়েছে।সুকুমার সেন নিশ্চিত হয়ে লেখেন নি,কে তার প্রচলন করেছিলেন।শুধু লিখেছেন,“অনেকে বলেন এ অক্ষর প্রবর্তনের কৃতিত্ব বিদ্যাসাগর মহাশয়ের।”৮৮

 

 

 রামেশ্বর শ’ এবং অসমিয়া-বাংলা লিপি:

 লিপি সম্পর্কে রামেশ্বর শ’-এর আলোচনা প্রাথমিক পরিচিতি দেবার জন্যেই।তাঁর উপস্থাপনার একটি সুবিধে হলো যে তিনি একেবারে ব্রাহ্মীর উৎস থেকে ছাপা জমানার ইতিবৃত্তের একত্রে সারসংক্ষেপ উপস্থিত করেছেন।

  পৃথিবীর তাবৎ লিপির যে চারটি ভাগের কথা সুকুমার সেন লিখেছেন,রামেশ্বর শ’ তাকেই সমর্থন করছেন।কিন্তু লিখেছেন শ্রেণিবদ্ধ করা হয় নি সেরকম কিছু লিপিও রয়েছে ভারতের হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতার লিপি গুলো ছাড়াও রয়েছে ইউরোপের ক্রীট বা মীনোয়ান লিপি,প্রাচীন আমেরিকার আদিবাসী মায়া এবং আজটেক লিপি।তিনিও মনে করেন ব্রাহ্মী লিপি সেমীয় লিপি থেকে এসেছেকিন্তু ফিনিসীয় নয়,আরামীয় উপশাখা থেকে। সেমীয়দের প্রথম দুই ভাগ পূর্বী এবং পশ্চিমা। পশ্চিমা উপশাখার আবার দুই ভাগ উত্তরা এবং দক্ষিণী।উত্তরা আবার দুই ভাগে বিভক্ত হয় আরামীয় এবং ফিনিসীয়।  ফিনিসীয় থেকে নবম শতক নাগাদ প্রথমে গ্রীক এবং পরে রোমান লিপি দেখা দেয়।আর আরামীয় শাখা থেকে ভারতীয় খরোষ্ঠী এবং ব্রাহ্মী লিপির উদ্ভব।‘সম্ভাব্য ভারতীয় লিপি’র তত্ত্ব সেই নলিনী সান্যাল,সুকুমার সেনদের পরেও একই অবস্থানে রয়েছে। কেউ কেউ যেহেতু মনে করেন,ব্রাহ্মী ভারতীয় উৎসের লিপি তাই শ্রেণি বিভাগটি রামেশ্বর শ’ও বিশ শতকের শেষ ভাগে এসেও রেখে দিয়েছেন।তিনি কিছু নতুন তথ্য জুড়ছেন। এডওয়ার্ড টমাস বলে এক লিপিবিদের দাবি ব্রাহ্মী প্রাগার্য দ্রাবিড়দের দান।সুধাংশু কুমার রায়ের মতো কেউ কেউ সিন্ধু লিপির থেকে ব্রাহ্মী লিপির উদ্ভব মনে করেন।কিন্তু সিন্ধু লিপির পাঠই সম্ভব হয় নি বলে রামেশ্বর শ’ সেই তত্ত্ব নাকচ করেন। ড’সন এবং কানিংহামের মতো যারা সেকালেই ভারতীয় উৎসের কথা লিখেছিলেন,তাঁদের অভিমত ছিল চিত্রলিপি থেকেই ভারতীয় পুরোহিতেরা ক্রমে ব্রাহ্মী লিপি গড়ে তুলেন।

রামেশ্বর শ’তেই জানা যাচ্ছে ব্রাহ্মীর বিদেশি উৎস নিয়েও দুই মত রয়েছেদ্বিতীয় মতটি অবশ্য এই আরামীয় উৎসের অভিমত এবং এটি সাম্প্রতিক।অভিমতটি ডেভিড ডিরিঙ্গারেরতিনি ব্রিটিশ প্রত্মলিপিবিদ।১৯৬২তে প্রকাশিত তাঁর ‘The Alphabet বেরুবার পরেই এই অভিমত গুরুত্ব পেতে শুরু করে।বইটির গুরুত্ব হচ্ছে এই যে এতে সারা দুনিয়ার সব লিপি নিয়েই তিনি অনুসন্ধান করেছেন।এটি ছাড়াও লিপি নিয়ে তাঁর আরো বহু বই রয়েছে।তাঁর যুক্তিটি খুবই সহজআনুমানিক খ্রি.পূ. অষ্টম-সপ্তম শতকে যখন ব্রাহ্মী লিপি দেখা দিচ্ছে তখন ভূমধ্য সাগরের পুব উপকূলের লোকজনের সঙ্গে ভারতীয়দের কোনো সরাসরি যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি।পুব উপকূলের গ্রীকেরা ফিনিসীয় লিপি গ্রহণ করলেও তারা বহু পরে আলেকজান্ডারের সময়েই প্রথম ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেসুতরাং এই সূত্রে লিপিটি ভারতে আসে নিএখন,আজকের গ্রিস কিন্তু ভূমধ্য সাগরের পূবে নয়,উত্তরে রয়েছে।তুরস্কের পশ্চিমে গ্রিস এবং পুবে আর্মেনিয়া।সুতরাং প্রশ্ন তো জাগেই স্থলপথে মিশর ইত্যদির সঙ্গেও যোগাযোগ তো সহজ হতেই পারতো।যাই হোক, আজকের ভূগোল জ্ঞান দিয়ে সেকালের বাংলাদেশ,অসমই বোঝা দুষ্কর,আর এখানে কথা হচ্ছে ভূমধ্য সাগরের  এবং সেকালের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আর রাজনীতির।প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসে,এমন কি সিন্ধু সভ্যতার ইতিহাসেও ব্যাবিলনীয়,সুমেরীয় সভ্যতার সঙ্গে ভারতীয়দের আদান প্রদানের সংবাদ মেলে বটে।কিন্তু সেসব হচ্ছে সেমীয় ভাষাগুলো যেখানে বিকশিত হয়েছিল সেই মূল আরব ভূখণ্ডের পুবের সভ্যতা।আরবের পশ্চিমে আফ্রিকার উত্তরে হচ্ছে মিশর।এই ছবিটা মনে রাখলে রামেশ্বর শ’-এর মতো আমাদেরও মনে হয় ডিরিঙ্গার সঠিক বলছেন।ডিরিঙ্গারের একটি মন্তব্য রামেশ্বর শ’ তুলে দিয়েছেন,তিনিও বিশেষ ইতিহাসের পুনপরীক্ষাতে এগোন নি,“All historical and cultural evidence is best co-ordinated by the theory which considers the early Aramic alphabet to be the prototype of the Brahmi script. The acknowledged resemblance of the Brahmi Signs to the Phɶnican Letters also applies to the early Aramic letters, while in my opinion there can be no doubt that of all the Semites, the Aramæan traders were the first who came in direct communication with the Indo-Aryan merchants. We need not assume that the Bramhi is a simple derivation of the Aramic alphabet. It was probably mainly the idea of alphabetic writing which was accepted, although the shapes of many Brahmi signs show also Semitic Influence”৮৯

  খরোষ্ঠী ডান থেকে বামে লেখা হত,তাই বলে সেটি তো আধুনিক আরবি লিপিও নয়।তার পূর্বসূরিও নয়।এটি একটি প্রাচীন ভারতীয় লিপি।অশোকের শাহবাজগঢ়ী ও মনসেরার পর্বতের গায়ে খোদিত দুই অনুশাসনে এই লিপি মিলেছে৯০ফলে,রামেশ্বর শ’-এর এই মন্তব্যকে মানা কঠিন হয়,“খরোষ্ঠী ব্যবহৃত হত সেমিটিক ভাষা (আরবী প্রভৃতি) লেখার জন্য এবং তা থেকে আধুনিক উর্দূ ভাষার লিপির জন্ম।”৯১ সেরকমই গুপ্তলিপির থেকে বাংলা অব্দি ব্রাহ্মীর বিকাশের ইতিবৃত্ত যেটি রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীতিকুমারে বেশ একটা শৃঙ্খলাতে বাঁধা পড়েছিল,রামেশ্বর শ’য়ে এসে সেটি সামান্য জটিল হয়ে যায় বলেই মনে হয়।তিনি প্রথমে বলছেন,গুপ্তলিপি দুই ধারায় বিভক্ত হয়---পূর্বী ও পশ্চিমা।পূর্বী ধারার পশ্চিমা উপধারা থেকে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে ‘সিদ্ধিমাতৃকা’ বলে একটি লিপি জন্ম নিচ্ছে। সেই সিদ্ধিমাতৃকার এক জটিলতর রূপ ‘কুটিল লিপি’ গড়ে উঠে সপ্তম শতকে।৯২সেই কুটিল থেকে একদিকে বাংলা লিপি আর দিকে নাগরী লিপি দেখা দেয়।এখানে তিনি ব্যুলরের উল্লেখ করছেন।নাগরী লিপির দু’টি প্রকারভেদ গড়ে উঠেছিল---পূর্ব ভারতীয় এবং পশ্চিম ভারতীয়।এরই পূর্বভারতীয় রূপ থেকেই প্রত্ন-বাংলা লিপি গড়ে উঠে।৯৩কিন্তু ব্যুলরকে খণ্ডন করে যে এগিয়েছেন রাখালদাস এবং সুনীতি কুমার ---তাঁদের উল্লেখ নেই।তার বদলে তিনি এস এন চক্রবর্তী বলে এক লেখকের উল্লেখ করেছেন,যাঁর মতে “প্রস্তরে খোদিত উত্তর ভারতীয় লিপির দু’টি শাখা ছিল পূর্বী এবং পশ্চিমা।পশ্চিমা শাখাটি থেকে সিদ্ধমাতৃকা লিপির জন্ম হয়।আর পূর্বী শাখাটি থেকে স্বতন্ত্র ধারায় প্রত্ন-বাংলা লিপির জন্ম হয় খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতেই।”৯৪ এতে অনেকটাই রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে।এই অভিমত গ্রহণ করলে সিদ্ধমাতৃকার সঙ্গে বাংলার কোনো সম্পর্ক থাকছে না।কিন্তু রামেশ্বর শ’ তাঁর পূর্ব উপস্থাপনাতে স্থির,“আমাদের মনে হয় সিদ্ধামাতৃকা লিপির যে জটিলতর রূপ কুটিল লিপি তা থেকে দুই স্বতন্ত্র ধারায় প্রায় সমান্তরাল ভাবে নাগরী ও বাংলা লিপির বিকাশ হয়েছিল।”৯৫ ‘সিদ্ধমাতৃকা’-তেই এত জোর কেন পড়ছে বোঝা মুশকিলগুপ্তলিপির পূর্বী-পশ্চিমা,পূর্বীর ধারার আবার পশ্চিমা উপধারা থেকে এসেছে সিদ্ধমাতৃকাএই সব তথ্যের কোনো আধার নেই,সেই আধারের ভিত্তিতে ব্যুলর কিংবা এস এন চক্রবর্তীর খণ্ডন ছাড়াই ‘আমাদের মনে হয়’ লিখে যে উপস্থাপনা তা আমাদের সমস্যা বাড়ায় বইকি। যে পূর্বী ধারার পশ্চিমা উপধারা থেকে সিদ্ধমাতৃকা এলো তার পূর্বী উপধারার কী হলো?কোন এলাকাতে ছড়াল---কোনো জবাব নেই।অথচ,পশ্চিমা ধারা-উপধারার থেকে এই পূর্বী ধারা-উপধারাই সহজ বিচারে গ্রহণ যোগ্য বলে বোধ জাগে।এর পরে কিন্তু আবার তিনি লিখছেন,“ নাগরী লিপির থেকে বাংলা লিপির জন্ম হয় নি।অবশ্য নাগরী লিপির কিছু প্রভাব প্রত্ন-বাংলা লিপির  উপর পড়েছিল।”৯৬সেসব সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ও লিখেছেন।তিনি নাগরী লিপির থেকে বাংলার উৎপত্তিতত্ত্ব অস্বীকার করতে অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুক্তি তুলে দিয়েছেন। সে আরেক সমস্যার মুখোমুখি করে দেয়।অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন “ ...দক্ষিণ পশ্চিমের এই নাগরী লিপি উত্তর পশ্চিম ভারতে আধিপত্য স্থাপন করে অনেক পরে---অন্তত: ১০ ম শতাব্দীর পূর্বে নহে।”৯৭ অথচ আমরা ইতিমধ্যে দেখিয়েছি সুনীতিকুমার আরো কয়েক শতক আগেই গুপ্ত লিপির পূর্বী বৈচিত্র্যে শৌরসেনী ভাষার দৌলতে সাময়িক নাগরী প্রভাবের কথা লিখছেন।

 আমরা ক্রমান্বয়ে লিপিচিন্তকদের চিন্তার সমাবেশ ঘটাচ্ছি এটা দেখাতে যে আমাদের শতাব্দী জোড়া অধ্যয়ন এবং অনুসন্ধান কত বিচিত্র মুখে গতি করেছে।হয় আমাদের আন্তরিকতার অভাব থেকেছে,আর যেখানে তা নেই, সেখানেও সর্বত্র না হলেও বহু জায়গাতেই ‘জাত্যাভিমান’ সত্যদৃষ্টিকে ভ্রমিত করেছে।অন্যথা নাগরীর থেকে বাংলা এসেছে কি আসে নি,এই তর্কে ১০ ম শতকের আগে কে আর পরে কে সেই তর্ক আসা অনুচিত।প্রত্ন-বাংলারই মতো, প্রত্ন-নাগরী তো লিপি মাত্র নয়,লিপিগুচ্ছ হওয়াই স্বাভাবিক।আর যিনি ‘সমান্তরাল স্বতন্ত্র ধারায়’ বিকাশের কথা লিখছেন, সেই রামেশ্বর শ’এর উচিত ছিল এই তত্ত্ব খণ্ডন করা।অথবা পক্ষে যুক্তি-তথ্য তুলে ধরা।অন্যথা আমরা তাঁর কোন  অবস্থানকে নেব---সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

এর পরেই রামেশ্বর শ’ চর্যাপদ,শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুথির প্রসঙ্গ এনেছেন।লিপি পরিচয় বিশেষ তুলে ধরেন নি। তিনি মূলত পুথির কাল নিয়ে কথা বলেছেন।এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের আলোচনায়চর্যা এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নিয়ে মোটা দাগে তিনরকমের বিতর্ক আছে। প্রথমটি হচ্ছে এই দুই সাহিত্যের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার কার কতটা বেশি। কবিরা কতটা কামরূপের,কতটা রাঢ় বঙ্গের,কতটাবা মিথিলা,মগধ কিংবা ওড়িশারদ্বিতীয়,তৃতীয় তর্কও এরই সঙ্গে সম্পর্কিত এবং বর্তমান প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিকদ্বিতীয়টি হচ্ছে,ভাষার উপরে কার দাবি বেশি--এই তর্ক।চর্যাকে ওড়িয়া,মৈথিল,বাঙালি এবং অসমিয়া সবাই নিজের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পছন্দ করেন। এমন কি যারা একে বাংলার মনে করেন,তাঁরাও কেউ রাঢ় বাংলা,কেউ উত্তর বাংলার দিকে টেনে নিয়ে যান। যেমন সুকুমার সেন লিখেছিলেন,“চর্যাগীতির ভাষায় একাধিক উপভাষার চিহ্ন আছে,তবে মোটামুটি ভাবে পশ্চিমবঙ্গের উপভাষার উপর প্রতিষ্ঠিত বলিতে পারিতবে তখনো বাঙ্গালা দেশের উপভাষাগুলির মধ্যে ভিন্নতা সর্বথা সুস্পষ্টভাবে অভিব্যক্ত হয় নাই।”৯৮ বুঝিবা চিরদিনই বাংলা ভাষার শেকড়টা ঐ পশ্চিমেই পোতা ছিল।স্বাভাবিক ভাবেই তার বিপরীতে জগন্নাথ চক্রবর্তী চর্যাকে বরাক উপত্যকাতে টেনে এনেছেন ‘বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান ও ভাষাতত্ত্ব’৯৯ বইতেসুকুমার সেন অবশ্য মৈথিলি,ওড়িয়া,অসমিয়া আদি প্রতিবেশী ভাষাগুলোর সঙ্গে চর্যার ভাষার আত্মীয়তাও স্বীকার করেছেন,এ যে বিশুদ্ধ বাংলা নয়,অনেকটাই ‘অবহটঠের ছাপ ও ছাঁদ’-এ১০০লেখা--- সেসব ইঙ্গিতও অন্যত্র দিয়েছেন।কিন্তু জোরটা যেন খুব জোরালো নয়।বিশশতকের শেষের দিকে ক্রমে ক্রমে অনেকেই একে ‘প্রত্ন-বাংলা’ বলতে শুরু করেন।তার মধ্যে সুকুমার সেন,সুনীতিকুমারও ছিলেন। সেই সংবাদ অধ্যাপক মৃণাল নাথের।১০১অতিসম্প্রতি চর্যা নিয়ে স্বতন্ত্র গবেষণাগ্রন্থে  অধ্যাপক মৃণাল নাথ একে ‘পূর্বী বা মাগধী অবহট̖ঠ’ বলে দাবি করেছেন।তিনি চর্যার টীকাকার মুনিদত্তের একটি মন্তব্যের উল্লেখ করেছেন,“প্রা[কৃ]তভাসয়া(=প্রাকৃতভাষয়া) রচয়িতুমাহ...”১০২‘অবহট̖ঠ’ কথাটি বিদ্যাপতির ‘কীর্তিলতা’ বা ‘প্রাকৃতপৈঙ্গল’-এর আগে পরিচিত ছিল না বলেই মুনিদত্ত ‘প্রাকৃত’ কথাটিই ব্যবহার করেছেন এই হচ্ছে মৃণাল নাথের অভিমত।১০৩চর্যাকে নিয়ে ‘জাত্যাভিমানে’র বিষয়টিকে বেশ চড়া স্বরেই ধরেছেন,মৃণাল নাথ, “চর্যার ভাষার বিচার করতে গিয়ে অন্যান্য পণ্ডিতের মতো বাঙালি পণ্ডিতদের মধ্যেই একটি সংকীর্ণ (প্রাদেশিক? সাম্প্রদায়িক?) অনুভূতি অজ্ঞাত- বা সজ্ঞাত-ভাবেই কাজ করে গেছে।পণ্ডিতেরা সকলেই ‘নিজ নিজ ভাষার গৌরব’ বাড়াতে গিয়ে প্রত্যেক নিজ ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন বলে দাবি করছেন।মুক্তমন নিয়ে কেউ বিচার করার চেষ্টা করেন নি।বিজয় চন্দ্র মজুমদার(১৯২৫: ২৪৭) একটি পরিহাস করেই বলেছিলেন চর্যাপদের আবিষ্কর্তা যেহেতু একজন বাঙালিনেপাল থেকে বয়ে নিয়ে এসেছেন।সুতরাং চর্যাকে বাঙলা হতেই হবে।”১০৪

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নিয়েও  একই রকম বিবাদ রয়েছে অসমিয়া বাঙালির মধ্যে।তৃতীয় হচ্ছে এর লিপি।লিপি প্রসঙ্গে আমরা বহু সময় ভুলে যাই রচনাকাল এবং প্রাপ্তপুথির লিপিকালে তফাৎ থাকা সম্ভব। যে সময়ে গ্রন্থটি লেখা হয়েছিল,ঠিক সেই সময়কার পুথি আমাদের হাতে না পৌঁছাতেও পারে।এবং পুথির সংখ্যা একটাই নাও হতে পারে। যেমন চর্যার কবিরা অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতক এই চারশবছরের চার শতক ধরেই,না কোনো দুই বা ততোধিক শতকগুচ্ছ ধরে পদগুলো লিখেছেন,-- সেসব নিয়ে তর্ক থাকলেও লিপির তর্কটি পিছিয়ে গেছে দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতকে। তেমনি শ্রীকৃষ্ণকীর্তন লেখা হয়েছিল জয়দেবের আগে না পরে সেরকম তর্কও যদিও বা ছিল,শ্রী চৈতন্যের আগে যে হয়েছিল এই নিয়ে কোনো তর্ক নেই আর।অর্থাৎ চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে।কিন্তু যেসব পুথি মিলেছে সেসব ষোড়শ শতকের।সুকুমার সেন তো শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কালি এবং কাগজ পরীক্ষা করে পুথির বয়স আঠারো শতক ঠাহর করেছেন।এমনকি উনিশ শতক হতে পারে বলেও লিখেছেন। আরো দাবি করেছেন,“শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুরানো ছাঁদের মতো অক্ষর অষ্টাদশ শতাব্দীর পুথিতে অনেক দেখিয়াছি।”১০৫  মূলত ‘ৰ’ দেখেই মনে হতে পারে লিপিটি অসমিয়া,কিন্তু বাংলাতে এই ‘ৰ’ অন্য বহু পুথিতেও মিলবে।আমরা সেরকম একটি সত্যপীরের কাহিনি ‘আজদ্যার কেচ্ছা’ পুথির একটি ছবি তুলে দিচ্ছি চিত্র ১৪-তে১০৬পুথির কাল আমাদের জানবার সুবিধে হয় নি,তবে এ রকম রামায়ণ-কাহিনিতে সত্যপীরের কাহিনি জুড়ে দেবার ঘটনা সতেরো আঠারো শতকের আগে ঘটা ইতিহাসের যুক্তিতেই অসম্ভব।আবার কোনো চিহ্ন নেই সেরকমও মিলবে।আগেই লিখেছি নিচে বিন্দু দেয়া ‘র’ মৈথেলি আর  অসমিয়াতে অন্তস্থ –ব বোঝাতে ব্যবহৃত হতবাংলাতে এভাবে ‘র’ বোঝানো একেবারেই সাম্প্রতিক।সপ্তদশ শতক থেকে পশ্চিম বাংলার কোনো কোনো পুথিতে দেখা দিচ্ছে,বলে সুকুমার সেন জানিয়েছেন। হুমায়ুন আজাদ পড়লে বোঝা যায় হ্যালহেডের ব্যাকরণেও আজকের ‘র’ ছিল না।১০৭কী ছিল,সেটি তিনি স্পষ্ট করেন নি। সম্ভবত সুকুমার সেন যাকে বলছেন শ্রীরামপুর সাট এবং কলকাতা সাট---এই দুইয়ের কোথাও বিদ্যাসাগরের আগেই এর প্রচলন হয়ে গিয়েছিল।ফলে সম্প্রতি প্রকাশিত যোরহাটের ‘অসম জাতীয় প্রকাশ’ তথা ‘অসমিয়া জাতীয় অভিধান’-এর প্রকাশক দ্বারা প্রকাশিত তথা অধ্যাপক দেবব্রত শর্মা সম্পাদিত কিন্তু ১৮১৪তে ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিল্টনের রচিত ‘Comparative Vocabularies of 10 Languages of North East India’ অভিধানের পাণ্ডুলিপিতে  বাংলা-অসমিয়া নির্বিশেষে শব্দের জন্যে ‘র’ রয়েছে।ছাপা প্রযুক্তিতে ‘র’-এর পরিচিতি ছাড়া তাঁর পক্ষে এই ‘র’-কে বেছে নেয়া কঠিন ছিল বলেই মনে হয়।অন্যদিকে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় জীবৎ কালে পাওয়া অধিকাংশ পুথিই পরীক্ষা করেছিলেন।অনেকেই এই নিয়ে তাঁর অভিমত নিতেন।তিনি লিখেছেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের একাধিক লোকের হাতের লিপি রয়েছে,অন্তত তিনটি লেখার ছাদতো দেখাই যায়।১০৮ আর ‘ৰ’ সর্বত্র মেলে না।‘ৰ’-এ ‘ব’-এ একটি বিভ্রান্তি থেকেই গেছিল।১০৯ ‘চর্যা’র পুথিতে ‘র’ লেখা পাওয়া বহু জায়গাতে পাওয়া গেছে ‘ব’ এর মাঝের সাদা ত্রিভুজ কালিমাখা করে দিয়ে,অথবা সামান্য শূন্যস্থান সাদা ছেড়ে দিয়ে।এমনটা ‘র/ৱ’ আর কোথাও মিলেছে বলে আমরা সন্ধান পাই নি।বাকি বিকল্প গুলোর মধ্যে বলতে পারি ‘র’এর জন্যে ‘ব’-এর ব্যবহারআমরা চিত্র-১৫-ক, খ, গ এবং ঘ-তে ব্রাহ্মী-গুপ্ত-কুটিল হয়ে চর্যা-শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের লিপির হরফগুলোর বিবর্তনের একটি ছবি দিচ্ছি। সেগুলোর পাশাপাশি রয়েছে আধুনিক বাংলা,মৈথিল,ওড়িয়া এবং নেওয়ারি হরফের একটি তুলনা।তালিকাটি তৈরি করেছেন কল্যাণ কিশোর চট্টোপাধ্যায়।তাঁর ‘বাংলা পুথির হস্তলিপি : উৎস ও বিবর্তন’ নিবন্ধের শেষে জুড়ে দিয়েছেন১১০শুধু ১৫ ঘ চিত্রে কিছু ছাপাভুল থেকে গেছে মনে হল,ব্রাহ্মী-গুপ্ত-কুটিল অংশে লিখেছেন স্বর এবং ব্যঞ্জন যোগে যুগ্মবর্ণগুলো কিন্তু বাকিগুলোতে বসিয়েছেন সংখ্যাশব্দ ইত্যাদি।তাই সেটিতে আমরা পূর্বাংশ ছেঁটে দিয়েছি।এগুলোতে দেখা যাবে,শুধুই ‘র’  কিংবা ‘ৱ’ নিয়ে বিবাদের কোনো মানেই হয়না।আরো বহু হরফ কালক্রমে পালটে গেছে। সেগুলোর দিকেও মনোনিবেশ করা সমান জরুরি।এই তালিকাতে অসমিয়া জুড়লে শুধু এই দুই হরফেই তা আধুনিক বাংলার থেকে আলাদা দেখাবে।কিন্তু চর্যার থেকে অন্তত ২৯ এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সঙ্গে কম করেও ২৪টি হরফে আধুনিক অসমিয়াকে স্বতন্ত্র দেখাবে।বাংলাকেও দুই একটি ব্যতিক্রম বাদে তাইই।সংখ্যার হরফেও কমেও পাঁচটি আধুনিক বাংলা অসমিয়ার থেকে ভিন্ন।হরফের এই ছবিটা আজ থেকে মাত্র পাঁচ শতক আগেকার। 

 






 

সতেরো শতকের শেষের দিকে ১৬৯২তে বাংলাতে প্রথম বই মুদ্রিত হবার সংবাদ ফাদার হস্টেনের একটি বইতে মেলে,এই তথ্য জানিয়েছেন রামেশ্বর শ’কিন্তু সেই বই,বইয়ের লেখক সম্পর্কে যেমন কোনো তথ্য নেই, সেরকমই ফাদার হস্টেন কে বা তাঁর বইয়ের নাম কী সেসবও নেই।এর পরে ১৭২৫এ জার্মানিতে ছাপা ‘Urent Szeb’ বইতে দুই একটি বাংলা সংখ্যা এবং শব্দ মেলে।বাংলা লিপির প্রথম পূর্ণাঙ্গ রূপ মেলে ন্যাথনিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডের ১৭৭৮এ ছাপা বই ‘A Grammar of the Bengal Language’ বইতে।যদিও প্রথম বাংলা বইয়ে রোমানে ছাপা হয়েছিল তার কয়েক দশক আগে সে আমরা তথ্য আমরা ইতিমধ্যে দিয়ে এসেছি। সেদিক থেকে এই বইটি বাংলা নয়,ইংরেজি।তাতে বাংলার নমুনা দেয়া আছে বাংলা হরফে।এই বইটির জন্যে দুই ব্যক্তির হাতের লেখার নমুনা কাজে লাগানো হয়েছিল।তাদের নাম হচ্ছে কালীকুমার রায় এবং খুসমৎ মুনশি সেই দুই নমুনা নিয়ে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির এক কর্মচারী চার্লস উইলকিনসন হ্যালহেডের ব্যাকরণের জন্যে একটি আদল গড়ে দেন। যে আদলটি দেখে পঞ্চানন কর্মকার এবং মনোহর কর্মকার বাংলা লিপির ছাদ ধাতুতে গড়ে দেনরামেশ্বর শ’ তাঁর আলোচনা সংক্ষিপ্ত করবার জন্যে লিখেছেন,“সেই ছাঁদে বাংলা লিপির যে মূল রূপটি দাঁড়িয়ে যায় মোটামুটি তা-ই দীর্ঘকাল পর্যন্ত বাংলা লিপির আদর্শ হয়েছিল।সাম্প্রতিক কালে বাংলা বানান-সংস্কার ও ছাপার জগতে লাইনো টাইপ, মনোটাইপ ইত্যাদি প্রবর্তন ও অফসেট মুদ্রণ-রীতি প্রভৃতি নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে বাংলা লিপির সরলীকরণ ও সুদৃশ্য রূপায়ণ হয়ে চলেছে।”১১১ তিনিও সব শেষে ব্রাহ্মী থেকে বাংলা লিপির বিবর্তনের একটি ছবি দিয়েছেন,আমরা সেটি চিত্র ১৬-তে তুলে দিয়ে দেখাচ্ছি।১১২

 

 

দেখা যাবে কল্যাণ কিশোর চট্টোপাধ্যায় যে গুলোকে চর্যা এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের লিপি বলে দেখিয়েছেন, রামেশ্বর শ’ সেগুলোকেই প্রাচীন এবং মধ্য বাংলা বলে দেখিয়েছেন। বেশ কিছু রকমফের রয়েছে। যেমন ‘চ’,‘ন’,বা ‘ল’-তে।কিন্তু চর্যার ‘র’ দুটিতেই কালিভরা,শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ‘র’- পেট কাটা ‘ৰ’বাকিগুলোতে রকমফের কি এই দুই লেখকের নিজেদের ত্রুটি?হতেও পারে।আবার লিপিকরেরাও যে একই ছাদ মনে রেখে লিখতেন না,মনে রাখা ভালো।

হ্যালহেড থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক যে সময়টির কথা সংক্ষেপে সেরে রামেশ্বর শ’ থামলেন এই সময়টিতেই আসলে বাংলা এবং অসমিয়া লিপি ভিন্ন খাতে বইতে শুরু করে।‘ৰ,ৱ’-এর রূপ কী হবে,‘ক্ষ’ ইত্যাদি যুগ্মাক্ষর বর্ণমালাতে থাকবে কিনা এই সময়ে সিদ্ধান্ত হয়।হ্যালহেডের ব্যাকরণ শুধু যে বাংলা হরফের ইতিহাসের মোড় ফেরাচ্ছে তাই নয়।মোড় ফেরাচ্ছে আরো বহু কিছুর।বাংলাদেশে লেখা গ্রন্থের বিষয় ভাবনার আমূল পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। সেটি অবশ্য দশক তিন আগে মনোয়েলের বই দুখানা থেকেই শুরু হয়েছিল। পেছনে ছিল এক নতুন যন্ত্রের প্রেরণা—সেই যন্ত্রের নাম মুদ্রণ যন্ত্র।পঞ্চানন এবং মনোহর  কর্মকারের মতো ধাতুজীবিকে এই প্রথম ভাষা সাহিত্য নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। তাঁর জীবিকার ধরণ পাল্টাচ্ছে।পঞ্চানন কর্মকারকে এর পরে দীর্ঘদিন এই মুদ্রণ শিল্পের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। শিকি শতক পরেও শ্রীরামপুর মিশনেও তাঁর ডাক পড়ছে।সবচাইতে বড় কথা ঘটনাগুলো ঘটছে পলাশীর যুদ্ধের পরে পরে এক নতুন শাসকশ্রেণির নতুন অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্বার্থে।একটি নতুন শ্রেণি এই সব করছে,এবং লেখক-পাঠক-শ্রোতার পুরোনো উৎপাদন সম্পর্ক পালটে দিচ্ছে।লিপির বিবর্তনের ইতিহাসের প্রতিটি ধাপে এমন কিছু রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনও হতে দেখা যাবে।কিন্তু তাৎক্ষণিক প্রেরণাটি হচ্ছে লিখবার  উপকরণটি আমরা দেখেছি,এর আগে উপকরণ কীভাবে ওড়িয়া লিপির আদল পালটে বাংলা-অসমিয়া-মৈথেলির ধারা থেকে একেবারেই আলাদা করে দিল।ওড়িয়ারা ইচ্ছে করে সেটি করেন নি। যেকোনো সামাজিক ইতিহাসের অধ্যয়নে এই বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করলে শেষমেশ জাতি-ধর্ম-বর্ণের প্রেরণাকেই বড় করে দেখবার প্রবণতাই প্রাধান্য পাবে,যদিও সেই সব কারক যে  কাজ করেনা,সে আমাদের বলবার কথা নয়।প্রযুক্তির উপরে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করবার জন্যেও জাত-বর্ণ-শ্রেণিগুলোর সংঘাত চলতেই থাকে।ছাপাপ্রযুক্তিকে দীর্ঘদিন বাংলার বর্ণহিন্দু সমাজের এক বড় অংশ জাত যাবার ভয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন,ভাবতেন সেই সব ‘বিধর্মী এবং ছোটলোকে’র কাজ।ঠিক একই সময়ে আমরা দেখব বাংলার পুরোনো শ্রেণি বিন্যাসও পাল্টাচ্ছে।হ্যালহেডের ব্যাকরণ ছাপার বছর কয় আগেই রাজস্ব আদায়ের স্বল্পমেয়াদী বন্দোবস্তের সূচনা হয়ে গেছিলযা দশক দুয়ের মধ্যেই ১৭৯৩ আসতে আসতে আক্ষরিক অর্থেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত হবে।স্বাভাবিক ভাবেই পুরোনো জমিদার শ্রেণির উচ্ছেদ হবে,যারা ছিলেন এর আগেকার ধর্মকেন্দ্রিক পুথি সাহিত্যের এক বড় পৃষ্ঠপোষক।নতুন জমিদার শ্রেণি এবং সেই সঙ্গে নাগরিক  মধ্যবিত্ত শ্রেণি উঠে আসবেন,যাদের হাতে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গোড়া পত্তন হবে।১৭৬০এ অন্নদামঙ্গলের রাজসভার কবি ভারত চন্দ্র মারা যাবেন।আর ঠিক এক শত বছর পরে ১৮৬১তে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ যিনি লিখবেন,তিনি বছরে একাধিক বই প্রকাশ করবেন,কিন্তু দুয়ারে দুয়ারে একটা চাকরির জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরবেন।আমরা বলছি মাইকেল মধুসূদনের কথাসুকুমার সেন উপকরণের সামাজিক বা অর্থনৈতিক ইতিহাসের পেছনে যান নি,তাই চিনারা কেন এখনো উপরে নিচে লেখেন সেসব কারণ ব্যাখ্যাও করেন নি।  কিন্তু ‘উপকরণ-সত্য’টি ঠিক ধরতে পেরেছিলেন তাঁকে তা ধরতেই হত তাঁর পুরো কথাটি বেশ চিত্তাকর্ষক।ওড়িয়া লিপি কেন বাংলা-অসমিয়া-মৈথিল ধারা থেকে সরে গেল তার একটা ব্যাখ্যা আমরা সুনীতিকুমারে পেয়েছিলাম।সুকুমার সেন সেটি আরো বিস্তৃত ব্যাখ্যা করছেন,আমরা পুরোটাই তুলে দিচ্ছি,“লিপির ইতিবৃত্ত অনুসরণ করলে দেখা যায় লিপির আধার ও উপকরণের অনুসারে লিপির ছাঁদ পরিবর্তন হয়।এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ মেলে চীনায়।চীনদেশে গোড়ার দিকে লেখা হ’তো সরু ও লম্বা বাঁশের ফালিতে। সেই জন্যে একটার নীচে আর একটা এমনি করে লম্বালম্বি ভাবে অক্ষরগুলি আঁকা হ’ত।তারপর বাঁশের ফালির স্থান নিলে সিল্ক,তারপর কাগজ। লেখা কিন্তু চলতে লাগল উপর-নীচে লাইন ধরে।এখনও তাই।উড়িয়া ও বাংলা অক্ষরের অব্যবহিত মূল একই।কিন্তু দুইয়ের মধ্যে এখন কোন সাদৃশ্য নজরে পড়ে না।তার কারণ উড়িষ্যায় শরের বা খাগের কলমের বদলে লোহার নরুন অর্থাৎ যথার্থ ‘লেখনী’ ব্যবহৃত হ’ত। নরুনের সোজা টানে তালপাতা কেটে যায়।তাই গোলগোল মাত্রা টানা হ’তকালক্রমে গোল গোল মাত্রাগুলি আসর জুড়ে বসে মূল অক্ষরগুলিতে অধঃপাতে দিয়েছে।বাংলায় ও মৈথিলে সাধারণত তরল কালিতে লেখা হ’ত কলম দিয়ে তাই অক্ষরের মাথায় লম্বা-টানা মাত্রা।”১১৩ এর পরে তাঁর বক্তব্য, বাংলাতে তালপাতা শুধু ব্যবহার করতেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা বাকি সবাই কাগজের লিখতেন।এটা মনে হয় সর্বাংশে সত্য নয়।আমাদের অনেকেরই দুই প্রজন্ম আগেও পাঠশালাতে তালপাতায় হাতেখড়ির স্মৃতি রয়েছে।কিন্তু সুকুমার সেন যখন লিখছেন,নিশ্চয় তালপাতাতে পুথি সেরকম মেলেনিকবে কাগজ প্রচলিত হলো নিশ্চিত হয়ে বলতে পারেন নি।জানিয়েছেন,একাদশ দ্বাদশ শতকে নেপালেই প্রথম কাগজের প্রচলন হয়।পঞ্চদশ শতকে বাংলা পুথিতে কাগজই চলত,তালপাতা নয়।বৈষ্ণবেরাও ভাগবতের মতো পবিত্র ধর্মগ্রন্থও কাগজে লিখছেন১১৪ডি ডি কোসাম্বী তাঁর ‘ভারতের ইতিহাস’ বইয়ের পদ্ধতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছিলেন,“উৎপাদনের উপকরণ আর (বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে) উৎপাদনের সম্পর্কের ক্রমাগতভাবে ঘটা বিকাশকে কালক্রম অনুসারে বর্ণনা করা বা পরিবেশন করাই হলো ইতিহাস।”১১৫ লিপির ইতিহাস বুঝতে এই বিষয়টি যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সে আশা করছি,আমরা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে পারছি।যদিও আমরাও সেই সব আর্থ-সামাজিক ইতিহাসের গভীরে এখানে প্রবেশ করিনি।কিন্তু করলেই যে সবচাইতে স্পষ্ট ছবিটি ধরা পড়ত তথা কার্যকারণ পরম্পরাটি স্পষ্ট হতো সেই নিয়ে সংশয় নেই।

    সুতরাং অসমিয়া বাংলা লিপি বিবাদ বুঝতে হলে এই সময়টির বর্ণনা এত সংক্ষিপ্ত হলে আমাদের কাজ চলছে না।প্রথম অসমিয়া ছাপা-গ্রন্থ ‘ধর্মপুস্তক’ ছাপাবার সময়  আত্মারাম শর্মা যেভাবে অসমিয়া হরফ দেখিয়েছিলেন, সেভাবেই ‘ৰ,ৱ’ তাতে প্রবেশ করেছিল।১১৬হ্যালহেডের ব্যাকরণ ছাপার সময় কালীকুমার রায় এবং খুসমৎ মুনশি যেভাবে যে আদল দেখিয়েছিলেন সেভাবেই উইলকিন্সন হরফের আদল তৈরি করেন,এবং পঞ্চাননেরা ধাতুতে ঢালাই করেন।শিবসাগরে ১৮৪৭এ যখন ‘অরুণোদয়’ ছাপা হচ্ছে তখন হেমচন্দ্র বরুয়াকে বেশ লড়তে হয়েছিল ‘ৱ’-টি রাখবার জন্যে১১৭মাগধী অপভ্রংশ স্তরেই বা প্রত্ন-বাংলা স্তরেই অষ্টম শতক থেকেই যে অন্তস্থ ব এবং বর্গীয় ব-তে একটি বিভ্রান্তি দেখা দিচ্ছিল,এবং ক্রমেই শব্দের আদিতে অন্তত সব বর্গীয় ব হয়ে যাচ্ছিল,আমরা সুনীতি কুমারের থেকে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছি।বাংলা সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে।অসমিয়ারও কিন্তু শব্দের আদিতে আর ‘অন্তস্থ ব’ নেই।যা কিছু আছে সবই শব্দের মাঝে বা শেষে।বাংলা এখন ‘য়’ দিয়ে কাজ চালায়,অসমিয়া ‘ৱ’ দিয়ে---তফাত এইটুকুনই।ফলে কালীকুমার বা খুসমৎ মুনশি স্বতন্ত্র ‘অন্তস্থ –ব’-দেখিয়েছিলেন কিনা আমরা জানি না,না দেখানোই সম্ভব। এবং দেখালে ‘অন্তস্থ ব’-এর জন্যে ‘র’ দেখাতে পারতেন।তখন সেটিই থেকে যেতে পারত বাংলা ‘অন্তস্থ-ব’-এর চিহ্ন।এখনকার  ‘র’-এর জন্যেও কী দেখিয়েছিলেন,আমরা জানি না।‘র’-এর জন্যে তাঁরা ‘ৰ’-দেখাতেও পারতেন দেখালে এটিই হতে পারতো বাংলা ‘ৰ’অসমিয়া ‘ধর্মপুস্তকে’-ও ‘র,ৰ’এর একটি বিভ্রান্তি ছিল উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী লিখেছেন।১১৮আমরা সেই ইতিহাসেই প্রবেশ করবকিন্তু তাঁর আগে দেখে নেব লিপি প্রসঙ্গে অসমিয়া তর্কটি কী? বাণীকান্ত কাকতির ‘এ আই এফ এ ডি’-তে লিপি প্রসঙ্গের আলোচনা আলাদা করে নেই। যেটুকু আছে ধ্বনিতত্ত্ব প্রসঙ্গেই  অসমিয়া বর্ণমালার আলোচনা। থাকলে সেখান থেকেই শুরু করা যেতএমনিতেও যারা রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়,সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বা সুকুমার সেনের সিদ্ধান্তগুলোকে প্রশ্ন করেন নি,তাদের নিয়ে স্বতন্ত্র আলোচনা না করলেও চলে।উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী একজন প্রধান আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানী এবং তাঁর ‘অসমীয়া লিপি’ বলে একটি স্বতন্ত্র বই রয়েছে। যেখানে অসমিয়া লিপিচর্চারও একটি সারাৎসার রয়েছে। সেখানে তিনি প্রশ্নগুলো তুলেছেন,আমরা শুরুতেই সেসব কথা লিখেছি। তাই লিপি প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত বিবেচনা করাটি গুরুত্বপূর্ণ।

 উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী এবং অসমিয়া-বাংলা লিপি তথা কুটিল-কামরূপী বিতর্ক:

এই অব্দি বাংলা-অসমিয়া লিপির ইতিবৃত্তের যে রূপরেখাটি পাওয়া গেল তাতে বহু কিছুই অস্পষ্ট রইল।সন্দেহ নেই।প্রথমত: ব্রাহ্মী দেশি কি বিদেশি উৎসের থেকে এসেছেসে তর্ক ছেড়ে দিলেও ব্রাহ্মীর উত্তরা বৈচিত্র্যের পশ্চিমা উপধারা থেকে দেবনাগরী,না কি পূর্বী উপধারারই এক শাখা থেকে দেবনাগরী,কায়থি,গুরুমুখী ইত্যাদি  অন্যান্য বৈচিত্র্য এবং আর শাখা থেকে বাংলা,অসমিয়া,মৈথেলি,ওড়িয়া লিপি এসেছে—সেই তর্কও অস্পষ্ট।কিন্তু শুরু থেকে যেটি স্পষ্ট---সে হল ব্রাহ্মী এক স্তরে এসে গুপ্ত,পরের স্তরে কুটিল কিংবা প্রত্ন-বাংলা-অসমিয়া ইত্যাদি রূপ পাচ্ছে। সেটির থেকে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে বাংলা-অসমিয়া-মৈথেলি-ওড়িয়া আলাদা হতে শুরু করেছেওড়িয়া আবার সেই পরিবার থেকে অনেকটাই বেরিয়ে যাচ্ছে পঞ্চদশ শতকে।ছাপা জমানাতে আসলে বাংলা-মৈথেলি—অসমিয়া লিপি পাকাপাকি তিন আলাদা রূপ পাচ্ছে।এই হচ্ছে আমাদের এই অব্দি বোধ।

এবারে যে মূল তর্কের মুখোমুখি হতে হবে সে হচ্ছে বাংলা-অসমিয়া-মৈথিল আদি ‘প্রত্ন’ স্তরে কুটিল থেকে এসেছে না প্রাচীন কামরূপীর থেকে এসেছে।লিপি সম্পর্কে একেবারেই প্রাথমিক দক্ষতা এবং জ্ঞান নিয়ে এবারে আমরা একটি সমস্যা সঙ্কুল পর্বে প্রবেশ করছি।এই কথাটি শুরুতেই লিখে ফেলা যাক।আমাদের নির্ভরতা মূলত লিপিবিদদের যুক্তিপরম্পরার যৌক্তিক পাঠ তথা অধ্যয়নের উপরএই অব্দি যদিও বা আমরা বহু বাঙালি লিপিবিদকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি,আমাদের যেকোনো দৃষ্টিভ্রম বা ত্রুটি বৌদ্ধিক বিতর্কের বিষয় হিসেবেই বিবেচিত হবে।কিন্তু এখানে অদক্ষতা কিংবা সীমাবদ্ধতা নিরাসক্ত বিজ্ঞানের সীমা অতিক্রম করে ‘জাত্যাভিমান’-এর দায়ে দুষ্ট হতে পারে।আর তা যে হয়, আমরা নিজেরাও দেখিয়েছি,অধ্যাপক মৃণাল নাথের কথাও আমরা উল্লেখ করে এসেছি।আমাদের ডিম্বেশ্বর নেওগের এই কথার সঙ্গে কোনো দ্বিমত নেই যে,“বঙলা লিপি আরু মৈথেলী আখরবোর প্রকৃততে এটা আরু পুরণি কামরূপ-লিপির সৈতে একে১১৯আমরা দেখিয়ে এলাম,কোনো বাঙালি বা বিদেশি লিপিবিদও এই নিয়ে প্রশ্ন তোলেন নি।শুধু যেভাবে আমরা দাবি করতে পারি না,আধুনিক বাংলা এবং মৈথেলি লিপি চর্যার লিপির সঙ্গে একই বা কুটিল বা গুপ্ত লিপির সঙ্গে একই--তেমনি সেই অর্থেই শুধু দাবি করতে পারি না যে বাংলা লিপি কামরূপী লিপির সঙ্গে একই।যদি এই তর্ক মেনে নিই যে গুপ্তলিপির পরের পর্বে কামরূপী লিপির ধারাবাহিক বিকাশই বাংলা লিপি --- তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবার কথা নয়।আমাদের শুধু দেখতে হচ্ছে কুটিল লিপির সঙ্গে কামরূপীর সমকালীন কোনো সম্পর্ক আছে কি নেই।এবং কুটিল লিপির সঙ্গে বাংলারও পরকালীন কোনো সম্পর্ক আছে কি নেই,যেমনটি বাংলার লিপিবিদেরা দাবি করে এসেছেন।না কি কুটিলকেই কামরূপী বলা উচিত? 

উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীও লিখেছেন,“অসমীয়া লিপির সৈতে বঙলা, উড়িয়া, মৈথেলি আদি লিপির এটা সম্পর্ক আছে।এই সম্পর্ক প্রাচীন কালরে পরা চলি অহা সম্পর্ক।এই সম্পর্কর পরা পূর্বভারতীয় লিপি কেইটার (অসমীয়া,বঙলা, উড়িয়া,মৈথেলি) মূল গুপ্ত লিপির পরিবর্তিত রূপ কামরূপীর লিপি বুলি ক’ব পরা যায়।”১২০আমরাও সেই সম্পর্ক দেখিয়েছি।এবং আরো দেখিয়েছি,ওড়িয়া পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে অনেকটাই দূরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে।মৈথেলির ইতিহাসও নানা বিড়ম্বনাতে ভরা এবং এখন যে রূপটি রয়েছে সে বাংলা-অসমিয়ার মতো হলেও যতটা তফাৎ নিয়ে টিকে আছে তার থেকে অসমিয়া-বাংলা বহু কাছের লিপি।তার তফাৎ মূলত দুই হরফে ‘র/ৰ’ এবং ‘ব/ৱ’-তে।বর্ণমালাতে ‘ক্ষ’ থাকবে কিনা সেই তর্কও আছে। সেটি আপাতত বাদ দিতে পারিবাংলা একে বর্ণ-অক্ষরের বোধ ভ্রান্তি বিবেচনা করে বর্ণমালা থেকে বাদ দিলেও বাংলা যুক্তাক্ষর তালিকাতে এবং ব্যবহারে অসমিয়ারই মতো সেটিকেও রেখেছে,যেমন রয়েছে জ্ঞ,ঞ্জ,ইত্যাদিদ্বিতীয়ত উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী তাঁর গ্রন্থের শেষে এরকম একটি কথা লিখেছেন,“গতিকে আধুনিক অসমীয়া লিপিটো মিছনেরীসকলর দান বা আধুনিক অসমীয়া লিপিটো অসমর সাঁচিপতীয়া পুথির বা তার আগর আখরর স্বাভাবিক বিকশিত রূপ নহয় আদি কথার কোনো যুক্তিযুক্ততা ধরা নপরে।”১২১ এখন,এই সব ‘অযুক্তি’ কে বা কারা তুলে ধরেন,তিনি লেখেন নি।তারা যদি অসমিয়া হন তবে ভাষা-লিপি সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞানও রাখেন না,হীনমন্যতাতেও আক্রান্ত---আমরা সহজেই বলতে পারিআর যদি কোনো বাঙালির হয় এই সব ‘অযুক্তি’ তারও ভাষাবোধের প্রচণ্ড অভাববোধের সঙ্গে যুক্ত হয় শুধু বাঙালি জাত্যাভিমান তথা উচ্চাত্মিকাবোধ—এইটুকু আমরা জোরের সঙ্গেই লিখতে পারি।আমরা অন্তত যে ক’জন প্রধান বাঙালি ভাষাবিদের কথা লিখে এলাম,তাদের অনেকেই অসমিয়া ভাষাবিদদের মধ্যেও সম্মানিত,তাঁরা এরকমটি লেখেন নি।এর সপক্ষে মনে হয় কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণেরও দরকার নেই।শুধু রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গ্রন্থের ভূমিকাতে ওড়িয়ার সঙ্গে অসমিয়া ‘developed out of the Bengali’ বলে একটি শিথিল মন্তব্য করেছিলেন,আমরা দেখিয়েছি।এমনতর আরো কেউ কেউ করে থাকতে পারেন।তার মানে এই নয় যে অসমিয়ার কোনো স্বাভাবিক বিকাশ নেই।ডিম্বেশ্বর নেওগও যে সময়ে বাংলা আলাদা হয়ে গেল বলে লিখছেন,ঠিক সেই সময় থেকেই বাংলার ইতিহাস শুরু হল এমনটাও তো নয়।যদিও তাঁর মন্তব্যে কোনো সময়ের হিসেব নেই,উপেন্দ্রনাথ যেভাবে সুকুমার সেন পড়েছেন তাতে মনে হয়েছে তিনি দ্বাদশ শতককেই জলবিভাজন রেখা বলে ধরতে চাইছেন।তার আগেকার লিপিকে যদি আমরা প্রত্ন-বাংলা বা প্রত্ন-অসমিয়া বলে ফেলি তাতেই সমস্যা চুকে বুকে যায়।নিশ্চয় অসমিয়া বা বাংলা লিপিও মিশনারিদের দান নয়।কিন্তু তাদের একটি বড়সড় ভূমিকা আছে লিপি দু’টির বিকাশে এই সত্য কী ভাবে অস্বীকার করবো? বাংলা ‘র’ যে এইভাবেই লেখা হবে অন্যভাবে নয়---সেতো মিশনারিরা বা ব্রিটিশ শাসকেরা মুদ্রণযন্ত্র নিয়ে এসে ছাপাখানা চালু করবার পরেই স্থির হয়ে গেল,তার আগে নয়।তার আগে তো একাধিক বিকল্প ছিল বাংলার সামনে ‘ব/ৰ/ব· এবং একেবারেই নবীন র’তেমনি অসমিয়ারাও যে অন্তস্থ-ব-কে ‘র’ দিয়ে লিখবেন না,‘ৱ’ দিয়েই লিখবেন সেতো মিশনারিদের সঙ্গে সংগ্রাম করেই হেমচন্দ্র বরুয়া পাকাপাকি ব্যবস্থা করলেন।তার উপরে ৎ,ং,ঁ,ড়,ঢ়,য় এরকম আরো কিছু  সব হরফের সন্ধানও তো এর আগে মিলছে না।‘ং’ লেখা হচ্ছে ‘০’ দিয়ে। সেরকম দেখে কোনো কোনো অর্বাচীন দাবি করতে পারেন বটে লিপিগুলো মিশনারিদের দান।কারণ শ্রীরামপুরেই হোক,কিংবা শিবসাগরেই ---প্রকাশনা শিল্পের শুরুটা হয়েছিল তাদেরই হাত ধরে।আর  মুদ্রণযন্ত্রের দাবিতেই হরফগুলো পাকাপাকি হচ্ছিল,বিকশিত হচ্ছিল,সংযোজন পরিবর্তন হচ্ছিল  তখনই।এখনো সেই প্রক্রিয়া সমানে চলছে। সেসব বিচার করে আমরা কিন্তু দাবি করতে পারি বাংলা আর অসমিয়া ভাষা হয়ত আলগা হয়েছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পরে,কিন্তু লিপির সংসার একেবারে আলাদা হয়েছে এই উনিশ শতকে মুদ্রণযন্ত্রের হাত ধরে।তার আগে নয়।দ্বাদশ শতকেতো নয়ই।তার আগে দুই লিপির বিবর্তনের ইতিহাস এক,--- সে আসুক কুটিল কিংবা কামরূপীর থেকে।হতে পারে তার লেখন রীতির পূর্বভারতের বিশাল ভূখণ্ডের এখানে ওখানে কিছু হেরফের ছিল,কিছু স্থানীয় লেখনরীতিও গড়ে উঠেছিল,কিন্তু প্রতিটি হরফ ধরে বিচার করলে বহু হরফের এমন কি তাদের বিকল্পেরও কামরূপ থেকে কাটিহার,কলকাতা থেকে কুমিল্লা একই আদল আমাদের নজর এড়াবে না।উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী কালিক এবং কালানুক্রমিক প্রচুর হরফের নজির এঁকে দিয়েছেন,বেশ কিছু পুথি এবং প্রত্নলেখের ছবিও দিয়েছেন,সেই সব দেখবার পরেই আমাদের এই সিদ্ধান্ত। আমরা সেই সব নজিরগুলোই পরীক্ষা করে দেখব

শুধু একটি কথা মনে হয় শুরুতেই স্পষ্ট করা উচিত যে ‘কামরূপী’ নামটির সঙ্গে যদি অসমিয়া জাত্যাভিমানকে জুড়ে দেয়া হয়,তবে প্রতিপক্ষেরও ‘জাত্যাভিমান’-কে জাগানো হবে। আর কোনো নিরাসক্ত বৈজ্ঞানিক সহমত হবে না। অর্থাৎ অসমিয়া তাত্ত্বিকদের বাইরে সংজ্ঞানামটি কেউ গ্রহণ করবেন না।অন্যদিকে মৈথিলদের যাই হোক বাঙালিদের এক বড় অংশের বিশেষ করে সিলেটি সহ পূর্ব এবং উত্তর বঙ্গের মানুষের কামরূপের উত্তরাধিকার স্বীকার করে নিতে বিচলিত বোধ করা ঐতিহাসিক কারণেই উচিত নয়। এই বিষয়টি এবং প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় আগে স্পষ্ট করে এগোনো উচিত।

 উপেন্দ্র নাথ লিখেছেন,“ইফালে মিথিলা আরু প্রাচীন কামরূপ রাজ্যর মাজত বর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছিল।”১২২ সঠিক লিখেছেন।এর মধ্যে মিথিলার গর্ব করবার আছে বহু কিছু।কিন্তু এই সম্পর্ক সারা বাংলারও ছিল।বিশেষ করে পঞ্চদশ শতক অব্দি নবদ্বীপের সমান্তরালে সারা বাংলার বিদ্যাচর্চার আরেকটি কেন্দ্র ছিল মিথিলা।বাংলার ছাত্ররা মিথিলাতে বিদ্যার্জন করতে যেতেন।তারাই মৈথিল কবি বিদ্যাপতির রচনা বয়ে বাংলাতে এনেছিলেনতাই বাঙালি শুধু তার সাহিত্যিক ঐতিহ্যের অংশ করে নেন নি। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মেও তাঁর বৈষ্ণব পদগুলো ভাবাদর্শের প্রেরণার কাজ করেছিল।পঞ্চদশ শতকে মিথিলা গৌড়ের সুলতান শাসকদের অধীনে এলে সুকুমার সেন লিখেছেন,“এই মিলনের ফলে দুই দফায় গৌড় লাভবান হইল,--- এক পাণ্ডিত্য চর্চায়---স্মৃতি ও নব্যন্যায়ে,আর সাহিত্যচর্চায় ব্রজবুলি পদাবলীতে ও গানে।”১২৩ বাংলাদেশে বিখ্যাত ন্যায়শাস্ত্রী রঘুনাথ শিরোমণি চৈতন্যের সমকালীন ছিলেনদুজনেই মূলত সিলেটের লোক ছিলেন।পারিবারিক বিবাদের জেরে তাঁর মা তাকে নিয়ে ছেলেবেলায় নবদ্বীপ চলে যাননবদ্বীপে ন্যায় শাস্ত্রের পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না বলে এখানে পড়াশোনা সাঙ্গ করে এক সময় তিনি মিথিলা চলে যান উচ্চশিক্ষার জন্যে। সেখান থেকে ‘শিরোমণি’ উপাধি নিয়ে নবদ্বীপে ফিরে এসে চতুষ্পাঠী খোলেন।ভারতীয় ন্যায়শাস্ত্রের বহু কীর্তিমান গ্রন্থের তিনি প্রণেতা।১২৪বাংলাদেশে ভাগবত পুরাণ পরিচিত ছিল নাসুকুমার সেন লিখেছেন,“শুধু সাহিত্যে নয়,অধ্যাত্মভাবনাও নূতন সূত্রের নির্দেশ দিল তীরহুত হইতে ভাগবত-পুরাণ আসিয়া।”১২৫অর্থাৎ গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের অন্যতম  প্রেরণা গ্রন্থটি এল সেখান থেকে।মিথিলার রাজদরবারও অখ্যাত ছিল না,সে তো বিদ্যাপতির সূত্রে আমাদের জানাই ছিল।সুকুমার সেন আরো লিখেছেন,“পঞ্চদশ শতাব্দীতে পূর্ব-ভারতে সাহিত্য–সংস্কৃতির দুই প্রধান শক্তিকেন্দ্র ছিল,গৌড়ের সুলতানের দরবার এবং তীরহুতের রাজন্য-জমিদারের আসর।গৌড়-সুলতানের দরবারীরা পাণ্ডিত্যের বেশি খাতির করিতেন তাই সেখানে সংস্কৃতেরই চর্চা।তীরহুতের রাজসদস্যরা সংস্কৃত ও দেশ-ভাষা দুইয়েরই চর্চা করিতেনতবে তাঁহাদের মন ছিল দেশ-ভাষার ও সঙ্গীতের দিকে।ইঁহাদের সংস্কৃত রচনা প্রায় সবই ব্যবহারিক প্রয়োজনে লেখা স্মৃতি ও পাঠ্যনিবন্ধ অথবা ক্ষুদ্র রাজপ্রশস্তি।”১২৬আমরা পরে দেখাব সুফী কাব্যগুলো কী ভাবে অযোধ্যা থেকে মিথিলা হয়েই আরাকান অব্দি গিয়ে পৌঁছুচ্ছে। সুতরাং সেই মিথিলার সম্পর্ক কামরূপের সঙ্গে থাকবেই।

কিন্তু আমরা আসলে কামরূপের উত্তরাধিকারের সন্ধান করছিলাম।উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী লিখেছেন,“মিথিলার এটা অংশ কামরূপ রাজ্যর ভিতরুয়া আছিল।”১২৭ভাস্কর বর্মার কামরূপ সম্পর্কে সেই তথ্য হয়তো সত্য।কিন্তু ততোধিক সত্য তিনি যখন লেখেন,“প্রাচীন কামরূপে কোচবিহারকে ধরি সমগ্র উত্তর-বঙ্গ,রংপুর আরু জলপাইগুড়ি জিলাকো সামরি লইছিল।”১২৮আমরা বরং প্রশ্ন করতে পারি,তিনি সিলেট ময়মনসিংহকেও এর সঙ্গে জুড়লেন না কেন?এখন নাহয়  ‘ভাষিক জাত্যাভিমান’-এর চাপে বহু বাঙালি কামরূপ–প্রাগজ্যোতিষের সঙ্গে নিজেদের সংযোগ স্বীকার করতে কুণ্ঠিত বোধ করেন।কিন্তু বঙ্কিম-রমেশ চন্দ্ররা যখন ভারতীয় কোনো ভাষাতে ভারতীয় ইতিহাসের চর্চা শুরু করছেন তখন আর্যাভিমানের স্বার্থে সগৌরবে কামরূপের গাথা গাইতেন।বঙ্কিমের একটি নিবন্ধ আছে,‘বাঙ্গালার ইতিহাসের ভগ্নাংশএর শুরুটাই কামরূপ-রংপুরের কথা দিয়ে।তিনি কামরূপের কথা লিখেছিলেন এই ভাবে,“যেমন এখন যাহাকে বাঙ্গালা বলি,আগে তাহা বাঙ্গালা ছিল না,তেমনি এখন যাহাকে আসাম বলি,তাহা আসাম ছিল না।অতি অল্পকাল হইল,আহম নামে অনার্য্য জাতি আসিয়া ঐ দেশ জয় করিয়া বাস করাতে উহার নাম আসাম হইয়াছিল। সেখানে, যথায় এখন কামরূপ,তথায় অতি প্রাচীন কালে এক আর্য্যরাজা ছিল।তাহাকে প্রাগ্‌জ্যোতিষ বলিত। বোধ হয়,এই রাজ্য পূর্ব্বাঞ্চলের অনার্য্যভূমিমধ্যে একা আর্য্য জাতির প্রভাব বিস্তার করিতে বলিয়া ইহার এই নাম।মহাভারতের যুদ্ধে প্রাগ্‌জ্যোতিষেশ্বর ভগদত্ত,দুর্য্যোধনের সাহায্যে গিয়াছিলেন।বাঙ্গালার অধিবাসী,তাম্রলিপ্ত,পৌণ্ড্র,মৎস্য প্রভৃতি সে যুদ্ধে উপস্থিত ছিল।তাহারা অনার্য্যমধ্যে গণ্য হইয়াছে।বাঙ্গালা যে সময়ে অনার্য্যভূমি,সে সময়ে আসাম যে আর্য্যভূমি হইবে, ইহা এক বিষম সমস্যা। কিন্তু তাহা অঘটনীয় নহে।মুসলমানদিগের সময়ে ইংরেজদিগের এক আড্ডা মান্দ্রাজে,আর আড্ডা পিপ্পলী ও কলিকাতায়,মধ্যবর্ত্তী প্রদেশ সকলের সঙ্গে তাহাদের কোন সম্বন্ধ নাই।ইহার ইতিহাস আছে বলিয়া বুঝিতে পারি। তেমনি প্রাগ্‌জ্যোতিষের আর্য্যদিগের ইতিহাস থাকিলে,তাহাদিগের দূর গমনের কথাও বুঝিতে পারিতাম। বোধ হয়,তাহারা প্রথমে বাঙ্গালায় আসিয়া বাঙ্গালার পশ্চিম ভাগেই বাস করিয়াছিল। তারপর আর্য্যেরা দাক্ষিণাত্যজয়ে প্রবৃত্ত হইলে,সেখানকার অনার্য্য জাতি সকল দূরীকৃত হইয়া,ঠেলিয়া উত্তরপূর্ব্বমুখে আসিয়া বাঙ্গালা দখল করিয়াছিলতাহাদেরই ঠেলাঠেলিতে অল্পসংখ্যক আর্য্য ঔপনিবেশিকেরা সরিয়া সরিয়া ক্রমে ব্রহ্মপুত্র পার হইয়া যাইতে বাধ্য হইয়াছিল।”১২৯তিনি কামরূপের সীমা নির্দেশ করছেন এই লিখে,“এক সময়ে এই কামরূপ রাজ্য অতি বিস্তৃত হইয়াছিলপূর্ব্বে করতোয়া ইহার সীমা ছিল;আধুনিক আসাম,মণিপুর,জয়ন্ত্যা,কাছাড়,ময়মনসিংহ,শ্রীহট্ট,রঙ্গপুর, জলপাইগুড়ি ইহার অন্তর্গত ছিল।১৩০কামরূপের পশ্চিম সীমার কথাতে করতোয়া নদীর কথা ঘুরে ফিরে মেলে।নদীটি নিয়ে ১৯৪৭ পরবর্তী অসমে,সম্ভবত পশ্চিম বাংলাতেও ধারণা খুব ভাসা ভাসানদীটি এখন বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের বগুড়া জেলার একটি ছোট নদী।মহাস্থানগড়ের পাশ দিয়ে গেছে। সেই মহাস্থানগড় যেখানে অশোকের ব্রাহ্মীতে উৎকীর্ণ লেখ মিলেছিল।বাংলাদেশের প্রথম শিলালেখ।প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধনের এটি রাজধানী ছিল।এককালে উত্তর বাংলার সবচাইতে বড় নদী ছিল।এটিই ছিল তিস্তা নদীর মূল ধারা।সম্ভবত তাই প্রাচীন ইতিহাসের কথাতে তিস্তার কথা শোনা যায় কম।তিস্তার মূল নাম নীহার রঞ্জন লিখেছেন ‘দিস্তাং’১৩১পাশাপাশি মনে করতে পারি আমরা দিসাং,দিখৌ ইত্যাদি অসমের বহু নদী নাম।বস্তুত এখনকার ‘তিস্তা’ মাঝে কোনো এক সময় পুবে করতোয়া,পশ্চিমে পূণর্ভবা এবং কেন্দ্রে আত্রাই এই তিনপথে গিয়ে পদ্মাতে পড়েছিল বলে নামটির সংস্কৃতকরণ হয়ে যায় ‘ত্রিস্রোতা’,পরে আবার তদ্ভব হয়ে নাম হয় ‘তিস্তা’নীহার রঞ্জন যখন ইতিহাস লিখছেন,তখনও মনে হয় এই তিন নদীই তিস্তার স্রোত ছিল।কিন্তু আমরা মানচিত্র দেখেছি,এখন তিস্তা স্বয়ং মূল স্রোতব্রহ্মপুত্রে এসে পড়বার পরে দুই নদীর নাম হয় যমুনা।তিস্তার দক্ষিণে আরো নিচে এসে পড়ে করতোয়া।যমুনা গিয়ে পদ্মাতে মেশে।নীহার রঞ্জন রায় লিখছেন,“উত্তর–বঙ্গের সর্বপ্রধান নদী করতোয়া।”১৩২এহ̖ বাহ্য!আমাদের জন্যে যেটি গুরুত্বপূর্ণ,তা হলো তিনি লিখছেন,“সপ্তম শতকে য়ুয়ান –চোয়াঙ পুণ্ড্রবর্ধন হইতে কামরূপ যাইবার পথে বৃহৎ একটি নদী অতিক্রম করিয়াছিলেন;তিনি এই নদীটির নাম করেন নাই,কিন্তু ‘টাং-সু’ (T’ang-shu) গ্রন্থের মতে এই নদীর নাম ক-লো-তু বা Ka-lo-tuWatters সাহেব Ka-lo-tu-কে ব্রহ্মপুত্র বলিয়া মনে করিয়াছিলেন।নিঃসন্দেহে ইহা ভুল। Ka-lo-tu স্পষ্টতই করতোয়া;এই নদীই যে সপ্তম শতকে পুণ্ড্রবর্ধন ও কামরূপের মধ্যবর্তী সীমা,এ খবরও ‘টাং-সু’ গ্রন্থে পাওয়া যাইতেছে১৩৩ 

করতোয়া নদীর পশ্চিমাংশ অর্থাৎ গৌড় বা পুণ্ড্রবর্ধন কামরূপের বর্মণ রাজারা জয় করেছিলেন কিনা,করলে কতদিন দখলে রেখেছিলেন,সেসব নিয়ে তর্ক আছে।বিশেষ করে নিধনপুর লিপির কথায়,যেটির দ্বিতীয় সংস্করণ ভাস্কর বর্মণ শশাঙ্কের আমলের গৌড়ের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ থেকে জারি করেছিলেন,এটি ঐতিহাসিক সত্য। সে করতোয়ারও বহু দক্ষিণে। সেটি এখনকার পশ্চিমবাংলার মুর্শিদাবাদ জেলাতে।তারপরে আর রাঢ় বাংলা ছাড়া আজকের পূর্ব-পশ্চিম বাংলার কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা,যদিও আজকের থেকে সেই পুরো ভূখণ্ড দক্ষিণে আরো অনেক খাটো ছিল।কিন্তু যে জমি দান করা হয়েছিল,সেটি করতোয়ার পশ্চিমে বা সিলেটে বা অন্য কোথাও সেই নিয়ে তর্ক আছে।এই লিপিটি এর জন্যেও জরুরি যে কামরূপী ‘প্রাকৃত’ এবং লিপির পক্ষে একে সবচাইতে বড় দলিল হিসেবে উপস্থিত করা হয়।কিন্তু ইউয়েনসাঙের ‘Ka-lo-tu’ নিয়ে আমরা বিবাদ দেখিনি।বিশ শতকের শুরুর দিকে ১৯১০ এবং ১৭তে অচ্যুতচরণ তত্ত্বনিধির ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ বইখানা বেরোয়।এই মাঝের সময়টিতে ১৯১২তে সিলেটের পঞ্চখণ্ড পরগণার নিধনপুর গ্রামে ভাস্করবর্মার তামার ফলকটি আবিষ্কৃত হয়। সেই থেকে এর নাম নিধনপুর তাম্রফলক।ব্রিটিশ আসামে তখন আধুনিক ইতিহাস চর্চার শুরু হচ্ছে।তিনি যার প্রেরণাতে এই গবেষণা গ্রন্থখানা লেখেন,সেই পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ নিধনপুর লিপির প্রথম পাঠোদ্ধার করেন।ফলে স্বাভাবিকভাবেই এর কথা সেই বইতে নেই।ভাটেরার তাম্রফলক দিয়েই তাঁর ইতিহাসের কাল বলতে গেলে শুরু।কিন্তু তিনি কামরূপের পৌরাণিক বিবরণ,বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,রমেশ চন্দ্র দত্ত এমন আরো কিছু দেশি-বিদেশি ইতিহাস অধ্যয়নের সঙ্গে পরিচিত ছিলেনআর ছিল তাঁর ইউয়েন সাঙের বিবরণের সঙ্গে পরিচয়। সেইটুকুর উপরে ভরসা করে তাঁর বিশ্বাস ছিল,“শ্রীহট্ট বহু শতাব্দী পর্যন্ত্য যে কামরূপের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাহার যথেষ্ট প্রমাণ আছে।খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে কামরূপ রাজ্যের অঙ্গ ছিল।তাহা বিদেশীয় ভ্রমণকারীর বর্ণনায় জ্ঞাত হওয়া যায়।”১৩৪তিনি যখন এই কথাগুলো লিখছিলেন তখন দীর্ঘদিনের সুবাহ̖ বাংলার এবং পরে ব্রিটিশ ‘বেঙ্গল’-এর অধীনে লালিত সিলেটকে দশক তিনেক আগে ১৮৭৪এ আসামের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়।সিলেটি মধ্যবিত্তের তার বিরুদ্ধে অভিমান বাড়ছিল।তারা একেই তখন ‘পরাধীনতা’ বলে ভাবছিলেন।এই কথাগুলো জানতেন বলেই একটি কৈফিয়ত দিচ্ছেন,--- সেই কৈফিয়ত ‘আর্যঅহমিকার’,“শ্রীহট্ট বহুদিন কামরূপের অন্তর্গত ছিল বলিয়া অগৌরবের কিছু নাই,যে কামরূপ যোগিনী তন্ত্রে বারানসীর ন্যায় মাহাত্ম্যময় বলিয়া উল্লেখিত,তদধীনে থাকা অগৌরবকর নহে;ইহাতে ‘চিরপরাধীন’ বলিয়া শ্রীহট্টের প্রতি বিদ্রূপ করা যাইতে পারে না।নিজ পল্লী,নগর,বা জিলার লোক নহিলেই যদি পরাধীনতা হয়,তবে বহুতর দেশের ভাগ্যই শ্রীহট্টের ন্যায়।বস্তুত: তাহা অগৌরব সূচক নহে,কামরূপের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় অতি প্রাচীনকাল হইতেই শ্রীহট্ট আর্য্য সভ্যতার ফল ভোগ করিতে পারিয়াছে বলিয়া বরং বিশেষ গৌরবাস্পদ।”১৩৫একই শতাব্দীর শেষের দিকে যখন ইতিহাসের সমৃদ্ধ উপকরণ হাতের কাছে নিয়ে এবং পরিণত পদ্ধতি অনুসরণ করে অধ্যাপক সুজিৎ চৌধুরী ‘শ্রীহট্ট-কাছাড়ের প্রাচীন ইতিহাস’ লিখছেন তিনি সিলেটের সঙ্গে কামরূপের এত সুদীর্ঘ সংস্রব মানতে প্রস্তুত নন।দশম শতকের পশ্চিমভাগ লিপির রাজা শ্রীচন্দ্র কিছু দিনের জন্যে কামরূপ জয় করেছিলেন।এর উল্লেখ সেই লিপিতেও আছে,আর সুজিৎ চৌধুরীও এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন নি।১৩৬কিন্তু কামরূপের বর্মণ রাজাদের শাসন কাল তাঁর মতে,“মোটামুটি একশত বৎসর”১৩৭ ভূতিবর্মণ থেকে ভাস্করবর্মণ অব্দি।তাও মাঝে কিছু বছর বাদ যাবে,কেননা ভাস্করবর্মণের ডুবি তাম্রশাসনেই আছে মাঝে কিছুদিন ভাস্করবর্মণ এবং সুপ্রতিষ্ঠিতবর্মণকে গৌড়ের রাজার হাতে বন্দি হতে হয়েছিল।অর্থাৎ বঙ্কিম থেকে কামরূপের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের যে একরকমের ‘আবেগের ঢেউ’ দেখতে পাচ্ছিলাম,সেসব সুজিৎ চৌধুরীতে নেই।তাঁর ইতিহাসের শুরুতে যদি বা পুরাণ,তীর্থমহিমা,কিংবদন্তী কিছু আছে সেসব সিলেটের অনার্য বসতির ইতিহাসের সন্ধানে কাজে লাগিয়েছেন মাত্র।কিন্তু আর্যপ্রভাব অস্বীকার করা যাবে কী করে? এটি ছাড়াতো সামন্তীয় সিলেটের ইতিহাসই শুরু হচ্ছে না।আমরা যে আর্যভাষা এবং তার লিপির সন্ধান করছি সিলেটে তারও ইতিহাসের সূচনা হচ্ছে কবে থেকে?সুজিৎ চৌধুরী পড়লে যেটি বোঝা যায়,সে ওই কামরূপের শাসক ভূতি বর্মণ বা পরবর্তী কালে ভাস্কর বর্মণের সময় থেকেইতারও কয়েক শতক আগেকার আর্যবসতির পরোক্ষ সংবাদ টুকটাক পাওয়া গেলেও,“সর্বভারতীয় রাজনীতির অঙ্গনে শ্রীহট্ট-কাছাড়ের অন্তর্ভুক্তির নিঃসংশয় বার্তাটি আমরা সর্বপ্রথম পাচ্ছি নিধনপুর লিপিরই সূত্রে।”১৩৮লিপিটি একটি ভূমিদানের দলিল।দুইশতাধিক ব্রাহ্মণদের নামে এই দান দিয়েছিলেন ভাস্কর বর্মার বৃদ্ধ প্রপিতামহ ভূতিবর্মণ।মাঝে আগুনে পুড়ে গেলে ভাস্করবর্মণ এখনকার মুর্শিদাবাদ জেলার কানসোনা গ্রামে তথা সমকালে তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে পরাস্ত গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ থেকে নতুন তাম্রফলক দিয়ে সেই দান আবার অনুমোদন করেন।এভাবে এক ফলকের সঙ্গে দু’জনের নাম জুড়ে যায়। সেই দু’জনের সময়টা হচ্ছে ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতক।ভূতি বর্মণের শাসন কাল হচ্ছে ৫১৮ থেকে ৫৪২ খ্রিঃ এই চব্বিশ বছর।সুজিৎ চৌধুরীর মতে নগাঁও জেলার ডবকার কাছে মেলা এক প্রস্তর লিপিতে তথ্যটি মেলে।১৩৯সেটি যদি নাও হয়,অন্যত্র লিখছেন,মোটামুটি ৫০০ থেকে ৫৫০ খ্রিস্টাব্দ ধরাই যায়।১৪০আমরা বাংলার অধিকাংশ মানুষের উপরে প্রাচীন কামরূপের উত্তরাধিকারের কথা লিখেছিলাম।লিপিটি সিলেটে আবিষ্কৃত হলেও যিনি প্রথম এটি পাঠ করেন,সেই পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ কিন্তু যেখানে এই জমি দান করা হয়,সেই চন্দ্রপুরী বিষয়কে করতোয়া নদীর পাড়ে ঠেলে দিয়েছিলেন।তাও তার পশ্চিম পাড়ে।এখনকার বিহারের কোশী নদীর এক মরাখাত এবং করতোয়া নদীর মাঝখানে।তিনি এই পুরো এলাকাকে রংপুরের ভেতরে ধরেছিলেন।রংপুরের ব্রাহ্মণরা কোনো এক সময় পঞ্চখণ্ডে চলে এলে লিপিটিও সঙ্গে নিয়ে আসেন, ফলে লিপিটি এখানে পাওয়া গেছে,এই হচ্ছে তাঁর যুক্তি।১৪১প্রখ্যাত অসমীয়া ঐতিহাসিক কনকলাল বরুয়া আবার জায়গাটিকে সামান্য এদিক ওদিক করে বিহারের পূর্ণিয়া জেলাতে তথা প্রাচীন মিথিলাতে ঠেলে দিয়েছেনমিথিলার ব্রাহ্মণেরা পরে পঞ্চখণ্ডে এসে  বসতি স্থাপন করলে লিপিটি তারা সঙ্গে করে নিয়ে আসেন।১৪২তাঁর অভিমতের শরিক আরো অনেক বিদগ্ধ অসমিয়া ঐতিহাসিক হয়েছেন।তাঁদের মধ্যে মুকুন্দ মাধব শর্মাও রয়েছেন। সেসব তথ্য সুজিৎ চৌধুরীতেই জানা যাচ্ছে।১৪৩শুধু প্রতাপ চন্দ্র চৌধুরী জায়গাটিকে তিস্তা এবং কোশীর মাঝামাঝি জায়গা বলে মেনে নিয়েও লিখেছেন সে ছিল পুণ্ড্রবর্ধন তথা উত্তরবঙ্গের এলাকা।পূর্ণিয়া তথা মিথিলা তখন গুপ্তদের দখলে ছিল বলে সেখানে কামরূপ রাজার পক্ষে ভূদান সম্ভব ছিল না।যাইহোক,বোঝা যাচ্ছে অসমিয়াদের মধ্যে করতোয়ার পশ্চিমেই ভূতিবর্মারা ভূদান করেছিলেন সেই মতটিও জনপ্রিয়সুজিৎ চৌধুরী লিখেছেন,“যেহেতু ভাস্করবর্মার তাম্রলিপি মূলত আসামের ইতিহাসের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট,ফলে আসামের ঐতিহাসিকরা এ নিয়ে সর্বাধিক লেখালেখি করেছেন এবং তাদের মতামতই সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে স্বীকৃতি ও প্রাধান্য পেয়েছে।”১৪৪সাধারণ বুদ্ধি বলে,সেই নিয়ে সুজিৎ চৌধুরীর এত ভাবনা কেন?কলেজপাঠ্য ইতিহাসের বইতে করতোয়ার পশ্চিমে ভূতিবর্মনের এই ভূদানকে কামরূপের রাজার বিজয় পরাক্রম হিসেবে দেখানো হয়েছে,“লৌহিত্যর সমীপস্থ রাজ্য জয় করি যশোবর্মণ নিজ রাজ্যলৈ উভতি যোয়ার অলপ পিচতে মহাভূত বর্মণে পুন্দ্রবর্দ্ধনর ত্রিস্রোতা নদীর পশ্চিম অংশ (উত্তরবঙ্গ) জয় করি কামরূপ রাজ্যর অন্তর্ভুক্ত করে।এই খণ্ড জয় রাজ্য করি মহাভূত বর্মণে ‘চন্দ্রপুরী’ বিষয়া ২০৫জন নাগর ব্রাহ্মণক মাটি-বৃত্তি দান করে।...পুন্দ্রবর্দ্ধন জয় করি নিজ রাজ্যর অন্তর্ভুক্ত করার বিজয় গৌরবর চিন স্বরূপে মহাভূত বর্মণে ব্রাহ্মণসকলক এইবিলাক মাটি-বৃত্তি দান দিছিল।”১৪৫এখন,এই একুশ শতকে রাজারা যুদ্ধ জয় করেন না বটেকিন্তু ইতিহাসের রাজাদের পরাক্রমী বলে উপস্থিত করিয়ে আধুনিক জাত্যাভিমান সন্তুষ্টি আদায় করে থাকে,সেসব দেখাতে মনে হয় না খেটেখুটে তথ্যানুসন্ধানের দরকার পড়ে।ক্ষুদ্র এক ভূখণ্ড গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক মহাপ্রতাপশালী হর্ষ এবং ভাস্কর বর্মণকে প্রতিহত করেছেন বলে সারা বাংলার বাঙালিকে এখনো ‘গৌরব’ করতে দেখা যায়,যাদের পূর্ব ইতিহাসের সঙ্গে হয়ত শশাঙ্কের আদৌ কোনো যোগাযোগ ছিল না।এই নিধনপুর লিপিটি এবং ভূদান পর্বকে সেভাবেই দেখা হয়ে থাকে।শুধু তাই নয়,লিপিটির গুরুত্ব এখানেও যে,“এই লিপির আলম লৈয়েই প্রাচীন কামরূপর চতুর্থ শতিকারপরা দ্বাদশ শতিকালৈকে বুরঞ্জী লিখার প্রয়াস পণ্ডিতসকলে করিছে।”১৪৬ সে যাই করুন পণ্ডিতেরা,সুজিৎ চৌধুরী কী করছিলেন?তিনি কি পশ্চিমে কামরূপের গৌরব কিছু কমানোর কথা ভাবছিলেন?কাজটা সেরকমই হয় বটে,কিন্তু তার ভাবনাটা সেরকম কিছু ছিল না।তিনি করতোয়া-কোশী তথা পুণ্ড্রবর্ধনের গৌরবকে সুরমা কুশিয়ারা তথা কামরূপের দক্ষিণে টেনে আনছিলেন।তাতে যে তাঁর বাঙালি জাত্যাভিমানের কিছু হানি হবে,সেরকম কোনো ভাবনাও তাঁকে বিচলিত করে নি।বরং আক্ষেপ করেছিলেন,“...প্রাচীন কামরূপের রাজ্যসীমা নিরূপণের ব্যাপারে লিপি-প্রদত্ত স্থান-পরিচয়ের গুরুত্ব থাকায় বিষয়টি অন্যতর চিন্তা দ্বারা অনেক সময়েই প্রভাবিত হয়েছে।পূর্বভারতের ইতিহাস নিয়ে অন্য যে ঐতিহাসিকরা চর্চা করেছেন,তাঁদের কাছে ঐ স্থান নির্বাচনের ব্যাপারটা আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়।এই পরিপ্রেক্ষিতে নিধনপুর লিপিকে কোনো সময়েই শ্রীহট্টের ইতিহাসের আলোকে তেমন করে পরীক্ষা করে দেখা হয় নি।”১৪৭তাঁর আরো আক্ষেপ অচ্যুতচরণ চৌধুরী এই লিপির উল্লেখ করবার সুবিধে পেলেন না,তাতেও সিলেটের ইতিহাস পড়তে গিয়ে এটি নিয়ে অনেকেই জানবার সুবিধেই পেলেন না।আর “নিধনপুর লিপিকে যাঁরা শ্রীহট্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত মনে করতেন,তাঁদের মতামতের সঙ্গেও অনেকেই পরিচিত নন,কারণ সেগুলো প্রধানত প্রকাশিত হয়েছে জার্নালে,পুস্তকাকারে নয় এবং তাও বহু আগে।”১৪৮যদিও আমরা যে কলেজ পাঠ্য  শ্রীচন্দ্রকান্ত মহন্তর লেখা বইটির কথা লিখে এলাম,সেখানে কিন্তু সিলেটের দাবির কথাটির উল্লেখ রয়েছে এইভাবে, “কোনো কোনো পণ্ডিতে শ্রীহট্টত এই চন্দ্রপুরী অবস্থিত বুলি প্রমাণ করিব খোজে।”১৪৯  বইটি সুজিৎ চৌধুরীর আগে লেখা। যাই হোক,আমাদের আপাতত কাজ নয় সিলেটের দাবিকে প্রতিষ্ঠা দেয়া।বরং এটি দেখানো যে যেখানে এই লিপি পুনরায় খোদাই করে দেয়া হয়েছিল,সেই কানসোনা এবং যেখানে নিধনপুর লিপিটি পাওয়া গিয়েছিল,কোনোটিই এখনকার অসমের অংশ নয়।প্রথমটি পশ্চিমবাংলা দক্ষিণ-পুবপ্রান্তীয় একটি জেলাতে রয়েছে,দ্বিতীয়টি বাংলাদেশের উত্তরপুব প্রান্তীয় জেলা।এই দুই স্থানের মধ্যে একটি কাল্পনিক রেখা টানলে রেখাটিও ঈশানমুখো হবে।তাতে অনুমান করা যাবে অবিভক্ত বাংলাদেশের ঠিক কতটা ভূখণ্ডের উপরে কামরূপের অধিকার ছিল সেময়অর্থাৎ কাদের পূর্ব ইতিহাস কামরূপের সঙ্গে জুড়ে আছে।করতোয়ার পশ্চিমে হোক কিংবা সিলেটে,যে ব্রাহ্মণদের ভূদান দেওয়া হয়েছিল, তারা নিশ্চয় এর পরে অসমিয়া নন,বাঙালিই হয়েছেন।তাঁরা যে নতুন সামন্তীয় কৃষি সমাজ গড়ে তুলেছিলেন সেটিও অসমিয়া নয়,বাঙালি বা বাংলার বিভিন্ন আর্যভাষী সমাজ।তৃতীয়ত,নিধনপুর লিপির লেখক ‘কালিয়া’কে যদি আধুনিক অসম ভূখণ্ডের সেকালের কোনো নগর বা গ্রাম থেকে ডেকে নিয়ে না যাওয়া হয়,তবে তিনি এবং তাঁকে যদি কেউ শ্রুতলিপি দিয়ে থাকেন তাদেরও আজ বাঙালি হওয়াই সম্ভব।নিধনপুর ফলকের লিপি এবং ভাষা নিয়ে কথা বলতে গেলে এই শেষোক্তদের সন্ধান করা নিশ্চয় অত্যন্ত জরুরি কাজ। সেটি শুধু হেড়ম্ব কুমার বরপুজারী সম্পাদিত পাঁচখণ্ডে মহা-সংকলনগ্রন্থ ‘The Comprehensive History of Assam’-এ দীনেশ চন্দ্র সরকারের লেখাতে পেলাম,“Kāliyā was the Sekyarā (brazzier) who apparently made the plates and engraved the record on them.”১৫০ ‘চন্দ্রপুরী’ বিষয়কে সিলেটে টেনে এনে সুজিৎ চৌধুরী যে দক্ষিণে কামরূপের আয়তন বাড়ালেন,সেরকম তো নয়। কেননা,এটি ছাড়াই সিলেটের উপরে কামরূপের অধিকার বঙ্কিম থেকে অচ্যুতচরণ দাবি করছিলেন।তবে কামরূপের পশ্চিমের সীমা তাতে কিছু কমে আসে বটে।কিন্তু তিনি পুরাকালের কামরূপ বা প্রাগজ্যোতিষের কথা ছেড়ে দিলে ইতিহাসের কামরূপের পুব সীমাকে তো কিছু কমিয়েছেন।তিনি লিখেছেন,“...আজকের আসাম এবং সেকালের কামরূপ অভিন্ন নয়। প্রাচীন কামরূপ রাজ্যের পূর্বসীমা কোনো সময়েই দরং জেলা অতিক্রম করেনি---অর্থাৎ বর্তমান আপার আসাম ঐ রাজ্যসীমার বাইরে ছিল।দক্ষিণ সীমা কখনও নগাঁও পর্যন্ত বিস্তৃত হত,কখনো বা নগাঁও অঞ্চল ডবকা নামে তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রাখত।কামরূপ রাজ্যের মূল কেন্দ্রাঞ্চল ছিল পশ্চিম আসাম (অর্থাৎ কামরূপ-গোয়ালপাড়া জেলা) ও উত্তরবঙ্গের সন্নিহিত অঞ্চলকে নিয়ে গঠিত।এবং কামরূপের রাজারা বরাবরই পশ্চিম ও পশ্চিম দক্ষিণ দিকেই নিজেদের রাজ্য সম্প্রসারণের চেষ্টা করতেন—পূর্ব দিকে নয়। সেই প্রয়াসের চূড়ান্ত প্রকাশই শশাঙ্ক-ভাস্করবর্মণের সংঘর্ষের পটভূমি তৈরি  করেছিল।”১৫১তিনি জানিয়েছেন কানিংহাম  Ancient Geography of India’ বইতে কোচবিহারের কামতাপুরকে কামরূপের রাজধানী চিহ্নিত করেছেন। সুজিৎ চৌধুরী লিখছেন,“পুণ্ড্রবর্ধন থেকে কামরূপের রাজধানীর যে দূরত্ব হিউ-এন-সাঙ দিয়েছেন,তা কামতাপুরের সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ,ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার কোনো স্থানের সঙ্গে যে তার সামঞ্জস্যবিধান সম্ভব নয়,তাও কানিংহাম দেখিয়েছেন।”১৫২এই তথ্য বা যুক্তিই চূড়ান্ত নাও হতে পারেকিন্তু যদি এটি হয়,এবং সেকরা ‘কালিয়া’-কে রাজধানী থেকেও ডেকে নেয়া হয়—তাহলেও সে ব্যক্তি আজকের আসামের কেউ নন,তিনি উত্তর বাংলার লোক।এবং কামরূপের বেশিটাই আজকের আসাম নয় --- উত্তর এবং পূর্ববাংলার মাটি।তা হলে কামরূপের উত্তরাধিকার নিয়ে এই বাঙালিদের আপত্তি করবার কিছু থাকে না।বস্তুত অসমিয়া –বাঙালির যৌথ দাবি প্রতিষ্ঠা পায়।এই অংশটির সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক গুরুত্বের কথা সুজিৎ চৌধুরী বোঝাচ্ছেন এই লিখে,“কামরূপের বর্মণেরা আর্যব্রাহ্মণ্য প্রভাবিত ছিলেন এবং এই প্রভাব যেখানে কার্যকর ছিল,সেখানেই রাজ্যবিস্তারের চেষ্টা করেছিলেন।আর্যব্রাহ্মণ্য প্রভাবের অগ্রদূত হিসাবে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা উত্তরবঙ্গ ও কামরূপকে একই সমন্বিত সংস্কৃতির আওতায় এনেছিলেন---আবার এই সংস্কৃতির বাহকেরাই পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের নূতন সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রদর্শনের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। গৌড়,কামরূপ ও সমতট নিয়ে আর্যপ্রভাবিত যে অঞ্চলটি গড়ে উঠেছিল,এই অঞ্চলের যেকোনো রাজাই নিজেদের শক্তি জাহিরের জন্য প্রথমেই এই পুরো অঞ্চলটার উপরেই আধিপত্য বিস্তার করতে চাইতেন।শশাঙ্ক যেভাবে কামরূপের  উপর অধিকার প্রয়োগ করতে চেয়েছেন,সে প্রয়াস পরবর্তী পাল,সেন বা চন্দ্রবংশীয় রাজারাও করেছেন,একই ভাবে বর্মণ বংশীয় বা শালস্তম্ভ বংশীয় কামরূপের রাজারাও করেছেন।সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিচারে গৌড়,কামরূপ ও সমতট তখন একটি বৃহত্তর ইউনিট হিসাবে বিবেচিত হতো১৫৩একই প্রসঙ্গে কবি-সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরী একটি নিবন্ধে চিত্তাকর্ষক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন,“একটি প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী,অসুররাজ বলি-র স্ত্রী বৃদ্ধ ও দৃষ্টিহীন আর্য ঋষি দীর্ঘতামসের পাঁচপুত্রের জন্ম দেন।জন্মসংক্রান্ত অযোগ্যতার কারণে এই পাঁচ পুত্র আর্য সমাজে স্থান না পেয়ে অনার্যতা প্রাপ্ত হন এবং তাদের নামেই আর্যাবর্তের বহিরভূত পাঁচটি কৌম জনপদের নাম হয়---অঙ্গ,বঙ্গ,কলিঙ্গ,পুণ্ড্র,এবং সূহ্মএখানে লক্ষ করার মত বিষয় এই যে,এই রূপক কাহিনিতে,পূর্বপ্রান্তীয় সকল আর্যবর্জিত অঞ্চলগুলি উল্লেখিত,এমন কি পুণ্ড্র পর্যন্ত;কিন্তু কামরূপের নাম নেই।এ থেকে এই সিদ্ধান্ত করা যায় যে উপরে উক্ত অতি প্রাচীন বৃত্তান্তটি যে সুদূরতম পুরাকালের স্মৃতি বহন করছে তখন কামরূপ আর্য সংস্কৃতি,আর্যভাষা ও আর্যজনের আশ্রয় হয়ে পড়েছে,যদিচ বাংলার অন্যান্য অংশ ও সন্নিহিত ভূখণ্ডগুলি অনার্য রয়েছে।”১৫৪প্নুণ্ড্র কোন ভূভাগ সে পরিচয় ইতিমধ্যে আমরা পেয়েছি।‘অঙ্গ’ হচ্ছে তার দক্ষিণে যেখানে পরে ছিল কর্ণসুবর্ণ ইত্যাদি।তার দক্ষিণে সমুদ্রপারে ‘সুম্ম’সুকুমার সেন লিখেছেন,“পতঞ্জলির পরে সুহ্ম নাম কলিঙ্গ নামে পরিচিত হইয়াছিল।”১৫৫কলিঙ্গ এখনকার ওড়িশার উত্তরের অনেকটার সঙ্গে পশ্চিম বাংলারও দক্ষিণের অনেকটা ছিল।কালিদাসের নাম যদিও গুপ্তরাজাদের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে,তাঁর ‘রঘুবংশ’-এ রঘুর দিগ্বিজয়ে সমুদ্রগুপ্ত নয়,অশোকের দিগ্বিজয়ের অনুসরণ করেছিলেন বলে সুকুমার সেনের অভিমত।১৫৬রঘু দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে পূর্ব দেশে এসে প্রথমে এখনকার পশ্চিমবঙ্গে সমুদ্র তীরে ‘সুহ্ম’দের জয় করলেন, পরে আরো পুবে ‘বঙ্গে’ প্রতিরোধের মুখে পড়েন,যদিও শেষে বিজয়ী হনএই ক্রমে ‘কামরূপে’র নাম না থাকাতে সুকুমার সেন কিছু বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।১৫৭সেই সঙ্গে লিখেছেন,রঘু পূর্ব দক্ষিণ থেকে দিগ্বিজয় আরম্ভ করে দক্ষিণ, পশ্চিম জয় করে উত্তরের হিমালয়ের নিচের প্রদেশগুলো জয় করতে করতে এসে কামরূপে পৌঁছেছিলেনসুম্ম এবং বঙ্গে কোনো রাজা ছিলেন না,কিন্তু কামরূপে ছিল।তিনি সেই রাজাকেও পরাস্ত করেন।সুকুমার সেন লিখছেন,“কালিদাসের এই বর্ণনা অত্যন্ত খাঁটি এবং তাৎপর্যপূর্ণ।তখনকার দিনে বাঙ্গালাদেশের সঙ্গে প্রাগজ্যোতিষ-কামরূপের কোনো স্থলবর্ত্মের সম্ভাবনাও ছিল না।তখনকার প্রাগজ্যোতিষ-কামরূপ (এখনকার উত্তর পূর্ববঙ্গ ও আসাম) সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন ছিল।ঐ দেশের সহজ যোগাযোগ ছিল হিমালয়ের পাদদেশ ধরিয়া উত্তরাপথের সঙ্গে।রঘু সেই পথ দিয়াই কামরূপ জয় করিয়াছিলেন।বাঙ্গালাদেশের সঙ্গে প্রাগজ্যোতিষ-কামরূপ অঞ্চলের প্রাচীন কালে সরাসরি যোগ না থাকিলেও এই দুর্গম স্থানে যে প্রত্ন-বাঙ্গালী উপনিবিষ্ট হইয়াছিল তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই।তার প্রমাণ অসমীয়া ভাষা। এ ভাষা বাঙ্গালার যমজ ভগিনী।”১৫৮এখানে সুকুমার সেন শোনাচ্ছেন সেই বহু আগে করা বঙ্কিমের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি, “বাঙ্গালা যে সময়ে অনার্য্যভূমি,সে সময়ে আসাম যে আর্য্যভূমি হইবে,ইহা এক বিষম সমস্যা।কিন্তু তাহা অঘটনীয় নহে। মুসলমানদিগের সময়ে ইংরেজদিগের এক আড্ডা মান্দ্রাজে,আর আড্ডা পিপ্পলী ও কলিকাতায়,মধ্যবর্ত্তী প্রদেশ সকলের সঙ্গে তাহাদের কোন সম্বন্ধ নাই।” 

সুতরাং যখন কামরূপের কথা আসবে,কামরূপী প্রাকৃত বা লিপির কথা আসবে এই ইতিহাসক্রম থেকে অসমিয়াদের অভিমানকে মর্যাদা না দেবার কোনো সঙ্গত কারণ থাকতে পারে না।কিন্তু একই সঙ্গে এও সত্য যে এই অভিমানের শরিক কেবল অসমিয়া একাও নন,বাঙালি এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য আর্যভাষীদের ভাগও অস্বীকার করবার অসমিয়া-বাঙালি কোনো পক্ষেই কোনো ঐতিহাসিক,সাংস্কৃতিক কারণ থাকতে পারে না।এই উত্তরাধিকার যৌথ উত্তরাধিকার

সুকুমার সেন নিধনপুর লিপি প্রসঙ্গেও প্রশংসাতে পঞ্চমুখ।কিন্তু এখানেই তিনি এক বিকল্প তর্কেরও অবতারণা করেছেন।বাংলাদেশে যে সব ফলক পাওয়া গেছে সেগুলোর পরিচয় দিতে গিয়ে প্রথমেই প্রাকৃতে লেখা অশোকের মহাস্থান গড়ের শিলালিপির কথাটি উল্লেখ করেছেনসেই লিপির কাল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক।১৫৯ মহাস্থানগড় এখনকার বাংলাদেশে,আমরা লিখে এলাম।প্রায় সহস্রাব্দ কাল পরে এরই আশেপাশে  ‘চন্দ্রপুরী’ বিষয়াতে ভূতি বর্মণ ব্রাহ্মণ বসতি করিয়েছিলেন বলে অসমিয়া পণ্ডিতেরা দাবি করেন।এই কথাটি মনে রাখা ভালো।কিন্তু এই ফলক আকারে ছোট,তায় পুরোটা মেলে নি।দ্বিতীয়টি পাওয়া গেছে সাত শতক পরে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের অর্থাৎ সমুদ্রগুপ্তের কালের এখনকার পশ্চিম বাংলার বাঁকুড়ার কাছে শুশুনিয়া পাহাড়ে।স্থানীয় কোনো রাজা সিংহ বর্মা বা তাঁর ছেলে চন্দ্রবর্মা এই ফলক লিখিয়েছিলেন।এর ভাষা সংস্কৃত১৬০ গুপ্ত রাজাদের আমলের আট দশখানা তাম্রফলক মিলেছে। সেগুলোর মধ্যে সবচাইতে প্রাচীন কুমার গুপ্তের আমলের তিনখানা ফলক।তার মধ্যে একটি পাওয়া গেছে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার নাটোরের ধানাইদহ গ্রামে। এর লিপি কাল ৪৩২ খ্রিস্টাব্দ,অর্থাৎ পঞ্চম শতক। বাকি দুটি দিনাজপুরের দামোদরপুর গ্রামে। সেও এখনকার বাংলাদেশ এবং মহাস্থানগড়ের কাছাকাছি এলাকা।লিপি দুটো ৪৪৪ ও ৪৪৭ খ্রিস্টাব্দের।১৬১ এই অব্দি সুকুমার সেনের উপস্থাপনা নিরস তথা উচ্ছ্বাসহীন।এর পরেই তিনি লিখছেন নিধনপুর লিপির কথা। আমরা তার পুরোটাই তুলে দিচ্ছি,“এখনকার বাঙ্গালাদেশের বাহিরে আসামে পাইতেছি কামরূপাধিপতি ভাস্করবর্মার শাসন।ভাস্করবর্মা ছিলেন হর্ষবর্ধনের মিত্র।ইঁহার সহযোগিতায় হর্ষবর্ধন গৌড়রাজ শশাঙ্ককে পরাজিত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।সংস্কৃত সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গদ্য লেখক বাণভট্ট হর্ষবর্ধনের সভাকবি ছিলেনযিনি ভাস্করবর্মার নিধনপুর-শাসনের খসড়া করিয়াছিলেন তিনি বাণভট্ট হওয়া অসম্ভব নয়।যদি অন্য কোন কবি হন তবে তিনি গদ্য লেখায় বাণভট্টের চেয়ে খাটো ছিলেন না।অনেককাল পূর্ব হইতে বাঙ্গালা দেশে গদ্য রচনায় একটি বিশিষ্ট রীতির উদ্ভব হইয়াছিল।ইহাই অলঙ্কার শাস্ত্রে গৌড়ী রীতি নাম পাইয়াছে।গদ্যে গৌড়ী রীতির খাঁটি নিদর্শন পাইলাম ভাস্কর বর্মার এই অনুশাসনে।আর্যা ছন্দে ধারাবাহিক শ্লোকরচনার নিদর্শনও পাইতেছি।”১৬২ তিনি এর পরে সেই গদ্যের কিছু নিদর্শন দিয়েছেন,আমাদের সেসবে আপাতত দরকার নেই।এই সময় থেকেই এইসব ফলক ‘সাহিত্যগুণসমৃদ্ধ’ হতে শুরু করে।তিনি পরে লিখছেন,“ভাস্কর বর্মার শাসনের কথা ছাড়িয়া দিলে সাহিত্যগুণ সমৃদ্ধ শাসন-রচনার নিদর্শন পাল-রাজাদের সময় হইতে মিলিতেছে।”১৬৩বোঝা গেল ‘কামরূপী প্রাকৃত এবং লিপি’র সঙ্গে এখানে ‘গৌড়ী রীতি’র অলঙ্কার শাস্ত্রের একটি তর্ক এসে হাজির হলো।সুকুমার সেনের প্রথম বাক্যে সামান্য বিভ্রান্তির সুযোগ রয়েছে।নিধনপুর তো এখনকার বাংলাদেশে। যেখানে জমি দিয়েছিলেন এবং যেখানে ফলক লিখিয়েছিলেন সেসবই এখনকার অসমের বাইরের।তাহলে তিনি ‘বাঙ্গালাদেশের বাহিরে আসামে পাইতেছি’ লিখলেন কেন? প্রথম কথা, এতশত তিনি এখানে ভাবেন নি,কারণ লিখছিলেন সাহিত্যের ইতিহাস। সেদিকেই তার নজর গেছে।দ্বিতীয়ত তাঁর ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ প্রথম বেরোয় ১৯৪০এ।তখন এখনকার সিলেটের পুরোটাই,মায় নিধনপুরও বাংলাদেশের বাইরে অসমের ভেতরেই ছিল।এখানে এসে ফলক লেখক ‘কালিয়া’র জন্যে কে খসড়া করে দিতে পারেন তাঁর একটি সম্ভাব্য নাম পাচ্ছি।তিনি নিশ্চিত নন,আমরাও নই।কিন্তু এই তথ্যটি মনে হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বাংলা উপন্যাসের নাম ‘শ্রীভূমির বাণভট্ট’সেখানে লেখক মানবেন্দ্র ভট্টাচার্য বাণভট্টকে একেবারেই এখনকার আসামের করিমগঞ্জ জেলার জাতক রূপে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র করে এঁকেছেনবাণভট্ট এখানেই প্রাথমিক শিক্ষাদীক্ষা অর্জন করছেন,বদরপুর অঞ্চলে,কাছাড়ের উত্তরাংশ কাটিগড়াতেও নাটক করে বেড়াচ্ছেন এবং হর্ষের রাজ্যে পৌঁছাবার আগেই ভাস্করবর্মার রাজদরবারেও তাঁর খ্যাতি গিয়ে পৌঁছোচ্ছে।১৬৪তিনি কোনো ইতিহাসের সূত্র দেন নি।আমরা একে পুরোটাই ‘উপন্যাস’ বলেই খারিজ করতে পারি।‘শ্রীহট্টকাছাড়ের বাণভট্ট—প্রাচীন ইতিহাসের বিস্ময়’- এরকম নামে তাঁর একটি স্বতন্ত্র বই অবশ্য রয়েছে।কিন্তু ধরা যাক বাণভট্ট এখানকারই লোক,তাহলে সেই সব মানুষেরই একজন বা আত্মীয় যারা ভাস্করবর্মণকে ফলকটি আবার তৈরি করে অনুমোদন জানাবার আর্জি জানিয়েছিলেন।  

নিধনপুর লিপির কথাতে আমরা আবার পরে ফিরব উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীর লিপি চিন্তা বুঝতে গিয়ে।উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীও নলিনী সান্যাল,সুকুমার সেন বা রামেশ্বর শ’য়ের মতোই মানব সভ্যতার লেখনকলার উদ্ভব থেকে শুরু করেছেন।কিন্তু বাকিরা যেভাবে প্রাচীন লিপির মূল চার ভাগের উল্লেখ করে,অশ্রেণিবদ্ধ লিপিগুলোর উল্লেখ করেছেন—তিনি সেরকম কিছু না করে লিখেছেন,“পৃথিবীর লিপিবোরক প্রধান দুটা ভাগত ভগাব পারি: ১) যিবোর লিপিত অক্ষর বা বর্ণ নাথাকে,যেনে –চীনা বা বাণমুখ লিপি আরু ২) যিবোর লিপিত অক্ষর বা বর্ণ থাকে,যেনে---রোমান,দেবনাগরী, অসমীয়া ইত্যাদি।”১৬৫ তারপরে তিনি সরাসরি ব্রাহ্মী,খরোষ্ঠীর কথাতে এসে গেছেন,“সিন্ধুলিপির কথা এরিলে ভারতর প্রাচীন লিপি হিছাপে দুটা লিপির কথাই মনলৈ আহে।তারে এটা খরোষ্ঠী আরু আনটো ব্রাহ্মী।”১৬৬ ব্রাহ্মীর দেশি বিদেশি উৎসের বিতর্কের তিনি উল্লেখ করেছেন,কিন্তু কোনো নিজস্ব অভিমত দেন নি।লিপিবিদ ভোলানাথ তেওয়ারি তাঁর ‘ভাষা-বিজ্ঞান’ বইতে সিন্ধু লিপির দশটি হরফের সঙ্গে ব্রাহ্মীলিপির দশটি হরফের মিল দেখিয়েছিলেন,আরো কেউ কেউ নিজেদের রচনাতে সেগুলোর ‘স্বীকৃতি’ দিয়েছেন,এরকম একটি মন্তব্য করে তিনি হরফগুলোর একটি ছবি দিয়েছেন। আমরাও সেটি দেখাচ্ছি চিত্র-১৭-তে১৬৭

এর পরে তিনি ব্রাহ্মী লিপি সম্পর্কে যে তথ্য দিচ্ছেন,সেটির উপস্থাপনাটি খানিক  জটিলতিনি লিখছেন তিনশ পঞ্চাশ খৃষ্টাব্দের পরে ব্রাহ্মী দুই মূল ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়—উত্তর ব্রাহ্মী এবং দক্ষিণ ব্রাহ্মী।“উত্তর—ভারতর লিপির দুটা প্রধান লিপির এটা হ’ল গুপ্ত লিপি আরু আনটো কুটিল লিপি১৬৮মনে হবে ‘কুটিল’ লিপি সম্পর্কে এই অব্দি আমরা যা জেনে এলাম তার সম্পূর্ণ বিপরীত এই কথা।অর্থাৎ গুপ্ত –কুটিল দুই লিপি একই কালে ছিল বুঝি বা।পরে কিন্তু ব্যাখ্যা করে লিখছেন,“গুপ্ত লিপির পরা কুটিল-লিপির বিকাশ ঘটে...ষষ্ঠ শতিকার পরা নবম শতিকালৈকে উত্তর-ভারতত প্রচলিত লিপিক (ই গুপ্ত-লিপির পরিবর্তীত রূপ) কুটিল লিপি বুলি কল্পনা করা হৈছে।”১৬৯‘কুটিল’ নামের একটি উৎস এখানে পাওয়া যাচ্ছেভোলানাথ তেওয়ারির কথাটি তিনি অনুবাদে দিয়েছেন,“স্বরর মাত্রাবোরর আকার কুটিল বা বেঁকা হোয়া কারণে ইয়াক কুটিল বুলি কোয়া হৈছে।”১৭০গৌরী শঙ্কর হীরাচান্দ ওঝার ‘ভারতীয় প্রাচীন লিপিমালা’-র থেকে আরো লিখেছেন,“এই লিপির আখরবোরর বেছি ভাগতে মূরটো ‘V’র নিচিনা হয়।স্বরর মাত্রাবোর বেছি অঁকা-বেঁকা আরু দীঘল।”১৭১এই যদি কুটিলের সংজ্ঞা হয় তাহলে যুক্তির দিক থেকে কিন্তু এর একই সঙ্গে কামরূপী হতেও অসুবিধে থাকবার কথা নয়,কারণ নামটি কোনো ভূগোলের দ্যোতক নয়।আমাদের শুধু দেখতে হবে হরফের আকারে সত্যি কোনো তফাত রয়েছে কিনা।স্বরের মাত্রা কিন্তু আধুনিক অসমিয়া বাংলারও আঁকা-বাঁকাই। 

 

এই “কুটিল-লিপির পরা প্রাচীন নাগরী আরু শারদা-লিপির উদ্ভব হৈছে বুলি পণ্ডিতসকলে মত প্রকাশ করিছে।”১৭২নাগরীর বেশ কিছু বৈচিত্র্যের উল্লেখ এর পরে তিনি করছেন তাতে দেবনাগরী,গুজরাটি,মহাজনী,মহারাষ্ট্রী  ইত্যাদির সঙ্গে কায়েথি,নেওয়ারিও রয়েছে।শারদা লিপির থেকে টাকরী,লণ্ডা,ডোগ্রী,ইত্যাদি এসেছেদক্ষিণ ব্রাহ্মীর থেকে তামিল,তেলেগু,মালয়ালম,কন্নড়,গ্রন্থ,টুলু ইত্যাদি লিপি বেরোয়।এছাড়াও শ্রীলঙ্কা সহ ব্রহ্মদেশ,কোরিয়া,ফিলিপাইন্স ইত্যাদি দক্ষিণ পুব এশিয়ার লিপিগুলো বেরোয়।এই দক্ষিণ ব্রাহ্মীরই একটি বৈচিত্র্য আহোম এবং খামতি লিপি।এই ক্রমে তিনি বাংলা-অসমিয়া আদির কথা উল্লেখ করেন নি।শুধু লিখেছেন এগুলো উত্তর ব্রাহ্মীর সঙ্গে সম্পর্কিত লিপি।১৭৩অসমিয়া লিপি নিয়ে তিনি পরের অংশে স্বতন্ত্র আলোচনা করছেন।লিখছেন,“অসমীয়া লিপিটো পূর্ব-ভারতর এটা লেখত ল’বলগীয়া লিপিবহু শতিকা জুরি চলা চিন্তা-চর্চার এক দীঘলীয়া ইতিহাসক সামরী অসমীয়া লিপিটোয়ে বর্তমানর রূপ পাইছে।”১৭৪তাঁর আগে যারা এই লিপি নিয়ে ভেবেছেন,তাঁদের মধ্যে সর্বেশ্বর কটকীর একটি মন্তব্য তিনি উল্লেখ করেছেন,“ব্রাহ্মী –লিপি প্রথম,কুশান-লিপি দ্বিতীয়,গুপ্ত-লিপি তৃতীয়,আরু এই গুপ্ত-লিপির পুবভারতীয় কুটিল-লিপি চতুর্থ,আরু এই কুটিল-লিপির পরিবর্তন আরু সংমিশ্রণ ঘটি ঘটা কামরূপ-লিপি বা পুরণি অসমিয়া লিপিয়ে পূর্বভারতীয় ভাষার বংশ-লতিকাত পঞ্চম স্থান অধিকার করিছে বুলি স্থির করিব পারিআরু এয়ে অসমীয়া লিপির উৎপত্তি।”১৭৫‘অসমীয়া লিপির মূল সন্ধান করতে গিয়ে প্রথম যে শিলালিপির সন্ধান মেলে সেটি পঞ্চম শতকের সুরেন্দ্র বর্মার উমাচলের শিলা-লিপি।এরও আগেকার একখানা নগাজরী-খনিকর গ্রামের প্রস্তর-লিপি।এখানে তিনি ‘নগাজরী-খনিকর গাঁও-প্রস্তরখণ্ড-লিপি’ নামে মুন্দমাধব শর্মার একটি প্রবন্ধের খানিকটা উদ্ধার করেছেন।কিন্তু ছাপা-ত্রুটির জন্যে এর শেষটা বোঝা গেলেও শুরুটা বোঝা যাচ্ছে না।আমরা ধরে নিচ্ছি এখান থেকে,“সমুদ্রগুপ্তর প্রয়াগ-শিলাস্তম্ভ-লিপি আদির দরে ইয়াতো ‘ব’ আরু ‘ৱ’ আখরর পার্থক্য রখালৈ চাই,আনহাতে উমাচল-লিপির পরা আরম্ভ কৰি পৰবর্তী সকলো শিলা-লিপি আরু তাম্রলিপিতে অধিক পরিমাণে স্থানীয় ভাষার প্রভাব পরালৈ চাই আরু ‘ব’ আরু ‘ৱ’ আখরর কোনো পার্থক্য নথকালৈ চাই,ইয়াক সংস্কৃত ভাষাত লিখিত এতিয়ালৈকে আবিষ্কৃত অসমর প্রাচীনতম লিপি বুলি ভাবিবর অবকাশ আছে।”১৭৬উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীর  বক্তব্য হচ্ছে  এর হরফের সঙ্গে কুটিল লিপিকে মেলাবার কোনো যুক্তি নেই। কুটিল লিপির জন্মকাল ধরা হয় ষষ্ঠ শতক থেকে,কিন্তু পঞ্চম শতক থেকেই অসমে শিলালিপির নিদর্শন রয়েছে।এই শিলালেখের অধিকাংশ হরফই গুপ্তলিপির সঙ্গে একই।বিশেষ করে,“শিলালিপি দুখনর ই,ক,খ,গ,চ,জ,ড,ণ,ত,দ,ধ,ন, প,ব,ভ,ম,য,ৰ,ল,ৱ,শ,ষ,স,হ আরু ৰা,জা,ণা,ধি,কী,গু,কৃ আদির রূপ গুপ্ত আখরেরে সৈতে একে১৭৭মোটের উপর কথাগুলো সঠিক।কিন্তু এর মানে বাকি হরফ গুলোতে তফাত আছে।তিনি এখানে পাশাপাশি এই দুই শিলালেখ এবং গুপ্ত লিপির এই  হরফগুলোরই  ছবি দিয়েছেন।আমরা দেখব,সেগুলোও সবই হুবহু এক নয়।না হওয়াটাই স্বাভাবিক। একেতো হাতের লেখা,তায় লিপি বিচার করবার সময় ছাপাজমানার মনস্তত্ত্ব ছেড়ে আমাদের তাকাতে হবে।চিত্র ১৮ ক, খ, গ এবং ঘ-তে সেগুলো রইল।১৭৮

 


 

 

          তিনি এরপরে লিখেছেন,“ ...সপ্তম শতিকার ভাস্করবর্মার তামর ফলির আখরবোর চালে সেইবোরত ব্রাহ্মী আরু গুপ্তলিপির আখরর পরম্পরা রক্ষিত হোয়া দেখা যায়।”১৭৯পরম্পরা রক্ষিত হবার কথাটি আমরা বাংলা–মৈথেলি সম্পর্কেও বলতে পারি। সেটি সম্ভবত তিনিও অস্বীকার করবেন না।কিন্তু পরম্পরা রক্ষাকে যেন ‘সমরূপতা’র অর্থে না পড়ি। দুটোই যে আগেকার লিপি থেকে পালটে গেছে,এবং নিজেরাও বহু ভিন্ন সেই কথা তিনি লিখছেন।এখানে এও মনে রাখা ভালো যে ডুবি নামে অসমে একাধিক গ্রাম থাকলেও এখানে এখনকার বরপেটা জেলার কথা হচ্ছে।১৮০তিনি লিখছেন, “কেইটামান আখরর অবশ্যে ইতিমধ্যে পরিবর্তন ঘটিছেভাস্কর বর্মার তাম্র –শাসন কেইখনরও ডুবির তাম্র-শাসন আরু নিধনপুর-তাম্র-শাসনর গঢ় সুকীয়া হৈ পরিছে।নিধনপুর আরু ডুবির তাম্র-শাসনত আখরর পার্থক্য আ,ক,তু,ব,য,ৰ, ল,স আদি আখরত প্রকট হয়।নিধনপুর –তাম্র-শাসনর ক,ব,ল আদি আখরবোর একেবারে আধুনিক রূপর।”১৮১এই হরফগুলোর ছবি তিনি পাশাপাশি দিয়েছেন। আমরা চিত্র ১৯-এ দেখাচ্ছি।১৮২


স্পষ্ট দেখা যাবে মোটের উপর একই কালের দুই শাসন হলেও ডুবি শাসনের হরফ শৈলী নিধনপুর লিপির শৈলী থেকে বেশি প্রাচীন পরম্পরাকে অনুসরণ করেছে। সেটি গুপ্ত লিপির কাছা কাছি।এই ছবিতে ‘ৰ’ থাকলেও ‘অন্তস্থ ব’ নেই। কেন নেই?‘ ‘ব’ আরু ‘ৱ’ আখরর পার্থক্য রখালৈ চাই’ কথাটির তবে কী হবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন,এই সব বৈচিত্র্য নিয়েও যদি এরা একই লিপি পরিবারের সদস্য হতে পারলো, তা হলে ‘কুটিল-লিপির পরিবর্তন আরু সংমিশ্রণ ঘটি ঘটা কামরূপ-লিপি’ বলে কুটিল এবং কামরূপীকে কষ্ট করে স্বতন্ত্র করা কেন?কেন একে ‘কুটিল পরিবার’-এর সদস্য বলে মেনে নিতে পারছি না? বা একত্রে বলছি না ‘কামরূপী কুটিল’—দুই নাম যে দুই ভিন্ন মাপদণ্ডের চিহ্নায়ক সে তো আমরা উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীর থেকেই দেখলাম।  প্রথম প্রশ্নের উত্তরে আমরা মুকুন্দমাধব শর্মারই একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য তুলে দিচ্ছি,“No Distinction has been maintained between v and b in all the inscriptions up to the Kanai Barasi Bowa Inscription.A v of the modern distinctively Assamese form with the slanting dash below the main triangle is found for the first time in the Nilachal Kamakhya Rock Inscription. (PS plate 3) The triangle with angular ends is noticed as early as in the Nidhanpur plates.But the vertical line remaning the same,the angular parts often become curved also as in the Plates of Harjara and Vanamāla”১৮৩নীলাচল প্রস্তর লিপি বহু পরের।পঞ্চম শতকে প্রায় একই জায়গাতে রাজা মহেন্দ্রবর্মণের একটি লিপি পাওয়া গেছিল,তফাত বোঝাবার জন্যে সেটি উমাচল লিপি বলে পরিচিত।১৮৪তাহলে দেখা যাচ্ছে,‘কানাই বরসি বোয়া’ অব্দি  ‘ব’-এ ‘ৱ’-এ তফাত করা হচ্ছে না।এই ‘কানাই বরসি বোয়া’টি উত্তর গুয়াহাটিতে পাওয়া ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ১৮৫ অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতকের প্রস্তর ফলক।অর্থাৎ যখন থেকে প্রত্ন-অসমিয়ার থেকে অসমিয়া লিপি বেরিয়ে আসছে।হরজর মানে হচ্ছেন রাজা হরজরবর্মণ।তাঁর ফলকটি তেজপুরের কাছে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে পাওয়া গেছে।৮২৯ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ নবম শতকের ফলক।তাঁর আরেকখানা খণ্ডিত ফলক মিলেছে কার্বি আঙলঙের হায়ুংথালে।১৮৬আর বনমাল হচ্ছেন তাঁরই পুত্র বনমালবর্মণ।তাঁরও একাধিক ফলক মিলেছে,তার একটি  তেজপুরে,একটি তারই কাছে পার্বতীয়াতে।তাঁর পরের বলবর্মণের লিপি একটি কার্বি আঙলঙের হাওরাঘাটে,একটি নগাঁওর পুরনিগুদামের কাছে ছুতারগাঁওতে,একটি দরঙ জেলার উলুবাড়িতে।সবই নবম শতকের মাঝামাঝি থেকে শেষদিককার। জেলা নামগুলো এখন কিছু এদিক ওদিক হওয়াই সম্ভব।আমরা হেড়ম্ব কুমার বরপুজারী সম্পাদিত সংকলনের প্রথমখণ্ডে দীনেশ চন্দ্র সরকারের ‘Sources of Early History’ নিবন্ধ থেকে তথ্যগুলো সংগ্রহ করলাম।১৮৭তার মানে এই মাঝের সময়টিতে সাধারণভাবে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় যে লিখছিলেন ‘ব’-এ ‘ভ’-এ একটি বিভ্রান্তি হচ্ছে সেসব এখানে এই আসামেও হয়ে থাকবেনতুবা মাঝের সময়টিতে কেন ‘Distinction has been maintained’ হবে না? আমরা আগে চিত্র ১৫ক,খ ইত্যাদিতে কল্যাণ কিশোর এবং চিত্র ১৬তে রামেশ্বর শ’য়ের যে লিপি নমুনা দেখে এলাম সেখানেও কিন্তু ‘অন্তস্থ ব’ গুপ্ত এবং কুটিল নমুনাতে নেই। যেভাবে এখানে নেই উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীতে।

              এবারে ‘কুটিল’ প্রসঙ্গ নিয়ে ভাবা যাক।কল্যাণ কিশোরের চিত্রগুচ্ছ ১৫ ক,খ,গ এবং রামেশ্বর শ’য়ের চিত্র ১৬র গুপ্ত-কুটিল নমুনার থেকে উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীর চিত্র ১৯শের ডুবি নিধনপুর লিপির নমুনা কি খুব ভিন্ন? পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ডুবি লিপিগুলো গুপ্তের কাছাকাছি,এবং নিধনপুর কুটিলের কাছাকাছি।আরেকটি বিষয় মনে হয় উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী এবং সেরকম অনেকেই ভাবেন নি,তা এই যে লিপি বা হরফ বৈচিত্র্য হচ্ছে কেন? যে রাজার নামে ফলক সেই রাজা এক ব্যক্তি হলেও লিপিলেখক এবং তাদের স্থান-কাল ভিন্ন হতেই পারে।একই লেখক ভিন্ন সময়ে লিখলেও লেখার ছাঁদ ভিন্ন হতেই পারে।এমনকি একই লেখকের একই কালের লেখাতে একেকটি হরফ কালবৈচিত্র্য রক্ষা করতে পারে,অর্থাৎ একটি যদি পুরোনো ছাঁদ রক্ষা করছে অন্য হরফ তখন ছাঁদ বদলে ফেলেছে।রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নলিনী সান্যাল থেকে শুরু করে অনেকেই তাই প্রতিটি হরফ ধরে ইতিহাস সন্ধান করছেন।লিপিবিদেরা তাই করেন। আমরা বিরক্তি বাড়াতে পারে বলে সে পথে এগোই নি,উপেন্দ্রনাথও সেরকম করেন নি। সে জন্যেই তিনিও সব স্তরের সব হরফের নমুনা একত্রে দিতে পারছেন না।এই সব হয় বলেই  তিনি যখন ব্রাহ্মী লিপির নজির দিচ্ছেন,সেখানে হরফ প্রতি এতো বৈচিত্র্যআমরা তাঁর নমুনা দেখাচ্ছি,চিত্র ২০-ক,খ,গ এবং ঘ-তে১৮৮সঙ্গে রইল নলিনী সান্যালের নমুনাগুচ্ছ চিত্র ২১ ক এবং খ-তে।১৮৯দেখা যাবে দুটো প্রায় একই।উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীর নমুনার বৈচিত্র্য অনেক বেশি। সেগুলোকে যদি আমরা বৈচিত্র্য ধরে স্বতন্ত্র করবার কথা ভাবছি না,তবে কুটিল-কামরূপীর সংসার ভাঙার কথা ভাবছি কেন? ডুবি এবং নিধনপুরের লিপি একই রাজার ফলক হলেও দুই লিপি লেখানো হয়েছে কামরূপ রাজ্যের পুব -পশ্চিম দুই প্রান্তে পশ্চিমেরটি লেখানো হয়েছে গৌড়ে,এখনকার মুর্শিদাবাদ জেলাতেপরেও যেটি দীর্ঘদিন বাংলার রাজধানী এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হবে। সেই গৌড়ে যখন লিপি কুটিল বা কামরূপী স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে,যাকে আমরা আজ কামরূপ বলে জানি সেই পুবপ্রান্তে তখনো গুপ্তশৈলী অনুশীলিত হচ্ছে ডুবি হরফের সঙ্গে উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীর চিত্র ১৮র হরফ গুলো মিলিয়ে দেখলেও বোঝা যাবে সেগুলো অনেকটাই গুপ্তলিপির সঙ্গে একই।অন্যদিকে কুটিল বলে তিনি কোনো হরফের বিস্তৃত পরিচয় দেন নি।কুটিলকে নাকচ করছি অথচ তার নমুনা মাত্র অতি অল্প দিচ্ছি,তাও হরফ গুলো অন্যদের মতো স্বতন্ত্র দেখিয়ে নয়--- বিষয়টি নিরাসক্ত পাঠককে সমস্যাতে ফেলবার পক্ষে যথেষ্টবিশেষ করে পাঠক যদি অসমিয়া-মন নিয়ে না পড়েন। দিলে ভালো করতেন। তিনি যেটুকু দিলেন, সেটুকু চিত্র ২২শে দেখাচ্ছি।১৯০এর সঙ্গে চিত্র ১৫,১৬-তে দেয়া কুটিলের নমুনা মিলিয়েও দেখা যেতে পারে।আমরা আরেকটি দিচ্ছি নলিনী সান্যালের থেকে চিত্র ২৩-শেসম্ভবত হুমায়ুন আজাদ এগুলো হাতে লেখা পাঠ থেকেই ছাপিয়েছেন,ফলে সবটা নেই।ট থেকে রয়েছে,এবং উপস্থাপন সামান্য বিশৃঙ্খল এবং অস্পষ্টকুটিল-নাগরী পাশাপাশি রেখেছেন।তবু তফাতটি বোঝা যায়।এখানে কিন্তু ‘অন্তস্থ ব’ রয়েছে। ‘বর্গীয় ব,অন্তস্থ য,র,ল,স’ অনেকটাই নিধনপুর লিপির কাছাকাছি এসে গেছে।
 





 





 

উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী এর পরে নবম শতকের বলবর্মার লিপি থেকে বেশ কিছু হরফের নজির দিচ্ছেন,সেগুলো নিধনপুর লিপির থেকেও এগোচ্ছে চিত্র ২৪এ সেগুলো আমরা দেখাচ্ছি।১৯১অনেকটাই চর্যার লিপির কাছাকাছি আসছে। এও ঠিককিন্তু কুটিল চেহারা একেবারেই ছাড়ছে না। যেমন ‘গ’ চিত্র ১৬-র কুটিল ‘গ’-এর সঙ্গে মিলবে।‘ঘ’-ও তাই, ‘ঞ’ বরং চিত্র ১৬তে অনেক স্পষ্টতিনি যেটি ‘ঢ’ দেখিয়েছেন চিত্র ১৫ খ-তে সেটি ‘ট’ দেখাচ্ছে,‘ফ’ অনেকটাই কাছাকাছি,‘য,ল,ষ,স’ চিত্র ১৫ গ-তে অনেকটা একই।কিন্তু যেখানে তিনি নিজেই ত্রয়োদশ শতক অব্দি একটি যুগ বিভাজন করছেন,সেখানে এই হরফ গুলোকে “আধুনিক অসমীয়া আখরর গঢ় ল’বলৈ উপক্রম করে”১৯২বা “ব্যঞ্জন-বর্ণবোরর বহুখিনি আধুনিক রূপর কাষ চাপে”১৯৩লিখে চলেছেন কেন বোঝা মুশকিলতখনো বহু হরফের আধুনিক অসমিয়ার কাছাকাছি আসতে বহু বাকি,কিছু কিছু যদিও আসছে। যেমন ‘গ,ত,থ,ন,ফ,ব,ম,য,ল,ষ,স’কিন্তু ‘ং’ তিনি যেটি দেখিয়েছেন,সেটি নিয়ে সমস্যা হতে তো বহু বাকি।তখনো ঁ নেই,ড়,ঢ়,য় এই সব নেই।সব চে’য়ে বড় কথা তাঁর এই নমুনাতেও ‘অন্তস্থ ব’ নেই।‘র’ আছে যুক্তাক্ষর বা যুগ্মাক্ষর তালিকাতে,সেটি কী রকম আমরা পরে দেখাচ্ছি।কিন্তু অনুস্বার যে তখনো হরফের উপরে ডানে বৃত্তও নয়,এখনকার দেবনাগরী শৈলীর মতো হরফের উপরে বিন্দু,সে তো তার দেওয়া লিপি পাঠের নমুনাতেই দেখাচ্ছে। চিত্র ২৫ এ সেটিই রইল।১৯৪এই পাঠে ‘পুৰমধ্যুৱাস’ কথাটিতে তিনি অসমিয়া লিপ্যন্তর করতে গিয়ে ‘ৱ’ ব্যবহার করেছেন।কিন্তু মূল পাঠে কিন্তু ‘বর্গীয় ব’-এর থেকে সামান্যই ভিন্ন। সেরকম ‘অন্তস্থ-ব’-এর জন্যে আমাদের নলিনী সান্যালের কুটিল লিপির নমুনা চিত্র ২৩-এর দিকে তাকাতে হবে।বলবর্মার লিপিতে যুগ্মাক্ষর গুলো অনেকটাই আধুনিক রূপের মতো বটে,কিন্তু ‘র-ফলা’ যুক্ত শুরুর দু’টি বাদ দিলে বাকিগুলোর হরফ তখনো চেনা যাচ্ছে।কিন্তু সে যে কয়েকটিতেই তথা ‘কিছুমান’১৯৫ হরফেই মাত্র,সেটি তিনি পরে লিখছেন,-- ত্রয়োদশ শতক অব্দি যুক্তাক্ষরের বিকাশের সারাৎসার লিখতে গিয়ে। সেখানে তিনি এও লিখছেন,একের নিচে আর ব্যঞ্জন জুড়ে যুক্তব্যঞ্জন গড়বার রীতিটিই প্রাচীন,আধুনিক রূপ হচ্ছে দুয়ে মিশে যাওয়াআমরা যুক্তাক্ষর তর্কে পরিসরের জন্যে প্রবেশ করব না।শুধু উল্লেখ করব যে,এখানেও দেখা যাচ্ছে প্রথম দু’টি বাদ দিলে একের নিচে বা পাশে  হরফগুলোকে স্পষ্টজুড়ে দেওয়া হয়েছে।তখনো চেনা কষ্টকর করে ‘ঞ্জ’ আসেনি,বোঝা যাচ্ছে।চিত্র ২৬-এ সেগুলো দেখা যাবে।১৯৬আধুনিক ছাপাপ্রযুক্তির কালে যুক্তাক্ষরগুলো বাংলা অসমিয়া লিপিতে হুবহু একএবং যাদের শুধুই বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিতি আছে,তাঁরা এদের অনেকগুলোই পড়তে পারবেন না,কেননা তার আকার ভিন্ন। যেমন ‘ঞ্জ’-তে ‘জ’,‘ঞ’ রয়েছে,বলে না দিলে কে ধরতে পারবেন?এখানে চেনা যাচ্ছে।একেবারে সাম্প্রতিক কালে কম্প্যুটার প্রযুক্তির সুবিধার্থে কেউ কেউ আবার বলবর্মার যুগে ফিরে যাবার প্রস্তাব করলেও দুই ভাষাতেই তা প্রতিহতও হচ্ছে। কেননা অধিকাংশ মানুষ এখনো কম্প্যুটারে সিদ্ধহস্ত হন নি।আধুনিক যুক্তাক্ষরগুলো দুই ভাষাতেই মূলত পুথি সাহিত্যের দান।কারণ ফলক লেখার থেকে পুথি সাহিত্যে দ্রুতির দরকার পড়ছিল বেশি।দ্রুতলেখন পদ্ধতি অনুসরণ করতে গিয়ে সেসব হয়েছে।১৯৭আমরা সেই তর্ক ছেড়ে এই ছবির ‘র’-এর দিকে তাকাবএই তালিকাতে স্বরের সঙ্গে জুড়ে ‘র’ রয়েছেঅনেকটাই দেবনাগরী ‘র’ এর মতো,যেমনটি চিত্র ১৯-এ নিধনপুর লিপিতে উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী দেখিয়েছেন। যেমনটা চিত্র ১৫ গ-তে,চিত্র ১৬-তে,এবং চিত্র ২৩-এ কুটিলের নমুনাতে রয়েছেএতো সবের পরে কি মনে হয় না,বৃথাই কুটিল থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র হবার প্রয়াস?এই অব্দি কিন্তু ‘কানাই বরসি বোয়া’ লিপির কথা বাদ দিলে ‘‘ব’ আরু ‘ৱ’ আখরর পার্থক্য রখালৈ চাই’ কথাটির কোনো সমর্থন মিলল না।তিনি পরে স্বতন্ত্র করে ব্রাহ্মী থেকে ত্রয়োদশ শতকের হরফের বিকাশ দেখাচ্ছেন,পাঁচটি ছবিতে।আমরা শেষেরটি তুলে দিচ্ছি চিত্র ২৭-এপরিষ্কার দেখব,আধুনিক অসমিয়া বা বাংলা ‘র/ৰ’ কোনোটিই নেই,এবং ‘ব’-এ ‘ৱ’-এও বিশেষ কোনো তফাত নেই।ত্রয়োদশ শতক অব্দি ‘আধুনিক অসমীয়া গঢ়’ নেয়া তথা  বিকশিত হরফের যে তালিকা তিনি উল্লেখ করলেন,সেই ক্রমটি এরকম,“অ,আ,এ,ও,ঔ,ক,খ,গ,ঘ,জ,ঞ,ড, ঢ,ত,থ,দ,ন,ফ,ব,ভ,ম,য,ল,শ,ষ,স,ক্ষ।”১৯৮ এই ক্রমেও ‘ৰ,ৱ’-এর উল্লেখ নেইস্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের প্রত্ন-বাংলা-অসমিয়া স্তর অব্দি অন্তত ‘ৰ,ৱ’ নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তাহলে যেমন কুটিলে –কামরূপীতে আমরা তফাত সেরকম পাচ্ছি না,কামরূপী বুঝতে গিয়ে কুটিলের দিকে তাকাতে হচ্ছে;সেরকমই  এই অব্দি অন্তত বাংলার অসমিয়া লিপির ইতিহাস থেকে বা অসমিয়াকে বাংলা লিপির ইতিহাস থেকে ‘ফালরি কাটি’ যাবার কোনো প্রশ্নই আসছে না।এইটুকুন সিদ্ধান্ত তো নেওয়াই যায়।বরং যদিও  ‘অন্তস্থ –ব’-এর  ব্যবহার বাংলাতে নেই,বর্ণমালাতে কিন্তু এখনো স্কুলপাঠ্য বইতে সেই দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের আগেকার কামরূপী-কুটিল রূপটিই রয়েছে। অসমিয়া ‘ৱ’ পালটে গেছে। আর ‘র/ৰ’ পাল্টেছে দুই ভাষাতেই।






এইখানে এসে আমরা এই ‘কামরূপী লিপি’র ধারণাটির উৎসের দিকে সামান্য তাকাতে পারিএই বিতর্কের গোড়াতে আছেন দুই অনসমীয়া প্রাজ্ঞজন।একজন সপ্তম শতকের সেই চীনা পরিব্রাজক হিউএন সাঙ,যিনি তাঁর বিবরণে এইটুকুনি মাত্র লিখেছিলেন,“কামরূপের ভাষা মধ্যভারতের ভাষার থেকে সামান্য আলাদা।”১৯৯সুতরাং অসমীয়া পণ্ডিতদের মধ্যে জিজ্ঞাসা জাগল ‘আলাদা’টি কোথায়?ডিম্বেশ্বর নেওগ লিখছেন,“ ...য়ুয়ান চোয়াঙর ইতিহাস-প্রসিদ্ধ মন্তব্যই অবশ্যে প্রাচীন অসমীয়া ভাষার জরিপর বাবে প্রথম খুটি।পিছে সেই কালর প্রাচীন অসমীয়ার কোনো নিদর্শন নথকা হেতুকে তার প্রমাণর বাবে পণ্ডিত সকল বিমোরত পরিছিল...”২০০দ্বিতীয়জন একজন সিলেটি পণ্ডিত আঠারো শতকের শেষে এবং উনিশ শতকের শুরুতে আসামের একজন নেতৃস্থানীয় প্রাজ্ঞজন-- মহামহোপাধ্যায় পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদএবারে,এই যে ‘প্রাচীন অসমীয়ার নিদর্শন’ নাথাকাতে সমস্যাটি হচ্ছিল সেটির সমাধান করে দিলেন তিনি। ডিম্বেশ্বর নেওগের কথাতে,“কিন্তু সম্প্রতি প্রাচীন কামরূপর সম্পূর্ণ শাসনাবলী মহামহোপাধ্যায় পদ্মনাথ ভট্টাচার্য্যর আশাশুধীয়া চেষ্টাত সম্পূর্ণকৈ সম্পাদিত হৈ ওলোয়াত সুধী সমাজর আগত পরোক্ষভাবে হলেও তার কিছু সাক্ষ্য পোয়া হল।এই শাসনবোরর ভাষা সংস্কৃত;কিন্তু পণ্ডিতসকলরে বা লিপিকারবিলাকর অনবধানতার ভিতরেদি তেওঁলোকর অজ্ঞাতসারেই ব্যাকরণ আরু জোটনিত স্থানীয় প্রাকৃতর কিছুমান বৈশিষ্ট্য ওলাই পরিছিল।”২০১পদ্মনাথ ভট্টাচার্য ভাষাশুদ্ধির টানে সেগুলো সম্পাদনা করে ছেপেছিলেন,কিন্তু“সৌভাগ্যক্রমে যেনিবা পাদটোকাত তেওঁ মূল পাঠবোর দি গৈছিল।”২০২সেগুলো তন্ন তন্ন করে পাঠ করে ত্রিপিটকার্য বেণীমাধব বরুয়া প্রথম ‘কামরূপী প্রাকৃত’-এর ধারণাটি প্রস্তাব করেন।তিনি দেখান যে রাজা ইন্দ্রপালের দ্বিতীয় তাম্রফলকের ‘সিরি’ শব্দটি পালি ভাষাতেও সঘন মেলে।এটি সংস্কৃত ‘শ্রী’র অপভ্রংশ নয়।ধনসিরি,সুবণসিরি ইত্যাদির শেষাংশের বডো ভাষার শব্দ ‘সিরি’ যার অর্থ নদী।২০৩রাজা ধর্মপালের প্রথম ফলকে ‘ঝরি,উড়িয়াম’ আদি অনেক অসমিয়া গাছ নাম মেলে।২০৪সপ্তম শতকের নিধনপুর লিপিতে ‘কৌশিকো’ না হয়ে ‘কোশিকো’,‘ছান্দোগ্য’ না হয়ে ‘ছন্দোগ্য,ইত্যাদি অসমিয়া স্বরের দীর্ঘ উচ্চারণ না করে হ্রস্ব উচ্চারণ করা বিশেষত্ব;‘হর্য্যদ্ভূত’ না হয়ে ‘হরি অদ্ভূত’,‘তেভ্যোহক্ষরাণি’ নাহয়ে ‘তেভ্যঃ অক্ষরাণি’ এগুলোতে আবার অসমীয়া ব্যাকরণের সন্ধি-হীনতার বৈশিষ্ট্য লক্ষ করবার মতো।২০৫এর পরের কথাগুলো মনে হয় ডিম্বেশ্বর নেওগের নিজস্ব। আমরা তাঁর কথাতেই তুলে দিচ্ছি,“তদুপরি বৌদ্ধ গান আরু দোহা বা চর্য্যাপদবোরত অসমীয়া শব্দাবলী আরু ব্যকরণর গঢ় বিশেষ মন করিব লগীয়া;আরু এইবোরর ওপরত উড়িয়া,বঙালী বা মৈথেলীতকৈ অসমীয়ার দাবী হীন নহয় নিশ্চয়।”২০৬বৌদ্ধ গান দোহা,চর্যার বিতর্ক আপাতত ছেড়ে দিতে পারি। সেকালে যদিও বা তাঁর মনে হয়েছিল,কেউ অসমিয়ার দাবি অস্বীকার করছেন,--- আজকাল কেউ করেন না।কিন্তু যে ইন্দ্রপাল,ধর্মপাল রাজাদের কথা হচ্ছে তখন এমনিতেও অবহঠট এবং প্রত্ন-অসমিয়া বাংলার সন্ধিক্ষণ চলছে।তখন ওদিকে চর্যা লেখা হচ্ছেইন্দ্রপাল দশম শতকে কামরূপের পালরাজবংশের তৃতীয় রাজা ছিলেন।৯৬০ থেকে ৯৯০ খ্রিস্টাব্দ অব্দি সিংহাসনে ছিলেন।২০৭আর ধর্মপাল ছিলেন তাঁর প্রপৌত্র,যিনি ১০৩৫ থেকে ১০৬০ খ্রিস্টাব্দ অব্দি শাসন করেন।২০৮ইন্দ্রপালের প্রথম তাম্রফলকটি গুয়াহাটি বা পাতিদরঙ ফলক বলে পরিচিত।শাসনের অষ্টম বছরে এটি লেখা হয়।দ্বিতীয়টি নলবাড়ির কাছে গুয়াকুচিতে মিলেছে বলে সেই নামেই পরিচিত।শাসনের একবিংশ বছরে এই দ্বিতীয়টি লেখা হয়।২০৯ধর্মপালের নামে তিনখানা ফলক মিলেছে। প্রথমটি খোনামুখ বা খুনামুখি ফলক বলে পরিচিত।এটি অবিভক্ত নগাঁও জেলার বরভাগিয়ার কাছে মিলেছে। শাসনের প্রথম বছরেই তৈরি।২১০ দ্বিতীয়টি শুভঙ্করপাটক ফলক বলে পরিচিত,শাসনের তৃতীয় বছরে এটি লেখান।২১১শেষেরটি উত্তর গুয়াহাটিতে মিলেছে পুষ্পভদ্র তাম্র ফলক বলে পরিচিত।২১২ভাস্কর বর্মণের নিধনপুর তাম্রলিপি সেগুলোর থেকে তিন শতক আগেকার।যখন সাধারণভাবে ধরা হয় প্রাকৃত স্তর পেরিয়ে ভাষা অপভ্রংশ স্তরে প্রবেশ করছে।এই অব্দি ডিম্বেশ্বর নেওগের কথাতে ‘প্রাকৃত বা অপভ্রংশে’র কথা নেই।কারণ এখানে তিনি অসমিয়া ভাষার প্রাচীন নজিরের কথা পাড়ছিলেন।আমরা তুলে দিলাম তিনি কী সব নিদর্শনের ভাষাতাত্ত্বিক ভিত্তিতে তত্ত্বটি দাঁড় করাচ্ছিলেন দেখাতে।এই সব তথ্যের ভিত্তিতেই অনেকে অসমিয়াকে বাংলা বা অন্যান্য মাগধী পরিবারের ভাষা থেকে প্রাচীনতর ভাবেন।

প্রাকৃতের কথাটি ছিল সামান্য আগে যেখানে লিপির কথা আলোচনা করছেন।তিনি আক্ষেপ করে লিখছেন,“অদৃষ্টর পরিহাস অসমীয়া বঙলার উপভাষা বোলা অপযশ লৈয়ে পোনতে ভাষা-তত্ত্বর ক্ষেত্রত ওলাব লগা হয়; তার পাছত মহামতি গ্রিয়ার্সনর নিরপেক্ষ বিচারত অসমীয়া বঙলার উপভাষা নহয়,কিন্তু ভনীভাষা রূপে মাগধী অপভ্রংশর জীয়রী বুলি পরিচিত হয়।এনে প্রতিষ্ঠাতেই গৌরব-উৎফুল্ল হৈ আমি এতিয়ালৈকে আছিলোঁহক আরু এনে তথ্যেরেই অসমীয়া ভাষা বিষয়ে তথাকথিত মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রচারিত হৈছিল।”২১৩ব্রিটিশ সাহেবরাই অসমিয়াকে বাংলার উপভাষা বলছিলেন,আবার আরেকদল ব্রিটিশ সাহেবই তার বিরোধিতা করছিলেন সেসব বৃত্তান্ত আমরা প্রথম অধ্যায়ে লিখে এসেছিস্বাভাবিক ভাবেই শুধু বাঙালিই নন,কিছু অসমিয়াও বিভ্রান্ত ছিলেন এই প্রশ্নে—এই সব সত্য। সেই বিভ্রান্তদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথও ছিলেন প্রথম দিকে।এই অব্দি তাঁর প্রতিবাদে কোনো সমস্যা ছিল না।সমস্যা তাত্ত্বিকভাবেই দেখা দেয়,যখন মাগধী পরিবারের সদস্য হিসেবেও অসমিয়াকে মানতে অস্বীকার করেনকিন্তু বাংলার ভগ্নিভাষা অসমিয়াকে মানতে তাঁর আপত্তি নেই। সেটি সম্ভব হচ্ছে,বাংলাকেও কামরূপী প্রাকৃতে টেনে নিয়ে গিয়ে।তিনি লিখছেন,“এনেতে জানিবা পুণ্যস্মৃতি বেণীমাধব বরুয়াই কামরূপ শাসন-মালার সংস্কৃত রচনাত থকা কামরূপী প্রাকৃতর প্রতি মোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে,আরু সেই নির্দেশ মতেই পম খেদি কামরূপী স্বতন্ত্র প্রাকৃতর সম্পূর্ণ আভাস পাবলৈ সমর্থ হওঁ। তেতিয়া জ্বলজ্বল –পটপটকৈ দেখিবলৈ পাওঁ মাগধী অপভ্রংশর পরা অসমীয়া বঙলা আদি ওলোয়া বোলা ইমান দিনর কথাটো এটা ভূয়াহে,কিয়নো বাস্তবতে মাগধীর লগত কামরূপী তথা অসমিয়া-বঙলা ভাষার কোনো মৌলিক সম্পর্ক নাছিল।”২১৪এই অব্দি পাওয়া গেল ‘প্রাকৃত’-এর কথা।লিপির কথা লিখছেন এই ভাবে,“যি কালর পরাই কামরূপী প্রাকৃতর চানেকি পোয়া হৈছে সেই কালর পরাই কামরূপী লিপিও একে ঠাইতে পোয়া হৈছে।প্রসিদ্ধ লিপিতত্ত্ব-বিশারদ সকলর মতে দেবনাগরী লিপির যি কাল পোয়া হয়,কামরূপী লিপি তাতকৈ অন্ততঃ দুশো বছরর আগর সন্দেহ নাই।তিনি চারি নির্ভরযোগ্য প্রমাণর পরা ভাস্কর বর্মার কাল সপ্তম শতিকার আগভাগত সুপ্রতিষ্ঠিত যেতিয়া,তার পরাই প্রাচীন শাসন মালাত দিয়া ঠায়র বংশ লতাইদি বগাই অন্ততঃ চতুর্থ শতিকালৈকে কামরূপর ঐতিহাসিক ঘটনাবোর সঠিক ভাবে পাঁওহ’ক।”২১৫তাঁর ‘প্রাকৃতভাষা’র তত্ত্ব নিয়ে এখন আর আমাদের তর্ক করবার কিছু নেই।বাণীকান্ত কাকতির২১৬থেকে শুরু করে অধিকাংশ ভাষাবিদই মাগধীপ্রাকৃতের তত্ত্ব স্বীকার করেন।আমরা সেরকম বেশ কিছু গ্রন্থ তলিয়ে দেখেছি। দীপ্তি ফুকন পাটগিরি স্পষ্টই লেখেন,“অধিকাংশ পণ্ডিতে অসমীয়া ভাষার উদ্ভবর ক্ষেত্রত মাগধী প্রাকৃতর পরা সৃষ্টি হোয়া মতটোকে গ্রহণ করিছে।”২১৭আমরা শুধু সংশয় না থাকবার জন্যে সুনীতিকুমার কেন লিখেছিলেন,‘we are thankful for these mistakes’ সেই প্রসঙ্গটি মনে করিয়ে দিতে চাই।কারণটি আমরা ব্যাখ্যা করে এসেছি।লিপি লেখকদের এই সব বিভ্রান্তি সর্বত্র ছিল।সন্ধান করলে সর্বত্র এরকম বিচ্ছিন্ন প্রাকৃতের নমুনা পাওয়া যাবে। সেগুলো খারিজ করে কামরূপী প্রাকৃতের তত্ত্ব দাঁড় করাতে হলে যে শৃঙ্খলার সঙ্গে তুলনামূলক অধ্যয়ন করা দরকার ছিল,ডিম্বেশ্বর নেওগ সেই পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যান নি।তিনি শুধু বিহারের পুব প্রান্ত সহ সমগ্র বঙ্গকেই ভাস্করবর্মণের কামরূপের অংশ হিসেবে দেখেন নি,অংশ হবার “...প্রমাণ রূপে  বঙালী মৈথিলী ভাষা আরু লিপি অসমীয়ারে (বর্তমান ‘ৰ’ সামরি) বাস্তবতে একে আছিল...” এই তথ্যকে হাজির করাচ্ছেন।আমরা দেখেছি,‘ৰ’ কবে অসমিয়া-বাংলাতে ঢুকেছে,আর মৈথেলিতে আদৌ ঢুকেছিল কি না।আসলে তাঁর তত্ত্বটি ছিল সেই এককালে অসমিয়াকে বাংলার উপভাষা বলবার বিপরীতে অতিপ্রতিক্রিয়া মাত্র। সেজন্যেই তিনি মাগধীর থেকে অসমিয়াকে আলাদা করলেও বাংলাকে করেন নি।বাংলাকে টেনে নিয়ে গেছেন ‘কামরূপী’ প্রাকৃতেঅথচ,তার জন্যে যে বাংলাদেশ বা বিহারের লিপি তথা ফলক সাহিত্য নিদর্শনের অধ্যয়ন করতে হত সেসব করেন নি।সম্ভবত লিপি নিয়ে অতি অল্প বিদ্বানই চর্চা করেছিলেন বলেই সাম্প্রতিক ভাষাবিজ্ঞানী উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীও ‘কামরূপী লিপি’র তত্ত্বটি প্রস্তাব করেছেন।তিনি মুকুন্দ মাধব শর্মার উল্লেখ করেছিলেন ‘ব,ৱ’-এর তফাৎ রাখা প্রসঙ্গে।স্বয়ং মুকুন্দ মাধব শর্মা সেই প্রসঙ্গে কী লিখেছিলেন অন্যত্র আমরা দেখিয়েছি।তিনি এই লিপি নাম নিয়েও সেখানে কিছু কথা লিখেছিলেন।তর্কটি হচ্ছে ত্রয়োদশ শতকের আগেকার লিপি নিয়ে। সেই সঙ্গে একে যে কেউ কুটিল,সিদ্ধমাতৃকা,পূর্বী নাগরী এবং প্রত্ন বাংলা বলে চিহ্নিত করেছেন সেসব তথ্য দিয়ে তিনি শুধু লিখছেন,“It may be suggested that this script also deserves to be called Proto-Assamese in as much as in the inscription of ancient Assam we notice a sure progress of the alphabet towards the Modern Assamese script.”২১৮এই প্রস্তাবে যে কেউ আপত্তি করেছেন আমরা দেখিনি।আমাদেরও করবার কিছু নেই।বরং আমরা আরেকটি প্রস্তাব সংযোজন করতে চাই,যেটি তিনি করেন নি। ‘কামরূপী প্রাকৃত’-এর সমস্যাটি তিনি এর আগে ‘Prākritism’ এই উপশিরোনামে আলোচনা করেছেন। সেখানে সাধারণভাবে লিপিকরেরা ভুল করাতে যে স্থানীয় প্রাকৃতের কিছু বৈশিষ্ট্য ছাপ রেখে গেছে সেসব লিখেছেন। তিনি ‘কামরূপী প্রাকৃত’-এর তত্ত্ব সমর্থন বিরোধিতা কিছুই করেন নি।শুধু যে কারণগুলো তত্ত্বটি নির্মাণের পেছনে ছিল সেসব উল্লেখ করে গেছেন। সেখানে বেণীমাধব বরুয়া এবং ডিম্বেশ্বর নেওগের ‘কামরূপী প্রাকৃত’-এর  তত্ত্বটি বিকাশের ইতিবৃত্ত সংক্ষেপে রয়েছে। শেষে সত্যেন্দ্রনাথ শর্মার একটি প্রস্তাব তিনি উল্লেখ করেছেন,“...even if we do not recognise it as a parallel variety of  Prākrit,we cannot avoid recognising it at best as an eastern or Kāmrūpī variety of the Māgadhī Prākrit itself.”২১৯ আমাদের মনে হয় না এই তর্কেও কেউ আপত্তি করেছেন বা করবেন বলে।করবার কোনো যুক্তিই নেই।মাগধীর কামরূপী বৈচিত্র্য থাকবে না,এ তো সম্ভবই নয়।আমাদের যেটি লিপি প্রসঙ্গে প্রস্তাব,সে হলো: এই লিপিটিকে ‘প্রত্ন-অসমিয়া’তো বলাই চলে,আমরা লিখেওছি ‘প্রত্ন-বাংলা’ কথাটির মধ্যেই এর স্বীকৃতি রয়েছে।কিন্তু যখন কুটিল প্রসঙ্গেও কথা হবে আর অসমিয়া লিপির কথা হবে তখন একে আমরা একত্রে ‘কামরূপী-কুটিল’ বললেও পারি।কামরূপীর থেকে কুটিল বাদ দিলে বিভ্রান্তি বাড়ে মাত্রবহু সত্য ঢাকা পড়ে যায়। তাতে গ্রহণযোগ্যতা কমে মাত্র বাড়ে না। 

এবারে আমরা পরের কথাতে এগোতে পারি তথা উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীর লিপি চিন্তাতে ফিরতে পারি। ত্রয়োদশ শতকের ‘কানাই বরসি বোয়া’তে ‘ব’-এ ‘ৱ’-তে তফাতের কথা আমরা জেনে এসেছি,কিন্তু কীরকম ছিল জানি নাউপেন্দ্রনাথ গোস্বামী একটি ছবি দিয়েছেন তার,কিন্তু সেটি অস্পষ্ট,বিশেষ কিছু বোঝা যায় না।শুধু বোঝা যায় ‘র/ৰ’ অনেকটাই ‘ব’ এর মতো,‘কামরূপে’ শব্দে যেমনচিত্র ২৮-এ সেটি রইল।২২০তার পাঠের যে অসমিয়া লিপ্যন্তর দিয়েছেন সেখানেও ‘ৱ’ নেই। সেটি এরকম,“শাকে তুৰগর যুগ্মেশে মধুমাসত্রয়োদশে।/কামরূপং সমাগত্য তুৰষ্কাঃ ক্ষয়মায়য়ু।।” এর পরে প্রথম,ষোড়শ শতকের শেষভাগে “নীলাচল কামাখ্যা মন্দিরর শিলর ফলিত( ১৫৬৫) ‘ৰ’ আরু ‘ৱ’ আখর দুটা আছে।”২২১এটি সেই সময় যখন সুকুমার সেনকে বাদ দিলে বাকিদের মতে ওদিকে বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামে বসন্তরঞ্জনের পাওয়া ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’–এর পুথিটি অনুলিপি করা হচ্ছে।এই সময়ে বা তার পরে বাংলাতেও বহু পুথিতে ‘ৰ’ মিলছে আমরা সেরকম আরেকটি দেখিয়েছি।যাই হোক,আমরা নীলাচল কামাখ্যা পাথুরে ফলকের যে দুই ছবি উপেন্দ্রনাথ দিয়েছেন,সেগুলোই তুলে দিচ্ছি ২৯ ক এবং খ-তে২২২ ‘ৰ’ রয়েছে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।কিন্তু ‘ৱ’-এ মনে হয় একটি অস্থিরতা তখনো আছে,কোথাও নিশ্চয় ‘ব’২৯ ক-তে যেখানে পঞ্চম সারিতে ‘গ্রামাদিনিৱাসিনো’ শব্দে উপেন্দ্রনাথ অসমিয়া লিপ্যন্তরে ‘ৱ’ লিখলেও ফলকের পাঠে ‘ব’ দেখাচ্ছে।আমরা সেই সারিটি বামমুখো তীরে চিহ্নিত করে দিয়েছি।অন্যদিকে ২৯-খ-তে ষষ্ঠ সারিতে ‘শ্রীমল্লদেবো’ শব্দে স্পষ্টই ‘ৱ’ দেখা যাচ্ছে।এতে যদিও নিম্নরেখটি এখনকার মতো দীর্ঘ না হলেও রয়েছে দেখা যাচ্ছে, বহু সময়েই সেটি নিচে বিন্দু দিয়েই আধুনিক বাংলা ‘র’-এর মতো লেখা হত,আমরা আঠারো শতকের রাজা প্রমত্ত সিংহের মুদ্রাতে দেখিয়েছি চিত্র ১-একয়েকটি পুথি সাহিত্যের নমুনাতেও দেখা যাবে,তাই হচ্ছে।চিত্র ৩০ ক এবং খ স্পষ্ট পড়া যাবে।৩০ গ সামান্য অস্পষ্ট বটে২২৩অনুস্বারে চন্দ্রবিন্দুতে তফাত করা হচ্ছে না।হরফের উপরে বিন্দু বসিয়ে বোঝানো হচ্ছে।এসব বোঝা যাচ্ছে।বাংলা ‘র’-এর মতো অসমিয়া ‘ৱ’ উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীর নিজে আলাদা করে দেখানো প্রাক-ঔপনিবেশিক অসমিয়ার ‘সাঁচিপাত’-এ লেখা পুথির তিন লিপিশৈলীর নমুনাতেও দেখা যাচ্ছে।চিত্র ৩১  ক এবং খ-তে আমরা সেগুলোও তুলে দিচ্ছি।

         

 
 

 



 

 

 

বাংলাতে যেখানে ষোড়শ শতকের আগেকার কোনো পুথি পাওয়া যাচ্ছে না,সেখানে অসমে এই সাঁচিপাতের পুথি চতুর্দশ শতক থেকে মিলছে।২২৪ভিন্ন আবহাওয়াতে ভিন্ন উপকরণে সেটি সম্ভব।‘সাঁচি’ মানে অগরু গাছ।কিন্তু অসমিয়াতে ‘সাঁচি’ শব্দের মানে ‘সঞ্চয়’-ও হয়মনে হয় যেহেতু অগরু গাছের ছাল থেকে এই লিখবার উপকরণ তৈরি করে সঞ্চয় তথা ‘সাঁচি’ রাখা হত,সেখান থেকেই ‘সাঁচিপাত’ কথাটি এসেছে এবং পরে গাছের নামও পড়ে গেছে ‘সাঁচি’ গছ। হরতকীতো অবশ্যই,কখনো বা আমলকি গাছের ছাল পুড়িয়ে,বিন্নি চাল ইত্যাদি পুড়িয়ে,বা মাটির প্রদীপের শিষ সংগ্রহ করে তাতে বলদের পেচ্ছাব মিশিয়ে কালি তৈরি করা হতোএখনো সে জন্যে  সাঁচিপাত পুথির হরফগুলো জ্বলজ্বল করে লিখছেন উপেন্দ্রনাথত্রয়োদশ শতকের পরে ঔপনিবেশিক কাল শুরু হবার আগে অব্দি এই ‘সাঁচিপাত’ পুথিকে কেন্দ্র করে অসমিয়াতে গড়গঞা,বামুণীয়া,কায়থেলী এবং লহকরী এরকম কটি লেখন রীতি গড়ে উঠে।২২৫আমরা অনুসন্ধান করিনি রীতিগুলো কবে থেকে গড়ে উঠছে। চিত্র ৩১ ক-তে যে নমুনাগুলো তিনি দেখিয়েছেন সেই পুথিগুলোই বা কবেকার। তিনিও স্পষ্ট কিছু লেখেন নি। কিন্তু চিত্র ১৫ ক, খ,  গ এবং ঘ-তে এবং চিত্র ১৬তে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র পুথির লিপির সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে স্বরবর্ণ থেকে শুরু করলেই হরফগুলো যে তুলনাতে তার থেকে বেশ প্রাচীন সেটি বোঝা যাবে।এখন,নিধনপুর এবং ডুবি লিপির মতো এও হতে পারে যে একই সময়েই এই সাঁচিপাতপুথিগুলোর হরফ প্রাচীনতর শৈলী রক্ষা করে চলেছে।এই নিয়ে আমরা নিশ্চিত কিছু নই।শুধু সম্ভাবনার কথাই উল্লেখ করে রাখলাম।এমন কি চিত্র ১৫ ঘ এর সংখ্যাগুলোর সঙ্গেও মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে চিত্র ৩১ খ-এর শৈলী প্রাচীনতর।

প্রথম অসমিয়া ছাপাগ্রন্থ আমরা আগেই লিখেছি আত্মারাম শর্মার অসমিয়া বাইবেল ‘ধর্মপুস্তক’স্বাভাবিক ভাবেই এটি একটি অনুবাদ গ্রন্থও।কাজটি করিয়েছিলেন উইলিয়াম কেরি,এবং তাঁর শ্রীরামপুরের ছাপাখানা থেকেই বেরোয় ১৮১৩তে।তখনো আসাম ব্রিটিশ শাসনের অধীনে সরাসরি আসে নি।আসবে আরেক দশক পরে।নন্দ তালুকদার একটি সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন যে হয়ত অসমিয়া সাঁচিপাত পুথির নমুনা দেখিয়েছিলেন তিনি কেরিকেতাতে সেই বইতে ‘র’ দুই এক জায়গাতে থাকলেও,অসমিয়া ‘ৰ’-ই দেখা যাচ্ছে।২২৬আত্মারামের  বইটি ছাপবার আগে কেরি বহু অসমিয়া পণ্ডিতদের থেকে এর ভাষা এবং লিপিটি অনুমোদন করিয়ে নিয়েছিলেন।কিন্তু পরে বহু পণ্ডিতদের সঙ্গে শিবসাগরের আমেরিকান ব্যাপটিস্ট মিশনের মাইলস রবিনসন এবং নাথা ব্রাউনেরা এর ভাষার বিরোধিতা করেন এই অভিযোগ এনে যে এতে সংস্কৃত এবং বাংলা শব্দের বহুল ব্যবহার হয়েছে।তথ্যটির উল্লেখ করেছেন ড সত্যেন্দ্রনাথ শর্মা।২২৭ফলে তারা ১৮৩৮এ এ আবার নতুন করে বাইবেল অনুবাদে হাত দেন।সত্যেন্দ্রনাথ শর্মা এও উল্লেখ করেছেন আত্মারাম শর্মার বাইবেলে ‘ৱ’ হরফটি ছিল।শিবসাগরের মিশনারিদের অসমিয়া ভাষার প্রতিষ্ঠাতে বিশাল ভূমিকা ছিল। তাঁদের উদ্যোগেই প্রশাসনে অসমিয়া ভাষা আবার প্রতিষ্ঠিত হয়।প্রথম অসমিয়া সাময়িক কাগজ ‘অরুণোদয়’ তাঁদের ছাপাখানা থেকেই বেরোয়। কেরির অনুগামী রবিন্সনের বিপরীতে গিয়ে সংস্কৃতানুসারী পদ্ধতি ছেড়ে নাথান ব্রাউনের অসমিয়া ব্যাকরণ লেখার ইতিবৃত্তও আমরা প্রথম অধ্যায়ে ছুঁয়ে এসেছি।অথচ তাঁরাই ‘ৱ’ গ্রহণ করতে চান নি।তথ্যটির উল্লেখ উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীও করেছেন।সত্যেন্দ্রনাথ শর্মাও করেছেন ১৯৯০তে দেওয়া ‘আত্মারাম শর্মা স্মারক বক্তৃতা’তে।২২৮এখন আপত্তি নাথান ব্রাউন বা সেরকম কারো থেকেও ছিল কি না স্পষ্ট নয়। হেমচন্দ্র বরুয়ার একটি মন্তব্য তাঁর আত্মচরিত থেকে তুলে দিয়েছেন,উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী,“তাতে মই তার (অরুণোদয়র) বর্ণবিন্যাস সংশোধনর নিমিত্তে যত্ন করিবলৈ ধরিলোঁ। মোর এই চেষ্টাত নিধিরাম ফেয়ারোয়েল নামেরে এটা দেশী খ্রীষ্টীয়ানর পরা বর বাধা পাইছিলোঁ,--পরিশেষত মোর যত্ন সফল হয়,তথাপি ‘ৱ’ আখরটোর ব্যবহার চলোয়া অসম্ভব যেন বোধ হল,--পিছত পাদ্রী ডক̖টর কম্পর্ট চাহাবর সহায়তার দ্বারা এই বিষয়র সকলো আপত্তির খণ্ডন হ’ল আরু ‘ৱ’র ব্যবহার চলিল।”২২৯যদি সেদিন ডক̖টর কম্পর্ট সাহেবরা এগিয়ে না আসতেন,তাহলে কিন্তু হেমচন্দ্র বরুয়া হতাশ হয়েই যাচ্ছিলেন,অসমিয়া ‘ৱ’-এর ইতিহাস অন্যরকম হতেও পারতো।এমন বহু ব্যক্তিগত সংগ্রামের ইতিহাস অসমিয়াতে পরেও আছে,বাংলাতেও আছে। সুতরাং লিপি বা হরফ বদল করে ফেলাটি একটি ভাষিক গোষ্ঠীর সম্মিলিত জাতীয় আবেগ কিংবা ইচ্ছে অনুসারে হয় না,যে প্রশ্ন করা যাবে বাঙালিরা এটা  করল,অসমিয়ারা এটা  করলেন  না কেন! বা তার উল্টোটি।এটি ঠিক যে অসমিয়া অন্তস্থ ব-এর ব্যবহারটি থাকলেও ‘কানাই বরসি বোয়া’কে বাদ দিলে  ষোড়শ শতকের আগে তার জন্যে স্বতন্ত্র হরফ দেখা যাচ্ছে না। তেমনি ‘ৰ’-এর পেট চেরা রূপটিও দেখা দিচ্ছে এই সময়।একই সময় বাংলাতেও ‘অন্তস্থ-ব’ প্রবেশ না করলেও কালিমাখা ‘ব’ থেকে ‘ৰ’ আসছে।পাশাপাশি ‘ব’ ছিল,‘ব·’-ও ছিল।অনেক পরে পশ্চিম বাংলাতে ‘র’ দেখা দিচ্ছে। যেটি অসমিয়ারা বহুদিন ‘অন্তস্থ-ব’-এর জন্যে ব্যবহার করেছেন।ছাপাখানার যুগে বাংলাতে পাকাপাকি হয়ে গেল ‘র’ঢাকাতে বাংলার রাজধানী হতো,তবে হয়তো ‘ৰ’–কে বাংলাতেও দেখা যেতঅথবা ‘ব·’কেপশ্চিম বাংলাতে রাজধানী ছিল বলেই ‘র’ ঠাই করে নিল।ঠিক তেমনি অসমিয়ারাও ‘ৱ’ এবং ‘র’-এর মধ্য থেকে প্রথমটি এই সময় বেছে নিলেন।অনুমান করতে পারি যে ‘অন্তস্থ-ব’ এর জন্যে ‘র’ নিলে সেটি বাংলা ‘র’ এর মতো দেখাততাই হেমচন্দ্র ‘ৱ’-এর জন্যেই লড়াইটা করলেন।তর্ক উঠতে পারে যে মৈথেলিরা তবে ‘বর্গীয় ব’ এর জন্যে ‘র’ নিলেন কী ভাবে?প্রথম উত্তর হবে,মৈথেলি সেরকম প্রবলভাবে ছাপাখানাতে এলো আর কই?দ্বিতীয়ত অন্য বহু  হরফে তারা  বাংলা বা অসমিয়ার থেকে অনেক বেশিই স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেছেন বা করতে বাধ্য হয়েছেন।একা ‘র’ নিয়ে হয়ত সেভাবে তারা কোনো সমস্যা বোধ করেন নি

আমাদের মনে হয় লিপি প্রসঙ্গে অসমিয়া বাঙালি মনস্তত্ত্ব স্বতন্ত্র হতে শুরু করবার পক্ষে আত্মারাম শর্মার ‘ধর্মপুস্তক’ একটি মাইলফলক। যেখানে পাশাপাশি ‘র’ এবং ‘ৰ’ ছিলইতিমধ্যে বাংলা ছাপাপুথিতে ‘র’ পাকা হয়ে গেছে।আত্মারাম শর্মার মতো যে অসমিয়া মধ্যবিত্ত তখন কলকাতা গিয়ে বাংলা ছাপা বই তথা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিলেন,তারা বাংলা ‘ৰ’ স্বচক্ষে তখন দেখেন নি। সেইসব বহু পরে পুথি সাহিত্যের গবেষকেরা বা ভাষাবিজ্ঞানীরা  জানাচ্ছেন।ফলে তারা ভেবে নিয়েছেন,যে ‘র’ হচ্ছে বাংলার আর ‘ৰ’ হচ্ছে অসমিয়ার পরম্পরাগত সম্পদসেই ভাবনাটি খুব গভীর না হলে ডিম্বেশ্বর নেওগের মতো বিদ্বানও ‘কানাই বরসি বোয়া’র আগে নথিপত্র যাচাই না করেই প্রাচীন ফলকে ‘ৰ’ ছিল—এই সব কথা লিখতেন না। সেসব যে তাঁরা বিশ্বাসের ভরেই লিখে গেছেন,তথ্য যাচাই করে নয়—আমরা তো দেখিয়েই এলাম।এখান থেকে ‘স্বাতন্ত্র্যে’র বোধটি অঙ্কুর মেলে।বাকি যেটুকু ছিল সে ‘ৱ’ রাখা কিংবা না রাখা নিয়ে মিশনারি সাহেবদের সঙ্গে বিতর্ক,সংগ্রাম এবং হেমচন্দ্র বরুয়ার সাফল্যে সম্পূর্ণ হয়ে গেল।বাণীকান্ত কাকতি তাই স্পষ্টই লিখেছিলেন,“ প্রা.ভা.. ৱ-, ব- বুজাবলৈ ব-আখরটো ব্যৱহার করা আরু সিহঁত দুয়োটাক ব উচ্চারণ করা হয়।ৱ শ্রুতি বুজাবলৈ আরু তৎসম শব্দত প্রা.ভা.. স্বরমধ্য -ৱ- বুজাবলৈও অসমীয়াই ৱ আখর এটা তৈয়ার করি লৈছে।”২৩০এখানে একটি তথ্যের উল্লেখ রাখা ভালো যে ‘অরুণোদয়’ ছাপার জন্যে মূল হরফ এবং হরফ বিন্যাসের আদলটি কিন্তু ১৯৪৭তে শ্রীরামপুর মিশন থেকেই কাটিয়ে আনা হয়েছিল।এরপরের ইতিবৃত্ত উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী আর বেশি টানেন নি,এই কথা লিখে অসমিয়া লিপির কথা তিনি সেরেছেন,“আধুনিক ছপা-যন্ত্রর বিবিধ কলা-কৌশলর পরিবর্তনে ছপা আখরবোরকো সময়ে সময়ে একোটা গঢ় দি আহিছে।”২৩১আমরা সেই ইতিবৃত্তে স্বতন্ত্র ভাবে প্রবেশ করব।

 

।। আধুনিক যন্ত্র প্রযুক্তি এবং অসমিয়া-বাংলা লিপি।।

 ১৭৯২তে ভারতে সংস্কৃতে ছাপা সবচাইতে প্রাচীন গ্রন্থের লিপি ছিল বাংলা এই সংবাদটি সুনীতি কুমারের সূত্রে পেলেও আমরা এটি জানিনা,সেটি ছাপা হয়েছিল কই।হ্যালহেডের বইতে বাংলা হরফের প্রয়োগ হলেও তার ব্যাপক প্রচলন হতে লেগেছিল আরো সিকি শতাব্দি।তাঁরা শুরু করেছিলেন মাত্রপঞ্চানন কর্মকার কোনো পূর্বনজির ছাড়াই যেটুকু কাজ করেছিলেন তা ছিল প্রশংসনীয়।কিন্তু সম্ভবত তিনি বা উইলকিনসন প্রযুক্তিটাকে ভালো বুঝতেন না।তাই এরপরের সিকি শতাব্দী এমন কি  শ্রীরামপুর মিশনের শুরুর দিনগুলোতেও বাংলা বইপত্তর ছাপা হ রোমান হরফে। কেউ কেউ এই রোমান হরফকেই একটা স্থায়ী রূপ দেবার প্রয়াস তখন থেকেই করছিলেন।এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা এবং তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের জনক স্যর উইলিয়াম জোনসের সেরকম প্রয়াসের কথা লিখেছি আগে।কিন্তু পাশাপাশি অন্যদের হাতে তখন আজকের বাংলা হরফের বিকাশের কাজও চলছিল।শ্রীরামপুর মিশন থেকে আঠারো শতকে তিনখানা মাত্র আইনের বইয়ের সংবাদ মেলে যেগুলো বাংলা হরফে ছাপা হয়েছিল।১৮০০তে বাইবেলের অনুবাদ দিয়ে বাংলা হরফে বই ছাপার ইতিহাসের শুরুততদিনে পঞ্চানন কর্মকারকেও সেখানে চাকরি দিয়ে বহাল করেছেন উইলিয়াম কেরি।পঞ্চানন কর্মকার এর পরে বেশিদিন জীবিত ছিলেননা।১৮০৪এ তিনি মারা গেলে তাঁর কাজকে এগিয়ে নিয়ে গেছিলেন তাঁর মেয়ের জামাই মনোহর মিস্ত্রি,ও মনোহরের ছেলে কৃষ্ণচন্দ্র মিস্ত্রি।বাঙালির লেখা প্রথম বাংলা হরফে ছাপা বই রামরাম বসুর প্রতাপাদিত্যচরিত্রতখন অব্দি বাংলা হরফে যে পরিবর্তনগুলো এসেছিল তারমধ্যে অন্যতম বাংলা পেট কাটা ‘ব’ বাদ দিয়ে,নিচে বিন্দু দিয়ে ‘র’-কে পাকা করে ফেলা।এখনকার বাংলা বেশ কিছু হরফের নিচে ফুটকি বা বিন্দু দেয়া হয়।এই ফুটকিগুলো সে যুগে প্রচলিত ছিল না।’ ছাড়াও য়-র নিচে কোন বিন্দু ছিল না;‘য’-ই শব্দে অবস্থানভেদে অন্যরকম করে উচ্চারিত হত।আবার ড় এবং ঢ়-এরও কোন অস্তিত্ব ছিল না।ড এবং ঢ শব্দের মাঝে বসলে ড় এবং ঢ়-এর মতো উচ্চারিত হত।ত+উ ব্যঞ্জন-স্বর জোড়টি ত্ত' দিয়ে প্রকাশ করা হত।আজও কোন কোন আধুনিক বাংলা যুক্তাক্ষরে,যেমন স+ত+উ = স্তু (যেমন- বস্তু) এবং ন+ত+উ = ন্তু (যেমন- কিন্তু) --- এই দুইটি যুক্তাক্ষরের ত+উ অংশে এর ফসিল দেখতে পাওয়া যায়।তখন যে কয়টি বাংলা বই ছাপা হয়েছিল সেগুলোতে বইয়ের একটি পাতা প্রথমে হাতে লেখা হত।তারপর সেই পুরো পাতার একটি প্রতিলিপি কাঠে বা ধাতুতে খোদাই করে নেওয়া হত। শেষে এই কাঠ বা ধাতুর ফলকে কালি লাগিয়ে একই পাতার অনেক কপি ছাপানো হত।একই লোকের হাতের লেখাতে যে বৈচিত্র্য থাকতে পারে,সেগুলো ঐ ছাপাতে আর শুধরানো যেত না।আত্মারাম শর্মার ‘ধর্মপুস্তক’-এর নমুনা রইল চিত্র ৩২-এ,২৩২ তাতে ধারণা করা যাবে।


 


শ্রীরামপুর মিশনের প্রয়াসগুলোর সমকালেই খুব শীঘ্রই আরো অনেকে বাংলা প্রকাশনার জগতে চলে আসেন। আমরা রাজা রামমোহন,ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের বই পত্রিকার জগতে আত্মপ্রকাশের কথাগুলো জানি।এরা ছাড়াও ছিলেন আরো  অনেকে।ততদিনে মুদ্রণযন্ত্রের সঙ্গে ঢালাই করা বাংলা হরফও বাজারে এসে গেছে।এবং এগুলোর মধ্যে বাজারের টানেই একটা সামঞ্জস্যও আসতে শুরু করেতখন যে পরিবর্তনগুলো হয় তার মধ্যে অন্যতম ছিল: অনুস্বরের নিচের দাগটি ছিল না।ছিল কেবল গোল চিহ্নটি।ব্যঞ্জনের খাড়া দাগের সাথে য-ফলা মিলে বাঁকিয়ে কমলার কোয়ার মত একটা চেহারা ছিল।এগুলি আজও কখনো কখনো দেখতে পাওয়া যায়অনেকটা স্য-তে যেমন।কিন্তু এখানে নিচে জুড়ে যায়নি তখন নিচের দিকে জুড়ে যেত।

তু যুক্তাক্ষরটি বর্তমান চেহারা পায়।অর্থাৎ ত-এর নিচে ু বসিয়ে।স্থ (স+থ) যুক্তবর্ণটি হ্যালহেডের সময়ে, অর্থাৎ ১৮শ শতকে স-এর নিচে পরিষ্কার থ লিখে দেখানো হয়েছিল,কিন্তু পরবর্তীতে এটি স-এর নিচে ছোট হ-এর মত অক্ষর বসিয়ে নির্দেশ করা হয়।হ্যালহেড এমন অনেক যুক্তাক্ষরেই পরের ব্যঞ্জনকে অক্ষত রেখেছিলেন। সেগুলো আর না থাকাতে যুক্তাক্ষরগুলো অস্বচ্ছ রূপ ধারণ করে।এখনও এই অস্বচ্ছ রূপই ব্যবহার করা হয়।এরকম আরও বহু যুক্তাক্ষরের অস্বচ্ছ রূপ ১৯শ শতকের শুরুর এই পর্বে নির্দিষ্ট হয়ে যায়

পেট কাটা ব অর্থাৎ ৰ এই সময় বাংলা বর্ণমালা থেকে বিদেয় নেয়।১৮শ শতকের মাঝামাঝিতে এই পর্বের শেষে এসে বর্তমান নিচে বিন্দু দেয়া রূপটিই সর্বত্র চালু হয়ে যায়।এরপরের বাংলা গদ্যের বিকাশের ইতিবৃত্তটা আমরা মোটামুটি সবাই জানি যারাই টুকটাক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ঘাঁটিয়েছিবাংলা গদ্যের বা সাহিত্যের বিকাশের ইতিহাসে ছাপা যন্ত্রের ভূমিকার কথাটাও আমরা পড়েছিকিন্তু যেটি কম জানি তাহলো,আড়ালে আবডালে থেকে ছাপা যন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা হরফ তথা বর্ণমালার বিকাশের কঠিন জটিল ইতিবৃত্তের কথা।ভাষাটাকে ভালোবেসে যারা তাকে ছাপা বইতে প্রকাশের যোগ্য করে তুলবার শ্রম স্বীকার করেছিলেন তাদের ত্যাগ আর তিতিক্ষার কথা।ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচ থেকেই আমর বাংলা বর্ণমালা শিখেছি।এইটুকুন জানা।অজানা কথাটি হলো,বর্ণপরিচয়ের লেখক বিশুদ্ধ অধ্যাপক বিদ্যাসাগর নন। মাঝে একবার সংস্কৃত কলেজের চাকরি ছেড়ে জীবিকার জন্যে তিনি এক ছাপাখানা খুলেছিলেন।মূলত সেখানেই তাঁর বর্ণমালা সংক্রান্ত ভাবনাগুলো বিকশিত হয়।সংস্কৃতের এই অধ্যাপকের উদ্দেশ্য ছিল সংস্কৃতের অধীনতার থেকে বাংলাকে মুক্ত করা।তিনি যে বদলগুলো নিয়ে আসেন সেগুলো ছিল এরকম: নিচে ফুটকি দিয়ে নতুন "য় বর্ণটি ব্যবহারের প্রস্তাব করেছিলেন।একইভাবে ড ও ঢ-এর নীচে ফুটকি দিয়ে ড় ও ঢ় হরফ দুইটির প্রচলন করেছিলেন।এর আগে এগুলো বাংলা বর্ণমালাতে ছিল না।তিনি বাদ দিয়েছিলেন,দীর্ঘ-ৠ ও দীর্ঘ-ৡ বর্ণটিরও ব্যবহার না থাকলেও কেন যে তিনি রেখে দিলেন সেটি স্পষ্ট নয়।এছাড়া সংস্কৃত স্বরবর্ণমালার অন্তর্গত অনুস্বার (ং),বিসর্গ (ঃ),এবং চন্দ্রবিন্দু (ঁ) যেহেতু প্রকৃতপক্ষে ব্যঞ্জনবর্ণ সেহেতু বিদ্যাসাগর এই বর্ণগুলিকে ব্যঞ্জনবর্ণমালার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।কিন্তু এগুলোর স্বতন্ত্র ব্যবহার নেই বলে আজ অব্দি কোনো বাংলা অভিধানই বিদ্যাসাগর প্রণীত এই বর্ণক্রমটি গ্রহণ করেনি।

বিদ্যাসাগর ণ-ন এবং শ-ষ-স-এর মধ্যে উচ্চারণের সমতা সম্ভবত লক্ষ করলেও এর কোনো সংস্কার করেন নি। বাংলা হরফের স্বচ্ছতা ও সমতা নিয়ে আসার জন্যও তিনি বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।তিনি য-ফলাকে ব্যঞ্জনের সাথে জুড়ে দিয়ে কমলার কোয়ার মতো না লিখে আলাদা করে লেখার ধারা চালু করেন।ফলে সর্বত্র য-ফলার আকার একই রূপ পেয়ে গেল।ঋ-কার ব্যঞ্জনের নিচে নানান চেহারাতে বসত।বিদ্যাসাগরই প্রথম ব্যঞ্জনের নিচে পরিষ্কারভাবে ৃ চিহ্নটি বসিয়ে লেখা চালু করেন।একইভাবে হ্রস্ব-উ কারের জন্য ু লেখা চালু করেন।

কিন্তু বিদ্যাসাগরের সংস্কারগুলি সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না।অনেকগুলি অস্বচ্ছ যুক্তব্যঞ্জনের চিহ্ন অস্বচ্ছই থেকে গিয়েছিল। যেমন - তু ত-এর নিচে উ-কার দিয়ে লেখা হলেও ন্তু,স্তু যুক্তাক্ষরগুলিতে পুরনো অস্বচ্ছ রূপটিই থেকে গেল। ছাপাখানাতে ইংরেজি ধাতুঢালাই হরফগুলো একটি ডালায় দুই খোপে নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী সাজানো থাকত।কিন্তু বাংলায় এ নিয়ে তেমন কোন চিন্তা হয় নি।বিদ্যাসাগরই প্রথম বাংলা হরফের জন্য ডালার একটি নকশা এবং কোন হরফের পর কোন হরফ বসবে তার নিয়ম স্থির করে দেন।তাঁর এই নকশাই ক্রমে সমস্ত হরফ ব্যবহারকারী বাংলা ছাপাখানাতে গৃহীত হয়। বাংলা মুদ্রণশিল্পে প্রতিষ্ঠিত হয় সমতা।

বিদ্যাসাগর বাংলা মুদ্রণশিল্পকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন।মূলত তার বেঁধে দেয়া নিয়মনীতি অনুসারেই পরবর্তী একশো বছর,বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাংলা হরফ মুদ্রিত হয়।সময়ের সাথে বিদ্যাসাগরীয় হরফের সামান্য কিছু পরিমার্জনের চেষ্টাও করা হয়েছেবিদ্যাসাগর নিজে বর্ণপরিচয়-এর ৬০তম সংস্করণ থেকে শব্দের শেষে অন্তর্নিহিত ও উচ্চারণযুক্ত ব্যঞ্জন,যেমন- বিগত,কত শব্দের শেষের ত-টা,যেন ৎ-এর মত উচ্চারণ না হয়,সেজন্য এগুলোর উপর তারাচিহ্ন দেয়া প্রবর্তন করেন।২৩৩বিশ শতকে অনেক লেখক একই কাজে ঊর্ধ্বকমা () ব্যবহার করেছেন,রবীন্দ্ররচনাবলীর জন্যে এই নীতি নির্ধারিত হয়েছিল।প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ একে লিখেছেন ইলেক চিহ্ন। যেমন- একশ, ইত্যাদি।২৩৪তবে এই সংস্কারগুলো সর্বজনগৃহীত হয়নি  

আমরা বানান নিয়ে খুবই স্পর্শকাতর অনেক সময়।কিন্তু এই ভাবনা সাধারণত কারো মাথাতেই আসে না যে বানানের সঙ্গে হাতে হাত ধরে আসে বর্ণমালা শুদ্ধির প্রশ্ন।এই দুটির কোনোটাই নিয়ন্ত্রণের দায়ভার কোনো মাস্টারমশাইর হাতে নেই তো বটেই। নেই কোনো একক ভাষাতাত্ত্বিকের হাতে।থাকলে সুনীতি চট্টোপাধ্যায়েরা যেমন লিখতেন বাঙ্গালাআমরাও তাই লিখতাম।কিন্তু আমরা লিখি বাংলা’ –রবীন্দ্রনাথ এটা শুরু করেছিলেন।রবীন্দ্রনাথের লিপি তথা বানান সংস্কার ভাবনার সঙ্গে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের আন্দোলনের যেমন একটা ভূমিকা ছিল তেমনি ছিল বিশ্বভারতীর।বিশ্বভারতী যখন তাঁর রচনাবলী ছাপার স্বত্ব পায় তখন তাদেরকেও এক বানান নীতি দাঁড় করাতে হয়। সেই নীতিই ক্রমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়,পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি এবং বাংলাদেশ বাংলা একাডেমীকেও বানান তথা বর্ণমালা বিধি তৈরিতে প্রভাবিত করে।কিন্তু এই প্রতিটি সংস্কার প্রয়াসের পেছনে রয়েছে ছাপাযন্ত্রের বিবর্তনের চাপা পড়া ইতিকথাআনন্দবাজার পত্রিকাকেও আমরা যে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলা লিপি এবং বানান রীতিকে শাসন করতে দেখি তা এরই জন্যেযথাপ্রাপ্ত অবস্থার কাছে যারা দাসত্ব করতে চান নি বা পারেন নি তাদের সৃজনী হাতেই এগিয়ে গেছে বাংলা লিপি,বর্ণমালা,বানান রীতি এবং ভাষা

বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়যখন বাংলাদেশের পাঠশালাগুলোকে শাসন করছে,বঙ্কিম যখন বঙ্গদর্শনেসজোরে বাঙালিকে তার ইতিহাস লিখতে উদ্বুদ্ধ করছেন তখন আবার ঐ রোমান হরফকে ফিরিয়ে আনাবার এক প্রয়াস শুরু হয়েছিল দেশজুড়ে। নেতৃত্বে অবশ্যই সাম্রাজ্যের স্বার্থরক্ষক বিলেতিরা। অধ্যাপক ড্রু নামে এক সাহেব রোমান লিপির প্রস্তাব দিলে দেশ জুড়ে সাহেবদের মধ্যেও বহুদিন বিতর্ক চলে এবং বহু ভাষাতে রোমান লিপি চালুও হয়ে যায়। পাঞ্জাবে দেখা দেয় রোমান উর্দু যা পাকিস্তানে এখনো আছে। হুমায়ুন আজাদ তাঁর বাংলা ভাষা সংকলনে উনিশ শতকের এক অজ্ঞাতনামা লেখকের লেখা উদ্ধার করেছেনবাঙ্গালা বর্ণমালা সংস্কার২৩৫লেখকের নাম না জানাটা বাংলা ভাষাতত্ত্বের ইতিহাসে এক দারুণ ক্ষতি।কবেকার লেখক-- সেই তথ্যেরও কোনো সন্ধান দেননি হুমায়ুন আজাদ। তবে ১৮৬৪র আগে নয়, কেননা তখনকার Asiatic society Journal থেকে নেয়া ঋণ স্বীকারোক্তি আছে প্রবন্ধের শেষে।এই লেখকের বাংলা বর্ণ সংস্কারে তাঁর অনেক প্রস্তাব পরের সময়ে গৃহীত হয়েছে,আবার অনেকগুলো হয়ও নি। যেমন তিনি লিখেছিলেন,‘ ছাড়া আর সব স্বরবর্ণগুলো তুলে দিয়ে তাদের -কার চিহ্নগুলো রেখে দিতে।অর্থাৎ া,ি,,,,,,,,ৌ এইও চিহ্নগুলো থাকবে আ,,ঈ ইত্যাদি নয়।এখন পড়তে গিয়ে আমাদের হাসি পাবেকিন্তু তিনি তখন বাংলা হরফ উঠিয়ে দিয়ে রোমান প্রচলনের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। তাঁর সেই প্রবন্ধেই দেশজোড়া সেই রোমান বলবত করবার সাহেবি প্রয়াসের সংবাদ আছে এই নিয়ে আমরাও অন্যত্র বিস্তৃত লিখেছি।২৩৬সেদিক থেকে তাঁকে বাংলাভাষা এবং লিপির স্বার্থে প্রথম লড়াকুর সম্মান দেয়া যেতেই পারে।সুতরাং বাংলাতে যে হরফ সংখ্যা কমিয়ে এনে জটিলতা কমানো যেতেই পারে এটি তাঁকে দেখাতে হয়েছিল।হুমায়ুন আজাদ তাঁর প্রবন্ধ সম্পর্কে লিখেছেন,“একজন দক্ষ মুদ্রাকরের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান প্রকাশ পেয়েছে প্রবন্ধটিতে।২৩৬সংস্কার প্রস্তাব সম্পর্কে ভদ্রলোক লিখেছেন,“আমাদের বর্ণমালা সংস্কারের প্রধান উদ্দেশ্য মুদ্রাঙ্কনের সৌলভ্যসাধন।অর্থাৎ ভাষার উচ্চারণের কোনো হানি না হয় অথচ মুদ্রাঙ্কনের সৌলভ্য হয় ইহাই আমাদের অভিপ্রেত।২৩৭

রোমান হরফ প্রচলন প্রয়াসের এই সব ইতিহাস ছিল বলেই সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ও ‘রোমান পক্ষে’র যুক্তির ‘সাম্রাজ্যবাদী’ সার বাদ দিয়ে ‘জাতীয়তাবাদী’ সার প্রবেশ করিয়ে ভিন্ন এক দৃষ্টি থেকে বাংলা সহ সব ভারতীয় ভাষার জন্যে রোমান হরফ প্রস্তাব করেছিলেন,আমরা লিখেছি।বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের দৌলতে আমরা পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রপতি আয়ুবখানের রোমান হরফ প্রচলনের প্রস্তাব যতটা জানি,বাকি ইতিহাস এত কিছু আজ জানিই নাকিন্তু বিষয়টি কি সেখানেই থেমে গেছে? টাইপ রাইটার প্রচলিত হলেও সহজে বাঙালি বাংলাতে টাইপ করতে সিদ্ধহস্ত হন নি। ফলে অফিস আদালতে রোমান হরফে ভারতীয় ভাষা না হলেও ইংরেজির দাপট কমানো যায় নি।আর কম্প্যুটার প্রযুক্তির দিনেও ভারতে অন্তত ছাপা প্রযুক্তিতে কম্প্যুটার আসবার বহু পরেও আন্তর্জালে অসমিয়া - বাংলা লিপিতে লিখতে এবং লেখাতে কিছু মানুষকে কঠিন সব লড়াইর মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ২০১০ থেকেও শুধু কিছু সফলতা দেখা যেতে শুরু করেছে। ফলে রোমান গেল আড়াই শতক ধরেই বাংলা-অসমিয়া সহ ভারতীয় ভাষাগুলোর নানা ভাবেই লেখার ছোট সহযোগী লিপি হিসেবে থেকে গেছে।

সুতরাং লড়াইটা শুধু বাংলা অসমিয়া লিপিরই নেই। সে লড়াই বহুমুখী। ভেতরেরও বহু লড়াইয়ে বিজয়ী হয়েই তবে লিপিগুলোকে এগোতে হয়েছে। আমরাতো অনেকে এও মানতে প্রস্তুত নই,বা জানিও না যে আজ যাকে বাংলা বা অসমিয়া লিপি বলে আমাদের বড়াইর কোনো অন্ত নেই তাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল ছাপাখানাই শুধু। আবার ছাপাখানার যুগের সাহেবি রাজনীতিটি যদি প্রতিষ্ঠা পেয়ে যেত তবে বহু উপনিবেশের মতো ভারতেরও সব ভাষার জন্যে লিপি হয়ে যেতে পারত রোমান।লিপি নিয়ে বাংলা অসমিয়া বিবাদের কিছুই অবশিষ্ট থাকত না।বাংলার লেখার জন্যে আর যে আট নটি লিপি এর আগে ব্যবহৃত ত বলে আমরা লিখে এসেছি সেগুলোর অনেকগুলোকে মুদ্রণশিল্প বাদ দিল বলেই সেগুলো আর বাংলাতে  অস্তিত্বই টিকিয়ে রাখতে পারল না। শুধু সিলেটি নাগরী কিছুদিন চেষ্টা করেছিল মাত্র।যারা এই বাংলা লিপিকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর সহ অজস্র ব্যক্তিত্বকে তার জন্যে বহু অপমানের মধ্য দিয়েও যেতে হয়েছে।আমাদের সংস্কারাচ্ছন্ন মন এখন যেমন ছেলেমেয়েকে বারোটা বাজাচ্ছে আন্তর্জাল বলে সতর্কবাণী শুনিয়ে থাকে,সেকালেও দেখা ধর্ম যাবার ভয়।সাহেবরা বাদ দিলে ছাপাখানার বিস্তারে নিম্নবর্ণ হিন্দু ছুতোর,কর্মকার আর মুসলমানেরাই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন।পঞ্চানন কর্মকারের ইতিহাস কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।বামুনেরাপুথি সাহিত্যে আধিপত্য না ধ্বসে যায় তাই জাত যাবার ভয় দেখাতেন। রাজা রামমোহন রায়,ভবানী চরণ বন্দ্যোপাধ্যায়রা যখন বই পত্র লিখছেন,কাগজ বের করছেন ভালো নজরে নেয় নি তখনকার নাগরীক বনেদী সমাজ১৮৩০শেশ্রীমদভাগবতেরমতো বই ছাপিয়ে ভবানীচরণকে বিজ্ঞাপন দিতে হচ্ছে তাঁর এই বইয়ের কম্পোজিটাররা সবাই ব্রাহ্মণ আর ছাপার কালি গঙ্গাজলে শুদ্ধ করে নেয়া হয়েছে।শতকের মাঝামাঝি যখন ঢাকাতে ব্রাহ্মসমাজের জনাকয় অগ্রণী পুরুষবাংলা যন্ত্রনামে প্রথম ছাপাখানা খোলেন তখনভদ্রঘরের সন্তান হইয়াও ইহারা এমন দুষ্কর্ম করিলেনবলে শহরের বহু বামুন-কায়েত রুষ্ট হয়েছিলেন।বহুদিন এরা অনেকে ছাপা-মাধ্যমকে প্রতিহত করেপুঁথিসাহিত্যকে রক্ষা করবার জন্যে লড়েছিলেন।কলকাতার সমাচারপ্রবন্ধে বিনয় ঘোষ উল্লেখ করেছিলেন,“ছাপাখানার প্রথম যুগে আমাদের দেশের বড় বড় জমিদারেরা অনেকে যে তার বিরোধিতা করেছিলেন,তারও প্রমাণ পাওয়া যায়।অর্থাৎ সাধারণ লোকের মধ্যে বিদ্যা জ্ঞান বিতরণ করতে তাদের আপত্তি ছিল,তাছাড়া গোঁড়ামিও ছিল।ধর্মগ্রন্থ ছাপা হবে, তাঁরা ভাবতেও পারতেন না।তাই তাঁরা পাল্লা দিতে আরম্ভ করেছিলেন প্রেসের সঙ্গে।দলবদ্ধ হয়ে তাঁরা পেশাদার অনুলেখকদের দিয়ে ধর্মগ্রন্থ কপি করিয়ে দল করতে শুরু করতে আরম্ভ করলেনহঠাৎ এই সময় বোস্টম-বোস্টমী কপিস্টদের কিছু রোজগার বাড়ল বটে,কিন্তু পাল্লা দেওয়া সম্ভব হলো না।বটতলার প্রকাশকদের অভিযানের সামনে জমিদারদের পাণ্ডুলিপি ষড়যন্ত্র টিকল না।বটতলার জয় হলো,তথা ছাপাখানার লোকসাধারণের।২৩৮বাংলাভাষাকে যে জন বীমসের গবেষণা উদ্যোগ নেবার আগে অব্দি এবং বঙ্কিমেরবাঙ্গালা ভাষাপ্রবন্ধের আগে অব্দি সংস্কৃত প্রায় করে তোলা হয়েছিল সেই অনেকটা রক্ষণশীলদের সঙ্গে আপস করবার জন্যেও।অর্থাৎ ভবানীচরণ কালিকে গঙ্গাজলে শুদ্ধ করুন চাই নাই করুন,পরের কালের লেখক প্রকাশকেরা ভাষাকে অবশ্যই দেবভাষা-প্রায় করে তুলেশুদ্ধকরে নিচ্ছিলেন।লড়াইটা শুরু হয় বঙ্কিমের ওই প্রবন্ধ থেকেতুঙ্গে ঠে রবীন্দ্রনাথ,রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীদের নেতৃত্বে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রতিষ্ঠাতে এসে।এই ইতিহাসের সঙ্গে অসমিয়া ভাষা এবং লিপির বিকাশও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িয়েছিল,সেসব অনেকেই স্বীকার করেন।এমন কি বাংলার স্বাস্থ্য না নিয়ে গিয়ে ব্যাধির সংক্রমণ ঘটাবার অভিযোগও রয়েছে

বহু সাধারণ অসমিয়া এবং অনেক বিদ্বজ্জনেরও ধারণা হেমচন্দ্র বরুয়ার ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘হেমকোষ’ অসমিয়া ভাষার স্বকীয়তার প্রতিষ্ঠাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।একে ইতিহাসের বিড়ম্বনা বলাই ভালো।আসলে এই সময় উইলিয়াম কেরির পাঠশালা থেকে বাংলাভাষাতে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত যে ব্যাধির বিরুদ্ধে বাঙালি লড়তে শুরু করেছে,যে ব্যাধির বিরুদ্ধে শিবসাগরের মিশনারিরাও উনিশ শতকের মাঝভাগেই লড়তে শুরু করেছিলেন—সেই ব্যাধিকে অসমিয়া ভাষা বরণ করে নিল এই ‘হেমকোষ’-কে ধরে নিজের অজান্তেই।এই সব আমাদের তত্ত্ব নয়। অসমিয়া পণ্ডিতেরাই লিখছেন বিশ শতকের শেষ ভাগে এবং একুশ শতকে,আমরা ধীরে ধীরে স্পষ্ট করছি।

শিবসাগরের মিশনারিদের সঙ্গে লড়ে ‘ৱ’ বর্ণটির প্রচলন ঘটালেন বলে মনে করবার কোনো কারণ নেই যে হেমচন্দ্র বরুয়ার বাংলা-ভাষা-সাহিত্য-লিপির বিরুদ্ধে কোনো রকম বিরাগ ছিল।বরঞ্চ সে সময়কার যে কোনো অসমিয়া মধ্যবিত্তেরই মতো প্রবল অনুরাগ ছিল।অরুণোদয় যখন বেরুচ্ছে সে সময়ে আসামের সরকারি ভাষা বাংলা ছিল। সেই বাংলা চাপিয়ে দেবার জন্যে সেকালের বাঙালি আমলা-কেরানি কুলকে দায়ী করবার তত্ত্বটি বিশ শতকে অসম সাহিত্য সভার প্রতিষ্ঠার সমবয়সী।২৩৯তার কিছুদিন পরেই ভারতে মণ্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন চালু হবে এবং নির্বাচনী রাজনীতি শুরু হবে।ইতিহাসের এই সব ঘটনাক্রম পরস্পর সম্পর্কিত আমরা অন্যত্র আলোচনা করেছি।২৪০এর আগে এই সব কথা কেউ বলতেনও না,ভাবতেনও না।এখনো যারা এই তত্ত্বের বিরোধিতা করেন তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক হীরেন গোঁহাই,অধ্যাপক প্রফুল্ল মোহন্ত,অধ্যাপক শিবনাথ বর্মণ,অধ্যাপক প্রসেনজিৎ চৌধুরী,অধ্যাপক দেবব্রত শর্মা প্রমুখের বহু রচনাতে সেই সব ইতিবৃত্তের উল্লেখ আছে।বিশেষ করে ড প্রফুল্ল মহন্তের ‘অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ইতিহাস’২৪১ এবং শিবনাথ বর্মণ ও প্রসেনজিৎ চৌধুরীর যৌথ রচনা ‘বাস্তব নে বিভ্রম’২৪২ পড়ে দেখা যেতে পারে।প্রফুল্ল মহন্ত লিখছেন,“আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকন (১৮২৯-৫৯),হেমচন্দ্র বরুয়া ( ১৮৩৫-৯৬),আরু গুণাভিরাম বরুয়া (১৮৩৭-৯৪) এই ত্রিমূর্তীয়েই আছিল ইংরাজী শিক্ষারে শিক্ষিত,অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অগ্রজ।এওঁলোকর ভিতরত আনন্দরামেই প্রথমে অসমীয়া ভাষার হকে মাত মাতিছিল।যি সময়ত তেওঁর পিতৃ-পিতৃব্য সকলোয়ে নিজর ভাষাটোর প্রতি উদাসীনতা অবলম্বন করিছিল,সেই সময়ত আনন্দরামে অকলসরে মাত মাতিছিল,তেওঁর কৃতিত্ব সেইখিনিতে‘অরুণোদই’র অবদান স্বীকার করি লৈও ক’ব লাগিব যে,হেমচন্দ্র–গুণাভিরামেই আধুনিক অসমীয়া ভাষা-সাহিত্যর ভেটিটো নির্মাণ করিছিল। তৎ-স্বত্বেও,এই কথা অনস্বীকার্য যে,তিনিওজনরে বাংলা ভাষা-সাহিত্যর প্রতি আছিল গভীর অনুরাগ।এইটোও অনস্বীকার্য যে,এই ত্রিমূর্তীয়ে,ব্রিটিছে অসমত বাংলাভাষা প্রবর্তন করার কারণে বাঙালী আমোলাক ক’তো জগরীয়া করা নাছিল।”২৪৩এরা তিনজনেই ছিলেন রামমোহন বিদ্যাসাগরের ধর্ম-সমাজ সংস্কারের নিষ্ঠাবান অনুগামীআনন্দরামের ঠাকুরদাদা যজ্ঞরাম রাজারামমোহনের ঘনিষ্ঠ অনুগামীদের একজন ছিলেন।২৪৪গুণাভিরাম বরুয়া বিদ্যাসাগরের ছেলের বিয়েতে স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন।বিধবা বিবাহের সমর্থনে ‘রাম-নবমী’ নাটক লিখেছিলেন।২৪৫এবং স্বয়ং প্রথমা পত্নীর মৃত্যুর পরে বিধবা রমণী বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীকে ১৮৭০এ ব্রাহ্মমতে বিয়ে করেন।তার আগের বছরে তিনি ব্রাহ্মও হন।২৪৬তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ চিঠি পত্র আদানপ্রদান চলত হেমচন্দ্র বরুয়ার।তিনিও লেখালেখিতে ব্রাহ্মণ্য আচার অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করাতে পরিচিত জনের বিরাগ ভাজন হয়েছিলেন।ব্যক্তিগত জীবনে আচার মেনে চলতেন না, অব্রাহ্মণ রাঁধুনি রেখেছিলেন।এইসব নানা কারণে অসমিয়া ব্রাহ্মণ সমাজ তাঁকে জাতিচ্যুত বলে ভাবতেন,এবং মৃত্যুর পরেও তাঁর শরীর স্পর্শ করে দাহন করা যাবে কিনা সেই নিয়ে মহা সংশয় উপস্থিত হয়েছিল।২৪৭সুতরাং তাঁর ভাষাচিন্তাতেও বিদ্যাসাগরের এবং বঙ্কিমের চিন্তার গভীর ছাপ পড়েছিল এমনতর ভাববার কারণ আছে।

জন বীমস থেকে বঙ্কিমের শেষ দিকে ভাষা চিন্তাতে বিশেষ করে বাংলা ভাষা চিন্তাতে যে নতুন ভাবনার বিকাশ ঘটছে সেসবের সঙ্গে হেমচন্দ্র বরুয়ার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল না এমনটা ভাববার অনেক সঙ্গত কারণ আছে।তিনি মারা যান, ১৮৯৬তে।তাঁর অসমীয়া ভাষার ব্যাকরণব্যাকরণ বেরোয় ১৮৫৯তেসেটিকে যে গোলোকচন্দ্র গোস্বামী ‘অসমীয়া ব্যাকরণর সুদৃঢ় আরু সুনির্মিত বুনিয়াদ’ বলে ভূষিত করেছেন,সেসব আমরা প্রথম অধ্যায়ে কিছু উল্লেখ করেছি।তাঁর অভিধান ‘হেমকোষ’ প্রকাশিত হয় চার দশক বাদে মৃত্যুর পরে  ১৯০০ খ্রিস্টাব্দেএই সময়টাতেই ওদিকে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ গড়ে উঠছে।বাংলা সন ১৩০০পরের বছর থেকেই নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’এই পত্রিকাতেই নতুন চিন্তার ঢেউ ওঠে। সেই ঢেউ এক সময়  গিয়ে ‘সবুজপত্র’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে তৎসম শব্দবহুল বাংলা সাধুভাষাকে সাহিত্যের জগত থেকে  বিদেয় জানায়।এইসব ঘটনাক্রমের সঙ্গে হেমচন্দ্র বরুয়ার পরিচয় না ঘটাতে যে বিড়ম্বনা ঘটল তাঁর বিরুদ্ধে আগে প্রশ্ন উঠেছিল কিনা,আমাদের জানবার সুযোগ হয় নি।কিন্তু ষাট-সত্তর দশক থেকে আধুনিক কাঠামোবাদী ভাষাবিজ্ঞান চিন্তার সঙ্গে যখন বাংলা অসমিয়া দুই ভাষাই পরিচিত হচ্ছে তখন অসমিয়া ভাষাবিদদের মধ্যে প্রবলভাবেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে।অসমীয়া ভাষাবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বরকটকীই সম্ভবত প্রথম প্রশ্নগুলো তোলেনতিনি ১৯৩২শে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞানে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।১৯৭২এ  ‘দৈনিক অসম’ কাগজে প্রবন্ধ লিখে অসমিয়া বানানের সংগে বর্ণমালা সংশোধনের বেশ কিছু প্রস্তাব রাখেন। সেই নিয়ে প্রবল তর্কের ঝড় ওঠে। গোলকচন্দ্র গোস্বামী সেই নিয়ে ‘আমার অসম’-এ  ২০১০এ ‘অসমীয়া জাতীয় অভিধান:এক নতুন দিগন্ত উদ্ঘাটিত’ শীর্ষক প্রবন্ধে লেখেন,“তেতিয়ার একমাত্র ‘দৈনিক অসম’ কাকতত এটা আলোড়নর সৃষ্টি হৈছিল;আচার্য মনোরঞ্জন শাস্ত্রী,দেবেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য,বিশ্বেশ্বর হাজরিকা, ডভগবান মরল আরু কেইবাগরাকীও লোকে সক্রিয়ভাবেই অংশগ্রহণ করিছিল।এইবোর বিতর্কত মোর লিখাবোরকে সংকলন করি ১৯৭২চনর মোর ‘অসমীয়া আখরজোঁটনি’ বোলা নিচেই সরু কিতাপখন প্রকাশ করিছিলোঁ;তাতেই অসমীয়া ভাষার কারণে সরলীকৃত অসমীয়া বর্ণমালা এখনো দাঙি ধরিছিলোঁ।সত্যেন্দ্রনাথ বরকটকীয়েও আমার বর্ণমালা সরল করিবলৈ প্রস্তাব দাঙি ধরিছিল। তেখতর সরল ব্যঞ্জন বর্ণমালাখন মোর সৈতে প্রায় একেই আছিল।কিন্তু স্বরবর্ণমালাখনর সরলীকরণ মোরখনতকৈও এখোপ চার আছিল।(অনুসন্ধিৎসু পাঠকে ১৯৭২ চনর ১০ এপ্রিলর ‘দৈনিক অসম’খন পঢ়ি চাওক।)”২৪৮

সত্যেন্দ্রনাথ বরকটকীর যে নিবন্ধটির কথা গোলোকচন্দ্র উল্লেখ করেছেন,সেখানে তিনি স্বরবর্ণমালাতে ‘ই-থেকে ঔ’ অব্দি বাদ দিয়ে এই ভাবে লেখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন,“অি,অু,অে,অৈ,অো,অৌ’২৪৯তিনি হুমায়ুন আজাদ সংকলিত সেই ‘অজ্ঞাতনাম’ লেখকের প্রস্তাবের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন?মনে প্রশ্ন তো জাগেই।প্রস্তাবগুলো হুবহু একই, শুধু সত্যেন্দ্রনাথ ‘ঈ,ঊ’ বা ‘অী,অূ’বাদ দিয়েছিলেন।ঋ,৯তো অবশ্যইআর ‘ক্ষ’ যুগ্মব্যঞ্জন,যেটিকেও নিতান্ত অদরকারেই অনেকেই মনে করেন বাংলা বর্ণমালার সঙ্গে অসমিয়ার স্বাতন্ত্র্যচিহ্ন,সেটি সম্পর্কে লিখেছিলেন,“‘ক্ষ’ অনাবশ্যকীয় যিহেতু ‘লক্ষ’ আদি শব্দক আমি ‘লখ্য’ বুলিহে সংস্কৃতে উচ্চারণ করোঁ।‘ক্ষ’ আখরর সংস্কৃত উচ্চারণ ksmh অসমীয়া ভাষাত নাই।”২৫০

সেইসব বিতর্কের ভেতর দিয়ে গেলেই বোঝা যাবে শুরু ‘ৰ,ৱ’-তেই নয়,আরো বহু বর্ণেই স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে অসমিয়া বাংলার থেকে স্বতন্ত্র পথে যেতে পারতো,অথবা যাওয়া উচিত ছিল--- তবু গেল না কেন? কেন তার বর্ণমালা মোটের উপরে বাংলার মতো একই রয়ে গেল? কী করে তার মধ্যেও য়, ৎ, ঁ, ং এই সব এসে গেল? যে ভাষাতে মূর্ধন্য উচ্চারণ বলে কিছু নেই সেই ভাষাতে ‘ড়,ঢ়’ এসে ঢুকলো কী ভাবে? ডিম্বেশ্বর নেওগরা ‘ৰ,ৱ’ নিয়ে ব্যস্ত রইলেও সেসব কথা বিশেষ ভাবলেন বলে দেখিই না।বাংলার থেকে অসমিয়াকে স্বতন্ত্র করতে গিয়ে তাঁদের নজরের সমস্তটা গিয়ে পড়ল ‘কামরূপী প্রাকৃত’ এবং ‘কামরূপী লিপি’র দিকে।এদিকে অসমিয়া বর্ণমালা ছাপাজমানাতে গড়ে উঠা নবীন বাংলা বর্ণমালাকে অসঙ্গতভাবে অনুসরণ করে বসে রইল।যদিও এই সব যে ধ্বনিতত্ত্ব সমর্থিত নয়,সেসব তো বাণীকান্ত কাকতির সময় থেকেই সবাই জানতেন।ধ্বনিতত্ত্ব প্রসঙ্গে সেসব আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে লিখে এসেছি।

             আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানী ড ভগবান চন্দ্র মরল ২০১০এ ‘আমার অসম’ কাগজে এক নিবন্ধে এই সব বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভে লিখেছিলেন,সেখানে অসমিয়া বর্ণবিন্যাস কীভাবে বাংলার মতো হয়ে গেল বোঝা যাবে,“বঙলা ভাষাত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর আদিয়ে কথিত চলতি বাংলাক ঘিণ করি সংস্কৃত শব্দ আরু শব্দ গঠনর ব্যাকরণ গ্রহণ করি সাহিত্যর ভাষা রূপে এটা সাধুভাষা সৃষ্টি করিছিল,তেওঁলোকর আখরবোর সংস্কৃত বর্ণর উচ্চারণ থকা বাবে উচ্চারণতে বানান কেনে হ’ব পারে জানে বাবেই বানান বিভ্রাট নহয়।কিন্তু অসমীয়া আখরবোরর লগত সংস্কৃত উচ্চারণর মিল নাই বাবে সংস্কৃত শব্দর উচ্চারণ অসমীয়াত দন্ত্য স,মূর্ধণ্য ষ,তালব্য শ আরু স্বর বর্ণর হ্রস্ব-দীর্ঘর পার্থক্য ধরিব নোয়ারি বানানত ভুল হোয়ার সন্দেহ রৈ যায়।শ্রদ্ধেয় হেম বরুয়াদেবে দেবভাষাক সম্মান করি আরু বাংলা ভাষাক অন্ধ অনুকরণ করি কথিত চলিত অসমীয়া ভাষাক একপ্রকার অবজ্ঞা করি সংস্কৃতর অ-ফলা আরু ক-ফলা অবিকৃত রাখি বিজতরীয়া অসমীয়া ভাষার অভিধান আরু ব্যাকরণ সৃষ্টি করিলে।তাতে আকৌ বঙলা প্রীতির বাবে সংস্কৃতত নথকা অথচ বঙলা ভাষার আছুতীয়া উচ্চারণত আখর ‘ড’ই বিন্দু ‘ড়’,‘ঢ’ই বিন্দু ‘ঢ়’ আরু সংস্কত ‘য’ই (ইঅ’) আখরর সলনি ‘য’ই বিন্দু ‘য়’ অধিকা আখর এটা অসমীয়াতো সংযোজন করিলে। এই দরে সাধুভাষার নামত সাধারণ শ্রমকোঙা জনগণর মুখর মাতষার অবজ্ঞা-অবহেলার গহ্বরত রাখি আভিজাত্যর গৌরব ঘোষণা করি বিজতরীয়া অসমীয়া ভাষার বিজয় সৌধ রচনা করিলে।তাকে লৈ আজি কোনো কোনোয়ে আমোদ-আনন্দত আপোনপাহরা হৈ নিজকে জটিলতার ‘নাগপাশেরে’ বান্ধি রাখি ‘চরম ঔদ্ধত্যরে’ উন্নাসিকতারে (?) পরিচয় দিবলৈ অকণো হেলা নকরিলে।”২৫১দেখা যাচ্ছে,ড ভগবান চন্দ্র মরল ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে’র বৃত্তান্তগুলো জানেন না।বাংলাতেও যে একই প্রশ্ন বহু আগে উঠেছিল এবং সেই প্রশ্ন ধরে বাংলা ভাষা কাঠামো বহুদূর পালটে  গেছে সেদিকে নজর না দিয়েই মেনে নিচ্ছেন বাংলাতে সংস্কৃতের অনুসরণ সংগত,অসমিয়াতে নয়।এই সব অবশ্য বর্তমান প্রসঙ্গে বাহুল্য।কিন্তু সংস্কৃত কিংবা একুশ শতকীয় বাংলাকেও অনুসরণ করা অসমিয়া ভাষার পক্ষে সংগত নয় এই নিয়ে বিরোধ থাকা উচিত নয়।অথচ,ঘটনা ঘটেছে এই,সারা বিশ শতক জুড়ে বাংলা সাধুভাষা কাঠামোকে অনুসরণ করে গেলেও ভাষা চিন্তার ইতিহাসকে অনুসরণ করতে বহু জায়গাতেই ব্যর্থ হয়েছেন।অথবা ‘অসমীয়া জাতীয় অভিধান’-এর মতো কীর্তি মুহম্মদ শহীদুল্লাহের আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধানের সমকালেই অসমিয়াতে দেখা দিতে পারতযদিও আমরা আগেও লিখেছি,‘অসমীয়া জাতীয় অভিধান’ শহীদুল্লাহের সেই অভিধান বা অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধান থেকে উন্নত ভাবনার ফসল।সম্ভবত কাজটি পরে হল বলেইতারা একই অভিধানে মান অসমিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন ভাষাবৈচিত্র্যের শব্দকে একপাতে আসন না দেবার সংস্কারমুক্তি ঘটিয়েছেন, বাংলাতে যা এখনো হওয়া বাকি। 

            ‘হেমকোষ’ এবং হেমচন্দ্র বরুয়ার ভাষাভাবনার সমালোচনাতে আরো এক লেখক,সমাজবিজ্ঞানী এবং ভাষাচিন্তক রাজেন বরুয়া ‘আমার অসমে’ একই সময়ে আরেক নিবন্ধে লিখছেন,যে মাইলস ব্রনসন ১৮৭৩এ আসামের প্রশাসনিক ভাষা অসমিয়া প্রচলনের অন্যতম প্রেরণা,যিনি তাঁর ১৮৬৭তে প্রকাশিত অভিধানে অসমিয়া ভাষা এবং বর্ণক্রমকে সঠিকভাবেই বুঝেছিলেন তাঁকে প্রায় হতাশ করে ফেলেছিলেন হেমচন্দ্র বরুয়া এবং সমকালীন অন্যান্যরা। তিনি লিখছেন,“...মাইলচ ব্রনচনর অভিধানক বেশি আগবাঢ়িবলৈ দিয়া নহ’ল১৮৭৩সনর ভিতরত অসমীয়া বাংলার পরা পৃথক ভাষারূপে স্বীকৃত হয় আর ই আদালতর ভাষারূপে পুনর প্রতিষ্ঠা হয়।এইখিনি সময়তে অসমীয়া ভাষাকো বৃহত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির সৈতে অধিকতত সম্বন্ধ অনা হয়।কথাটো এনেহে হয় যেন মূলসুঁতির অসমীয়া সকলে হঠাৎ তেওঁলোকর বহুদিন আগতেই হেরোয়া ককাই-ভাই আরু সাংস্কৃতিক শিপাডাল বিচারি পালে। সেই প্রভাবতে মাইলচ ব্রনচনর সরল আখরজোঁটনির বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা চলিল।অসমীয়া পণ্ডিত হেমচন্দ্র বরুয়া আছিল এনে এজন কঠোর সমালোচক যি বাংলা আরু সংস্কৃত বানানর সদৃশ এক বানান পদ্ধতির প্রস্তাব করিলে।স্থানীয় সমালোচকসকলর এনে কঠোর সমালোচনার সমুখত মাইলচ ব্রনচনর প্রকৃতার্থত তেওঁর অভিধানখন প্রকাশর আগতেই পরাজিত হ’ল। বিতর্কত জিকি হেমচন্দ্র বরুয়াই তেওঁর নতুন অভিধানর কামত আগ বাঢ়িল।এইখনেই আছিল ১৯০০ চনত প্রকাশিত হেমকোষ।”২৫২  

            উনিশ শতকে অসমিয়া ভাষা এবং লিপিকে এই বাংলা-প্রায় করে ফেলবার আয়োজন থেকে অসমিয়াকে বের করে আনবার যে প্রয়াস ষাট সত্তর দশকে শুরু হয়েছিল তাঁকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে গিয়ে চারখণ্ডে মহাগ্রন্থ ‘অসমীয়া জাতীয় অভিধান’ যখন ২০১০এ বেরুতে শুরু করে,বছরে একটি করে খণ্ড বেরোয়---সমগ্র অসমিয়া মধ্যবিত্ত সমাজকে সেটি নাড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়।ফলে একে এক রকম অসমিয়া ভাষা আন্দোলন বলেই অভিহিত করা যেতে পারে।তাঁরা লিখছেন,“আমি যাক প্রস্তাবিত বানান,বিকল্প বানান বা সরল বানান বুলি কৈছোঁ,সেয়া কিন্তু অসমীয়া জাতীয় অভিধান সম্পাদনা সমিতি অথবা ইয়ার মুখ্য সম্পাদকর (উর্বর) মস্তিষ্ক প্রসূত নহয়।বরং ই অসমীয়া ভাষা তথা লিপির বিগত অন্তত: ৮০০-৯০০ বছর জুরি প্রবাহিত এক প্রধান ধারা।ক’ব পারি যে ইতিহাসর এক প্রধান ধারা আছিল আরু আজিও ই গুরুত্বপূর্ণ হৈয়েই আছে।”২৫৩লক্ষ করবার বিষয় তারা ৮০০-৯০০ বছরের কথা লিখছেন।অর্থাৎ ‘চর্যাপদ’-র থেকে দিন গুনছেন।তারও সহস্রাব্দ পেছনে চলে যাবার চেষ্টা করেন নি।‘অসমীয়া জাতীয় অভিধান’ গোষ্ঠী যা করেছেন,মান অসমিয়া বাদে বাকি ভাষাবৈচিত্র্যের শব্দে গোলকচন্দ্র গোস্বামীকে স্পষ্টই অনুসরণ করেছেন।তাঁরা লিখেছেন,“উপভাষার শব্দসমূহর আখর জোঁটনির ক্ষেত্রত অসমীয়া জাতীয় অভিধানর মুখ্য উপদেষ্টা ড গোলকচন্দ্র গোস্বামীর এই খিনি কথা আমি মানি চলিম,‘আঞ্চলিক বা উপভাষিক শব্দবোর আমার নতুন সরল আখর –জোঁটনিরে দেখুওয়া ভাল। তেনে শব্দত ব্যঞ্জনর দন্ত-মূর্ধন্যর ঠাইত দন্ত্য,আরু হ্রস্ব-দীর্ঘর ঠাইত হ্রস্ব লিখিব লাগে।উচ্চারণতেই তো আমার ভাষাবোরত দন্ত্য-মূর্ধন্য পোয়া নাযায়,অবশ্যে বর্ণগত (phonemically) ভাবে। সেই দরে স্বরর মাত্রাও শব্দর অবস্থানর ওপরত অর্থাৎ শ্বাসাঘাতর ওপরত প্রধানত: নির্ভর করে।এইবোর আমার ভাষার স্বাভাবিক বিজ্ঞাত (predictable) বিষয়,বর্ণগত নহয়।”২৫৪ প্রায় একই বানান পদ্ধতি তাঁরা মান অসমিয়া শব্দগুলোর জন্যেও বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে রেখেছেন।এখনই প্রচলিত বানানগুলো বাদ দেন নি,কিন্তু পাশাপাশি বিকল্প বানানের শব্দও রেখেছেন। যেমন: ‘খাদ্য সহযোজক’ শব্দটির বিকল্প বানান হচ্ছে ‘খাদ্য সহজোজক’;‘ঘাটি’ শব্দের বিকল্প বানান হচ্ছে ‘ঘাতি’,‘গুপ্তবেশ’ বিকল্প হচ্ছে ‘গ‌ুপ্তবেস̖’, ‘শুক্র’ বা ‘শ‌ুক্র’ বিকল্প হচ্ছে ‘সুক্র’সম্পাদকের নাম প্রথম দুই খণ্ডে ছাপা হচ্ছে ‘ দেবব্রত শর্মা’,শেষ দুই খণ্ডে ‘ দেবব্রত শর্মা’এই সব সংস্কার প্রস্তাব গৃহীত হয়ে গেলে বা প্রচলিত হলে অসমিয়া বর্ণ সংখ্যা যে বেশ কিছু কমে আসবে সেই নিয়ে কোনো সংশয় নেই।তারা এমন কি বডো,মিশিং,কার্বি ইত্যাদি ভাষার অসমিয়াতে প্রচলিত শব্দ অভিধানে লিখবার জন্যে এই  ‘ৗ’ (অৗ) স্বরলিপি চিহ্নকেও সম্মানে ঠাই দিতে দ্বিধা করেন নি।

            এই ‘গ‌ু,শ‌ু’ ইত্যাদি প্রসঙ্গে উল্লেখ করা ভালো গেল শতকের শেষদিকে ১৯৯৭ নাগাদ ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি’ বাংলা যুগ্মহরফের জন্যে এরকম বেশ কিছু সরলীকরণের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন।‘আকাদেমি বানান অভিধান’-এও তাঁরা সেই রীতি অনুসরণ করেছেন।তাঁদের যুক্তিটি পরিষ্কার,“বাংলা লেখার রীতিতে স্বরচিহ্নযুক্ত একক ব্যঞ্জনের (ক গ র) বা যুক্তব্যঞ্জনের (ক‌্র,র্ক,গ‌্র) বিন্যাসে একই বর্ণের একাধিক চেহারা প্রচলিত(যেমন গ গু র রূ; ক̖+র=ক্র;ক̖+র=ক্র)ভাষাবিজ্ঞানে একে বলে allograph,অর্থাৎ সমান্তরালভাবে,কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে,বর্ণের ভিন্নরূপ।বর্ণমালা-লিখনে বা ভাষা শিক্ষায়,প্রয়োগগত সমতাবিধানের জন্যে সেগুলিকে যথাসম্ভব একই চেহারায় নিয়ে আসার ভাবনাচিন্তা  বিজ্ঞানসম্মতভাবে নানা দিক থেকে শুরু হয়েছে।আধুনিক মুদ্রণে যেহেতু আর পূর্ব- থেকে-ঢালাই  হরফের প্রয়োগে বা ব্যবহার অপরিহার্য নয়,তাই সমতাবিধান বর্তমানে সম্ভব ও সংগত। কেবল সামান্য অভ্যাসেই তা চোখে মানানসই ও ব্যবহারে সন্তোষজনক হতে পারে।”২৫৫ প্রযুক্তির গতিপথ যারা অনুধাবন করতে পারেন নি সেরকম অনেকেই এই সব প্রস্তাবের এখনো বিরোধিতা করেন। সেই ভ্রান্তির শিকার সুজিৎ চৌধুরীও হয়েছিলেন।তিনি এই বিতর্কে অংশ নিয়ে এক জায়গাতে লিখেছিলেন,“এই পরিবর্তনের সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ায় আমরা যাচ্ছি না,তাৎক্ষণিক ও স্থূল কিছু অসুবিধার কথা বলি।এতদিন বাংলা ও অসমিয়া বর্ণমালায় যুক্তাক্ষরের চেহারা একই ছিল।পশ্চিম বঙ্গে দৃষ্টিসিদ্ধ যে পরিবর্তন যুক্তাক্ষরের ক্ষেত্রে আনা হচ্ছে,অসমিয়া লিপির ক্ষেত্রে তা অনুসৃত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।আসামের ছাপাখানা বাংলা আর অসমিয়া একই যুক্তাক্ষরে ছাপে।ফলে আসামের বাংলা যুক্তাক্ষর আর পশ্চিমবঙ্গের যুক্তাক্ষর দুটো স্বতন্ত্র রূপ পাবে,আসামের বাংলা পড়ুয়া পশ্চিমবঙ্গে ছাপা বাংলা বই পড়তে হোঁচট খাবে।”২৫৬প্রযুক্তির বিকাশের জমানাতে ‘অসমিয়া লিপির ক্ষেত্রে তা অনুসৃত হওয়ার সম্ভাবনা’ না দেখা দেবার কোনো কারণই ছিল না। এক মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক হিসেবে উৎপাদনের উপকরণের এই ভূমিকার দিকে তিনি তাকাতেই পারতেন।

এই খানে যুক্তাক্ষর নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অসমিয়া জাতীয় অভিধানের অভিজ্ঞতার কথাটি আমাদের মনে পড়ছে।বাংলার লিপি বিকাশেও আমাদের ভাবনাকে সমৃদ্ধ করতে পারে।তাঁরা লিখছেন,এই অভিধান নিয়ে কাজ করতে যাবার আগে অসমিয়া যুক্তাক্ষর নিয়ে তাঁদের কোনো ধারণাই ছিল না। কোনো ব্যাকরণে ৪৫,কোনোটিতে বা ৬০ লিখে রেখেছে যুক্তাক্ষরের সংখ্যা“আচরিত কথা যে এতিয়ালৈকে প্রকাশিত কোনো অভিধানতে এনে যুক্তাক্ষরর ক্রমটো দূররে কথা,সিবিলাকর তালিকা বা সংখ্যার উল্লেখ পর্যন্ত পাবলৈ নাই।”২৫৭ তাঁরা কাজ করতে শুরু করে দেখলেন যে অসমিয়া ভাষাতে প্রায় ২২৩টি যুক্তাক্ষরের দরকার হচ্ছে।কিন্তু,“কথা ইমানতে শেষ নহল।আরু থাকিল বাকী।স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ,যুগুতোয়া সমন্বিতে অসমীয়া ভাষাত ব্যবহৃত মুঠ চিহ্ন বা glfy অর সংখ্যা ৮৭৮টা বুলি আমাক জনালে আমার চফ̖তয়ের নির্মাতা ইন্দ্রকান্ত দত্তই। সেয়ে হ’লে চিনা ভাষার আখরতকৈ অসমীয়া ভাষার চিহ্ন প্রায় দুগুণ।”২৫৮এই ছবিটা বাংলা ভাষা সম্পর্কেও একই হবার সম্ভাবনাফলে তাঁরা যে ‘বিনম্র প্রচেষ্টা’ হাতে নিলেন,বাংলাতেও সেরকম ভাবা জরুরি বটে,“কোয়া বাহুল্য যে বর্ণানুক্রমর বিরাজ করা এনে জটিল পরিস্থিতি জটিলীকরণপন্থীসকলে আরু কুটিলহে করি তোলার আশঙ্কা আছে।সরলমনা সরলীকরণপন্থী হিচাপে আমি এই ধূয়লী কুয়লী পরিস্থিতি শাম কটাই প্রচলিত আখর বা চিহ্নসমূহর পদ্ধতিগত ক্রম নির্মাণর বিনম্র প্রচেষ্টা করিছোঁ মাত্র।”২৫৯

 বোঝা যাচ্ছে যে বাংলা-অসমিয়া লিপির ইতিহাসে নতুন বড় মোড় এনেছে কম্প্যুটার প্রযুক্তি।আসতে পারত টাইপ রাইটারেই।কিন্তু কিছু নিয়মিত লেখকদের বাইরে বাংলা-অসমিয়াতে সেটির সেরকম প্রচলন হলই না।আমরা অন্যত্র সেসব বাংলা এবং অসমিয়া দুই ভাষা সম্পর্কেই বিস্তৃত আলোচনা করেছি।২৬০

আন্তর্জালে বাংলা-অসমিয়া লিপি ব্যবহার শুরু হতেই আরেক নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছিল ইউনিকোড কনসর্টিয়াম লিপিটিকে বাংলা বলে লিখে রেখেছে দেখেসেখানে একই ক্রমে অসমিয়া ‘ৰ,ব’ ব্যবহারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এই নিয়ে কিছুদিন সংবাদ মাধ্যমে প্রচুর তর্ক বিতর্ক চলে।আসাম সরকারও প্রয়াস শুরু করে যদি ইউনিকোডে বলে কয়ে হয়,অসমিয়ার জন্যে বিকল্প ব্যবস্থা করা যায়,অথবা কোনো যৌথ নাম রাখা যায়। আমরা এই নিয়ে বিস্তৃত যাচ্ছি নাশুধু ‘শব্দ ডট অর্গ’ এর এক কর্মী এবং অসমিয়া উইকিপেডিউয়ার অগ্রণী কর্মী শিলচর নিটের অধ্যাপক প্রভাকর শর্মা নেওগের এই প্রশ্নে একটি নিবন্ধ ‘শব্দ’ সাইটে তুলে রাখা আছে। সেখান থেকে কিছু কথা তুলে দিচ্ছি,বিতর্ক এবং প্রস্তাবটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে।

 ধাৰণা ১) অসমীয়া ভাষার আখরক বাংলা নাম দি অসমীয়া জাতিক অপমান করি ইয়ার ভাষা সংস্কৃতিক গৌণ করার প্রয়াস করা হৈছে।এই ষড়যন্ত্রত ইউনিকড কনচৰ্টীবামো জড়িত অথবা ইউনিকড কনচৰ্টীয়ামক ভুল তথ্যরে পরিচালিত করি এনে করা হৈছে।

আলোচনা: ইউনিকড পঞ্জীয়নর বাবে ইউনিকড কনচৰ্টীয়ামর নিৰ্দিষ্ট নিয়ম আগতেই সৰ্বসন্মতিক্রমে স্থির করা আছে আরু এইবোর সকলো সিদ্ধ হলেহে তেওঁলোকর মান্যতা পোয়া সম্ভৱ।পঞ্জীয়নর পদ্ধতিটো যথেষ্ট জটিল আরু উচ্চস্তরর বিশেষজ্ঞর প্রয়োজন। কেৱল সেয়ে নহয়,লিপি সম্পৰ্কীয় তথ্য সংগ্রহর বাবে কনচৰ্টীয়ামৰ ওয়েবচাইটতে যিকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে কম খরচতে সহজে ভাগ লব পরার ব্যৱস্থা আছে।এই সম্পৰ্কীয় সকলো নীতি-নিয়মো দ্ব্যৰ্থবিহীন ভাবে বৰ্ণনা করা আছে। কোনোবাই কোনো লিপি সম্পৰ্কীয় কিবা আপত্তি থাকিলে উক্ত পদ্ধতি অনুসরী সেই তথ্য যোগান ধরিলেই হল।লিপি বা সংস্কৃতি সম্পৰ্কীয় এই তথ্যবোরো নিৰ্দিষ্ট নিয়ম মতে সাব্যস্ত করিলেহে তেওঁলোকে এইবোর গ্রহণ করিব।অব্যবসায়িক সংগঠন ইউনিকড কনচৰ্টিয়ামর কোনো জাতি বা ভাষার প্রতি পক্ষপাত দুষ্ট মনোভাৱ থকা বুলি সন্দেহ করারো কোনো কারণ নাই।

গতিকে লিপি বা ভাষা সম্পৰ্কত ইউনিকড কনচৰ্টীয়ামক যদি কোনোবাই কোনো ভুল তথ্য দিয়া বুলি কারোবার সন্দেহ আছে,তেন্তে কনচৰ্টীয়ামর ওয়েবচাইটত গৈ ভালকৈ নীতি-নিয়ম পঢ়ি সেইমতে শুদ্ধ তথ্য উপযুক্ত প্রমাণ সহকারে যোগান ধরিলেই হল।

ধারণা ২) অসমীয়া ভাষাত ‘নিজর’ (অসমীয়া নামত?) ইউনিকড নাথাকিলে জাতির ঐতিহ্যই বিপন্ন,কারণ তেতিয়া ‘অসমীয়াই ইন্টারনেটত নিজর স্বকীয়তা সাব্যস্ত করিব নোয়ারিব’ আরু বেলেগ ভাষার বহতীয়া হৈ রৈ যাব।বা ‘আমি ইউনিকডক আদরি ললোঁ,কিন্তু ইউনিকডে আমাক আদরি নললে।

আলোচনা: ইউনিকড হৈছে এটা কারিকরী মানক বা ষ্টেণ্ডাৰ্ড। কোনো জাতি,ধৰ্ম,কোনোবা ক্লাবর মেম্বারশ্বিপ বা ‘ষ্টেটাচ চিম্বল’ নহয়,যাক ব্যবহার কোনো ব্যক্তি বা গোটক সরু বা ডাঙর অথবা উন্নত বা অনুন্নত বুলি ভাগ করিব পারিগতিকে এইবোর বিষয়ত আৱেগিক হৈ পরা নিস্প্রয়োজন।

লিপিটোর নাম বাংলা।নিজর মরমর আখরকেইটাক নিজর মাতেরে মাতিবলৈ মন যোয়াতো স্বাভাবিককিন্তু কি করিম,আমি সময়র শর সময়ত নমরা কারণে বেলেগে নিজর ভাষাটোর পৃথিবীর যিকোনো স্থানত চৰ্চা করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করি লিপিটো পঞ্জীয়ন করি ললে। তেওলোকে ইউনিকডর সকলো নীতি নিয়ম সম্পূৰ্ণ করি হে এই স্থান পাইছে।অসমীয়া ভাষার ৰ আরু ৱ-র অন্তৰ্ভুক্তিও শুদ্ধ পদ্ধতি অৱলম্বন কৰাৰে প্রমাণ।খুব সম্ভব এইখিনি কাম বাংলাদেশর কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনে করিছে আরু সেয়ে স্বাভাবিকতে নিজর ভাষার নাম দিবলৈ ইচ্ছা করাটো স্বাভাবিক।আমি নিজেও এনে করিবলৈ ইচ্ছা নকরিলোহেতেন নে? আরু এটা কারণো থাকিব পারেতুলনামূলকভাবে এই লিপিত সন্নিহিত চিহ্নর সকলো ভাষার ভিতরত বাংলাভাষী মানুহর সংখ্যাই সরহ,সিও এই নামকরণর কারণ হব পারে

ইউনিকডর নিয়ম বা ফৰ্মুলা অনুসরি একে একে চিহ্নত দুটা লিপি পঞ্জীয়ন করিব নোয়ারি আরু সেয়ে আমি যি পাইছোঁ তাকে ব্যবহার করাই বুদ্ধিমানর কাম।ইউনিকড‘টো’ নিজৰ নামত নাই বুলি আমি নিলিখাকৈ থাকিলেহে জাতিৰ অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হব। তেতিয়া আমি সকলো স্থানতে সুকলমে অসমীয়া ভাষা চৰ্চা করিব নোয়ারিম।কার লোকচান হ?

আমি এটা কাম করিবলৈ চেষ্টা করিব পারোঁআমার বাংলাভাষী ভাই-ভনীসকলক মরমেরে কথাটো বুজাই এটা উমৈহতীয়া নাম গ্রহণ করিবলৈ অনুরোধ জনাব পারোঁ২৬১এই প্রস্তাব নিয়ে বাঙালি পক্ষেরও ভাবাই উচিত।প্রভাকর যদিও নিবন্ধের শেষে লিখে রেখেছেন,“নামতনো কি আছে?ইউনিকডর দরেই সৰ্বব্যাপ্ত ASCII code-তো দেখোন আমেরিকার নাম আছে?আমি সদাই ব্যবহার করিয়েই আছো,গমকে নাপাওঁ।প্রকৃততে সাধারণ ব্যবহারকারীয়ে ইমানবোর কথা নজনাকৈয়ে কম্পিউটার ব্যবহার করিব পরা করাটোও কম্পিউটার বিজ্ঞানর এক অন্যতম লক্ষ্য।সকলো ক্ষেত্রতে নিজর নাম দিবলৈ মানুহে ভাল পায়েই। সেইবুলি সকলোতে সেইটো বিচারিবই লাগিব নেকি?২৬২

 

।। বাংলা ভাষার তৃতীয় লিপি সিলেটি নাগরী।।

‘তৃতীয়’ এর জন্যে যে বাংলা এবং রোমান লিপির পরে পরিমাণের দিক থেকে এটিই তৃতীয় লিপি যা ছাপাখানা অব্দি এসেছিল। সিলেটি নাগরীতে কি সিলেটি লেখা হয়েছে,না বাংলা--- এই নিয়ে এক তর্ক আছে।সমস্যা হলো,তর্কটি বাংলা লিপি নিয়েও করা চলে। যেমন,এই বৈষ্ণব পদটি পড়ামাত্র মনে হবে সিলেটিতে লেখা,“বন্ধুর লাগি কোন দেশে যাইমু/রজনী হৈলে কায় মুখ চাইমু/ভোখে ভাত নাহি খাঙ পিয়াসে না খাঙ পানি/জ্বলিয়া জ্বলিয়া উঠে হৃদয়ে আগুনি/শুতিলে না আইসে নিদ্রা বসিলে পোড়ে হিয়া/বিষ খাই মরি যাইমু কালার বালাই লৈয়া/প্রতাপ আদিত্যে বলে বিড়ম্বনা আশে/মিছা ভুলি রহিলুম এ ভব-মায়ারসে।”২৬৩ হতেও পারে,এটি সিলেটি পদ।কিন্তু সুকুমার সেনের দাবি পদটি পাওয়া গেছে গোবিন্দ্র দাস কবিরাজের নামে প্রচলিত পদ সংগ্রহে এবং ভনিতার প্রতাপাদিত্য  বারো ভূঞার অন্যতমজন যশোহরের রাজা হওয়াই সম্ভব।২৬৪ কিংবা ধরা যাক এই পদটিতো জ্ঞানদাসের নামেই রয়েছে,“দেইখ্যা আইলাম তারে---/সই দেইখ্যা আইলাম তারে/এক অঙ্গে এত রূপ নয়ানে না ধরে।।/বান্ধ্যাচে বিনোদ চূড়া নব গুঞ্জা-দিয়া।/উপরে ময়ুরের পাখা বামে হেলাইয়া...গৃহকর্ম করিতে আল্যায় সব দেহ/জ্ঞানদাস কহে বিষম শ্যামের লেহ।”২৬৫ একে ভাষার বিচারে হবিগঞ্জের সিলেটি না বলবার কতটুকু কী কারণই বা রয়েছে? সিলেটে বিকশিত  বলে আর এখানকারই কিছু বাংলার পুথি সাহিত্য এই লিপিতে লেখা হত বলে এর নাম পড়ে গেছে ‘সিলেটি নাগরী’ তাও এই নামটিই মনে হয়ে সবচাইতে সাম্প্রতিক।নইলে ফুল নাগরী,শুধু নাগরী,মুসলমান নাগরী,দেবনাগরী,আরো কত নাম এর।বাংলা এবং রোমান লিপির পরে এটি তৃতীয় লিপি যা ছাপাখানার মুখ দেখেছিলমুহম্মদ আবুল বশর ‘সিলেটে বাংলা সাহিত্য চর্চাঃ প্রাচীন ও মধ্যযুগ’ নিবন্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন,“লিপি আছে ভাষা নেই--- তা বোধহয় বিশ্বলোকে একটাই,আর তা সিলেটি নাগরী লিপি২৬৬এই লিপিতে লেখা সাহিত্যের ভাষা যে বাংলা এই নিয়ে কোনো সংশয় নেই।গ্রিয়ার্সন থেকে শুরু করে অধিকাংশই তাই লিখেছেন।গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৯তে ‘Jalalabadi Nagri Script and Literature’ শীর্ষক গবেষণা করেছিলেন অধ্যাপক আব্দুল মুসাব্বির ভূঞা অধ্যাপক ঊষারঞ্জন ভট্টাচার্যের তত্ত্ববধানে।তিনিও এর ভাষাকে বাংলাই লিখেছেন।শুধু সামান্য কিছু শব্দ ভিন্নতা এবং স্বতন্ত্র উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যের জন্যে তিনি এগুলোকে ‘সিলেটি বাংলা’ বলে মনে করেন,It would be convenient to refer to it as Sylheti-Bangla”২৬৭এক দল আছেন অতি সাম্প্রতিকতাঁরা মূলত লন্ডন প্রবাসী সিলেটিমনে করেন এটিই একমাত্র লিপি সিলেটির এবং সিলেটি একটি স্বতন্ত্র ভাষা।তাদের কথা কিছু আমরা ষষ্ঠ অধ্যায়ে লিখেছি।এখানে যেহেতু লিপির কথাতেও মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করব,ভাষার বিতর্কে প্রবেশ করা হচ্ছে নাকিন্তু সিলেটি নাগরী মোটেও সিলেট অঞ্চলে একমাত্র লিপি ছিল না সেই কথাও অধ্যাপক আব্দুল মুসাব্বির লিখেছেন,“During the last several centuries,in Chachar, Hailakandi and Karimganj,Sylhet and in parts of Maymanshingh and Tripura side by side with traditional Bengali script,this ingenious script,Syloti Nagri,appeared and gradually became the written medium of local literature in the rural area.”২৬৮এত বিশাল এক অঞ্চলে প্রচলিত লিপিকে,শুধু তার সাম্প্রতিক নাম সিলেটি নাগরী বলে,সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্যের সঙ্গে জুড়ে ভাষার স্বাতন্ত্র্য দাবি করা তাহলে যুক্তি এবং তথ্য সমর্থিত নয়।

সত্য বটে,নাগরী লিপিটি সিলেটি তথা পূর্ববাংলার উচ্চারণরীতি অনুসরণ করে গড়ে ওঠা।এও সত্য যে এর ভাষারীতিতে সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্যের ছাপটি গোপন নয়।কিন্তু সে তো প্রাক-ঔপনিবেশিক কালের প্রায় যেকোনো সাহিত্য কর্ম সম্পর্কেই সত্য।তারউপরে যদি সেই সাহিত্য রাজসভা লালিত না হয়।রাজসভা লালিত প্রাচীন প্রস্তর কিংবা তাম্রফলকগুলোতেই যেখানে স্থানীয় ভাষাবৈচিত্র্যের ছাপ চাপা থাকে নি,সেখানে নাগরী লিপিতে থাকা এই সব সাহিত্যে অন্যরকম আশা করাই বাহুল্য।তবু সাহিত্যের সাধারণ সাধুভাষার প্রবণতাটি মোটেও অস্বীকার করা যাবে না।এই যেমন দইখুরার পদে আছে,“দই খুরা পাগলে কএ পেরমের বিমার জে জন হএ/কিশের নিদরা কিশের খানা পিনা।।/দিবা রাত্রি ওবিরতে চিন্তা করে খেমাইর শাতে/পেরমের মালা করে জপনা...”খাটি সিলেটিতে ‘কিশের নিদ্রা’,দিবা রাত্রি অবিরতে’ এই সব শব্দ সমাবেশ ঘটা উচিত ছিল না।অন্যদিকে সাহিত্যের হাত ধরে এক ভাষাবৈচিত্র্যের শব্দ এবং বাকরীতি অন্য ভাষাঞ্চলে গেছে এমনতরো ঘটনাও অপরিচিত নয়।তাতেই শুরুতেই তুলে দেয়া প্রতাপাদিত্যের বা জ্ঞানদাসের ভনিতার পদ সিলেটের বাইরেও মেলে।জ্ঞানদাসের জন্ম ১৫৬০-এ সিউড়ী ও কাটোয়ার মাঝামাঝি ‘কাঁদরা’ গ্রামে২৬৯নিত্যানন্দ পত্নী জাহ্নবার অনুচর ছিলেন২৭০,সুতরাং নবদ্বীপ এবং আশেপাশেই সারাজীবন কাটিয়েছেন।হতে পারে যে নবদ্বীপে প্রচুর সিলেটি ছিলেন বলেই বাগভঙ্গীটিও রপ্ত করে ফেলেছিলেন।তাই বলে তাঁর পদকে কেউ কখনো সিলেটি বলে স্বতন্ত্র করবার কথা ভেবেছেন বলে জানি না।অধ্যাপক আব্দুল মুসাব্বির ভূঞা আরবি সাহিত্যের অধ্যাপক।সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের সাধারণ ঐতিহাসিক গতিবিধির সঙ্গে পরিচিত নন।তাই তাঁর মনে হয়েছে এগুলো ‘সিলেটি বাংলা’যারা সিলেটি নাগরীকে শাহজালালের কালের বা তারও আগের কালের মনে করেন,তাঁরাও সিলেটে সাহিত্যের ইতিহাসকে বাকি বাংলার সমাজ এবং সাহিত্যের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখেছেন বলেই আমাদের ধারণা। সেই তর্কে পরে আবার আমরা ফিরব

সিলেটি নাগরীর কথা গ্রিয়ার্সন তাঁর মহাগ্রন্থে খুব ছোট করে আলোচনা করেছিলেন,‘Written Character২৭১উপশিরোনামে। সেই অধ্যায়ে যেখানে তিনি পশ্চিমা সিলেটি (Western Sylhet) নিয়ে কথা বলছিলেন।২৭২তাঁর তথ্যগুলো খুবই সামান্য।লিপিটিকে লিখছেন ‘দেবনাগরী’ বলে।নিম্নশ্রেণির মুসলমানদের মধ্যে শিখতে সহজ বলে দেবনাগরীতে স্বাক্ষর দেবার রীতি আছে।এর বাইরে তাঁরা খুব বেশি এর ব্যবহার করেন না।সম্প্রতি এই লিপিতে লেখা ‘বাংলা পুথি’  ছাপা হচ্ছে,“But except for this purpose and for the writing of signature by otherwise illiterate men,the script is hardly used,--never at least in formal documents.”২৭৩বি সি এ্যালেন সম্পাদিত ‘Assam District Gazatteers’ প্রথম খণ্ডে আলোচিত হয়েছে ‘কাছাড়’সেখানে নয়,‘সিলেটি নাগরী’র কথা এসেছে দ্বিতীয় খণ্ডে যেখানে তিনি ‘সিলেট’ নিয়ে কথা বলেছেন।এই খণ্ডের তৃতীয় অধ্যায়ে সামান্য ধ্বনি এবং রূপতাত্ত্বিক প্রসঙ্গে ছুঁয়ে এই লিপির কথাতে এসেছেন।ওতেও লেখা হয়েছে ‘দেবনাগরী লিপি’,ছাপা হয় ‘বাংলা’ বই।২৭৪এখানে তিনি ‘শ্রেণি’র বদলে ‘বর্ণ’ কথাটি ব্যবহার করেছেন।লিপিটি ব্যবহৃত হয়,“amongst low caste Muhammadans in the east of the district.২৭৫এরও বছর কয় পরে পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ,যিনি গ্রিয়ার্সনের মহাকর্মেও সহযোগী ছিলেন এবং অসমের এক প্রধান ভাষা এবং ইতিহাসবিদ ছিলেন,তিনিই এই নিয়ে প্রথম বিস্তৃত এক নিবন্ধ লেখেন ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’র ১৩১৫ বাংলার চতুর্থ তথা শেষ সংখ্যাতে।বিশ শতকের বছর ছয়ের মধ্যে এই তিন তিনটি উল্লেখ মেলে লিপিটির।এর মধ্যে পদ্মনাথ ভট্টাচার্যের লেখাটি সামান্য বিস্তৃত।‘সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’তে তিনি নানা সময়ে যে কটি প্রবন্ধ লেখেন তার মধ্যে প্রথমটিরই২৭৬ নামেই ‘সিলেটি নাগরী’ কথাটি তাত্ত্বিকভাবে প্রথম পাওয়া গেলবছরখানিকের মধ্যে প্রকাশিত অচ্যুতচরণ তত্ত্বনিধির ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ বইতেও অতিসামান্যই আছে।বইটির পূর্বাংশ প্রকাশিত হয় ইংরাজি সন ১৯১০এ।তার প্রথম ভাগে অষ্টম অধ্যায়ে ‘ভাষা’ উপশিরোনামে সিলেটে প্রচলিত ‘ভাষা’গুলো সম্পর্কে লিখতে গিয়ে লিখছেন,সিলেটের ‘উচ্চশ্রেণীর মোসলমান’ পরিবারে উর্দুতে কথা বলবার রীতি রয়েছে।আর,“শ্রীহট্টের মোসলমানদের মধ্যে একরূপ নাগরাক্ষর প্রচলিত আছে।অনেক মোসলমান কেতাব এই অক্ষরে মুদ্রিত হয়এই অক্ষর অতি সহজে শিক্ষা করা যায়। কলিকাতায় শ্রীহট্টবাসী মোসলমানগণ এই অক্ষরে একটা মুদ্রাযন্ত্র স্থাপন করিয়াছেনতাহাতেই পুস্তকাদি ছাপা হইয়া থাকে।”২৭৭একেবারে শেষে পরিশিষ্ট (ঝ) তে সিলেটি ‘শ্রীহট্টের মোসলমানী নাগরাক্ষর’ নামে হরফগুলোর নমুনা দিয়েছেন।২৭৮সেগুলো আমরা  চিত্র  ৩৩-এ তুলে দেখাচ্ছি। আগের বছর পদ্মনাথ এই নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন বলেই অচ্যুতচরণ এই নিয়ে আর বিস্তৃত লেখেন নি,---এমন একটি সম্ভাবনার কথা লিখেছেন অধ্যাপক উষারঞ্জন ভট্টাচার্য।২৭৯এমনটা হওয়া সম্ভব কেননা ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’-এর পরিকল্পনার সঙ্গে পদ্মনাথও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়েছিলেন। উষারঞ্জন উল্লেখ করেছেন এর পরে ‘শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষদ –পত্রিকা’তেও লিপিটি নিয়ে অনেকেই আলোচনা শুরু করেন।তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন মোহম্মদ আশরফ হোসেন সাহিত্যরত্ন২৮০এর পরেই সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখটি সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়েরওডিবিল-এর ভূমিকা অংশের পরিশিষ্টে বাংলার অন্যান্য লিপির সঙ্গে ‘সিলেটি নাগরী’ নিয়েও তিনি বেশ কিছু পঙক্তি ব্যয় করেছেন,আমরা আগে উল্লেখ করে এসেছি।সুনীতিকুমারে পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদের উল্লেখ আছে।ফলে গ্রিয়ার্সন-এ্যালেনরা যাকে ‘দেবনাগরী’ বলে লিখছিলেন,অচ্যুতচরণ যাকে ‘নাগরাক্ষর’ বলে লিখছিলেন সুনীতিকুমার লিখলেন,‘a kind of modified Dēva-nāgari,called ‘Silēt Nāgari’২৮১ভাষাবিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রায় সমস্ত তাত্ত্বিক আলোচনাতে এর পরে ‘সিলেটি নাগরী’ কথাটি চালু হয়ে গেল। সুকুমার সেনও তাই লিখলেন।২৮২কিন্তু তার মানে এই নয় যে লিপিনামটি পদ্মনাথই চালু করলেন।তিনি দশক তিনেক পরে ১৩৪৪ বাংলাতে ‘শ্রীহট্ট-সাহিত্য-পরিষদ পত্রিকা’তে ‘ভবানন্দের হরিবংশ’ নামে আরেকখানা প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে লেখেন,“শ্রীহট্ট শহরে বন্দরবাজারে সিলেট নাগরীর পহেলা কেতাব পাওয়া যায়---অনায়াসে তৎসাহায্যে এই নাগরী শিখিতে পারা যায়।শ্রীহট্টের সাহিত্যামোদী শিক্ষিত ব্যক্তি মাত্রেরই ইহা শিক্ষা করা উচিত।”২৮৩ ‘পহেলা কেতাব’-এর উল্লেখ তাঁর প্রথম নিবন্ধেও ছিল।কিন্তু দ্বিতীয়টি যখন লিখছেন তার বছর কয় আগে ১৩৩৬এ বইটির আরেকটি সংস্করণ বেরিয়েছিল। যেটির উপরে ভিত্তি করে সম্প্রতি ১৪১৩ বাংলাতে আরেকটি সংস্করণ সম্পাদনা করে ছেপেছেন অধ্যাপিকা অনুরাধা চন্দ।এই ১৩৩৬এর সংস্করণে সম্পাদক তথা সংশোধকের নাম রয়েছে মহাম্মদ আব্দুল লতিফের। তাঁর দুই একটি বাড়তি পদও বইটির বিষয়ে রয়েছে।‘তামাম শুদ’ শিরোনামে আছে,“তার পর আরজ করি করিনু তামাম।।/ছিলেটি নাগরী পুথি পহেলা কিতাব নাম*২৮৪সেখানে ‘শংশোধকের আরজ’-এর পুরো কথাগুলো এই,“শুনহে মুমিন ভাই আরজ আমার।।/নাগরী ইলিম তরে লুক বেশমার*/খাহেশ রাখেন দিলে শিখিতে তাহাএ।।/পহেলা কিতাব তারা খুজি নাহি পাএ*/ছহল ইলিম এছা ছিলেট নাগরী।।/শিখে শরব লুকে বড় মেহনত করি*/দেখিআ এমত আমি ভাবিলু দিলেতে।।/পহেলা কিতাব হলে আছান হবে তাতে*২৮৫ পদ্মনাথের ১৩১৫-তে লেখা প্রথম নিবন্ধের আগেকার সংস্করণেও যদি মহাম্মদ আব্দুল লতিফের এই পদগুলো ছিল অথবা তখন অব্দি প্রকাশিত অন্যান্য গ্রন্থেও যদি ‘সিলেটি নাগরী’ কথাটি ছিল তবে নামটি সেই সব পুথির লেখক বা সম্পাদকদেরই দেয়াঅন্তত ‘নাগরী’ কথাটি তো ছিলইআর যদি এই ১৩৩৬এর সংস্করণেই আব্দুল লতিফের ‘ছিলেটি নাগরী’ শেখাবার ‘খাহেশ’ পূরণের ঘটনাটি ঘটে থাকে তবে পূর্বাংশে ‘সিলেটি’ শব্দটি জুড়ে লিপি নামটি দেবার গৌরব পদ্মনাথেরই।যাই হোক,আমরা চিত্র ৩৪ ক,খ,গ- তে আব্দুল লতিফ যেভাবে বর্ণ শিখিয়েছেন তার নমুনা দেখাচ্ছি।

 

 
 

যদি শুধু একক স্বর এবং ব্যঞ্জনগুলোর বিচার করি, তবে দেখবো চিত্র ৩৩ এবং ৩৪ গ-এ সামান্য বিসঙ্গতি আছে।অচ্যুতচরণে ‘অ’ আছে।এবং সব ক’টি অনুনাসিক ধ্বনি সহ ব্যঞ্জন কয়েকটি বাড়তি আছে।তবে অনুস্বার ৩৪-খ-তেও আছে।সঙ্গে ৩৪ গ-তে হসন্ত চিহ্ন আছে বাংলারই মতো।৩৩-এর যুগ্মব্যঞ্জন ‘ক্ষ’  কিন্তু ৩৪ গ-তেও নেই। যেটি অনুমান করা চলে সে হল,অচ্যুতচরণ চৌধুরী কোনো পুথি দেখে অথবা পুরোনো ছাপা বই থেকে হরফগুলো নিয়েছিলেন।ইতিমধ্যে ছাপা বইতে এই সিলেটি নাগরী বর্ণমালারও সংস্কার হয়ে গেছে।অনুরাধা চন্দের মতে  উনিশ শতকের মাঝামাঝি কোনো ১৮৬০ থেকে ৭০ কোনো এক সময়২৮৬,উষারঞ্জনের মতে ১৮৬৯র কাছাকাছি২৮৭মুন্সী আব্দুল করিম এই লিপির হরফ কাটিয়ে প্রথম তাঁর প্রতিষ্ঠিত সিলেটের ‘ইসলামীয়া প্রেস’ থেকে বই ছাপানো শুরু করেন। দুজনেই অবশ্য হিসেবটি পদ্মনাথ ভট্টাচার্যের নিবন্ধের উপরে ভিত্তি করে করেছেন পদ্মনাথই লিখেছিলেন,“মোন̖শী আব্দুল করিম যখন এই অক্ষরগুলির সংস্কার করেন,তখন তিনি বর্ণমালার এবং সংযুক্ত বর্ণের অনেকটা সংস্কার সাধন করেন।”২৮৮পরে পরে কলকাতা এবং সিলেটে আরো কতকগুলো প্রেসে সিলেটি নাগরী বইপত্র ছাপা শুরু হয়।পদ্মনাথ ভট্টাচার্য ছাড়াও পরবর্তী কালে শিবপ্রসন্ন লাহিড়ি,মুর্তাজা আলিও সিলেটি নাগরীতে স্বরব্যঞ্জন মিলিয়ে ৩২টি হরফের কথাই লিখেছিলেন,২৮৯যেমনটি আমরা চিত্র ৩৪ গ-তে দেখছি।কিন্তু তারপরেও এই বর্ণমালাতে সংশোধন হয়েছে।অনুরাধা চন্দ লিখছেন,“মনে হয় শুরুতে এই বর্ণমালা দ্বৈতস্বর ও যুক্তব্যঞ্জন বর্জিত ছিলতবে কালক্রমে বেশ কয়েকটি যুক্তব্যঞ্জন সংযোজিত হয়।পদ্মনাথ যে পহেলা কেতাব ব্যবহার করেছেন তাতে ষোলোটি সংযুক্ত বর্ণ রাখা হয়েছে।আমাদের আলোচ্য পহেলা কেতাব পুস্তিকায় একুশটি সংযুক্ত বর্ণ রয়েছে।পদ্মনাথ এই লিপির বর্ণনা প্রসঙ্গে হসন্ত চিহ্নটির অভাব লক্ষ্য করেছেন,‘যদি হসন্ত চিহ্নটি পরিগৃহীত হইত,তাহা হইলে ‘সমপদ’ যে ‘সম্পদ’ তাহা অনায়াসেই বুঝিতে পারা যাইত।’২৯০ ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে মুদ্রিত পহেলা কেতাব পুস্তিকাটির বর্ণমালা তালিকায় হসন্ত চিহ্ন গৃহীত হয়েছে,যদিও পাঠের মধ্যে কোথাও ব্যবহার পাওয়া যায় না।”২৯১চিত্র ৩৪ গ-তে  ষোলটি যুগ্মব্যঞ্জন এবং আরো পাঁচটি তাদের স্বরযুক্ত রূপ দেখাচ্ছে। সব মিলিয়ে এই একুশটির কথাই লিখেছেন অনুরাধা। হসন্ত চিহ্নের ব্যবহার না থাকাতেই যে দইখুরার পদে ‘প্রেমের মালা’ হয়েছে ‘পেরমের মালা’ এবারে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।লিপির সীমাবদ্ধতাতেই শব্দটি ‘পেরম’ হয়েছে,যা কিনা মান বাংলা বা সিলেটি কোনো শব্দই নয়।‘প্রেম’ হলে এটি দুই ভাষাবৈচিত্র্যেরই যৌথ শব্দ।যাই হোক, লিপিটি এখন কম্প্যুটারে এবং আন্তর্জালে ব্যবহার উপযোগী করে ‘ইউনিকোড কনসর্টিয়াম’ (The Unicode Consortium)২৯২স্বীকৃতি দিয়েছে। সেখানে একক বর্ণসংখ্যা মোটের উপর একই আছে।হলন্ত চিহ্ন,এবং অনুস্বারের জন্যে স্বতন্ত্র সংকেতের ব্যবস্থা রাখাতে যুগ্মব্যঞ্জনের স্বতন্ত্র সংকেতের দরকার পড়বার কথা নয়।  তার বিপরীতে চারটি ‘পদ্যচিহ্ন’-এর জন্যে সংকেত রয়েছে। চিত্র ৩৫ এর২৯৩ একেবারে শেষ চারটি সংকেত তাই।সম্ভবত পর্বাঙ্গ,পর্ব,চরণ,স্তবক ভেদ দেখাবার জন্যে।ইতিমধ্যে কিছু ইউনিকোড ফন্ট তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেগুলো খুব ব্যবহারবান্ধব মনে হল না।আন্তর্জালে সরাসরি লেখা যাচ্ছে না, আমরা বহু চেষ্টায় কয়েকটি বর্ণ টাইপ করলাম এভাবে: a i u e O k K g G c C j J t Tসম্ভবত ব্যবহারবান্ধব নয় বলেই যাদের মূল উদ্যোগে লিপিটি স্বীকৃত পেল সেই লন্ডনের ‘Sylheti Translation And Research (STAR)’সংস্থাটির ওয়েব সাইট ‘sylheti.org.uk’-এ পুরোনো পুথির কিছু ছবি আছে।কিন্তু আর যা কিছু সবই ইংরেজিতে লেখা,সিলেটি নাগরীতে লেখা এখন অব্দি কিছু নেই।কনসর্টিয়াম’ এবং ‘স্টার’--এই দুই সংস্থারই সমর্থিত একটি হরফ তালিকা আছে ‘Omniglot’(online encyclopaedia of writing systems and language)-এর সাইট omniglot.com-এ। সেখানে কিন্তু যুগ্মব্যঞ্জন ‘ক্ষ’ এবং ‘র্ল’ (র+ল) এই দুই বাড়তি হরফ নিয়ে যুগ্মব্যঞ্জন সংখ্যা ১৮টি। চিত্র  ৩৬-এ২৯৪ তাই দেখা যাবে।  


 

যাই হোক,একক বর্ণ হিসেবে পাঁচটি স্বর এবং সাতাশটি ব্যঞ্জনের সংখ্যাতে এই অব্দি আর কোনো হেরফের হয় নি, নিশ্চিত বোঝা যাচ্ছে। সংখ্যা বোঝাবার জন্যে স্বতন্ত্র কোনো সিলেটি নাগরী চিহ্ন নেই। দেবনাগরী বা কাইথির থেকেও কোনো সংখ্যা নেয়া হয় নি। বাংলা সংখ্যা-সংকেত দিয়েই শুরু থেকেই কাজ চালানো হচ্ছে বলেই ৩৪ খ এবং ৩৬ চিত্রে একই রকম দেখাচ্ছে।অনুরাধা চন্দ লিখেছেন,“ ...সিলেটি কথ্যভাষার উচ্চারণ ও ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই বর্ণমালা গড়ে উঠেছে।একটি ধ্বনির জন্য একটি বর্ণ,এই নিয়মটি তত্ত্ব হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে হয়। সরলীকরণের আরেকটি চিহ্ন যুক্তব্যঞ্জনের সীমিত ব্যবহার।২৯৫ অনুরূপ অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্য এবং মীনা দানের কিছু কথা আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে উল্লেখ করেছিলাম। সেখানে আমরা দেখেছিলাম,সিলেটিতে স্বরস্বনিম বলতে সত্যিই পাঁচটির বেশি নেই।ব্যঞ্জন স্বনিম পেয়েছিলাম মাত্র ত্রিশটি।এবং অনেকেই যেভাবে ,,আদি সিলেটি বর্ণমালা তালিকাতে বাদ দিয়ে দেন,আমরা স্বনিম তালিকার থেকে বাদ দিই নি এবং সিলেটি নাগরী বর্ণমালাতেও এগুলো দিব্বি শোভা পাচ্ছে।এই বিষয়গুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ।বাংলা কিংবা দেবনাগরী যে বর্ণমালা থেকেই লিপিটি এসে থাকুক, সংস্কৃতানুসরণ না করে স্বাভাবিক উচ্চারণরীতি অনুসরণ করেছিলেন বলেই কিছু বিভ্রান্তি এই লিপির স্রষ্টারা এড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন বলেই মনে হয়।আরবি লিপি শৈলীরও কিছু প্রভাব অবশ্যই পড়েছে,সিলেটি নাগরী পুথিকে তাই পেছন থেকে পড়তে হয়।তাই বলে,পঙক্তি গুলো যে ডান থেকে বামে পড়তে হয় তা যে নয় চিত্র ৩৪ গ’-এর উদাহরণ বাক্য গুলোতেই তা বোঝা যাবে। সেরকম আরবি বর্ণমালা সংখ্যা দিয়েও এই লিপির স্রষ্টারা বিভ্রান্ত হয়েছেন এমনটা দেখি না।

লিপিটির দেবনাগরী উৎস নিয়ে অধিকাংশেরই কোনো দ্বিমত নেই।শুধু মুর্তাজা আলি মনে করতেন দেবনাগরীর সঙ্গে  বাংলা-কাইথির কাছেও সিলেটি নাগরী ঋণী।২৯৬কোনটি বাংলা আর কোনটি দেবনাগরী থেকে এসেছে এই নিয়ে  শিবপ্রসন্ন লাহিড়ি এবং মুর্তাজা আলির বক্তব্যের একটি তুলনামূলক অধ্যয়ন করেছিলেন অধ্যাপক উষারঞ্জন ভট্টাচার্য।২৯৭ আমরা তাঁর উপস্থাপনাটিই তুলে দিচ্ছি:


 

কিন্তু মুর্তাজা আলি আরো লিখছেন,“নাগরীর ফ ও র বর্ণগুলি কাইথী অক্ষর হইতে আসিয়াছে।সিলেটি ভ বর্ণের সঙ্গে কাইথী লিপির ভ বর্ণের সাদৃশ্য আছে।”২৯৮ ‘ফ’-এর সঙ্গে না হোক, কাইথি ‘ভ,র’-এর কথাটি খুব একটা ভুল নয় বলে আমাদেরও মনে হলআমরা বুঝবার সুবিধে জন্যে ‘Omniglot’-এর থেকে কাইথি-সিলেটি নাগরী এবং দেবনাগরী-সিলেটি নাগরী বর্ণমালার পাশাপাশি বসিয়ে উপস্থিত করছি চিত্র ৩৭ ক এবং খ-তে

 


 কিন্তু দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হুসেন চৌধুরী বলে এক গবেষক তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত ‘আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা: উত্তরাধিকার ও মুসলমান নাগরী’ শীর্ষক এক নিবন্ধে আরবি লিপি শৈলীর প্রভাবে সরাসরি বাংলা থেকেই হরফগুলো এসেছে বলে দাবি করেছেন।সম্ভবত এটি লন্ডনের সেন্টার ফর বাংলাদেশ রিসার্চ বলে সংগঠনটির কোনো পত্রিকাতে বেরিয়েছিল এবং ঢাকার বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ‘জালালাবাদের কথা’ সংকলনে প্রকাশিত হয়েছিল ২০০১এ।প্রকাশনার বিষয়টি অনুরাধা চন্দের উল্লেখে অস্পষ্ট।২৯৯কিন্তু বাংলার এই দাবিটিকে খারিজ করেছেন অনুরাধা চন্দ এই লিখে,“এ –পর্যন্ত আমরা যা প্রমাণ-উপাদান পেয়েছি তাতে সিলেট নাগরীর দেবনাগরীর উৎস সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন ওঠে না।”৩০০

আরবি লিপির প্রভাবটি সামান্য ঘোরালো।অনুরাধা চন্দ লিখছেন,“আরব ও পারস্যে ‘জের’,‘জবর’,‘পেশ’ এই তিনটি স্বরচিহ্ন সামান্য অদলবদল ক’রে নানা ধ্বনির প্রকাশ করা যায়।সিলেট নাগরী লিপিতেও আমরা এই রীতি দেখতে পাইসামান্য পরিবর্তিত একই অক্ষর দিয়ে ভিন্ন ধ্বনির প্রকাশ সম্ভব।”৩০১তিনি প,দ,খ,ছ,ঝ,ধ এই ক্রমে সিলেটি নাগরী হরফগুলোর নজির দিয়েছেন।আমরা ৩৪ ক-তে মিলিয়ে দেখতে পারি।তিনি গোলাম কাদিরের একটি বক্তব্য তুলে দিয়েছেন এরকম,“সিলেটী নাগরীর বর্ণবাছাই ও বিন্যাসে আরবি বর্ণমালার বিন্যাসিক অবস্থান ও উচ্চারণগত প্রভাব পড়েছে প্রচুর।সিলেটী উপভাষার উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যই উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করেছে সিলেটি নাগরী।আর সিলেটি উপভাষার উচ্চারণ-স্বাতন্ত্র্য নির্মাণ করেছে মূলত ফারসি-উর্দুর প্রভাব।... সিলেটে মুসলিম বিজয় (১৩০৩) এবং সেই সঙ্গে বহিরাগত মুসলিম উপনিবেশ এই ফারসি-উর্দু চর্চার বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠা করে।তারপর দীর্ঘ তিন-চার শতকের অনুশীলন এবং দরবারী ভাষা ফারসির প্রসারে সেখানে স্থানীয় উপভাষায় এই উচ্চারণগত প্রভাব প্রতিষ্ঠা লাভ করে।কিন্তু লিখার ক্ষেত্রে ফারসি বা উর্দু কারোরই কোনো স্বতন্ত্র লিপি ছিল না।আরবি সিমেটিক লিপিমালার সাহায্যেই এই দুই ভাষা লিখিত হয়। সেইজন্য উচ্চারণ প্রতীক বা চিহ্নরূপে আরবি বর্ণলিপিকেই গ্রহণ করতে হয়।সিলেটী উপভাষার উচ্চারণ তথা সিলেটি নাগরীর লিপি ও উচ্চারণ বিশ্লেষণে ফারসি-উর্দুর উচ্চারণ প্রভাবকেও তাই আরবি বর্ণমালার দ্বারা প্রকাশ ভিন্ন বিকল্প নেই।”৩০২ কথাগুলো সামান্য গোলমেলে।সিলেটি নাগরীকে তো আর ‘আরবি বর্ণমালার দ্বারা প্রকাশ’ করা হয় নি। সেটি তিনি বলতেও চান নি।স্পষ্ট করলে মনে হয় এইভাবে বলা চলে,দরবারি ভাষা হিসেবে ফারসি-উর্দু চর্চার একটা পরম্পরা ছিলই,তাও আরবি লিপিতে।ফলে সিলেটিতে ভাষাতেও সেসবের একটা গভীর প্রভাব পড়েছেকিন্তু সিলেটি নিজের বৈশিষ্ট্যও অনেকটাই অক্ষুণ্ণ রেখেছে। গোটা বক্তব্যই কিন্তু উচ্চারণ কেন্দ্রিক।সুতরাং যেটি হয়ত তিনি বলতে চান,সিলেটি নাগরীর স্রষ্টারাও দেবনাগরী বা কাইথি হরফ বেছে নিলেও সেগুলোকেই বেছে নিয়েছেন, যেগুলো এই ফারসি-উর্দু এবং আরবি হরফের প্রভাবে আরবি উচ্চারণ রীতি প্রভাবিত সিলেটি ভাষার উচ্চারণরীতিকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।এখানে কিন্তু শব্দে হরফ কিংবা বাক্যে শব্দের ক্রম নিয়ে কোনো কথাই বলা হলো না।কিন্তু অনুরাধা চন্দ এবং গোলাম কাদিরের বক্তব্য মিলিয়ে পড়লে বোঝা যাচ্ছে, দেবনাগরী-কাইথি হরফ পালটে সিলেটি হরফ তৈরির বেলা আরবি হরফ শৈলীও প্রভাব ফেলেছে।বাকি কথা কিন্তু স্পষ্ট হচ্ছে অনুরাধা চন্দের বহু পরে করা একটি মন্তব্যে‘পহেলা কেতাবে’র ‘মুদ্রণ-পরিচয়’ যেখানে দিচ্ছেন সেখানে।তিনি লিখছেন,“আরবি-ফার্সি রীতি অনুসরণে মূল পুথিটি আমাদের অভ্যাস অনুযায়ী ‘পেছন’ থেকে শুরু,যদিও পঙ̖ক্তির বিন্যাস বাঁ দিক থেকে ডান দিকে,আরবি-ফার্সি নিয়মমাফিক ডান দিক থেকে বাঁ দিকে নয়।বইটি ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে ‘মহাহ্মদ আবদুল লতিফ দ্বারা সংশোধিত ও রেজিস্টারিকৃত এবং মহাহ্মদ আবদুল গণি দ্বারা শ্রীহট্ট ইসলামিয়া প্রেসে মুদ্রিত ও প্রকাশিত’’’৩০৩একই বইয়ের নিজের সম্পাদিত সংস্করণ সম্পর্কে তিনি আরো লিখছেন,“ আরবি-ফার্সি-উর্দু মুদ্রণের ঐতিহ্য অনুসারে বর্তমান বইয়ের মূল পাঠ অংশ প্রথানুযায়ী ‘পেছন’ থেকে ছাপা হয়েছে। আশা করি, পাঠক বুঝবেন, এ কোনো অভিনবত্বের জন্য নয়, একটি পরিণত ঐতিহ্যের পরিচয় দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য।”৩০৪এই পেছন থেকে ছাপা বা লেখা বিষয়টিকে আনুষঙ্গিক সাংস্কৃতিক পরম্পরা হিসেবে নেওয়া যেতে পারে এই টুকুনই।হরফক্রম যদি ডান থেকে বামে সাজানো হত তবেই তা লিপির শৈলীতে যে প্রভাব ফেলতে পারত,সেরকম কিছুই আমরা দেখছি না।

           এই যে আরবি পরম্পরার সবটা নিলেন না,সেখানে একটি আন্তসংগ্রামের সংকেতও অবশ্যই মেলে। যে কথা রিচার্ড ঈটন বাংলাতে কেন আরবি লিপি চলল না,বোঝাতে গিয়ে লিখেছিলেন।নিছক ইসলাম প্রীতির জন্যেই নাগরীপুথির লেখকেরাও বাংলা লিপি বেছে নেন নি,যদি এমনতর হত তবে আরবি লিপির আরো ঘনিষ্ঠ অনুসরণ দেখা যেতে পারতএই প্রসঙ্গে মনে করতে পারি,যে হিন্দুদের মধ্যে যেমন রীতি ছিল সংস্কৃত ছাড়া ধর্মগ্রন্থাদি চর্চা করা যাবে না,করলে রৌরব নরক বাস হবে,মুসলমানদের মধ্যেও ছিল,আল্লাহ আরবিতে কোরান দিয়েছেন। অন্য লিপি বা ভাষার ব্যবহার মানেই তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধাচরণ করা। তবু যারা ভারতে হিন্দুস্তানির থেকে উর্দুর উদ্ভব করিয়েছিলেন,তারা সেই ইসলামী সংস্কৃতির সংস্কার করেই করেছিলেন।ভারতেই প্রথম অন্য কোনো ভাষাতে কোরান অনুবাদ হয়,আর সেটি উর্দুতে।তাও উর্দুর জন্যে তারা আরবি লিপি মেনে নিয়ে আপস একটা করেছিলেন। বাংলাতে কেউ কেউ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাংলার মুসলমান সেই লিপিও মানেন নি। অধিকাংশই বাংলা লিপি আর বাংলা ভাষা মেনে নিলেন বলেই বাঙালি আজ এতো বিশাল এক জনগোষ্ঠী। সিলেটি নাগরী লিপি ছিল তার মাঝামাঝি একটি ব্যবস্থা।প্রধানত যে লিপিকে নির্ভর করে সিলেটি নাগরী এল সেটি দেবনাগরীলিপিটি উত্তর ভারতেও তখনো আজকের মতো জনপ্রিয় ছিল না।সংস্কৃতের সর্বমান্য লিপিও ছিল না।প্রত্যন্ত এলাকার নিরক্ষর বহু মানুষের কাছে বাংলা লিপি পরিচিতও ছিল না মোগল আমলে রাজকার্যেও ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছিল ফার্সির ব্যবহার।আজ যেমন হয় প্রধানত ইংরেজি এবং হিন্দি। ফলে এক প্রজন্মের ব্যবধানে আজকের আমাদের ছেলেমেয়েদের কাছেও বাংলা লিপির পরিচয় আর সেভাবে নেই।সুতরাং বাঙালি হয়ে কেন বাংলা লিপি জানবে না,এই প্রশ্ন শুধু উন্নাসিক সমাজবিচ্ছিন্ন আধুনিক মধ্যবিত্ত মনেই জাগতে পারে।তাদের কাছে সেদিন বাংলা লিপি শেখা যা,দেবনাগরী শেখাও তাই ছিল।তবু,তারা করলেন কি,জ্ঞান পিপাসার প্রাবল্যে দেবনাগরী-বাংলা যেটুকু বুঝলেন,তাই ভেঙেচুরে অনেক সংক্ষিপ্ত আর সরল একটি বর্ণমালা গড়ে ফেললেন।বর্ণ সংখ্যা রাখলেন ততটাই যতটা উচ্চারণ অনুমোদন করে। তাঁরা ভাষাবিজ্ঞান জানতেন না,কিন্তু এই সরল সত্য বুঝতেনসেকালে আজকের মতো মান-উচ্চারণরীতি গড়ে তুলবার কোনো উপায় ছিল না। রেডিও,টিভি,রেকর্ড,ক্যাসেট বা কম্প্যুটার কিছুই তো ছিল না।ফলে তাঁরা বাধ্য ছিলেন  অনুসরণ করতে সিলেটি উচ্চারণ।কিন্তু যে ভাষাতে কাব্য করলেন সেটি সেকালের সাহিত্যের মান সাধু বাংলা...মহম্মদ আব্দুল লতিফের এই চরণগুলো পড়লে দুই একটি রাবীন্দ্রিক ক্রিয়াপদও দুর্লভ হয় না,তার পর আরজ করি করিনু তামাম।।/ ছিলেটি নাগরী পুথি পহেলা কিতাব নাম*

লিপিটিতে লেখা সাহিত্য কারা কবে প্রচলন এবং জনপ্রিয় করেন সেসব জানতে গেলে আমাদের তার অন্তর্বস্তু এবং সেই অন্তর্বস্তুর পেছনকার ইতিহাসের দিকে তাকাতেই হবে।সিলেটি নাগরীতে লেখা পুথিগুলোর বিষয়বৈচিত্র্য সম্পর্কে অধ্যাপক উষারঞ্জন ভট্টাচার্য খুব সংক্ষেপে কিছু কথা লিখেছিলেন এই ভাবে,“সিলেটি নাগরী সাহিত্যে গৃহীত বিষয়গুলির বৈচিত্র্য আছে বই কি।নামাজ,রমজান,হজমাহাত্ম্য, পীর ও আউলিয়া-জীবনী,আধ্যাত্মিক তত্ত্ব থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক যুদ্ধ কাহিনি,দৈনিক ধর্মব্যবহার,রমণী চরিত্র, লোকচরিত্র ও সমাজচিত্র,ব্যবহার শাস্ত্র,বাউল,মারিফতি,চরকামাহাত্ম্য,বারমাসী,মিলন-বিচ্ছেদমূলক লৌকিক কাহিনি, নাগরী শিক্ষা,ঝড়-ভূমিকম্প –বন্যার বর্ণনা,কচুরি পানার অত্যাচার,হাস্যরসের ‘গল্পসল্প’ ও নীতিদীর্ঘ পরিসরে উপস্থাপিত হয়েছে সিলেটি নাগরী লিপির মাধ্যমে।বাউল,মারিফতি ইত্যাদিতে বিভিন্ন ক্ষণে সাহিত্যশিল্পের উজ্জ্বল উদ̖ভাস দেখা যায়।রচয়িতাদের মধ্যে শীতলাং শা,সৈয়দ শাহ নূর,ইরফান আলী,শাহ আরকুম এবং আরো কয়েকজনের বেশ কিছু গীত যথার্থই মর্মস্পর্শী।”৩০৫ গ্রিয়ার্সন থেকে শুরু করে অনেকেই যখন লিখেছিলেন নিম্নশ্রেণির বা বর্ণের মুসলমানদের মধ্যে এই লিপি প্রচলিত ছিল,স্বল্প শিক্ষিতরাই শেখা সহজ বলে এই লিপি গড়ে তোলেন এবং লালন করেন,তাতে এমন একটি ধারণাও গড়ে উঠেছিল যে সিলেটি লিপিতে লেখা পুথিগুলোর সাহিত্যমান খুব উন্নত নয় অথচ,উচ্চশ্রেণির লেখক পাঠক হলেই যে উচ্চমানের সাহিত্য সৃষ্টি করবেন এবং উপভোগ করবেন---আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতা কিন্তু তা বলে না।অধ্যাপক উষারঞ্জন তাই প্রচলিত ধারণার বিপরীতে গিয়ে বাউল –মারিফতি গানগুলোর শিল্পমানের সপ্রশংস উল্লেখ করছেন।এমনিতেও এই ‘মান’-এর ধারণাটি একটি বিমূর্ত ধারণা,এবং এর বিষয়মুখ (objective) বিচারের কোনো মাপদণ্ড কোথাও নেই যে তর্কাতীত সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।বিচারটি সবসময়েই হয় বিষয়ীমুখ (Subjective)বিষয়ীর রুচি, সমাজ সংস্কার সবই এতে প্রভাব ফেলে।একই প্রশ্ন দীনেশ চন্দ্র সেন সংকলিত এবং সম্পাদিত ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ সম্পর্কেও উঠেছিল। দীনেশ চন্দ্র সেন জবাবে লিখেছিলেন,“এই সাহিত্যের নানাদিক হইতে বিচার করিলে দেখা যাইবে যে,তাহা শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সর্ব্ব-সম্প্রদায়ের অতীব উপভোগ্য। শুধু তাহাই নহে,এই নিরক্ষর চাষাদের সাহিত্য এত বড় যে,তাহার চূড়া বড় বড় শিক্ষিত কবিদের মাথা ছাপাইয়া উঠিয়াছে,আমি লিখিয়াছি পশ্চিম বঙ্গের লোকেদের মধ্যে অনেকেই এই সাহিত্যের গুণে ও অপরাজেয় কাব্য-সৌন্দর্যে মুগ্ধ।কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ আমার প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষের জন্যে,কেহ কেহ বা পূর্ববঙ্গের প্রতি বিরূপতার দরুন এই সাহিত্যকে তাদৃশ আদর করেন নাই।বিদ্বিষ্ট ব্যক্তিদের কথা ছাড়িয়া দিলেও এই গীতি সাহিত্যের ভাষা তাহাদের নিকট কতকটা দুর্ব্বোধ এবং শ্রুতিকঠোরতজ্জন্য তাঁহারা সকলে ইহার রসাস্বাদনের অধিকারী হইতে পারেন নাই।৩০৬মনে হতে পারে দীনেশ সেন অতিশোয়ক্তি করছেন। কবিশেখর কালিদাস রায় হাজার বছরের বাংলা কবিতার একটি সংকলন করেছিলেন ‘মাধুকরী’তাতে তিনি চর্যাপদকে ঠাই দেন নি। যুক্তি দিতে গিয়ে লিখেছিলেন,“বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যের সাধন-ভজন গুহ্য তত্ত্বের বাহন চর্চপদগুলির কবিত্বের দিক হইতে বিশেষ কোনও মূল্য নাই বলিয়া বড়ু চণ্ডিদাস হইতেই বাংলা কাব্যের সূত্রপাত ধরিয়াছি।”৩০৭ সিলেটি নাগরী লিপিতে লেখা আখ্যান গুলোকে পূর্ববঙ্গগীতিকার আখ্যান কাব্যগুলোর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখবার কোনো কারণ আমরা দেখছি না। এগুলো সেই পরম্পরারই উৎপাদ। অন্যদিকে বাউল-মারিফতি গানগুলো চর্যার সাহিত্যিক উত্তরাধিকার বহন করছে,সেই কথা আমরা নিঃসংশয়েই বলতে পারি। চর্যার এবং ‘যোগকলন্দর’-এর দার্শনিক উত্তরাধিকারও এগুলো বহন করে গোলাম কাদির, নন্দলাল শর্মা৩০৮, অনুরাধা চন্দ সহ অনেকেই সেসব কথা তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন। অনুরাধা চন্দ সম্পাদিত সম্প্রতি প্রকাশিত ‘Script Identity Region’ সংকলনে একটি নিবন্ধে অধ্যাপক আবদুল মুসাব্বির ভূঞা লিখেছিলেন,“Some scholars have repeatedly asserted that the literature in the script is not of a high order.We do not dispute it.But it may be said in this connection that whatever little of the vast literature of medieval Bengali has remained,is not necessarily of a high standard either.”৩০৯ আমরা যে আগে উল্লেখ করে এসেছি,অধ্যাপক  মুসাব্বির ভূঞার সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় তত প্রবল নয়,যেরকম আমাদের প্রবল নয় আরবি সাহিত্যের সঙ্গে ভালো পরিচয়---সেই সংশয়কে সবল করে  সাধারণভাবে প্রাক-ঔপনিবেশিক তথা ‘মধ্যযুগ’-এর বাংলা সাহিত্য নিয়ে করা তাঁর এই মন্তব্য থাকলে তিনি ‘We do not dispute’ লিখতেন না। বাক্যটিকে চিহ্নিত করে একটি সম্পাদকীয় মন্তব্য করেছেন অনুরাধা চন্দ এরকম,“The literature resembles medieval Bengali Literature.Its literary quality may be debated but the philosophy embodied in the literature is of very high order and that such complex ideas could be expressed in simple words full of local flavour would rank the literature high in quality.”৩১০এগুলোর দার্শনিক এবং সাংস্কৃতিক মর্মবস্তু নিয়ে অন্যত্র তিনি একটি সুন্দর মন্তব্য করেছেন,“The Songs of Daikhurā and Rādāpiāri reflect the kind of culture that arose out of the intermingling of indigenous culture with the Islamic as disseminated by the Sufi saints in this remote region.These are products of medieval religio-cultural space in a predominantly rural society.Unlike the modern,this medieval space was not dominated by any over-arching religion---Hinduism or Islam.Instead,there were numerous groups under different minor religious sects arose out of fusion of the Yogi-tantric practices with the speculative philosophy of the major religious systems mentioned earlier. This intermixing led to the rise of esoteric cults in the form of tantric Buddhism or Sahajiya Vaisnavism and Natha yogis, which initially was Saivite but later assumed Vaisbavite character.”৩১১ রিচার্ড ঈটন একইরকম ব্যাখ্যা করে এই ধর্ম-সংস্কৃতিকে ‘প্রাগাধুনিক বাংলার লোক ধর্ম’ লিখেছিলেন।৩১২

 চর্যা এবং যোগকলন্দরের মতো কিছু বই তো বহুপঠিত ছিল বলেই বাংলা সহ অন্যলিপিতেও লিপ্যন্তর হয়েছিল।এরকম বহুপঠিত অনেক বই সিলেটি নাগরীতেও লিপ্যন্তর হয়।ভবানন্দের ‘হরিবংশ’,শাহ হুসন শাহের ‘ভেদসার’ সেরকমই বই। প্রথমে বাংলা লিপিতে লেখা হয়,পরে সিলেটি নাগরীতে লিপ্যন্তর হয়।উষারঞ্জন যে বিষয় বৈচিত্র্যগুলোর উল্লেখ করেছিলেন,সেগুলোর অনেক কিছুই ছাপা প্রযুক্তিতে আসবার পরে ছাপাখানা এবং প্রকাশনা শিল্পকে টিকিয়ে রাখবার দায়েও হয়েছে বলে আমাদের মনে হয়।‘পহেলা কেতাব’ বইতেই দেখছি,যার পদ সেই কবি দইখুরা বা মুনির উদ্দিন (অথবা মুনিব উদ্দিন)৩১৩ ধর্মের ভেদ-সমন্বয়-বুদ্ধি সম্পর্কে উদাসীন।বলা যেতে পারে সেগুলো ‘প্রাগাধুনিক বাংলার লোকধর্মগীতি’ অন্যদিকে ভনিতাহীন শৈলীতে দু’টো পদ রয়েছে যার একটিতে সরাসরি লেখা হচ্ছে,“শুন শুন উপদেশ গিআন হিন শিশু।।/ভুলেতেও কভু দিলে ভেব নাক ইশু*/খিরিশটান দল যত পাতি আছে জাল।।/মাকড়ের মত জেন ধরিআছে চাল*৩১৪তেমনি আরেকটি পড়লেই বোঝা যায় শরিয়তী ইসলাম মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে।উপদেশ দেয়া হচ্ছে,“ওহে মন বুইদধি জদি থাকে তর মাজে।।/মিলিওনা তুমি কভু নাদান সমাজে*” মিললে ‘নরক’-এর ভয় টয় দেখানো হচ্ছে। অনুরাধা চন্দ লিখেছেন,“মনে হয় এ-পদ্যগুলি ‘পাগলা দইখুরা’র গানের অনেক পরে লেখা।”৩১৫কার লেখা কবে লেখা ---তাঁর অভিমত সেসব ‘গবেষণা সাপেক্ষ’কিন্তু যিনি ১৩৩৬ বাংলার সংস্করণের সংশোধক,--সেই মহাম্মদ আবদুল লতিফের সংযোজন কি না তিনি লেখেননি। না লিখলেও সংশোধক যে এতে অসঙ্গতি কিছু পাচ্ছেন না এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।এহেন ‘ভেদবুদ্ধি’ ঔপনিবেশিক আমলে উনিশ বিশ শতকে ছাপা জমানারই রাজনৈতিক দান।অনুরাধা চন্দ লিখেছেন এক জায়গাতে,“The language and treatment of the subject-matter in the handwritten texts are distinctly different from the printed ones which are widely circulated.”৩১৬প্রকাশ মাধ্যম এবং সামাজিক সময় পালটাবার সঙ্গে সঙ্গে এগুলো হওয়া অবধারিত ছিল।ফলে অনেকেই তাদের রচনা ছাপাতেও অস্বীকার করেছিলেন।শীতলাং শা,শাহ নূর তাঁদের অন্যতম।৩১৭বাংলা ছাপাজমানাতে কলকাতায় এবং ঢাকার কেতাব পট্টিতে গড়ে ওঠা ‘বটতলা সাহিত্য’ পরম্পরারও এগুলো অংশ ছিল বললে মোটেও ভুল বলা হবে না।আমরা এই কথা মোটেও তুচ্ছার্থে লিখছি না।নিশ্চয় তার সব কিছুই উন্নতমানের ছিল না,কিন্তু সবই তার অবনত মানেরও ছিল না।সবচাইতে বড় কথা ‘বটতলা’র সাহিত্য বাংলা ছাপাখানার ইতিহাস নির্মাণ করেছিল,বই বাণিজ্যকে টিকিয়ে রেখেছিল এবং সাধারণ বাঙালিকে শিক্ষিতও করেছিল।বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’কে বটতলাই প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পৌঁছে দিয়েছিল,এখনো দিচ্ছে।বটতলার সাহিত্য নিয়ে উন্নাসিকতার বিপরীতে এই সব প্রতিবয়ান সম্প্রতি নির্মিত হচ্ছেপ্রচুর গ্রন্থাদিও লেখা হয়ে গেছে। ছোট পত্রিকা সংখ্যা করছে।অথচ বটতলার ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলিয়ে কাউকে সিলেটি নাগরী ছাপাবইগুলোর আলোচনা করতে দেখছি না। আরো একটি সাহিত্যের ঐতিহ্যের কথা  সিলেটি নাগরী প্রসঙ্গে মনে রাখা উচিত,সেটি হল সুকুমার সেন যাকে লিখেছেন‘এছলামী বাঙ্গালা’এগুলোর থেকে বিচ্ছিন্ন করে সিলেটি নাগরী সাহিত্যের বিচার সম্পূর্ণ হয় না বলেই আমাদের অভিমত।

সিলেটি নাগরী সাহিত্যের মতো বটতলার সাধারণ সাহিত্য নিয়েও ধারণা ছিল যে এসব নিম্নশ্রেণির মানুষের সাহিত্যসবটা মিথ্যেও নয় বটে।যাদের শিক্ষার থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল তাদের যদি সেবা করেছে বটতলা তবে মহৎ কর্তব্যই করেছিল।তাঁদের থেকে ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ আশা করাটাই অন্যায়।সিলেটি নাগরী সাহিত্য নিয়েও উষারঞ্জনের সশ্রদ্ধ উল্লেখ,“ ...এই লিপির আশ্রয়ই এক সময়ে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন সমাজে অসংখ্য মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছিল একথা স্বীকার করতেই হবে।”৩১৮ কিন্তু কোনোভাবেই এই সব সাহিত্য উচ্চশ্রেণির দ্বারা লেখা হয় নি, বা তাদের পড়ার টেবিলে গিয়ে পৌঁছোয় নি এই কথাও সত্য নয়। বনেদী বাড়ির যে মেয়েদের লেখাপড়ার বাইরে রাখা হয়েছিল,তাদেরও ‘মাটির প্রদীপ’ ছিল এই সব সাহিত্য।এই সব মাটির প্রদীপের সঙ্গে বই বাণিজ্যে টিকে থাকা কঠিন হয়েছিল বলেই ‘অশ্লীল’ ইত্যাদি বলে দেগে দেবারও সংগঠিত প্রয়াস হয়েছিল।এমন কি বটতলাতে ছাপা হত বলে ভারত চন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’-এর বিক্রিও বন্ধ করিয়ে দেয়া হয়েছিল।৩১৯ কিন্তু তার পরেও মাইকেল এবং দীনবন্ধু মিত্রের  প্রহসনগুলো বটতলার প্রেরণা ছাড়া লেখা হয় নি।৩২০অনিন্দিতা ঘোষ এক জায়গাতে লিখেছেন,“ সাধারণ পাঠাগার বা সাহিত্য সভার মাধ্যমে পুরুষদের সাহিত্যরুচি যেভাবে পরিশীলিত হচ্ছিল,পর্দানশীন মহিলা পাঠক-সমাজ স্বভাবতই সেভাবে প্রভাবিত হন নি।রামায়ণ-মহাভারতের সঙ্গে অন্দরমহলে অনায়াসে প্রবেশ ঘটত বটতলার সাহিত্য নভেল –নাটক-প্রহসনের। কলকাতায় অনেক বছর কাটানোর পর কবি নবীন সেন যখন তাঁর গ্রামে ফিরে আসেন তখন গ্রামের মেয়েদের পুঁথির বদলে নাটক-নভেল পড়তে দেখে বিস্মিত হন।”৩২১ নবীন চন্দ্র সেনের তথ্যটি আর কোথাও নয়,তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার জীবন’ থেকে সংগ্রহ করেছেন লেখিকা।‘পুঁথির বদলে নাটক-নভেল’ কথাটির ব্যঞ্জনা মনে দাগ না কেটে যায় না।বিপিন চন্দ্র পাল সিলেটে শৈশব কাটিয়েছেন,সিলেটি নাগরী বই পত্র পড়েছেন কিনা জানি না। কিন্তু,“নিরস পাঠ্যপুস্তকের একঘেঁয়েমি কাটাতে লুকিয়ে পড়তেন বটতলা প্রকাশিত ‘গোলেবাকাওলি’ ও ‘কামিনীকুমার’৩২২এর থেকে এই অনুমানটি করা চলে যে যাকে ‘নিম্নশ্রেণি’র সাহিত্য বলা হচ্ছে ‘উচ্চশ্রেণি’র সাহিত্যের থেকে তার প্রচার প্রসার এবং গ্রহণযোগ্যতা অবশ্যই ছিল বহু বেশি।সিলেটি নাগরী পুথি বা ছাপা বইয়ের যে শ’খানিক বা তার বেশি সংখ্যার সংবাদ পাচ্ছি,তার তুলনাতে কি বেশি লেখা এবং পড়া হয়েছে সিলেট এবং প্রতিবেশী এলাকাতে ‘উচ্চশ্রেণি’র সাহিত্য-- এই সমীক্ষাটি করা যেতে পারে। বাংলা লিপিতে ছাপা পুথি-সাহিত্য সংখ্যাই সম্ভবত তার সঙ্গে টেক্কা দিতে পারে। আমরা জানি না। বটতলা সাহিত্যের যে ইতিকথা আমরা পড়লাম,প্রায় একই কথা এই সব নাগরীগ্রন্থ সম্পর্কে লিখেছিলেন সৈয়দ মুর্তাজা আলি,“কম পরিশ্রমে ও কম সময়ে শেখা যায় বলিয়া স্ত্রীলোকের মাঝেও ইহার বহুল প্রচার ছিল।”৩২৩দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী লিখেছিলেন,“প্রকৃত পক্ষে মুসলিম সাধক ও সাহিত্যিকদের প্রচেষ্টায় এই নাগরী সাহিত্য গড়িয়া উঠেসিলেটের সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েলোকও নাগরীতে চিঠিপত্র লিখিতে ও পুঁথি পুস্তক অধ্যয়ন করিতে পারেন।”৩২৪ অনুরাধা চন্দ খানিক সজোরেই লিখছেন,“এ-লিপির ব্যবহার ‘নিম্নবর্গীয়’ মুসলমানরা করতেন,এ-কথা গ্রাহ্য নয়।এ-লিপির চর্চাকারী কবিরা অঞ্চলের গ্রামীণ লোকায়ত জীবনের কাছের লোক ছিলেন সন্দেহ নেই,কিন্তু তাঁদের মননে ও সৃজনে নিম্নবর্গীয় কোনো লক্ষণ দেখি না।যারা এই লিপি পাঠ করতেন তাঁদের সকলেই নিম্নবর্গীয় ছিলেন না।”৩২৫ নিজের বক্তব্যের সমর্থনে তিনি সুনামগঞ্জের এক জমিদার বাড়ির কন্যা সাহিত্যিক সাদিয়া চৌধুরী পরাগের কিছু কথা তুলে দেন,যেটি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী বলে আমরাও আকর্ষণ বোধ করছি পড়াতে,“আসলে সিলেটি নাগরী সম্পর্কে কিছু কথা লিখতে ব’সে,একটা রক্ষণশীল পরিবারের পর্দাবন্ধ নারীদের জীবনচিত্র উঠে আসছে। প্রকৃতপক্ষে এঁরাই পুথিশাস্ত্রের একান্ত পাঠক ছিলেন।বাড়ির অন্দরমহলের প্রায় সকল কক্ষে কাঠের আলমিরার থাকে-থাকে সাজানো সিলেটি নাগরীতে লিখিত গ্রন্থগুলো যেন ওই সকল রমণীদের পরম বন্ধুর মতই ছিল আর সে কারণেই আমাদের পরিবারের সিংহ-পুরুষ মেঝ দেওয়ান আনসফের অকাল মৃত্যুর পরে তাঁর স্ত্রী যিনি মাত্র ২২/২৩ বৎসর বয়সে বৈধব্যের শাপে পড়েছিলেন,তাঁকে একটা নির্জন প্রকোষ্ঠে ব’সে সফেদ সাদা শাড়ি দ্বারা আপাদমস্তক ঢেকে ঝুঁকে একান্ত নিবিষ্ট মনে পাঠ করতে দেখতাম,জোলেখা বলে গো দাই আমার উপায় নাইরে/ ও আমি কি-বা দোষে হারাইলাম ইউসুফেরে।”৩২৬ সাদিয়া চৌধুরী পরাগের নিবন্ধটি পরে ‘Script Identity Region’ বইতে সংকলিত হয়। সেখানে তিনি আরো লিখেছেন,“ পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে বাড়ি ছেড়ে এলেও মাঝে মাঝে সেখানে বেড়াতে গেলে পুঁথি পড়া শুনতাম। আমাদের পাহারাদারদের একজন, ললাটি---তিনি সত্তর দশকেও পদ্মপুরাণ থেকে ভাসান পাঠ করে শুনিয়েছেন এবং আমাদের গ্রামের হিন্দু-মুসলমান লোকজন অনেকেই সিলেট নাগরীর পুঁথি পাঠ করত।তবে সবগুলো পুঁথি যে মুসলমানদের দ্বারা লিখিত সে কথাটি সত্য নয়।পদ্মপুরাণ,চন্দ্রমুখী এসব হিন্দু ধর্মীয় পুঁথি হিন্দু রচয়িতাদের দ্বারা লিখিত এবং এটাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। মোটকথা,যারা সিলেট নাগরী পুঁথির পাঠক ছিল তারা হলো সঙ্গতিশীল  কৃষক সমাজ অর্থাৎ কৃষাণ-কৃষাণী,যারা ফসল তোলার অবসরে জোছনা রাতে অথবা বর্ষার অফুরন্ত অবসরে বাড়িতে পুঁথিপাঠের আসর জমিয়ে অবসর বিনোদন করত।আবার কখনো পুঁথিপাঠ জানা নারীও বা পুরুষ জমিদারের বাড়িতে পুঁথিপাঠ করে বখশিশ নিয়ে যেতো। যেমন আমাদের গ্রামে ছিল আফলাতুন (ফালাতু)আমাদের নায়েব কাজী আজিজুর রহমান ও মাফিজ শেখভালও পুঁথিয়াল বা গায়েন ছিল।নব্বই দশকের শেষের দিকে আমার বোনের বাসার যুবতী কাজের মেয়ে মীনা আমাকে সিলেট নাগরীতে লেখা একখানা পুঁথি দেখিয়েছিল এবং বলেছিল সে পাঠ করে শোনাবে...৩২৭মহিলাদের মধ্যেই যে সিলেটি নাগরী পুথি সবচাইতে বেশি জনপ্রিয় ছিল সেই কথা আহমদ হাসান দানীও উল্লেখ করেছিলেন,“একথা বলা ভুল যে শুধু ‘নিম্নশ্রেণীর মুসলমানেরা’ বা ‘নিরক্ষর লোকজন’ এই লিপির ব্যবহার করে।সত্য কথা বলতে গেলে মুসলিম মহিলাদের মধ্যেই এ লিপি সমধিক প্রচলিত।”৩২৮

একেবারে শেষে সিলেটি নাগরী লিপি কবে এলো এবং কবে গেল,আদৌ গেছে কি টিকে আছে এই প্রসঙ্গটি স্পষ্ট করা জরুরি। বস্তুত শুরুর তারিখ নিয়ে এক বড় বিতর্কই আছে।সুনীতিকুমার তাঁর ছোট উল্লেখে কালের কোনো সুনির্দিষ্ট উল্লেখ না করলেও এই কথাগুলো লিখেছিলেন,“..this use of Nāgari in distant East Bengal, and among Mohammedans, too, is explained as being the result of the influence of early colonies of proselytising Moslems from Upper India who wrote their vernaculars (Eastern and Western Hindi dialects) in Dēva-nāgari—persianised Hindi (or Urdū) being not yet in the field—and taught it to the local converts..”৩২৯অর্থাৎ উত্তরভারতীয় মুসলমানদের সিলেট তথা পুব-বাংলাতে আসবার আদি ইতিহাসের সঙ্গে সিলেটি নাগরীকে জুড়ছেন।সুনীতিকুমারের এই সিদ্ধান্তকে আশ্রয় করে অনেকেই সিলেটি নাগরীর প্রাচীনতা প্রমাণ করতে পরে উৎসাহী হয়েছেন। শিবপ্রসন্ন লাহিড়ি তো সুনীতিকুমারের কলমে একেবারে ‘চতুর্দশ শতক’ কালসীমাকেও বসিয়ে দিয়েছিলেন। সেটি যে সত্য নয় এই কথার উল্লেখ করেই শিবপ্রসন্নের মন্তব্যটি উদ্ধার করেছিলেন উষারঞ্জন ভট্টাচার্য,“ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীকে সিলেটে এই লিপির প্রচলন-কাল বলে অনুমান করেন।”৩৩০

সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্তকে সম্ভবত প্রথম প্রশ্ন করেন আহমদ হাসান দানীই। সুতরাং আমাদের দানীকে সামান্য বিস্তৃতই বোঝা দরকার।তাঁর বক্তব্য ছিল,হিন্দি বা উর্দু পরের কালের ভাষা হতে পারে,কিন্তু,“মুসলমানদের মধ্যে তখন আরবী লিপির ব্যাপক প্রচলন ছিল।”৩৩১বিপরীত কোনো প্রমাণ নেই যে তাদের মধ্যে দেবনাগরীর সেরকম কোনো জনপ্রিয়তা ছিল।প্রথম যুগের মুসলমান শাসকদের মুদ্রাতে আরবির পাশে নাগরী লিপি থাকত শুধু হিন্দু প্রজার সুবিধের জন্যে বা “বড় জোর মৌদ্রিক প্রথাকে চালু রাখবার জন্য।”৩৩২কিন্তু,“এটি বড়ই অর্থপূর্ণ যে হিন্দুদের মধ্যে আরবী লিপি ব্যাপকভাবে পরিচিত তথা প্রচলিত হ’য়ে উঠবার পর সৈয়দ,লোদী প্রভৃতি পরবর্তী তোগলক এবং মোগলদের মুদ্রায় নাগরী লিপির অঙ্কন ছেড়ে দেওয়া হ’লো।এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম রইল সুরী সুলতানেরা এবং বাংলায় তাদের উত্তরাধিকারী করবাণীরা।মুদ্রায় নাগরী লিপির এই পুনরাবির্ভাব (এবারে আফগান শাসনকর্তাদের রৌপ্য মুদ্রায়) একটা বিক্ষিপ্ত বা বিচ্ছিন্ন ব্যাপার তথা ঘটনা মাত্র নয়নবাগত মুঘল বিজেতাদের বিপক্ষে এঁদের রাজনৈতিক উত্থানের পটভূমিকায় এটিকে হিসেব করে দেখতে হবে।”৩৩৩হিসেবটা এই যে,আহমদ হাসান দানীর মতে সংকটকালে সুরী সুলতানদের দরকার পড়ছিল হিন্দু অধিবাসীদের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সাহায্য ও সহযোগিতা।“অন্যকথায়---আমাদের এখানে মানসচক্ষে এমন একটা নোতুন সাংস্কৃতিক শক্তির পরিচয় লাভ করা আবশ্যক,যে শক্তি তার স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার জন্য একটা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় রত বিহারে উপনিবিষ্ট আফগানদের উদ্দেশ্যের পরিপোষকতা করে’ছিল। আফসোস এই যে,সুরী সাম্রাজ্যের এই সাংস্কৃতিক দিকটায় কোন ঐতিহাসিক নজর দেন নি।”৩৩৪ তখন,“মুদ্রায় আবার নাগরী লিপি স্থান পেয়েছে,এবং কররাণী যে বাংলায় আদৌ আর নাগরী লিপির ব্যবহার নেই সেই বাংলায় রাজত্ব করলেও,মুদ্রাঙ্কনে এই রীতির অনুসরণ করেন।”৩৩৫আহমদ হাসান দানী এখানে সারা বাংলার ইতিহাসের প্রেক্ষিতে সিলেটি নাগরীকে বিচার করছিলেন,সেটি গুরুত্বপূর্ণ।আফগানরা ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি কয়েক দশক বাংলাতে শাসন করেছিলেন।এবং পরে হেরে গিয়ে প্রত্যন্ত এলাকাতে কিছু ছোট ছোট সামন্ত রাজ্য গড়েছিলেন,সিলেটেও সেসব হয়েছিল।এসব অন্য আরো অনেকেও লিখছেন। মোগল আমলে কী হয়েছিল সে সম্পর্কে খুব ছোট করে গোলাম মুর্শিদ লিখেছেন এই ভাবে,“বাংলার সুলতান এবং তাঁদের অমাত্যরা –পনেরো এবং ষোলো শতকে---বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকণা করেছিলেন।কিন্তু মোগল আমলে তাও বন্ধ হয়।তখনকার কোনো সুবেহদার বাংলা ভাষা-সাহিত্যের চর্চায় কোনো উৎসাহ দিয়েছেন বলে জানা যায় না।বরং এ সময়ে ত্রিপুরা,কোচবিহার,বিষ্ণুপুর,কৃষ্ণনগর,আরাকান ইত্যাদি জায়গার রাজা কি জমিদারেরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চায় উৎসাহ দিতে আরম্ভ করেন। আরাকান রাজদরবারের দৌলত কাজী এবং আলাওল যে অসাধারণ বাংলা রোম্যান্টিক আখ্যান কাব্য রচনা করেন,সেটা আরাকান রাজাদের পৃষ্ঠপোষণার ফলেই সম্ভব হয়েছিলো। কেবল তাই নয়,আরাকান মুসলিম শাসনের প্রান্তে অথবা প্রায় বাইরে অবস্থিত হওয়ায় এঁদের লেখায় বিষয়বস্তুর দিক দিয়েও ইসলামী প্রভাব অনেক কম।”৩৩৬আরাকানের প্রায় সব কাব্যই সুফী ধর্ম-দর্শন জাত ছিল।সুতরাং গোলাম মুরশিদ যে ইসলামী প্রভাবের কথা লিখেছেন,তাকে আরবি-ফার্সি শব্দের প্রভাব কম –এই অর্থেই নিতে পারি।তিনি যে এলাকাগুলোর নাম করেছেন,তাতে সিলেট নেই।কিন্তু আমরা বুঝে নিয়ে পারি,তিনি সিলেটই নয়,কাছাড়ের কথাও বলছেন।এই সময়টি সিলেটি নাগরী লিপি উদ্ভবের জন্যে মনে রাখা জরুরি।আহমদ হাসান দানী লিখছেন মোগলদের কাছে হেরে গিয়ে ঠাই নিয়েছিলেন,“এই অঞ্চলটিতেই,এই যেখানে আজ পর্যন্ত আফগানদের প্রাধান্য রক্ষা করা যায় সেখানে,আমরা নাগরী লিপির এখনো ব্যবহার করতে দেখিকার্যকারণের সাধারণ যুক্তিতে তাহলে শ্রীহট্ট নাগরীর উৎপত্তিকে আমরা খ্রীষ্টীয় ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে এ অঞ্চলে আফগানদের উপনিবেশ স্থাপনের এবং মুদ্রায় এ লিপি ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের সহজ প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত ক’রে দেখতে পারি।”৩৩৭ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে,তিনি শুধুই মুদ্রার কথাই লিখছেন না,আরো বহু যুক্তি হাজির করছেন।এবং ষোড়শ শতক থেকে ‘যেখানে আজ পর্যন্ত আফগানদের প্রাধান্য রক্ষা করা যায়’ লিখে সেকাল থেকে একাল অব্দি টেনেছেন। যে পাণ্ডুলিপিগুলো পাওয়া গেছে,সেগুলোও এর আগেকার নয়,সবই পরের।আফগান মুদ্রাতে যে সব বর্ণ পাওয়া গেছে,তাও নয়।তিনি লিখছেন, “যদিও মাত্র দশটি বর্ণ (ই,উ,দ,ব,ম,র,ল,শ,স,এবং হ) আফগান মুদ্রা থেকে জানা যায়,এবং এ কথা বলাও ভুল হবে যে, সেগুলো শ্রীহট্ট-নাগরীর সঙ্গে হুবহু মিলে যায়,তবু এ দুয়ের মধ্যকার সাদৃশ্য,অবশ্য,দ,ল,এবং হ ছাড়া,লক্ষ করবার মতো।উ,ব,ম,ও শ বর্ণগুলোর মধ্যে আদৌ কোন পার্থক্য নেই।‘র’ বর্ণের বেলায় শ্রীহট্ট-নাগরীতে বাঁ-হাতি দাগটা তেরছা, আর আফগান মুদ্রায় তা অনুভূমিক (horizontal)মুদ্রায় অঙ্কিত ‘ই’ আধুনিক দেবনাগরী বর্ণের প্রাচীন রূপ,আর শ্রীহট্ট-নাগরীতে এর নীচের গোল প্যাঁচটা একেবারে সমতল রেখা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে।”৩৩৮

সৈয়দ মুর্তাজা আলি তো এই লিপির কাল আরো এগিয়ে পলাশী যুদ্ধের পরে নিয়ে এসেছেনআফগানরা বাংলা হরফের জটিলতা দেখে কাইথি লিপিতে বাংলা লিখতে শুরু করেন,ক্রমে নবদীক্ষিত মুসলমানেরাও এই লিপি ব্যবহার করতে শুরু করেন,এবং দুয়ে মিলে সিলেটি নাগরী গড়ে তুলেন অনেকটা এরকমই তাঁর অভিমত।৩৩৯কিন্তু সেসব হয় বহু পরে,“পলাশীর যুদ্ধের পর যখন দেশ হইতে ফারসী ও উর্দু ভাষার চর্চা উঠিয়া গেল তখন সাধারণ মুসলমানেরা বাংলা সাহিত্যের দিকে নজর দিল।তাহারা দেখিতে পাইল বাংলা লিপি---বিশেষত যুক্তবর্ণ অত্যন্ত জটিল,আবার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের প্রভাবে বাংলা গদ্য তখন জাতবদল করিয়াছে।... একে ত সিলেটের কথ্যভাষা নদীয়া শান্তিপুরের সাধুভাষা থেকে অনেক পৃথক,তদুপরি সংস্কৃত শব্দের বহুল প্রয়োগ নিয়েও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের সাধুভাষা মুসলমানদের একেবারে দুর্বোধ্য মনে হইল।কাজেই বাধ্য হইয়া তাঁহারা নিজস্ব লিপি ও সাহিত্য সৃষ্টি করতে অগ্রসর হইলেনযে সকল মুসলমান এই লিপির সৃষ্টি করেন তাঁহারা দেবনাগরী ও কাইথী লিপি জানিতেন।”৩৪০

দেওয়ান নূরুল হোসেন চৌধুরী লিখেছেন,“সিলেটের কুতুবল আউলিয়া (রঃ) সিলেটী নাগরী ভাষার গোড়াপত্তন করেন।”৩৪১ উষারঞ্জন ভট্টাচার্য লিখেছেন,“ইনি সম্ভবত ষোলো শতকের শেষের দিকে জীবিত ছিলেন।”৩৪২ কোনো একক ব্যক্তি এভাবে একটি লিপির প্রচলন ঘটাতে পারেন কি না,সেই সংশয় আমাদের আছে।তার উপরে ইনি সিলেটি নাগরী লিপি আর সিলেটি ভাষাকে এক করে লিখেছেন ‘সিলেটী নাগরী ভাষা’যাই হোক,তবু সময়টা ষোলো শতক থেকে পেছনে যাচ্ছে না।এইখানে আমরা আবার মনে করিয়ে দিতে চাই সুকুমার সেনেই সেই কথা,কোনো বাংলা পুথিই এর আগেকার মেলে নি।

আহমেদ হাসান দানীকে খণ্ডন করে যারা সিলেটি নাগরী লিপির সময়কে পিছিয়ে ‘চতুর্দশ শতক’-এ নিয়ে গেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম শিবপ্রসন্ন লাহিড়ি।যাঁর ‘সিলেটী ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা’ বইটি উপমহাদেশেই উপভাষাবিজ্ঞানের আদি যুগের বই। সেখানে তো সিলেটি নাগরী নিয়ে আলোচনা আছেই,ঢাকার বাংলা একাডেমী পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যাতেও তাঁর একটি নিবন্ধ ছিল ‘সিলেটী নাগরী লিপির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ’আমাদের কোনোটিই দেখবার সুযোগ হয় নি।কিন্তু উষারঞ্জন ভট্টাচার্য তাঁর যুক্তিগুলোকে তুলে ধরে খণ্ডন করে গেছেন,সেই সূত্রে কিছু পরিচয় হয়েছে।এর মধ্যে প্রথমটি সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভুল উল্লেখ সেই আমরা লিখে এসেছি।তিনি আহমেদ হাসান দানীর যুক্তি খণ্ডন করে লিখছেন,“...নাগরী লিপি আগে থেকেই এ সব অঞ্চলে প্রচলিত ছিল বলে আফগান সুলতানগণ (অনিচ্ছায় হলেও) মুদ্রা পরিচিতির জন্য তাঁদের মুদ্রায় নাগরীর জন্য সামান্য স্থান বরাদ্দ করেছিলেন বলে মনে করা যুক্তিসঙ্গত।”৩৪৩এখন,আগে যে লিপিটি পরিচিত ছিল সেই কথা কিন্তু আহমদ হাসান দানীও লিখেছেনকিন্তু তিনি আর যেসব ইতিহাসের যুক্তি দিয়েছেন,সে সবে কিন্তু শিবপ্রসন্ন লাহিড়ি যান নি।এমন কি যে নাগরীর ব্যবহার মোগলেরা তুলে দিয়েও পারলেন,তাদের ‘অনিচ্ছায়’ কিছু করতে হল না-- সেটিকেই কেন আফগান সুলতানেরা অনিচ্ছায় হলেও আবার বহুল ব্যবহার শুরু করলেন সেসব তর্কেও যান নি বলেই মনে হয়। গেলে উষারঞ্জন সেগুলোর উল্লেখ করতেন।শিবপ্রসন্নের বাকি যুক্তি উষারঞ্জনের ভাষাতে এরকম,“ষোলো শতকের আগের কোনো পুথি পাওয়া যায় নি বলে ধরা যায় না যে এর আগে সিলেটি নাগরীর প্রচলন ছিল নাশ্রীহট্ট অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক পাণ্ডুলিপি আজও উদ্ধার হয় নি।এগুলির বেশির ভাগই পীর,দরবেশ,ফকিরদের লেখা,মুসলমানেরা পবিত্র জ্ঞানে এগুলিকে নিজেদের বাড়িতে,মসজিদে বা দরগাতে  রেখেছেন এবং হস্তান্তর করতে রাজি হন না। চেরাপুঞ্জির অনতিদূরে বৃষ্টিবহুল শ্রীহট্ট জেলায় পাণ্ডুলিপি কিছুতেই দীর্ঘজীবন পেতে পারে না।শ্রীহট্টে চারশ বছর আগের কোনো পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করা অত্যন্ত দুরূহ ও প্রায় অসম্ভব।”৩৪৪এর পরেই উষারঞ্জন লিখছেন নিজের কথা,“অন্যান্য বিষয়ে শিবপ্রসন্নের যুক্তি সবল,কিন্তু উদ্ভব কালের প্রশ্নে যে যুক্তিকে অকাট্য বলে ভেবেছেন তিনি,তাকে সমর্থন করতে পারছি না।”৩৪৫ না পারবার কারণটি মুর্তাজা আলিই লিখেছেন,জগন্নাথ দেব,অচ্যুতচরণ তত্ত্বনিধিরা বহু প্রাচীন ফার্সী,উর্দু পুথির উল্লেখ করেছেন,অথচ সিলেটি নাগরী পুথির উল্লেখ করেন নি। পেলে না করবার কোনো কারণ ছিল না।উষারঞ্জন সেই সঙ্গে জুড়ছেন,বৃষ্টিপাত, পবিত্রজ্ঞানে সংরক্ষণ ইত্যাদি কথা সত্য কিন্তু,“আশরফ হোসেন সাহিত্যরত্ন অথবা মুর্তাজা আলীর মতো বিশিষ্ট জনের কাছে মুসলমান পরিবারে বা উপাসনাস্থলে রক্ষিত প্রাচীন পুথি দুর্গম ছিল বলে মনে করি না।”৩৪৬আশরফ হোসেন সাহিত্যরত্ন বহু সিলেটি নাগরী পুথি সংগ্রহ করেছিলেন।‘শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা’তে বেশ কিছু প্রবন্ধ নিবন্ধও লেখেনসেরকম একটি প্রবন্ধ ‘সিলেটের নাগরী সাহিত্য ও তাহার প্রভাব’ থেকে  ছিয়াশিটি পুথির এক তালিকা উষারঞ্জন ভট্টাচার্যও তুলে দিয়েছেন।৩৪৭আমরা উষারঞ্জনের যুক্তিক্রমের সঙ্গে আরেকটি যুক্তি জুড়ে দিতে চাই যে প্রাচীন পুথি না পাওয়া গেলেও অনুলিপির মধ্য দিয়ে কিন্তু  রচনার ভাষা এবং অন্তর্বস্তুতে প্রাচীনতা ধরা পড়ে।‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’- কিংবা চর্যার পুথিগুলো তার নিদর্শন।শিবপ্রসন্ন লাহিড়ি বা তাঁর মতো প্রাচীনতার দাবিদারেরা মনে হয় না সেদিকে তাকিয়েছেন। তাঁরা আমরা আগে যেমন লিখেছি,বাংলা দেশ এবং সাহিত্যের সাধারণ ইতিবৃত্ত থেকে বিচ্ছিন্ন করে গোটা বিষয়টিকে ভেবেছেন। 

শিবপ্রসন্ন ‘চতুর্দশ শতক’-এর কথা লিখলেও শাহজালালের কথা স্পষ্ট করে সম্ভবত লেখেন নি।লিখলে উষারঞ্জন ভট্টাচার্য বা অনুরাধা চন্দ উল্লেখ করতেন।অনুরাধা চন্দ অধ্যাপক আসাদ্দর আলী,ডক্টর মুহম্মদ আবদুল মুসাব্বির ভূঁঞা প্রমুখ আরো কয়েকজনের কথা উল্লেখ করেছেন যারা পদ্মনাথ ভট্টচার্য বিদ্যাবিনোদের মতোই হজরত শাহজালাল এবং তাঁর সঙ্গীদের দ্বারা লিপিটির প্রচলনের কথা লিখেছেন।অনুরাধা চন্দ বাংলাতে যে জনজাতীয় সমাজ মুসলমান হয়েছিলেন সেই প্রশ্নে রিচার্ড ঈটনের ‘Rise of Islam’ বইটির কথা উল্লেখ করেছেন ‘পহেলা কেতাব’এর ভূমিকাতে। ভেতরে গিয়ে আলোচনা করেছেন তাঁর সম্পাদিত ‘Script Identity Region’ বইতে। সেকথায় আমরা পরে ফিরবঈটনের বইতে এই সাহিত্যের উদ্ভব সম্ভাবনার কালের ইঙ্গিত মেলেদেবনাগরী লিপির সঙ্গে এই অঞ্চলের আর্যায়নের প্রথম দাবিদার ব্রাহ্মণেরাও পরিচিত ছিলেন,সেসব অধ্যাপিকা অনুরাধা চন্দ বিস্তৃত লিখেছেন ‘পহেলা কেতাবে’শুধু নিধনপুর লিপিটিও দেবনাগরীতে লেখা বলে তিনি লিখেছেন।৩৪৮এটি ঠিক নয়,আমরা দেখিয়েছি সেটি ‘কামরূপী-কুটিল’-এ লেখা।সুতরাং দেবনাগরীর সঙ্গে পরিচিতির কাল সপ্তম শতকে পিছিয়ে যায় না।পশ্চিম ভাগ ফলকের কথাও তিনি লিখেছেন। সেটি হলেও হতে পারে।তাতে আমাদের কোনো সমস্যা হবার কথা নয়। কেননা, আহমদ হাসান দানীও কোথাও এই কথা লেখেন নি যে এই লিপির সঙ্গে এখানে কারো পরিচয় ছিল না।

আমরা ঈটনের কথাতে যাব,তার আগে আবদুল মুসাব্বির ভূঁঞার লেখাটি যেহেতু পড়বার সুযোগ হচ্ছে,তাঁর যুক্তিটি দেখে নিতে পারি।তিনি সিলেটি নাগরী লিপির উদ্ভব নিয়ে আমরা যে সব তাত্ত্বিকদের কথা লিখে এলাম,এদের বাইরেও দুই একজনের কথা লিখেছেন,যেমন যোগেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ এবং নগেন্দ্র নাথ বসুর কথাযোগেন্দ্রনাথের কথাটি বেশি কিছু নয়,নিধনপুর লিপি নিয়ে ১৯৩০এর একটি লেখার পার্শ্ব মন্তব্যতাঁর বক্তব্য হচ্ছে হিন্দু ব্রাহ্মণদের মধ্যে দেবনাগরীর চল ছিলই,তাঁরা যখন ইসলাম বরণ করলেন অনেকে,“It is for the expert to say if the Nagari and Musalmani Nagari were derived from a common script.”৩৪৯সেটি সম্ভবত নগেন্দ্রনাথ বসুর অনুসরণ।নগেন্দ্রনাথ বসুর মন্তব্যটি আরো আগে  ১৯২২এ প্রকাশিত তাঁর ‘The Social History of Kamrupa’ বইয়ের তৃতীয় খণ্ডে ছিল। সেখানে ধর্মান্তরিত ব্রাহ্মণেরাই নাগরী লিপির প্রচলন ঘটিয়েছিলেন এই তত্ত্ব প্রায় নিশ্চিত হয়েই লিখেছেন,“ ...though converted to Mohammadan religion those who resided in Sylhet & its neighbourhood,and near Bishnupur (Bankura) retained to a certain extent the distinctive feature of their community.It is remarkable that the alphabet which they adopt while writing their books on subjects connected with the Muhammadan religion is Nagari though the language used is Bengali.This alphabet is known as Sylhet Nagari and Mussalman-Nagari.”৩৫০ একই কথার উদ্ধার উষারঞ্জন ভট্টাচার্যও করেছেন।কিন্তু তিনি আরো জানিয়েছেন, নগেন্দ্রনাথ সিলেটি নাগরীর কোনো পুথি দেখেন নি,ছাপা বই দেখেছিলেন।অন্যদিকে বাঁকুড়ার সাতটি পুথি তাঁর হাতে পড়েছিল।তার ভিত্তিতেই তিনি আরো লিখেছিলেন,“Though the writing of these bears strong resemblance to the Sylhet Nagari,the letters used in them are larger in number and have a close affinity to Devanagari.”৩৫১আমাদের জানবার সুবিধে হলো না বাঁকুড়ার পুথিগুলো কবেকার,ষোড়শ শতকের আগেকার হবার সম্ভাবনা খুবই কম।বাংলার পশ্চিমে দেবনাগরী,কাইথি,মৈথেলি লিপিতে বাংলা লেখা হয়েছিল, সেসব কথা সুনীতিকুমারও লিখেছিলেন।গ্রিয়ার্সনও মালদা-পূর্ণিয়া এলাকার ভাষার নমুনা দিতে গিয়ে হাতে লেখা কাইথি প্রতিলিপি তুলে দিয়েছিলেন। চিত্র-৩৮-এ৩৫২ আমরা তুলে দিচ্ছি।তার মানে,তখন অব্দি তো প্রচলিত ছিলই।তিনি একে ‘Northern Bengali Dialects’ বলে লিখেছিলেন।মালদা-পূর্ণিয়ার ধর্মান্তরিত কোচেদের মধ্যে প্রচলিত।সুতরাং দেবনাগরী আগে থেকে সিলেটে প্রচলিত ছিল  কিনা সেসব আমাদের সমস্যা হবার কথা নয়এই নিয়ে স্বতন্ত্র ইতিহাসের অনুসন্ধানও করা যেতে পারে।আহমদ হাসান দানীও অস্বীকার করেন নি।কিন্তু প্রশ্ন হল এই লিপির থেকে সিলেটি নাগরী এলো কবে,আর তাতে সাহিত্য রচনার ঢেউ এসেছে কবে।দানী তো কাইথির কথাও লিখেছিলেন।অধ্যাপক আবদুল মুসাব্বির ভূঁঞা শিবপ্রসন্ন লাহিড়ি,নগেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখদের প্রাচীনতর অধ্যয়নের উপরে নির্ভর করে লিখেছেন,“Dani is reluctant to admit the emergence of Sylot Nagari prior to the sixteenth century.Our Contention is that not only during the period of Shāh Jalāl but even before his appearance, Muslim influence began to spread in Sylhet. Hence doubtlessly it can be asserted that Sylot Nāgari came in to being and was propagated before the advent of Shāh Jalāl and the sixteenth century. Nor can we agree to the contention of Dani regarding borrowing of Sylot Nagari from the characters of afgan coins.”৩৫৩আহমদ হাসান দানী কিন্তু কোত্থাও লেখেন নি যে সিলেটি নাগরী আফগান মুদ্রার থেকে এসেছে।তিনি শুধু একবার নাগরী লিপির চল উঠে গিয়ে আফগানদের সময় আবার শাসকীয় ব্যবহারে বেড়ে গেছে দেখাতে মুদ্রার প্রসঙ্গটি টেনেছিলেন,এবং সেখানে যে বেশি হরফ মেলেনা সেও লিখেছিলেন।নাই মিলতে পারে,মুদ্রা তো আর সাহিত্যের পাঠ নয়। যেটুকুনি দরকার সেটুকুনই কথা ছিল।কিন্তু তার কাছে তুলনা করবার জন্যে এই মুদ্রাগুলো ছিল,তিনি তাই করেছেন।এইভাবে,আমাদের মতে,আহমদ হাসান দানীকে বিরোধিতা করতে গিয়ে দুর্বলতর দৃষ্টি নিয়ে পড়া হয়েছে।এবং সেই দৃষ্টি ভাষাবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকে অতিক্রম করে কিছুতো ধর্মীয় দৃষ্টির দ্বারা আচ্ছন্নও হয়েছে। সেরকম আচ্ছন্ন দৃষ্টিতেই তিনি লিখেছিলেন,“The script has been named differently by different scholars.Some call it Phulnāgari,while others name it Mussalmānī Nāgari.I have called it Jājālāvādi Nāgari,Jalalavad being an alternative name for Sylhet due to its association with Shāh Jalāl.”৩৫৪জালালাবাদ’ সিলেটের ঐতিহাসিক,সরকারী নাম নয়।‘শ্রীভূমি’,‘শ্রীহট্ট’ ইত্যাদি সংস্কৃত নামাকরণ চেষ্টার বিপরীতে একটি জনপ্রিয় প্রস্তাব মাত্র। এই নামে সিলেটের কাছে একটি ছোট্ট থানা মাত্র রয়েছে।তাছাড়া বাকি নামগুলো বিদ্বজ্জনেরা নিজে ইচ্ছে করে দিয়েছেন,এমন কোনো প্রমাণ নেই।প্রচলিত নাম ছিল বলেই তাঁরাও সেরকম লিখে গেছেন কেউ সেরকম নাম প্রস্তাব করেন নি।তিনি করেছেন,যার কারণটি স্পষ্ট --শাহজালালের সঙ্গে লিপিটিকে জুড়ে দেওয়া।যদিও এই নামটি তাঁর গবেষণা নিবন্ধে ছিল। যে নিবন্ধ আমরা ব্যবহার করছি,সেখানে তিনি লন্ডনের সিলট একাডেমির ‘Sylot Nāgari’নামটিই লিখে গেছেন। 

 

 

 

শুধু সিলেটই নয়,সম্ভবত সারা পূর্ববাংলাতেই হজরত শাহজালাল এবং তাঁর অনুগামীদের ভূমিকাটি ঐতিহাসিক ভাবেই বিশাল।দ্বাদশ শতকের শুরুতে ১৩০৩ এ ৩৬০ আউলিয়া সঙ্গে নিয়ে সিলেটে এসেছিলেন বলে মনে করা হয়অনুগামীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন রিচার্ড ঈটন।আদৌ সেটি তিনশ ষাটই কিনা।তাঁর বক্তব্য হচ্ছে,বদর যুদ্ধে হজরত মুহম্মদের ৩১৩ সঙ্গী সাহেবাদের সঙ্গে সংখ্যাটিকে মিলিয়ে দেখিয়ে গল্পটি পরে তৈরি তাঁকে মহিমান্বিত করবার জন্যে।৩৫৫যে কোনো বিশ্বাসী অনুগামীদের পক্ষে সেকালে সেসব ছিল অতি সাধারণ কথা,যে কোনো গ্রন্থ পড়লেই বোঝা যায়। সে যাই হোক,ধারে কাছে একটি সংখ্যা ছিল।এবং তাঁরা শুধু ইসলামের প্রচার প্রসারই করেন নি।সরিয়তি ইসলাম তো একেবারেই করেন নি।তাঁদের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকাটির কথা লিখেছেন সঞ্জীব দেব লস্কর, Besides propagating and preaching Islam to the Masses,Shah Jalal and his three hundred and sixty disciples had made a second agricultural revolution in this region.”৩৫৬ প্রথম কৃষি বিপ্লবটি ঘটেছিল আর্যব্রাহ্মণদের দ্বারা।যাদের কথা সপ্তম শতকের নিধনপুর ফলক থেকে আমরা জেনে এসেছি।কীভাবে সেসব হয়েছিল,সুজিৎ চৌধুরীর আশ্রয় নিয়ে আমরা দেখিয়েও এসেছিকাছাড়ের পরিপ্রেক্ষিতে হজরত শাহজালালদের দ্বারা আরো কী হয়েছিল ব্যাখ্যা করেছেন সঞ্জীববিশ্বাসের বাইরে সেই সব সত্য আমাদের বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তের ধারে কাছে নিয়ে যেতে পারে বলে,কিছু তাঁর ভাষাতেই উল্লেখ করা যাক,“Among the immigrants who settled in Cachar,there were Hindus,Muslims,and Strikingly a group of Muslim-converts from the animistic tribesthe Naga and the Dimasa –of the pri-Hinduised state. They had undergon a process of double metamorphosis –from animism to Islam,and then integrated to Bengali society adopting Bengali Language and culture.A number of Bengali Muslim families in Barkhola and Sonai region in Cachar were loosely termed as Kachari in Barkhola,eventhough they neither spoke Kachari or Dimasa Language, nor did they have anything to do with the Dimasa society.The Naga Maulavis in Sonai were neither Naga nor Maulavi.The term implies that they had a tribal legacy (Naga, Kuki,Lushai of any other),prior to their conversion to Islam.”৩৫৭ এই সব তথ্যই আরো বহু বিস্তৃত রিচার্ড ঈটনে।পীর-ফকিরদের নেতৃত্বে স্থায়ী কৃষির বিস্তার,সেই সুবাদে স্বাভাবিকভাবেই কৃষকরা পীর-ফকিরদের সাংস্কৃতিকভাবে অনুগমন করছেন ধর্মান্তরিত হচ্ছেন,সেই সঙ্গে হচ্ছেন ভাষান্তরিত।জনজাতীয় সমাজ থেকে একটি বৃহত্তর জাতিগঠনের প্রক্রিয়াতে প্রবেশ করছেন।এবং সারা ভারত ছেড়ে এসে মুসলমান শাসকদের সাম্রাজ্যের একেবারে প্রত্যন্ত দুর্বল পূর্ব প্রান্তেই যে এত বেশি মুসলমান জনতার দেখা মেলে তার প্রধান কারণই তিনি এইভাবে ব্যাখ্যা করেন। সেসব শুরু হয় তো হয়েছে শাহজালালেরও আগে শেখ জলাল উদ্দিন তাবরিজি বা সুলতান বায়াজিদ বাস্তামীদের সময়ে, যার কথা অধ্যাপক আবদুল মুসাব্বির ভূঞাও৩৫৮ উল্লেখ করেছেন--তাদের দ্বারা,কিন্তু মোগলদের আগে তত ব্যাপক সংখ্যাতে এসব ঘটেনি বলে লিখছেন রিচার্ড ঈটন,“So far as concerns the countryside,it is only from the late sixteenth century,and in particular after the Mughal conquest (1574),that we have solid evidence of a Muslim peasnat population anywhere in Bengal.৩৫৯ অথচ এমনও নয় যে মোগলরা ধর্মান্তরণে খুব উৎসাহ দেখিয়েছিলেন,দিল্লিতে কিছু উলেমারা সম্রাটের কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিলেও ঔরঙ্গজেবের আমলেও সেসব ঘটেনি।তাঁদের মূল আগ্রহ ছিল অনাবাদী জমিতে কৃষির বিস্তার ঘটানো।আর সেই প্রক্রিয়াতেই যা নিয়ে তারা উদাসীন ছিলেন,তাই ঘটে গেল। একে বলা যেতে পারে ঘটনার বৈপরীত্য বা দ্বন্দ্ব।ঈটনের ভাষাতে ‘paradox’,তিনি লিখছেন,“If large numbers of rural Muslims were not observed until as late as the end of the sixteenth century or afterward,we face a paradox--namely,that mass Islamization occurred under a regime,the Mughals,that as a matter of policy showed no interest in proselytizing on behalf of the Islamic faith.Ruling over vast empire upon a bottom-heavy agrarian base,Mughal officials were primarily interested in enhancing agricultural productivity by extracting as much of the surplus wealth of the land as that could,and in using that wealth to the political end of creating loyal clients at every level of administration.Although there were always conservative ulamā who insited on the emperorsduty to convert the Hindu infedels to Islam,such a policy was not in fact implemented in Bengla,even during the reign of the conservative emperor Aurangzeb (1658-1707)৩৬০ এর পরে তিনি এই দ্বন্দ্বের বিস্তৃত ব্যাখ্যা করে গেছেনমাঝে কিছু দিন আফগান শাসনের ইতিবৃত্তও লিখে গেছেন।এক দিকে হুসেন শাহের সঙ্গে আফগানদের মিত্রতা,আর দিকে মাড়োয়াড়ি বণিকদের মোগলদের সহায়ক হিসেবে বাংলাতে প্রথম প্রবেশের৩৬১ ইতিবৃত্তও ব্যাখ্যা করে গেছেন।আমাদের সুযোগ নেই,সেসবের গভীরে যাবার।শুধু বলবার কথাটি এই যে শিবপ্রসন্ন লাহিড়ি কিংবা আবদুল মুসাব্বির ভূঞা যারাই সিলেটি নাগরীকে শাহজালাল বা তাঁরও আগে নিয়ে যাবার কথা লিখেছেন,তারা লিপিটির সাহিত্যিক ব্যবহারের জন্যে,বিশেষ করে পুথি পাঠের স্রোতা হবার জন্যে যে বিশাল বাঙালি জনতার দরকার তাদের উদ্ভবের ইতিবৃত্তের দিকে ফিরে তাকান নি।

ঈটন লিখছেন,“It would be wrong,however,to explain religious change here and elsewhere as simply a cultural dimension of political or economic change,or to understand Islam itself as a timeless and fixed system of beliefs and rituals that the people of the delta passively accepted.For in the midst of the dramatic socioeconomic changes taking place in premodern Bengal, Islam creatively evolved into an ideology of world-construction---an ideology of forest-clearing and agrarian expansion,serving not only to legitimize but to structure the very socioeconomic changes taking place on the frontier.On the one hand,Islamic institution proved sufficiently flexible to accommodate the non-Brahmanized religious culture of premodern Bengal.On the other,the religious traditions already present in eastern Bengal made accommodations with the amalgam of rites, rituals, and beliefs that were associated with the village mosques and shrines then proliferating in their midst.In the process,Islamic and Bengali worldviews and cosmologies became fused in dynamic and creative ways,a topic to which we now turn.৩৬২ ইসলাম একটি ‘timeless and fixed system’ –এটি আমাদের আধুনিক সংস্কার বললেই চলে।যার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেইতিনি এর পরে ষোড়শ শতক থেকে বাংলাদেশে ইসলাম এবং বাঙালি সমাজ নির্মাণের বিভিন্ন স্তরভেদ ধরে ‘dynamic and creative ways’ ব্যাখ্যা করে গেছেন। সেই সঙ্গে তখন থেকে রচিত বিভিন্ন মঙ্গল কাব্যে,আখ্যান কাব্যে ও গানে সেই সব ইতিবৃত্ত কীভাবে ধরা পড়েছে তারও বিস্তৃত নজির দিয়ে গেছেন।আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন।এই কথাগুলোই নিজের ভাষাতে উল্লেখ করে অনুরাধা চন্দ লিখেছেন,“One creative and innovative expression of this cultural process can be seen in the rise an indigenous script which originated in this region and developed as an alternative script of the Bengali language.”৩৬৩যদিও তিনি পরমুহূর্তেই লিখেছেন,“It is difficult  to fix a date for the emergence of the date...৩৬৪ একে শুধু এই অর্থেই পড়া উচিত যে এই ষোড়শ বা সপ্তদশ শতকের কোনো তারিখ বা বছর নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল,যা কিনা প্রাক_ঔপনিবেশিক যে কোনো ভাষা-লিপি এবং সাহিত্য সম্পর্কে একটি সাধারণ সত্য কথা।তাঁর এই মন্তব্য ধরে ষোড়শ শতকের পেছনে পিছিয়ে যাবার অন্য কোনো ঐতিহাসিক,এমন কি ভাষাবৈজ্ঞানিকও যুক্তি নেই।অধ্যাপক আবদুল মুসাব্বির ভূঞা এক জায়গাতে লিখেছেন,“Bengali characters prevalent throughout Bengal became current in Sylhet along with Sylot Nagari.Consequently several characters of Sylot Nagari were conspicuously influenced by them.”৩৬৫ এই কথাগুলো বেশ বাঁকানো।একে যদি এই ভাবে কেউ পড়েন,যে বাকি বাংলাতে বাংলা লিপি ছিলই, সেই লিপি সিলেটেও পরে এল এবং সিলেটি নাগরীকেও প্রভাবিত করল,দুয়ে মিলে পাশাপাশি ব্যবহৃত হতে থাকল ---তবে সেই পড়া ঠিক হবে না।নিধনপুর লিপি এবং তাতে ব্যবহৃত প্রত্ম-বাংলা তথা ‘কুটিল কামরূপী’ লিপিটির কথা মনে রাখলে,বাংলা লিপি সিলেটে পরে এল বলে ভাববার কোনো সুযোগই থাকে না।আর দ্বাদশ শতক থেকে দেখা দেয়া প্রাগাধুনিক বাংলা লিপির প্রভাব যদি সিলেটি নাগরীতে পড়েছে,তবে নাগরী লিপি প্রাচীন মোটেও নয়,অর্বাচীন লিপি।

হজরত শাহজালাল আসবার সময়কার তিনটি পদ ‘সেকসুভোদয়া’তে রয়েছে।সুকুমার সেন সেগুলোও পঞ্চদশ ষোড়শ শতকে রচিত বলে অনুমান করেন।৩৬৬তিনি সেগুলো পুরোটাই তুলে দিয়েছেন।প্রথম এবং তৃতীয় আকারে ছোট। আমাদেরও তুলে দিতে অসুবিধে নেই।প্রথমটি এই,“মকদম সেক শাহ জলাল তবরেজ তব পাদে করোঁ পরণাম/চৌদীশ মধ্যে জানিবে যাঁহার নাম।/বারেক রক্ষা কর মোর ধন প্রাণ/দেশে গেলে দিব তোমার নামে অর্ধেক দান।”৩৬৭তৃতীয়টিতে হজরত শাহজালাল কিংবা জলাল তবরেজ কিংবা সেরকম পীর ফকিরদের  ‘কৃষিবিপ্লবী’ ছবিটি স্পষ্ট,“বনের শাক খায় সেক বনের গোনা/ঝিকরির পোটলি বান্ধিয়া দেয় সেক/হাটে বিকাইলে হয় সোনা।”৩৬৮দ্বিতীয়টির প্রথম চরণটি এরকম,“মধ্যে আছে পীরের মোকাম তস্যপরি বিদ্যতে প্রধান-পুরুষের স্থান/তৃতীয়াঞ্জলী তাহার নামে দান।...” এই পদগুলোর লেখক হিন্দু বা মুসলমান যে কেউ হতে পারেন।কিন্তু যেটি লক্ষ করবার মতো,সে হল আরবি ফার্সি শব্দ এই নামগুলো ছাড়া একটিও নেই। সেরকমই ছিল না আরাকান রাজসভার কাব্যে।অথচ কাব্যের বিষয়গুলো গিয়েছিল সিলেট হয়েইসেসব নিশ্চয় এক দিনে বা মাসে সরাসরি যায় নি। পুরো যাত্রা পথের বিবরণ সুকুমার সেন দিয়েছেন এই ভাবে,“রোমাণ্টিক কাব্যকাহিনীর ধারা গৌড় হইতে সিলেট সিলেট-কামতা হইয়া(?) চাটিগাঁ-আরাকানে পৌঁছায় যোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতে। সেখানে হইতে যায় উত্তর বঙ্গে অষ্টাদশ শতাব্দীতে।তাহার পরে আসে দক্ষিণরাঢ়ে।অবশেষে ঢাকায়, ফরিদপুরে ও কলিকাতায়—ঊনবিংশ শতাব্দীতে।”৩৬৯কিন্তু গৌড়ই এর আদি উৎস নয়। সে এসেছে অযোধ্যা থেকে মিথিলা হয়েসুকুমার সেন যেখানে সিলেটি নাগরী নিয়ে লিখছেন,তার শুরুর কথাগুলো গুরুত্বপূর্ণ,“পশ্চিম হইতে অবধি ভাষায় আখ্যায়িকা সিলেটবাসী মুসলমানদের দ্বারাই আরাকানে নীত হইয়াছিল বলিয়া মনে করিপাঠান আমলে সিলেট সুলতানদের অধিকারে স্থায়ী সীমান্ত-ঘাঁটি ছিল বলিয়া বোধ হয়সিলেটের পূর্বে ও দক্ষিণ-পূর্বে সুলতানদের অধিকার বিস্তৃত হইলে পর তবেই সেখানে স্থানে স্থানে বাঙ্গালী মুসলমানদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার উপযুক্ত আবহাওয়া সৃষ্টি হইয়াছিল।আরাকানের চাটিগাঁয়ে বাঙ্গালী মুসলমানের প্রভাব লুপ্ত হইবার পরেও সিলেট বরাবর---ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত---ইসলামি সাহিত্যের প্রধান কেন্দ্র রহিয়া যায়।পশ্চিমা মুসলমানদের সঙ্গে যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ থাকার ফলে সিলেটের মুসলমানদের মধ্যে একটি বিশেষ ধরনের লিপিমালা প্রচলিত হয়।”৩৭০এই যে সুকুমার সেন ‘উপযুক্ত আবহাওয়া’ সৃষ্টির কথাটি লিখেছেন রিচার্ড ঈটন তারই ইতিহাস ব্যাখ্যা করেছেন। সুতরাং তাঁর তত্ত্বটি পশ্চিমা পণ্ডিতের কল্পনা বলে খারিজ করবার উপায় নেই।এই কথাগুলো মনে না রেখে সিলেটি নাগরী সাহিত্যের উৎস সন্ধান করে লাভ নেই।সিলেটি নাগরী সাহিত্যে আরবি ফার্সি শব্দমালার প্রাচুর্য।এমন কি হিন্দি শব্দেরও। সেগুলো তবে কখন আসছে বাংলা ভাষায়? অনেকেই লিখেছেন সিলেটি নাগরী সাহিত্য সম্পর্কে,তাদের মধ্যে অধ্যাপক গোলাম কাদিরও রয়েছেন। সপ্তদশ শতক থেকে শুরু,আঠারো,উনিশে ব্যাপকতা বৃদ্ধির কথা।৩৭১সুকুমার সেন লিখছেন,সারা বাংলা ভাষার সম্পর্কে একই কথা,কিন্তু তার আগেরও একটি পর্বের  শেষের কথা তিনি লিখছেন,“সপ্তদশ শতাব্দী শেষ হইবার আগেই আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা সংস্কৃতির আদর চলিয়া যায়।তাহার কারণ তিনটি: পোর্তুগিজ জলদস্যুর অত্যাচার,আরাকান রাজ্যে বিশৃঙ্খলতা এবং তাহার ফলে বাঙ্গালীর প্রভাব-হ্রাস। তবে চাটিগাঁয়ে শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে সাহিত্য চর্চা লুপ্ত হয় নাই,এবং সিলেটে সাহিত্য ও সংস্কৃতি মুসলমান সমাজে খানিকটা নিজস্ব পথে পরিচালিত হইয়াছিল।উত্তর ও উত্তর বঙ্গেও মুসলমান লেখকের আবির্ভাব হইয়াছিল।”৩৭২‘খানিকটা নিজস্ব পথ’ মানে ঐ সিলেটি নাগরীর পথ।এর পরে তিনি লিখছেন,“অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাঙ্গালাদেশে স্বাধীন নবাবি আমলেরও পূর্বে বাঙ্গালী মুসলমান জনসাধারণের মধ্যে ধীরে ধীরে বাঙ্গালা শিক্ষার প্রসার হইতে থাকে।এবং সেই সূত্রে মুসলমান লেখকেরাও অল্পস্বল্প উৎসাহিত হইতে থাকেন। সে সময়ে বাঙ্গালা ভাষায় আরবী-ফারসী শব্দের প্রবেশ প্রায় অবারিত ছিল।অতএব মুসলমান লেখকদের রচনায় এমন শব্দের পরিমাণ স্বভাবতই সমধিক হইবে।শুধু ধর্ম সংক্রান্ত ব্যাপারে নয় ঘর সংসারের কাজে এবং সমাজের ব্যবহারে বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে অনেক বিশেষ বিশেষ আরবী-ফারসী শব্দ চলিত ছিল (এবং এখনো আছে)সেই সব শব্দ মুসলমান লেখকেরা পরিহার করিতেন না।তাহার উপর হিন্দুস্তানীভাষা ও বাঙ্গালাভাষী মুসলমানের সামাজিক ও গার্হস্থ্য মিলনে কোন রকম জাতিপাঁতির দুস্তর বাধা ছিল নাসম্ভ্রান্ত মুসলমানেরা অনেকে হিন্দুস্তানীকে দ্বিতীয় ভাষারূপে ব্যবহার করিতেন।এই কারণে মুসলমান লেখকদের ভাষা সাধারণ সাধুভাষা হইতে একটু স্বতন্ত্র হইয়া পড়িয়াছিল,কিন্তু তবুও তাঁহাদের ভাষাকে ইসলামি বাঙ্গালা বলিতে পারি না।ইংরেজ আমলের শুরু হইতে কলিকাতার মজদুর মুসলমানদের ব্যবহার্য গ্রন্থে যখন আরবী –ফারসীর সঙ্গে বাঙ্গালার ও হিন্দীর মিশ্রণ খুব ঘন ঘন হইয়াছিল তখনকার সেই গ্রন্থ-ভাষাই যথার্থ‘এছলামী বাঙ্গালা’৩৭৩এই যে আরবি-ফারসি বহুল বাংলার স্তরভেদের কথা সুকুমার লিখলেন,সিলেটি নাগরী লিপি সাহিত্যেরও ক্রমঅনুসরণ করে অধ্যয়ন করলে সেই স্তরভেদ সেখানেও দেখা যাবে বলেই আমাদের মনে হয়। অন্তত ‘এছলামী বাঙ্গালা’ তো অবশ্যইএই অব্দি যত পুথি পাওয়া গেছে,সবগুলো যদি দুই মলাটে একত্রে মেলে তবেই এধরণের অধ্যয়ন সহজ হবে।‘দইখুরার রাগ’ এবং তাঁর সংশোধক মুহম্মদ আব্দুল লতিফের পদের মধ্যেও এই  স্তরভেদ সূক্ষ্ম হলেও নজরে আসে।‘এছলামী বাঙ্গালা’-তে লেখা আঠারো শতকের একেবারে শেষের দিকের একটি স্তবক এরকম,“ত্রিপদী করিয়া ছন্দ করিয়া তারিখবন্দ/লেখা গেল তেইশে আশ্বিনে/বার শ চারি সালে জোম্মার নামাজ কালে/বাকি সে মাসের সাত দিনে/ভুরশুট পরগণা বিচে উদনা বাগের নিচে/বসবাস কদিমি মোকাম/আব্দুল কাদের দাদা তার বড়া দেল শাদা বাপ মেরা হেদাতুল্লা নাম”৩৭৪এর সঙ্গে এইবারে মুহম্মদ আব্দুল লতিফের পদ মনে করা যাক। কিংবা উনিশ শতকের জেলা করিমগঞ্জের ‘হিলচার’ গ্রামের কবি শীতলাং শাহের এরকম স্তবক পড়া যাক,“শাহ আবদুল আলি মোর পির দস্তগির/হাশিল মুরাদ ওলি বাতিনে জাহির।/মুরশিদ কামিল মোর শাহ আবদুল ওহাব।/তিনির পরশাদে হৈল ধিআনেতে লাভ।”৩৭৫ অথবা পড়া যেতে পারে শিতালাং শাহের এই পদ,“জালাই মমের বাতি পুশাইলাম সারা রাতি গ/ফুল বিছানাএ আতর ছিটাই ইনতেজার বেদনি।।/হরেক রংএ জনতর বাজে হরেক কুঠাএ গুপি শাজে গ/খালি গিরদক কুলে লইয়া পুশাইলাম রজনি।।/বুকেতে ধুকধুকি করে রহিতে না পারি ঘরে গ/কেউয়ের ঠাইন কইতে নারি শাম কালিয়ার কাহিনি।।/মাছ কাটিতে হাত কাটি ওন্ন খাইতে বরতন চাটি গ/আন্দার মানিক চিনে কথাএ ঘুরে শএতানি।৩৭৬

সিলেটি নাগরী নিয়ে অন্যতম লেখক অধ্যাপক গোলাম কাদির।কিন্তু তাঁকে সরাসরি পড়তে পারবার সুযোগ আমাদের হয় নি।তিনি সেই সব তাত্ত্বিকদের অন্যতম যারা মনে করেন,সপ্তদশ শতকের আগে এই লিপি দেখা দেয় নি।সম্ভবত তিনি উনিশ শতকে ছাপাযন্ত্রে আসবার আগে এবং সমকালের জনপ্রিয়তার কারণগুলোও স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা করেছিলেন।আমরা আমাদের বোধটি সংক্ষেপে উপস্থিত করছি।আফগান-মোগল,রাষ্ট্র–কৃষক প্রজা,সুফী-বৈষ্ণব,যোগ-তন্ত্র এইসব বৈপরীত্য আদির সঙ্গে মারিফতি শরিয়তি পথের বিরোধ এবং ঐক্যেরও৩৭৭যে একটি ভূমিকা ছিল সেসব অনুরাধা চন্দ এবং অন্যেরা  দেখিয়েছেনসেই সঙ্গে আসরাফ–আতরাফ দ্বন্দ্বও সম্ভবত শুরু থেকেই কাজ করছিল।ইসলাম এল, আর সব সামাজিক বৈষম্যের থেকে মানুষকে মুক্ত করে দিল---এরকমটি বাস্তবে ঘটে নি।বাস্তবে ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদ ইসলামেও অনুপ্রবেশ করেছিল।আর একটি নতুন কৃষিব্যবস্থা এমনিতেও নিজেই একটি নতুন শ্রেণিব্যবস্থাও।আমরা ‘আধুনিক’(?) মন নিয়ে বহুসময় আতরাফদের সহিত্যে আরবি-ফারসি-উর্দু-তথা হিন্দুস্তানী শব্দ মিশেল,ভারত চন্দ্রের কথায় ‘যাবনী মিশাল’,বাংলার সমালোচনা করতে পারিকিন্তু এই কথা ভুললে চলবে না যে আশরাফদের অনেকে উত্তরভারতীয় আর্যভাষা উর্দু-তথা হিন্দুস্তানীকেই নিজেদের মাতৃভাষাই মনে করতেন,এ অনেকটা ব্রাহ্মণ-কায়স্থদের সংস্কৃতকে নিজেদের মাতৃভাষা মনে করবার মতো বিষয়।তার উপরে উনিশ শতকে ফারসি রাজভাষা হিসেবে বিদেয় নিল,কিন্তু যে বাংলা ভাষা এল তাকে সংস্কৃতের মোড়ক আরো বেশি করে পরানো হলযে বর্ণহিন্দু বাঙালিরা এই কাজটি করলেন,আতরাফদের অধিকাংশ তাদেরও প্রজাই ছিলেন।স্বাভাবিক ভাবেই এককালে আশরাফদের তরফে যে প্রচার ছিল বাংলা হচ্ছে হিন্দুয়ানী ভাষা সেই প্রচারটির বিরোধিতা করবার জমি বেশ দুর্বল হয়ে গেল। সে সময়ে যদি বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিকতার থেকে দূরের মানুষ জন,যারা খুব জরুরি নয় যে সমাজের নির্ধন,এবং শিক্ষাবিহীন হবেন,‘এছলামী বাঙ্গালা’ বা ‘দোভাষী সাহিত্য’ বা ‘সিলেটি নাগরী’ লিপিকে বেছে নিয়েছিলেন তবে সেটি বহুমুখী অভ্যন্তরীণ একটি সংগ্রামের পরিণতিতেই সম্ভব হয়েছিল। হতে পারে,তারও অনেকটাই গোলাম কাদিরের ভাষাতেও ‘প্রতিক্রিয়াশীল’৩৭৮, কিন্তু সেসবও উনিশ,আরো সঠিক হবে যদি বলি বিশ শতকের কথা।যখন সিলেটি নাগরী লিপির উদ্ভবের দিনের আর্থসামাজিক বাস্তবতাও পালটে গেছে বা যাচ্ছে। বেশিটাই তার ওঠে আসা বাঙালি সমাজের ‘লোকধর্ম’-এর প্রগতিশীলতা,এই আমাদের অভিমত।এইটুকুন গৌরব সিলেটি নাগরীর অবশ্যই প্রাপ্য। সেই সব অভ্যন্তরীণ বিরোধগুলো যখন একটি সমাধানের দিকে এগুলো তখন ঠিক এই লিপি এবং সাহিত্য ছাপাযন্ত্রেও আর নিজেকে টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলঅন্যথা,পাঞ্জাবি ভাষার তিন লিপির মতো বাংলারও দুটো তো কমেও লিপি থাকতএর থেকে বাংলা রক্ষা পেয়ে গেছে বলে ইতিহাসকে আমরা ধন্যবাদ দিতেই পারি।শুধু তো সিলেট নয় ময়মন সিংহ থেকে চট্টগ্রাম অব্দি সিলেটি নাগরীর অনুরাগী ছিলেন এই কথা আমাদের মনে রাখা ভালো। 

‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে’র প্রয়াসগুলোর পরে এমনিতেও বাংলা ভাষার সংস্কৃতের মোড়ক খসানো হচ্ছিলযদিবা কিছু অবশিষ্ট ছিল,পাকিস্তান হবার পরে পুব বাংলাতে সেই ভয় আর কিছু রইল না।সিলেটের অসম অংশ,তো তখন এমনিতেই সামগ্রিক ভাবে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়ে গেল।তখন বিরোধ সামনে এল উর্দুর সঙ্গে।এই সংঘাত খুব তাৎক্ষণিক নয়।ভারতে ইসলামের বিস্তার এবং মুসলমান জনতার সম্প্রসারণের দিন থেকে যে বিরোধ চাপা ছিল,ব্রিটিশ ভারতের রাজনীতিতেও যে বিরোধ প্রায়শই মাথা তুলছিল,কিন্তু হিন্দু-মুসলমান বিরোধের প্রচারের তলাতে চাপা ছিল,সেই বিরোধ এবারে সামনে এল পাকিস্তানের রাজভাষা কী হবে সেই প্রশ্নে।বাকিটা সাদিয়া চৌধুরী পরাগের সহজ কলমে সরাসরিই পড়া যাক,এমনতরো অন্য অনেকেও লিখেছেন,“বস্তুত তৎকালীন পূর্ব-বাংলার জনগণ পাকিস্তানের সঙ্গে পতাকার নীচে আসে এবং নব-গঠিত রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হওয়ার অল্পদিনের মধ্যে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণগুলো স্পষ্টই অনুধাবন করে তারা ভাষা আন্দোলন সহ অন্যান্য ন্যায়নীতি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।এ সকল বৃহত্তর স্বার্থরক্ষার দায়িত্বে ও জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দাবিতে অন্যান্য বিষয়গুলো স্তিমিত হতে থাকে।১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এই চব্বিশ বৎসরের সংগ্রামে লিপ্ত দেশবাসীর এক অংশ সিলেটি জনগণ,জনপ্রিয় সিলেট নাগরী লিপি প্রচার ও প্রকাশে আর এগিয়ে আসতে পারেনি।তাছাড়া ঐ সময়ে জমিদারি প্রথা অবলুপ্তিকরণ,প্রজাস্বত্ব আইন প্রতিষ্ঠা,শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা,নারীদের শিক্ষাঙ্গনে নিয়ে আসা ইত্যাদি কারণগুলোও সিলেট নাগরী লিপিকে স্তিমিত করে দেওয়ার কারণ স্বরূপ মনে করা হয়।”৩৭৯

স্বাধীন বাংলাদেশে কিংবা অসমে ১৯৭১এর পরে বহুদিন আর সিলেটি নাগরী বই পত্র ছাপাবার কথা শোনা যায় নিকিন্তু অতি সম্প্রতি যে বিলেতের লন্ডন এবং আরো কিছু পশ্চিমা দেশের সিলেটিদের উদ্যোগে শুধু লিপি নয়, ভাষাবৈচিত্র্যটিকেই স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে দাঁড় করাবার প্রয়াস শুরু হয়েছে,প্রাথমিক স্কুলে পড়ানো হচ্ছে সেসব আমরা ষষ্ঠ অধ্যায়ে লিখে এসেছিSylheti Translation And Research’ (STAR)-এর উদ্যোগে ইউনিকোডে এসেছে,এই কথা এই অধ্যায়েও উল্লেখ করেছি।ইউনিকোডে আসাটি খুবই স্বাভাবিক ছিল।কম্প্যুটারে আন্তর্জালে নাগরী পুথি পড়তে পারা,শুধু লিপিটির জন্যেই নয় সামগ্রিক ভাবে বাংলা ভাষা -সাহিত্য-সমাজ-ইতিহাস অধ্যয়নের স্বার্থেই জরুরি। ইউনিকোড এমন বহু অপ্রচলিত ভাষার লিপকেই প্রচলনে এনেছে। খুব ভালো রকম করে যে আসেনি এখনো সেটিই

বরং আমাদের উদ্বেগের বিষয় হওয়া উচিত। এবং নিজেরাও সেই সক্রিয়তাতে অংশ নেয়া উচিত। স্টারের ওয়েব সাইটে যেসব তথ্য পাচ্ছি,৩৮০তাতে জানা যাচ্ছে বাংলাদেশী সাংবাদিক মতিয়ার চৌধুরী,ব্রিটিশ ভাষাবিদ জেমস এবং  সু লয়েড উইলিয়ামস (James and Sue Lloyd-Williams) নব্বুই দশক থেকে এই উদ্যোগ শুরু করেন। জেমস বাংলাদেশে এসেও বেশ কিছু পুথি সংগ্রহ করে নিয়ে যান,বিলেতেও কিছু হাতে পান ১৯৯৭ তে সু প্রথম একটি সিলেটি নাগরী ফন্ট তৈরি করলে,তখন সেটি অসমে বাংলাদেশে এবং বিলেতের সংবাদ মাধ্যমগুলোকে বড় করে সংবাদের বিষয় হয়। দুজনেই বেশ ভালো সিলেটি বলতেও পারেন, আমরা ভিডিও শুনেছি। ২০০২ থেকে ৮ অব্দি ডেভিড কানে বলে এক গবেষক ছাত্রকেও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে “Puthi-Poṛa: Melodic Reading and its Use in the Islamisation of Bengal (2008)” শীর্ষক গবেষণাতে ‘স্টার’ নানা ভাবে সহায়তা করে। আর ২০১৬-তে যে মে মাসে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আন্তর্জাতিক ভাষাবিজ্ঞানীদের আলোচনাচক্র  এই নিয়ে হয়ে গেল সেই তথ্য আমরা উল্লেখ করেছি। আন্তর্জাল যোগাযোগ সহজ হবার জন্যে এই সব প্রবাসী বাংলাদেশীদের এমনিতেই দেশে যাতায়াত লেগেই থাকে। তদুপরি আন্তর্জালের সুবাদে বাকি বিশ্বেও এই সব উদ্যোগের সংবাদ আদান প্রদান এখন খুবই সহজ। বাংলাদেশে তাই ৭ মে ২০১৫তে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের অধিবক্তা ড মুমিনুল হকের নেতৃত্বে ‘নাগরী বর্ণে সিলেটি ভাষা স্বীকৃতি পরিষদ’ গড়ে উঠে।তিনি লন্ডনে পিএচডি করেছেন।পড়েছেন আইন এবং অর্থনীতিকিন্তু নামের আগে ‘ইতিহাসবিদ’ এবং নামের পরে একগুচ্ছ উপাধির উল্লেখ দেখে খুব একটা শ্রদ্ধা জাগে না। লেখা পড়েও মনে হয় না ভাষাবিজ্ঞানে খুব দখল আছে বলে।তাঁদের ওয়েব সাইটও রয়েছে এই ঠিকানাতে--http://sylheti.netএই দুই সংস্থাই ইতিমধ্যে বেশ কিছু বই পত্র আবার ছেপেও বের করেছেন।তার মধ্যে সিলেটি কোরান,রামায়ণ সবই আছে। যদিও অন্যান্য প্রকাশনা সংস্থাও ইতিমধ্যে আবার সজীব হয়ে উঠেছেন। সেরকমই বেশ কিছু বই বের করেছেন ঢাকার উৎস প্রকাশনের সেলিম মুস্তফা।২০০৯এ প্রকাশিত ‘চন্দরমুখি’র প্রচ্ছদ এবং ভেতরের পাতার একটি  ছবি রইল চিত্র ৩৯-ক এবং খ-তে।৩৮১ বাংলাদেশের সংস্থাটি ‘সিলেটি খবর’ নামে একটি কাগজও বের করেছেন।তাঁদের প্রকাশিত বর্ণপরিচয় বইও আমাদের হাতে পড়েছে২০১৬তে জেমস এবং  সু লয়েড উইলিয়ামস দম্পতি অসম,বিশেষ করে বরাক উপত্যকা ঘুরে গেছেন,ক্ষেত্র সমীক্ষা করতে।সম্ভবত ডেভিডও এসেছিলেন,না এলেও যোগাযোগ তো করেইছেন। যাদের সঙ্গে দেখা করেছেন,কথা বলেছেন সেসব তথ্যও আমাদের সংগ্রহে রয়েছে।ভবিষ্যৎ অধ্যয়নে কাজে আসতে পারে,এখনি সেসব উল্লেখ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়এর পরে থেকেই ‘সিলেটি ভাষা’ দাবি বিতর্ক খুব ছোট করে হলেও সামাজিক মাধ্যম এবং সংবাদ মাধ্যমে আসতে শুরু করেছেঅনেকে এর মধ্যে ‘আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র’ ইত্যাদি দেখতে শুরু করেছেন।আমাদের সেরকম কিছু মনে হয় নি।বাংলাদেশেও যে নতুন করে নাগরী লিপিতে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিটি খুব একটি জনপ্রিয়তা পাবে,আমাদের মনে হয় না। ভাষাবৈচিত্র্যটিকে যদি স্বতন্ত্র ভাষাও বলি,তার একমাত্র লিপি মোটেও সিলেটি নাগরী লিপি ছিল না,প্রাচীন লিপি তো ছিলই না। সুতরাং তাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি খুবই দুর্বল। জেমসরা দেখা করেছিলেন,এমন বদরপুরের এক শিক্ষক মহম্মদ শাহাজাহানের সঙ্গে আমরা আন্তর্জালে বাক বিনিময় করেছিলাম।তিনি প্রচুর পুথির সংবাদ নিজেও রাখেন।তিনি যা লিখেছেন,আমাদের মতেও এটাই সত্য,“জেমস উইলিয়ামস বা সু উইলিয়ামস দম্পতি---আসলে সিলেটি ভাষা নিয়ে তাদের বিশেষ কোনো অবদান নেই,তারা শুধু নাগরী লিপি নিয়ে কিছু কাজ করেছেন।সিলেটি ট্রেন্সলেশন এবং রিসার্চের হয়ে এরা কিছু অনুবাদ করে বই ছেপেছেন। আসলে সত্য হলো সিলেটি ভাষা এবং সাহিত্য নিয়ে কাজ খুবই কম হয়েছে।ঢাকার মুস্তফা সেলিম কিছু পুথি সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছেন, এটি এক বড় কাজ” সিলেটি নাগরীর সাম্প্রতিক এই পুনরুত্থান এবং ‘সিলেটি ভাষা’র স্বাতন্ত্র্যের দাবিটি ভালো বুঝতে হলে বিলেত প্রবাসী সিলেটিদের ইতিহাস এবং সমাজবাস্তবতা অধ্যয়ন করা ভালো।বিলেতে ঝড় উঠেছে বলেই বাংলাদেশ- আসামে,কিছু তার ঢেউ এসে পৌঁছেছে।এটি একটি তৃতীয়-বিশ্ব মানসিকতার ঢেউ,এর বেশি কিছু নয় বলেই আমাদের আপাতত মনে হচ্ছে।নিছক ‘ষড়যন্ত্র’-তত্ত্ব নিজেদের ‘বদ্ধজলা’টিকে আরো সামান্য গভীর করতে পারে মাত্র নতুন কোনো চিন্তার বিকাশ ঘটাতে পারে না।আপাতত আমাদের লিখবার কথা এইটুকু।

 

 




।। উল্লেখপঞ্জি।।

            ১)   বাণীকান্ত কাকতি:অসমীয়ার সম্বন্ধশীলতা; পরিচয়করণ; অসমীয়া ভাষার গঠন আরু বিকাশ;

     বিশ্বেশ্বর হাজরিকার অনুবাদ; বাণীকান্ত কাকতি  জন্মশতবার্ষিকী উদ̖যাপন সমিতি,বরপেটা;

     অক্টোবর,১৯৯৬;পৃ: ০৭

২)  Suniti Kumar Chatterji: Bengali Orthography; Appendix E; Introduction;

     The Origin and Development of the Bengali Language; Rupa & Co,

     Kolkata;1993; pg.:228

৩)  প্রবোধচন্দ্র সেন:আমার কথা; বাংলা ছন্দশাস্ত্রের রূপকার প্রবোধচন্দ্র সেন;মুখ্য সম্পাদক ভবতোষ দত্ত;

     দে’জ পাবলিশিং;কলকাতা ৭৩;পৃ: 15

৪)  অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়:বাংলা ছন্দের মূল সূত্র;কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়;অষ্টম সংস্করণ;১৯৮৯;

     পৃ: ১০৫

৫)  পবিত্র সরকার: বাংলা ছন্দচিন্তা ও আচার্য প্রবোধ চন্দ্র;প্রবোধ চন্দ্র;বাংলা ছন্দশাস্ত্রের রূপকার

      প্রবোধচন্দ্র সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫২

৬)  মহেন্দ্র বরা:অসমীয়া ছন্দর শিল্পতত্ত্ব;ষ্টুডেন্টচ ষ্ট’রচ;গুয়াহাটি ০১;১৯৯৭

৭)  নলিনী সান্যাল:ভারতবর্ষে লিপিবিদ্যার বিকাশ; বাঙলা ভাষা, দ্বিতীয় খণ্ড;সম্পাদনা: হুমায়ুন আজাদ;

     আগামী প্রকাশনী,ঢাকা;২০০৯;পৃ: ৫৫১

৮ ) D. Neog: New Light on the Development of the Asamiya Script; উপেন্দ্রনাথ

     গোস্বামীর ব্যবহৃত অসমিয়া অনুবাদে উদ্ধৃতি:অসমীয়া লিপি;অসম প্রকাশন পরিষদ;গুয়াহাটি ২১;সপ্তম 

     সংস্করণ;জুলাই ২০০৮;পৃ: ৩৫

৯)  উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী:অসমীয়া লিপি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৬

১০) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৩

১১) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৬

১২) R.D.Banerji: The Final Development of the Alphabets; Chapter IV; The

      origin of the Bengali script;University of Calcutta;1919; pg.:  87.

১৩)  R.D.Banerji;ibid;pg.: 87.

১৪)  R.D.Banerji:The Northern Indian Alphabets (B.C. 350--A.D. 600);

       Chapter II;ibid;pg.: 23.

১৫)  R.D.Banerji: The Final Development of the Alphabets; Chapter

       IV;ibid;pg.:87.  

১৬)  The Coin Galleries: Assam; ttp://coinindia.com/galleries-assam.html

১৭)  R.D.Banerji ;ibid;pg.:93.

১৮)  R.D.Banerji:The Eastern Alphabet, 550-1100 A.D.; Chapter III; ibid;

       pg.:61.

১৯) তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতিটির উৎস স্পষ্ট নয়।সম্ভবত বিশ্বভারতী পত্রিকার,৩০ বর্ষ,৩য়-৪র্থ

      সংখ্যাতে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ শীর্ষক নিবন্ধের থেকে নেয়া।অণিমা মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘পুঁথির পাতার বর্ণ,শব্দ

      ও লিপি বৈচিত্র্য’ নিবন্ধে ব্যবহার করেছেন;অনুষ্টুপ;বিশেষ বাংলা পুঁথি সংখ্যা,প্রাক শারদীয় ১৪২২;

      সম্পাদক অনিল আচার্য;অতিথি  সম্পাদক অণিমা মুখোপাধ্যায়;কলকাতা;পৃ: ৪৬১

২০) R.D.Banerji: Introduction;ibid;pg.: 06.

২১) R.D.Banerji: The Final Development of the Alphabets;ibid;pg.:84.

২২) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৮

২৩) সুকুমার সেন:লিপির কথা;প্রথম অধ্যায়;ভাষার ইতিবৃত্ত;আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড,

      কলকাতা-৯;প্রথম আনন্দ  সংস্করণ,তৃতীয় মুদ্রণ,নভেম্বর,১৯৯৪;পৃ: ২৭

২৪) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭

২৫) সুকুমার সেন:বাংলা লিপির ইতিকথা;অনুষ্টুপ,বিশেষ বাংলা পুথি সংখ্যা,প্রাক শারদীয় ১৪২২;

       প্রাগুক্ত; পৃ: ৬৯০

২৬) সুকুমার সেন; প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৯০

২৭) R.D.Banerji:Introduction; ibid; pg.:1.

২৮) R.D.Banerji:The Northern Indian Alphabets (B.C. 350-A.D. 600);chapter

      II;ibid;pg.:7.

২৯) R.D.Banerji:The eastern alphabet ---550-1100 A.D;ibid; pg.: 42.

৩০) অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত;পূর্বাংশ;কথা;কলকাতা;২০১০;পৃ: ১২০

৩১) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 224.

৩২) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 224.

৩৩) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 224.

৩৪) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 224.

৩৫) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 225.

৩৬) আধা ঝা:মিথিলাক্ষর শিক্ষা: মৈথিলী অকাদেমী;পাটনা;তৃতীয় সংস্করণ,২০০৮;পৃ:

৩৭) Radhakrishna Choudhary: Evolution of Language and Script;A Survey of

      Maithili  Literature;Shruti Publications;New Delhi 08; First Shruti

      Publications edition2010; pg.: 23.

৩৮) Omniglot (The Online encyclopaedia of writing systems & languages);  

       http://www.omniglot.com/writing/kaithi.htm)

৩৯) ibid; .../devanagari.htm

৪০) ibid;... /maithili.htm

৪১) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 225.

৪২) ancientscripts.com; http://www.ancientscripts.com/kalinga.html

৪৩) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 225.

৪৪) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 226.

৪৫) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 226.

৪৬) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 228.

৪৭) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 226.

৪৮) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 226.

৪৯) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 227.

৫০) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 227.

৫১) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 227.

৫২) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 228.

৫৩) সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়:ভারতে এক লিপি প্রচলন কার্যত:কতদূর সম্ভব;অগ্রন্থিত সুনীতি কুমার;

      সম্পাদনা বারিদবরণ ঘোষ;দীপ প্রকাশন;কলকাতা ০৬;২০১১;পৃ: ১১০

৫৪) Keith Edward Cantú:Theurgy and the Snake:The Yoga Kalandar and

      Bengali Sufism; Lambert Academic Publishing;

      https://www.academia.edu/12325697/

      Theurgy_and_the_Snake_The_Yoga_Kalandar_and_Bengali_Sufism?

                 auto=download

৫৫) যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য:বাংলা পুথির লিপিকাল ও লিপিবৈচিত্র্য;বাংলা বিভাগীয় পত্রিকা,গৌহাটি

      বিশ্ববিদ্যালয়;২০০৪-৫;যতীন্দ্রমোহন  স্মরণসংখ্যা;সম্পাদক উষারঞ্জন ভট্টাচার্য,অমলেন্দু চক্রবর্তী,

      তড়িৎ কুমার চৌধুরী,সুভাষ দে,সঞ্জয়  ভট্টাচার্য,দীপক সেন,অমলকান্তি রাহা;পৃ: ১৪

৫৬) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 229.

৫৭) Richard M. Eton: Literacy and Islamization;The Rooting of Islam in

      Bengal;The Rise of Islam and the Bengal Frontier,1204-1760.Berkeley:

      University of California Press,

      c1993.http://ark.cdlib.org/ark:/13030/ft067n99v9/

৫৮) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 234.

৫৯) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 235.

৬০) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 235.

৬১) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 235.

৬২) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 235.

৬৩) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 234.

৬৪) যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য;প্রাগুক্ত;পৃ:১৩

৬৫) সৈয়দ মুহম্মদ শাহেদ:চর্যা ও নবচর্যার পুথি;অনুষ্টুপ;বিশেষ বাংলা পুঁথি সংখ্যা,প্রাক শারদীয় ১৪২২;

      প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫১

৬৬) সৈয়দ মুহম্মদ শাহেদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫১

৬৭) যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩

৬৮) যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য;প্রাগুক্ত; পৃ: ১৩

৬৯) নলিনী সান্যাল:ভারতবর্ষে লিপিবিদ্যার বিকাশ;বাঙলা ভাষা,দ্বিতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৬৪

৭০) নলিনী সান্যাল;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৬৪

৭১) নলিনী সান্যাল;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৬৫

৭২) নলিনী সান্যাল;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৬৫

৭৩) নলিনী সান্যাল;প্রাগুক্ত;পৃ:৫৬৬

৭৪) নলিনী সান্যাল;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৫০

৭৫) নলিনী সান্যাল;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৬৩

৭৬) নলিনী সান্যাল;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৪৪  

৭৭) সুকুমার সেন:লিপির কথা;প্রথম অধ্যায়;ভাষার ইতিবৃত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৫

৭৮) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৬

৭৯) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৬

৮০) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ:২৭

৮১) সুকুমার সেন;অনুষ্টুপ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৮৯

৮২) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৯০

৮৩) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৯০

৮৪) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৯০

৮৫) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ:৬৯১ 

৮৬) অণিমা মুখোপাধ্যায়:পুঁথির পাতার বর্ণ, শব্দ ও লিপি বৈচিত্র্য;অনুষ্টুপ;বিশেষ বাংলা পুঁথি সংখ্যা,প্রাক

       শারদীয় ১৪২২;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৬৯

৮৭) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৯০

৮৮) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৯০

৮৯) Devid Diringer:The Alphabet,Vol.I, London, Hutchinson & Co. (Pub.)

      Ltd., 1963, p.262; রামেশ্বর শ’-এর উদ্ধৃতি;ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের পদ্ধতি:লিপিবদ্ধ দলিল

      বিশ্লেষণ;সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও  বাংলা ভাষা;পুস্তক বিপণি,কলকাতা -৯;অখণ্ড দ্বিতীয় সংস্করণ,৩০শে

      শ্রাবণ,১৩৯৯;পৃ:  ৪৮১

৯০) নলিনী সান্যাল;প্রাগুক্ত;পৃ:  ৫৫০

৯১) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৮১

৯২) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৮২

৯৩) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৮২ 

৯৪) S.N. Chakraborty; Journal of the Royal Asicatic Society of Bengal, Vol.IV,

      1938, pp.351-91-এ প্রকাশিত নিবন্ধের  রামেশ্বর শ’য়ের বাংলা অনুবাদে ব্যবহৃত উদ্ধৃতি;

                 ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের পদ্ধতি: লিপিবদ্ধ দলিল বিশ্লেষণ; সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা;

                 প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৮২

৯৫) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৮১

৯৬) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৮৩

৯৭) অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ:৪৮৩

৯৮) সুকুমার সেন;ভাষার ইতিবৃত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪০

৯৯) জগন্নাথ চক্রবর্তী:বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান ও ভাষাতত্ত্ব;ভাষা-

      সংস্কৃতি আকাদেমি অসম,হাফলং;প্রথম প্রকাশ- বৈশাখ,১৪২২বঙ্গাব্দ;পৃ: ৫৭৩

১০০)সুকুমার সেন:চর্যাগীতি;চতুর্থ পরিচ্ছেদ;বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস;প্রথম খণ্ড;আনন্দ পাবলিশার্স

       প্রাইভেট লিমিটেড,কলকাতা ০৯;প্রথম আনন্দ সংস্করণ,দ্বিতীয় মুদ্রণ;১৯৯৩;পৃ: ৫৫

১০১) মৃণাল নাথ: চর্যাপদের ভাষা;চর্যাপদ ভাষা পাঠ রূপান্তর;এবং মুশায়েরা;কলকাতা ৭৩;এপ্রিল

        ২০১১;পৃ: ৩৯ এবং  ৪২ 

১০২) মৃণাল নাথ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০ 

১০৩) মৃণাল নাথ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০

১০৪) মৃণাল নাথ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৪

১০৫) সুকুমার সেন:নাট্যগীতি-পাঞ্চালী ও চণ্ডীদাস-রহস্য;অষ্টম পরিচ্ছেদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১২২

১০৬) সম্পদ কুমার ভট্টাচার্য:সত্যপীরের নতুন কাহিনিঃ আজদ্যার কেচ্ছা;অনুষ্টুপ;বিশেষ বাংলা পুথি সংখ্যা

        প্রাক শারদীয় ১৪২২;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪২৩

১০৭) হুমায়ুন আজাদ: অবতরণিকা: বাঙলা ভাষাতত্ত্ব [১৭৪৩-১৯৮৩] ;বাঙলা ভাষা,প্রথম খণ্ড;সম্পাদনা:

        হুমায়ুন আজাদ;আগামী প্রকাশনী, ঢাকা;২০০৯;পৃ: ৬২

১০৮) রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়:শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পুথির লিপিকাল;পরিশিষ্ট খ;ফিরে দেখা;অনুষ্টুপ;বিশেষ

        বাংলা পুথি সংখ্যা প্রাক শারদীয় ১৪২২;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৭৫

১০৯) রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৭৯   

১১০) কল্যাণ কিশোর চট্টোপাধ্যায়:বাংলা পুঁথির হস্তলিপি:উৎস ও বিবর্তন;অনুষ্টুপ;বিশেষ বাংলা পুঁথি সংখ্যা,

       প্রাক শারদীয় ১৪২২;প্রাগুক্ত;পৃ:৫১১

১১১) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৮৫

১১২) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৮৬

১১৩) সুকুমার সেন:বাংলা লিপির ইতিকথা;অনুষ্টুপ;বিশেষ বাংলা পুঁথি সংখ্যা,প্রাক শারদীয় ১৪২২;প্রাগুক্ত;

        পৃ: ৬৯১

১১৪) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৯১  

১১৫) ডি ডি কৌশাম্বী:পরিধি আরু পদ্ধতি;প্রথম অধ্যায়;ভারতর ইতিহাস;ড বীরেন্দ্রকুমার ভট্টাচার্যের

       অনুবাদ থেকে আমাদের বাংলা অনুবাদ;অসম প্রকাশন পরিষদ;গুয়াহাটি ২১;চতুর্থ প্রকাশ,ডিচেম্বর

       ২০০৬;পৃ: ০২

১১৬) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৮

১১৭) উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৯

১১৮) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:৪৮

১১৯) D.Neog;ibid; উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীর অসমিয়া অনুবাদে ব্যবহৃত উদ্ধৃতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৫

১২০) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫০

১২১) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫০

১২২) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫০

১২৩) সুকুমার সেন:পঞ্চদশ শতাব্দী;ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ;বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস;প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;

        পৃ: ৯২

১২৪) অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৫৫

১২৫) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ৯৩

১২৬) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ৯৩ 

১২৭) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫০

১২৮) উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫০

১২৯) বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: বাঙ্গালার ইতিহাসের ভগ্নাংশ;বিবিধ প্রবন্ধ;সম্পাদক ড ভবানী গোপাল

        সান্যাল;মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড;কলিকাতা ৭৩;তৃতীয় সংস্করণ ১৯৯০;পৃ: ১৬৭

১৩০) বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬৮

১৩১) নীহাররঞ্জন রায়:দেশ পরিচয়;বাঙ্গালীর ইতিহাস আদি পর্ব;দে’জ পাবলিশিং;কলকাতা ৭৩;প্রথম

       দে’জ সংস্করণ ১৪০০ বাংলা;পৃ: ৮৮

১৩২) নিহার-রঞ্জন রায়;প্রাগুক্ত; পৃ: ৮৮  

১৩৩) নিহার-রঞ্জন রায়;প্রাগুক্ত; পৃ: ৮৮

১৩৪) অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪০

১৩৫) অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি;প্রাগুক্ত;পৃ:১৪০ 

১৩৬) সুজিৎ চৌধুরী:রাজনৈতিক ইতিহাস ৪;দশম অধ্যায়;শ্রীহট্ট-কাছাড়ের প্রাচীন ইতিহাস;দিনকাল প্রেস

        লিমিটেড;শিলচর;তৃতীয় প্রকাশ (সংশোধিত নবপর্যায়);২০০৬;পৃ: ১১৩ 

১৩৭) সুজিৎ চৌধুরী:রাজনৈতিক ইতিহাস ২;অষ্টম অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ৭৭

১৩৮) সুজিৎ চৌধুরী:রাজনৈতিক ইতিহাস ১;সপ্তম অধ্যায়;প্রাগুক্ত; পৃ: ৭৪

১৩৯) সুজিৎ চৌধুরী:কিংবদন্তীর আলোকে ইতিহাস ২,ভুবন পাহাড়;তৃতীয় অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৭

১৪০) সুজিৎ চৌধুরী:আর্যব্রাহ্মণ্য প্রভাবের বিস্তার ও প্রতিষ্ঠা ২,নিধনপুর লিপি;পঞ্চম অধ্যায়;প্রাগুক্ত;

        পৃ: ৫৭

১৪১) সুজিৎ চৌধুরী:আর্যব্রাহ্মণ্য প্রভাবের বিস্তার ও প্রতিষ্ঠা ১,নিধনপুর তাম্রফলক;পঞ্চম অধ্যায়;প্রাগুক্ত;

       পৃ: ৫২

১৪২) সুজিৎ চৌধুরী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৩

১৪৩) সুজিৎ চৌধুরী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৩

১৪৪) সুজিৎ চৌধুরী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৩

১৪৫) শ্রীচন্দ্রকান্ত মহন্ত:অসমর চমু ইতিহাস;পাঠ্যপুথি প্রস্তুতি সমন্বয় সমিতি,ডিব্রুগড় বিশ্ববিদ্যালয়;

       ডিব্রুগড়;প্রথম সংস্করণ  ১৯৭২;পৃ: ৫৮

১৪৬) শ্রীচন্দ্রকান্ত মহন্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৮

১৪৭) সুজিৎ চৌধুরী;প্রাগুক্ত;পৃ:  ৫৪

১৪৮) সুজিৎ চৌধুরী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৪

১৪৯) শ্রীচন্দ্রকান্ত মহন্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৮

১৫০) D.C.Sircar:The Bhauma-Naraka or Varman Dynasty of Pushyavarman;

        Chapter Six;The Comprehensive History of Assam; Vol-I; Editor

        H.K.Barpujari;Publication Board of Assam;Guwahati 21; 1990; pg.:111.

১৫১) সুজিৎ চৌধুরী:রাজনৈতিক ইতিহাস ২;অষ্টম অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ৭৮

১৫২) সুজিৎ চৌধুরী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৭৮

১৫৩) সুজিৎ চৌধুরী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৭৯

১৫৪) অমিতাভ চৌধুরী:সিলেটনামা;উনিশে মে;সম্পাদক শান্তনু গুপ্ত;কলকাতা;২০১৪;পৃ: ২২

১৫৫) সুকুমার সেন:উপক্রমণিকা;প্রথম পরিচ্ছেদ;বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস;প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: 

১৫৬) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ:

155১৫৭) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ:

১৫৮) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ:

১৫৯) সুকুমার সেন:সংস্কৃতে রচনা;দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯

১৬০) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯ 

১৬১) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০

১৬২) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০

১৬৩) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০

১৬৪) মানবেন্দ্র ভট্টাচার্য:শ্রীভূমির বাণভট্ট;অক্ষর পাবলিকেশনস;আগরতলা;২০০৫

১৬৫) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩

১৬৬) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩

১৬৭) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫

১৬৮) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮

১৬৯) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯

১৭০) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯

১৭১) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০

১৭২) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০

১৭৩) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২১

১৭৪) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২১

১৭৫) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২১

১৭৬) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৩ 

১৭৭) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৩

১৭৮) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৩

১৭৯) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৬

১৮০) D.C.Sircar: Sources of Early History; Chapter Three; The Comprehensive

        History of Assam;Vol-I;ibid.;pg.: 49.

১৮১) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৬

১৮২) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৬

১৮৩) M.M. Sharma:The Development of the Assamese Scripts; Appendix;

        Language and Literature;Chapter Ten;The Comprehensive History of

        Assam;Vol-I;ibid.;pg.:283.

১৮৪) D.C.Sircar;ibid.;pg.: 49.  

১৮৫) D.C.Sircar;ibid.;pg.: 53.

১৮৬) D.C.Sircar;ibid.;pg.: 53.

১৮৭) D.C.Sircar;ibid.;pg.: 53.

১৮৮) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬

১৮৯) নলিনী সান্যাল;প্রাগুক্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৭৪ 

১৯০) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৩

১৯১) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০

১৯২) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭

১৯৩) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭

১৯৪) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩১

১৯৫) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪

১৯৬) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩১

১৯৭) অণিমা মুখোপাধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৮২

১৯৮) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২

১৯৯) ডিম্বেশ্বর নেওগ:আদি মধ্যযুগর অসমীয়া সাহিত্য;নতুন পোহরত অসমীয়া সাহিত্যর বুরঞ্জী;শুয়নী

                  প্রকাশ;গুয়াহাটি;অষ্টম সংস্করণ;১৯৯৯;পৃ: ২৩

২০০) ডিম্বেশ্বর নেওগ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২  

২০১) ডিম্বেশ্বর নেওগ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২

২০২) ডিম্বেশ্বর নেওগ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২

২০৩) ডিম্বেশ্বর নেওগ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২

২০৪) ডিম্বেশ্বর নেওগ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২

২০৫) ডিম্বেশ্বর নেওগ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪

২০৬) ডিম্বেশ্বর নেওগ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪

২০৭) D.C.Sircar:The Bhauma-Naraka or Varman Dynasty of Pushyavarman;

        Chapter Six;The Comprehensive History of Assam;147.

২০৮) D.C.Sircar;ibid.; pg.:152.

২০৯) D.C.Sircar: Sources of Early History;Chapter Three;The Comprehensive

        History of Assam;Vol-I;ibid.;pg.:52.  

২১০) D.C.Sircar;ibid.;pg.: 52.  

২১১) D.C.Sircar;ibid.;pg.: 52.   

২১২) D.C.Sircar; ibid.;pg.: 53.  

২১৩) ডিম্বেশ্বর নেওগ:অসমীয়া ভাষা আরু লিপির আঁতি-গুরি;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৭

২১৪) ডিম্বেশ্বর নেওগ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮

২১৫) ডিম্বেশ্বর নেওগ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮

২১৬) ডবাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ:  

২১৭) দীপ্তি ফুকন পাটগিরি:অসমীয়া,বাংলা আরু উড়িয়া ভাষা—তুলনামূলক অধ্যয়ন;বনলতা, গুয়াহাটি –

        ডিব্রুগড়;প্রথম প্রকাশ,এপ্রিল ২০০৪;পৃ:

২১৮) M.M. Sharma;ibid.;pg.:  269. 

২১৯) M.M. Sharma;ibid.; pg.: 265.

২২০) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৭

২২১) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩

২২২) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৯

২২৩) উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৭৫,৭৬,৭৭

২২৪) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৬

২২৫) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৬

২২৬) নন্দ তালুকদার:অসমীয়া ছপা কিতাপ আরু ছপা-যন্ত্র;অসমবাণী;রূপালী জয়ন্তী আরু বিহু সংখ্যা;

        ১৯৮০ থেকে   উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীর উল্লেখ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৮

২২৭) ড সত্যেন্দ্রনাথ শর্মা:আত্মারাম শর্মা: প্রথম অসমিয়া আধুনিক গদ্য লেখক;আত্মারাম শর্মা স্মারক

        বক্তৃতা;কলিয়াবর সাহিত্য কানন ১৯৯০;অসমিয়া ব্লগ: নীলাচরাই;১৬ ডিসেম্বর,২০১২;

        http://nilacharai.com/atmaram- 

        sharma-pratham-axamiya-gadya-lekhak/

২২৮) ড সত্যেন্দ্রনাথ শর্মা:আত্মারাম শর্মা:প্রথম অসমিয়া আধুনিক গদ্য লেখক;প্রাগুক্ত

২২৯) হেমচন্দ্র বরুয়া: আত্ম-জীবন চরিত;ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীর ব্যবহৃত উদ্ধৃতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৯

২৩০) ডবাণীকান্ত কাকতি:ধ্বনিতত্ত্ব;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০০ 

২৩১) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৯

২৩২) ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:৭৮

২৩৩) সুশান্ত কর:রোমান হরফে বাংলা লেখার পুরাকথা;প্রজ্ঞান, ৯ম বর্ষ,২য় সংখ্যা,ডিসেম্বর, ২০১১; মুখ্য

        সম্পাদক ডঅপূর্ব ভাস্কর গগৈ;আসাম কলেজ শিক্ষক সংস্থা,তিনসুকিয়া কলেজ শিক্ষক সংস্থার

        প্রকাশনা;পৃ: ৯২

        http://ishankonerkotha.blogspot.in/

২৩৪) প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ:চ’ল̖তি ভাষার বানান;বাঙলা ভাষা,দ্বিতীয় খণ্ড;সম্পাদনা: হুমায়ুন আজাদ;

        পৃ: ৬৭১

২৩৫) অজ্ঞাত নাম: বাঙ্গালা বর্ণমালা সংস্কার;বাঙলা ভাষা,প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬০৮

২৩৬) সুশান্ত কর;প্রাগুক্ত;পৃ: ৯২

২৩৭) হুমায়ুন আজাদ:ভূমিকা;বর্ণমালা ও বানান সংস্কার;বাঙলা ভাষা,প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬০৬

২৩৮) বিনয় ঘোষ:কলকাতার সমাচার;‘আলোর ফাঁদ বটতলার সাহিত্য নামে শর্বরী নন্দীর লেখাতে

        উদ্ধৃতঅনুষ্টুপ; বটতলা বিশেষ সংখ্যা;কলকাতা;২০১১;পৃ: ১০৫

২৩৯) ড প্রফুল্ল মহন্ত:মধ্যবিত্ত শ্রেণী আরু অসমর ভাষিক দুর্যোগ;লয়ার্স বুক স্টল;গুয়াহাটি ০১;দ্বিতীয়

        প্রকাশ,২০০৯;পৃ: ১৯২

২৪০) সুশান্ত কর:অসমের মাটি এবং মাটির মানুষ;আমাদের সমকাল;৩৬তম বর্ষ,১ম সংখ্যা;

        ফেব্রুয়ারি,২০১৫;সম্পাদনা  স্নিগ্ধা নাথ;গণতান্ত্রিক লেখক সংস্থা;শিলচর;

         পৃ: ৫২http://sushantakar40.blogspot.in

২৪১)   প্রফুল্ল মহন্ত;প্রাগুক্ত।              

২৪২) শিবনাথ বর্মণ এবং প্রসেনজিৎ চৌধুরী:বাস্তব নে বিভ্রম;শান্তি প্রকাশন;গুয়াহাটি;দ্বিতীয় প্রকাশ ২০১১

২৪৩) ড প্রফুল্ল মহন্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮৭  

২৪৪) ড প্রফুল্ল মহন্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫৮

২৪৫) ড প্রফুল্ল মহন্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫৮

২৪৬) ড প্রফুল্ল মহন্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫৮

২৪৭) ড প্রফুল্ল মহন্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬৭

২৪৮) ড গোলোক চন্দ্র গোস্বামী:অসমীয়া জাতীয় অভিধান:এক নতুন দিগন্ত উদ্ঘাটিত;আমার অসম,২রা

        মে,২০১০;অসমীয়া জাতীয় অভিধান;অসম জাতীয় প্রকাশ;যোরহাট;২০১০;দ্বিতীয় খণ্ড;পৃ: ১৬

২৪৯) ডসত্যেন্দ্রনাথ বরকটকী:অসমীয়া বর্ণমালার সরলীকরণ সম্ভব;দৈনিক অসম,১০ এপ্রিল,

        ১৯৭২;অসমীয়া জাতীয় অভিধান;দ্বিতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৮

২৫০) ডসত্যেন্দ্রনাথ বরকটকী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৮

২৫১) ড ভগবান চন্দ্র মরল:অসমীয়া জাতীয় অভিধান আরু বিকল্প বানান;আমার অসম,৯মার্চ,২০১০;

       ‘অসমীয়া জাতীয়  অভিধান’ দ্বিতীয় খণ্ডে পুনর্মুদ্রিত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৫ 

২৫২) রাজেন বরুয়া:মাইলচ ব্রনচন,অসমীয়া আখর জোঁটনি আরু অসমীয়া জাতীয় অভিধান;আমার অসম,

        ১৩ মে,২০১০;‘অসমীয়া জাতীয়  অভিধান’ দ্বিতীয় খণ্ডে পুনর্মুদ্রিত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০

২৫৩) ড মদন শর্মা এবং ড দেবব্রত শর্মা:অসমীয়া জাতীয় অভিধান:বিতর্কর সন্দর্ভত সম্পাদনা সমিতির

        বক্তব্য;অসমীয়া  জাতীয় অভিধান;দ্বিতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৭০ 

২৫৪) ড দেবব্রত শর্মা:অসমীয়া জাতীয় অভিধান,বৃহত্তর আরু মহত্তর জাতিগঠনর অভিজ্ঞান (২);অসমীয়া

        জাতীয় অভিধান;অসমীয়া  জাতীয় অভিধান; দ্বিতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫২

২৫৫) পবিত্র সরকার (সম্ভাব্য। কেননা সম্পাদনা সমিতিতে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী,শঙ্খ ঘোষ,নির্মল দাস,

        অমিতাভ চৌধুরী প্রমুখ অনেকে থাকলেও মুখবন্ধটিও তিনিই লিখেছেন):লিপি বিষয়ে সিদ্ধান্ত;

        পরিশিষ্ট;আকাদেমি বানান অভিধান;পশ্চিমবঙ্গ  বাংলা আকাদেমি;কলকাতা ২০;ষষ্ঠ সংস্করণ,

        জানুয়ারি ২০০৮;পৃ: ৫৪৪

২৫৬) সুজিৎ চৌধুরী: বাংলা ভাষার নতুন বিপ্লব আর আসামের বাঙালিরা; ভাষা ও সাহিত্য;সম্পাদনা

        বিবেকানন্দ মহন্ত;স্রোত  প্রকাশনা;আগরতলা;২০১৩;পৃ: ৬৮

২৫৭) ড দেবব্রত শর্মা;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৭

২৫৮) ড দেবব্রত শর্মা;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৭

২৫৯) ড দেবব্রত শর্মা;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৭

২৬০) সুশান্ত কর:ভাষা ও প্রযুক্তি ও আন্তর্জালে বাংলাভাষা;আকাদেমি পত্রিকা,২০১৬;‘ভাষা ও সংস্কৃতি:

        বরাক উপত্যকা’ সংখ্যা;সম্পাদনা সঞ্জীব দেবলস্কর;বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন,

        শিলচর;পৃ: ১৫

        http://sushantakar40.blogspot.in/

২৬১) প্রভাকর শর্মা নেওগ:ইউনিক,ইণ্টাৰনেট আৰু অসমীয়া লিপি;শব্দ ডট অর্গ;

        http://www.xobdo.org/article/unicode-xobdo-wikipedia

২৬২) প্রভাকর শর্মা নেওগ;প্রাগুক্ত

২৬৩) সুকুমার সেন:পদাবলী ও কৃষ্ণলীলা কাব্য;দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ;বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস;দ্বিতীয় খণ্ড;

        প্রথম আনন্দ সংস্করণ,দ্বিতীয় মুদ্রণ,১৪০০ বাংলা;কলকাতা;পৃ: ১৫

২৬৪) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪

২৬৫) জ্ঞানদাস:বৈষ্ণবপদাবলী;সম্পাদনা খগেন্দ্রনাথ মিত্র,সুকুমার সেন,বিশ্বপতি চৌধুরী,শ্যামাপদ

        চক্রবর্তী;দ্বাদশ সংস্করণ;কলিকাতা  বিশ্ববিদ্যালয়,১৯৯০;পৃ: ৪৮

২৬৬) মুহম্মদ আবুল বশর: সিলেটে বাংলা সাহিত্য চর্চা-প্রাচীন ও মধ্যযুগ; আবিদ রাজা মজুমদারের ‘নাগরী

        পুঁথির পাঠক ও শ্রোতা:বরাক উপত্যকা’ নিবন্ধে উদ্ধৃত;Script Identity Region;Edr.

        Anuradha Chanda;Dey’s Publishing and  Maulana Abul Kalam Azad

        Institute of Asian Studies;Kolkata;2013;pg.: 146.

২৬৭) Abdul Musabbir Bhuiya:The Sylhet Nāgari Script;Script Identity Region;

        Edr.Anuradha Chanda;ibid;pg.: 113.

২৬৮) Abdul Musabbir Bhuiya;ibid; pg.: 115.  

২৬৯) কবি জ্ঞানদাস: মিলনসাগর বাংলা ব্লগ;

        http://www.milansagar.com/kobi-gyanadas.html

২৭০) সুকুমার সেন:বৈষ্ণব পদাবলী ও কৃষ্ণমঙ্গল;ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ;বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস;প্রথম খণ্ড;

        প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৬০

২৭১) George Abraham Grierson: Eastern Bengali; Indo-Aryan Family, Eastern

        Group;Part I;Linguistic survey of India;Vol-IV; Compiled and Edited by

        George Abraham Grierson;Calcutta:Office of the Superintendent of

        Government Printing,India,1903-1928.pg.:

        224.

        http://dsal.uchicago.edu/books/lsi/lsi.php?volume=5-1&

        pages=463#page/237/mode/1up

২৭২) George Abraham Grierson;ibid.;pg.:222.

২৭৩) George Abraham Grierson;ibid.;pg.:224.

২৭৪) B.C Alle n:Assam District Gazetteers;Vol II;Chapter III;Sylhet,The

        People;Baptist  Mission Press,Calcutta;1905;pg.:74.

২৭৫) B.C Allen ;ibid.; pg.:74.

২৭৬) উষারঞ্জন ভট্টাচার্য:সিলেটি নাগরী লিপি ও সাহিত্য; শ্রীহট্ট-কাছাড়ের মনীষী  মনীষা ও অন্যান্য;অক্ষর,  

        আগরতলা;২০০৯;পৃ:১০

২৭৭) অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৯

২৭৮) অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৯২

২৭৯) উষারঞ্জন ভট্টাচার্য; প্রাগুক্ত;পৃ: ১০

২৮০) উষারঞ্জন ভট্টাচার্য;প্রাগুক্ত;পৃ: ১০

২৮১) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 234.

২৮২) সুকুমার সেন:মুসলমান লেখক:বিবিধ রচনা;বিংশ পরিচ্ছেদ;বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস;দ্বিতীয়

        খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৬৫

২৮৩) পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ:ভবানন্দের হরিবংশ;উষারঞ্জন ভট্টাচার্যের ‘সিলেটি নাগরী লিপি ও

        সাহিত্য’ নিবন্ধে উদ্ধৃত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪ 

২৮৪) মহাম্মদ আব্দুল লতিফ:তামাম শুদ;সিলেটি নাগরির পহেলা কেতাব ও দইখুরার রাগ;সম্পাদনা

        অনুরাধা চন্দ;পৃ: ৩২

২৮৫) মহাম্মদ আব্দুল লতিফ:শংশোধকের আরজ;সিলেটি নাগরির পহেলা কেতাব ও দইখুরার রাগ;প্রাগুক্ত;

        পৃ: ৩০

২৮৬) অনুরাধা চন্দ:ভূমিকা;সিলেটি নাগরির পহেলা কেতাব ও দইখুরার রাগ;প্রাগুক্ত;পৃ: 16

২৮৭) উষারঞ্জন ভট্টাচার্য;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮

২৮৮) পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ:সিলেটি নাগরি;‘সিলেটি নাগরির পহেলা কেতাব ও দইখুরার রাগ’

        গ্রন্থের ভূমিকাতে অনুরাধা চন্দের  উদ্ধৃতি;প্রাগুক্ত;পৃ: 16 

২৮৯) উষারঞ্জন ভট্টাচার্য;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮

২৯০) পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ;প্রাগুক্ত;পৃ: 17

২৯১) অনুরাধা চন্দ; প্রাগুক্ত; পৃ: 17 

২৯২) http://www.unicode.org/charts/beta/nameslist/n_A800.html

২৯৩) http://www.unicode.org/charts/beta/nameslist/c_A800.html

২৯৪) http://www.omniglot.com/writing/syloti.htm

২৯৫) অনুরাধা চন্দ;প্রাগুক্ত;পৃ: 17

২৯৬) উষারঞ্জন ভট্টাচার্য;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬

২৯৭) উষারঞ্জন ভট্টাচার্য;প্রাগুক্ত;পৃ:

২৯৮) মুর্তাজা আলি:সিলেটের নাগরী লিপি ও বাংলা সাহিত্য;সাহিত্য পত্রিকা,ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয় থেকে

        উষারঞ্জন ভট্টাচার্যের  উদ্ধৃতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০

২৯৯) অনুরাধা চন্দ:রচনাসূচী;প্রাগুক্ত;পৃ: 43

৩০০) অনুরাধা চন্দ:ভূমিকা;প্রাগুক্ত;পৃ: 22

৩০১) অনুরাধা চন্দ;প্রাগুক্ত;পৃ: 22

৩০২) গোলাম কাদির:সিলেটি নাগরী লিপি:ভাষা ও সাহিত্য;বাংলা একাডেমী;ঢাকা;১৯৯৯;অনুরাধা চন্দের

        উদ্ধৃতি;প্রাগুক্ত;পৃ: 23

৩০৩) অনুরাধা চন্দ;প্রাগুক্ত;পৃ: 38

৩০৪) অনুরাধা চন্দ;প্রাগুক্ত;পৃ: 38

৩০৫) উষারঞ্জন ভট্টাচার্য;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪

৩০৬) রায় বাহাদুর ডাঃ দীনেশচন্দ্র সেন: মুসলমান কবিদের শ্রেষ্ঠ অবদান--পল্লীগাথা; সপ্তম পরিচ্ছেদ;

                   প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান;করুণা প্রকাশনী;কলকাতা ০৯;১৯৯৫;পৃ: ৯০

৩০৭) কবিশেখর কালিদাস রায়:ভূমিকা; মাধুকরী;সম্পাদনা--কবিশেখর কালিদাস রায়; ওরিয়েণ্ট বুক

        কোম্পানি,কলকাতা-৭৩;দ্বাদশ সংস্করণ,১৪১৬ বাং;পৃ:

৩০৮) নন্দলাল শর্মা:শিতলাং শাহ ও তাঁর গান;Script Identity Region;ibid;pg.: 213.

৩০৯) Abdul Musabbir Bhuiya;ibid; pg.: 123.

৩১০) Anuradha Chanda:as editorial note on Abdul Musabbir Bhuiya quoted

       earlier;ibid; pg.: 123. 

৩১১) Anuradha Chanda:Being a ‘True’ Mussalman;Script Identity Region;ibid;

        pg.: 182.

৩১২) Richard Eton;ibid.

৩১৩) অনুরাধা চন্দ;প্রাগুক্ত;পৃ: 35

৩১৪) অনুরাধা চন্দ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১২

৩১৫) অনুরাধা চন্দ;প্রাগুক্ত;পৃ: 36

৩১৬) Anuradha Chanda;ibid;pg.: 181.

৩১৭) Anuradha Chanda;ibid; pg.: 181.

৩১৮) উষারঞ্জন ভট্টাচার্য;প্রাগুক্ত;পৃ: ২১

৩১৯) অনিন্দিতা ঘোষ:বটতলার বই বাজার ও তার সামাজিক ইতিহাস;অনুষ্টুপ,বটতলা বিশেষ সংখ্যা;

        প্রাগুক্ত;পৃ:

৩২০) অনিন্দিতা ঘোষ;প্রাগুক্ত;পৃ:  

৩২১) অনিন্দিতা ঘোষ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪

৩২২) অনিন্দিতা ঘোষ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪

৩২৩) উষারঞ্জন ভট্টাচার্য;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪

৩২৪) মুর্তাজা আলি;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪

৩২৫) অনুরাধা চন্দ;প্রাগুক্ত;পৃ: 23

৩২৬) সাদিয়া চৌধুরী পরাগের বক্তব্য ক্ষেত্র সমীক্ষার বক্তব্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন  অনুরাধা চন্দ;

        প্রাগুক্ত;পৃ: 24  

৩২৭) সাদিয়া চৌধুরী পরাগ: সিলেট নাগরী লিপি ও এর পাঠপ্রিয়তা; Script Identity Region;

         ibid;pg.: 159.

৩২৮) আহমদ হাসান দানী: শ্রীহট্ট-নাগরী লিপির উৎপত্তি ও বিকাশ; বাঙলা ভাষা, দ্বিতীয় খণ্ড;সম্পাদনা:

        হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬২০

৩২৯) Suniti Kumar Chatterji;ibid;pg.: 234.

৩৩০) শিবপ্রসন্ন লাহিড়ি:সিলেটি নাগরী লিপির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ; বাংলা একাডেমী পত্রিকা;তৃতীয় বর্ষ,

        প্রথম সংখ্যা;বৈশাখ-শ্রাবণ ১৩৬৬;ঢাকা;উষারঞ্জন ভট্টাচার্যের উদ্ধৃতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫

৩৩১) আহমদ হাসান দানী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬২২

৩৩২) আহমদ হাসান দানী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬২২

৩৩৩) আহমদ হাসান দানী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬২২

৩৩৪) আহমদ হাসান দানী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬২২

৩৩৫) আহমদ হাসান দানী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬২২

৩৩৬) গোলাম মুরশিদ:ইন্দো-মুসলিম আমলে সংস্কৃতির রূপান্তর;দ্বিতীয় অধ্যায়;হাজার বছরের বাঙালি

        সংস্কৃতি;অবসর  প্রকাশনা সংস্থা;ঢাকা ১১০০;২০০৬;পৃ: ৪৭

৩৩৭) আহমদ হাসান দানী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬২৩

৩৩৮) আহমদ হাসান দানী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬২৩

৩৩৯) উষারঞ্জন ভট্টাচার্য;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬

৩৪০) সৈয়দ মুর্তাজা আলি:সিলেটের নাগরী লিপি ও বাংলা সাহিত্য;উষারঞ্জন ভট্টাচার্যের উদ্ধৃতি;প্রাগুক্ত;

        পৃ: ১৬

৩৪১) দেওয়ান নুরুল হোসেন চৌধুরী:জালালাবাদের কথা;বাংলা একাডেমী;ঢাকা;উষারঞ্জন ভট্টাচার্যের

        উদ্ধৃতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬

৩৪২) উষারঞ্জন ভট্টাচার্য;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬

৩৪৩) শিবপ্রসন্ন লাহিড়ি;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬

৩৪৪) শিবপ্রসন্ন লাহিড়ি;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৭

৩৪৫) উষারঞ্জন ভট্টাচার্য;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৭

৩৪৬) উষারঞ্জন ভট্টাচার্য;প্রাগুক্ত ;পৃ: ১৭

৩৪৭) উষারঞ্জন ভট্টাচার্য;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৭

৩৪৮) অনুরাধা চন্দ;প্রাগুক্ত;পৃ: 23

৩৪৯) Jogendra Chandra Ghosh:Grant of Bhaskara Varman and the Nagara

        Brahmans;The Historical Quarterly 6:1,1930,pp.60-71;

        as quoted  by Abdul Musabbir Bhuiya; ibid; pg.: 117.

৩৫০) Nagendranath Basu: The Social History of Kamrupa, Vol. III; Calcutta,

        1922,pp. 139- 40; as quoted  by Abdul Musabbir Bhuiya; ibid; pg.:118.

৩৫১) Nagendranath Basu: The Social History of Kamrupa, Vol. III; Calcutta,

        1922,pp. 139- 40;উষারঞ্জন ভট্টাচার্য;প্রাগুক্ত;পৃ: ১২

৩৫২) George Abraham Grierson;ibid.;pg.: 140.

৩৫৩) Abdul Musabbir Bhuiya;ibid;pg.: 123.

৩৫৪) Abdul Musabbir Bhuiya;ibid; pg.: 113.

৩৫৫) Richard M. Eton: Early Sufis of Delta;ibid.

৩৫৬) Sanjib Deb Laskar: The Process of Demographic Formation and

        Acculturation:A Study of ancient and Medieval Society in The  Sylhet-

        Cachar Region;Script Identity Region;ibid;pg.: 58.

৩৫৭) Sanjib Deb Laskar;ibid;pg.: 57.

৩৫৮) Abdul Musabbir Bhuiya;ibid;pg.: 116.

৩৫৯) Richard M. Eton: Mass Conversion to Islam: Theories and Protagonists;

        ibid.

৩৬০) Richard M. Eton;Ibid.

৩৬১) Richard M. Eton:Bengal Under the Mughals;ibid.

৩৬২) Richard M. Eton:Mosque and Shrine in the Rural Landscape;ibid.

৩৬৩) Anuradha Chanda:Introduction;Script Identity Region;ibid;pg.: 6.

৩৬৪) Anuradha Chanda;ibid;pg.: 6.

৩৬৫) Abdul Musabbir Bhuiya;ibid;pg.: 123.

৩৬৬) সুকুমার সেন:পীরের গাথা ও গান;পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ;বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস; দ্বিতীয় খণ্ড;

        প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৯৭

৩৬৭) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৯৭

৩৬৮) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৯৭

৩৬৯) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৯৭

৩৭০) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৯৭

৩৭১) Anuradha Chanda;ibid; pg.:7. 

৩৭২) সুকুমার সেন: মুসলমান লেখক: বিবিধ রচনা;বিংশ পরিচ্ছেদ;বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস;দ্বিতীয়

        খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৬৫

৩৭৩) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৬৬

৩৭৪) সৈয়দ হামজা:জৈগুন-হানিফা;সুকুমার সেনের উদ্ধৃতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৬৯

৩৭৫) মতিন উদ্দীন আহমদ:সাধক কবি শিতালাং শাহ;মরমী কবি শীতালাং শাহ,সম্পাদনা নন্দলাল শর্মা;

        ঢাকা;২০০৫; পৃঃ ২৩৫ থেকে নন্দলাল শর্মার ‘শিতলাং শাহ ও তাঁর গান’ নিবন্ধে উদ্ধৃত;Script

        Identity Region; ibid;pg.: 214.

৩৭৬) মতিন উদ্দীন আহমদ:সাধক কবি শিতালাং শাহ;মরমী কবি শীতালাং শাহ,সম্পাদনা নন্দলাল শর্মা;

        ঢাকা;২০০৫;পৃ: ২৩৫ থেকে নন্দলাল শর্মার ‘শিতলাং শাহ ও তাঁর গান’ নিবন্ধে উদ্ধৃত;ibid;

        pg.: 220.

৩৭৭) Anuradha Chanda;ibid;pg.:190.

৩৭৮) গোলাম কাদির:সিলেটি নাগরী লিপি:ভাষা ও সাহিত্য;নন্দলাল শর্মার ব্যবহৃত উদ্ধৃতি থেকে;ibid;

        pg.:207.

৩৭৯) সাদিয়া চৌধুরী পরাগ;প্রাগুক্ত;pg.: 156

৩৯১) Our History: Sylheti Translation And Research’(STAR);

        www.sylheti.org.uk/our- history/

৩৯২) মুহম্মদ খলিল:চন্দরমুখি;উৎস প্রকাশন;ঢাকা;২০০৯

 

~***~

 

 

 

 

 

 

 

 

Comments

Popular posts from this blog

।।রোমান হরফে বাংলা লেখার পুরাকথা । ।

।। অসমিয়া,মানবাংলা,সিলেটি এবং দু’একটি প্রতিবেশী ভাষা ও ভাষাবৈচিত্র্যের ধ্বনিতাত্ত্বিক তুলনা ।। তৃতীয় অধ্যায় ৷৷