।। অসমিয়া,মানবাংলা,সিলেটি এবং দু’একটি প্রতিবেশী ভাষা ও ভাষাবৈচিত্র্যের ধ্বনিতাত্ত্বিক তুলনা ।। তৃতীয় অধ্যায় ৷৷
৷৷ অসমিয়া ভাষা এবং বাংলার সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্যের পারস্পরিক সম্পর্ক ৷৷
৷৷ একটি কালানুক্রমিক এবং কালিক অনুসন্ধান ৷৷ তৃতীয় অধ্যায় ৷৷
📚📚📚📚📚📚📚
(মূল গবেষণা অভিসন্দর্ভে ‘উপভাষা’ শব্দটিই ছিল, ‘ভাষাবৈচিত্র্য’ ছিল না । ছবি ভালো পড়তে না পারলে দুবার ক্লিক করে বড় করুন। তাতেও না পারলে এখানে ক্লিক করে বা একেবারে নিচে গোগোল ড্রাইভে পিডিএফে পড়ুন। )
শুরুতেই আমরা স্বাধীন ভাবে বাংলা,অসমিয়া,সিলেটি এবং দুই একটি প্রতিবেশী বাংলা ভাষা বৈচিত্র্যের ধ্বনি সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কটি বোঝার চেষ্টা করব।সুবিধের জন্যে প্রথমে প্রথানুগ ব্যাকরণ অনুযায়ী ধ্বনির শ্রেণি বিভাগ,ধ্বনির পরিবর্তনের সূত্র এবং স্বরূপ আলোচনা করব।যদিও এই অংশে এক কালিক ধ্বনিবৈজ্ঞানিক প্রসঙ্গ একেবারে এড়িয়ে যাওয়া কঠিন হবে। শেষে ভাষাবিজ্ঞান অনুসারে ভাষাগুলোর ধ্বনিম বা স্বনিম (phoneme) বোঝার চেষ্টা করছি।
।। ধ্বনির শ্রেণি বিভাগ।।
ধ্বনির যেকোনো পরম্পরাগত আলোচনা শুরু হয় সাধারণত স্বর-ব্যঞ্জন বিভাজন দিয়ে।স্বর স্বাধীনভাবে উচ্চারিত ধ্বনি,ব্যঞ্জন স্বরের সাহায্য নিয়ে উচ্চারিত ধ্বনি—এই কথাগুলো আমরা সংস্কৃত ব্যাকরণ থেকেই জেনে এসেছি।‘ব্যঞ্জনমন্বক,স্বর: স্বয়ং রাজ্যতে’।কিন্তু ধ্বনিবিজ্ঞানের দিক থেকে মুখবিবরে শ্বাসবায়ুর যাতায়াত পথের উপরে নানাভাবে যেসব নিয়ন্ত্রণ মানুষ কায়েম করে,ধ্বনিবৈচিত্র্য তাতেই দেখা দেয়।স্বর-ব্যঞ্জনের শ্রেণিবিভাজনও তার ব্যতিক্রম নয়। যাতায়াতের কথা যখন হচ্ছে তখন তার গতিমুখের কথাও হবে। ধ্বনি উচ্চারণের জন্যে মুখের বাইরে থেকে ভেতরে যাবার বেলা,না ভেতর থেকে বাইরে বেরুবার বেলা শ্বাসবায়ু বাধা পেয়ে ধ্বনিগুলো তৈরি হচ্ছে —এই প্রশ্নের মীমাংসা শুরুতেই করে অন্তর্গামী এবং বহির্গামী ---এই দুইভাগে ভাগ করা হয়।অর্থাৎ শ্বাসবায়ুর গতিমুখ অনুসারে এই বিভাজনটি করা হয়ে থাকে।তবে ভারতের প্রায় সমস্ত প্রধান আর্যভাষাই বহির্গামী।কিন্তু কিছু কিছু ভাষাবৈচিত্র্যে কিছু কিছু অন্তর্গামী ধ্বনি আছে। বাংলাতেই আছে।সিলেটি অবরুদ্ধ বা অন্তঃস্ফোটন ব্যঞ্জন ‘ গ’,দ’ ’ ইত্যাদি এরকম ধ্বনি।কিন্তু এর পরের গুরুত্বপূর্ণ বিভাজনকে রামেশ্বর শ’ লিখেছেন,‘ধ্বনিসত্তার স্বরূপ’ অনুযায়ী বিভাজন।১ দুই ভাগের নাম --- বিভাজ্য এবং অবিভাজ্য ধ্বনি।অবিভাজ্য ধ্বনি তথা স্বরাঘাত,শ্বাসাঘাত,যতি,দৈর্ঘ্য ইত্যাদি প্রসঙ্গ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।বিশেষ করে স্বরাঘাতের বৈচিত্র্য বলে বা লিখে বোঝানো খুবই কঠিন,কিন্তু শুনিয়ে বোঝানো এতোই সহজ যে যেকোনো অশিক্ষিতজনও --- ভাষার স্বর শোনেই, কী বলছেন তা না বোঝেই--- অনুমান করে নিতে পারেন বক্তা কোন অঞ্চলের ভাষাবৈচিত্র্যে কথা বলছেন। আমরা তাই সেই সব অবিভাজ্য ধ্বনিকে নিয়েও আলাদা করে কথা বলব।বিপরীতে স্বর-ব্যাঞ্জনাদি হচ্ছে বিভাজ্য ধ্বনি।অর্থাৎ ধ্বনিগুলোকে আলাদা করে উচ্চারণ করা যায়,চিহ্ন দিয়ে লেখাও যায়---যে চিহ্নগুলোকে আমরা বলি বর্ণ,একত্রে বর্ণমালা। এই বিভাজ্যধ্বনিগুলো এত দ্রুত পরিবর্তিত হয় যে পরিবেশ,প্রতিবেশের প্রভাবে এক ব্যক্তির শৈশব এবং বার্ধক্যেই উচ্চারণ বা ব্যবহার অভ্যাস ভিন্ন হতে পারে,প্রজন্মান্তরে তো বটেই।বস্তুত তাই বিভাজ্য এবং অবিভাজ্য ধ্বনিকে ‘চঞ্চল’ এবং ‘অচঞ্চল’ বিশেষণেও বিশেষিত করা যেতে পারে।
মুখবিবরে শ্বাসবায়ুর বাধার মাত্রাভেদ অনুযায়ী ধ্বনিগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়।স্বরধ্বনি উচ্চারণে শ্বাসবায়ু মুখবিবরের কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হয় না,যদিও বা কোথাও হয়--- ধ্বনিটি সেই বাধার থেকে উৎসারিত হয় না। বিপরীতে ব্যঞ্জনধ্বনি জিহ্বা বা অন্যান্য বাগযন্ত্র দিয়ে শ্বাসবায়ুকে বাধা দেবার ফলেই দেখা দেয়।শ্বাসবায়ুর একেবারে বাধাহীন এবং একেবারেই বাধাযুক্ত --এই দুইয়ের মাঝামাঝি আরেকটি তৃতীয় অবস্থা রয়েছে।এই অবস্থাতে উচ্চারিত ধ্বনিকে নৈকট্য ধ্বনি বলা হয়,যদিও প্রথানুগ ব্যাকরণে সেগুলোকে ব্যঞ্জনধ্বনির মধ্যেই ধরা হয়।পাণিনি যখন চারটি মাহেশ্বর সূত্রে ‘অচ̖’ দিয়ে স্বরবর্ণ বোঝান তখন অ,ই,উ,ঋ,৯,এ,ও,ঐ,ঔ এই নয়টি স্বরের উল্লেখ করেন। এর মধ্যে আবার প্রথম পাঁচবর্ণের ( অক̖) দ্বিমাত্রিক দীর্ঘরূপ রয়েছে।৯ বাদ দিয়ে বাকি আটটির আবার ত্রিমাত্রিক প্লুতস্বরে কথাও সংস্কৃত বৈয়াকরণিকেরা বলে থাকেন,যদিও সেগুলোর আলাদা চিহ্ন নেই।২ কিন্তু দীর্ঘ স্বরগুলোর আছে- আ,ঈ,ঊ, দীর্ঘ ঋৠ, দীর্ঘ ৯ৡ(ব্লগে হরফদুটি প্রায়োগিক কারণে দেখানো যাচ্ছে না। উপরে ছবিতে দেখুন)। সব মিলিয়ে স্বর দাঁড়ালো,চব্বিশ।এর মধ্যে ৯ এর প্লুতস্বর,এবং দীর্ঘ ঋৠ, দীর্ঘ ৯ এর থাকা না থাকা নিয়ে নানা মুনির নানা মত ছিল। বাংলা এবং অসমিয়া বর্ণমালাতে আমরা ‘দীর্ঘ ঋৠ, দীর্ঘ ৯’ এবং প্লুতস্বরের কথা বাদ দিয়ে বাকি বারোটি স্বরবর্ণের কথা পড়ে এসেছি।এর মধ্যে ৯ বর্ণের ব্যবহার বাংলা এবং অসমিয়া কোনো ভাষাতেই নেই।ধ্বনি হিসেবে এটি আসলে স্বরব্যঞ্জনের যুক্ত ধ্বনি –‘লি’।তাই বাংলা-অসমিয়া বর্ণমালার গ্রন্থ থেকে ৯ বিদেয় নিয়েছে।একই কথা ‘ঋ’(রি) সম্পর্কেও সত্য হলেও দুই ভাষাতেই এর পূর্ণ এবং সংক্ষিপ্তরূপ (ৃ) লেখায় প্রচলিত থেকে গেছে।দুই ভাষাতেই লিখবার জন্যে এখনকার ‘বাংলা-অসমিয়া’ লিপি ছাড়াও একাধিক লিপি ব্যবহৃত হয়েছে,এবং বর্ণ সংখ্যার তারতম্য হয়েছে।যেমন সিলেটি নাগরিতে স্বরবর্ণ সংখ্যা মাত্র পাঁচটি --- ‘আ,ই,উ,এ,ও’/
এই সিলেটি নাগরি ছাড়া উপভাষা বা ভাষাবৈচিত্র্য অনুযায়ী যেহেতু আলাদা লিপি নেই,আমরা এই অংশে মূলত বাংলা- অসমীয়া বর্ণ তথা সেগুলোর উচ্চারণবৈচিত্র্য নিয়েই আলোচনা করব।সিলেটি ধ্বনি বুঝতে সাহায্য করবে বলে সিলেটি নাগরি প্রসঙ্গও থাকবে।
পাণিনি মাহেশ্বর সূত্রে আরো দশটি ব্যঞ্জন বর্ণের উল্লেখ করেছেন,একত্রে এরা ‘হল̖’ সূত্র দিয়ে পরিচিত। হল̖ সাকুল্যে তেত্রিশটি---ক,খ,গ,ঘ,ঙ,চ,ছ,জ,ঝ,ঞ,ট,ঠ,ড,ঢ,ণ,ত,থ,দ,ধ,ন,প,ফ,ব,ভ,ম,য,র,ল,ব,শ,ষ,স,হ।কিন্তু বিদ্যাসাগর ‘ং,ঃ’ এই দুইটি বর্ণকে ব্যঞ্জনের মধ্যে ধরে মোট সংখ্যা পঁয়ত্রিশ বলে উল্লেখ করেছেন৩।তিনি এই দুটিকে ‘অযোগবাহ’ বর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন।এগুলো স্বর না ব্যঞ্জন---এই নিয়ে বৈয়াকরণদের মধ্যে শুরু থেকেই তর্ক ছিল, তেমনি ছিল ‘ক্ষ’ ধ্বনিটি নিয়েও।পাণিনি ‘ক্ষ’কে স্বতন্ত্র বর্ণ বলে স্বীকার না করলেও,পরবর্তী অনেকে করেছেন।‘অকারাদি-ক্ষকারান্তা বর্ণমালা প্রকীর্ত্তিতা’--- পুরুষোত্তমের এই উক্তির উল্লেখ করেছেন সমগ্র ব্যাকরণ কৌমুদীর সম্পাদক৪। তিনি ঃ, ৯ ইত্যাদির আরো প্রকারভেদ সহ সংস্কৃত ব্যাকরণের কোথাও কোথাও বিয়াল্লিশটি ব্যঞ্জন এবং তেইশটি স্বর মিলিয়ে পঁয়ষট্টিটি বর্ণের কথাও লিখেছেন।এতো সব কথার উল্লেখ আমরা করছি এই দরকারে যে বাংলাতে আমরা -- ‘ড়,ঢ়,য়,ৎ,ঁ’ এই আরো পাঁচটি বর্ণ মিলিয়ে মোট চল্লিশটি ব্যঞ্জনের কথা জেনে এসেছি। চল্লিশটি ব্যঞ্জন এবং বারোটি স্বরবর্ণ মিলে বাংলা বর্ণ সংখ্যা বাহান্ন। অন্যদিকে অসমিয়াতে এগুলো ছাড়াও ‘ক্ষ’কে স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনবর্ণ বলে স্বীকার করা হয়।সত্যনাথ বরা ‘বহল ব্যাকরণে’ “সংস্কৃত বর্ণমালাত মুঠত পঞ্চাশটা আখৰ আছে” লিখে, শেষ চারটি আখর ‘ষ,স,হ,ক্ষ’-এর উল্লেখ করেছেন৫।তেমনি অসমিয়াতে “ব্যঞ্জনবর্ণ মুঠতে চৌত্রিশটা” লিখে শেষ চারটি ঐ একই বর্ণের উল্লেখ করেছেন৬।তাঁর গণনাতে সংখ্যাটি চৌত্রিশ কী করে হলো,সেই তর্কে আমরা না গিয়েও নিশ্চিত হয়েই লিখতে পারি,অসমিয়া বর্ণমালাতে বাংলার চল্লিশটি আছেই,আর আছে ‘ক্ষ’।‘ক্ষ’ কে বাহুল্য ভেবে বিদ্যাসাগরই বাংলাতে রাখেন নি।অসমিয়া স্কুল পাঠ্য ‘কুঁহিপাঠ’ প্রথম ভাগে ‘৯’ নেই,কিন্তু ‘ক্ষ’ আছে।‘ক্ষ’ আছে নবকান্ত বড়ুয়ার ‘অ-আ শিকোআ গীত’-এও৭।প্রথম অসমিয়াতে এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রবল প্রশ্ন তোলেন গোলোকচন্দ্র গোস্বামী।তাঁর কোনো বইতেই বর্ণটি নেই।এখন অধিকাংশ ভাষাবিজ্ঞানীই তাঁর তৈরি বর্ণমালাকে অনুসরণ করেন।আমরাও তাই সেই বর্ণমালা ধরেই অসমিয়া বুঝবার চেষ্টা করব।তাঁর দর্শানো পথেই তৈরি সুবৃহৎ ‘অসমিয়া জাতীয় অভিধান’-এ ‘ব্যবহৃত বর্ণক্রম এবং শব্দক্রমে’ও কিন্তু ‘ক্ষ’ আছে।কিন্তু নিজেদের প্রস্তাবিত বিকল্প বানানের জন্যে যে বর্ণতালিকা রেখেছেন সেখানে আবার ‘অসমীয়া বর্ণ’(আসলে স্বনিম চিহ্ন) বা ‘অসমীয়া আখর’ (ধ্বনি চিহ্ন)কোনোটিতেই এই ‘ক্ষ’ নেই।৮ তবে এখনো প্রাতিষ্ঠানিক মত হলো ‘ক্ষ’ থাকবে এবং যেহেতু ৯ স্বরের তালিকার থেকে বাদ গেছেই, সব মিলিয়ে বর্ণ সংখ্যা সেই বাহান্নই। শুধু ‘র, এবং অন্তস্থ-ব’ –এর হরফ আলাদা আমরা সবাই জানি,‘ৰ এবং ৱ’।
সিলেটি নাগরি লিপি নিয়ে মীনা দানের একটি কথা গুরুত্বপূর্ণ,“A comparison between the current Bāṅglā writing system and the Sylhet Nāgari writing system confirms in the latter a high degree of (i) orthographic simplification and (ii) reduction in the alphabet. Both the traits are the results of a script reform process aiming towards establishing 1:1 relationship between the sounds and letters of the language.”৯ অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্যও এক জায়গাতে লিখেছেন,“ ...এই লিপিতে লিখিত পাণ্ডুলিপিগুলির মধ্যে ঔপভাষিক বৈশিষ্ট্য অবিকৃতভাবে উপস্থিত।”১০তাই এই লিপির সাতাশটি ব্যঞ্জনের উল্লেখটাও এখানে করে রাখা যাক।
মুখবিবরের ভেতরে নিচের দিকে স্বরতন্ত্রীতে শ্বাসবায়ুর বাধার মাত্রাভেদ অনুসারেও ধ্বনির চারটি শ্রেণিবৈচিত্র্য দেখা দেয়।স্বরপথের পূর্ণ অবরোধজনিত স্পর্শধ্বনি,সঘোষ বা ঘোষবৎ ধ্বনি,ফিসফিসিয়ে ধ্বনি এবং অঘোষ ধ্বনি। বাগযন্ত্রের দুটি নমনীয় পর্দার মতো অঙ্গ স্বরতন্ত্রী দুটি চাররকমের অবস্থানে থেকে সেখানেই শ্বাসবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।সেই চারটি অবস্থান হলোঃ ১) পূর্ণ বিচ্ছেদের অবস্থান,২) পূর্ণ সংযোগের অবস্থান,৩) প্রায় পূর্ণ-সংযোগের অবস্থান,এবং ৪) প্রায়-পূর্ণ বিচ্ছেদের অবস্থান। প্রথম অবস্থান থেকে অঘোষ ধ্বনিগুলো উচ্চারিত হয়।বাংলা বর্গের প্রথম এবং দ্বিতীয় ধ্বনি ছাড়াও শ,স ইত্যাদি অঘোষ ধ্বনি।অসমিয়াতেও কথাটি একই।অসমিয়া ষ,স-ও অঘোষ ধ্বনি।দ্বিতীয় অবস্থানে শ্বাসবায়ু ক্ষণকালের জন্যে পুরো আটকে দিয়ে আকস্মিক খুলে দিলে রুদ্ধস্বরপথ (glottal stop) ধ্বনি উচ্চারিত হয়। মান বাংলাতে এই ধ্বনি নেই।বর্ণের উপরে ডানে এই ( ˀ ) চিহ্ন দিয়ে ধ্বনিগুলো বোঝানো হয়।আরবি হামজা (ء) এরকম উচ্চারিত হয়। সিলেটি সহ পূর্ববঙ্গীয় ভাষাগুলোতে ‘হ’/ɦ/ ধ্বনিটি লোপ পেলে এই ধ্বনিটি উচ্চারিত হয় বলে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন। যেমন ˀঅইব /ˀoibɔ/< হইবে/হবে১১।মুহম্মদ আবদুল হাই-ও কথাটি সমর্থন করেন।তিনি ‘আত’ < হাত,অয়< হয়,ইন্দু< হিন্দু শব্দগুলোর উদাহরণ দিয়েছেন।১২ গোলক চন্দ্র একে কণ্ঠ্য স্ফোটধ্বনি বলে লিখেছেন,“ ...কণ্ঠ্য স্ফোটধ্বনি সদায় অঘোষ হয়।”১৩ অসমিয়াতে স্বরধ্বনি দিয়ে শব্দের শুরু হলে কখনো এই ধ্বনি শোনা যায়। যেমন ʔআকআৰ, ʔইদ ইত্যাদি।পদান্ত স্বরের পরে বিরাম থাকলেও কখনো শোনা যায়। যেমন ‘তেওঁ কয় যে’ =তএওঁ কঅয় যএʔ১৪ এই ধ্বনির উচ্চারণ স্কটিশ সহ বেশ কিছু ব্রিটিশ ভাষাবৈচিত্র্যে,তিব্বত-বর্মী সহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ভাষাগুলোতেও মেলে।যদিও খাসি ভাষাতে একটি একটি বিশিষ্ট ধ্বনি এবং এর প্রয়োগও ব্যাপক১৫।সিলেটির প্রতিবেশী আর্যভাষা বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিতেও আছে।গারোতে এর ব্যবহার ব্যাপক।সুতরাং সিলেটি আদি পুব বাংলার ভাষাতে ধ্বনিটি খাসি-গারো সূত্রে আসাটা সম্ভব।আরবি সূত্রে আসাও অসম্ভব নয়।আরবি বর্ণ হামজা ‘ء’ সাধারণত অন্যস্বরের সঙ্গে যুক্ত হয়।সিলেটিতে এই ধ্বনিগুলোর অস্তিত্বের কথা আমরা খানিক সাহস করেই লিখছি।‘ক,চ,প’ বর্গের প্রথম দুটি ধ্বনিকে অনেকেই যে ঊষ্মপ্রভাবান্বিত বলে লিখেছেন,তার অন্য কোনো ব্যাখ্যা সম্ভব বলে মনে হয় না।শুধুই উচ্চারণ স্থান দিয়েতো না-ই।সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ও পূর্ববঙ্গীয় ভাষাগুলোতে ‘প’ উচ্চারণ করতে গিয়ে দুই ঠোঁটে অনেকটা ফাঁকের কথা লিখেছেন,ফলে উচ্চারণে ধ্বনিটি /p/ না থেকে /F/ হয়ে যায় লিখেছেন।নোয়াখালি, চট্টগ্রামে /F/ প্রায় অঘোষ ‘হ’/h/ তে পরিণত হয়। তিনি সিলেটি নজির দিয়েছেন পাপ=[FɑːF] চট্টগ্রামীতে পুত = [Fuːt,huːt]।১৬ ‘হ’ নিজেও স্বরতন্ত্রীয় ধ্বনি এবং রুদ্ধস্বরপথ ধ্বনির সঙ্গে এর তফাত সামান্য।রবীন্দ্র কুমার দত্ত তাই নোয়াখালিতে ‘ক,খ,গ’–এর এবং চট্টগ্রামীতে ‘খ,গ’-এর স্নিগ্ধতালব্য রূপের সঙ্গে ‘স্বরতন্ত্রীয়’ বৈচিত্র্যেরও উল্লেখ করেছেন১৭।তিনি ‘রুদ্ধস্বরপথ ধ্বনি’র কথা আলোচনা করেছেন,যতটুকু সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন। সেই সঙ্গে আরেকটি লক্ষণীয় মন্তব্য করেছেন,“‘হ’ লুপ্ত হলে তার আশ্রিত স্বরটা অনেক সময় স্বরাঘাত সহ দীর্ঘ হয়”১৮।এই কথা সিলেটি সম্পর্কেও সত্য।‘হ’ এবং ‘ˀঅ’ এর তফাত সামান্য বলেই সিলেটি, ঢাকাই আদি ভাষা বৈচিত্র্যে হাত< ˀআত হতে পারে।একে ‘হ’ ধ্বনিটির ‘মধ্যপ্রাণীভবন’ নাম দিতে পারি।শব্দটি আবিদ রাজা মজুমদারের।আমরা পরে ব্যাখ্যা করবো।সিলেটি সহ পূর্ববঙ্গীয় ভাষাগুলোর এই তিনবর্গের প্রথম অল্পপ্রাণ বর্ণের এবং ঘোষ -অঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনি মাত্রেরই ‘মধ্যপ্রাণীভবন’ বলেও একটি ঘটনা ঘটে বললে আমাদের অনেক জটিলতাই সহজ হয়ে যায়---এই কথা আমরা ক্রমে ক্রমে ব্যাখ্যা করব।সিলেটি পাপ শব্দেও দুই ‘প’ একই রকম উচ্চারিত হয় না বলেই আমাদের মনে হয়।আমরা এর উচ্চারণ লিখবার প্রস্তাব করি এরকম /ˀpɐf/।এমনিতেও /F/ধ্বনিটি এখন আন্তর্জাতিক ধ্বনিবর্ণমালাতে নেই।তার বদলে এখন গ্রীক ধ্বনি ফাই /ϕ/ দিয়ে এই দ্বিঔষ্ঠ বর্ণটিকে বোঝানো হয়।শব্দটিতে শেষ /f/-এর ব্যাখ্যা আপাতত এই করতে পারি যে একবার স্বরতন্ত্রীর বাধা সরে গিয়ে নিম্ন-মধ্য স্বর ‘আ’ উচ্চারণ করবার পরের ধ্বনিটি পূর্ণসংযোগের অবস্থান থেকে উচ্চারিত হওয়া মুস্কিল। /ϕ/ উচ্চারিত হয় উচ্চ-স্বরধ্বনির সঙ্গে,সিলেটি ফুন /ϕun/< শুন (শোনা) ইত্যাদি শব্দে। ইংরেজি ‘Camphor,Humphrey’ এরকম শব্দে এই ধ্বনি শোনা যায়।আমরা ইউট্যুবে আরবি হামজা ‘ء’-র ব্যবহার নিয়ে এক শিক্ষিকা মাহার বক্তৃতা শোনে নিশ্চিত যে সিলেটি সহ পূর্ববঙ্গীয় এই ধ্বনিগুলো রুদ্ধস্বরপথ ধ্বনিই বটে, যাদের কথা আমরা লিখছি।অনুরূপ সিলেটি সহ পূর্ববাংলার ‘ক,খ’ /k,kh/ দুইই প্রায় ‘খ’/x/এ রূপান্তরিত হয় বলে সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন ১৯।আমরা পরে দেখাব, সর্বত্র তা হয় না।আব্দুল হাই সিলেটি –চট্টগ্রামীতে ‘খ’এর /x/উচ্চারণটি সমর্থন করেন।আরবি ‘খ’ (خ) দিয়ে তিনি উচ্চারণটি বুঝিয়েছেন।কিন্তু চট্টগ্রামের ভাষাতে ‘কাপড়’কে ‘খাওড়’ শুনে লিখছেন,“‘কাপড়’ যে ‘খাওড়’ যে হয়েছে তাতে কিছু যায় আসে না,কিন্তু ‘কাপড়ের’ উচ্চারণ যখন (‘خাওড়’ )শুনি তখনই কানে লাগে।”২০ কানে তাঁর লাগে, কেন না ঢাকাই সহ এই অঞ্চলের ভাষাতে এমনটা শোনে অভ্যস্ত নন। ঢাকাই ভাষাবৈচিত্র্যের আলোচনাতে তিনি শব্দ মধ্য এবং শেষ অবস্থানে ‘ক’ –এর /x,g বা ɦ/ রূপান্তরের কথা লিখেছেন।২১ প্রথম অবস্থানে মান বাংলার মতোই ‘ক’/k/। আমাদের অনুমান এটাও ঠিক নয়। কলম ঠিক/kɔlɔm/হবে না।ঢাকার ভাষাবৈচিত্র্য আমাদের অধ্যয়নের কেন্দ্রে নেই, তার উপরে আব্দুল হাইর এটি মাতৃভাষা এবং তিনি বাংলা ধ্বনিবিজ্ঞানের অন্যতম পথদ্রষ্টা,আমরা এখনই অন্যরকম বলবার অবস্থাতে নেই।কিন্তু সিলেটিতে শব্দটি /kɔlɔm/,/khɔlɔm/,/k’ɔlom/ বা /xɔlɔm/কোনোটাই হবে না,হবে/ˀkɔlɔm/--এই আমাদের বলবার কথা।‘চ’-বর্গ সম্পর্কেও আমাদের একই কথা।সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের উত্তর এবং পূর্ববঙ্গের “class dialects in the [t͜s] –areas”২২ কথাগুলো এবং দন্ত্য ঘৃষ্ট শিস ধ্বনিগুলোর [ts,s,dz,z] তিব্বতী কামরূপী উৎসগুলোর কথা মনে রেখেই আমাদের বক্তব্য মান বাংলা চাপ,সিলেটি ‘চাপ’ আর ‘ছাপ’-এর উচ্চারণ এক নয়,আবার সিলেটি ‘ছাপ’ এবং ‘সাফ’-এরও উচ্চারণ ভিন্ন নয়।পরে আমরা কথাগুলো আরো স্পষ্ট করব।এইখানে এইটুকুন বলতে পারি যে খুব জরুরি নয়,কোনো স্বরের সঙ্গেই এই ব্যঞ্জন ধর্মটি যুক্ত হয়ে ‘ˀঅ’,‘ˀআ’,‘ˀই’,‘ˀউ’ ইত্যাদি হতে হবে।আসলে ঠিক স্বরের সঙ্গে যুক্ত হয় না। এই নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্বিধা আছে।অনেকেই মনে করেন,একবার স্বরতন্ত্রে শ্বাসবায়ু বাধা পাবার পরে মুখের ভেতরে আর কোথাও শ্বাসবায়ু বাধা পায় না।সেক্ষেত্রে স্বরধ্বনিটিই অবশিষ্ট থাকে বটে।‘ˀআ,ˀঅ,ˀই’ উচ্চারণ করতে গেলে যেকেউ অনুভব করবেন শুরুতে একবার যেন শ্বাসবায়ু গলার ভেতরে আটকে গেছে।এবং হঠাৎ সেই বায়ু ছেড়ে দিয়েই ধ্বনিগুলো উচ্চারণ করা গেছে।তাতে মনে করা হয় যে একবার এই বাধার থেকে মুক্ত বায়ু মুখের ভেতরে আর কোথাও বাধা পেতে পারে না।ঠিক তাই আব্দুল হাইও ঢাকাই ভাষাবৈচিত্র্যের আলোচনাতে ধ্বনিটিকে ‘হ’ ধ্বনির মুক্তবৈচিত্র্য (free variant) বলে উল্লেখ করেছেন২৩। এর বেশি এগোন নি।কিন্তু মুখের ভেতরে আর কোথাও শ্বাসের বাধা পেয়ে ধ্বনিটিকে একই সঙ্গে স্নিগ্ধতালব্য বা তালু দন্তমূলীয় ধ্বনি হতে অসুবিধে কোথায় এই নিয়ে ধ্বনি বিজ্ঞানে আলোচনা বেশি নেই। অথচ এর একটি যদি মুখের ভেতরের উচ্চারণ স্থান অনুযায়ী বিভাজন,দ্বিতীয়টি স্বরপথে বাধার মাত্রাভেদ অনুযায়ী বিভাজন। সিলেটি /ˀk/ উচ্চারণের বেলাও অনুভূত হবে যেন এর আগে কোনো এক স্পর্শ ধ্বনি উচ্চারণ করবার ছিল,করা হলো না। কিন্তু শ্বাসকে গলার ভেতরে বাধাটা দেয়া হলো, এবং সেই বাধা ঠেলে আকস্মিক খুলে দিয়ে ‘ক’ ধ্বনিটি উচ্চারিত হলো। এক জায়গাতে বাধার ফলে ‘ ˀঅ’/ˀɔ/ উচ্চারণে যে শৈথিল্য থাকে, দু’জায়গাতে বাধা এবং বাধা মুক্তির ফলে ‘ˀক’/ˀk/ এর উচ্চারণ অনেকটাই সুস্থির।মুখের ভেতরে উচ্চারণ স্থান যত তালু, দন্তমূল, ঠোঁটের দিকে এগুতে থাকে ততই শৈথিল্য অর্জন করতে থাকে।অন্যদিকে ‘ কি’লা ’/k’ilɐ/ (কী রকম) শব্দের ‘ক’’ তে বাধামুক্তি মুখের ভেতরেই ঘটে স্বরতন্ত্র পুরো বন্ধ থাকে। সেগুলোকে বহিঃস্ফোটক ধ্বনি বলে।এই দুয়ের মধ্যে অনেকে আবার গুলিয়েছেন।গ্রিয়ার্সন মন-খমের পরিবারের মুণ্ডারি ইত্যাদি ভাষাতে এমন যৌথবাধার থেকে উচ্চারিত ধ্বনিগুলো দেখেছিলেন।লিখেছেন,“The most characteristic feature of Muṇḍā phonology are the so-called semi-consonants k’,ch’,t’,p’. They are formed in the mouth in the same way as the corresponding hard consonants k,ch,t, and p, but the sound is checked, and breath does not touch the organs of speech in passing out.The sound often makes the impression of being slightly nasalized, and we therefore find writings such as tn or dn instead of t’; pm or bm instead of p’,and so forth.”২৪ তিনি ‘ˀk’ না লিখে ‘ k’’ লিখেছেন। দেখে মনে হতে পারে ‘অন্তঃস্ফোটক’ ধ্বনির কথা বলছেন। কিন্তু প’ল সিডওয়েল এবং ফেলিক্স রাউ স্পষ্টই ‘ˀp,ˀt,ˀc,ˀk’ লিখেছেন, “ The role of glottal stops in modern Munda and pMunda is has been the source of some problems in the reconstruction of pMunda, we believe that it is a solved issue. In the first place, we assume a pre-Munda merger in which final glottal –both ˀ and h—became phonological zeroes.Etymological k became [ˀ] in coda position, although in some languages such as Santali, the glottal character of syllable final /k/, represented as k’ in Neukom (2001) is less clear. In some Munda languages such as Kharia, [ˀ] is still a transpatrent (?) allophone of /g/ in syllable final position. …to represent the velar character which is still preserved in Santali and Kharia, we represent pAA k in pMunda as ˀk.২৫ ‘pAA’ মানে হচ্ছে প্রত্ন অস্ট্রোএশীয়।
এই সব যুক্তিতে এবং সিলেটিতে কোল-মুণ্ডারি ভাষাগুচ্ছের পুরোনো প্রভাবের কথা মনে রেখে আমরাও সিলেটিতে ‘ˀক,ˀচ,ˀপ’/ˀk,ˀt͡s,ˀp/ ধ্বনির অস্তিত্ব প্রস্তাব করছি।যদিও আমাদেরটি প্রস্তাব মাত্র।এর আগে অধ্যাপক জন্মজিৎ রায়,সুধাংশু শেখর তুঙ্গ প্রমুখ সিদ্ধান্তই ঘোষণা করেছিলেন।জন্মজিৎ রায় শুধু ‘ক’ ধ্বনিটি সম্পর্কেই ‘কণ্ঠ্যমূলীয় স্পৃষ্ট ধ্বনি’ হবার কথা লিখেছিলেন।২৬অধ্যাপক সুধাংশু শেখর যদিও সামান্য বিস্তৃত,তাঁর সিদ্ধান্ত অনুসরণ করতে আমাদের অসুবিধেও আছে কিছু।তিনি লিখেছিলেন,“Most plosives and other consonants, especially non-voiced and voiced aspirates, are uttered with a preceding or following glottal stop. Glottal stop plays a prominent part in the consonant system of Cachar as well as Sylhet Bengali. But this Characteristic is not a monopoly here; almost all the speech forms of Eastern Bengal have it. It is entirely unknown in stand.Beng. Hence the people of that area feel it difficult to grasp the speeches of Eastern Bengali.”২৭ তিনি আরো লিখেছেন,“Glottal Stop is, however, more active with the consonants. And of the consonants the voiced aspirate plosives are the most important, whom Cach.Beng. as well as Bish. never allow. As a result the sounds are deaspirated and deaspiration is compensated by the glottal stop.These new sounds are also described by some as ‘recursives’,‘implosives’,etc,although their recursive/implosive quality has been discarded by part by laboratory researchers. We shall, however, continue the use of glottal stop in the easy.”২৮ এইটুকুনে একটা কথা স্পষ্ট যে তিনি আসলে স্বরযন্ত্রে ফুসফুসবিচ্ছিন্ন অন্তঃস্ফোটক এবং বহিঃস্ফোটক ধ্বনির কথা লিখছেন।এর সঙ্গে রুদ্ধ-স্বরপথ ধ্বনির তফাত আছে।যদিও তফাতটি ধরা খুবই কঠিন।আমরা সেগুলো পরে স্পষ্ট করব।এগুলোর অস্তিত্ব নিয়ে খুব একটা দ্বিমত ধ্বনিবিজ্ঞানীদের মধ্যে নেই,বিশেষ করে বহিঃস্ফোটকের অস্তিত্ব নিয়ে।এই গুলোতো বর্গের দ্বিতীয় এবং চতুর্থ ধ্বনির সমস্যা।সব ধ্বনিকে একগোত্রে ফেলে দেবার কাজ যে তিনি খুব স্পষ্ট ধারণা নিয়ে করেছিলেন,আমাদের মনে হয় না।বিস্তৃত বিশ্লেষণের এখানে সুযোগ নেই।আমরা শুধু এই কথাটিকে নিতে পারি, “ …they say /x’al/ for both /khal/,channel, and /kal/,time….।”২৯ এটি একটি বিভ্রান্তির জায়গা। তিনি সিলেটি ‘ক’এর ‘/x/-like’ উচ্চারণ এবং ‘ক,খ’এর ভেদহীনতা মেনে নিয়ে এর পর স্বরতন্ত্রীয় স্পৃষ্ট (glottal stop) ধ্বনির তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন।অথচ,যে কেউ মানবেন যে সিলেটি ‘কাল’ এবং ‘খাল’ শব্দের উচ্চারণ আদৌ এক নয়।খাল যদিও বা /x’al/ হয়,‘কাল’ অবশ্যই অন্য কিছু।আমাদের মতে /ˀkɐl/।তিনি / ˀ/ চিহ্নটিও ব্যবহার করেন নি, এও লক্ষ করবার মতো।আমাদের তাই আপাতত সমস্যা বর্গের প্রথম ধ্বনিকে নিয়েই।‘ত,ট’ বর্গ নিয়ে নয়,কেননা মূলের উচ্চারণ প্রায়শই অক্ষত আছে।সম্ভবত তাই, সেই প্রথম ধ্বনি নিয়ে অধ্যাপক সুধাংশু শেখর তুঙ্গ যখন কিছু উদাহরণ সহ তাঁর বক্তব্য উপস্থিত করেছেন,‘ত,ট’ বর্গ এড়িয়ে গেছেন,“Other consonants such as /k,c,p,n,r,l,h/, etc are found to be followed by the glottal stop also, e.g.
x’ɔileu koilei to say
x’ɔtɔ kɔto how much
x’al kal time
ts’air car four
ts’akɔr cakɔr servant
n’ut not note
fua pua once fourth
b’air outside
tar’ar tader theirs
r’uga roga sicky
l’axan like ”৩০
আমরা /ন,র,ল,হ/ সম্পর্কেও আপাতত নীরব রইলাম,কেন না এহেন উচ্চারণে শ্বাসাঘাত,স্বরাঘাতের ভূমিকারও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ না করে কথা বলা নিরাপদ হবে না।কিন্তু এই অব্দি আলোচনাতে আমরা খুব পরিচিত একটি বাংলা ধ্বনির কথা এড়িয়ে গেলাম।সেটি বিসর্গ (ঃ)। সুকুমার সেন একে স্বরতন্ত্রীয় বলেছেন।৩১ সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ও তাই বলে চিহ্নিত করে একে ‘হ’এর অঘোষ রূপ বলে ব্যাখ্যা করেছেন।৩২ লিখেছেন,বাংলা স্বরধ্বনির পরে,এবং অক্ষরের শেষে যুক্ত হয়।তাছাড়া অঘোষ অল্পপ্রাণধ্বনির সঙ্গে যুক্ত হয়ে সেগুলোকে মহাপ্রাণ করে।ঘোষ অঘোষ ‘হ’ –এর জন্যে /ɦ/এবং /h/ তিনি ব্যবহার করেছেন।আমরাও নিজেরা কোনো ধ্বনির উচ্চারণ বোঝাতে তাঁকেই অনুসরণ করে যাচ্ছি।অর্থাৎ /kh/ কিন্তু /gɦ/ -এই ভাবেই লিখে যাচ্ছি।/ ˀ/ তার থেকে ভিন্ন ধ্বনি।এই ধ্বনিতে বাধাটি সম্পূর্ণই হয়,এবং হঠাৎ খুলে যায়।/h/ তে স্বরতন্ত্রী পুরো বিচ্ছিন্ন থাকে।
স্বরতন্ত্রীতে শ্বাসবায়ুর বাধার মাত্রাভেদের তৃতীয় অবস্থানে স্বরতন্ত্রী দুটি সামান্য খোলা থাকে বলে,এর মধ্য দিয়ে যাবার পথে শ্বাসবায়ু কম্পন তথা নাদের সৃষ্টি করে। সেই নাদ মেশানো ধ্বনিগুলোকে ঘোষধ্বনি বলে।বাংলা বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ধ্বনিগুলি ঘোষ।অসমিয়াতেও এই ধ্বনিগুলোই ঘোষ।এছাড়াও ‘র,ল,হ,ড়,ঢ়,য়’ এবং সমস্ত স্বরধ্বনি ঘোষ ধ্বনি।অসমিয়াতেও একই।তবে ‘ড়’ বানানে থাকলেও উচ্চারণে ‘র’-এর সঙ্গে একই।সিলেটিতেও মান বাংলার থেকে তফাত বিশেষ নেই। চতুর্থ অবস্থানে উচ্চারিত ধ্বনিগুলো বাংলা–অসমিয়াতে নেই।ফিসফিস করে কথা বলবার সময় সঘোষ ধ্বনিগুলো অঘোষ হয়ে যায় মাত্র।
শ্বাসবায়ুকে স্বরপথে বাধা দেবার জন্যে স্বরতন্ত্রীর এই দুটি পর্দাই রয়েছে।এবং দু’টোই সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এর উপরের ভাগে মুখবিবরের উপরের দিকে আছে উপরের ঠোঁট তথা ওষ্ঠ,দাঁত,দাঁতের মূল,তালু,মূর্ধা ইত্যাদি। এগুলোকে বলে ঊর্ধ্বস্থ উচ্চারক।এমনিতে অঙ্গগুলো নিষ্ক্রিয়।সক্রিয় ভূমিকা নেয় মুখবিবরের নিচের ভাগের জিহ্বা এবং ঠোঁট তথা অধর।এদের বলে নিম্নস্থ উচ্চারক।নিম্নস্থ উচ্চারক মুখবিবরের উপরের ভাগের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ঊর্ধ্বস্থ উচ্চারকে শ্বাসবায়ুকে বাধা দেবার ফলেই ধ্বনির অধিকাংশ বৈচিত্র্য দেখা দেয়।ফলে ধ্বনির যে শ্রেণিবিভাজন সম্ভব হয় সেগুলোকে একত্রে বলা যেতে পারে উচ্চারণ স্থান অনুযায়ী শ্রেণিবিভাজন।
।। উচ্চারণস্থান অনুসারে ধ্বনির শ্রেণি বিভাজন।।
উচ্চারণস্থান অনুসারে মান বাংলা–অসমিয়া এবং সিলেটি সহ আরো কিছু ভাষাবৈচিত্র্যের ধ্বনির শ্রেণি বিভাজনগুলো এরকম :
ওষ্ঠ্য ধ্বনি: নিচের ঠোঁট বা অধর দিয়ে উপরের ঠোঁটে শ্বাসবায়ুকে বাধা দিয়ে বাংলা ‘প,ফ,ব,ভ,ম’ এই পাঁচটি ওষ্ঠ্য বর্ণ উচ্চারিত হয়।উপরের দাঁতে অধর দিয়ে শ্বাসবায়ু বাধা দিয়েও কিছু ধ্বনি উচ্চারিত হয়।সেগুলোকে দন্তৌষ্ঠ ধ্বনি বলে।কিন্তু মান বাংলাতে সেরকম ধ্বনি নেই। ইংরেজিতে আছে /f,v/। সিলেটি৩৩,চট্টগ্রামী এবং নোয়াখালিতেও আছে৩৪। রবীন্দ্র কুমার দত্ত এ দুটিকে এই ভাবে ‘ফ̣,ভ়̣’ লিখেছেন।মান অসমিয়া ওষ্ঠ্যবর্ণগুলোও বাংলার মতো একই।৩৫ নিখিলেশ পুরকাইত লিখেছেন সিলেটি এবং কাছাড়িতে ‘প’ অনেকটা ‘ফ’এর মতো উচ্চারিত হয়।৩৬ জগন্নাথ চক্রবর্তীর মতে সিলেটিতে ‘প,ব’ ওষ্ঠ্য ধ্বনি হলেও প-এর খানিক উষ্মীভবন ঘটে।অর্থাৎ বাধাটা পুরো হয় না,সামান্য ফাঁক থাকে।৩৭তিনি মনে হয় রুদ্ধস্বরপথ ধ্বনির কথা লিখেছেন।আবিদ রাজা ‘প’ সম্পর্কে লিখেছেন এর উচ্চারণ ‘উষ্ম এবং মৃদু দন্তৌষ্ঠ’৩৮। উষ্মতা বোঝাতে বর্ণটি লিখতে উপরে একটি বিন্দু বসিয়েছেন,আমরা বিকল্পে ঊর্ধ্ব-পার্শ্ব বৃত্ত বসাচ্ছি ‘প̊ ’।‘ফ’কে দন্তৌষ্ঠ, এবং ‘ব’কে ওষ্ঠ্য বলছেন।‘ভ’এর উচ্চারণ মান বাংলা ‘ব’ এবং ‘ভ’এর মাঝামাঝি এবং ধ্বনিটি অবরুদ্ধ স্পষ্টই বলছেন।কিন্তু বর্ণটিকে ‘ব’’ দিয়ে চিহ্নিত করেন নি ভ-এর শব্দশ্রেণিতে।করেছেন ব-এর শব্দশ্রেণিতে।বু’শি=ভুষি।এই ‘ব’’ /ɓ/-এর কথা জগন্নাথ উল্লেখ করেন নি।অর্থাৎ দু’জনে মতভেদ আছে,এবং বিসঙ্গতিও আছে।যদিও দু’জনেই অনেকটা সত্য বলছিলেন।যদি এইভাবে লিখি চারটি ধ্বনিই ওষ্ঠ্য,কিন্তু দন্তৌষ্ঠ ‘ফ̣,ভ̣’ ও আছে,তবে খানিকটা সঙ্গতি হয়।‘প’ রুদ্ধ-স্বরপথ ধ্বনি বললে উষ্মতার সমস্যারও সমাধান হয়।অর্থাৎ ‘প’-এর ধ্বনিবৈচিত্র্য বা বিস্বন হচ্ছে ‘দন্তৌষ্ঠ-ফ’।‘পাপ’ /ˀpɐf/ শব্দে যেমন। তেমনি ভাব/bɦɐb/> বা’ব/ɓɐb/,কিন্তু লাভ/lɐbɦ/ > লাভ̣ /lɐv/।মান বাংলা ‘প’ নেই,এর ‘মধ্যপ্রাণীভবনে’র ফলে উচ্চারিত হয় /ˀp/,এর পরেই যুগপৎ মহাপ্রাণীভবন এবং উষ্মীভবনের ফলে আর স্পর্শ ধ্বনি থাকে না,উচ্চারিত হয় /f/,/ϕ/।মান বাংলা স্পৃষ্ট /ph/ও নেই,তার বদলে সাধারণত নিম্নস্বরের পাশে বা সঙ্গে /f/,উচ্চস্বরের পাশে বা সঙ্গে /ϕ/ উচ্চারিত হয়।যেমন ‘ফুল,পিপড়া’/ ϕul,ˀpiϕɽɐ/।কিন্তু এরও ‘অল্পপ্রাণীভবন’ বিরল নয়।কিন্তু সেটি/ˀp/নয়,/p’/হয়। যেমন পা’লানি/p’ɐlɐni/(<ফেলা+নি),কিন্তু ফালানি/fɐlɐni/(লাফানো;উঠিলা সত্বরে নারায়ণ।বাহু ফাল করিআঁ তখন।।-শ্রীকৃষ্ণকীর্তন)।পা’লানি /p’ɐlɐni/(ফেলা+নি),কিন্তু পালা/ˀpɐla/ (কীর্তন,প্রতিপালন)।/b,m/নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।/bɦ/ কখনো বা যুক্তাক্ষরে বা দুইএর বেশি অক্ষরের শব্দে মুক্তবৈচিত্র্য হিসেবে উচ্চারিত হয়।চট্টগ্রামী এবং নোয়াখালিতে সিলেটির মতো মান বাংলার ‘ব,ম’ /b,m/ আছে।কিন্তু রবীন্দ্র কুমার দত্ত লিখেছেন ‘প’/p/-ও আছে।‘ফ’/ph/ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘ফ’̣ /f/ হয়ে যায়৩৯।এই নিয়ে আমাদের দ্বিধা আছে।কিন্তু সিলেটির মতোই ‘ব’’/ɓ/আছে।‘ভ’/bɦ/কখনো বা যুক্তব্যঞ্জনে মেলে, চট্টগ্রামীতে তাও মেলেনা।তার মানে ‘ভ,ভ̣,ব’’ এবং ‘ফ,ফ̣’ পরস্পর বিকল্প ধ্বনি। নোয়াখালিতে কারো কারো মুখে ‘ফ’̣ /f/ ‘হ’ হয়ে যায়।যেমন লাফালাফি > ফালাফালি > হালাহালি। সিলেটিতে উলটো হয়, শোন> হুন> ফুন /ϕun/।
জিহ্বাপ্রান্তীয় ধ্বনি: জিহ্বাপ্রান্ত বা শিখরে ঊর্ধ্বস্থ উচ্চারকের নানা অংশে বাধা দিয়ে চাররকমের ধ্বনি উচ্চারিত হয়।
দন্ত্যধ্বনি: শ্বাসবায়ুকে দাঁতে বাধা দেয় বলে এদের দন্ত্য ধ্বনি বলে।মান বাংলা /ত,থ,দ,ধ,স/ এই শ্রেণির ধ্বনি।সংস্কৃতে /ন/ও দন্ত্যধ্বনি।অসমিয়াতে দন্ত্য ধ্বনি নেই বলেই গোলোক চন্দ্র গোস্বামীর অভিমত।কাছাড়ি বিভাষাতে দন্ত্যধ্বনি অক্ষত আছে বলেই জগন্নাথ অভিমত দিয়েছেন।৪০কিন্তু আমাদের অভিমত সিলেটিতে বিভাষা নিরপেক্ষ ভাবে ধ >দ’ হয়েছে। জন্মজিৎ রায় সিলেটি সম্পর্কে কথাটি সমর্থন করেন।৪১নিখিলেশ পুরকাইতেরও তাই অভিমত।৪২নোয়াখালি –চট্টগ্রামীতেও একই ঘটনা ঘটে৪৩।সুধাংশু শেখর তুঙ্গ অধিকাংশ ভারতীয় ভাষাতেই দন্ত্য ধ্বনিগুলো “clear and well-formed” লিখেছেন৪৪।লিখেছেন,“They are different only in Assamese to some extent as Assamese does not really have a true dental series except nasal.”৪৫ কিন্তু কাছাড়ি বিভাষাতে বিষয়টি অন্যরকম ব্যাখ্যা করে তিনি লিখছেন,“ ...both Cach.Beng and Bish. Have practically three /t/s, a pure, plosive /t/ with no aspiration, as aspirated /th/ , and aspirated /th/ with slight friction.”৪৬ এরকম ধ্বনি-বৈচিত্র্য সব ধ্বনিতেই বিভিন্ন অবস্থানে এবং সমাবেশে তিনের বেশিই পাওয়া যেতে পারে।‘তার, তারার’ এমন শব্দে যেখানে ‘র’ রয়েছে ‘ত’ সামান্য মহাপ্রাণীভূত এবং উষ্ম হয়ে যায়,‘তান, দিতাম, যাইতাম’ এমন শব্দে সামান্য মহাপ্রাণীভূত হয়,‘ˀআত,ˀআত্তি’ (< হাত,হাতি)এমন শব্দে মান বাংলার ‘ত’ উচ্চারিত হয় এই তাঁর অভিমত।‘সামান্য মহাপ্রাণীভবন’ কথাটিতে আমরা ‘মধ্যপ্রাণীভবন’ ধারণাটির সমর্থন পাই।এগুলো হতে পারে।সূক্ষ্ম পরীক্ষার দরকার। গোলকচন্দ্র গোস্বামী এরকম সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আন্তর্দন্ত্য ধ্বনির কথা লিখেছিলেন,সেগুলোকে ‘তৃ,থৃ,দৃ,ধৃ’ দিয়ে চিহ্নিত করেছেন৪৭।আমরা আপাতত ‘ত’ সমস্যাকে স্থগিত রাখলেও ‘থ’ নিয়ে স্পষ্টই সমস্যা আছে।সিলেটিরা সহজে মান বাংলা ‘কোথা থেকে,কোথায় থাকে’ এমন শব্দ বা শব্দজোড় উচ্চারণ করতে পারেন না এই কথা আমাদের উপেক্ষা করা কঠিন।সিলেটি উচ্চারণ করেন অনেকটা ‘কো’তা তে’কে’।সিলেটিতে প্রথম শব্দজোড়টি কখনো বা মিশে এক শব্দ ‘কৈত্তাকি’ হয়েছে,দ্বিতীয়টি হবে ‘কই থাকে’। মনে হতে পারে এই ‘ত্ত’ আসলে ‘ত’ এর দ্বিত্ব,এবং ‘থ’ স্পষ্টই /t̪h/।‘ত্তাকি’র স্বতন্ত্র ব্যবহারও আছে,সেখানে দ্বিত্বের আভাস মাত্র হয় (কই তাকি,তার তাকি হে বা’লা।)।এ নিছক ‘থ’/t̪h/ এর অল্পপ্রাণীভবন নয়।সুতরাং ‘থ’ আমাদের ভাবায় বটে। এর আগে সাধারণ ভাবে ঘোষ –অঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনির রুদ্ধ-স্বরপথ ধ্বনিতে (Glottal stop) রূপান্তরের কথা লিখে এলেও ‘থ’ প্রসঙ্গে সুধাংশু শেখর তুঙ্গ সামান্য দ্বিধান্বিত। তিনি লিখছেন,“Interestingly,loss of aspiration in this case does not generally cause intrusion of glottal stop;a voiceless aspirates in Cach.Beng. allows glottal stop in a limited scale.However,on some occasions when the /th/ is deaspirated, glottal stop does occur.It is difficult to say at what particular situation it will occur,as there is no hard and fast rule about this as stated earlier.”৪৮সিলেটি ‘দা’ক্কা’ (<ধাক্কা)-র পাশে এই ‘ত্তাকি’ (<থাকি) উচ্চারণ করলে স্বরতন্ত্রে শ্বাসবায়ু বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার ব্যাপারটি স্পষ্ট হবে।এমন অবস্থাতে বহির্গামী বায়ুতে উচ্চারিত ধ্বনিকে বহিঃস্ফোটক বলে,আমরা আগে লিখে এসেছি। গোলকচন্দ্র গোস্বামী একে ‘উদ্গীর্ণ’ ধ্বনিও লিখেছেন। এবং ‘প’,ত’,ক’’ এইভাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে বলে জানিয়েছেন।সিলেটি ‘থ’/t̪h/-এর সেরকমই এক ‘অল্পপ্রাণীভূত’ ধ্বনিবৈচিত্র্য ‘ত’’/t̪’/। সুতরাং ‘কৈত্তাকি’ শব্দটি সন্ধিসূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা গেলেও,‘তাকি, তনে’ অবশ্যই /t̪’ɐki,t̪’ɔne/।
দন্তমূলীয় ধ্বনি: জিহ্বাপ্রান্ত দন্তমূলে শ্বাসবায়ুকে বাধা দিলে দন্তমূলীয় ধ্বনি উচ্চারিত হয়। মান বাংলা /র,ল,ন/ এই শ্রেণির ধ্বনি। সিলেটিতেও তাই৪৯।আবিদ রাজা মজুমদার ভুল করেই র-এর উচ্চারণ স্থান মূর্ধা লিখেছেন।৫০নোয়াখালি চট্টগ্রামের ভাষাবৈচিত্র্যেও একই ঘটনা ঘটে।৫১অসমিয়াতেও ধ্বনি তিনটি দন্তমূলীয়ই।এ ছাড়াও সংস্কৃতে যেসব ধ্বনি দন্ত্য-ধ্বনি বর্গ বলে পরিচিত এর সবই অসমিয়াতে দন্ত্যমূলীয় ধ্বনি বলে,লিখেছেন গোলোকচন্দ্র।আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালাতে এই বর্ণগুলোর জন্যেই /t,d/ চিহ্নগুলো নির্ধারিত।বাংলা দন্ত্যধ্বনিগুলোকে চিহ্নিত করতে হয় এইভাবে /t̪,d̪/।অসমিয়া ‘স,য’ –ও দন্তমূলীয় ধ্বনি।এমন কি মূর্ধন্য ধ্বনিগুলোরও ‘অসমীয়া ভাষাত দন্তমূলীয় বুলি বুজিব লাগে’৫২ বর্ণমালাতে এগুলোকে মূর্ধন্য ধ্বনি হিসেবে দেখাবার কারণ স্পষ্টই লিখেছেন,“আমার বর্ণমালাখন সংস্কৃতর আর্হিত তৈয়ার করা হৈছে । সেই দেখি সংস্কৃতর অনুকরণত আমারো আখরর দুটা বর্গ হৈছে”৫৩কিন্তু এও লিখেছেন,“এই আখরবোরর উচ্চারণত পার্থক্য নাথাকিলেও বানানত পার্থক্য রাখিব লাগিব।”৫৪
উত্তর দন্তমূলীয় ধ্বনি: দন্তমূলের শেষ ভাগ তথা তালুর কাছাকাছি অংশ স্পর্শ করে এই ধ্বনি উচ্চারিত হয়। মানবাংলাতে এবং মান অসমিয়াতে উত্তর দন্তমূলীয় ধ্বনি নেই।
প্রাক-শক্ততালব্য ধ্বনি: তালুর সর্বোচ্চ অংশ বা মূর্ধার ঠিক আগের নরম তালুতে জিহ্বাপ্রান্ত শ্বাসবায়ুকে বাধা দিলে এই ধ্বনিগুলো উচ্চারিত হয়।বাংলা ‘ট,ঠ,ড,ঢ,ড়,ঢ়’ এই শ্রেণির ধ্বনি।প্রথাগত ব্যাকরণে এগুলোকে সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুসরণে মূর্ধন্য ধ্বনি বলা হয়।কারণ জিহ্বা প্রান্ত শক্ত তালু তথা মূর্ধাকে স্পর্শ করে এই ধ্বনিগুলো উচ্চারিত হত।এবং তা করতে গিয়ে জিহ্বাপ্রান্ত সামান্য পেছন দিকে বেঁকে যেত বলে এই ধ্বনিগুলোর আরেক নাম প্রতিবেষ্টিত (Retroflex)।সংস্কৃত মূর্ধন্য ধ্বনির তালিকাতে তাই ‘ণ,ষ’ ছিল বা আছে।কিন্তু বাংলাতে মূর্ধা অব্দি জিহ্বাপ্রান্ত এগোয় না বলে প্রকৃত মূর্ধন্য ধ্বনি বাংলায় নেই।‘ণ,ষ’এর স্বতন্ত্র কোনো উচ্চারণ নেই।তারা ‘ন,শ’এর সঙ্গে একীভূত হয়েছে।শুধু বানানে ব্যবহার আছে বলে বর্ণমালাতে আছে এগুলো।তার বদলে বাংলা প্রাক-শক্ততালব্য ধ্বনি তালিকাতে /ড়,ঢ়/ যুক্ত হয়েছে, যে দুটি ধ্বনি সংস্কৃতে ছিল না।অসমিয়াতে এই ধ্বনিই দন্তমূলীয় ধ্বনির সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছে।‘ড়’ উচ্চারণে ‘র’এর সঙ্গে একীকৃত হয়ে গেছে, আর বানানেও শর্ত মেনে চলে।‘ঢ়’-কে ‘র’ আর ‘হ’-তে মিলে সংযুক্ত ব্যঞ্জন বলেছেন গোলকচন্দ্র।অর্থাৎ ‘র’-এর মহাপ্রাণ।এবং বানানে শর্ত মেনে চলে,শব্দের আদিতে বসে না।এহেন শর্তাধীন হয়ে অসমিয়াতে দন্তমূলীয় ধ্বনিগুলোর মূর্ধন্য উচ্চারণ হয়ে থাকে।গোলোক চন্দ্র লিখেছেন,“ৰ-অর পাচতে এই ধ্বনিবোৰক পৰিবেশজনিত মূর্ধন্য ধ্বনিরূপে পোয়া যায়।”৫৫জগন্নাথ চক্রবর্তীর মতে কাছাড়ের বিভাষাতে ধ্বনিগুলো মূর্ধন্যই।কিন্তু বিশেষ যুক্তি দেন নি।যদিও ‘ঢ়’ এবং নাসিক্য ‘ণ’ সম্পর্কে তিনি নীরব।‘টাটুয়া,ঠনকা,ডেং,ঢর,ঘাড়া’ শব্দগুলো নজির হিসেবে উল্লেখ করেছেন।আবিদ রাজা মজুমদার ‘ড’কে হঠাৎ করে তালব্য ধ্বনি বলে লিখেছেন৫৬ কিন্তু ‘ঢ’ যে অবরুদ্ধ ‘ড’’ এই কথা মনে রেখেও উচ্চারণ স্থান লিখেছেন ‘অগ্রতালু’,মানে ‘প্রাক শক্ততালু’।‘ট,ঠ’–এর উচ্চারণ স্থান তিনিও ‘মূর্ধা’ই লিখছেন।কিন্তু ‘ট’ সম্পর্কে,“বরাক উপত্যকার কথ্য আঞ্চলিক বাংলা ভাষায় এই বর্ণ উচ্চারণে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য শোনা যায় না”৫৭ লিখে একটা ‘ধোঁয়াশা’ রেখে দিয়েছেন।বৈদিক আর্য,প্রাচীন দ্রাবিড়,না বাংলা--- কার থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কথা তিনি লিখলেন? আমাদের মনে হয় শেষেরটিই সম্ভব।তাই যদি হয়,তবে সিলেটিতেও ধ্বনিগুলো মান বাংলার মতোই প্রাক শক্ততালব্যই।অন্যরকম ভাবতে গেলে অনুরূপ যুক্তি লাগবে।জগন্নাথ চক্রবর্তী ‘ড়’ ধ্বনির স্পষ্ট উচ্চারণ রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন।নিখিলেশ পুরকাইত সিলেটি সম্পর্কে স্পষ্টই লিখেছেন ‘ড়,ঢ়’ ‘র’ হয়ে যায়,৫৮ কাছাড়ি প্রসঙ্গে কিছুই লেখেন নি।‘হ’-কার লোপ প্রসঙ্গে ‘উড়াউড়ি’ শব্দের নজির দিয়েছেন৫৯।আমাদের মনে হয় জগন্নাথ সঠিকই লিখেছেন।সত্য বটে পূর্ববঙ্গের বহু ভাষাবৈচিত্র্যেই ‘ড়’ এর ‘র’-কার প্রবণতা প্রবল।কিন্তু ‘লড়া’,‘পড়া’,‘লাবড়া’,‘কড়াই’ শব্দগুলো মোটেও উচ্চারণে ‘লরা’,‘পরা’,‘লাব্রা’,‘করাই’ নয়।নোয়াখালির কোথাও কোথাও ‘ড়’ ধ্বনিটি শোনা যায় বলে রবীন্দ্র কুমার লিখেছেন।৬০ চট্টগ্রামীতে ‘ড়’এর বদলে ‘ড’ ব্যবহৃত হয়।তবে তিনি পারিভাষিক শব্দ ‘তালু পশ্চাৎ দন্তমূলীয়’ লিখে মনে হয় না মান বাংলা ধ্বনিগুলো থেকে আলাদা কিছু বুঝিয়েছেন।তেমনি আব্দুল হাই ঢাকার উপভাষাতে ‘ট-বর্গীয় দন্তমূলীয় মূর্ধন্য ধ্বনি’ কথাটি লিখে আমাদের বেশ সমস্যাতে ফেলেছেন।৬১ মনে হয় না তিনিও পারিভাষিক শব্দে রবীন্দ্র কুমার দত্তের থেকে আলাদা কিছু বুঝিয়েছেন।কিন্তু যে সূত্রটি কেউ মনে রাখেন নি, সুধাংশু শেখর তুঙ্গ ছাড়া---সে হলো অঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনি ঠ /ʈh/ অক্ষত থাকবে কিনা।সিলেটিতে ধ্বনিগুলোকে তিনি মূর্ধন্য বলেনি,বলেছেন অধিকাংশ নব্য ভারতীয় আর্যেই এমন কি অসমিয়াতেও দন্তমূলীয় প্রতিবেষ্টিত (alveolo retroflex)৬২। অসমিয়ার তত্ত্ব আমরা নাকচ করতে পারি।যেটি গ্রহণ করতে পারি,সে হলো কাছাড়ের বাংলাতেও ধ্বনিগুলো অক্ষত আছে। শুধু ‘ট,ঠ’ পরস্পর জায়গা বদল করে ফেলে।“ … a Cach.Beng. /ṭ/ is a /ṭh/ in stand.Beng. and a stand.Beng. /ṭ/is a /ṭh/ in Cach.Beng. although as it is already said,aspiration is a little less in the former.”৬৩ তিনি কয়েকটি উদাহরণ দিয়েছেন এরকম:
কাছাড় বাংলা মান বাংলা
k’uṭhi khūṭi pole
xuṭi kuṭhi hut
ϕaṭha phaṭa cracked
faṭa pāṭha goat
শব্দ চারটি আমরা জগন্নাথ চক্রবর্তীর অভিধানে পেলাম এরকম: খুটা/খুটি/khuṭɑ/< সং কূট,কুটা/kuṭɑ/ (আঁকশি);ফাটা /fɑṭɑ/।আবিদ রাজার অভিধানে পাচ্ছি: খুটা/খুটি (স্তম্ভ),কুটা (আঁকশি);ফাটা;পা̊’টা (পাঁঠা)।/xuṭi/পাওয়া গেল না,কিন্তু আবিদ রাজার মজুমদারের অভিধানে ‘কুটুরি’ (কুঠুরি )পাওয়া গেল।দেখা যাচ্ছে ‘ট’ ‘ঠ’ হচ্ছে না,কিন্তু ‘ঠ’ অবশ্যই ‘ট’-প্রায় হচ্ছে।অর্থাৎ দুই ধ্বনির মধ্যে রদবদলের সূত্র খাটছে না।কিন্তু মহাপ্রাণ ধ্বনির ‘মধ্যপ্রাণীভবনে’র সূত্র খাটছে।এবং ‘বহিঃস্ফোটক’ বা ‘উদ্গীর্ণ’ ধ্বনিতে পরিণত হচ্ছে।শব্দের শুরুতে ‘ঠ’ /ʈh/ থাকলেও,মাঝে এবং শেষে ‘ট’’ /ʈ’/ কিংবা ট /ʈ/ হচ্ছে।/k’uṭhi,xuṭi, ϕaṭha,faṭa/ শব্দগুলো আসলে হবে /khuʈi,kuʈi,fɐʈɐ,ˀpɐʈ’ɐ/।কুটা /kuʈɐ/,কিন্তু কুটা’ /kuʈ’ɐ/(কোঠা)।কু’টা/k’uʈɐ/ও হতে পারে,‘কথ্য বাংলার অভিধানে’ এইভাবেই আছে শব্দটি।নির্ভর করবে শ্বাসাঘাত কই পড়ছে।
তালুদন্তমূলীয় ধ্বনি: জিহ্বার সামনের পাতলা অংশ তথা জিহ্বা ফলক শক্ততালু এবং দন্তমূল দুটোকেই দুইয়ের সংযোগস্থলে স্পর্শ করে শ্বাসবায়ুকে বাধা দিয়ে তালুদন্তমূলীয় ধ্বনিগুলো সৃষ্টি করে।বাংলা /চ,ছ,জ,ঝ,শ,য়/এই শ্রেণির ধ্বনি।সংস্কৃতে তালুদন্তমূলীয় ধ্বনি নেই,ছিল তালব্য ধ্বনি,কেননা জিহ্বাপ্রান্ত শক্ততালুতে শ্বাসবায়ুকে বাধা দিয়েই এই ধ্বনিগুলো উচ্চারণ করত/ চ,ছ,জ,ঝ,ঞ,য়/।অসমিয়া পরম্পরাগত ব্যাকরণে এগুলোকে বাংলার মতোই সংস্কৃতের অনুসরণে তালব্য ধ্বনি বলা হলেও বাস্তবে অসমিয়াতে ‘য়’কে তালব্য ধ্বনি বলে চিহ্নিত করেছেন গোলকচন্দ্র,বাকিগুলো দন্তমূলীয় ‘স,য’এর মতো একই।কিন্তু ‘চ,ছ,জ,ঝ’ উচ্চারণে মান বাংলাতে প্রথমে স্পর্শধ্বনির মতো জিহ্বা উপরের উচ্চারকে পূর্ণ বাধার সৃষ্টি করে,পরে উষ্মধ্বনির মতো আংশিক বাধাতে পরিণত হয় বলেই এদের ঘৃষ্ট ধ্বনি বলে।উপরের উচ্চারক বাধার স্থানঅনুযায়ী এদের নাম হয়।সুকুমার সেন লিখেছেন,“স্পৃষ্ট ব্যঞ্জন এবং উষ্মধ্বনি যুগপৎ উচ্চারিত হইলে ঘৃষ্ট ধ্বনির উৎপত্তি হয়”৬৪।রামেশ্বর শ’ও একই কথা লিখেছেন,“সহজ কথায় ঘৃষ্টধ্বনি হলো স্পর্শধ্বনি ও ঊষ্মধ্বনির যৌগিক রূপ”৬৫ তাই তিনি যখন বাংলা ব্যঞ্জনের ছক তৈরি করেছেন (চিত্র০১ ক,খ)৬৬ তখন ঘৃষ্ট ধ্বনিকে প্রতিহত এবং প্রবাহী ধ্বনির মাঝে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন।এদিকে অসমিয়া অভিজ্ঞতার থেকেই মনে হয় গোলোকচন্দ্র এদের উষ্মধ্বনিরই প্রকারভেদ বলে ভেবেছেন,“ঘৃষ্ট ধ্বনিক উষ্মধ্বনি বোলে।”৬৭ অসমিয়া ভাষাতে কি জিহ্বাফলক উপরের উচ্চারকের কোনো অংশকে স্পর্শ করে না? করতে করতেই কি শ্বাসবায়ু ঠেলে ঘসে বেরিয়ে যায়? গোলকচন্দ্র গোস্বামী কিন্তু এর স্পষ্ট জবাব দেন নি।কিন্তু লিখেছেন,“বায়ুপ্রবাহত ঘর্ষণ হয় কারণে এনে উষ্মধ্বনিবোরক ঘৃষ্ট ধ্বনিও বোলে।”৬৮এখন,আমাদের কাছে সমস্যা হলো ভাষাভেদে কি ভাষাতত্ত্ব ভিন্ন হবে? মান বাংলার সঙ্গেও এদের আরো অমিল আছে।জটিলতাও কম নেই।যেমন ‘চ-ছ’,‘জ-ঝ’ এবং ‘য’ উচ্চারণে প্রায় একই।অন্য ব্যঞ্জনের সঙ্গে উচ্চারিত হলে ‘শ,ষ,স’ এর উচ্চারণ ‘চ’এর মতোই হয়।অথবা উলটো-- ‘চ’ এর উচ্চারণ অসমিয়াতে ‘স’এর মতো হয়।এই নিয়ে তাই পরে ঘৃষ্ট ধ্বনি প্রসঙ্গে আমরা আরো আলোচনা করব।আপাতত জানা
রইল,অসমিয়াতে তালুদন্তমূলীয় বলে কোনো ধ্বনি নেই।
জগন্নাথ চক্রবর্তীর মতে সিলেটি ‘চ,ছ’ /cʃ,cʃɦ/ তালু দন্তমূলীয়,‘জ,ঝ’/ɈƷɈƷ,ɈƷɦ/ তালব্য ধ্বনি।৬৯ ‘চ’ কখনো বা ‘স’এর মতো।‘ছ’ কখনোই নয়।এই ‘স’ কি দন্ত্য ধ্বনি,না অসমিয়ার মতো দন্তমূলীয়? ‘ছ,ঝ’এর উচ্চারণ ‘উষ্ণ প্রভাবান্বিত’। “‘চ’ বর্গের ব্যঞ্জনধ্বনিগুলো ঘর্ষণ ও উষ্মতার জন্য উচ্চারণে বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্র হয়ে আছে বরাকে। আঞ্চলিক বা ঔপভাষিক লক্ষণ হিসেবে তা খুবই উল্লেখ যোগ্য”৭০ ---শুধু মাত্র ঘর্ষণ বা উষ্মতার মধ্যে কোনো স্বাতন্ত্র্য আমাদের বোধে ধরা পড়ে নি।কারণ ঘৃষ্টধ্বনির ধর্মই এই।অথচ,তাঁর গ্রন্থের ব্যাকরণ ভাগে ধ্বনিগুলোকে তিনি সংস্কৃতের মতো ‘স্পৃষ্ট’ বলেছেন।অন্য প্রায় সবাই সিলেটি ‘চ,ছ,স’এর উচ্চারণ সাম্যের কথা লিখেছেন এবং জ এর উচ্চারণ /z/ হয় বলে লিখেছেন।৭১ ‘ঝ’ এর কথা লেখেন নি।এই তত্ত্ব কিন্তু সিলেটি-অসমিয়াকে এক করে।
সিলেটি নাগরি উচ্চারণোনুসারী বর্ণমালাতে ‘চ,ছ,জ,ঝ’-র উপস্থিতি দেখে মনে করবার কারণ আছে জগন্নাথ হয়তো সঠিক বলছেন।সিলেটি নাগরিতেও ‘য’ নেই।জগন্নাথও ‘য’ নিয়ে তাঁর অভিধানে কোনো স্তম্ভই রাখেন নি।আবিদ রাজা মজুমদার তাঁর অভিধানের শুরুতে ধ্বনি চারটির সঙ্গে ‘য’কেও তালব্য ব্যঞ্জন বলে লিখলেও৭২ ভেতরে নির্দিষ্ট বর্ণ দিয়ে শব্দক্রমের শুরুতেই বর্ণগুলোর পরিচয় দিতে গিয়ে ‘চ’কে৭৩ অগ্রতালব্য-দন্তমূলীয় ঘৃষ্ট,‘ছ’কে তালুদন্তমূলীয়৭৪,‘জ’কে দন্ত্যতালব্য৭৫ এবং ‘য’কে তালব্য বর্ণ বলে লিখেছেন৭৬।‘ঝ’কে স্পষ্ট চিহ্নিত করেন নি,কিন্তু বিশ্লেষণ দেখে অগ্রতালব্য ঘৃষ্ট বলে ধরা যায়৭৭ প্রথম চারটির উচ্চারণ আলাদা বোঝাতে তিনি সবক’টির উপরে বিন্দু বসিয়েছেন যেখানেই ধ্বনিগুলো রয়েছে। আমরা তার বদলে প্রায়োগিক অসুবিধের জন্যে একটি ঊর্ধ্ব-পার্শ্ব বৃত্ত দিয়ে কাজ চালাবো এভাবে ‘চ̊,ছ̊,জ̊,ঝ˚’।‘য’ নিয়ে একটি স্তম্ভ তিনি আলাদা করে অভিধানে রাখলেও পরে আমরা দেখাব,‘জ,ঝ’এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন। দেখা যাচ্ছে সিলেটিতেও ধ্বনিটি নিয়ে বেশ জটিলতা রয়েছে।এবং অসমিয়ার মতোই মান বাংলার ‘ঘৃষ্টধ্বনি’ তত্ত্ব ভেঙ্গে পড়ছে। এই জট আমরা পরে খুলবো। সরলরৈখিক পথে এই জাল ছিঁড়ে বেরোনোই কঠিন।
এখানে এই তথ্যও উল্লেখ থাকা ভালো যে সংস্কৃতে ঘৃষ্ট ধ্বনি বলে কিছু ছিল না।চ-বর্গীয় ধ্বনিগুলো তালব্য স্পর্শধ্বনি মাত্র। সেগুলো আদি মধ্যভারতীয় আর্যে শুধু কালিক বিবর্তনে নয়,সংস্পর্শে আসা দেশী-বিদেশী ভাষার প্রভাবেও ‘ঘৃষ্ট’ হতে শুরু করে।“The OIA. Palatal stops [c,ch,ɟ,ɟɦ] became palatal affricate in Eastern India as early as First MIA. Period”৭৮পশ্চিম বাংলাতে পালি-প্রাকৃতের এই বৈশিষ্ট্য অক্ষত থেকে গেছে।“This value is preserved in West Bengali;…”৭৯ কিন্তু ,“ in North and East Bengali, they have been further modified to the dental affricate and sibilants [t͜s,s,d͜z,z]”৮০ অর্থাৎ স্পৃষ্ট ধ্বনি শুধু যে শিস ধ্বনিতে রূপান্তরিত হচ্ছে তাই নয়,তালব্য ধ্বনি থেকে দন্ত্য ধ্বনিতে রূপান্তরিত হচ্ছে।বিষয়টি এতোই জটিল যে সুকুমার সেন যেখানে ভারতীয় আর্যভাষার বিভিন্ন স্তরের লক্ষণ চিহ্নিত করছেন, চ-প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেছেন৮১।মুহম্মদ শহীদুল্লাহও তাই করেছেন৮২,শুধু বাংলা ‘চ’-বর্গের বিবর্তন সামান্য ব্যাখ্যা করেছেন।কিন্তু বাংলার প্রাচ্য উপভাষার সম্পর্কে--- যার মধ্যে সারা বাংলাদেশই রয়েছে---লিখতে গিয়ে “তালব্য বর্ণ স্থলে দন্ত-তালব্য ঘৃষ্ট বর্ণ”৮৩ রয়েছে বলে লিখেছেন।তার মানে তাঁর মতে মানবাংলা ধ্বনিগুলো তালব্যই। সুকুমার সেনও মান বাংলা ধ্বনিকে তালব্যই বলছেন।“বাঙ্গালা (ও নব্য আর্য ) চ(=ক̖শ),জ (=গজ̖)”৮৪ তালব্য-ঘৃষ্ট ধ্বনি।“কোনো কোনো নব্য আর্য ভাষায় চ [=ৎস], জ [দজ·]”৮৫ হচ্ছে দন্ত্য ঘৃষ্ট। দন্তমূলীয় ঘৃষ্ট বলছেন ইংরেজি ‘চ(ts),জ(dz)কে।তালু –দন্তমূলীয় কেবলই ইংরেজি [চ,জ] এবং “আমাদের [ষ,শ]”৮৬।মান বাংলা ধ্বনিগুলোকে ‘তালুদন্ত্যমূলীয়’ লিখেছেন রামেশ্বর শ’। এইটুকুনই শুধু কারণ দেখিয়েছে যে ধ্বনিগুলো উচ্চারণের সময় শক্ততালু বা দন্তমূল অথবা দুইএরই সংযোগ স্থলকে স্পর্শ করে বলে ধ্বনিগুলোর এই নাম।৮৭ ধ্বনিগুলো তালব্য নয় কেন সেই ব্যাখ্যা করেন নি।কিন্তু আমরা কেন তাঁর মতকেই গ্রহণ করলাম এর একটি ব্যাখ্যা দরকার নতুবা কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না।
তিনি ব্রিটিশ ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক জে.ডি ও’ কোনোর-এর ‘Phonetics’ বই থেকে একটি মন্তব্য ভাবানুবাদ করে লিখেছেন,“পৃথিবীর সব ভাষার সব ধ্বনির বর্ণনা তো আমরা দিতেই পারি না, এমন কি কোনো একটি ধ্বনিরও সব দিকের বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়।”আরো লিখেছেন,“ ...বাগধ্বনির এত সব জটিল সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বৈচিত্র্য রয়েছে যে তাদের সব গুলির বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব;তাদের কয়েকটি মোটামুটি শ্রেণিতে ভাগ করে শুধু সেই সব শ্রেণি সম্পর্কে আলোচনা করাই সম্ভব।দ্বিতীয়ত,কোনো ধ্বনির বিভিন্ন দিকের বৈজ্ঞানিক বর্ণনাও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দিতে গেলে তা অতি বিস্তৃত হয়ে যায়,অথচ তাতেও নিজের মনে একটা অপূর্ণতার অসন্তোষ জেগেই থাকে।”৮৮ ভাষাবিজ্ঞানের আলোকে ধ্বনির শ্রেণিবিভাজন নিয়ে লিখছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে এমন স্পষ্ট স্বীকারোক্তি।আশা করছি এতে শুধু চ-বর্গ নিয়েই নয়,ধ্বনি-নিরপেক্ষভাবেই আমাদের যে সমস্যাগুলো হচ্ছিল,এই এক উক্তিতে তিনি সেই সব জটই যেন একটানে খুলে দিলেন।কিন্তু শ্রেণিবিভাজন তিনি নিজেও করেছেন,অন্যকেও করতে মানা করেন নি।শুধু পথ নির্দেশটুকু করেছেন,এই লিখে যে,“সুতরাং ধ্বনির বর্ণনা এবং শ্রেণীবিভাগে মনে রাখতে হবে ধ্বনির কোনো বর্ণনাই পূর্ণাঙ্গ (exhaustive) নয়,আর ধ্বনির সবদিক অবলম্বন করে নির্ণয় করাও সম্ভব নয়।বৈজ্ঞানিক আলোচনার জন্য তার প্রয়োজনও নেই।ধ্বনির শুধু তাৎপর্যপূর্ণ দিকের বর্ণনা দেওয়াই সম্ভব এবং বৈজ্ঞানিক আলোচনায় তার আলোকে শ্রেণীবিভাগই বাঞ্ছিত।”৮৯ তাই বলে কি আমরা যথেচ্ছ কোনো ধ্বনিকে তালব্য,দন্ত্য,দন্তমূলীয়,তালু দন্তমূলীয় বলতে পারি?অসমিয়ার সঙ্গে মান বাংলা বা সিলেটির সম্পর্কটাই বা সুচিহ্নিত হবে কী করে? আমাদের কাছে এটাই তাৎপর্যপূর্ণ এবং সমস্যাটির মীমাংসা আমাদের প্রয়োজনীয়।
দন্ত্য বা দন্তমূলীয় প্রসঙ্গটি ঘৃষ্ট –উষ্ম বিরোধ মীমাংসার আগে স্পষ্ট করা কঠিন। আপাতত কাজটি স্থগিত রেখে আমরা তালব্য-তালুদন্ত্যমূলীয় বিরোধে রামেশ্বর শ’এর সংজ্ঞা এর জন্যেই গ্রহণ করতে পারি যে তিনি আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের আলোকে সমস্যাটিকে দেখবার চেষ্টা করেছেন।অন্যথা,চুলচেরা বিশ্লেষণের দরকার পড়বে।সুনীতি চট্টোপাধ্যায়,সুকুমার সেন,মুহম্মদ শহীদুল্লাহদের ভাষাবিজ্ঞানে বিশাল সব অবদানের কথা মনে রেখেও,আমাদের মনে রাখা ভালো যে তাঁরা ছিলেন মূলত ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের লোক।বাংলাতে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের যথার্থ সূচনাই হয় বাংলাদেশে ষাটের দশকে।সুনীতিকুমার, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ,ও সুকুমার সেনেরা এবং তাঁদের প্রভাবে দীর্ঘদিন ভাষার ইতিহাসের উলম্ব বিবর্তনের বাইরে আনুভূমিক তুলনামূলক অধ্যয়ন বিশেষ হয় নি বলে হুমায়ুন আজাদ যে স্পষ্টই লিখেছেন সেই কথা আমরা প্রথম অধ্যায়ে উল্লেখ করে এসেছি।ব্যাকরণ লিখতে বসেও তাঁরা অনুসরণ করেছেন প্রথাগত ইংরেজি ও সংস্কৃত ব্যাকরণ প্রণেতাদের ।‘এ ব্রিফ স্কেচ অফ বেঙ্গলি ফোনেটিক্স’ বইতে ১৯২১শেই সুনীতিকুমার আধুনিক ধ্বনিতত্ত্বের সূচনা করলেও “বাঙলা ধ্বনিশৃঙ্খলার ব্যাপক- গভীর বর্ণনায় প্রবেশ করেন নি”৯০।কিন্তু তারপরেও আমরা রামেশ্বর শ’এর ব্যবহৃত ধ্বনিবৈজ্ঞানিক চিহ্নগুলোকে গ্রহণ করতে পারছি না।তিনি লিখেছেন,/cʃ,cʃh,ɟƷ,ɟƷh/। শুধু সংস্কৃত তালব্য ‘জ,ঝ’কে লিখেছেন সামান্য অন্যভাবে /ɈƷ,ɈƷh/। জগন্নাথ চক্রবর্তী রামেশ্বর শ’এর ব্যবহৃত এই সংস্কৃত বর্ণলিপিগুলোকেই সিলেটির জন্যে ব্যবহার করেছেন।অথচ,ধ্বনিগুলোকে ‘ঘৃষ্ট’ নয়,‘তালব্য স্পৃষ্ট’ ধ্বনির তালিকাতে রেখেছেন।‘ঘৃষ্ট’ধ্বনি নিয়ে আলাদা করে কোনো আলোচনাও করেন নি।যদি স্পৃষ্টই হয়,তবে বর্ণলিপি হওয়া উচিত ছিল এরকম [c,ch,ɟ,ɟɦ]।জগন্নাথ পুরো ব্যাপারটিই গুলিয়ে ফেলেছেন।মানবাংলা তালব্যধ্বনি ঘৃষ্ট বলেই সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সঠিক ভাবেই ব্যবহার করেছেন এই চিহ্ন গুলো- /c͡ʃ,c͡ʃh,Ɉ͡Ʒ,Ɉ͡Ʒɦ/। /c,ɟ./হচ্ছে ধ্বনিগুলোর স্পৃষ্ট অংশের সূচক।/ʃ,Ʒ/ উষ্ম।তালব্য এবং তালুদন্তমূলীয় ধ্বনির সূচক এক হয় কী করে?আমরা তাই আই পি এ তালিকা ব্যবহার করে রামেশ্বর শ’ কথিত মানবাংলা ধ্বনিগুলো শুদ্ধ করে লিখছি এইভাবে /t͡ʃ,t͡ʃh,d͡Ʒ,d͡Ʒɦ/।এবারে আমাদের সিলেটি ধ্বনিগুলো নিয়ে কথা বলা সহজ হয়ে যাবে। আপাতত স্থগিত রইল।
চট্টগ্রামী নোয়াখালিতেও ধ্বনি চারটিকে তালু দন্তমূলীয়ই লিখছেন রবীন্দ্র কুমার দত্ত।৯১তালব্য বলে কোনো ধ্বনিই নেই তাঁর তালিকাতে।নোয়াখালির খণ্ডল অঞ্চলে এবং দক্ষিণ ত্রিপুরার বাইরে ‘ঝ’ নেই বলেই লিখছেন।তার মানে ধ্বনিটি প্রধান ধ্বনি নয়।তার বদলে ‘ জ̣’’/z’/ ধ্বনিটি আছে। আর আছে ‘চ̖̣,ছ̖̣ ,জ̣̖’ /ch,tch,z’/ এবং ‘য়’/gˊ/। তিনি ‘ৎস’/ts/ বলে আরেকটি ধ্বনির কথা উল্লেখ করে সম্মুখ দন্তমূলীয় বলে চিহ্নিত করেছেন।৯২ কিন্তু বইয়ের শেষে যখন দুই ভাষাবৈচিত্র্যের কিছু শব্দ তালিকা দিয়েছেন,সেখান ‘চ’ দিয়ে কোনো শব্দই নেই,সবই ‘ৎস’ দিয়ে।ধ্বনিগুলো নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা আমরা পরে ঘৃষ্ট ধ্বনি এবং শিস ধ্বনি প্রসঙ্গে করব।কিন্তু একটা সিদ্ধান্তে যেতেই পারি যে মান বাংলার থেকে শুধু সিলেটি ধ্বনিগুলোই অপসৃত হয় নি।বাংলার অন্য ভাষাবৈচিত্র্যের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে।এবং ‘ছ,ঝ’ অসমিয়ার মতো সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয় নি ।
স্নিগ্ধতালব্য বা কণ্ঠ্যধ্বনি: তালুর পশ্চাৎভাগ তথা স্নিগ্ধতালুতে জিহ্বা তার পশ্চাৎভাগ দিয়ে শ্বাসবায়ুকে বাধা দিয়ে যে কটি ধ্বনি তৈরি করে সেগুলোকে স্নিগ্ধতালব্য ধ্বনি বলে।বাংলাতে এগুলো কণ্ঠ্যধ্বনি বলে পরিচিত হলেও রামেশ্বর শ’র মতে সূক্ষ্মবিচারে এগুলোকে কণ্ঠ্যধ্বনি বলা ঠিক নয়,কেননা কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয় না।৯৩বাংলা-সংস্কৃত দুইয়েতেই এগুলো স্নিগ্ধতালব্য ধ্বনি, ‘ক,খ,গ,ঘ,ঙ’। গোলোকচন্দ্রও অসমিয়াতে এই ধ্বনিগুলোকে কণ্ঠ্যধ্বনি বলেন নি। একই উচ্চারণ স্থানের এবং প্রক্রিয়ার উল্লেখ করে ‘অসমিয়া ব্যাকরণ প্রবেশ’-এ ‘কোমল –তালব্য’ বলে লিখেছেন,কিন্তু ‘অসমিয়া বর্ণ প্রকাশে’ এবং ‘ধ্বনি-বিজ্ঞানের ভূমিকা’তে লিখেছেন ‘পশ্চতালব্য’।শেষেরটিতে আরো গভীরে বিশ্লেষণ করে অগ্র-পশ্চতালব্যও লিখেছেন।এমন পারিভাষিক শব্দগুলোর বৈচিত্র্য তুলনামূলক অধ্যয়নে বেশ বিপাকে ফেলে।তবে এই দুটোরই বাংলা প্রতিশব্দ ‘স্নিগ্ধতালব্য’ই বটে।রামেশ্বর শ’ স্নিগ্ধতালুর বিকল্পে ‘তালুর পশ্চাৎ-দিকের নরম অংশ’ কথাটি লিখেছিলেন।৯৪ অসমিয়া ‘হ’কে গোলোকচন্দ্র এবং পরবর্তী ভাষাবিজ্ঞানীরা ঘৃষ্ট-সঘোষ ‘কণ্ঠ্য ধ্বনি’ বলেই তালিকা বদ্ধ করেছেন।কিন্তু আসলে বুঝিয়েছেন Glottal ধ্বনিকে।এই কণ্ঠ্য --- স্নিগ্ধতালব্য নয়।সিলেটিতে ‘ক,খ,গ,ঘ’ এর উচ্চারণ স্থান নিয়ে জগন্নাথ চক্রবর্তী যা লিখেছেন তা বেশ গোলমেলে।‘জিহ্বামূলীয় স্পৃষ্টধ্বনি’ পারিভাষিক শব্দে ঊর্ধ্বস্থ উচ্চারকের উল্লেখ নেই।পরে,“জিভের গোড়ার দিক নরম তালুর মধ্য ও সামনের অংশ স্পর্শ” করে বলে লিখেছেন।৯৫ নরম তালুর মানে আমরা স্নিগ্ধতালব্য করতেই পারি।“‘ক’ উচ্চারণে শ্বাসবায়ু সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে না, অল্প বায়ু নির্গত হয়ে যায়।ফলে উষ্মতার মিশ্রণ ঘটে।”৯৬‘ঘ’ উচ্চারণে“মান্য বাংলার ঘোষ উচ্চারণ আংশিক রক্ষিত। শুধু ঘোষবত্তার যে গাম্ভীর্য তা এখানে অণুমাত্র কমে যায়।”৯৭ অর্থাৎ ‘ক’ ভিন্ন অন্য ধ্বনিগুলোর ক্ষেত্রে তিনি উপরের এবং নিচের উচ্চারকের মধ্যে স্পর্শের অভাবের কথাটি স্বীকার করছেন না।আবিদ রাজা মজুমদার লিখছেন ধ্বনিগুলো ‘স্পৃষ্ট ও অধিক উষ্মীভবনে আপ্লুত”৯৮।অভিধানের ভেতরে ‘ক’ধ্বনির উচ্চারণ স্থান কণ্ঠ্য লিখছেন।এর রূপবৈচিত্র্য সম্পর্কে লিখছেন,“কখনো অগ্রতালু কণ্ঠ্য ঊষ্মরূপে উচ্চারিত হয় ।”৯৯ কিন্তু অভিধানে তিনরকম ‘ক’ রয়েছে---উপরে বিন্দু দিয়ে ‘ক’ যেটি আমরা দেখাতে পারছি না বলে উর্ধ্বপার্শ বৃত্ত দিয়ে বোঝাচ্ছি ‘ক̊ এবং ‘ক,ক’ ’।‘খ’ সম্পর্কে লিখছেন,‘কণ্ঠ্য’, ‘উষ্ম এবং ঘৃষ্ট’।“অবশ্য আদ্যক্ষরে স্বরবর্ণ যুক্ত থাকলে এ বর্ণের উচ্চারণ মহাপ্রাণ কণ্ঠ্য হয়।”১০০ অভিধানে ‘খ’-এরও দু’টি রূপবৈচিত্র্য রয়েছে,‘খ̊,খ’। ‘গ’কেও কণ্ঠ্য বলছেন এবং এরও দুই রূপবৈচিত্র্য রয়েছে অভিধানে – ‘গ,গ’ ’।এর মধ্যে ‘গ’ ’ টি আসলে মান বাংলা ‘ঘ’-এর সিলেটি রূপবৈচিত্র্য। যেমন গ’র(< ঘর),গা’ইয়াড়ি (< ঘাই+হাড়ি)।মান বাংলা ‘ঘ’-এর উচ্চারণ স্থান নিয়ে যা লিখেছেন তাতে স্পষ্ট তিনি ব্যাকরণ নিয়ে গভীরে গিয়ে ভাববার সুযোগ পান নি।‘ঘ’-এর “উচ্চারণ স্থান কণ্ঠের অগ্রভাগের জিহ্বামূল”১০১ হতে পারে না।পরে অবশ্য সঠিক ভাবেই বরাক উপত্যকার ভাষাতে ‘ঘ’ ধ্বনি লিখেছেন,“শ্বাসবায়ুর প্রক্ষেপণ দ্বারা ‘ঘ’ বর্ণের যে উচ্চারণ পাওয়া যায় সেই প্রক্ষেপণ সংযত করত: জিহ্বামূল দ্বারা পশ্চাৎতালু ঈষৎ স্পর্শ করে তরল উচ্চারণের স্থলে স্থিতমুখী উচ্চারণ দ্বারা এ অঞ্চলে এই বর্ণ উচ্চারিত হয়। ‘গ’ এর স্বল্পপ্রাণ উচ্চারণ এবং ‘ঘ’এর মহাপ্রাণ উচ্চারণ এর মধ্যবর্তী ধ্বনিতেই এর উচ্চারণ এতদঅঞ্চলের কথ্য বাংলার বৈশিষ্ট্য।স্বল্পপ্রাণ ও মহাপ্রাণের মাঝখানে এর উচ্চারণ ‘মধ্যপ্রাণ’ প্রবণতা বলে অভিহিত করা যায়।”১০২ এই ‘মধ্যপ্রাণ’-এর ধারণাটি আবিদ রাজা মজুমদারের মৌলিক সংযোজন বলেই আমাদের মনে হয়। সিলেটি বর্গীয় বর্ণের চতুর্থ বর্ণ মানেই এই ‘মধ্যপ্রাণ’ ধ্বনি। কিন্তু উচ্চারণ স্থান নিয়ে এই দুই আভিধানিকই কিছু ধোঁয়াশা রেখে দিয়েছেন বলেই আমরা মনে করি।আমাদের মতে উচ্চারণ স্থানের দিক থেকে ‘ক,খ,গ’ মান বাংলা এবং অসমিয়ার মতো ‘স্নিগ্ধতালব্য’ ধ্বনিই। কিন্তু আবিদ রাজার রূপবৈচিত্র্যগুলোও মোটের উপরে সঠিক। ‘ক,চ,প’ বর্গের প্রথম ধ্বনির স্বরতন্ত্রী রূপও রয়েছে। যাকে আমরা ইতিমধ্যে রুদ্ধ-স্বরপথ (glottal stop) ধ্বনি বলে এসেছি।স্বরতন্ত্রী দু’টির পূর্ণ সংযোগের অবস্থান থেকে আকস্মিক বাধামুক্ত হয়ে ধ্বনিগুলো উচ্চারিত হয়।‘ক’ সম্পর্কে জগন্নাথের ‘শ্বাসবায়ু সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে না,অল্প বায়ু নির্গত হয়ে যায়’ কথার এই অর্থ বলেই আমাদের ধারণা।সিলেটি ‘ˀকালা’/ˀkɐlɐ/,ˀকাউয়া/ˀkauɐ/ শব্দে ‘ক’ এই ধরনের ধ্বনি।আবিদ রাজার উপরে বিন্দুর বদলে আমরা ( ˀ ) চিহ্নটি ব্যবহার করলাম।কিন্তু কিল /kil/ (ঘুসি),খিল /khil/(<কিলক) এই ধরনের শব্দে মান বাংলার মতো একই।ধ্বনি দুটি স্বতন্ত্র।কোনো অবস্থানে ‘ক এবং খ’-এর তফাতটুকুও লুপ্ত হয়ে অসমিয়া স/x/ধ্বনির মতোই উচ্চারিত হয়।যেমন দেখˀ/dex/,ˀপেক/ˀpex/। এই সব কারণে স্বরতন্ত্রী এবং উষ্মধ্বনি প্রসঙ্গেও ‘ক,খ’ নিয়ে আমাদের আরো আলোচনা করতে হবে। ক-এর আরো একটি ধ্বনিবৈচিত্র্য রয়েছে।কিলা/ kilɐ/ (ঘুসি মার), কিন্তু কি’লা/k’ilɐ/(কী রকম?)।এটি ফুসফুস বিচ্ছিন্ন বহিঃস্ফোটক ধ্বনি। যে রকম ‘গ’ ’ হচ্ছে ফুসফুসবিচ্ছিন্ন অন্তঃস্ফোটক ধ্বনি /ɠ/।সাধারণত ব্যঞ্জনের ঘোষত্ব বা মহাপ্রাণতা লোপ পেলে বা যুক্তব্যঞ্জনের একটি লোপ পেলে তার রেশ হিসেবে এই ধ্বনিগুলো উচ্চারিত হয়।চট্টগ্রামী নোয়াখালিতেও ধ্বনিগুলো স্নিগ্ধতালব্যই।‘ঘ’-এর মুক্তবৈচিত্র্য হিসেবে নোয়াখালিতেও অন্তঃস্ফোটক ‘গ’ ’ রয়েছে।চট্টগ্রামীতে ‘ঘ’ নেই,‘গ’ ’ আছে। পরের স্বরে ঊর্ধ্বস্বরাঘাত যুক্ত হয়।১০৩ যেমন গ́’র /ɠɔ́r/ (< ঘর)।১০৪
সুকুমার সেন লিখেছেন,চট্টগ্রামীতে,স্পৃষ্টব্যঞ্জনে ব্যাপক উষ্মীভবন লক্ষণীয়। যেমন কালীপূজা>খা·লী ফুˑজা (xali fuza)।সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়তো পূর্ববঙ্গীয় ভাষাবৈচিত্র্যগুলোতে ‘ক,খ’/k,kh/-এর যথেচ্ছ /x/ পরিণতির কথা লিখেছেন।কখনো বা /ɦ/,কখনো বা উষ্ম ‘গ’/ɣ/পরিণতির কথাও। /ɣ/ এর বদলে তিনি অনেকটা এইরকম চিহ্ন ব্যবহার করেছেন/g/।১০৫ আমরা আই পি এ-র শেষ তালিকার থেকে গ্রীকবর্ণ ‘গামা’ ব্যবহার করলাম।তার দেয়া নজিরে দেখা যাচ্ছে মধ্য অক্ষরে ‘k’ > ‘ɣ’ হচ্ছে।কিন্তু /x/ হচ্ছে যত্রতত্র।যেমন, ঢাকা [ɖɦɐkɐ,ɖɐɦɐ,ɖɐɣɐ,ɖɐxɐ]।তিনি লিখছেন,“Initial [k,kh] becomes the spirant [x] regularly in Eastern and South Eastern Vaŋga (Sylhet, Tipperah,Noalkhali and Chittagong): e.g.,কালী [kɑli]< [xɑɑ], কিছু [kic͡ʃhu]..”১০৬।আরো লিখেছেন, “Final [k] also found as [x] commonly enough: e.g.,তিলক [tilɔk]> [tilɔx],এক [æ:k]> [ɛx, hɛx, æ:x],etc.”১০৭দেখা যাচ্ছে/x/ধ্বনিটি ‘ক’-এর থেকেও পূর্ববাংলার বহু ভাষাবৈচিত্র্য লাভ করছে।কিন্তু সিলেটিতে আমাদের মনে হয় এতোটা ব্যাপক নয়। ‘ক,খ’-অন্ত শব্দেই ঘটনাটা ঘটে। তেমনি উষ্ম ‘গ’ (ɣ< k) সিলেটিতে নেই।
সর্বত্র ‘ক,খ’-এর /x/ না হবার আমাদের আরো একটি যুক্তি আছে।অসমিয়া ‘শঙ্কর,শাসন,শব্দ,সার’ ইত্যাদি যেকোনো একক শিসধ্বনি নিয়ে শব্দ উচ্চারণ করলেই বোঝা যাবে এগুলো ঠিক সিলেটি ‘ক,খ’ দিয়ে শুরু শব্দের মতো একই রকম উচ্চারিত হচ্ছে না।সিলেটিতে শব্দটি ‘খঙ্কর বা কঙ্কর’ লিখলেও কিছুতেই অসমিয়া ‘শঙ্কর’ উচ্চারণের কাছাকাছি যাবে না।‘কাখন’ লিখে সিলেটিকে অসমিয়া ‘শাসন’ শব্দের উচ্চারণ বোঝানো যাবে না।অসমিয়া ‘শেষ’ শব্দের উচ্চারণও সিলেটিতে ‘খেক’ লিখে বোঝানো কঠিন।কিন্তু অসমিয়া ‘দেশ’ আর সিলেটি ‘দেখ’ শব্দে কোনো সমস্যা নেই---দুটোই /dex/।মানবাংলা ‘খ’/kh/-এর থেকে অসমিয়া ‘খ’/kh/-এর উচ্চারণ ভিন্ন বলে কেউ লেখেন নি।কিন্তু অসমিয়া ‘খোৱা’ আর সিলেটি ‘খাওয়া,খাউয়া,খাউরা’ ইত্যাদি শব্দের ‘খ’ও একই রকম উচ্চারিত হয় না, হয় এরকম,/ˀkhɐŏɐ,ˀkhɐurɐ, ˀkhɐuĕɐ/।বিকল্পে একে ঘৃষ্ট ধ্বনি /kxh/ প্রস্তাব করতে হয়।সেটি অন্যান্য বর্গেও আরো সব জটিলতার সৃষ্টি করবে এবং নিবিড় পরীক্ষার অপেক্ষা রাখে এবং আমাদের পরিসর বিস্তৃত হয় বলে ভাবনাটি ছেড়ে দিয়ে আমরা বিরত রইলাম।
ওষ্ঠ্য-স্নিগ্ধতালব্য ও ওষ্ঠ্য-তালব্য ধ্বনি: দুই একটি ধ্বনি উচ্চারণের সময় শ্বাসবায়ু মুখবিবরের দুই জায়গাতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এ জাতীয় উচ্চারণকে দ্বৈত-উচ্চারণ বলে।১০৮ দ্বৈত-উচ্চারণের দুই প্রধান শ্রেণির একটিতে --- অধর এবং জিহ্বার পেছন ভাগ যখন একই সঙ্গে উপরে উঠে ওষ্ঠ এবং স্নিগ্ধতালুতে শ্বাসবায়ুকে বাধা দেয় তখন ওষ্ঠ্য-স্নিগ্ধ তালব্য ধ্বনি বাংলাতে ‘ওয়’ /ŏ/,হিন্দি এবং সংস্কৃত অন্তঃস্থ ব̖ (व) তৈরি হয়। গোলোকচন্দ্র গোস্বামী দ্বৈতউচ্চারণের আলোচনা ‘ধ্বনি-বিজ্ঞানের ভূমিকা’ গ্রন্থে বেশ বিস্তৃত করেও অসমিয়া অন্তঃস্থ ৱ,য় ধ্বনি সম্পর্কে কেন নীরব রইলেন,আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। অথচ সেখানে তিনি আফ্রিকার বেশ কিছু ভাষাতে এর অস্তিত্ব নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।১০৯ অন্যত্র তিনি লিখেছেন, “য়-র উচ্চারণত তালুত আরু ৱ-র উচ্চারণত ওঁঠ দুটাত অতিনগণ্য পরিমাণে ঘঁহনি খায়। সেই দেখি য় তালব্য আরু ৱ ওষ্ঠ্যবর্ণ।”১১০ অর্থাৎ অসমিয়া ‘ৱ’-তে তালুর ব্যাপারটি অস্পষ্ট রইলো।বাণীকান্তও লিখেছেন,‘ৱ’ ‘ঘোষ দ্বৌষ্ঠ অর্ধস্বর’১১১।তিনি আরো লিখেছেন, স্বরমধ্য অবস্থানে এটি সংস্কৃত ‘व’-এর প্রতিনিধিত্ব করে। শব্দের শেষ অবস্থানে একে প্রায়ই ‘ও’ লেখা হয়।‘ও’ প্রসঙ্গে গোলোকচন্দ্র গোস্বামীর একটি কথা খুবই প্রাসঙ্গিক হবে,“ৱ-উচ্চারণত জিভার গুরিখণ্ডরো ভূমিকা আছে; ই ওপরলৈ দাং খায়---উ আরু ও-র উচ্চারণতও তেনেকৈ দাং খায় --।”১১২ ‘গুরিখণ্ড’ মানে জিহ্বামূল বা পেছনভাগ।উ-এর উচ্চারণ প্রসঙ্গে লিখেছেন,“ইয়ার উচ্চারণত জিভার গোটেই গুরিখণ্ড কোমল তালুর ফাললৈ দাং খায়...।”১১৩ সুতরাং অসমিয়াতেও ‘ৱ’ উচ্চারণে কোমল বা স্নিগ্ধ তালুর ভূমিকা একই রকম। গোলোকচন্দ্র সংস্কৃত অন্তঃস্থ ব̖ (व) ধ্বনির সঙ্গে অসমিয়া ‘ৱ’–এর তফাত নিয়ে বেশ বিস্তৃত আলোচনা করেছেন,এবং লিখেছেন,“দুয়োটা সম্পূর্ণ সুকীয়া ধ্বনি”১১৪।সামান্য পরেই আরো লিখেছেন,“সংস্কৃতর দন্তৌষ্ঠ্য व (=v) উচ্চারণ অসমীয়াত যেনেকৈ নাই,সেই व=ধ্বনি লিখিবলৈকো আখর তেনেকৈ নাই।”১১৫ সংস্কৃত ধ্বনিটিকে কিন্তু ব্যাকরণ কৌমুদীতেও ‘দন্তৌষ্ঠ্য’ বর্ণ বলেই বর্ণিত রয়েছে।১১৬ বাণীকান্তের মতো তিনিও ব্যাখ্যা করেছেন,কী পরিস্থিতিতে অসমিয়াতে “ৱ-আখরর সৃষ্টি” করে নেয়া হয়েছে।১১৭ যাই হোক,এখানে এই সব জটিলতাতে না গিয়েও আমাদের মনে হয়,বাংলা ধ্বনির সঙ্গে অসমিয়া ধ্বনিটির তফাত অতি সামান্যই অথবা আদৌ নেই।অসমিয়াতে শুধু হরফটিই আলাদা।একে ওষ্ঠ্য-স্নিগ্ধতালব্য ধ্বনি বলা যেতেই পারে।প্রস্তাবটি অসমিয়া ভাষাবিজ্ঞানীদের জন্যে ছেড়ে দিয়ে আমরাও অসমিয়াতে একে দ্বৌষ্ঠ্যবর্ণ বলেই গ্রহণ করে নিচ্ছি।বাংলা ব্যাকরণে একে কণ্ঠোষ্ঠ্য ধ্বনিও বলে।অর্ধস্বরও বলে।বাংলার মতোই অসমিয়াতেও এদের শ্রুতিধ্বনিও বলে। শব্দের আদিতে অসমিয়াতে এই দুই ধ্বনিরই কোনো ব্যবহার নেই।
দ্বৈত-উচ্চারণের দ্বিতীয় শ্রেণিতে অধর এবং জিহ্বাপ্রান্ত উপরে উঠে ওষ্ঠ এবং শক্ততালুতে শ্বাসবায়ুকে বাধা দেয়। সেরকম ধ্বনিকে বলে ওষ্ঠ-তালব্য ধ্বনি। বাংলা-অসমিয়াতে -সংস্কৃতে এই /ɥ/ ধ্বনিটি নেই।
সিলেটিতে অর্ধস্বরের আলোচনা করতে গিয়ে জগন্নাথ চক্রবর্তী অহেতুক স্বাতন্ত্র্য টেনেছেন বলেই আমাদের মনে হয়েছে। তিনি সিলেটিতে চারটি অর্ধ্বস্বরের কথা লিখেছেন ই,এ(য়),ও,উ/ĭ,ĕ,ŏ,ŭ/,উচ্চারণ স্থান নিয়ে নীরব।১১৮তাই নৈকট্য ধ্বনি প্রসঙ্গেই আলোচনা করব। রবীন্দ্র কুমার দত্ত লিখেছেন,“ মান্য কথ্য বাংলার মতো নোয়াখালি চট্টগ্রামীতেও ‘য়্’ (g) এবং ‘ৱ্’ বা ‘ওয়’ (w) –এই দুটি অর্ধস্বর বিদ্যমান।”১১৯ অসমিয়া ‘ৱ্’ বর্ণচিহ্নটির ব্যবহার লক্ষ করবার মতো।
স্বরতন্ত্রীয় বা কণ্ঠ্যনালীয় ধ্বনি: এই ধ্বনির কথা আগে আমরা স্বরতন্ত্রীতে বাধার মাত্রাভেদ আলোচনা প্রসঙ্গে সামান্য লিখে এসেছি।স্বরতন্ত্রী দুটি যখন ক্ষণকালের জন্যে পূর্ণ সংযোগের অবস্থা তৈরি করে তখন বাংলা,সংস্কৃত উষ্মধ্বনি /হ/ উচ্চারিত হয়। উচ্চারণ স্থান অনুযায়ী এগুলোকে স্বরপথের বা কণ্ঠনালীয় ধ্বনিও বলে।অসমিয়াতেও /হ/ উচ্চারণে ঘটনা একই ঘটে।“কণ্ঠত,অর্থাৎ ডিঙির ঘটিকাত বায়ুর সোঁত অহা বাটটো স্বরতন্ত্রীয়ে ঠেক করি ধরে কারণে তাত ঘর্ষণ হয়।”১২০ স্বরতন্ত্রীতে সেই সংযোগ আকস্মিক ভাবে খুলে গেলে রুদ্ধ-স্বরপথ ধ্বনি সৃষ্টি হয়।মান বাংলাতে নেই,সিলেটি-কাছাড়ি সহ বাংলার অন্যান্য কিছু ভাষা বৈচিত্র্যে ধ্বনিগুলো রয়েছে সে কথাও আগে লিখে এসেছি।
সিলেটিতেও ‘হ’ স্বরতন্ত্রীয় ধ্বনিই।১২১অসমিয়াতে যেমন ‘শ,ষ,স’ ধ্বনি একক অবস্থানে পশ্চজিভ-স্নিগ্ধতালব্য ধ্বনি ‘ষ’/x/উচ্চারিত হয়,সিলেটিতে তেমনই শব্দের আদিতে থাকলে স্বরতন্ত্রীয় ‘হ’/ɦ/হয়ে যায়।মূলে ‘হ’ থাকলে সেটি লোপ পেয়ে যায় অথবা স্বরতন্ত্রীয় রুদ্ধ ধ্বনিতে পরিণত হয়।ঊষ্মধ্বনি প্রসঙ্গে কথাগুলো আরো স্পষ্ট হবে। চট্টগ্রামী,নোয়াখালিতেও তাই হয়। ১২২
।। উচ্চারণ প্রকৃতি অনুযায়ী ধ্বনির রূপভেদ ।।
শ্বাসবায়ুর আচরণের আরো কিছু রকমফের রয়েছে যার জন্যে ধ্বনির উচ্চারণ প্রকৃতিতে প্রভেদ ঘটে। আমরা শুরুতেই শ্বাসবায়ুর গতিমুখ অনুসারে অন্তর্গামী-বহির্গামী বায়ুর কথা লিখেছি। ধরে নিয়েছি, দুটোই ফুসফুসের আকর্ষণে বা বিকর্ষণেই ঘটে থাকবে। কিন্তু শ্বাসবায়ুতো মূলত নাকের ভেতর দিয়েই যাতায়াত করে,আমরা মুখবিবরের কথাই লিখে এসেছি।এবং সেখানে বাগযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণের কথা আলোচনা করে এসেছি। বাগযন্ত্র আরো কিছু হস্তক্ষেপ করে শ্বাসবায়ুর আচরণ প্রকৃতির প্রভেদ ঘটায় তথা ধ্বনির উচ্চারণ প্রকৃতিতেও তফাত ঘটে।
উচ্চারণ প্রকৃতি অনুযায়ী ধ্বনিগুলোকে ১) ফুসফুস চালিত এবং ২) ফুসফুস বিচ্ছিন্ন বায়ুপ্রবাহ জাত ধ্বনি ---এই দুই শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। বাংলা –হিন্দি –সংস্কৃত –ইংরেজি-জার্মান সহ প্রায় সব প্রধান ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার স্বাভাবিক ধ্বনিগুলোকে ফুসফুস চালিত ধ্বনি বলে রামেশ্বর শ’ উল্লেখ করেছেন।১২৩আমাদের বুঝতে হবে বাংলা,অসমিয়া ইত্যাদি ভারতীয় আর্যভাষার প্রধান ধ্বনিগুলো ফুসফুসচালিত বহির্গামী ধ্বনি।অন্তর্গামী নয়।স্বরতন্ত্রী এবং স্নিগ্ধতালু -- এই দুই জায়গাতে শ্বাসবায়ু বাধা পেয়ে দু’রকম ফুসফুসবিচ্ছিন্ন ধ্বনি তৈরি হয়। সেই বাধাতেই এই ধ্বনিগুলো তৈরি হয় না।বরং ফুসফুসের থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন যেটুকু বায়ু মুখবিবরে থাকে সেগুলোকে বাকি বাগযন্ত্রে নিয়ন্ত্রণ করেই এই ধ্বনিগুলো তৈরি হয়। সিলেটি রুদ্ধ-স্বরপথ বা স্নিগ্ধতালব্য ধ্বনিকে এই শ্রেণিতে ফেলা যাবে না।আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালার তালিকাতেও সেগুলোকে ‘pulmonic plosive glottal’ তালিকাতে রাখা আছে।অর্থাৎ ফুসফুস চালিত ধ্বনি।এই ধ্বনি মানবাংলা –সংস্কৃতাদি ভাষাতে নেই বলে রামেশ্বর শ’ উল্লেখ করে সংক্ষেপে এর তিনটি শ্রেণির কথা লিখেছেন।তার প্রথম দুটিতে শ্বাসবায়ু স্বরতন্ত্রীতে বিচ্ছিন্ন, শেষেরটিতে স্নিগ্ধতালুতে বিচ্ছিন্ন।প্রথমটি বহিঃস্ফোটক বা হিক্কিত ব্যঞ্জন,ইংরেজিতে যাকে বলে Ejective consonant বা Glottalised Stop। আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালাতে এগুলো দেয়া আছে এই ভাবে/ʼ,pʼ,tʼ,kʼ,sʼ/। বাংলার ‘পরিশীলিত উচ্চারণে এই ধ্বনি সাধারণত শোনা যায় না’ বলে রামেশ্বর শ’ উল্লেখ করেছেন। গোলকচন্দ্র একে ‘উদ্গীর্ণ’ ধ্বনি বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন। অসমিয়া হরফে ক’,ত’,প’ নজির দিয়েও অন্য কোনো ভাষার কথা লেখেন নি। কিন্তু এটিও স্পষ্ট করেন নি ধ্বনিটি অসমিয়াতে আছে কি নেই।অন্যভাষাতে থাকলে রোমান বা দেবনাগরী হরফ ব্যবহার করতেন বলেই দেখে মনে হয়।১২৪ সিলেটিতে এই ধ্বনিগুলো রয়েছে,আমরা ইতিমধ্যে দেখিয়ে এসেছি।রামেশ্বর শ’যে দ্বিতীয় ধ্বনির কথা উল্লেখ করেছেন তাকে অবরুদ্ধ বা অন্তঃস্ফোটক ব্যঞ্জন,ইংরেজিতে Implosive বা Recursive consonant বলে।“পূর্ববাংলার কোনো কোনো স্থানে ঘ̖,ধ̖,ভ̖ প্রভৃতি মহাপ্রাণ ধ্বনি অল্পপ্রাণ হয়ে যায় এবং একটু অন্তর্গামী বায়ুর সাহায্যে উচ্চারিত হয়”১২৫।কথাটা পরেশ চন্দ্র মজুমদারও উল্লেখ করেছেন।১২৬ স্পষ্টতই সিলেটিতে এই ধ্বনিগুলো রয়েছে।যেমন—ব’,দ’,জ’,গ’/ɓ,ɗ,ʄ,ɠ/।অসমিয়াতে এই ধ্বনি থাকা না থাকা নিয়ে আমরা কিছু দ্বিধাতে আছি,এর জন্যে যে গোলক চন্দ্র গোস্বামী ধ্বনির এহেন বিভাজন প্রসঙ্গ আলোচনা করে এসেও১২৭ বহিঃস্ফোটক তথা উদ্গীর্ণ ধ্বনির আলোচনাতে এসে তার আবার ‘আদ্যুদগীর্ণ’(preglottalized) বলে আরেকটি উপশ্রেণিতে বিভাজন করেছেন।“মুখবিবরর স্থানত স্ফোটন হোৱাৰ পূর্বে কণ্ঠত স্ফোটন হয়”১২৮ এই সব ধ্বনিতে।স্পষ্ট যে তিনি স্বরতন্ত্রীয় রুদ্ধ ধ্বনির কথা লিখছেন।এবং অসমিয়া ‘গ,ঘ,দ,ধ,ব’ শব্দের আদিতে থাকলে কখনো ‘আদ্যুদগীর্ণ’ বা ‘ঈষৎ আদ্যুদগীর্ণ’ হয় বলে লিখছেন।১২৯ সিলেটি এই ধ্বনিগুলো সম্পর্কে সুধাংশু শেখরের লেখাতেও একই কথার প্রতিধ্বনি আছে অন্য সুরে।যদিও সুধাংশু শেখর বেশ জোরের সঙ্গেই বলে দিয়েছেন,স্বরতন্ত্রীয় স্পৃষ্ট বলে কিছু অসমিয়াতে নেই। “Glottal stop does not occur in Assamese”১৩০গোলক চন্দ্র গোস্বামীর পারিভাষিক সংজ্ঞা ‘আদ্যুদগীর্ণ’ মেনে নিয়েও বলতে পারি,এগুলো আসলে সিলেটি অন্তঃস্ফোটক বা অবরুদ্ধ ধ্বনির থেকে আলাদা কিছু নয়।চট্টগ্রামী,নোয়াখালিতেও এই ধ্বনি আছে।চট্টগ্রামীতে মানবাংলার ঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনিগুলো নেইই।দক্ষিণ ত্রিপুরা এবং বৃহত্তর ফেনী অঞ্চলের নোয়াখালিয় মানুষের মুখে মানবাংলার ধ্বনিগুলোর উচ্চারণ শোনা গেলেও বাকি অঞ্চলে অন্তঃস্ফোটক বা অবরুদ্ধ ধ্বনিগুলোই শোনা যায়১৩১।এইখানে সুধাংশু শেখর তুঙ্গের একটি কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ,“…in this respect the whole E.B. area distinguishes non-aspirate voiced consonants with glottal stop and those without glottal stop very precisely…’’১৩২ আমরা তাঁর কথাগুলোকে সামান্য বদলে দিতে চাই---‘Glottal Stop’কথাটার জায়গাতে ‘Glottalic Implosive/Recursive’ অর্থাৎ অবরুদ্ধ অন্তঃস্ফোটক কথাটা বসিয়ে দিতে চাই।সঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনিগুলোর অল্পপ্রাণীভবন ঘটে এবং তাঁর ক্ষতিপূরণ করতে গিয়ে সেই অল্পপ্রাণ ধ্বনিটিই স্বরতন্ত্র রোধ করে অন্তর্গামী বায়ুপ্রবাহে উচ্চারিত হয়।ফলে অল্পপ্রাণীভবন সম্পূর্ণ হতে পারে না,যা হয় তাকে আবিদ রাজাকে অনুসরণ করে ‘মধ্যপ্রাণীভবন’ নাম দিতে পারি এবং বাংলার ভাষাবৈচিত্র্যগুলোকে সঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনিসহ ভাষাগুচ্ছ এবং সঘোষ মধ্যপ্রাণসহ ভাষাগুচ্ছ –এই দুই বড় ভাগে ভাগ করে ফেলতে পারি। এ ব্যাপারে প্রতিবেশী তিব্বতবর্মী ভাষা বডো,তিওয়া ইত্যাদির সঙ্গে সিলেটি সহ উত্তর পূর্ব বাংলার ভাষাগুলো আত্মীয়তা আছে।এই দুই ভাষাতে অন্তত সঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনিগুলো নেই।১৩৩ প্রতিবেশী আর্যভাষাগুচ্ছের মধ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিতেও ধ্বনিগুলো নেই।১৩৪ সুতরাং এ ব্যাপারে বিচ্ছিন্ন ভাবে অসমিয়ার সঙ্গে সিলেটির আত্মীয়তা সন্ধানের কোনো মানে হয় না।সন্ধান করতেই হয় তবে আসামের পশ্চিমে বাংলার উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদী যেখানে দক্ষিণে বাঁক নিয়েছে,অর্থাৎ দক্ষিণ পাড় বেঁকে পুব পাড়ে পরিণত হয়েছে সেখান থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের সাগর পার অব্দি সমস্ত ‘সঘোষ মধ্যপ্রাণসহ বাংলাভাষাগুচ্ছ’-এর সঙ্গেই করতে হয়।কোচবিহার, জলপাইগুড়িকে হিসেব থেকে আপাতত বাদ দিয়েও পুব পাড়ের ময়মনসিঙি থেকে শুরু করে চট্টগ্রামী ভাষা অব্দি।চাইকি যশোর,খুলনা ফরিদপুরের ভাষাকেও টেনে আনা যেতে পারে।অসমে প্রচলিত ময়মনসিঙি ভাষাকে ‘অসমিয়া’ বলে মেনে নিয়েও কিন্তু ড০ উপেন রাভা হাকাচাম সঘোষ মহাপ্রাণ সম্পর্কে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের একটি উক্তি মেনে নিয়েছেন।১৩৫ সুনীতিকুমার লিখেছিলেন,“As regards consonants,Vangŋa is easily distinguished by some special features, e.g.,the disaspiration of the medial aspirates in all cases: « gh, dh, dh,bh » being pronounced in all cases as « g,d,b », and « jh » as « z »; and « ḍh-, -ḍh-> -ṛh- » as « ḍ-,-r- ».”১৩৬ তিনি এই সঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনিগুলো সম্পর্কে ভোট-বর্মী উৎসের কথা বিশেষ লেখেন নি।কিন্তু সম্প্রতি মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানী জেমস মেটিশফ যেভাবে প্রত্ন তিব্বত-বর্মীভাষা পুনর্গঠন করেছেন তাতে মনে করবার কারণ আছে যে সিলেটি সহ পূর্ববঙ্গীয় এবং আসামের এই সব বাংলা ভাষা প্রবণতাটি সেখান থেকেই পেয়েছে।যদিও এখন সব ভোট-বর্মীভাষাতে ধ্বনিগুলো নেই এমনটা নয়।তিনি এক জায়গাতে লিখেছেন,“ ...many Himalayish Languages of Nepal (e.g including Chamling,Chepang,Dumi,Khaling,Kulung,Limbu,Newar, Thulung) have developed a series of voiced asprates due to Indospheric influence,first confined to borrowings from Indo-Aryan, but now occurring in native TB vocabulary items as well.”১৩৭ তার মানে সঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনিগুলো আর্যভাষারই দান।
স্নিগ্ধতালুতে ফুসফুস বিচ্ছিন্ন তৃতীয় যে শ্রেণির কথা রামেশ্বর শ’ লিখেছেন সেগুলো ক্লিক বা শীৎকার ধ্বনি,বাংলা-অসমিয়া কোনো ভাষারই স্বাভাবিক ধ্বনি নয় বলেই মনে হয়।আন্তর্জাতিক ধ্বনিমালাতে এগুলোর চিহ্ন এই রকম /ʘ,ǀ,ǃ,ǂ, ǁ /।
প্রতিহত এবং প্রবাহিত ধ্বনিঃ ফুসফুসের থেকে বেরোবার সময় শ্বাসবায়ু স্বরতন্ত্রীতে বাধার মাত্রাভেদ নিয়ে আমরা আগেই আলোচনা করেছি। কিন্তু মুখবিবরে তার উপরের ভাগেও এই মাত্রাভেদ ঘটে। সেই অনুযায়ী এই ফুসফুসচালিত ধ্বনিও দুই রকমের হয়।প্রতিহত এবং প্রবাহিত ধ্বনি।অসমিয়াতে গোলোকচন্দ্র এগুলোকেই যথাক্রমে নিয়ত এবং অনিয়ত বলে চিহ্নিত করেছেন।স্বরতন্ত্রী বা মুখবিবরের যেখানেই হোক নিম্নস্থ উচ্চারক ঊর্ধ্বস্থ উচ্চারক স্পর্শ করে সামান সময়ের জন্যেও যদি শ্বাসবায়ুকে পুরো আটকে দেয় এবং সেই বাধার থেকেই ধ্বনির উৎপন্ন হয় তবে সেগুলোকে প্রতিহত ধ্বনি বলে। চ-বর্গ বাদ দিয়ে বাংলা বর্গীয় বর্ণগুলোর প্রথম চারটি ধ্বনিগুলো প্রতিহত বা স্পৃষ্ট ধ্বনি।যদিও পরম্পরাগত বাংলা- অসমিয়া দুই ব্যাকরণেই ‘ক’ থেকে ‘ম’ অব্দি পঁচিশটি বর্ণকেই স্পর্শ ধ্বনি বলে। গোলোকচন্দ্র গোস্বামী নিয়ত ধ্বনির অন্তঃস্ফোট এবং ‘প্রস্ফোট’ ধ্বনি-- এই দুই ভাগের কথা লিখেছেন।স্পৃষ্ট ধ্বনিগুলোই প্রস্ফোট এবং ব্যবহার বৈচিত্র্য অনুযায়ী এর আবার ‘স্ফোট’ এবং ‘অস্ফোট’ এই দুই উপশ্রেণির কথাও আলোচনা করেছেন।১৩৮ যেমন ‘পাপ’ শব্দে প্রথম ‘প’ উচ্চারণের পরে পরে ‘আ’ উচ্চারণের জন্যে শ্বাসকে বাধামুক্ত করে দেয়া হয়।কিন্তু দ্বিতীয় ‘প’-তে তা করা হয় না বলে দুই ‘প’ কানে দু’রকম শোনায়।প্রথমটিকে ‘স্ফোট’ এবং দ্বিতীয়টিকে ‘অস্ফোট’ বলে।আমাদের মতে এহেন শ্রেণি বিভাজন বাংলাতেও সম্ভব।চ-বর্গকে অসমিয়াতেও স্পৃষ্ট ধ্বনির তালিকার থেকে বাদ দিতেই পারি।কারণগুলো আগেই লিখে এসেছি। গোলোকচন্দ্র এগুলোকে একাধারে ঘৃষ্ট এবং উষ্ম বলেছেন। আর একই ক্রমে ‘য,শ,ষ,স,হ’-কেও ধরেছেন। ‘য’ উচ্চারণে ‘জ’ বা ‘ঝ’-এর সঙ্গে কোনো তফাত রাখে না সঠিক ভাবেই লিখেছেন।অন্যদিকে অসমিয়া ‘চ,ছ’-এর উচ্চারণেও কোনো তফাত নেই বলে স্কুলপাঠ্য বর্ণমালার বইতেও এগুলোকে ‘প্রথম চ’,‘দ্বিতীয় ছ’ বলে বোঝাতে হয়।নইলে কোনো অসমিয়ার পক্ষে বোঝাই কঠিন হয়।এমন কি অসমিয়া ‘চ,ছ’ এবং ‘স’এর উচ্চারণও একই। বাংলাতে ঘৃষ্টধ্বনি প্রতিহত এবং প্রবাহী ধ্বনির মাঝামাঝি উচ্চারিত হয়।অসমিয়াতে ঘৃষ্ট ঊষ্মধ্বনিরই প্রকার ভেদ।আর ‘শ,ষ,স’ উচ্চারণে যে জিহ্বার প্রান্ত স্নিগ্ধ তালুর কাছে গেলেও স্পর্শ করে না তিনি স্পষ্টই লিখেছেন।এই তিন ধ্বনির উচ্চারণেও অসমীয়াতে বিশেষ তফাত নেই।এই কথাগুলো তিনি ছাত্রপাঠ্য ‘অসমিয়া ব্যাকরণ প্রবেশে’ লিখেছেন।সেদিক থেকে অসমিয়াতে এগুলো ‘কোমল তালব্য’ বা স্নিগ্ধ তালব্য ধ্বনিই। কিন্তু বিদগ্ধদের জন্যে লেখা ‘অসমিয়া বর্ণপ্রকাশে’ কথাগুলো বেশ বিস্তৃত এবং জটিল।তারউপরে ধ্বনিগুলো একক উচ্চারণে ‘হ’-বৎ উচ্চারিত হয়,আর তা হলে ‘স্বরতন্ত্রীয় সঘোষ’ হবারই কথা।এই অব্দি আলোচনাতে যা বোঝা গেল,মানবাংলা এবং অসমিয়া দুই ভাষার ধ্বনিবৈচিত্র্যগুলো একসাথে নিলে সিলেটি ধ্বনিগুলো মেলে। নোয়াখালি চট্টগ্রামীতেও অনেকটা তাই।রবীন্দ্র কুমার দত্ত তো ‘চ,ছ,জ,ঝ’ ধ্বনিগুলোকে ঘৃষ্ট এবং উষ্ম দুই তালিকাতেই আলাদা করে দেখিয়েছেন।১৩৯ তাই আমরা প্রসঙ্গটি উষ্মধ্বনি প্রসঙ্গে আরও স্পষ্ট করব।
শ্বাসবায়ুর বাধা যদি পুরো না হয়ে আংশিক হয় শ্বাসবায়ুর বেরিয়ে যাবার সামান্য হলেও পথ খোলাই থাকে তবে যে ধ্বনিগুলো উচ্চারিত হয় সেগুলোকে প্রবাহী ধ্বনি বলে।
নাসিক্য ও মৌখিক ধ্বনিঃ প্রবাহী ধ্বনি আবার দু’রকম।বায়ু মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলে মৌখিক প্রবাহী ধ্বনি,মুখে বাধা পেয়ে নাক দিয়ে বেরিয়ে গেলে নাসিক্য প্রবাহী ধ্বনি হয়।নাসা পথ দিয়ে বেরিয়ে যাবার পথে নাকের দেয়ালে ঘষা খেয়ে একটি অনুরণন হয়। সেই অনুরণনে সৃষ্ট ধ্বনিকে নাসিক্য ব্যঞ্জন বলে। সংস্কৃত ‘ঙ,ন,ণ,ঞ,ম’ এই পাঁচটি নাসিক্য ব্যঞ্জন।বাংলাতে এর সব ক’টি বর্ণমালাতে থাকলেও বাস্তবে নাসিক্য ব্যঞ্জন তিনটি ‘ঙ,ন,ম’।অসমিয়াতে ‘ঞ’ আসলে বাংলারই মতো এককভাবে নৈকট্য ধ্বনি ‘য়’-র আনুনাসিক রূপ।অন্য ব্যঞ্জনের সঙ্গে বাংলা-অসমিয়া দুইয়েতেই ‘ন’।বানানে ‘ঞ’-র কিছু ব্যবহার আছে।কিন্তু শব্দের আদিতে নেই।বাংলা এবং অসমিয়া বানানে ‘ঙ,ণ’-ও শব্দের শুরুতে বসে না। সিলেটিতেও কোনো তফাত নেই।১৪০ চট্টগ্রামী,নোয়াখালিতেও একই কথা১৪১।মুখের ভেতরেও এমন অনুরণন হয়।তাতে ‘র,ল’ ধ্বনি তৈরি হয়।কিন্তু সেখানে আরো কিছু ঘটনা ঘটে।ফলে মৌখিক বাধাযুক্ত ধ্বনিকে আংশিক বাধাযুক্ত এবং প্রায় বাধাহীন -- এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়।আংশিক বাধাযুক্ত ধ্বনিগুলোর আবার তিনটি ভাগ।কম্পিত,তাড়িত এবং ঊষ্মধ্বনি।ঊষ্মধ্বনি দুই রকমের: মধ্যগামী এবং পার্শ্বিক। মধ্যগামী উষ্মের আবার দুই প্রকার: সঙ্কীর্ণ বা নালীবৎ এবং প্রশস্ত বা ফালিবৎ।অন্যদিকে প্রায় বাধাহীন বা নৈকট্য ধ্বনিও মধ্যগামী এবং পার্শ্বিক এই দুই রকমের হয়।
কম্পিত,তাড়িত এবং ঊষ্মধ্বনিঃ কম্পিত ধ্বনি উচ্চারণ করতে গেলে জিহ্বা বাধা দিতে গিয়েও শ্বাসবায়ুর বারংবার ঠেলাতে কাঁপতে থাকে। বাংলা, সংস্কৃত ‘র’ এরকম ধ্বনি।অসমিয়াতেও তাই।সিলেটিতেও একই।১৪২নোয়াখালি এবং চট্টগ্রামীতেও তাই। জিহ্বার প্রথম বাধাকেই যদি শ্বাসবায়ু তাড়া করে সরিয়ে দেয় তাতে যে ধ্বনি উচ্চারিত হয় তাকে তাড়িত ধ্বনি বলে। বাংলা,হিন্দি ‘ড়,ঢ়’ এই রকম ধ্বনি। অসমিয়াতে বানানের বাইরে ‘ড়’ ধ্বনির উচ্চারণে ব্যবহার নেই। কিন্তু ‘ঢ়’ ধ্বনির অবস্থা বিশেষে আছে এবং উচ্চারিত হলে ধ্বনিটি ‘তাড়িত’র ধর্ম লাভ করে। দন্তমূলীয় তাড়িত মহাপ্রাণ।১৪৩অসমিয়াতে ‘ৰ’ এবং ‘ড়’-এর উচ্চারণ একই।‘ঢ়’ আসলে ‘র’-এরই মহাপ্রাণ বা ‘ৰ+হ’ এর সংযুক্তধ্বনি।এই কথা আমরা আগে লিখে এসেছি।বাংলা অসমিয়া দুই ভাষাতেই শব্দের আদিতে এদের ব্যবহার নেই।শব্দের মাঝে থাকলে দুই স্বরের মাঝে উচ্চারিত হয়। যদিও ‘র/ৰ’ যে কোনো অবস্থানেই দুই ভাষাতেই স্বাধীনভাবে বসে। সিলেটিতেও ধ্বনি দু’টি তাড়িতই। কিন্তু ‘ড়’-এ ‘ঢ়’-এ তফাত করা হয় না।বাংলাতে এগুলো ‘ড,ঢ’ এর বিকল্পে ব্যবহৃত হয়।পূর্ববঙ্গীয় অধিকাংশ ভাষাবৈচিত্র্যেই অসমিয়ার মতোই ‘ড়’ আর ‘র’-এ কোনো তফাত করা হয় না।বর্গের চতুর্থ বর্ণ ‘ঢ’ যেহেতু অবরুদ্ধ ড’ /ᶑ / উচ্চারিত হয়ই, সিলেটিতে আর যাই হোক ঢ় /ɽɦ/ থাকবার কথাই নয়। বাংলা আষাঢ়/ɐʃ̇ɐɽɦ/ তাই সিলেটিতে ‘ʔআড়’/ʔɐ’ɽ/। অর্থাৎ ‘ঢ়’> ‘ড়’ হচ্ছে। সম্ভবত তাই জগন্নাথ চক্রবর্তী শুধু ‘ড়’/ɽ/ নিয়েই লিখেছেন,“বরাক উপত্যকায় এর যথাযথ উচ্চারণ লক্ষ করা যায়।”১৪৪ তাঁর অভিধানের মুখবন্ধে পবিত্র সরকার লিখেছেন,“আমার ধারণা ছিল,অসমিয়াতে যেমন ‘ড়্’ ধ্বনিটি নেই,এবং নেই পূর্ববঙ্গের কোনো ভাষাবৈচিত্র্যতে সেহেতু বরাকের বাংলাতেও ‘ড়্’ থাকার কথা নয়। কিন্তু শ্রী চক্রবর্তী একাধিক শব্দে ‘ড়্’-এর ব্যবহার দেখিয়েছেন দেখে একটু অবাকই হলাম।কিন্তু এটি তাঁরই ‘মাতৃভাষা’,ফলে তাঁর নির্দেশ মানতে আমরা বাধ্য।”১৪৫কিন্তু ‘আষার’/ɐʃɐr/ও সিলেটি শব্দই বটে।জগন্নাথ চক্রবর্তীর অভিধানে ‘ʔআড়’ কিংবা ‘আষার’ কোনোটাই নেই। এও আমাদের কৌতুহল বাড়ায় যে ‘বাড়ি,গাড়ি,শাড়ি’/bɐɽi,gaɽi,ʃɐɽi/এমন বহু পরিচিত শব্দগুলো নেই কেন!বিকল্পে ‘বারি,গারি,হারি’/bɐri,gɐri,ɦɐri/ও রাখতে হবে বলে?এবং তাই করলে তাত্ত্বিক অবস্থানটি পোক্ত হতো না বলে?‘গারি’/gɐri/ শব্দটি আছে ‘পুরু’ অর্থে।১৪৬ এ যে মান বাংলা ‘গাঢ়’/gaɽɦɔ/শব্দের রূপান্তর সে উদাহরণ বাক্যে স্পষ্ট, ‘রাগ ইখান যেলা গারি ওলা উম।’ ‘ড়’এবং ‘র’-এর ভেদ ঘুচে যাওয়া সিলেটি তথা পূর্ববাংলার ভাষাবৈচিত্র্যগুলোর যে বিশেষ চরিত্র সেই কথা সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ও উল্লেখ করেছেন।১৪৭এই ভাষাগুলোর মানুষই তো আসাম ত্রিপুরার বাঙালি জনবিন্যাস গড়ে তুলেছেন।দুই ধ্বনির মধ্যে তারা প্রভেদ করেন না বলেই সংবাদপত্রাদিতেও আকছার মান বাংলার বানানেও এই দুই বর্ণ স্থান বদল করে ফেলে।তবু,আমাদের অভিমত শুধু কাছাড় করিমগঞ্জ তথা বরাক উপত্যকাতেই নয়, গোটা সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্যেই ‘ড়’ ধ্বনিটি আছে।এই নিয়ে জগন্নাথ চক্রবর্তীর সিদ্ধান্তটি সঠিক।কিন্তু ‘ড়’-এর বিকল্প ধ্বনিবৈচিত্র্য বা মুক্তবৈচিত্র্য –দুই ভাবেই ‘র’-এর উচ্চারণও আছে।‘লড়া’,‘পড়া’,‘লাবড়া’,‘কড়াই’ শব্দগুলো মোটেও উচ্চারণে ‘লরা’,‘পরা’,‘লাব্রা’,‘করাই’ নয়। যেটি জগন্নাথ লেখেন নি,কখনো তো ‘র’>‘ড়’ হয়ে যায়।যেমন খেচর/ʔkhesɔr/,খেচ্চড়/ʔkhet͡ʃt͡ʃɔɽ/<খচ্চর/ʔkhɔt͡ʃt͡ʃɔr/। অর্থাৎ ‘ড়’-এর ‘র’ পরিণতি যদি অসমিয়া এবং সিলেটি দুই ভাষার মিলন চিহ্ন হয়,তবে অসমিয়াতে ‘ঢ়’ এবং সিলেটি ‘ড়’-এর স্থিতি দুই ভাষার প্রভেদ চিহ্নও বটে। একই সম্পর্কে অসমিয়া নোয়াখালির সঙ্গেও জড়িয়ে আছে।রবীন্দ্র কুমার দত্ত লিখেছেন,ফেনী জেলার একাংশ খণ্ডল অঞ্চল বাদ দিলে নোয়াখালিতে সর্বত্র ‘ড়’ উচ্চারিত হয়। চট্টগ্রামীতে একেবারেই হয় না। এমন কি বহুস্থলে ‘র’টিও লোপ পায়।১৪৮ তাই তাঁর মতে বাড়ি হয় বাঁʹːই /b’ɐ̃i/,গাড়ি হয় গাঁʹːই/g’ɐ̃i/।
উষ্মধ্বনির কিছু কথা আমরা আগেই লিখেছি। এবারে তার প্রকার ভেদের আলোচনা করব। গলা থেকে ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় শ্বাসবায়ু যদি জিহ্বার মাঝবরাবর বেরিয়ে যেতে পারে,তাতে যে ধ্বনি উচ্চারিত হয় তাকে মধ্যগামী ঊষ্মধ্বনি বলে।তারও আবার দুই প্রকার -- জিহ্বার দুই ধার উঠে গিয়ে মধ্যরেখা বরাবর গোল নালীর মতো সংকীর্ণ সোজা পথ রেখে দেয় তবে সেগুলোকে সঙ্কীর্ণ বা নালীবৎ বা শিস ধ্বনি বলে।সংস্কৃতে এই তিনটি ‘শ,ষ,স’ শিসধ্বনি।মান বাংলাতে ‘শ’ (বিকল্পে স/s/),হিন্দিতে ‘স’ (বিকল্পে ‘শ’) শিস ধ্বনি।বর্ণমালাতে যদিও সংস্কৃতের তিনটিই রয়েছে।
অসমিয়া বর্ণমালাতে এবং বানানে এই বর্ণ কয়টি থাকলেও উচ্চারণে জটিল তফাত রয়েছে। একা উচ্চারিত হলে কোমল তালব্য অঘোষ ‘হ’/x/এর মতো উচ্চারিত হয়। রাজেন বরুয়া লিখেছেন,“পণ্ডিতেরা এখন সঠিকভাবেই এই অনন্য অসমিয়া ধ্বনিটিকে ‘কণ্ঠ্য-উষ্ম’(velar fricative) ধ্বনি বলে চিহ্নিত করেছেন।ড০ বাণীকান্ত কাকতি বলেন যে অসমিয়াতে এটি এক ‘অঘোষ কণ্ঠ্য উষ্ম’ ধ্বনি।ড০ গোলক চন্দ্র গোস্বামী একে ‘কণ্ঠ্য অঘোষ মহাপ্রাণ’ (velar voiceless aspirant) বলে ব্যাখ্যা করেছেন।আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক সংস্থা(IPA)পৃথিবীর সমস্ত ভাষার সমস্ত ধ্বনিকে চিহ্নিত করেছে এবং প্রতিটির জন্যে কিছু অনন্য চিহ্ন নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।অসমিয়া এবং অন্য যে সব ভাষাতে ‘কণ্ঠ্য উষ্ম’ ধ্বনি পাওয়া যায় তার জন্যে আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালাতে নির্দিষ্ট করে দেয়া চিহ্ন হলো রোমান বর্ণ x।”১৪৯ এখন,বাণীকান্ত বা গোলোকচন্দ্র ধ্বনিগুলোকে ঠিক কী বলেছেন এও বড় জটিলতাপূর্ণ।এই সম্পর্কে পণ্ডিতেরা সচেতনও।‘ষ’ ধ্বনিটি নিয়ে লিখতে গিয়ে গোলোকচন্দ্র নিজেও লিখেছেন,“একেটা বর্ণর একে পরিবেশতে সংস্কৃত বানান পদ্ধতির অনুকরণত তিনিওটা আখর ব্যবহার হোয়া হেতু লিখোঁতে বর বেমেজালিয়ে দেখা দিয়ে।”১৫০‘ষ’-কে তিনি ‘পশ্চতালব্য অঘোষ ঊষ্মবর্ণ’ লিখেছেন।‘স’-কে আবার ‘অঘোষ দন্তমূলীয় উষ্মবর্ণ’ লিখেছেন।‘স’-এর উপধ্বনির “কোনো কোনো পরিবেশত দন্তমূলীয় তালব্য উচ্চারণও শুনা যায়।”১৫১ কিন্তু ‘মহাপ্রাণ’ বলতে আমরা দেখিনি।যদিও মহাপ্রাণ হতে কোনো অসুবিধে নেই, বাংলাতেও তালু-দন্তমূলীয় ‘শ’(স+হ) মহাপ্রাণ ধ্বনিই।বাণীকান্ত লিখেছেন,“(সˎ/x/): অঘোষ কণ্ঠ্যমূলীয় ঘৃষ্ট”১৫২ তিনি ‘অঘোষ দন্তমূলীয় ঘৃষ্ট’ বলেছেন ‘চ’ ধ্বনিকে, যখন সংস্কৃতের ‘চ,ছ’ ধ্বনি অসমিয়া উচ্চারণে ‘স’ হয়ে যায়। ঘৃষ্ট হ (x)-- যার কথা রাজেন বরুয়া লিখেছেন সেই ধ্বনিকে নয়।অর্থাৎ সংস্কৃত ‘চিহ্ন’ শব্দটি > যখন অসমিয়াতে ‘সিন’(চিন) হচ্ছে। ‘সিন’ (চিন) কখনো /xin/ উচ্চারিত হয় না।কিন্তু ‘সকল’/xɔkɔl/ হয়। অন্য ব্যঞ্জন ধ্বনি বা ঋ-কারের সঙ্গে ব্যবহৃত হলে ‘চ,ছ’-এর উচ্চারণের সঙ্গে একীকৃত হয়ে যায়। রেফ যুক্ত হলে আবার একক ‘শ,ষ’-এর মতোই উচ্চারিত হয়।‘ৎ’এর পরে স-কে কেউবা ‘চ,ছ’-এর মতো কেউ স্পষ্ট শিস ধ্বনি ‘স’-এর মতোই উচ্চারণ করেন। কেউ বা অসমিয়া একক ‘স’ ধ্বনি অর্থাৎ/x/-এর মতো।এই অভিমত গোলকচন্দ্র গোস্বামীর।কিন্তু তিনি লিখেছেন,“এই সংযোগত স-ক অকলশরীয়া স-র দরে উচ্চারণ করাটো বর শুদ্ধ নহয়।”১৫৩যাই হোক,এই তিনজনের সংজ্ঞাতে আমরা ‘স’ ধ্বনি প্রসঙ্গে ‘কণ্ঠ্য,পশ্চতালব্য,দন্তমূলীয়,কণ্ঠ্যমূলীয়’ এই চারটি কথা পাচ্ছি।
উচ্চারণস্থান নিয়ে এই বিভ্রান্তি দূর করতে না পারলে অসমিয়া ধ্বনিটিকে চিনতে ব্যর্থ হবো।এর মধ্যে ‘দন্তমূলীয়’ কথাটিকে শুরুতেই আলাদা করতে পারি।বাকিগুলো নিয়ে পরে কথা হবে।বাণীকান্তের ‘চ’ আর গোলোকচন্দ্রের ‘স’ আসলে একই।গোলোকচন্দ্র ‘চ’ নিয়ে আলাদা করে কথা বলেন নি।অর্থাৎ এই ধ্বনিটি ‘অঘোষ দন্তমূলীয়’ এবং এরই সঘোষ ধ্বনি ‘য’। আন্তর্জাতিক ধ্বনিবর্ণমালাতে এদের চিহ্ন /s,z/-- যা সঠিক ভাবে ‘অসমীয়া জাতীয় অভিধান’-এও উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাতে ‘চ,ছ,জ,ঝ’-কে কিছুতেই উষ্ম কিংবা স্পর্শ কোনো শ্রেণিতেই ফেলা যাবে না। স্পর্শধ্বনি এবং ঊষ্মধ্বনির সংযোগে সৃষ্ট এগুলো ঘৃষ্ট ধ্বনি।কিন্তু অসমিয়াতে ঘৃষ্টধ্বনিও আসলে দুটোই - ‘স’ এবং ‘য’।
আমরা ইতিমধ্যে দেখিয়ে এসেছি সিলেটিতে ‘ক,প,ফ’ আদি ধ্বনিকেও অনেকে নানান মাত্রার ‘উষ্ম’ বলতে চেয়েছেন।তাই যদি হয় তবে সিলেটিতে উষ্মধ্বনির ঘনঘটা লেগে বসে।চ-বর্গতো উষ্ম হয়ই।তাই সমস্যাটা আমাদের সমাধান করতে হচ্ছে।সুকুমার সেন লিখেছেন,“শ্বাসবায়ু সম্পূর্ণভাবে বাধা পাইলে স্পৃষ্ট।আংশিকভাবে বাধা পাইলে উষ্ম।”১৫৪ ঘৃষ্টকে তিনি ‘দ্বিব্যঞ্জনধ্বনি’তে ধরেছেন।মহাপ্রাণ ধ্বনিও তাই।মহাপ্রাণধ্বনির কথাটি স্পষ্ট।বর্গের প্রথম এবং তৃতীয় ধ্বনির সঙ্গে ‘হ’ যুক্ত হলেই মহাপ্রাণ হয়। এই ‘হ’ কিন্তু উষ্মধ্বনি। সুতরাং ‘খ,ফ কিংবা ছ’ ইত্যাদি ধ্বনিকে যখন আলাদা করে কেউ উষ্ম বলেন তখন সমস্যা গুলিয়ে যায়।তার উপরে প্রশ্ন দাঁড়ায় ঘৃষ্ট ধ্বনিতে স্পৃষ্ট ধ্বনির সঙ্গে কোন উষ্ম যুক্ত হয়? উত্তরটি স্পষ্ট। ‘হ’ বাদ দিয়ে যে ধ্বনিগুলো আছে, মান বাংলাতে যেগুলোকে শিসধ্বনি বলে ‘শ,স,ষ’ ইত্যাদি। ইংরাজি –অসমিয়া ইত্যাদি ভাষাতে /z/-ও।
এবারে বোঝা সহজ যে, ঊষ্মপ্রবণতা বেশি,অর্থাৎ উপরের এবং নিচের
উচ্চারকের মধ্যে বাধাজনিত ঘর্ষণের মাত্রাটি অসমিয়াতে কম কিংবা আভাস মাত্র থাকে বলেই
অসমিয়া ভাষাবিজ্ঞানীরা উষ্ম এবং ঘৃষ্টকে একাকার করে ভেবেছেন। আদি বৈদিক আর্যে বিশুদ্ধ
‘স্পৃষ্ট’ ধ্বনির আদি মধ্য-ভারতীয়তে
‘ঘৃষ্ট’ ধ্বনিতে পরিণতি এবং
মানবাংলাতে সেই প্রবণতা অক্ষত থাকলেও উত্তর এবং পূর্ববাংলাতে দন্ত্যঘৃষ্ট এবং শিস ধ্বনি
হয়ে যাবার কথা সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ও লিখেছেন।সুতরাং অসমিয়ার তত্ত্বটি আলাদা কিছু নয়।ঠিক
এরই জন্যে সম্ভবত এই ভাষাতে ‘চ’ এবং ‘জ’-এরও কোনো মহাপ্রাণ
উচ্চারণ হয় না।এবং ‘চ,ছ-স’ ‘জ,ঝ-য’এর উচ্চারণও বাংলার মতো নয়।এগুলোর তফাত ঘোচে যায়।এই দুটি অসমিয়া
সংকীর্ণ তথা নালীবৎ উষ্ম তথা শীষধ্বনি ।সিলেটিতে সব পূর্ববাংলার ভাষাগুলোতেও একই
ঘটনা ঘটলে তাত্ত্বিক ভাবে ধ্বনিগুলো এরকম দাঁড়ানো উচিত /tʃ, tʃh,dƷ,dƷɦ/=/ʃ,ʃh,Ʒ,Ʒɦ/।আন্তর্জাতিক ধ্বনিবৈজ্ঞানিক
বর্ণমালা তালিকাতে/ʃ,Ʒ/ উত্তর দন্তমূলীয় ঊষ্মধ্বনিরই চিহ্ন।তাহলে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
কেন এভাবে লিখছেন [t͜s,s,d͜z,z]? /s,z/-তে না হয় বোঝা গেল,তিনি দন্ত্য শিসধ্বনিতে
রূপান্তরের কথাই বলেছেন।কিন্তু /t,d/-র উপস্থিতি তো থাকার নয়।তার উপরে /s,z/ অল্পপ্রাণ ধ্বনি।মান
বাংলা ‘ছ,ঝ’-এর অল্পপ্রাণী ভবন
হচ্ছে এই বার্তাই তো এখানে। আই পি এ তালিকাতে এ দুটো স্পষ্টই উষ্ম শিস ধ্বনি বলে চিহ্নিত।তাহলে
/ts,dz/
কেমন ধ্বনি?জগন্নাথ চক্রবর্তীও লিখেছেন এরকম /cʃ,cʃɦ,ɈƷ,ɈƷɦ/।ব্যবহৃত চিহ্ন বলছে
ধ্বনিগুলো তালব্য ঘৃষ্ট।তিনি লিখেছেন ‘তালব্য স্পৃষ্ট’,সংস্কৃতের মতো। তাঁর
তত্ত্বে প্রথম দুই ধ্বনি যদি তালু দন্তমূলীয় এবং শেষ দুটি তালব্য হয় তবে ধ্বনি চিহ্ন
হওয়া উচিত /tʃ,tʃh,ɈƷ,ɈƷɦ/। ‘চ’-এর সঙ্গে ‘স’-এর তফাত যদি খুব
কম থাকে তবে /tʃ/= /s/ হওয়া উচিত। ‘ছ’ ‘স’ হয় না, কিন্তু উষ্ম-প্রভাবিত।
‘ঝ’ও তাই। ‘ঝ’ > ‘z’ হয়ে থাকে এমন কোনো
বার্তা তিনি দেন নি।উত্তর এবং পূর্ববাংলার ভাষাতে কি তবে স্পৃষ্ট এবং উষ্ম প্রবণতা-প্রধান
দু’রকম ধ্বনিই রয়েছে? জন্মজিৎ রায়কে অনুসরণ করলে এর উত্তর--না।সিলেটি অসমিয়াতে ভেদ
বিশেষ নেই। সিলেটি কাছাড়ি বিভাষা সম্পর্কেও নিখিলেশ পুরকাইতের একই কথা,“চ,ছ–এর উচ্চারণ –স- এর মতো,শ,স-এর উচ্চারণ প্রায়ই
হ-এর মতো,জ-এর উচ্চারণ ইংরেজি জেডের (z) মতো হয়। যেমন কাছে--কাসে; আছে—আসে; আছলাম---আসলাম; চিন্তা—সিন্তা; ... সে–হে,..শুন—হুন...”১৫৫ কুমিল্লা১৫৬,নোয়াখালি১৫৭
এবং চট্টগ্রাম ১৫৮ আদি ভাষা-বৈচিত্র্য সম্পর্কেও কথা একই।সুতরাং একটি কথা স্পষ্ট যে অসমিয়ার সঙ্গে
শিস ধ্বনির সাদৃশ্য সন্ধান করতে গেলে প্রাক-স্বাধীনতাকালের আসাম সীমান্তে সন্ধান করলেই
কাজ ফুরোয় না।স্বাধীন বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমান্ত অব্দি এগোনো যায়,চাই কি সেই সীমান্ত
পেরিয়ে মায়ান্মারের আরাকান অব্দি এগুলে ‘রোহিঙ্গিয়া’ ভাষাতেও একই ঘটনাক্রম
নজরে পড়বে।১৫৯এমন কি রবীন্দ্রনাথ তো মান বাংলা সম্পর্কেই এই কথা লিখেছিলেন,“...এ ছাড়া "নাচতে,মুছতে’ প্রভৃতি শব্দে চ-ছ’এর
সঙ্গে ত’এর ঘেঁষ লেগে দন্ত্য স’ এর ধ্বনি জাগে।”১৬০ কিন্তু সমস্যাটি জটিল হয় যখন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
সারা পূর্ববাংলার ভাষা সম্পর্কে,জগন্নাথ চক্রবর্তী কিংবা আবিদ রাজা মজুমদার
বরাক উপত্যকার সিলেটি বা কাছাড়ি বিভাষা সম্পর্কে,এবং রবীন্দ্র কুমার
দত্ত চট্টগ্রামী এবং নোয়াখালি সম্পর্কেও ভিন্ন
ভিন্ন কথা লেখেন।এবারে একে একে তাদের বক্তব্যকে বিচার করা যাক।
জগন্নাথ চক্রবর্তী ‘য’ সম্পর্কে কিছু বলেন নি।তাঁর অভিধানেও ‘য’ নিয়ে কোনো আলাদা স্তম্ভ নেই।শুধু এক জায়গাতে লিখেছেন,“‘জ’ ধ্বনির উচ্চারণ অনেকটা ইংরেজি ‘z’ এর মতো হলেও বাধার মোচন বিলম্বিত হয়ে ঘৃষ্ট ধ্বনিত্ব এসে যায়।”১৬১ অন্যদিকে ‘উষ্মধ্বনি’ প্রসঙ্গে মান বাংলার মতোই দুটি সংকীর্ণ ঊষ্মধ্বনি ‘শ,স’ এবং প্রশস্ত উষ্মধ্বনি ‘হ’-এর কথা লিখেছেন।১৬২ সেখানে তিনি ‘ক,খ’=/x/এর কথা লেখেন নি,তবু সেগুলো নিয়ে সমস্যা অতি সামান্য।তার মানে ধ্বনিগুলো নিয়ে তিনি খুব একটা স্পষ্ট হতে পারেন নি।‘চ’ যদিও বা কখনো ‘স’ হয়,‘ছ’ কখনোই হয় না বলে তিনি স্পষ্ট লিখেছেন।অথচ ‘স’ দিয়ে যে ক’টি শব্দ তিনি অভিধানে রেখেছেন তার অনেকগুলোই আসলে মূলে ‘চ’-তো বটেই,‘ছ’-ও। কিংবা আরবি ফারসি ইত্যাদি থেকে ঋণ করা।কিংবা বানানে তিনি ‘স’ লিখলেও উচ্চারণে ‘শ’। যেমন সাট <বাং.ছাঁট,সানদা < বাং. ছাদন,সাইটপিট < বাং.ছটপট বিকারে,সেফ< আঞ্চ বাং. ছেপ< সং. ক্ষেপ।উৎস শব্দগুলো আমরা তাঁর অভিধান থেকেই দিয়েছি। স=চ যেমন-- সটি < চটি,সগুনত< চগুনত।সআ <বাং. সওয়া <সং. সপাদ (১১/৪ ),সকড়া < প্রাবাং. সঁকড়ি < প্রা. সঙ্কডিয়া-- এগুলোর মূলেও উচ্চারণ ‘শ’ /ʃ/। আর তাঁর যুক্তি যদি মেনেও নিই বরাক উপত্যকার বাংলাতে এগুলোর উচ্চারণ ‘স’ /s/,তবু আমরা দাবি করেই বলতে পারি যে ‘শ’/ʃ/ উচ্চারণে শব্দগুলো সিলেটিতেও আছে,কাছাড়ি বিভাষাতেও রয়েছে।অভিধানে ‘স’ রয়েছে এরকম দেশী-বিদেশী ঋণকৃত শব্দে --- সদদু < হি. চৌন̖ধ,সদরি < আ. সদর+ই,সফা < আ. সফা (পরিষ্কার),সিংগেল < ইং. Single Stick ইত্যাদি।প্রায় প্রত্যেকটি শব্দের তিনি আন্তর্জাতিক ধ্বনিবর্ণমালাতে উচ্চারণও উল্লেখ করেছেন।‘স’ দিয়ে শুরু সব কটি শব্দ /s/ না হয়ে /S/ দিয়ে কেন শুরু করেছেন, আমাদের বোধগম্য হয় নি। তবু ‘চৌধুরী’ জাত দুটি শব্দই অভিধানে রয়েছে ‘সদরি’ এবং ‘চদরি’।প্রথমটির উচ্চারণ/Sɔdri/ এবং দ্বিতীয়টির উচ্চারণ /cʃɔdri/।একই শব্দ দুই উচ্চারণ হতে পারে,দুই বানান সাধারণত হয় না।আরো আছে আরবি ‘সদর’ + ই পরসর্গযোগে শব্দ ‘সদরি’/Sɔdri/ এবং ‘ছদ̖রি’ /cʃhɔdri/।দেখা যাচ্ছে, ‘স’ শুধু ‘ছ’ হচ্ছে না, বিদেশী শব্দেও ধ্বনিরূপান্তর হওয়াটা আটকাচ্ছে না।এই ‘চৌধুরী’ এবং ‘সদর’-জাতশব্দ দু’টো অবশ্য উচ্চারণে এক নয়।সম্ভবত বানানেও হওয়া উচিত হবে না।জগন্নাথ এক জায়গাতে শুধু লিখেছেন,‘ঘ’ ধ্বনিটির ঘোষত্ব আংশিক রক্ষিত, আর বাংলা ‘ভ’ ইংরেজি ‘v’এর মতো দন্তৌষ্ঠ।বর্গের চতুর্থ ধ্বনির অন্তঃস্ফোটক উচ্চারণ নিয়ে তিনি ভাবেন নি।তাই এটা ধরতে পারেন নি,যে চৌধুরী আসলে সিলেটিতে ‘চদ̖’রি’ বা ‘সদ’রি’ কিন্তু উচ্চারণে/cʃ’ɔɗri/।অন্যদিকে আরবি ‘সদর’ জাত শব্দটি সদ̖রি বা ছদ̖রি যাই হোক উচ্চারণে/sɔdri/,‘সদরি’ /sɔdɔri/ হতেও অসুবিধে নেই।ছ=স হয় মেনে নিয়ে আমরাও যেটুকু তফাত করতে পারছি,স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে জগন্নাথ সেটুকুও করতে পারেন নি। সুতরাং ‘ছ’ = ‘স’ হয় না---এই তত্ত্ব নাকচ করতে পারি। তেমনি ঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনির অন্ত:স্ফোটক ধ্বনিতে রূপান্তর তথা মধ্যপ্রাণীভবনের তত্ত্ব মেনে ‘ঝ’-ও =‘জ’’ হয়। সামান্য নজর দিলে নিজের অভিধানেই তিনি সেটি দেখতে পেতেন।‘জেং’ এবং ‘ঝেং’ ‘তেজ’ অর্থে দুই স্তম্ভ বা প্রবিষ্টিতেই রয়েছে।শব্দ দুটির উচ্চারণও মোটেও আলাদা নয়। ‘ জ’ ’ উচ্চারণে হবে ‘ জেং’ ’ (টাইপে ং-এর আগে ’ বসানো সমস্যা বলে পরে বসালাম।--গবেষক)।
আমরা সিদ্ধান্ত নিতেই পারি যে,মান বাংলাতে ‘স’/s/-এর স্বতন্ত্র উচ্চারণ না থাকলেও সিলেটি আদি পূর্ববাংলার বহু ভাষাতেই আছে। তেমনি ‘ জ’ ’/z’(?)/আছে।তার পরেও ‘ছ,ঝ’-এর স্বতন্ত্র উচ্চারণ আছে কিনা পরে দেখবো।কিন্তু আপাতত আমাদের সমস্যা হচ্ছে ‘চ’-কে নিয়ে। সেটি কি /s/,/ʃ/ অথবা /tʃ/ না /ts/।মান বাংলা ‘চাপ’ এবং সমোচ্চারিত সিলেটি শব্দ ‘চাপ,ছাপ,সাফ,সাপ’ তুলনা করে পরীক্ষা করা যাক। মান বাংলা ‘চাপ’-এর উচ্চারণ এভাবে বোঝানো যাচ্ছে/tʃɐp/,সিলেটি ছাপ (হাতের ছাপ),এবং সাফ (পরিষ্কার করা)দুটোরই উচ্চারণ আসলে একই-/sɐf/।বাংলা সাপ এভাবে লেখা যাবে /ʃɐp/,কিন্তু সিলেটি সাপ/ʃɐf/ অথবা/ɦɐf/।কিন্তু আমাদের সমস্যা হচ্ছে সিলেটি ‘চাপ’ লিখতে।এইখানেই বোঝা যাচ্ছে অসমিয়ার থেকে সিলেটির সমস্যা ভিন্ন।/cʃ/ হবারতো প্রশ্নই নেই,সিলেটি ধ্বনিটি /tʃ/-ও হবে না,মান বাংলা ‘চাপ’ লিখতেই নয়, ইংরেজি ‘champion’,‘change’ শব্দগুলোর ‘ch’-এর উচ্চারণও আসলে এই /tʃ/।তবে কি সেলেটি ‘চ’ অবশিষ্ট যুগ্ম ধ্বনি যেটি সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় প্রস্তাব করেছেন সেই /ts/? লিখতে হবে এই ভাবে? /tsɐp/? রুশি এবং চিনারাই নয়, ‘জার’ এবং ‘মাও জে দং’-উচ্চারণ করতে গিয়ে বাঙালিরও সমস্যাতে পড়বার একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে।মাও-এর নাম অনেকেই বাংলাতেও লেখেন ‘মাও ৎসে তুং’ (ইংরাজিতে Mao Tse-tung);বাঙালিরাই রুশি শব্দ বাংলাতে ‘জার’ ইংরেজিতে লেখেন/tsar /। আমরা কি সিলেটি ‘চাপ’/tsɐp/কে অনেকটা ‘জাপ’ উচ্চারণ করতে চাইবো? অনুরূপ আরেকটি যুগ্ম ধ্বনি /dz/ উচ্চারিত হয় ব্রিটিশ ‘কুকনি’ এবং মার্কিন কিছু কিছু ইংরেজি ভাষাবৈচিত্র্যে ‘day’ বলতে গিয়ে/d͡zeˑɪ̯/। নিছক ভাষার অভ্যন্তরীণ ধ্বনিপরিবর্তনের কথা মাথাতে রেখে এই সমস্যার সমাধান হবে না বলেই মনে হয়।সূত্র এবং চিহ্নগুলো ব্যবহারে আনতে গিয়ে সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় এবং পরবর্তী অনেকেই যখন ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন,ইতিহাস সেখানে আমাদের কিছু সাহায্য করতে পারে।অন্তত তাঁরা কোন পথে ভেবেছেন সেই দিশা পাওয়া যাবে।
এগুলোকে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তিব্বতি ধ্বনিমূল্য (‘Tibetan values’) বলছেন। প্রথম সহস্রাব্দের শেষ এবং দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরুর দিকে যখন প্রচুর বাঙালি পণ্ডিতেরা তিব্বতে গিয়ে অথবা না গিয়ে সংস্কৃত পাঠের তিব্বতি অনুবাদ করছিলেন তখন এই ধ্বনিমূল্যগুলো প্রথমে কামরূপে দেখা দেয়।নিশ্চিত হয়ে কিছু লেখেন নি,সম্ভাবনার (probably, perhaps )কথা বলেছেন। ‘transliteration of Sanskrit word’ কথার থেকে বোঝা যায় তিব্বতি অনুবাদে সংস্কৃত শব্দের ব্যবহারের কথা বলছেন।কামরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে উত্তর এবং পূর্ব বাংলাতে ছড়ায় এই ধ্বনিমূল্য, কিন্তু পশ্চিম বাংলাতে প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়।১৬৩ তিনি সপ্তম শতকের চীনা পরিব্রাজক হিউএন সাং-এর সেই বিখ্যাত মন্তব্যের প্রসঙ্গ এনেছেন যেখানে তিনি লিখেছেন,কামরূপের লোকেদের ভাষা ‘মধ্যভারত থেকে সামান্য স্বতন্ত্র’। হিউএন সাঙের এই বক্তব্য তুলে ধরে অসমিয়া আদৌ মাগধী প্রাকৃত জাত ভাষা কিনা, সেই প্রশ্নও অসমিয়া বহু ভাষাতাত্ত্বিক তুলে থাকেন।কিন্তু সেই কামরূপ যে আজকের আসাম নয়,পশ্চিম আসাম মাত্র, সঙ্গে উত্তর এবং পূর্ববঙ্গেরও অনেকটা--- সেই সত্য অনেকে ভুলে থাকেন।সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সেটি মনে রেখেছেন,এবং এই তিব্বতি ধ্বনিমূল্য প্রসঙ্গে অসমিয়া ভাষার কথাও পাড়ছেন।শুধু পণ্ডিতদের ভাষাব্যবহারেই এই ঘটনা ঘটেনি,“The presence of large Tibeto-Burman element in the population of Assam and East and North Bengal may have something to do with this (cf. The Tebetan and Burmese pronunciation of IA.« c, ch, j [jh]» as « ts,ts-h, dz» and « ts [s], s-h, s-h ,z» ,and Burmese pronunciation of « s » as a spirant «th » [θ] ) ; and these phonetic modifications very likely were first brought about in the Magadhi Prakrit or Apabhraṅśa dialect current in Kāma-rūpa with its predominantly Tebeto-Burman population, as noticed by Hiuen Thsang ; and from Kāma-rūpa the « ts, dz », « r » and « h » pronunciation might have spread into the contiguous tracts of Bengal,--where , however , they do not seem to have become regularly established in the way done on Assamese .”১৬৪ এই টুকুনে আমরা সিলেটি অসমিয়া সহ পূর্ববঙ্গীয় বাংলার ভাষাবৈচিত্র্যে ধ্বনিগুলো কাছাকাছি চলে আসবার সামাজিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি পাচ্ছি।এই প্রশ্নে ঐতিহাসিক ভাষাবিদদের মতে মোটের উপরে একটা ঐকমত্যই আছে।তিব্বতে বুঝি সপ্তম শতকের পণ্ডিত থোন –মি সাম্ভোট তালব্য এবং দন্ত্য দু’রকম ধ্বনিই লিখবার জন্যে বর্ণ প্রবর্তন করেছিলেন।বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের একটি নিবন্ধে এই তথ্য জানতে পাচ্ছি। তিনি লিখছেন,“উচ্চারণে একটু যতি (accent) দিলেই পূর্ব্ববঙ্গে প্রচলিত দন্ত্য ছ ও ঝ –বর্ণের অল্পপ্রাণ উচ্চারণ প্রাপ্ত হওয়া যায়।পূর্ব্ববঙ্গের ভাষায় ছ ও ঝ-বর্ণ অল্পপ্রাণতা প্রাপ্ত হওয়ায় এই দুই বর্ণের অস্তিত্ব নাই বলিলেই চলে।”১৬৫ তিনি অবশ্য পরে পার্শি এবং মুসলমান সমাজের সূত্রেও ধ্বনিগুলোর বাংলাতে ব্যাপক প্রচলিত হবার উদাহরণ সহ বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন।কিন্তু সিদ্ধান্ত সেই একই,অর্থাৎ দু’টোই ধ্বনি আছে।সেগুলোকে দন্ত্য উষ্ম বললেই চলে।অসমিয়ার মতো।অসমিয়াতে ধ্বনিগুলোকে দন্তমূলীয় বলে চিহ্নিত করা হলেও কিছু যায় আসে না, দুইয়ের মধ্যে ভেদ খুবই কম।মুখবিবরের পেছন থেকে এগোলে তালু-দন্তমূল-দাঁত এই হচ্ছে ক্রম।আমরা সিলেটিতেও এদের দন্তমূলীয় বলতে পারি।কিন্তু সিলেটিতে অসমিয়ার মতো দুইয়ের বেশি তৃতীয় ধ্বনি নেই বলা যাবে না,শব্দোচ্চারণের দিক থেকে সেরকমই ইঙ্গিতের কথা আমরা ইতিমধ্যে দেখিয়ে এসেছি।সেদিক থেকে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় যে /ts,dz/এর মধ্যি দিয়ে সিলেটি সহ পূর্ববাংলার ভাষাতে দন্ত্য ঘৃষ্ট ‘চ-জ’-এর অস্তিত্বের কথা জানাচ্ছেন,আমাদের মেনে নিতেই ইচ্ছে করে।মানবাংলা ‘ঝ’ ‘দন্ত্য বা দন্তমূলীয় –জ’ হয়ে যায় এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে ইচ্ছে করে।আবিদ রাজা মজুমদার এই সিদ্ধান্তই খানিক অস্পষ্ট রেখে দিলেও,ধ্বনি দুটির উচ্চারণ ‘ৎস,দ̖জ’ দিয়েই বুঝিয়েছেন। এগুলো ঘৃষ্ট ধ্বনিই।কিন্তু কথাগুলো স্পষ্ট করতে পারেন নি কেন? জগন্নাথ চক্রবর্তী ‘ঘৃষ্টধ্বনিত্ব এসে যায়’ জাতীয় বাক্য বন্ধ ব্যবহার করছেন কেন?বসন্ত চট্টোপাধ্যায় কোন ‘যতি’-র কথা লিখছেন?তাঁর উদ্ধৃত এরকম পদ্য পঙক্তি “চু˳ল বান্ধনের ফিতা দিচি˳ আর কি দেওন জা˳য়” ‘চ,ছ’-এর বিরোধ ঘুচিয়ে দিলেন কেন? বর্ণলিপি দিয়ে লিখলে মান বাংলা চ/tʃ/ এবং সিলেটি /ts/এর দূরত্ব খুব বেশি নয়।জিহ্বাগ্র দাঁতকেই স্পর্শ করুক, কিংবা দন্তমূলকে কিংবা তালুকে-- উচ্চারণ ভেদ বিশেষ একটা হয় না।প্রথমে মান বাংলা ‘চাপ’ উচ্চারণ করে বাকি দুই অবস্থানে শব্দটিকে ছুঁয়ে ছেড়ে দিয়ে সাধারণ উচ্চারক ব্যক্তিও পরীক্ষাটা করে দেখতে পারেন।কিন্তু তাতে সিলেটি ‘চ’ উচ্চারিত হয় না।মহাপ্রাণ না হোক ‘মধ্যপ্রাণীভবনে’র একটি ঘটনা ঘটবে না সিলেটিতে,এটা হতে পারে না।বিশেষত ভোটবর্মী ভাষাগুলোর প্রভাবেই যদি ধ্বনিগুলো এসেছে,আর ভোটবর্মী প্রতিবেশেই সিলেটির বিকাশ।‘বাংলা ভাষায় ভোট বর্মী উপাদান’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে অধ্যাপক দীপক কুমার রায় এক স্বল্পপরিচিত পরিভাষার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটাচ্ছেন---‘স্বরের অন্তঃশ্বাসমূলক মহাপ্রাণ’।ধারণাটি তিনি নিয়েছেন অধ্যাপক নির্মলেন্দু ভৌমিকের থেকে।মূল গ্রন্থ আমাদের দেখবার সুবিধে হয় নি, কিন্তু যে ক’টি উদাহরণ তিনি দিয়েছেন,‘অহকারণ,কহপাল, পহরান,অহঞ্চল,জহঞ্জাল,চহমপা’১৬৬ তাতে আমাদের স্বরতন্ত্রীয় স্পৃষ্ট তথা রুদ্ধ-স্বরপথ ধ্বনির কথাই মনে পড়ে যায়,যদিও ধ্বনিটির বিপর্যয় ঘটছে বলেও মনে হচ্ছে।অথচ খানিক পরেই আবার সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের উধৃতি দিতেই চ> ছ,জ> ঝ হয়ে যায় লিখছেন।/ts,dz/ গেল কই!
এই ধ্বনিগুলোকে চিহ্নিত করা নিয়ে ভারতে চিরদিনই এবং দুনিয়া জুড়েও ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যে সংকট প্রবল ছিল।ইন্দো-ইরানীয়ের আবেস্তার ভাষাতে দন্ত্য ধ্বনিগুলো ছিল,পশ্চিম ভারতীয় অধিকাংশ আর্যভাষাতে দন্ত্য-চ বর্গের উপস্থিতি দেখেই বোধ করি,মাগধী ভাষার ব্যাকরণে বররুচি লিখেছিলেন,“চবর্গস্য স্পষ্টতা তথোচ্চারণঃ”। অথচ, কবীন্দ্রের প্রাকৃত ব্যাকরণে একটি সূত্র আছে “চজ য়োরুপরি যঃ স্যাৎ”।অর্থাৎ ‘চ’ ও ‘জ’ বর্ণের আগে ‘য’ আসবে। যেমন,‘য̖চিওং’।১৬৭ ইঊরোপীয় ভাষাগুলোতে এই ধ্বনিগুলো নিয়ে সমস্যার এক চিত্তাকর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন বসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায়,“অধ্যাপক বীমস বিস্মিত হইয়াছেন,-চ ও জ- বর্ণের সরল উচ্চারণ ইউরোপের বহু জাতির বিশেষ অসুবিধার কারণ হইয়াছে। জর্ম্মনীতে য-বর্ণের জন্য j-ব্যবহার হয় এবং خ (খ) বর্ণের জন্য ch ব্যবহার করা হয়। সুতরাং জ ও চ লইয়া বিষম গোলযোগ উপস্থিত হইয়াছে।জ-বর্ণের জন্য সুপণ্ডিত জর্মনবাসিগণ dsch লিখিবার ব্যবস্থা করিয়াছেন এবং চ –বর্ণের জন্য tsch বিহিত হইয়াছে।সম্প্রতি k ও g দ্বারা সংক্ষিপ্ত ভাবে এই দুই বর্ণের উচ্চারণ উপলক্ষিত হয়।ফরাসী দেশে j বর্ণের উচ্চারণ অর্দ্ধ –z (ژ ) বর্ণের ন্যায় হইয়াছে;সুতরাং জ-বর্ণের জন্য dj ব্যবহৃত হয় এবং ch-এর উচ্চারণ ش (শ) বর্ণের অনুরূপ হওয়ায় চ-বর্ণের জন্য tch লিখিত হয়।অন্যান্য জাতির মধ্যেও এইরূপ হইয়াছে।”১৬৮ আন্তর্জাতিক ধ্বনিবৈজ্ঞানিক বর্ণমালাতেও দন্ত্য-ঘৃষ্ট বোঝাবার জন্যে শুধু /ts,dz/ নেই।মধ্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলোর পশ্চিমা শাখাতে দন্ত্য ঘৃষ্টের অস্তিত্ব এবং এমন কিছু কিছু লক্ষণ দেখেই বোধ করি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি কোনো কোনো ভাষাবিদ শৌরসেনী প্রাকৃতের থেকে ভাষাটির উদ্ভব মনে করে থাকেন।অবশ্য অধ্যাপক কালী প্রসাদ সিনহা মাগধী উৎসের কথাই স্বীকার করেন।১৬৯ যে উৎসই হোক,ভাষাটির দন্তমূলীয় ঘৃষ্ট ধ্বনি তিনটির জন্যে এই বর্ণলিপি ক’টিই ব্যবহার করেন /c∫, ∫δ,∫δ'/।১৭০ /ts, dz/- নয়।অথচ দন্তমূলীয় বর্ণলিপি আই পি এ-তে এ দুটোই। দন্ত্য এবং দন্তমূলীয় ‘অশিস’ ঘৃষ্ট ধ্বনি চিহ্ন আসলে ক্রমান্বয়ে,/tθ,dð,tθ̠, dð̠/।এগুলো ছাড়াও আন্তর্জাতিক তালিকাতে যত সব ঘৃষ্ট ধ্বনির সন্ধান মেলে, আমাদের অস্বস্তি বাড়াবার পক্ষে যথেষ্ট। /tʃ -dʒ,ʈʂ-ɖʐ ,tɕ-dʑ,pϕ-bβ,p̪f-b̪v,t̠ɹ̠̊˔-d̠ɹ̠˔,cç-ɟʝ,kx-ɡɣ,qχ-ɢʁ,ʡħ-ʡʕ,ʔh/। দু’টো স্বতন্ত্র ধ্বনি বোঝাতে আমরা কমা (,)-র বদলে মাঝে হাইফেন (-) ব্যবহার করলাম।দুই চিহ্ন মিলে একক ধ্বনি বোঝাতে এখন উপরে বা নিচে একটি অর্ধবৃত্ত ব্যবহৃত হয় এরকম /p͡f, t͡sʼ,d͡z, t͡ɬ,d͡ɮ, t͡ʃʼ,d͡ʒ, t͡ɕʼ,d͡ʑ, t͡ʂʼ,d͡ʐ ,k͡xʼ/।
এমন আরো অসংখ্য আছে।আমরা একটা আভাস দেবার চেষ্টা করলাম।এটা দেখাতে যে সিলেটি তথা পূর্ববঙ্গীয় ভাষাগুলোতে ঘৃষ্ট ধ্বনির জন্যে বিশেষ কোনো পরীক্ষা না করেই সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের সংজ্ঞা এবং চিহ্নগুলো চলছে। আমরাও খুব একটা পরীক্ষা করলাম দাবি করি না,শুধু যে সব সমস্যার সামনে পড়তে হলো,সেগুলোকে চিহ্নিত করতে এত দূর আলোচনা করা হলো।তার উপর মানবাংলা, অসমিয়া এবং প্রতিবেশী ভাষাগুলোর সঙ্গে সিলেটির সম্পর্ক বুঝতে এর দরকার ছিল।পূর্বসূরিরা হয় অতি সরল কিংবা জটিল করে রেখেছিলেন।জগন্নাথ চক্রবর্তী তাই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না সংস্কৃতের মতোই ধ্বনিগুলো স্পৃষ্ট অথবা মান বাংলার মতো ঘৃষ্ট কিনা। তিনি হয়তো সংস্কৃতের সঙ্গে আত্মীয়তা ঘনিষ্ঠ দেখে আনন্দিতই হয়েছিলেন।এর বেশি পরীক্ষা করবার আপাতত দরকার নেই,তার জন্যে আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানের স্বনিমের শ্রেণিবিভাজনের স্বতন্ত্র পদ্ধতি আছে। সেই পথ ধরতে হলে শুধুই এই বিষয়টি নিয়ে আলাদা অধ্যয়ন করাই সমীচীন হবে। সুতরাং আমরাও ধ্বনিগুলোর জন্যে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের /ts,dz/ গ্রহণ করলাম।শুধু আন্তর্জাতিক ধ্বনিবর্ণমালার রীতি মেনে উপরে অর্ধবৃত্ত যোগ করলাম /t͜͡s, d͜͡z/। এবং যে ‘মধ্যপ্রাণ’ প্রসঙ্গটি ছুঁয়ে গেছিলাম সেটি বোঝাতে সিলেটিতে প্রধান ধ্বনি/ʔt͡s/,এবং অপ্রধান ধ্বনি /t͜͡s’/ প্রস্তাব করলাম।আর /d͡z/ এর বদলে, /d͡z’/।রবীন্দ্র কুমার দত্ত নোয়াখালি এবং চট্টগ্রামী /z’/ব্যবহার করেছেন।বস্তুত অন্তঃস্ফোটক অবরুদ্ধ ধ্বনির জন্যে আন্তর্জাতিক ধ্বনিবর্ণমালার/ʄ̊/ চিহ্নটি ব্যবহার করা যেত। কিন্তু এটি তালব্য ধ্বনির জন্যে ব্যবহৃত হয় বলে সম্ভবত তিনিও এড়িয়ে গেছেন,আমরাও তাই করলাম।বসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্র কুমার দত্তের অনুসরণে /z/ উচ্চারণে ‘জ’ (=য) লিখবার জন্যে ‘জ̣’ ব্যবহার করাই সমীচীন।আবিদ রাজা যেভাবে যথেচ্ছ উপরে বিন্দু ব্যবহার করেছেন,সেরকম নয়।এই প্রস্তাবটি প্রথম করেন উনিশ শতকে প্রখ্যাত কাশ্মীরি ভাষাবিদ ঈশ্বর কৌল।রবীন্দ্র কুমার দত্তও সেরকমই করেছেন।উপরের অর্ধবৃত্ত বাদ দিলে /dz’/ প্রস্তাবটিও অবশ্য নতুন নয়। অধ্যাপক সুধাংশু শেখর তুঙ্গ-- যিনি প্রথম দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ধ্বনি নির্বিশেষে স্বরতন্ত্রীয় স্পর্শ যুক্ত হবার মত দিয়েছেন, তিনি জ̣’র/dz’ɔr/< মান বাং. ঝড়,জা̣’ল /dz’al/ ইত্যাদি শব্দোচ্চারণ প্রস্তাব করবেনই।১৭১তিনি /ts’/-ও প্রস্তাব করেছিলেন। /ts’al/ < /tshal/ (ছাল, চামড়া); /ts’uli/ < /tshuli/ (ত্বক ছড়ে যাওয়া,freckle) /ts’ana/ < tshana (শিশু)। তিনি ছ/tsh/ এবং ঝ /zh/ এমন উচ্চারণও প্রস্তাব করেছিলেন।তাঁর /ts’/ কিংবা /tsh/ নিছক /s/ বলেই আমাদের মনে হয়। শুধু মহাপ্রাণ কিংবা তার ক্ষতিপূরণে ‘স্বরতন্ত্রীয় স্পর্শ’-এর কথা তিনি ভেবেছিলেন,এই তথ্যটুকু জানিয়ে রাখা গেল।আমাদের এখন সিলেটি ‘চাপ’ লিখবার সমস্যার সমাধান হয়েছে,সেটি হবে /ʔt͡sɐp/ কিংবা /ʔt͡sɐf/,চদ̖’রি হবে /t͡s’ɔɗri/। এমন কিছু সমস্যার সমাধান না করতে পেরেই বোধ করি আবিদ রাজা মজুমদার ‘চা’ই’,‘চা-লা’ এধরনের কিছু শব্দ অভিধানে রেখেছেন,অর্থের দিক থেকে যেগুলো ‘চাই,চালা’র থেকে ভিন্ন।‘ জেং̣’ ’ হবে /d͡z’eŋ/। ছাপ এবং সাফ হবে /sɐf/। জা̣ল হবে /zɐl/।কিন্তু /ʔpɔnt͡ʃɔm/,/ɔnd͡Ʒɔn / --এমন কিছু যুক্তাক্ষরে এবং অন্যত্র মানবাংলা ধ্বনিগুলো উচ্চারিত হয়। আবিদ রাজা মজুমদার লিখেছেন অনুনাসিক ব্যঞ্জনের পরে ‘চ,জ’ স্বাভাবিক উচ্চারণে অর্থাৎ মান বাংলা উচ্চারণে শোনা যায়, আমরা এই মত মেনে নিচ্ছি।
দাঁড়ালো এই যে, সিলেটি চ-বর্গের ধ্বনিগুলো বাংলার মতো অবিমিশ্র ঘৃষ্ট কিংবা অসমিয়ার মতো অবিমিশ্র উষ্ম নয়।ʔচ,জ̣’/ ʔt͡s, d͡z’/ দন্তমূলীয় ঘৃষ্ট, ছ,জ̣ (য) /s,z/ দন্তমূলীয় উষ্ম এবং অসমিয়ারই মতো শিস ধ্বনি।এছাড়াও অপ্রধান ঘৃষ্ট ধ্বনি তথা বিস্বন বা মুক্তবৈচিত্র্য রূপে চ’, চ,জ/ t͡s’, t͡ʃ,d͡Ʒ / রয়েছে, সম্ভবত মান বাংলা ছ,ঝ / t͡ʃh,d͡Ʒɦ /-ও দুর্লভ নয়।
অসমিয়ারই মতো সিলেটিতে আরেকটি শিস ধ্বনি রয়েছে।সুনীতি চট্টোপাধ্যায়,সুধাংশু শেখর তুঙ্গ প্রমুখের অভিমত মানতে গেলে প্রায় সর্বত্রই, আমাদের মতে কখনোবা ‘ক,খ’= /x/ উচ্চারিত হয়।আমরা রাজেন বরুয়া,বাণীকান্ত কাকতি এবং গোলোকচন্দ্র গোস্বামীর ‘কণ্ঠ্য,পশ্চতালব্য,কণ্ঠ্যমূলীয়’ ঊষ্মধ্বনি প্রসঙ্গে আলোচনা মাঝখানে ছেড়ে এসেছিলাম।বাণীকান্তের ‘স’ এবং গোলকচন্দ্রের ‘ষ’ একই ধ্বনি।যদিও প্রথম জন একে ‘কণ্ঠ্যমূলীয়’ এবং দ্বিতীয়জন একে ‘পশ্চতালব্য’ বলে লিখেছেন।দু’জনের দেয়া দুই একটি উদাহরণে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।বাণীকান্ত শর এবং ষোল-র বিপরীতে লিখেছেন ‘সৰ্/xor/,সোল্ল/xolla/’;অন্যদিকে গোলোকচন্দ্রের ‘ষ্যই,সি’,‘ষ্যইল,শিল’ –শব্দগুলোর প্রথমটিতে উচ্চারণ এবং দ্বিতীয়টিতে বানান বুঝিয়েছেন।কিন্তু অসমিয়া ভাষার শ্রোতা মাত্রেই জানেন শব্দদুটির উচ্চারণ আসলে /xi/ এবং /xil/। পশ্চতালব্য বা স্নিগ্ধতালব্য ধ্বনির সঙ্গে কণ্ঠ্য ধ্বনি গুলিয়ে যাবার কথা আমরা বাংলা ধ্বনি প্রসঙ্গেও লিখে এসেছি,কণ্ঠমূল স্নিগ্ধ তালুকেই বলা যেতে পারে---সেদিক থেকে বাণীকান্ত এবং গোলোকচন্দ্রে তফাত বিশেষ রইল না।রাজেন বরুয়াও এই অর্থেই ‘কন্ঠ্য’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও তাঁর ODBL গ্রন্থের শুরুতে যে আন্তর্জাতিক ধ্বনি প্রতিলিপির উদাহরণ দিয়েছেন তাতে /x/ কে স্নিগ্ধতালব্য ধ্বনিই লিখেছেন।এই সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য “velar spirant, unvoiced=German ch in ach, Persian خ : found in dialectical East Bengali.. .”১৭২ এটিও অসমিয়াতে শিস ধ্বনি এবং গোলোকচন্দ্রের অনুসরণে একে আমরা অসমিয়াতে ‘ষ’ দিয়েই চিহ্নিত করবো।সাধারণ ভাষাবৈজ্ঞানিক যুক্তি বলে ধ্বনিটিকে তিনি ‘ক’ দিয়েও চিহ্নিত করতে পারতেন,‘ষ’-তো একটি মূর্ধার থেকে উচ্চারিত ধ্বনি। কিন্তু তাতে অসমিয়ার অভ্যন্তরীণ যুক্তি শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ত।অসমিয়া বানানের ‘ক’ কখনোই /x/নয়। গোলকচন্দ্র নিজেও এই ‘ষ’ ধ্বনির জন্যে পরবর্তী গ্রন্থগুলোতে আন্তর্জাতিক ধ্বনিবর্ণমালার /x/ চিহ্নটিই ব্যবহার করেছেন। সিলেটিতে ‘ক,খ’= /x/ অপ্রধান ধ্বনি,অপ্রধান বলেই এগুলোকে বাংলা হরফে আলাদা করে চিহ্নিত করবার দরকার আছে বলে মনে হয় না।
বাণীকান্ত কাকতির মতে এই অসমিয়া স্নিগ্ধতালব্য ‘স(হ)’/x/-এরই ঘোষ রূপ হচ্ছে অসমিয়া ‘হ’/h/।“ইংরাজী behind-র দরে ঘোষ কণ্ঠ্যমুলীয় ঘৃষ্ট”।১৭৩কিন্ত গোলোকচন্দ্রের মতে এটি একটি কণ্ঠ্যধ্বনি।‘ই এটা কণ্ঠত উচ্চারিত সঘোষ উষ্মবর্ণ’ (অসমীয়া বর্ণপ্রকাশ)। আমাদের মতে গোলোকচন্দ্রই সঠিক।আন্তর্জাতিক ধ্বনি বর্ণমালাতেও ‘অঘোষ’ এবং ‘সঘোষ’ ‘হ’ কে কণ্ঠ্য বা ‘Glottal’ বর্গেই ক্রমে এই দুই চিহ্ন দিয়ে বোঝানো আছে /h,ɦ/। সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ও ধ্বনি দুটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন,/h/ হচ্ছে,“ unvoiced glottal fricative”১৭৪ ইংরেজি ‘hat,happy’ শব্দে যেমন। তিনি আরো লিখেছেন,“ This is the Skt. And Bengali «visarga» and the «prāṅa» or aspiration in the « aghōs̟a mahā-prān̟a» or unvoiced aspirated sounds …”১৭৫ অন্যদিকে /ɦ/ হচ্ছে,“ voiced glottal fricative”১৭৬ইংরেজি ‘behind,perhaps’ শব্দে যেমন।“=Sanskrit ह,Bengali হ,Arabi ه ।” সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং বাণীকান্ত দু’জনেই ইংরেজি ‘behind’শব্দের নজির দিয়েছেন।আমরা তাই সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের সংজ্ঞাই নিতে পারি। বাণীকান্তও পরে ‘হ’ ধ্বনির উৎস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আবার একে ‘সঘোষ কন্ঠ্য ঘৃষ্ট’ই লিখেছেন১৭৭। অর্থাৎ উচ্চারণ স্থানের দিক থেকেও /x/ এবং /h/ দুটি স্বতন্ত্র ধ্বনি।আমাদের অনুসৃত পরিভাষা ব্যবহার করে লিখলে প্রথমটি স্নিগ্ধতালব্য এবং দ্বিতীয়টি স্বরতন্ত্রীয়।কণ্ঠ্য উষ্ম ধ্বনির কথা আলোচনা করতে গিয়ে গোলোকচন্দ্র স্পষ্টই উচ্চারণ স্থান স্বরতন্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন১৭৮। এই স্বরতন্ত্রীয় ‘হ’/h/এর অসমিয়াতেও বাংলার মতো কখনো ‘অঘোষ’ উচ্চারিত হয়।অসমিয়া–বাংলা বর্ণমালাতে তার জন্যে বিসর্গ (ঃ) চিহ্নটি রয়েছে।আমরা তাই সুনীতি চট্টোপাধ্যায়কে অনুসরণ করে ‘অঘোষ –হ’-এর জন্যে /h/ এবং ‘সঘোষ-হ’-এর জন্যে /ɦ/-- আন্তর্জাতিক ধ্বনি বর্ণমালার চিহ্ন ব্যবহার করব।যেমন অনেকে করেছেন -- তাঁদের মধ্যে রামেশ্বর শ’ও আছেন,‘সঘোষ-হ’এর জন্যে /h/-- আমরা সেটি ব্যবহার করব না।সংস্কৃত বাংলা এবং অসমিয়াতে ‘হ’ /ɦ/ প্রশস্ত বা ফালিবৎ ঊষ্মধ্বনি।নিচের উচ্চারক গুলো যদি উপরের উচ্চারকগুলোর খুব কাছাকাছি গিয়ে পাতলা ফালির মতো পথ শ্বাসবায়ুর জন্যে খোলা রাখে তবে সেই মধ্যগামী ঊষ্মধ্বনিকে প্রশস্ত বা ফালিবৎ ঊষ্মধ্বনি বলে।সিলেটিতেও তাই।এরই বিকল্প উষ্ম রূপ হচ্ছে ঃ /h/। একক উচ্চারণে অসমিয়া ‘শ, স, ষ’ যেমন ষ /x/ উচ্চারিত হয়,সিলেটিতে প্রায়শই হ/ɦ/ হয়।হওয়াটা আবশ্যিক নয়,--বহু শব্দেই অক্ষত থাকে- কিন্তু প্রায়শই আদি অবস্থানে ‘হ’ হয়,শেষ অবস্থানে লোপ পায়। যেমন শাক/ʃɐx/ কিন্তু হাক/ɦɐk/,সজা̣গ/ʃɔzɐg/ এবং হজা̣গ/ɦɔzɐg/, শনি/ʃɔni/ এবং হনি/ɦɔni/,বাশ /bɐʃ/(<বাঁশ) এবং বা’/ɓa/,গা’স(< ঘাস)/ɠɐʃ/ এবং গা’/ɠɐ/। মূলে ‘চ,ছ’ বা দেশী-বিদেশী ঋণ করা শব্দে স থাকলে এবং যুক্তাক্ষরে অসমিয়ার মতো অক্ষত থাকে।সিরি/ছিরি /siri/(<শ্রী/sri/),সেলাম /selɐm/।‘সিলেট’ শব্দটি ‘হিলেট’ না হবার কারণ এটাই।তা সে শব্দটি হিউএন সাং-এর উল্লেখিত ‘শিলিচটল’,থেকেই কিংবা রাজা শ্রীচন্দ্রের তাম্রশাসনে প্রথম উল্লেখিত ‘শ্রীহট্ট’ মণ্ডল থেকেই আসুক।শব্দমধ্যেও শিসধ্বনিগুলো অক্ষত থাকে। যেমন অপ̣সর/ɔfʃɔr/(< অবসর),অশুজ̣/ɔʃuz/(<অশৌচ)।মানবাংলা বা উৎস শব্দে ‘হ’ থাকলে সেটি লুপ্ত হয়,স্বরতন্ত্রীয় রুদ্ধ ধ্বনিতে অথবা দন্তৌষ্ঠ উষ্ম ‘ফ̣’-তে পরিণত হয়।ʔঅয়/ʔɔĕ/(< হয়),কও/ʔkɔo/(< কহ̖),ফু̣ন/ϕun/(< হুন < শোন)। মানবাংলাতে এই একটিই প্রশস্ত বা ফালীবৎ উষ্ম ধ্বনি থাকলেও,সিলেটিতে দু’টি অপ্রধান দন্তৌষ্ঠ উষ্ম ধ্বনি ফ̣,ভ̣/f,v/ রয়েছে।
নৈকট্য ধ্বনিঃ মৌখিক প্রবাহী প্রায় বাধাহীন ধ্বনিকে বাংলাতে নৈকট্য ধ্বনিও বলা হয়।আগেই লিখেছি,এরও মধ্যগামী এবং পার্শ্বিক দুই ভাগ।ধ্বনির এত শ্রেণি বিভাজনে আমাদের বোধ না গুলিয়ে যায়,তাই রামেশ্বর শ’এর একটি উক্তির উল্লেখ করা কাজের হবে।তিনি লিখেছেন,“শ্বাসবায়ুর গতিপথে সম্পূর্ণ বাধা হলে স্পর্শধ্বনি,আংশিক বাধার ফলে ঘর্ষণধ্বনি শোনা গেলে উষ্মধ্বনি,আর বাধা যদি এতোই কম হয় যে কোনো ঘর্ষণ ধ্বনি শোনা যায় না অথচ মনে হয় বাধার ভাবটি রয়েছে তবে নৈকট্য –ধ্বনি হয়।”১৭৯ তিনি আরো লিখেছেন,“...এরকমই যদি বাধা না থাকে অথবা বাধা থাকলেও ধ্বনিটি সেই বাধাজনিত ধ্বনি না হয়,তবে সেইভাবে উচ্চারিত ধ্বনি হলো স্বরধ্বনি।আসলে নৈকট্য ধ্বনি হলো ঊষ্মব্যঞ্জন ও স্বরধ্বনির মাঝামাঝি রকমের ধ্বনি।আগেকার ধ্বনিবিজ্ঞানীরা যাকে ‘অর্ধ্বস্বর’ বলতেন তা নৈকট্য ধ্বনির মধ্যে পড়ে।”১৮০ শ্বাসবায়ু সেই জিহ্বার মাঝবরাবর বেরিয়ে গেলে মধ্যগামী নৈকট্য ধ্বনি তৈরি হয়।বাংলা ‘ওয়,য়’,অসমিয়া ‘য়,ৱ’,সংস্কৃত অন্তঃস্থ –‘য়, ব’ এই শ্রেণির ধ্বনি।কিন্তু আমরা সমস্যাতে পড়ি যখন জগন্নাথ চক্রবর্তী সিলেটিতে চারটি নৈকট্য ধ্বনির প্রস্তাব করেন-- ই,এ(য়),ও,উ/ĭ,ĕ,ŏ,ŭ/।১৮১ /ĭ,ŭ/-র জন্যে তিনি চর্যাপদ এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকে ক্রমে এমন দুই পঙক্তি দুলে দিয়েছেন: ‘দুলি দুহি পিটা ধন ন জাই’ এবং ‘এবেঁ মোরা মনে হউ সুখ’। সিলেটি বাক্য এবং প্রবাদ তুলে দিয়েছেন,এরকম:‘তাই (সে/স্ত্রী) বারইয়া গেলে মুইও জাই।’ এবং ‘আইতে যাইতে ধনাইর বাফ/ আম পাক̖কিলে মউআ’।আমাদের সহজ যুক্তি হলো চর্যার ‘জাই’ আর তাঁর উপস্থাপিত সিলেটি বাক্য ‘জাই’ একরকম শব্দ নয়। প্রথমটি ‘সমর্থ’ অর্থে একটি বহুপদী ক্রিয়াপদের শেষাংশ। ধরা যায়,পাওয়া যায়,পড়া যায়—এইসব ক্রিয়াপদে যেমন ব্যবহৃত হয়,দ্বিতীয়টি সম্পূর্ণ একপদী ক্রিয়া পদ,√ যা ধাতুর থেকে উৎপন্ন শব্দ।এবং শেষের –ই পুরুষবোধক পরসর্গ বা বিভক্তি মাত্র।মান বাংলা শব্দ ‘যাই’।তেমনি মউআ (< মৌসা< মেসো) শব্দের দ্বিস্বর ঔ-(অউ) ব্যঞ্জন লোপের ফলে ত্রিস্বর ‘অউয়া’তে পরিণত হয়েছে বলে মনে হয়।দুই স্বর দ্রুত উচ্চারিত হলে ‘য়’ বা ‘ওয়া’-ই শোনা যেতে পারে। যেমন মৌয়া /mɔuĕɐ/।এমনিতেও নৈকট্য ধ্বনি বা অর্ধ্বস্বরের সংজ্ঞা সুকুমার সেন লিখেছেন এরকম,“ই-কার এবং উ-কার এই দুই স্বরধ্বনি উচ্চারণ করিবার সময় যদি জিহ্বাগ্র অধিক উচ্চ অথবা ওষ্ঠদ্বয় অধিক সঙ্কীর্ণ হইয়া বায়ুপথ আংশিকভাবে রুদ্ধ করে এবং ধ্বনি ঈষৎ উষ্ম হইয়া যায়,তখন ধ্বনি দুইটিকে অর্ধ্বস্বর বলে।”১৮২ সুতরাং ‘ই,উ’ আলাদা করে নৈকট্যধ্বনি হতে পারে না।আদি বা মধ্যযুগের ধ্বনি নিয়ে আলোচনাতে কেউ কোথাও এমন দুই ধ্বনির অস্তিত্বের কথা লিখেছেন বলে আমরা দেখিনি,প্রতিবেশী ভাষাগুলোতেও এগুলোর অস্তিত্বের কথা কেউ লেখেন না।জগন্নাথের অভিমত মানতে গেলে অসমিয়াতেও ধ্বনিগুলোর অস্তিত্ব মানতে হয়।অথচ,গোলকচন্দ্র গোস্বামীও অসমিয়া অর্ধ্বস্বরগুলো সম্পর্কে সুকুমার সেনের স্বরেই বেশ বিস্তৃতই লিখেছেন এরকম,“অসমীয়া ভাষাত ঈ,এ’, এ-র পরা য় আরু ঊ,ও’,ও-র পরা ৱ অন্তঃস্থ ধ্বনি পোয়া যায়।যেনে ‘সি ভাত খাই কলেজলৈ গ’ল।আরু ‘সি ভাত খায়।’--এই বাক্য দুটাত ‘খাই’ শব্দত ‘ই’ আরু ‘য়’ দুয়োটাই অন্তঃস্থ য় ধ্বনি। ইহঁতর ‘ই’র পরা হোয়া য়-র উচ্চারণ (অর্থাৎ প্রথম বাক্যটো) ‘য়’-র পরা হোয়া য়-র উচ্চারণতকৈ কিছু উচ্চ।”১৮৩ কেন উচ্চ---সেই প্রশ্নের তিনি এর পরে আরো বিস্তৃত ব্যাখ্যা করেছেন।বাহুল্য ভেবে আমরা বাদ দিলাম।কিন্তু ‘য়’-র এমন রূপান্তর অসমিয়াতে খুবই সাধারণ কথা।সিলেটিতে যদিবা কেউ ‘যায়’ অর্থে ‘জাই’ বলেও থাকেন তবে তার ব্যাখ্যাও এমনটাই উপস্থিত করা যায় বলে আমাদের অভিমত।আর ‘মউআ’-তে ‘উ’ ধ্বনির কথা শ্রুতিধ্বনি প্রসঙ্গে স্পষ্ট করবার চেষ্টা করব।আমাদের মতে সিলেটিতে মান বাংলার মতোই নৈকট্যধ্বনিতে কোনো ভেদ নেই।অসমিয়ার সঙ্গেও খুবই সামান্যই।
শ্বাসবায়ু যদি জিহ্বার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় তবে পার্শ্বিক নৈকট্য ধ্বনি উচ্চারিত হয়।সংস্কৃত,বাংলা এবং অসমিয়া ‘ল’ এই ধ্বনি। গোলোকচন্দ্র ভাষাবিজ্ঞানের সাধারণ আলোচনা করতে গিয়ে এই পার্শ্বিক ধ্বনির আরো বেশ কিছু উপশ্রেণির আলোচনা করেছেন,--তার মধ্যে স্পষ্ট ল, দুষ্ট ল ইত্যাদিও আছে--- আমরা সেই সব প্রসঙ্গে আপাতত এগোচ্ছি না।সিলেটি, নোয়াখালি,চট্টগ্রামীতেও এই ধ্বনি নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই।
ঘৃষ্ট ধ্বনি: যদি কোনো ধ্বনি উচ্চারণের সময় শ্বাসবায়ুর গতিপথে প্রথমে সম্পূর্ণ বাধা ও পরে সেই বাধা কমে ঊষ্মধ্বনির মতো আংশিক বাধাতে পরিণত হয় তবে সেই ধ্বনিকে ঘৃষ্ট ধ্বনি বলে।সহজ করে লিখলে এই ধ্বনিগুলো স্পৃষ্টধ্বনি এবং মধ্যগামী উষ্মধ্বনি তথা শিসধ্বনির যৌগিক রূপ।বাংলা চ-বর্গীয় প্রথম চারটি ধ্বনি এই শ্রেণির ধ্বনি।অসমিয়াতে ঘৃষ্টধ্বনির প্রকৃতিটি স্বতন্ত্র।চারটি উষ্মধ্বনি,‘স,য,ষ,হ’-কেই কেন ঘৃষ্ট ধ্বনি বলা হয় সেই কথা আমরা আগেই আলোচনা করে এসেছি।সিলেটি ঘৃষ্ট ধ্বনির প্রসঙ্গ আমরা উষ্মধ্বনি আলোচনা করতে গিয়ে স্পষ্ট করে এসেছি।মানবাংলা ধ্বনিগুলো সিলেটিতে কখনো বা ব্যবহৃত হয়,কিন্তু প্রধান ঘৃষ্ট ধ্বনি দুটিই ʔচ,জ̣’/ʔt͡s,d͡z’/।
সঘোষ-অঘোষ ধ্বনি: এই ধ্বনির কথা আমরা আগে স্বরতন্ত্রীতে বাধার মাত্রা ভেদ অনুযায়ী ধ্বনির প্রকার ভেদে আলোচনা করে এসেছি।রামেশ্বর শ’ এই বিভাজনকে উচ্চারণ প্রকৃতি অনুযায়ী বিভাজিত তালিকাতেও উল্লেখ করেছেন।স্বরতন্ত্রীর কম্পন জাত সুর তথা ঘোষ মিশিয়ে দিলে ঘোষধ্বনি, না মেশালে অঘোষ।
মহাপ্রাণ-অল্পপ্রাণ ধ্বনি: মহাপ্রাণ-অল্পপ্রাণ ধ্বনি এই শ্রেণিতে শেষ উল্লেখযোগ্য বিভাজন। এর আগে আমরা স্বরতন্ত্রীয় বা কণ্ঠনালীয় ধ্বনি ‘হ’-এর কথা লিখে এসেছি। প্রশস্ত ফালিবৎ উষ্মধ্বনি প্রসঙ্গেও ধ্বনিটির কথা লিখেছি।স্বরতন্ত্রী দুটিকে প্রায় জুড়ে দিয়ে শ্বাসবায়ুতে বেশ জোরে ঠেলা দিয়ে সেই বাধা খোলে ‘হ’ উচ্চারণ করতে হয়।ফলে একটি ঘর্ষণ অনুভূত হয়।এ যেন নিতান্তই বাড়তি শ্বাসবায়ুর চিহ্ন,তাই সেই ধ্বনি যখন অন্যকোনো ধ্বনির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয় তখন একে ‘মহাপ্রাণতা’ গুণ বলে,আর ধ্বনিটিকে মহাপ্রাণ ধ্বনি।যে ধ্বনিতে এই গুণ মেশানো না হয় তাকে বলে অল্পপ্রাণ।গোলক চন্দ্র গোস্বামীকে অনুসরণ করে মহাপ্রাণ এবং সঘোষ ধ্বনির তফাতকে খুব সংক্ষেপে এভাবে বোঝানো যেতে পারে। যে ধ্বনি উচ্চারণে স্বরতন্ত্রীতে ঘর্ষণের সৃষ্টি হয়---সেই ধ্বনি মহাপ্রাণ।আর যে ধ্বনির উচ্চারণে স্বরতন্ত্রীতে কম্পনের সৃষ্টি হয় সেগুলো সঘোষ।১৮৪বাংলা অসমিয়া বর্গীয় বর্ণের প্রথম এবং তৃতীয় বর্ণগুলো অল্পপ্রাণ ধ্বনি,দ্বিতীয় এবং চতুর্থ ধ্বনিগুলো মহাপ্রাণ ধ্বনি।কিন্তু সিলেটি তথা পূর্ববঙ্গীয় ভাষাগুলোর ধ্বনিতে ‘মধ্যপ্রাণ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।আমরা বেশ কয়েক বার উল্লেখ করে এসেছি।নানা প্রক্রিয়াতে সিলেটি ধ্বনিগুলোর সঙ্গে একটি হালকা ‘হ’ যুক্ত অথবা বিযুক্ত হয়।অল্পপ্রাণ ধ্বনিগুলো মহাপ্রাণ,বা মহাপ্রাণ ধ্বনি গুলো অল্পপ্রাণ ধ্বনিতে পরিণত হবার ভ্রম তৈরি হয়।বিশেষ করে অঘোষ বা সঘোষ মহাপ্রাণ মাত্রেই ‘হ’ লোপের রেশটা যেন রেখে দেয়,তাতে প্রথমগুচ্ছের ধ্বনিগুলো বহিঃস্ফোটক উদ্গীর্ণ এবং দ্বিতীয় গুচ্ছের ধ্বনিগুলো অন্তঃস্ফোটক রুদ্ধ ধ্বনিতে পরিণত হয়। যেমন ‘ক’,প’,ট’,চ’,গ’,দ’,ড’,ব’,জ̣’/k’,p’,ʈ’, t͡s’ ɠ,ɗ,ɓ,d͡z’/।
পুরো ছবিটাকে স্পষ্ট করবার জন্যে আমরা এবারে আন্তর্জাতিক ধ্বনিবিজ্ঞান সংস্থার ২০১৫ পর্যন্ত শেষ সংশোধিত তালিকার (চিত্র-০২ ক,খ এবং ৩)১৮৫আশ্রয় নিয়ে বাংলা,অসমিয়া,সিলেটি আদি ভাষা এবং ভাষাবৈচিত্র্যের তুলনামূলক ছবিটি তুলে ধরবার চেষ্টা করব।এবং পুরো গবেষণা নিবন্ধে এই বর্ণমালার চিহ্নগুলোই ব্যবহার করব।
বাংলা ব্যঞ্জনধ্বনির শ্রেণিবিভাগের ছকটি (চিত্র ০৪-ক,খ) এবং বর্ণলিপিগুলো আমরা নিয়েছি রামেশ্বর শ্ব থেকে। কিন্তু কয়েকটি চিহ্ন অন্যরকম দেখাবে।যেমন সঘোষ মহাপ্রাণ আমরা লিখেছি এইভাবে,‘ভ্,ধ্,ঢ্,ঘ্ /bɦ,dɦ,ɖɦ,gɦ/’। রামেশ্বর লিখেছেন এই ভাবে,‘ভ্,ধ্ ,ঢ্,ঘ্ /bh,dh,ɖh,gh/’।কেন?এর কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেন নি।সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলা ‘হ’-এর জন্যেও /ɦ/ ব্যবহার করেছেন,এই সম্পর্কে ইতিমধ্যে আমরা লিখে এসেছি।আমরা আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালার যে ছকটি দিলাম (চিত্র ২ ক) সেখানেও নিচে লেখা আছে, “Symbols to the right in a cell are voiced ….” এবং fricative-glottal-এ দুটি চিহ্ন আছে/h ɦ/।এই সূত্রানুসারে সঘোষ ধ্বনিতে/ɦ/ বসবে।অসমিয়া ব্যঞ্জনধ্বনি ছকটিও আমরা প্রথমে ভাষাচার্য গোলোকচন্দ্র থেকে নিয়েও (চিত্র -০৫ ),তুলনায় বুঝতে সুবিধের জন্যে আমাদের মতো করে সাজিয়ে নিলাম।(চিত্র -০৬-ক,খ) ধ্বনিবৈজ্ঞানিক চিহ্নের ধারণা নিতে তাঁর ‘অসমীয়া ভাষার উচ্চারণ’ গ্রন্থের থেকে কিছু সাহায্য নিলেও মূলত সুনীতি চট্টোপাধ্যায়কেই অনুসরণ করেছি। ক্রমে ক্রমে এর পরে সিলেটি,নোয়াখালি এবং চট্টগ্রামী ভাষাবৈচিত্র্যের ছক থাকছে।
সিলেটি ধ্বনিগুলোও মানবাংলার মতো একই নিয়মে সাজিয়েছি,পরিবর্তিত বর্ণলিপিগুলো সম্পর্কে ইতিমধ্যে বিস্তৃত আলোচনা করে এসেছি। সেগুলোকেই চিত্র -৭-ক,খ-তে সামান্য গুছিয়ে নিলাম। দেখা যাচ্ছে,প্রবাহিত –প্রতিহত সব মিলিয়ে সিলেটি প্রধান ব্যঞ্জন ধ্বনিসংখ্যা ত্রিশ(৩০)টি।বাকিগুলো অপ্রধান।বিকল্পে ব্যবহৃত হয়।সিলেটি লিখতে গেলেও আমরা মান বাংলা বর্ণলিপি তথা বর্ণমালাই ব্যবহার করি।এখানে যেহেতু নিতান্ত ধ্বনির চরিত্র বুঝবার জন্যেই উল্লেখ করা হচ্ছে, তাই ছকটিতে বিকল্প ধ্বনিগুলোও ছায়াচ্ছন্ন করে বন্ধনীতে উল্লেখ করে রাখলাম।তাতে প্রধান ধ্বনিগুলোর সম্পর্কেও ধারণা স্পষ্ট হবে।
নোয়াখালি এবং চট্টগ্রামী ভাষাবৈচিত্র্যের ছক দু’টিও সঙ্গে রাখা গেল যাতে সিলেটির সঙ্গে অসমিয়ার মিলন চিহ্নগুলো যে প্রতিবেশী বাংলাভাষাবৈচিত্র্যে ও দুর্লভ নয় সেই সম্পর্কে একটা ধারণা মেলে। সেটিতে আমরা বর্ণলিপিগুলো পাল্টাই নি কিছু। যেভাবে লিখেছিলেন রবীন্দ্র কুমার দত্ত ঠিক সেই ভাবেই রেখেছি।ভাষা-বৈচিত্র্য দু’টি আমাদের অধ্যয়নের কেন্দ্রীয় বিষয় নয় বলেই রবীন্দ্র দত্ত কতটা সঠিক কতটা বেঠিক সেই বিশ্লেষণে বিস্তৃত যাবার সুযোগ না থাকাতে আমাদের তাই করতে হলো।শুধু পারিভাষিক শব্দগুলো যতটা সম্ভব তাঁর ধারণাকে অক্ষত রেখে আমাদের ধারণার কাছাকাছি নিয়ে এলাম,অন্যথা বোঝা কঠিন হত,ছবিটা অনেক বেশি অস্পষ্ট হত।ফলে আমাদের ছকটিকেও আদর্শ বলা যাবে না,শুধু ধারণা পেতে সাহায্য করবে। দেখা যাচ্ছে,নোয়াখালির ছক চিত্র -৮-ক,খ এবং চট্টগ্রামী ছক চিত্র-৯-ক,খ মোটের উপরে একই রকম।চিত্র -৯-ক-তে শুধু চট্টগ্রামীতে প্রতিহত সঘোষ মহাপ্রাণের জায়গাগুলো খালি। চিত্র -৯-খ-তে প্রবাহিত তাড়িত ধ্বনি বলে কিছু নেই।প্রবাহিত ঘৃষ্ট উষ্ম স্বরতন্ত্রীয় অল্পপ্রাণ ধ্বনি ক̣̖ /ḳ/ চট্টগ্রামীতে নেই। নেই প্রবাহিত ঘৃষ্ট-উষ্ম মহাপ্রাণ ঝ /zh/ ধ্বনিও।দুই একটি বিসঙ্গতিও আমাদের ভাবায়।চিত্র – ৮-খ এবং ৯-খ-তে চ-বর্গীয় উষ্ম-ঘৃষ্ট ধ্বনি রয়েছে,কিন্তু সেই তালিকাতে নেই জ̣̖’/z’/ ধ্বনিটি। সেটি আছে প্রতিহত ধ্বনির তালিকাতে চিত্র ৮-ক এবং ৯-ক-তে। তেমনি গ̖’/g’/ ধ্বনিটি কী করে একাধারে অন্তঃস্ফোটক এবং স্বরতন্ত্রীয় তালিকাতে বসতে পারে! বাকি অন্তঃস্ফোটক ধ্বনিগুলোর যদি সমগোত্রীয় অঘোষ ধ্বনিগুলোর সঙ্গে উচ্চারণ স্থান একই হতে পারে,এই ধ্বনিটির একই রাখতে অসুবিধে কোথায় ছিল? ধ্বনি চিহ্নের সমস্যাও আছে,( ’ ) দিয়ে তিনি স্বরতন্ত্রীয় স্পৃষ্ট ধ্বনিকে বুঝিয়েছেন।এমন আর যেগুলো রয়েছে ছাপাখানার সীমাবদ্ধতা ভেবে নিতে অসুবিধে নেই।কিন্তু পাঠকদের অবশ্যি বিভ্রান্ত করে।এই কথাগুলোকে মনে রেখে আমাদের তৈরি সিলেটি ভাষা ছকের সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে হবে। অসমিয়া এবং বাংলার সিলেটি সহ তিন ভাষাবৈচিত্র্যের ছকের কিছু ধ্বনিকে আমরা তিন রকম ভাবে করে চিহ্নিত করেছি। প্রতিটি ধ্বনির কোষসীমা (Cell Border) তিন রকম আঁকা আছে। প্রথম প্রকারে কোষটি ছায়াচ্ছন্ন সঙ্গে কোষ সীমা বিন্দু জুড়ে তৈরি, দ্বিতীয় প্রকারে কোষসীমা হাইফেন জুড়ে তৈরি এবং তৃতীয় প্রকারে হাইফেন বিন্দু হাইফেন এই ক্রমে সীমারেখাগুলো সাজানো। যদি কোথাও দুই প্রকারই মিশেছে তবে সীমারেখার মধ্যেও সেই মিশ্রণ দেখা যাবে—যেমন ০৭-ক চিত্রে চ’ /t͡s’/ এরকম দেখানো আছে।
১ম প্রকারের ধ্বনিগুলো সিলেটির বিকল্প তথা অপ্রধান ধ্বনি। এর সীমা বিন্দুতে ঘেরা।২য় প্রকার সীমাচিহ্নতে আমরা নোয়াখালি,চট্টগ্রামী এবং অসমিয়ার কিছু প্রবাহী ধ্বনিকে চিহ্নিত করেছি। এর সীমা হাইফেনের মতো ছোট্ট রেখাতে ঘেরা। ৩য় প্রকার সীমাচিহ্নতে নোয়াখালি,চট্টগ্রামী এবং সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্যের কিছু ধ্বনিকে চিহ্নিত করেছি। এর সীমাচিহ্ন রেখা-বিন্দু-রেখা এই ক্রমে ঘেরানো। পারিভাষিক জটিলতাকে পাশে সরিয়ে রাখলে একই রকম সীমাচিহ্নিত ধ্বনিগুলো হয় একই বা কাছাকাছি সদৃশ ধ্বনি।এমন নয় যে আর কোনো ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছের সঙ্গে সাদৃশ্য নেই। কিন্তু বিশেষ করে ছায়াচিহ্নিত ধ্বনিগুলো ভাষাগুলোর ঘনিষ্ঠতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ২য় প্রকার ছায়াচিহ্নে আমরা সিলেটির কোনো ধ্বনিকে চিহ্নিত না করলেও এগুলো সিলেটিতেও মোটের উপর একই রকম।এবং সেগুলোকে সিলেটি –অসমিয়ার ঘনিষ্টতার চিহ্নস্বরূপ প্রায়ই দেখানো হয়। কিন্তু ছকগুলো দেখাচ্ছে সেরকম ঘনিষ্ঠতা পূর্ববাংলার আরো সব ভাষাবৈচিত্র্যে দেখানো সম্ভব।এমনটা আমরা ঢাকা,কুমিল্লা,ময়মনসিংহের ভাষা-বৈচিত্র্য দিয়েও দেখাতে পারতাম।অন্যদিকে ৩য় প্রকার সীমাচিহ্নিত ধ্বনিগুলো দেখায় পূর্ববঙ্গীয় ভাষাবৈচিত্র্যগুলো মানবাংলার থেকে আলাদা বটে,কিন্তু যত না অসমিয়ার সঙ্গে---তার থেকে বেশি পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে ধ্বনি সম্পর্কে বাঁধা।সিলেটিকে সেই সম্পর্ক বন্ধন থেকে আলাদা করে ভাবাটাই কঠিন।
।। স্বরধ্বনি ।।
বাংলা–অসমিয়া দুই ভাষাতেই স্বরধ্বনিগুলো সবটাই সঘোষ ধ্বনি। তারপরেও এদের শ্রেণিবিভাজন আলাদা আলোচনার দাবি রাখে।রামেশ্বর শ’ লিখেছেন,“স্বরধ্বনির বৈচিত্র্য নির্ভর করে মূলত দুটি বিষয়ের উপরে:এক,স্বরধ্বনি উচ্চারণের কাল-পরিমাপের উপরে;এবং দুই,স্বরধ্বনির উচ্চারণের সময় শ্বাসবায়ুর যাতায়াতের পথের আকৃতির উপরে”১৮৬।প্রথমটিকে বলে মাত্রাগত শ্রেণিবিভাগ আর দ্বিতীয়টিকে বলে গুণ বা প্রকৃতিগত শ্রেণিবিভাগ।বাংলাতে স্বরধ্বনির দৈর্ঘ্য উচ্চারণের বেলা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয় যদিও বর্ণমালাতে আছে এবং একই ধ্বনি শব্দে অবস্থান ভেদে হ্রস্ব-দীর্ঘ হয়। যেমন, ‘দিন’ কিংবা ‘দীন’---বাংলাতে দুই শব্দেই ‘ই’ উচ্চারণে দীর্ঘ,কিন্তু ‘দিনের’ কিংবা ‘দীনের’ দুই শব্দেই ‘ই’ উচ্চারণে হ্রস্ব। অসমীয়াতেও তাই ঘটে।কিন্তু সংস্কৃত–ইংরাজি ইত্যাদি ভাষাতে হ্রস্ব-দীর্ঘ উচ্চারণ ভেদে অর্থভেদ ঘটে যায়।সংস্কৃতে তাই এই ধ্বনিগুলো ঈ,এ,আ,ও,ঊ [iː,eː,aː,oː,uː] এবং ইংরেজিতে [iː,aːɔː,uː,əː] এই ধ্বনিগুলো দীর্ঘস্বর।অসমিয়া-বাংলাতে তাই স্বরধ্বনির গুণ বা প্রকৃতিগত শ্রেণিবিভাগই গুরুত্বপূর্ণ।এই শ্রেণিবিভাগ নির্ভর করে মুখের ভেতরে শ্বাসবায়ুর যাতায়াতের গতিপথের আকৃতির উপর।সেই আকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে জিহ্বার অবস্থান,ঠোঁটের আকৃতি এবং মুখের ভেতরে শূন্যস্থানের পরিমাপের উপরে। সেই অনুযায়ী ধ্বনির তিনরকম বিভাজন করা হয়।১)জিহ্বার অবস্থান,২)মুখবিবরের শূন্যতার পরিমাপ এবং ৩)ঠোঁটের আকৃতি।
সামনের কাঠিটি সামনের দিকে সামান হেলানো,পেছনের কাঠিটি সোজা খাড়া।চারটি শোয়ানো সমান্তরাল রেখা দিয়ে একে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে।চারপাশে আটটি মিলন বিন্দু দেখাচ্ছে।সামনের চারটি বিন্দু দাঁতের দিককার,পেছনের চারবিন্দু গলার দিককার। এই বিন্দুগুলোই হলো সামনে পেছনে উপরে নিচে জিহ্বার অবস্থান বিন্দু। সামনের বিন্দুগুলোতে জিহ্বাকে রেখে ধ্বনি উচ্চারণ করতে গেলে ঠোঁট দুটো কানের দিকে প্রসারিত হয়ে যায়,পেছনের দিকে ঠোঁট ফুঁ দেবার সময় যেমন হয় গোলাকার হয়ে যায়।
সামনের বিন্দু গুলোতে উপর থেকে নিচে উচ্চারিত ধ্বনিগুলোর চিহ্ন [i,e,ɛ,a], পেছনের বিন্দুগুলোতে উপর থেকে নিচে উচ্চারিত ধ্বনিগুলোর চিহ্ন ক্রমান্বয়ে [u,o,ɔ,ɒ]। এই আটটিকে প্রাথমিক মৌলিক স্বরধ্বনি বলে।তবে এর ক্রম গোণা হয় এই ভাবে-- সামনে উপর থেকে নিচে কিন্তু পেছনে নিচে থেকে উপরে।ক্রমটি এরকম [1.i,2.e,3.ɛ,4.a,5.ɒ,6.ɔ,7.o,8.u]।বাংলাতে এই ধ্বনিগুলো লেখা যেতে পারে এইভাবে ‘ই,এ,এ্যা,আ’,আ,অ০,ও,উ’। বাংলাতে এগুলো স্বাভাবিক উচ্চারণ,কিন্তু কিছু কিছু ভাষাতে জিহ্বা পেছনে গেলে জিহ্বা প্রসারিত থাকে,আর সামনে এসে ধ্বনি উচ্চারণ করতে গেলে জিহ্বা কুঞ্চিত হয়ে যায়।এই সব ভাষার জন্যে আরো একগুচ্ছ মৌলিক স্বরধ্বনি চিহ্নিত করে এক মাপকাঠি কল্পনা করা হয়েছে।চিত্র -১০এ এই ধ্বনির চিহ্নগুলো ভেতরের দিকে দেখানো হয়েছে।তাই এই ধ্বনিগুলোকে বলে গৌণমৌলিক স্বরধ্বনি।এদের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে।রামেশ্বর শ’ লিখেছিলেন ১৪টি,তার মধ্যে ১১টিই প্রধান।কিন্তু আমাদের ছবিতে সেই সংখ্যা আরো বেশি। গৌণ মৌলিক স্বরধ্বনির ক্রম সংখ্যা প্রাথমিক মৌলিক স্বরধ্বনির পরে থেকে গোনা হয়।আর এই দুয়ের মাঝখানেও কিছু ধ্বনি রয়েছে যেগুলো উচ্চারণের সময় ঠোঁট কুঞ্চিত বা প্রসারিত কিছুই হয় না। সেগুলোকে মাঝরেখা বরাবর দেখানো হয়েছে। এই মাপকাঠির সুবিধে হলো যদি বলা হয়-- বাংলা ‘ই’ ১ নং স্বরধ্বনি বা মৌলিক স্বরধ্বনি [i]র সামান্য নিচে থেকে উচ্চারিত হয় তবে যে কেউ ধরে ফেলবেন এর উচ্চারণ আসলে কী?এই আটবিন্দুর স্বতন্ত্র নাম রয়েছে।জিহ্বাকে সামনের দিকে রেখে উচ্চারিত ধ্বনির নাম সম্মুখ স্বরধ্বনি,পেছনে রেখে উচ্চারিত স্বরধ্বনির নাম পশ্চাৎ স্বরধ্বনি।প্রাথমিক এবং গৌণ মিলিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মুখ স্বরধ্বনি [ i,e,ɛ,a,y,ø,œ, ɶ,] –এই আটটি হলেও বাংলাতে আসলে তিনটি ই,এ,অ্যা/i,e,æ/। অসমিয়াতে ই,এ’,এ/i,e,ɛ/। তেমনি আন্তর্জাতিক পশ্চাৎ স্বরধ্বনি এই আটটি হলেও [ɒ,ɔ,o,u,ɑ,ʌ,ɤ,ɯ] বাংলাতে পশ্চাৎ স্বরধ্বনি তিনটি অ,ও,উ/ɔ,o,u/, অসমিয়াতে চারটি অ,অ’,ও,উ/ɒ,ɔ,o,u/। সম্মুখ এবং পশ্চাদ স্বরধ্বনির মাঝের স্বরধ্বনিকে কেন্দ্রীয় স্বরধ্বনি বলে। গৌণ মৌলিক স্বরধ্বনি যেমন ə। বাংলার একটি সেরকম ধ্বনি রয়েছে ‘আ’। কিন্তু সেটি উচ্চারণের সময় জিহ্বা /ə/-এর থেকে নিচে থাকে বলে এর চিহ্ন ɐ হওয়া উচিত।অথচ রামেশ্বর শ’/a/ দিয়েই কাজ চালিয়েছেন।১৮৭অসমিয়াতে গোলোকচন্দ্র বা অন্যেরাও তাই করেছেন।১৮৯
জিহ্বা যতটা উপরের দিকে উঠলে পরেও এমন কোনো বাধা তৈরি হয় না যে উচ্চারিত ধ্বনির গুণ পালটে ব্যঞ্জন হয়ে যায়,সেই সর্বোচ্চ অবস্থানে উচ্চারিত স্বরকে উচ্চ-স্বরধ্বনি বলে।প্রাথমিক মৌলিক উচ্চ-স্বরধ্বনি দুটি [i,u];গৌণ মৌলিক উচ্চ-স্বরধ্বনি আরো দুই [y,ɯ];বাংলাতে উচ্চ-স্বরধ্বনি দুটিই ই,উ/i,u/। অসমিয়াতেও তাই। জিহ্বাকে একেবারে নিচে নামিয়ে এনে উচ্চারিত ধ্বনিকে বলে নিম্ন-স্বরধনি।প্রাথমিক মৌলিক নিম্ন-স্বরধ্বনি দুটি [a,ɒ]; গৌণ মৌলিক নিম্ন স্বরধ্বনি দুটি [œ,ɑ];বাংলা নিম্ন-স্বরধ্বনি একটি ‘আ’/ɐ/। অবস্থান অনুসারে একে কেন্দ্রীয় স্বরধ্বনিও বলে।কিন্তু অসমিয়াতে দুটি।আ,অ/ɐ,ɒ/।উচ্চ এবং নিম্ন স্বরধ্বনির মাঝামাঝি আরো দুই স্তর রয়েছে।উচ্চ-মধ্য এবং নিম্ন-মধ্য স্বরধ্বনি।একেবারে উপরের বিন্দু থেকে এক তৃতীয়াংশ নামিয়ে আনলে উচ্চ-মধ্য ধ্বনি উচ্চারিত হয়।আরো এক তৃতীয়াংশ নামিয়ে আনলে নিম্ন-মধ্য ধ্বনি।প্রাথমিক মৌলিক উচ্চ-মধ্য স্বরধ্বনি [e,o],গৌণ মৌলিক উচ্চ-মধ্য স্বরধ্বনি [ø,ə,ɤ]; বাংলা উচ্চ-মধ্য স্বরধ্বনি এ,ও/e,o/। অসমিয়াতেও তাই। প্রাথমিক নিম্ন-মধ্যমৌলিক স্বরধ্বনি [ɛ,ɔ],গৌণ নিম্ন-মধ্য মৌলিক স্বরধ্বনি [œ,ʌ] ; বাংলা নিম্ন-মধ্য স্বরধ্বনি অ্যা,অ/æ,ɔ/। অসমিয়াতে প্রাথমিক নিম্ন-মধ্য মৌলিক স্বরধ্বনির মতোই এ’,অ’/ɛ,ɔ/।
মুখের ভেতরকার শূন্যস্থানের পরিমাপ অনুসারে এই চারটি শ্রেণি ভেদের আরো চারটি নাম রয়েছে।একেবারে উপরে জিহ্বা থাকলে যেহেতু ফাঁকা ঠাই প্রায় থাকেই না তাই এই উচ্চ অবস্থানে উচ্চারিত ধ্বনির নাম সংবৃত। অন্যদিকে জিহ্বা একেবারে নিচে থাকলে যেহেতু মুখের ভেতরটা প্রায় ফাঁকাই থাকে তাই এই নিম্ন অবস্থানে উচ্চারিত ধ্বনির আরেক নাম বিবৃত ধ্বনি। তেমনি উচ্চ-মধ্য এবং নিম্ন-মধ্য স্বরধ্বনির বিকল্প নাম যথাক্রমে অর্ধ-সংবৃত এবং অর্ধ-বিবৃত স্বরধ্বনি। গোলোকচন্দ্র সংবৃতাভাস এবং বিবৃতাভাস বলে মাঝে আরো দুই শ্রেণির কথা উল্লেখ করেছেন১৯০।যেমন ক্রমানুসারে অসমিয়া এ’ এবং এ।এই অব্দি চিত্র ১০- এর পরিভাষা এবং ধ্বনি গুলো ব্যাখ্যা করা হলো।কিন্তু জিহ্বার কুঞ্চন–প্রসারণ নিয়ে আরো কিছু কথা লেখার আছে। ছবিতে এই নিয়ে বিস্তৃত নেই। শুধু নিচে লেখা রয়েছে,“Where symbols appear in pairs,the one to the right represents a rounded vowel.” অর্থাৎ সম্মুখ গৌণ মৌলিক ধ্বনিগুলো এবং পশ্চাদ-প্রাথমিক মৌলিক ধ্বনিগুলো rounded,মানে কুঞ্চিত স্বরধ্বনি। কেননা এগুলো জোড়ের ডানে রয়েছে।বামে থাকা ধ্বনিগুলো প্রসারিত ধ্বনি। গোলোকচন্দ্র অসমিয়াতে এগুলোকে ক্রমে সংবৃত্তৌষ্ঠ্য এবং বিবৃতৌষ্ঠ্য লিখেছেন।এই দুয়ের মাঝামাঝি অবস্থাতে কিছু ধ্বনির কথা আগেই লিখে এসেছি যেখানে জিহ্বার কুঞ্চন প্রসারণ কিছুই হয় না। যেমন বাংলা–অসমিয়া ‘আ’--সেগুলোকে স্বাভাবিক ধ্বনি বলে।
এবারে আমরা আন্তর্জাতিক ধ্বনিবর্ণমালার মাপকাঠিতে বাংলা ধ্বনিগুলোকে চিহ্নিত করবার মতো অবস্থাতে এসে গেছি। সেই ছবি হবে চিত্র ১১-তে যেমন দেখাচ্ছে।
এছাড়াও ব্যঞ্জন ধ্বনির মতোই শ্বাসবায়ুর গতিপথ অনুসারে স্বরধ্বনিকে নাসিক্য এবং মৌখিক এই দুইভাগে ভাগ করা হয়।এই অব্দি আলোচিত সব স্বরধ্বনিরই অনুনাসিক রূপ আছে।এবং অনুনাসিক রূপটি অসমিয়া বাংলা দুই ভাষাতেই শব্দের অর্থ পালটে দেয়।এই নিয়ে পরে আমরা বিস্তৃত আলোচনা করব।আপাতত এর আগে তৈরি ব্যঞ্জন ধ্বনির ছকের মতো বাংলা স্বরধ্বনির একটি সহজ ছকে (চিত্র ১২) উপস্থাপন করা হচ্ছে।
অসমিয়া স্বরধ্বনির ছক (চিত্র ১৩) ব্যঞ্জন ধ্বনিরমতোই আমরা গোলোকচন্দ্রের থেকে নিলেও কেন্দ্রীয় নিম্ন ধ্বনি ‘আ’ এর জন্যে তিনিও ‘a’ লিখলে আমরা IPA-র শেষ সংস্করণের অনুসরণে /ɐ/-ই লিখলাম।কারণ /a/ কুঞ্চিত প্রাথমিক মৌলিক ধ্বনি।আরো কিছু পারিভাষিক এবং তাত্ত্বিক সমস্যা আমাদের এখানেও হচ্ছিল। যেমন জিহ্বার উচ্চতা অনুসারে চারটি শ্রেণির মধ্যে উচ্চ-মধ্য এবং নিম্ন-মধ্যকে ক্রমে তিনি মধ্যসম, মধ্যাভাস বলে উল্লেখ করেছেন। এর কারণ অসমিয়া এবং বাংলা ধ্বনির উচ্চারণ বিন্দু এক নয় এবং তিনি বেশ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণে গেছেন।তার উপরে ‘ই’-কে প্রসারিত বোঝাতে বিবৃত১৯১,কোথাও ‘অ’-কে কুঞ্চিত বোঝতে ‘সংবৃত্ত’ লিখছেন।‘ধ্বনি-বিজ্ঞানর ভূমিকা’ বইতে যদিও সংজ্ঞাগুলো স্পষ্ট,কিন্তু দুই ভাষাবিজ্ঞানে দুই ধরণের পরিভাষা প্রথম পাঠককে বেশ কঠিন যাত্রাতেই ঠেলে দেয়।আমাদের বেলাও তা হয়েছে । যেমন গোলকচন্দ্রের আলোচনা অনুসরণ করে অসমিয়া স্বরধ্বনির ছক যদি তৈরি করি সেটি দেখাবে চিত্র ১৩-র মতন। এই ছক অনুসরণ করে আমরা মৌলিক স্বরধ্বনি চিত্রে অসমিয়া ধ্বনিকে বসাতে পারি।কিন্তু যখন গোলোকচন্দ্র লেখেন,--“অসমিয়া ভাষার ও ধ্বনি যথেষ্ট উচ্চ,মুখ্য মান ধ্বনি ও-র অবস্থানতকৈ উচ্চ নহলেও নিম্ন নহয়। বঙলা ভাষার ও-ধ্বনি মুখ্য ধ্বনি ও-তকৈ কিছু নিম্ন।গতিকে অসমিয়া ভাষার ও-ধ্বনি বঙলা ভাষার ও ধ্বনিতকৈ বহুত উচ্চ।”১৯২--- তখন আমাদের মনে হয় উপরের ছবিতে ও বসানো উচিত ছিল আমরা যেখানে উ/U/ বসিয়েছি,সেখানে।কিন্তু এই উ ধ্বনির জন্যে তিনি /U/ চিহ্ন ব্যবহার করেছেনই এর জন্যে যে এটি /u/ থেকে নিম্ন ধ্বনি,এবং এর পরেও অসমিয়াতে অপ্রধান একটি ‘মধ্যসম’ ধ্বনি ও’ /O/ এর কথা উল্লেখ করেই শুধু তিনি তার নিম্নবর্তী ও /o/ ধ্বনির কথা আলোচনা করেছেন।১৯৩সুতরাং কথাগুলো বেশ গোলমেলে।এই গোলমাল ভাষাবিজ্ঞানের একটি সাধারণ সমস্যা। কেননা,আন্তর্জাতিক স্বরধ্বনির মাপকাঠিটি বানিয়েছিলেন ডানিয়েল জোনস।১৯৫৬তে তিনি ধ্বনিগুলোর শেষ সংস্করণ রেকর্ড করেন।এটি একটি বিমূর্ত মাপকাঠি।দীর্ঘ অনুশীলন এবং শিক্ষকের দিকনির্দেশনা ছাড়া এটি ব্যবহার করা কঠিন বলে তিনি নিজেও সচেতন ছিলেন।বহু ভাষাবিজ্ঞানী এর সমালোচনাও করেছেন,যদিও আলোচনার সুবিধের জন্যে মাপকাঠিটি আন্তর্জাতিক ধ্বনিবিজ্ঞান সংস্থা এখনো ব্যবহার করে। গোলোকচন্দ্র সেসব কথা জেনেই নিজে সেটি ব্যবহার করে অসমিয়া স্বরধ্বনিকে সুস্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত করতে যান নি ১৯৪।আমরাও তাই বিরত থাকছি।
তাঁর ‘Structure of Assamese’ বইয়ের অনুসরণে দীপ্তি ফুকন পাটগিরি একটি ছক তৈরি করে রেখেছেন।তিনি অসমিয়াতেও আমাদের মতো একই পারিভাষিক শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন।১৯৫সুতরাং আমরাও নিজেদের পরিভাষাতেই স্থির থাকতে পারি।এবং সেই ছকে আন্তর্জাতিক বর্ণলিপি ব্যবহারে ব্যঞ্জনধ্বনিতে যে নীতি অনুসরণ করেছি, সেটা এখানেও করছি।চিত্র ১৪-তে। এই কথা মনে রেখে যে গুলোকে দেখে বাংলার মতো হুবহু মনে হচ্ছে সেগুলোও হুবহু আসলে নয়। বিশেষ করে জিহ্বার উচ্চতার এবং মুখের ভেতরে শূন্যতার তফাত হয়েই থাকে।এই নিয়ে সমস্যা হলে আমরা গভীরে যাবার চেষ্টা করব। জিহ্বার কুঞ্চন প্রসারণে যদিও সেরকম কোনো সমস্যা নেই। দেখা যাচ্ছে, বাংলা এবং অসমিয়া স্বরধ্বনি মোটের উপরে একই।শুধু একটি বাড়তি নিম্ন বিবৃত পশ্চাৎ ধ্বনি রয়েছে ‘অ’/ɒ/।আর তিনটি ধ্বনিচিহ্নের সমস্যা আমাদের সমাধান করতে হচ্ছে।বিস্তৃত আলোচনা আমরা স্বনিম প্রসঙ্গে করব। এই ছক অনুসারে দৃশ্যত অসমিয়া এ’ এবং বাংলা এ, অসমিয়া এ এবং বাংলা অ্যা,অসমিয়া অ’ এবং বাংলা অ একই বা কাছাকাছি অবস্থানে উচ্চারিত ধ্বনি।কিন্তু দুই ভাষাতে দুই রকম বর্ণচিহ্ন ব্যবহার করে লেখা হয়।এর মধ্যে এ’ ধ্বনিটির জন্যে অসমিয়া শব্দে কোনো আলাদা লেখ্যরূপ না থাকলেও, ব্যঞ্জনের সঙ্গে সংলগ্ন অ’ কে বোঝাতে একটি ঊর্ধ্বকমা ব্যবহৃত হয়। যেমন এ’ দিয়ে লেখা বেদ,দেশাচার; এ দিয়ে লেখা এতেকে,এটা। অ’ দিয়ে লেখা অ’ত,গ’ল,ল’ৰা ইত্যাদি।এই ঊর্ধ্বকমা অসমিয়াতে বিশ শতকেই প্রচলিত হয়।১৯৬ এই ছকে এটাও স্পষ্ট যে অসমিয়া এ বাংলা অ্যা-র থেকে সামান্য উপরে কিন্তু অ বাংলা অ-এর থেকে অনেকটা নিচে উচ্চারিত হয়।বস্তুত এই উচ্চারণ মান বাংলাতে নেই। সিলেটি নিয়ে যা কিছু বিচ্ছিন্ন প্রবন্ধাদি মেলে সেখানে স্বরধ্বনি প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা নজরে পড়ে না বললেই চলে। নিখিলেশ পুরকাইত তাঁর উপভাষা সমীক্ষাতে শুধু লিখেছেন সিলেটি-কাছাড়ি দুই বিভাষাতেই ‘ও’-কারের উচ্চারণ –‘উ’-কার হয়১৯৭।এবং কাছাড়ি বিভাষাতে ‘এ’ > ‘অ্যা’ হয়।সুকুমার সেন কথাটি পূর্ববাংলার তথা ‘বঙ্গালী’ ভাষাবৈচিত্র্যগুলো সম্পর্কে লিখেছিলেন১৯৮।সুধাংশু শেখর তুঙ্গ লিখছেন,“Cachar Bengali and Bishnupriya have only six primary vowels:/ɔ,a,i, u,e,ɛ/,dipthongal /ɔi/ and /ou/.” ১৯৯ তিনি মৌলিক স্বরধ্বনির যে ছকে এই দুই ভাষা সহ তাঁর আলোচ্য ভাষাগুলোর ধ্বনিকে বসিয়ে দেখিয়েছেন,তাতে /a/ হচ্ছে আসলে কেন্দ্রীয় ধ্বনি/ɐ/।অর্থাৎ প্রাথমিক স্বরধ্বনি নয়।তিনি /ɛ/ ধ্বনির উল্লেখ করেছেন যেটি কিনা.৩ নং প্রাথমিক মৌলিক স্বরধ্বনি।অসমিয়াতে ‘এ’ এবং রবীন্দ্র কুমার দত্ত একে ‘এ্য’ লিখেছেন।সুকুমার সেন একে ‘এ’ ’ লিখে চিহ্নিত করেছেন২০০।অর্থাৎ বাংলা ‘অ্যা’/æ/ নয়।তিনি /u/ এবং /ɔ/-এর মাঝখানে সিলেটিতে অল্পব্যবহৃত কিন্তু মানবাংলা থেকে ভিন্ন ধ্বনির অস্তিত্বের কথাও লিখেছেন--/ɔ’/। ‘কই’ /kɔ’i/-এমন শব্দে দ্বিস্বরের সঙ্গে শোনা যায় বলে লিখেছেন।একক ধ্বনি (Monophthong) নয় বলে আপাতত আলোচনা থেকে সরিয়ে রাখতে পারি।আমাদের সমস্যাতে ফেলেছে এই /ɛ/ কিংবা /æ/ ধ্বনি।অধ্যাপক নিখিলেশ পুরকাইত লিখছেন দ্বিতীয়টি কাছাড়ি ভাষাবৈচিত্র্যে রয়েছে,তাঁরই সহকর্মী লিখছেন প্রথমটি আছে।অবশ্য নিখিলেশ পুরকাইত লিখেছেন বাংলা হরফে এবং সুধাংশু শেখর তুঙ্গ ব্যবহার করেছেন আন্তর্জাতিক বর্ণলিপি। দুইজনে একই ধ্বনির কথা ভেবেও লিখতে পারেন।কিন্তু জগন্নাথ চক্রবর্তী লিখেছেন,“বাংলা মৌলিক স্বরধ্বনির প্রায় সবগুলিই বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা ভাষায় পাচ্ছি।বাদ পড়েছে শুধু নিম্নমধ্য সন্মুখ অর্ধবিবৃত স্বরধ্বনি ‘অ্যা’ [ বা ‘এ্যা’]... বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার আলোচনা ও অভিধানেও মহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘অ্যা’-কে একটি পৃথক স্বরধ্বনি রূপে গণ্য করেছেন।কিন্তু বরাক উপত্যকায় এই তীব্র স্বরধ্বনিটি প্রকৃতই উচ্চারণের প্রবণতা নেই।তাই স্বরধ্বনিগুচ্ছ থেকে এটিকে বাদ দিলাম।”২০১ তিনিও আসলে /ɛ/ তথা অসমিয়া ‘এ’ ’ ধ্বনিটির কথাই বলছিলেন,মানবাংলা /æ/ নয়।ধ্বনিটি বাদ দিতে গিয়ে তিনি কোনো কালিক কিংবা কালক্রমিক তুলনা করে যৌক্তিক উপস্থাপন করেন নি। নিছক বাদ দিয়ে দিয়েছেন,অথচ ‘বরাক উপত্যকার কথ্য বাংলার অভিধান’-এ আবিদ রাজা মজুমদার ‘এ্যারাম,এ্যারার,এ্যারে,এ্যারা,এ্যালান,এ্যাশনা’ এমন প্রচুর শব্দ রেখেছেন।২০২ ধ্বনিটি নিয়ে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কিছু কথা আমাদের ভাবনাকে রূপ দিতে সাহায্য করতে পারে। তিনি লিখেছেন “[æ] is comparatively recent sound in the NB. Standard Colloquial, and it originated from MB. [ɛɑ,ɛa,ea], not earlier than towards the very end of the MB. Period. In East Bengal dialects, [æ] is rare or unknown, and [ɛ] and [ɑ, a] are used for it.”২০৩ ধ্বনিটির উৎপত্তিতে আসলে বহু সময় স্বরসঙ্গতির আকর্ষণ কাজ করে।পাশের নিম্নস্বরের টানে উচ্চমধ্য স্বর নিম্নমধ্য স্বরে পরিবর্তিত হয়,এটাই সাধারণ নিয়ম। নিখিলেশ পুরকাইত যদিও কেবল কাছাড়ি বিভাষাতেই ‘এ’ > ‘অ্যা’ হয় বলে লিখেছেন,তাঁর সিলেটি নমুনা পরিচ্ছেদগুলোত কিন্তু এমন বাক্যে --“অ্যাক বদ্রমইলা বুট দিতা আইলা।”---ধ্বনিটির অস্তিত্ব দুর্লভ নয় (দ্বিতীয় অধ্যায়)।সুতরাং একটি ইঙ্গিততো স্পষ্ট,ধ্বনি দু’টি প্রায়শই পরস্পরের জায়গা বদল করে।উচ্চারণ পাল্টালেও অর্থ বদল হয় না।‘অ্যাক/ এ্যাক’ কিংবা ‘এক’ উচ্চারিত হোক,‘এ্যালান’ কিংবা ‘ʔএলান’(< হেলান) হোক অর্থের বদল হয় না।এই একটি কারণ হতে পারে যে জগন্নাথ চক্রবর্তী ধ্বনিটিকে বাদ দিয়েছেন।আমরা বিষয়টি পরে স্বনিম আলোচনাতে স্পষ্ট করবো,আপাতত অপ্রধান ধ্বনি হিসেবে সিলেটিতে এ’/ɛ/ ধ্বনিটির অস্তিত্বের পক্ষে।এই ধ্বনিটির জন্যে সিলেটি যদি অসমিয়ার ঘনিষ্ঠ হয়,তেমনি নিম্ন পশ্চাৎ ‘অ’/ɒ/ এর অনস্তিত্ব একে মান বাংলার কাছাকাছিও নিয়ে যায়। আন্তর্জাতিক ধ্বনিবর্ণমালার মাপকাঠিতে সিলেটি ধ্বনিগুলোকে তাহলে এভাবে চিত্র ১৫-র মতন দেখানো যায়, যদিও মান বাংলা ধ্বনি থেকে কোনটি কতটা উপরে বা নিচে,সামনে বা পেছনে উচ্চারিত হয় সেসব সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে আপাতত আমরা গেলাম না।একটি সাধারণ ছকে ধ্বনিগুলোকে সাজানো যেতে পারে এরকম,চিত্র ১৬-তে যেমন। নোয়াখালি-চট্টগ্রামী “উপভাষা দুটিতে ‘এ্য’ (ɛ) ধ্বনির ব্যবহারই অত্যধিক” লিখছেন রবীন্দ্র কুমার দত্ত।আরো লিখছেন,“উপভাষাদ্বয়ে ‘অ্যা’ (æ) এর ব্যবহার খুবই সীমিত।”২০৪ এর সমর্থনে বাংলাদেশের ভাষাবিদ ড০ আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ-এর অভিমতের উল্লেখ করেছেন।যদিও দুই ধ্বনিই শব্দের শেষে হয় বিরল অথবা দেখাই যায় না।এই নিয়ে ভাষাবৈচিত্র্য দুটিতে স্বরধ্বনির সংখ্যা দাঁড়ানোর কথা ছিল আটটি।কিন্তু তিনি দুই ভাষাবৈচিত্র্যতেই ও̀ /ò/ বলে আরেকটি ধ্বনির উল্লেখ করেছেন।কিন্তু কোনো ধ্বনিরই গুণ বা প্রকৃতিগত কোনো পরিচয় তুলে না ধরাতে আমরা ধরতে পারবো না,মৌলিক স্বরধ্বনির ছকে ধ্বনিটি ঠিক কোন বিন্দুতে বসছে। যে আন্তর্জাতিক বর্ণলিপিটি (ò) ব্যবহার করেছেন,সেটিও আমাদের কোনো সাহায্য করে না।চিত্র -১০-এ সেটি নেই।সম্ভবত সুধাংশু শেখর তুঙ্গ সিলেটিতে এরকমই ধ্বনি দেখে /ɔ̀/-র কথা উল্লেখ করেছেন।ধ্বনিটি /ɔ/-এর থেকে সামান্য উপরে উচ্চারিত হয়।কিন্তু,‘it may also be a mid-low central vowel’২০৫ বলে আমাদের কিছু সমস্যাতে রেখেছেন। সম্ভবত ‘অ,ও’-এর বৈচিত্র্যগুলো অসমিয়া,সিলেটি,নোয়াখালি,চট্টগ্রামীতে কেমন সব শব্দে ব্যবহৃত হয়,পরীক্ষা করে দেখলে আমাদের সমস্যা কিছু সমাধান হতে পারে।এর জন্যে আমরা শব্দগুলো দীপ্তি ফুকন পাটগিরি,জগন্নাথ চক্রবর্তী, সুধাংশু শেখর,রবীন্দ্র কুমার দত্ত যেভাবে ব্যবহার করেছেন সেভাবেই রাখবার চেষ্টা করছি।অসমিয়ার বর্ণলিপিগুলো আমাদের। চিত্র -১৭। দেখা যাচ্ছে /ɔ̀ga/ নিয়ে রবীন্দ্র দত্তও সামান্য ধন্দে আছেন। তেমনি অনিল/ònil/ এবং অশুৎ/òʃut/ নোয়াখালি এবং চট্টগ্রামী দুই ভাষার তালিকাতেই থাকলেও অ/ɔ/ ধ্বনির সঙ্গে জায়গা বদল করেছে,যা এই ছকে আমরা দেখাই নি।২০৬ এ নিছক মনোযোগের অভাব নয়,ধ্বনিগুলোর তফাত করবার সমস্যা বলেই আমাদের মনে হয়। তেমন করলে মানবাংলাতেও আরো অনেক পশ্চাৎ স্বরধ্বনি দেখা যাবে।যেমন সুনীতি কুমার অভিশ্রুতির ফলে ‘করিলে’ শব্দের রূপান্তরের রকমফের দেখাতে গিয়ে এতোগুলো শব্দের উল্লেখ করেছেন > কোরলে,কোল্লে,ক’ল্লে,কল্লে। তেমনি হইল > হোলো,হলো,হোল,হ’ল,হল’।২০৭ তিনটি ধ্বনিতো সেখানেও স্পষ্ট--‘ও, অ’,অ’। অসমিয়াতে ‘অ’ ’ ধ্বনিটি নতুন এবং স্বরলোপের রেশ স্বরূপ স্বীকৃতি পেয়ে বসে আছে।আমরা সেখানে কিছু করতে পারি না। বাংলাতেও এমন প্রস্তাব করেছিলেন যোগেশ চন্দ্র বিদ্যানিধি। কিন্তু সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সহ কেউই গ্রহণ করেন নি বাহুল্য ভেবে।২০৮ সুতরাং আমাদের মনে হয় পূর্ববাংলার অন্যান্য ভাষাবৈচিত্র্যেও এই ধ্বনি বাহুল্য মাত্র।সামান্য লক্ষ করলেই দেখা যাবে ‘অশুৎ,গকুল’ ইত্যাদি শব্দে ঠিক পরের স্বরধ্বনিটিই একটি উচ্চধ্বনি,সুতরাং ‘অ’ সামান্য উপরে উঠতেই পারে। তেমনি ‘রামও’ শব্দে ‘ও’ আসলে একটি পরসর্গ এবং শ্বাসাঘাত প্রভাবিত। তবু যেহেতু ভাষা-বৈচিত্র্য দুটি আমাদের অধ্যয়নের কেন্দ্রে নেই,আমরা ভিন্ন মত দিচ্ছি না। কিন্তু সিলেটিতে ধ্বনিটিকে ‘ও̀’ বা ‘অ’ ’ কোনোরূপেই স্বীকার করবার কারণ দেখি না। তবে, সুধাংশু শেখর তুঙ্গ যে মান বাংলার ও/o/ ধ্বনি সিলেটিতে নেই বলেই লিখেছেন,এটিও একেবারে অকারণ নয় বলেই আমাদের মনে হয়।ওআল/oɑl/,খোআস/khoɑs/,অগো/ɔgo/ শব্দ তিনটি এভাবেও উচ্চারিত হয় /ɔɐl,khuɐʃ,ɔgɔ/।‘চোর,তোমার’ /t͡ʃor,t̪omɐr/এমন শব্দ সিলেটিতে অনেকেই ‘চুর,তুমার’/ʔt͡sur,t̪umɐr/ এইভাবেও উচ্চারণ করেন।‘কোমর’ /komɔr/ > হয়ে যায় কমর /kɔmɔr/। সুতরাং এই দুটি ধ্বনি সিলেটিতে একটি অন্যটির বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়,বলে ও/o/কে অপ্রধান ধ্বনি হিসেবে রাখতেই পারি। এ’/ɛ/ ধ্বনিটির মতো। বাকি কথা স্বনিম প্রসঙ্গে স্পষ্ট করা যাবে। রবীন্দ্র দত্তের অভিমত অনুসারে নোয়াখালি এবং চট্টগ্রামী ভাষাবৈচিত্র্যে স্বরধ্বনির সংখ্যা নয় (৯),সেগুলো এরকম:‘ই,এ,এ্য,অ্যা,আ,অ,ও̀,ও,উ’/i,e,ɛ,æ,a,ɔ,ò,o,u/।‘আ’/a/ধ্বনিটি নিয়েও আমাদের সংশয় রইল।স্পষ্ট নয়,এটি কেন্দ্রীয় অথবা সম্মুখ নিম্ন প্রসারিত মৌলিক ধ্বনি।আন্তর্জাতিক বর্ণলিপি কিন্তু দ্বিতীয়টির সম্ভাবনাই দেখায়। সেসব সমস্যার জন্যে মৌলিক স্বরধ্বনির চিত্রে এগুলো দেখানো গেল না।
।। ধ্বনির পরিবর্তনের সূত্র এবং স্বরূপ ।। আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালা নিয়ে কথা বলে এলেও আমরা ধ্বনির প্রকারভেদ সম্পর্কে মূলত পরম্পরাগত ব্যাকরণের কথাই এতোক্ষণ অধ্যয়ন করেছি,আধুনিক ভাষাবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে আমরা ধ্বনির আরো সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে এগোব। কিন্তু এই অব্দি আলোচনাতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে ভাষাভেদে এবং একই ভাষার স্থান এবং কাল ভেদে ধ্বনিগুলো এক থাকে না। নইলে সংস্কৃতে যেগুলো মূর্ধন্য ধ্বনি বাংলাতে সেগুলো প্রাক তালব্য হবে কেন? অথবা সংস্কৃতে দীর্ঘস্বর থাকলেও বাংলাতে এগুলো গুরুত্বহীন হবে কেন? তাই ধ্বনিপরিবর্তনের ধারাটিও এই সুযোগে আমাদের বুঝে রাখা ভালো।ধ্বনি এমনি এমনি পরিবর্তিত হয় না।হয় ব্যবহারকারীদের ভৌগোলিক,রাজনৈতিক,সামাজিক সূত্রে পাওয়া অভ্যাস আচরণের ফলে। আর তারা সেগুলো ব্যবহার করেন কথা বলতে গিয়ে ---যে কথা কিনা শব্দ বাক্যের সমষ্টি।কথা মাত্রেরই ক্ষুদ্রতম অর্থবহ একক ‘শব্দ’।তাই ধ্বনি পরিবর্তনের ধারা শব্দার্থতত্ত্ব,রূপতত্ত্ব বা বাক্যতত্ত্বে আলোচিত হবে কিনা,এই নিয়ে তর্ক থাকতে পারে।সংশয়ও আছে।তবে পরম্পরাগত ব্যাকরণে এগুলো ধ্বনি প্রসঙ্গেই আলোচিত হয়ে এসেছে।এবং আমরা যেহেতু ধ্বনির তুলনামূলক অধ্যয়ন করছি,মান বাংলা,সিলেটি সহ বাংলার অন্যান্য ভাষাবৈচিত্র্যে এবং অসমিয়াতে ধ্বনির কালানুক্রমিক পরিবর্তন কীভাবে কালিক পার্থক্য তৈরি করলো সেটি বোঝা ছাড়া আমাদের কাজ এগুবে না,তাই এখানেই আলোচনাটি সারছি। সাধারণত চারটি ধারাতে ধ্বনির পরিবর্তন হয়। ধ্বনির ১) আগম,২)লোপ,৩) রূপান্তর,৪) স্থানান্তর বা বিপর্যাস। স্বরধ্বনি এবং ব্যঞ্জন ধ্বনি দুয়েরই এই পরিবর্তন হয়ে থাকে। শব্দের আদি,মধ্য এবং অন্ত এই তিন অবস্থানেই ধ্বনির আগম বা লোপ হয়ে থাকে। ধ্বনির আগম: আদি স্বরাগম: সাধারণত শব্দের আদিতে সংযুক্ত ব্যঞ্জনের আগে উচ্চারণ সৌকর্যের জন্যে একটি স্বরধ্বনি নিয়ে আসা হয়। যেমন স্কুল > বাং. --সিলেটি ইস্কুল, অস. ইস্কুল (উচ্চারণে ইচ্কুল্); খদিকা> অস. আখৈ (বাং. খৈ )। স্পর্ধা > চট্ট.–নোয়া. আশ̖ফ̣দ̖দা, স্টেশন > চট্ট.–নোয়া. এ্যশ̖টেশন̖/ ইশ̖টিশন̖ , বাং. –সিল. এশটেশন, ইশটিশন। মধ্য স্বরাগম: এখানেও ঘটনাটি ঘটে যুক্তব্যঞ্জনেই।শব্দের মাঝখানের যুক্ত ব্যঞ্জনকে ভেঙ্গে একটি স্বরধ্বনি দিয়ে জুড়ে দেয়া হয়।ভাঙা হয় বলে এর অন্য নাম বিপ্রকর্ষ,আবার জুড়ে দেয়া হয় বলে এর আরেকনাম স্বরভক্তিও!সংক্ষেপে কথাটি এই। যেমন: ভক্তি> বাং.–অস.ভকতি;গ্লাস> মান বাং.-সিল.গেলাস,অস. গিলাস,সিল.গলাস,গল্লাস,চট্ট.–নোয়া.গ্যেলাশ ইত্যাদি। সিলেটিতে এছাড়াও আছে,হানজা < সঞঝা < সন্ধ্যা, বর̖তো < ব্রত। চক্র > সি.-চট্ট.–নোয়া.চক্কর,ইং.ডবল > সি.-চট্ট.–নোয়া.ডাবল। মূলত সিলেটি সহ পূর্ববাংলার ভাষাবৈচিত্র্যগুলোতে শব্দমধ্যে য-ফলা,জ্ঞ,ক্ষ থাকলে তার আগে /ই/ উচ্চারণ করে যুক্তব্যঞ্জনের সমীভূত যুগ্ম উচ্চারণে ধ্বনিপরিবর্তনের সঙ্গে অনেকগুলো ঘটনা ঘটে।এই /ই/-এর আগমটা এখানে মধ্যস্বরাগমের নজির। যেমন: বাক্য > মান বাং.বাক্কো> সি.-চট্ট.–নোয়া.বাইক্ক,যজ্ঞ> বাং.যজ্ঞো, সি.-চট্ট.–নোয়া.জ̣ইজ্ঞ; অন্য > সি.-চট্ট.–নোয়া.অইন্ন,অসমিয়া অইনˎ; রাজ্য > বাং.রাইজ্জ,অস.রাইজˎ। সিলেটি হাইঞ্জা < সঞঝা < সন্ধ্যা। যদিও এর পরিচিত নাম অপিনিহিতি।অসমিয়ার কামরূপী বৈচিত্র্যে অপিনিহিতি ব্যাপক। ই,উ আগে এসে কখনো বা দ্বিস্বর ত্রিস্বর ধ্বনিও তৈরি করে ফেলে২০৯। যেমন কন্যা>কোইনা।তেমনি বাউইম̖না,নাইর̖কল,চাইর।কিন্তু অপিনিহিতিতে আরেকটি ঘটনাও ঘটে,ধ্বনির স্থানান্তরও ঘটে।সে নিয়ে পরে কথা হবে। অন্ত্যস্বরাগম: বাংলাতে সাধারণত শব্দের শেষে যুক্তাক্ষর স্বরধ্বনি ছাড়া থাকে না।কিন্তু বিদেশী বা ঋণকৃত বহু শব্দে তা না থাকলে বাংলাতে একটি স্বরধ্বনি জুড়ে দেয়া হয়। যেমন: কিস্ত > কিস্তি;বেঞ্চ> বাং.বেঞ্চি,অস.বেন্সি;বন্ধ > বন্ধো। তল > সিলেটি তলই।সং.দিশ> সি.-চট্ট.–নোয়া.দিশা,ফা.তখ̖ত̖ > সি.-চট্ট.–নোয়া.তখ̖তা। মান অসমিয়াতে এমনিতেই সংযুক্ত ব্যঞ্জন খুবই কম,যা কিছু পাওয়া যায় সেগুলো হয় তৎসম নতুবা বিদেশী শব্দ।অসমিয়াতেও শব্দের শেষে যুক্তাক্ষর স্বরধনি ছাড়া উচ্চারিত হয় না।তাই অন্ত্যস্বরাগম সম্পর্কে অসমিয়া ব্যাকরণ নীরব বললেই চলে।কিন্তু কখনো যে ঘটে থাকে অস্বীকার করা যাবে না। গোলকচন্দ্র বন্ধ,গোন্ধ শব্দের উচ্চারণ যথাক্রমে এরকম লিখেছেন বটে,বঅনধ,গওনধ২১০ কিন্তু কান পাতলেই অসমিয়াতে বন্ধ’,গোন্ধ’ (বঅনধঅ’,গওনধঅ’) শব্দগুলো শোনা যায়। মান অসমিয়ার বাইরে পশ্চিম অসমের ভাষাতে এমন কিছু শব্দ শোনা যায় দৱাই,কৱেই,শোধেই। আদি ব্যঞ্জনাগমঃ বাংলায় সাধারণত শব্দের আদিতে ব্যঞ্জনধ্বনির আগম হয় না। দুই একটি শব্দে /র/ এর আগম হয়ে থাকে। সেগুলো ব্যতিক্রম। যেমন ঋজু > উজু > রুজু;উপাধ্যায় > ওঝা> রোজা ইত্যাদি।অসমিয়াতেও আদি ব্যঞ্জনাগমের নজির নেই। জগন্নাথ চক্রবর্তী শব্দের আদিতেও ব্যঞ্জন আসে বলে একটি ভুল নজির দিয়েছেন ‘ছইর’ < বাংলা ছই।২১১ নোয়াখালি চট্টগ্রামীতেই আদি ব্যঞ্জনাগমের নজির খুবই কম বলে রবীন্দ্র দত্ত বৃথাই ‘ঠোঁট, রূপকথা < ওষ্ঠ,উপকথা’র নজির দিয়েছেন। এগুলো মান বাংলাতেও বহুল প্রচলিত শব্দ। আর ঠোঁট শব্দটির উৎস সম্ভবত ওষ্ঠ নয়,সংস্কৃত ‘তুণ্ড’।২১২ মধ্য ব্যঞ্জনাগমঃ এর অন্য নাম শ্রুতিধ্বনি। শব্দের ধ্বনিগুলি উচ্চারণ করার সময় আমাদের জিহ্বা অসাবধানতাবশত দু’টি ধ্বনির মাঝখানে কোনো অতিরিক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণ করে ফেললে সেই প্রক্রিয়াকে মধ্যব্যঞ্জনাগম বলে।এইভাবে যে অতিরিক্ত ধ্বনিটি শব্দের মাঝখানে উচ্চারিত হয়ে যায় তাকে শ্রুতি ধ্বনি (Glide)বলে। এমনটাই লিখেছেন রামেশ্বর শ’২১৩ তিনি শুরুতেই দুটি উদাহরণ দিয়েছেন। যেমন –চা-এর (ষষ্ঠী বিভক্তি) > চায়ের (এখানে ‘য়’-এর আগম হয়েছে);শৃগাল > সিআল (‘গ’ এর লোপ ) > শিয়াল (এখানে ‘য়’ এর আগম হয়েছে)। যেটি তাঁর উদাহরণে স্পষ্ট কিন্তু সংজ্ঞাতে স্পষ্ট হয় নি, তা এই যে-- ‘চায়ের’ শব্দে /য়/ আসলে /এ/-র বিকল্পে বসেছে।আর শৃগাল থেকে অন্তত দুটি ব্যঞ্জন লোপও পেয়েছে তবে গিয়ে শিয়াল হয়েছে।এবং এখানেও /য়া/ আসলে /আ/ এর বিকল্পে বসেছে।অথবা শুধুই একক স্বর নয়,দ্বিস্বরের বিকল্পে বসেছে। চ+/আয়/+র এবং শ+/ইয়া/+ল। শ্রুতিধ্বনির ইতিহাস লিখতে গিয়ে কথাগুলো লিখেছিলেন সুনীতি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথাগুলো বেশ দীর্ঘ এবং জটিল।আমরা একটি সহজ উদ্ধৃতি দিচ্ছি, “Insertion of glides was brought in (at least in some dialects like Ardha -magadhi),to judge from the « ẏa-śruti » in spelling) at a period when the spirant pronounciation of the original intervocal stops was dying out,but was not entirely dead. At that stage, when memory was not lost, there was a consciousness in the speaker that there was a consonant between the vowels, even when it existed no more; and the time taken up by the original stop, or its later spirant modification, in pronouncing the whole word, was now utilized in passing from one vowel to another, resulted as a matter of course in the production of intermediate vocalic sounds, or glides.”২১৪তিনি আরো লিখেছেন,“In ordinary N.B. pronunciation,there is not much of a deliberation,or slow enunciation, and the « ẏ, ẇ » glide is not ordinarily an audible sound, except between low vowels (e,o,å,ā).There has been thus a tendency towards dipthongisation and contraction, -words like M.B. শিয়াল « śi-ẏ-ā-lå » being reduced to [ ʃ̇iɑl, ʃ̇ial ]…”২১৫ উদ্ধৃতি আর দীর্ঘ না করে আমরা যেটি বলতে চাইব,মধ্যব্যঞ্জনাগম বা শ্রুতিধ্বনি আসলে কেবল ব্যঞ্জন ধ্বনির আগম নয়,অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটির লোপের ফলে অন্যটির আগম। সেটি আবার থেকে যাওয়া দুই স্বরের মিলনে তৈরি দ্বিস্বর যা নৈকট্য ধ্বনির রূপ নেয়।অসমিয়াতেও ঘটনাক্রম একই। তাই সম্ভবত গোলকচন্দ্র লিখেছেন,“পুরণ অসমীয়া লিখন রীতিত য়-শ্রুতি লিখা হোয়া নাছিল।উদাহরণ স্বরূপে,কথা গুরুচরিতত আছে, ‘বুঢ়ীএ, ধুতিএ,ইত্যাদি।আনকি ঊনবিংশ শতিকার কোনো লিখকে আধুনিক অসমীয়াতো য়-শ্রুতি নিলিখিছিল।”২১৬ তিনি আরো স্পষ্টই লিখেছেন,“অসমীয়া ভাষাত ঈ,এ’,এ –র পরা য় আরু ঊ,ও’,ও-র পরা অন্তঃস্থ ৱ ধ্বনি পোৱা যায়।”২১৭ যেমন: খা+এ=খায়, দে+উ= দেৱ। যাই হোক, যে ধ্বনিটির আগম ঘটে সেই অনুসারে মধ্যব্যঞ্জনাগমের নাম হয়ে থাকে।যেমন— য়-শ্রুতি: মোদক > মোঅঅ (‘দ’ এবং ‘ক’ এর লোপ) > বাং.-সিল.-চট্ট.–নোয়া.মোয়া (য় –এর আগম)। সংস্কৃত বৈবাহিক> বাং.বেয়াই,অস.বিয়ৈ। শৃগাল > বাং.শিয়াল,অস.শিয়াল (ষিয়াল)। সি.-চট্ট.–নোয়া.হিয়াল। ও̮য়-শ্রুতি: যা( =to go, ধাতু )+আ (প্রত্যয়) > যাওয়া (ও̮য় –এর আগম ) । ৱ-শ্রুতি: সংস্কৃত মোদক >বাং.মোয়া= অস.মোৱা।(বাংলা য়-শ্রুতি এবং অসমিয়া ৱ-শ্রুতি সাম্য প্রায়ই ঘটে থাকে। আরো যেমন কুহেলিকা > বাং.কুয়াশা,অস.কুৱলি।) ঘৰ্ + উআ (প্রত্যয়) > অস.ঘৰোৱা,বাং.ঘরোয়া (ও̮য়), সিলেটিতে কিন্তু ঘরুয়া। হ-শ্রুতি: সংস্কৃত বিপুলা> প্রাকৃত বিউলা (প-এর লোপ) > বিহুলা (হ-এর আগম)> মান বাং.–অস.বেহুলা। বিউলা মান অসমিয়া- বাংলার বাইরেও দুই ভাষারই অন্যান্য বৈচিত্র্যে প্রচলিত শব্দ।এখানে প লোপে ‘উ’ থেকে গেছে মাত্র। দ-শ্রুতি: সংস্কত বানর>প্রাচীন বাংলা বান্দর (দ–এর আগম)>আধুনিক অস.বান্দৰ,সি.-চট্ট.–নোয়া.বান্দর,বাংলা বাঁদর। ব-শ্রুতি: সংস্কৃত তাম্র >তম̖ব̖র (ব –এর আগম) > প্রাকৃত তম্ব > বাংলা তাঁবা ( তাওয়া)। অসমিয়াতে তৎসম পদের আদিতে ৱ থাকলে ব হয়ে যায়। যেমন বেদ,বাণী,বিদ্বান ইত্যাদি। তবে এগুলো ধ্বনির রূপান্তরের নজির।জগন্নাথ চক্রবর্তী বরাক উপত্যকার বাংলা তথা কাছাড়ি বিভাষাতে “ ‘অন্তস্থ ব-শ্রুতি’ খাঁটি ব-শ্রুতিতে রূপান্তরিত”২১৮ হয়ে যাবার কথা লিখেছেন। যেমন খাবা<খাওয়া,ছেবা> ছাওয়া ইত্যাদি। এগুলো কোথাও কখনো সত্য বটে।তার মধ্যে ধ্বনিরূপান্তরেরও ভূমিকা আছে।অন্যথা ‘খাওয়া’,‘দেওয়া’ ইত্যাদি শব্দও আছে।আবিদ রাজা মজুমদারের ‘কথ্য বাংলার অভিধানে’ শব্দগুলো আছে।তাঁর নিজের অভিধানেও ছেআ < ছায়া শব্দটি আছে।২১৯ স্পষ্টতই এটি স্বরের বিসঙ্গতি ( আ> এ )ছাড়া আর কিছুই নয়। শব্দটিকে ‘ছেয়া’ বলেও লেখাই যেতো। জগন্নাথ চক্রবর্তী শব্দ মধ্যে ব্যঞ্জন আসে বলে দুটি নজির দিয়েছেন। লেন̖জ < বাংলা লেজ। এবং ইরাইদ < ফারসি য়াদ।প্রথমটি আসলে আদি স্বরাগমের নজির,সংস্কৃতে শব্দটি ছিলই লঞ্জ২২০। অভিধানের ভেতরে জগন্নাথ লিখেছেন ইরাইদ শব্দের মূলে ফারসি ইরাদা।২২১ সুতরাং এটিও স্পষ্টই মধ্যস্বরাগম তথা অপিনিহিতির নজির। তেমনি রবীন্দ্র দত্তের নোয়াখালি-চট্টগ্রামীতে ‘ল’ শ্রুতির প্রস্তাব করেছেন।২২২তিনি ‘ছাই’ থেকে ‘ছালি’র নজির দিয়েছেন।কিন্তু শব্দটি অপভ্রংশেই ছার>ছাল> ছালি হয়েছিল।২২৩ ‘ল’ বরং লুপ্ত হয়েছে বলেই মনে হয়। শব্দটি মূলে ‘ক্ষার’ থেকেই এসেছে।কিন্তু তাতই (?) তাঐ > তালই সঠিক।২২৪শব্দটি সিলেটিতেও আছে,বঙ্গীয় শব্দকোষের সাক্ষী মানতে গেলে কৃষ্ণনগর চব্বিশ পরগণা,অর্থাৎ রাঢ় বাংলার ভাষাতেও ‘তালই/তালুই’। অতএব ‘ল’ শ্রুতি সাধারণভাবেই বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্য। বরং ময়মনসিংহীর মতো পূর্ব বাংলার কিছু ভাষাতে ‘ল’ লোপ পায়।যেমন-“নেত্তুকুনা আইছি, তাঐ বারি!” অন্তব্যঞ্জনাগমঃ শব্দের শেষে ব্যঞ্জনাগমের নজির মান বাংলাতে খুবই কম।ব্যতিক্রমী দুই একটি নজির রয়েছে। সংস্কৃত দয়তু,বা দেউ > দেউক;প্রা-বা জালিলি > জালিকিক (= জ্বালিল)২২৫ তেমনি অসমিয়াতেও শব্দের শেষে ব্যঞ্জন আসার নজির বিরল।জগন্নাথ চক্রবর্তী তিন অবস্থানেই সিলেটিতে ব্যঞ্জনাগম হয় বলে লিখে ‘ছইর< বাংলা ছই’ বলে একটি শব্দের উল্লেখ করলেও তাঁর এবং আবিদ রাজা মজুমদারের অভিধানের কোত্থাও শব্দটি পাইনি।তবে ‘ছইল’ কখনো > ছইর শোনা যায় বটে,সেটি ধ্বনির রূপান্তর, র-কারি ভবনের নজির।আর যদি সংস্কৃত ছদি> ছই হয়,তবে ‘র’ অবশ্যই সম্বন্ধ কারকের বিভক্তি। নোয়াখালি-চট্টগ্রামীতেও শব্দের শেষে ব্যঞ্জনাগম কম লিখে রবীন্দ্র দত্ত ‘খোকন,বাবুন’(<খোকা, বাবু) এমন দুই নজির দিয়েছেন।২২৬ এগুলো সারা বাংলাতেই স্নেহাবেগ বোঝাতে শোনা শব্দকে পালটে ফেলা হয়। ধ্বনির লোপ: আদি স্বরলোপ: শব্দের শুরুতে শ্বাসাঘাত না থেকে মাঝের কোনো ধ্বনিতে থাকলে শুরুর স্বরধ্বনিটি ক্ষীণ হতে হতে কখনো বা লোপ পেয়ে যায়। যেমন উদ্ধার > উধার>ধার;অলাবু > বাং.লাউ,অস.লাও;স্থান > বাং.-অস.থান। শব্দগুলো সিলেটি নোয়াখালি,চট্টগ্রামীতেও একই। পোর্তুগিজ আনোনা > নোয়া.চট্ট.নোনা। মধ্যস্বরলোপ: আবার শব্দের শুরুতেই শ্বাসাঘাত থাকলে মাঝের কোনো স্বরধ্বনিরও একই গতি হয়,অর্থাৎ লোপ পেয়ে যায়। যেমন: গামোছা > বাং.-সিল.-নোয়া.-চট্ট.গামছা। প্রেতিনী > সিল.পেতনি/ʔpet̪ni/,চট্ট.ফে̣তনি /fet̪ni/, নোয়া. হেতনি/ɦet̪ni/।অসমীয়াতে কামরূপী ভাষাবৈচিত্র্যতে শ্বাসাঘাতের এই প্রবণতা ব্যাপক।মান অস.টুকুরা > কাম. টুক̖ৰা;মান অস. কোমোৰা > কাম. কুম̖ৰা;মান অস.দুই+ডাল > দুডাল।সিলেটিতে বিভক্তি যোগ হলে কখনো বা মূল শব্দের শেষ স্বরটি লোপ পেয়ে যায়।জগন্নাথ সঠিক নজির দিয়েছেন এরকম:গতরো (অধি) < বাং.গতর < সং.গাত্র,মুল̖কো (অধি) > মুলুক < আ.মুল̖ক,কুকরে (কর্তৃ ) < কুকুর।এছাড়াও আছে দলান < দালান,পনরো < পনেরো।২২৭ অন্ত্যস্বরলোপ: শব্দের শেষের দিকে শ্বাসের জোর এমনিতেই কমতে থাকে,ফলে শেষের স্বরধ্বনিও ক্ষীণ হয়ে প্রায়ই লোপ পেয়ে যায়। যেমন:সন্ধ্যা >সঞঝা>সাঁঝ।অন্ত্যস্বর লোপের প্রবণতা অসমিয়াতে বাংলার চাইতেও ব্যাপক। যেমন বাংলা পিপাসা = অসমিয়া পিয়াহˎ;বাংলা বিবাহ = অসমিয়া বিবাহˎ;বাংলা শিলা = অসমিয়া শিল̖; বাংলা কলা = অস.কল̖। বাণীকান্ত লিখেছেন,“অন্ত্য –অ রক্ষা করা শব্দ আরু রূপ সাধারণতে বঙলাতকৈ অসমীয়াত কম”২২৮।সিলেটিতে হিল < বাং. তৎ.শিলা। পোকা > সি.পুক/ʔpuk /,নোয়া.হোক /ɦok/,চট্ট.ফোক/fok/। দ্বিমাত্রিকতা/ দ্ব্যক্ষরতাঃ উদ্ধার বা সন্ধ্যা এমন শব্দকে স্বরলোপ একাক্ষর শব্দে পরিণত করল বটে।কিন্তু দুইয়ের বেশি অক্ষরে গড়া বাংলা শব্দের স্বরলোপের ফলে একটি চিত্তাকর্ষক প্রবণতা দেখা যায়। শব্দটি যদি বেজোড় অক্ষরের হয়ে থাকে, তবে বাংলাতে স্বরলোপের ফলে জোড়-মাত্রিক বা জোড় অক্ষরের শব্দে পরিণত হয়।ব্যাকরণে তাকেই দ্বিমাত্রিকতা বলে। যেমন গামোছা (ত্রিমাত্রিক শব্দ) > গামছা (দ্বিমাত্রিক);অপরাজিতা (পাঁচমাত্রিক) > অপ̖রাজিতা (চারমাত্রিক)।এই বাংলা শব্দগুলো সিলেটিতেও বহুল ব্যবহৃত শব্দ।অসমিয়া কামরূপী ভাষাবৈচিত্র্যে এই প্রবণতাটি দেখা যায়,কিন্তু সামান্য অন্যরকম।আদ্য শ্বাসাঘাতের ফলে মাঝের স্বরগুলো লোপ পেয়ে ত্রিমাত্রিক শব্দ দ্বিমাত্রিক,চতুর্মাত্রিক শব্দ ত্রিমাত্রিক,পঞ্চমাত্রিক শব্দ চতুর্মাত্রিক শব্দে রূপান্তরিত হয়।২২৯ এটা হয় এর জন্যে যে কামরূপীতে আদি শ্বাসাঘাত প্রবণতা বাংলার থেকেও প্রবল।২৩০ ব্যঞ্জনধ্বনি লোপ: রামেশ্বর শ’ লিখেছেন উত্তর বঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্যতে আদি /র/ এর আগম এবং লোপের নজির ছাড়া শব্দের শুরু এবং শেষের থেকে ব্যঞ্জনধ্বনি লোপের নজির বাংলাতে প্রায় নেই বললেই চলে।কিন্তু আমরা দেখব,মান বাংলাতেও শব্দের মাঝে বা শেষে ‘হ’ থাকলে প্রায়ই লোপ পায় যেমন শিয়ালদহ > শিয়ালদঅ> শিয়ালদা।এই ‘হ’ লোপ প্রবণতা সিলেটিতে একটি সাধারণ প্রবণতা। কিন্তু তার রেশ স্বরূপ আদিতে সংশ্লিষ্ট স্বরধ্বনিকে রুদ্ধ-স্বরপথ ধ্বনিতে রূপান্তরিত করে। যেমন ʔঅলদি< হলদি।মাঝে বা শেষে আগের ব্যঞ্জনকে বহিঃস্ফোটক বা অন্তঃস্ফোটক ধ্বনিতে রূপান্তরিত করে রেশ রেখে যায়।একে তাই ধ্বনিলোপ না বলে রূপান্তর বলাই শ্রেয়। যেমন ত’বিল <তহবিল,যেমন গা’ < গা’হ < ঘাস। সিলেটিতে আদি ব্যঞ্জন লোপের নজির তন< স্তন,মধ্যব্যঞ্জন লোপের নজির অমইশশা < অমাবশ্যা,শেষ ব্যঞ্জন লোপের নজির কাত্তি < কার্তিক।দুই স্বরের মাঝখান থেকে ব্যঞ্জন লোপ পেয়েছে মধ্যভারতীয় আর্যেই।সখী> সহি> সই। মধ্যভারতীয় আর্যের যুগ্মব্যঞ্জনের একটিও মান বাংলাতে লোপ পায়। যেমন,সংস্কৃত ভক্ত< মধ্য ভারতীয় ভত্ত > ভাত। এমন লোপের নজির অসমিয়াতেও ব্যাপক। ভাত,হাত,সাত---এসব অসমিয়াতেও ব্যঞ্জন লোপেই এসেছে। অসমিয়া এক+ডাল = এডাল।এমন যুগ্মব্যঞ্জন না হয়ে পাশাপাশি দুই সমধ্বনি থাকলেও একটি লোপ পায়। যেমন বড়দাদা> বড়দা।একে সমাক্ষরলোপ বলে।অসমিয়াতেও মুখশুদ্ধি > মুহ+হুধˎধি> মুহুদি।‘য়’ শ্রুতির বিপরীতে সিলেটিতে কিন্তু ‘য়’ ধ্বনি লোপেরও নজির আছে। যেমন গেছিল,দিছিল < গিয়েছিল,দিয়েছিল< গিয়াছিল,দিয়াছিল। নোয়াখালি চট্টগ্রামী অন্য বাংলা ভাষীদের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকার অন্যতম কারণই এই---বাকি বাংলার তুলনাতে এই দুই ভাষাবৈচিত্র্যে অস্বাভাবিক রকমে স্বরমধ্য ব্যঞ্জন লোপ পায়। যেমন কপাল > কোয়াল,রকম> রঃ́মˎ,যখন> জঃনˎ,কমলা> কওঁলা।২৩১ ধ্বনির রূপান্তর: ধ্বনির রূপান্তরের বিচিত্র প্রক্রিয়া।স্বরধ্বনি রূপান্তরের দুই প্রধান প্রক্রিয়া হলো অভিশ্রুতি এবং স্বরসঙ্গতি। ব্যঞ্জনধ্বনি রূপান্তরের প্রধান প্রক্রিয়া তেমনি সমীভবন এবং বিষমীভবন। অভিশ্রুতি: অপিনিহিতির প্রক্রিয়াতে শব্দের অন্তর্গত /ই,উ/ তার আগেকার ব্যঞ্জনের আগে সরে এসে পাশাপাশি স্বরধ্বনিকে প্রভাবিত করে নিজেও তার সঙ্গে মিশে পালটে গেলে তাকে অভিশ্রুতি বলে।অভিশ্রুতি অপিনিহিতির পরবর্তী ধাপ। যেমন: করিয়া > কইর্যা > করে।কিন্তু দুই অক্ষরের শব্দে অভিশ্রুতি হয় না লিখেছেন রামেশ্বর শ’। যেমন আজি,কালি,যজ্ঞ,বাক্য > আইজ,কাইল,যইজ্ঞ,বাইক্ক।তিনি লিখেছেন অভিশ্রুতির বদলে সেখানে এই মাঝের /ই/টি লোপ পেয়ে যায়।২৩২ হয় ---আজ, কাল,যগ̖গো,বাক̖কো।অসমিয়াতেও বহু সময় কিছুই হয় না।যেমন আজি,কালি,চারি।অথবা কিছু শব্দে অপিনিহিতি হয়,সে নজির আমরা আগেই দিয়ে এসেছি। অন্য > বাংলা অইন্ন,অসমিয়া অইনˎ;ৰাজ্য > বাং.রাইজ্জ,অস.ৰাইজˎ।কিন্তু বহু সময় দুই অক্ষরের শব্দে অভিশ্রুতি হয়ও। যেমন চৈত্র>চইত্ত>চ’ত, কৈত < কহি+ত> ক’ত,মৈরা < ময়ূৰ> ম’ৰা।অভিশ্রুতি এবং অপিনিহিতি বাংলাকে মোটা দাগে পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলাতে ভাগ করে। সিলেটি সহ পূর্ববাংলার ভাষাগুলোতে অভিশ্রুতি হয় না বললেই চলে। পশ্চিমেও এই প্রবণতাটি একেবারেই নবীন। পঞ্চদশ শতক অব্দি সারা বাংলাতেই অপিনিহিতই ছিল মূল প্রবণতা। সে যে কবে অভিশ্রুতি অব্দি রাঢ় বাংলাতে এগুলো দিনক্ষণ স্পষ্ট করা কঠিন বলে সুনীতিকুমার উল্লেখ করেছিলেন।২৩৩ উনিশ শতকে এসেই এর পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ঘটে বলে তাঁর অভিমত।কিন্তু একবার মানবাংলাতে অভিশ্রুতি প্রতিষ্ঠা পাবার পরে সে কীভাবে পূর্ববাংলার ভাষাতেও প্রভাব ফেলেছে তার দুই একটি নজির তিনি দিয়েছেন,যেমন থেইকা,রেইখা < থাকিয়া,রাখিয়া।২৩৪ সেসব ঢাকার ভাষাবৈচিত্র্যে শোনা গেলেও সিলেটিতে শোনা যায় না। স্বরস্বঙ্গতিঃ শব্দের পাশাপাশি বা প্রায় কাছাকাছি দুই স্বর যদি পরস্পরের প্রভাবে একই ধ্বনি বা প্রায় একই ধ্বনিতে পরিণত হয়ে যায় তবে সেই প্রক্রিয়াকে স্বরসঙ্গতি বলে।পুরো পরিবর্তিত হয়ে গেলে তাকে পূর্ণ স্বরসঙ্গতি বলে। যেমন সুপারি > সুপুরি। দুই ধ্বনি কাছাকাছি এলে একে বলে আংশিক স্বরসঙ্গতি। যেমন পূজা> পুজো।এখানে একেবারে নিম্ন স্বর /আ/ পালটে উচ্চ স্বর /উ/এর কাছাকাছি উচ্চমধ্য /ও/ গেছে। ধ্বনিপরিবর্তনের গতিমুখ অনুযায়ী স্বরসঙ্গতির আবার তিনটি প্রকারভেদ।১) প্রগত -- পূর্ববর্তী ধ্বনির প্রভাবে পরের ধ্বনি পালটে গেলে বলে প্রগত। যেমন পূজা >পুজো। অসমিয়া স্তূপ > থুপি। ২) পরাগত---পরের ধ্বনির প্রভাবে আগের ধ্বনি পালটে গেলে বলে পরাগত। যেমন দেশি > দিশি।অসমিয়া জোল+ঈয়া> জুলীয়া, লোহিত> লুইত। ৩) পারস্পরিক বা অন্যোন্য--আর আগে পরের দুই ধ্বনিই যদি পরস্পরের প্রভাবে পালটে যায় তবে তাকে বলে পারস্পরিক স্বরসঙ্গতি। যেমন যদু> যোদো।অসমিয়া কোষ> কুঁহি,আপোনা > আপুনি। মধ্য স্বরসঙ্গতির কথা কেউ কেউ বলে থাকলেও রামেশ্বর শ’ একে প্রগত পরাগতর মিশ্রণ বলেছেন। যেমন বিলাতি> বিলিতি।২৩৫ সিলেটিতে স্বরসঙ্গতি মেলে না। জগন্নাথ চক্রবর্তী এর কোনো উল্লেখ করেন নি,সুধাংশু শেখর তুঙ্গ স্পষ্টই লিখেছেন,“Vowel harmony in real sense is absent in Cachar Bengali as well as Bishnupriya”২৩৬এমন কি আংশিক স্বরসঙ্গতির ফলে মান বাংলাতে যেখানে শব্দগুলো উচ্চারিত হয় ওতুল,গোতি,প্রোতি,প্রোভু সিলেটিতে সেখানে শব্দগুলো থেকে যায় অতুল,গতি,প্রতি,প্রভু।কিন্তু একেবারেই কি নেই? মিলিমিশি< মিলেমিশে,মিশামিশি< মেশামেশি। রবীন্দ্র কুমার দত্ত আবার নোয়াখালিতে ওতুল,ওশুর (< অতুল,অসুর ) হয় বলে সমস্যাতে ফেলেছেন।২৩৭ তবে আবার লিখেছেন বোতল > বতল হয়। চোরি > চুরি হয় শুধু নোয়াখালি,চট্টগ্রামীতেই নয়,চিলেটিতেও হয়। কিন্তু খুশ+ই > খুশি মান বাংলাতেও হয়। স্বরের অসঙ্গতি: ভাষা অদ্ভুত সব আচরণ করে ভিন্ন ধ্বনিকে এক করে।আবার একই রকম ধ্বনি পেলে ভিন্ন করে দেয়, স্বরসঙ্গতির বিপরীত প্রক্রিয়া স্বরের অসঙ্গতিও তাই রয়েছে। যেমন কাকা > কাকু। অসমিয়া আন্ধার > এন্ধার;আদা > এদা। কাকু,দাদু ইত্যাদি ছাড়াও সিলেটিতে আছে বিতিকিচ্ছা < বিতিকিচ্ছি,গেছিল < গিয়েছিল< গিয়াছিল। জগন্নাথ চক্রবর্তী ছেআ,বেকা < ছায়া, বাঁকা ইত্যাদি শব্দের নজির দিয়ে নাম দিয়েছেন স্বরের ‘ঊর্ধ্বায়ন’।২৩৮ সে নামে অসুবিধে নেই।নিম্নস্বর উচ্চমধ্য স্বরে পরিবর্তিত হচ্ছে বটে,কিন্তু সে অসমিয়া এন্ধার, এদা-র মতোই। দুইয়ের মধ্যে মিল আছে। আর একে স্বরের অসঙ্গতি নামেই রাখা যেতে পারে। তেমনি পঙ্ক > যেমন সিলেটিতে ‘পেক’ হয়, চট্টগ্রামীতে ‘ফ্যেঁ̣ক’, নোয়াখালিতে ‘হ্যেঁক’ হয়।২৩৯ ক্ষতিপূরণ দীর্ঘীভবন বা পরিপূরক দীর্ঘীভবনঃ শব্দের কোনো ব্যঞ্জনধ্বনি লোপ পেলে বহু সময় সেই লোপের ক্ষতিপূরণ করতে গিয়ে পূর্ববর্তী হ্রস্বস্বর দীর্ঘ হয়ে যায়। যেমন ভক্ত> ভত্ত> বাংলা.-অস.ভাত,ধর্ম > ধম্ম> বাং.-অস.ধাম।চর্ম > আঞ্চ.বাং. এবং অস. চাম। এই পরিবর্তন না হবার নজিরও দুই ভাষাতেই কম নেই,যেমন বাংলা গাছ,কিন্তু অসমিয়া গছ (< বৃক্ষ);বাং.-অস. সব (< সর্ব) ইত্যাদি। এগুলো সিলেটি,চট্টগ্রামী,নোয়াখালিতেও মান বাংলার মতো একই। সমীভবনঃ স্বরসঙ্গতির মতো এ হলো ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গতি। এও পূর্ণ এবং আংশিক দুরকমই হতে পারে। পূর্ণ সমীভবন যেমন ধর্ম > ধম্ম,উৎ+লাস > বাংলা.-অস. উল্লাস; উৎ+ছেদ> বাংলা.-অস.উচ্ছেদ।এমন সমীভবন অবশ্যে সংস্কৃতেই হয়েছিল। পালি –প্রাকৃতে সমীভবন ব্যাপক। আংশিক সমীভবন যেমন পার্শি রোজকার > বাং.রোজগার। বাংলা বানানে লক্ষণ > কিন্তু উচ্চারণে লক̖খোন> কিন্তু অসমিয়াতে লখমন। বিপরীতে বাংলা বানানে লক্ষণ লেখা হলেও উচ্চারণে সবসময়েই লক̖খোন।/ষ/ পালটে পূর্ববর্তী /ক/-এর কাছাকাছি /খ/ হয়ে গেলো। সিলেটিতে লক̖খন /lɔkkhɔn/। অসমিয়াতে আতমা,বিসময় (বানানে আত্মা, বিস্ময়) বাংলাতে পূর্ণ সমীভূত হয়ে আত্তা,বিসসয় হয়ে যায় উচ্চারণে।এই সব দেখে অসমিয়াতে আংশিক সমীভবন নেই মনে করবার কোনো কারণ নেই। প্রচুর আছে। যেমন,সাত দিন > সাদ্দিন,মাতˎবোল> মাদ̖বোল। গোলকচন্দ্র দেড় শতাধিক অসমিয়া দ্বিব্যঞ্জন,ত্রিব্যঞ্জন,চতুর্ব্যঞ্জন যুক্তাক্ষরের উচ্চারণ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।অধিকাংশই সেগুলো তৎসম।২৪০ আমরা পরীক্ষা করে দেখলাম তৎসম শব্দে যুগ্মব্যঞ্জনে ওষ্ঠ্য নাসিক্য ধ্বনি ‘ম’ থাকলে বাংলাতে পূর্ণ বা আংশিক সমীভবনের প্রবণতা দেখাচ্ছে।অসমিয়াতে সেগুলো অক্ষত থাকছে। এছাড়াও শব্দের শেষে য-ফলা,ব-ফলা,ক্ষ ইত্যাদি থাকলেও বাংলাতে উচ্চারণে পূর্বের ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব হয়। যেমন বাক্য,দ্বিত্ব,যজ্ঞ,লক্ষ> বাক্কো,দিত্তো,যগ̖গো,লক̖খো। অসমিয়াতে নৈকট্য ধ্বনি সাধারণত অক্ষত থাকে।কিন্তু অপিনিহিতি সহ উচ্চারণে দ্বিত্ব হয় কিনা ভেবে দেখবার বিষয়। যেমন বাইক্ক’,দ্বিইত্ত’।সিলেটিতে এমনই হয়। কিছু শব্দের উচ্চারণ গোলোকচন্দ্র এভাবে দেখিয়েওছেন,ষঅএ’সসঅ (শস্য),তঅততঅ (তত্ত্ব)।বাণীকান্ত স্পষ্টই দেখিয়েছেন,লৈক̖খ (লক্ষ),অইগ̖গান (অজ্ঞান)। সিলেটিতেও শব্দগুলো একই রকম উচ্চারিত হয়।অন্য সর্বত্র গোলকচন্দ্র যেসব শব্দের নজির দিয়েছেন সেগুলোর দুই একটু ব্যতিক্রম বাদে বাংলাতেও রয়েছে হুবহু,সমীভূত না হয়েই।এমন কি বাংলাতেও জন্ম,কম্পন রয়েছে।তৎসম সম্মান,সম্মুখ (< সম+মান,মুখ) বাংলাতে অপরিবর্তিত থাকলেও অসমিয়াতে বিসমীভূত হয়ে সন্মান,সন্মুখ হয়ে গেছে। অসমিয়া নঞর্থক অব্যয় যেহেতু ক্রিয়াপদের আগে জুড়ে যায় ক্রিয়াপদের আদ্যস্বর অনুসারে ‘ন’-এর সঙ্গে যুক্ত স্বরও পালটে যায়। যেমন নমরে,কিন্তু নামারে। তেমনি নেখেলে,নিদিয়ে ইত্যাদি। একে পরাগত স্বরসঙ্গতিই বলা যায়। অসমীয়া ভাষাবিজ্ঞানীরা একে স্বরের সমীভবনও বলেন।২৪১ বাণীকান্ত যে ক’টি নজির দিয়েছেন তার অধিকাংশতেই আদ্য স্বরের প্রভাবে পরের দুই স্বরের পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন বিৰিণা (<ৱিৰণ),পুখুৰী (<পুষ্কৰ),ধুমুহা (< ধূম্রাভ)। দুই একটিতে একাধিক সমস্বরের বিষমীভবন বা অস্বরসঙ্গতি বললে ত্রুটি হয় না। যেমন তেঁতেলী (<তিন্তিলিকা>) বাংলা তেঁতুল। একটিতো স্পষ্টই প্রগত স্বরসঙ্গতির নজির মেখেলা (<মেখলা)২৪২। যাইহোক,একাধিক স্বরের সঙ্গতি বাংলাতে বিরল। রামেশ্বর শ’ যাকে প্রগত পরাগতর মিশ্রণ বলেছেন,সেখানেও একটি স্বরেরই পরিবর্তন হয়েছে। ফলে অসমিয়াতে এগুলোকে স্বরের সমীভবন মেনে নিলে তফাত স্পষ্ট থাকে।কিন্তু অন্যান্য ভাষাতে সমীভবনে মূলত ব্যঞ্জনেরই রূপান্তর বোঝায়। এমন দুই একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাংলা –অসমিয়াতে প্রবণতা একই। সে এতোটাই—যে,বাণীকান্ত কাকতি এর বিস্তৃত আলোচনা না করে সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের ওডিবিএল দেখবার পরামর্শ দিয়েছেন।২৪৩ ধ্বনিপরিবর্তনের গতিমুখ অনুসারে সমীভবনেরও তিনটি প্রকারভেদ। ১)প্রগত –আগের ব্যঞ্জন ধ্বনির প্রভাবে পরেরটি পালটে গেলে। যেমন---মান বাং.-সিলেটি পদ্ম> পদ্দ,সিলেটি পদ্দ /ʔpɔd̪d̪o/,চট্ট.ফ̣দ্দ/fɔddɔ/,নোয়া.হদ্দ/ɦɔddɔ/। দুধ +নৈ > অস.দুদনৈ।সিলেটি চিল̖লা< ছিলকা, ২) পরাগত ---পরের ধ্বনির প্রভাবে আগের কোনো ধ্বনি পালটে গেলে। যেমন--- সর্দার > সদ্দার,স্বর্গ> সগ̖গ। সিলেটি কাইল̖লা < কাৎলা,বাশ̖শা< ফা.বাদ̖শাহ̖ । পাঁচশ > সিল.পাচশ /ʔpɐsʃo/,নোয়া. হাঁশশ/ɦɐsʃo/,চট্ট.ফাঁশশ /faɐsʃo/। দ্রুত বলতে গিয়ে বাংলা বাক্যের পদ্গুচ্ছ কখনো বা এমন সমীভূত হয়ে জুড়ে যায়। যেমন তার জন্য> তাজ্জন্য, পাখির ডানা> পাখিড্ডানা। মান অসমিয়াতে এগুলো স্বাভাবিক ঘটনা। আংশিক সমীভবনে যেমন,সাত দিন > সাদ্দিন, মাত̖বোল> মাদ̖বোল।সিলেটি হাদ্দিন,মাত̖বোল < সাত দিন,মাতবোল। এল্লাগি < এর লাগি। চট্টগ্রামের ভাষাবৈচিত্র্যতে এই পরাগত সমীভবন ব্যাপক। এই ব্যাপকতা একে বাংলার অন্যান্য ভাষাবৈচিত্র্যের থেকে আলাদা করেছে বলে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন।২৪৪ যেমন যাইতে পারি > যাইত্তারি,নমস্কার > নস̖সার। ৩) পারস্পরিক বা অন্যোন্য--দুই ধ্বনির প্রভাবে দুটোই পালটে গেলে। যেমন- উৎ+শ্বাস > উচ্ছ্বাস। সত্য> অসমিয়া সঁচা,সিলেটি হাচা,নোয়া. শাচ̖চা। বিষমীভবনঃ সমীভবনের বিপরীত প্রক্রিয়ার নাম বিসমীভবন।একই রকম দুই ধ্বনি পরস্পরের প্রভাবে ভিন্ন হয়ে যায়। যেমন পর্তুগীজ আর্মারিও> আলমারি। সম্মান > অস.সন্মান।সিলেটিতে বিকল্পে সন্মান। সিলেটি শরিল < শরীর,জরমো< জন্ম, জিব̖রা < জিব্বা’ < জিহ্বা। লাঙল > চট্ট.নঃল,নোয়া.নাগল।পিঁপড়া > চট্ট.ফিঁউরা,নোয়া. হুঁ:́রা। ধ্বনি রূপান্তরের আরো বহু রকমফের আছে।একে একে সেগুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক।এর অনেকগুলোই আসলে সমীভবনই । ঘোষীভবনঃ যদি সঘোষ ধ্বনির প্রভাবে আগে বা পরের অঘোষ ধ্বনি ঘোষ হয়ে যায় তাকে ঘোষীভবন বলে। যেমন চাকদহ> চাগদা।বাংলা অসমিয়া শব্দের সন্ধিতে প্রায়ই এমন হয়। যেমন বাক + দেবী =বাগদেবী,একাদশ> এগারহ> বাং এগারো। অসমিয়াতে ধ্বনিটি স্বতোমহাপ্রাণীভবন ঘটে হয় ---এঘার’। কখনো বা এমনি এমনিই ঘোষীভবন হয়ে যায়। যেমন লোক> লোগ,ছাত> ছাদ।এগুলোকে স্বতোঘোষীভবন বলে। শকুন > অস.শগুন,ঢাকাই.হগুন। জগন্নাথ চক্রবর্তী বরাক উপত্যকাতে শাগ < শাক শব্দটির উল্লেখ করেছেন। এটি সর্বজনীন নয়। শাক /ʃɐx/-ও আছে। যেমন “বিষর লাখান কচু শাক” (সুরমা গাঙর পানি; কুড়ি)। তবে কবি,বড < কপি,বট আছে বটে সিলেটিতে। আবুল কালাম মনজুর মোরশেদের উল্লেখ করে রবীন্দ্র কুমার দত্ত লিখেছেন নোয়াখালি চট্টগ্রামীতে অঘোষ ‘ট,ঠ’ ঘোষ ‘ড’ এবং অঘোষ ‘ক’ ঘোষ ‘গ’-তে রূপান্তরিত হয়ে যায়।২৪৫ যেমন শাক> শাগ,হাগ,পোক > নোয়া.হোগ,চট্ট.ফো̣গ। মাটি >মাডি। অঘোষীভবনঃ ঘোষীভবনের বিপরীত প্রক্রিয়া হলো অঘোষীভবন। যেমন ফারসি গুলাব > বাং.-অস. গোলাপ,সিল.-নোয়া.- চট্ট.গোলাফ। আরবি কিতাব > অস.কিতাপ। সিলেটিতে কোথাও বা,বিশেষ করে কাছাড়ে মুরগি,জিগানি < মোরগ,জিজ্ঞাসা+নি > মুরকি,জিকানি হয়ে যায়।এহেন রূপান্তর নোয়াখালি চট্টগ্রামীতেও হয়। যেমন রাগ করেছো>নোয়া. রাক̖কইচ̖ছ,চট্ট.রাক̖কইর̖গ। জগন্নাথ চক্রবর্তী কাগজ > কাগচ হয় লিখেছেন যদিও রবীন্দ্র কুমার দত্ত লিখেছেন লাজ > লাচ হয়,আজ হয় আইচ । মহাপ্রাণীভবনঃ মহাপ্রাণ ধ্বনির প্রভাবে পাশের অল্পপ্রাণ ধ্বনিও মহাপ্রাণ হয়ে গেলে তাকে মহাপ্রাণীভবন বলে। যেমন—স্তম্ভ > বাং.-সিল.-অস.-নোয়া.-চট্ট.থাম।কামরূপী ভাষাবৈচিত্র্যে এই মহাপ্রাণীভবন ব্যাপক। যেমন ভোক=ভোখ,ভখ,বাষ্প > বাং.-অস ভাপ > কাম.ভাফ। কখনো বা এমনি এমনি মহাপ্রাণীভবন হয়ে যায়।যেমন পুস্তক> বাং.-অস.-পুথি,নোয়া.হুঁথি,চট্ট.ফু̣থি।মান বাংলা আপনি>সিল.আফনে। তেমনি কালীপূজা>নোয়া.কালি ফু̣জা/হুজা,চট্ট.খা̣লি ফু̣জা(xɐli fuza)।এই প্রক্রিয়াকে স্বতোমহাপ্রাণীভবন বলে। অল্পপ্রাণীভবনঃ মহাপ্রাণীভবনের বিপরীত প্রক্রিয়া হলো অল্পপ্রাণীভবন। যেমন শৃঙ্খল> প্রাচীন বাংলা শিংকল> মান বাংলা > শিকল,অসমিয়া শিকলি /xikɔli,সিলেটি হিকল /ɦikol/। শির+স্থান> অসমিয়া শিতান। নখ >সিল.--নোয়া.-চট্ট.নোউক। দুধ > সিল.-নোয়া.-চট্ট.দুদ। মধ্যপ্রাণীভবনঃ ‘মধ্যপ্রাণ’ শব্দটি আমরা আগেই উল্লেখ করেছি,আবিদ রাজা মজুমদারের পরিভাষা।‘ঘ’ ধ্বনির নিয়ে লিখেছেন,“স্বল্পপ্রাণ ও মহাপ্রাণের মাঝখানে এর উচ্চারণ ‘মধ্যপ্রাণ’ প্রবণতা বলে অভিহিত করা যায়।”২৪৬ আমরা তার থেকে সিলেটিতে ধ্বনি পরিবর্তনের এই সূত্র প্রস্তাব করছি। সিলেটিতে ভাত,ঘর যখন > বা’ত,গ’র হয় তখন এই ঘটনাটি ঘটে।কিন্তু সেখানে ফুসফুস চালিত বহির্মুখী বায়ুপ্রবাহের দ্বারা সৃষ্ট স্পর্শ ধ্বনি পালটে রুদ্ধ-স্বরপথ –চালিত অন্তর্মুখী বায়ুপ্রবাহের দ্বারা সৃষ্ট অন্তঃস্ফোটক ধ্বনিতে পরিণত হয় বলে এই প্রক্রিয়ার নাম কণ্ঠনালীয়ভবন লিখেছেন রামেশ্বর শ’।২৪৭ কিন্তু তিনি অঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনিগুলোর স্বরপথ চালিত অন্তর্মুখী ধ্বনি ‘ক’,প’,চ’,ট’,ত’ ’, কিংবা রুদ্ধ-স্বরপথ ধ্বনি ‘ʔক,ʔখ,ʔপ,ʔচ’ ইত্যাদির কথা উল্লেখ করেন নি।করবার কথা ছিল না। যদিও সবগুলোই কোনো না কোনো ভাবে স্বরপথে বায়ুকে বাধা দিয়েই উচ্চারিত হয়,তাই সেগুলোকে ‘কণ্ঠনালীয়ভবন’-এ বৃত্তবন্দি করা যায়। কিন্তু সাধারণভাবে সিলেটিতে মহাপ্রাণীভবন-অল্পপ্রাণীভবন নিয়ে একটি বিভ্রান্তি আছে।তা না হলে,নিখিলেশ পুরকাইত যে ভাষা নমুনাগুলো জোগাড় করেছেন,সেখানে এইভাবে বাক্যগুলোতে প/ফ,ত/থ বিভ্রান্তি হতো না। যেমন,“ আফনারে পরের বার দেখতাম ফারমু কিনা সন্দেঅ।” এবং “যে যে পতের পতিক,যে যেতা বালা পার হে ঠিক হউতাউ /হটাউ ফাইলার/ ফার।” তিনিও কাছাড়ি-সিলেটি দুই ভাষা-বৈচিত্র্য সম্পর্কেই লিখতেন না,“অল্পপ্রাণিতের নিদর্শন মেলে” কিংবা “‘প’ উচ্চারিত হয় ‘ফ’ এর মতো।”২৪৮ রণবীর পুরকায়স্থ সুরমাগাঙর পানিতে প-কে ফ লেখেন নি। যেমন “কেরাইয়ার ইত কালা পিত কালা পাত কালা”২৪৯। লেখেন নি,‘হকুনর ছাও’ নাটকে রামকৃষ্ণ দেবনাথ, কিন্তু ‘ত’ নিয়ে সমস্যাতে পড়েছেন কোথাও বা। যেমন “ইথা আপনে মাথৈন কিতা মাষ্টুব্বু”২৫০। মহাপ্রাণীভবন বা অল্পপ্রাণীভবন হয় না নয়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় এই মাঝামাঝি পরিবর্তন। এই সূত্রটি স্পষ্ট করতে আমরা ‘মধ্যপ্রাণীভবন’-এর প্রস্তাব করলাম। এই সূত্র অনুযায়ী প্রথম দুই বাক্যের নিম্নরেখ শব্দগুলো লেখা উচিত এরকম: আফনারে /ɐfnɐre/,পরের /ʔpɔrer/,পারমু /ʔpɐrmu/,পথের পথিক/ʔpɔt̪’er ʔpɔt̪’ik/,ভালা /b’ɐla/,পার/ʔpɐr/,পাইলার /ʔpɐilɐr/,পার/ʔpɐr /। হকুনর ছাও নাটকের সংলাপটি এভাবে লিখলে সঠিক হতো: ‘ইতা আপনে মাতৈন কিতা মাষ্টুব্বু’ /it̪’ɐ ɐfne mɐt̪’ɔin kit̪’ɐ mɐʃʈubbu/।মধ্যপ্রাণীভবনের দুই বিপরীত গতির কথা মনে রেখে অল্পপ্রাণ মধ্যপ্রাণ হলে অগ্রমুখ মধ্যপ্রাণ (পথের পথিক) এবং মহাপ্রাণ মধ্যপ্রাণ হলে পশ্চমুখ মধ্যপ্রাণ (ভালা / b’ɐla/) বলে চিহ্নিত করতে পারি। সিলেটি যেহেতু লেখার ভাষা নয়, ‘আফনারে’ /ɐfnɐre/ --শব্দের মতো পূর্ণমহাপ্রাণীভূত বা অল্পপ্রাণীভূত শব্দ না হওয়া সাধারণ সাহিত্যিক রচনায় মানবাংলার ব্যবহৃত বর্ণ পাল্টাবার প্রস্তাব আমরা করি না। শুধু বর্তমান অধ্যয়নের দরকারে উচ্চারণ বোঝাতে প্রাসঙ্গিক উদাহরণে আমরা বাংলা বর্ণের সঙ্গে কখনো বা প্রাসঙ্গিক চিহ্ন কিছু -- ʔপ,প’ আদি আগেও ব্যবহার করেছি,পরেও করে যাব। নাসিক্যীভবনঃ কোনো না নাসিক্যধ্বনি যদি ক্ষীণ হতে হতে লোপ পেয়ে যায় এবং তার রেশ স্বরূপ আগেকার স্বরধ্বনিতে একটি অনুনাসিক অনুরণন যোগ হয় তবে সেই প্রক্রিয়াকে নাসিক্যীভবন বলে। যেমন বন্ধ> বাঁধ।অসমিয়াতে এরকম শব্দে সাধারণত মূলের নাসিক্য ধ্বনিটি থাকে। যেমন,চান্দ,বান্দ,ফান্দ।সিলেটি সহ বাংলার পূর্ববঙ্গীয় বহু ভাষাবৈচিত্র্যেও এই ঘটনা ঘটে।কিন্তু অসমিয়াতে পরের নাসিক্য ধ্বনি আগেকার অ-কে এ-ধ্বনিতে উন্নীত করে এবং এই ঘটনা কেবল প্রাচীন অসমিয়াতেই ঘটে বলে বাণীকান্ত লিখেছেন।২৫১ যেমন ৰঙ্গ > ৰেঙ্গা,পর্যঙ্ক > পালেং,পঙ্গু > পেঙ্গা। কিন্তু তিনি এমন কিছু নজির দিয়েছেন যেগুলোতে নাসিক্যীভবন ঘটে এবং ঘটুক চাই নাই ঘটুক সিলেটি সহ পূর্ববঙ্গীয় ভাষাবৈচিত্র্যগুলোতেও অসমিয়ারই মতো আগেকার অ-ধ্বনি এ-তে উন্নীত হয়ে যায়। যেমন বেঁকা,পেঁকˎ,চেঙˎ(< চঙ্গ),ঠেং (< টঙ্গ)। শব্দগুলো নোয়াখালি চট্টগ্রামীতেও সামান্য অন্যরকম উচ্চারিত হয় মাত্র। ব্যেঁকা,ব্যেঁয়া,ফ্যেঁক,হ্যেঁক ইত্যাদি। বাণীকান্তের এই নজিরেতো একই সঙ্গে বিনাসিক্যীভবনও ঘটে-- লেজ, নেজ (লঞ্জ)। অসমিয়া তেওঁ ( অপ.তেহঁ), এওঁ (অপ.এহঁ) ইত্যাদি শব্দের নাসিক্যীভবন অপভ্রংশের কালেই ঘটে গিয়েছিল। সেখানে কখনো বা এমনি এমনিও নাসিক্যীভবন হয়ে যায়। যেমন পুস্তক> পুথি> বাংলা পুঁথি।সং.কর্টক> বাং.-অস.কণ্টক > বাং.কাঁটা,অস.কাঁইট।এই প্রক্রিয়াকে স্বতোনাসিক্যীভবন বলে। চট্টগ্রামী,নোয়াখালীতে ব্যাপক হারে স্বতোনাসিক্যীভবন ঘটে যেমন। তুই > তুঁ:́ই,আমাদের > আঁরার এমন শব্দে মনে হতে পারে শব্দ মধ্যে নাসিক্য ‘ম’ লুপ্ত হওয়াতে আগের ব্যঞ্জন আনুনাসিক হয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্র দত্ত লিখেছেন শব্দের দ্বিতীয় ব্যঞ্জন লোপ হলেই আগের ব্যঞ্জনের স্বর আনুনাসিক হয়ে যায়। তাই টাকা> ট্যেঁয়া, কুড়ি > কুঁ:ই ইত্যাদি। বিনাসিক্যভবনঃ বহুসময় নাসিক্যধ্বনিটি লোপ পায়,কিন্তু কোনো চিহ্ন রেখে যায় না। যেমন শৃঙ্খল < বাং. শেকল,অস. শিকলি, সিলেটি হিকল। মূর্ধন্যীভবনঃ কখনো বা শব্দের ভেতরের মূর্ধন্য ধ্বনির প্রভাবে সংশ্লিষ্ট বা কাছাকাছি দন্ত্যধ্বনি মূর্ধন্য ধ্বনিতে পরিণত হয়ে যায়।এই প্রক্রিয়াকে মূর্ধন্যীভবন বলে।যেমন মৃত্তিকা> বাং.-সিল.মাটি,নোয়া.-চট্ট.মাডি। দক্ষিণ > বাং.ডান,সিল.-নোয়া.-চট্ট.ডাইন।তির্যক > বাং.-সি.তেড়া/টেরা,নোয়া.-চট্ট.ট্যেরা। বৃদ্ধ > বুড̖ঢ > বুড়া। বাং.-সি.-নোয়া.-চট্ট.বুড়া। বুড়া অসমিয়াতে বুঢ়া -- এই ঘটনাটি ঘটে কী করে? অসমিয়াতে মূর্ধন্যধ্বনি নেই বলে আমরা আগেই লিখে এসেছি। মূর্ধন্য ধ্বনিগুলোর দন্তমূলীয় উচ্চারণ তিব্বত বর্মী ভাষার প্রভাব বলে গ্রিয়ার্সন লিখেছেন।যার জন্যে বাণীকান্ত লিখেছেন,“ অসমীয়া ঐতিহাসিক ভাবে ন.ভা.আ. ভাষাবোরর মূর্ধন্যকারী গোষ্ঠীত পরে ...।”২৫২ অসমিয়া জাতীয় অভিধানে ট বর্গের ধ্বনিগুলো দিয়ে শুরু প্রতিটি শব্দের,এমন কি বিদেশী শব্দেরও,দন্তমূলীয় ধ্বনি দিয়ে বিকল্প বানান প্রস্তাব করা হয়েছে। এবারে,বাণীকান্তের মতে প্রাচ্য মধ্যভারতীয় আর্যভাষার থেকে অসমিয়া মূর্ধন্যীভূত শব্দ এবং মূর্ধন্যকারী প্রবণতা দুয়েরই উত্তরাধিকার পেয়েছে। কিন্তু দুই দুইটি বর্গের দন্তমূলীয় উচ্চারণ হওয়াতে ‘অসমীয়াক স্বতঃ মূর্ধন্যীভবনর বাবে নতুন গতিবেগ দিয়া যেন লাগিছে।”২৫৩ ঋণকৃত দেশি বিদেশী শব্দে বা অপরিচিত শব্দগুলোকে মূর্ধন্যবর্গের বর্ণ দিয়ে বানান করা শুরু হলো। যেমন,টগর,ডিব্রু ইত্যাদি শব্দ এলো। ধরে নেয়া হলো যে এগুলোতে বানানের দন্তমূলীয় বর্গ যথাযথ উচ্চারণকে প্রতিনিধিত্ব করে না। ফলে যথাযথ ধ্বনিমূল্য দিতে গিয়ে মূর্ধন্য বর্ণগুলো এলো। কিন্তু সেই ধ্বনিমূল্য চোখকেই দেয়া হলো,কানকে দিতে পারা গেল না। কিন্তু শুদ্ধবাদীরা বুৎপত্তির দিকে নজর রেখে প্রায়ই লেখেন তগর,দিব্রু ইত্যাদি। বাংলাতেও কখনো বা এমনি এমনি মূর্ধন্যীভবন হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াকে স্বতোমূর্ধন্যীভবন বলে। যেমন সংস্কৃত পততি>প্রাকৃত পড়ই> বাংলা পড়ে। অসমিয়াতে এটাই মূল প্রবণতা। বুঢ়া-র ঢ় আসলে অসমীয়াতে দন্তমূলীয় ‘ৰ’-এর মহাপ্রাণ উচ্চারণ। তেমনি সং. পঠতি >অসমিয়া পঢ়ে= কিন্তু বাংলা পড়ে।অথচ, সং.পততি > অসমিয়া পৰে। সিলেটিতে পততি>পড়ে/পরে দুটোই,নোয়াখালিতেও হড়ে/হরে, কিন্তু চট্টগ্রামীতে অসমিয়ার মতো শুধুই ফ̣রে। বিমূর্ধন্যীভবনঃ মূর্ধন্যধ্বনি যদি দন্ত্য বা অন্য কোনো ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয় তবে তকে বিমূর্ধন্যীভবন বলে। যেমন প্রাণ > বাংলা উচ্চারণে প্রান,চট্টগ্রামী ফান।প্রত্ন-অসমিয়া বা বিদেশী ভাষার সমস্ত মূর্ধন্যধ্বনিরই অসমিয়াতে এই বিমূর্ধণ্যীভবন ঘটে। তালব্যীভবনঃ তালব্যধ্বনির প্রভাবে কোনো দন্ত্যধ্বনি বা অন্যধ্বনি তালব্যধ্বনীতে পরিবর্তিত হবার প্রক্রিয়াকে তালব্যীভবন বলে। যেমন সন্ধ্যা> সঞঝা (য-ফলার প্রভাবে /ন,ধ/ পালটে তালব্যধ্বনি /ঞ,ঝ/ হয়েছে।) > সাঁঝ > সিলেটি হাইঞ্জা /ɦɐinzɐ/।অসমীয়াতে তালব্য বা তালুদন্ত্যমূলীয় ধ্বনিতে পরিবর্তিত হবার কোনো প্রশ্নই নেই। কেননা,এই বর্গের ধ্বনিও অসমিয়াতে নেই। বরং ম.ভা. আ. ভাষার তালব্য ধ্বনি অসমিয়াতে এবং সিলেটিতে দন্তমূলীয় হয়ে যায়। যেমন প্রা. চচ্ছই > অস.সাঁসে/ সিলেটিতে চাছে /ʔt͡sɐse/।সত্য> অসমিয়া সঁচা, সিলেটি হাচা,নোয়া.শাচ̖চা। কখনো বা এমনি এমনি তালব্যীভবন হয়ে যায়। যেমন ইংরেজি graduate > গ্রাজুয়েট। এই প্রক্রিয়াকে স্বতোতালব্যীভবন বলে। অসমিয়া গ্রেজুৱেত-এ দন্ত্যমূলীয়ভবন (d> জ/z) হয়। উষ্মীভবন: স্পর্শ ধ্বনি উচ্চারণের সময় শ্বাসবায়ু পুরো বাধা না পেয়ে আংশিক বাধা পেলে ঊষ্মধ্বনিতে পরিণত হয়ে যায়।উষ্মীভবন পূর্ববঙ্গীয় ভাষাগুলোর একটি সাধারণ প্রবণতা। যেমন জানতে/d͡Ʒɐnt̪e]/ >জানতি/ zɐnt̪i]/,কালীপূজা > নোয়া.কালি ফু̣জা/ হুজা,চট্ট.খা̣লি ফু̣জা (xɐli fuza)।ছাগল/t͡ʃhɐgol/ >সিলেটি ছাগল/sɐgɔl,পাপ /pɐp/>সিলেটি পাপ /ʔpɐf/।অসমিয়াতে উষ্মীভবন নিয়ে আলাদা করে আলোচনা করতে দেখা যায় না,সম্ভবত এরই জন্যে যে তালব্য সংস্কৃত এবং মধ্যভারতীয় আর্যের ঘৃষ্ট ধ্বনির উষ্মীভবনের ফলেই অসমিয়া চˎ=সˎ,জˎ=ঝˎ=যˎ হয়েই আছে।এছাড়াও কক্ষ> কাষ, পক্ষ >পষেক এরকম শব্দ ঊষ্মীভবনেরই পরিণাম যদিও এহেন শব্দে ‘ষ’ কখনোবা ‘খˎ’ উচ্চারিত হয়। উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী ধ্বনি পরিবর্তন নিয়ে বেশ বিস্তৃত আলোচনা করলেও একে কোনো উপশ্রেণির অধীনে আলাদা করেন নি। শুধু কালান্তরে ধ্বনি যে কিছু নিয়ম মেনে পরিবর্তিত হয়ে সেসব কথা আলোচনা করতে গিয়ে এই সূত্রের কথা উল্লেখ করেছেন,“অসমীয়া ভাষার এটা ধ্বনি নিয়ম হ’ল সংস্কৃতর অসংযুক্ত উষ্ম ধ্বনি শ,ষ,স অসমীয়াত ‘স’ হয়,যেনে শৰ>সৰ, ষণ্ড>সাঁৰ,সাৰ>সাৰ,আশা> আসা,আকাশ>আকাস ইত্যাদি। সংস্কৃতর অসংযুক্ততা এটা বিশেষ পরিস্থিতি।এই পরিস্থিতিটো না থাকিলে উষ্ম ধ্বনিবোৰ স-ধ্বনিত পরিণত নহয়;যেনে কৃষ্ণ> ক্রিচ̖ন।”২৫৪ তাঁর ‘স’-কে /x/ এবং ‘চ’-কে /s/ পড়তে হবে। সিলেটিতে অবশ্য চ-বর্গ ধ্বনি /x/ হয় না যদিও ‘ক’,‘খ’ শব্দের মাঝে বা শেষে থাকলে কখনো হয়। যেমন,পেক /ʔpex/> পাঁক /pɐ̃k/,দেখ /ʔdex/ > দেখ /dekh/।‘চ,ছ’ একক উচ্চারণে যেখানে উষ্ণ ‘স’ হয় যুক্তাক্ষরে সেখানে তালুদন্তমূলীয় স্পৃষ্ট উচ্চারণ অক্ষত রাখে। যেমন খেচর/ʔkhesɔr/,খেচ্চড় /ʔkhet͡ʃt͡ʃɔɽ/< মা.বা.খচ্চর /khɔt͡ʃt͡ʃɔr/। সকারীভবনঃ উষ্মীভবনের ফলে যদি স্পৃষ্ট বা ঘৃষ্ট ধ্বনি ‘স’,‘শ’,বা ‘জ’-তে পরিণত হয় তবে তাকে সকারিভবন বলে। যেমন আগাপাছতলা > আগাপাসতলা।সকারিভবনেও অসমিয়াতে আলোচনার কিচ্ছু থাকে না।সিলেটিতে এই নিয়ে আলাদা আলোচনা করবার কিছু নেই। রকারীভবন/ লকারীভবনঃ শ,ষ,স বহু সময় পালটে র বা ল হয়ে যায়। যেমন সংস্কৃত পঞ্চদশ> প্রাকৃত পন্নডহ > পনর> পনেরো,অস.পোন্ধৰ। সংস্কৃত ষট̖+দশ >ষোড়শ >ষোল(বাং[ʃolɔ],অস.[ xolɔ])। সিলেটিতে ‘ন,র’ প্রায়শই > ‘ল’ হয়ে যায়। যেমন বাংনড়া,নামা,নিক,নাগাল> সিলেটি লড়া,লামা,লিক,লাগাল।বাং.রঙিন,ননি >রঙিল,লনি। নোয়াখালি, চট্টগ্রামীতে ঠিক তার বিপরীত হয়। ল> ন হয়ে যায়। যেমন লাঙল > চট্ট.নঃল,নোয়া.নাগল। কিন্তু শরীর সিলেটি নোয়াখালিতে শরিল-ও হয়। হকারীভবনঃ কখনো বা সংকীর্ণ উষ্মধ্বনি ‘স’ প্রশস্ত উষ্মধ্বনি ‘হ’-তে রূপান্তরিত হয়ে যায়। যেমন সংস্কৃত সিন্দু>হিন্দু। সিলেটি সহ পূর্ববঙ্গীয় বহু ভাষাবৈচিত্র্যে এটি এক সাধারণ প্রবণতা এই কথা আমরা আগেই আলোচনা করে এসেছি। তবে শুধু ‘স’ নয়,বানানে একক ‘শ,ষ’ থাকলেও অসমিয়াতে যেখানেই ‘স’/x/ হয় সিলেটি সহ পূর্ববঙ্গীয় প্রায় সব ভাষাবৈচিত্র্যে অধিকাংশ সময়েই ‘হ’ হয়ে যায়। যেমন সে>হে,হেতি;শাঁখ> হাখ; ষাঁড়> হাড় ইত্যাদি।সুনীতি চট্টোপাধ্যায় ওডিবিএল-এ একটি শাস্ত্রবাক্য উদ্ধার করেছিলেন,“আশীর্বাদম ন গৃহ্যিয়াত পূর্ব দেশ নিবাসিনাম।/‘শতায়ুর’ ইতি বক্তব্যে, ‘হতায়ুর’ ইতি ভাষিনাম।।”২৫৫ আমরা পূর্বদেশবাসীদের থেকে আশীর্বাদ নিতে মানা করা হচ্ছে। কেন না আমরা ‘শতায়ু’ হবার আশীর্বাদ দিতে গিয়ে ‘হতায়ু’ হবার শাপ দিয়ে বসি।আমরা মানে,অসমিয়ারা আর পুব বাংলার লোকেরা।এই শাস্ত্রবাক্য প্রমাণ করে আমরা বহু আগে থেকেই এই ‘হ’ উচ্চারণ করি। কেন?-- এই প্রশ্নের উত্তরই খুব কম লোক সন্ধান করেছেন।সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ও তাঁর গ্রন্থে খুব নিশ্চিত হয়ে কিছু উত্তর দেন নি। লিখেছেন ,“. . . The presence of a large Tibeto-Burman element in the population of Assam and East and North Bengal may have something to do with this....”।২৫৬ বডো,তিওয়া,ডিমাছা আদি ভাষাতে ‘শ,স,ষ’ ধ্বনি-ত্রয়ীর অনুপস্থিতি দেখে আমাদেরও মনে হয় সুনীতিকুমার সঠিক অনুমান করেছেন,যদিও রাজেন বরুয়া পূর্বোক্ত রচনাটিতে প্রাকবৈদিক আর্য বা আল্পাইন আর্য উৎসের কথাও লিখেছেন অসমিয়া ষ/x/এর উৎস স্বরূপ।আমাদের প্রস্তাব -- আদি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাকে যেমন কেন্তুম -সতম গোষ্ঠীতে ভাগ করেছিলেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়--তেমনি বাংলা ভাষাকেও মোটা দাগে এই শ্লোক অনুসরণ করে--- শতায়ু-হতায়ু ভাগে দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলা যায়। সিলেটিতে ‘ফ’-ও কখনো বা ‘হ’ হয়ে যায়। যেমন ফকির> হকির। উল্টোটাও হয় শোন > হুন> ফুন।একে ফকারীভবন নাম দেয়া যেতে পারে। নোয়াখালিতেও ‘ফ’ প্রায়ই ‘হ’ হয়।যেমন পূজা,পড়ে > হুজা,হরে।এমন বেশ কিছু নজির ইতিমধ্যে উল্লেখ করে এসেছি। সঙ্কোচন: উচ্চারণ দ্রুততার জন্যে বা প্রয়াস লাঘবের জন্যে একাধিক ধ্বনিকে স্পষ্ট উচ্চারণ না করে মিলিয়ে দিয়ে এক ধ্বনি করে ফেলা হয়,একে সঙ্কোচন বলে। যেমন বৈবাহিক >বাং-সিল.বেয়াই,অস.বিয়ৈ;করিমগঞ্জ > সিল.করিমঞ্জ।ছোট কাকু>সিল.ছোটাক্কু। মাস্টার বাবু > সিল.মাস্টাব্বু।মহাশয় >মাশয়।অসমিয়া নৱ+কোমল>নোমল।নোয়াখালিতে এই প্রবণতা ব্যাপক,চট্টগ্রামীতে তারচেও বেশি। যেমন নোয়া.আনো গিয়া যাও > আনোগৈজ̣ও́,চট্ট.প্রাণ-এ-লাগ-এর > পাআনলার’ (বোধ হয়),সেই স্থান দিয়া> ইনদি। বিস্ফোরণ: বহুসময় আবার উচ্চারণ আয়াসের জন্যে শব্দের উচ্চারণকে দীর্ঘও করে ফেলা হয়। এ একাধারে ধ্বনির রূপান্তর এবং আগমের নজির হয়ে থাকে। যেমন ভক্তি> ভকতি।এ স্বরভক্তিরও নজির।দ্বিমাত্রিকতার বিপরীতে শব্দকে এখানে ত্রিমাত্রিক করে ফেলা হয়েছে। তেমনি পোর্তুগীজ পেরা >বাংলা পেয়ারা। সংস্কৃত পর্যঙ্ক >ব্রজবুলি পরিষঙ্ক। তেমনি বর্ষা> অসমিয়া বাৰিষা। নিম্ন > অসমিয়া নামনি ইত্যাদি। সং.মৃত্তিকা > সিলেটি মিরতিঙ্গা,বাং.ঘামাচি> সিলেটি ঘামামাছি। বিভাজন: একই ভাষার পরিবর্তনের ফলে কালে গিয়ে যদি একই স্বনিমের উপধ্বনি যদি স্বতন্ত্র স্বনিমের মর্যাদা লাভ করে তবে তাকে বিভাজন বলে। যেমন বাংলাতে /ড়/ শব্দের শেষে বা দুই স্বরধ্বনির মাঝেই বসতো,অন্যত্র বসত/ড/। ফলে ধ্বনি দুটি ছিল একই স্বনিমের উপধ্বনি। কিন্তু বহু বিদেশী শব্দের প্রচলনে এই শর্ত ভেঙ্গে গেছে। যেমন রেডিও,রড। তেমনি অসমিয়া স্বাভাবিক হ্রস্ব স্বর অ’। উৎস শব্দের –ৱ-,-অহ- আদি ধ্বনি সমষ্টির সংকোচনের ফলে স্বতন্ত্র নিম্ন স্বরধ্বনি –অ̊-এর উদ্ভব। বাণীকান্ত কাকতি একে উপরে বিন্দু দিয়ে লিখেছিলেন,এখন সেটি ছাড়াই লেখা হয়। যেমন নৱ> ন̊,নৱনীত > ন̊নী। মান বাংলা ‘চ,ছ’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ এইটুকুন মাত্র লিখেছিলেন,“"নাচতে,মুছতে’ প্রভৃতি শব্দে ‘চ-ছ’এর সঙ্গে ত’এর ঘেঁষ লেগে দন্ত্য স’এর ধ্বনি জাগে।” সিলেটি সহ বহু পূর্ববঙ্গীয় ভাষাতে ‘চ,ছ’-এর বহু সময় ‘স’ পরিণতির কথা আমরা এর আগে উল্লেখ করে এসেছি। ফলে সিলেটিতে ‘স’ একটি স্বতন্ত্র ধ্বনি তথা স্বনিম। একীভবন: বিভাজনের বিপরীত একীভবন। দুই ভিন্ন স্বনিমের একটি কখনো স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে অন্য স্বনিমের সঙ্গে মিশে যায়। যেমন সংস্কৃতের/ণ/ বাংলা,সিলেটি,অসমিয়া সবেতে স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে দন্ত্য-ন-এর সঙ্গে এক হয়ে গেছে।অসমিয়াতে সংস্কৃতের তালব্য এবং মূর্ধন্যধ্বনিগুলো দন্তমূলীয় ধ্বনির সঙ্গে এক হয়ে গেছে। ব্যঞ্জনদ্বিত্ব: কোনো শব্দে জোর দেবার জন্যে যখন বিশেষ অক্ষরে শ্বাসাঘাত পড়ে তখন বহু সময় স্বরমধ্যবর্তী ব্যঞ্জন দুবার উচ্চারিত হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলে ব্যঞ্জনদ্বিত্ব। যেমন বড় > বড্ড,কোথাও > কোত্থাও। অসমিয়াতে এমন প্রয়োগ নেই। সিলেটিতে ছাত্তা < ছাতা,পাত̖থর /pɐt̪t̪’ɔr/< পাথর,বাট্টি < বেঁটে ইত্যাদি। নোয়াখালি,চট্টগ্রামীতে ব্যঞ্জন দ্বিত্ব একটি সাধারণ প্রবণতা। যেমন পাইত্তে,কইল্লো< পারতে,করলো। সিলেটি,নোয়াখালি, চট্টগ্রামী সবেতে সকলে,ছোট হয়ে যায় > হক্কলে,ছোট্ট। জগন্নাথ চক্রবর্তী ‘স্বরায়ন’ বলে একটি বাড়তি ধ্বনিরূপান্তরের সূত্রের উল্লেখ করেছেন। তারও দুই প্রকার দেখিয়েছেন।২৫৭ আমাদের মতে তার মধ্যে প্রথমটিকে কণ্ঠনালীয়ভবন বা স্বরতন্ত্রীভবন নাম দেয়াই সঠিক। রবীন্দ্র কুমার দত্ত তাই দিয়েছেন।২৫৮ আদ্য ‘হ’ লোপ পেলে সিলেটিতে পরিপূর্ণ স্বরে রূপান্তরিত হয় না,স্বরের স্বরতন্ত্রীয়ভবন ঘটে। ফলে বানানে শব্দগুলোকে এভাবে যদিও বা লেখা যায় ‘অয়,আড়,আস,ইন্দু,আত্তি’ (<হয়,হাড়,হাঁস,হিন্দু,হাতি) উচ্চারণে শব্দগুলো আসলে ‘ʔঅয়,ʔআড়,ʔআস,ʔইন্দু,ʔআত্তি’ /ʔɔĕ,ʔɐɽ,ʔɐs,ʔind̪u,ʔɐt̪t̪i/। তেমনি তিনি ‘শ,ষ,স’ লোপ পেয়ে সংশ্লিষ্ট স্বর রেখে দেবার নজির দিয়েছেন। সেগুলো স্পষ্টই ‘য়,ওয়’ শ্রুতির নজির। যেমন চআ,বআ,কিঅর,গআগয়ি (< চষা,বসা,কিসের,ঘষাঘষি)। শেষ শব্দের শেষ বর্ণটি তিনি ‘য়’-ই লিখেছেন। আমাদের মতে শব্দগুলোকে এইভাবেও লেখা যেতো – চওয়া,বওয়া,কিয়র,গওয়াগয়ি। অন্যথা হিয়াল (< শিয়াল <শৃগাল)-কেও হিআল লিখতে হয়। ধ্বনির স্থানান্তর: বিপর্যাস: দুই সংযুক্ত বা কাছাকাছি ধ্বনি প্রায়ই নিজেদের মধ্যে স্থানবদল করে ফেলে। একে বিপর্যাস বলে। যেমন বাক্স> বাং.-অস.-সিল.-নোয়া.-চট্ট.বাস্ক;আধিক্যতা> আদিখ্যেতা; ৰস+উণ > রশুন > নহৰু;ফারসি রুমাল > কাম.উরমাল। দূরস্থ ধ্বনির বিপর্যাস বা স্পুনারিজম : শব্দের মধ্যে পাশাপাশি ধ্বনির স্থানবদলের মতো বাক্যেও ব্যাপারটি ঘটে যায়। তাকে স্পুনারিজম বলে। যেমন এক কাপ চা> এক চাপ কা। মহানুভব জাঁহাপনা> জাহানুভব মহাপনা! অপিনিহিতি: মধ্যস্বরাগম নিয়ে লিখতে গিয়ে আমরা অপিনিহিতির কিছু কথা বলে এসেছি। য্য-ফলা যুক্ত ব্যঞ্জন ‘ক্ষ,জ্ঞ’- এর আগে সিলেটি সহ পূর্ববঙ্গের ভাষাগুলোতে এমনিতেই একটি /ই/ বা /উ/ যুক্ত হয়ে যায়। তখন আগম হয়। কিন্তু অন্য সময় শব্দের পরবর্তী ই বা উ স্বস্থানে থেকে বা না থেকেও আগে চলে আসে। যেমন করিয়া> কইরিয়া> কইর্যা। একে বিপর্যাস বলা হয় না এরই জন্যে যে দুই ধ্বনি নয়,একটিই শুধু স্থান বদল করে।এমন স্থানান্তরের নজির মান অসমিয়াতে বেশি নেই।বাণীকান্ত কাকতি লিখেছেন,অপিনিহিতি পশ্চিম অসমের কথ্য ভাষাতে এক বিশেষত্বপূর্ণ লক্ষণ।২৫৯ সেখানে দুইয়ের বেশি অক্ষরের শব্দে ই,উ-র অপিনিহিতি হয়েই যায়। যেমন হালোৱা> হাউলা।বিশেষণ প্রত্যয় যুক্ত হলে অপিনিহিতি হয়ে যায়। যেমন ৰাতি> ৰাইতা;কাতি> কাইতা। এই অব্দি যা কিছু আলোচনা করলাম সেগুলো ভাষার বহিরঙ্গ কারণে ধ্বনি পরিবর্তন। ভাষার অন্তরঙ্গ কারণে বা অর্থের প্রভাবেও ধ্বনির পরিবর্তন হয়। সাদৃশ্য: মনে রাখবার সুবিধের জন্যে বা উচ্চারণ বৈষম্য কমিয়ে আনতে একটি শব্দের আদলে অন্য শব্দকেও আমরা পালটে দিয়ে থাকি।একে সাদৃশ্য বলে।সাদৃশ্যের ফলে ধ্বনি,অর্থ,রূপ পাল্টায়। এমন কি একেবারেই নতুন শব্দও তৈরি হয়।এখানে আমরা ধ্বনি পরিবর্তনের বিষয়টিই আলোচনা করবো। যেমন টাকার কুবির > হয়ে গেছে -টাকার কুমীর।সংস্কৃত প্রাচীর > বাংলা পাঁচের সাদৃশ্যে হয়ে গেছে পাঁচিল।বাংলা হাঁসের সাদৃশ্যে হাসি শব্দটিও চট্টগ্রামীতে হয়ে গেছে হাঁশি,নোয়াখালিতে ʔআঁশি। এই প্রবণতাটি সিলেটিতেও রয়েছে। সমমুখ ধ্বনি পরিবর্তন: ধ্বনি পরিবর্তনের ফলে যদি একাধিক শব্দ বানানে এবং উচ্চারণে একই হয়ে যায়,তবে তাকে সমমুখ ধ্বনি পরিবর্তন বলে। যেমন সংস্কৃত পততি > বাংলা পড়ে;সংস্কৃত পঠতি> বাংলা পড়ে। বানানে তফাত থেকে গেলে তাকে সমোচ্চারিত বা সমধ্বনি শব্দ বলে। যেমন শ্রবণ > শোনা,ও সুবর্ণ> সোনা। উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী এগুলোকে অভিসারী পরিবর্তন লিখেছেন।২৬০ সং.কর্ম> বাং.-অস.কাম। সংস্কৃত কাম (যৌন আবেগ) > বাং.-অস.কাম। বিমুখ ধ্বনি পরিবর্তন: একই শব্দ পালটে গিয়ে বানানে,উচ্চারণে এবং অর্থে কালে কালে ভিন্ন শব্দে পরিণত হতে পারে। একে বিমুখ ধ্বনি পরিবর্তন বলে। যেমন ভণ্ড > ভান,ভাঁড়।উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী এগুলোকে অপসারী পরিবর্তন লিখেছেন।২৬১ সং.কর্ম> বাং.-অস.কাম,বাং.কাজ (শ্রাদ্ধ),অস.কাম (শ্রাদ্ধ);কর্ম(ভাগ্য)।এই শেষোক্ত শব্দে অবশ্য কোনোরকম ধ্বনি পরিবর্তন হয় নি। পরম্পরাগত ব্যাকরণে বা তুলনামূলক ভাষা বিজ্ঞানে ভাষার অন্তরঙ্গ কারণে বা অর্থের প্রভাবেও ধ্বনির পরিবর্তনের কথা আলোচনা করতে গিয়ে সাদৃশ্যের আরো প্রকার ভেদ,বিমিশ্রণ,জোড়কলম শব্দ,সঙ্কর শব্দ,লোকনিরুক্তি,শব্দবিভ্রম,বিষমচ্ছেদ,ভুয়া শব্দ,পুনর্গঠন ইত্যাদি আরো কিছু প্রকারভেদের কথা আলোচিত হয়ে থাকে। সুকুমার সেন থেকে রামেশ্বর শ’ উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী,জগন্নাথ চক্রবর্তী, রবীন্দ্র কুমার দত্ত সবাই করেছেন।সত্য বটে, শব্দ বা অর্থের প্রভাবে শব্দের মধ্যে ধ্বনিরও অবাঞ্ছিত পরিবর্তন হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে যদিও বা ধ্বনি পরিবর্তিত হয় শব্দগুলোও পুনর্গঠিত হয় বলে এগুলো শব্দতত্ত্ব,রূপতত্ত্বেই আলোচনা করা উচিত। আমরা তাই এখানেই থামছি।
।। স্বনিম এবং বিস্বন।। এই পর্যন্ত আমরা ধ্বনির বৈচিত্র্য নিয়ে আলোচনা করেছি। তার পরিবর্তনের স্বরূপও ধরবার চেষ্টা করেছি। করতে গিয়ে দেখেছি বহু ধ্বনি বর্ণমালাতে আছে ব্যবহারে নেই। বানানে আছে উচ্চারণে নেই। উচ্চারণে থাকলেও তা শর্তাধীন এবং কিছু শর্তাধীন উচ্চারণের কোনো হরফ নেই। সর্বত্র একই ধ্বনির উচ্চারণ একই রকম হয় না। যেমন ‘দীনের’ শব্দে দ-এ হ্রস্ব-ই,কিন্তু ‘দিন’ শব্দে দ-এ দীর্ঘ ঈ উচ্চারিত হয়। এই অসঙ্গতিগুলো কিংবা পরিবর্তনের ফলে একটি ভাষাতে তার ধ্বনিগুলো ঠিক কী চেহারা নেয় পরম্পরাগত ব্যাকরণ ব্যাখ্যা করতে পারে না। আধুনিক এককালিক ভাষাবিজ্ঞানেই শুধু এর ব্যাখ্যা সম্ভব। ভাষা বিজ্ঞানে যে ধ্বনিগুলোর ব্যবহার আছে শুধু সেগুলোকেই চিহ্নিত করে। আবার কোনো ধ্বনির যদি একাধিক উচ্চারণ বৈচিত্র্য আছে,তবে সেগুলোকে আলাদা ধ্বনি বলে হিসেবে না নিয়ে একটিই মূলধ্বনি বলে বিবেচনা করে। তাকে স্বনিম বা ধ্বনিতা বা ধ্বনিমান বা ধ্বনিমূল বলে। আমরা ‘স্বনিম’ই বলবো। আর তার উচ্চারণ বৈচিত্র্য দু’রকমের হয়। তার একটিকে বলে উপধ্বনি বা পূরকধ্বনি বা সহধ্বনি বা বিস্বন। অন্যটিকে বলে মুক্তবৈচিত্র্য বা স্বচ্ছন্দ বৈচিত্র্য। আমরা স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যে বিস্বন এবং মুক্তবৈচিত্র্য বলবো। এর আগে ‘ধ্বনিসত্তার স্বরূপ’ অনুযায়ী বিভাজনে ধ্বনির দুই ভাগের কথা লিখে এসেছি --- বিভাজ্য এবং অবিভাজ্য ধ্বনি।অবিভাজ্য ধ্বনি তথা স্বরাঘাত,শ্বাসাঘাত,যতি,দৈর্ঘ্য ইত্যাদি প্রসঙ্গের কথা ছুঁয়ে এসেছি। কেননা,এর দুবার আলোচনার মানে হয় না। তাছাড়া এর যথার্থ আলোচনা স্বনিম প্রসঙ্গেই সম্ভব। ধ্বনির মতোই স্বনিমও দুই রকম ---বিভাজ্য এবং অভিভাজ্য স্বনিম। আমরা প্রথমে বিভাজ্য স্বনিমের আলোচনা করবো। কোনো ভাষাতে স্বনিম নির্ণয়ের প্রধান পদ্ধতি হলো ন্যূনতম শব্দজোড়ের শব্দ দুটির মধ্যে অর্থের পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারে এমন ধ্বনিগুলোকে বেছে বের করা। পার্থক্য সৃষ্টির ক্ষমতাকেই বলে স্বনিমীয় বিরোধ। এই ধ্বনিগুলোই হচ্ছে আলোচ্য ভাষার স্বনিম। সেটি করতে গিয়ে দুটি সীমা মেনে চলা হয়। প্রথমত একটি ভাষার প্রত্যেক ধ্বনির সঙ্গে সেই ভাষার অন্য সব ধ্বনির স্বনিমীয় বিরোধ এরকম ন্যূনতম শব্দজোড়ের সাহায্যে প্রমাণ করবার জন্যে সুবিস্তৃত স্থান এবং অবকাশ দরকার বলে সাধারণত তা করা হয় না। যে ধ্বনিগুলো আদৌ সমোচ্চারিত নয়,যে ধ্বনিগুলোর মধ্যে উচ্চারণের দিক থেকে কোনো সাধর্ম্য নেই ---যেমন /গ/ এবং /প/ সেগুলোকে বিনা প্রমাণে পৃথক স্বনিমরূপে মোটামুটি মেনেই নেয়া হয়।শুধু যেসব ধ্বনি সমোচ্চারিত-- সেগুলোকে সন্দেহভাজন জোড়রূপে গ্রহণ করে তাদের মধ্যে অর্থপার্থক্য সৃষ্টির ক্ষমতা যাচাই করা হয়। যে সব ধ্বনির ন্যূনতম শব্দজোড় মেলেনা তাদের বেলা কাছাকাছি শব্দজোড় দিয়ে বিচার করা হয়। অথবা সাধারণত শুধু এটাই দেখা হয় যে ধ্বনি দুটি পরিপূরক অবস্থানে আছে কি না, তাদের অবস্থান শর্তাধীন কিনা। দ্বিতীয়ত শব্দের মধ্যে ধ্বনির তিন রকম অবস্থান হতে পারে: আদি মধ্য এবং অন্ত্য। দুটি ধ্বনির মধ্যে এই তিন অবস্থানেই স্বনিমীয় বিরোধ বিচার করে দেখানো যায়। যেমন: আদি মধ্য অন্ত্য স্বনিম কাল /kɐl/ পাকা /pɐkɐ/ মূক /muk/ ক /k/ খাল /khɐl / পাখা/pɐkhɐ/ মুখ /mukh/ খ /kh/
তেমনি অসমিয়াতে কাল /kɐl/ পকা / pɒkɐ/ মূক /muk/ ক /k/ খাল /khɐl/ পখা / pɒkhɐ মুখ /mukh/ খ /kh/
কিন্তু তিন অবস্থানে বিচার করবার উপযোগিতা থাকলেও অপরিহার্যতা নেই। কেবল একটি বা দুটি স্থানে স্বনিমীয় বিরোধ থাকলেই দুটি ধ্বনি স্বনিমের মর্যাদা পেতে পারে। কোনো কোনো ধ্বনি তো সব অবস্থানে বসেই না। যেমন বাংলা-অসমিয়া ঙ /ŋ/। ঙ-র আবার বাংলা অসমিয়া দুই ভাষাতেই লেখার দুই রূপ আছে। একক ব্যবহার হলে সাধারণত ং লেখা হয়। বিশেষ করে কোনো স্বরের সঙ্গে লিখতে গেলে ঙ-ই লিখতে হয়,ং নয়। কোনো ভাষাতে একবার যে ধ্বনি স্বনিম রূপে স্বীকৃত তা সেই ভাষার সবক্ষেত্রেই স্বনিম রূপে স্বীকৃত। স্বনিম হবার দু’টি শর্ত হলো ১) উচ্চারণ স্পষ্ট হতে হবে।২) দুই শব্দের মধ্যে অর্থের তফাত করবার ক্ষমতা থাকতে হবে। প্রায়-সমোচ্চারিত যে দুটি ধ্বনি নিয়ে সন্দেহভাজন জোড় সেই ধ্বনিগুলো যদি এই দুই শর্তই পূরণ করে তবে তাদের স্বতন্ত্র স্বনিমের মর্যাদা দেয়া হয়। শর্তপূরণ না করলে দেখা হবে এরা পরিপূরক অবস্থানে বসে কি না,যদি বসে তবে তাদের পূরক ধ্বনি বা বিস্বন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এবং নির্দিষ্ট ভাষাতে বেশি প্রচলিত ধ্বনিটির নামেই স্বনিমের নাম হয়। যেমন /স,শ/ দুইই বাংলাতে বিস্বন।কিন্তু স্বনিম ‘শ’-ই ---কেননা উচ্চারণে এরই ব্যবহার বেশি। কিন্তু যদি পরিপূরক অবস্থানেও বসে না অথচ একের স্থানে অন্যটি বক্তার খেয়ালখুশি অনুসারে ব্যবহৃত হলেও অর্থের কোনো হেরফের ঘটে না তখন তাদের একই স্বনিমের মুক্তবৈচিত্র্য রূপে গ্রহণ করা হয়। যেমন সিলেটি,নোয়াখালি ‘ড়,র’ অধিকাংশ সময়েই পরস্পরের বিকল্পে উচ্চারিত হয়। মোটামুটি এই নীতিগুলো অনুসরণ করে ন্যূনতম শব্দজোড়ের সাহায্যে আদর্শ চলিত বাংলার ব্যঞ্জন স্বনিমগুলো নির্ণীত হতে পারে আমরা যেভাবে দেখাচ্ছি,সেভাবে।বাংলাতে এই কাজ শুরুর দিকে করেছিলেন চার্লস ফার্গুসন,মুনীর চৌধুরী,রফিকুল ইসলাম প্রমুখ অনেকেই। ভারতে সম্ভবত রামেশ্বর শ’ই প্রথম করেন। আমরা তাঁর কাছ থেকে সব ক’টি স্বর –ব্যঞ্জন স্বনিমের নজির দিচ্ছি। স্পর্শধ্বনি ও ঘৃষ্ট ধ্বনি পাল /pɐl/ পˎ /p/ ১ ফাল /phɐl/ ফˎ/ph/ ২ বাল /bɐl/ বˎ/b/ ৩ ভাল /bɦɐl/ ভˎ/bɦ/ ৪ তান /t̪ɐn/ তˎ / t̪ / ৫ থান /t̪hɐn/ থˎ / t̪h/ ৬ দান /d̪ɐn/ দˎ /d̪/ ৭ ধান /d̪ɦɐn/ ধˎ /d̪ɦ/ ৮ টক /ʈɔk/ টˎ /ʈ/ ৯ ঠক /ʈhɔk/ ঠˎ / ʈh/ ১০ ডক/ɖɔk/ ডˎ / ɖ/ ১১ ঢক-ঢক/ɖɦɔk/ ঢˎ / ɖɦ/ ১২ চাল/t͡ʃɐl/ চˎ /t͡ʃ/ ১৩ ছাল/t͡ʃhɐl/ ছˎ /t͡ʃh/ ১৪ জাল/d͡Ʒɐl/ জˎ /d͡Ʒ / ১৫ ঝাল /d͡Ʒɦɐl/ ঝˎ /d͡Ʒɦ/ ১৬ কোল /kol/ কˎ /k/ ১৭ খোল /khol/ খˎ /kh/ ১৮ গোল /gol/ গˎ /g/ ১৯ ঘোল /gɦol/ ঘˎ/gɦ/ ২০
নাসিক্য ধ্বনি: হিম /him/ মˎ /m/ ২১ হীন /hin/ নˎ /n/ ২২ হিং /hiŋ/ ঙˎ /ŋ/ ২৩
কম্পিত এবং পার্শ্বিক ধ্বনি রাশ /rɐʃ/ রˎ /r/ ২৪ লাশ /lɐʃ/ লˎ /l/ ২৫
উষ্মধ্বনি শাল /ʃɐl/ শˎ /ʃ/ ২৬ হাল /ɦɐl/ হˎ /ɦ/ ২৭
কম্পিত তাড়িত হার /ɦɐr/ রˎ /r/ হাড় /ɦaɽ/ ড়ˎ /ɽ/ ২৮
নৈকট্য ধ্বনি/ অর্ধস্বর ছায়া /cʃhɐjɐ/ বা /cʃhɐĕɐ/ য়ˎ /j/ বা/ ě/ ২৯ ছাওয়া /cʃhɐwɐ/ বা /cʃhɐŏɐ/ ও̮য়ˎ /w/ বা /ŏ/ ৩০
দুই অর্ধস্বর সহ এই ত্রিশটি ব্যঞ্জন।অথচ এর আগে আমরা বাংলাতে চল্লিশটি ব্যঞ্জন ধ্বনির কথা জেনে এসেছি। রামেশ্বর শ’ লিখেছেন,“মোটামুটিভাবে প্রমাণ করা গেল।”২৬২ ‘মোটামুটিভাবে’-- কেননা সব ধ্বনির সঙ্গে অন্য সব ধ্বনির স্বনিমীয় বিরোধ দেখানো হয় নি। বাংলা বর্ণমালার অনেকগুলো ধ্বনি যেমন ঞ,ণ,য, অন্তস্থ-ব,ষ,স এর স্বনিম হবার দুই শর্তের কোনোটাই পূরণ করে না।ঞ-র ব্যবহার যে দুই একটি শব্দের বানানে আছে,সেখানেও উচ্চারণ আসলে নৈকট্যধ্বনির নাসিক্য উচ্চারণ। যেমন মিঞা>মিয়াঁ /miēɐ/। ণ-এর উচ্চারণ ন–এর সঙ্গে একাকার।য জ-এর সঙ্গে একাকার। ষ,স বানানে লেখা হলেও উচ্চারণে ‘শ’ই। যেমন সব,শব দুইয়ের অর্থ ভিন্ন হলেও এরা প্রথম শর্তই পূরণ করে না।উচ্চারণে দুটিই /ʃɔb/। তবে দন্ত্য ধ্বনির সঙ্গে যুক্ত থাকলে স-এর স্বতন্ত্র উচ্চারণ শোনা যায়। যেমন শীল /ʃil/ কিন্তু শ্লীল /slil/। তাই এই ধ্বনি দুটি বিস্বন বা পূরক ধ্বনি। যদিও রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশের ভাষাতে স-এর স্বতন্ত্র স্বনিমীয় মর্যাদার কথা লিখেছেন,এই নিয়ে আমরা পরে কথা বলব।২৬৩ এবারে অসমিয়া ব্যঞ্জন স্বনিমগুলোকে চেনা যাক।অসমিয়াতে অনেকেই যথেচ্ছ উদাহরণ নিয়েই কাজ করতে দেখেছি। দীপ্তি ফুকন পাটগিরি যেমন কল,খক,গুবৰুৱা ---দিয়ে ক,খ,গ এর আদ্য অবস্থানে ব্যবহার দেখিয়েছেন। বা কল,বুকু,ভোক দিয়ে ক-ধ্বনির তিন অবস্থানে ব্যবহার দেখিয়েছেন।২৬৪ এগুলো ন্যূনতম শব্দ জোড় নয়। জোড়ে যে ধ্বনি দুটিকে আলাদা দেখাতে হবে সেগুলো ছাড়া বাকি ধ্বনিগুলো হুবহু এক না হলেও কাছাকাছি থাকা চাই। গোলোকচন্দ্র গোস্বামী ন্যূনতম শব্দজোড়ের বিরোধ দেখিয়েছেন বটে,কিন্তু সেগুলোও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছাড়া আমাদের পক্ষে বোঝানো কঠিন। যেমন দ দেখাতে ‘ডাক’,ধ দেখাতে ‘ঢাক’ শব্দ দুটি তিনি ব্যবহার করেছেন। সেটি অনসমিয়া পাঠকের বোঝতে কঠিন হবার কথা। তাই আমাদের নিজস্ব শব্দজোড় বেছে নিয়ে কাজটি করতে হচ্ছে ।ভাষাটি আমাদের মাতৃভাষা নয় বলে প্রথম বন্ধনীতে দেবব্রত শর্মা সম্পাদিত ‘অসমিয়া জাতীয় অভিধান’ নির্ভর ন্যূনতম একটি বাংলা অর্থ সহ উল্লেখ করব ।
অসমিয়া স্পর্শধ্বনি পাল /pɐl/ ( যৌথ কাজে একক ব্যক্তির জন্য নির্ধারিত সময়।) পˎ /p/ ১ ফাল /phɐl/ ( দিক। যেমন উত্তর ফাল বা দিষˎ। ) ফˎ/ph/ ২ বাল /bɐl/ (বাংলার সঙ্গে একই। শিশু বা যৌনকেশ।) বˎ/b/ ৩ ভাল /bɦɐl/ (বাংলা ভালো) ভˎ/bɦ/ ৪ তান /tɐn/ (সঙ্গীতের তান) তˎ / t / ৫ থান /thɐn/ ( স্থান। পুজোর পুরোনো প্রতিষ্ঠিত স্থান। যেমন মালিনীথান। ) থˎ / th/ ৬ দান /dɐn/ ( প্রতিদান আশা না করে উপহার দেয়া। খেলার দান) দˎ /d/ ৭ ধান /dɦɐn/ ( তৃণ জাতীয় ফসল ) ধˎ /dɦ/ ৮ কোল /kol/ (মোঠো না করে রাখা ধান, কাছ, শরীরের স্নেহাশ্রয় স্থান।) কˎ /k/ ৯ খোল /khol/ (বাদ্য, বাকল ইত্যাদি) খˎ /kh/ ১০ গোল /gol/ (বৃত্তাকার ) গˎ /g/ ১১ ঘোল /gɦol/ (তরল পানীয় বিশেষ) ঘˎ/gɦ/ ১২
নাসিক্য ধ্বনি: হিম /him/ (শিশির) মˎ /m/ ১৩ হীন /hin/ (অধম) নˎ /n/ ১৪ হিং /hiŋ/ (মশলা) ঙˎ /ŋ/ ১৫
কম্পিত এবং পার্শ্বিক ধ্বনি ৰাজ /rɐz/ (রাজত্ব, জমানা) রˎ /r/ ১৬ লাজ /lɐz/ (লজ্জা) লˎ /l/ ১৭
উষ্মধ্বনি চাল/sɐl/ (বছর, খাদ্য, ঘরের আচ্ছাদ্দন, শরীরের ত্বক ইত্যাদি ) চˎ /s/ ১৮ জাল/zɐl/ ( মাছ, পাখি ধরবার ফাঁদ, খাবারের উত্তেজক স্বাদবিশেষ ।) জˎ /z/ ১৯ শাল /xɐl/ (উদ্ভিদ, মাছ বিশেষ ) শˎ /x/ ২০ হাল /ɦɐl/ (কাৎ, জোড়া, চাষের যন্ত্র) হˎ /h/ ২১
নৈকট্য ধ্বনি/ অর্ধস্বর ভয় /bɦɒj/ (আতঙ্ক, ত্রাস) য়ˎ /j/ ২২ ভৱ /bɦɒwɒ/ (জগৎ , পৃথিবী) ৱ্ /w/ / ২৩ ‘অসমীয়া জাতীয় অভিধান’ও অসমিয়া বর্ণ,যাকে আমরা ধ্বনি বা স্বনিম বলছি এই ২৩টিই চিহ্নিত করা আছে। গোলোক চন্দ্র গোস্বামী,ভীমকান্ত বরুয়া,দীপ্তিফুকন পাটগিরি প্রমুখ যারাই অসমিয়া স্বনিমের তালিকা দিয়েছেন এই ২৩টির কথাই উল্লেখ করেছেন। অথচ আমরা ৪১টি অসমিয়া ‘আখর’ তথা বর্ণের কথা পারম্পরিক ব্যাকরণে আছে বলে লিখেছি আগে। সেগুলো অবশ্যই লেখার ভাষাতে বানানে ব্যবহৃত হয়। সেগুলো কেন স্বনিম নয়,আমরা ধ্বনির শ্রেণিবিভাগ প্রসঙ্গেই আলোচনা সেরে এসেছি। এখানে শুধু এই কথাগুলো উল্লেখ করতে পারি যে শরীরের ত্বক অর্থে বাংলাতে শব্দটি ছাল,বছর অর্থে সাল। অসমিয়াতে সেভাবে লিখতে পারি। কিন্তু তাতে স্বনিম হবার প্রথম শর্তই পূরণ করবে না,অর্থাৎ উচ্চারণ পৃথক হবে না।বাংলাতে সাল এবং শাল-এর উচ্চারণ একই হতো। অসমিয়াতে কিন্তু ভিন্ন /s/ এবং /x/। আবার শ-স-ষ /x/-এর একক এবং যুগ্ম-ব্যবহারে উচ্চারণ এক নয়। যুগ্ম-উচ্চারণে ধ্বনিটি চ(স)/s/ হয়। যেমন শ্রী /sri/ বা শ্লীল /slil/। তাই এরা বিস্বন।আবার সংস্কৃত বা অন্যভাষার তালব্য,দন্ত্য বা তালুদন্ত্যমূলীয় থেকে ধ্বনিটি অসমিয়াতে এলে একক ভাবেই অসমিয়াতে উচ্চারিত হয়। চাল, ছাল বা বছর অর্থে ফারসি সাল শব্দে যেমন। তাই এরা স্বতন্ত্র স্বনিম। বিস্বন নয়। তো এহেন জটিলতা অসমিয়াতে রয়েছে। তেমনি ফাঁদ অর্থে বাংলাতেও জাল,কিন্তু স্বাদ অর্থে ঝাল।এখানেও অসমিয়াতে ধ্বনি দুটির উচ্চারণ একই ---যাল zal/। সিলেটি স্বনিমের আলোচনা আলাদা করে করেন নি জগন্নাথ চক্রবর্তী,কিংবা সুধাংশু শেখর তুঙ্গ।ফলে কাজটি আমাদেরই শুরু করতে হচ্ছে। আমরা তুলনামূলক আলোচনাতে অনেকটা ছুঁয়ে এসেছি বটে,কেননা স্বনিমের ধারণাটি অবচেতনে রেখে দুই অধ্যয়নকে স্বতন্ত্র রাখা খুবই কঠিন। সেই আলোচনাতে আমরা দেখেছি সিলেটিতে কোনটি প্রধান এবং কোনটি অপ্রধান বা গৌণ নির্ণয় করতে আমাদেরতো বটেই পূর্বতন সমস্ত তাত্ত্বিকদের জটিল সমস্যা হচ্ছিল। অনেক অসঙ্গতি এবং অন্তর্বিরোধের সমস্যা তাঁদের নজরে পড়ে নি। স্বনিম এবং বিস্বনের ধারণা স্পষ্ট করিনি বলে প্রধান অপ্রধান ধ্বনি বলে আমরা আসলে সেগুলোরই ইঙ্গিতই দিচ্ছিলাম। ন্যূনতম শব্দজোড়ের আশ্রয় নিই নি বলে সেই আলোচনা সম্পূর্ণ এবং সঠিক বলে দাবি করতে পারি না। ন্যূনতম শব্দজোড়ের আশ্রয় নিলেও যে সিলেটিতে কাজটি খুব সহজ হবে তাও নয়। নোয়াখালি চট্টগ্রামী ভাষাতে স্বনিম চিহ্নিত করবার চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্র কুমার দত্ত। তিনি সঠিকভাবেই লিখেছেন,“ ... উপভাষা দু’টিরই ধ্বনিগুলো ধর্মভেদে,সম্প্রদায়ভেদে,নারী-পুরুষভেদে এবং সর্বোপরি অঞ্চলভেদে এতো বিচিত্রভাবে উচ্চারিত হয় যে,সেইগুলোর কোনটি মূলধ্বনি আর কোনটি যে উপধ্বনি তা নির্ণয় করা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে উঠে।”২৬৫ তিনি সব ক’টি স্বনিম এবং তাদের বিস্বন নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। আমরা এত বিস্তৃতিতে যাব না।কিন্তু ‘স’ ধ্বনি নিয়ে যা কিছু লিখেছেন সিলেটি ‘স’ সম্পর্কেও কথাটা সত্য।‘শ,স,ষ’ মান বাংলার মতো ‘শ’-ই উচ্চারিত হয়। আবার ত-বর্গীয় দন্ত্য ধ্বনির সঙ্গে ‘স’ উচ্চারিত হয়। সুতরাং একে ‘শ’এর বিস্বন বলা যেতে পারে। আবার যেহেতু ‘চ,ছ’ কখনো বা ‘স’ উচ্চারিত হয় –একে তাই ‘চ,ছ’-এরও বিস্বন বলতে হয়।আবার যেহেতু শব্দের যেকোনো অবস্থানেই ধ্বনিটি বসে তাই “একে মূলধ্বনি বলেও ধরা যেতে পারে”২৬৬।এভাবে তিনি সব স্বনিম,বিস্বন,মুক্তবৈচিত্র্য চিহ্নিত করবার চেষ্টা করলেন বটে,কিন্তু ন্যূনতম শব্দজোড়ের সাহায্যে স্বনিমীয় বিরোধ দেখিয়ে সেগুলোকে আলাদা করেন নি। একটি ছকে শব্দের তিন অবস্থানেই স্বনিমগুলোর ব্যবহার দেখিয়েছেন মাত্র।২৬৭ যেমন: কলা নকল নাক খা̣জু̣র জ̣খ̣ম মুঃ́ (মুখ) গলা ছা̣গল দাকˎ(দাগ) অনেকটা এরকম। এভাবে স্বনিমীয় বিরোধ দেখানো যায় না।রামেশ্বর শ’ একটি সুন্দর নজিরে কথাটি বুঝিয়েছিলেন।“একটি ঘর থেকে একই সঙ্গে দু’টি লোক চলে গেল এবং দেখা গেল একটি কলম চুরি গেছে। এক্ষেত্রে বোঝা যাবে না কলম চুরির জন্যে কোন লোকটি দায়ী। তেমনি ‘কাম’ ও ‘খাল’ শব্দের মধ্যে অর্থের পার্থক্য হলো কিন্তু বোঝা গেল না ঠিক কোন ধ্বনিটা তার জন্যে দায়ী। কারণ শব্দ দু’টির মধ্যে দু’টি করে ধ্বনির পার্থক্য আছে।”২৬৮ রবীন্দ্র কুমার দত্ত তো দুয়ের বেশি ধ্বনিতেও তফাত রেখেছেন।‘কলা, গলা’ এবং ‘নাক, দাক’-এ যদিও বা উলম্বে ন্যূনতম শব্দজোড় হলো আনুভূমিক শব্দজোড় হলো না। বস্তুত ‘নাক, দাক’-এ এটুকুই স্পষ্ট হয় ‘ন,দ’ দুই আলাদা স্বনিম। ‘ক’ নয়। ‘গ’-এরতো কোনো প্রশ্নই নেই।তবে এই টুকুন আঁচ করা যায় ‘খ’ শব্দ শেষে লোপ পেয়ে যায়,‘গ’ > ‘ক’ হয়ে যায়।তার বদলে শব্দের তিন অবস্থানে ‘ঘ’-এর ব্যবহার দেখাতে গিয়ে শেষে তিনি যে ‘বাগ’-এর (<বাঘ ) নজির দিয়েছেন—সেটিকে ‘গ’-এর সারিতে বসালে স্বনিমটিকে আলাদা করা যেতো। আসলে তিনি যে সমস্যাতে পড়েছেন বলে আমাদের মনে হয়েছে বিস্বনগুলোর থেকে কোনটি স্বনিম হবে তা নিশ্চিত নির্ণয় করা কঠিন বলে বিস্বন তথা মুক্তবৈচিত্র্যগুলোকেও চিহ্নিত করবার চেষ্টা করছেন। যে কাজটি এইভাবে পুরো করা প্রায় অসম্ভব।কারণ,একই ভাষাবৈচিত্র্যের মধ্যে ব্যক্তি স্থান-কাল-শ্রেণি-বর্ণ-সম্প্রদায় বিশেষে স্বতন্ত্র উচ্চারণ করে এই কথাগুলোতো তিনি নিজেই লিখেছেন। সে সবকে চিহ্নিত করতে আলাদা করে অন্য উপায় নিতে হবে।স্বনিমের স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্যগুলোকেও স্পষ্ট চিহ্নিত করতে হবে। যে কাজটির সূচনা করেছিলেন নিকোলাই ত্রুবৎস্কয়,পরে একে সমৃদ্ধ করেছিলেন রোমান য়াকপসন।বাংলাতে তাঁদের সূত্রগুলো প্রথমে প্রয়োগ করেছিলেন চার্লস এ ফার্গুসন এবং মুনীর চৌধুরী। ভারতে বাংলাতে রামেশ্বর শ’২৬৯ । ফলে আমাদের সামনেও সিলেটি স্বনিম চিহ্নিত করবার কোনো আদর্শ নেই। আমরাও সেই বিস্তৃত পথে যাচ্ছি না। শুধু এইটুকু স্পষ্ট করতে পারি যে ---যতভাবেই একটি ধ্বনি উচ্চারিত হোক,সবই তার বিস্বন। যেমন আমরা লিখে এসেছি,মান বাংলাতে ‘শ,স’ দুইই বিস্বন।তার মধ্যে যেটি বেশি উচ্চারিত হয় সেটির নামেই স্বনিম চিহ্নিত হয়। আবার অসমিয়া,সিলেটি,নোয়াখালি,চট্টগ্রামীতে যেহেতু ‘চ,ছ’ প্রায়ই ‘স’ উচ্চারিত হয় তাই সেটি এক স্বতন্ত্র স্বনিম। যেমনটি রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশের বহু ভাষা-বৈচিত্র্য সম্পর্কে দাবি করেছেন।‘চ’ না হলেও ‘ছ’ যদিবা কখনো মূলবৎ উচ্চারিত হয় তবে অবশ্যই সেটি বিস্বন।যথার্থ কোন ধ্বনির নামে স্বনিমের নাম হবে সেটি নির্ধারণ করতে গেলে ব্যাপক পারিসাংখ্যিক সমীক্ষাও চাই। ফলে আমাদেরও কাজটি হবে মোটাদাগের। বিস্বনের বিস্তৃত পরিচিতি প্রসঙ্গ আমরা ছেড়ে যাবো। কিন্তু তাতে আশা করছি মান বাংলা এবং অসমিয়ার সঙ্গে সিলেটির সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য অনেকটাই স্পষ্ট হবে।যেভাবে ‘ক,খ’ স্বনিম চিহ্নিত করতে তিন অবস্থানে তাদের ব্যবহার দেখানো হয়েছিল মান বাংলাতে,সিলেটিতে সেগুলো দেখাতেও আমাদের সমস্যা হবে। আদি মধ্য অন্ত্য স্বনিম কাল /kɐl/ পাকা /pɐkɐ/ মূক /muk/ ক /k/ খাল /khɐl / পাখা/pɐkhɐ/ মুখ /mukh/ খ /kh/ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় কিংবা সুধাংশু শেখর তুঙ্গের অভিমত স্বীকার করে নিলে সিলেটিতে শব্দগুলো ন্যূনতম শব্দজোড়ই নয়। অর্থ যদিও ভিন্ন,উচ্চারণে ‘ক,খ’ দুইই /x/। কিন্তু আমরা শব্দগুলোকে সাজাতে পারি এইভাবে। ʔকাল /ʔkɐl/ ʔপাকা /ʔpɐʔkɐ/ /ʔk/ ʔখাল /ʔkhɐl/ ʔপাখা /ʔpɐʔkhɐ / /ʔkh / ‘মূক’ শব্দটি সিলেটিতে নেই,উলটে ‘মুখ’ উচ্চারিত হয়/muk/।সুতরাং উলম্ব কিংবা আনুভূমিক কোনো শব্দজোড়েই এদের বসানো যাবে না।মুখের সঙ্গে ন্যূনতম শব্দজোড় হতে পারে বুক /buk/,অন্যদিকে দেখ /d̪ex/-এর সঙ্গে পেক /ʔpex/।তার মানে জটিলতাটি অনেকটাই বৃত্তাকার। শব্দের শেষে /k,x/ দুটোই /ʔk,ʔkh /-এর বিস্বন। শর্ত হচ্ছে উচ্চস্বরের পরে /k/,নিম্নতর স্বরের পরে /x/। বস্তুত উচ্চস্বরের সঙ্গে শব্দের আদিতে,মাঝে এবং কিছু যুক্তাক্ষরে মান বাংলার মতোই ‘ক,খ’ /k, kh/ উচ্চারিত হয় আমরা ধ্বনি প্রসঙ্গে দেখিয়ে এসেছি।নিচের সারণীতেও দেখা যাবে।
সিলেটি স্পর্শধ্বনি ও ঘৃষ্ট ধ্বনি ʔপাল̖ /pɐl/ (উপাধি, ঝাঁক, নৌকার পাল) ʔপˎ /ʔp/ ১ বাল̖ /bɐl/ (যৌন কেশ) বˎ /b/ ২ বা’ল̖ / ɓɐl/ (ভালো) ব’ / ɓ / ৩ তান̖ /t̪ɐn/ (তাঁর, সঙ্গীতের তান) তˎ / t̪ / ৪ থান̖ /t̪hɐn/ ( স্থান, পাড় বিহীন এক রঙের কাপড়) থˎ / t̪h/ ৫ দান̖ /d̪ɐn/ (স্বত্ব ত্যাগ করে দেয়া) দˎ /d̪/ ৬ দা’ন̖ / ɗɐn/ (ফসল) দ’ˎ / ɗ / ৭ টালি /ʈɐli/ ( ঘরের চালের আচ্ছাদন, ডুলি, জুঙ্গি) টˎ /ʈ/ ৮ ঠালি /ʈhɐli/(নারকেলের খোলা, পিঠা তৈরির হাঁড়ি) ঠˎ / ʈh/ ৯ ডাল̖ /ɖɐl/ (গাছের ডাল) ডˎ / ɖ/ ১০ ডা’ল̖ / ᶑɐl/ ( বর্ম, ক্রিয়াপদ ঢাল) ড’̖ / ᶑ / ১১ ʔচালˎ/ʔt͡sɐl/ ( ঘরের চাল, চাতুরি) ʔচˎ /ʔt͡s/ ১২ জা̣’লˎ /d͡zɐl/ (লঙ্কার স্বাদ) জ’̣ˎ /d͡z/ ১৩ ʔকালˎ /ʔkɐl/ (সময়) ʔকˎ /ʔk/ ১৪ ʔখালˎ /ʔkhɐl/ ( বড় নালা) ʔখˎ /ʔkh / ১৫ গাছˎ /gɐs/ (বৃক্ষ) গˎ /g/ ১৬ গা’সˎ /ɠɐs / (তৃণ) গ’ˎ/ ɠ / ১৭
নাসিক্য ধ্বনি: হুমা /ɦumɐ/ (গোঁয়ার) মˎ /m/ ১৮ হুনা /ɦunɐ/ (কানে শোনা) নˎ /n/ ১৯ হুঙা /ɦuŋɐ/ (নাকে নাক লাগিয়ে সোহাগ, ঘ্রাণ নেয়া) ঙˎ /ŋ/ ২০
কম্পিত এবং পার্শ্বিক ধ্বনি রামˎ /rɐm/ (ব্যক্তিনাম, বড়) রˎ /r/ ২১ লামˎ /lɐm/ (নিচে নামা) লˎ /l/ ২২
উষ্মধ্বনি ফা̣ল̖ /fɐl/ (লাঙ্গলের ডগার লোহার ফলক, লাফ) ফ̣ˎ /f/ ২৩ ছালˎ/sɐl/ (ত্বক, চামড়া) ছˎ /s/ ২৪ জা̣লˎ/zɐl/ (ফাঁদ) জ̣ˎ /z/ ২৫ শাদা /ʃɐd̪ɐ/ (< ফা. সাদাহˎ, তামাক জাতীয় খাদ্য) শˎ /ʃ/ ২৬ হাদা /ɦɐd̪a/ (সাধা, ইচ্ছে জানানো) হˎ /h/ ২৭
কম্পিত তাড়িত কুরা / kurɐ/ ( মাটি খোঁড়া বা সেরকম কাজের যন্ত্রের বাঁট) রˎ /r/ কুড়া /kuɽɐ/ ( কর্ষণ, খনন, খোঁড়া) ড়ˎ /ɽ/ ২৮
নৈকট্য ধ্বনি/ অর্ধস্বর ছায়া /sɐĕɐ/ (বাং. ছায়া, আলো রোধী অবস্থা) য়ˎ ě/ ২৯ ছাওয়া /sɐŏɐ/ (আচ্ছাদন) ও̮য়ˎ /ŏ/ ৩০ দেখা যাচ্ছে,সিলেটি ধ্বনির সংখ্যাও মান বাংলার মতো ত্রিশটিই। আরো সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে হয়তো সংখ্যাটা বাড়তে পারে। জন্মজিৎ রায় লিখেছিলেন,“সিলেটিতে উচ্চারিত ব্যঞ্জন ধ্বনির মোট সংখ্যা ৩২ (২৪+৮) ধরা হয়।”২৭০অন্যদিকে অসমিয়া ব্যঞ্জন স্বনিমের সংখ্যা কিন্তু ২৩। নোয়াখালি,চট্টগ্রামীতেও সুনির্দিষ্ট করে সংখ্যাটি বলবার মতো অবস্থাতে নেই কেন,ইতিমধ্যে লিখেছি।এই দুই ভাষাবৈচিত্র্যের ধ্বনিগুলো সম্পর্কে একটি ধারণা চিত্র ৮-ক,খ এবং ৯ –ক,খ-তে দেখা যেতে পারে।তবে যেহেতু প্রাক শক্ততালব্য,তালুদন্ত্যমূলীয় এবং তাড়িত ধ্বনি রয়েছে সংখ্যাটি সিলেটির থেকে কম হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। স্বরস্বনিম বাংলা স্বরস্বনিমগুলো এভাবে চিহ্নিত করেছেন রামেশ্বর শ’ খিল / khil/ ই / i/ ১ খেল/khel/ এ/ e/ ২ খ্যাল /khæl/ অ্যা / æ/ ৩ খাল /khɐl/ আ / ɐ/ ৪ খল /khɔl/ অ /ɔ/ ৫ খোল /khol/ ও /o/ ৬ খুল /khul / উ /u/ ৭ এই সাতটিই বাংলা স্বনিম। অথচ এর আগে আমরা বাংলা বর্ণমালাতে বারোটি স্বরের কথা লিখে এসেছি। স্বরধ্বনীর দৈর্ঘ্য বাংলাতে স্বনিমীয় বিরোধ তৈরি করে না বলে বর্ণমালার ‘ঈ,ঊ’ এখানে নেই। অন্যদিকে বাংলা স্বনিম /অ্যা/ বর্ণমালাতে নেই। ঋ,৯- এই অর্ধব্যঞ্জন দুটির উচ্চারণ আসলে ‘রি,লি’।তার উপরে ৯-এর ব্যবহার বাংলা বানানেও নেই। যৌগিক স্বর ‘ঐ,ঔ’ আসলে দুই স্বরের মিশ্রণে তৈরি যৌগিক স্বর/ɔi,ɔu/। বাংলা বর্ণমালাতে এই দুটোই থাকলেও উচ্চারণ বিচারে আছে আসলে পঁচিশটি ।২৭১ তবে বাংলাতে অনুনাসিকতার স্বনিমীয় গুরুত্ব আছে। সব ক’টা মৌখিক স্বরধ্বনির সঙ্গে অনুনাসিক স্বরধ্বনির স্বনিমীয় বিরোধ আছে। যেমন বিধি /bidɦi/ নিয়তি ই / i/ বিঁধি /bĩdɦi/ ফুটিয়ে দিই ইঁ /ĩ/ এমন সাতটি স্বনিমেরই অনুনাসিক রূপ পাওয়া যাবে। সেগুলো ধরলে বাংলা স্বরস্বনিমের সংখ্যা দাঁড়ায় চৌদ্দ। সব মিলিয়ে বাংলা স্বনিমের সংখ্যা চুয়াল্লিশ। অসমিয়া স্বরস্বনিমগুলো নিয়ে ধ্বনি প্রসঙ্গেই আমরা অনেকটা আলোচনা করেছি। শব্দজোড় গুলো আমরা গোলোক চন্দ্র গোস্বামীর থেকে নিয়ে নিজেদের মতো করেই সাজিয়ে দিলাম।২৭২শব্দার্থ যথারীতি ‘অসমীয়া জাতীয় অভিধান’ থেকে নেয়া। বিচ / bis/ (সংখ্যা বিশ, কুড়ি, হাতপাখাতে বাতাস কর̖ ।) ই / i/ ১ বেছ /bes/ (চমৎকার । ) এ’ /e/ ২ বেচ /bɛs/ (বিক্রি করে ফেল̖, ভাতা ।) এ /ɛ/ ৩ বাচ /bɐs/ (পরিবহন বাস, বেঁচে থাক̖।) আ /ɐ/ ৪ বল /bɒl/ (শক্তি) অ /ɒ/ ৫ ব’ল /bɔl/ (চলো যাই,) অ’ /ɔ/ ৬ বোল /bol/ (কথা,আমের কলি।) ও /o/ ৭ বুল /bul / ( কামরূপী চল̖ ) উ /u/ ৮
এই আটটিই অসমিয়া স্বনিম।অথচ এর আগে আমরা অসমিয়া বর্ণমালাতে এগারোটি স্বরের কথা লিখে এসেছি। স্বরধ্বনীর দৈর্ঘ্য অসমিয়াতেও স্বনিমীয় বিরোধ তৈরি করে না বলে বর্ণমালার ‘ঈ,ঊ’ এখানে নেই।অন্যদিকে অসমিয়া স্বনিম এ’,অ’/e,ɔ/ বর্ণমালাতে নেই।ঋ,৯-এই অর্ধব্যঞ্জন দুটির উচ্চারণ অসমিয়াতেও ‘রি,লি’।তার উপরে ৯- অসমিয়া স্কুলপাঠ্য বর্ণমালার বই থেকেও বাদ গেছেই। যৌগিক স্বর ‘ঐ,ঔ’ অসমিয়াতেও দুই স্বরের মিশ্রণে তৈরি যৌগিক স্বর /ɔi,ɔu/।অসমিয়া বর্ণমালাতেও সংস্কৃতের অনুসরণে এই দুটোই থাকলেও উচ্চারণ বিচারে আছে বাইশটির বেশি।২৭৩অসমিয়াতেও অনুনাসিকতার স্বনিমীয় গুরুত্ব আছে। শুধু এঁ’,অঁ’/e͂,ɔ͂/ধ্বনি বিরল,বাকি সব ক’টা মৌখিক স্বরধ্বনির সঙ্গে অনুনাসিক স্বরধ্বনির স্বনিমীয় বিরোধ সহজেই নজরে আসে।এমনকি শব্দে একটি অনুনাসিক ধ্বনি থাকলেই পাশের স্বরগুলোও বহু সময় অনুনাসিক হয়ে পড়াতে লেখার বেলা অনেকেই সিহঁত না সিঁহত,গোঁহাই না গোহাঁই লিখবেন সমস্যাতে পড়ে যান। গোলকচন্দ্র তাই অসমিয়া অনুনাসিক স্বরের লঘু গুরু দুই প্রকারের কথা লিখেছেন।২৭৪লঘু অনুনাসিক স্বরের উচ্চারণ অসমিয়াতে স্বাভাবিক বলে চিহ্ন দিয়ে এদের বোঝানো হয় না। গুরু অনুনাসিক স্বরে হয়। চা /sɐ/ তাকিয়ে দেখ, পানীয় বিশেষ আ / ɐ/ ছাঁ /sɐ͂/ ছায়া আঁ /ɐ͂/ এমন আটটি স্বর-স্বনিমেরই অনুনাসিক রূপ পাওয়া যাবে।সেগুলো ধরলে অসমিয়া স্বরস্বনিমের সংখ্যা দাঁড়ায় ষোল। সব মিলিয়ে অসমিয়া স্বনিমের সংখ্যা ৩৯ মাত্র। সিলেটি স্বরধ্বনি প্রসঙ্গে আমরা অনেকটাই স্বনিম চিহ্নিত করে এসেছি। এদের এবারে ন্যূনতম শব্দজোড়ে চেনা যেতে পারে এইভাবে: বীর / bir/ ( বীর।) ই / i/ ১ বের /ber/ ( বেষ্টন, বেড়) এ / e/ ২ বারা /bɐrɐ/ ( বাইরে যাও ।) আ / ɐ/ ৩ বরা /bɔrɐ/ ( স্বীকার করা, বড়া ) অ /ɔ/ ৪ বুরা /burɐ/ (মন্দ, বা’লা বুরা) উ /u/ ৫
এই পাঁচটিই সিলেটি স্বনিম।‘ও,এ’ ’ /ɛ,o/ ধ্বনিদুটি যদিও বহুল ব্যবহৃত আমরা ধ্বনি প্রসঙ্গে দেখিয়ে এসেছি,কীভাবে প্রথমটি প্রায়ই ‘উ,অ’/u,ɔ/ এবং দ্বিতীয়টি ‘এ’/e/-র বিকল্পে ব্যবহৃত হয়। সুধাংশু শেখর তুঙ্গ প্রথমটি এবং জগন্নাথ চক্রবর্তী দ্বিতীয়টি সিলেটিতে নেই বলে লিখেছেন। তাঁরা দু’জনেই আংশিক সত্য। আসলে ধ্বনি হিসেবে দুটোরই ব্যবহার সিলেটিতে আছে। সেদিক থেকে তাঁরা ভুল। কিন্তু ‘উ,অ’ এবং ‘এ’ ধ্বনির মুক্ত বৈচিত্র্য হিসেবেই ধ্বনি দুটি উচ্চারিত হয়। সেদিক থেকে তাঁরা দু’জনেই সঠিক,এদের স্বতন্ত্র স্বনিমের মর্যাদা দেয়া যাবে না।আমরা যে দুই অভিধানের কথা উল্লেখ করে এসেছি,‘বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান ও ভাষাতত্ত্ব’ এবং ‘ বরাক উপত্যকার কথ্যবাংলার অভিধান’ এই দুইটিতেই বুরা/বোরা,বেরা/ব্যারা— এমন সমস্ত শব্দ এইভাবেই রয়েছে। এবং ও-এর স্তম্ভে শব্দ বেশি নেই। আর প্রতিটি ব্যঞ্জনের স্তম্ভে এ-কারের পরে আর শব্দের উল্লেখ নেই বললেই চলে।সিলেটি নাগরিতেও কিন্তু স্বরধ্বনি হুবহু ইংরেজির মতো পাঁচটিই।কিন্তু ইংরেজি স্বরস্বনিমের সংখ্যা অনেক বেশি,স্বরের দৈর্ঘ্য সেই ভাষাতে স্বনিমীয় বিরোধ তৈরি করে। আবার ইংরেজির মতোই স্বরের অনুনাসিকতা সিলেটিতে কোনো স্বনিমীয় বিরোধ তৈরি করে না। সুধাংশু শেখর তুঙ্গ এই প্রশ্নেও একটি আংশিক সত্য মন্তব্য করেছেন,পূর্ববঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্যগুলো, “None of them allows nasalization except only in Chittagong and Noakhali dialects have a preponderance of nasalization and also Maumenshing and Rangpur where nasalisation occurs on some occasions”২৭৫।একেও আংশিক সত্য বলছি কেন না,স্বরের অনুনাসিক উচ্চারণ সিলেটিতে আছে। কিন্তু সেরকম না করলেও অর্থের কোনো হেরফের হয় না।‘চাঁপা’/ʔt͡sɐ̃ʔpɐ/,কিংবা ‘চাপা’/ʔt͡sɐʔpɐ/ -- দুইভাবেই উচ্চারণ সম্ভব।অনানুনাসিক উচ্চারণেও অর্থ সেই একি--চাঁপা ফুল এবং চাপা দেয়া।কাঁচি/ʔkãʔt͡si/ কিংবা কাচি/ʔkaʔt͡si/ উচ্চারণে দুটোই আছে--- অনানুনাসিক উচ্চারণেও অর্থ কাস্তে,জল মুছে বা সেচে শুকিয়ে ফেলি ইত্যাদি।অর্থাৎ অনুনাসিক স্বরকেও সিলেটিতে মুক্ত বৈচিত্র্য বলতে পারি। জগন্নাথ চক্রবর্তী তাঁর অভিধানে অনুনাসিক ধ্বনির অনুপস্থিতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন এই লিখে,“এই আঞ্চলিক ভাষায় চন্দ্রবিন্দুর (ঁ) নাকা উচ্চারণ মূলত নেই;যা আছে তা ন,ম—এই নাসিক্য ধ্বনিতেই কুলিয়ে যায় তাই (ঁ) পরিহার করা হলো।”২৭৬ আবিদ রাজা মজুমদার এই নিয়ে কিচ্ছুই লেখেন নি,তাঁর অভিধানেও অনুনাসিক ধ্বনি সহ কোনো শব্দ নেই।‘ন,ম’ নাসিক্য ধ্বনিতে ‘কুলিয়ে যাবা’র যে বিষয়টি জগন্নাথ লিখেছেন,এর ব্যাখ্যা এরকম যে অধিকাংশ সময় মূলের নাসিক্যধ্বনিটি লোপ না পেয়েই সিলেটিতে থাকে,যেমন চান <চন্দ্র> চাঁদ।বান্দ’,বান (মারা) <বান্ধ> বাঁধ।কিন্তু বহুসময় লোপ পেয়ে পূর্বস্বরের ঊর্ধ্বায়ণ ঘটায়।পঙ্ক,বঙ্কিম > হয় পেক,বেকা। ঊর্ধ্বায়িত স্বরটি এ অথবা এ’ হবে,অনুনাসিক স্বর থাকবে কি থাকবে না-- এই নিয়ে এক বিভ্রান্তিও কাজ করে। সেক্ষেত্রে শব্দগুলো প্যেঁক,ব্যেঁকা/pɛ̃x,bɛ̃ʔkɐ/ এমনও উচ্চারিত হয়। যাই হোক না কেন, তাতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে এগুলো সিলেটিতে মুক্তবৈচিত্র্য।স্বনিম নয়। স্বনিম স্বর-ব্যঞ্জন মিলিয়ে তাহলে সিলেটিতে দাঁড়াচ্ছে ৩০+৫= ৩৫টি। নোয়াখালি এবং চট্টগ্রামী স্বনিম সম্পর্কে আলাদা আলোচনা করবার সমস্যা আমাদের ব্যঞ্জন স্বনিমের মতো একই। রবীন্দ্র কুমার দত্ত ন’টি স্বরধ্বনির কথা লিখেছেন,সেগুলোকেই স্বরস্বনিম রূপে দেখিয়েছেন।২৭৭এবং ন্যূনতম শব্দজোড়ে পরীক্ষা না করলেও দুই ভাষা বৈচিত্র্যেই শব্দের তিন অবস্থানে অনুনাসিক স্বরের ব্যবহার দেখিয়েছেন। তাই যদি হয়, তবে মোট স্বরের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ১৮। ভাষাবিজ্ঞানের এই মৌলিক সিদ্ধান্তটি কিন্তু রবীন্দ্র কুমার দত্তও জানেন,স্বনিম মাত্রেই পরম্পরাগত ব্যাকরণের ধ্বনি বটে,কিন্তু পরম্পরাগত ব্যাকরণের ধ্বনি,যাদের লেখার বর্ণ হিসেবে আমরা জেনে এসেছি,সেই সব ধ্বনিমাত্রেই স্বনিম নয়।
।। অবিভাজ্য স্বনিম ।। এই অব্দি বিভাজ্য স্বনিমের কথা আলোচিত হলো। এবারে অবিভাজ্য স্বনিমের প্রসঙ্গ। অবিভাজ্য ধ্বনি কিংবা স্বনিম পাঁচ রকমের।১) শ্বাসাঘাত,২) স্বরাঘাত (সুরাঘাত), ৩) যতি,৪) দৈর্ঘ্য, ৫) নাসিক্যীভবন। কথা বলবার সময় আমরা বাক্যের সব শব্দে বা শব্দের সব ধ্বনিতে সমান গুরুত্ব দিই না। যেটিকে গুরুত্ব দিই সেটি বেশ জোরের সঙ্গেই উচ্চারণ করি।দুইভাবে এই জোরটা দিয়ে থাকি। এরই প্রথম প্রকারটির নাম শ্বাসাঘাত,দ্বিতীয় প্রকারের নাম স্বরাঘাত। যখন গলার পেশীকে শক্ত করে বেশি পরিমাণে শ্বাসবায়ু বের করে আওয়াজ খানিকটা বাড়িয়ে উচ্চারণ করি তখন তাকে বলে শ্বাসাঘাত।আর যখন স্বরতন্ত্রী দুটির কম্পনের দ্রুতি বাড়িয়ে স্বরকে তীব্র করে তুলি তখন তাকে বলে স্বরাঘাত। শ্বাসাঘাতে আওয়াজের জোর বাড়ে,স্বরাঘাতে সুরের তীব্রতা বাড়ে। ১) শ্বাসাঘাতঃ শ্বাসাঘাত দুই রকম শব্দ শ্বাসাঘাত এবং বাক্য শ্বাসাঘাত। নামেই স্পষ্ট,শব্দের কোনো ধ্বনির উপরে জোর পড়লে এবং এর ক্রিয়া বাক্য ব্যবহৃত হবার পরেও সেই শব্দেই সীমাবদ্ধ থাকলে তাকে শব্দ শ্বাসাঘাত বলে। পুরো শব্দে কখনোই জোরটা পড়ে না।কিন্তু ধ্বনিমাত্রের উপরে জোরটা পড়েও যখন এর ক্রিয়া সেই শব্দকে ছাড়িয়ে বাক্যে ছড়িয়ে পড়ে তখন মনে হয় যেন পুরো শব্দেই জোর পড়ল। এবং সেই শ্বাসাঘাতকে বাক্য শ্বাসাঘাত বলে। জোরের মাত্রা ভেদ অনুসারে শব্দ শ্বাসাঘাত তিনরকমের হয়। যে ধ্বনিতে যে প্রকারের শ্বাসাঘাত পড়ল তাকে চিহ্নিত করবারও তিনটি উপায় আছে। দাড়ির মতো চিহ্ন ধ্বনিটির আগে বসিয়ে বোঝানো হয়। সেগুলো এরকম: ১) প্রবল বা মুখ্য শ্বাসাঘাত = [ । ] ২) মধ্যম বা গৌণ শ্বাসাঘাত= [ । ] ৩) দুর্বল বা ক্ষীণ শ্বাসাঘাত= [ -- ] ইংরেজিতে শ্বাসাঘাত পাল্টালে শব্দের মানে পালটে যায়। যেমন ।in--sult / । in--sʌlt / মানে,অপমান (বিশেষ্য); কিন্তু –in।sult / --in।sʌlt/ মানে, অপমান করা (ক্রিয়া)। বাংলাতে এমনটা হয় না। শব্দে শ্বাসাঘাত পড়ে ঠিক, কিন্তু শব্দের অর্থ পালটে দেয় না।বাংলা ভাষাতে শ্বাসাঘাতের স্থান শব্দের ভেতরে সুনির্দিষ্ট।এক অক্ষরের শব্দে শ্বাসাঘাত শব্দের সীমা ছাড়িয়ে বাক্যে প্রভাব ফেলে বলে এটি বাক্য শ্বাসাঘাতে আলোচনার বিষয়। দুই অক্ষরের শব্দে যদি স্বর-ব্যঞ্জন স্বনিম বা ধ্বনিগুলো পরপর এই ক্রমে থাকে vcv,cvcv,vcvc,cvcvc --যেমন আছে/ɐ।t͡ʃhe/,রাজা/rɐ।d͡Ʒɐ/,আকাশ /ɐ।kaʃ/,কমল/kɔ।mol/ ইত্যাদিতে --- তবে দ্বিতীয় অক্ষরে শ্বাসাঘাত পড়ে।২৭৮ সামান্য লক্ষ করলেই দেখা যাবে এই সব শব্দে আসলে প্রথমাক্ষরটি স্বরান্ত।প্রথম অক্ষরটি যদি ব্যঞ্জনান্ত হয় তবে শ্বাসাঘাত পড়ে প্রথম অক্ষরেই। যেমন চঞ্চল/।t͡ʃɔnt͡ʃol/,উৎসব/।ut̪ʃɔb/,বস্তি/।bɔst̪i/ ইত্যাদি।তিন অক্ষরের শব্দেও একই নিয়ম। প্রথমাক্ষর স্বরান্ত হলে দ্বিতীয় অক্ষরেই শ্বাসাঘাত পড়ে। যেমন অবলা/ɔ।bolɐ/,নিরীক্ষক/ni।rikkhɔk/,আহাম্মক /ɐ।hammɔk/। বিভিন্ন গঠনের শব্দে শ্বাসাঘাতের অবস্থান বাংলাতে এরকম সুনির্দিষ্ট।এই অবস্থান পাল্টাতে পারে শুধু যখন শব্দটি বাক্যে ব্যবহৃত হয়, তখন যে অর্থের বদল ঘটে সেটি শব্দটি নয় পুরো বাক্যের অর্থকেই প্রভাবিত করে। কিন্তু বাংলা এবং অসমিয়া ভাষাতে শ্বাসাঘাতের ব্যবহার এক নয়। এই নিয়ে সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ও সচেতন ছিলেন২৭৯।শ্বাসাঘাত সম্পর্কে গোলোকচন্দ্র গোস্বামীর দুটি কথা গুরুত্বপূর্ণ। ১) শ্বাসাঘাত বহন করে প্রবাহী ধ্বনিই।প্রবাহী ধ্বনিগুলোর মধ্যে আবার স্বরধ্বনিগুলোর শ্বাসাঘাত বহনের ক্ষমতা বেশি২৮০। ২) অসমিয়া ভাষাতে শাব্দিক শ্বাসাঘাত দুই রকম-- গুরু (প্রবল বা মুখ্য) এবং লঘু (মধ্যম বা গৌণ)। যদিও এর পরে তিনি লঘু শ্বাসাঘাতের আরো বহু মাত্রাবৈচিত্র্যের উল্লেখ করে শব্দ ভেবে উচ্চারণ স্থান নির্ণয়ের বিস্তৃত আয়োজন করেছেন। এর মধ্যে প্রথমটি যেহেতু সাধারণ ভাষাবৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত বাংলার সম্পর্কেও সেটি প্রযোজ্য কিনা আমাদের ভাবায়। তিনিও কিন্তু এর পরে ধ্বনি নয়, অক্ষরগুলোতেই শ্বাসাঘাত কোন অবস্থানে পড়ে সেই বিচার করেছেন,এমন কি মুক্তাক্ষর (মুক্তদল),বদ্ধাক্ষরে (বদ্ধদল) স্বনিমীয় বিরোধের বিচার করেছেন। সেখানে প্রথম সিদ্ধান্তটি কতটা দরকারি আমাদের প্রশ্ন। অক্ষরমাত্রেই তো স্বরকেন্দ্রিক। স্বর বাদ দিয়ে বাকি প্রবাহী ধ্বনিতে কোনো অক্ষর গড়ে উঠে না। সুতরাং স্বরের শ্বাসাঘাত বহন ক্ষমতা বেশি কি কম বিচার বাহুল্য বলেই আমাদের মনে হয়েছে। স্বরান্ত-হলন্ত (মুক্তদল-বদ্ধদল) অক্ষরের বিভাজন বিচারই যথেষ্ট।তিনি আরো লিখেছেন,অসমিয়াতে,“ ...এই দুয়ো প্রকারর শ্বাসাঘাত বিশিষ্ট ধ্বনিগুণ অর্থাৎ লয়বর্ণ (prosodies) বুলি স্বীকৃত হৈছে।”২৮১ ‘লয় বর্ণ’ কেন না শ্বাসাঘাতে স্বরের মাত্রা বা উচ্চারণ সময় দীর্ঘ হয়।‘শ্বাসাঘাত যুক্ত ভাষা’ বলছেন ইংরেজিকে,‘শ্বাসাঘাতহীন ভাষা’ বলছেন কামরূপী উপভাষা’কে,মান অসমিয়াকে নয়।২৮২ স্বরান্ত এবং ব্যঞ্জনান্ত অক্ষর যুক্ত প্রায় সমোচ্চারিত একাধিক শব্দে তিনি শ্বাসাঘাত পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন,‘ ।বাৰ,।তেৰ,।পিছে,।নিছিলা’ শব্দে প্রথম মুক্ত-অক্ষরেই গুরু শ্বাসাঘাত পড়লেও ‘পা।ৰ,টে।ৰা,পি।চে, নি।চিনা’ শব্দে পড়েছে দ্বিতীয় অক্ষরে। আবার ‘।কাণ্ড,।পিণ্ড,।চিন্তে,।বান্ধ’ ইত্যাদি শব্দের প্রথম বদ্ধ দল বা অক্ষরে শ্বাসাঘাত পড়লেও,‘কা।ন্দ,পি।ন্ধ,পি।ন্ধে,বা।ন্ধ’ ইত্যাদি শব্দে গুরু শ্বাসাঘাত পড়েছে দ্বিতীয় অক্ষরে২৮৩।অর্থাৎ প্রথম না দ্বিতীয় অক্ষর ঠিক কোথায় শ্বাসাঘাত পড়বে সেটি সূত্রায়িত করা কঠিন। কিন্তু শ্বাসাঘাত জায়গা বদল করলে সমোচ্চারিত শব্দেরও অর্থ পালটে যাচ্ছে। যেমন ।কাণ্ড/। kɐndɔ/(কাজ),কান্দ /kɐn।dɔ/( কাঁদো)। তবে গুরু শ্বাসাঘাত প্রথম বা দ্বিতীয় অক্ষরেই পড়ে।একই শব্দে একাধিক অক্ষরে গুরু বা প্রবল শ্বাসাঘাত পড়ে না।বাকি অক্ষরে লঘুমাত্রার বিভিন্ন বৈচিত্র্য শোনা যায়। গোলোকচন্দ্র সেগুলোও বেশ বিস্তৃত বিশ্লেষণ করেছেন। সেগুলোর স্থান নির্দিষ্ট,স্বনিমীয় তাৎপর্য বিহীন। জগন্নাথ চক্রবর্তী এত জটিল পরীক্ষাতে যান নি,না গিয়েই মন্তব্য করেছেন,“বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা ভাষায় শ্বাসাঘাতের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে।এখানে বহু শব্দের অর্থ শ্বাসাঘাতের উপস্থিতি ও অবস্থানের উপর নির্ভর করে।”২৮৪ তিনি বিভাজিত স্বনিমের পরীক্ষা ন্যূনতম শব্দজোড়ে না করে কী সব সমস্যাতে পড়েছিলেন,সেসব আমরা দেখিয়েছি। হাত>ʔআত তাঁর কাছে মনে হয়েছে ‘স্বরায়নে’র নিদর্শন।অথচ,শ্বাসাঘাতের আলোচনাতে তিনি ন্যূনতম শব্দজোড়ের আশ্রয় নিয়েছেন, কিন্তু বাক্য শ্বাসাঘাত নিয়ে নীরব। নিখিলেশ পুরকাইত বা জন্মজিৎ রায় এই নিয়ে কিছু লেখেন নি। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ওডিবিএল-এ এই লিখে ছেড়ে দিয়েছিলেন,“All Bengali dialects,however, cannot be said to possesess a uniform system of stressing: the accent habits of the various dialectical areas have not been studied, and only some general remarks can be made about the Standard Colloquial Speech.” ২৮৫ সম্ভবত এই সুযোগে জগন্নাথ চক্রবর্তী সিলেটিতে শব্দ-শ্বাসাঘাত অর্থ বদল করে বলে দেখিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তারপরে ভাষা বিজ্ঞান বহু এগিয়েছে। মান বাংলা সম্পর্কেও আমরা দেখিয়ে এলাম, সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের আদ্য-শ্বাসাঘাতের তত্ত্ব থেকে সরে আসা হয়েছে। জগন্নাথ চক্রবর্তী যেসব শব্দে শ্বাসাঘাত আছে বলে দেখিয়েছেন,সেগুলো প্রথমত ধ্বনিপরিপর্তনের ফল—যা তিনি সঠিক অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন।দ্বিতীয়ত এগুলো মোটেও স্বনিমীয় তাৎপর্য বহন করে না।তিনি আলি শব্দের তিন নজির দিয়েছেন ‘আ̀লি,আলি,আলি̀’= ‘ধানের চারা,অলসতা,টিকটিকি’।২৮৬এর মধ্যে প্রথমটিতে উৎস শব্দ ‘হালি’,দ্বিতীয়টিতে উৎস শব্দ ‘আলসিয়া < আলস্য+ইয়া,এবং তৃতীয়টিতে ‘লণ্ডিকা’।সুতরাং তিনটিতেই ধ্বনিলোপের রেশ কেন বিবেচিত হবে না, সে এক প্রশ্ন। প্রথম ‘আলি’ এবং ‘আগা’ (বিষ্ঠা),‘আউয়া’ (ফাঁক) এই সব শব্দের প্রথম ধ্বনিতে শ্বাসাঘাত পড়ে কিনা,সেই তর্ক পাশে সরিয়ে রেখে,যদি এই বিবেচনা করি যে এরই জন্যে অর্থের বদল ঘটেছে তবে জগন্নাথ চক্রবর্তীরই ‘স্বরায়ন’ তত্ত্ব বাদ দিতে হয়।আমাদের মতে এই শব্দগুলোর আদ্য ‘হ/ফ’ লোপ পেয়ে সংশ্লিষ্ট স্বরের স্বরতন্ত্রীভবন ঘটিয়েছে শব্দগুলো দাঁড়িয়েছে ‘ʔআলি,ʔআগা,ʔআউয়া’। এবং এটা হওয়া সম্ভব দ্বিতীয় অক্ষরে শ্বাসাঘাতের ফলেই। এবং স্বনিমীয় বিরোধটি শ্বাসাঘাত নয়,হচ্ছে পরিবর্তিত বিভাজিত স্বনিম বৈচিত্র্যের জন্যে। আবিদ রাজা মজুমদার ‘আ’লি’ (< হালি) এবং ‘আ’লিয়া’ (<আলসিয়া) দুই শব্দেই শুরুর ‘আ’-এর পরে ঊর্ধ্বকমা (’ ) বসিয়েছেন।এগুলো তিনি করেছেন শুরুর ‘আ’-এর দীর্ঘ উচ্চারণ বোঝাতে।২৮৭ শ্বাসাঘাত পড়লে সংশ্লিষ্ট স্বরটি দীর্ঘ উচ্চারিত হয়। তবে কি শ্বাসাঘাতের দিকে ইঙ্গিত করছেন? অন্যথা,সিলেটিতে স্বরের দৈর্ঘ্য স্বনিমীয় তাৎপর্য বহন করে কিনা,সেই তর্কে যেতে হবে।অথচ,অন্যত্র লিখেছেন,“উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য এবং অর্থ স্বাতন্ত্র্য নির্দেশ করতে শব্দের আদ্যাক্ষরের ডান দিকে উপরে ’ (ঊর্ধ্ব কমা) ব্যবহার করা হয়েছে। এই চিহ্নদ্বারা শব্দের উচ্চারণে আদ্যক্ষর ধ্বনির অবরুদ্ধবৎ আওয়াজ শোনা যায়।”২৮৮তিনিও কয়েকটি ন্যূনতম শব্দজোড়ের নজির দিয়েছেন,“আগা/আ’গা,কিলা/কি’লা,চালা/চা’লা” (= অগ্রভাগ/হাগা,মুষ্ট্যাঘাত কর/কি রকম,ঘরের সম্প্রসারিত চাল/ দৈহিক তৎপরতার মাত্রা)। মাঝের ধ্বনি লোপের ফলে যে বহিঃস্ফোটক অবরুদ্ধ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়,আমরা তার নজিরে ‘কি’লা’/k’ilɐ/ শব্দটির উল্লেখ আগেই করে এসেছি। ‘চা’লা’/t͡s’ɐlɐ/-ও সেরকমই অবরুদ্ধ ধ্বনি,অন্যদিকে ‘আ’গা’ (ʔআগা)-র ‘আ’ ’ ভিন্ন ধ্বনি,ইতিমধ্যে আমরা উল্লেখ করে এসেছি।‘ধানের চারা’ অর্থে ‘আলি’-তে যদি প্রথম শব্দে শ্বাসাঘাত পড়ে দেখিয়েছেন জগন্নাথ ‘পরিমাণে চারটি’ অর্থে একই শব্দকে আবার অকারণে অভিধানের ভেতরে শ্বাসাঘাত মুক্ত রেখেছেন। এর কারণ অনুধাবন করা যায় তার উদাহরণ বাক্যে “ জাটিংগা তনে কয়আলি কমলা আনিছ।” ‘কয় আলি’ জুড়ে দেয়াতে শ্বাসাঘাত শব্দের শুরুতে ‘ক’-এর উপরে পড়েছে,‘অ’এর উপরে আর খোঁজে পান নি। জগন্নাথ চক্রবর্তী পরেশ চন্দ্র মজুমদারের একটি মন্তব্য পড়েছেন এই ভাবে,“শ্রী কৃষ্ণকীর্তনের স্বরপাতন নির্ভর করতো শ্বাসাঘাতের ওপর। ...তা সর্বদাই আদি অক্ষর কেন্দ্রিক”২৮৯ মন্তব্যটিকে যে তিনি কেমন ভুলভাবে পড়েছেন,তার নজির সামান্য পরেই এই মন্তব্য,“বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলাতেও শ্বাসাঘাত আদ্যক্ষর কেন্দ্রিক। শ্বাসাঘাতের ফলে এখানে অর্থবৈভিন্ন্য সৃষ্টি হয়।”২৯০ যদি ‘সর্বদা’ই হবে তবে ‘অর্থবৈভিন্ন্য’ কী করে দেখা দেয়,এবং এক শব্দে শ্বাসাঘাত থাকবে না, আর শব্দে থাকবে--- তাই বা কী করে হয়? সুতরাং এসব কষ্টকল্পিত সিদ্ধান্ত। এত সব বিসঙ্গতির জন্যে সিলেটিতে শব্দ-শ্বাসাঘাত নিয়ে তাঁর সিদ্ধান্তগুলোর সঙ্গে আমরা সহমত পোষণ করি না। করতে গেলে আমরা যে ভাবে সিলেটি ধ্বনিগুলোকে পরীক্ষা করে এসেছি,সে সবের পুনঃপরীক্ষা করতে হয়।তার উপরে সিলেটি বাক্য শ্বাসাঘাত তো বটেই, ছন্দের ব্যাখ্যাও নতুন করে দিতে হবে। এই কথা আর বলা যাবে না,যে সিলেটিতেও পয়ারে বিশেষ করে বাংলার মতো শ্বাসাঘাত সাধারণত পর্বের আদিতে পড়ে। মান বাংলাতে শব্দের শ্বাসাঘাতের অবস্থান নিয়ে যেসব সিদ্ধান্তের কথা লিখে এলাম,সিলেটিতেও এর থেকে ভিন্ন হয় বলে মনে হয় না।যদিবা অসমিয়ার মতো কিছু বৈচিত্র্য দেখাও যায় তবু স্বনিমীয় বিরোধ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত পাল্টাবার কোনো কারণ দেখি না। এর আগে আমরা সুধাংশু শেখর তুঙ্গের ‘রুদ্ধ স্বরপথ’ (Glottal Stop) সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে গিয়ে লিখে এসেছিলাম, এই নিচের শব্দে /ন,র,ল,হ/ আদৌ অবরুদ্ধ উচ্চারিত হয় কিনা সে কথা “উচ্চারণে শ্বাসাঘাত, স্বরাঘাতের ভূমিকারও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ না করে কথা বলা নিরাপদ হবে না”। n’ut not note r’uga roga sicky l’axan like এর মধ্যে প্রথমটি একাক্ষর,সুতরাং বাক্য–শ্বাসাঘাতের বিষয়। শেষেরটি দ্ব্যক্ষর,কিন্তু প্রথম অক্ষরটি ব্যঞ্জনান্ত হওয়াতে শ্বাসাঘাতকেই তাঁর মনে হয়েছে অবরুদ্ধ উচ্চারণ। আর ‘রুগা’ দ্ব্যক্ষর শব্দটি বারবার উচ্চারণ করলেই ‘র’-এর মধ্যে ‘রোগা’-র থেকে কোনো ব্যতিক্রমী কিছু শোনা যাবে না,শুধু নিম্ন স্বর ‘ও’ এর উচ্চস্বর ‘উ’-তে রূপান্তরণ আঁচ করা যাবে। দ্বিতীয় অক্ষর ‘গা’-তে সিলেটি এবং মান বাংলা দুই শব্দেই শ্বাসাঘাত আঁচ করা যাবে। ‘অবরুদ্ধবৎ’ উচ্চারণ বলে এগুলোতে কিছুই নেই। বাক্যে শ্বাসাঘাতকে চিহ্নিত করবার জন্যে সাধারণত এই শব্দ বা শব্দগুচ্ছের আগে উপরে একটি ছোট বৃত্ত (০) বসানো হয়। যেমন ০আমি বই পড়ি। সাধারণ বিবৃতিমূলক বাক্যে শুরুতেই শ্বাসাঘাতটি পড়ে। জটিল বা যৌগিক বাক্য হলে সাধারণত প্রতিটি পদগুচ্ছের আগেই শ্বাসাঘাত পড়ে। কিন্তু যদি এইভাবে বলা হয় --- আমি ০বই পড়ি-- তবে আমি যে বইই পড়ি নোট বা ম্যাগাজিন সেরকম কিছু নয় এই কথাটি বোঝায়। আবার যদি বলা হয় –আমি বই ০পড়ি---তবে বোঝানো হচ্ছে শুধুই কিনি না,বা কেজি দরে বিক্রিও করি না।নিয়মিত পড়ি।বক্তা যে কথাটিতে জোর দিতে চাইছেন তার সেই ইচ্ছে অনুসারেই তিনি জোর দেবেন,এবং সেই অনুসারে বাক্যের অর্থ পালটে যাবে। খুব সুনির্দিষ্ট কোনো অবস্থান নেই,যেমন আছে শব্দ শ্বাসাঘাতে।অসমিয়াতেও মোটের উপরে কথাগুলো একই।আমরা লিখলাম সাধারণ বিবৃতিমূলক বাক্যে শুরুতেই শ্বাসাঘাত পড়ে,যখন দেখালাম ‘বই’ বা অন্য বাক্যে ‘পড়ি’ শব্দের আগেও শ্বাসাঘাত পড়তে পারে---সেগুলোর আলাদা কোনো ব্যাখ্যা এখানে করিনি। গোলোকচন্দ্র এগুলোকে সাধারণ বাক্য শ্বাসাঘাত এবং গুরুত্বজ্ঞাপক বাক্য শ্বাসাঘাত বলে স্বতন্ত্র চিহ্নিত করে বিশ্লেষণ করেছেন। লিখেছেন,“গুরুত্বজ্ঞাপক শ্বাসাঘাতর স্থানান্তর হ’লে অর্থও বেলেগ হৈ পরে।”২৯১ সিলেটিতেও কথা গুলো একই। নোয়াখালি-চট্টগ্রামীতে শ্বাসাঘাতের ভূমিকা নিয়েও আমরা নিজেদের ধারণা স্পষ্ট করবার সুযোগ পাইনি,রবীন্দ্র কুমার দত্ত স্পষ্ট করে কিছু লেখেন নি। ২) সুরাঘাতঃ শ্বাসাঘাতের মতোই সুরাঘাতেরও দুই প্রকার শব্দ এবং বাক্য সুরাঘাত। শব্দ সুরাঘাত যে সব ভাষাতে গুরুত্বপূর্ণ সেখানে সেটি বোঝাবার জন্যে ধ্বনিবিশেষের উপরে বাংলা রেফের মতো এই ( ́) চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। যেমন সংস্কৃতে রা́জপুত্র মানে রাজা যার পুত্র;রাজপু́ত্র মানে রাজার পুত্র। বৈদিক আর্যে স্বরাঘাতেরও তিনটি শ্রেণিভেদ ছিল ---সেগুলোকে উদাত্ত,অনুদাত্ত,স্বরিত বলা হয়।অসমিয়া- বাংলাতে শব্দ সুরাঘাতে শব্দের মানে পাল্টায় না,কিন্তু বাক্য সুরাঘাতে---যাকে স্বরাঘাতও বলে--- মানে পাল্টায়। তার তিনটি প্রকার ভেদ ১) অবরোহী –উপর থেকে নিচের দিকে গতি করে; ২) আরোহী----নিচের থেকে উপরের দিকে গতি করে; ৩) সমান্তরাল--- সাধারণত ক্রমে এই তিরমুখো রেখা দিয়ে এদের চিহ্নিত করা হয়-- ↘ , ↗ , → । বাক্য স্বরাঘাত প্রায়ই এই তিন গতির মিশ্রণে হয়। আমরা নিচে রেখাচিত্র দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করছি। সুরের তীব্রতার বহু সূক্ষ্ম মাত্রাভেদ হয়ে থাকে। আন্তর্জালে আজকাল বহু সুরবিশ্লেষক সফটওয়ার মেলে । তার একটি এখানে পাওয়া যাবে: https://tone-analyzer-demo.mybluemix.net ।সেগুলো দিয়ে বিশ্লেষণ করলেই নজরে পড়বে।তবে সাধারণ আলোচনার জন্যে উচ্চ-নিম্ন-মধ্যম এই তিন মাত্রাভেদ ধরে তিন স্তরে সুরকে রেখাচিত্রের সাহায্যে উপস্থাপন করবার রীতি প্রথম দেখিয়েছিলেন অধ্যাপক জোনস এইভাবে।২৯২
‘সুমন বলে।’ এই সাধারণ বিবৃতিমূলক বাক্যে এই রেখাচিত্রটি দেখাতে পারে এরকম:
‘সুমন কি বলে’ যদি প্রশ্নের উত্তর হয় শুধু ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ তবে রেখাচিত্রটি হবে এরকম:
উত্তরে যদি আরো কিছু জানতে চাওয়া হয় তবে রেখাচিত্রটি হবে এমন:
‘সীতা বললেন, ‘রাম আমায় সন্দেহ করেন।’ –এরকম যৌগিক বাক্যে আরোহী-অবরোহী স্বরাঘাতের এমন মিশ্রণ ঘটবে।
এমন স্বরাঘাতের আরো অনেক বৈচিত্র্য দেখানো সম্ভব। গোলোকচন্দ্র কোনো রেখাচিত্রের সাহায্য নেন নি। কিন্তু ‘তুমি এতিয়া যোৱা।’ বাক্যটির তিন বৈচিত্র্যের যে সুরবর্ণনা দিয়েছেন,তাতে বাংলার সঙ্গে বিশেষ কোনো তফাত নেই।২৯৩ কিন্তু আমরা আগে যেমন লিখেছি,এই স্বরাঘাত শোনেই বহু অশিক্ষিত স্বল্পশিক্ষিত ব্যক্তিও ধরে ফেলতে পারেন বক্তা কোন ভাষা বা কোন অঞ্চলের ভাষা বৈচিত্র্যে কথা বলছেন,সেই কথাটি মনে রাখতে হবে।বাংলা- অসমিয়ার সব বাক্যের স্বরাঘাত রেখাচিত্র একই দেখাবে না। আমাদের অভিমত হচ্ছে একটি ভাষার সবচাইতে ধীর লয়ে পরিবর্তনটি ঘটে এই স্বরাভ্যাসে। একজন অসমিয়া যদি অন্য সব ধ্বনিগত উচ্চারণ সঠিক রেখেও বাংলা বলেন,তাঁর অসমিয়া স্বরাভ্যাস চাপা থাকে না। শোনেই বোঝা যায় অসমিয়া ব্যক্তি বাংলা বলছেন।একজন মণিপুরি যখন প্রথম প্রথম সিলেটিতে কথা বলেন,কিংবা সিলেটি যখন মানবাংলাতে বা ইংরেজিতে কথা বলেন—তখন তার বাক-বিসঙ্গতি যে বহুসময় শ্রোতার হাসির কারণ হয় সে এই স্বর পরিবর্তনের এই ধীর লয়ের জন্যেই। এই স্বরের ভেতরে একটি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ তার প্রাচীনতম ইতিহাস ঐতিহ্য ধরে রাখে। একে ভাষার জীবন্ত ফসিল বা প্রত্ননিদর্শন বললেও অত্যুক্তি হয় না। গোলোকচন্দ্র গোস্বামী লিখেছেন,“সকলো ভাষাত সঘোষ স্বরধ্বনিয়ে সুর বহন করে। গতিকে শব্দর প্রত্যেক অক্ষরতে একোটা সুর পাব পারি।”২৯৪ অসমিয়া বাংলার প্রতিবেশী তিব্বত-বর্মী ভাষাগুলোতেও এই সুর বৈচিত্র্য শব্দের অর্থ পালটে দেয়। বাংলা-অসমিয়াতে সেটি হয় বাক্যে। সুতরাং স্বরাঘাতকে বাদ দিয়ে কোনো ভাষাবৈচিত্র্যের আলোচনা সম্পূর্ণ হতেই পারে না। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দুই ভাষা বা ভাষাবৈচিত্র্যের স্বরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তফাত দেখানো সম্ভব। বাংলা ‘তুমি কি যাবে?’,অসমিয়া ‘তুমি যাবা নে’,সিলেটি ‘তুমি যাইবায় নি?’ ---বাক্য তিনটির অর্থ একই। কিন্তু উচ্চারণ করলেই বোঝা যাবে তিন ভাষাতে স্বরাঘাতের রেখাচিত্র এক হবে না।এমন নয় যে স্বরাঘাত স্বরধ্বনিগুলোর সমন্বয় মাত্র,তার অতিরিক্ত একটি ভাষাবিশেষের বিভাজ্য ধ্বনিনিরপেক্ষ অবিভাজ্য উচ্চারণ অভ্যাস। তবু স্বর বা অক্ষর বিন্যাস এর ভিত্তিটি গড়ে দেয়। সামান্য মনোযোগ দিলেই বোঝা যাবে বাক্য তিনটিতে প্রায় সব ক’টি অক্ষরই স্বরান্ত। সিলেটি ‘যাইবায়’ শব্দে একটি দ্বিস্বর এবং অর্ধস্বর আছে।‘ত̖,ম̖,য̖,ব̖’ এই চারটি ব্যঞ্জন অপরিবর্তিতই আছে। একটি ব্যঞ্জন ‘ক̖’-এর বদলে অসমিয়াতে ‘ন̖’ এসেছে। সেটি বাক্যে জায়গাও বদল করেছে। সিলেটিতেও তাই হয়েছে। কিন্তু সেগুলোকে জুড়ে যে স্বরধ্বনিগুলো পুরো বাক্যটিকে তৈরি করেছে সেগুলোর পরিবর্তন হার ব্যাপক এবং নানা ক্রম এবং সংখ্যাতে বসে ভাষা তিনটিকে ভিন্ন করে দিয়েছে। যা শুধু লিখে নয়,শোনেও বোঝা সম্ভব। মাঝখান থেকে ব্যঞ্জনগুলোকে পালটে দিয়ে শব্দগুলোকে অর্থহীন করে দিয়ে উচ্চারণ করে গেলেও আঁচ করা যাবে কোন কথন ভঙ্গীটি কোন ভাষার। এমন কি বাংলা বাক্যটিকে ‘তুমি যাবে কি?’ লিখেও যদি অর্থ এক রাখার ইচ্ছে নিয়ে বলা যায় (বিকল্পার্থে প্রশ্নের ছলে যাবার জন্যে তাড়া দেয়াও বোঝাতে পারে।) দেখা যাবে স্বরধ্বনি তথা অক্ষর ক্রমের সাম্য বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে বাক্যটি অসমিয়া বাক্যের সুরের কাছাকাছি এসে গেছে। কানে না শুনিয়ে লিখে বোঝানো কতটা সম্ভব আমাদের সন্দেহ আছে। তাই,আপাতত আর এগুনো গেল না। জগন্নাথ চক্রবর্তী যেমন বরাক উপত্যকার প্রচলিত সিলেটিতে শব্দ-শ্বাসাঘাতের সন্ধান দিয়েছিলেন,রবীন্দ্র কুমার দত্ত তেমনি নোয়াখালি চট্টগ্রামীতেও শব্দ-সুরাঘাতের কথা লিখছেন।এর জন্যে তিনি প্রতিবেশী মগ,মণিপুরি,কগ̖বরক আদি তিব্বত-চিনি ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার প্রসঙ্গও টেনেছেন। সেসব ভাষাতে শব্দ-সুরাঘাতে স্বনিমীয় বিরোধ তৈরি হয়। কিন্তু যেভাবে তর্কটিকে উপস্থিত করেছেন,তা জগন্নাথ চক্রবর্তীর মতোই বিশ্বাসযোগ্য নয়।প্রথমত তিনি মাত্রা,শ্বাসাঘাত,সুর, সুরতরঙ্গ,যদি ইত্যাদি ‘বিভাজনাতিরিক্ত ধ্বনিতা’র কথা উল্লেখ করেও বাকিগুলো নিয়ে বিশেষ কিছু লেখেন নি বা পরীক্ষা করেন নি।এই কথা লিখেছেন,“নোয়াখালি চট্টগ্রামী উপভাষায় শ্বাসাঘাতের ফলে অর্থ না পাল্টালেও শব্দে স্বরাঘাত ও বাক্যে সুরতরঙ্গের ফলে অর্থ পালটে যায়।”২৯৫জগন্নাথ চক্রবর্তী যদি পরেশচন্দ্র মজুমদারের একটি মন্তব্যের পাঠে অতি-অর্থের নিষ্কাশন করেছেন, রবীন্দ্র দত্তও সেরকমই করেছেন বলেই মনে হয়েছে মুহম্মদ আব্দুল হাই-র একটি সঠিক মন্তব্য নিয়ে,“সাধারণ বর্ণনা,ক্রোধ,বিরক্তি,স্নেহ,সোহাগ,বিস্ময়,আপত্তি,আদেশ,অনুরোধ প্রভৃতি প্রকাশ করতে পরিবেশের গুরুত্ব অনুসারে সংশ্লিষ্ট শব্দের অক্ষর–বিশেষে জোর পড়ে;কখনো তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অক্ষরের স্বরধ্বনিও দীর্ঘায়িত হয়ে যায়। এমন ভাবেইতো বাকপ্রবাহের মধ্যে অগণিত ও বিচিত্র রেখাভঙ্গীর ও ধ্বনি তরঙ্গের সৃষ্টি হয়।”২৯৬ যদি আব্দুল হাই শব্দ-সুরাঘাতের কথাই বোঝাতেন,তবে “আপত্তি, আদেশ, অনুরোধ” –বোধক শব্দের কথা বলতেন। ‘পরিবেশের গুরুত্বে’র প্রসঙ্গ তুলতেন না।কেননা,স্বনিমীয় বিরোধসহ শব্দ নিজেই পরিবেশ তৈরি করে,পরিবেশ অনুযায়ী সে পাল্টায় না। চীনা ভাষাতে যে উঁচু সমান্তরাল উচ্চারণে ‘মা’ শব্দে ‘মাতা’ বোঝায়---তার কোনো সম্ভাবনা নেই পরিবেশ অনুযায়ী পালটে যাবার। ‘মাতা’র সঙ্গে ‘ক্রোধ,বিরক্তি,স্নেহ,সোহাগ’ এই সব আবেগ জুড়লেও না। মানবাংলাতে কিন্তু সেই সম্ভাবনা আছে,আমাদের অনুমান চট্টগ্রামী আদিতেও কথাটি এরকমই। আব্দুল হাই-র ‘বাকপ্রবাহে’র উল্লেখে স্পষ্ট তিনি সামগ্রিক ভাবে কথন-অভ্যাসের কথা বলছেন।একক শব্দে মান বাংলাতে বাক্য হয়। এবং সুরাঘাত পালটে তার অর্থ পালটে দেয়া যেতেই পারে। সেটি বাক্য –সুরাঘাত তথা স্বরাঘাতের বিষয় হবে। তিনি গোপাল হালদারেরও একটি প্রাসঙ্গিক কথার উল্লেখ করেছেন,“A point has however to be noted that in EB,as in other branches of Bengali (West,Central,East .etc), each dialectical variety or type is popularly distinguished from the other , or even from its next neighbor,besides by their differences in the Phonetic or Grammatical marks,as,according to the speakers of each dialects,be their difference in what they call ṭān,flow,or sur,i.e. tone.A difference can really be perceived between the Groups of dialects (Dacca Group,Sylhet East-Kachar group,Chittagong –Noakhali Group),and sometimes between two dialectical verities of the same group, though the unpracticed ear of Std. Coll. Speakers may miss it.”২৯৭ গোপাল হালদারের এই কথাগুলোর সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই,বরং সুরাঘাত নিয়ে আমাদের বোধকে এ স্পষ্টই করে। কিন্তু এখানে তিনি স্পষ্টই সুরাঘাতের কথা লিখছেন,শ্বাসাঘাত নয়,স্বরের দৈর্ঘ্যও নয় এবং শব্দ-সুরাঘাত নিয়ে আলাদা করে কোনো কথা নেই।কিন্তু রবীন্দ্র কুমার দত্ত যখন এসব কথার মর্মোদ্ধার করেছেন তিনি শ্বাসাঘাত,দৈর্ঘ্য সব কিছুর একত্র জট পাকিয়ে দিয়েছেন।সামান্য আগে তিনি লিখছেন,“শ্বাসাঘাত,স্বরাঘাত,স্বরদৈর্ঘ্য ওঠা-নামায় শব্দে সৃষ্ট সুরবৈচিত্র্য (Tonal variation) এবং বাক্যে সৃষ্ট সুরতরঙ্গের (Intonation) ফলে যে বাকভঙ্গি দেখা দেয় সেই বাকভঙ্গির দিক থেকে একটি ভাষা কিংবা উপভাষার সঙ্গে অপর ভাষা কিংবা উপভাষার মধ্যে পার্থক্য দেখা দেয়।”২৯৮কেবল কৃষ্ণপদ গোস্বামীর একটি সাক্ষ্য তিনি উপস্থিত করেছেন,যেখানে শ্রী গোস্বামী লিখছেন চট্টগ্রামীতে সুরতরঙ্গে তিব্বত-বর্মী ভাষাগুলোর প্রভাব থাকা সম্ভব। তাও শব্দ-সুরাঘাত নয়,তিনি কথাটি বলেছেন,‘The peculiar form of stress and intonation system’২৯৯নিয়েই।হতে পারে,রবীন্দ্র কুমার দত্তের সিদ্ধান্তগুলো সঠিক। কিন্তু উপস্থাপনা অসঙ্গতিপূর্ণ বলে আমাদের মেনে নিতে বেগ পেতে হচ্ছে।তার উপরে এই দুই ভাষাবৈচিত্র্যের কোনোটিই আমাদের মাতৃভাষা নয়,নিবিড় পরীক্ষাও আমাদের অধ্যয়নের উদ্দেশ্য নয়। তাই আমরা তাঁর সিদ্ধান্তকে প্রত্যাহ্বান জানাচ্ছি না,শুধু প্রশ্নগুলো তুলে রাখলাম।বিভাজ্য-ধ্বনিগুলোকে তিনিও ন্যূনতম শব্দজোড়ে পরীক্ষা করেন নি,ফলে কী সব অসঙ্গতি ছিল আমরা কিছু ইঙ্গিত দিয়েছি। কিন্তু শব্দ-সুরাঘাত তিনি ন্যূনতম শব্দজোড়েই দেখাবার চেষ্টা করেছেন। নিচু বনাম উঁচু [চট্টঃ ফা̣̀:ত̖ ( পায়ে ),ফা̣́:ত̖ (চুলাতে);নোয়াঃ দুঁ̀র̖ (দৌড়ানোর নির্দেশ),দুঁ́র̖ (দ্বিপ্রহর)],মধ্যম বনাম নিচু [ চট্টঃ ফ̣র̖ (পড়ার নির্দেশ), ফ̣̀র̖ (অপর);নোয়াঃ হা:ত̖ (পায়ে),হা̀ত̖ (সাত)], মধ্যম বনাম উঁচু [চট্টঃ বর̖ (পানের খেত),ব́:র̖ (অত্যন্ত, লম্বা),নোয়াঃ হা:ত̖ (পায়ে),হা́:ত (চুলাতে)]। এই তিন ভাগে দুই ভাষাবৈচিত্র্যের প্রচুর শব্দজোড়ে সুরাঘাতের স্বনিমীয় বিরোধ দেখিয়েছেন। কিন্তু যখনই বাক্য-স্বরাঘাতের সম্পর্কে লিখছেন মোটা দাগে সেগুলো অনেকটাই মান বাংলার মতো রেখাচিত্রে ধরা যাচ্ছে। যদিও সূক্ষ্মবিশ্লেষণে রেখাচিত্রগুলো ভিন্ন হওয়াই সম্ভব কেন,আমরা আগে ব্যাখ্যা করে এসেছি। বিশেষ করে চিত্র -২০-এ যে প্রশ্নবোধক বাক্যের তিরমুখো রেখাটি ঊর্ধমুখী,সেখানে চিত্র—২৩-ক-তে একই রকম বাক্যে নিম্নমুখী। কিন্তু চিত্র ২১-এর সঙ্গে ২৩-খ-এর কোনো বড় সড় প্রভেদ নেই।কিন্তু তাতে মূল সিদ্ধান্তের কোনো হেরফের হচ্ছে না যে মান-বাংলা,অসমিয়া, সিলেটির মতো নোয়াখালি চট্টগ্রামীতেও বাক্য-স্বরাঘাত স্বনিমীয় তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর রেখাচিত্র গুলো এরকম:
(ক) তুঁ́:ই কি খা̣ইবা – শ্রোতা খাবে কি না জানতে চাওয়া হচ্ছে। (খ) তুঁ́:ই কি খা̣ইবা—শ্রোতা কী খাবে জানতে চাওয়া হচ্ছে।
২) যতি: যতি চিহ্ন বললে আমরা পরম্পরাগত ব্যাকরণে যে কথা গুলো জেনে এসেছি তা বাক্যে ব্যবহৃত শব্দের বা শব্দ সমষ্টির অর্থ সম্পর্কিত। ধ্বনি বিজ্ঞানের যতি তার অতিরিক্ত কিছু।বাক প্রবাহে দুই স্বনিমের মধ্যবর্তী বিরতি বা পারস্পরিক সংযোগকে যতি বা সন্ধান বা ধ্বনিসংযোগ বলে। যতি তিন রকম: ১) বাহ্য উন্মুক্ত যতি। ২) অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত যতি। ৩) ঘনিষ্ঠ বা সংবদ্ধ যতি। গোলোকচন্দ্র যতির বদলে সন্ধি কথাটি ব্যবহার করেছেন। এবং শ্রেণিবিভাজনও সামান্য অন্যরকম করেছেন। উন্মুক্ত যতিকে মুক্তসন্ধি সংবদ্ধ যতিকে বদ্ধসন্ধি বলে লিখেছেন,“বদ্ধসন্ধি এটা শব্দর ভিতরর গুণ,আরু মুক্তসন্ধি বাহিরর গুণ।৩০০ ১) বাহ্য উন্মুক্ত যতি: এক বিশেষ ভাষাতে ব্যবহৃত বাক-প্রবাহে দু’টি ধ্বনির মধ্যে যদি এমন বিরাম থাকে যেটি কানে শোনেই বোঝা যায় তবে সেই বিরতিকে বাহ্য উন্মুক্ত যতি বলে।দুই ধ্বনির মধ্যে সরাসরি সংযোগ ঘটে না,বলা যেতে পারে নেতিমূলক সংযোগ ঘটে।এই ভাবটি বোঝাবার জন্যেই একে বাহ্য উন্মুক্ত যতি বলে।এর আবার দুই শ্রেণি।বাক্যের শেষে যতি পড়লে বাক্য প্রান্তিক যতি,পদগুচ্ছের শেষে পড়লে পদগুচ্ছ-প্রান্তিক যতি বলে।প্রথমটিকে এই চিহ্ন (।।) এবং দ্বিতীয়টিকে এই চিহ্ন (।) দিয়ে বোঝানো হয়। সাধারণ বাংলা অসমিয়া বাক্যে আমরা এগুলো কমা,সেমিকলোন,দাড়ি দিয়েই বুঝিয়ে থাকি।বহু সময় কোনো চিহ্নই ব্যবহার করি না কথন অভ্যাসেই যতিটি অনুভব করি। যদিও ভিনভাষীর কাছে চিহ্ন বিনা এটি বুঝে ওঠা কঠিন হতে পারে। যেমন,“সীতা বললেন,‘রাম আমায় ভালোবাসেন কিন্ত সন্দেহও করেন।” এই বাক্যকে বাহ্য উন্মুক্ত যতি দিয়ে বোঝাতে গিয়ে লিখতে হবে এই ভাবে--সীতা বললেন। রাম আমায় ভালোবাসেন। কিন্তু। সন্দেহও করেন।। ইংরেজির মতো কোনো কোনো ভাষাতে এই যতির পরে পরেই শ্বাসাঘাত পড়ে,অল্পপ্রাণ ধ্বনির মহাপ্রাণীভবনের মতো ঘটনা ঘটে। সেইসব ভাষাতে তাই বাহ্য উন্মুক্ত যতি স্বনিমীয় তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু বাংলাতে তা হয় না,বাক্যে অর্থ বদল ঘটালেও শব্দে হয় না।অসমিয়াতেও ঘটনাটি মোটের উপরে একই ঘটে। গোলোকচন্দ্র বাহ্য উন্মুক্ত যতির বদলে ‘বাক্যসন্ধি’ এবং বিকল্পে ‘যতিসন্ধি’ কথাটি ব্যবহার করেছেন।৩০১মধ্যসন্ধি এবং অন্ত্যসন্ধি বলে যা কিছু বুঝিয়েছেন তা ঐ পদগুচ্ছপ্রান্তিক এবং বাক্যপ্রান্তিক যতিই। সিলেটিতে এই বাক্যটিই নেয়া যাক---“আমারে কইলা,‘আমার ছেলেয় বু’ট গ’রো দিতে কইছে।গ’র কই পাইমুরে বা?” এই বাক্যকে বাহ্য উন্মুক্ত যতি দিয়ে বোঝাতে গিয়ে লিখতে হবে ---আমারে কইলা। আমার ছেলেয় বু’ট গ’রো দিতে কইছে। গ’র কই পাইমুরে বাবা।। এর যতি পালটে দেখা যেতে পারে---আমারে কইলা আমার ছেলেয়।বু’ট গ’রো। দিতে কইছে গ’র। কই পাইমুরে বাবা।। --বাক্যের অর্থ দাঁড়ালো ---আমাকে আমার ছেলে বলল, ভোট ঘরে ( বলেছে)। ঘর দিতে বলেছে, বাবা ঘর পাই(টা) কই? বাক্যের অর্থ পাল্টালো। কিন্তু কোনো একটি শব্দের অর্থ পাল্টায় নি। ২) অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত যতি: রামেশ্বর শ’ লিখেছিলেন ‘আভ্যন্তরীণ’।আমরা ‘আকাদেমী বানান অভিধান’ অনুসরণে ‘অভ্যন্তরীণ’ লিখছি। যখন দুই ধ্বনির মধ্যে উচ্চারণে বিরতিটি বোঝা যায় না কিন্তু বাহ্য উন্মুক্ত যতির অন্যান্য বৈশিষ্ট্য নজরে আসে তখন তাকে অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত যতি বলে। এর চিহ্ন এইরকম (-)। সাধারণত সমাসবদ্ধ শব্দের মাঝে এই যতি পড়ে। বাংলাতে এমন শব্দে যতির আগে পরে স্বনিমীয় বৈচিত্র্য নজরে না পড়লেও মিলন রেখাটি চেনা যায়। যেমন দিন-রাত,রেল-গাড়ি,হাত-ধরে। সামান্য অদলে বদল এমন যতি সিলেটিতেও একই। দিন-রাইত,রেল-গাড়ি,হাত-ধরি। গোলোকচন্দ্র গোস্বামী লিখেছেন,“শাব্দিক বিশিষ্ট মুক্ত সন্ধি এটা”।৩০২ কিন্তু এহেন সমাসবদ্ধ পদের ব্যবহার নিয়ে কিছু লেখেন নি, দিনে-নিশাই,দিনে-রাতিয়ে,ৰেল-গাড়ি,হাত-ধৰি---এগুলো অসমিয়া শব্দই। এমন কি ‘ধ্বনি-বিজ্ঞান’ কথাটিও। তিনি যখন লেখেন, “এই সন্ধির অভ্যন্তরীণ বদ্ধ সন্ধি আরু বাক্যর বহিঃসন্ধির লগত বিরোধ দেখা যায়। ( +) চিনেরে শাব্দিক মুক্ত সন্ধির নির্দেশ দিয়া হৈছে।”৩০৩ তখন স্পষ্টই বোঝা যায় শব্দযতি বা সন্ধিরও তিনি বদ্ধ এবং উন্মুক্ত দুই শ্রেণির কথা মনে রেখেছেন। কথাটি আরো স্পষ্ট হবে সংবদ্ধ যতি প্রসঙ্গে। ৩) ঘনিষ্ঠ বা সংবদ্ধ যতি: দুই ধ্বনির মাঝে বাহ্য বা অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত যতি না থাকে তবে সংবদ্ধ যতি আছে বলে ধরা হয়। লিখেছেন, রামেশ্বর শ’। এর চিহ্ন এরকম (+)। কিন্তু এটি সামান্য বিভ্রান্তিমূলক বলে আমাদের মনে হয়েছে। এইভাবে বললে,মনে হবে একটি শব্দের প্রতিটি ধ্বনির পরেই বুঝিবা সংঘবদ্ধ যতি রয়েছে।ঘটনা এমনটা হয় না। এখানেও বিরতিহীন উচ্চারণ হলেও মিলনরেখা রয়েছে বলে ভ্রম হয়।তিনি আরো লিখেছেন,“সাধারণত সংবদ্ধ যতি একই শব্দের দুই অক্ষরের মাঝখানে পড়ে আর অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত যতি বিরতিহীন দুই শব্দের মাঝখানে পড়ে।”৩০৪ কিন্তু এর পরেই লিখেছেন,“বাংলা এবং ইংরেজীতে এই দ্বিবিধ যতি স্বনিমীয় তাৎপর্যপূর্ণ”৩০৫--- এই কথাটি সঠিক নয়। তিনি দুটি উদাহরণ দিয়েছেন:
মন্তোর [mɔn+tor] –সংবদ্ধ যতি। মন-তোর [mɔn-tor]—অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত যতি। জলপাই [Ɉʒɔl+pɐi]—সংবদ্ধ যতি। জল-পাই [Ɉʒɔl-pɐi] —অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত যতি। তিনি এগুলোর অর্থ লেখেন নি--সংস্কৃত ‘মন্ত্র’ থেকে বাংলা তদ্ভব শব্দ এই উল্লেখটুকু ছাড়া। আমরা বুঝতে পারি, মন-তোর মানে –তোর মন। জলপাই মানে ফল। জল-পাই---মানে পান বা স্নান করবার জল কোথায় পাই—সেই প্রশ্ন করা হচ্ছে। সত্য বটে একই শব্দের যতি ধর্ম পরিবর্তনে অর্থ পাল্টাচ্ছে। কিন্তু এটা অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত যতি থাকা সব শব্দের ক্ষেত্রে ঘটে না। যেমন দিন-রাত,রেল-গাড়ি,হাত-ধরে কখনো দিন+রাত,রেল+গাড়ি,হাত+ধরে হবে না। অসমিয়া মুক্ত- বদ্ধ সন্ধির আলোচনাতে গোলোক চন্দ্র গোস্বামী আরো স্পষ্ট করে উপস্থাপন করেছেন সমস্যাটির। ক) সি+ পাৰ+লৈ+ গ’ল। (সে পায়রা পাখি নিয়ে গেছে।) খ) সি+ পাৰলৈ+গ’ল। (সে নদী বা পুকুর পাড়ে গেছে।) গ) সিপাৰলৈ +গ’ল। (ওপাড়ে চলে গেছে।) তিন বাক্যের তিন অর্থ।অথচ বর্ণ বা অক্ষর ক্রম একই। যা পাল্টেছে তা এই সন্ধির স্থান বা গুণ।ক –বাক্যে ‘পার’ এবং ‘লৈ’-র মাঝে মুক্তসন্ধি ছিল।খ-বাক্যে সেটি বদ্ধসন্ধি হয়ে ভিন্নার্থক ‘পাৰলৈ’ শব্দে পরিণত হয়ে গেছে।অনুরূপ খ-বাক্যে ‘সি’ এবং ‘পাৰলৈ’-র মাঝে মুক্তসন্ধি ছিল।গ-বাক্যে সেটি বদ্ধসন্ধি হয়ে ভিন্নার্থক ‘সিপাৰলৈ’ হয়ে গেছে। শেষ বাক্যে একটিই মুক্ত সন্ধি রইল। একে শাব্দিক মুক্তসন্ধি না বলে বাহ্য উন্মুক্ত সন্ধি বা বাক্যমধ্য মুক্ত সন্ধি বলা ভালো। এর স্থানান্তর তথা বিলোপ ঘটালে ‘সিপাৰলৈগ’ল’ কথাটির শব্দ বা বাক্য হিসেবে কোনো অর্থই থাকবে না।সুতরাং সিদ্ধান্তে যেতেই পারি,শব্দের যতি ধর্ম পাল্টালে অসমিয়া শব্দ এবং বাক্য দুইয়েরই অর্থ পালটে যায়।অর্থাৎ মুক্তসন্ধি স্বনিমীয় তাৎপর্য পূর্ণ। সিলেটিতে কিন্তু ‘মন্তোর,জলপাই’ এসবের মতো সংবদ্ধ এবং অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত যতির স্বনিমীয় বিরোধ কখনো কখনো দেখা গেলেও,অধিকাংশ সময় শব্দগুলো জুড়ে যায়। মিলন রেখাটি আছে বলে ভ্রম হয়,কিন্তু স্পষ্ট চেনা যায় না। উচ্চারণেও তফাত হয় কিন্তু তাতে কোনো অর্থের বদল ঘটে না। অর্থাৎ স্বনিমীয় বিরোধ মেলে না। যেমন কয় ʔআলি (কয়েক হালি) > কয়ালি,হ বায় দি (সেই দিক দিয়ে) > হবায়দি,জামাই বাবু > জাম্বু। হাঁটু (সমান) উঁচা গা’ (ঘাস) > হাটুইচ্চাগা’। নোয়াখালি –চট্টগ্রামীতে এই প্রবণতা আরো ব্যাপক।রবীন্দ্র কুমার দত্ত ‘যতি’ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করতে পারতেন।এই দুই ভাষাবৈচিত্র্যের,বিশেষ করে চট্টগ্রামীতে বদ্ধ বা সংবদ্ধ যতির চিত্তাকর্ষক সব নজির মেলে। তিনি এগুলোকে সংকোচন এবং জোড়কলম শব্দ প্রসঙ্গেই আলোচনা করেছেন। এই স্থান দিয়া > ইনদি,সেই তার লাগিয়া > হিতাললাই,আনো গিয়া যাও> আনোগৈজও। এই নিয়ে আমরা এর বেশী গভীরে মন্তব্য করবার মতো অবস্থাতে নেই। ৪) নাসিক্যীভবনঃ বাংলাতে নাসিক্যীভবন স্বনিমীয় তাৎপর্য বহন করে স্বর স্বনিম প্রসঙ্গে আগেই লিখে আসাতে এখানে আর বিস্তৃত টানছি না। নোয়াখালি-চট্টগ্রামীতেও তাই।সিলেটিতে নাসিক্যীভবন থাকলেও স্বনিমীয় তাৎপর্য বহন করে না—সে সম্পর্কেও আলোচনা সেরেছি। ৫) দৈর্ঘ্যঃ বাংলাতে দৈর্ঘ্যও স্বনিমীয় তাৎপর্য বহন করে না,সেই কথা আগেই লিখে এসেছি। সংস্কৃত বা হিন্দিতে করে। যেমন দিন[din] মানে দিবস,দীন [di:n ] মানে দরিদ্র। বাংলাতে তৎসম শব্দরূপে লেখাতে এগুলো আছে। কিন্তু উচ্চারণে কোনো তফাত নেই। দুটোই [ di:n]। কিন্তু দীনের এবং দিনের দুটোই উচ্চারণে [diner] হ্রস্ব। তার মানে উচ্চারণ বৈচিত্র্য একটি আছে,সেটি পরিপূরক। বাংলা এক অক্ষরের শব্দে বা যে কোনো শব্দের শেষে স্বরধ্বনির উচ্চারণ হয় দীর্ঘ। কিন্তু শেষ ধ্বনিটি ব্যঞ্জন হলে তার আগের স্বরটি হয় হ্রস্ব। দিনের বা দীনের শব্দ দুটি দুই অক্ষরের ব্যঞ্জনান্ত শব্দ তাই প্রথমাক্ষরের ‘ই/ঈ’-র উচ্চারণও হ্রস্ব। মানে দাঁড়ালো বাংলা /ই/ এবং /ঈ/ বিস্বন।অসমিয়াতেও কথাটি একই। গোলোকচন্দ্র লিখেছেন,“অসমীয়াত একাক্ষরী শব্দত,দ্ব্যক্ষরী বা অধিক অক্ষরী শব্দত দ্বিতীয় অক্ষরত,অথবা শ্বাসাঘাতযুক্ত অক্ষরত স্বরধ্বনি দীর্ঘ হয়।”৩০৬ সিলেটিতেও মান বাংলার থেকে ভিন্ন তেমন কিছু হয় বলে মনে হয় না। ‘ʔআরাও’ (< হারাও) এবং ‘ʔআর’ (হার)—প্রথমটিতে ‘আ’ হ্রস্ব এবং শেষেরটিতে দীর্ঘ—কয়েকবার উচ্চারণেই বোঝা যায়।এখন কেউ যদি ‘আলি’(প্রত্যয়,ঘর+আলি) এবং ‘আ’লি’ (<হালি,ধানের চারা)—র মধ্যে তুলনা করে ভাবেন,দ্বিতীয়টিতে ‘আ’-এর উচ্চারণ দীর্ঘ তবে অতিপৃথকীকরণের ভ্রমে পড়বেন। কারণ দ্বিতীয় শব্দের ‘আ’ ’ আসলে তো সিলেটি রুদ্ধ-স্বরপথ ব্যঞ্জন ধ্বনি ‘ʔআ’।
।। সিলেটি ধ্বনিতত্ত্ব এবং বাংলা - অসমিয়া ভাষা বিতর্ক ।।
এই অব্দি যেটুকু আলোচনা করে এলাম তাতে অসমিয়া এবং সিলেটির ধ্বনিতাত্ত্বিক প্রসঙ্গ নিয়ে ড০ উপেন রাভা হাকাচামের সূত্রগুলো বোঝা আমাদের পক্ষে সহজ হয়ে আসবে।অন্যান্য উৎসের সঙ্গে তাঁর অন্যতম তথ্য সূত্র ছিল গ্রিয়ার্সনকৃত ভারতের ভাষা সমীক্ষা। সেখানে বাবা এবং তাঁর দুই ছেলের যে বাইবেলীয় গল্পের বিভিন্ন ঔপভাষিক রূপ রয়েছে,এখন অব্দি যে অধিকাংশ বাঙালি ভাষাবিদেরও ভাষাবৈচিত্র্য চর্চার মূল আশ্রয় সেই গল্পটি। গ্রিয়ার্সন আরো কিছু কথা ও কাহিনির আশ্রয় নিলেও তাঁরা সেগুলো বিশেষ ব্যবহার করেন নি। কিন্তু এর কোনোটিই যে খুব নির্ভরযোগ্য নয়, সেই কথা আমরা এর আগের অধ্যায়ে উল্লেখ করেছিলাম।তাঁকে মান বাংলার নজির নিয়েই বেশ বিপাকে পড়তে হয়েছিল। প্রথম যে নজিরটি বইতে হাতে লেখাই উদ্ধার করেছেন,সেটি স্পষ্টই সাধু বাংলাতে লেখা।৩০৭ পরে যে মহিলার ভাষা বলে নমুনা দিয়েছেন,সেটিই চলিত মান বাংলা।৩০৮ এর সঙ্গে মেলে তৃতীয় নমুনা যেটি তৈরি করেছিলেন হাওড়ার পণ্ডিত মহেশ চন্দ্র ন্যায় রত্ন।৩০৯ড০ উপেন রাভা হাকাচাম এতো খুঁটিয়ে দেখেন নি।তিনি সাধুটিকেই ব্যবহার করে যেভাবে তর্কটিকে উপস্থিত করেছেন,আমরা সেগুলো নিয়ে এবারে আলোচনা করছি একে একে। ১) শ ষ স ধ্বনি: ড০ উপেন রাভা হাকাচাম লিখেছেন “বাংলা শ ষ স ধ্বনি চিলেটীয়াত হ হয়।এই ধ্বনি কেইটা নিম্ন শ্রেণির অসমীয়ার মুখত হ আরু আঢ্যবন্ত অসমীয়ার মুখত কোমল হ উচ্চারিত হয়। উদাহরণ—বাংলা সাপ,শশুর,সকল,সার শালি, মানুষ,পিশী,সে > চিলেটীয়াঃ হাপ,হউর,হকল,হার,হালি,মানুহ,পিহী,হে। সেই দরে শুনা,বসা,শিখা,আসা আদি ধাতুরো উচ্চারণ প্রায় অসমীয়ার দরে হয়।” ৩১০ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন,“In earlier Assamese,inter-vocal [Ś] became [ɦ ],and in recent Assamese single [Ś] initial or intervocal is pronounced as guttural spirant [x], although written শ, ষ, স « ś,ş,s ».East Bengali partly agrees with Assamese in turning [Ś] to [ ɦ ]”.৩১১ ‘ঐক্যে’র উৎসাহে ড০ হাকাচাম এই ‘partly agrees’ কথাটা খেয়াল করেন নি। এর মানে তিনি নিজের উদাহরণেই খোঁজে পেতেন। তাঁর উদাহরণের প্রায় সমস্ত শব্দে ‘শ,স' ধ্বনিগুলো শব্দের শুরুতে রয়েছে। ‘মানুহ’,‘পিহী’ র মতো নাম শব্দ কিংবা ‘বস’ ক্রিয়াপদ সিলেটিতে নেই। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন,“ [ ɦ ] cannot occur in Bengali as a final sound in a syllable:it must either have a vowel to prop itself up,or it must be dropped:and occasionally,it is changed to a semivowel [ ĕ],or to [ì ].”৩১২ সিলেটিতে অসমিয়াকে আংশিক অনুসরণ করে অক্ষরান্ত [শ, স] [হ] -তে পরিণত হয় ঠিকই। কিন্তু তার পরেই সে বাংলার ধর্ম অনুসরণ করে লোপ পেয়ে যায়। তাই সিলেটি শব্দগুলো হলোঃ মানু,পি’ই,বা’ ( বাঁশ) ইত্যাদি) ।সঞ্জীব দেব লস্কর নজির দিয়েছেন,গোরুয়ে ঘা খাইন না।অর্থাৎ,গরু ঘাস খাচ্ছে না। পুলিশে লাগাল পাইলে বা হারাইব। অর্থাৎ,পুলিশে ধরলে বাঁশ দেবে।”৩১৩ জগন্নাথ চক্রবর্তী লিখেছেন,“... ‘হ’ আদ্য নিজস্ব প্রচুর শব্দ ছাড়াও আদর্শ বাংলার অনেক আদ্য শিসধ্বনি [শ,ষ,স] বরাকে ‘হ’ ধ্বনিতে পরিণত হয়েছে।”৩১৪ অর্থাৎ পদ মধ্য কিংবা পদান্ত [শ,ষ,স] এর কোনো রূপান্তরের কথা তিনি বলেন নি।পদান্ত [শ,ষ,স]- এর ‘হ’-তে রূপান্তর এবং শেষে বিলোপের প্রবণতা প্রাকৃতেই ছিল।এবং মান বাংলাতেও তার রেশ একেবারেই অপরিচিত নয়। যেমনঃ স্নেহ> প্রাঃ ণেই বা নেই > নাই> একেবারে আধুনিক বাংলা--লাই। তেমনি: রাধিকা> প্রাঃ রাহিআ> প্রা-বাঃ রাহী > মধ্য ও আধুনিক বাংলা রাই । সং: নাসিৎ> প্রাঃ ণাহি > বাঃ নাই। সংস্কৃত পঞ্চদশ থেকে বাংলা পনের হবার কাহিনিও একই। সিলেটির মতোই ঢাকার বাংলাতেও ঘটনাক্রম প্রায় একই রকম ঘটে।একটি ঢাকাই রসিকতা নিখিলেশ পুরকাইত উল্লেখ করেছেন,“তোরা ঢাকার লোক ‘স’-কে নাহি ‘হ’ বলিস? কোন হালায় কয়? এই তো বল্লি।তর হুননেরই ভুল।”৩১৫মুহম্মদ আব্দুল হাই লিখছেন,“.../শ/ধ্বনিটি প্রায়ই /হ/ হয়ে যায়,যেমন/হাগ/= ‘শাক’ অর্থে,/হউন/= ‘শকুন’ অর্থে...।”৩১৬তিনি আরো লিখছেন,“শব্দের মূলধ্বনি /হ/ প্রায়ই লুপ্ত হয়। যেমন/আত/=হাত অর্থে।/অয়/=‘হয়’ অর্থে”৩১৭ শব্দের মূলেই যদি আদিতে /হ/ থাকে তবে সিলেটিতেও ঘটনাক্রম একই পথে এগোয়। ‘হাত’ হয়ে যায় ‘ʔআত’,‘হয়’ হয়ে যায় ‘ʔঅয়’,‘হাইলাকান্দি’ ‘ʔআইলাকান্দি’ ইত্যাদি।এই কথাগুলো অবশ্যি উপেন রাভা হাকাচামও বেনুধর রাজখোয়ার সূত্র থেকে উল্লেখ করেছেন।৩১৮ কিন্তু বেনুধর রাজখোয়া ভোট-বর্মীমূলীয় মিশিং জনজাতিদের উচ্চারণ প্রবণতার সঙ্গে এর সাদৃশ্যের সন্ধান করেছেন।যখন কিনা ঢাকার মতো পুব বাংলার যে কোনো বাংলা ভাষাবৈচিত্র্যেরই এ এক সাধারণ প্রবণতা।মিশিংদের একাংশের মধ্যে প্রচলিত অসমিয়াকে ড০ উপেন রাভা হাকাচাম বলেন মিশিংমিজ। সেখানে তিনি যা বলছেন তার অর্থ অবস্থান নির্বিশেষে মিশিংমিজে ‘হ’ লোপ পায়,সিলেটির মতো কেবল আদ্য অবস্থানে নয়।৩১৯ [হ] লোপ পেয়ে দ্বিস্বরে পরিণত হবার যে কথাটি সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলছেন সেটি সিলেটিতেও সত্য। আর ঢাকাইয়া সম্পর্কে আব্দুল হাই লিখছেন,“ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব অনুসারে /শ/ এর /হ/ য়ে পরিবর্তন এবং তারপরে /হ/ লোপের ফলে দ্বিধ্বনিপরিবর্তনের ( Double sound change) দৃষ্টান্তও এ উপভাষায় বিরল নয়,--/বসা/ > /বহা/ > /বওয়া/।”৩২০ √বস ধাতু জাত অসমিয়া ‘বহ,বহক’ শব্দগুলো সিলেটিতে দাঁড়ায় ‘বও,বইন,বউক্কা’।√আস ধাতু জাত অসমিয়া ‘আহ,আহক’ শব্দগুলো সিলেটিতে দাঁড়ায় ‘আও,আইন,আউক্কা’। ( অসমিয়া ‘-অক’ এবং সিলেটি ‘-উক্কা’ বিভক্তিটি লক্ষণীয়,সেটি আমরা রূপতত্ত্বে আলোচনা করব।) অন্যদিকে আবার আদ্য ‘হ’-এর স্বরূপ অবস্থানের ফলে চট্টগ্রাম কিংবা নোয়াখালির কিছু শব্দ বরং অদ্ভুত ভাবে অসমিয়ার সঙ্গে মিলে যায়। যেমন অসমিয়া ‘সিহঁত/ সিহঁতি’-র (মান বাংলা ওরা,সিলেটি তারা) সাদৃশ্যে চাঁটগেয়ে ‘হিতি’,নোয়াখালিতে ‘হেতি’। দাঁড়ালো এই যে চাঁটগেয়ে বা নোয়াখালির ভাষাবৈচিত্র্য কোথাও কোথাও সিলেটির থেকে অসমিয়া ভাষার বহু কাছের।‘সিহঁত-হিতি-হেতি’ শব্দগুলো ঐতিহাসিকভাবেই পরস্পর সম্পর্কসূত্রে বাঁধা। যেমন সম্পর্ক সূত্রে বাঁধা সিলেটি সহ পুব বাংলার আরো কিছু ভাষাবৈচিত্র্য এবং অসমিয়া প্রথম পুরুষ একবচনে স্ত্রী-লিঙ্গ শব্দ ‘তাই’। বাংলা গদ্যের আদি গ্রন্থগুলোর অন্যতম বলে স্বীকৃত পাদ্রি মানোএল দা আস্সুম্পসাঁউ-র লেখা ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থ ভেদ’ বইটিতে ঢাকার অদূরে ভাওয়ালের উপভাষা ব্যবহৃত হয়েছিল। সুনীতিকুমার এর উচ্চারণ অনুযায়ী রোমান হরফে নাম লিখছেন,‘Crepar Xaxtrer Orthobhed’।৩২১ বইটি বাংলাতে লেখা হলেও হরফ রোমান ব্যবহৃত হয়েছিল। সম্ভবত মূলেই বইটির নাম এরকম লেখা হয়েছিল।সম্ভবত ‘স’ ধ্বনির ‘হ’ উচ্চারণ বোঝাবার জন্যে ‘x’ রোমান অক্ষরের ব্যবহার যে কোনো অসমীয়া লেখকের বহু আগে এই বইতেই প্রথম হয়েছিল। যে বইটির ভাষা ছিল বাংলার ঢাকাইয়া ভাষাবৈচিত্র্য। ২) চ, ছ, জ,ঝ ধ্বনি: ড০ উপেন রাভা হাকাচাম লিখছেন,“চিলেটীয়াত অসমীয়ার দরে চ আরু ছ র পার্থক্য সিমান তীব্র নহয়। সংস্কৃত তৎসম শব্দর স অসমীয়ার দরে চ বা ছ হয় (অবশ্যে তদ্ভবর ক্ষেত্রত অসমীয়াত কোমল হ হয়)। অসমীয়ার দরে চিলেটীয়াতো বাংলা ঝ,জ-র দরে উচ্চারিত হয়। যেনে মাঝে : মাজে,ওঝা : ওজা।”৩২২ প্রসঙ্গটি নিয়ে আমরা ইতিমধ্যে এত দীর্ঘ আলোচনা করে এসেছি, যে আর কোনো আলোচনা বাহুল্য বলেই মনে হতে পারে।আমরা দেখিয়ে এসেছি,সিলেটিতে অসমিয়ার মতো ‘স,জ̣’ দুই উষ্ম ধ্বনি থাকলেও,‘ʔচ,জ̣’ ’ দুই ঘৃষ্ট ধ্বনিও আছে,এবং যুক্তাক্ষরে মানবাংলা ধ্বনিগুলোই উচ্চারিত হয়। এবং আত্মীয়তার সন্ধানে কীভাবে সিলেটির বাইরেও বহুদূর এগোনো যায়।এমন কি মায়ান্মারের আরাকান অব্দি। উপেন রাভা হাকাচামের দুই শব্দই আসলে সিলেটি উচ্চারণে লিখতে গেলে লিখতে হবে,অসমিয়ার মতো দন্ত্যউষ্ম ধ্বনি দিয়ে নয়,দন্তমূলীয় ঘৃষ্ট ধ্বনি দিয়ে এইভাবে ‘মাজে̣’,উজা̣’ ’ /mɐd͡z’e,ud͡z’ɐ/। ঢাকার ভাষাবৈচিত্র্যে বরং ‘জ’ আর ‘ঝ’- এর পার্থক্য অস্বীকার করছেন বাংলার পথিকৃত ভাষাবিজ্ঞানী মুহাম্মদ আব্দুল হাই।তাই যদি হয়,তবে ঢাকার ভাষাবৈচিত্র্য বরং এক্ষেত্রে অসমীয়া ভাষার ঘনিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। আব্দুল হাই লিখছেন,এই দুটোই ঢাকাই ভাষাবৈচিত্র্যতে /য/ = /z/ হয়ে যায়। “...দ্বিত্ব লাভ করলে সাধারণত: /জ্জ/ রূপে উচ্চারিত হয়,তবে /য/ রূপেও উচ্চারিত হতে শোনা যায়।”৩২৩ যেমন: বুঝেছেন = বুজ্জেন,জাজ্জ্বল্যমান= যাজ্জ্বলিমান। ৩) ও, য় তথা অন্তস্থ -ব ধ্বনি: ড০ উপেন রাভা হাকাচাম লিখছেন,“ সিলেটীয়াত অসমীয়ার দরে ৱ ( ও/য়) ধ্বনির উচ্চারণ আছে।অর্থাৎ সিলেটীয়াত বাংলার দরে ৱ -র ঠাইত ব উচ্চারণ নকরে। যেনে--নৱাব (নবাব নহয়),দেৱর (দেবর) নহয়, হাৱর/ হাওর (=বিশাল পথার) বরঞ্চ বানানত য় লিখিলেও ৱ বুলি উচ্চারণ করে। যেনে সোয়াদ: হোয়াদ,গুয়া,পোয়া:পোৱা ইত্যাদি।”৩২৪ বাংলা থেকে স্বাতন্ত্র্য বোঝাবার জন্যে অসমীয়াতে দুটো ধ্বনি রয়েছে।ৰ এবং ৱ। বাংলা র এককালের বাংলা-অসমিয়া ‘ৰ' এর উত্তরসুরী বলে প্রচার আছে। আগেকার বেশ কিছু প্রাচীন বাংলা ফলকে –পুথিতেই ওই অসমীয়া ৰ দেখা গেছে। আমরা পরে দেখাব পুরো বাংলাতে না হলেও রাঢ় বাংলাতে ‘র’-এর ব্যবহার ছিল। যার থেকে মুদ্রণ যুগে পঞ্চানন কর্মকারেরা ‘র’-এর প্রচলন ঘটান। কিন্তু অন্তস্থ- ৱ-এর বাংলা ব্যবহার আমাদের জানা নেই। বাণীকান্ত কাকতি,গোলকচন্দ্র গোস্বামী দু’জনেই মনে করেন,‘অসমীয়াই ৱ আখর এটা তৈয়ার করি লৈছে’ ---আমরা ইতিমধ্যে লিখে এসেছি। কথাটার একটা অর্থ স্পষ্ট যে এগুলো প্রা.ভা.আ. কিংবা বাংলাতে নেই। ড০ উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী তাঁর ‘অসমীয়া লিপি’ গ্রন্থে প্রাচীন বাংলা পুঁথি বা লিপিতে অসমীয়া ৰ এর অস্তিত্বের কথা লিখলেও ৱ-এর সম্পর্কে কিন্তু নীরবতা অবলম্বন করেছেন। লিপিটি যে প্রাচীন অসমীয়া পুঁথি কিংবা তাম্রলিপি গুলোতে ছিল সে তিনি নজির টেনেই দেখাচ্ছেন। কিন্তু সেগুলো ত্রয়োদশ শতকের আগেকার নয়। আমরা সেই নিয়ে পরে স্বতন্ত্র অধ্যায়ে আলোচনা করব।আধুনিক কালে হেমচন্দ্র বরুয়া একে জনপ্রিয় করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।কিন্তু বাণীকান্ত কাকতির ‘অসমীয়াই ...তৈয়ার করি লৈছে’ কথাটার অন্য আরেক অর্থও রয়েছে। অসমিয়াতে লিপিটির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রয়েছে বলেই প্রাচীন ভারতীয় আর্যের মর্যাদাতে ধ্বনিটি অসমিয়াতেও নেই। বাণিকান্ত কাকতি লিখেছেন,“তদ্ভ.আরু তৎ.দুয়োবিধ শব্দতে আদ্য য়-(य) আরু ৱ-ই (व) উচ্চারণত জ-আরু ব-র ধ্বনিমূল্য আহরণ করিছে।”৩২৫ বাংলাতেও প্রায় সব অবস্থানেই এরকম ব্যাপার ঘটেছে বটে।কিন্তু একেবারেই লুপ্ত হয় নি যে সিলেটিতে অন্তস্থ-ব-এর কোনো রকম ব্যবহার দেখলেই বাংলার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে।“পদাদিস্থিত অন্তস্থ [ব-] সর্বদা বর্গীয় [ব-] হইয়াছে”,লিখছেন সুকুমার সেন।৩২৬যে কথাটি বাণীকান্ত কাকতি লিখছেন অসমীয়ার সম্পর্কে।জগন্নাথ চক্রবর্তী বরাক বাংলা (কাছাড়ি ?,সিলেটির বিভাষা?) ‘বয়ার’ শব্দকে ওষ্ঠ্য স্পৃষ্টধ্বনি বলেছেন। লিখেছেন,“ ব-ধ্বনি এখানে মূলানুগ বলতে পারি। বরাক বাংলায় এর কোনো উচ্চারণ বৈলক্ষণ্য ঘটেনি।”৩২৭ তিনি আরো জানাচ্ছেন,স্বরমধ্যবর্তী অন্তস্থ [ব-] সাধারণত লোপ পেয়েছে,কখনো কখনো সেটি শ্রুতিধ্বনি রূপে [ও] হয়ে গেছে। এখানে এসে উপেন রাভা হাকাচামের ‘দেৱর (দেবর) নহয়,হাৱর/ হাওর’ শব্দদুটোর ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। শব্দগুলো দেওর, হাওর (বিশাল জলাজমি,পথার বা ধানের মাঠ নয়) এভাবে লেখা হয়।এই শব্দগুলো শুধু সিলেটিতেই নেই। রবীন্দ্র কুমার দত্ত যে চট্টগ্রামী-নোয়াখালিতে ধ্বনিটি বোঝাতে সরাসরি ‘ৱ’ বর্ণটিই ব্যবহার করেছেন,সে আমরা দেখিয়ে এসেছি। ঢাকাই সহ পুব বাংলার আরো বিভিন্ন ভাষাবৈচিত্র্যে একে পাওয়া যাবে। ‘দেওরা' যেমন। আব্দুল হাই লিখছেন ‘ʔআওর’। সিলেটিতেও উচ্চারণ অনেকটা তাই। প্রাকৃতে উৎপন্ন ব-শ্রুতি প্রায়ই বাংলাতে লোপ পেয়েছে বলেও সুকুমার সেন যেগুলোর উদাহরণ দিয়েছেন সেগুলো আসলে অন্ত অবস্থানের ব-ধ্বনি। যেমন তাপ-তাব-তা।কিন্তু তিনি কিছু ব্যতিক্রমও দিয়েছেন ---নাও,নায়্,গাঁও,দাও।সিলেটিতে তাপ—থেকে ‘তাও' রয়েছে। সে কি খুব একটা দূরের কিছু? সুকুমার সেন কোনো কোনো বাংলা শব্দে লঘু ব-শ্রুতি কথা লিখে বেশ জনপ্রিয় কিছু শব্দের নজির টেনেছেন—খাওয়া, হাওয়া। শব্দগুলো সিলেটিতেও প্রচলিত শব্দ। সেখানে ‘খ’ ধ্বনির উচ্চারণ স্বাতন্ত্র্য থাকলেও ‘ওয়া’র নেই বিশেষ। ‘গাওয়া ঘি’ সিলেটিতে চেনা শব্দজোড়। ‘সোয়াদ:হোয়াদ,গুয়া,পোয়া: পোৱা’ শব্দগুলো অসমিয়ার মতোই বটে,কিন্তু বাংলার থেকে মোটেও বেশি দূরের নয়। ‘গুয়া’র বদলে মান বাংলাতে ‘সুপারি' বেশি প্রচলিত হলেও ‘গুয়া' একেবারেই অচেনা শব্দ নয়। সাধু বাংলাতেই পাওয়া যাবে এমন বাক্য,“তাহার পর,ফুটফুটে’ চাঁদের আলোয় আগুন-পুরুতে সম্মুখে,গুয়াপান,রাজ-রাজত্ব যৌতুক দিয়া,রাজা পঞ্চরত্ন মুকুট পরাইয়া রাজপুত্রের সঙ্গে রাজকন্যার বিবাহ দিলেন।চারিদিকে জয়ধ্বনি উঠিল।” (ঘুমন্ত পুরী,ঠাকুরমার ঝুলি)। এই শব্দগুলোর মতো শুয়া (শোয়াবসা;সিলেটি শওয়া বওয়া),মোয়া-- মান বাংলার বহুচেনা আর প্রচলিত শব্দ। শব্দ শেষে ‘য়া’ না ‘ওয়া’ হবে সেটি নির্ভর করে পূর্ববর্তী স্বরের উপর। এগুলো আসলে প্রতিস্থাপনযোগ্য অর্ধস্বরধ্বনি।এই শব্দগুলোতেও য়-শ্রুতি শব্দের শুরুতে নেই। বাণীকান্ত কাকতি যেকথাগুলো অসমিয়ার ক্ষেত্রে লিখেছেন,একই কথা সুকুমার সেন বাংলার ক্ষেত্রেও লিখেছেন। মধ্য অবস্থানের সম্পর্কে সুকুমার সেন লিখছেন, [-য়] লুপ্ত হইয়াছে যেমন: ছায়া> ছা। সিলেটিতে এই শব্দটিও রয়েছে। অসমীয়াতেও অনেক সময় ঘটনা সেরকম ঘটেছে। যেমনঃ ছাঁ। কিন্তু সিলেটিতে ‘ছেওয়া/ ছাওয়া’ও রয়েছে। তেমনি রয়েছে ‘বাওয়া’(বাবা অর্থে)। জগন্নাথ চক্রবর্তীকে মানতে হলে অবশ্যি ড০ উপেন রাভা হাকাচাম একেবারেই অস্বীকৃত হয়ে পড়েন। সেক্ষেত্রে মান বাংলাকেই অসমীয়ার কাছাকাছি ভাষা বলতে হয়।তিনি লিখেছেন,“বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলায় 'শ্রুতিধ্বনি-ব’ বা ‘ব-শ্রুতি’র তাৎপর্যই আলাদা। মানবাংলার ব-শ্রুতি আসলে ‘অন্তঃস্থ ব-শ্রুতি’। ‘ওয়’ বা ‘ও’-কারের সাহায্যে এই ধ্বনিকে নির্দেশ করা হয়। যেমন,পা+আ>পাওয়া...কিন্তু বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলায় মানবাংলার ‘অন্তঃস্থ ব-শ্রুতি’ খাঁটি ব-শ্রুতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। অর্থাৎ ‘ওয়’ বা ‘ও’ এখানে পুরোপুরি ‘ব’ ধ্বনিতে পর্যবসিত হয়েছে। যেমন,খা+আ> খাবা (=খাওয়া),দে+আ > দেবা (= দেওয়া),বা+আ> বাবা(=বাওয়া),ছা+আ>ছেবা(= ছায়া)।”৩২৮ কাছাড়ি বিভাষাতে এগুলো সত্য হলেও বিকল্প মান বাংলার শব্দগুলো সিলেটিতে প্রচলিত শব্দ। উচ্চারণ বৈচিত্র্য বরং আদ্য বর্ণগুলোতে চোখে পড়ে। এই অর্ধস্বর বা যৌগিক স্বরধ্বনিগুলোর সাদৃশ্য দেখিয়ে যদি সিলেটিকে অসমিয়ার দিকে টেনে নিতে হয়,তবে কিন্তু অসমিয়াকে বাংলার দিকেও টেনে নিয়ে যাবার সম্ভাবনা পূর্ণমাত্রাতে সম্ভব হয়ে উঠবে। বিশ শতকের শুরু অব্দি যা কিছুদিন হয়েও ছিল। কিন্তু এগুলো ভাষাতত্ত্বের যুক্তি নয়। ‘ভাষারাজনৈতিক’ যুক্তি। ৪) ও-কারের উ-কারে পরিবর্তন: ড০ উপেন রাভা হাকাচাম লিখেছেন ‘অসমর গ্রামাঞ্চলর লোকে করার দরে সিলেটর গ্রামাঞ্চলর লোকেও ও ধ্বনিক উ র দরে উচ্চারণ করে। যেনে—চোর : চুর,তোমার : তুমার,টোকা: টুকা।৩২৯ মোটের উপর তিনি ঠিকই লিখেছেন। কিন্তু সর্বত্র ও উ-তে পরিণত হয় না,কাছাকাছি চলে আসে মাত্র।তাঁর ‘গ্রামাঞ্চলে'র কথাটা বড় বিভ্রান্তিজনক। ভাষাবৈচত্র্যের নাম নিলে সুবিধে হত। কারণ,সমস্ত গ্রামাঞ্চলের উচ্চারণ প্রবণতা এক নয়। তাছাড়া স্বরধ্বনিগুলোর আচরণের সাধারণ প্রবণতার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে কিছুই স্পষ্ট হয় না।অসমীয়াতে উ-কারের ও-কার প্রবণতা ব্যাপক (যেমন তাম্বুল=তামোল),স্বরসঙ্গতির জন্যে কখনো বা উল্টোটা হয় (যেমন কোষ=কুঁহি)।মানবাঙলাতেও স্বরসঙ্গতির এমন উদাহরণ ব্যাপক। বস্তুত সমগ্র ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলোরই এ এক সাধারণ প্রবণতা। নাম বা ক্রিয়াপদের গুণ ধর্ম পাল্টালেই এই ব্যাপারগুলো ঘটে । সুনীতি কুমার নজির টেনেছেন, “...the root দুল [dul] to swing has [u], but the verbal noun by «guņa» in OIA. Has [o] –দোল [do:l] a swing,--also the casuative দোলাই [ dolai] I cause to swing...”৩৩০লিখেছেন,“Alternances of [i] and [u] with [e] and [o] through Vowel-Harmony is a most important thing in New Bengali....”৩৩১ এর কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন,“This is due to partly to the low position of the Bengali [i] and [u] vowels.”৩৩২ অন্যদিকে জগন্নাথ লিখছেন,“মানবাংলা থেকে এখানে এই ধ্বনির (ও/o/--গবেষক) অবস্থান সামান্য উচ্চে।৩৩৩তাই তিনি স্বীকার করছেন,“বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলায় এই স্বরধ্বনি (ও /o/-লেখক) অনেকটা ‘উ’ ধ্বনির কাছাকাছি উচ্চারিত হয়।”৩৩৪ ধ্বনিগুলোর এমন ঊর্ধ্বায়নের ফলেই মান বাংলা,ছায়া এখানে হয় ছেবা/ ছেওয়া,বাঁকা হয় বেঁকা,টাকা হয় টেকা ইত্যাদি।৩৩৫ টাকা থেকে অসমিয়াতে 'টকা'ও এই ঊর্ধ্বায়নের পরিণাম। ৫) র এবং ড় ধ্বনি : মোটের উপর সঠিক ভাবেই ড০ উপেন রাভা হাকাচাম লিখেছেন,“চিলেটীয়াতো অসমীয়ার দরে র আরু ড়-র মাজত উচ্চারণ পার্থক্য নাই। যেনে বড় : বর,বাড়ী : বারি।”৩৩৬ কিন্তু বাংলার ভাষাতাত্ত্বিকেরা জানেন যে শুধু সিলেটি নয় পুব বাংলার প্রায় কোনো ভাষাবৈচিত্র্যতেই অসমিয়ার মতো ‘ড়' এর উচ্চারণ নেই,রয়েছে ‘র’।আমরা এসব দেখিয়েছি ইতিমধ্যে।কিন্তু নোয়াখালির কোথাও এবং বরাক উপত্যকার ভাষাতে ‘ড়’-এর স্থিতি নিয়ে রবীন্দ্র কুমার দত্ত,জগন্নাথ চক্রবর্তীর অভিমতও উল্লেখ করে এসেছি।শব্দের আদিতে ‘ড়’-এর ব্যবহার নেই। তাই ‘ড়’তে শুরু হওয়া কোনো শব্দ তাঁর অভিধানে নেই। কিন্তু মাঝে বা শেষে রয়েছে। সেখানে তিনি স্পষ্ট ড় এবং র-এর ব্যবধান দেখাচ্ছেন। যেমন থুর (কলার মোচা),থুড়থুড়া(জরাভাব সূচক),থুড়থুড়ি(বুড়ি দুদু থুড়থুড়ি/হাড়ি পিনদে নকুড়ি-- বরাক প্রবাদ)৩৩৭।কিন্তু আগ্রহ ব্যঞ্জক শব্দ ‘থুড়া’ (সামান্য)। এর সমর্থনে তিনি বরাক বাংলা বাক্য লিখছেন, ‘মোরে থুড়া নুন দিও।’ এর পরেই তাঁর বরাক বাংলা যে সিলেটি থেকে ভিন্ন তার প্রমাণ স্বরূপ উল্লেখ করছেন শ্রীহট্টে শব্দটি ‘থুরা’। এই প্রবাদের ‘মোরে’ সিলেটিতে অপরিচিত শব্দ,অসমিয়াতে পরিচিত।কিন্তু ‘থুড়া’র ‘ড়’ অসমিয়ার ঘনিষ্ঠ হবার শর্ত ভাঙছে। ড০ উপেন রাভা হাকাচামের উল্লেখিত দুটি শব্দের মধ্যে আশ্চর্য রকম ভাবে বাসা অর্থে ‘বাড়ি’ শব্দটি জগন্নাথে নেই। সেখানে আছে আঘাত অর্থে। ‘বারি’ শব্দটির অর্থ কার্যার্থে নির্ণীত সময় পরম্পরা। পালা,পর্যায় (এলকু কার বারি?)৩৩৮ তেমনি আশ্চর্য রকম ভাবে জ্যেষ্ঠ অর্থে ‘বড়’ বা ‘বর’ কোনো শব্দই নেই। ‘বর’ শব্দের অর্থ পানের খেত। শব্দটি অস্ট্রিক ‘বরোজ’ উৎসজাত এই তথ্যের উল্লেখ তিনি করছেন,অর্থাৎ সংস্কৃত ‘বর’ উৎসজাত নয়।‘বড়’ আলাদাভাবে অভিধানটিতে না থাকলেও ‘বড়ন’ আছে। অর্থ বড়ঠান,বড় ঠাকরুণ,বাবার মা। তেমনি আছে ‘বড়া’,(বরা নয়) পিষ্ট খাদ্যদ্রব্যের ভাজা ছোট ছোট পিণ্ড বিশেষ।‘শাড়ি,গাড়ি,কাপড়’-এর মতো বহু চেনা শব্দগুলো এই অভিধানে নেই কেন,সে এক প্রশ্ন থেকেই যায়। আমরা এর একটা জবাব সন্ধানের চেষ্টা ইতিমধ্যে করে এসেছি। তিনি ‘ড়’এর বিকল্পে ‘র’-এর ব্যবহার নিয়ে বিশেষ ভাবেন নি।মধ্য বা অন্ত্য অবস্থানে ‘ড়’ নিয়ে প্রচুর শব্দ রয়েছে এটি সত্য। যেমন ‘সাধুগিরি’জাত শব্দ ‘শাউকাড়ি’ স্পষ্টতই সিলেটিতে ‘র’ অন্ত শব্দ। ‘বাঙ্গালনামা’তে সঞ্জীব দেব লস্কর ডিমাছা রাজাদের চিঠিপত্র থেকে পুরোনো বাংলা গদ্যের যে নমুনা দিয়েছেন,তাতে আছে,“আর বড়খলার চান্দলস্করর বেটা” ‘বরখলা’ নয় কিন্তু। সঞ্জীব তেমনি আরো বেশ কিছু ‘ড়’ অন্ত শব্দের উল্লেখ করেছেন,যেমন: চিনেনা ভুবির গুড়ি বিয়া করতে চায় মৌলবির পুড়ি। কিন্তু জগন্নাথে বাঁশের নাম ‘বরুয়া’ আছে,আছে বেষ্টন অর্থে ‘বেরা’,বেড়া নয়। আমরা তাই এই সিদ্ধান্তে এখনো অনড় যে ‘ ‘ড়’-এর ‘র’ পরিণতি যদি অসমিয়া এবং সিলেটি দুই ভাষার মিলন চিহ্ন হয়, তবে অসমিয়াতে ‘ঢ়’ এবং সিলেটি ‘ড়’-এর স্থিতি দুই ভাষার প্রভেদ চিহ্নও বটে।’ ঢাকার ভাষাবৈচিত্র্য সম্পর্কে আব্দুল হাই কিন্তু স্পষ্টতই লিখছেন,“দন্তমূলীয় প্রতিবেষ্টিত ঘোষ স্বল্পপ্রাণ ও মহাপ্রাণ তাড়ন জাত /ড়/ ও /ঢ়/ ধ্বনি ঢাকাই উপভাষায় নেই।এ ধ্বনি দুটির জায়গায় ‘র’ ব্যবহৃত হয়।শিক্ষিত লোকের মুখে মাঝে মাঝে /র/ ও /ড়/ দুটিই শোনা যায়।”৩৩৯ ঢাকার ভাষাবৈচিত্র্যের নজির যেমন,বিয়ার কয়দিন বাদে হ্যার হউর বারিত হ্যার নিমন্তন অইলো। ৬) স্বরধ্বনির ক্ষতিপূরণ দৈর্ঘীকরণ /এ,ও/ -র /আ/তে রূপান্তর : ড০ উপেন রাভা হাকাচাম লিখছেন,“অসমীয়ার দরে ক্ষতিপূরণ দৈর্ঘীকরণ হিচাপে রৈ যোয়া অন্ত্য আ-র প্রয়োগ আছে,যিটো বাংলাত এ বা ও হয়। যেনে মিঠা (বাংলা মিঠে), তিতা ( বাংলা তিতো),বিয়া (বাংলা বিয়ে),কন্যা (বাংলা ক’নে)।”৩৪০ এই মাত্র আমরা দেখালাম ঢাকার ভাষাবৈচিত্র্যতেও অসমিয়ার মতো ‘বিয়া’ হয়,বিয়ে নয়। আব্দুল হাই দেখিয়েছেন,কর্তৃকারকে এক বচনে দুএকটি শব্দ ছাড়া ঢাকাইয়াতে শব্দের শেষে ‘এ' ধ্বনির ব্যবহার নেই,ও-কারের একেবারেই ব্যবহার নেই।সুতরাং মিঠে,বিয়ে,কনে ঢাকার ভাষাবৈচিত্র্যতেও থাকবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। সিলেটি ‘কন্যা’ একটি কষ্ট কল্পিত শব্দ।ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্রের অন্যতম রাশিনাম কন্যা।সত্যজিৎ রায়ের এক বিখ্যাত ছায়াছবির নাম ‘তিনকন্যা’। ‘কন্যা’ অর্থে এখন যদিও বিয়ের কনেও বোঝায় এর আসল অর্থ বারো বছরের অবিবাহিত কুমারী।অপিনিহিতির ফলে সিলেটিতে শব্দটি দাঁড়ায় ‘কইন্না’ (বাইক্ক,যইজ্ঞ-যেমন)। কখনো বা ‘ন’-এর দ্বিত্বও হয় না।অসমিয়ার মতোই ‘কইনা’ শব্দ সিলেটিতেও ব্যবহৃত হয়,ঢাকাইয়াতেও। তফাত থাকে কেবল শ্বাসাঘাত আর সুরের ব্যবহারে।সুনীতিকুমার লিখছেন,“the ‘Crepar Xaxtrer Orthobhed’ being in the Dacca dialect,indicates epenthesis quite regularly:e.g., «coina» = কন্যা ( kanyā)”৩৪১ এধরণের অপিনিহিতি অসমীয়াতেও অপরিচিত নয়। লক্ষ থেকে লইকখ;অজ্ঞান থেকে অইগগান,রাজ্য থেকে রাইজ,বাক্য থেকে বাইক,অবাক্য থেকে অবাইক হয়ে ‘অবাইচ’ এগুলো বহু চেনা অপিনিহিতির নজির। কিন্তু কইরা,রাইকখা-র মতো ঢাকার ভাষাবৈচিত্র্যতে সুলভ,সিলেটিতে নয়। সিলেটিতে শব্দগুলো সাধু বাংলার মতো--করিয়া,রাখিয়া। বিবাহ থেকে জাত পূর্ব বাংলা ভাষাগুলোর এবং অসমিয়ার ‘বিয়া’ শব্দে যে ব্যঞ্জনের ক্ষয় থাকলেও দৈর্ঘীকরণ নেই এত একেবারে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।একমাত্র মিষ্ট থেকে মিঠা,তিক্ত থেকে তিতা-তে ব্যাপারটা সত্য হতে পারে।কিন্তু সাধারণত দৈর্ঘীকরণ হয় লুপ্ত ব্যঞ্জনের আগের হ্রস্বস্বরের। ভক্ত থেকে যেমন ভাত,সপ্ত থেকে সাত,কর্ম থেকে কাম,কিংবা ধর্ম থেকে ধাম।মিঠা,তিতা-তে সেরকম ঘটনা ঘটেছে কি?আমাদের মতে এগুলো অন্ত্য স্বরাগমের পরিণাম। সংস্কৃত ‘দিশ’ থেকে সিলেটি (এবং মান বাংলাতেও) ‘দিশা’ যেমন (তার পরে আবার স্বরসঙ্গতির ফলে ‘দিশে’)। মান বাংলাতে ড০ উপেন রাভা হাকাচাম যেমন লিখেছেন শব্দটি ‘তিতো’ নয়,‘তেতো’। স্পষ্টই এটি ‘তিতা’র পরবর্তী রূপান্তর এবং অন্যোন্য সরসঙ্গতির নজির।অর্থাৎ যেখানে স্বরধ্বনিগুলো পরস্পরের প্রভাবে দুটোই পালটে গেছে। দুটো ধ্বনিরই অবস্থান অর্ধ সংবৃত উচ্চ-মধ্য।আমাদের বক্তব্য হচ্ছে,বাকি শব্দগুলোও স্বরসঙ্গতির ফলে মান বাংলাতে পরিবর্তিত হয়েছে।‘কইনা'র ক্ষেত্রে অভিশ্রুতি হয়েছে। দেখা গেলো, সাদৃশ্য দেখাতে গিয়ে ড০ উপেন রাভা হাকাচাম কিছু ভুল শব্দের উল্লেখ করেছেন,এবং ধ্বনি পরিবর্তনের এক ভুল সূত্রের উল্লেখ করেছেন।এরকম মিল দেখাবার আগ্রহ এক পক্ষকে তুষ্ট করলেও অন্য পক্ষমাত্রেই বিব্রত বোধ করে। এবং সব পক্ষেরই ভাষাতাত্ত্বিকেরা বিব্রত বোধ করেন। ৭) পদান্ত স্বরলোপ: ড০ উপেন রাভা হাকাচাম লিখেছেন,“ব্যঞ্জনান্ত রূপর প্রতি দুর্বলতা বেছি (বাংলার অ-কারান্ত দুই-এক শব্দ বা রূপ চিলেটিয়াত ব্যঞ্জনান্ত হয়)।যেনে-- আছিল,খাইছিল,দিছিল।কিন্তু বাংলাত ছিল(-অ),খাইছিল(-অ),দিছিল (-অ)।”৩৪২ প্রথম কথা হলো,‘দিছিল (-অ),খাইছিল (-অ) মান বাংলা শব্দ নয়। মান বাংলাতে শব্দগুলো দিয়েছিল (+অ),খেয়েছিল (+অ)।দ্বিতীয়ত,তাঁর ‘দুর্বলতা বেছি’ এবং ‘দুই-এক শব্দ বা রূপ’ স্ববিরোধী হয়ে গেছে।এভাবে কোনো ভাষাতত্ত্বের সূত্র তৈরি হতে পারে না। ভাষাতত্ত্বের ছাত্রমাত্রেই জানেন যে পদান্ত স্বরলোপ আধুনিক বাংলা-অসমিয়াতে ব্যাপক।সুনীতি কুমার৩৪৩এবং বাণীকান্ত কাকতি৩৪৪দু’জনেই এই কথা লিখেছেন।‘টালত মোর ঘর নাহি পড়িবেশি’ চর্যার এই চরণের প্রত্যেকটি শব্দ স্বরান্ত ছিল,না বলে দিলে সম্ভবত এখন কোনো বাঙালি অসমিয়া চরণটি শুদ্ধভাবে পড়তেই পারবেন না,ওড়িয়ারা পারবেন। তৃতীয়ত,ড০ উপেন রাভা হাকাচাম যে নজিরগুলো টেনেছেন সেগুলো সব ক’টাই ক্রিয়াপদ।‘-ছিল’ একটি ক্রিয়া বিভক্তি। এর বাকি আলোচনা রূপতত্বেই হতে পারে।চর্যার ‘টালত' শব্দটি মান বাংলাতে স্বরহীন করে কেউ পড়বেন কিনা আমাদের সন্দেহ। কেননা,এর আধুনিক রূপ যদি হয় ‘টিলাত্’ , তবে সিলেটি অসমিয়াতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু মানবাংলাতে হবে ‘টিলাতে’। তেমনি ‘বাড়িত্,ঘরত্' অথচ মান বাংলাতে ‘বাড়িতে,ঘরে’। কিন্তু এখানেও এই ‘ত্’ কিংবা ‘এ’ হচ্ছে কারক বিভক্তি সুতরাং রূপতত্ত্বের আলোচনার বিষয়। কিন্তু ড০ উপেন রাভা হাকাচামের স্বরান্ত ‘খাইছিল (+অ),দিছিল (+অ)’ শব্দগুলো,এমন কি ‘আছিল’ একেবারেই উৎস বিহীন শব্দ নয়।অসমিয়াতেও শব্দগুলোর বানান একই রকম,এবং পূর্ব বাংলার ঢাকা,নোয়াখালি,কুমিল্লার ভাষাবৈচিত্র্যতে শব্দগুলো স্বর-সহ কিংবা স্বরহীন দুই রূপেই পাওয়া যাবে। এমন কি ঢাকার ভাষাবৈচিত্র্যতে ‘বারিত্’ শব্দটির নজির আমরা পঞ্চম সূত্র ব্যাখ্যার সময় দিয়েই রেখেছি।সমস্যা হচ্ছে, এই প্রতিবেশি বাংলা ভাষবৈচিত্র্যগুলো অধিকাংশ অসমিয়া ভাষাবিদ অধ্যয়ন করেন না, অথচ ভাষাগুলো অসমেও আছে। এগুলোর অধ্যয়ন অসমিয়া ভাষারও বহু নতুন রহস্য খুলে দিতে পারে। ৮) ই-কার এবং উ-কারের আগম তথা অপিনিহিতি: ড০ উপেন রাভা লিখেছেন,“কামরূপীর দরে চিলেটিয়াতো আপিনিহিতির প্রয়োগ সর্বাধিক;যিটো বাংলার লগত নিমিলে। যেনে-বেইল( অসমীয়াঃ বেলি,বাংলা: বেলা) রাইত(অসমীয়া রাতি,বাংলা: রাত),সইত্ত (অসঃ সইত),দেইখ্যা < দেখ+ ইয়া তু কামরূপীঃ দেইখছা < দেখ+ ইছা, ইত্যাদি।”৩৪৫ অপিনিহিতি অসমীয়াতেও অপরিচিত নয় এই কথাটা আমরা আগেই লিখেছি,তেমনি লিখেছি কেবল সিলেটি নয়, সমস্ত পূর্ব বাংলার ভাষাবৈচিত্র্যতেই অপিনিহিতি ব্যাপক।বস্তুত ড০ উপেন রাভা হাকাচামের ‘দেইখ্যা’ শব্দটি ঢাকা,কুমিল্লা,ময়মনসিংহের ভাষাবৈচিত্র্যতে বেশি ব্যবহৃত শব্দ।কুমিল্লার প্রতিবেশী মহকুমা হওয়াতে হবিগঞ্জ,মৌলবীবাজার এবং এখনকার ধর্মনগরাদি উত্তর ত্রিপুরার সিলেটিতে এমন ক্রিয়াপদের দেখা মেলে। সদর সিলেট,বা কাছাড়ে এহেন ক্রিয়াপদ সুপ্রচলিত নয়।প্রাক ব্রিটিশযুগের বাংলা সাহিত্যেও শব্দটি অচেনা ছিল না,“দেইখ্যা আইলাম তারে সই,দেইখ্যা আইলাম তারে। একই অঙ্গে এতো রূপ নয়ানে না ধরে...” (জ্ঞানদাস) সিলেটিতে শব্দটি ‘দেখিয়া’--এতে কোনো অপিনিহিতি নেই। ‘সইত্ত’ সিলেটিতে ব্যবহৃত হয় বটে,কিন্তু ঢাকার ভাষাবৈচিত্র্যতেই শব্দটির ব্যবহার ব্যাপক,সিলেটিতে সাধারণ প্রচলিত শব্দটি অসমিয়ার ঘনিষ্ঠ ‘হাচা’(= অসমিয়া সঁচা)। কেবল কামরূপী নয়,বাণীকান্ত কাকতির মতে,“... পশ্চিম অসমর কথ্যর ই এটা বিশেষত্বপূর্ণ লক্ষণ।ই ইমান বেছিকৈ প্রচলিত যে শব্দ একোটাক দ্বিস্বরীকরণ করি চিনিব নোয়ারা করি পেলায়।”৩৪৬ সুনীতিকুমার লিখছেন,“So far as Bengali is concerned,we see a weakeneing of «-i,-u» after «å,ā» in the 14th century;and the beginnings of epenthesis certainly go back to that century.In the 15th century,in the works of Kŗttibasa,Vijaya-Gupta,and the rest,works which are preserved in rather late MSS, epenthesis is a noticeable thing”৩৪৭ তিনি আরো লিখেছেন,“Among the NB. Dialects,epenthesis still retains its force in the Vanga or east Bengal speeches.In standard,Colloquial Bengali,and in west Bengali generally,there has been contraction of epenthetic vowels,as well as Umlaut,which was a direct result of epenthesis in these forms of NB.... the 'Crepar Xaxtrer Orthobhed' being in the Dacca dialect, indicates epenthesis quite regularly: e.g., «coina» = কন্যা ( kanyā)” ৩৪৮। যার জন্যে আমরা লিখেছিলাম,“অভিশ্রুতি এবং অপিনিহিতি বাংলাকে মোটা দাগে পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলাতে ভাগ করে।” এই প্রবণতাই অসমিয়ার কামরূপী ভাষাবৈচিত্র্য অব্দি সম্প্রসারিত হয়েছে বললে খুব মিছে বলা হবে কি? কামরূপের কিংবা পশ্চিম অসমের অসমীয়ার সঙ্গে বাংলার ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে শরৎ চন্দ্র গোস্বামীর বক্তব্য আমরা আগে উল্লেখ করেছি।তিনি লিখছিলেন,“কামরূপীয়া বা গোয়ালপরীয়া মাত কথাতো বঙলুয়াই।যি বিশিষ্ট ভাষার বহির্ভূত।” ‘বঙলুয়া’ কথাটার অর্থ কিন্তু ‘বাংলা’ নয়,বাংলা গন্ধী। বাংলার নিকট সম্পর্কিত।এবারে দেখা যাক স্বয়ং ড০ উপেন রাভা হাকাচাম এ নিয়ে কী লিখছেন। তিনি প্রায়ই সত্যের খুব কাছাকাছি গিয়ে চমকে দিচ্ছেন,“নামনি অসমর অর্থাৎ পশ্চিম অঞ্চলর অসমীয়ার অন্যতম দুটা উপভাষা হৈছে অবিভক্ত কামরূপ জিলাত প্রচলিত কামরূপী উপভাষা আরু অবিভক্ত গোয়ালপারা জিলাত প্রচলিত গোয়ালপরীয়া বা রাজবংশী (দেশী) উপভাষা...উজনি অসমর অর্থাৎ পুব অঞ্চলর উপভাষা (মান অসমীয়া)র সৈতে নামনি অসমর উপভাষাসমূহর বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।...পশ্চিম গোয়ালপারা অঞ্চলত প্রচলিত রাজবংশীসকলর কথিত অসমীয়ার সৈতে উত্তর বঙ্গ অঞ্চলত প্রচলিত কথিত বাংলার পার্থক্য নাই বুলিবই পারি।”৩৪৯ রাজবংশী অসমীয়া না বাংলা না স্বতন্ত্র ভাষা--এই প্রশ্ন কামতাপুর আন্দোলনের ফলে আগামী দিনগুলোতে আরো বেশি বেশি করে উঠছে আর উঠবে। গোয়াল পাড়ার লোকগীত যারা গান করেন,তাদের প্রায়ই দেখা যায় অসম সীমান্ত অতিক্রম করলেই বাংলা লোকগান বলে চালিয়ে দেন।অতিনৈকট্যের ফলে বরং এই সমস্যাগুলোও বড় করে দেখা দেয়। কিন্তু যে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ --- ‘উত্তর বঙ্গ অঞ্চলত প্রচলিত কথিত বাংলার পার্থক্য নাই’ বলে যে ড০ উপেন রাভা লিখছেন সিলেটির সঙ্গে পার্থক্যটা কি তার চেয়েও কম? তা যদি না হবে, তবে সিলেটিকেই শুধু ‘প্রায় অসমিয়া’ করে দেখাবার এতো তোড়জোড় বেমানান।
।। উল্লেখপঞ্জি ।। ১) রামেশ্বর শ’: ধ্বনির শ্রেণীবিভাগ বা বর্গীকরণ;সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা;পুস্তক বিপণি;কলকাতা -৯;অখণ্ড দ্বিতীয় সংস্করণ;৩০শে শ্রাবণ,১৩৯৯;পৃ: ২২৭। ২) ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর: সমগ্র ব্যাকরণ কৌমুদী; সম্পাদক মহামহোপাধ্যায় দুর্গাচরণ সাংখ্য – বেদান্ততীর্থ;দেব সাহিত্য কুটির প্রাইভেট লিমিটেড;কলকাতা -০৯;এপ্রিল ১৯৯৪;পৃ: ২। ৩) ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর;প্রাগুক্ত;পৃ: ২। ৪) ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩। ৫) সত্যনাথ বরা:ভাষা আরু ব্যাকরণ; প্রথম অধ্যায়;বহল ব্যাকরণ;বরুয়া এজেন্সি;গুয়াহাটি-১; সেপ্টেম্বর,১৯৯২;পৃ: ২। ৬) সত্যনাথ বরা;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩। ৭) নবকান্ত বড়ুয়া: শিশু সাহিত্য সমগ্র- ১ম খণ্ড;সম্পাদনা গগন চন্দ্র অধিকারী; অন্বেষা; গুয়াহাটি; প্রথম প্রকাশের দ্বিতীয় মুদ্রণ;মার্চ ২০০৫;পৃ: ২১। ৮) ড০ দেবব্রত শর্মা : অসমীয়া জাতীয় অভিধান, ৪র্থ খন্ড;অসম জাতীয় প্রকাশ;যোরহাট;২০১০; পৃ: ৬৬ । ৯ ) Mina Dan : Sylhet Nāgari: A Linguistic Point of View;Script Identity Region-A Study in Sylhet Nāgari;Editor Anuradha Chanda; Dey’s Publishing , Kolkata; 2013; pg.: 133. ১০) তপোধীর ভট্টাচার্য : সিলেটি উপভাষা: প্রসঙ্গ অনুষঙ্গ;কোরক সাহিত্য পত্রিকা,প্রাক শারদ ১৪১৮ সংখ্যা;সম্পাদক তাপস ভৌমিক;কলকাতা;পৃ: ১১৫। ১১) Suniti Kumar Chatterji : The Origin and Development of the Bengali Language; Rupa & Co, Kolkata;1993; pg.: 143,269 and 594. ১২) মুহম্মদ আবদুল হাই : আমাদের বাংলা উচ্চারণ;বাঙলা ভাষা-প্রথম খণ্ড; সম্পাদক—হুমায়ুন আজাদ;আগামী প্রকাশনী;ঢাকা;সংশোধিত দ্বিতীয় সংস্করণ-১৯৯৭;পৃ: ২৬৫। ১৩) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : ধ্বনির উচ্চারণ আরুই প্রকার;ধ্বনি-বিজ্ঞানর ভূমিকা;বীণা লাইব্রেরী, গুয়াহাটি-১;সংশোধিত চতুর্থ সংস্করণ,২০০০;পৃ: ৫১। ১৪) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত; পৃ: ৫২। ১৫) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত; পৃ:৫২। ১৬) Suniti Kumar Chatterji: Phonology;Chapter V;ibid.;pg.: 509. ১৭) রবীন্দ্র কুমার দত্ত: নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের উপভাষার ধ্বনি-বিজ্ঞানগত বৈশিষ্ট্যের তুলনা; প্রথম অধ্যায়;নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের উপভাষা—একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ;প্রগ্রেসিভ পাব্লিশার্স,কলকাতা-৭৩;মার্চ,২০১২;পৃ: ৫৪। ১৮) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৭। ১৯) Suniti Kumar Chatterji: Phonology;Chapter I;ibid.; pg.: 270. ২০) মুহম্মদ আবদুল হাই;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৬৪। ২১) মুহম্মদ আবদুল হাই;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৬৪। ২২) Suniti Kumar Chatterji: Phonology;Chapter V;ibid.; pg.: 464. ২৩) মুহম্মদ আবদুল হাই; প্রাগুক্ত; পৃ: ৩০০ । ২৪) George Abraham Grierson: Introduction; Linguistic survey of India; compiled and edited by George Abraham Grierson;Calcutta : Office of the Superintendent of Government Printing, India, 1903- 1928.Vol-IV;Muṇḍā and Drabidian Languages; Part-I; Muṇḍā Family; Introduction; pg.: 11.; http://dsal.uchicago.edu/books/lsi/ ২৫) Paul Sidwell and Felix Rau:Austroasiatic Comparetive Historical Reconstruction: An Overview;The Handbook of Austroasiatic Languages,Part I; Edr. Paul Sidwell, Mathias Jenny;Brill,Leiden/ Boston,pg.: 313;313 https://books.google.co.in/books?id=xwSjBQAAQBAJ&dq= %CB%80k,%CB%80p,+%CB%80c&source=gbs_navlinks_s ২৬) জন্মজিৎ রায়: সিলেটি উপভাষা: ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিত;শ্রীহট্ট-কাছাড়ের প্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতির রূপরেখা;সম্পাদনা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ চৌধুরী,সুনির্মল দত্ত চৌধুরী, অমলেন্দু ভট্টাচার্য,মানবেন্দ্র ভট্টাচার্য;বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ---শিলং;১৯৯৬;পৃ: ১৮৯। ২৭) Sudhāṃśu Śekhara Tuṅga: Consonant; Bengali and Other Related Dialects of South Assam; Mittal Publications,New Delhi-59; first Edition,1995;pg.: 122 ২৮) Sudhāṃśu Śekhara Tuṅga;ibid;pg.: 123. ২৯) Sudhāṃśu Śekhara Tuṅga;ibid;pg.:124. ৩০) Sudhāṃśu Śekhara Tuṅga;ibid;pg.:124. ৩১) সুকুমার সেন: তৃতীয় অধ্যায়;ভাষার ইতিবৃত্ত;আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা-৯;প্রথম আনন্দ সংস্করণ,তৃতীয় মুদ্রণ,নভেম্বর,১৯৯৪; পৃ: ৩৮। ৩২) Suniti Kumar Chatterji : Phonology; Chapter V ; ibid.; pg.: 558. ৩৩) জগন্নাথ চক্রবর্তী : ধ্বনিতত্ত্ব;বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান ও ভাষাতত্ত্ব; ভাষা-সংস্কৃতি আকাদেমি অসম,হাফলং;প্রথম প্রকাশ- বৈশাখ,১৪২২বঙ্গাব্দ;পৃ: ৩৮৪। ৩৪) নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের উপভাষা—একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ;রবীন্দ্র দত্ত; প্রগ্রেসিভ পাব্লিশার্স,কলকাতা-৭৩;মার্চ,২০১২;পৃ: ৪৯। ৩৫) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : ব্যঞ্জন বর্ণমালা;অসমীয়া ব্যাকরণ প্রবেশ;বীণা লাইব্রেরী, গুয়াহাটি -০১;দ্বিতীয় সংস্করণ,২০০৩;পৃ: ২৭। ৩৬) নিখিলেশ পুরকাইত: বঙ্গ উপভাষাগুচ্ছ;তৃতীয় অধ্যায়;বাংলা অসমীয়া ও ওড়িয়ার উপভাষার ভৌগোলিক জরিপ;সুবর্ণ রেখা,কলকাতা-৯;প্রথম প্রকাশ,জুন,১৯৮৯;পৃ: ১৮৫,১৯২। ৩৭) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮৪। ৩৮) আবিদ রাজা মজুমদার: বরাক উপত্যকার কথ্য বাংলার অভিধান;সৃজন,শিলচর -০১;প্রথম প্রকাশ,২০১১;পৃ: ২৬০। ৩৯) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৯। ৪০) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮৩। ৪১) জন্মজিৎ রায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮৯। ৪২) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮৫ এবং ১৯২। ৪৩) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৯ । ৪৪) Sudhāṃśu Śekhara Tuṅga; ibid;pg.:145. ৪৫) Sudhāṃśu Śekhara Tuṅga;ibid.;pg.: 145. ৪৬) Sudhāṃśu Śekhara Tuṅga;ibid.;pg.: 146 ৪৭) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : ধ্বনির উচ্চারণ আরু প্রকার;ধ্বনি বিজ্ঞানর ভূমিকা;প্রাগুক্ত; পৃ:৪৭। ৪৮) Sudhāṃśu Śekhara Tuṅga ; ibid; pg.:146. ৪৯) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৮৪। ৫০) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৭৭। ৫১) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৮। ৫২) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : ব্যঞ্জন বর্ণমালা;অসমীয়া ব্যাকরণ প্রবেশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৬। ৫৩) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:২৬। ৫৪) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৬। ৫৫) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : ধ্বনির উচ্চারণ আরু প্রকার;ধ্বনি বিজ্ঞানর ভূমিকা;প্রাগুক্ত; পৃ: ৪৮। ৫৬) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮৫। ৫৭) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:১৭৩। ৫৮) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ:১৮৫। ৫৯) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯২। ৬০) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৮। ৬১) মুহম্মদ আবদুল হাই;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৯৮। ৬২) Sudhāṃśu Śekhara Tuṅga;ibid.;pg.:140. ৬৩) Sudhāṃśu Śekhara Tuṅga;ibid.;pg.:140. ৬৪) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৯। ৬৫) রামেশ্বর শ’: ধ্বনির শ্রেণীবিভাগ বা বর্গীকরণ;সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা;প্রাগুক্ত; পৃ: ২৫২। ৬৬) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৬০। ৬৭) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : ব্যঞ্জন বর্ণমালা;অসমীয়া ব্যাকরণ প্রবেশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৯। ৬৮) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : ধ্বনির উচ্চারণ আরু প্রকার;ধ্বনি বিজ্ঞানর ভূমিকা;প্রাগুক্ত; পৃ: ৬০। ৬৯) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮৩। ৭০) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮৩। ৭১) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮৫ এবং ১৯২;জন্মজিৎ রায়:প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯০। ৭২) আবিদ রাজা মজুমদার:‘বরাক উপত্যকার কথ্য বাংলার অভিধান’ পুস্তকের প্রধান আলোচ্য বিষয়: যা যা আছে;বরাক উপত্যকার কথ্য বাংলার অভিধান;সৃজন---শিলচর;২০১১। ৭৩) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:১২৭। ৭৪) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪৩। ৭৫) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:১৫৪। ৭৬) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৭২। ৭৭) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬৮। ৭৮) Suniti Kumar Chatterji: Phonology;Chapter V;ibid.; pg.: 464. ৭৯) Suniti Kumar Chatterji;ibid.;pg.: 464. ৮০) Suniti Kumar Chatterji;ibid.;pg.: 464. ৮১) সুকুমার সেন: অষ্টম অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ৯১। ৮২) ড০ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ:বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত;মাওলা ব্রাদার্স;ঢাকা,বাংলাদেশ;প্রথম মাওলা ব্রাদার্স সংস্করণ;পঞ্চম মুদ্রণ;জানুয়ারি ২০১০;পৃ: ৩৮ এবং ৬৫। ৮৩) ড০ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ : বাঙ্গালার উপভাষা সমূহ;সপ্তম পরিচ্ছেদ;বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত; প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৩। ৮৪) সুকুমার সেন: তৃতীয় অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৯। ৮৫) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৯। ৮৬) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮। ৮৭) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ:২৪৩। ৮৮) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ:২২৫। ৮৯) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ২২৬। ৯০) হুমায়ুন আজাদ;অবতরণিকা: বাংলা ভাষাতত্ত্ব [১৭৪৩-১৯৮৩]; বাঙলা ভাষা---প্রথম খণ্ড; সম্পাদক হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৩। ৯১) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৮। ৯২) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৮। ৯৩) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ:২৪৪। ৯৪) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪৩। ৯৫) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮২। ৯৬) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮২। ৯৭) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮৩। ৯৮) আবিদ রাজা মজুমদার:‘বরাক উপত্যকার কথ্য বাংলার অভিধান’ পুস্তকের প্রধান আলোচ্য বিষয়: যা যা আছে;প্রাগুক্ত;২০১১। ৯৯) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৩। ১০০) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৮৩। ১০১) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:১১৫। ১০২) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:১১৫। ১০৩) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৮। ১০৪) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৮। ১০৫) Suniti Kumar Chatterji: Phonology;Chapter V;ibid.;pg.: 454. ১০৬) Suniti Kumar Chatterji;ibid.;pg.: 454. ১০৭) Suniti Kumar Chatterji;ibid.; pg.: 454. ১০৮) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪৪। ১০৯) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : ধ্বনির উচ্চারণ আরু প্রকার;ধ্বনি বিজ্ঞানর ভূমিকা;প্রাগুক্ত; পৃ: ৫৪ । ১১০) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : ব্যঞ্জন বর্ণমালা;অসমীয়া ব্যাকরণ প্রবেশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩। ১১১) ড০ বাণীকান্ত কাকতি: ধ্বনিতত্ত্ব ;অসমীয়া ভাষার গঠন আরু বিকাশ; অনুবাদক বিশ্বেশ্বর হাজরিকা;ড০ বাণীকান্ত কাকতি জন্মশতবার্ষিকী উদ̖যাপন সমিতি,বরপেটা;অক্টোবর, ১৯৯৬;পৃ: ৫৫। ১১২) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : ব্যঞ্জন বর্ণমালা;অসমীয়া ভাষার উচ্চারণ;বীণা লাইব্রেরী, গুয়াহাটি;জুন-২০০২;পৃ: ১৪০। ১১৩) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:৪৯। ১১৪) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪১। ১১৫) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪১। ১১৬) ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর;প্রাগুক্ত;পৃ:৬। ১১৭) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪২। ১১৮) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮৫। ১১৯) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫২। ১২০) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী :স্বরবর্ণমালা;অসমীয়া ভাষার উচ্চারণ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০। ১২১) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮৫। ১২২) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৭। ১২৩) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪৬। ১২৪) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : ধ্বনির উচ্চারণ আরু প্রকার;ধ্বনি বিজ্ঞানর ভূমিকা;প্রাগুক্ত; পৃ: ৫৫। ১২৫) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৫৩। ১২৬) পরেশ চন্দ্র মজুমদার: বাংলা ভাষা পরিক্রমা, ১ম খণ্ড;১৩৮৩ বাং;পৃ: ২৭১। ১২৭) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : ধ্বনির উচ্চারণ আরু প্রকার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৩। ১২৮) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : ধ্বনির উচ্চারণ আরু প্রকার;প্রাগুক্ত;পৃ:৫৫। ১২৯) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : ব্যঞ্জনবর্ণর বিষদ আলোচনা;অসমিয়া বর্ণপ্রকাশ;বীণা লাইব্রেরী;গুয়াহাটী,অসম;পঞ্চম সংস্করণ,২০১১;পৃ: ৩৪,৪৪,৪৭,৫৭,৬০। ১৩০) Sudhāṃśu Śekhara Tuṅga ; ibid; pg.:125। ১৩১) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৩। ১৩২) Sudhāṃśu Śekhara Tuṅga ; ibid; pg.: 123. ১৩৩) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম: অসমর থলুয়া প্রধান (স্বতন্ত্র) ভাষাসমুহ;অসমীয়া আরু অসমর ভাষা-উপভাষা;জ্যোতি প্রকাশন,গুয়াহাটি;জুলাই ২০০৯;পৃ: ৯,১৭। ১৩৪) Sounds of Bishnupriya Manipuri;The Bishnupriya Manipuri Language; http://manipuri.freeservers.com/bpm.html#sounds ১৩৫) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম: অসমীয়ার জাতিগত আরু সামাজিক শ্রেণিগত উপভাষা; অসমীয়া আরু অসমর ভাষা-উপভাষা;জ্যোতি প্রকাশন,গুয়াহাটি;জুলাই ২০০৯;পৃ: ২১৭। ১৩৬) Suniti Kumar Chatterji: Introduction;ibid.; pg.: 143. ১৩৭) James A. Matisoff:Handbook of Proto-Tibeto-Burman;University of California Press;2003; pg.: 15. ১৩৮) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : ধ্বনির উচ্চারণ আরু প্রকার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৪-৪৫। ১৩৯) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত ;পৃ: ৫৪ । ১৪০) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮৫ । ১৪১) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫১। ১৪২) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮৪। ১৪৩) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : প্রবাহ ধ্বনি;ধ্বনি-বিজ্ঞানর ভূমিকা;প্রাগুক্ত;পৃ: ৭৪। ১৪৪) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮৪। ১৪৫) পবিত্র সরকার:ভূমিকা;জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত; পৃ: ১৫ । ১৪৬) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১২১। ১৪৭) Suniti Kumar Chatterji: Phonology;Chapter V;ibid.;pg.: 541। ১৪৮) রবীন্দ্র কুমার দত্ত; প্রাগুক্ত ;পৃ: ৫২ । ১৪৯) Rajen Barua : A Perspective of the Assamese Language:A Plea to Save the Assamese X (স) Sound;প্রজ্ঞান,তিনসুকিয়া কলেজ থেকে শিক্ষকদের প্রকাশিত ত্রৈমাসিক সাময়িকী;জুন ০৯;পৃ: ৪১ এ প্রকাশিত প্রবন্ধের ‘অসমিয়া ভাষার এক বিশেষ প্রেক্ষাপট: অসমিয়া ‘স’ (X) ধ্বনিটি রক্ষা করবার জন্যে একটি আবেদন’ নামে সাময়িক প্রসঙ্গ,২০সেপ্টেম্বর, ২০০৯ তে প্রকাশিত বর্তমান গবেষকের অনুবাদ। ১৫০) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : ঊষ্মবর্গ;অসমিয়া বর্ণপ্রকাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৭২। ১৫১) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : ঊষ্মবর্গ;অসমিয়া বর্ণপ্রকাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৩। ১৫২) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৫। ১৫৩) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী: ব্যঞ্জনবর্ণমালা;অসমীয়া ব্যকরণ প্রবেশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩১। ১৫৪) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৮ । ১৫৫) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯২। ১৫৬) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯৮। ১৫৭) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০৪ । ১৫৮) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২১১। ১৫৯) https://sites.google.com/site/rohingyalanguagewebsite/ ১৬০) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:বাংলাভাষা পরিচয়;অধ্যায় -১২;রবীন্দ্র-রচনাবলী;১২৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ;বিশ্বভারতী;১৯৮৫;১৩শ খণ্ড;পৃ: ৬০১। ১৬১) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮৩। ১৬২) জগন্নাথ চক্রবর্তী : ধ্বনিতত্ত্ব;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮৪। ১৬৩) Suniti Kumar Chatterji: Phonology;Chapter V;ibid.;pg.: 465। ১৬৪) Suniti Kumar Chatterji: Introduction;ibid.;pg.: 79. ১৬৫) বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় : চ-বর্গীয় বর্ণসমূহের উচ্চারণ;বাঙলা ভাষা-প্রথম খণ্ড;সম্পাদক হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৩৭। ১৬৬) দীপক কুমার রায়:বাংলা ভাষায় ভোট বর্মী উপাদান;উত্তর বঙ্গের ভাষা;সম্পাদক-- রতন বিশ্বাস;বইওয়ালা;কলকাতা-৪৮;প্রথম প্রকাশ,দ্বিতীয় মুদ্রণ- অক্টোবর,২০০৫;পৃ: ৩৪৪। ১৬৭) বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৩৯ । ১৬৮) বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪৩।১৬৯) সঞ্জিতা সিংহ: বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা;অসমীয়া আরু অসমর ভাষা;সম্পাদক ড০ বিশ্বজিৎদাস,ড০ ফুকন চন্দ্র বসুমাতারী;আঁক-বাক,গুয়াহাটি ৩;২০১০;পৃ: ৬৭।১৭০) Sounds of Bishnupriya Manipuri;The Bishnupriya ManipuriLanguage;ibid.১৭১) Sudhāṃśu Śekhara Tuṅga;ibid; pg.:138.১৭২) Suniti Kumar Chatterji: Phonetic Transcription;ibid.;pg.:xxxiii.১৭৩) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৫।১৭৪) Suniti Kumar Chatterji;ibid.;pg. xxx১৭৫) Suniti Kumar Chatterji;ibid.;pg. xxx১৭৬) Suniti Kumar Chatterji;ibid.;pg. xxx১৭৭) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ২১২।১৭৮) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : প্রবাহ ধ্বনি;ধ্বনি-বিজ্ঞানর ভূমিকা;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৭।১৭৯) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫০।১৮০) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫০।১৮১) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮৫।১৮২) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৯।১৮৩) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : অন্তঃস্থ ধ্বনি;ধ্বনি-বিজ্ঞানর ভূমিকা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১১২ ।১৮৪) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : বাগিন্দ্রিয়;ধ্বনি-বিজ্ঞানর ভূমিকা;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৯ ।১৮৫) The International Phonetic Alphabet (revised to 2015): InternationalPhonetic Association;https://www.internationalphoneticassociation.org১৮৬) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৬২ ।১৮৭) The International Phonetic Alphabet (Revised To 2015);ibid.১৮৮) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ:২৭০। ১৮৯) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : ভূমিকা;অসমীয়া ভাষার উচ্চারণ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৯। ১৯০) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : অনিয়তাঘৃষ্ট স্বরধ্বনি;ধ্বনি-বিজ্ঞানর ভূমিকা;প্রাগুক্ত;পৃ: ৮৭। ১৯১) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী: স্বরবর্ণমালা;অসমিয়া বর্ণপ্রকাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৬। ১৯২) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : স্বরধ্বনির পর্যালোচনা;ধ্বনি-বিজ্ঞানর ভূমিকা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১০৭। ১৯৩) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : অনিয়তাঘৃষ্ট স্বরধ্বনি;ধ্বনি-বিজ্ঞানর ভূমিকা;প্রাগুক্ত;পৃ: ৯৩। ১৯৪) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৯৩। ১৯৫) দীপ্তি ফুকন পাটগিরি:ধ্বনিতত্ত্ব;অসমীয়া,বাংলা আরু উড়িয়া ভাষা—তুলনামূলক অধ্যয়ন;বনলতা-গুয়াহাটি;এপ্রিল,২০০৪;পৃ: ২৭। ১৯৬) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : স্বরবর্ণমালা;অসমীয়া ভাষার উচ্চারণ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪২। ১৯৭) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮৫,১৯২। ১৯৮) সুকুমার সেন: একাদশ অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪৯। ১৯৯) Sudhāṃśu Śekhara Tuṅga ;ibid;pg.:88. ২০০) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৬। ২০১) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮১। ২০২) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৯ । ২০৩) Suniti Kumar Chatterji: Phonology;Chapter IV;ibid.;pg.:410. ২০৪) রবীন্দ্র কুমার দত্ত: নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের উপভাষার ধ্বনিতা ও তার তুলনামূলক বৈশিষ্ট্য; দ্বিতীয় অধ্যায়;প্রাগুক্ত ;পৃ: ৮৩ । ২০৫) Sudhāṃśu Śekhara Tuṅga;ibid; pg.:89. ২০৬) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৮০। ২০৭) Suniti Kumar Chatterji;ibid.;pg.: 392 ২০৮) Suniti Kumar Chatterji; ibid.;pg.:392. ২০৯) ড০ উপেন্দ্র নাথ গোস্বামী;ভাষা-বিজ্ঞান;মণি-মাণিক প্রকাশ-গুয়াহাটি;২১তম সংস্করণ— ২০১৪;পৃ: ১৪১ । ২১০) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : সংযুক্ত ব্যঞ্জন;অসমিয়া বর্ণপ্রকাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১১২। ২১১) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮৯ । ২১২) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়:বঙ্গীয় শব্দকোষ;১ম খণ্ড;সাহিত্য একাদেমি;অষ্টম মুদ্রণ,২০১১; পৃ: ৯৯৪। ২১৩) রামেশ্বর শ’:ধ্বনিপরিবর্তন;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫০১। ২১৪) Suniti Kumar Chatterji: Phonology;Chapter III;ibid.;pg.: 338. ২১৫) Suniti Kumar Chatterji;pg.: 341. ২১৬) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : ব্যঞ্জন বর্ণমালা;অসমীয়া ভাষার উচ্চারণ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১২৭ । ২১৭) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : অন্তঃস্থ ধ্বনি;ধ্বনি-বিজ্ঞানর ভূমিকা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১১১। ২১৮) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৯৪। ২১৯) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫২। ২২০) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়:বঙ্গীয় শব্দকোষ;২য় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯৬৯। ২২১) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৩ । ২২২) রবীন্দ্র কুমার দত্ত: নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের উপভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য;তৃতীয় অধ্যায়; প্রাগুক্ত;পৃ:১৪০। ২২৩) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়:বঙ্গীয় শব্দকোষ;১ম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৯০৮। ২২৪) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ১০৩১। ২২৫) সুকুমার সেন: ত্রয়োদশ অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৭১। ২২৬) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪০। ২২৭) জগন্নাথ চক্রবর্তী : ধ্বনিতত্ত্ব;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৯০। ২২৮) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৭৯। ২২৯) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৯৭। ২২৩) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৭৪। ২৩১) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৮। ২৩২) রামেশ্বর শ’:ধ্বনিপরিবর্তন;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫০৫। ২৩৩) Suniti Kumar Chatterji: Phonology;Chapter IV;ibid.;pg.:388. ২৩৪) Suniti Kumar Chatterji;ibid.;pg.: 390. ২৩৫) রামেশ্বর শ’:ধ্বনিপরিবর্তন;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫০৬। ২৩৬) Sudhāṃśu Śekhara Tuṅga;ibid;pg.: 95. ২৩৭) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪২। ২৩৮) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৯৩। ২৩৯) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;পৃ: ১৩৮ । ২৪০) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : সংযুক্ত ব্যঞ্জন;অসমিয়া বর্ণপ্রকাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১০০। ২৪১) ড০ ভীমকান্ত বরুয়া:ভাষার ইতিবৃত্ত;বনলতা গুয়াহাটি-ডিব্রুগড়-০১;জুলাই ২০০২;পৃ: ২৬। ২৪২) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ১২১। ২৪৩) ড০ বাণীকান্ত কাকতি; প্রাগুক্ত ;পৃ: ১৫৮। ২৪৪) Suniti Kumar Chatterji: Phonology;Chapter IV;ibid.; pg.:432. ২৪৫) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪৩। ২৪৬) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ১১৬ । ২৪৭) রামেশ্বর শ’:ধ্বনিপরিবর্তন;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫১০। ২৪৮) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮৫ এবং ১৯২। ২৪৯) রণবীর পুরকায়স্থ:সুরমা গাঙর পানি;প্রথম অধ্যায়;একুশ শতক,কলকাতা-৭৩;অক্টোবর, ২০১২;পৃ: ৮। ২৫০) ড০ রামকৃষ্ণ দেবনাথ:হকুনর ছাও;আগরতলা;প্রথম প্রকাশ,১৩৮৭ বাং;পৃ: ১৫। ২৫১) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ১১৩ । ২৫২) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৭৭। ২৫৩) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত ;পৃ: ১৭৭। ২৫৪) ড০ উপেন্দ্র নাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪৬। ২৫৫) Suniti Kumar Chatterji: Phonology;Chapter V;ibid.;pg.:550 ২৫৬) Suniti Kumar Chatterji: Introduction;ibid.;pg.:79 ২৫৭) জগন্নাথ চক্রবর্তী ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৯২। ২৫৮) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪৫। ২৫৯) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ১২৬। ২৬০) ড০ উপেন্দ্র নাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪৫। ২৬১) ড০ উপেন্দ্র নাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪৫। ২৬২) রামেশ্বর শ’:বাংলা ভাষায় ধ্বনি পরিবর্তন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৯৪। ২৬৩) রফিকুল ইসলাম:ভাষাতত্ত্ব;রামেশ্বর শ’-এর উল্লেখ:ধ্বনিপরিবর্তন;প্রাগুক্ত;পৃ:২৯৬। ২৬৪) দীপ্তি ফুকন পাটগিরি;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৩। ২৬৫) রবীন্দ্র কুমার দত্ত:দ্বিতীয় অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ:৭০। ২৬৬) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ:৭১। ২৬৭) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৯৯। ২৬৮) রামেশ্বর শ’: মূল ধ্বনি বা স্বনিম : সংজ্ঞা ও বিশ্ল্বেষণ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৮৪। ২৬৯) রামেশ্বর শ’:বাংলা বিভাজ্য স্বনিমের স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০৩ । ২৭০) জন্মজিৎ রায়:প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮৯। ২৭১) রামেশ্বর শ’: ধ্বনির অবস্থান ও ধ্বনি সমাবেশ: বাংলা ভাষার ধ্বনি;বাংলা ভাষায় ধ্বনি; প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩০। ২৭২) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : স্বরবর্ণমালা;অসমিয়া বর্ণপ্রকাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১২৭। ২৭৩) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : দ্বিস্বরধ্বনি;ধ্বনি-বিজ্ঞানর ভূমিকা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১১৪। ২৭৪) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : স্বরধ্বনির কলন;ধ্বনি-বিজ্ঞানর ভূমিকা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১০৮। ২৭৫) Sudhāṃśu Śekhara Tuṅga; ibid;pg.: 93. ২৭৬) জগন্নাথ চক্রবর্তী: বানান বিধি;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৫। ২৭৭) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৮৪। ২৭৮) রামেশ্বর শ’:বাংলা অবিভাজ্য স্বনিম;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩৮। ২৭৯) Suniti Kumar Chatterji: Phonology;Chapter II;ibid.;pg.:279. ২৮০) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : শ্বাসাঘাত;ধ্বনি-বিজ্ঞানর ভূমিকা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১২১। ২৮১) গোলোক চন্দ্র গোস্বামী;অসমীয়া বর্ণপ্রকাশ;১৬৩। ২৮২) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : শ্বাসাঘাত;ধ্বনি-বিজ্ঞানর ভূমিকা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১২৩। ২৮৩) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : শ্বাসাঘাত বর্গ ;অসমিয়া বর্ণপ্রকাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬৪। ২৮৪) জগন্নাথ চক্রবর্তী: ধ্বনিতত্ত্ব;প্রাগুক্ত ;পৃ: ৩৮৬। ২৮৫) Suniti Kumar Chatterji; ibid.; pg.:279. ২৮৬) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮৬। ২৮৭) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬। ২৮৮) আবিদ রাজা মজুমদার; ‘বরাক উপত্যকার কথ্য বাংলার অভিধান’ পুস্তকের প্রধান আলোচ্য বিষয়: যা যা আছে;প্রাগুক্ত;২০১১। ২৮৯) জগন্নাথ চক্রবর্তী: শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের দেশ সমাজ মানুষ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৮৮। ২৯০) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত ;পৃ: ৫৮৯। ২৯১) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : শ্বাসাঘাত বর্গ ;অসমীয়া বর্ণপ্রকাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬৯। ২৯২) রামেশ্বর শ’:বাংলা অবিভাজ্য স্বনিম;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪৬। ২৯৩) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : সুর আরু সুরলহর;ধ্বনি-বিজ্ঞানর ভূমিকা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১২৫। ২৯৪) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১২৪। ২৯৫) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ:১২৩। ২৯৬) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ:১২৩। ২৯৭) Gopal Haldar;A Comparative grammar of East Bengali Dialects, 1st Edition---1986,p.40;রবীন্দ্র দত্তের ব্যবহৃত উদ্ধৃতি;প্রাগুক্ত ;পৃ:১২৯ । ২৯৮) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১২৯। ২৯৯) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১২৬। ৩০০) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : ধ্বনির লয়;ধ্বনি-বিজ্ঞানর ভূমিকা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১১৯। ৩০১) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : সন্ধিবর্গ;অসমিয়া বর্ণপ্রকাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৭২। ৩০২) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:১৭২ ৩০৩) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী : স্বরধ্বনি;ধ্বনি-বিজ্ঞানর ভূমিকা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১১০। ৩০৪) রামেশ্বর শ’:বাংলা অবিভাজ্য স্বনিম;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৫৪। ৩০৫) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৫৪। ৩০৬) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১১০। ৩০৭) George Abraham Grierson: Introduction;Linguistic survey of India; compiled and edited by George Abraham Grierson;Vol.5,Pt.1; ibid.;pg.: 38. ৩০৮) George Abraham Grierson: Central or Standard Bengali;ibid; pg.:47. ৩০৯) George Abraham Grierson; ibid; pg.:51. ৩১০) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম; প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৭। ৩১১) Suniti Kumar Chatterji: Phonology;Chapter V;ibid.;pg.:546. ৩১২) Suniti Kumar Chatterji;ibid.;pg.:557. ৩১৩) সঞ্জীব দেবলস্কর: প্রসঙ্গ সিলেটি ভাষা;বাঙালনামা;দ্বিতীয় বর্ষ,দ্বিতীয় সংখ্যা; http://bangalnama.wordpress.com/2010/09/13/prasango-sylheti- bhasha/ ৩১৪) জগন্নাথ চক্রবর্তী: ধ্বনিতত্ত্ব;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮৫। ৩১৫) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৭৬। ৩১৬) মুহম্মদ আবদুল হাই;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০০। ৩১৭) মুহম্মদ আবদুল হাই;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০০। ৩১৮) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৭। ৩১৯) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৭০। ৩২০) মুহম্মদ আবদুল হাই;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০০। ৩২১) Suniti Kumar Chatterji: Phonology;Chapter IV;ibid.;pg.: 384. ৩২২) মুহম্মদ আবদুল হাই;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৭ । ৩২৩) মুহম্মদ আবদুল হাই;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০০। ৩২৪) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৮। ৩২৫) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯৯। ৩২৬) সুকুমার সেন: ত্রয়োদশ অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮১। ৩২৭) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮৪। ৩২৮) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৯৪ । ৩২৯) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৮। ৩৩০) Suniti Kumar Chatterji;ibid.;pg.:414. ৩৩১) Suniti Kumar Chatterji;ibid.;pg.: 415. ৩৩২) Suniti Kumar Chatterji;ibid.;pg.: 415. ৩৩৩) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮২ । ৩৩৪) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮২ । ৩৩৫) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৯৩। ৩৩৬) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৮। ৩৩৭) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০১। ৩৩৮) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭০। ৩৩৯) মুহম্মদ আবদুল হাই;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৯৭। ৩৪০) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৮। ৩৪১) Suniti Kumar Chatterji; ibid.; pg.: 384. ৩৪২) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম; প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৮। ৩৪৩) Suniti Kumar Chatterji: Phonology;Chapter III;ibid.;pg.: 301. ৩৪৪) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৭৬। ৩৪৫) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৮। ৩৪৬) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ১২৬। ৩৪৭) Suniti Kumar Chatterji;ibid.;pg.: 379. ৩৪৮) Suniti Kumar Chatterji; ibid.; pg.: 384. ৩৪৯) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম: ভাষা-উপভাষার তুলনামূলক আলোচনা;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩৪।
|
Comments