।। অসমিয়া,মানবাংলা,সিলেটি এবং দু’একটি প্রতিবেশী ভাষা ও ভাষাবৈচিত্র্যের বাক্যতাত্ত্বিক তুলনা।। ষষ্ঠ অধ্যায় ৷৷

  ৷৷ অসমিয়া ভাষা এবং বাংলার সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্যের পারস্পরিক সম্পর্ক ৷৷
 ৷৷ একটি কালানুক্রমিক এবং কালিক অনুসন্ধান ৷৷  ষষ্ঠ অধ্যায় ৷৷


📚📚📚📚📚📚📚

(মূল গবেষণা  অভিসন্দর্ভে ‘উপভাষা’ শব্দটিই ছিল, ‘ভাষাবৈচিত্র্য’ ছিল না । আই পি এ (IPA) হরফগুলো যদি বা এখানে নাও পড়তে পারেন এখানে ক্লিক করে বা  একেবারে নিচে গোগোল ড্রাইভে পিডিএফে পড়ুন। ছবিগুলো দুবার ক্লিক করলে বড় হয়ে যাবে। আগে পরের অধ্যায়গুলোর জন্যে এখানে ক্লিক করুন।)



ব্দতত্ত্বে’র মতোই বাংলা এবং অসমিয়াতে ‘বাক্যতত্ত্ব’ অধ্যয়নেরও সমস্যা এবং সীমাবদ্ধতা নিয়ে কিছু কথা আমরা আগের অধ্যায়ে লিখে এসেছি।বস্তুত সমস্যাটি জটিল বলেই যে অসমিয়া তাত্ত্বিকেরাই সিলেটি এবং অসমিয়ার সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা দেখাতে গেছেন,তারাই কিছু সমরূপ শব্দের তালিকা দিয়ে যেমন কাজ সেরেছেন,বাক্যের বেলা এসে আরো জটিলতাতে পড়েছেন।পাশাপাশি অসমিয়া বাক্য বা পদ বসাতে পারেন নি। সেই উনিশ শতকের শুরুতে বেণুধর রাজখোয়া যেভাবে বিষয়টির উপস্থাপন করেছিলেন,তাকে আমরা স্থান কালের কথা ভেবে ইতিহাসের নথি হিসেবেই নিতে পারি,ভাষাবৈজ্ঞানিক দৃষ্টি কেন ছিল না,সেই প্রশ্ন না করলেও পারি।আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান তখন বাংলা কিংবা অসমিয়া দুই ভাষাতেই ভ্রুণাবস্থাতে ছিল।তাঁর বইটি এখন দুর্লভ।অন্যের লেখা পড়েই বুঝতে হয়। বইটি বেরোবার দশক দেড়েকের মধ্যেই এর এক সমালোচনা গ্রন্থ লিখেছিলেন সিলেটের বড়লেখার ব্রজদয়াল বিদ্যাবিনোদ সেই ১৩৩৬ বাংলাতে।সেখানে শুরুতেই তিনি বেণুধর রাজখোয়ার একটি মন্তব্য তুলে দিয়েছেন।তারপরে সেকালে যেটুকু ভাষাবিদ্যার যুক্তি দাঁড় করানো গিয়েছিল,তাই দিয়েই তিনি সেই মন্তব্যকে খণ্ডন করেছিলেন, তথা দাঁড় করাতে গেছিলেন যে সিলেটি অসমিয়া বাংলা সবই সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত হয়ে এসেছে।আজকে আমাদের মনে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে,যে বাংলা অসমিয়া সিলেটি প্রাকৃত কোনো ভাষাবৈচিত্র্যের থেকে এসেছে কিনা,সেটি আবার নতুন করে প্রমাণ করবার কী দরকার?কিন্তু ১৩৩৬ বাংলাতে সেই কাজটিই ব্রজদয়াল বিদ্যাবিনোদকে সঙ্গত কারণেই করতে হয়েছিল।কারণ বেণুধর রাজখোয়া লিখেছিলেন এই,“The Kamrupi Language was the language at one time,not only of Sylhet,but also of Cooch Behar,Rangpur,Jalpaiguri,Mymensing,Chittagong,and the neighbouring districts.It spread from there further westwards.The Bengali Language has been derived from the ancient Kamrupi.”এই প্রশ্ন উঠতেই পারে যে ব্রজদয়াল কতটা সঠিক পাঠ উদ্ধার করেছিলেন।কিন্তু এর পরে যে কথাগুলো লিখেছেন,তার সঙ্গে অসমিয়া ভাষাবিদেরা যেভাবে বেণুধর রাজখোয়ার উল্লেখ করেন তার কোনো বিরোধ নেই।অর্থাৎ বেণুধর রাজখোয়ার পদ্ধতি এরকমটাই ছিল,ব্রজদয়াল লিখছেন,“কোন স্থানের ভাষার সমালোচনা করিতে হইলে সেই স্থানের ভাষার প্রকৃতি পরীক্ষা করা প্রয়োজন।শ্রীযুক্ত রাজখোয়া মহাশয় তাহা করেন নাই,তিনি কেবল আসামের ভাষার সহিত শ্রীহট্টের কথ্য ভাষার (সিলেটি ডায়ালেক্টের) সামান্য সাদৃশ্য দেখাইয়া অসমীয়া (কামরূপী) ভাষার প্রসার দেখাইতে প্রয়াস পাইয়াছেনএই প্রয়াসের যথেষ্ট কারণও আছে;যেহেতু শ্রীযুত গ্রিয়ার্সন সাহেবের মতে অসমীয়া ভাষাভাষীর সংখ্যা মাত্র ১৪৪০,০০০ এবং তাহা শ্রীহট্টের মুসলমান অধিবাসী সংখ্যার সমান।”এর পরে ব্রজদয়াল সেকালে যেটুকু ধ্বনিতাত্ত্বিক,রূপতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা যেত,সেভাবেই দেখাবার চেষ্টা করেছেন,কীভাবে বাংলা অসমিয়া সিলেটি সবই প্রাকৃত হয়ে এসেছে। বেণুধর যেমন ‘কামরূপী’ প্রাকৃত কিনা লেখেন নি,ব্রজদয়ালও প্রাকৃত মাগধী কিনা,সেসব স্পষ্ট করেন নি।কিন্তু বোঝা যায় বছর কয় আগে প্রকাশিত সুনীতিকুমারের ওডিবিএল পড়ুন বা না পড়ুন গ্রিয়ার্সনের সঙ্গে তাঁর কিছু কিছু পরিচয় ছিল।তাঁর বিশ্লেষণের আমরা উল্লেখ দরকার মনে করছি না,তাহলে কেবল বেণুধর রাজখোয়ার সমালোচনাতেই আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে।আমাদের যেটি দরকার তা হলো,বেণুধর রাজখোয়া ‘ভাষার প্রকৃতি পরীক্ষা’ করেন নি।

          বহু পরে,আমরা দেখবো এখনো কেউ সেই পদ্ধতির থেকে বাইরে বেরোচ্ছেন না।এবং বেরোবার দরকারও বোধ করছেন না।সিলেটি-অসমিয়া এবং মান বাংলা যে শব্দগুলো নিয়ে আমরা আগের অধ্যায়ে আলোচনা করে এলাম,সেগুলো যে বেণুধর রাজখোয়ারই সংগ্রহ  রমেশ পাঠক পড়লে তা আরো নিশ্চিত হওয়া যায়। বেণুধর রাজখোয়া প্যারীলাল সোম বলে এক ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে প্রাচীন পুথি কিছু পেয়েছিলেন,সেগুলো তাঁর ‘Notes on the Sylheti Dialects’-এ তুলে দিয়েছেন।এই অব্দি কোনো সমস্যা নেই।সমস্যা এইখানে শুরু হয় যখন ২০০৮এ প্রথম প্রকাশিত নিজের ‘উপভাষা বিজ্ঞানর ভূমিকা’ বইতে ড রমেশ পাঠক লেখেন,“এইবোরর রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তেখেতে করা নাই;করার প্রয়োজনও অনুভব করা নাই। অসমীয়া আরু বাংলা ভাষার সৈতে সামান্য পরিচয় থকা ব্যক্তিয়েও ‘পুথি’খনর (পদ্মপুরাণ,বণিক্য খণ্ড) ভাষার সৈতে অসমীয়া ভাষার গভীর সাদৃশ্য দেখা পাব।” তার পরে তিনি কিছু নজির তুলে দিয়েছেন আমরা সেসবে পরে আসবআমাদের কাছে যেটি আপাতত দরকারি,সেটি হলো একুশ শতকে এসেও কোনো বিচার বিশ্লেষণ না করে একটি  সিদ্ধান্তকে দাঁড় করাবার অবস্থানটি। যে সাদৃশ্যের কথা তিনি লিখলেন,এই পদ্ধতিতে অসমিয়া এবং  বাংলার ‘সাদৃশ্য’ দেখানোও খুবই সহজ।রবীন্দ্রনাথ সেই দেখেই অসমিয়াকে বাংলা বলেই মনে করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথই কেন, সাধারণ বহু বাঙালিও এরকম ভুল ধারণাটি এরই জন্যে মনে লালন করেন যে তাঁরা দেখেন চট্টগ্রামী থেকে ময়মন সিংহী অব্দি বাংলার তামাম উপভাষাতথা ভাষাবৈচিত্র্যগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ট আত্মীয়তাতে বাঁধা অসমিয়া। শুনলেই বোঝা যায়।  ফলে এইভাবে তর্কে মাতলে, শুধু তর্কটি এর পরে আর কোনো ভাষাবৈজ্ঞানিক যুক্তির সীমাতে থাকবে না। কে কার উপভাষাএই নিয়ে বিবাদ চলতেই থাকবে। মানুষের মন তো ভাষা-ধর্ম নিরপেক্ষ ভাবে সমান আচরণ করে। যে অসমিয়া মনোভাবে অন্যায় নেই, একই বাঙালি মনোভাবে অন্যায় হবে? তাত্ত্বিক অবস্থান রবীন্দ্রনাথের তখন বেণুধর রাজখোয়ার থেকে সামান্যও ভিন্ন ছিল না।অধ্যাপক রমেশ পাঠক যখন অসমিয়ার কামরূপী বা গোয়ালপাড়ার ভাষাবৈচিত্র্যের মতো অন্যগুলো নিয়েও কথা বলছেন সেখানেও ‘বাক্যতত্ত্ব’ বলে কিছু নেই। বস্তুত এই বইতেই ‘বাক্যতত্ত্ব’ বলে কিছু নেই। ফলে তা এদিকটাতে আমাদের কোনো দিশানির্দেশ করে না।

            কী দিয়ে শুরু হওয়া উচিত বাক্যের আলোচনা? কোন ক্রমে এগোনো উচিত আমাদের? সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বা বাণীকান্ত কাকতিও যে এদিকটাতে বিশেষ স্পর্শ করেন নি,তাদের প্রথম গবেষণা সন্দর্ভে,সে আমরা আগেই লিখে এসেছি।ফলে ওডিবিএল-এর মতো মহাগ্রন্থ লিখে আসবার পরেও ‘বাক্য’ কথাটির সংজ্ঞা নিয়ে সুনীতি কুমারের সমস্যা হচ্ছিল। ১৯৪২-এ প্রকাশিত ‘ভাষা প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’-এ তিনি বাক্যের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন,এরকম:“যে পদ- বা শব্দ- সমষ্টির দ্বারা কোনও বিষয়ে সম্পূর্ণ-রূপে বক্তার ভাব প্রকটিত হয়,সেই পদ-বা সমষ্টিকে বাক্য (Sentence) বলে।” কিন্তু তিন দশক পরে তিনি গঠনবাদে প্রভাবিত হয়েই বোধ করি,১৯৭২এ প্রকাশিত ‘সরল ভাষা প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’-এ সেই সংজ্ঞাকে শুধরে নিয়ে লিখছেন এরকম,“কোনও ভাষায় যে উক্তির সার্থকতা আছে,এবং গঠনের দিক হইতে যাহা স্বয়ং সম্পূর্ণ, সেইরূপ একক উক্তিকে বাক্য (Sentence) বলা হয়।” রামেশ্বর শ’ এই পরিবর্তনের  উল্লেখ করেছেন। এর পরে তিনি বাক্যের  সঠিকতর সংজ্ঞাটি তুলে দিয়েছেন ডব্ল্যু পি লেমানের থেকে। সেটির বাংলা অনুবাদও তিনি করেছেন,এভাবে,“বাক্য হচ্ছে এমন কতকগুলি নির্বাচিত উপাদানের পরম্পরাক্রমিক বিন্যাস যেগুলিকে ভাষাবিশেষের বিশেষ ছাঁদ, রূপপরিবর্তন ও সুরতরঙ্গের বিশেষ নিয়ম অনুসারে মিলিত করে একটি একক রূপে গড়ে তোলা হয়েছে১০সংক্ষেপে রামেশ্বর শ’ আরো লিখছেন,“সহজ করে বলা যায়,বাক্য হচ্ছে ভাষার একক (unit);ভাষাকে বিশ্লেষণ করলে প্রথম যে বৃহত্তম একক আমরা পাই তা হলো বাক্য।”১১

 প্রায় একই প্রসঙ্গের অবতারণা করে ড নির্মল দাশ লিখছেন,“বাক্য হলো ভাষার বৃহত্তম একক।”১২তাঁর সেই অধ্যায়ের নাম ‘বাক্য-প্রকরণ’একবিংশ অধ্যায় থেকে চতুর্বিংশ অধ্যায় অব্দি তিনি বাক্য নিয়েই আলোচনা করেছেন।এর পরে তিনি যেভাবে অধ্যায়টি সাজিয়েছেন,শুরুতে আমরা তার একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিচ্ছি।তিনি লিখেছেন,বাক্য রচনার করবার সময় তিনটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হয়এই তিনটি বিষয় হলো:পদের অবস্থান,ক্রম এবং সঙ্গতি।“এগুলির পারিভাষিক নাম: ১)যোগ্যতা ২)আকাঙ্ক্ষা ও ৩)আসত্তি।প্রসিদ্ধ অলংকারশাস্ত্রী বিশ্বনাথ চক্রবর্তী তাঁর ‘সাহিত্য দর্পণ’ গ্রন্থে লিখেছেন:স্যাদ যোগ্যকাঙ্খ্যা যুক্ত পদোচ্চয়ো।”১৩এর পরে তিনি এই তিনটি ‘বিষয়’-এর বিস্তৃত পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন।এগুলো ব্যাখ্যা করবার পরে আলাদা করে আবার ‘বাংলা বাক্যে পদস্থাপনের সাধারণ নিয়ম ও তার ব্যতিক্রম’ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করছেন।আসলে ব্যাখ্যা করছেন কোন কারকের পদ কোথায় বসবে।তাহলে আমরা যে তিনটি ‘বিষয়ে’র মধ্যে ‘ক্রম’ তথা ‘আকাঙ্ক্ষা’র কথা জেনে এলাম,তার পরে আবার এর দরকার পড়লো কেন?এই ‘ক্রম’ আর ‘পদস্থাপন’-এর নিয়ম কি তবে আলাদা?প্রশ্নটি আপাতত তোলা থাক।তিনি এর পরে ‘ছেদ’-এর কথা আলোচনা করছেন।অস্বীকার করবার উপায় নেই,যে বাক্য রচনাতে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।এমন কি অবিভাজ্য ধ্বনি প্রসঙ্গে আলোচনা করতে করতে আমরাও কিছু কথা বাক্য প্রসঙ্গে আলোচিত হবে বলে রেখে এসেছিলাম,বিশেষ করে বাক্য শ্বাসাঘাত এবং স্বরাঘাত।এর পরের দ্বাবিংশ অধ্যায়ে আলোচিত হচ্ছে ‘বাক্যের প্রকার ভেদ ও বাক্য পরিবর্তন’এই অধ্যায়ে বাক্যের গঠন এবং অর্থ অনুসারে ভাগ করা হচ্ছে।গঠন অনুসারে শব্দের মতোই বাক্যকেও  .সরল বাক্য ২. জটিল বাক্য ৩. যৌগিক বাক্য—এই তিন ভাগে ভাগ করা হচ্ছে।১৪এর পরে অর্থ অনুযায়ী বাক্যের নানান প্রকার ভেদ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করছেন। যেমন-- নির্দেশক বাক্য,অস্ত্যর্থক বাক্য,নাস্ত্যর্থক বাক্য,প্রশ্নবোধক বাক্য,অনুজ্ঞাবাচক বাক্য ইত্যাদি।এবং এই সমস্ত প্রকারভেদের একটির থেকে আর প্রকারে বাক্যের পরিবর্তন কী করে ঘটানো যায় সেসব ব্যাখ্যা করা হচ্ছে ছাত্রদের জন্যে।এর পরের ‘ত্রয়োবিংশ অধ্যায়’টির নাম ‘উক্তিপরিবর্তন’,যাকে ইংরেজিতে বলে Narration১৫ চতুর্বিংশ অধ্যায়টির নাম ‘বাক্য-বিশ্লেষণ’সেখানে তিনি বাক্যের আরেকটি সংজ্ঞা উপস্থিত করছেন,“শব্দ সমষ্টির অর্থবোধক বিন্যাসকে বাক্য বলে।”১৬এবং লিখছেন,“বাক্যের প্রধান দুটি অংশ উদ্দেশ্য ও বিধেয়। প্রতিটি বাক্যে এই দুটি অংশ অবশ্যই থাকবে।”১৭এখানে তিনি উদ্দেশ্য প্রসারক,বিধেয় প্রসারক ইত্যাদি ধারণারও অবতারণা করছেন।আমাদের কাছে যেটি প্রশ্ন  তা হলো ‘উদ্দেশ্য –বিধেয়’ যদি বাক্যের অংশ হয় তবে ‘পদসংস্থাপন’-এর নিয়মে যে কারক বোঝানোর ‘পদ’-এর কথা পড়ে এলাম,সেগুলো কী ছিল? দেখা যাচ্ছে যদিও এখানে এসে ‘অর্থবোধক বিন্যাসে’র কথা বলছেন,বিশ্লেষণ করছেন গঠন অনুযায়ী বাক্যের প্রকার ভেদগুলোকেই তথা---সরল বাক্য,জটিল বাক্য এবং যৌগিক বাক্যকেই।বাচ্য প্রসঙ্গকে তিনি সপ্তদশ অধ্যায়ে ‘ক্রিয়ার বাচ্য’ এই শিরোনামে আলোচনা করেছেন।এবং তাঁর সংজ্ঞাটি মেনে নিলে  বোঝা যায় এটি রূপতত্ত্বের বিষয়,“ক্রিয়ার যে রূপভেদের দ্বারা ক্রিয়া প্রধানত কাকে অবলম্বন করে কাজ করছে তা বোঝা যায় তাকে বাচ্য বলে।”১৮

সুকুমার সেনের বইতে অধ্যায়টির নাম ‘বাঙ্গালা পদবিধি’১৯এখানে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করছেন। লিখছেন,“প্রাচীন ভারতীয়-আর্য ভাষা (সংস্কৃত) রূপপ্রধান ছিল।”২০মধ্যভারতীয় আর্যতেই পদের শেষের বিভক্তিগুলো খসে যেতে শুরু করে, আধুনিক আর্যভাষাগুলোতে প্রায় নেই বললেই চলে।ফলে,“মোট কথা এই যে বাঙ্গালার মতো ব্যাকরণ-জটিলতাহীন ভাষায় পদবিধির গুরুত্ব রূপপ্রক্রিয়া অপেক্ষাকৃত বেশি।এই গুরুত্ব ভাষার প্রাচীন মধ্য ও আধুনিক স্তরে ক্রমশ বাড়িয়া আসিয়াছে।”২১ এর পরে তিনি এই গুরুত্বটিই বিচার বিশ্লেষণ করছেন।কী ভাবে প্রাচীন বাংলা থেকে আধুনিক বাংলাতে পদের পরসর্গগুলো খসে যাচ্ছে বা তির্যক প্রয়োগ হচ্ছে ক্রমে ক্রমে তাই আলোচনা করেছেন।মূলত সেগুলো কারক এবং কালের পরসর্গ কথা।‘সরল, জটিল,যৌগিক’ বাক্য বা ‘উদ্দেশ্য-বিধেয়’ আদি পারিভাষিক শব্দগুলোর ব্যাবহার থাকলেও ব্যাখ্যা নেই।এবং কোথাও কোথাও বা কোনো সূত্র সম্পর্কে বলেই দিচ্ছেন ‘রূপপ্রক্রিয়ায় বলা আছে’ বা ‘রূপপ্রক্রিয়ায় দ্রষ্টব্য’২২ তিনি যখন প্রাচীন ভারতীয় আর্য, মধ্যভারতীয় আর্য বা বাংলা ভাষার নানা ‘উপভাষা’র আলোচনা করছেন,সেখানেও এর বেশি কিছু নেই। আধুনিক বাংলা বাক্যের পদবিন্যাস রীতি নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র দিয়েছেন,যা হয়তো বা আমাদের কাজে আসবে,এখানে উল্লেখ করা ভালো,“বাক্যের সর্ব শেষে সমাপিকা ক্রিয়া---নঞর্থক বাক্য না হইলে---তাহার পূর্বে মুখ্য কর্ম,তাহার পূর্বে গৌণকর্ম,তাহার পূর্বে করণ অধিকরণ, তাহার পূর্বে অসমাপিকা (ও তদ̖যুক্ত বাক্যাংশ),তাহার পূর্বে কর্তা।সমাপিকা ক্রিয়া বলিতে যুক্ত ও যৌগিক ক্রিয়াপদও ধরিতে হইবে।”২৩তিনি বাচ্য প্রসঙ্গে সামান্য আলোচনা করেছিলেন,‘কর্ম ও ভাব-বাচ্য’ ‘বাঙ্গালা রূপপ্রক্রিয়া’ তথা চতুর্দশ অধ্যায়ে২৪ অতীন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘ভাষাতত্ত্বে’ এই প্রসঙ্গটি ‘ক্রিয়াপদের কাল’ অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন খুব সংক্ষেপে।২৫

সত্যনাথ বরা ‘বহ্ল ব্যাকরণে’র দ্বাদশ অধ্যায়ে  ‘বাক্যবিন্যাস প্রকরণ’ নিয়ে আলোচনা করেছেন।তিনি বাক্যের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন,সেটি খুবই সংক্ষিপ্ত,“দুটা বা অধিক পদ গোট খাই কথা বুজালে,তাক বাক্য বোলে।”২৬“বাক্য দুবিধ—পূর্ণ বাক্য আরু খণ্ড বাক্য।”২৭তার পরেই তিনি ‘বাক্যর বাচ্য’ নিয়ে আলোচনা করছেন।“প্রত্যেক পূর্ণ বাক্যর পদসঙ্গতি তিনি প্রকার।এই পদ-সঙ্গতিক বাক্যর বাচ্য বোলা যায়।এতেকে বাক্যর বাচ্য তিনিবিধ---কর্ত্তৃবাচ্য,কর্ম্মবাচ্য আরু ভাববাচ্য।”২৮এই সংজ্ঞা থেকেই স্পষ্ট তিনি একই সঙ্গে ‘পদসঙ্গতি’ নিয়েও আলোচনা করছেন।আর কী কী নিয়ে আলোচনা করছেন, উপশিরোনামের স্পষ্ট। সেগুলো এরকম—‘কর্ত্তা আরু ক্রিয়ার সঙ্গতি’,‘ক্রিয়া আরু কর্ম্মর সঙ্গতি’,‘আন আন কারক আরু ক্রিয়ার সঙ্গতি’,‘কাল আরু ক্রিয়ার সঙ্গতি’,‘বিশেষ্য আরু বিশেষণ পদর সঙ্গতি’,‘সর্ব্বনাম সঙ্গতি’ ইত্যাদি।২৯গোলোকচন্দ্র গোস্বামীর বহু আগেই ‘বাচ্য’ বিষয়টি যে বাক্যতত্ত্বেরও অংশ-- সেই কথা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন সত্যনাথ বরা।

সেদিক থেকে ‘অসমীয়া ব্যাকরণ-প্রবেশ’ বইতে কয়েক দশক পরে আধুনিক অসমিয়া ভাষাবিজ্ঞানের জনকই যাকে বলা চলে সেই গোলোকচন্দ্র গোস্বামীর ‘বাক্য প্রকরণ’ বেশ বিস্তৃত।অনেকটাই ড নির্মল দাশের মতোতাঁর পরবর্তী অধ্যায়টির নামও ‘বাক্য বিশ্লেষণ’৩০তিনি বাক্যের সংজ্ঞা লিখছেন এরকম:“সংস্কৃত বাক̖ শব্দর পরা বাক্য সৃষ্টি হৈছে।বাক̖ মানে মুখর কথা।মানুহে বাক্যরে কথা কয়।মুখেরে উচ্চারিত ধ্বনিময় সংকেতেরে অর্থবহ পদর সৃষ্টি হয়;তেনে এক বা একাধিক পদ বা পদ সমষ্টিরে বাক্য হয়। সেই বাক্যই কথা বা ভাষা।বাক্যর গঠনকে,সেয়েহে,এক প্রকারে ভাষার গঠন বুলি কব পারি।”৩১বাক্যের গঠনে পদই মূল সামগ্রী এবং সেগুলো যেমন খুশি জুড়ে গেলেই বাক্য হয় না।“বাক্য হ’বলোই হ’লে,(১)বাক্যর আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হ’ব লাগে;(২) পদবোর বাক্যত প্রয়োগ হ’বর যোগ্য হ’ব লাগে;আরু,(৩)পদর লগত পদর আসত্তিও সুদৃঢ় আরু সুস্পষ্ট হ’ব লাগে।”৩২ফলে, তিনিও এই ‘আকাঙ্ক্ষা’,‘যোগ্যতা’ এবং ‘আসত্তি’র কথা দিয়েই শুরু করেছেন। ‘আসত্তির প্রসঙ্গেই শ্বাসাঘাত, স্বরাঘাত ইত্যাদি প্রসঙ্গও ছুঁয়ে গেছেন।৩৩এই ক্রমেই পূর্ণ বাক্য,খণ্ডবাক্যের আলোচনাও করছেন।এর পরে তিনি ‘বাক্যর প্রকার’৩৪ নিয়ে আলোচনাতে শুরুতেই বাংলার মতো যথারীতি ‘সরল’,‘জটিল’ এবং ‘যৌগিক’ বাক্যের আলোচনা করছেন।প্রকার ভেদটি গঠন না অর্থ অনুযায়ী --সেটি স্পষ্ট করেন নি।কিন্তু বোঝা যায় ‘গঠনে’র কথাই হচ্ছেসংজ্ঞাগুলোও মোটের উপরে একই।অর্থ তথা ‘ভাব অনুযায়ী’ বিভাজন নিয়েও কথা বলছেন।৩৫কিন্তু ড নির্মল দাশ যেগুলোকে ‘উক্তি পরিবর্তন’ বলে আলাদা রেখেছেন,তিনি সেগুলোকেও ‘উক্তির ভিত্তিত বাক্যর প্রকারভেদ’ বলছেন।৩৬ কিন্তু যে বাচ্যকে বাংলার ভাষাবিদ বা বৈয়াকরণ রূপতত্ত্বের বিষয় করে রাখছেন,দেখা যাচ্ছে সত্যনাথ বরাকে অনুসরণ করে তিনিও একে ‘বাক্য প্রকরণে’র বিষয় করে রেখেছেন।‘বাচ্য অনুসরি বাক্যর প্রকার’ ভেদ আলোচনা করছেন।৩৭অর্থাৎ বিজ্ঞানের বিশ্বজনীনতা বলে এখানে কিছু নেই। যেহেতু এগুলো পারম্পরিক ভাষাবিদ্যাই-- দুই ভাষাবিদ্যার পরম্পরা তাই ভিন্ন।বাংলা যাকে রাখছে রূপতত্ত্বে,অসমিয়া তাকে রাখছে বাক্যতত্ত্বে।তাঁর সংজ্ঞাটিও ভিন্ন,“ব্যাকরণত বাচ্য শব্দর অর্থ কথা কোয়ার ভঙ্গী বা বাক্য প্রকাশর ধরণ।কথা কওঁতে বা লিখোঁতে কেতিয়াবা কর্তার ওপরত, কেতিয়াবা কর্মর ওপরত আরু কেতিয়াবা ক্রিয়াপদে সম্পাদন করা কার্যর ওপরত গুরুত্ব দিয়া হয়।এই গুরুত্ব অনুসরি বাক্যর গঠনর তারতম্য ঘটে;পদর প্রয়োগরও সাল সলনি হয়এনে তারতম্য বা সালসলনির ভিত্তিত বাক্যত তলত দিয়ার দরে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারর বাচ্য পোয়া যায়। যেনে,(ক) কর্তৃবাচ্যর বাক্য;(খ) কর্মবাচ্যর বাক্য;(গ)কর্তৃ-ভাববাচ্যর বাক্য;আরু (কর্ম-ভাববাচ্যর বাক্য)৩৮ আমাদের একটি সমস্যাতে পড়তে তো হয়ই,‘বাচ্য’ কি বাক্যতত্ত্বের বিষয় হবে,না রূপতত্ত্বের?পদের গঠনের দিক থেকে দেখলে এটি ‘রূপতত্ত্ব’-এরই বিষয়।তাও মূলত ক্রিয়ারূপেরই।বাকি পদগুলোর বিন্যাস ক্রম  হয়তো পাল্টায় কিন্তু রূপ পাল্টায় না।তিনি নিজেও এর পরে দেখা যাবে পদগুলোর পরসর্গ নিয়েই কথা বলছেন। যেমন ধরা যাক,কর্তৃবাচ্যের বাক্য প্রসঙ্গে লিখছেন,“কর্তৃবাচ্যর বাক্যত কর্তাপদর লগত ক্রিয়াপদর সঙ্গতি থাকে;অর্থাৎ কর্তার পুরুষ অনুযায়ী ক্রিয়া পদত পুরুষর বিভক্তি যুক্ত হয়।”৩৯কিন্তু বাচ্য যে সমগ্র বাক্যের গঠন এবং অর্থও পালটে ফেলে,তাও অস্বীকার কী করে করা যাবে?এই ‘সঙ্গতি’-টাইতো কর্ম বাচ্যে পালটে যাচ্ছে,কর্মবাচ্যের বাক্যে,“কর্তাপদর অভাব হেতুকে কর্মপদর লগত ক্রিয়াপদর সঙ্গতি স্থাপিত হয়।এনে বাক্যর ক্রিয়া সদায় নামপুরুষর বিভক্তিযুক্ত হয়।”৪০‘অধ্যায় ওঠর’-তে তিনিও ‘বাক্য বিশ্লেষণ’ নিয়ে আলোচনা করছেন,এবং বাক্যের ‘উদ্দেশ্য- বিধেয়’ বিভাজনের ভিত্তি বলছেন,‘আসত্তি’“আসত্তির ভিত্তিত পূর্ণ বাক্যক প্রধানত: দুটা ভাগত ভগোয়া হয়। যেনে এটা উদ্দেশ্য আরু আনটো বিধেয়।”৪১      

‘ভাষা-বিজ্ঞান’-এ ড উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীও অতীন্দ্র মজুমদারের মতো প্রথমে বাক্যতত্ত্ব স্পর্শই করেন নি।পরে সংযোজন অংশে ‘প্রোক্তিবিজ্ঞান (Discoursology)’৪২ বলে অতি সামান্য একটি অংশ যোগ করেছেন,তাও সম্ভবত  ১৯৭০এ দ্বিতীয় সংস্করণের পরে।১৯৭০ কথাটি এর জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ,যে আধুনিক বাক্যতত্ত্ব বা Syntax –এর সঙ্গে তখন আলাপ হতে শুরু করেছে ।

এদিকে দীপ্তি ফুকন পাটগিরি কিন্তু ‘ক্রিয়ার বাচ্য’-কে রূপতত্ত্ব প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন।৪৩আমরা আগের অধ্যায়ে লিখেছি,তিনিও ‘অসমীয়া, বাংলা আরু উড়িয়া ভাষা—তুলনামূলক অধ্যয়ন’-এ বাক্যতত্ত্ব নিয়ে কোনো স্বতন্ত্র আলোচনা করেন নি।

ভারতে যে রূপান্তর মূলক সৃজনমূলক ব্যাকরণের পদ্ধতিতে পবিত্র সরকার কিছু কাজ করেছিলেন,সেসব আমরা আগের অধ্যায়ে লিখে এসেছি।বাংলাদেশে হুমায়ুন আজাদ এই নিয়ে কাজ শুরু করেন তার পরে,১৯৮৩-৮৪তে৪৪‘বাঙলা ভাষা’ প্রথম খণ্ডে ‘বাক্যতত্ত্ব’ বিভাগে আমরা তাঁর একটিই মাত্র প্রবন্ধের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি,‘বাঙলা বিশেষ্যপদ’৪৫তাতে  আমরা যে রূপকল্প ধরে এগোচ্ছি তার কাজ হচ্ছে না।কিন্তু তিনি ‘বাক্যতত্ত্ব’ অধ্যয়নের গতিপ্রকৃতি নিয়ে কিছু কাজের কথা লিখেছেন।তিনিও পরিষ্কার লিখেছেন,“বাঙলা বাক্য বিশ্লেষিত হয়েছে প্রধানত প্রথাগত পদ্ধতিতে –প্রথাগত ব্যাকরণে।”৪৬কাঠামোবাদ ধরে,“কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নেয়া হয় নি”৪৭, আর চমস্কি তত্ত্বকে অনুসরণ করে,“বাঙলা বাক্যের কিছু কিছু এলাকা বিশ্লেষিত হয়েছে।”৪৮ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৪তে।এই উক্তি তাঁর ২০০২তে প্রকাশিত দ্বিতীয় সংশোধিত সংস্করণের দ্বিতীয় মুদ্রণেও।অর্থাৎ সামগ্রিক কাজ সেরকম  কিছু তখনো হয় নি।এর পরে তিনি যে কথাগুলো লিখেছেন,এটি আমাদের ভাষাবিজ্ঞানের যে কোনো ছাত্রের জন্য অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য।পুরোটাই তুলে দিচ্ছি,যাতে আমাদের সমস্যার জটিলতাও স্পষ্ট করতে পারি।তিনি লিখছেন,“প্রথাগত বাঙলা ব্যাকরণে বাক্য বর্ণনায় ব্যবহৃত হয় দু’টি পরস্পর বিরোধী তত্ত্ব---একটি সংস্কৃত কারকতত্ত্ব,ও অন্যটি পাশ্চাত্য উদ্দেশ্য-বিধেয়ভিত্তিক বাক্যতত্ত্ব।প্রথাগত ব্যাকরণ প্রণেতারা একথা বুঝতেও পারেন না যে ওই তত্ত্ব দু’টির একটিকে গ্রহণ করলে অন্যটি গ্রহণের কোনো সুযোগ থাকে না। কেননা একই উপাত্ত বর্ণনায় পরস্পর বিরোধী তত্ত্ব ব্যবহৃত হ’লে তারা বাতিল করে দেয় একে অন্যকে।অবশ্য কারকতত্ত্ব যে বাক্যতত্ত্ব তা তারা হৃদয়ঙ্গম করতেও অসমর্থ;তাই সংস্কৃত সুগভীর কারকতত্ত্ব তাদের হাতে হ’য়ে ওঠে বিভক্তিপ্রয়োগের বিধান।পাশ্চাত্য উদ্দেশ্য-বিধেয়তত্ত্বকেও বেশ স্থূলভাবে প্রয়োগ করেন তাঁরা বাংলা বাক্যের ওপর;তাতে বাঙলা বাক্যের বৈশিষ্ট্য উদ্ঘাটিত না হয়ে জন্ম নেয় নানা বিভ্রান্তি বিশৃঙ্খলা।প্রথাগত বাঙলা ব্যাকরণে বাক্য বিশ্লেষিত হয়ে আসছে দু-শো চল্লিশ বছর ধরে;আস̖সুম্পসাঁউর(১৭৪৩) খণ্ডিত ব্যাকরণে উনিশটি অনুচ্ছেদে নির্দেশ করা হয় বাঙলা বাক্যগঠনের নিয়ম;হ্যালহেডের(১৭৭৮) ব্যাকরণের সপ্তম অধ্যায়ে ‘অফ সিনট্যাকস’ নামে পেশ করা হয় বাঙলা বাক্য সম্পর্কে কিছু মন্তব্য।উনিশ-বিশ শতকের বিভিন্ন ব্যাকরণে ‘অথ বাক্যরচন প্রকরণ’,‘অন্বয় প্রকরণ’,‘বাক্য’,‘বাক্য –প্রকরণ’,‘বাক্য-গঠন’ প্রভৃতি শিরোনামে ব্যাখ্যা করা হয়েছে বাঙলা বাক্য,তবু আজো বাঙলা বাক্যের সংগঠন আমাদের কাছে অনেকটা অজ্ঞাত।তার কারণ কোনো ব্যাকরণপ্রণেতাই প্রধান গুরুত্ব আরোপ করেন নি বাঙলা বাক্যের ওপর;সমস্ত ব্যাকরণ পুস্তকেই বাঙলা বাক্যের বর্ণবিশ্লেষণ সীমাবদ্ধ থাকে কয়েক পাতায়।”৪৯তারপরেও অন্যত্র হুমায়ুন আজাদেরই একটি সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করেছেন রামেশ্বর শ’ এরকম,“একদিক দিয়ে প্রথাগত বাক্যচিত্র সাংগঠনিক চিত্রের চেয়ে অনেক উন্নত।প্রথাগত চিত্র বাক্যের বিভিন্ন অংশের ভূমিকা অস্পষ্ট ভাবে হলেও নির্দেশ করে,কিন্তু সাংগঠনিক বাক্যচিত্র তা করে না।”৫০ বাক্যের আলোচনা করতে গিয়ে ‘কারক’ এবং ‘উদ্দেশ্য-বিধেয়’ দুই প্রসঙ্গই যে অনেকে ছুঁয়ে যান,সে তো আমরা দেখিয়ে এলাম।আর স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণেও আমরা এই দুই বিষয়ের সঙ্গে সুপরিচিত।কারক তথা পদক্রম প্রসঙ্গেই শেখানো হয়ে থাকে,সংক্ষেপে বাংলা বাক্যের পদক্রম হলো কর্তা কর্ম ক্রিয়া, আর ইংরেজি বাক্যে পদক্রম হলো Subject-Verb-Objectতার পরে আবার ‘উদ্দেশ্য-বিধেয়’ কিংবা ‘Subject-Predicate’ কেন?-- এই প্রশ্ন না করেই আমরা ব্যাকরণ মুখস্থ করে এসেছিবাংলাতে  বা অসমিয়াতে ‘কর্তা’ এবং ‘উদ্দেশ্য’ দুই ভিন্ন শব্দ হলে কী হবে,---ইংরেজিতে দু’টোই ‘Subjectএই ধারণাটি প্রাচীন গ্রীক ব্যাকরণের পরম্পরা থেকে আসা বলে লিখেছেন,রামেশ্বর শ’-ও।গ্রিসেই প্রাচীন পশ্চিমা ভাষাবিদ্যার সূচনা হয়েছিল।তাদের বহু ঋণ আছে ভাষাবিদ্যার উন্মেষে।কিন্তু সেসব স্বীকার করেই রামেশ্বর শ’ লিখেছেন,“তাঁদের ভাষাদৃষ্টি ছিল বৈজ্ঞানিক নয়,মূলত দার্শনিক;বিশেষত তাঁদের বাক্য বিশ্লেষণ ছিল তর্কশাস্ত্রের(logic) কাঠামোতে ঢালা।বাক্যকে উদ্দেশ্য(subject),বিধেয়(predicate) ও সংযোজক ক্রিয়া(copula)-তে বিভাজনের যে রীতি তাঁরা অনুসরণ করেছেন তা স্পষ্টত তর্ক শাস্ত্রের Syllogism থেকে গৃহীত।”৫১ব্যাকরণ ছিল তাদের কাছে দর্শনশাস্ত্রের বিষয়।এরিস্টটল ভাষাকে,আমরা সবাই জানি,কাব্য বা নাট্য শাস্ত্রের বিষয় করে নিয়ে আলোচনা করেছিলেন Poetics-এ।তাদের বিচারের বিষয় ছিল অতি অবশ্যই সাহিত্যের ভাষা।এই কথাটি অবশ্য ভারতীয় ব্যাকরণ শাস্ত্র সম্পর্কেও সত্য। রামেশ্বর শ’ লিখছেন,“সাহিত্যের ভাষা অপেক্ষাকৃত কৃত্রিম,তাই আধুনিক ভাষা-বিজ্ঞানীরা কথ্যভাষার উপরে ভিত্তি করেই ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেন।”৫২ এই কথাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আমরা যখন মান ভাষা এবং ভাষাবৈচিত্র্যগুলো নিয়ে অধ্যয়ন করছি।‘ভাষাবৈচিত্র্য’-এর এখনো জনপ্রিয় পরিভাষা ‘উপভাষা’,কারো কারো মতে ‘লৌকিক ভাষা’নিশীথ রঞ্জন দাশের বইটির নাম যেমন ‘বরাক উপত্যকার লৌকিক বাংলা ভাষা।’তিনি যদিও বা ভাষাটির অধ্যয়ন করেছেন সসম্মানে,কিন্তু যে পদ্ধতিটি ব্যবহার করেছিলেন, তা সেই পরম্পরাগত ব্যাকরণেরপতঞ্জলি শব্দকে দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন,বৈদিক এবং লৌকিক৫৩ এবং অবশ্যই তাঁর ‘মহাভাষ্য’-এর উদ্দেশ্য ছিল বৈদিক ভাষা,তথা শব্দের সুরক্ষা।যাই হোক,আপাতত এহ বাহ্য।মূল কথা হল,উদ্দেশ্য-বিধেয় তত্ত্ব পশ্চিমা,প্রাচ্যতত্ত্ব নয়।এটি শুধু তথ্য হিসেবেই আমরা উল্লেখ করে রাখলাম। সেটি দোষের কি গুণের হুমায়ুন আজাদও ব্যাখ্যা করেন নি,আমরাও এখনই সেই স্থিতিতে নেই।তিনি শুধু লিখেছেন যে এই তত্ত্ব এবং কারক তত্ত্বকে এক সঙ্গে গ্রহণ করা চলে না।একটিকে করলে আরটি গ্রহণের সুযোগ থাকে না,বা বাহুল্য মাত্র হয়

কিন্তু কারক-তত্ত্বটিই কি তাহলে বাক্যতত্ত্ব?আমরা কিন্তু একে রূপতত্ত্বেই আলোচনা করে এসেছি।এবং বাংলা-অসমিয়া দুই ভাষাতেই এটি যে নামপদনির্মাতা ব্যাকরণিক সংবর্গ সেটি তথ্য দিয়েই শুধু দেখাই নি,পূর্বাপর ভাষাবিজ্ঞানীরাও তাই করে এসেছেনআমরা কি ভুল কিছু করে এসেছি?অর্থাৎ এমনটাতো হচ্ছে না,যে কারকের বাক্যতত্ত্বের আলোচনা করতে গিয়ে আমরা নামপদের রূপনিয়ন্ত্রণে কারক কী ভূমিকা নেয়,সেই অসঙ্গত কাজটি করে এসেছি?যা করেছি,তাতে ভুল কিছু নজরে পড়ে নি।কিন্তু বাক্যতত্ত্বের আলোচনাতেও যে পরম্পরাগত ব্যাকরণে বা ভাষাতত্ত্বে ‘কারক’ প্রসঙ্গটি আসছে সেও আমরা ইতিমধ্যে দেখিয়ে এসেছি।যদিও কার্যত কী হচ্ছে তা এখনো পরীক্ষা করে দেখা বাকি।কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট যে ‘কারক’ আর ‘কারক-বিভক্তি’ দুই ভিন্ন বিষয় সেটি আমাদের বোধে আছে।পরম্পরাগত ব্যাকরণেও দু’টিকে একেবারেই এক করে ফেলা হয় না।যদি ‘ক্রিয়ান্বয়ী কারকম’ সংজ্ঞাটিকেও ধরে নিই,তাহলেও আমরা শুধু এইটুকুন বুঝে এসেছি,কোন কারকে কোন বিভক্তি বা পরসর্গ যুক্ত হয়। কিন্তু সেই কারকের পদটি বাক্যে কই বসবে ক্রিয়া বা কর্তার আগে না পরে---সেসব প্রসঙ্গ কিন্তু আমরা স্পর্শ করিনি।বচন-লিঙ্গ- কাল- ভাব এবং পুরুষ নিয়ে সেসব সমস্যা নেই।যদি ধরে নিই,একটি মাত্র কর্তাতে বা ক্রিয়াতে পুরো বাক্য তৈরি হচ্ছে তাহলেও কিন্তু সেই কর্তার বচন লিঙ্গ থাকছে,আর ক্রিয়ার কাল-পুরুষ-ভাব থাকছে।কিন্তু যেই কারকের প্রসঙ্গ এল,সেই মাত্র বাক্যে একাধিক নামপদের প্রসঙ্গ এল এবং স্বাভাবিক ভাবেই তাদের ক্রম বা বিন্যাসের কথাও আসছেসেই ক্রম বা বিন্যাসের প্রসঙ্গটি যে বাক্যতত্ত্বের বিষয়ই হবে,এই নিয়ে আমাদের দ্বিমত থাকবার কথা নয়।মনে হয় হুমায়ুন আজাদ সেইটুকুনই বলতে চেয়েছেন।তবে তিনি যখন তাঁর সম্পাদিত সংকলনে ‘রূপতত্ত্ব’ বিভাগটি সাজাচ্ছেন,সেখানে কিন্তু বিষয় হিসেবে ‘প্রত্যয়’ আছে,‘উপসর্গ’ আছে,‘পুরুষ’,‘সমাস’ এমন কি ‘বাচ্য’ও আছে,কিন্তু ‘কারক’ নেই।‘কারক’ প্রসঙ্গে তাবৎ রচনাগুলোকে তিনি ‘বাক্যতত্ত্ব’-এর পরিসরেই ঠাঁই দিয়েছেন।এমনকি রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ‘কারক-প্রকরণ’-কেও।ভূমিকাতে তিনি লিখছেন,“শাব্দ রূপতত্ত্বে স্থান পায় তিনটি প্রক্রিয়া সমাস,প্রত্যয় ও উপসর্গ।অন্য সবই কোনো –না –কোনো প্রকার প্রাত্যয়িক রূপতত্ত্বের মধ্যে পড়ে।”৫৪ সেখানে কারক পড়ে কিনা,সেটি স্পষ্ট নয়কিন্তু কারক ভিন্ন সমাস বিশেষ করে তৎপুরুষ সমাস স্পষ্ট হয় কী করে?যাই হোক,তিনি একটি সংকলন সম্পাদনা করেছেন মাত্র।এবং ‘বাক্যতত্ত্ব’ নিয়ে এই বইটি পড়ে মনে হয় যেন তাঁর একটি ‘ধোঁয়াশা’ থেকে গেছেকিন্তু এই সংকলনের বছর কয় পরে ১৯৮৮তে প্রকাশিত,কিন্তু ২০০৮এর সংস্করণ --তাঁর ‘তুলনামূলক  ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান’-এ আমাদের নজর ফেরাবার সুযোগ হয়েছে। সেখানে কিন্তু ‘রূপতাত্ত্বিক ও বাক্যিক পরিবর্তন’ খুব সংক্ষেপে একত্রে আলোচনা করছেন।৫৫ এবং ‘কারক’ প্রসঙ্গে খুব সংক্ষেপে ‘কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া’র ক্রম নিয়েই আলোচনা করেছেন।

এই যে সংশয়ের জায়গা-- একে সুন্দর ব্যাখ্যা করেন রামেশ্বর শ’,“সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষায় শব্দগুলির বিন্যাস(word order) গৌণ,রূপতত্ত্বই প্রধান।আবার বাংলা প্রভৃতি অনেক আধুনিক ভাষায় বাক্যগঠন নির্ভর করে বাক্যমধ্যে শব্দের বিন্যাস (word order) ও রূপতত্ত্ব দুইএরই উপর।”৫৬এসব আমরা আগে লিখে ব্যাখ্যাও করে এসেছি।এইখানে শুধু এই লিখে রাখা ভালো যে এই কারণেই সংস্কৃত বা আর্য ভাষাতে ‘কারক’ বাক্যতত্ত্বের বিষয় হতে পারত নাএটি রূপতত্ত্বেরই তথা ‘সুবন্ত’ প্রকরণেরই বিষয় হওয়া সম্ভব ছিল এবং তাই হয়েছিলসেই সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুসরণে যখন বাংলা- অসমিয়া আদি আধুনিক ভাষার ব্যাকরণ তৈরি হবে তখন বাংলা বা অসমিয়া ভাষাবিদদের সমস্যাতে পড়া স্বাভাবিক।কারক এবং শব্দবিন্যাস নিয়ে আনকোরা নতুন করে ভাবতে হচ্ছে ভাষাবিদদের।রামেশ্বর শ’ এর পরে লিখছেন,“এই জন্য রূপতত্ত্ব ও বিন্যাসক্রম ব্যাপক অর্থে দু’টিই বাক্যতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে পড়ে।”৫৭ রূপপ্রধান বহু ভাষাতে সেগুলো আলাদা বিষয়।অনেক ভাষাতে একটি আছে তো অন্যটি নেইফলে আলোচনার সুবিধের জন্যে ভাষাবিজ্ঞানে দু’টি স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবেই এগুলো বিকশিত হয়েছে।কিন্তু বাংলার মতো ভাষাগুলোর কথা মনে রেখেই বোধ করি গ্লীসন প্রমুখ পশ্চিমা আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানীরাও এই কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে,“The distinction between morphology and syntax is not always sharp.”৫৮ এই খানে মনে রাখা ভালো,গ্লীসন হচ্ছেন সেই কালের বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানী,যিনি রূপান্তর মূলক সৃজনী ব্যাকরণের প্রবল প্রত্যাহ্বানের যুগেও বর্ণনামূলক ধারাকে ধরে রেখেছেন।

সুতরাং ‘কারক’ প্রসঙ্গটিকে আমরা ‘বাক্যতত্ত্বে’ এড়িয়ে যেতে পারব না,এটি স্পষ্ট হলো।কিন্তু আমাদের কাছে যে সমস্যা রইল,সেটি হল ‘উদ্দেশ্য-বিধেয়’-কে বাক্যতত্ত্বে ধরা হবে কি না।‘বাচ্য’ (Voice)-কে নিয়ে কী করা হবে? ‘উক্তি’ (Narration) বিষয়টি কি বাক্যতত্ত্বে খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস? কী করে বাক্য বিশ্লেষণ করে আধুনিক বর্ণনামূলক ভাষা বিজ্ঞান?এই নিয়ে যদিও বা রামেশ্বর শ’ খানিকটা বিস্তৃত ধারণাই দিয়েছেন,চমস্কিতত্ত্ব নিয়ে তিনি খুবই সংক্ষিপ্ত-- সেকথা আমরা লিখে এসেছি।চমস্কিতত্ত্ব নিয়ে তার চেয়ে সাবলীল এবং বিস্তৃত ব্যাখ্যা একটি আমাদের সংগ্রহে রয়েছে,সেটি অসমীয়াতে লিখেছেন,ড ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া ‘রূপান্তর স্ফোট ব্যাকরণর পরিচয়’৫৯ এ ব্যাপারে অসমীয়াতে তিনিই পথিকৃৎ এই দাবি তাঁর নিজেরই। সেখানে পদ্ধতিটি অসমিয়া বাংলাতে ব্যবহারের সমস্যা নিয়ে তিনি যে কথাগুলো লিখেছেন,সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ,“রূপান্তর স্ফোট ব্যাকরণর পটভূমিত ইংরাজী ভাষার বাক্য বিন্যাসর বিচার বিশ্লেষণ ভালেখিনি হৈছে যদিও সি এতিয়ালৈকে পূর্ণাঙ্গ আরু স্থির রূপ লোয়া নাই।ভারতীয় ভাষাবোররো রূপান্তর স্ফোট ব্যাকরণর পটভূমিত বহল আলোচনা তেনেকৈ ওলোয়া নাই।ভারতীয় ভাষাবোরর স্বরূপ রূপান্তর স্ফোট ব্যাকরণর গণ্ডীর ভিতরত আলোচনা করিব পারি নে নোয়ারি সিও এটা বিবদমান বিষয়। সেই দৃষ্টিকোণর পরা অসমীয়া বাক্য গঠনর উদাহরণেরে রূপান্তর স্ফোট ব্যাকরণর স্বরূপ প্রকাশ করিবলৈ করা প্রয়াস এক বলিষ্ঠ পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ মাথোনমাত্র সময়েহে তার স্থায়ী মূল্য নিরূপণ করিব।”৬০এই কথা তিনি লিখছেন ১৯৯৩তে প্রকাশিত একটি সংকলন ‘ভাষার তত্ত্ব-কথা’-তে। যার ২০০৪এ প্রকাশিত সংস্করণ থেকে কথাগুলো আমরা তুলে দিয়েছি।

স্বাভাবিক ভাবেই যে রূপকল্পে আমরা আলোচনা করে আসছি,তাতে কেবল রূপান্তরমূলক ব্যারকণে ভরসা করা কঠিন। কেবল বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানে আশ্রয় নেয়াও অসম্ভব।স্বাভাবিক ভাবেই পরম্পরাগত পদ্ধতি দিয়ে এখানেও আলোচনা শুরু করা ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নেই।এবং এগুলো কেন,পরস্পর একেবারেই সম্পর্কশূন্য নয়---সে সম্পর্কে কিছু কথা আমরা ‘শব্দতত্ত্ব’-এর আলোচনা করতে গিয়ে লিখে এসেছি।বাক্যতত্ত্বে কথাটি আরো স্পষ্ট করেছেন রামেশ্বর শ’রূপান্তর মূলক ব্যাকরণাদি এসে উপস্থিত হবার পরে পরম্পরাগত বাক্যতত্ত্বের বহু খামতি বা ত্রুটি নজরে আসতেই পারে।তারপরেও রামেশ্বর শ’ লিখছেন,“কিন্তু যেহেতু ঐতিহ্যাগত ব্যাকরণের বাক্যতত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গী ঐতিহাসিক ছিল না,মূলত এককালিক বর্ণনামূলকই ছিল,এবং যেহেতু তার কিছু কিছু মূল ধারণা আধুনিক বাক্য বিশ্লেষণেও প্রতিষ্ঠাভূমি রূপে কাজ করে,সেহেতু আধুনিক বর্ণনামূলক বাক্যতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনার আগে ঐতিহ্যাগত ব্যাকরণের বাক্যতত্ত্বের মূল সূত্রটি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।”৬১আমরা তাই এবারেও মূলত তাঁর দিশাপথ ধরে এগোনোই সঠিক বলে মনে করছি। রামেশ্বর গঠন অনুযায়ী বাক্যের প্রকার ভেদ দিয়ে শুরু করেছেন।আকাঙ্ক্ষা, যোগ্যতা, আসত্তি-র কথা লিখেছেন পরে।আমরা নির্মল দাশ এবং গোলোকচন্দ্র গোস্বামীকে অনুসরণ করেই  শুরু করবো।

 

।। বাক্যের  গুণ ।।

আকাঙ্ক্ষা,যোগ্যতা,আসত্তি’ কে ‘বিষয়’ মাত্র বলে লিখেছেন ড নির্মল দাশ।৬২ গোলকচন্দ্র স্পষ্ট লেখেননি এগুলো কী। শুধু লিখেছেন,‘বাক্য হ’বলৈ হ’লে’৬৩এই তিনটি চাই।অর্থাৎ তিনটি ‘সর্ত’ পূরণ করা চাই।রামেশ্বর শ’ লিখেছেন,‘শুদ্ধ বাক্যের ত্রি-সূত্র’৬৪এক কথাতে এগুলোকে বাক্যের ‘গুণ’ বলা ভালো।নির্মল দাশও ‘মৌলধর্ম’ এবং ‘ত্রিগুণ’ শব্দগুলো পরে ব্যবহার করেছেন।৬৫‘গুণ’ শব্দটি গোলোকচন্দ্রও পরোক্ষে হলেও ব্যবহার করেছেন। যেমন,“অর্থর যোগ্যতার দরেই রূপগত যোগ্যতাও বাক্যর গঠনত অতি প্রয়োজনীয় গুণ৬৬আলঙ্করিক বিশ্বনাথের থেকে এসেছে এই ধারণাটি।তিনি ‘সাহিত্যদর্পণ’-এ লিখেছিলেন,‘বাক্যং স্যাৎ যোগ্যতা –আকাঙ্ক্ষা-আসত্তি-যুক্ত পদচ্চয়ঃ’যেমন আমরা শব্দার্থতত্ত্বে লিখে এসেছি, অর্থই গঠনের নির্ধারক, এখানেও এই কথা সত্য।কতকগুলো ধ্বনি সমাবেশের সমষ্টি মাত্রই বাক্য নয়।শ্রোতা বা পাঠকের কাছে তাঁর অর্থ স্পষ্ট করবার দক্ষতা গুলো থাকতে হবে। যে তিনটি প্রধান গুণে এই দক্ষতা অর্জিত হয় সেইগুলোই এই—যোগ্যতা,আকাঙ্ক্ষা এবং আসত্তি।

 যোগ্যতা:

 নির্মল দাশ লিখেছেন,“বাক্যের অন্তর্গত পদসমষ্টির পারস্পরিক ভাবসঙ্গতি থাকার নাম যোগ্যতা।”৬৭ গোলকচন্দ্র লিখেছেন,পদের যোগ্যতা নির্ভর করে দুটি কথার উপরে,“প্রথমত: পদর অর্থ;আরু দ্বিতীয়ত: পদর রূপ বা গঠন।”৬৮  অর্থগত যোগ্যতা হচ্ছে,“বাক্যত ব্যবহৃত পদর অর্থর সঙ্গতি বা মিল থাকিব লাগিবো।”৬৯ আর রূপগত যোগ্যতার,“...অভাবত বাক্য দেখাত শুদ্ধ যেন লাগিলেও প্রকৃতার্থত অসার্থক আরু ভুল হয়।”৭০রূপগত যোগ্যতাকে আবার তিনি ‘রূপাত্মক যোগ্যতা’ এবং ‘সাধনগত যোগ্যতা’ বলে আলাদা করেছেন।আসলে আমরা যেগুলোকে শব্দনির্মাতা এবং পদনির্মাতা রূপিম বলছিলাম,সেই অনুযায়ীই তিনি এই বিভাজন করেছেন।মূল কথাটি সেই ‘অর্থের সঙ্গতি’ যেন বিপন্ন না হয়,সেদিকে নজর রাখা।রামেশ্বর শ’ লিখেছেন আরেকটু গভীরে গিয়ে,“বাক্যের অর্থ অর্থাৎ বক্তার বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতার বা বৃহত্তর বা গভীরতর সত্যের যে সঙ্গতি থাকে তাকে যোগ্যতা বলা হয়।এই সঙ্গতি না থাকলে যোগ্যতা বিঘ্নিত হয় এবং তাতে বাক্য অর্থহীন হয়ে পড়ে।আর অর্থযুক্ত না হলে কোনো পদসমষ্টিকে বাক্যই বলা যায় না।”৭১ অর্থাৎ ‘অর্থ’ কথাটির সামাজিক মর্মের দিকে তিনি ইঙ্গিত করছেন।অন্যথা ‘বাস্তব অভিজ্ঞতা’ কথাটির কীই বা মানে?কিন্তু এই সব ‘অর্থসঙ্গতি’ও আসলে প্রাথমিক স্তরের কথাবার্তা,যেটুকু ‘ধরে না নিলে’ কোনো কথার সূচনাই করা যায় না।অন্যথা বক্তা-শ্রোতার অভিজ্ঞতার সঙ্গতিরও আরেকটি কথা পাড়তে হয়।নইলে এই ধরনের সঙ্গতি সম্পন্ন যথাযোগ্য বাক্যের অর্থও যে কেউ বুঝতে পারবেন না:

অ। কথিত আছে এসব জানার পরে নেপোলিয়ন ল্যাপ্লাসকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,মহাবিশ্বের এই   

     চিত্রে ঈশ্বরের যায়গা কোথায়? ল্যাপ্লাসের উত্তর ছিলো,“স্যার, ঐ হাইপোথিসিসটার আমার

     কোনো প্রয়োজন পড়েনি।৭২

আ।চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,

    মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর

    হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা

    সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,

    তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন?

   (বনলতা সেন:জীবনানন্দ  দাশ)

এই  বাংলা বাক্যটি নেয়া যাক---আমরা পা দিয়ে হাঁটি এবং হাত দিয়ে ভাত খাই।তার বদলে যদি বাংলাতে লেখা হয়,--- আমরা হাত দিয়ে হাঁটি আর পা দিয়ে ভাত খাই।তবে শব্দগুলোর অর্থ বোঝা গেলেও বাক্যের অর্থটি হবে নিতান্তই হাস্যকর। একই কথা যদি বাংলাতে লিখি---আমরা পায়ে হাঁটি আর হাতে ভাত খাই--- তাহলেও অর্থ একটি বোঝা যাবে বটে।তবে শোনাবে না ভালো।অন্যদিকে অসমিয়াতে যদি লিখি –আমি ভৰি দি খোজ কাঢ়োঁ,আৰু হাত দি ভাত খাওঁ---সেটিতেও মানে বোঝা যাবে।কিন্তু শোনাবে ভালো যদি লিখি---আমি ভৰিৰে খোজ কাঢ়োঁ,আৰু হাতেৰে ভাত খাঁও।এর জন্যেই রূপতাত্ত্বিক গঠনটিও জরুরি বিষয়।অন্যপক্ষ কেউ কাজটা করছে বোঝাতে গিয়ে যদি লেখা হয়-- সে স্কুলে গেলাম,সি স্কুললৈ গলোঁ।বাক্যের গঠন ভুল,ফলে বক্তার থেকে শ্রোতার কাছে যথার্থ অর্থ বহনে অক্ষম হবে।বাংলাতে এর মানে হয়ে যাবে, “আমি সেই স্কুলে গেলাম।”

গোলকচন্দ্র বেশকিছু অসমিয়া পদগুচ্ছের উল্লেখ করে,অসমিয়াতে যেগুলোকে ভুল বলে দেখিয়েছেন৭৩...দেখা যাবে যে সেগুলো রূপভেদ বাদ দিলে বাংলাতে সঠিক।তার মানে এই যোগ্যতা ভাষাভেদে ভিন্ন হয়। যেমন—

 

ভুল                                                        শুদ্ধ

আঘাত হানে                                             আঘাত কৰে

সৈন্য মোতায়েন কৰে                                   সৈন্য নিয়োগ কৰে

বক্তব্য ৰাখে/থাকে                                      বক্তব্য দাঙি ধৰে/বক্তৃতা দিয়ে

নিমন্ত্রণ থাকিল                                           নিমন্ত্রণ জনালোঁ

নিয়ম মাফিক                                            নিয়ম মতে বা নিয়ম অনুসৰি

 

বাংলাতে শুধু ‘নিমন্ত্রণ থাকিল’-এর বদলে হবে, ‘নিমন্ত্রণ থাকল’‘আঘাত হানে’ কথাটি সাধুবাংলাতে মানায়।এমন কি অসমিয়াতে যেগুলো শুদ্ধ,সেগুলোও সামান্য রূপভেদ বাদ দিলে পদবিন্যাসের দিক থেকে বাংলাতে সঠিকই। যেমন ‘বক্তব্য দাঙি ধৰে’-র বদলে বাংলাতে হবে ‘বক্তব্য তুলে ধরে/ ধরেন’,‘নিয়ম অনুসৰি’র বদলে বাংলাতে হবে ‘নিয়ম অনুসারে’

 আকাঙ্ক্ষা:

 নির্মল দাশ লিখেছেন,“যতক্ষণ বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণ না হয় ততক্ষণ বাক্যটির পূর্ণ অর্থ অনুধাবনের জন্য শ্রোতার মনে অপূর্ণতাজনিত আকাঙ্ক্ষা জাগে। শ্রোতা অনুক্ত অংশটি জানতে আগ্রহী হয়।বাক্যে ব্যবহৃত পদসমষ্টি যদি এই আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত করতে পারে তবে সেই বাক্যটির আকাঙ্ক্ষা আছে বুঝতে হবে।”৭৪‘আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত করবার’ পরে আর ‘আকাঙ্ক্ষা আছে’ কেন  বুঝতে হবে আমাদের পক্ষে বোঝা কঠিন।বরং সহজ এই ভাবে বোঝা যে বাক্যটি ‘আকাঙ্ক্ষা’ অবশিষ্ট রাখে নি,পূরণ করেছেগুণটির নাম বিশ্বনাথকে হুবহু অনুসরণ না করে ‘আকাঙ্ক্ষা পূরণ’ রাখলে কেমন হয়? গোলোকচন্দ্র লিখেছেন,এরকম,“আকাঙ্ক্ষা শব্দর সাধারণ অর্থ হেঁপাহ বা ইচ্ছাবাক্য গঠনত এই আকাঙ্ক্ষাই বাক্যর অপূর্ণতা গুচাই পূর্ণতা লাভ করার ইচ্ছা বুজায়।কিহে বাক্য সম্পূর্ণ করে সেই কথাও তোমালোকে জানিব লাগে।বাক্যর অপূর্ণতা গুচাই কিহে সম্পূর্ণতা করে সেই কথা জানিবলৈ বাক্যর,অর্থাৎ কথা কোয়ার সুর বা সুর-লহরর জ্ঞান অপরিহার্য।”৭৫ এই প্রসঙ্গে তিনি অসমীয়া বাক্যে সুরলহর,ছেদ তথা যদি চিহ্নের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে দেখিয়েছেন।এক বা বহু পদ তথা সমাপিকা ক্রিয়া নিয়ে বা না নিয়েও বাক্য সম্ভাবনার কথা নজির দিয়ে দেখিয়েছেন।কিন্তু নির্মল দাশ যেভাবে ‘ভাবতে পারি নি মা আমার একটা সামান্য কথায়......” এমতর অর্ধ বাক্য রেখে তাকে ‘এতো কষ্ট পাবেন’ জুড়ে৭৬ সম্পূর্ণ করবার নজির দিলেন,সেরকম কোনো প্রসঙ্গে গোলোকচন্দ্র যান নি।আবার ছেদ আদির প্রসঙ্গ নির্মল দাশ টানেন নি। রামেশ্বর শ’ নির্মল দাশের কথাগুলোই লিখেছেন,কিন্তু তাঁর ব্যাখ্যাটি পরিষ্কার।তিনি লিখেছেন,“কোনো বাক্যের বক্তব্য পূর্ণরূপে জানার জন্য শ্রোতার মনে যে আকাঙ্ক্ষা বা কৌতূহল থাকে বাক্যের দ্বারা তা নিবৃত্ত হওয়া চাই। শ্রোতার মনে কৌতূহল জাগিয়ে দিয়ে কোনো বাক্য যদি হঠাৎ মাঝপথে থেমে যায় তা হলে সেই বাক্য পূর্ণাঙ্গ হলোই না।”৭৭‘আজ যদি বৃষ্টি হয়’ ......এই টুকু বলে থেমে গেলে হলো না।‘তা হলে আমি ইস্কুলে যাব না।’ --এমন কিছু বলে বাক্য শেষ করতে হবে।৭৮  

আসত্তি:

নির্মল দাশ লিখেছেন,“আসত্তির মূল কথা,বাক্যের যথাস্থানে বিভিন্ন অংশ সন্নিবেশের নাম আসত্তি।”৭৯এই বাক্যটির শুরু এবং শেষে ‘আসত্তি’ কথাটির পুনরুল্লেখ করবার পরে বাক্যটির নিজের কোনো যোগ্যতা আছে কিনা,এই প্রশ্ন তোলা থাকলমূল কথা তবু বোঝা যাচ্ছে।তিনি নজির দিয়েছেন,“‘প্রমীলারে অধীর হইলা বীর ভাবি।’-- বাক্যটিতে আসত্তি নেই অর্থাৎ যথাস্থানে পদস্থাপনা হয় নি।আসত্তির অসঙ্গতি দূর করতে হলে বাক্যটি হবে:‘অধীর হইলা বীর ভাবি প্রমীলারে।’এবারে,বাক্যের পদগুলি অর্থবোধক সামীপ্য অর্জন করেছে।”৮০গোলোকচন্দ্র গোস্বামীর সংজ্ঞাটি বেশ বিস্তৃত।তিনি লিখছেন,আসত্তির,“ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ওচরতে বহা বা লগালগি থকা অবস্থা,অর্থাৎ নিকটতা।অর্থগত আরু রূপগত যোগ্যতা থকা পদবোর বাক্যত যথোপযুক্ত ক্রমত যথাসম্ভব ওচরা-উচরিকৈ সজোয়া হয়।পদবোরর এনে অবস্থানকে পদর আসত্তি বোলে।”৮১তিনি আরো লিখছেন,“ ...আসত্তি নির্ণয় করি তলত দিয়া কথাবোর জানিব পারিযেনে,

১) পদর লগত পদর সঙ্গতি আরু সেই সঙ্গতির গাঢ়তা।

২) সমস্ত পদ আরু খণ্ডবাক্যর গঠন।

৩) গর্ভবাক্যর গঠন আরু অবস্থান। আরু

৪) বাক্যর অর্থর স্পষ্টতা।

একে আষারে কবলৈ গ’লে আসত্তি নির্ণয়েই বাক্য বিশ্লেষণ বুলি ধরিব পারি।”৮২স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর এই অংশটি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘএবং বাংলাতে নির্মল দাশ প্রমুখ যারা বাক্য বিশ্লেষণাদি আলাদা করে আলোচনা করছেন,তিনি সেগুলো এখানেই অনেকটা করে নিচ্ছেন।বাক্যের গঠন অনুসারে প্রকারভেদ আলোচনা করতে গিয়ে যেখানে খণ্ডবাক্য আদির প্রসঙ্গের দরকার পড়ছে,সেগুলোও তিনি অনেকটাই সারছেন।তার পরে সরল,জটিল আদি বাক্যের প্রকারভেদের আলোচনাতে এগোচ্ছেন।আমরা প্রয়োজনে আবার সেখানে ফিরবো।তার আগে দেখা যাক,রামেশ্বর শ’ কী লিখছেন।“আসত্তি বলতে বোঝায় বাক্যের অন্তর্গত পদগুলির মধ্যে রূপতাত্ত্বিক সঙ্গতি ও বিন্যাসের নৈকট্য বা ক্রমবাক্যে বিন্যস্ত পদগুলির মধ্যে রূপতাত্ত্বিক সঙ্গতি থাকা চাই।”৮৩ যেমন—‘আমি কলকাতা যাই’ না লিখে যদি লেখা হয় –‘আমি কলকাতা যান’--- তবে বক্তাপক্ষের কর্তার সঙ্গে শ্রোতা বা অন্যপক্ষের ক্রিয়ার সঙ্গতি থাকছে না।এখানে একটি সমস্যা আছে।প্রথমত আমরা স্পষ্টই দেখব,এই প্রসঙ্গটি গোলোকচন্দ্র গোস্বামী ‘যোগ্যতা’তে ধরছেন।এমনিতেও ‘রূপতাত্ত্বিক সঙ্গতি’ ও ‘বিন্যাসের নৈকট্য’ দু’টি স্বতন্ত্র বিষয়দুই স্বতন্ত্র বিষয়ই কি ‘আসত্তি’ কথাতে বোঝাচ্ছে?অবশ্য এর পরে তিনি আলাদা করে ‘বিন্যাসের নৈকট্য’ও আলোচনা করছেন।লিখছেন,“যেসব পদ দিয়ে বাক্য গঠিত হয় সেই পদগুলির মধ্যে পারস্পরিক দূরত্বের ব্যাপারে প্রত্যেক ভাষায় যে নিজস্ব নিয়ম আছে,কোনো পদ বাক্যে কোথায় বসবে সে বিষয়ে যে প্রথা আছে,তা মেনে চলা দরকার।”৮৪আমাদের মনে হচ্ছিল ‘তা মেনে চলা দরকার’ না লিখে ‘তাকে আসত্তি বলে’ লিখলে কথাটি বেশি স্পষ্ট হতো।তারপরে কোনো তর্ক থাকতো কিনা,সেই প্রশ্ন পরে।তিনি এই নজির দিচ্ছেন,‘আমরা চিনি দিয়ে সরবৎ করে খাই’—না লিখে যদি লেখা হয় ‘আমরা সরবৎ দিয়ে চিনি করে খাই’,তাহলে “বাক্যটি অর্থহীন হয়ে পড়ে এবং আমাদের বক্তব্যটি ঠিক-ঠাক প্রকাশিত হয় না।”৮৫ কিন্তু একই কথা কি আমরা ‘যোগ্যতা’ প্রশ্নেও আলোচনা করে আসি নি?অর্থের সঙ্গতির প্রশ্ন?এই অব্দি এসে আমরা নিশ্চিত,সব কিছু কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।পদক্রমের যে ‘কবিতায় বা বিশেষ উক্তিতে বা আবেগ উত্তেজনার সময়’ ‘অল্পসল্প পরিবর্তিত করা চলে’৮৬ এই কথা তিনি এর পরে বেশ নজির দিয়েই বোঝাচ্ছেনএবং এর পরে তিনি আলাদা করে আবার ‘বাংলা বাক্যে পদক্রম’৮৭ আলোচনা করছেন। সেখানে উদ্দেশ্য বিধেয়,কর্তা –কর্ম –ক্রিয়া আদি আসছে।আমরা সেদিকটাতে পরে যাচ্ছি।তার আগে এই বিষয়টি স্পষ্ট করা যাক।

আমাদের অভিমত চতুর্দশ শতকের সংস্কৃত কাব্যের আলঙ্করিক ‘সাহিত্যদর্পণ’-এর রচয়িতা বিশ্বনাথ কবিরাজ বাংলা বা অসমিয়ার মতো আধুনিক ভাষা নিয়ে কথা বলেন নি।তাঁর বিচারের বিষয়ও ছিল না মানুষের মুখের ভাষা।রীতিমত সমুন্নত সংস্কৃত কাব্য লিখবার দিশা তিনি দিচ্ছিলেন,এবং তাঁর পূর্বসুরিদের খণ্ডন এবং বিস্তার ঘটাচ্ছিলেন।তাঁর সেই তাত্ত্বিক অবস্থানকে বিচ্ছিন্ন ভাবে তুলে এনে আমরা আধুনিক একটি ভারতীয় ভাষা---যে ভাষার ব্যাকরণ না শিখেই বা অলঙ্কারশাস্ত্র না পড়েই লোকে শিখছে এবং ব্যবহার করছে ---তার উপরে সাহিত্যগুণের ভার চাপাবো কেন?এটা কি আনুশাসনিক ব্যাকরণের ধারাকে অনুসরণ করা হচ্ছে না?আমরা কি ভাষাব্যবহারকারীর অসীম বাক্য গঠনের ক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন তুলতে চাইছি?অথবা,সেই ক্ষমতাকে অস্বীকার করছি?তাছাড়া বাক্য প্রসঙ্গেই যদি ‘গুণ’-এর প্রসঙ্গ টানতে হয়,তাহলে ধ্বনি,শব্দ প্রসঙ্গেও ‘উচ্চারণ গুণ’,‘শব্দনির্মাণ গুণ’, ‘পদনির্মাণ গুণ’ এই সব প্রসঙ্গের অবতারণা করতে হয়।তারপরেও প্রশ্ন,এই গুণগুলো কি ব্যক্তির না ভাষাগোষ্ঠীর অর্জনের বিষয়? এরকম প্রশ্ন পরম্পরার এক দীর্ঘ তালিকা তৈরি করা খুবই সহজ,যদি বিজ্ঞানের দৃষ্টি থেকে তাকানো হয়।বাক্যের বিশ্লেষণেও তো সব ক’টার দরকার পড়ছে নানইলে ‘বিশ্লেষণ’ কথাটি গোলোকচন্দ্র শুধু আসত্তি প্রসঙ্গেই ওঠাবেন কেন?কোন বাক্যটি কীভাবে বললে শ্রোতাকে ভালো বোঝানো যাবে,সেসব কি বক্তা বোঝেন না?আর সব কিছু ঠিকঠাক থাকলেই যে শ্রোতা যথার্থ অর্থটি বুঝে নেবেন---সেরকম কোনো নিশ্চয়তা দেয়া কি সম্ভব?আমরা একটি স্টিফেন হকিঙের রচনার অনুবাদ এবং জীবনানন্দের কবিতার নজির দিয়েছি।‘আমি খাবো না’,‘খাবো না আমি’,‘খাবো না’,‘আমি না’ ---এই চার  বাক্যকে বেঠিক বলা যাচ্ছে কি?বললেই, সাধারণ ব্যবহারকারীর কাছে তার কোনো মর্যাদা থাকছে কি?এই সংস্কৃতের ধাঁচে বাংলা বাক্যেরও গত বেঁধে দেবার প্রবণতাটি ‘সাধুবাংলা’তে এসেছিল।রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,“যাঁরা সাধু ভাষায় গদ্যসাহিত্যকে রূপ দিয়েছিলেন স্বভাবতই তাঁদের হাতে বাক্যবিন্যাসের একটা ধারা বাঁধা হয়েছিল।তার প্রয়োজন নিয়ে তর্ক নেই।আমার বক্তব্য এই যে,এ বাঁধাবাঁধি বাংলা চলতি ভাষায় নয়। কোথায় গেলেন তোমার দাদা,তোমার দাদা কোথায় গেলেন,গেলেন কেথায় তোমার দাদা,দাদা তোমার গেলেন কোথায়, কোথায় গেলেন দাদা তোমার:প্রথম পাঁচটি বাক্যে গেলেনক্রিয়াপদের উপর এবং শেষের বাক্যটিতে কোথায়শব্দের উপর ঝোঁক দিয়ে এই সবকটা প্রয়োগই চলে।আশ্চর্য তোমার সাহস,কিংবা,রেখে দাও তোমার চালাকি,একেবারে ভাসিয়ে দিলে কেঁদে : সাধু ভাষার ছাঁদের চেয়ে এতে আরও বেশি জোর পৌঁছয়।যা থাকে অদৃষ্টে,যা করেন ভগবান,সে পড়ে আছে পিছনে:এ আমরা কেবল-যে বলি তা নয়,এইটেই বলি সহজে।”৮৮আমাদের এই চার বাক্য কিংবা রাবীন্দ্রিক ‘প্রথম পাঁচটি’ বাক্যে তো বিশেষ পরিপ্রেক্ষিত এবং সুরের সংযোগে একই অর্থ বোঝাতে পারে। সেই সুরের ব্যবহার প্রসঙ্গ অসমিয়াতে গোলোকচন্দ্র যদিও বা টানলেন, বাংলার দুই ভাষাবিদ কিন্তু সে সম্পর্কে আপাতত নীরব।এবং খুব স্পষ্ট সংজ্ঞা প্রায় কেউই দিতে পারছেন না।‘আমরা হাত দিয়ে হাঁটি আর পা দিয়ে ভাত খাই’ দিয়ে তো ‘আসত্তি’র কথাটিও আলোচনা করতে পারতাম।অথবা,‘আমরা সরবৎ দিয়ে চিনি করে খাই’ –বাক্য দিয়ে ‘যোগ্যতা’র কথাও আলোচনা করা যেতো—দুই জায়গাতেই পদের অর্থের এবং বিন্যাসের অসঙ্গতি স্পষ্ট  কিন্তু সেই কথা কি আমাদের আলোচনাতে স্পষ্ট হলো?‘আমি কলকাতা যান’- ধরনের বাক্য সম্পর্কেও একই কথা।তার উপরে গোলোকচন্দ্র গোস্বামী যদিওবা সঠিক ভাবেই একে ‘যোগ্যতা’র প্রসঙ্গেই আলোচনা করেছেন,কেন না এতে অর্থের সঙ্গতি বিনষ্ট হচ্ছে,রামেশ্বর শ’ এর কথা আনছেন ‘আসত্তি’র প্রসঙ্গে।অথচ,এতে পদের বিন্যাসে কোনো অসঙ্গতি নেই।আমরা তবে কাকে ধরে এগোই?দুই ভাষা-বিদ্যার দুই ভিন্ন তত্ত্ব?বিজ্ঞানের বিশ্বজনীনতা তো এখানেই বিপন্ন! আর ‘আকাঙ্ক্ষা’র কথাটি কি বাহুল্য বলে মনে হচ্ছে না?বহু বক্তাই ‘ভাবতে পারি নি মা আমার একটা সামান্য কথায়......’--এইটুকুন বলে থেমে যেতেই পারেন। শোনে আরজনে রেগে মেগে বলতেই পারেন,‘যা বলবার পুরোটা বলো।আধা-মাধা বলে কী বোঝাতে চাইছ?’---তাতে তৃতীয় কারো কি বুঝতে অসুবিধে হবে যে-- ঝগড়া একটা হচ্ছে;একজন কথা বলতে পারছে না,আর জন বকাঝকা করে তাকে বলতে দিচ্ছে না। কিন্তু বাক্য যে বললে পুরোটাই বলতে হয়,সে বক্তাও জানেন। সে যদি সাহিত্যের সংলাপ হয় লেখকও জানেন।কিন্তু লোকে আদ্ধেক বলেন,এবং অর্থও বোঝেন---এও ঘটনা। গোলোকচন্দ্র তাই এহেন বাক্যের নজির দিয়েই ‘সুরলহর’-এর প্রসঙ্গে চলে গেছেন। বক্তা যে বাক্যটি সম্পূর্ণ করবেন,এই নিয়ে তিনি নিশ্চিত। কোনো ঔচিত্যের পরামর্শ দিচ্ছেন না।কথাগুলো তিনি লিখেছেন এইভাবে,“মই এতিয়া নাযাওঁ... (এই ... চিনে অপূর্ণ বাক্যর সুর-লহর বুজাইছে।)—এই সুর-লহরেরে মাতিলে বুজা যাব যে এই বাক্যর বক্তাজনর আরু কথা ক’বলৈ বাকী আছে,ক’বলগীয়া কথার অন্ত পরা নাই;পিচর কথাখিনি মনলৈ অহা নাই কারণে হয়তো অলপ রৈছে।বক্তাজনর কথা কোয়া যেনেকৈ শেষ হোয়া নাই,শ্রোতারো তেনেকৈয়ে শ্রবণর আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হোয়া নাই।এতিয়া, সেইখিনি কথাকে যদি এনে দরে কোয়া হয়,মই এতিয়া নাযাওঁ বুলি ভাবিছোঁ।এই বাক্যটো শুনি শ্রোতায়ো লগে লগে ভাবিব যে বক্তার বক্তব্য শেষ হৈছে;গতিকে শ্রবণর আকাঙ্ক্ষাও সিমানতে শেষ।এনেকৈয়ে,বাক্যর আকাঙ্ক্ষা প্রধানতঃ সুর-লহরর দ্বারা পূর্ণ হয়।”৮৯ কিন্তু তাতে তো স্পষ্ট হচ্ছে না ‘সুরলহর’টিই কি ‘আকাঙ্ক্ষা’ শব্দের অর্থের বিস্তার?তাছাড়া ‘আকাঙ্ক্ষা’টি তো শ্রোতারবক্তার নিয়ন্ত্রণে সেই ‘আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্তি’টিই থাকে,অথবা ‘সুরলহর’এই ‘সুরলহর’ তথা বাক্য-স্বরাঘাতের স্বনিমীয় তাৎপর্যের কথাটি তো আমরা ধ্বনিতত্ত্বে জেনেই এসেছি।আলাদা করে সেই নিয়ে কথা বললেই হলো।সম্ভবত ডনির্মল দাশও কথাটি আঁচ করেছেন। তাই স্পষ্টই লিখেছেন,“তবে শব্দের অর্থ ও পদস্থাপনা ও পদবিন্যাসের নিয়ম জানা থাকলে এ জন্য পৃথক প্রযত্নের প্রয়োজন হয় না।আপনা থেকেই এই ত্রিগুণ বাক্যরচনা কালে চলে আসে।”৯০ এর পরেই লিখছেন,আসল কথা,“তাই এবার জানতে হবে বাক্যে পদস্থাপনে বা পদবিন্যাসের (Syntax) নিয়ম।”৯১যে কাজটি রামেশ্বর শ’-ও করেছেন।‘শুদ্ধ বাক্যের ত্রি-সূত্র’ অতি সংক্ষেপে সেরে চলে এসেছেন,‘বাংলা বাক্যে পদক্রমে’৯২ তিনি নিতান্ত পারম্পরিক ধারাটির পরিচয় দিতে গিয়ে এই সব লিখেছেন,অন্যথা এর বৈজ্ঞানিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে তিনি সচেতন।জগন্নাথ চক্রবর্তী এই তিনটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন,তাঁর ‘বাক্যতত্ত্ব’ অধ্যায়ে ‘উদ্যম:দুই’-তে।মান বাংলার কিছু নজির দিয়েছেন।সিলেটি নেই।পরে এর প্রয়োগ কিছুই দেখান নি।অর্থাৎ করতে হয় বলেই করেছেন।৯৩বিষয়টি কবে কীভাবে বাংলা ব্যাকরণে প্রবেশ করেছিল,সেই তথ্য দিয়েছেন হুমায়ুন আজাদ।তিনি লিখেছেন,“সম্ভবত উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে সংস্কৃত পণ্ডিত বাঙলা ব্যাকরণ রচয়িতারা সাহিত্যদর্পণঃ থেকে চয়ন করেন ‘বাক্যং স্যাদযোগ্যতাকাঙ্ক্ষাসত্তিযুক্তঃ পদোচ্চয়ঃ’ সংজ্ঞাটি,এবং গ’ড়ে তোলেন বোপদেবের মুগ্ধবোধ-অনুসারী বাঙলা ব্যাকরণ ও কারকবর্ণনার রীতি।”৯৪

ফলে আমরা যে তিন ভাষাবিদের ‘গুণ’তত্ত্ব নিয়ে কথা বলে এলাম, তাঁদের উপস্থাপনাকে জটিলতা-মুক্ত করে  যেটি লিখতে চাইছি, এক বাক্যে--- সে হলো এই--- একটি ‘আপাত’ সঠিক বাক্য হতে গেলে বাক্যের এবং তাতে ব্যবহৃত প্রতিটি পদের  গঠনগত বিন্যাসের এবং অর্থের সঙ্গতি,সম্পূর্ণতা এবং স্পষ্টতা নিশ্চয় থাকা চাইসেটি আনতে গিয়ে বক্তা বা লেখক কী করেন, (স্পষ্টতই--- কী করবেন?-- নয়।) আমরা ক্রমে বিচার করবো।কিন্তু তার আগে এর মধ্যে আলঙ্করিক বিশ্বনাথ কবিরাজকে প্রেক্ষিত বিচ্ছিন্ন করে মাঝখান থেকে টেনে আনবার আমরা বিরোধীবাংলা ও অসমিয়া ভাষাতে দুর্বোধ্য ‘যোগ্যতা’,‘আকাঙ্ক্ষা’,এবং ‘আসত্তি’ ---এই তিন পারিভাষিক শব্দ ক’টি বাদ দেবার পক্ষে।গুণতত্ত্ব শৈলীবিজ্ঞানের বিষয় হতে পারে,সাধারণ ভাষাবিজ্ঞানের নয়।

 

।। বাক্যের পদক্রম ।।  

সুকুমার সেন শুধু এই একটি বিষয় নিয়েই কথা বলেছেন,আমরা আগে লিখে এসেছি। গোলকচন্দ্র গোস্বামী ‘আসত্তি’ প্রসঙ্গকেই আধুনিক পরম্পরাগত ভাষাবিজ্ঞানের আদলে পুনর্গঠন করতে গিয়ে সেখানেই বাক্যাংশ,খণ্ডবাক্য আদি প্রসঙ্গ দিয়ে ক্রমে পূর্ণবাক্য,তার প্রকারভেদ ইত্যাদি আলোচনা করে শেষের দিকে ‘পদক্রম’ নিয়ে আলোচনা করেছেন।উদ্দেশ্য- বিধেয় প্রসঙ্গটি আছে তারও পরে,আলাদা করে ‘বাক্য বিশ্লেষণ’ অধ্যায়েএবং সেখানে ‘আসত্তি’ প্রসঙ্গ আবার টেনেছেন৯৫একেবারে শেষে আছে ‘কারক’ প্রসঙ্গ।নির্মল দাশেরও ‘উদ্দেশ্য-বিধেয়’ প্রসঙ্গ রয়েছে পরে ‘বাক্য বিশ্লেষণ’ অধ্যায়ে একেবারে শেষে।৯৬তাতে বিশেষ কোনো অসুবিধে হয় নিবরং গোলোকচন্দ্র যেভাবে  ক্রমে ক্রমে ক্ষুদ্র থেকে বৃহতের দিকে এগোচ্ছেন তাতে বোঝাটা সহজই হয়। তবে রামেশ্বর শ’য়ের ক্রমেরও একটি সুবিধে আছে।তিনি ব্যাকরণ নয়,বাংলা ভাষাবিজ্ঞানের অধ্যয়ন পরম্পরাকেই অনুসরণ করছেন।সুকুমার সেনের মতো পদক্রমটিই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভেবে সেটিকেই আগে এনেছেন।তিনি পদক্রমের আলোচনা শুরুই করেছেন ‘উদ্দেশ্য-বিধেয়’ দিয়ে।এসবের আগে কিন্তু বাক্যের গঠন অনুসারে প্রকারভেদ ছুঁয়ে এসেছেন,আমরা আগেই লিখেছি।আমরা সেটিকে আপাতত স্থগিত রেখে পদক্রম ধরেই এগোচ্ছি।স্বাভাবিক ভাবেই  হুমায়ুন আজাদের কথাগুলো মনে রেখে আমাদের দেখতে হচ্ছে,‘কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া’র আগে বা পরে ‘উদ্দেশ্য–বিধেয়’র আদৌ কোনো দরকার পড়ছে  কি না।

বাক্যের  উদ্দেশ্য-বিধেয়:

একটি চিত্তাকর্ষক বিষয়ের উল্লেখ শুরুতেই করে রাখা ভালো যে সুকুমার সেনেরই মতো উনিশ শতকের শুরুর ভাগে লেখা সত্যনাথ বরার ‘বহল ব্যাকরণ’-এও কিন্তু উদ্দেশ্য-বিধেয়’ প্রসঙ্গ নেই।সুতরাং এই ধারণাটি যে কবে কোন পথে দুই ভাষার অধ্যয়ন ইতিহাসে প্রবেশ করল,সেটি এক স্বতন্ত্র অধ্যয়নের বিষয় হতে পারে।‘ব্যাকরণ- বিভীষিকা’ এই একই নামে ললিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়৯৭ এবং বিধুশেখর ভট্টাচার্যের৯৮ দুটি নিবন্ধ সংকলন করেছেন হুমায়ুন আজাদ। সেখানেও ধারণাটির উল্লেখ মাত্র নেই। রবীন্দ্রনাথের ‘শব্দতত্ত্ব’-গ্রন্থে তো এসব থাকবার কথাই নয়।‘বাংলা ভাষা পরিচয়’-এর একেবারে শেষের দিকে যৎসামান্য ‘বাক্যতত্ত্ব’ রয়েছে।৯৯সেখানেও এসব নেই।হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন,“ইংরেজি ব্যাকরণের সাথে পরিচিত বাংলা ব্যাকরণপ্রণেতারা সূচনা করেন উদ্দেশ্য-বিধেয় ভিত্তিক বাক্য বর্ণনা---উনিশ শতকেই...১০০বিশ শতকে সম্ভবত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভাষাপ্রকাশ বাংলা ব্যাকরণ’-এ বিষয়টির সমর্থন পেয়ে বাংলাতে তো বটেই অসমিয়াতেও ছড়িয়ে থাকবে,নইলে  সত্যনাথ বরার বইতে সেটি থাকত

রামেশ্বর শ’ লিখছেন,“বাংলা বাক্যের দু’টি মূল উপাদান---উদ্দেশ্য ও বিধেয়।সাধারণত বাক্যে দু’টি উপাদান উপস্থিত থাকেই।”১০১নির্মল দাশ লিখেছেন,“বাক্যের প্রধান দুটি অংশ:উদ্দেশ্য ও বিধেয়।প্রতিটি বাক্যে এই দুটি অংশ অবশ্যই থাকবে।”১০২ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী লিখেছেন,“আসত্তির ভিত্তিত পূর্ণ বাক্যক প্রধানত:দুটা ভাগত ভগোয়া হয়। যেনে:এটা উদ্দেশ্য আরু আনটো বিধেয়।বাক্যর উদ্দেশ্য আরু বিধেয় দুয়োটাই পরস্পরে পরস্পরর আসন্ন অঙ্গ।”১০৩জগন্নাথ চক্রবর্তীও ‘উদ্দেশ্য ও বিধেয়’-র পরিচিত সংজ্ঞাটি শুরুতে উল্লেখ করেছেন১০৪,এবং পরে গঠনবাদী,রূপান্তরবাদী বিশ্লেষণে ব্যবহার করে গেছেন।এই তিন সংজ্ঞাতই দু’টি করে সাধারণ বা সমার্থক শব্দ রয়েছে,তা হলো ‘প্রধান/মূল’ এবং ‘অংশ/উপাদান/অঙ্গ’আমাদের প্রশ্ন ১)‘অপ্রধান’ ‘অংশ’ বলে কি অতিরিক্ত তৃতীয় কিছু রয়েছে? এই প্রশ্নে এরা সবাই নীরব।২)কর্তা- কর্ম-ক্রিয়াদি কি বাক্যের অংশ বা উপাদান নয়?এর স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই।

তবে উদ্দেশ্যের অংশ হিসেবে কর্তা এবং সম্বন্ধের পদ মেলে বটে।বিধেয়র অংশ হিসেবে সম্বন্ধ সহ কর্তা বাদে বাকি সব কারকের পদ,এমন কি ক্রিয়া পদটিও।কিন্তু এইভাবেও কাউকে সরাসরি ব্যাখ্যা করতে দেখা যাচ্ছে না।

এখান ওখান থেকে তাঁদের ধারণাগুলোকে তুলে গুটিয়ে আনলে কী মেলে আমরা দেখছি।নির্মল দাশ লিখছেন,     “সম্বন্ধ পদ,বিশেষণ,কৃদন্ত শব্দ ইত্যাদি যোগে উদ্দেশ্যকে এবং কর্ম,বিশেষ্য,বিশেষণ,সর্বনাম অথবা অব্যয় যোগে বিধেয়কে প্রসারিত করা যেতে পারে।উদ্দেশ্য প্রসারক: যে-সব পদ যুক্ত হয়ে উদ্দেশ্যকে প্রসারিত করে তাকে উদ্দেশ্য প্রসারক বলে। সম্বন্ধপদ,বিশেষণ,কৃদন্ত শব্দ ইত্যাদি যোগে উদ্দেশ্যকে প্রসারিত করা যেতে পারে।বিধেয় প্রসারক: যে-সব পদ যুক্ত হয়ে বাক্যের বিধেয়–অংশকে প্রসারিত করে তাকে বলা হয় বিধেয়-প্রসারক।বিধেয়কে প্রসারিত করতে সাধারণত: কর্ম,সম্প্রদান বা অন্য কারকে প্রযুক্ত বিশেষ্য,বিশেষণ,সর্বনাম অথবা অব্যয় পদ যুক্ত হয়।”১০৫সম্বন্ধ-কর্ম-সম্প্রদানাদি নিজেই বিশেষ্য, বিশেষণ,সর্বনামওসুতরাং একযোগে এদের পৃথক সংবর্গের মতো উল্লেখ করাটাও বিভ্রান্তি বাড়ায় বলেই আমাদের অভিমত।রামেশ্বর শ’ সরল বাক্য বোঝাতে গিয়ে উদ্দেশ্য এবং বিধেয় প্রসারক ব্যাখ্যা করছেন।তিনি লিখছেন,“সরল বাক্যের উদ্দেশ্যের আগে তার কোনো বিশেষণ থাকতে পারে,তেমনি বিধেয়র অন্তর্গত ক্রিয়ার আগে তার কর্ম থাকতে পারে।উদ্দেশ্যের বিশেষণ প্রভৃতি যেসব শব্দ উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তার অর্থকে বিশেষভাবে পরিস্ফুট বা বিশেষিত করে তাকে উদ্দেশ্যের প্রসারক( Adjuncts to Subject word) বলে।আবার বিধেয়র অর্থকে বিশেষায়িত করার অথবা তাকে বিশেষ করে পরিস্ফুট করার জন্য ক্রিয়ার যে বিশেষণ ইত্যাদি থাকে তাকে বিধেয়ের প্রসারক(Adjuncts to Predicate Verb)বলে১০৬ উদ্দেশ্যের আগেই বিশেষণাদি প্রসারক যুক্ত হয়।কিন্তু বিধেয়র আগেই নয়,---‘অন্তর্গত ক্রিয়ার আগে’,‘ক্রিয়ার যে বিশেষণ’ এই পদগুচ্ছগুলো লক্ষ করবার মতো।‘Predicate Verb’ কথাটিও।তার পরেও তাকে বলা হচ্ছে না ‘ক্রিয়ার সম্প্রসারণ’গোলোকচন্দ্র লিখছেন,“উদ্দেশ্যর কেন্দ্র কর্তা।কর্তার লগত সঙ্গতি পূর্ণ আসন্ন পদবোর,অর্থাৎ অঙ্গবোর মিলি উদ্দেশ্য তৈয়ার হয়উদেশ্যত কর্তার পূরক আরু সম্প্রসারকো পোয়া যায়।”১০৭এবং “বিধেয়র কেন্দ্র ক্রিয়াপদ।ক্রিয়াপদর লগত সঙ্গতিপূর্ণ আসন্ন পদবোর মিলি বিধেয়র সৃষ্টি হয়।বিধেয়ত ক্রিয়াপদ আরু ইয়ার সম্প্রসারক পোয়া যায়।”১০৮ লক্ষ করবার মতো নির্মল দাশ ‘কর্তা’ ‘ক্রিয়া’র মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করেন নি।অবশ্য ‘কর্তা’টি লক্ষণার্থ হিসবে তাঁর উপস্থাপনাতে রয়েছে,ছাত্রদের সেটি অনুমান করে নিতে হচ্ছেরামেশ্বর শ’ ‘কর্ম’,ক্রিয়া’ –র উল্লেখ করলেও ‘কর্তা’র কথাটি সরাসরি আনলেন গোলোকচন্দ্রই।  

এবারে দেখা যাক বিষয়টি কে কীভাবে নজির দিয়ে বোঝাচ্ছেন।রামেশ্বর শ’য়ের উদাহরণ বাক্যটি হলো---

অ। সবদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের যথার্থ ভালো ছাত্ররা খুব মনোযোগ সহকারে মূল বই পড়ে।

একে আমরা একটা ছকে,চিত্র-০১-এ হাজির করে তাঁর কথাকে স্পষ্ট করছি।

 

“উদ্দেশ্যের প্রসারক বা বিধেয়র প্রসারককে বাদ দিলেও বাক্যের অর্থ অসমাপ্ত থাকে না।”১০৯তার মানে মূল বাক্যটি ‘ছাত্ররা মূলবই পড়ে’স্পষ্টতই আমরা কর্তা–কর্ম-ক্রিয়া এই ক্রমে শব্দ বা শব্দগুচ্ছ তিনটিকে ধরতে পারি।কিন্তু তিনি সেভাবে লেখেন নি।‘ছাত্ররা’ শব্দের ‘উদ্দেশ্য’ ভিন্ন কোনো পরিচয় নেই।‘মূল বই’ শব্দটির আছে।এটি এর পরে ব্যাখ্যা করেছেন।উপরের কথা ক’টির ঠিক পরেই  লিখেছেন,“...কিন্তু কোনো কোনো বাক্যে ক্রিয়ার অর্থকে পূর্ণ করার জন্য অন্য দু’একটি শব্দ অপরিহার্য, সেসব শব্দকে বাদ দিলে বাক্যের অর্থই অপূর্ণ থাকে। যেমন---‘সুভাষ চন্দ্র আদর্শ নেতা ছিলেন’১১০এই বাক্যে ‘আদর্শ নেতা’ অংশটি বাদ দিলে বাক্যটির কোনো অর্থই থাকবে না,তাই একে বলে ‘বিধেয় ক্রিয়ার পরিপূরক’ বা ‘বিধেয়ের পরিপূরক’আসলে ‘আদর্শ’ অংশটুকুও বাদ দেয়া চলে।এটি ‘নেতা’ শব্দের বিশেষণ,সুতরাং ‘প্রসারক’তেমনি প্রথম বাক্যে ‘মূল বই’ হচ্ছে তাঁর মতে ‘বিধেয়র পরিপূরক’তা হলে এই দুই বাক্য নিয়ে ছকটিকে আবার ঢেলে সাজালে দাঁড়ায় এরকম চিত্র-০২-এর মতো

 
 

তা হলে ‘প্রসারক’ এবং ‘পরিপূরক’ এই দুই অংশ বাদ দিলে ‘বিধেয়’ বলে যা অবশিষ্ট থাকে তা কিন্তু স্পষ্টতই দুই ‘ক্রিয়া’---‘পড়ে’ এবং ‘ছিলেন’‘পরিপূরক’ অংশটি কিন্তু ‘কর্ম’গোলকচন্দ্রের ‘আসন্ন অঙ্গ’-এর ধারণাটি১১১মনে রাখলে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কসহ পদ গুচ্ছ ‘মূল বই’ এবং ‘আদর্শ নেতা’ সেই কর্ম।এবং ‘খুব মনোযোগ সহকারে’ করণ।

গোলকচন্দ্র গোস্বামী সরল বাক্য দিয়েও বিষয়টি বেশ বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।আমরা পরিসরের কথা ভেবে তিনি  একটি জটিল বাক্যকে কীভাবে নিজেই একটি ছকে (চিত্র ০৩)ধরেছেন,হুবহু দেখাচ্ছি১১২

 

বাক্যটি হচ্ছে:

আ। মধ্যযুগত নিয়ম আছিল যে যি সকলে অধ্যাপনাৰ ব্রত গ্রহণ কৰে,তেওঁলোকে কৌমার্য ব্রত

     অৱলম্বন কৰিব।

এখানে মূল বাক্যটি হচ্ছে-- মধ্যযুগত নিয়ম আছিল (যে)অধীন বা ‘গর্ভ’ বাক্য হচ্ছে,দুটো—১)যি সকলে অধ্যাপনাৰ ব্রত গ্রহণ কৰে।২) তেওঁলোকে কৌমার্য ব্রত অৱলম্বন কৰিব।এই বাক্যগুলোকে একটি ছকে তিনি সাজিয়েছেন এইভাবে চিত্র ০৩-এর মতো।

স্পষ্ট যে উদ্দেশ্য সম্প্রসারকগুলো হচ্ছে ‘কর্তা’র বিশেষণ বাক্য বা বাক্যগুচ্ছ।বিধেয় সম্প্রসারকের শেষ দু’টিকে তিনি নিজেই লিখেছেন ‘কর্ম’প্রথমটি লেখেন নি,বোঝা যায় কালাধিকরণের পদ।এই সম্প্রসারক বাদ দিলে বিধেয় বলে যেটি অবশিষ্ট থাকে সেটি পরিষ্কার ‘ক্রিয়া’

তাই যদি হয়,সম্প্রসারকগুলোকে ‘কর্তা’ এবং ‘ক্রিয়া’র সম্প্রসারক বলছি না কেন?তাতে অন্তত ‘উদ্দেশ্য’ এবং ‘কর্তা' ---একই বিষয়ের এই দুই পারিভাষিক শব্দের থেকে মুক্তি মেলে।‘বিধেয়’ আর ‘ক্রিয়া’ নিয়েও বিভ্রান্তি থাকে না।বিধেয়র সম্প্রসারক অংশটিও মূলত কর্ম এবং অন্যান্য কারক পদসাধারণ নিয়ম হচ্ছে,-- উদ্দেশ্য আগে,বিধেয় পরে বসবে।কিন্তু গোলকচন্দ্রের উদাহরণ বাক্যে প্রধান বাক্যটি যদি হয়--- ‘মধ্যযুগত নিয়ম আছিল’- তবে তাতে বিধেয় সম্প্রসারক বসল কই,স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। বিধেয়র দুই অংশের মাঝে বসেছে ‘কর্তা’ বা ‘উদ্দেশ্য’-- ‘নিয়ম’!সুতরাং নিয়মের বাহুল্য বাড়ানোই বৃথা।রবীন্দ্রনাথ যেটি বাংলার সম্পর্কে বলছিলেন,অসমিয়ার সম্পর্কেও তাই সত্য বটে—আমরা কারক প্রসঙ্গে তা দেখাচ্ছি

রূপান্তরমূলক সৃজনমূলক ব্যাকরণ নিয়ে আলোচনা করবার সময় আমরা বিশেষ্য পদগুচ্ছ (noun phrase) এবং ক্রিয়া পদগুচ্ছের(verb phrase) ধারণার সঙ্গেও পরিচিত হবসম্প্রসারক সহ বাক্য,বাক্যাংশ বা খণ্ডবাক্যকে এভাবে দেখাও সঠিক দেখা। গোলোকচন্দ্র গোস্বামী যদিওবা ‘উদ্দেশ্য-বিধেয়’ প্রসঙ্গ আলোচনা করেছেন,তিনিও এই বিষয়টি নিয়ে সচেতন ছিলেন। কারক নিয়ে লিখতে গিয়ে স্পষ্টই লিখেছেন,“...কর্তাপদ,ইয়ার পূরক আরু সম্প্রসারকবোর উদ্দেশ্যর ঘরত,আরু ক্রিয়াপদ আরু ইয়ার সম্প্রসারকবোর বিধেয়র ঘরত অন্তর্ভুক্ত করা হয়;...১১৩  

আমরা ‘রূপান্তরমূলক সৃজনমূলক ব্যাকরণ’-এর কথা লিখলাম বটে,বর্ণনাতে সুবিধের জন্যে চমস্কিও ইংরেজি ব্যাকরণের ‘subject-predicate’ এখানে ওখানে ব্যবহার করেছেন।সম্ভবত জগন্নাথ চক্রবর্তী চমস্কিতে প্রভাবিত বলেও ‘উদ্দেশ্য-বিধেয়’ প্রয়োগে আনছেন।কিন্তু মুশকিল হল,তার বিশ্লেষণের আদলটিও উপর থেকে চমস্কির স্তরীভূত সাধন ব্যাকরণ বা পতিত বৃক্ষ  আদলের পদগুচ্ছ সূচকের মতো দেখালেও,তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে,-- পদ্ধতিটি তাঁর নিজস্ব। সে আমরা রূপান্তর ব্যাকরণ প্রসঙ্গে স্পষ্ট করবতাতে খুব ক্ষতি হয় নি,বহু সিদ্ধান্তই তাঁর সঠিক।আবার বহু বিকল্প সিদ্ধান্ত তিনি এড়িয়ে গেছেন।শুধু এইভাবে না নিলেই হলো যে তার সিদ্ধান্তগুলোই সিলেটি বাক্যগঠনে চূড়ান্ত।তাঁর পদ্ধতিটি তিনি ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে,“এখানে আমি প্রাতিপদিক[base] বা রূপমূলকেই সবচেয়ে ছোট একক এবং সরল বাক্যকেই সবচেয়ে বড় একক রূপেই গ্রহণ করব।প্রাতিপদিক বা ধাতু থেকে পদ,পদ থেকে পদগুচ্ছ এবং পদগুচ্ছ থেকে বাক্য গঠনের শৈলীটি বিশ্লেষণ করে দেখানো হবে।”১১৪ বোঝা যাচ্ছে, তিনি রূপতত্ত্ব থেকে শুরু করবেন।আপাতত, তিনি কী ভাবে উদ্দেশ্য বিধেয় দেখাচ্ছেন দেখা যাক।





 


বৃক্ষ ১,২-তে ‘উদ্দেশ্য-বিধেয়’ পরিভাষার বিকল্পে ‘কর্তা-ক্রিয়া’র তাঁর দরকার পড়ছে।এবং বৃক্ষ ৩-এ ‘কর্ম’-এরো।বৃক্ষ ১-এ তাঁর কোনো অনুসিদ্ধান্ত নেই।দুইতে “অনুসিদ্ধান্ত ১—বাক্য নির্মাণে প্রাথমিক উপাদান উদ্দেশ্য ও বিধেয়।একটি ক্ষুদ্রতম বাক্যগঠনে অন্বয়ার্থ কর্তা ও ক্রিয়া আবশ্যক [বৃক্ষ ১]১১৮কর্তা ক্রিয়া উপাদান নয় কেন,অন্বয়ার্থ উদ্দেশ্য বিধেয় যথেষ্ট নয় কেন?—কোনো জবাব নেই।বৃক্ষ ১-এ ‘বাবা’ কর্তার পরে কিন্তু কোনো পরসর্গ তথা ‘শব্দবিভক্তি’ নেই।তার পরেও বৃক্ষ ৩-এর পরে তাঁর,“অনুসিদ্ধান্ত ২ –উদ্দেশ্য গঠনে অর্থের দুরকম রূপ পাচ্ছি বিশেষ্য [বৃক্ষ ২] এবং সর্বনাম [বৃক্ষ ৩]অন্বয়ার্থ অর্থাৎ কর্তা বিশেষ্য হলে শব্দবিভক্তি যুক্ত হয় [বৃক্ষ ২] দ্র.শব্দ বিভক্তি ও কারক বিভক্তি।আর সর্বনাম হলে শূন্য বিভক্তি।‘ক্রিয়া’র গঠন ধাতু ও কালবিভক্তির সংযোগে হয় [বৃক্ষ ১/২] অন্বয়ার্থ ‘কর্ম’ বিধেয়ের অন্তর্গত।”১১৯ কর্তাতে অসমিয়ার মতো পরসর্গ ‘-এ’ যুক্ত হয় বটে,কিন্তু বহু সময় হয় না,যা তাঁর নিজের নজিরেও রয়েছে---সেই উল্লেখ কোথাও নেই। সে সম্পর্কে আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে কারক প্রসঙ্গে লিখেছি।এরই জন্যে লিখছিলাম,তাঁর সিদ্ধান্তগুলোকে চূড়ান্ত ভেবে নেবার কারণ নেই।‘সম্প্রসারক’-এর বদলে তিনি উদ্দেশ্য বিধেয়র ‘বিবর্ধক’ কথাটির উল্লেখ করেছেন পরে।‘পূরক’ কথাটিও রয়েছে।১২০ ভাবার্থ সেই একইশুধু উপস্থাপন ভঙ্গিটি ভিন্ন।

হুমায়ুন আজাদকে অনুসরণ করে আমাদের তাই সিদ্ধান্ত---বাংলা এবং অসমিয়া ব্যাকরণ তথা ভাষাবিদ্যাতে ‘উদ্দেশ্য-বিধেয়’ প্রকরণ বাহুল্য মাত্রএকে বর্জন করাই যেতে পারে। ‘কর্তা- কর্ম-ক্রিয়া’ ধারণাকে বাদ দেয়া যেহেতু যাবে না,প্রয়োজনে ‘সম্প্রসারক’ পদগুচ্ছকে বিশেষায়িত করবার দরকারে কারক পদের নামগুলোকেই ব্যবহার করে  ‘কর্তা সম্প্রসারক’(কর্তার লগত সঙ্গতিপূর্ণ আসন্ন পদবোর---গোলোকচন্দ্র)  এবং  ‘কর্ম সম্প্রসারক’ বা ‘ক্রিয়া সম্প্রসারক’ (ক্রিয়াপদর লগত সঙ্গতিপূর্ণ আসন্ন পদবোর—গোলোকচন্দ্র) বলে বোঝানো যেতে পারে।তার জন্যে স্বতন্ত্র নিয়মসূত্র তৈরি করা বাহুল্য মাত্র,অর্থাৎ বৃথা।

 

বাক্যের কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া তথা কারক ক্রম:

সুকুমার সেনের কথাটি আমরা সুবিধের জন্যে আবার স্মরণ করছি,“ বাক্যের সর্ব শেষে সমাপিকা ক্রিয়া---নঞর্থক বাক্য না হইলে---তাহার পূর্বে মুখ্য কর্ম,তাহার পূর্বে গৌণকর্ম,তাহার পূর্বে করণ অধিকরণ,তাহার পূর্বে অসমাপিকা (ও তদ̖যুক্ত বাক্যাংশ),তাহার পূর্বে কর্তা।সমাপিকা ক্রিয়া বলিতে যুক্ত ও যৌগিক ক্রিয়াপদও ধরিতে হইবে।”১২১ নঞর্থক বাক্য হলে কী হবে, তাও তিনি পরে ব্যাখ্যা করেছেন।এবং স্পষ্ট যে শুধুই ‘কারক’কে বাক্যতত্ত্বের অঙ্গ করে আলোচনা করেন নি। যেভাবে হুমায়ুন আজাদ দাবি করেছেন,করা উচিত বলে।কালকেও স্পর্শ করতে হয়েছে।সুকুমার সেন ক্রমটিকে বুঝিয়েছেন শেষের থেকে শুরুর দিকে এগিয়ে। দেখা যাচ্ছে সদর্থক বাক্যে ক্রিয়ার আগে কর্ম বসছে,তার আগে গৌণ কর্ম।সম্প্রদান কারকের কথা লেখেন নি। গৌণ কর্মের সঙ্গে সেটি একই।বাকি সব কারক পদ কর্তা এবং কর্মের মাঝে বসছে।একেই সংক্ষেপ করে বলা হয়,(বাংলা-অসমিয়া) বাক্যের ক্রম -- কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া।সিলেটিতেও এমনটাই হয়,আমরা চিত্র ০৪-এ বৃক্ষ ৩-এ দেখলাম।

কিন্তু এও হচ্ছে নিতান্তই ছোট সরল বাক্যের সাধারণ নিয়ম।অর্থাৎ বলা যেতে পারে,সাধারণত বাংলা বাক্য এই ক্রম মেনে চলে।চলতে হবেই!--- বললে বাংলা বাক্যের তো বটেই ভাষাটিরই ‘প্রাণভোমরা’কে টিপে মেরে ফেলা হয়।কর্মের পরে করণ,কর্ম(সম্প্রদান),অপাদানের নজির নির্মল দাশ দিয়েছেন১২২,আমরা শুধু তাঁর বাক্য ক’টির অন্তর্বস্তু তথা প্রসঙ্গ পালটে দিয়ে গঠন  একই রেখে  দেখাচ্ছি:

 অ। গ্রামরক্ষীরা বেচারা চোরটিকে লাঠি দিয়ে নির্মম ভাবে মারল।

আ। আয়োজকেরা একটি করে স্মারক উপহার প্রত্যেক  শিল্পীকে দিয়েছেন

 ই। শহরের পুরসভা কর্তৃপক্ষ পান-তামাকের দোকানগুলো সব বিদ্যালয়ের সামনে থেকে সরিয়ে

     দিলেন।   

‘অ-বাক্য’-এ বড় হরফে দেখানো করণ-পদগুচ্ছ,‘আ-বাক্য’-এ গৌণকর্ম-পদগুচ্ছ এবং ‘ই-বাক্য’-এ অপাদান পদগুচ্ছ ঠিক ক্রিয়াপদ বা পদগুচ্ছের আগে বসেছে।এমন কি ক্রিয়া কখনো কর্মের আগেও চলে যায়,যেমন---তোমরা উচ্চবর্ণেরা কি বেঁচে আছো?তোমরা হচ্চ দশ হাজার বছরের মমি!!(স্বামী বিবেকানন্দঃভারত-বর্তমান ও ভবিষ্যৎ)কর্তাও পেছনে সরে আসে বহু সময়—‘মানুষকেও ভয় পায় না বৈতল’(সু.গা.পা.:এক)সম্বন্ধ পদের তো বালাই নেই,কর্তা-কর্ম-করণ-অধিকরণে যেকোনো নামপদের আগেই বসতে পারে।‘ই-বাক্য’-এ সেরকম তিনটি সম্বন্ধ পদ রয়েছে,‘শহরের’,‘পান-তামাকের’,‘বিদ্যালয়েরসম্বোধন পদ সাধারণত কর্তার আগেই বসে,যেমন ---বাছাধন!তুমি করলে কি এটা!নির্মল দাশ,এর উল্টোটাও দেখিয়েছেন,--- এ কী ব্যবহার করলে তুমি,বাছাধন!১২৩ যেকোনো ভাষারই বাক্যের ন্যূনতম অংশটি হচ্ছে তার কর্তা এবং ক্রিয়া।ক্রিয়া অকর্মক হলে কর্ম থাকবার প্রশ্নই উঠে না।কিন্তু দুই বা ততোধিক ব্যক্তির সংলাপে সেই কর্তা বা ক্রিয়ার একটির উবে যাবার নজির আকছার মেলে। যেমন--- প্রশ্ন: কে করবে? উত্তর—আমিপ্রশ্ন---হয়েছে?উত্তর---হয়েছেঅর্থাৎ যে ব্যাপারটি স্পষ্ট—তা হলো,পরসর্গ লোপের ফলে বাংলা বাক্যে ইংরেজির মতো পদক্রমের গুরুত্ব বাড়ল বলে আমরা লিখে এলাম।কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে---সেখানেও বাংলা ভাষা কোনো নিয়মতন্ত্রের অধীন হতে অস্বীকার করে। যেভাবে রবীন্দ্রনাথ লিখে এসেছেন।এই স্বাধীনতার গৌরব গাথা রবীন্দ্রনাথ আরো  লিখেছেন,এমন করে,“বাংলা ভাষার একটা বিপদ তার ক্রিয়াপদ নিয়ে;‘ইল’‘তেছে’‘ছিল’-যোগে বিশেষ বিশেষ কালবাচক ক্রিয়ার সমাপ্তি।ক্রিয়াপদের এই একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি এড়াবার জন্যে লেখকদের সতর্ক থাকতে হয়।বাংলা বাক্যবিন্যাসে যদি স্বাধীনতা না থাকত তা হলে উপায় থাকত না।”১২৪ কিন্তু তাই বলে যথেচ্ছাচার চালানো যাবে তাও নয়।বিশৃঙ্খলারও একটি শৃঙ্খলাসূত্র থাকে,নইলে ‘সৌন্দর্য’ বলে কোনো গুণ থাকে না।রবীন্দ্রনাথই লিখেছেন এর পরেই,“এই স্বাধীনতা আছে বটে,কিন্তু তাই বলে স্বৈরাচার নেই।ভাসিয়ে একেবারে দিলে কেঁদেকিংবা ভাসিয়ে দিলে একেবারে কেঁদেবলি নে।সে পড়ে সবার আছে পিছনেকিংবা রেখে চালাকি দাও তোমারহবার জো নেই।তার কারণ জোড়া ক্রিয়ার জোড় ভাঙা অবৈধ।”১২৫ এই জোড় প্রসঙ্গে আমরা ‘আসন্ন অঙ্গ’ কথাটি মনে রাখতে পারি। সাধারণত এই ‘আসন্ন অঙ্গ’ ভাঙা হয় না। আগে আমরা রবীন্দ্রনাথেরই ‘কোথায় গেলেন’ পদজোড় দিয়ে যে ক’টি বাক্য দেখিয়ে এলাম তার প্রত্যেকটিতে কর্তা এবং ক্রিয়া জায়গা বদল করলেও ‘তোমার দাদা’ এবং ‘কোথায় গেলেন’ নিজেদের মধ্যে আগে পরে হয়ে গেলেও সেই ‘জোড়’ তথা ‘আসন্ন অঙ্গ’টি কিন্তু ছাড়ে নি।

তবে এই সব ‘কর্মনাশা’ ব্যাপার স্যাপার বাংলাতে ঘটেই থাকে, যেমন---“তোমার মেম বউদি আমার স্বামীকে তো কবজা করেইছে, শেষ পর্যন্ত তোমাকেও ছিনিয়ে নিয়ে গেল।” (ঠাকুরবাড়ির আঁতুড়ঘরেঃরীতা রায় মিঠু)  ‘ই’ নিশ্চয়ার্থকটি পরসর্গ হয়ে ক্রিয়া ‘করেছে’–র শেষে জোড়া উচিত ছিল,জুড়েছে মধ্যসর্গ হয়ে মাঝে। এর প্রতিটিতে যে দ্বিতীয় নিয়মটি স্পষ্ট,সে হলো বাংলা বাক্য ক্রমেই অবিভাজ্য স্বনিম শ্বাসাঘাত তথা স্বরাঘাতের নিয়ন্ত্রণেই নিজের অর্থ স্পষ্ট করে।এই কথাটি পরোক্ষে যৎসামান্য স্পষ্ট করে রামেশ্বর শ’ তাই লিখেছেন,“বিশেষ শব্দের উপরে জোর দেবার প্রয়োজন না হলে স্বাভাবিক ক্ষেত্রে বাংলা বাক্যে পদক্রমের সংক্ষিপ্ত সূত্র হলো কর্তার পরে কর্ম,কর্মের পরে ক্রিয়া।”১২৬বাংলা ভাষার স্বাভাবিক প্রবণতা হল নিয়ত তার স্বভাব বদল করা।অর্থাৎ সংবাদ প্রতিবেদন এবং নিরস নিবন্ধের বাইরে ‘অস্বাভাবিক আচরণ’ করাই স্বভাব তার।আমরা দু’টি শৃঙ্খলা সূত্রের কথা  লিখলাম,---‘আসন্ন অঙ্গ’ এবং ‘অবিভাজ্য স্বনিমে’র কথা।পরে পরে দেখবো,আরো কোনো সূত্রের সন্ধান মেলে কিনা। 

 সিলেটি প্রসঙ্গেও অন্য কোনো রকম কথা জগন্নাথ চক্রবর্তী লেখেন নি।তবে কিনা তিনি ‘কর্তা-কর্ম-ক্রম’ নিয়ে স্পষ্ট করে কোথাও কিছু লেখেন নি।কিন্তু ‘উদ্দেশ্য-বিধেয়’ আদলে উদ্দেশ্য এবং বিধেয়র ‘বিবর্ধক’,‘পূরক’-এর অংশ হিসেবে প্রতিটি কারক রূপ নিয়েই বিস্তৃত আলোচনা করলেও সেগুলো আসলে রূপতত্ত্বের বিষয়।বিন্যাসক্রম নিয়ে তিনি ভাবেননি নয়।কিন্তু সে ওই ‘সম্প্রসারক-পূরক’গুলোর প্রসঙ্গেই।অর্থাৎ আমাদের পরিভাষাতে বলতে পারি ‘আসন্ন অঙ্গ’-এর বিন্যাস সূত্রই ব্যাখ্যা করেছেন।উদাহরণ স্বরূপ ‘বাক্যের সম্বন্ধবাচক পদ গঠন’ এই শৈলীতে তিনি আলোচনা করেছেন।এই শিরোনামের পরবর্তী শিরোনাম হচ্ছে ‘প্রয়োগ বৈভিন্ন্যে সম্বন্ধপদ অর্থ বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে।’১২৭ সেই বিশ্লেষণ অনেক ব্যাপক এবং বিস্তৃত।কিন্তু বাক্যে পদবিন্যাস নিয়ে কোনো  সূত্র আমরা পাই নি।ভাবানুসারে গঠন পাল্টালে অর্থাৎ সরল বাক্য,প্রশ্নবোধকে বা নঞার্থক বাক্যে পরিণত হলে যেহেতু কিছু বিন্যাস এমনিতেই পাল্টায় সেসব নিয়ে লিখেছেন।কিন্তু সাধারণ ভাবে কর্তা-কর্ম-ক্রিয়াদি কারকপদ গুলোর ক্রম পাল্টালে কী হয়,কী হয় না সেসব নিয়ে কিছু নেই।সুতরাং আমরা সিদ্ধান্ত নিতেই পারি,সিলেটি মানবাংলা অসমিয়ার থেকে অন্যরকম আচরণ করে না।সম্বন্ধ পদ স্থান পাল্টালে অর্থ কীভাবে পাল্টায় সেসবের তিনি কিছু চিত্তাকর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন,কিন্তু

            উ। আমার চিঠি

এই বাক্য বা বাক্যাংশে যখন দুই অর্থ হচ্ছে।

            ঊ.১আমার লেখা চিঠি।

               আমার উদ্দেশ্যে অন্য কারো লেখা চিঠি।

এরকম আরো দুই বাক্য বা বাক্যাংশের এবং তাদের দুটি করে অর্থের উল্লেখ করেও ব্যাখ্যা না করে ছেড়ে দিয়েছেন।১২৮শ্বাসাঘাত,স্বরাঘাত ইত্যাদি অবিভাজ্য স্বনিম প্রসঙ্গ তিনি ধ্বনিতত্ত্বেও বিশেষ স্পর্শ করেন নিফলে সমস্ত মনোযোগ গিয়ে পড়েছে পদের গঠনে।আমরা অন্য উৎস থেকে কিছু সিলেটি বাক্য তুলে দিচ্ছি,যেখানে পদবিন্যাস বৈচিত্র্য নজরে আসবে।

           ঋ। বাপ ত তরে আদরও করে বেটি (সু.গা.পা.:এক) সম্বোধন একেবারে শেষে।

            এ। যা যা দূর যা,বেইমান বেটির পুত,দূর যা (সু.গা.পা.:এক) শুধু ক্রিয়াতে সম-গর্ভবাক্য;

  কর্তা-সম্বোধন ক্রিয়ার পরে।

            ঐ। অতদূর বিয়া দিলায় কেনে তুমরা (সু.গা.পা.:দুই) অধিকরণে বাক্য শুরু, কর্তা সবার শেষে।

            ঔ। পেট ভরি খাইলা সকালবেলার মুঠি সারাদিনের খুটি (সু.গা.পা.:তিন) কর্তা নেই;কর্ম, সম্প্রসারক

                                                                                               সহ বাক্যের শেষে।

অধ্যাপক নিখিলেশ পুরকাইতের বাংলা অসমীয়া ও উড়িয়ার উপভাষার ভৌগোলিক জরিপ’ বই থেকে মান বাংলার সঙ্গে বাংলার বেশ কিছু ভাষা বৈচিত্র্যের নমুনাতে দেখা যাক পদবিন্যাস বৈচিত্র্য কেমন দেখায়।আমরা ইচ্ছে করেই ক্রমচ্যুত বাক্যের দুটি বাক্যের নমুনা তুলে দিচ্ছি:

            ক.মান বাং.আমার ছেলে বলেছে ভোট ঘরে দিতে

                          লোক সঙ্গীত সংগ্রহের জন্য এক ছাত্রবন্ধুকে নিয়ে বেরিয়েছি পাড়াগাঁয়ে।১২৯           

            ক.ময়.সিং.১আমার ছাইল্যায় কৈছে ঘরো ভুট দিবার।

  লুকসংগীত জুগার করার লাইগ্যা এক ছাত্রবন্ধুরে লইয়া বাইর̖হইছি

      পাড়াগেরামে।১৩০

                        ক.ঢাকা.   আমার পোলায় কইছে ভোটটা ঘরে দিতে।

                           লোকগীত জোগারের লাইগ্যা এক ছাত্রবন্ধুরে নিয়া গেরামে/গায়ে বাইর হইছি                            

                             পাড়াগেরামে।১৩১   

            ক.সিলেট. আমার সেলেয়  বুট গরো দিতে কইসে

                            গীত জুগার করার লাগি/লাগিয়া/ লাইগ্যা এক ছাত্রবন্ধুরে লইয়া গাউও বারইছি১৩২

            ক.কাছাড়.   আমার পুআয় কইসে গরো বুট দিতাম।

                            গাওর গান জোগাড় করার লাগি এক ছাত্রবন্দুরে লইয়া গাওত বারইছি১৩৩

            ক.কুমিল্লা.   আমার পোলা কইছে ভুট ঘরো দিত

                           লোকগীত জুগাড়ের লাইগ্যা এক ছাত্রবন্ধুরে  লইয়া বাইরইয়াছি পাড়াগ্রামে।১৩৪

            ক.নোয়া.    আর ফোলায় কইছে ভোট ঘরে দিতাম̖

                          লোকসংগীত জোগাড় কইরবার লাই আঁর এক ছাত্র লই গেরামে  বাইর অইছি১৩৫

            ক.চট্ট.       আর ফুআ কইয়ে যে ভুট ঘরইতর দিতাম

                           দেশইত্তা গয়ন জোগাড় গড়িবার লাই উগগোয়া ক্লাসর হঙ্গীয়ারে লইয়ারে বাইর হই  

                            পাঁড়াগঁত।১৩৬

প্রায় প্রতিটি ভাষাবৈচিত্র্যে ‘ক.১,২-বাক্য’-এ পদক্রম হচ্ছে কর্তা-ক্রিয়া-কর্ম।ব্যতিক্রম শুধু ‘ক.সিলেট.১,২’, ‘ক.কাছাড়.২’ এবং ‘ক.নোয়া. ১’ এই মাত্র চারটিতে।তাও সেগুলো নমুনাদাতার ইচ্ছেতে হয়েছে,সেটি সিলেটি কাছাড়িতে তো নিশ্চিত হয়েই বলা যায়।

কারকের বিষয়টি বাংলা –অসমিয়া ভাষাদু’টিতেই এতই স্বাভাবিক বিষয় যে দেখা যাবে,এই নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সব্বাই প্রায় একই স্বরে,সুরে,সঙ্গত এবং স্পষ্ট কথা লিখছেন।আরোপিত হলে যা হয়-- বিভ্রান্তি কাটেনা,ব্যক্তি ভেদে স্বর এবং সুর আলাদা হয়-- সেরকমটি হয় নি। গোলোকচন্দ্র গোস্বামী তাই কারক নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অত্যন্ত সাবলীল।একটি সুন্দর উপমা দিয়ে,বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন,“ ...বাক্যর কারক বাচক পদ সমূহর স্থিতি,সঙ্গতি আরু কার্যলৈ লক্ষ্য করিলে এনেহে লাগে,যেন সেই সমস্ত পদরাজি এটা পরিয়ালর অন্তর্গত: এহাতে কর্তা আরু আনহাতে ক্রিয়াপদ সেই পরিয়ালর পতি-পত্নী তুল্য;কর্মপদ যেন সন্তান; আরু করণ,নিমিত্তার্থক,অপাদান আরু অধিকরণ প্রত্যেকেই একোটাহঁত আনুষঙ্গিক সাধন বিশেষ।”১৩৭ অসমিয়া বাক্যেরও ক্রম বাংলারই মতো সাধারণত ‘কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া’এই কথাটি তিনি এভাবে একত্রে বলেন নি।স্পষ্ট হবে যখন ‘কর্মপদর স্থান’ বোঝাতে গিয়ে লিখছেন,“কর্মপদর স্থান সাধারণতে কর্তা আরু ক্রিয়াপদর মাজতে।”১৩৮কিন্তু বাংলার মতোই অসমিয়াও যে স্বভাব মেনে চলে না,সেই কথাও তাঁর স্পষ্ট,কিন্তু ‘উদ্দেশ্য-বিধেয়’ প্রসঙ্গ মেশানো,“আমার ভাষাত বাক্যত উদ্দেশ্য প্রথমতে আরু বিধেয় তার পিচত বহে;এইটো স্বাভাবিক নিয়ম।প্রকাশভঙ্গী বিশেষে প্রবন্ধত,নাইবা কথনভঙ্গী-বিশেষে স্থানর সলনি ঘটে। সেই দরে উদ্দেশ্য আরু বিধেয়র অন্তর্গত পদবোররো স্থানর ইফাল সিফাল হ’ব পারে।পদর স্থানর সালসলনি ঘটাই কথার গুরুত্ব হ্রাস-বৃদ্ধি করিব পারি।বাক্যত লঘু রচনার পদর ক্রম আরু গভীর দার্শনিক তত্ত্বর আলোচনার পদর ক্রম একে নহয়,অথবা,একে নহ’বও পারে।”১৩৯

‘কর্তা- কর্ম-ক্রিয়া’ ক্রম মেনে একটি জটিল অসমিয়া বাক্য আমরা আগে চিত্র ৩-এ দেখিয়ে এসেছি। সেই ক্রম ভঙ্গ করবার বেশ কিছু নজির তিনি আলাদা করে দিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।আমরা কয়েকটি নজির১৪০ প্রথমে তুলে আনছি।

মই আঁহিলো কালিয়েই কলিকতাৰ পৰা।যামগৈ আৰু কেইদিন মানৰ পিচত।

অনিৰুদ্ধঃ চাইছোঁ তুমি কোন? তুমি মানবী নে দেৱী,নে এটি সৌন্দর্য!

                     উষাঃ নহওঁ নহওঁ,মই একো নহওঁ;মই তুমিয়েই। (জ্যোতিপ্ৰসাদ:শোণিতকুৱৰী)

গেথৌ গায়নক এজন নির্জু প্রকৃতির লোক বুলি গাঁৱৰ দহজনে কয়। (মহীচন্দ্র বরা:চাকনৈয়া)

‘খ-সংলাপ’-এর প্রথম বাক্যে কর্তার পরেই এসেছে ক্রিয়া।তার পরে অধিকরণ,অপাদান।দ্বিতীয় বাক্যেও একই,তার উপরে তাতে কর্তার উল্লেখই নেই।‘গ-সংলাপ’-এর অনিরুদ্ধের কথা শুরুই হয়েছে ক্রিয়া দিয়ে,কর্মটি তার পরে।ঊষার কথাতেও তাই।‘মই একো নহওঁ’-টি কর্মবাক্যও বটে।এবং শেষাংশে কোনো ক্রিয়াই নেই।‘ঘ-বাক্য’-এ গৌণকর্মটি দিয়েই বাক্যের শুরু হয়েছে।মুখ্যকর্ম তার পরে।তার পরে কর্তা। শেষে ক্রিয়া।

ক্রম পাল্টালে কিন্তু অর্থও পালটে যায়।তার থেকে দু’টি দার্শনিক (সচেতনভাবেই ‘বৈয়াকরণিক’ মাত্র লিখিনি আমরা) সিদ্ধান্ত হতে পারে। ১) তাই বাক্যের ক্রম পালটানো ঠিক নয়,শ্রোতার কাছে ভুল অর্থ গিয়ে পৌঁছুবে। ২) প্রয়োজনে ক্রম পাল্টানোই উচিত যাতে শ্রোতার কাছে সঠিক অর্থটি গিয়ে পৌঁছোয়।আমরা এই দ্বিতীয় সিদ্ধান্তের পক্ষে। কেননা,সঠিক অর্থ ছাড়া বাক্যের ‘সঠিক’ গঠন কোনো কাজেরই নয় বাক্যের ক্রম তথা গঠনকে শব্দের প্রসঙ্গে যা লিখে এসেছিলাম,নির্ধারণ করে তার কাঙ্ক্ষিত অর্থই। সেটিই তার যথার্থ যোগ্যতা। সেটিই ‘আসত্তি।’

‘আমি গুৱাহাটিৰ পৰা কলিকতালৈ বিমানেৰে যাম’

এই স্বাভাবিক ক্রমের বাক্যটি দিয়ে অর্থ বদলের বিষয়টি বুঝিয়েছেন গোলোক চন্দ্র গোস্বামী।১৪১

            আমি বিমানেৰে গুৱাহাটিৰ পৰা কলিকতালৈ যাম।

            আমি গুৱাহাটিৰ পৰা বিমানেৰে  কলিকতালৈ যাম।

            আমি  কলিকতালৈ গুৱাহাটিৰ পৰা বিমানেৰে যাম।

যে তিনটি পদ বা পদগুচ্ছ জায়গা পাল্টালো বা বড়হরফে শ্বাসাঘাতের এবং স্বরাঘাতের জোরটি আমরা বোঝালাম, সেগুলো বাংলাতে করণ,অপাদান,অধিকরণ।কিন্তু অসমীয়াতে ‘কলিকতালৈ’ নিমিত্তার্থক আমরা আগে লিখে এসেছি। সেগুলো ক্রম পালটে ‘চ-বাক্য’-এ বোঝালো,আমরা গুয়াহাটি থেকে কলকাতা বিমানেই যাচ্ছি,অন্য কিছুতে নয়।‘ছ-বাক্য’-এ বোঝালো গুয়াহাটি থেকে কলকাতা বিমানে যাচ্ছি,বাকি পথ অন্য উপায়ে যাওয়া যাবে না হয়।‘জ-বাক্য’-এ বোঝালো অন্য কোনো শহর থেকে নয় গুয়াহাটি থেকেই বিমানে কলকাতা যাচ্ছি।

এসব অর্বাচীন অসমিয়ার নজির।তিনি একটি প্রাচীন অসমিয়া নজির দিয়েও আমাদের সুবিধে করে দিয়েছেন। সেটি ‘কথা গুরুচরিত’ থেকে।১৪২

            আৰু বাউসীত কোৰ দামোদৰে তিনিটা বাৰী পোষে কোৰ খনেৰেই—মাক, বাএক, বৌএক।

এখানে ‘তিনিটা বাৰী’ কর্মপদ।এর পূরক হচ্ছে ‘মাক,বাএক,বৌএক’কিন্তু এগুলো বসেছে বেশ দূরে বাক্যের শেষাংশে। ক্রিয়া,করণের পরে।ক্রিয়া হচ্ছে ‘পোষে’করণপদগুচ্ছ ‘কোৰ খনেৰেই’ তার আগে বসা উচিত ছিল,বসেছে পরে।“এনেদরেই অসমীয়া ভাষার বাক্যত পদর ক্রমর তারতম্য আরু ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়।”১৪৩

তাই বলে অসমিয়াতেও যথেচ্ছাচার করা যায় না। যে দুই শৃঙ্খলা সূত্র--‘আসন্ন অঙ্গ’ এবং ‘অবিভাজ্য স্বনিম’-এর কথা আমরা বাংলার প্রসঙ্গে লিখে এলাম,অসমিয়াতেও দেখা যাচ্ছে সেটি সত্য।‘মাক,বাএক,বৌএক’ পূরকগুলো ‘অস্থানে’ বসলো বটে,তাই বলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তিনটিকে আলাদা করে বাক্যের শুরু,মাঝে এবং শেষে বসালে কিন্তু কোনো অর্থই বেরোবে না। তেমনি ‘খনেৰেই’ ‘কোৰ’ শব্দের পরেই বসবে,কেননা এটি এখানে অনুপদ,অন্যত্র বসালে অর্থবিভ্রাট ঘটাবে।‘অবিভাজ্য স্বনিম’ তথা স্বরাঘাত,শ্বাসাঘাত এবং যতির কথা ধ্বনি প্রসঙ্গে লিখে এসেছি।এখানে‘বাহ্য উন্মুক্ত যতি’ তথা দাড়ি,কমা,সেমিকলোনাদির কথা আলোচনা করা যেতো।কিন্তু দুই ভাষাতেই এতে তফাত কিছু নেই।স্বতন্ত্র আলোচনা করা মানে পরিসরের  বিস্তার।তাছাড়া স্বরাঘাতের বিষয়টি আনুমানিক ছবিতে যতটা বোঝানো যায়,আজকাল কম্প্যুটার প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরো স্পষ্ট দেখানো যায় বটে।শুধু তাই নয়,ভাষাবৈচিত্র্যগুলোর স্পষ্ট তফাত রেখাচিহ্নিত করা সম্ভব,যা আমরা কানে শোনে এমনিই আঁচ করি।কিন্তু সেসব এই সন্দর্ভে দেখাতে এবং শোনাতে গেলে,প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ এবং বিস্তৃত পরিসরের দাবি রাখে।  

গোলোকচন্দ্র গোস্বামীর ‘আসন্ন অঙ্গ’-এর কথাটি স্পষ্ট করতে হলে,বাক্য সম্পর্কে আরো কিছু কথা স্পষ্ট হতে হবে।এই অব্দি আলোচনাতে ছোট বড় নানা ধরনের বাক্য নিয়ে আমরা কথা বলে এসেছি। সেই সব বাক্যের প্রকারভেদটি স্বাভাবিকভাবেই এবারে স্পষ্ট করতে হবে।

 

।। বাক্যের প্রকার ভেদ।।

পদ বিন্যাস অনুসারে বাক্যের গঠন ভেদ:

আমাদের একটি উপস্থাপন অসঙ্গতির জন্যেই ‘বাক্যের পদ বা পদগুচ্ছ ক্রম প্রসঙ্গ’ সম্পূর্ণ না করেই ‘প্রকারভেদ প্রসঙ্গে’ চলে আসতে হলরামেশ্বর শ’ সঠিক ভাবেই শুরু করেছিলেন প্রকার ভেদ দিয়ে।কিন্তু তাঁর এবং অন্যদের সংজ্ঞাগুলো ছিল ‘উদ্দেশ্য-বিধেয়’ নির্ভর।আমরা তার থেকে সরে আসব বলেই সেভাবে শুরু করিনি।

মোটের উপর গঠন ভেদে বাংলা এবং অসমিয়া বাক্যের তিনটি প্রকারভেদের কথা বলা হয়ে থাকে—সরল,জটিল এবং যৌগিক গোলোকচন্দ্র গোস্বামী আরো একটি ‘মিশ্রবাক্য’-এর কথা লিখেছেন।১৪৪

সরল বাক্য: রামেশ্বর শ’ নিজে কোনো সংজ্ঞা দেন নি। “সাধারণত বলা হয়ে থাকে যে” লিখে তাঁর উপস্থাপিত সংজ্ঞাটি এরকম,“যে বাক্যে একটি মাত্র উদ্দেশ্য এবং একটি মাত্র বিধেয় থাকে তা-ই হলো সরল বাক্য।’১৪৫ নির্মল দাশ ঠিক এই সংজ্ঞাটিই লিখেছেন।১৪৬

সরল বাক্য আকারে খুবই  ছোট হতে পারে এরকম:

অ। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র কর্মবীর ছিলেন।

নির্মল দাশ লিখছেন,“সরল বাক্যে মূল উদ্দেশ্য থাকবে একটি এবং মূল বিধেয়ও (সমাপিকা ক্রিয়া) থাকবে মাত্র একটি। অবশ্য অসমাপিকা ক্রিয়া এক বা একাধিক থাকতে পারে,আবার নাও থাকতে পারে।”১৪৭

সুতরাং সরল বাক্য অনেক  বড়ও হতে পারে। যেমন:

আ। অনিকেত ভারত থেকে উচ্চতম ডিগ্রি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন।

ওদিকে সুনীতিকুমার বলছেন ভিন্ন কথা।রামেশ্বর শ’ সেটি উল্লেখ করেছেন,“সরল বাক্যে উদ্দেশ্য-পদ একাধিক থাকতে পারে,কিন্তু বিধেয়-পদ একটি মাত্র থাকা চাই অর্থাৎ বিধেয়র মূল সমাপিকা-ক্রিয়া মাত্র একটি থাকবে।যদি একটি মাত্র সমাপিকা-ক্রিয়ার একাধিক কর্তা থাকে তবে সব ক’টি কর্তা মিলিয়ে একটি মাত্র উদ্দেশ্য রূপে গণ্য করা হবে১৪৮ যেমন:

ই। ঠেলাগাড়িতে ইংরাজ রমণী ও অশ্বপৃষ্ঠে ইংরাজ পুরুষগণ বায়ু সেবনে বাহির হইয়াছে। (রবীন্দ্রনাথ:

    দুরাশা)

“আবার বাক্যে একাধিক অসমাপিকা ক্রিয়া থাকলেও সমাপিকা ক্রিয়া একটি মাত্র থাকলেই সে বাক্য সরল বাক্যই হবে।”১৪৯ যেমন:

ঈ। সেই ছেলের পাল ফুল ছিঁড়ে , ফল পেড়ে, ডাল ভেঙে চুরমার করত।(অবনীন্দ্রনাথ:রাজকাহিনী)

দেখা যাচ্ছে অসমাপিকা ক্রিয়া নিয়ে কোনো বিরোধ নেই‘বিধেয়’ লিখেই আবার ‘সমাপিকা ক্রিয়া’ কথাটা নিয়ে স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে।এবং ‘উদ্দেশ্য’ একাধিক থাকতে পারবে কি পারবে না,এই নিয়ে স্পষ্ট একটা মতভেদ রয়েছে।‘কর্ম’ নিয়েও কিছু ব্যাখ্যা রামেশ্বর শ’কে দিতে হচ্ছে,“সরল বাক্যের উদ্দেশ্যের আগে তার কোনো বিশেষণ থাকতে পারে,তেমনি বিধেয়র অন্তর্গত ক্রিয়ার আগে তার কর্ম থাকতে পারে।”১৫০

জগন্নাথ চক্রবর্তী সুনীতি কুমারের সংজ্ঞা বলে উল্লেখ করে লিখেছেন,“একটি মাত্র উদ্দেশ্য ও একটি সমাপিকা ক্রিয়া থাকবে।”১৫১  সুতরাং তিনি একটি উদ্দেশ্য এবং ক্রিয়ার উল্লেখ সহ গুটি কয় সিলেটি বাক্যের নজির দিয়েছেন। যেমন:

            উ। আলুয়ার আল বায়

            ঊ। তাই গুড়ি কুটের।

            ঋ। চিত̖রা চিত̖রা দুগ̖গু বাগর বাইচ̖চাইন পানিবায় হাতরিআ গেছইন।

গোলোকচন্দ্র সরাসরি সরল বাক্যের সংজ্ঞা লেখেন নি।‘সরল বাক্য’ বোঝাতে গিয়েই লিখেছেন,“কর্তা আরু ক্রিয়াপদ যুক্ত চুটিবাক্যও পূর্ণবাক্য হ’ব পারে।”১৫২  যেমন:

মানুহ মৰে।

আমি ভাত খাঁও

আজি দেওবাৰ।

আরো বেশ কিছু নজির দিয়েছেন।দীর্ঘ বাক্যও সরল বাক্য হতে পারে।কিন্তু তাঁর বক্তব্য হলো, “ ...সৰল বাক্যত এটা কর্তাপদৰ ক্রিয়াপদ একাধিক থাকিব পাৰে১৫৩ যেমন:

তেওঁ বৰ  শিৱভক্ত আছিল আৰু শিৱৰ বৰত বৰ বিক্রমশালী হৈ উঠিল। (ড বাণীকান্ত কাকতি)

ডাক্তৰখানাৰ চকীদাৰৰ হতুৱাই কমলাই গা-ধোৱা ঘৰত পানী থোৱালে; ধুতি-গামোছা দিয়ালে;

     কেনভাচৰ আৰামী চকীখন ভিতৰ চোতালত পাতিলে; বিচনীখন আৰু পানী সলাই গুৰগুৰিটো

     কাষত থ’লে;চাহৰ নিমিত্তে জুইৰ ওপৰত পানীৰ টেকেলীটো তুলি দিলে।” (ড বিৰিঞ্চিকুমাৰ

     বৰুৱা:আঘোণী আই)

আবার, “ ...এটা মাথোন ক্রিয়াপদৰ একাধিক কর্তাপদ হ’লেও বাক্য সৰল হয়।”১৫৪ যেমন:

শ্রীকৃষ্ণই পাঞ্চজন্য,কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠিৰে অনন্ত বিজয়,ভীমকর্মা বৃকোদৰে পৌণ্ড্র,ধনঞ্জয়ে

    দেৱদত্ত,নকুলে সুঘোষ আৰু সহদেৱে মণিপুষ্পক নামৰ শঙ্খ বজালে

            এবারে আমাদের সামনে স্পষ্ট সমস্যা হলো,তিনজনে তিন সংজ্ঞা এবং ব্যাখ্যা দিয়েছেন।দুই বাংলা ভাষাবিদ এক রকমের সংজ্ঞা দিতেন,তাহলেও ভাবা যেত দুই ভাষাতে সংজ্ঞা দু’রকম হতেও পারেতার উপরে যে নজিরগুলো নিয়েছি আক্ষরিক অনুবাদ বাংলার থেকে অসমিয়া এবং অসমিয়ার থেকে বাংলাতে করে ফেললে রূপতাত্ত্বিক কিছু পরিবর্তন ছাড়া পদের ক্রম পাল্টাবার  দরকার পড়বে না বললেই চলে।আমরা ‘ ঔ এবং ক-বাক্য’-কে অনুবাদ করে দেখাচ্ছি,কেননা এগুলোর প্রতিরূপ বাংলাতে দেখানো হয় নি।

তিনি খুব  শিবভক্ত ছিলেন এবং শিবের  বরে ভীষণ  বিক্রমশালী হয়ে  উঠলেন।

ডাক্তারখানার  চৌকিদারকে দিয়ে কমলা স্নান-ঘরে জল রাখালো; ধুতি-গামাছা দেয়ালো; 

    কেনভাসের আরাম চেয়ারটি ভেতরের চৌহদে আনিয়ে রাখালো; পাখাটা আর জল পালটে হুকোটা

    কাছে রাখলো; চায়ের জন্যে  আগুনের উপর জলের কেটলিটা তুলে দিল ।

 অথচ,এই নিয়ে নির্মল দাশ কিছুই লেখেন নি।এবং রামেশ্বর শ’ একাধিক ‘ক্রিয়া/বিধেয়’ থাকলে কী হবে,সেই নিয়ে নীরব।একটি কারণ হতে পারে যে এগুলো ‘যৌগিক বাক্য’ বলে মনে হয়।‘আৰু’ অব্যয় দিয়ে জুড়লে দুই বা ততোধিক পূর্ণ বাক্য যৌগিক হয় সে কথা গোলোকচন্দ্রও লিখেছেন।১৫৫‘ঔ-বাক্য’-টি স্পষ্টতই তাই।কিন্তু সেরকম পূর্ণ বাক্যের ‘কর্তা’ একই বা ভিন্ন হবে কিনা সেই নিয়েও কারো কোনো স্পষ্ট অভিমত নেই।বিষয়টি আমরা যথাস্থানে ব্যাখ্যা করবদ্বিতীয় কারণটি হলো এরকম দীর্ঘ সরল,জটিল কিংবা যৌগিক কোনো রকম বাক্যই লেখার প্রবণতা ইংরেজির দেখাদেখি বাংলাতে ক্রমহ্রাসমান।কথাটি রামেশ্বর শ’ উল্লেখও করেছেন।১৫৬ফলে একাধিক কর্তার বিপরীতে একাধিক ক্রিয়ার প্রসঙ্গ বাংলার ভাষাবিদদের নজর এড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব। কিন্তু একেবারে নজর এড়িয়ে গেছে তাও নয়।আমাদের মনে হয় এই প্রসঙ্গটি ‘একাধিক অসমাপিকা’-র আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। এই প্রসঙ্গটির উল্লেখ নির্মল দাশ এবং রামেশ্বর শ’ করলেও গোলোক চন্দ্র গোস্বামীর করেন নি

‘ঈ-বাক্য’-টিকে এভাবেও লেখা যেতে পারে বাংলাতে,এবং লিখলেই সেটি ‘ক-বাক্য’-এর প্রতিরূপ হয়ে দাঁড়ায়:

সেই ছেলের পাল ফুল ছিঁড়ত,ফল পাড়ত,ডাল ভেঙে চুরমার করত।

তার বিপরীতে একাধিক অসমাপিকা ক্রিয়াতে যে অসমিয়াতেও বাংলারই মতো সরল বাক্য তৈরি হয়,সেরকম নজির ‘ক্রিয়াপদে’র আলোচনাতে গোলোকচন্দ্র গোস্বামী কিন্তু দিয়েছেন।

মই কলেজৰ পৰা আহি কানি কাপোৰ সলাই,মুখ হাত ধুই চাহ জলপান খাই বজাৰলৈ গ’লোঁ।১৫৭             

 তাই আমাদের অভিমত দুই ভাষার ভাষাবিদদের ‘একাধিক ক্রিয়া’ এবং ‘অসমাপিকা ক্রিয়া’-র তত্ত্ব মেলানো যেতে পারে।কিন্তু গোলোক চন্দ্র গোস্বামীও ‘কর্তা-কর্ম’-এর পরিভাষা ব্যবহার করলেও সংহত কোনো সংজ্ঞা দেন নি।আমরা বাংলা এবং অসমিয়াতে সরল বাক্যের সংজ্ঞাটি পুনর্নিমাণ করতে চাই এইভাবে,‘উদ্দেশ্য-বিধেয়’ বাদ দিয়েঃ

যে বাক্যে অন্যান্য এক বা একাধিক কারক  এবং অসমাপিকা ক্রিয়াপদ থাকুক বা নাই থাকুক, ন্যূনতম একটি  কর্তা এবং সমাপিকা ক্রিয়া থাকবেই , অথবা  কর্তা এবং সমাপিকা ক্রিয়ার একটি যদি  একাধিক থাকে তবে অন্যটি একটিই মাত্র থাকবে  তাকেই সরল বাক্য বলা হবে 

 সরল বাক্যের নোয়াখালি এবং চট্টগ্রামী দু’একটি নজির এখানে সঙ্গে রইল:

ঞ.নোয়া.১  হুকি বায়গন দশ ট্যায়া চাস কোন আক্কেলে?১৫৮

           এক বাম̖নার̖ এগগা হোলা আছিল̖

                                 চট্ট. ওগ̖গোয়া বনেততাই ওগ̖গোয়া ফোয়া আছিল̖  

জটিল বাক্যঃ রামেশ্বর শ’ লিখছেন,“যে বাক্যে একটি প্রধান উপবাক্য থাকে এবং এক বা একাধিক অপ্রধান বা আশ্রিত বাক্য থাকে তাতে মিশ্র বা জটিল বাক্য বলে।”১৫৯ এখানে  সংজ্ঞার ভেতরে ‘উদ্দেশ্য-বিধেয়’ কিংবা ‘কর্তা-ক্রিয়া’ প্রসঙ্গ নেই। নির্মল কান্তি দাশও একই কথা লিখেছেন,শুধু ‘উপবাক্য’ এবং ‘আশ্রিত বাক্য’-এর স্থানে ‘খণ্ড বাক্য’ লিখেছেন।১৬০ ‘মিশ্র’ কথাটির উল্লেখ তিনি করেন নি।আমরা আগে উল্লেখ করেছি,গোলোক চন্দ্রের মতে এটি বাক্যের চতুর্থ প্রকার ভেদ।‘খণ্ডবাক্য’ কথাটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রামেশ্বর শ’ও ব্যবহার করেছেন।স্বাভাবিক ভাবেই এখানে এই পারিভাষিক শব্দগুলোর ব্যাখ্যার দরকার পড়ে।এবং তা তাঁরা করেছেন

দেখা যাচ্ছে,একাধিক বাক্য মিলে জটিল বাক্য তৈরি হচ্ছে। সেগুলো,রামেশ্বর শ’ লিখছেন,“যেহেতু একটি বড় বাক্যের অংশ,সেহেতু বড় বাক্যের পরিপ্রেক্ষিতে এগুলি হলো উপবাক্য বা খণ্ডবাক্য।”১৬১নির্মল দাশ লিখছেন,“যে বাক্যাংশগুলির দ্বারা (প্রধান বা অপ্রধান) জটিল বা যৌগিক বাক্য গড়ে উঠে,সেগুলিকে উপাদান বা খণ্ড বাক্যাংশ বলে।”১৬২‘খণ্ড’ কথাটির পরে আবার ‘অংশ’ কথাটি বাহুল্য,খানিকটা হলেও সমস্যাও বটে,আমরা পরে দেখাবো।

রামেশ্বর শ’ আরো লিখেছেন,“বাক্যের যে উদ্দেশ্য সম্পর্কিত বক্তব্যই সেই বাক্যের মুখ্য বক্তব্য সেই উদ্দেশ্য এবং তার বিধেয় সম্বলিত বাক্যই প্রধান বাক্য।আর প্রধান বাক্যের মধ্যে অন্য যে বাক্যটি বসে শুধু মূল বাক্যের সর্ত বোঝাবার জন্যে বা মূল বাক্যের কর্তার বা ক্রিয়ার বিশেষণ রূপে,তাকে অপ্রধান বাক্য বলে।”১৬৩এই সংজ্ঞাটি অস্পষ্ট।‘প্রধান বাক্যের মধ্যে’-ই যদি ‘অপ্রধান বাক্য’ বসবে তবে সেটি নিজেও প্রধান বাক্যের অংশ হয়ে গেল।পরপর দুই বাক্যে ‘প্রধান বাক্য’ কথাটি আসলে দুই ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।তার উপরে রইল নতুন করে ‘মুখ্য বক্তব্য’ কোনটি বোঝার সমস্যা।নির্মল দাশ তুলনাতে সহজতিনি লিখছেন,“মূল বাক্যের মধ্যে যে বাক্যাংশটি স্বয়ম্ভর অর্থাৎ অন্য কোনো বাক্যাংশের ওপরে নির্ভরশীল নয় তাকে প্রধান বাক্যাংশ বলে।... একে নিরপেক্ষ বাক্যও বলা যায়।”১৬৪এবং,“যে বাক্যাংশ মূল বা প্রধান বাক্যের উপর নির্ভরশীল তাকে অপ্রধান বা সাপেক্ষ বাক্যাংশ বলে১৬৫‘মূল’ শব্দটি এখানেও দুই সংজ্ঞাতে দুই অর্থে ব্যবহৃত।প্রথমটিতে বৃহত্তম পূর্ণ বাক্যকে বোঝানো হচ্ছেদ্বিতীয়টিতে তার প্রধান অংশটিকে বোঝানো হচ্ছে।‘বাক্যাংশ’ কথাটি নিয়ে সমস্যাতো রইলই।এর তিনি ইংরেজি করছেন Clause বলে।আর রামেশ্বর শ’ Phrase বলে।তিনি লিখছেন,“বাক্যাংশের বা পদগুচ্ছের (Phrase) সঙ্গে উপবাক্যের (Clause) পার্থক্য জানা দরকার১৬৬পার্থক্যটি এরকম,“উপবাক্য বাক্যের অংশ হলেও তাতে একটি উদ্দেশ্য (কর্তা) ও একটি বিধেয় (অন্তত একটি ক্রিয়া) থাকেই;কিন্তু পদগুচ্ছের এরকম উদ্দেশ্য বা বিধেয় সর্বদা থাকে না,তা হচ্ছে অর্থের আপেক্ষিক একক অনুসারে গোষ্ঠীবদ্ধ পদসমষ্টি।”১৬৭  যেমন:

অ।  পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র কর্মবীর ছিলেন।

এই বাক্যে কর্তা কেবল ‘ঈশ্বরচন্দ্র’ নয়,বিশেষণ হিসেবে যে ‘পণ্ডিত’ শব্দটি রয়েছে যাকে অন্যভাবে ‘কর্তার সম্প্রসারক’-ও বলতে পারি সেটি নিয়েই কর্তা।একত্রে এই দুটি মিলে একটি বাক্যাংশ বা পদগুচ্ছ।আমরা বলতে পারি,‘পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র’ কর্তা। অন্যদিকে

যে বিভূতিভূষণ প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন তিনি পথের পাঁচালি লিখতে পেরেছেন।

এই পুরো বাক্যে দুই উপবাক্য বা খণ্ডবাক্য রয়েছে।

(যে) বিভূতিভূষণ প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন

তিনি পথের পাঁচালি লিখতে পেরেছেন

এই দুই উপবাক্য মিলে তৈরি হয়েছে একটি জটিল বাক্য।এই পুরো বাক্যে দুটি করে কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া রয়েছে।অর্থাৎ সরল বাক্যে যা জেনে এসেছি,একাধিক ক্রিয়া থাকলে কর্তা হবে একটিই,কিংবা একাধিক কর্তা থাকলে ক্রিয়া থাকবে একটিই---সেই সূত্র থেকে সমগ্র বাক্যটি বেরিয়ে এসেছে।স্পষ্টতই দুই স্বতন্ত্র বাক্য মিলে সেটি তৈরি করেছে।নির্মল দাশ লিখেছেন,“প্রধান খণ্ডবাক্যে একটি সমাপিকা ক্রিয়া এবং প্রতিটি অপ্রধান খণ্ডবাক্যেও একটি করে সমাপিকা ক্রিয়া থাকে বলে জটিল বাক্যে অন্তত: দুটি সমাপিকা ক্রিয়া থাকবেই।”১৬৮আমরা দেখছি,দু’টি ‘কর্তা’ও থাকছে।যদিও ‘তিনি’ কর্তাটি ‘বিভূতিভূষণ’-এরই সর্বনাম এবং একই ব্যক্তি দুই ভিন্ন কাজ করেছেন,তবু ‘তিনি’ কর্তাটির উল্লেখ করবার দরকার পড়েছেই শুধু নয়,সর্বনাম হলেও এটিই প্রধান কর্তা।‘বিভূতিভূষণ’ দিয়ে শুরু পুরো বাক্যটি সেই কর্তার বিশেষণ মাত্র,অন্যভাবে বললে ‘তিনি’ কর্তার সম্প্রসারক।সুতরাং এই বাক্যের কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব নেই।বাক্যটি ‘তিনি পথের পাঁচালি লিখতে পেরেছেন’ বাক্যের আশ্রিতএটি এবং ‘তিনি’ সহ পুরো পদগুচ্ছ বা বাক্যাংশ ‘(যে) বিভূতিভূষণ প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন তিনি’ ‘লিখতে পেরেছেন’ বহুপদী ক্রিয়াটির কর্তা।‘পথের পাঁচালি’ কর্ম‘যে’ হচ্ছে এই দুই খণ্ডবাক্যের সঙ্গতিসূচক সর্বনাম।দুই খণ্ডবাক্যকে জুড়েছে।ব্যাকরণে সঙ্গত হতো যদি এর পরে ‘তিনি’-র আগে আরেকটি ‘সে’ থাকতো।কিন্তু বাহুল্য ভেবে বাংলাতে সেটি উচ্চারণ না করে সামান্য যতি দেয়া হয়,সুর নামিয়ে আনা হয় লেখাতে কখনো (,) ব্যবহার করা হয়,এখানে তাও করা হয় নি।

জগন্নাথ চক্রবর্তী জটিল বাক্যের সংজ্ঞা লিখেছেন এরকম,“একটি প্রধান বাক্যের অঙ্গ হিসেবে এক বা একাধিক খণ্ডবাক্য বা অপ্রধান বাক্য যুক্ত হলে জটিল বাক্য নির্মিত হয়।”১৬৯একটি প্রধান বাক্যের অন্তর্গত একটি খণ্ডবাক্য থাকলেও চলবে,দু’টি না হলেও চলবে।আর যদি একাধিক খণ্ডবাক্য যুক্ত হয় তবে সেগুলো সবই ‘অপ্রধান’ অর্থাৎ সমান গুরুত্বের খণ্ডবাক্য,প্রধান খণ্ডবাক্য বলে কিছু নেই।কিন্তু তাঁর জটিল বাক্যের নজিরগুলোর স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য আছে,যেগুলো মানবাংলাতেও একই রকম হতে পারতো:

                        ই। জেমনে নাচে নাগর কানাই তেমনি নাচে রাই। (লোকগান)

                        মাছ হামায় জদি ডরি তুলি লাইমু।

                        উ।আততিএ খায় জেলা লাদেও ওলা। (প্রবচন)

‘ই-বাক্য’-এ কানাই,রাই দুই কর্তার দুই সমাপিকা ‘নাচে’;‘ঈ-বাক্য’-এ মাছ,আমি (উহ্য) দুই কর্তার দুই সমাপিকা হামায়,তুলি লাইমু‘উ-বাক্য’কে নিয়ে সমস্যা এই যে দৃশ্যত মনে হয় কর্তা একটিই ‘আততি’কিন্তু ‘সরল--ঈ,ক,ঘ,ঙ বা চ’ কোনোটির মতোই নয় যে সরল বাক্য বলে বিবেচনা করা যাবে।প্রধান বাক্য ‘আততি লাদে(ও) ওলা’‘জেলা-ওলা’ সঙ্গতিবাচক বা এখানে তুলনাবাচক পদ।আর অপ্রধান বাক্যটি ‘আততিএ খায়’ প্রধান বাক্যের ক্রিয়া’র বিশেষণ বা সম্প্রসারকের ভূমিকা পালন করছে।অর্থাৎ ‘ আততিএ খাইয়া লাদের’ বা ‘আততিএ খার আর লাদের’ লিখলে যেটি সরল বাক্য হতে পারতো,এখানে সেরকম দুই স্বাধীন ক্রিয়া বোঝাচ্ছে না।প্রথমটি দ্বিতীয় ক্রিয়ার পরিমাণ বিশেষায়িত করতেই বসেছে,অন্যথা এর কোনো দরকার নেই। সেরকমই ‘ই-বাক্য’-এ প্রথমটি দ্বিতীয়টির রূপ সাদৃশ্যকে বিশেষায়িত করছে।এবং ‘ঈ-বাক্য’-এ প্রথমটি দ্বিতীয়টির সর্ত হয়ে বসেছে। সেরকমই ক্রিয়া সম্প্রসারকের ভূমিকাতে অপ্রধান বাক্য রয়েছে এই দুই বাক্যেও: 

                        তলাইত ধান থাকলে চড়া আইয়া পড়ইন।

                        জেতা দেখতে কুটিমুটি ইতার ঝেং বেশ̖(প্রবচন)

এখানে সমস্যা হলো,অপ্রধান বাক্যের ক্রিয়াপদ দু’টি ‘থাকলে’ এবং ‘দেখতে’ দুটিই অসমাপিকা।তাহলে,“জটিল বাক্যে অন্তত: দুটি সমাপিকা ক্রিয়া থাকবেই১৭০-- এই যুক্তিটির কী হবে?এগুলো কি সরল বাক্য? কোথাও কোনো সরাসরি ব্যাখ্যা নেই। সুতরাং আমাদের যে যুক্তিটি দাঁড় করাতে হচ্ছে,তা এই যে সমাপিকা দুটিই থাকবে বটে।কিন্তু অসমাপিকাও যেটি রয়েছে  ‘সরল—ঈ বা চ বাক্য’-এর অসমাপিকার মতো স্বাধীন কোনো কাজের কথা এখানে বোঝাচ্ছে নাঅর্থাৎ পর পর কোনো কাজ বোঝাতে অসমাপিকাগুলো নেই।এগুলোও রয়েছে শেষের ক্রিয়াটিকে বিশেষায়িত করতেই।পরালম্ব হয়ে।‘সরল-ঈ বাক্য’কে যেভাবে ‘সরল-ঙ-বাক্য’-এ রূপান্তর করেছিলাম,সেভাবে এই দুটিকেও করলে দাঁড়াবে এই:

                        এ। তলাইত ধান থাকে যখন চড়া আইয়া পড়ইন।

                        ঐ। যেতা কুটিমুটি দেখা যায় ইতার বেশ ঝেং অয়।

অপ্রধান বাক্যের ক্রিয়াপদ একাধারে প্রধান বাক্যের সমাপিকার বিশেষণ এবং দুই বাক্যের সংযোজকের ভূমিকাতে  নেমে তার অসমাপিকা রূপান্তর ঘটেছে এই দুই বাক্যে।এরকম হতে পারত ‘জটিল-ঈ-বাক্য’-এরও এরকম:

                        ও। মাছ হামাইলে ডরি তুলি লাইমু।      

গোলোকচন্দ্র গোস্বামী ‘জটিল বাক্যে’র সংজ্ঞা লিখেছেন,“অধীন গর্ভবাক্যযুক্ত বাক্যক জটিল বাক্য(Complex Sentense) বোলে।”১৭১শব্দক্রম ভিন্ন হলেও মূলে কথাটি একই।তিনি এর আগেই শুধু ‘গর্ভবাক্য’ নয় বাক্যাংশ,খণ্ডবাক্য,আসন্ন অঙ্গ’ ইত্যাদি এবং এদের প্রকার ভেদ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করে এসেছেন,তাই সংজ্ঞাটি এরকম দাঁড়িয়েছে।‘বাক্যাংশ, খণ্ডবাক্যে’র ধারণার অতিরিক্ত এখানে ‘গর্ভবাক্য’স্বাভাবিক ভাবেই এই পরিভাষাগুলোর ব্যাখ্যা না করে আমাদের পক্ষে এগুনো কঠিন।

আসন্ন অঙ্গ: এর কথাটি আমরা আগেই উল্লেখ করে এসেছি।‘আসত্তি’ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি এর ব্যাখ্যা শুরু করেছিলেন।“বাক্যর মাথোন দুটাহে পদ থাকিলে সেই পদ দুটার পরস্পরর মাজত আসত্তি গাঢ় বুলি সহজে বুজা যায়। যেনে,আমি ছাত্রল’ৰাবোৰে খেলিছে।”১৭২ একটি ছাড়া অন্যটি অর্থ-বিচ্যুত হয়একে মানবাংলাতে ‘নিকট সম্পর্কিত’ বললে কাজ চালানো গোছের কিছু বোঝা যায়।কিন্তু কাছাকাছি থাকলো বলেই দুটো শব্দের সম্পর্ক ‘আসন্ন অঙ্গ’ হচ্ছে না। যেমন:

ল'ৰাবোৰে ফুটবল খেলিছে।

এই বাক্যে ‘ফুটবল খেলিছে’ আসন্ন অঙ্গকেননা কেউ বা কারা ফুটবল খেলছে বোঝা যাচ্ছে।তৎক্ষণাৎ আর কোনো কৌতূহল জন্মায় না।কিন্তু ‘ল'ৰ’বোৰে ফুটবল’ শব্দ দু’টি আসন্ন অঙ্গ নয়।এর কোনো অর্থ বেরুচ্ছে না। খেলছে,না তুলে রাখছে,না নিয়ে যাচ্ছে কোথাও,না কিনে আনছে ---এমন সব প্রশ্ন তৎক্ষণাৎ দেখা দেয়।উত্তরটি ছাড়া পদগুচ্ছ অর্থহীন।আসন্ন অঙ্গ কীভাবে একই পদক্রমের বাক্যের অর্থ পালটে দেয়,তিনি বেশি বিস্তৃত দেখিয়েছেন।আসন্ন অঙ্গ বোঝাতে লিখবার সময় মাঝে হাইফেন জুড়ে দিয়ে অথবা গায়ে গা লাগিয়ে দিয়ে লেখা ভালো বলে-- পরামর্শ দিয়েছেন।বলবার সময় পূর্বপদে জোর তথা শ্বাসাঘাত দেবার কথাও লিখেছেন১৭৩ যেমন এই বাক্যটি:

গুৱাহাটিত পুৰণি কিতাপৰ দোকান নাই।

এই বাক্যটিতে একটি অস্পষ্টতা আছে।একে এই দুই ভাবে লিখলে দু’রকম অর্থ বেরোয়।   

গুৱাহাটিত পুৰণি-কিতাপৰ দোকান নাই।

গুৱাহাটিত পুৰণি কিতাপৰ-দোকান নাই।

প্রথম গঠনে বোঝাচ্ছে--গুয়াহাটিতে বইয়ের দোকান আছে ঠিকই,কিন্তু পুরোনো বইয়ের নেই।দ্বিতীয় গঠনে বোঝাচ্ছে-- গুয়াহাটিতে বইয়ের দোকান আছে ঠিকই,কিন্তু কোনোটিই পুরোনো  নয়,সবই নতুন।

বাংলাতে সাধারণত এই সব আলোচনা শ্বাসাঘাত বা ছেদ-যতির আলোচনাতে হয়ে এসেছে।কিন্তু ‘আসন্ন অঙ্গ’-এর ধারণাটি আনকোরা মৌলিক বলেই আমাদের মনে হয়।অন্তত বাংলা শব্দ-বাক্যের আলোচনাতে এটি মেলে নিবাংলাতে আলোচনাটি ‘আসত্তি’-তে এসে থেকে গেছে।‘আসত্তি’ একটি গুণের নাম।কিন্তু ‘আসন্ন অঙ্গ’ সেই গুণ সম্পৃক্ত বস্তুটি তথা বর্তমান প্রসঙ্গে শব্দ বা পদসজ্জার নাম।একে ‘পদগুচ্ছ’-এর সঙ্গে মেলানো যাবে না। যে কোনো বিচ্ছিন্ন শব্দের অর্থ যেমন তার প্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন করেও বোঝা যায়,আসন্ন অঙ্গ-ও তেমনি।অন্যদিকে ‘পদগুচ্ছ’-কে প্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন করে সব সময় বোঝা নাও যেতে পারে।রামেশ্বর শ’-এর সংজ্ঞাটি আবার পড়া যেতে পারে,‘অর্থের আপেক্ষিক একক অনুসারে গোষ্ঠীবদ্ধ পদসমষ্টি।’সে অনুসারে ‘ল'ৰাবোৰে ফুটবল’-ও একটি পদগুচ্ছ। যেমন ‘(যে) বিভূতিভূষণ প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন তিনি’-ও একটি পদগুচ্ছ। কিন্তু ‘প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন’ একটি আসন্ন অঙ্গ এবং পদগুচ্ছওরামেশ্বর শ’য়ের ‘পদগুচ্ছ’-এর সংজ্ঞাকে ‘আসন্ন অঙ্গ’-এর ধারণার সঙ্গে এক করে দেখবার সুযোগ রয়েছেকারণ বাংলাতে অর্থবহ এবং অর্থহীন পদগুচ্ছকে আলাদা করে ভাবা হয় নি। গোলোকচন্দ্র গোস্বামী অসমিয়াতে করেছেন।কথাটি পরে স্পষ্ট করবো।দুয়ের বেশি শব্দে আসন্ন অঙ্গের নজির গোলকচন্দ্র দিয়েছেন এইভাবে,এগুলো বাংলাতেও একইঃ১৭৪

খ.১ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি।

   ভাষা-সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতি।

   জাতি-বর্ণ-ধর্ম-সম্প্রদায়-নির্বিশেষে।

অসমিয়াতে ‘সঙ্গ’,‘সঙ্গী’ শব্দগুলো আছে যদিও প্রচলন বেশি নেই, প্রচলিত শব্দ ‘লগ̖সম্ভবত তাই তিনি ‘সঙ্গ’ কথাটি ব্যবহার করেন নি। মূলে কিন্তু পদগুলো পরস্পরের ‘অঙ্গ’ নয়। বাক্যের অঙ্গ। ধারণাটির জন্যে কালিক ভাষাবিজ্ঞানের কাঠামোবাদের ‘অব্যবহিত গঠনগত উপাদান’-এর ধারণার কাছেই তাই তাঁকে ঋণী বলে মনে হয়। বিষয়টি আমরা পরে স্পষ্ট করবো। কিন্তু এখানে এরা  পরস্পর ‘সঙ্গ’ গুণে বাঁধা ‘সঙ্গী’তাই বাংলাতে‘আসন্ন সঙ্গ’ কথাটিই মানাবে ভালো।আমরা এটি প্রচলনের প্রস্তাব করছি।

 খণ্ডবাক্য: এর সংজ্ঞা এরকম,দু’টা বা ততোধিক আসন্ন অঙ্গর গোটকে খণ্ডবাক্য বোলে১৭৫গোলোকচন্দ্র গোস্বামী আরো লিখছেন,“খণ্ডবাক্যবোর বাক্যর খণ্ড বা অংশ;পূর্ণ বাক্য নহয়। সেই কারণে খণ্ডবাক্যত কর্তা আরু কর্তার লগত সঙ্গতি থকা সমাপিকা ক্রিয়াপদ পোয়া নাযায়;কেতিয়াবা সমাপিকা ক্রিয়ার পরিবর্তে অসমাপিকা কৃদন্ত পদ পোয়া যায়।”১৭৬  

পরিষ্কার যে,আমরা বাংলাতে যে ‘খণ্ডবাক্য’ বা ‘উপবাক্য’-এর কথা জেনে এসেছি,এই ‘খণ্ডবাক্য’ তার থেকে স্বতন্ত্র। বাংলা খণ্ডবাক্যের ধারণাতে ‘সমাপিকা’ ক্রিয়া রয়েছে।তিনি উদাহরণ দিচ্ছেন,এরকম:

গ.১পুৰণি কিতাপৰ দোকান...

   অসমীয়া ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি...

আমাদের মতে ‘বৃহত্তর আসন্ন অঙ্গ’ বা আসন সঙ্গ বললেও চলে।রামেশ্বর শ’ ‘বাক্যাংশ’ বা ‘পদগুচ্ছ’ মূলত এগুলোকেই বুঝিয়েছেন।পরম্পরাগত ইংরেজি ব্যাকরণে এগুলোকেই ‘Phrase’বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়।এবং Noun Phrase,Adjective Phrase ইত্যাদি বিভাজনও দেখানো হয়।১৭৭তিনিও খণ্ডবাক্যের ‘নাম বাচক’,‘ক্রিয়াবাচক’,‘বিশেষণ বাচক’,‘ক্রিয়া-বিশেষণ বাচক’ ইত্যাদি নানা বিভাজনের উদাহরণ সহ ব্যাখ্যা করেছেনসেগুলোকে ‘আসন্ন সঙ্গ’ বা নিছক ‘সম্প্রসারক’ হিসেবে ধরলেও এই বিভাজনটি করা যায়।‘উপবাক্য’ হলে তো করাই যায়বাংলাতে সেটি নির্মল দাশ করে দেখিয়েছেন।১৭৮ 

 কিন্তু গোলোকচন্দ্র গোস্বামীর সংজ্ঞানুসারে ‘দু’টা বা ততোধিক আসন্ন অঙ্গর গোট’ কথাটি খাটছে নাএমনিতেও ‘কিতাপৰ দোকান’ কিংবা ‘ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি’ যেখানে স্পষ্টতই ‘আসন্ন সঙ্গ’ তার সঙ্গে ‘পুৰণি’ বা ‘অসমীয়া’ একক শব্দ।স্বতন্ত্র আসন্ন সঙ্গ হবার সর্ত মেনে এদের কোনো স্বতন্ত্র নিকট সঙ্গী বা জুটি নেই।সুতরাং রামেশ্বর শ’র সংজ্ঞাটিই বেশি স্পষ্ট মনে হয়।শুধু তাতে ‘আসন্ন সঙ্গ’ ধারণাটিকে নিয়ে এইভাবে পুনর্গঠন করা যায় ,-- দুই বা ততোধিক আসন্ন সঙ্গ কিংবা পদের সমষ্টিকে নিয়ে গঠিত অর্থের বৃহত্তর সঙ্গতিসম্পন্ন একককে খণ্ডবাক্য বলে। উপবাক্যের বিকল্পে আমরা বাংলা ‘খণ্ডবাক্য’-এর ধারণা বাদ দেবার প্রস্তাব করি। কারণ বাংলা ‘খণ্ডবাক্য’ একেকটি কর্তা-ক্রিয়া সহ পূর্ণ বাক্য। তাকে খণ্ডবাক্য বলা মানায় না।  

 বাক্যাংশ: এর সংজ্ঞা গোলোকচন্দ্র গোস্বামী লিখছেন এরকম,“ বাক্যর যিকোনো পদ বা  পদসমষ্টিকে বাক্যাংশ,অর্থাৎ বাক্যর এটা অংশ বোলে। কর্তা,কর্ম ক্রিয়া আরু এইবোরর সম্প্রসারকবোরক বাক্যাংশ বুলি ক’ব পারি।”১৭৯ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি আরো স্পষ্টই লিখেছেন,“বাক্যাংশ আরু খণ্ডবাক্য একে নহয়।আমার সূত্রমতে খণ্ডবাক্যবোর একোটাহঁত বাক্যাংশ;কিন্তু বাক্যাংশবোরে সদায় খণ্ডবাক্য নুবুজায়,অথবা নুবুজাবো পারে।”১৮০ তিনি একটি দীর্ঘ উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট করতে চাইছিলেন এই ভাবে।

সাম্প্রদায়িক উৎপীড়নত কামৰূপ ৰাজ্য এৰি গৈ কোচ-বিহাৰৰ অন্তর্গত ভেলা-ডোৰাত সত্র পাতি 

    থাকোঁতে মহাপুৰুষ মাধৱদেৱে জীৱনৰ শেষ ভাগত এই অনুপম ঘোষাগ্রন্থ ৰচনা কৰে।

    (ড বাণীকান্ত কাকতি: নামঘোষা)

এই বাক্যে ‘সাম্প্রদায়িক উৎপীড়নত’ একটি ‘খণ্ডবাক্য’ বলে তিনি লিখছেন।এর পদদুটোর অর্থের সঙ্গতি আছে,ফলে এরা ‘পরস্পরে আসন্ন অঙ্গ’১৮১কিন্তু ‘সাম্প্রদায়িক উৎপীড়নত কামৰূপ’ খণ্ডবাক্য নয়।কেননা,“ইহঁতর সাম্প্রদায়িক উৎপীড়নত গোটটোর লগত কামৰূপ পদর সঙ্গতি নাই।”১৮২এর বেশি তিনি সরাসরি কিছু লেখেন নি। ফলে আমাদের পরোক্ষে ধরে নিতে হয়, এই অসঙ্গত পদগুচ্ছই বাক্যাংশ।

আমরা তাঁর কথাকেই সামান্য পালটে  বাংলা-অসমিয়া দুই মানভাষা সম্পর্কেই লিখতে পারি,--- আসন্ন সঙ্গ,খণ্ডবাক্য, উপবাক্য বা গর্ভ বাক্য এই সমস্ত অর্থবহ এককই (গোট) বাক্যাংশ বা পদগুচ্ছ।কিন্তু পদগুচ্ছ মাত্রেই আসন্ন সঙ্গ,খণ্ডবাক্য,উপবাক্য বা গর্ভ বাক্য নয়,কেননা  পদগুচ্ছ অর্থহীনও হতে পারে।

গর্ভবাক্যঃ  “এটা প্রধান বাক্যর অন্তর্গত পূর্ণবাক্যক গর্ভবাক্য (Clause )বোলে১৮৩ যেমন:

ৰাম আহিল,শ্যাম নাহিল।

মাধৱ আহিলে আহিব,মোৰ চিন্তা কৰিব লগিয়া একো নাই।

এই দুই বাক্যে ‘ৰাম আহিল’ এবং ‘শ্যাম নাহিল’ এই দুটো ‘ঙ বাক্য’ -এর এবং ‘মাধৱ আহিলে আহিব’ এবং ‘মোৰ চিন্তা কৰিব লগিয়া একো নাই’ ‘চ- বাক্য’-এর একটা করে গর্ভবাক্য।

দু’রকম গর্ভবাক্যের কথা লিখছেন:

সম-গর্ভবাক্য:“যৌগিক বাক্যর অন্তর্গত প্রত্যেকটো বাক্যকে সম-গর্ভবাক্য (Coordinate Clause) বোলে।”১৮৪  উপরের ‘ঙ,চ’ বাক্যের গর্ভবাক্যগুলো সম-গর্ভবাক্য।

অধীন-গর্ভবাক্য: “কেতিয়াবা একোটা দীঘল বাক্যত কর্তা,কর্ম আৰু ক্রিয়াপদর সম্প্রসারক রূপে পূর্ণবাক্যও ব্যবহার হ’ব পারে।এনে পূর্ণবাক্য কর্তা আরু কর্মপদর পূরকো হ’ব পারে। তেনে গর্ভবাক্যক প্রধান বাক্যর অধীন-গর্ভবাক্য  (Subordinate Clause) বোলে।”১৮৫ যেমন:

 তুমি আজি আহিবা বুলি মই জানিছিলোঁ।

এখানে ‘তুমি আজি আহিবা (বুলি)’ বাক্যটি ‘ক্রিয়াপদর কর্ম হৈছে১৮৬

মোটের উপর গোলকচন্দ্র গোস্বামী এবং নির্মল দাশের সংজ্ঞা একই।পরম্পরাগত ইংরেজি ব্যাকরণেও সংজ্ঞাগুলো মেলে।১৮৭সেখানে Coordinate Clause বলেও একটি সংজ্ঞা মেলে,যার উল্লেখ নির্মল দাশ বা রামেশ্বর শ’ করেন নি।আবার  প্রধান গর্ভবাক্য বা Principal Clause নিয়ে গোলোকচন্দ্র গোস্বামী কিছু সরাসরি লেখেন নি।

এই ‘প্রধান’ শব্দটি নিয়ে বেশ একটা গোলমেলে ব্যাপার আছে। গোলোক চন্দ্রের গর্ভবাক্যের সংজ্ঞাতে ‘প্রধান বাক্য’ আসন্ন সঙ্গটি রয়েছে অন্য অর্থে,‘প্রধান বাক্যর অন্তর্গতঅর্থাৎ বৃহত্তম সমস্ত বাক্যকেই তিনি ‘প্রধান বাক্য’ বলে লিখছেন।কিন্তু যখন ‘অধীন গর্ভবাক্য’-এর সংজ্ঞা লিখছেন,তখন এই ‘প্রধান বাক্য’ আসন্ন সঙ্গ বা পদজোড়ের অর্থ পালটে যাচ্ছে,‘তেনে গর্ভবাক্যক প্রধান বাক্যর অধীন-’লক্ষ করবার মতো তিনি জটিল বাক্যের সংজ্ঞাতেও ‘প্রধান বাক্য’ না লিখুন,‘প্রধান গর্ভবাক্য’ কিংবা ‘সম-গর্ভবাক্য’ আসন্ন সঙ্গের দু’টিকেই এড়িয়ে গেছেন।বিপরীতে নির্মল দাশ ‘Principal Clause’-কে বলছেন,‘প্রধান বাক্যাংশ’সেখানে ‘বৃহত্তম সমস্ত বাক্য’ বোঝাচ্ছেন ‘মূল’ শব্দটি দিয়ে।কিন্তু যখন ‘অপ্রধান বা সাপেক্ষ বাক্যাংশ’-এর সংজ্ঞা লিখছেন,‘প্রধান-বাক্য’ আসন্ন সঙ্গটি ব্যবহার করেছেন গোলোকচন্দ্র গোস্বামীর মতো,‘যে বাক্যাংশ মূল বা প্রধান বাক্যের উপর নির্ভরশীল’ তেমনি,রামেশ্বর শ’ যখন জটিল বাক্যের সংজ্ঞা দিচ্ছেন,তখন ‘Principal Clause’-কে লিখছেন ‘প্রধান উপবাক্য’কিন্তু সেই আসন্ন সঙ্গটির যখন সংজ্ঞা দিচ্ছেন,তখন লিখছেন,  ‘...বিধেয় সম্বলিত বাক্যই প্রধান বাক্য।’ তার ঠিক পরে পরেই যখন তিনি ‘অপ্রধান বাক্য’-এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লিখছেন,‘আর প্রধান বাক্যের মধ্যে অন্য যে বাক্যটি বসে’---তখন এই বাক্যাংশ বা পদগুচ্ছে ‘প্রধান’ কথাটির অর্থ আসলে ভিন্ন।তখন দুই ভিন্ন ‘উপবাক্য’ বা ‘গর্ভবাক্য’ মিলে যে বৃহত্তম সমস্ত বাক্য,এখানে সেটিকেই বোঝাচ্ছেন,তার প্রধান অংশটিকে নয়।এরই জন্যে,লিখছিলাম রামেশ্বর শ’য়ের সংজ্ঞাটি অস্পষ্ট। সেই সঙ্গে ‘বাক্য’,‘উপবাক্য’, ‘বাক্যাংশ’ এই সব অভিধা নিয়েও সবার মধ্যে কেমন যেন একটি তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। 

তাই,যেহেতু ‘বৃহত্তম সমস্ত বাক্য’টির ‘অন্তর্গত’ দুই বা ততোধিক ‘কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া’ ক্রমে সম্পূর্ণ কিন্তু ক্ষুদ্রতর একক তথা বাক্যের কথা হচ্ছে এখানেও গোলোকচন্দ্র গোস্বামীর ‘গর্ভবাক্য’ ধারণাটিই বাকি সব বিভ্রান্তিকে দূর করতে পারে।‘উপবাক্য’ ধারণাটিও চলতে পারে।কিন্তু এই প্রসঙ্গে ‘বাক্যাংশ’ বা ‘পদগুচ্ছ’-এর ধারণা নিতান্তই কাজ চালানো গোছের হতে পারে, পারিভাষিক নাম হিসেবে শব্দগুলি বিভ্রান্তিকর। ‘গর্ভবাক্য’-এর সংজ্ঞাটি গোলোকচন্দ্র যা লিখেছেন,তাই সুস্পষ্ট।আমরা আরো খানিকটা স্পষ্টতর করে অনুবাদ করছি এরকম,“একটি  প্রধান তথা  বৃহত্তম সমস্ত-বাক্যের অন্তর্গত একাধিক পূর্ণবাক্যের প্রতিটিকে গর্ভবাক্য (Clause ) বলে।” এর প্রকারভেদগুলোর সংজ্ঞা আমরা বাংলা অসমিয়া দুই ভাষার জন্যেই পুনর্গঠন করছি এইভাবে:

সমগর্ভ বাক্য: প্রধান বাক্যের অন্তর্গত দুই বা ততোধিক পরস্পর সহযোগী,স্বাধীন,এবং সম্পূর্ণ বাক্যকে সমগর্ভ বাক্য (Coordinate Clause) বলে। 

প্রধান গর্ভবাক্য:  প্রধান বাক্যের অন্তর্গত দুই বা ততোধিক সম্পূর্ণ বাক্যের  একটি যখন আরটির অধীন হয়ে পড়ে, একটি অন্যটিকে সহযোগিতার বদলে পরিপূরকের ভূমিকাতে নেমে পড়ে তখন স্বাধীন সম্পূর্ণ বাক্যটিকেই বলে প্রধান গর্ভবাক্য Principal Clauseপ্রধান বাক্যে প্রধান গর্ভবাক্য হবে একটিই।

অধীন বা আশ্রিত গর্ভবাক্য: প্রধান বাক্যের অন্তর্গত দুই বা ততোধিক সম্পূর্ণ বাক্যের একটি যখন আরটির অধীন হয়ে পড়ে,একটি অন্যটিকে সহযোগিতার বদলে পরিপূরকের ভূমিকাতে নেমে পড়ে তখন অধীন-পরিপূরক এক বা একাধিক সম্পূর্ণ বাক্যকেই বলে অধীন বা আশ্রিত গর্ভবাক্য (Subordinate Clause)

এবারে আমরা এই পরিভাষাগুলো ব্যবহার করে ‘জটিল বাক্য’-এর সংজ্ঞাটিকেও পুনর্গঠন করতে পারি এভাবে: যে বাক্য  একটি প্রধান গর্ভবাক্য এবং এক বা একাধিক অধীন বা আশ্রিত গর্ভবাক্য জুড়ে তৈরি হয় তাকে জটিল বাক্য বলে। প্রতিটি গর্ভবাক্যের কর্তা এবং ক্রিয়া ভিন্ন হয় বলে জটিল বাক্যের কর্তা এবং ক্রিয়াও হয় গর্ভবাক্যের সঙ্গে সমানুপাতিক।কর্ম সমানুপাতিক হয় না, কেননা বাক্য অকর্মকও হতে পারে।কিন্তু অধীন বা আশ্রিত গর্ভবাক্যগুলো গর্ভবাক্যের কর্তা,কর্ম বা ক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করে বা সম্প্রসারকের তথা গভীর বিচারে অধিকাংশ সময় কর্তা বা কর্মের ভূমিকাই পালন করে।কখনো বা ক্রিয়া বিশেষণেরও। যেমন ‘আ-বাক্য’-এ ‘(যে)বিভূতিভূষণ প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন’ এই আশ্রিত গর্ভবাক্যটি ‘তিনি পথের পাঁচালি লিখতে পেরেছেন’ এই প্রধান গর্ভবাক্যের কর্তা ‘তিনি’র বিশেষণ তথা সম্প্রসারকের ভূমিকা পালন করেছে।এবং ‘(যে)বিভূতিভূষণ প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন তিনি’ এই পুরো বাক্যাংশ বা পদগুচ্ছ প্রধান বৃহত্তম বাক্যটির কর্তা। তেমনি অসমিয়া ‘ক-বাক্য’-এ ‘তুমি আজি আহিবা (বুলি)’ এই অধীন বা আশ্রিত গর্ভবাক্যটি ‘মই জানিছিলোঁ’ এই প্রধান গর্ভবাক্যের কর্মসিলেটি ‘ই-বাক্য’-এ ‘জেমনে নাচে নাগর কানাই’ আশ্রিত গর্ভবাক্যটি সঙ্গতিজ্ঞাপক সর্বনাম ‘তেমনি’ সহ  ‘নাচে’ ক্রিয়াপদের বিশেষণ তথা সম্প্রসারক।প্রধান গর্ভবাক্য ‘নাচে রাই’‘রাই’ প্রধান গর্ভবাক্যের কর্তা।

জটিল বাক্যের সিলেটি নজির আগেই দিয়েছি, এখানে নোয়াখালি এবং চট্টগ্রামী দু’একটি নজির এখানে সঙ্গে রইল:

জ.নোয়া. আঁর মা জেরুম কইল আঁই হেরুম কইলাম। 

                              চট্ট.আঁর̖ মা জ্যেন̖ কইলাক̖, আঁই হ্যেন̖ কইলাম̖

 

যৌগিক বাক্য: যে বাক্য একের বেশী প্রধান উপবাক্য-সংযোগে গঠিত হয় তাকে যৌগিক বা সংযুক্ত বাক্য বলে”,লিখেছেন রামেশ্বর শ’১৮৮ এগুলোকে সংযোজক অব্যয় ‘এবং,ও,আর ইত্যাদি’ বা বিয়োজক অব্যয় ‘অথবা,বা,কিংবা ইত্যাদি’ দিয়ে যুক্ত করা হয়।অব্যয়ের কথাটি সংজ্ঞার ভেতরে ধরেই লিখেছেন নির্মল দাশ,“ দুই বা ততোধিক স্বাধীন বাক্য যখন সমুচ্চয়ী অব্যয় দ্বারা যুক্ত হয় তখন সেই বাক্যকে যৌগিক বাক্য বলে১৮৯ যেমন:

বিভূতিভূষণ প্রকৃতি প্রেমিক ঔপন্যাসিক এবং তিনি মানুষের বাস্তব জীবনের দুঃখবেদনা সম্পর্কেও সচেতন  ছিলেন।

‘আ- জটিলবাক্য’-এর সঙ্গে তুলনা করলে এই বাক্যটি বোঝা যাবে ভালো,‘যে বিভূতিভূষণ প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন তিনি পথের পাঁচালি লিখতে পেরেছেন।’ ‘আ-জটিলবাক্য’-এ মূল কথাটি ---বিভূতিভুষণ পথের পাঁচালি লিখতে পেরেছেন।তিনি প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন কি না বাসতেন সেই তথ্য বাহুল্য মাত্র।না থাকলেও বাক্যটি সম্পূর্ণ হয়।কিন্তু এখানে ‘অ-বাক্য’-এ তিনি ‘প্রকৃতি প্রেমিক ঔপন্যাসিক ছিলেন’,এবং ‘মানুষের বাস্তব জীবনের দুঃখবেদনা সম্পর্কেও সচেতন  ছিলেন’ এই দুই তথ্যই সমান গুরুত্বপূর্ণ।দ্বিতীয় গর্ভবাক্যে ‘তিনি’ একই ব্যক্তি বিভূতিভুষণের সর্বনাম বটে,কিন্তু প্রথম গর্ভবাক্যটি দ্বিতীয়টির ‘কর্তা’ ‘তিনি’-র সম্প্রসারক নয়।অর্থাৎ গর্ভবাক্য দু’টি একে অন্যের অধীন নয়,এরা পরস্পর সম-গর্ভবাক্য।সর্বনামটি উল্লেখ না করলে ধরে নেয়া হতো ‘উহ্য’ আছে। যেরকম প্রথম গর্ভবাক্যে ‘ছিলেন’ ক্রিয়াপদটি উহ্য আছে।প্রতি গর্ভবাক্যে একটি করে  ‘কর্তা-ক্রিয়া’ রয়েছে এবং প্রধান বাক্যে ‘কর্তা-ক্রিয়া’ একাধিক।

     গোলোকচন্দ্র গোস্বামীর অসমিয়া সংজ্ঞাটিও ভাবার্থের দিক থেকে একই এবং আরো স্পষ্ট,“দুটা বা ততোধিক পূর্ণবাক্য আরু,নাইবা,অথবা,কিন্তু,যদি,যদিও,কারণে,অথচ,তেনেহলে আদি অব্যয় পদর দ্বারা সংযুক্ত হৈ এটা দীঘল বাক্যর সৃষ্টি হ’লে তেনে বাক্যক যৌগিক বাক্য বোলে।”১৯০আমরা জটিল বাক্য আলোচনা করতে গিয়ে সম-গর্ভবাক্য প্রসঙ্গে যে ‘ঞ,চ’ দুটি বাক্যের নজির দিয়েছিলাম,সে দু’টি যৌগিক বাক্য। সে দু’টিতে কিন্তু কোনো অব্যয় নেই।একটি কমা (,) দিয়ে দুই বাক্য জুড়ে দেয়া হয়েছে। সেটি তিনি লিখেওছেন,“কেতিয়াবা কোনো অব্যয় পদর দ্বারা সংযুক্ত নোহোয়াকৈও দুটা বা ততোধিক স্বতন্ত্র বাক্য লগ লাগি এটা যৌগিক বাক্য হ’ব পারে।”১৯১ একই কথা নির্মল দাশও লিখেছেন।১৯২এবং তিনি এরকম কিছু নজিরও দিয়েছেন:

আ। তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।

 ই। ওখানে আমিও যাবো,কে আমায় নিয়ে যেতে পারো?

            তার মানে ‘অব্যয়’ পদের থাকা না থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গোলোকচন্দ্রের  আরেকটি দীর্ঘ বাক্যের নজির এরকম:

এই দুটি পিতৃ-মাতৃহীন শিশুক ফুকন আৰু ফুকননীয়ে তেওঁলোকৰ সমুদায় বস্তুৱে সৈতে ঘৰলৈ আনিলে আৰু জয়মতী নামে এটি বিধৱা ব্রাহ্মণী আৰু কণিকী নামে এজনী দাসী সেই দুই শিশুৰ লগত আহিল(গুণাভিরাম  বরুয়া:আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকনর জীবন চরিত্র)

এই সম্পূর্ণ বা প্রধান বাক্যে তিনটি অব্যয় ‘আৰু’ রয়েছে। যৌগিক বাক্যের সংজ্ঞাতে যে সব অব্যয়ের কথা লেখা হয়েছে, এই তিনটিই সেই অব্যয় নয়। শুধুই মাঝেরটি দুই সম-গর্ভবাক্যকে জুড়েছে।প্রথম এবং তৃতীয় অব্যয় ‘আৰু’ দুই সমগর্ভবাক্যের দু’টি করে কর্তার সংযোজক।একাধিক কর্তা নিয়েও এরা এক একেকটি সরল বাক্য,কেননা ক্রিয়া একটি করেই আছে,‘আনিলে’ এবং ‘আহিল’দুই গর্ভবাক্যে ‘এই দুটি পিতৃ-মাতৃহীন শিশুক’ এবং ‘সেই দুই শিশুৰ’–এই দুই পদগুচ্ছ এমনিতেই সম্পর্কিত,তার উপরে ‘এই-সেই’ সর্বনাম দিয়ে সম্পর্কিত করে দেখানো হয়েছে।প্রথমটিকে দ্বিতীয়টির দূর-সম্প্রসারকও বলতে পারি।কিন্তু সেই সম্পর্ক ‘অ-বাক্য’-এর ‘বিভূতিভুষণ’ এবং ‘তিনি’র মতো।‘অ-বাক্যে’ পদদুটি কর্তা,‘ঈ-বাক্যে’ পদগুচ্ছগুলো কর্ম।পুরো প্রথম গর্ভবাক্যটি দ্বিতীয় গর্ভবাক্যের কর্মের সম্প্রসারক বা কর্ম নয়, যেভাবে জটিল বাক্যে হয়ে থাকে।  

জগন্নাথ চক্রবর্তীতে ‘যৌগিক বাক্য’-এর সংজ্ঞাটি সংক্ষিপ্ত,“একাধিক স্বাধীন বাক্য দ্বারা একটি বড় বাক্য গঠিত হলে যৌগিক বাক্য বলা হয়।”১৯৩ তাঁর দেয়া দুই একটি নজির এরকম:

            তাইর হড়ি খন̖নাস̖ হউর ভালা।

            নালাত ফুত আছে রনি বআইলে মাছ উঠিবা।

দেখা যাচ্ছে তিনি কমা (,) চিহ্ন দেয়াটাও দরকারি মনে করছেন না।কিন্তু বাক্যগুলো উচ্চারণ করে গেলে ‘খন̖নাস̖’ এবং ‘আছে’–র পরে একটি যতি আছে,সেটি অনুভব  করা যায়।এই যতি যে অনুচ্চারিত অব্যয়ের রেশ—সেটিও আঁচ করা কঠিন কিছু নয়। যেমন ‘উ-বাক্য’টি হতে পারত,--

            তাইর হড়ি খন̖নাস̖ কিন্তু হউর ভালা।

 আমাদের মনে রাখা ভালো সিলেটি লেখার ভাষা নয়।সুতরাং যতি চিহ্ন দেয়া না দেয়ার কোনো কঠিন বিধি থাকা না থাকাতে কিছু যায় আসে না। লেখার বেলা দিলেই পাঠকের সুবিধে।অব্যয় দিয়ে জুড়ে তাঁর নজিরটি এরকম:

            মায় চায় পেটেদি আর বউএ চায় কুচেদি। (প্রবচন)

যৌগিক বাক্যের লিখে আসা সংজ্ঞাগুলো মোটের উপরে সঠিক হলেও আমরা সঠিক পারিভাষিক শব্দসহ দুই ভাষাতেই সংজ্ঞাটিকে পুনর্গঠন করতে পারি এরকম: দুটি সমগর্ভ বাক্যকে সমুচ্চয়ী অব্যয় কিংবা কমা দিয়ে জুড়ে তৈরি দীর্ঘতর বাক্যকে যৌগিক বাক্য বলে।

যৌগিক বাক্যের নোয়াখালি এবং চট্টগ্রামী দু’একটি নজির এখানে সঙ্গে রইল:

ঐ.নোয়া.মড়াও পোড়াইতাম নঁ, চিড়াও খাইতাম নঁ।১৯৪

       চট্ট.  আগর জামাইয়ে কাট্টল ন খায়।

                                                 হেএশের জামাইয়ে ভোঁতা অ ন পায়।।১৯৫

মিশ্রবাক্য: রামেশ্বর শ’ জটিল বাক্যকেই বিকল্পে ‘মিশ্রবাক্য’ লিখেছেন আমরা আগে দেখিয়ে এসেছি।কিন্তু গোলোকচন্দ্র গোস্বামী অসমিয়া বাক্যের চতুর্থ শ্রেণি বিভাগটি করেছেন এই বলে,“কেতিয়াবা এটা প্রধান বাক্যত যৌগিক বাক্য আরু জটিল বাক্য মিশ্রিত হৈ থাকিব পারে।”১৯৬  তিনি নজির দিয়েছেন এরকম:

অ। সি যি নহওক,ৰাধাকৃষ্ণবাদ চৈতন্যদেৱৰ আগৰ পৰা যি ভাবে বঙ্গদেশত চলি আহিছিল,সি বৌদ্ধ আৰু হিন্দু ধর্মৰ নিগূঢ় সংঘর্ষৰ পৰা উদ্ভূত হৈছিল আৰু চৈতন্যদেৱে জয়দেৱ-চণ্ডীদাস সকলৰ ভাৱকেই নিজ সাধনাৰ জীৱনত আধ্যাত্মিক ৰহস্যৰ চৰম সীমালৈ লৈ গৈছিল।

তিনি যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর অর্থ এরকম:

সি যি নহওক ---একটি সরল বাক্য।এ কোনো প্রধান বাক্যের অন্তর্গত অধীন গর্ভবাক্য নয়।এই বাক্য এবং বাকি সমস্ত বাক্যটি ‘ৰাধাকৃষ্ণবাদ চৈতন্যদেৱৰ...সীমালৈ লৈ গৈছিল’ ‘পরস্পরে পরস্পরর আসন্ন অঙ্গ’১৯৭

 দুটি বাক্য পরস্পরের ‘আসন্ন অঙ্গ’ হচ্ছে এই ধারণাটি প্রথম পাচ্ছি।

‘ৰাধাকৃষ্ণবাদ চৈতন্যদেৱৰ...সংঘর্ষৰ পৰা উদ্ভূত হৈছিল’ এই অংশটি হচ্ছে একটি জটিল বাক্য।এর ‘সি বৌদ্ধ আৰু হিন্দু ধর্মৰ নিগূঢ় সংঘর্ষৰ পৰা উদ্ভূত হৈছিল’ অংশটি হচ্ছে প্রধান গর্ভবাক্য,অন্যটি অধীন গর্ভবাক্য। এবং

‘চৈতন্যদেৱে জয়দেৱ-চণ্ডীদাস...সীমালৈ লৈ গৈছিল’ হচ্ছে একটি দীর্ঘ সরল বাক্য।এটি ‘আৰু’ অব্যয় দিয়ে আগেকার জটিল বাক্যের প্রধান গর্ভবাক্যের সঙ্গে জুড়েছে।বা পুরো জটিল বাক্যটির সঙ্গেই জুড়েছে

“এতেকে দেখা গ’ল”,গোলোকচন্দ্র লিখছেন,“সম্পূর্ণ বাক্যটোত সৰল বাক্য,যৌগিক বাক্য আৰু জটিল বাক্যৰ মিশ্রণ ঘটিছেএনে বাক্যকে মিশ্রবাক্য বোলে।”১৯৮

তার পরেও কিন্তু ১নং সরল বাক্যটি এবং দুই বাক্যের আসন্ন অঙ্গ বা সঙ্গের স্থিতি বোঝাটা কঠিন রইল।একে পদ্যের অতি পর্বের মতো,‘অতি বাক্য’ বলা যেতে পারে।এই বাক্যে কোনো যৌগিক বাক্যের মিশ্রণ ঘটেনি,বরং জটিল এবং সরল মিলে যৌগিক বাক্য হয়েছে বলা যেতে পারে।এরকম দীর্ঘ বাংলা বাক্য সাধুবাংলাতে খুব ছিল। যেমন:

আ। রাস্তায় গাড়িঘোড়ার বিরাম নাই,ফেরিওয়ালা অবিশ্রাম হাঁকিয়া চলিয়াছে,যাহারা আপিসে কালেজে

     আদালতে যাইবে তাহাদের জন্য বাসায় বাসায় মাছ-তরকারির চুপড়ি আসিয়াছে ও রান্নাঘরে

     উনান জ্বালাইবার ধোঁওয়া উঠিয়াছেকিন্তু তবু এত বড়ো এই-যে কাজের শহর কঠিন হৃদয়

     কলিকাতা,ইহার শত শত রাস্তা এবং গলির ভিতরে সোনার আলোকের ধারা  আজ যেন একটা

     অপূর্ব যৌবনের প্রবাহ বহিয়া লইয়া চলিয়াছে। (রবীন্দ্রনাথ:গোরা)

ই। যখন দেখিবে, বকুলের অতি ঘনবিন্যস্ত মধুরশ্যামল স্নিগ্ধোজ্জ্বল পত্ররাশির শোভা আর গাছে ধরে

     না-পূর্ণযৌবনা সুন্দরীর   লাবণ্যের ন্যায় হাসিয়া হাসিয়া, ভাসিয়া হেলিয়া দুলিয়া, ভাঙ্গিয়া গলিয়া,

     উছলিয়া উঠিতেছে,তাহার অসংখ্য প্রস্ফুট কুসুমের  গন্ধে আকাশ মাতিয়া উঠিতেছে-তখন

     তাহারই আশ্রয়ে বসিয়া,সেই পাতার স্পর্শে অঙ্গ শীতল করিয়া, সেই গন্ধে দেহ পবিত্র করিয়া, সেই

     বকুলকুঞ্জ হইতে ডাকিও,কু-উ (বঙ্কিম চন্দ্র: বসন্তের কোকিল)

 

এর সব জটিলতাকে পরম্পরাগত ব্যাকরণ ব্যাখ্যা করতে সমর্থ বলেও মনে হয় না,অন্তত কোনো নজির আমাদের সামনে নেই।কিন্তু একটি ব্যাপার স্পষ্ট যে মৌলিক প্রকার ভেদ প্রথম তিনটিই।এমনততর ‘মিশ্র বাক্য’-কে পূর্ণযতিচিহ্ন () দিয়ে আলাদা করাও খুব কঠিন নয়।বস্তুত ইংরেজিতে তাই করা হয়,তাই সবাই এই চতুর্থ প্রকারভেদটির কথা স্বীকার করেন না।একটি ইংরেজি ব্যাকরণে লিখছে,“…some uses the term ‘Mixed Sentence’;but in view of the arguments above,it is not desirable.”১৯৯ ‘arguments above’ সেখান থেকে ব্যাখ্যা করতে হলে পুরো বিষয়টাই আবার ইংরেজিতে উপস্থাপন করতে হয়।এইটুকুন বুঝে নিলে হয়,আমরা তিন প্রকার বাক্যের যে সংজ্ঞা এবং ব্যাখ্যাগুলো করলাম,সেই সব যুক্তির কথাই হচ্ছে।এমনিতেও আধুনিক ইংরেজিতে দীর্ঘবাক্যের প্রবণতা কমছে। রামেশ্বর শ’ লিখেছেন,“উপবাক্য যোগ করে বড় বড় জটিল বাক্য রচনা করার প্রবণতা আধুনিক ইউরোপীয় ভাষাগুলিতে যথেষ্ট কমে এসেছে।বাংলাতেও বহু উপবাক্য যোগ করে বড় বড় জটিল বাক্যরচনার প্রবণতা ক্রমশ কমে আসছে।”২০০তবে বাংলার সম্পর্কে রামেশ্বর শ’ যে কথাগুলো লিখেছেন,সে প্রবণতার সূচনা চলিত বাংলার শুরুর দিনগুলোতেই রবীন্দ্রনাথ,প্রমথ চৌধুরীদের হাতেই হয়েছিল।ফলে তাঁর ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাস শুরু হতে পেরেছিল এরকম করে:

ঈ। অমিত রায় ব্যারিস্টার।

 এই বাক্যটি সম্ভবত বাংলা গদ্য সাহিত্যে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক।একই বছরে প্রকাশিত তাঁর ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসেরও প্রথম বাক্যটি হচ্ছে,--

উ। আজ ৭ই আষাঢ়।

 তারপর থেকে বাংলা বাক্য রচনাতে এই প্রবণতা ক্রমবর্ধমানব্যাকরণের রীতি ভেঙ্গে একক সরল বাক্যে যেমন শ্বাসাঘাত,সুরাঘাত,জটিল এবং যৌগিক বাক্যে এসে অবিভাজ্য স্বনিম,বাহ্য উন্মুক্ত যতি’-ও সক্রিয় হয়ে বাংলা বাক্যকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিচ্ছেভেঙ্গে ছোট করে ফেলছে,শুধু জটিল বা যৌগিক বাক্যকেই নয়,সরল বাক্যকেও:

আকাশটা লাল। খুব লাল। বৃষ্টি না এসে পড়ে। (বিমল কর:আঙুরলতা)  

ওরা আসে নিশুতি রাতে। প্রতি অমাবস্যায়(সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়:গরমভাত অথবা নিছক ভূতের    

     গল্প।)

মার ছোট,এক মামা বৈতলের (রণবীর পুরকায়স্থ:সুরমা গাঙর পানি)

পাশাপাশি দুই বাক্যের সঙ্গতির পরম্পরা ভেঙ্গেও তৈরি হচ্ছে নতুন গদ্য শৈলী:

আমাদের একটা জিপ আছে।চাইবাসাতে মালপত্র নিয়ে নেমেছিলাম।আমাকে নিতে এসেছিল

    জিপগাড়িটা। ফিল্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট কল্যাণ মুন্ডা এসেছিল আমাকে নিতে।

    (স্বপ্নময় চক্রবর্তী:এসো সুসংবাদ এসো)

অসমিয়াতেও সেই প্রবণতা রয়েছে কিনা বিস্তৃত সমীক্ষা না করে লেখাটা কঠিন।একেবারে নেই তাও নয়, আমরা ‘শোণিত কুয়রী’-র সংলাপে আগে দেখিয়েছি।কিন্তু দীর্ঘ মিশ্রবাক্য অসমিয়াতেও ক্বচিৎ দেখা যায়গোলোক চন্দ্র গোস্বামী লিখেছেন,‘কেতিয়াবা’

এই অব্দি এসে একটি বিষয়ে মনে হয় আমরা নিশ্চিত হতেই পারি যে,‘উদ্দেশ্য-বিধেয়’ বিধির থেকে বেরিয়ে ‘কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া’ বিধিটি স্পষ্ট করবার সঙ্গে সঙ্গে বাক্য সম্পর্কে আমাদের ধারণা অনেক স্পষ্ট হয়ে গেল।আরো একটি বিষয় স্পষ্ট হলো,--এই অব্দি বাক্যের যে তিনটি মূল প্রকারভেদের কথা আলোচনা করে এলাম,সে আসলে এই ‘কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া’ পদগুলোরই বিচিত্র বিন্যাসের পরিণাম।আমরা তাই এই উপ-অধ্যায়টির নাম লিখেছিলাম,‘পদ বিন্যাস অনুসারে বাক্যের গঠন ভেদ।’ যদিও ‘আসন্ন সঙ্গ’ বা ‘খণ্ডবাক্য’ স্তরের বিন্যাস নিয়ে আমরা পরিসরের কথা ভেবে,বিস্তৃত কিছু আলোচনা করছি না। সেটি শুধু সরল-জটিল-যৌগিক বাক্য নিয়ে করাটাই যথেষ্ট হবে না।বাক্যের যত রকমের গঠন ভেদ নিয়ে আলোচনা করব সব ভেদেই আসন্নসঙ্গ স্তরে বিন্যাস ভেদ হয়েই থাকে।সুতরাং সবার শেষে আবার একত্র আলোচনা না করলে বিষয়টি স্পষ্ট হয় বলেও আমাদের মনে হয় নি।যদিও অন্যেরা অনেকটা তাই করে গেছেন।  

ভাব অনুসারে  বাক্যের গঠন ভেদ:

নির্মল দাশ ‘বাক্যের অর্থমূলক শ্রেণীভেদ’-এর কথা লিখেছেন।২০১  গোলোকচন্দ্র গোস্বামী লিখেছেন, ‘ভাব অনুসরি বাক্যর প্রকার।’২০২জগন্নাথ চক্রবর্তী লিখেছেন ‘বাক্যের অর্থগত বিভাগ’২০৩ এটি যে কীরকম প্রকারভেদ ইংরেজি ব্যাকরণেও স্পষ্ট জবাব নেই।কিন্তু অর্থকে কি কোনো ‘প্রকারভেদ’-এর সীমায় বাঁধা তথা অর্থের উপর নির্ভর করে বাক্যের প্রকারভেদ কি সত্যি সম্ভব?বিবৃতি,প্রশ্ন,বিস্ময়,আদেশ,উপদেশ,এগুলো কি নিছক অর্থ?এসব নিতান্তই মানুষের আবেগ-অনুভূতি তথা ভাবের নাম। যে ভাবের প্রকারভেদগুলো সসীম।কিন্তু সেই ভাব থেকে বেরিয়ে আসা বাক্য তো অসীম।তাই একে আমরা ‘অর্থমূলক’ শ্রেণিভেদ বলবার বিরোধী।‘ভাব অনুসারে প্রকারভেদ’ বলা যেতে পারে। এমনিতেও আমরা ‘ভাব’ অনুসারে বাক্যের ক্রিয়াপদের প্রকার ভেদ নিয়ে কথা চতুর্থ অধ্যায়ে লিখেই এসেছি।কিন্তু শেষ অব্দি ভাব সেই ক্রিয়ার গঠন নিয়ন্ত্রণে যে ভূমিকা পালন করে,সেই অনুসারেই আমরা সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলা এবং অসমিয়া ক্রিয়ারূপের প্রকারভেদ নির্দেশ করেছিলাম।এখানেও একই কথা।যদি গঠনই বদল না হলো,তবে ‘বাক্যের প্রকারভেদ’ নিয়ে কথা বলা বৃথা।সম্ভবত রামেশ্বর শ’ যেহেতু ভাষাবৈজ্ঞানিক দৃষ্টি থেকে লিখছিলেন,তিনি এইভাবে প্রকারভেদের বিষয়টি সচেতন ভাবেই এড়িয়ে গেছেন।কিন্তু যেহেতু পরম্পরাগত ভাষাবিদ্যার সংক্ষিপ্ত পরিচয়ই তুলে ধরছিলেন,খুব বেশি গভীরে গিয়ে তার শুদ্ধাশুদ্ধি বিশ্লেষণ করছিলেন না,তাই এই প্রকারভেদের স্বরূপটি কী সেই নিয়েও নীরব ছিলেন। তিনি ‘বাংলা বাক্যে পদক্রম’২০৪ বলে যে আলোচনা করছিলেন,তাতে পর পর ক থেকে ঠ বারোটি সূত্র সাজিয়ে গেছেন, তারই শুরুতে উদ্দেশ্য-বিধেয়,সরল-জটিল-যৌগিক বাক্য প্রসঙ্গ আলোচনা করে ক্রমে ক্রমে প্রশ্নবোধক বাক্য,পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ উক্তি ইত্যাদি আলোচনা করে গেছেন।এবং আরো কিছু সূত্রাদি লিখে গেছেন,যার অনেকটাই সুকুমার সেন ব্যাখ্যা করেছিলেন।‘উক্তি’ তথা ‘Narration অনুসারে ভাগটির ভিত্তি কী তা ব্যাখ্যা করেন নি।ইংরেজি ব্যাকরণও বিষয়টি ভালো ব্যাখ্যা করতে পারে বলে আমাদের মনে হলো না।রূপকল্প বা ‘আর্হি’টি যে ইংরেজি ব্যাকরণেরই,গোলোকচন্দ্র গোস্বামীতে তার স্পষ্ট স্বীকারোক্তি আছে।২০৫ নির্মল দাশ ‘উক্তিপরিবর্তন’২০৬ নামে স্বতন্ত্র অধ্যায় রেখেছেন।কিন্তু সেটি গঠন না অর্থ অনুসারে ভেদ সেসব সরাসরি বলেন নি। গোলোকচন্দ্র গোস্বামী লিখেছেন,‘উক্তির ভিত্তিত বাক্যর প্রকার’২০৭যদিও এই বিষয়টি যে গঠন নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে এই বিষয়ে তিনি স্পষ্টতই ।লিখছেন,“বাক্য গঠনর অন্য বিচারেরেও বাক্যর প্রকারভেদ করিব পারি।”২০৮ আমরা তাই বর্তমান উপ-অধ্যায়টির নাম দিয়েছি,‘ভাব অনুসারে  বাক্যের গঠন ভেদ’ তেমনি ‘উক্তির ভিত্তিত বাক্যর প্রকার’ না লিখে আমরা লিখবো,‘কথা উপস্থাপন অনুসারে বাক্যের গঠনভেদ।’ এই গঠনভেদগুলোর সংজ্ঞা নিয়ে বিশেষ কোনো সমস্যা বা জটিলতা নেই।তাই আমরা সরাসরি বাক্যের গঠন দেখিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা করে যাবো।

নির্দেশক বাক্য: আমরা উপরে যে কটি বাক্যের আলোচনা করে এসেছি তার অধিকাংশই নির্দেশক বা বিবৃতিমূলক

                    নির্দেশক বাক্যের দুই প্রকারভেদ:

                    ১) অস্ত্যর্থক বাক্য: আমরা উপরে যে কটি বাক্যের আলোচনা করে এসেছি তার অধিকাংশই

নির্দেশক বা  বিবৃতিমূলক অস্ত্যর্থক বা হ্যাঁ-বোধক বাক্য। যেমন:

            অ.বাং. যে বিভূতিভূষণ প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন তিনি পথের পাঁচালি লিখতে

                          পেরেছেন।

                       অমিত রায় ব্যারিস্টার।

                  অস. এই দুটি পিতৃ-মাতৃহীন শিশুক ফুকন আৰু ফুকননীয়ে তেওঁলোকৰ

                          সমুদায় বস্তুৱে সৈতে ঘৰলৈ আনিলে আৰু জয়মতী নামে এটি বিধৱা   

                          ব্রাহ্মণী আৰু কণিকী নামে এজনী দাসী সেই দুই শিশুৰ লগত

                          আহিল।(গুণাভিরাম  বরুয়া:আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকনর জীবন চরিত্র)

                                           সিল. তাইর হড়ি খন̖নাস̖ হউর ভালা।

                                           চট্ট.আঁচা আঁচাই ফঁথ̖ দিয়ারে জওনর̖ শমত ইতে ইতার̖ মার̖ খথা মতন̖

                                                মুয়রে মিডা গরিবাল̖লাই ওগগোয়া ফইশার̖ মিডা কিনি লইল̖

                 নোয়া.হাঁচা হাঁচাই, হঁথদি জাওনের̖ শোমে হ্যেতে হ্যেতার̖  মার̖ কতা মতন̖

                           মুকেরে মিডা কইবার̖ লাই ইগ̖গা হইশার̖ মিডাই কিনি লইল

                    ২) নাস্ত্যর্থক বাক্যঃ      .অস. মই জনা নাছিলোঁ।

     বাং. রাজপথে আজ লোক দেখি না।

      সি.বারিষর সময় মাটি পাইতে না(সুগাপাঃপাঁচ)

      চট্ট.আগর জামাইয়ে কাট্টল ন খায়।

             হেএশের জামাইয়ে ভোঁতা অ ন পায়।।২০৯

    নোয়া.মড়াও পোড়াইতাম নঁ, চিড়াও খাইতাম নঁ।২১০

নঞর্থক বাক্যে ইংরেজিতে সহায়ক ক্রিয়া এবং ক্রিয়ার মধ্যে ‘not’ বসে। যেখানে সহায়ক ক্রিয়াটি থাকে না, সেখানে ‘do/does/did’ এই ক্রিয়াপদগুলো যোগ করে তার পরে not’ বসিয়ে দেয়া হয়।বাংলাতে ক্রিয়াপদের পরে ‘না/নি/নে’ বসিয়ে দিলেই চলে।সিলেটিতে ‘না/নায়’অসমিয়াতে সেটি ক্রিয়ার আগে পুরোসর্গ হয়ে জুড়ে যায় রূপতত্ত্বে আমরা সেসব আলোচনা করে এসেছি।বাংলাতে,এবং সিলেটি সহ বাংলার অধিকাংশ ভাষাবৈচিত্র্যে অসমাপিকার ক্রিয়ার আগে ‘না’ বসে। যেমন- না খেয়ে,না যেয়ে,না খাইয়া,না যাইয়া ইত্যাদি।অসমিয়াতে অসমাপিকা ক্রিয়াতেও ক্রিয়াপদের মতো একই রীতি মেনে,অসমাপিকা পদের সঙ্গে জুড়ে যায় এবং পদটির প্রথম স্বরটি ‘ন’ নিজেও গ্রহণ করে। যেমন- নাখাই, নুলিয়াই,নিদি ইত্যাদি।কর্তাদি অন্যান্য কারকপদগুলোর একাধিক বিকল্পের একটিকে নিষেধ বা প্রত্যাখ্যান করতে হলে দুই ভাষাতেই সেই কারক বোঝাবার বিশেষ্য পদগুলোর মাঝে বাংলা-সিলেটিতে ‘না’ অসমিয়াতে ‘নে’ বসেবাকি সব রীতিই চর্যার যুগ থেকেই বাংলা অসমিয়া দুই ভাষাতেই ছিল। যেমন-জো তরু ছেব ভেবউ ণ জাণই (চর্যা:৪৫) শুধু ক্রিয়াপদের পরে ‘না’ বসাটি চট্টগ্রামী বাদে সিলেটি সহ বাংলার প্রায় সব আধুনিক ভাষাবৈচিত্র্যের নিজস্ব রীতি।এমন কি হিন্দিতেও এই নিষেধার্থক অব্যয়টি ক্রিয়ার আগে বসে,--नहीं मिली, नहीं जाऊंगी ইত্যাদি। বাক্যগঠন প্রক্রিয়াতে এই একটি বিষয়ে বাংলার সঙ্গে অসমীয়ার বড় প্রভেদ। সিলেটি এবং অসমিয়ারও প্রভেদ বিন্দু এটিই। বরং চট্টগ্রামী  এই প্রশ্নে অসমিয়ার সামান্য সহচর।  তবে কখনো বা ‘ন’ > ‘নয়’ হয়ে গিয়ে চট্টগ্রামীও নোয়াখালি, সিলেটি সহ মান বাংলাকেই  অনুসরণ করে, এই কথা লিখেছেন রবীন্দ্র কুমার দত্ত।২১১

প্রশ্নবোধক বাক্য:        . অস.  তুমি যাবলৈকে ওলালা?

                                        তই এই বিলাক কাৰ বাৰীত পালি?                       

                                বাং.     আমাকে চিনতে পারছো ?

                                         তোর নাম কী রে?

                                 সি.   ছেরাগু দেখিয়া ডরাইরায় নি ? (সুগাপাঃদুই)

                                         অখন যদি উল্টা কথা কই কিতা ভাববা কাকাবাবুয়ে ? (সু.গা.পা.:আঠারো)

                                   চট্ট.১ ন জানস অউডা?

                                        আঁর̖ মা জ্যেন̖ কইলাক̖, আঁই হ্যেন̖ কইলাম̖, ত মানুশ̖শুনে কিল̖লাই আঁরে

                                          ফাওল̖ ডার̖?

         নোয়া.  দশ ট্যায়া? কস কি? বাইচলামি নি? হাগল হইছস নি? হুকি বায়গন দশ

                    ট্যায়া চাস কোন আক্কেলে?২১২

 

প্রশ্ন বোধক বাক্যে ইংরেজিতে সহায়ক বা গৌণক্রিয়াটি যেভাবে কর্তার আগে চলে আসে,বাংলা কিংবা অসমিয়াতে সেরকম কোনো পরিবর্তন হয় না। রামেশ্বর শ’ লিখেছেন,“বাংলায় বাক্যে প্রশ্নের বোধটি জাগে পদক্রমের পরিবর্তন থেকে নয়,সুরতরঙ্গের (intonation) পরিবর্তন থেকে।পদক্রম পরিবর্তিত হতেও পারে, নাও হতে পারে।”২১৩  আমরা দেখছি,কথাটি অসমিয়া সম্পর্কেও সত্য।‘.অস.১’ এবং ‘.বাং.১’ এই দুই বাক্যের পদক্রম নির্দেশক বাক্যেও একই থাকবে।সুর পালটে কীভাবে প্রশ্নবোধক বাক্য তৈরি হয়,আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে রেখাচিত্রে তা দেখাবার চেষ্টা করেছি।এখানে লেখায় দেখাবার জন্যে যতি চিহ্ন (?) ব্যবহার করা হয়েছে।দুইভাষাতেই তাই করা হয়।পদক্রম দেখে কিছুই বোঝার উপায় থাকে না।তবে ‘.অস.১’ বাক্যে শেষে জোর দেবার জন্যে একটা স্বার্থিক ‘নে’ অনুপদ জুড়তে পারতসিলেটিতে-নোয়াখালিতেও প্রায়ই জুড়ে ‘নি’বস্তুত পুববাংলার অধিকাংশ ভাষাবৈচিত্র্যেই তাই হয়।ই-সি.১ এবং নোয়া’-তে তাই হয়েছে।বাংলাতে জুড়ে ‘কি’ (কী নয়)প্রশ্নবোধক সর্বনামও ইংরেজি বাক্যের শুরুতে জুড়ে,তার পরেই চলে আসে সহায়ক ক্রিয়া।কিন্তু বাংলা কিংবা অসমিয়াতে সর্বনামটি কারকপদের সংগে সম্পর্কিত হয়ে তার বিকল্পে বসে। যেমন ‘.অস.২’-এ ‘কাৰ’ শব্দটি অধিকরণের ‘বাৰি’ শব্দটির আগে সম্বন্ধ পদের বিকল্পে বসেছে।‘.বাং.২’-এ ‘কী’ সর্বনামটি কর্মের বিকল্পে বসেছে।‘.সি. সিলেটি বাক্যেও তাই হয়েছে।‘কাকাবাবুয়ে খারাপ ভাববা’ এই প্রধান গর্ভবাক্যের ‘খারাপ’ কর্মের বিকল্পে বসেছে ‘কিতা’বাংলা-অসমিয়া-সিলেটি বাক্যে কারকপদের গুরুত্ব এই সব নঞর্থক এবং প্রশ্নবোধক বাক্যের গঠন থেকে ভালো বোঝা যায়। যেভাবে কারকপদগুলোও বক্তার জোর দেবার ইচ্ছে অনুসারে প্রায়শই জায়গা পালটায় নঞর্থক অব্যয় এবং প্রশ্নবোধক সর্বনামগুলোও সেরকমই শুধু পাল্টাতে পারে  জগন্নাথ চক্রবর্তী কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া ক্রম ধরে সন্ধান করেন নি বলেই মনে হয় এরকম এক সিদ্ধান্তের কথা লিখেছেন,“তথ্যান্বিষ্ট বাক্যে প্রশ্নের অন্বিষ্ট যদি ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমূহ হয় তাহলে প্রশ্নাত্মক সর্বনাম বসবে বাক্যের শুরুতেই।”২১৪  কিন্তু তিনি যে তিনটি নজির দিলেন তার দুটিতেই বসেছে শেষে। এরকম:

 .সি.বরই পাড়িতরা কিগুইনতে?

        বুড়াকালো মোরে চাইব কুনে?

সুতরাং এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন,“তবে বক্তার ক্রোধ প্রকাশ পেলে বা ব্যক্তির উপর সমধিক গুরুত্ব দিলে প্রশ্নাত্মক সর্বনামটি বাক্যের অন্তে স্থান পাবে।”২১৫যেখানেই বসুক সে যে ক্রমে কর্তা এবং কর্মকে প্রতিস্থাপিত করেছে,সেই ভাবনাটি তাঁর আসে নি।এবং তিনি ভাবেন নি সাধারণ ভাবে অবিভাজ্য স্বনিম তথা বাক্য স্বরাঘাত  নিয়ে।তিনি অবস্থান নিয়ে চিন্তিত ছিলেন,এবং এক স্থির সূত্র চাইছিলেন।এই সমস্যা প্রায় সর্বত্র হয়েছে।এই দুই বাক্যে প্রশ্নাত্মক সর্বনাম মাঝেও বসতে পারত এরকম:

    .সি.বরই কিগুইনতে পাড়িতরা?

            বুড়াকালো মোরে কুনে চাইব?       

অনুজ্ঞাবোধক বাক্য:  . অস.তই এতিয়াই ইয়াৰ পৰা গুচ̖গুচ̖ বুলিছো নহয়! 

                                       দৰবটো দিনে তিনিপালিকৈ খাবা।

                                       আপুনি দীর্ঘজীৱী হওক।

                                 বাং. এমন কাজ আর কখনো করো না।

                                        আমাকে বইটা এনে দাও দেখি।

                                        আপনি দীর্ঘজীবী হোন।

                                   সি.আরিপরির লগে লাগালাগি করিও না।

    পট̖ করি আশ লইআ জা।

    আপনে বাঁচি থাকইন।

                                            নোয়া.১ব্যায়ান হৈ গেছে গৈ। উঠ উঠউডানে জলের ছিডা দাও।২১৬

                                                     হইশা ইঁয়ান̖ দি হঁথের̖ মইদদে কিছু কিনি খাইছ̖ আর হোর বাড়িত̖ জাই

                                                    বেউগ̖গুনের̖ উয়রে বই মিডা মুয়ে কুকিলর̖ শরে কতা কইস̖

                                                 চট্ট.ফইশাউয়া দিয়ারে ফঁথর̖ মইদ̖দে কিছু কিনিইয়ারে খাইছ, আর হউর̖ বারিত̖

                                                    জাইয়ারে বেয়াগ̖গুনর̖ বইয়ারে মিডা মুয়ে কুঁইল̖র শরে কথা কইছ̖        

          সন্দেহাদিবোধক বাক্যঃ . অস. তেওঁ জানো ঘুৰি আহিব?

                                                 ডাক্তৰজন যদি ঠিক সময়ত আহিপালেহেঁতেন!

                                           বাং.দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে। (রবীন্দ্রনাথ; সোনার তরি)

                                                 আকাশে মেঘ করেছে, বৃষ্টি আসবে কি?

                                          সিল.শিলচরি গাড়ি গেছে গি বুধহয়।

                                                আজকু জাত̖রাগান অইবনি কিতানি বুজিআর না।

                                           নোয়া.বোদয় তোঁয়ার̖ হঙ্গে এইয়ে শেশ̖ দেখা।২১৭

                                              চট্ট.বোদয় তোঁয়ার হঙ্গে এইয়ে শেশ̖ দেয়া।২১৮

            বিস্ময়াদিবোধক বাক্যঃ. অস. আয়ৈদেহি! তোমাৰ আজি এই দশা হ’ল!

                                                   কি! মোক এনেকৈ ক’বলৈ তোমাৰ ইমান সাহ!

                                              বাং.হায়রে! তোমার আজ এই দশা হলো!

                                                   কী! আমাকে এভাবে বলবার তোমার এতোই সাহস!

                                               সি.হায় রে! তুমার আইজ অউ দশা নি অইলো!

                                                   কিতা ! আমারে ইলা কইবার তোর অতো সাহস!

                                           নোয়া.১ ও ম্মা-মা-মা!ভাবিও না আমনে আইচেন।ক্যামনে আইলেন?ফৎ ভুলি

                                                        নি?২১৯                                                                                                                                   হালার পো, হুইশা দিলি না। ব্যাদ্দপ।ব্যাতুরিব্যাতবহুত দিন সবুর

                                                       কইচ্ছি।এ্যাল তোর হোন্দে বাঁশ দিউম। খাইচ্চত কোনানের। ফাইরগা

                                                       কোনানের।২২০

                  চট্ট।আহারে!বালা মানুশশুয়া কেঙগরি মরি গেল̖রে!২২১

                            সর্তাধীন বাক্য:.অস. সি আহিলে মই যাম।

                                                   বাং. ও এলে আমি যাবো।

                                                    সি. হে আইলে আমি যাইমু।

                                                 নোয়া.জদি বিশটি অয় তইলে আইতাম ন।২২২

                                                    চট্ট.জদি বিশটি অয় তইলে ন আইশশম/ আইসতাম নয়।২২৩

রামেশ্বর শ’ লিখেছিলেন,“নির্দেশক ভাব ছাড়া অন্যভাবের ক্রিয়া(যেমন--সর্তজ্ঞাপক ভাব,Subjuctive Mood) হলে নঞর্থক অব্যয় সমাপিকা ক্রিয়ার আগেও বসে। যেমন-‘আমি যদি মুখ্যমন্ত্রী না হই তা হলে দেশের সেবা করব কি করে?’”২২৪বিষয়টি সামান্য স্পষ্ট হওয়া দরকার।‘ঈ.বাং.১-বাক্যে’ দেখানো গেল অনুজ্ঞাতে এই কথা খাটছে না।অন্যান্য ভাবেও তাই।সমস্যা এই শর্তাধীন বাক্য নিয়েই।আসলে এমন বাক্য জটিলই হয়,আর সেরকম  হলে সর্তের ক্রিয়াপদটিকে অসমাপিকা করে দিয়ে দুই বাক্য জুড়ে দেয়া হয়,আমরা সিলেটি সেরকম বাক্যের নজির দেখিয়েছিলামযেমন ‘ঋ-বাক্য’টি আছে।অসমাপিকা থাকলে ‘না’ আগেই বসবে।অন্যথা পরে। যেমন-

                                         . বাং.ও না এলে আমি যাবো।

                                                   ও এলে আমি যাবো না।

যে নজির রামেশ্বর শ’ দিয়েছেন সেটিরও শেষাংশকে প্রশ্নবোধক না রেখে নিষেধার্থক করলেই দেখা যাবে,‘না’ পরে বসছে যেমন:

                                         . বাং.আমি যদি মুখ্যমন্ত্রী না হই তা হলে দেশের সেবা করতে পারব না।

এটি অবশ্য সরল নয়,জটিল বাক্যই।সুতরাং আশ্রিত বাক্যের সমাপিকার আগে ‘না’ বসে কিনা সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে।বাক্যটিকে এভাবেও পুনর্গঠন করা যেতে পারে:

                                       . বাং.আমি যদি মুখ্যমন্ত্রী  হই না তা হলে দেশের সেবা করব কী করে?

              তেমনি:

                                                 তুমি যখন বলছো আসবে না তবে আর আমি যাবো আর কি।

  তার মানে ‘না’ এখানে বক্তার জোর দেবার ইচ্ছে অনুসারে আগে যেতে পারে।অন্যথা পরেই বসে।

            এগুলোই প্রধান।এছাড়াও গোলোকচন্দ্র গোস্বামী ‘বাদপ্রতিবাদমূলক বাক্য’২২৫বলে একটি বহুবাক্য সমাবেশে দীর্ঘ সংলাপের উল্লেখ করেছেন।বাক্যগুলোকে আলাদা ধরলে উপরের কোনো না কোনো এক বিভাজনে সেগুলো বসে। নির্মল দাশ ‘ইচ্ছা বা প্রার্থনাসূচক বাক্য’২২৬জগন্নাথ চক্রবর্তী ‘ইচ্ছাত্মক বাক্য’২২৭বলে স্বতন্ত্র বিভাজন করেছেন,সেগুলোকে ‘অনুজ্ঞা’র মধ্যে ধরলেই চলে।দু’জনেই তাঁরা ‘কার্য-কারণাত্মক বাক্য’ বলে যা বোঝালেন,আমরা তাকে ‘শর্তাধীন বাক্য’ বলে লিখলাম।

            কথা উপস্থাপন অনুসারে  বাক্যের গঠনভেদঃ 

বিষয়টির এই নামকরণের যুক্তি আমরা আগে উপস্থাপন করে এসেছি।এই ধরনের বাক্য আমরা এই গবেষণা নিবন্ধে অজস্র লিখে এসেছি, যখনই অন্য কারো মন্তব্য উদ্ধার করেছি। এতে যা হয়, তা আসলে এই যে-- কর্মের জায়গাতে অন্যের পুরো একটি মন্তব্য বা কথা বা ‘উক্তি’ কর্তার নিজস্ব ভাষাতে ‘প্রত্যক্ষ’ অথবা বক্তা বা উপস্থাপকের ভাষাতে রূপান্তরিত করে ‘পরোক্ষ’ রূপে ‘উপস্থাপন’ করা হয়। সেই অনুসারে  কর্তা-কর্ম–ক্রিয়াগুলোর গঠন এবং বিন্যাস পালটে যায়। বস্তুত ‘কথা বা উক্তি’ অংশটিকে যদি কর্ম ধরি তবে সেটি এমনিতেও ‘প্রত্যক্ষ উপস্থাপন’-এ ক্রম পালটে শেষে চলে যায়।‘কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া’ সূত্র ধরে দেখলে এই ‘কথা’ তথা narration বিষয়টি এমনই স্পষ্ট।আমরা পদবিন্যাসের দিক থেকে সরল-জটিল-যৌগিক বলে বাক্যের যে প্রকার ভেদের কথা আলোচনা করে এলাম,তাতেও মোটা দাগে বিষয়টি বসে যায়।শুধু এই ‘কথা’ অংশটি রয়েছে বলে এবং সেখানেও এক বা বহুবাক্যের সমাবেশ থাকতে পারে বলেই এর আরো গভীরে গিয়ে স্বতন্ত্র আলোচনা করা দরকার।

গোলোকচন্দ্র গোস্বামী ‘উক্তির ভিত্তিত বাক্য’-এর তিনরকম প্রকার ভেদের কথা লিখেছেন,“বিবৃতিমূলক বাক্য, প্রত্যক্ষ উক্তিমূলক বাক্য আরু পরোক্ষ উক্তিমূলক বাক্য।”২২৮বিবৃতিমূলক বাক্যকে এখানে বাহুল্য বলে মনে হয়।তাছাড়া উপস্থাপকের ভাষাতে বাক্যটি বিবৃতিমূলকেই পরিণত হয়।এমন কি ‘কথা’ অংশটির যদি ‘ভাবভেদ’-ও থাকে তবে সেগুলোও সাধারণ বিবৃতিমূলক বা নির্দেশক বাক্যে রূপান্তরিত হয়।নির্মল দাশ দুটিই প্রকারভেদ করেছেন –প্রত্যক্ষ উক্তি ও পরোক্ষ উক্তি২২৯ ইংরেজি ব্যাকরণেও তাই করা হয়—Direct Narration Indirect Narrationআমরা শুধুই ‘উক্তি’র বদলে তার সঙ্গে ‘উপস্থাপন’ কথাটি যোগ করতে চাইকেননা ‘উক্তি’ বাক্যটির একটি অংশ মাত্র। সেটিই মূল কথা এখানে।সুতরাং শব্দটি থাকবে।কিন্তু সেটি পুরো বাক্যের গঠনকে নিয়ন্ত্রণ করে কীভাবে ‘উপস্থাপিত’ হয় তার উপরে ভিত্তি করে এই বিভাজনআমরা আলোনার বিষয় একে করছি সে জন্যেই।তাই পুরো ঘটনাক্রমের বার্তা দেয়া নাম চাইতার উপর ‘উক্তি’ কথাটি যেন একটু আনুষ্ঠানিক,এর প্রতিশব্দ হিসেবে ‘কথা’ অনানুষ্ঠানিক এবং আটপৌরে।সাবলীল তথা শ্রুতিমধুর।বাংলা এবং অসমিয়া দুই ভাষাতেই সুপ্রচলিত।রবীন্দ্ররচনার নাম রয়েছে ‘কথা ও কাহিনি’কাহিনি তথা গল্প সাহিত্যকে বলাই হয় ‘কথা সাহিত্য’লোকে বলতে বলে,‘কথায় কথা বাড়ে।’আমরা তাই আসন্ন সঙ্গ তথা পুরো পদগুচ্ছের নাম দিলাম,কথা(র) উপস্থাপন অনুসারে  বাক্যের গঠনভেদ।

প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ উপস্থাপনের গঠনে বলবার সময় মৌলিক যে প্রভেদটি ঘটে সে হলো—

প্রত্যক্ষ উপস্থাপনে ‘কথা’ অংশের আগে যতিটিকে সামান্য বিলম্বিত করে দেয়া হয়,লিখবার সময় একটি কমা বসানো হয়।সাধারণত নিয়ম হচ্ছে পুরো ‘কথা’টি পরে দুমুখো দুটি উর্ধ্বকমার (“”) মাঝে বসিয়ে দেয়া হয়। অসমিয়াতেও একই নিয়মবহু সময় উর্ধ্বকমা না বসিয়ে ড্যাস (_) চিহ্ন বসিয়ে দেয়া হয়। যেমন:

. বাং. হারাণী সেই কথাই বলে,“বৌদিদি যদি বারণ না করে,তবে পারি।তবে জানিব,

               এতে দোষ  নাই।” (বঙ্কিম চন্দ্র:ইন্দিরা)

           মা চমকিয়া ফিরিয়া চাহিয়া কহিল,রাঁধবোখন রে!হঠাৎ উপরে অঙ্গুলি নির্দেশ  

              করিয়া ব্যগ্রস্বরে কহিল,দ্যাখ দ্যাখ বাবা,—বামুন-মা ওই রথে চড়ে সগ্যে

              যাচ্চে! (শরৎ চন্দ্র; অভাগীর স্বর্গ)

   ছেলে মাকে গিয়ে বললে,‘মা,দেবতাকে অনেককাল ছেড়েছি,এমন অবস্থায়  

        আমাকে দেবতার ছাড়াটা নেহাত বাহুল্য।কিন্তু জানি বেড়ার ফাঁকের মধ্য দিয়ে

        হাত বাড়ালে তোমার প্রসাদ মিলবেই।ঐখানে কোনো দেবতার দেবতাগিরি খাটে

        না,তা যত বড়ো জাগ্রত হোন-না তিনি।’ (রবীন্দ্রনাথ:রবিবার)

                                       অস. জীয়েকৰ এই কথা শুনি বৰফুকন শান্ত হৈ কলে,“চাচোন আইদেউ, আজিৰ পৰা

                                                  ঈশ্বৰৰ অনুগ্ৰহত মই শত্ৰুশূন্য হলো। তোৰ সূৰ্য্যকুমাৰৰ কাৰ্য্য দেখিলি ? আমি

                                                  ভাল সাপটো পুহিছিলো” (লক্ষীনাথ বেজবরুয়া:পদুম কুঁৱৰী)

          “কেলেই সোণটিহঁত নাহিব জানো পৰহিলৈ?”বৌৱে ক'লে,চকুদুটা অলপ ডাঙৰ

                কৰি,“ইলা-নীলাৰ কাৰণে--” (সৌরভ কুমার চলিহা:অশান্ত ইলেক্ট্রন)

পরোক্ষ উপস্থাপনে বলবার সময় এবং লিখবার সময়েও (,)-র জায়গাতে ‘যে’ অব্যয় বসিয়ে দেয়া হয়।এই ‘যে’ টি আসলে বাংলা-অসমিয়াতে ইংরেজি that’-এর অনুবাদ ঋণ।নইলে বাংলাতে বিকল্পে ‘বলে/বুঝি’,অসমিয়াতে ‘বোলে/বুলি’২৩০,সিলেটিতে ‘বুলে/কইয়া’ দিয়ে কাজ চালানো হয়।মানবাংলা ‘বুঝি’র বিকল্পে সিলেটিতে ‘বুলে’ বসে। সিলেটি মুখের ভাষা বলেই মনে হয়,‘বুলে’-কে এখনো ‘যে’ প্রতিস্থাপিত করে উঠতে পারে নি।মুখের ভাষা বলেই তাতে প্রত্যক্ষ উপস্থাপনে ঊর্ধ্বকমা বসে কি না বসে,সেই তর্কও অর্থহীন।আমরা তাই ‘অ-বাক্য’ তালিকাতে সিলেটি দেখাই নি। গোলোক চন্দ্র লিখেছেন,এই ‘বোলে/বুলি’র প্রয়োগে বাক্যগঠনই সত্যিকার অসমিয়া ‘ঠাঁচ’ বা গঠন।২৩১বাংলা সম্পর্কেও কথাটি একই।বাংলা- অসমিয়া-সিলেটিতে বহু সময় যতি দিয়েও কাজ চালানো হয়।কিন্তু উর্ধ্বকমার তখন আর কোনো দরকার পড়ে না। যেমন:

.বাং. হোমি মোদিই ১৯৪৫ সালে দুঃখ করে বললেন যে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে সুবর্ণ

             সুযোগ যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতিতে পাওয়া গিয়েছিল, জরুরি ভিত্তিতে তার ফায়দা

             তোলার কাজটা করা যাচ্ছে না,কারণ কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের ঝগড়া না-মেটায়

             কেন্দ্রে কোনও শক্তিশালী সরকার বসতে পারছে না।২৩২

          আজ আসতে পারবে না বলে মাধুরিমা জানালো।

          আইজ আইত পারত নায় কইয়া মাধুরিমায় জানাইল।

     অস.এবাৰো তেওঁ প্রুফ ভালদৰে চোৱানাই নেকি সোধাত,তেওঁ বৰ গৌৰবেৰে মোক

              ক’লে যে সেইটো তেওঁৰ কাম নহয়। তেওঁ ‘সহকাৰী সম্পাদক।’এইবোৰ প্রুফ চোৱা

              আদি কামকৰিবলৈ প্রুফ ৰিডাৰ আছে। সেইটো প্রুফ ৰিডাৰৰহে দায়িত্ব আৰু

              কাম।২৩৩

           আজি আহিব নোৱাৰে বুলি মাধুৰিমাই ক’লে।

আমরা দেখছি,‘কথা উপস্থাপন’ প্রসঙ্গে মৌলিক কথাগুলো দুই ভাষা এবং ভাষাবৈচিত্র্যে একই।দুই ভাষাই ইংরেজি ব্যাকরণের রূপকল্প অনুসরণ করে বলে আরো এক হবার দিকে এগুচ্ছে।নির্মল দাশ,যখন প্রত্যক্ষকে পরোক্ষ করে প্রচুর নজির দিয়ে দেখাচ্ছেন,অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘যে’ ব্যবহার করে দেখিয়েছেন।২৩৪এগুলো সাম্প্রতিক অনুশাসন নির্মাণ করবার মতো বিষয়।বাস্তবে দুই ভাষাই এইসব রীতি মেনে চলে না।এমন কি ‘বুলে/বলে’ ব্যবহার করবার সময় কোথায় যে বসবে,সেটি বক্তা কোন পদ বা পদগুচ্ছে জোর দিতে চাইছে,তার উপরে নির্ভর করে। গোলোকচন্দ্র গোস্বামী সেরকম একাধিক নজির দেখিয়েছেন।আর সেখান থেকেই একটি নিয়ে দুই রূপে দেখাচ্ছিঃ২৩৫

.অস। প্রত্যক্ষ:     ৰামে ক’লে, “সীতা , তুমি মোৰ লগত বনলৈ যাব নালাগে; কষ্ট পাবা।”

         পরোক্ষ: ১বনলৈ গ’লে কষ্ট পাব কাৰণে ৰামে সীতাক তেঁওৰ লগত যাব নালাগে বুলি 

                        ক’লে। 

  ‘প্রত্যক্ষ কথা’-কে দুটো ভাগে ভাগ করে ফেলা হলো।দ্বিতীয় সম গর্ভবাক্যটিকে এনে পরোক্ষে ‘আশ্রিত’ করে তাই দিয়েই শুরু হলো প্রধান বাক্য।প্রত্যক্ষের প্রথম গর্ভবাক্যটিকে পরোক্ষের প্রধান গর্ভবাক্যের কর্ম করে ফেলা হলো। সেই কর্মের আগে বসলো কর্তা ‘ৰাম’ এবং গৌণ কর্ম ‘সীতাক’তার পরে বসল ক্রিয়া ‘ক’লে।‘প্রত্যক্ষ কথা’-তে জোরটা পড়েছে,‘যাব নালাগে’ ক্রিয়াতে,পরোক্ষে জোরটি পড়েছে,‘কষ্ট পাবা’-তে।একে বাংলা অনুবাদ করলে বাক্যটি দাঁড়াবে এরকম:

 বাং. প্রত্যক্ষ:    রাম বললেন, “সীতা, তুমি আমার সঙ্গে বনে যেতে হবে না, কষ্ট পাবে।”

      পরোক্ষ: ১বনে গেলে কষ্ট হবে বলে রাম সীতাকে তার সঙ্গে না যেতে বললেন।

অসমিয়ার মতো আক্ষরিক অনুবাদও হবে, এরকম:

                   বনে গেলে কষ্ট হবে বলে রাম সীতাকে তার সঙ্গে যেতে হবে না বলে 

                      বললেন।

 কিন্তু বাংলাতে শ্রুতিমাধুর্যের জন্যে ক্রিয়াপদ সহ যেকোনো পদের পুনরুক্তি এড়িয়ে যাওয়াই প্রবণতা। বাংলাতে শোনাবে না ভালো,তাই অসমিয়া ‘কারণে’ শব্দটিকেই প্রতিস্থাপিত করে বাংলা ‘বলে’ বসবে।আরেকভাবে হতে পারে,সেক্ষেত্রে বাক্যটিকে ভেঙ্গে দুই স্বাধীন বাক্য করে ফেলতে হবে,এবং বাংলাতে সেটাও করা হয়।দাড়ি ()-র বদলে সেমিকোলন ব্যবহার করা যেতে পারে:

                  বনে গেলে কষ্ট হবে;সেজন্যে রাম  সীতাকে তার সঙ্গে যেতে মানা করলেন।

আমাদের মনে হয় এর অসমীয়া অনুবাদটিও ভুল হবে না এই ভাবে:

                               অস.পরোক্ষ: ২ বনলৈ গ’লে কষ্ট পাব;সেইবাবে ৰামে সীতাক তেঁওৰ লগত যাবলৈ মানা

                                                    কৰিলে।

‘বোলে’ ব্যবহার না করে কমা(,)দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে বাক্যটিকে এইভাবেও লিখেছেন গোলোকচন্দ্র গোস্বামীঃ২৩৬

                              অস.পরোক্ষ: ৩ৰামে সীতাক তেঁওৰ লগত বনলৈ যাবলৈ হাক দিলে,কাৰণ তেওঁ (সীতাই) কষ্ট

                     পাব।

   ‘হাক দিলে’ শব্দজোড়ের  অর্থ ‘মানা কৰিলে’একেও বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়াবে এই:

বাং.পরোক্ষ: ৪রাম সীতাকে তার সঙ্গে বনে যেতে মানা করলেন,কারণ তিনি (সীতা) কষ্ট

                    পাবেন।

‘মানা করলেন’ প্রসঙ্গে বলা ভালো যেহেতু,এখানে ‘প্রত্যক্ষ কথা’টি অনুজ্ঞা ভাবের,তাই ‘বললেন’,‘ক’লে’ ইত্যাদি ক্রিয়ার বদলে ‘মানা করলেন’,‘নিষেধ করলেন’,‘উপদেশ দিলেন’ ‘আদেশ দিলেন’ এই সব ভাবার্থবোধক ক্রিয়া দিয়ে ‘কথা বহির্ভূত বাক্যাংশ’-টির ‘বললেন’ আদি ক্রিয়াপদ প্রতিস্থাপিত হবে---এমন রীতি বাংলা অসমিয়া দুই ভাষাতেই রয়েছে।একই ঘটনা সাধারণ বিবৃতিমূলক বাক্য ছাড়া আর সব ধরনের বাক্যেই হয়ে থাকে।প্রশ্ন করলে যেমন পরোক্ষ বাক্যে লিখতেই হয়,‘জিজ্ঞেস করলেন’,‘প্রশ্ন করলেন’ ইত্যাদি।এখানে একটি কথা উল্লেখ করা ভালো, রূপকল্প বা ‘আর্হি’টি যে ইংরেজি ব্যাকরণের সে নির্মল দাশের ‘ভাষাবীথি’তে নজর ফুরোলেও স্পষ্ট হয়।২৩৭গোলোকচন্দ্রে তো হয়ই।ইংরেজিতে এগুলো যেভাবে বিস্তৃত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে,Reporting verb,reported verb ইত্যাদি নানা পারিভাষিক শব্দ বিকশিতও হয়েছে,বাংলা বা অসমিয়াতে সেরকমটি হয়েছে বলে মনে হয় নি।তাই গোলোকচন্দ্র গোস্বামী,নির্মল দাশ এবং রামেশ্বর শ’ যদিও বা কথা পরিবর্তেনের কিছু সূত্র দিয়েছেন,সেসব বাস্তবে যে সবটা স্পষ্ট হয়েছে সেরকম আমাদের মনে হয় নি।আমরা সেগুলো ক্রমে ক্রমে উল্লেখ করছি।

 গোলোকচন্দ্র সরাসরিই ইংরেজি ব্যাকরণের অনুসরণে কিছু সূত্র দিতে গিয়ে লিখেছেন,“ইংরাজী ব্যাকরণর আর্হিত প্রত্যক্ষ উক্তিক পরোক্ষ উক্তিলৈ নিওঁতে ক্রমে ব্যক্তিবোধক,স্থানবাচক আরু কালবোধক সর্বনামর তলত দেখুয়াবর দরে সলনি ঘটে।”২৩৮ ক্রমটি তিনি দেখিয়েছেন এইভাবে:


এগুলোর অসমিয়া বাক্যে বসিয়ে পরীক্ষা করলে অনেকগুলোই হয় নাকচ হবে,অথবা সংশোধন হবে বলেই আমাদের মনে হয়। যেমন ‘তই/তহঁত’ যে কোনো অবস্থাতে ‘তেওঁ/তেওঁলোক’-এ রূপান্তরিত হবে বলে মানা কঠিন আছে।তিনি অবশ্য এর পরেই আরেকটি সর্ত সংযোজন করছেন,“উত্তম পুরুষ আরু মধ্যমপুরুষর সর্বনামক যদি প্রত্যক্ষে সম্বোধন করি কথা কয়,তেনে হলে পরোক্ষ উক্তিলৈ নিওঁতে সেই সর্বনামর পুরুষর সলনি নঘটে।”২৩৯ কিন্তু ধরা যাক বাক্যটা এরকম:

 . প্রত্যক্ষ:মাধৱে তাক কৈছিল,“তই কালিলৈ আহিবি চোন!”

এর পরোক্ষ কি এরকম হবে?

 .পরোক্ষ:মাধৱে তাক কৈছিল তেঁও যাতে পিচদিনা যায়/আহে। (?)

‘তাক’ অন্যপক্ষ তথা ‘প্রথম পুরুষ’ এই সর্বনাম ব্যবহার করছেন উপস্থাপকবক্তা ‘তই’ বা ‘তুমি’ এমন কি ‘আপুনি’ বলেও সম্বোধন করে কথা বলতে পারেন।তাতে কিছু যায় আসে না।উপস্থাপকও ‘তাক’-এর বদলে,‘তেওঁক’ বলতে পারতেন। সেক্ষেত্রে পরোক্ষ কথাতে সর্বনামটি প্রথম ক্ষেত্রে ‘সি’ এবং শুধু শেষ ক্ষেত্রেই ‘তেঁও’ হওয়া সম্ভব।প্রথম ক্ষেত্রে পরোক্ষে বাক্যটি দাঁড়ানো উচিত এরকম:

               পরোক্ষ:মাধৱে তাক কৈছিল সি যাতে পিচদিনা আহে/ তালৈ যায়।

দ্বিতীয় ক্ষেত্রেই শুধু  হবে:

               পরোক্ষ:মাধৱে তেওঁক কৈছিল তেওঁ যাতে পিচদিনা আহে/ তালৈ যায়।

ক্রিয়াপদটি ‘যায়’ হবে না ‘আহে’ থাকবে---সেটিও অসমিয়াতে একটি সমস্যা। সে ইংরেজি ব্যাকরণের রীতি অনুসরণ করে না।স্পষ্টতই ক্রিয়াপদের পরিবর্তন একটি স্বতন্ত্র ব্যাখ্যার দাবি রাখে।আরেকটি তর্ক এরকম হতে পারে:

             . প্রত্যক্ষ:মাধৱে তোমাক কৈছিল,“তই কালিলৈ আহিবি চোন!”

এখানে কিন্তু যাকে বলা হচ্ছে,অর্থাৎ উপস্থাপক যাকে বলছেন,তার পক্ষ শ্রোতা,তথা ‘মধ্যম পুরুষ’এক্ষেত্রে অবশ্য পরোক্ষ হবে এই,প্রত্যক্ষ কথার সর্বনাম পালটাবে না।উল্লেখ না করলেও চলবে।

               পরোক্ষ: মাধৱে তোমাক কৈছিল (তুমি) পিচদিনা  তালৈ যাবলৈ/ ইয়ালৈ আহিবলৈ

বাক্যটি অবশ্য আমাদের নির্মাণ। গোলোক চন্দ্র লিখেছেন, এরকম:

                পরোক্ষ:তুমি পিচদিনা আহিবা বুলি মাধৱে তোমাক কৈছিল।২৪০

‘তোমাক’-এর বদলে এখানে ‘মোক’ বসালেও একই হতো।

 সর্বনামপদগুলোর রূপান্তর  বাংলায় অনুবাদ করলে এরকম দাঁড়াবে:



আমরা রূপতত্ত্বে কারকের আলোচনাতে দেখিয়েছি অসমিয়া ‘তালৈ’,‘কলিকতালৈ’ ইত্যাদির বাংলা প্রতিরূপ নেই।সুতরাং সেসব স্পষ্টতই কারকের সমস্যা। তেমনি,বাংলাতে ‘গত,আগামী’ বিশেষণ পূর্বপদের দরকার পড়ে। অসমিয়াতে ‘লৈ’ পরসর্গ যোগ দিয়ে না দিয়েই ‘গত-আগামী’-র তফাত করা যায়।ফলে ‘কালি/কালিলৈ’-র মতো রূপভেদ বাংলাতে নেই।বাকি সমস্যা বাংলাতেও অসমিয়ার মতো একই,যা এই কটি রূপান্তর সূত্র সবটা ব্যাখ্যা করতে সমর্থ নয়।

            নির্মল দাশ প্রত্যক্ষ থেকে পরোক্ষে কথা পরিবর্তনের বেশ কিছু  সূত্রের উল্লেখ করেছেন।২৪১তার মধ্যে প্রথম দু’টি সেই উদ্ধৃতি চিহ্নের ব্যবহার এবং অব্যয় ‘যে’-র ব্যবহার সম্পর্কিত।বাকিগুলো এরকম,আমরা পারিভাষিক শব্দগুলো আমাদের মতো করে নিয়ে বাকি কথা তাঁরই রাখছিঃ

            প্রত্যক্ষ উক্তিতে যে পক্ষের ক্রিয়া থাকে,পরোক্ষ উক্তিতে তা উক্তিটির ভাব অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়।

            সাধারণত,বক্তা ও শ্রোতা পক্ষের স্থলে অন্য পক্ষ হয়। প্রয়োজনে ভাব-প্রকাশের জন্য অন্য শব্দ (দুঃখ,

               বিস্ময়, শ্রদ্ধা, অনুরোধ, প্রার্থণা ইত্যাদি) ব্যবহৃত হয়

ইংরেজিতে পরোক্ষ কথাতে প্রত্যক্ষ কথার প্রধান ক্রিয়াটির কাল অনুযায়ী পরিবর্তন ঘটে।বাংলায় তা সব

    সময় হয় না। তবে সাধারণ অতীত কালের স্থলে সম্পন্ন অতীত ব্যবহৃত হতে পারে।

প্রত্যক্ষ কথার সর্বনাম পরোক্ষ কথাতে ভাব-অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়।

প্রত্যক্ষ কথার সম্বোধন পদ  পরোক্ষ কথাতে কর্ম কারকে পরিবর্তিত হয়।

প্রত্যক্ষ কথার অনুজ্ঞাবাচক ক্রিয়া  পরোক্ষ কথাতে অসমাপিকা ক্রিয়ায় পরিণত হয়প্রত্যক্ষ কথার  

    বিস্ময়বোধক,প্রশ্নাত্মক বা প্রার্থনাসূচক হলে তা ভাবানুযায়ী নির্দেশাত্মক বাক্যে পরিণত হয়।

প্রত্যক্ষ কথার মূল ক্রিয়া সাধু বা চলিত ---যে ভাষায় থাকবে সম্পূর্ণ বাক্যটি সেই ভাষায় পরিবর্তিত হবে।

প্রত্যক্ষ কথার ---আজ,অদ্য,গতকাল,আগামীকাল,আসা,এখন,যেখানে ইত্যাদি শব্দ পরোক্ষ কথাতে 

    যথাক্রমে সেদিন,তখন,আগের দিন,পরদিন,সেখানে ইত্যাদি শব্দে পরিবর্তিত হয়।

পরোক্ষ থেকে প্রত্যক্ষে পরিবর্তন করবার বেলা,

বাক্যটির অর্থ ভালো করে বুঝে বক্তা ও শ্রোতাকে চিহ্নিত করতে হয়। যদি বক্তা ও শ্রোতার উল্লেখ না থাকে

    তবে লেখকের বক্তব্য হিসাবেই তা গ্রহণ করা উচিত।

১০বাক্যের যে অংশটুকু প্রত্যক্ষ কথাতে রূপান্তরিত হবে তার পূর্বে পাদচ্ছেদ (কমা) এবং উদ্ধৃতি চিহ্ন দিতে

      হয়।

১১ক্রিয়াপদকে কর্তার পক্ষ অনুযায়ী পরিবর্তিত করতে হয়।

১২প্রত্যক্ষ কথার অন্তর্গত পক্ষ হবে শ্রোতা এবং বক্তা পক্ষ।

 সূত্রগুলো বেশ বিস্তৃত এই নিয়ে কোনো সংশয় নেই। মোটের উপর সবগুলোই সঠিক।অসমিয়াতেও কথাগুলো মোটের উপরে একই।কিন্তু অসমিয়া কিংবা বাংলা ভাষার সবটাকে এই সব সূত্র ব্যাখ্যা করে না।৯ নং (নয়) সূত্রটিই নেয়া যাক,‘বক্তা শ্রোতা’র মাঝখানে ‘লেখক’ এসে বাক্যের সঙ্গতি নষ্ট করে।নিতান্ত প্রত্যক্ষ পরোক্ষ কথার কথা হচ্ছে বলে, ‘বক্তা-শ্রোতা’ এলো,নইলে ব্যারকণবিদের অবচেতনে এই ভাবটি স্পষ্ট যে তিনি লেখার  ভাষাকেই ব্যাখ্যা করছেন,মুখে বলবার ভাষা নয়।ফলে আমাদের মুখে ভাষাটি বলবার অভিজ্ঞতার সঙ্গে সূত্রগুলো কিন্তু অনেকটাই মেলেনা।দ্বিতীয়ত আমরা ১২ (বারো) নং সূত্রটিই নিই।একটি বাক্য নেয়া যাক এরকম:

. পরোক্ষ: তুমি আমাকে বলেছিলে যে ওর সঙ্গে তুমি আমার আলাপ করিয়ে দিচ্ছ(/দেবে),

                খুব ভালো ছাত্র।

    প্রত্যক্ষ: তুমি আমাকে বলেছিলে,“ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই/দিচ্ছি ও খুব ভালো ছাত্র।”

এখানে পরোক্ষ কথাকে প্রত্যক্ষে রূপান্তরিত করবার আগে আমরা ৯ (নয়) নং সূত্র ভালো করেই অনুসরণ করেছি।তারপরেও কিন্তু এটা স্পষ্ট হলো না,প্রত্যক্ষ কথা অংশে অন্যপক্ষের ‘ওর,ও’ না বসবে কেন? ১২ (বারো) নং সূত্র অনুযায়ী বসবার কথা নয়।একটি মাত্র ক্রিয়া ‘দিই’-র পক্ষরূপটি হচ্ছে ‘বক্তা’র।‘দিই’-র কালরূপ নিয়ে অবশ্য সমস্যা নেই।কাল যে সব সময় ইংরেজির মতো পাল্টায় না,সে কথা তিনি ৩ (তিন) নং সূত্রে উল্লেখ করেছেন।সুতরাং সেই সূত্র ‘দিই/দিচ্ছি’ এবং ‘দিচ্ছ/দেবে’-র সমস্যাকে ব্যাখ্যা করে।বক্তার ইচ্ছে অনুসারে বিকল্পে দুটোই হবে। তেমনি,৭ নং সূত্রটি পরীক্ষার খাতার বাইরে আর কোত্থাও সত্য নয়।ধরা যাক, ‘অ-১ এবং ২’ বাক্য দু’টি।আমরা নিয়েছিলাম বঙ্কিম এবং শরৎ চন্দ্রের থেকে।

.  বাং. হারাণী সেই কথাই বলে,“বৌদিদি যদি বারণ না করে, তবে পারি। তবে

               জানিব,এতে দোষ  নাই।” (বঙ্কিম চন্দ্র:ইন্দিরা)

           মা চমকিয়া ফিরিয়া চাহিয়া কহিল, রাঁধবোখন রে! হঠাৎ উপরে অঙ্গুলি নির্দেশ

               করিয়া ব্যগ্রস্বরে কহিল, দ্যাখ দ্যাখ বাবা,—বামুন-মা ওই রথে চড়ে সগ্যে

               যাচ্চে! (শরৎ চন্দ্র; অভাগীর স্বর্গ)

প্রথমটি পুরোটাই সাধু,দ্বিতীয়টিতে সাধু এবং দক্ষিণ পশ্চিম বাংলার ভাষাবৈচিত্র্যের মিশেল আছে।এই দুই বাক্য বা বাক্যগুচ্ছকে যদি আমাদের এখন মান বাংলাতে লেখা কোনো নিবন্ধে বা মান সহ অন্য যেকোনো ভাষাবৈচিত্র্যে বক্তৃতায় সরল পরোক্ষ গদ্যে লিখে স্পষ্ট করতে হয়,সাধু ভাষাতে রূপান্তর করাটা কি সঙ্গত এবং সমীচীন হবে? প্রশ্নটি তুলা থাকল। 

 ‘পুরুষ’ তথা পক্ষ পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিশ্চয়,কিন্তু সেই পুরুষ নিয়ে এখানে শুধু ক্রিয়াতেই নয়,কর্তা কর্মেও সমস্যা হচ্ছেতাহলে কারকেরও রূপভেদ হয়,ক্রমও পাল্টায়।অসমিয়াতে,সিলেটি সহ পূর্ববাংলার ভাষাবৈচিত্র্যগুলোতে  সর্বনামের লিঙ্গভেদও মনে রাখতে হয়।বক্তারও,শ্রোতারও;এবং প্রত্যক্ষ কথাতে যদি তৃতীয় ব্যক্তি কেউ রয়েছে,তবে তারও।ক্রিয়ার কাল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।ইংরেজি ব্যাকরণ সেসব বিস্তৃত ব্যাখ্যা করে। সেরকম কিছু গোলকচন্দ্র গোস্বামী  করেন নি,নির্মল দাশ অল্প ছুঁয়ে গেছেনআমরাও সেটি করতে পারতাম,কিন্তু যেহেতু অধ্যয়নটি তুলনা করবার,এই অব্দি এসে  আমাদের মনে হয় নি তাতে দুই ভাষা এবং ভাষাবৈচিত্র্যগুলোর স্বতন্ত্র কোনো স্বভাব আমাদের কাছে ধরা দেবে।অধ্যয়নটি এমনই বিস্তৃত হবে যে সঠিক কারণেই নির্মল দাশ একে স্বতন্ত্র অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন,ইংরেজি ব্যাকরণেও তাই করা হয়।শুধু যে বিষয়টি আমরা ধারণা স্পষ্ট করবার জন্যে উল্লেখ করে রাখতে চাই,সেরকম অধ্যয়নে ইংরেজি ভাষা অধ্যয়নের রূপকল্পকে অন্তর্ঘাত করবার সম্ভাবনাই বেশি।সমগ্র  প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ উপস্থাপনাতে,শুধু কথা বা ‘উক্তি’-তে নয়,নাম এবং ক্রিয়াপদের বিন্যাস এবং রূপের পরিবর্তন হয়ে থাকে।রূপের পরিবর্তন বলতে আমরা লিঙ্গ,বচন,কারক,ভাব,কাল,পুরুষ---এই সবক’টি ব্যাকরণিক সংবর্গের কথাই বোঝাচ্ছি।এই সব কিছুকে ধরে ক্রমান্বয়ে এগোলে ‘কথা উপস্থাপন’ প্রসঙ্গটি অধ্যয়নের একটি চিত্তাকর্ষক বিষয় হতে পারেএবং বাংলা-অসমিয়া দুই ভাষাতেই শৈলীবিজ্ঞানের বিকাশে এ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।অবশ্য স্বতন্ত্র ভাবে যদি সেসব কেউ করেছেন,আমাদের জানা নেই।পরম্পরাগত ব্যাকরণে নেই, আমরা খানিক  জোরের সঙ্গেই এখন লিখতে পারি। 

গোলোকচন্দ্র গোস্বামী প্রাচীন অসমিয়া কিছু নজির দিয়ে দেখিয়েছেন সেখানে ঊর্ধ্বকমার ব্যবহার হতো না। তার থেকে দুটি নজির আমরা নিচ্ছি এরকম:

            .অস.            মাৱৰ বচন                        শুনি পাশ চাপি

                                    হাসিয়া বোলে কানাই।

                        কেনেকুৱা গোটে                কান খাই ফুরে

                                    চিনোৱা হাৰলী আই।। (শ্রীধৰ কন্দলিঃ কাণখোৱা)

                     আৰু কমতেশ্বৰে বোলে পুৰোহিতৰ বেটাও নষ্ট গৈল, আমাৰো ভার্যা কলঙ্কী হৈ ৰহিল।

                                                                        (অসম বুরঞ্জী)

‘আমাৰো ভার্যা’ আসন্ন সঙ্গটি লক্ষ করবার মতো।আমার একবচনেই ব্যবহৃত হচ্ছে বলে মনে হয়।কিন্তু এই যে উদ্ধৃতি চিহ্নের ব্যবহার না করা,কমারও ব্যবহার না করা---এই রীতি ছাপাযুগের আগে বাংলাভাষাতেও স্বাভাবিক রীতি। প্রথম চরণে দাড়ি এবং দ্বিতীয় চরণে দুই দাড়ির (,।।) বাইরে বাকি যতি চিহ্নগুলোতো আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলো  নিয়েছে ইংরেজির থেকে। বাংলা অসমিয়া দুই ভাষারই আদি গ্রন্থ চর্যাগীতিতে আছে:

                . হরিণী বোলই সূণ হরিণা তো

                       এ বণ ছাড়ী হোহু ভান্তো ধ্রু॥ (চর্যাঃ৬)

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে আছেঃ

                    আসিআঁ নারদ তবেঁ সত্বরে আপণে।

সকল কহিল তত্ব বসুদেব থানে॥

এবে দৈবকীঞঁ যত গর্ব্ভ ধরিব।

পাপ দুঠ্ঠ কংসে তাক সবই মারিব

আষ্টম গর্ব্ভ হৈব দেব নারায়ণে।

সেই উপদেশে দিব তোহ্মাক তখণে॥

সেই উপদেশে হয়িব সকল রক্ষণে।

গাইল বড়ু চণ্ডীদাস বাসলীগণে ৪ (জন্মখণ্ড)

            ভারত চন্দ্রের আঠারো শতকের কাব্য ‘অন্নদা মঙ্গলে’ আছে:

                     হীরা বলে সে সকল কব রে বাছনি।

পরিচয় দেহ আগে কে বট আপনি।।

বিষয় আশয় বুঝি রাজপুত্র হবে।

আমার মাথার কিরা চারুরী না কবে।।

রায় বলে চাতুরী কহিলে কিবা হবে।

ব্যক্ত হবে আগে পাছে ছাপা ত না রবে।। (বিদ্যাসুন্দরঃ মানিনী সহ সুন্দরের কথোপকথন)

         একেবারেই একালে সংকলিত আসাম –ত্রিপুরাতে প্রচলিত পদ্মাপুরাণে দ্বিজবংশী দাসের পদে আছে:

                                 রাজা বলে এক বস্তু খাইয়াছি ভালো তার ঘ্রাণ।

                                    পথে আসিতে পাসরিয়াছি নাম।।

                                    তোমারে আনিয়া দিব কল্য যদি পাই।

এমন অপূর্ব ফল দিয়াছেন গোঁসাই।।

‘সুরমা গাঙর পানি’ উপন্যাসে রণবীর পুরকায়স্থ এমন বহু সংলাপে, ব্যাকরণের রীতি অনুসরণ করেন নি।

                        .সিল.প্রত্যক্ষ:     হজরত মহম্মদে কইলা কও কী রঙর কাপড় লাগব

                               পরোক্ষ: আমি এক সবুজ তফন পিন্দিছিলাম,আপনার বাড়ির হক্কলে কইলা আমি বাঙ্গাল হই

                                              গেছি।                                               

                                         ফটো তুলি নিছলা নীতিশদায়, দিতা পারছইন না, ফটো ছাপার মেশিনে বুলে

                                             কাম করের নাদিবা কইছইন পরে

                                        ইতা আমিও হুনছি মাইনষে রটাইছে,হে বুলে তুমার রিক্সা জ্বালাইছে

            ‘এ.সিল.প্রত্যক্ষ’ উপস্থাপনে ‘কইলা’র পরে কমা,ঊর্ধ্বকমা কিছু নেই।‘এ.সিল.পরোক্ষঃ১’ উপস্থাপনে ‘কইলা’র পরে ‘যে/বুলে’ কিছু নেই।‘এ.সিল.পরোক্ষঃ২’ উপস্থাপনে ‘কথা’ অংশকে দুই বাক্যে ভেঙে দেয়া হয়েছে।‘বুলে’এবং ‘কইছইন’ সেই ‘কথা’র পরোক্ষ উপস্থাপনার মাঝে বসে মিশে গেছে।‘‘এ.সি.পরোক্ষ:৩’-এও ‘বুলে’ তাই হয়েছে।এবং ‘কইছে’র বদলে বসেছে ‘রটাইছে’

রবীন্দ্র কুমার দত্ত যখন তাঁর ‘নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের উপভাষা’ বইয়ের শেষে ‘এক বোকা জামাতার গল্প’ মান বাংলাতে তুলে দিচ্ছেন,তখন একটি ড্যাসের পরে যে প্রত্যক্ষ কথাগুলো বসিয়েছেন ঊর্ধ্বকমার ভেতরেইকিন্তু সেগুলোই যখন নোয়াখালি-চট্টগ্রামীতে উপস্থিত করছেন,কিছুটা যেন শিথিল নিয়মে।দু’টির বদলে একটি করে ঊর্ধ্বকমা ব্যবহার করছেন।আমরা তাঁর উচ্চারণ অনুসারী ধ্বনিচিহ্ন ছেড়ে নিজেদের মতো করেই এই অধ্যায়ে আগেও উপস্থিত করেছি। এখানেও করছি।

এ.নোয়া.প্রত্যক্ষ: দাবাতে জাওনের̖ শোমে হোতার মা হ্যেতারে কইলো---‘ওরে হুত̖, এগ̖গা হইশা নে।

       হইশা ইঁয়ান̖ দি হঁথের̖ মইদদে কিছু কিনি খাইছ̖ আর হোর বাড়িত̖ জাই বেউগ̖গুনের̖                                                    

       উয়রে বই মিডা মুয়ে কুকিলর̖ শরে কতা কইছ̖

এ. চট্ট.প্রত্যক্ষ:  নিয়নত্রনে জওনের শমত ইতার মা ইতারে কইলজে, ‘ও ফুত, ওগগোয়া ফইশা নে।

                               ফইশাউয়া দিয়ারে ফঁথর̖ মইদ̖দে কিছু কিনিইয়ারে খাইছ, আর হউর̖ বারিত̖ জাইয়ারে 

                                বেয়াগ̖গুনর̖ বইয়ারে মিডা মুয়ে কুঁইল̖র শরে কথা কইছ̖  

বাচ্য অনুসারে  বাক্যের গঠনভেদঃ 

বাচ্য বা voice বিষয়টি রূপতত্ত্ব না বাক্যতত্ত্বের বিষয় ইংরেজি পরম্পরাগত ব্যাকরণে তা ব্যাখ্যা করে না। স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু যে সংজ্ঞাটি দেয়া হয় তাতে একে রূপতত্ত্ব তথা ক্রিয়ার বিষয় হিসেবেই মনে হয়।“Voice is the form of the verb which show whether the Subjects acts or acted upon.”২৪২ এবারে দুটি নজির নেয়া যাক।

                        অ। Aactive: He said this

                            Passive: This was said by him.

ক্রিয়ার রূপ পাল্টালো বটে।কিন্তু কর্তা কর্মের ক্রম এবং গঠন দুইই পাল্টালো। সেসব কীভাবে পাল্টাবে তার বিস্তৃত ব্যাখ্যা করে ইংরেজি ব্যাকরণ,কিন্তু সংজ্ঞাতে কথাটি স্বীকার করে না।সংজ্ঞাতে শুধু বলে এ হচ্ছে ‘the form of the verb’ অর্থাৎ ক্রিয়ার রূপ।সম্ভবত তাই পরম্পরাগত বাংলা ব্যাকরণে এবং ভাষাবিদ্যায় একে ক্রিয়াপদের সঙ্গেই আলোচনা করা হয়েছে।সুকুমার সেন তাই করেছেন।২৪৩ নির্মল দাশও তাই করেছেন।২৪৪অথচ আমরা দেখব ক্রিয়ার রূপপরিবর্তনে এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে না বাচ্য। যেটুকু হয় সেটুকু শব্দনির্মাণ তত্ত্ব তথা পরম্পরাগত ব্যাকরণে যাকে ‘পদ পরিবর্তন’ বলে তাই দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায়।আমরা রূপতত্ত্বে সেটি করিনি।অর্থাৎ শব্দনির্মাণ বিষয়টি পরিসরের জন্যে এড়িয়ে কেবলই ‘পদনির্মাণ’ বিষয়টিই আলোচনা করে এসেছি।কিন্তু করলে দেখা যাবে ক্রিয়াপদটি নামপদে পরিণত হচ্ছে।বাকি যেটুকু থাকছে সেটুকু সেরকমই থাকে যেরকম পদনির্মাণ প্রসঙ্গে ‘কাল-পক্ষ-ভাব’ ক্রমে  আলোচনা করে এসেছি। যেমন এই নজিরটিই নেয়া যাক:

                        আ। কর্তৃবাচ্য: আমি আজ যাব না।

                             ভাববাচ্য: আমার আজ যাওয়া হবে না।

‘যাওয়া’ প্রেক্ষিত বিচ্ছিন্ন করে দিলে বিশেষ্য।এখানে ‘হবে’-র আগে জুড়েছে বলে ‘বিশেষণ’তার বদলে ‘খাওয়া’,‘খেলা’,‘দেখা’,‘লেখা’,‘গাওয়া’ যে কোনো পদই বসতে পারতো ‘হবে’-কে বিশেষায়িত করবার জন্যে।আর ‘হবে’ সাধারণ ভবিষ্যতের রূপ।অর্থাৎ রূপিমের দিক থেকে বড় সড় পরিবর্তন বিশেষ নেই।কিন্তু এক শব্দকে আর শব্দ কিংবা শব্দজোড়ে প্রতিস্থাপিত করছে,তাতে ক্রিয়ার অর্থ যেমন পাল্টাচ্ছে বাক্যের গঠনও পাল্টাচ্ছে।এবং সেটি শুধু ক্রিয়াতেই নয়,কর্তাতেও হচ্ছে।আমি > আমার-- হচ্ছে।অর্থাৎ এখানেও সেই ‘কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া’-র সূত্র ফল্গুধারার মতো সজীব এবং সক্রিয়।উদ্দেশ্য-বিধেয় তত্ত্ব এখানে এসে সম্ভবত ইংরেজি ব্যাকরণেও ভেঙে পড়ে।শুধু ক্রিয়া নয়,আমরা দেখব--মূল কথাটা হচ্ছে জোরটা বাক্যের কোন পদে কীভাবে পড়ছে।কিন্তু সেই জোর শ্বাসাঘাত থেকে ভিন্ন,কেননা এখানে পদের গঠন এবং কখনো বিন্যাস পরিবর্তিত হচ্ছে।ফলে অসমিয়াতে বহু আগে সত্যনাথ বরা২৪৫ এবং পরে গোলোকচন্দ্র গোস্বামী সঠিক ভাবেই একে রেখেছেন ‘বাক্য প্রকরণে’২৪৬ঢাকা থেকে সম্প্রতি ২০১১-তে প্রকাশিত  রফিকুল ইসলাম এবং পবিত্র সরকার সম্পাদিত ‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ সংকলনের সূচীপত্র আমাদের দেখবার সুবিধে হয়েছে আন্তর্জালে। সেখানেও বাচ্যকে রাখা হয়েছে ‘বাক্যতত্ত্ব’-এই।২৪৭ কিন্তু আরো সঠিক হবে,যদি বলা হয়--- কারকের মতোই বাচ্য রূপতত্ত্ব এবং বাক্যতত্ত্ব দুয়েরই যৌথ বিষয়।

বাচ্য চাররকমের,লিখেছেন নির্মল দাশ:২৪৮১) কর্তৃবাচ্য (Active Vocice),২) কর্মবাচ্য (Passive Voice), ৩) ভাববাচ্য (Impersonal Voice), ৪) কর্মকর্তৃবাচ্য (Reflexive Passive Voice)

১) কর্তৃবাচ্য: “বাক্য বিন্যাসে যখন কর্তৃপদ প্রাধান্য লাভ করে তখন তাকে কর্তৃবাচ্য বলে।” এইভাবে লিখেছেন নির্মল দাশ।২৪৯ আরো লিখেছেন,“কর্তৃবাচ্যে ক্রিয়া কর্তার অনুগামী।কর্তৃবাচ্যে কর্তা নিজে প্রত্যক্ষ ভাবে কাজ করে।”২৫০ অর্থাত এই অব্দি যত বাক্যের গঠন নিয়ে আলোচনা করে এসেছি প্রায় তার সবক’টিই এই কর্তৃবাচ্যের বাক্য।তাঁর অনেক নজিরের একটি এই:

                         ই। ১ রাম স্কুলে যায়।

কিন্তু এহেন বাক্যকে কেন এই তালিকাতে রাখলেন, আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।

                            আমাকে শিলং যেতেই হবে।

২) কর্মবাচ্য:যে বাক্যে কর্মই প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয় এবং কর্মের পুরুষ অনুসারে ক্রিয়ার পুরুষ হয় তাকে কর্মবাচ্য বলে” লিখেছেন,নির্মল দাশ।২৫১আরো লিখেছেন,“বিধেয় ক্রিয়ার কর্মপদ এখানে বাক্যের উদ্দেশ্য এবং ক্রিয়া সেই উদ্দেশ্যের কর্মের অনুগামী হয়।”২৫২ যে নজিরগুলো তিনি দিয়েছেন তার দুই একটি এরকম:

                        পুলিশ কর্তৃক চোর ধৃত হয়েছে।

                              বইটি আমার দ্বারা পঠিত হয়েছে

৩) ভাববাচ্য: নির্মল দাশ লিখছেন,“যে বাচ্যে ভাব অর্থাৎ ক্রিয়ার ভূমিকা প্রধান তাকে ভাববাচ্য বলে।ভাববাচ্যে ক্রিয়ার কোনো কর্ম থাকে না,কর্তা ক্রিয়ার সঙ্গে অন্বিত হয় না বা সম্পর্কিত থাকে না। ভাববাচ্যে ক্রিয়াপদ প্রথম পুরুষে হয়ে থাকে২৫৩ তাঁর দুই একটি নজির এরকম:

                        মহাশয়ের কোথায় থাকা হয়?

                            তোমার আজ কলকাতা যাওয়া হবে না।

                            তোমায় দুটি ভাত খেতে হবে।

৪) কর্মকর্তৃবাচ্য: এর সংজ্ঞা নির্মল দাশ লিখছেন এরকম,“যে বাক্যে কর্মই কর্তার কাজ করে বলে মনে হয় তাকে কর্মকর্তৃবাচ্য বলে।”২৫৪তিনি আরো লিখছেন,“কর্মই কর্তৃপদের মতো কাজ করে।”যেমন—

                         শঙ্খ বাজে।

                              স্কুলের গেট খুলল।

আপাত দৃষ্টিতে এসবে কোনো সমস্যা আছে বলে মনে হয় না।শুধু ‘ই-২’ বাক্যটিকে ‘উ-৪’ বলে ভাববাচ্যের নজিরে বসালেই ভালো মানাতে বলে মনে হয়।তার উপরে ‘শিলং,কোথায়,কলকাতা,ভাত’ ইত্যাদি শব্দের পরে ভাববাচ্যে ‘কর্ম’ নেই বলে মানতে কষ্ট হয়।আর কর্তৃবাচ্যে ‘ঈ-১,২’ এর মতো বাক্য মান বাংলাতে কেউ বলে না, লেখেও না।এসব বাংলা বাক্য ব্যাকরণেই মেলে।অথবা সাধু বাংলার বাক্য।লোকের ব্যবহারের বাক্য হয় এরকম:

                        ঋ।১পুলিশের হাতে চোর ধরা পড়েছে।

                            বইটা আমার পড়া হয়েছে।

কিন্তু আরো কিছু প্রশ্ন আপনি দেখা দেয় যখন অসমিয়াতে বাচ্য সম্পর্কে গোলোকচন্দ্র গোস্বামীর কথাগুলো দেখিতিনি অসমিয়াতেও চারটি বাচ্যের কথাই লিখছেন,কিন্তু শেষ নামদুটো আলাদা২৫৫ -১) কর্তৃবাচ্য,২) কর্মবাচ্য,৩) কর্তৃ-ভাববাচ্যে,এবং ৪)কর্ম-ভাববাচ্য। শেষ দুটিকে ভাববাচ্যেরই প্রকারভেদ বলে উল্লেখ করছেন পরে,যখন সেগুলোর ব্যাখ্যা করতে যাচ্ছেন।২৫৬

১) কর্তৃবাচ্য: সংজ্ঞাটি বাংলাতে যা নির্মল দাশ লিখেছেন সেরকমই। গোলোকচন্দ্র লিখছেন,“যি বাক্যত কর্তা প্রধান,ইয়ার ওপরতে গুরুত্ব প্রকাশ পায়,সেই বাক্যক কর্তৃবাচ্যর বাক্য বোলে।কর্তৃবাচ্যর বাক্যত কর্তাপদর লগত ক্রিয়া পদর সঙ্গতি থাকে;অর্থাৎ কর্তার পুরুষ অনুসরি ক্রিয়া পদত পুরুষর বিভক্তি যুক্ত হয়।”২৫৭এই অব্দি কোনো সমস্যা নেই। তিনি যে নজির গুলো দিচ্ছেন তাতেও দুই একটিতে  বাংলার কর্তৃবাচ্যের সঙ্গে তফাত বিশেষ নেই।এই অব্দি আমরা যে কটি অসমিয়া বাক্য লিখে এসেছি তার প্রায় সব কটাই কর্তৃবাচ্যের বাক্য। যেমন:

এ.১পুলিচে চোৰটোক বৰকৈ পিটিলে।

   আমি ভাত খালোঁ।

   পাদ্রীসকলে অসমীয়া ভাষা চলাবলৈ বৰ যত্ন কৰিছিল। (গুণাভিরাম বরুয়া)

সমস্যার শুরু হয় তখন যখন এই বাক্যকেও এই তালিকাতে বসান এই বাক্যটি২৫৮ ---

                            তেতিয়াও অসম দেশত স্কুল আৰু কাছাৰীত বঙ্গলা ভাষা চলিছিল। (গুণাভিরাম বরুয়া)

স্পষ্টই মনে হয় যেন ‘বৃতিছ কর্তৃপক্ষৰ দ্বাৰা’ এরকম কোনো পদগুচ্ছের উল্লেখ নেই,তবু বাক্যটি কর্মবাচ্যেরই। অথবা অথবা ‘জ্বৰ উঠিছে’,‘পানী লাগিব’র মতো এই বাক্যও আসলে কর্তৃ-ভাববাচ্য বা ভাববাচ্যের বাক্য।বিষয়টি ক্রমে স্পষ্ট হবে

২) কর্মবাচ্য: এখানেও বাংলা সংজ্ঞার সঙ্গে তফাৎ বিশেষ নেই। গোলোকচন্দ্র লিখছেন,“কিছুমানত বাক্যত কর্তার ভূমিকা দেখা নাযায়;কর্মর ওপরতে প্রাধান্য প্রকাশ পায়। তেনে বাক্যক কর্মবাচ্যর বাক্য বোলে।সকর্মক ক্রিয়াপদ যুক্ত বাক্যরহে কর্মবাচ্য হ’ব পারে।কর্তাপদর অভাব হেতুকে কর্মপদর লগত ক্রিয়াপদর সঙ্গতি স্থাপিত হয়।এনে বাক্যর ক্রিয়া সদায় নামপুরুষর বিভক্তিযুক্ত হয়।”২৫৯ যে উদাহরণগুলো দিচ্ছেন,তার সঙ্গে বাংলা নজিরগুলো মেলে না:

                          ঐ.১ইয়াৰ পৰা হিমালয় পর্বত ৰিণিকি ৰিণিকিহে দেখি।

                             নিস্তব্ধ হ’লেহে কথাবোৰ ভালদৰে শুনি।

                             অঙ্কটো সহজে কৰিব পাৰি।

‘নামপুরুষ’ মানে আমরা যাকে বলছিলাম ‘অন্যপক্ষ’শুধু নির্মল দাশ এই কথাটি লিখেছেন ভাববাচ্যের প্রসঙ্গে যে,ক্রিয়াপদ প্রথম পুরুষে হয়ে থাকেএই সূত্রটি ইঙ্গিত দিচ্ছে,নির্মল দাশ এবং গোলোক চন্দ্রের ‘কর্মবাচ্য’ আসলে এক নয়।তার উপরে,পঞ্চম অধ্যায়ে আমরা দেখিয়ে এসেছি সাধারণ বর্তমানে অন্যপক্ষে বাংলা-অসমিয়া-সিলেটি পরসর্গ একই     ‘-য়’এখানে দেখা যাছে ধাতুর পরে ‘-ই’ যুক্ত হচ্ছে।এর একটি ব্যাখ্যা গোলোকচন্দ্র দিচ্ছেন এইভাবে,“অসমীয়া ভাষাত দুই প্রকারে কর্মবাচ্য প্রকাশ হয়।এক প্রকারে,ক) কর্মবাচ্যর বিভক্তির যোগত;আরু অন্য প্রকারে খ) যৌগিক ক্রিয়াপদর যোগত।”২৬০ ‘-ই’ হচ্ছে সেই কর্মবাচ্যের পরসর্গ।‘দেখি,শুনি,পাৰি’ মানে হচ্ছে => ‘দেখা যায়,শুনা যায়,পৰা যায়’

বিষয়টি বেশ জটিল।সুনীতি চট্টোপাধ্যায় ওডিবিএল-এর ৬৫৫ নং ছেদে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।আমরা সেসব জটিলতাতে না গিয়ে একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করছি।এই ক্রিয়াপদগুলো দেখতে শুনতে বাংলা সাধারণ বর্তমানে বক্তাপক্ষের ক্রিয়াপদের মতো।‘আমি দেখি,আমি শুনি,আমি পারি’-তে যেমনচর্যাতে অন্যান্য পরসর্গাদিও ছিল,কিন্তু সরাসরি এই ‘-ই’ পরসর্গটি অন্যপক্ষেও ব্যবহৃত হতো। যেমন:

          ও.১  তিণ ন ছুবই হরিণা পিবই ন পাণী

                   হরিণা হরিণির নিলঅ ণ জাণী ধ্রু॥ (চর্যাঃ৬)

            এই স্তবকে ‘জাণী’ অন্যপক্ষের ক্রিয়াপদ,অর্থ ‘জানে’অন্যদিকে ‘ছুবই’,‘পিবই’--- এগুলোও তাই।একই পদে যখন এই কথাগুলো পড়ছি,তখন প্রায় একই রূপের ‘দীসই’,‘পইসই’ ক্রিয়াপদগুলো এই ‘কর্মবাচ্যে’র পদ হয়ে যাচ্ছে। অর্থ ‘দেখা যায়’,‘প্রবেশ করে’‘ভণই’ হচ্ছে-- ‘বলে’

     তরঙ্গতেঁ হরিণার খুর ন দীসই

          ভুসূকু ভণই মূঢ়া-হিঅহি ণ পইসই (চর্যাঃ৬)

            কিন্তু কোথাও বা ‘-এ’-র বদলে ‘-অ’ জুড়ছে।এই পাঠ অধ্যাপক মৃণাল নাথের।২৬১

                                        খেপহুঁ জোইনি লেপন জাঅ

         মণিমূলে বহিআ ওড়িআণে সমাঅ।। (চর্যা:৪)

            সুকুমার সেন প্রথম চরণের একটি ভিন্ন পাঠের উল্লেখ করেছেন,যেখানে পরসর্গ ‘-এ’ জুড়ছে-- ‘খেপহুঁ জোইনি লেপন যায়।’২৬২একই পাঠ অতীন্দ্র মজুমদারও উল্লেখ করেছেন--- ‘খেপহুঁ জোইনি লেপন জায়।’২৬৩ কিন্তু দ্বিতীয় চরণে তিনি মৃণাল নাথের মতো এক রেখেছেন।তাতে শেষ শব্দ ‘সমাঅ’ প্রথম চরণের ‘জায়’-এর সঙ্গে ছন্দে এবং অনুপ্রাসে মেলে নাসুতরাং পাঠটি নিয়ে সংশয়ের জায়গা থেকেই যায়।কিন্তু  শ্রীকৃষ্ণকীর্তন অব্দি আসতে আসতে এই ক্রিয়াপদের পরিবর্তন হচ্ছে এরকম--- দেখা যাবে ‘-ই’ এবং ‘-এ’ পরসর্গদুটিই একত্রে এসে জুড়ছে,অথবা ‘-ই’ সরে যাচ্ছে:

                                       এ বোল সুণিআ     নাগরী রাধা

 হাণএ সকল গাএ

      যত নানা ফুল     পান করপুর

             সব পেলাইল পাএ

    উঠিআ বড়ায়ি   রাধাক বুইল

            হেন কাম না করিএ

    নান্দের নন্দন        ভুবন বন্দন

            তোর দরশনে জীএ (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন; তাম্বুলখণ্ড)

হাণএ=> হানে,জীএ=> জিয়ে,কিন্তু করিএ=> ‘করো না’ অথবা ‘করে না’?সংশয় এখানেই।‘করো না’ অর্থ করলে যেটি কর্তৃবাচ্য,‘করে না’ অর্থ করলেই সেটি ‘কর্মবাচ্য’ হয়ে যাচ্ছে।অন্যপক্ষে ‘-ই’-এর ‘-এ’তে এই যে ক্রমাবসরণ এটা এর পরে বাংলার ইতিহাস জুড়ে হচ্ছেএই তিন ভণিতা দেখা যাক:

                                     ভুসূকু ভণই মূঢ়া-হিঅহি ণ পইসই (চর্যাঃ৬)

                                     ভনয়ে বিদ্যাপতি শন বরনারী(বিদ্যাপতির ব্রজবুলি পদ)

                                      ভারত জানয়ে প্রেম এমনি জঞ্জাল(ভারত চন্দ্র:বিদ্যাসুন্দর)

            আমাদের বলবার কথা এই নয় যে এই দুই একটি পরসর্গ নিয়েই পক্ষ বোঝাবার পরিঘটনাটি বাংলা অসমিয়া ভাষাতে কালান্তরে হয়ে এসেছে।পরসর্গ অনেকগুলোই ছিল,এবং কালান্তরে যে সেগুলোর কাল কিংবা পক্ষ স্থির থাকত না,এতে যেমন দেখানো গেল,তেমনি আপাতত যে দুই পরসর্গ ‘-ই’ এবং ‘-এ’ নিয়ে আমাদের সমস্যা হচ্ছিল সে দুটি যে আকস্মিক নয় উত্তরাধিকার সূত্রেই অর্বাচীন কালের ভাষাতে এসেছে,দেখানো গেল।অসমিয়াতে ‘-ই’-টি যদি কর্মবাচ্যের পরসর্গ হয় তবে সেই চর্যার বা প্রত্ন-অসমিয়া-বাংলার উত্তরাধিকারকে রক্ষা করেছে,যেখানে এটি অন্যপক্ষেই ব্যবহৃত হতএই রীতিটি অসমিয়াকে আধুনিক মান বাংলা এবং সিলেটি সহ বাংলার অন্যান্য ভাষাবৈচিত্র্যের থেকে আলাদা করেছেঅসমিয়া যেখানে ‘-ই’ এবং ‘-এ’ দুটোরই উত্তরাধিকার রক্ষা করেছে,মান বাংলা এবং সিলেটি করেছে শুধু একটির ‘-এ’ যদিও এই তর্কটিও আমাদের তুলতে হবে,একে ‘ভাববাচ্য’ বলা হবে না ‘কর্মবাচ্য’কিন্তু উপরের ‘ঐ-১,২,৩’ বাক্য তিনটি কি বাংলাতে একেবারেই অচেনা?এগুলোকে বাংলাতে ‘ভাবানুবাদ’ করলে দাঁড়ায় এরকম:

                          ঔ.১এখান থেকে  হিমালয় পর্বত আমরা রোজ রূপোলি রেখার মতো দেখি।

                              সবাই ঘুমিয়ে গেলে,চারদিক নিস্তব্ধ হলে তবে ওবাড়ির কথাগুলো ভালোকরে শুনি।                                          এভাবে আমরা  অঙ্কটা  সহজেই করতে  পারি

আরো দুই একটি জুড়ে দেয়া যাক:

                              এখান থেকে সকালে বাসে চাপলে বিকেলে গিয়ে পৌঁছুতে পারি।

                              আজ বিমানে চড়ে আমরা পাখির মতো আকাশে উড়ে বেড়াতে পারি।

বাংলাতে এভাবে বক্তাপক্ষের ক্রিয়ারূপ ব্যবহার করে কর্তাকে নৈর্ব্যক্তিক করে দিয়ে বাক্য গঠনের রীতি কিন্তু রয়েছে।‘আমরা’টি আসলে যে কেউ,অর্থের বিস্তার ঘটিয়ে সে অন্যপক্ষকেও নিজের ভেতরে নিয়ে নেয়।এরই বিকল্পে অন্যপক্ষের ক্রিয়ারূপ দিয়ে সবক’টা বাক্যকেই এভাবে পুনর্নির্মাণ করা যায়,আমরা ‘ঔ-৬’ করে দেখাচ্ছি:

                              আজ বিমানে চড়ে  পাখির মতো আকাশে উড়ে বেড়ানো যায়।

এই বাক্যগুলোর বাচ্য কী হবে?‘ভাষাবীথি’-তে তার স্পষ্ট কোনো জবাব নেই। গোলোকচন্দ্রের অসমীয়া বাক্যের নির্দেশিকা মানলে প্রতিতুলনাতে এই বাংলা বাক্যগুলোকেও ‘কর্মবাচ্য’-এর বাক্য বলে মনে হয়।আবার ইংরেজি ব্যাকরণের ‘by’-র অনুসরণে নির্মল দাশ যেভাবে বাংলা বাক্যে ‘দ্বারা/কর্তৃক’ অব্যয় সহ কর্তাকে স্থানান্তরিত করে বা রূপান্তরিত করে ‘কর্মবাচ্য'-এর সংজ্ঞা দিলেন,তাতে এগুলোকে ‘কর্মবাচ্য’ বলবারও সমস্যা আছে।তাই,তার আগে আরো কিছু সমস্যা আমাদের দুই ভাষার জন্যেই সমাধান করে এগোতে হচ্ছে

           এই ‘-ই’ পরসর্গ যোগে আগে যে ক’টি অসমিয়া ধাতুর কথা উল্লেখ করা হলো সেরকম গুটি কয়েকেই ব্যবহৃত হয়অন্যত্র ‘যৌগিক ক্রিয়া’ যোগেই কর্মবাচ্যের বাক্য তৈরি হয় বলে গোলোকচন্দ্র গোস্বামী লিখেছেন।২৬৪তিনি যে উদাহরণগুলো দিয়েছেন,সেগুলো এরকম:

                                    ক.১চোৰটোক বৰ শাস্তি দিয়া হ’ল।

                                       আই-এছ-আই-ৰ এজেন্ট দুজন ধৰা পৰিছে।

                                       ইয়াৰ পৰা হিমালয় পর্বত দেখা যায়।

                                       তোমাৰ গীত কেতিয়াবা ৰেডিঅ’ত শুনিবলৈ পোৱা যায়। 

            ‘ক.১,২’-তে অনুমান করতে পারি ‘পুলিছৰ দ্বাৰা’ কথাটি উল্লেখ করা হয় নি।কিন্তু ‘ঋ.১,২’ বাক্যকে যদি এভাবে অনুবাদ করি,তবে প্রশ্নতো দেখা দেয়ই অসমিয়াতে কি কর্তার উল্লেখ সহ এহেন বাক্য সত্যি বিরল?

খ।১পুলিছৰ হাতত চোৰ  ধৰা  পৰিল।

                           কিতাপখন মোৰ পঢ়া হৈছে।

            ‘ঔ.১ থেকে ৭’ বাক্যগুলো নিয়ে যেভাবে নির্মল দাশ নীরব,‘খ.১,২’ নিয়ে গোলকচন্দ্র গোস্বামী নীরবতার উপর ‘ক.৩,৪’-এ সমস্যা সেই থেকেই গেল।শুধু ‘দেখি’,‘পাই’ ক্রিয়াপদগুলোর বদলে ‘যৌগিক’ তথা ‘বহুপদী’ ক্রিয়ার পূর্বাংশে একটি ‘-আ’ পরসর্গ জুড়ছে,বাংলার মতো।এবং বাংলার মতোই ‘যায়’ পরপদ জুড়ছেএ দু’টিকে বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়াবে এবারে এরকম:

                                    গ.১এখান থেকে হিমালয় পর্বত দেখা যায়।

                                       তোমার গান কখনো  রেডিওতে  শুনতে পাওয়া যায়/ শোনা যায়।

এগুলো কিন্তু কোনো বিশেষ ঘটনার কথা বলা হচ্ছে না।কর্মটির নিয়মিত সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে,একটা সাধারণীকরণ ঘটছেনিত্যক্রিয়ার প্রতিকল্পে এ যেন নিত্যকর্ম।হিমালয় যে কেউ দেখতে পারে,আর গীত যে কেউ শুনতে পারে,---‘মই, তুমি, হি বা তেখেত’-এ।‘ক.৪’-এর ঠিক পরের বাক্যটিতো এমন হতেই পারে:

                                     তেখেতে গীতবোৰ প্রায়েই শুনি মোকও শুনিবলৈ কয় ।  

            এর মীমাংসাটি আমরা স্থগিত রেখে বাচ্যের আরো দুই প্রকার ভেদ নিয়ে এগোনো যাক।

৩) কর্তৃ-ভাববাচ্য: গোলোকচন্দ্র গোস্বামী লিখছেন,“কপাল ফুল̖,জ্বৰ উঠ̖,জ্বৰ হ,পানী লাগ̖,আদি কেতবোৰ জতুৱা যৌগিক ধাতুর পরা কর্তৃ-ভাববাচ্যর বাক্য পোৱা যায়।”২৬৫  যেমন:

                                    ঙ.১বেপাৰীজনৰ কপাল ফুলিছে, টকাই টকা।  

                                      ল’ৰাটিৰ জ্বৰ উঠিছে।

                                      বৰষুণত নিতিতিবা, পাণী লাগিব।

একে ‘কর্তৃ-ভাববাচ্য’ বলবার কারণ তিনি ব্যাখ্যা করেছেন এই বলে,“ ...কপাল ফুলিছে বুলিলে যেন কপাল খনেই ফুলিছে, জ্বর উঠিছে বুলিলেও যেন জ্বর আহি গাত উঠিছেহি বা লম্ভিছেহি, মনলৈ হয়তো তেনে এটা ভাব আহে। এতেকে কপাল আৰু জ্বৰ পদক কর্তা যেন লাগিব খোজে।পিছে মনত রাখিবা,কপাল আরু জ্বর যৌগিক ক্রিয়াপদর লগর অংশহে;ইহঁতক কর্তা যেন লাগিব খোঁজে যদিও আচলতে কর্তা নহয়;সেই কারণেই এনে বাক্যক কর্তৃভাববাচ্যর বাক্য বোলা হয়।”২৬৬‘জতুৱা’ মানে হচ্ছে ‘বাগধারা’এগুলো এমন সব শব্দজোড় যার ভাষাবিশেষে নিজস্ব অর্থ আছে।কিন্তু বাংলা অসমিয়াতে এমন বহু ‘বাগধারা’ রয়েছে যার অর্থ দুই ভাষাতেই এক।‘জ্বর উঠেছে’,‘কপাল ফুলেছে’ কথাটির মান বাংলাতেও অর্থ একই।‘ঙ.১,২’-কে বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়াবে:

                                    চ.১দোকানিটির কপাল ফুলেছে, টাকাই টাকা।

                                       ছেলেটার জ্বর উঠেছে।

৪) কর্ম-ভাববাচ্য: গোলোকচন্দ্র গোস্বামী লিখছেন,“আমার ভাষাত আরু এবিধ যৌগিক ধাতু আছে;যেনে ৰ’দ দি,বৰষুণ দি।এই যৌগিক ধাতুদুটার দি সকর্মক ধাতু যদিও এই ধাতুরে রচিত বাক্যত কর্মপদ নাথাকে।”২৬৭ যেমন:

                                    ছ. ১আজি বৰ ৰ’দ দিছে।

                                        কালি বৰ বৰষুণ দিছিল।

            এর ব্যাখ্যা তিনি যেভাবে করেছেন,আমরা প্রায় পুরোটাই তুলে দিচ্ছি,“...যদি প্রশ্ন করা হয় ---ৰ’দ দিছে কোনে?বৰষুণ কোনে দিছে?—ইয়ার উত্তর পোৱা না যায়।তোমালোকে জানা,বেলি ওলালেহে ৰ’দ দিয়ে;সেই দৰে, মেঘর পরাহে বৰষুণ হয়।তথাপি,অসমীয়া মানুহে বেলিয়ে ৰ’দ দিছে,অথবা,মেঘে বৰষুণ দিছে বুলি নকয়।ৰ’দ আরু বৰষুণ কর্মপদ যেন লাগে,অথচ কর্ম নহয়।সেই কারণেই,ৰ’দ দি,বৰষুন দি আদি যৌগিক ধাতুর পরা পোয়া বাক্যবোৰক কর্ম-ভাববাচ্যর বাক্যবোলে।”২৬৮

                        এবারে আমাদের সমস্যা হলো,এই কর্ম-ভাববাচ্যকেই নির্মল দাশ বাংলাতে কর্তৃ-কর্মবাচ্য বলে লিখেছেন।এবং তিনি ‘কর্ম নেই’ কথাটি স্বীকার করেন নি,বরং ‘কর্ম’ই ‘কর্তা’র কাজ করে বলে লিখেছেন।লাঠি,শঙ্খ কর্ম।তারাই কর্তার মতো ভাঙছে,বাজছে।কোনোভাবেই ‘ঊ.১,২’ বাক্য গঠনের দিক থেকে অসমিয়া ‘ছ.১,২’-র থেকে ভিন্ন নয়।‘ঊ.১,২’-কে অসমিয়া অনুবাদ করলে দাঁড়াবে:

জ.১লাঠি ভাঙিছে।

   শঙ্খ বাজিছে।

আর ‘ছ.১,২’ বাক্যকে বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়াবে:

ঝ.১আজ বেশ রোদ দিয়েছে

   কাল বেশ বৃষ্টি দিয়েছিল।

            তা হলে কোনো যুক্তিই নেই যে অসমিয়াতে আমরা ‘ৰ’দ,বৰষুণ’-কে কর্ম বলব না,কিন্তু বাংলাতে ‘রোদ, বৃষ্টি’-কে কর্ম বলবো।‘কর্তৃ-ভাববাচ্য’ সম্পর্কে নির্মল দাশ কিছু লেখেন নি।কিন্তু এই বিভাজনও সম্ভব আমরা দেখালাম। তবে একে তিনি স্বতন্ত্র বিভাজনের দরকার মনে করেন নিঅসমিয়াতেও অনেকে করেন না--- এই সিদ্ধান্তে আরেকটি তথ্যের থেকে যেতে পারি যে অসমিয়াতেও কেউ কেউ এই দু’টোকে মিলিয়ে ‘কর্তৃ-কর্মবাচ্য’-এর বাক্য বলেন এই সংবাদ একেবারে শেষে দিচ্ছেন গোলোকচন্দ্র গোস্বামী।২৬৯আপাতত যদি আমরাও মেনে নিই,যে এই দুই মিলিয়ে অসমিয়াতেও এগুলো ‘কর্তৃ-কর্মবাচ্য’-ই,তা হলে যে প্রশ্ন আমাদের সামনে চলে আসে,সে হলো অসমিয়াতে কি তবে আর কোনো রকম  ‘ভাববাচ্য’-এর বাক্য নেই? ‘উ.১,২,৩’ বাক্যের কি অসমিয়া প্রতিরূপ নেই?অনুবাদের কথা ভাবতেই আমাদের মনে হলো ‘উ.১’ বাক্যটির অসমিয়া প্রতিরূপ হয়তো নেই।যখন কাউকে ‘আপনি,তিনি,তুই’-এর কোনটি সম্বোধন করে কথা বলতে হবে এই নিয়ে বক্তা সংশয়ে থাকেন,তখন এরকম করে ‘ভাববাচ্য’-এর প্রয়োগকে ‘বাংলা বাক্যের একটি সুন্দর বৈশিষ্ট্য’ বলে উল্লেখ করেছেন নির্মল দাশ২৭০ কিন্তু বাকি দুটোকে এভাবে অনুবাদ করা সম্ভব:

ঞ.১তোমাৰ আজি কলিকতা যোৱা নহ’ব।

    পিচে তোমাক ভাত এসাজ খাবো লাগিবো।

      ‘দুটি ভাত’ আর ‘ভাত এসাজ’-এর তফাৎ হলো দুই ভাষার বাগবিধির।অন্যথা বাচ্য বা বাগভঙ্গীর দিক থেকে অসমিয়া এবং বাংলা বাক্যের গঠনে তফাত বিশেষ নেই।আর এগুলো অসমিয়াতে সুপ্রচলিত বাক্যের গঠন।অর্থাৎ স্পষ্টতই গোলোকচন্দ্র গোস্বামী যেগুলোকে অসমিয়া ‘কর্মবাচ্য’ বলছেন সেগুলো নিয়ে বাংলাতে নির্মল দাশ নীরব।তার বিপরীতে নির্মল দাশ যেগুলোকে ‘ভাববাচ্য’-এর বাক্য বলছেন সেগুলো নিয়ে  গোলোকচন্দ্র গোস্বামী নীরব।দুই ভাষার দুই ব্যাকরণবিদকে স্বতন্ত্র ভাবে পড়লে ‘বাচ্য’ বিষয়টিকে তাত্ত্বিক ভাবে যত স্পষ্ট মনে হচ্ছিল,বাস্তবে সেটি আর রইল না।অথচ,‘বাক্য’ গঠনের দিক থেকে ‘ঐ.১,২,৩’ এবং ‘ঔ.১-৭’ এর মধ্যে সামান্য কিছু তফাত ছাড়া বাংলা এবং অসমীয়া ভাষাতে মৌলিক কোনো তফাত আমাদের নজরে এলো না।যা কিছু এলো অধিকাংশই রূপতাত্ত্বিক। সেই রূপতত্ত্বেই সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়,সুকুমার সেন এবং বাণীকান্ত কাকতিও ‘বাচ্য’-কে ছুঁয়ে গেছিলেন।তাঁরা বাক্যতত্ত্ব স্পর্শ করেন নি,আমরা আগে লিখেছি।আমাদের কাছে যেটি স্পষ্ট,সে হলো গোলোকচন্দ্র গোস্বামীও যদিও বিষয়টি ‘বাক্য প্রকরণে’ই আলোচনা করেছেন,ক্রিয়াকেন্দ্রিক ভাবনার থেকে তিনিও বেরোতে পারেন নি।বিশেষ করে কর্ম-ভাববাচ্য এবং কর্তৃভাববাচ্যের সংজ্ঞাতে সেটি তাঁর ক্ষেত্রেও সত্য।নির্মল দাশের ক্ষেত্রেও সত্যআমরা সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।তার আগে বাণীকান্ত কাকতি এবং সুকুমার সেন বিষয়টিকে কীভাবে দেখেছিলেন,বুঝে নেয়া যাক।

            “ক্রিয়াপদর ধাতুর পাচত –য় যোগ দি প্রা.ভা..ত কর্মবাচ্য রচনা করা হৈছিল” এই দিয়ে বাণীকান্ত কাকতি বাচ্যের আলোচনা শুরু করেছেন।২৭১এ কথা সুকুমার সেনও উল্লেখ করেছেন।২৭২এই ‘-য়’ কীভাবে প্রাকৃতে এবং অপভ্রংশের নানা ভাষাবৈচিত্রে বিভিন্ন পথে বিবর্তিত হয়েছে সেসব ব্যাখ্যা করে তার অবশিষ্ট যে প্রাচীন এবং মধ্য অসমিয়া বাংলাতেও এসেছিল সেসব ব্যাখ্যা করে এসে লিখছেন,“আধুনিক অসমীয়াত বিভক্তিযুক্ত কর্মবাচ্য অপ্রচলিত, কিন্তু কিছুমান জতুয়া প্রকাশভঙ্গীত ই রক্ষিত হৈছে;যেনে--- বতাহ̖ চকুৰে নেদেখি,চকুৰে বতাহ দেখা নাযায়।”২৭৩ তিনি আরো কিছু উদাহরণ দিয়েছেন,আমাদের এইটুকুনই দরকার। ১)‘-ই’ পরসর্গ যোগ করে ক্রিয়ারূপগুলোকে তিনিও কর্মবাচ্যই বলছেন।২) এগুলোকে ‘জতুয়া প্রকাশভঙ্গী’ বলছেন।৩) এগুলো বেশি নেই,বিভক্তিযুক্ত কর্মবাচ্য আধুনিক অসমিয়াতে অপ্রচলিত।৪) যা ধাতু জাত ‘যায়’ ক্রিয়া দিয়ে বিকল্প এধরণের কর্মবাচ্যের রূপ তৈরি হচ্ছে।অর্থাৎ ‘ঐ.১,২,৩’ এবং ‘ক.৩,৪’ আদলের বাক্যগুলো প্রসঙ্গে গোলোকচন্দ্র গোস্বামীও তাই বলছেন যা বাণীকান্ত কাকতি বলছেন।

            অসমিয়া-বাংলা বাচ্য গঠন পদ্ধতি যে পরস্পর থেকে ভিন্ন নয়,সেটি এই অব্দি আমাদের অধ্যয়নেও দেখা যাচ্ছে। বাণীকান্ত কাকতিও লিখছেন,“(বর্তমান চলিত পদ্ধতি) বঙলার দরে বিশ্লেষণাত্মক আরু সংযুক্তপদ্ধতি।আগতে উল্লেখ করি অহা ভাষাবোরর বাহিরে সকলো ন.ভা.. ভাষাতে সকর্মক ক্রিয়ার অতীত কৃদন্তকত সহকারী ক্রিয়া যা,গমন কর̖, যোগ দি ব্যাকরণগত ভাবে কর্মবাচ্য তৈয়ার করা হয়।কিন্তু প্রায়ে যৌগিক ক্রিয়ার সহায়েরে বেশি জতুয়াভাবে কর্মবাচী অর্থ প্রকাশ করা হয়;যেনে--- সি মার খালে,তাক মরা হ্ল;সি মরা পরিল,সি ক্ষতিগ্রস্ত হল; ইত্যাদি।”২৭৪অর্থাৎ ‘ক.১,২’ আদলের বাক্যকেও তিনি কর্মবাচ্যই ধরছেন।‘খ.১,২’ আদলের বাক্য নিয়ে তিনি এই অব্দি নীরব,অর্থাৎ যেগুলোতে ‘দ্বারা/দি’ বা বিকল্প অব্যয় বা রূপিম যোগে কর্তার এক রকম গৌণ হলেও উল্লেখ থাকছে।ইংরেজিতে যে কর্তা ‘by’ preposition নিয়ে  কর্মের জায়গাতে গিয়ে বসে।ইচ্ছে করলেই আমরা  ‘ক.১,২’ এবং ‘খ.১,২’-এর বাক্যকে একই ক্রমে ধরে দু’টোকেই ‘কর্মবাচ্যে’-র বাক্য বলতে পারি।বাংলাতেও,অসমিয়াতেওকর্তার উল্লেখটাতো গুরুত্বপূর্ণ নয়, আসল কথা,কাজটা কী হলো।অর্থাৎ কর্ম এবং ক্রিয়া।সুকুমার সেনও তাই করেছেন বলে ভ্রম একটা হয়কিন্তু মুশকিল হলো তিনি এগুলোকে ‘কর্মভাববাচ্য’ বলেছেন।তিনি কী লিখেছেন,আমরা ক্রমানুসারে উপস্থাপন করছি।

            ১) “যৌগিক ক্রিয়ার সাহায্যে যৌগিক কর্ম ও ভাববাচ্য( Periphrastic Passive) প্রাচীন বাংলা হইতে চলিত আছে।ভাববচনের(action noun) অথবা কৃদন্ত বিশেষণের সঙ্গে যাওয়া পাওয়া দেওয়া ইত্যাদি অর্থের ধাতুর যোগে কর্মভাববাচ্যের অর্থ প্রকাশ পায়। যেমন প্রা-বা ‘দুলি দুহি পিঠা ধরণ ন জাই’...২৭৫যে কথাগুলো আমরা ‘ও.১-৭’ উদাহরণ বাক্যগুলোতে দেখিয়ে এলাম।কিন্তু এখান থেকে তিনি কেন,শুধু পরের কথাটিই লিখলেন,আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।

            ২) “ আধুনিক বাংলায় [-অন] প্রত্যয়ান্ত শব্দের সঙ্গে ‘যা’ ধাতুর যোগ বঙ্গালীতেই মিলে। যেমন ‘আর কি দেওন যায়।’”২৭৬যৌগিক ক্রিয়ার পূর্বাংশে,বা সমাপিকার ক্রিয়ার বিশেষণে ‘-অন’ প্রত্যয়ের বিষয়টি স্পষ্ট।কিন্তু সেটি তো ‘বঙ্গালী’-র সিলেটি-কাছাড়ি সব বিভাষা সম্পর্কে সত্য নয়।হবিগঞ্জ মৌলবিবাজারের ভাষাতে শোনা যায়। সে সবে এবং মান বাংলাতে যে  ‘-আ’ প্রত্যয় জুড়ে বিশেষণটি বা ‘যৌগিক ক্রিয়া’র পূর্বপদটি তৈরি হচ্ছে,এবং ‘গ.১,২’-র আদলে মান বাংলা বাক্য সম্ভব সেটি নিয়ে তিনি কিছু লেখেন নি।অথচ এই নিয়ে আমাদের কোনো সংশয়ই নেই।আমাদের সিদ্ধান্তের সমর্থনে বোধ করি দু’একটি রবীন্দ্র বাক্যের নজির দেয়া সমীচীন হবে:

                                    ট.১ভাবনা নিয়ে তো পিছনের দিকে যাওয়া যায় না (রবীন্দ্রনাথঃমালঞ্চ)

                                       কাউকে বদ-রঙের কাপড় পরতে দেখলে জিজ্ঞাসা করে কাপড়টা কোন্ দোকানে

                                        কিনতে পাওয়া যায়। (রবীন্দ্রনাথঃশেষের কবিতা)

                                       নানা বরণের মেঘ মিশেছে বনের শিরে

                                                 এখনো বুঝি রে যায় দেখা!(রবীন্দ্রনাথঃ অতীত ও ভবিষ্যৎ)

            বাণীকান্ত কাকতি বরং এই বিশেষত্বকে ‘কর্মবাচ্য’ বলে মেনে নিয়ে এই সম্পর্কে লিখেছেন,“‘-আ’ যুক্ত কর্মবাচ্য বঙলার বিশেষত্বপূর্ণ লক্ষণ যেন লাগে।”২৭৭

            ৩) “আধুনিক সাধুভাষায় নিষ্ঠান্ত পদের সঙ্গে ‘আছ̖,হো,যা,পড়’ ইত্যাদি ধাতুর যোগে কর্মভাববাচ্যের পদনিষ্পন্ন হয়। যেমন---বইটা আমার পড়া আছে;কখন আপনার আসা হইল?কোথায় যাওয়া হচ্ছে?শোনা গেল চোরটা ধরা পড়েছে।”২৭৮অর্থাৎ নির্মল দাশকে অনুসরণ করে আমরা ‘ভাববাচ্য’-এর যে নজির ‘উ.১,২,৩’-এ দিয়ে এসেছি তিনি তার কথা বলছেন।‘বইটা আমার পড়া আছে’ কিংবা ‘শোনা গেল চোরটা ধরা পড়েছে।’--- এই দুই বাক্য দেখে মনে হতে পারে যে বুঝিবা অধ্যাপক নির্মল দাশ ‘কর্মবাচ্য’-এর নজিরে যে সাধু বাক্যগুলোর উল্লেখ ‘ঈ.১,২’ বাক্যে করেছিলেন এবং আমরা ‘ঋ.১,২’ বাক্যে যার মান বাংলা আদলটি দেখিয়েছি সুকুমার সেন সেগুলোর কথাই বলছেন। সেরকম কিছু নয়।বিভ্রান্তি একটি হয় ‘ঋ.১’ বাক্যটি দেখলে,কিন্তু ‘ঋ.২’ বাক্য আবার দেখলেই বোঝা যাবে,আদলটি ভিন্ন।সামান্য পরেই আমরা দেখাচ্ছি। 

            বাণীকান্ত আলাদা করে হ ধাতুটি নিয়ে কিছু কথা এরকম লিখেছেন,““...হ ধাতুর ক্রয়ারূপ হএ-র সহায়েরে সাধারণতে কর্মবাচী অর্থর ইঙ্গিত দিয়া হয়।কর্তৃবাচ্যর কর্তাক সম্প্রদান কারকত রখা হয় আরু এটা ক্রিয়ামূলক বিশেষ্যই কর্তার কাম করে;যেনে--মোক̖ দিয়া হয়,মোক দান কৰা হয়;আক্ষ.মোৰ প্রতি দিয়া হয়;অর্থাৎ দিয়া কাম সম্পন্ন কৰা হয়।”২৭৯সেরকম ‘পুথি(ক̖) পঢ়া হ’ব’,‘কাম̖ (অক̖) কৰা হোল’ –এরকম আরো দুই বাক্যের বিশ্লেষণ সহ ব্যাখ্যা রয়েছে। তাতে আমাদের কাছে স্পষ্ট হলো না ১) অন্যান্য ধাতুকে বাদ দিলেন কেন? ২) আমরা যে  ‘উ.১,২,৩’-এর শেষ দুটি বাক্যকে ‘ঞ.১,২’-তে অসমিয়া অনুবাদ করেছিলাম,তার প্রথমটি অর্থাৎ ‘ঞ.১’ বাক্যটির সমাপিকা ক্রিয়ার ধাতুটি কিন্তু তার পরেও আমরা নিশ্চিত নই সেই বা সেই আদলের অন্যান্য ধাতুতে তৈরি ক্রিয়াপদের বাচ্যকে তিনি কী বলতেন। অর্থাৎ বাক্য শেষে যদি যৌগিক ক্রিয়াগুলো হয়—‘যোৱা হব/নহব’,‘খাবো লাগিবো/নেলাগে’ ইত্যাদি।‘ঞ.১’-এর সমাপিকা যদিও ‘নহ’ব’ কর্তাতে কিন্তু পরসর্গটি ‘-ৰ̖’ (তোমাৰ̖)বিপৰীতে ‘ঞ.২’ বাক্যে কর্তাতে যদিও ‘-ক̖’ (তোমাক̖) পরসর্গটি রয়েছে সমাপিকার ধাতু লাগ

            ৪) “নিষ্ঠান্ত তৎসম পদের দ্বারা সাধু ভাষায় কর্ম-ও ভাব-বাচ্য নিষ্পন্ন হয়।যেমন একটি অদ্ভুত ব্যাপার দৃষ্ট হইল; গল্পটি রাজার কর্ণগোচর হইল;ব্যাঘ্রটি ব্যাধ কর্তৃক নিহত হইয়াছিল।”২৮০এর মধ্যে কোনটি ‘ভাব’ আর কোনটি ‘কর্ম’ স্পষ্ট বোঝার উপায় নেই।আমরা ধরে নিতে পারি,তিনি ক্রম ভেঙে শেষটিকে ‘কর্মবাচ্য’ বলছেন।‘ঈ.১,২’ আদলের সঙ্গে এটি মিলছে।কিন্তু সেগুলোর মান বাংলা রূপান্তর করে ‘ঋ.১,২’ আদলে যে দুই বাক্যের কথা লিখেছিলাম,‘পুলিশের হাতে চোর ধরা পড়েছে’ এবং ‘বইটা আমার পড়া হয়েছে’---এতোদূর তিনি এগোন নি।কিন্তু বাণীকান্ত কাকতি একেবারে শেষের দিকে একে যেভাবে ব্যাখ্যা করছেন,তা কিছু জটিলতা বাড়িয়েও দেয়,আবার দুই ভাষার জন্যে কিছু নতুন ভাবনার দ্বার খুলেও দেয়।‘ঋ.১,২’-এর আমরা অসমিয়া অনুবাদ করেছিলাম ‘খ.১,২’-তে।তিনি লিখছেন,“করোঁতা আরু করা কামর মাজত সম্বন্ধ বুজোৱা কর্মবাচী রচনর বাক্যাংশবোৰ অবশ্যে তেনেই সাধারণ।কর্তাত করণ-কর্তা কারকর –এ বিভক্তি বা সম্ব.র –ৰ বিভক্তি যোগ দিয়া হয়;আরু ক্রিয়াটো –আ যুক্ত অতীত কৃদন্তক করা হয়;যেনে--- ৰামে বা ৰামৰ̖ কৰা কাম̖,ৰামৰ দ্বাৰা কৰা কাম। গোপালে লিখা চিঠি বা গোপালৰ̖ লিখা চিঠি,গোপালৰ দ্বাৰা লিখা চিঠি।”২৮১ এগুলোকে বাক্যাংশ কেন রাখলেন,‘লিখা’ বিশেষ্য বা বিশেষণকে কেন ক্রিয়া বললেন--- এই সব প্রশ্ন সংগত কারণেই দেখা দেয়।দুই বাক্যের শেষে ক্রমে ‘হ’ল’ এবং ‘আহিল’ বসিয়ে দিলেই একটা করে বাক্য সম্পূর্ণ হয়ে যায়,যে বাক্যগুলো কর্তৃবাচ্যের হবে না,এটি নিশ্চিত।‘কর্মবাচ্য’-ই হবে--- এই নিয়ে এর পরে সংশয় থাকা উচিত নয়।এগুলো হচ্ছে এর জটিলতার দিক।নতুন চিন্তাসূত্রটি হলো,‘দ্বারা’-অনুপদের ব্যাবহারটি আছেতো বটেই,তার বদলে যে অসমিয়াতে করণ কারকের পরসর্গগুলোর তির্যক ব্যবহারের কথাই তিনি লিখতে চাইছেন এই বিষয়টিও এখানে স্পষ্ট। এই রীতি বাংলাও মেনে চলে বলেই আমরা ‘ঋ.১,২’ আদলের দুই বাক্য লিখেছিলামএমন কি কখনো ‘করা’ এবং ‘লিখা/লেখা’ দুই ভাষাতেই উহ্য থেকে যায়। প্রেক্ষিত অনুযায়ী শ্রোতাকে বুঝে নিতে হয় – গোপালের লেখা চিঠি এলো, না গোপালকে লেখা চিঠি এলো।‘ৰামৰ̖ কৰা কাম̖ হ’ল’ না বলে বলা চলে ‘ৰামৰ̖  কাম̖ হ’ল’  

            নির্মল দাশ যেগুলোকে ‘কর্ম-কর্তৃবাচ্য’  বলছেন বা গোলোকচন্দ্র যেগুলোকে ‘ভাববাচ্য’ বলছেন সে সব নিয়ে সুকুমার সেনে স্পষ্ট কিছু নেই।বাণীকান্ত কাকতিতে রয়েছে।এবং তাঁর কথাগুলো আমাদের সমাধানসূত্রে পৌছুতেও সাহায্য করবে,“বঙলার দরেই অসমীয়াতো মূলত: –য় যুক্ত বিভক্তিপ্রধান কর্মবাচ্যর বিস্তারণ যেন লগা কিছুমান নৈর্ব্যক্তিক রচনর উদাহরণ পোয়া যায়;যেনে—কাপোৰ̖ ছিৰে, কাপোৰ ছিরা যায়,বাঁহ̖ ভাঙ্গে,বাঁহ̖ ভঙ্গা যায়;এপাট̖ তালে কেতিয়াও নাবাজে,এপাট̖ তালৰ কেতিয়াও শব্দ নোলায়;কলহ̖ ভৰে,কলহ̖ ভর্তি হয়।”২৮২স্পষ্ট যে তিনি এগুলোকে ‘কর্মবাচ্যের বিস্তার’ বলছেন,অন্য কোনো নাম ব্যবহার করছেন না।কিন্তু ইংরেজি ব্যাকরণের ‘impersonal voice’ কথাটির একটি প্রভাব আছে,‘নৈর্ব্যক্তিক রচন’ কথাটিতে। যেখান থেকে সূত্রগুলো নিয়েছেন,সেই সুনীতিকুমারের ওডিবিএল-এ কিন্তু ‘so-called middle voice’ এবং এর বাংলা অনুবাদে ‘কর্ম-কর্তৃবাচ্য’ কথাটারও উল্লেখ আছে।২৮৩

            স্বতন্ত্র ভাবে প্রতিজন ভাষাবিদই খুব স্পষ্ট।কিন্তু যখনই পাশাপাশি অধ্যয়ন করছি এখনই পাঠের পরিমাণ বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে একটি গুণগত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছেজটিলতাগুলো কাটিয়ে একটি সরলপথে পৌঁছুতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের পূর্বজ অনেকেরই তাত্ত্বিক অবস্থানকে নাকচ করে এগোনো ছাড়া কোনো পথ নেইএই ভ্রমণ পথের ছবিটা না দেখিয়ে সেই গন্তব্যটাই শুধু দেখাই,তবে প্রতীয়মান হবে আমাদের মতটি একটি পঞ্চম বা ষষ্ঠ ভিন্ন অভিমত শুধুএর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠত;এবং সেটা উঠতে পারত নিজেদেরও কোনো ভবিষ্যৎ অধ্যয়নের বেলাও।তাই পুরো পথের ছবিটা রাখা গেল,যাতে আমরা যে প্রস্তাব রাখব,সেখানেও যদি ভুল দেখা এবং লেখা কিছু থাকে সেগুলোকেও পরে চেনা সহজ হয়ে থাকেকিন্তু এই অব্দি এসে মনে হয় দু’টি  সিদ্ধান্ত স্পষ্ট করেই নেয়া চলে,--১) এঁরা সকলেই ‘বাচ্য’ বিষয়টিকে ‘ক্রিয়াকেন্দ্রিক’ অবস্থান থেকে দেখেছেন। গোলোকচন্দ্র গোস্বামী একে ‘বাক্যপ্রকরণ’-এ  রাখবার পরেও মৌলিক কোনো সিদ্ধান্ত বদল ঘটে নি।২) ভাষাভেদে তাত্ত্বিক অবস্থান ভিন্ন হবার কোনো কারণ নেই। বাংলা এবং অসমিয়া –দুই ভাষাতেই বাচ্য অনুসারে বাক্যের যে গঠন ভেদ তার ইতিহাস এবং স্বরূপ কিছু রূপতাত্ত্বিক ভিন্নতা ছাড়া মোটের উপর একই।বাণীকান্ত কাকতির অধ্যয়নে এই সিদ্ধান্ত এক শক্ত ভিতের উপরে দাঁড়ায়।সুতরাং তাদের পরিভাষা,সংজ্ঞা এবং সামগ্রিকভাবে তাত্ত্বিক অবস্থানকে পুনর্নির্মাণ করবার সময় আমাদের আপাতত মনে না রাখলেও চলে যে,তাঁরা দুই ভিন্ন ভাষা নিয়ে কথা বলে গেছেন। 

এবারে  আমরা গুটিয়ে এনে দেখছি,‘কর্তৃবাচ্য’ বাদ দিয়ে কে কীভাবে ‘বাচ্য’ বিষয়টিকে দেখছেন।

            ১) অধ্যাপক নির্মল দাশ আরো তিনভাগে ‘বাচ্য’-কে ভাগ করেছেন। ১) কর্মবাচ্য,২) ভাববাচ্য,৩) কর্মকর্তৃবাচ্য।

            ২) সত্যনাথ বরার বিভাজনটি সম্পর্কে আমরা বিস্তৃতি এড়াতেই আগে লিখিনি।কিন্তু এটুকু মনে হয় উল্লেখ থাকা ভালো যে তাঁর বিভাজনও অনেকটাই নির্মল দাশেরই মতো, ---১) কর্মবাচ্য,২) ভাববাচ্য।নির্মল দাশ যেসব বাক্যকে কর্মবাচ্য এবং ভাববাচ্য বলছেন,তিনিও তাই করেছেন।  

            ৩) অধ্যাপক গোলোকচন্দ্র গোস্বামী আরো তিন ভাগে বাচ্যকে ভাগ করেছেন ১) কর্মবাচ্য,২) কর্তৃ-ভাববাচ্য,৩) কর্ম-ভাববাচ্যনির্মল দাশ যেগুলোকে ‘ভাববাচ্য’ বলছেন,গোলোকচন্দ্র সেগুলোকেই ‘কর্মবাচ্য’ বলছেন,তার অতিরিক্ত কিছু বিষয়কেও কর্মবাচ্যের অন্তর্ভুক্ত করছেন।এবং নির্মল দাশের ‘কর্মকর্তৃবাচ্য’-কে গোলোক চন্দ্র গোস্বামী দুই ভাগে ভাগ করেছেন,‘কর্তৃ-ভাববাচ্য’ এবং ‘কর্ম-ভাববাচ্য’অর্থাৎ নির্মল দাশ এবং গোলোকচন্দ্র দু’জনেই যেগুলোকে ‘কর্মবাচ্য’ বলছেন অন্যজনে মোটের উপরে সেগুলো নিয়ে নীরব

৪) অন্যদিকে সুকুমার সেন কর্ম এবং ভাববাচ্যে যদি কোনো তফাত করেওছেন সেগুলো স্পষ্ট নয় –নির্মল দাশের ‘কর্মবাচ্য’ এবং ‘ভাববাচ্য’ দুটিকেই এবং গোলোকচন্দ্র গোস্বামীর ‘কর্মবাচ্য’-এর যে ক’টি বিষয় সুকুমার সেন ছুঁয়ে গেছেন তাকে ‘কর্মভাববাচ্য’ বলে চিহ্নিত করেছেন বলেই মনে হয়।নির্মল দাশের ‘কর্ম-কর্তৃবাচ্য’ এবং গোলোকচন্দ্রের ‘কর্তৃ-ভাববাচ্য’,‘কর্ম-ভাববাচ্য’-নিয়ে তিনি প্রায় কিছুই লেখেন নি।

৫) বাণীকান্ত কাকতি নির্মল দাশের ‘কর্মবাচ্য’ এবং ‘ভাববাচ্য’ দুটিকেই এবং গোলোকচন্দ্র গোস্বামীর ‘কর্মবাচ্য’ সব কিছুকেই বলছেন,‘কর্মবাচ্য’এমন কি নির্মল দাশের ‘কর্ম-কর্তৃবাচ্য’ এবং গোলোকচন্দ্রের ‘কর্তৃ-ভাববাচ্য’,‘কর্ম-ভাববাচ্য’-কে তিনি বলছেন,‘কর্মবাচ্যের বিস্তারণ’

৬) কিন্তু সুনীতি চট্টোপাধ্যায় সেগুলোকে প্রসঙ্গক্রমে ‘কর্ম-কর্তৃবাচ্য’ বলেই লিখেছেন,ইংরেজিতে ‘so-called middle voice’ বলেও উল্লেখ করেছেন।

এবারে আমাদের প্রস্তাবিত ভাবনা এরকম:

১) ‘বাচ্য’ কথাটির অর্থ “কথা কোয়ার ভঙ্গী বা বাক্য প্রকাশর ধরণ।”২৮৪সুতরাং এই মূল পরিভাষা নিয়ে আমাদের কোনো প্রশ্ন নেই,যেমন ছিল ‘উক্তি’ প্রসঙ্গে। 

            ২) আমরা ‘আ’ থেকে শুরু করে ‘ট’ অব্দি ‘কর্তৃবাচ্য’ বাদ দিয়ে যে ক’টি বাক্য সংশ্লিষ্ট ভাষাবিদদের থেকে বা অন্যান্য সাহিত্যিক নিদর্শন থেকে অথবা নিজেরা অনুবাদে পুনর্নির্মাণ করে উদাহরণগুলোতে উপস্থিত করেছি তার সব ক’টিতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে বাংলা-অসমিয়া বাক্যে এই সব বাচ্যের ক্রিয়াপদটি অধিকাংশ সময় ‘যৌগিক ক্রিয়া’যেখানে পূর্বপদটির পরসর্গ কখনো ‘-আ’ দুই ভাষাতেই জুড়েছে,কখনো অসমাপিকাতে একই কাজ হয়েছে,কখনোবা কোনো রূপ-পরিবর্তন হয় নি।কিন্তু সর্বাবস্থাতেই নামপদ থেকে কিংবা ক্রিয়াপদ থেকেই তৈরি হোক বাস্তবে সেই পূর্বপদ  বিশেষ্য;এবং যৌগিক ক্রিয়ার শেষাংশ তথা সমাপিকা ক্রিয়াটিকে বিশেষিত করে বলে এগুলো অধিকাংশ সময় বিশেষণও। যেমন –দেখা যায়,ধরা পড়েছে,ধৰা পৰিল,জ্বৰ উঠিল ইত্যাদিসমাপিকা ক্রিয়ার এগুলো কর্মও। যৌগিক ক্রিয়ার সম্পর্কে এই কথা সুকুমার সেনও লিখেছেন,“বাঙ্গালায় যৌগিক ক্রিয়া তিনরকমের।এক রকমে প্রথম পদটি বিশেষ্য,দ্বিতীয় পদটি  সমাপিকা ক্রিয়া এবং প্রথম পদ দ্বিতীয়পদের কর্ম অথবা কর্মস্থানীয়উভয় পদ মিলিয়া একটি মাত্র পদের অর্থ প্রকাশ করে।”২৮৫উভয় পদ মিলে সব সময় একই অর্থ প্রকাশ করে কিনা,সে নিয়ে তর্ক হতে পারে এসব ক্ষেত্রে---শঙ্খ বাজে,ৰ’দ দিছে।অর্থাৎ যেগুলোর পূর্বাংশ সরাসরিই নামপদ,ধাতু থেকে তৈরি বিশেষ্য নয়কিন্তু এটা ঠিক আদলটি যৌগিক ক্রিয়ারযে গুলো যৌগিক ক্রিয়া নয় বলে ভ্রম হয়আর সেটি  হয় বলেই বহু সময় ‘বাগধারা’,‘জতুৱা’ কথাগুলোও এসেছেতাছাড়া পূর্বপদটি আমরা ‘আসন্ন সঙ্গ’ বলেও কাজ চালাতে পারি।প্রথমাংশই গোটা ‘আসন্ন সঙ্গ’-এর অর্থ নিয়ন্ত্রণ করে।কিন্তু রূপতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যগুলো শেষাংশেই দেখা যায়।অর্থাৎ কাল-পুরুষ কিংবা ভাব ঠিক সেরকমই এই শেষাংশের রূপকে নিয়ন্ত্রণ করে যেভাবে ‘কর্তৃবাচ্য’-এর ক্রিয়াপদকে করে। সেই শেষাংশ বহুপদীও হতে পারে,যেমন—তখন তোমার লেখা চলতে থাকবেপূর্বপদটিও হতে পারে বহুপদী। যেমন—তেতিয়া ইয়াত এইবোৰ দেখা পাব লাগিছিল।

৩) আমরা নিশ্চিত নই,সেই শেষাংশের সব কালে-পুরুষে বা ভাবে সর্বাবস্থাতে রূপভেদ মেলে কিনা।তার জন্যে যে বিশাল স্বতন্ত্র অধ্যয়ন দরকার স্বাভাবিক ভাবেই তা অনুমান করা যায়।তবে যে বাক্যগুলোর নজির আমরা দেখে এলাম,তাতে নির্মল দাশ ‘ভাববাচ্য’-এর বাক্যে এবং গোলোকচন্দ্র গোস্বামী  ‘কর্মবাচ্য’-এর বাক্য সম্পর্কে যে লিখেছেন ক্রিয়াপদের অন্যপক্ষ হয়,সেটি ‘কর্তৃবাচ্য’ ছাড়া বাকি সব বাচ্যেই সত্য বলে মনে হয়।এর তাত্ত্বিক যুক্তিটি হলো ‘বক্তা’ বা ‘শ্রোতা’ পক্ষের ক্রিয়া থাকতে হলে ‘কর্তা’র একটি মুখ্যভূমিকা থাকতে হয়।আর ‘কর্তৃবাচ্য’ ছাড়া আর কোথাও কর্তার সেই ভূমিকা থাকে না।‘কর্তা’ হয় লোপ পায়,অথবা গৌণভূমিকাতে চলে যায়।তাই আমরা ‘ঔ.১ থেকে ৬’ আদলে যে বাংলা বাক্যগুলোর কথা লিখে এসেছিলাম,সেগুলো কর্মবাচ্য বা ভাববাচ্যের বাক্য নয়।‘ঔ.৬’ বাক্যটি ছিল--- আজ বিমানে চড়ে আমরা পাখির মতো আকাশে উড়ে বেড়াতে পারি।তার বিপরীতে গোলোকচন্দ্র ‘এ.৪’-এ একটি নজির দিয়েছিলেন এরকম--- তেতিয়াও অসম দেশত স্কুল আৰু কাছাৰীত বঙ্গলা ভাষা চলিছিল।এরকম বাক্যও  ‘কর্তৃবাচ্য’-এর নয়।এর জন্যে নয় যে,এতে ক্রিয়াপদের পক্ষ অন্যবরং এর জন্যে যে ‘বঙ্গলা ভাষা’ এখানে কর্ম। যে তার প্রচলন করেছিল,সেই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের এখানে উল্লেখ নেইঅর্থাৎ কর্তাটি গৌণ।অনুরূপ ‘শঙ্খ বাজে/বাজছিল/ বাজবে/বাজিছিল/বাজিব/বাজি থাকিবো’ ‘কর্মকর্তৃবাচ্য’ বা ‘কর্ম-ভাববাচ্য’ হলেও,‘শঙ্খ  বাজাও,বাজাই,বাজা,বাজান, বাজাচ্ছিলাম,বাজাবে,বাজাতে থাকবি’ ---এমন সব বাক্য কিন্তু ‘কর্তৃবাচ্য’-এর বাক্য।‘তুমি/আমি/মই’ কর্তা জুড়ে দিলেও হয়,না দিলেও কর্তাকে স্পষ্ট চেনা যায়।কর্তৃবাচ্য ভিন্ন ‘কর্ম ও ভাববাচ্যে’ অনুজ্ঞার রূপ আধুনিক বাংলাতে নেই লিখেছিলেন সুকুমার সেন।২৮৬ এর সঙ্গে আমাদের সহমত পোষণ এর জন্যেই কঠিন,যে শঙ্খ বাজুক,স্কুল গেট খুলুক,বৃষ্টি হোক---ইত্যাদি বাংলা বাক্যের তথা ক্রিয়াপদের গঠনের সঙ্গে আমরা সুপরিচিত।আদেশ না বোঝালেও ইচ্ছেতো বোঝায়ই এই সব বাক্যে।অথচ,কর্তা এসব বাক্যে গৌণ অথবা নেই।অনুরূপ অসমিয়াতে আমাদের লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার লেখা ‘অসম সঙ্গীত’-এর সেই বিখ্যাত পঙক্তিটিই মনে পড়ছে—“বাজক দবা,বাজক শঙ্খ/বাজক মৃদং খোল,/অসম আকৌ উন্নতি-পথত/'জয় আই অসম' বোল

            ৪) মোটা দাগে অসমিয়া-বাংলা বাচ্য অনুসারে গঠনভেদ বাণীকান্ত কাকতিকে অনুসরণ করে দু’রকমই বলা চলে-- ‘কর্তৃবাচ্য’ এবং ‘কর্মবাচ্য’বাকি সব ক্ষেত্রেই ‘কর্ম’-এর ভূমিকাই মুখ্য।কর্তা-কর্ম দুটিকেই বাদ দিয়ে বা গৌণ করে দিয়ে কোনো বাংলা বাক্য নেই।সুতরাং বাচ্যও নেই।ফলে ‘বাচ্য’-এর  বাকি যে প্রভেদ সেগুলো ‘কর্মবাচ্য’-এরই প্রকার ভেদনির্মল দাশ যেগুলোকে ‘কর্মবাচ্য’ এবং ‘ভাববাচ্য’ বলে ভাগ করেছেন,খেয়াল করলে দেখা যাবে---তার প্রতিটিতেওই কর্মটি সম্পাদন করবার জন্যে একটি সুনির্দিষ্ট কর্তা রয়েছে যে কাজটি করেছে,বা যাকে করতে হবে অথবা হয়। সেরকম সুনির্দিষ্ট কর্তার উল্লেখ না থাকলেও গোলোকচন্দ্রের  ‘ক.১,২’ বাক্যে কিন্তু কাজটি কোনো এক বা একক ব্যক্তিদল কোনো এক বিশেষ কালে কাজটি করেছে --সেটি বোঝা যাচ্ছেসেই কাজের পুনরাবৃত্তি অন্য কারো দ্বারা অন্য কোনো সময় সম্ভব নয়।তিনিও সেগুলোকে ‘কর্মবাচ্য’ বলছেন।সুকুমার সেন ‘কর্ম’ না ‘ভাব’ বলবেন,সেরকম একটা অনিশ্চয়তার জায়গা রেখে দিয়ে শেষে ‘কর্মভাব বাচ্য’ লিখছেনএগুলোকে তাই শুধুই ‘কর্মবাচ্য’ বা ‘ব্যক্তিক কর্মবাচ্য’ বলা যেতে পারে।

 অন্যদিকে গোলোকচন্দ্র গোস্বামীর ‘ক.৩,৪’ আদলের বাক্য এবং ‘ঐ.১,২,৩’ আদলের বাক্যগুলোর ‘কর্ম’-এর ভিন্ন স্থানে কালে ভিন্ন কর্তাকে দিয়ে পুনরাবৃত্তি করানো সম্ভব।অর্থাৎ ‘কর্তা’-তো বটেই অধিকরণাদিও এই সব বাক্যে সুনির্দিষ্ট নয়।বাণীকান্ত কাকতিকে অনুসরণ করে বলতে পারি এগুলো ‘নৈর্ব্যক্তিক রচন’ইংরেজিতে বলা হয় ‘impersonal’নির্মল দাশ এরকম বাংলা বাক্যের সম্পর্কে লেখেন নি,কিন্তু আমরা দেখিয়েছি এগুলো বাংলাতে আছে, অসমিয়ার সঙ্গে এ ব্যাপারে বাংলার মৌলিক কোনোই পার্থক্য নেই। সুতরাং সেগুলোকে ‘নৈর্ব্যক্তিক কর্মবাচ্য’ বলা যেতে পারে।একই যুক্তিতে ‘ঔ.১ থেকে ৬’ আদলের বাক্যগুলোকে ‘নৈর্ব্যক্তিক কর্তৃবাচ্য’ বলে ভাবা যেতে পারে।এমনিতেও ‘ভাব অনুসারে’ বাক্যের গঠন ভেদে ‘ভাব’ কথাটির আমরা অন্য অর্থ জেনে এসেছি।‘ভাববাচ্য’-এর বাক্যেরও ‘ভাবানুসারে গঠন ভেদ’ সম্ভব।যেমন---অঙ্কটো ইমান সহজে কৰিব পাৰি নে? সুতরাং ‘বাচ্য’ প্রসঙ্গে ‘ভাব’ কথাটিকে বাদ দিলেই বিভ্রান্তি কমে।তার উপরে,‘ভাব অর্থাৎ ক্রিয়া’২৮৭–নির্মল দাশের এই ব্যাখ্যা প্রশ্নাতীতভাবে গ্রহণ করাটা কঠিন। এই ‘নৈর্ব্যক্তিক বাচ্য’-এ বাংলা এবং অসমিয়াতে সামান্য একটি প্রভেদ আছে। ‘দেখ,পাৰ̖,শুন̖’ এরকম কয়েকটি ধাতুতে ‘-ই’ পরসর্গ জোড়ে অসমিয়াতে সমাপিকা অংশটি গড়ে উঠে, যে কিনা বাংলাতে নেই। অন্যদিকে, বাকি বাক্যগুলোতে সাধারণত বাংলা –অসমিয়া দুই ভাষাতেই সমাপিকা অংশটি যা,  ইত্যাদি ধাতুতে তৈরি হয়। ধাতু তথা ক্রিয়াপদগুলো খুব সুনির্দিষ্ট কিনা,পরীক্ষা না করে বলা কঠিন। কিন্তু এগুলোতে আরেকটি ব্যাপার আমরা স্পষ্ট করতে চাই সে হলো এই ক্রিয়াপদগুলোও এখানে ‘নৈর্ব্যক্তিক’অর্থাৎ ‘যায়’ বলবা মাত্র এমনটা বোঝায় না যে কেউ সত্যি যাচ্ছে,বা কাজটি করছে।করতে চাইলে করতে পারে অথবা পারে না---ক্রিয়াতে শুধু সেই সম্ভাবনার কথাই বোঝাচ্ছে।সুতরাং নির্মল দাশ এবং সত্যনাথ বরা২৮৮যেভাবে লিখছেন ভাববাচ্যে ‘ক্রিয়ার ভূমিকা প্রধান’ –কথাটি  এই সব বাক্যে অন্তত সত্য বলে গ্রহণ করা কঠিন।যদিও যুক্তি হিসেবে –‘কর্তা,কর্ম,ক্রিয়া’-র প্রাধান্য অনুসারে তিন বাচ্য মেনে নেয়াটা বেশ সহজ বলেই মনে হয়

 ‘নৈর্ব্যক্তিক’তার এই যুক্তিতে ‘ঔ.১ থেকে ৬’ আদলের বাক্যগুলোকে ‘নৈর্ব্যক্তিক কর্তৃবাচ্য’ বলে স্বতন্ত্র করতে পারি।এগুলো কালের বিচারে সাধারণ বা নিত্যবর্তমানের কর্তৃবাচ্যের বাক্য।কিন্তু ‘মানুষ মরে’,‘সূর্য উঠে’,‘পাখি ডাকে’, ‘বেলা বাড়ে’ জাতীয় নিয়মিত ঘটনা বোঝানো বাক্যের থেকে স্বতন্ত্র।এরকম বাক্য শ্রোতা এবং অন্যপক্ষের কর্তা বসিয়েও তৈরি হতে পারেযেমন –‘ওরা বেশ ইচ্ছে করলেই বিমানে এদেশ ওদের ঘুরে বেড়াতে পারে।’

গোলোকচন্দ্র গোস্বামী যেভাবে ‘কর্তৃ-ভাববাচ্য’ এবং ‘কর্ম-ভাববাচ্য’-এ প্রকারভেদ দেখিয়েছেন--সেগুলো আপাত দৃষ্টিতে যৌক্তিক বলেই মনে হয়।‘জ্বৰ উঠিছে’ বললে মনে হয় ‘জ্বৰ’ সক্রিয় কর্তার ভূমিকাতে নেমেছে।আর ‘ৰ’দ দিছে’ বললে মনে হয় কেউ একজন আড়ালে থেকে ‘ৰ’দ’ দেবার কাজটা করেছে।কিন্তু আমরা দেখালাম তিনিও ‘লাঠি ভাঙিছে’,‘শঙ্খ বাজিছে’ আদলের বাক্য নিয়ে কথা বলেন নি।বাণীকান্ত কাকতি করেছেন। সেগুলোতে কিন্তু কোনো এক স্থানে কালে কেউ কাজটি না করলে চলে না।তবে কি আমরা তার জন্যে তৃতীয় কোনো ‘বাচ্য’-এর প্রকার ভেদ প্রস্তাব করবো? এগুলো বরং দেখায়  বাংলা-অসমিয়া বাক্যে কর্তা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয় নাঅন্তত নিশ্চিহ্ন হবে-- এই সত্য অসমিয়া-বাঙালি মন মেনে নেয় না।তাই ‘কর্তৃ-কর্মবাচ্য’ বা ‘কর্তৃ-ভাববাচ্য’-এ কর্মই কর্তা হবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে ওঠে।সত্যনাথ বরা ‘আমাৰ দ্বাৰা’,মোৰ দ্বাৰা’ ইত্যাদি আসন্ন সঙ্গকে ‘কর্তা’ বলে লিখেইছেন,‘পঢ়া’,‘দিয়া’-র মতো ‘ভাববাচ্যৰ কৃদন্ত পদগুলো’-কেও ‘কর্তা’ বলেই লিখেছেন২৮৯ ‘কর্তৃবাচ্য’-এরা আদলে তথা সাদৃশ্যে ভাষাতে এমন কিছু বাগধারা বা আলঙ্করিক প্রয়োগ গড়ে উঠে যাকে সাধারণ ব্যাকরণের নিয়মে ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়।তাই এগুলোকে একত্রে ‘নৈর্ব্যক্তিক কর্ম-কর্তৃ (বা কর্তৃ-কর্ম) বাচ্য’ বলাই সঠিক হবেএই ভাবে ‘ক্রিয়াকেন্দ্রিক’-তার বিপরীতে  প্রকার-ভেদগুলো দাঁড়াচ্ছে ‘কর্তাকেন্দ্রিক’;আর বাচ্য দাঁড়াচ্ছে চাররকম: ১) কর্তৃবাচ্য,২) কর্মবাচ্য,৩) নৈর্ব্যক্তিক কর্মবাচ্য  এবং ৪) নৈর্ব্যক্তিক কর্ম-কর্তৃবাচ্য।  

  ৫) ‘কর্মবাচ্য’ এবং ‘কর্তৃবাচ্য’-র মৌলিক তফাত এই নয় যে ক্রিয়া কর্তা-কর্মের মধ্যে  কাকে অনুসরণ করে তার রূপ বদলায়।রূপতাত্ত্বিক এবং ক্রিয়াকেন্দ্রিক ভাবনার থেকে বাচ্যের বিচার করবার জন্যেই এই দিকটাতে জোর পড়েছে বলে মনে হয়। মৌলিক তফাত হলো ‘কর্তা’ এখানে গৌণভূমিকাতে চলে যায়।উল্লেখ থাক বা না থাক  নির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট কর্তা রয়েছে বোঝা যায়।‘নৈর্ব্যক্তিক কর্ম-কর্তৃবাচ্য’-এ কর্মই কর্তা হবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে ওঠে আমরা লিখে এলামবাকি সব কারকই অক্ষত থাকে,শুধু কর্তা গৌণ হয়ে যায় বলে যখন সেটি বাক্যে উল্লেখ করা হয় তখন তাতে  সম্বন্ধের পরসর্গ বা করণের অনুপদ যুক্ত হয়।বাংলা-অসমিয়া বাক্যে তার ক্রম বা বিন্যাস ‘বাচ্য’-এর জন্যে পাল্টায় না। বক্তার জোর দেবার ইচ্ছে অনুসারে পাল্টাতে পারে।কিন্তু এই বাক্যে মূল প্রশ্নটা এই নয় যে কে করেছে।মূল প্রশ্ন এই যে কী করেছে।তাই ক্রিয়া কর্মের সঙ্গে নিজের সঙ্গতি রক্ষা করে।এবং স্বাভাবিক ভাবেই পক্ষ ‘অন্যপক্ষ’ হয়ে যায়।কিন্তু কাল প্রসঙ্গে সে অধিকরণের সঙ্গেও সঙ্গতি রক্ষা করতে পারে,বাক্যের পদক্রম তথা বিন্যাসের কথা মনে না রাখলে এই সব তথ্যও আমাদের নজরে না পড়ে থাকে। যেমন—‘ক.১’ বাক্যটি এই ছিল—‘চোৰটোক বৰ শাস্তি দিয়া হ’ল।’বাক্যটি এমনও হতে পারত---চোৰটোক কালি থানাত বৰ শাস্তি দিয়া হৈছিল‘ঝ.১,২’ বাক্যে আমরা দেখিয়েছিলাম,আজ বেশ রোদ দিয়েছে’ এবং ‘কাল বেশ বৃষ্টি দিয়েছিল 

 উপরে যেসব উদাহরণ বাক্যের উল্লেখ করে এসেছি,সেগুলোর থেকে ‘কর্মবাচ্য’-এর বিভিন্ন প্রকারভেদের  নজির তাহলে হতে পারছে,এই বাক্যগুলো :

                        কর্মবাচ্য:            ঈ। ১ পুলিশ কর্তৃক চোর ধৃত হইয়াছে।

                                          বইটি আমার দ্বারা পঠিত হইয়াছে। (সাধু কাঠামোতে সংশোধিত)

                                    ঋ।১ পুলিশের হাতে চোর ধরা পড়েছে।

                                         বইটা আমার পড়া হয়েছে।

                             .সিল.পুলিশর আতো চুর ধরা পড়ছে।

                                        বইটা আমার পড়া অইছে।

                                     ক.১ চোৰটোক বৰ শাস্তি দিয়া হ’ল।

                                        আই-এছ-আই-ৰ এজেন্ট দুজন ধৰা পৰিছে।

                                     খ।১ পুলিছৰ হাতত চোৰ  ধৰা  পৰিল।

                                        কিতাপখন মোৰ পঢ়া হৈছে।

                                    উ। ১ মহাশয়ের কোথায় থাকা হয়?

                                         তোমার আজ কলকাতা যাওয়া হবে না।

                                        তোমায় দুটি ভাত খেতে হবে।

                              .সিল.থাকা অয় কই তে?

                                        তোমার আইজ করিমঞ্জ যাওয়া অইতো নায়।

                                        তোমারে দুইটা ডাইল-ভাত খাইতে লাগবো।

                                    ঞ.১ তোমাৰ আজি কলিকতা যোৱা নহ’ব।

                                         পিচে তোমাক  ভাত এসাজ খাবো লাগিবো।

                        এবং    .বাং. গোপালের  চিঠি এসে পৌঁছোলো/ এলো

                                 অস.  ৰামৰ̖  কাম̖ (কৰা) হ’ল। 

                                 সিল. গোপালর চিঠি আইছে।

                                         রামর কাম অইল।

                   সংযোজন নোয়া.১হোলাগা ল্যেয়া-হড়া কিছু না জাননে বউত কশ̖টে হ্যেতারে বিয়া করান̖ গেছিল̖

                                         (আঁর) কাম কইত্তে মন যায় না।২৯০         

                                        চট্টফোয়াউয়া ল্যেয়া ফরা কিছু ন জাননে বউত কশটে হিতারে  বিয়া করান̖ গেইল̖

            নৈর্ব্যক্তিক কর্মবাচ্য:  ঐ.১ ইয়াৰ পৰা হিমালয় পর্বত ৰিণিকি ৰিণিকিহে দেখি।

                                           নিস্তব্ধ হ’লেহে কথাবোৰ ভালদৰে শুনি।

                                           অঙ্কটো সহজে কৰিব পাৰি।

                                       ঔ.৭ আজ বিমানে চড়ে  পাখির মতো আকাশে উড়ে বেড়ানো যায়।

                                       সিল.আইজ কাইল পেলেইনো করি পাখির মতো আকাশো উড়িয়া বেড়ানি যায়।

                                        ক.৩ইয়াৰ পৰা হিমালয় পর্বত দেখা যায়।

                                            তোমাৰ গীত কেতিয়াবা ৰেডিঅ’ত শুনিবলৈ পোৱা যায়। 

                                         গ.১ এখান থেকে হিমালয় পর্বত দেখা যায়।

                                             তোমার গান কখনো  রেডিওতে  শুনতে পাওয়া যায়/ শোনা যায়।

                                     সিল. ইখান তনে বড়াইল পাহাড় দেখা যায়।

                                             তোমার গান কুনো সময় রেডিওত ফুনা/হুনা/ শুনা যায়।

                     সংযোজন নোয়া.  আইল্যার ঘণ্ট ক্যম্নে করতে হয়? ২৯১

                                            আইল্যা দিয়া কল্যাই ডাইল খাইতে বড় ভালা২৯২

    নৈর্ব্যক্তিক কর্ম-কর্তৃবাচ্য:      ঊ। ১ শঙ্খ বাজে।

                                              স্কুলের গেট খুলল।

                                    সিল.  শঙ্খ বাজে।

                                              ইস্কুলর গেইট খুলল।

                                         ঙ. বেপাৰীজনৰ কপাল ফুলিছে,টকাই টকা।  

                                             ল’ৰাটিৰ জ্বৰ উঠিছে।

                                             বৰষুণত নিতিতিবা,পাণী লাগিব।

      চ. দোকানিটির কপাল ফুলেছে, টাকাই টাকা।

                                             ছেলেটার জ্বর উঠেছে।

                                      সিল.দোকানি/ বেপারি ইটার কপাল ফুলছে, টাকাউ টাকা।

                                             ছেলেটার জ্বর উঠছে।

                                              ছ. ১আজি বৰ ৰ’দ দিছে।

                                              কালি বৰ বৰষুণ দিছিল।

                  জ.১লাঠি ভাঙিছে  

          শঙ্খ বাজিছে।

                  ঝ.১আজ বেশ রোদ দিয়েছে

          কাল বেশ বৃষ্টি দিয়েছিল।

               সিল.আইজ বাক্কা রউদ̖ দিছে।

                     কাইল বাক্কা বৃষ্টি দিছিল।

                       সংযোজন নোয়া.১ আইজ রোদ উঠব ভালা।২৯৩

                                            ব্যায়ান হৈ গেছে গৈ।২৯৪

                                              হেই খাইল̖ হিয়াঁন̖ কাডনের শোমে মাডী জেইগিন̖ বাইর̖ অইছিল̖ হেই মাডিগিন̖

                                                কোনাই গেল?

                                           চট্ট। হেই খাল̖লান কাডনর̖ শমত̖ মাডি জেইন̖ বাইর অই-ইল̖ হেই মাডিইন̖ কডে

                                               গেল̖?

সেই সঙ্গে আমাদের প্রস্তাব ‘কর্তৃবাচ্য’-এর একটি বিকল্প গঠনভেদঃ

         নৈর্ব্যক্তিক কর্তৃবাচ্য: ঔ.১এখান থেকে  হিমালয় পর্বত আমরা রোজ রূপোলি রেখার মতো দেখি।

                        সবাই ঘুমিয়ে গেলে,চারদিক নিস্তব্ধ হলে তবে ওবাড়ির কথাগুলো ভালোকরে শুনি।                                             এভাবে আমরা  অঙ্কটা  সহজেই করতে  পারি

                          এখান থেকে সকালে বাসে চাপলে বিকেলে গিয়ে পৌঁছুতে পারি।

                         আজ বিমানে চড়ে আমরা পাখির মতো আকাশে উড়ে বেড়াতে পারি।

                           ওরা বেশ ইচ্ছে করলেই বিমানে এদেশ ওদের ঘুরে বেড়াতে পারে।

                           সিল.ইখান তাকি হিমালয় পর্বত আমরা রুজউ রুপালি চুলোর জটার লাকান দেখি।

                                      অলাখান আমরা অঙ্কটা সুজাউ করতাম পারি।

বাচ্য সম্পর্কে পবিত্র সরকারের বিকল্প ভাবনা:

এইখানে এসে আমাদের কথা ফুরোতে পারতকিন্তু ফুরোলোনা এর জন্যে যে বাচ্য নিয়ে পবিত্র সরকার আগেই আরেক রকম ভেবেছিলেন। সে এতোটাই অন্যরকম যে এবং তাঁর আলোচনা এতোটাই বিস্তৃত যে এখানে প্রতিটি প্রসঙ্গ ধরে আলোচনা করলে আমাদের উপস্থাপনাতে জটিলতা আরো বাড়তে পারতআমরা তাই আলাদা করে সেটি উল্লেখ করবার জন্যে এই অব্দি অপেক্ষা করলাম।তিনি শুরুই করেছেন এরকম,“বাংলা ভাষার ক’টি ‘বাচ্য’ এবং সেগুলি কী কী – এ নিয়ে আজও কিছুটা বিভ্রান্তি লক্ষ করি২৯৫সুতরাং তাঁর আলোচনা দৃষ্টি আকর্ষণ না করে যায় না।কিন্তু এটি একটি বিচ্ছিন্ন প্রবন্ধ।পড়লে মনে হয়,মণীন্দ্র কুমার ঘোষের ১৩৩৯ বাংলাতে প্রকাশিত ‘বাংলা বানান’ বইতে এই নিয়ে কিছু লেখা থাকবে। সেটিকে পুনর্বিচার করতে গিয়ে লেখা।শুরুতেই বাংলা বাচ্যের সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বাংলা বাচ্য বিভাজন নিয়ে প্রশ্ন তুলে বাংলা বাচ্যকে মোটা দাগে পবিত্র সরকার যে দুই ভাবে ভাগ করেছেন,সে হচ্ছে ১) কর্তৃবাচ্য এবং ২)ভাববাচ্য।পরে অবশ্য এই দুয়ের আরো নানা প্রকার ভেদ দেখিয়েছেন।সুনীতিকুমার থেকে আমরা যেগুলোকে ‘কর্মবাচ্য’ জেনে এসেছি তিনি সেগুলোকে ‘ভাববাচ্য’-এ ঠেলেছেন।আর ‘কর্ম-কর্তৃবাচ্য’কে ঠেলেছেন ‘কর্তৃবাচ্য’-এ।অবশ্যই তাঁর পুরো প্রস্তাবনাটিই বিস্তৃত বিশ্লেষণ না করে চূড়ান্তভাবে বলা যাবে না,তাঁর এই বিভাজনটি সঠিক কী বেঠিক।হয়ত আমাদের সিদ্ধান্ত পাল্টাতেও হতে পারে।কিন্তু কিছু কিছু প্রসঙ্গ দেখে আমাদের মনে হয়েছে, এখনই অবস্থান পাল্টাবার কোনো কারণ নেই। সেটি কেন--- একে একে লিখছি

১) তাঁর এই বাচ্যের আলোচনাটি আছে ২০০৬এ প্রকাশিত ‘বাংলা ব্যকরণ প্রসঙ্গ’২৯৬ বইতে।আমরা আগেই লিখে এসেছি, ২০১১তে রফিকুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর যৌথ সম্পাদিত ‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’-এ বাচ্য বিষয়টি আছে ‘বাক্যতত্ত্ব’-এ। সে বইতে তাঁর কী বক্তব্য আমদের জানবার সুযোগ হয় নি।কিন্তু এখানে তিনি গঠনবাদ, রূপান্তরবাদকেও কাজে লাগাচ্ছেন,বুঝতে পারি।তারপরেও এখানে তিনি সুনীতিকুমারের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিচ্ছেন,“বাচ্যের ধারণার মূল ভিত্তি হল ভাষার ক্রিয়ার রূপভেদ।”২৯৭এবং সেখান থেকে তাঁর বক্তব্য,“মূল প্রশ্নটি হল: ক্রিয়ার কর্তা কে?ক্রিয়াটিকে কে নিয়ন্ত্রণ করছে?”২৯৮অর্থাৎ গোটা বিষয়টিকেই রূপতত্ত্ব,আরো স্পষ্ট করে লিখলে ‘ক্রিয়াতত্ত্ব’-এর বিষয় হিসেবেই দেখছেন।এবং তাঁকে অনুসরণ করে জগন্নাথ চক্রবর্তীও বিষয়টিকে রূপতত্ত্বেরই একেবারে শেষে আলোচনা করছেন।২৯৯আমরা যেভাবে লিখলাম,বিষয়টি রূপতত্ত্ব এবং বাক্যতত্ত্বের যৌথ বিষয়---এভাবে দু’জনের কাউকেই ভাবতে দেখা যাচ্ছে না।সুনীতিকুমার ছাড়াও  তিনি ক্রিস্টাল এবং ইয়েসপার্সনের দুইখানা ইংরেজি সংজ্ঞাও বিচার করে যে সব প্রাকসিদ্ধান্তে পৌঁছোন সেগুলো হচ্ছে এই এইঃ৩০০

ক. বাচ্যে ‘একই’ অর্থকে একাধিক বাক্যরূপের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা হয়;

খ. ঐ একাধিক বাক্যে ক্রিয়াটি অভিন্ন,শুধু তার রূপ আলাদা;

গ. রূপ আলাদা হওয়ার কারণ,এক-এক বাক্যে তার ‘কর্তা’ এক –এক রকম;কর্তৃবাচ্যে কর্তা হলো যে ক্রিয়াটি

    সম্পাদন করে সেই ব্যক্তি বা প্রাণী;আর কর্মবাচ্যে ‘কর্তা’ হয়ে ওঠে যে ব্যক্তি,প্রাণী বা বস্তু ক্রিয়ার

    সম্পাদনের লক্ষ্য বা হেতু---সে।

ঘ. বিভিন্ন ভাষার বাচ্যের শ্রেণি ও প্রকরণ হুবহু এক নাও হতে পারে।

এই প্রাক সিদ্ধান্তগুলোকে তিনি প্রশ্ন করছেন না।বরং এই সূত্রগুলো প্রয়োগ করেই,বিশেষ করে ‘খ’ এবং ‘গ’ তিনি বিচার করছেন বাংলা বাচ্য সুনীতিকুমারের বিভাজন মেনে চলে কিনা।এবং সিদ্ধান্তে যাচ্ছেন বাংলাতে কর্মবাচ্য নেই। 

২) যদিও লিখছেন ‘ক্রিয়ার রূপভেদ’ই হচ্ছে বাচ্যের ধারণার মূল ভিত্তি,এক জায়গাতে কিন্তু লিখছেন,“ কর্তা-কর্ম আর ক্রিয়া –বাচ্য নির্ণয়ে এই তিনটির রূপ আর ভূমিকাই আসল৩০১এ হচ্ছে আমরা বাক্যের যতপ্রকার গঠনভেদের কথা লিখে এলাম তার সবগুলোরই গোড়ার কথা।তিনি বাচ্য নির্ণয়েও হঠাৎ করে স্বীকার করে নিচ্ছেন।শুধু তাই নয়, যেহেতু অনেক রকম বাক্য নিয়ে বিশ্লেষণ করছেন বহু সময়ই রূপতত্ত্বের সীমা ছেড়ে স্পষ্টতই বাক্যতত্ত্বে প্রবেশও করছেন।এক জায়গাতে বাক্যনির্মাণের প্রয়োজনে কীভাবে অসমাপিকা তৈরি হয় দেখাতে গিয়ে লিখছেন,“‘হঠাৎ শাঁখ বেজে উঠল’ বাক্যে ‘বেজে’ এই অসমাপিকা রূপ ‘বেজে উঠা’ ক্রিয়ার অংশ,তা বাক্যের প্রয়োজনে নতুন করে তৈরি হয় নি।কিন্তু ‘আমি খেয়েছি’র বদলে যখন বলি ‘আমার খাওয়া হয়েছে’ তখন ‘খাওয়া’ এই অসমাপিকা রূপ তৈরি হয় বাক্য-নির্মাণ বা বিবক্ষার প্রয়োজনে।”৩০২

৩) কিন্তু গোটা নিবন্ধে সন্ধান করে যাচ্ছেন,বাক্যের ‘কর্তা’ কে?সেদিক থেকে তাঁর অনুসন্ধানটিও আমাদেরই মতো ‘কর্তাকেন্দ্রিক’ বলে দাবি করতেই পারি।মণীন্দ্র কুমার প্রশ্ন করেছিলেন,‘প্রহরী কতৃক চোর ধৃত হল’ এই বাক্য কর্মবাচ্য হবে কেন?প্রশ্নটা পবিত্র সরকারেরও।যদিও দুজনেই বাক্যটি বাংলা কতটা সেই প্রশ্নও সঠিক ভাবেই তুলেছেন। কিন্তু কর্ম বাচ্য নয় কেন? কারণ,কাঠামোর দিক থেকে ‘চোর ধৃত হলো’ বাক্যাংশটি ‘চোর খুশি হলো’,‘চোর বড়ো হলো’ এরকম বাক্যের মতো একই।সুতরাং সেগুলো যদি কর্তৃবাচ্যের হয়,‘ধৃত হলো’ বাক্যটি কেন নয়---এই তাঁদের প্রশ্ন। অর্থাৎ এই ‘চোর ধৃত হলো’ এবং ‘চোর খুশি হলো’--- এই দুই বাক্যেরই কর্তা ‘চোর’‘চোর’-এর পক্ষ অন্য তাই ক্রিয়ারও পক্ষ অন্য---এই হচ্ছে মোটামুটি যুক্তি।৩০৩কিন্তু ‘পুলিশ কর্তৃক’ প্রসঙ্গটি বিবেচনার বাইরে রইল। তেমনি ‘এই জল খাওয়া যায়’ বাক্যে ‘কর্তা’ হচ্ছে ‘এই জল খাওয়া’ এই বাক্যাংশটি।“এই কাজের পেছনে যুক্তি হলো বাক্যটায় ক্রিয়া আর কর্তা কে সেইটা বুঝে নিয়ে সিদ্ধান্ত।ক্রিয়াকে যে নিয়ন্ত্রণ করছে সেই কর্তা।”৩০৪ এরকম বাক্যে ক্রিয়ার কর্তা হচ্ছে একটি ‘ভাব’“ভাব কথাটার অর্থ হচ্ছে এখানে একটি action বা ঘটনাএক্ষেত্রে ঘটনাটার উপরে জোর পড়ছে। কে ঘটনা ঘটাচ্ছে তার উপরে নয়... ‘ভাব’ বাক্যের কর্তা বলেই তা ভাববাচ্য।”৩০৫মোটামুটি এরকম একটা ব্যাখ্যার উপরে দাঁড়িয়েই তাঁর সিদ্ধান্ত “কর্মবাচ্য বাংলায় নেই।”৩০৬ এবারে,আমরা যে ‘ভাব অর্থাৎ ক্রিয়া’ বলেই বাচ্যকে বলে ‘ভাব’ জেনে এসেছিলাম--সেই কথাটার থেকে অনেকটাই সরে আসতে দেখছি পবিত্র সরকারকে।এবারে জানা গেল ‘ভাব কথাটার অর্থ হচ্ছে একটি ঘটনা এবং  ভাববাচ্যে ঘটনাটার উপরে জোর পড়ছে।’ একই কথা আমরাও সামান্য ঘুরিয়ে লিখেছিলাম,“কর্তার উল্লেখটাতো গুরুত্বপূর্ণ নয়,আসল কথা,কাজটা কী হলো।অর্থাৎ কর্ম এবং ক্রিয়া।” আরো স্পষ্ট করে লিখতে পারি,কে করছে প্রশ্নটি বড় নয়,বড় হলো কী হচ্ছে,হলো বা হবে ?

৪) তা হলে আমাদের এবং পবিত্র সরকারের ‘কর্তাকেন্দ্রিকতা’-র মাঝে তফাৎ কোথায়?তিনি যখন লিখছেন,‘ক্রিয়াকে যে নিয়ন্ত্রণ করছে সেই কর্তা’ তখন আসলে সেই নির্দিষ্ট বাক্যের গঠনটির কথাই ভাবছেন।ফলে তাঁর মনে হচ্ছে ‘চোর ধৃত হলো’ এবং ‘চোর খুশি হলো’ একই গঠনের বাক্য।‘এই জল খাওয়া যায়’ আর ‘মধু  যায়’ (এই বাক্য আমাদের) দুইই একই গঠনের বাক্য।তবু যেহেতু অর্থের দিক থেকে ‘এই জল খাওয়া’ কোনো ব্যক্তি নয়,বা সে  আদৌ ‘যাবে’ না,তাই সে ‘ভাব’,কিন্তু কিছুতেই কর্ম নয়।কর্ম এই সব বাক্যে নেই -- এই হচ্ছে সিদ্ধান্ত।অন্যদিকে আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে ‘ক্রিয়াকে যে নিয়ন্ত্রণ করছে সেই কর্তা’ অবশ্যই।কিন্তু সে যে কোনো কর্তৃবাচ্য সম্পর্কেই সত্য।তার উপরে,অনেকে যে ভাবে ভাবেন ‘কর্মবাচ্য’-এ ‘কর্ম’ই ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে---সেই মত পবিত্র সরকার মানতে চাইছেন না।আমরাও তাঁর মতোই মানতে পারিনি।এই অব্দি ঐক্য আছেকিন্তু সেজন্যেই তিনি যেখানে ‘কর্ম’-কেই বাদ দিয়েছেন,আমরা সেখানে ‘ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ’-এর প্রসঙ্গটিকেই ভুলে যাবার পক্ষে।আমরা দেখিয়েছি,ক্রিয়াকে অধিকরণও নিয়ন্ত্রণ করে।আমরা যা লিখেছিলাম,সে এরকম,“‘কর্মবাচ্য’ এবং ‘কর্তৃবাচ্য’-র মৌলিক তফাত এই নয় যে ক্রিয়া কর্তা-কর্মের মধ্যে কাকে অনুসরণ করে তার রূপ বদলায়। মৌলিক তফাত হলো ‘কর্তা’ এখানে গৌণ ভূমিকাতে চলে যায়। উল্লেখ থাক বা না থাক  নির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট কর্তা রয়েছে বোঝা যায়।” যেগুলোকে আমরা কর্মবাচ্য বলছি এবং তিনি ভাববাচ্য বলছেন তার অধিকাংশেরই যদি বাচ্যান্তর করে ফেলা যায়,তবেই অর্থের দিক থেকে স্বাভাবিক কর্তা-কর্ম-ক্রিয়ার সন্ধান স্পষ্ট পাওয়া যাবে।তখন স্পষ্টই জানা যাবে যে ‘চোরকে পুলিশ ধরেছে’,সুতরাং পুলিশই ‘কর্তা’চোর কর্ম।‘অনেক টানাটানি করে দরজাটা খুলল’---বাক্যকে এভাবে পাল্টানো যাক --‘আমি/তুমি/সে অনেক টানাটানি করে দরজাটা খুললাম/খুললে/খুলল।’তবেই কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া স্পষ্ট সামনে চলে আসবে।অর্থাৎ রূপান্তরবাদী ব্যাকরণের তত্ত্বের পরিভাষাতে বলতে পারি,কর্মবাচ্যে কর্তা-কর্মের আসল স্বরূপ তার উপরিগঠনে (Surface Structure)--এ ধরা যাবে না;অন্তর্গঠনে (Deep Structure)-এ ধরতে হবে।তার জন্যে যথা সম্ভব কর্তৃবাচ্যে রূপান্তর করাই হবে সঠিক পদ্ধতি। তিনি যখন ‘কর্তৃ-কর্মবাচ্য’-কে ‘কর্তৃবাচ্য’-এ ঠেলছেন, তখনো দেখা যাচ্ছে ‘ঝ-বাক্য’-এর মতো কোনো নজির তাঁর ভাবনাতে আসে নি।এলে নিশ্চয় ভাবতেন ‘রোদ/বৃষ্টি’ যখন দেয় তখন সেগুলো কর্তা হয় কী করে? ‘জ্বর-শঙ্খ’ না হয় হলো।

৫) রূপতো শুধু ক্রিয়ারই পাল্টায় না।‘এই জল খাওয়া’-র মতো বাক্যাংশ ছাড়াও কর্তা কর্মে কর্ম-সম্বন্ধ-করণ-অধিকরণের পরসর্গ বা পরপদ বদল নিয়েও তাঁকে ভাবতে হয়েছে।ক্রিয়ারও সবটা পাল্টায় না।বিশেষ করে পরপদের রূপ বাচ্যের জন্যে কিছুই পাল্টায় না আমরা দেখিয়ে এসেছি।এর জন্যেই বাকি ব্যাখ্যা আমরা যেভাবে দিয়ে এসেছি, এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছি,তা এখনি পাল্টাবার কারণ মনে করছি না।        

            বাচ্যের আমরা যেভাবে বিভাজন করলাম,সেই পদ্ধতিতে আমরা যখন মান বাংলা এবং মান অসমিয়া ছাড়া অন্যান্য ভাষাবৈচিত্র্যগুলোর নজির সন্ধান করছিলাম,বা বসিয়ে যাচ্ছিলাম এক নতুন অভিজ্ঞতা আমাদের হলোনানা সূত্র থেকে বাক্য আমাদের সংগ্রহ করতে হয়েছে। যেগুলোর সূত্রের উল্লেখ নেই সেসব এই অধ্যায়ে পুরোটাই রবীন্দ্র কুমার দত্তের বইতে একেবারে শেষে ‘বোকা জামাতার গল্প’ থেকে নেয়া।৩০৭আমরা শুধু কাজটি সহজ করবার জন্যে তাঁর বাংলা ধ্বনি চিহ্ন অনুসরণ করিনি।এই মাত্র।দেখা গেল,কোনো বাক্যের বাচ্য কী হবে,সেই নিয়ে ভাবতে আমাদের কোনো সমস্যাই হয় নি।কারণ আমরা শুধু ‘কর্তা’টি কে আর কোন অবস্থানে,-- অর্থাৎ অর্থের দিক থেকে মুখ্য না গৌণ,আছে সেসব দেখছিলাম। ব্যক্তিক না নৈর্ব্যক্তিক, প্রাণী বা অপ্রাণী সেইসবই বিবেচনাতে নিচ্ছিলাম। বোধ করি,আরো আরো ভাষাবৈচিত্র্য জুড়ে গেলেও আমাদের একই অভিজ্ঞতা হতরবীন্দ্র কুমার দত্ত ‘বাচ্য’-কে বাক্যতত্ত্বেই আলোচনা করেছেন।৩০৮এটি একটি ব্যতিক্রমকিন্তু শুরু করেছেন ‘বাক্য’-এর সুনীতিকুমারের দুই সংজ্ঞার পুরোনোটি ধরে।তিনি রামেশ্বর শ’ পড়েছেন,বাদবাকি বাক্যতত্ত্বের সবেতেই তাঁকেই অনুসরণ করেছেন।কিছু কিছু উদারহণ বাক্য দেখলেই বোঝা যায়।তারপরেও সুনীতিকুমারের দ্বিতীয় সংজ্ঞাটি নজর এড়িয়ে গেছে।এহ বাহ্য।পুরো অবস্থানই যেটুকু আমরা জেনে এলাম সেরকমই।এবং বাক্যতত্ত্বে ‘বাচ্য’-কে রাখবার পরেও ভাবনাটি সেই ‘ক্রিয়াকেন্দ্রিক’ফলে তিনি স্বাধীন ভাবে ‘কর্মকর্তৃবাচ্য’-এর নজির দিতে পারেন নি।হয়তো দরকারও মনে করেন নি।সেই ‘ভাঙ̖’ এবং ‘ছিঁড়̖’ ধাতু দিয়ে সুনীতিকুমার,বাণীকান্ত হয়ে যে ধারা চলে আসছে তাকেই অনুসরণ করে দুই বাক্য এমন লিখে গেছেন:

                        ক.নোয়া-চট্ট.ঠাঁশ ঠাঁশ করি বাঁশ ভাঙের।

                                 নোয়া। কাবর গান ছিঁড়ি গেছে।

                                    চট্ট। খওরগান ছিরি গেইয়ে।৩০৯

            আমরা ইচ্ছে করেই নিজেদের সিদ্ধান্ত পরীক্ষা করতে গিয়ে অন্য নজির সন্ধান করেছি।তাতে আমাদের ভাষা দুটির উপরে সেরকম দখল না থাকলেও অসুবিধে বিশেষ হয়েছে বলে মনে হলো না।

 

।। কালিক ভাষা বিজ্ঞান এবং বাংলা-অসমিয়া ভাষা ও সিলেটি সহ ভাষাবৈচিত্র্য গুলো ।।

            বস্তুত অসমিয়া-বাংলা বাক্যতত্ত্বের আলোচনা আমরা এক রকম সেরে এসেছি বলেই দাবি করতে পারি। কালিক অথবা রূপান্তরমূলক সৃজনমূলক ব্যাকরণ ধরে পুরো বিষয়টি আলোচনার সমস্যা এবং সীমাবদ্ধতার কারণগুলো আমরা আগেই লিখে এসেছি।তাত্ত্বিক প্রসঙ্গেই বাইরে আমাদের সামনে প্রায়োগিক দিশা বলে কিছু নেই বললেই চলে।তার উপরে যে রূপকল্প ধরে এগুচ্ছি তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভাষা বা ভাষাবৈচিত্র্যগুলো নিয়ে তো আরো নেই।কিন্তু রামেশ্বর শ’ যে লিখেছিলেন, ‘ঐতিহ্যাগত ব্যাকরণের বাক্যতত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গি ঐতিহাসিক ছিল না,মূলত এককালিক বর্ণনামূলকই ছিল’৩১০ এই কথাটি আবারও মনে পড়ে যখন দেখি,যে গোলোকচন্দ্র গোস্বামী কিংবা জগন্নাথ চক্রবর্তীর বাক্যতত্ত্বের আলোচনাতে দুই ধারা প্রায় কোনো তফাত রেখা স্পষ্ট না রেখেই মিলেমিশে গেছে। গোলোকচন্দ্র গোস্বামী যখন ‘আসত্তি’র ব্যাখ্যা করছেন তিনি তখন বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানকে কাজে লাগাচ্ছেন বলেই ধারণা হয়।জগন্নাথ চক্রবর্তী তো রূপান্তর মূলক সৃজনমূলক ব্যারকণকেও প্রয়োগে আনবার চেষ্টা করেছেন।

গ্লীসনের সমর্থন নিয়ে রামেশ্বর শ’ বলতে চাইছিলেন,“The distinction between morphology and syntax is not always sharp.”৩১১ এর জটিলতা যে কী ভীষণ বোঝা যায় লিওনার্দ ব্লুমফিল্ডের Syntax অধ্যায়ের শুরুতে করা এই মন্তব্যের থেকে।তিনিও লিখছেন,There has been considerable debate as to the usefulness of this division,and as to the scope of the two headings.৩১২এও উল্লেখ করা ভালো যে ব্লুমফিল্ডের ‘Morphology’অধ্যায়টি ছিল ‘Syntax’-এর পরে,আগে নয়।মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানী চার্লস হকেট তবু একটা বিভাজন রেখা স্পষ্ট করবার চেষ্টা করেছেন এরকম,“Morphology includes the stock of segmental morphemes,and the ways in which words are built out of them.Syntax includes the ways in which words,and spurasegmental morphemes,are arranged relative to each other in utterances.৩১৩ জগন্নাথ চক্রবর্তীতে৩১৪ তাই দেখব বাক্যতত্ত্বের আলোচনাতে আবারও সেই রূপতত্ত্বের কথা পাড়ছেনসুতরাং আমাদের উপস্থাপনাটি যদি ‘অবতারণা’ মাত্র হয়—সেও অধ্যয়নক্রমটি ধরে রাখবার জন্যে দরকারি বলেই আমাদের মনে হয়। পদ্ধতিটির কার্যকরীতা নিয়ে হুমায়ুন আজাদ এবং রামেশ্বর শ’ যেটুকু লিখেছেন,তার কম বা বেশি আমরা সিদ্ধান্ত নেবার জায়গাতে নেই।

            এইখানে,আমরাও মনে হয় একটি বিষয় স্পষ্ট করতে পারি যে আমাদের এই সম্পূর্ণ অধ্যয়নে যদিও আমরা প্রাসঙ্গিক ইতিহাসের কথা উল্লেখ করে গেছি মূলত আমাদের অনুসন্ধান থেকেছে চরিত্রের দিক দিয়ে ‘কালিক’ অর্থাৎ Syncronicএক নির্দিষ্ট স্থানে কালে আমরা ভাষাগুলোকে স্থির ধরে নিয়েই তাদের মধ্যে পারস্পরিক তুলনা করে গেছি।ভাষাতো সেরকম স্থির কিছু নয়।স্থানে কালে রূপ পাল্টাতেই থাকে।আমরা যেমন অসমিয়া ভাষার ভেতরে বিভিন্ন ভাষাবৈচিত্র্যের মধ্যে তুলনাটি বিস্তৃত আলোচনা করি নি,তেমনি চর্যা বা প্রাক চর্যা আমল থেকে তার ইতিহাসের নানা সময় ধরে পরিবর্তনের পথরেখা নিয়েও বিস্তৃত অধ্যয়নে যাই নি।একই কথা মান বাংলা ভাষা বা সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্য নিয়েও সত্য।সিলেটি নিজেও একটি মাত্র ভাষাভেদ তথা বৈচিত্র্য নয়।তার ভেতরেও রয়েছে নানা বৈচিত্র্য। যেমন কাছাড়ে যদি ‘মুই’ বলে,করিমগঞ্জে তথা সদর সিলেটে বলে ‘আমি’কাছাড়ে যদি ‘যাইবা’,হবিগঞ্জে তবে ‘যাইবাইন’হবিগঞ্জে বা মৌলবি বাজারে যেসব  অপিনিহিতি হয় ---যেমন ‘কইর‍্যা, লাইগ্যা’ বাকি সিলেটে বা কাছাড়ে সেরকম হয় নাসুতরাং আমাদের কাজটি হয়েছে,অনেক কিছুই স্থির ধরে নিয়ে।পরম্পরাগত ব্যারকরণও তাই করে।কিন্তু সেই স্থৈর্য কখনো বা জড়তার নামান্তরে গিয়ে দাঁড়ায়অন্যথা ‘পুলিশ কর্তৃক চোর ধৃত হয়েছে’-- ধরণের ‘গুরুচণ্ডালী’ দোষে দুষ্ট বাক্যের মুখোমুখি আমাদের হতে হবে কেন?পরম্পরাগত ব্যাকরণ যেন ভাষা নয়,তার অনুশাসনের সঙ্গে পরিচয় ঘটায়।অনুশাসন যেন ভাষার গতিশীলতাকে হয় ভুলে থাকে,অথবা ভুলে যাবার পরামর্শ দেয়।ফলে সেই ব্যাকরণের শিক্ষা অনুসরণ করতে গিয়ে বরং লোকে অন্যথা যে প্রয়োগ শুদ্ধ ভাবেই করতেন হয়তো বা,সেগুলোকেও ভুল প্রয়োগ করে।বাঙালির প্রথাগত বিয়ের চিঠি  কিংবা সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে সেই ভাষা আকছার মেলে।অথবা মুখের ভাষা নয়,সাহিত্যের ভাষাতেই তার আগ্রহ। সেদিক থেকে সে নিজেকে বাস্তবতার থেকে বিছিন্ন করে।তার বিপরীতে কালিক  ভাষাবিজ্ঞান সমষ্টিতো বটেই, প্রতিটি ব্যক্তি মানুষের মুখে ভাষার বৈচিত্র্য নিয়ে ওয়াকিবহাল থেকেই কোনো এক ব্যক্তি বা শ্রেণি বা গোষ্ঠী বা লিঙ্গ বা ভাষাগোষ্ঠীর ব্যবহৃত ভাষার এক নির্দিষ্ট সময়ের স্বরূপ আলোচনা করে।ফলে পরম্পরাগত ব্যাকরণের থেকে তার সম্ভাবনা ব্যাপক হয়ে পড়ে।

আলোচনার সুবিধের জন্যে আমরা যদিও পরম্পরাগত ব্যাকরণ, ভাষাবিদ্যা এবং ঐতিহাসিক বা Diacronic ভাষাবিজ্ঞানের উল্লেখ পাশাপাশি করে গেছি,সে দু’টিও মূলত এক নয়। কেননা,ভাষার গতিশীলতার ধারণাটিতো ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানেরই।তার সীমাবদ্ধতা হলো,সেই গতির স্বরূপ অধ্যয়ন করতে গিয়েও সে পরম্পরাগত ব্যাকরণের সংজ্ঞা বা পরিভাষাগুলোকে ধরেই এগিয়েছে।তার নিজস্ব পরিভাষা সে ঐ ভাষাপরিবার দেখাবার ‘বৃক্ষআদল’ (Tree Model) এর মতো কিছু বিষয় বাদ দিলে অতিঅল্পই নির্মাণ করেছে।কালিক ভাষাবিজ্ঞান কিন্তু সেটি করেছে,যদিও পরম্পরাগত ব্যাকরণ এবং ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান থেকে বহু ঋণও নিয়েছেবহু সময় দেখা যাবে শুধু নামই যেন ভিন্ন, বিষয়তো একই।তার পরেও এটা সত্য যে নিজের পরিসর এত বিস্তৃত করেছে যে বাস্তবে শুধু বাক্য নিয়েও আমাদের এতো ছোট এবং সরল পরিসরে সব কথা স্পষ্ট করাই কঠিন।এই প্রসঙ্গটি বাদ দিলে কালিকভাষা বিজ্ঞান যেভাবে ইতিহাসের প্রসঙ্গকে নিজের অধ্যয়নের বাইরে রাখে,ঐতিহাসিক ভাষা বিজ্ঞান কিন্তু সেটি করে না।যাঁর হাতে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের সূচনা সেই ফার্দিনান্দ দু স্যসুর ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানকে বাতিল করেন নি।তিনি নিজেও এই ধারারই ছাত্র ছিলেন।তিনি শুধু পদ্ধতিটির কিছু সীমাবদ্ধতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে কালিক ভাষাবিজ্ঞানের তত্ত্বটিকে দাঁড় করিয়েছিলেন।তাঁর ‘সাধারণ ভাষাবিজ্ঞানের পাঠক্রম’ বইটির একটি অধ্যায়ের তথা তৃতীয় খণ্ডের নামই ‘কালক্রমিক ভাষাবিজ্ঞান’ তথা ‘Diachronic Linguistics’সে বইতে এক জায়গাতে তিনি দুই ধারার তফাৎ স্পষ্ট দেখিয়েছিলেন এরকম,তাও তাঁর নিজের আলোচনা পদ্ধতি কী হবে---শুধু সেটুকুই বোঝাতে,“Synchronic Linguistics will be concerned with the logical and psychological relation that bind together coexisting terms and forms in the collective mind of the speakers.Dicachronic linguistics,on the contrary,will study reletions that bind together successive terms not percieved by the collective mind but substituted for each other without forming a system.”৩১৫ তিনি শুধু কালানুক্রমিক ভাষাবিজ্ঞানকে ‘ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান’ বলতে অস্বীকার করছিলেন এর জন্যে যে ইতিহাসের মতো দিন ক্ষণ ধরে ভাষার পরিবর্তন ব্যাখ্যা করা যায় না।তার বদলে ‘বিবর্তনীয় ভাষাবিজ্ঞান’ বলতে চাইছিলেনতাঁর অনুবাদক ওয়াড বাসকিন লিখেছেন,‘Evolutionary Linguistics’,অন্যটিকে ‘স্থির ভাষাবিজ্ঞান’ বা ‘Static Linguistics৩১৬তবে তাঁর এই সব পরিভাষা জনপ্রিয় হয় নি,হয়েছে কালক্রমিক এবং কালানুক্রমিক।কিন্তু তাঁর অনুগামী লিওনার্দ ব্লুমফিল্ড ‘Language’ বইতে ‘The Comparative Method’ বলে অষ্টাদশ অধ্যায়টি রেখেছিলেন,পদ্ধতিটিকে বাতিল করবার যুক্তি দেখাতে।কিছু প্রশ্ন  তিনি যথার্থই তুলেছিলেন  বলে মনে হয়,যেমন আদি-ইন্দোইউরোপীয় ভাষা বলে আদৌ কিছু ছিল কিনা,আদৌ কেউ এই ভাষাতে কথা বলত কিনা ইত্যাদি।এসব ভাষারূপের পুনর্গঠন সেকালের ভাষাবিজ্ঞান-বহির্ভূত ইতিহাসে আলো ফেলতে পারে,ভাষা চেনাতে পারে না---এসব তিনি লিখেছেন।৩১৭তিনি যেটি লক্ষ করেন নি বলে মনে হয়েছে,সে হলো ভাষাবিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ইতিহাসের অধ্যয়নে আলো ফেলাটাও কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ নয়।ডারউইনের অধ্যয়ন পদ্ধতিতেও এর প্রভাবের কথা ভাষাবিজ্ঞানীরা দাবি করে থাকেন,আমরা আগের অধ্যায়ে দেখিয়ে এসেছি।কিন্তু ভাষাবিজ্ঞানের দিক থেকেও সে যে কালিক ভাষাবিজ্ঞানকে সহজেই নিজের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলতে পারে—এসবকে তিনি দেখেও খুব গুরুত্ব দিতে চান নি।বস্তুত এটা না করলে ঐতিহাসিক বা তুলনামূলক পদ্ধতির কাজই চলে না।তাই আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের জন্মের আগে থেকেই নিজের মতো করে বেদের কালের ভারতীয় আর্য বা আবেস্তার কালের ইরানীয় বা হোমারের কালের গ্রীক বা সম্রাট অশোকের কালের প্রাকৃত বা পালি ভাষার স্বরূপের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে। সেকালের মুখের ভাষার সঙ্গে যে সবটা পরিচয় ঘটাতে পারে নি সেসব সে অস্বীকারও করেনি।হয়তো পদ্ধতি বা পরিভাষার সবটা আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের ছিল না কিন্তু ভারতের সব ভাষাই সংস্কৃতের থেকে এক অদ্ভুত প্রক্রিয়াতে সরাসরি এসছে বলে আজও যেভাবে অনেকে বিশ্বাস করেন,সেই বিশ্বাসের জায়গাটিকে বিশাল প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ভাষাগুলোর স্বাধীন উৎস,সেসব যদি কোনো ‘সাধারণ উৎস’ও হয়,এক স্বাধীন অনুসন্ধানের সূচনা যে করে দিতে পেরেছিল তাকে কী করে অস্বীকার করা যাবে?বিপরীতে কালিক ভাষাবিজ্ঞানও আর ভাষার গতিশীলতার বিষয়টিকে নিজের অধ্যয়নের বাইরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে বা চাইছে না। সেসব অবশ্য ব্লুমফিল্ডের সহযোগী বন্ধু এডোয়ার্ড স্যাপীরই চান নি।তাঁর হাত ধরেই ‘নৃতাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞান’-এর মতো এক চমৎকার শাখা বিকশিত হয়।কিন্তু তার পরেও বহুদিন কালিক(Synchronic) এবং বর্ণনামূলক (Descriptive) ভাষাবিজ্ঞানকে পরস্পর প্রতিশব্দই মনে করা হত,ব্লুমফিল্ড পরবর্তী সাম্প্রতিক কালের  মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানী চার্লস হকেট এই দুইকেও পৃথক করেছেন এই লিখে,“Descriptive linguistics deals with the design of the language of some community at a given time,ignoring interpersonal and intra-group differences.Such differences are always to be found in any language spoken by more than one person,since no two people have exactly the same set of speech habits.Synchronic linguistics includes descriptive linguistics,and also certain further types of investigation,particularly synchronic dialectology,which is the systematic study of inter-personal and inter-group differences of the speech habits.”৩১৮ হকেটের বাক্যতত্ত্বের আলোচনাতে দেখা যাবে তিনি মূলত ইংরেজির উপর নির্ভর করে আলোচনা করে গেলেও  ইউরোপের অন্যান্য বেশ কিছু ভাষাকেতো ছুঁয়েছেনই শুরুতেই তাঁর তাত্ত্বিক ভিত্তি দাঁড় করাতে চীনা ভাষার প্রসঙ্গ না টেনে নিজের কথাগুলো স্পষ্ট করতে পারছেন নাতাঁর এমন এক ভাষার দরকার পড়ছিল যার সঙ্গে কাঠামোগত ভাবে ইংরেজির সামান্যতমও মিল নেই।তাঁর ‘Grammatical Systems’ অধ্যায়ের প্রথম উপ-অধ্যায় ‘immediate constituents’-এই সেটি নজরে পড়বে।তাঁর সেই অধ্যয়ন খুবই চিত্তাকর্ষক ছিল,আমাদের বাংলা-অসমিয়া ভাষাবিদ্যার অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলানো খুবই কঠিন। সেসবে আপাতত যাচ্ছি না।

            হকেটের কথাগুলো যদিও স্পষ্ট,আমাদের কাছে বিষয়টি ইতিমধ্যেই বেশ জট পাকিয়ে গেছে।সম্পর্কগুলো বোঝাবার জন্যে ড দয়ানন্দ পাঠক একটি ছক প্রস্তুত করেছিলেন চিত্র -০৫-এর মতো।৩১৯ তিনি যদিও লিখেছেন ছবিটি,“ ...আমাক এই সম্পর্কে এক স্পষ্ট ধারণা দিব।”আমাদের কাছে কিন্তু তারপরেও প্রশ্ন ‘সমকালিক’,‘ক্রমকালিক’, ‘তুলনাত্মক’ এবং ‘ঐতিহাসিক’ শব্দগুলো ছকে দুবার করে এল কেন?আর ‘পরম্পরাগত ব্যাকরণ’-এর কথাটি কেন রইল বাইরে?ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান কি তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞান থেকে স্বতন্ত্র কিছু?সমকালিক ভাষাবিজ্ঞান কি তুলনামূলক অধ্যয়ন করে না কিছুই?আমরা একটি বিকল্প ছকের কথা ভেবেছিলাম।কিন্তু দেখা গেল সেরকম কিছু অস্পষ্টতা কিংবা প্রশ্নের জায়গা  সব সময়েই থাকা সম্ভব।


আমরা শুধু আমাদের অধ্যয়নের রূপকল্প সম্পর্কে বলতে পারি এটি-- মূলত কালিক,কিন্তু একাধারে তুলনামূলক  এবং কালানুক্রমিক (ঐতিহাসিক) পদ্ধতির রূপকল্প।তুলনাটি কালক্রমে এবং একই কালে হতে পারে মনে রাখলে আমাদের অধ্যয়ন পদ্ধতিকে সংক্ষেপে ‘কালিক এবং কালানুক্রমিক’ বলাই যথার্থ,যেটি শিরোনামে রয়েছে।  ধ্বনিতত্ত্ব এবং রূপতত্ত্বে বাংলা অসমিয়াতে আমাদের আগেই কাজ কিছু হয়েছে,সিলেটিতেও হয়েছে আমাদের তাই সেখানে কালিক ভাষাবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক অর্জন ধরে অধ্যয়নে অসুবিধে বিশেষ হয় নিকিন্তু শব্দার্থতত্ত্ব এবং বাক্যতত্ত্বে সেরকম কাজ বিশেষ হয়নি বলেই আমাদের নির্ভরতার বেশিটাই থেকেছে কালানুক্রমিক ভাষাবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক ভিত্তির উপর।এইটুকুনই যা।অন্যথা,শব্দার্থতত্ত্ব বা বাক্যতত্ত্বেও আমরা শুরু থেকেই কালিক পদ্ধতিটি যুগপৎ অনুসরণ করে গেছি। এই দুই পদ্ধতিকে বোঝাবার স্যসুরের একটি বিখ্যাত রেখাচিত্র রয়েছে এরকম,সেটি তুলে দিলে বোধ করি বুঝতে সুবিধে হবে।এই চিত্র ০৬-এ ‘আ-আ’ হচ্ছে ‘কালিক ভাষাবিজ্ঞান’-এর গতিপথ,আর ‘ক-খ’ ‘কালানুক্রমিক ভাষাবিজ্ঞান’-এর গতিপথ।৩২০               

  

 

কোনো পূর্বাধিকার ছাড়াই আমরা কেন বাক্যতত্ত্বের আধুনিক অর্জনগুলোকে স্বাধীন ভাবে কাজে লাগাতে পারি না,তার বাস্তব কারণটি সামান্য ব্যাখ্যার দাবি রাখেরামেশ্বর শ’ কালিক ভাষাবিজ্ঞানের বাক্যতত্ত্বের অধ্যয়ন পদ্ধতিটির পরিচয় দিয়েছেন তাঁর ‘সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা’ বইটির ৪২১ থেকে ৪৩৯ এই উনিশ পৃষ্ঠাতে৩২১ তাঁর সমগ্র বইতে ইংরেজি,জার্মান ভাষারও তুলনামূলক অধ্যয়ন ছিল।কিন্তু এই প্রসঙ্গে এসে সেসব বাদ দিয়ে শুধু মান বাংলা ভাষাটিকে ধরেই তত্ত্বটির সঙ্গে আলাপ করিয়েছেন।সস্যুরের দুই শতাধিক পৃষ্ঠার বইতে ‘বাক্যতত্ত্ব’ বলে আলাদা কোনো অধ্যায় নেই।লিওনার্দো ব্লুমফিল্ড যে বাক্যতত্ত্ব অধ্যায়েই সবটা সারেন নি,তাঁর কথাতেই আমরা ইঙ্গিত আগে দিয়েছি।যদি দশম অধ্যায় ‘Grammatical Forms থেকে পঞ্চদশ অধ্যায় ‘Substitution’ অব্দি ধরি তাহলেও ‘Language’ বইটির ১৫৮ থেকে ২৬৩ প্রায় ১০৫ পৃষ্ঠা নিয়েছেন।৩২২ সেই একই প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করতে চার্লস হকেট নিয়েছেন তাঁর ‘A Course in Modern Linguistics’ বইটির ১৪৭ থেকে ২৬১ প্রায় ১১৪ পৃষ্ঠা।৩২৩তেমনি চমস্কির প্রথম বই ‘Syntactic Structures’ (১৯৫৭) এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ১১১র বেশি৩২৪,পরবর্তী বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The Aspects of the Theory of Syntax’ (১৯৬৫) বইখানারই পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৩৬এর উপরে।৩২৫ অন্যান্য বইপত্র এবং পরবর্তী বিকাশ এবং বিতর্ক তো রয়েইছে। সেখানে রামেশ্বর শ’ চমস্কির গোটা জীবন এবং কর্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে বরাদ্দ করেছিলেন ১০৯ থেকে ১২০  মাত্র ১১ পৃষ্ঠা৩২৬আর চমস্কিতত্ত্বের সার বোঝাতে ‘ভাষার তত্ত্ব–কথা’ সংকলনে ড ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া নিয়েছেন ১৩২ থেকে ১৪৯ মাত্র ১৭ পৃষ্ঠা।৩২৭321আমাদের খুব কমেও তিনটি ভাষা তথা ভাষাবৈচিত্র্য  ধরে কাজ করতে হবে।সুতরাং পদ্ধতিটির প্রতি সুবিচার করতে হলে আসলে এই বিষয়টিকে একটি স্বতন্ত্র গবেষণার বিষয় করা উচিত।গোলোকচন্দ্র গোস্বামী ‘আসত্তি’ বোঝাতে গিয়ে কালিক ভাষাবিজ্ঞানের ছককে বা জগন্নাথ চক্রবর্তী ‘উদ্দেশ্য-বিধেয়’ তত্ত্ব বোঝাতে গিয়ে যেভাবে চমস্কিতত্ত্বকে কাজে লাগিয়েছেন,তাতে হয়ত সংশ্লিষ্ট ভাষাগুলোর স্বভাব বোঝা কঠিন কিছু থাকে নাকিন্তু তত্ত্বগুলোর প্রতি ন্যায় হয়েছে বলে আমরা দাবি করতে পারি না।

জগন্নাথ চক্রবর্তী খুব সংক্ষেপে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান এবং চমস্কিতত্ত্ব ‘উদ্যম:এক’-এ ছুঁয়েছেন।৩২৮তিনি দাবি করেছেন,“বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা ভাষার ‘বাক্য বা কথার নির্মাণ’ প্রসঙ্গে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের নোয়াম চমস্কি ও লিওনার্দো ব্লুমফিল্ডের মতবাদের মূলকথাটি উল্লেখ করা আবশ্যক।কারণ এই (বাক্যনির্মাণ) আলোচনায় এঁদের প্রভাব পড়বে।অনেকটা অনিবার্য ভাবেই।”৩২৯সেখানে ‘উপরিগঠন’ (Surface Structure) এবং ‘অন্তর্গঠন’ (Deep Structure) এর যৎসামান্য ব্যাখ্যা করেছেনNP,VP-র উল্লেখ করলেও বিষয়টি স্পষ্ট করেন নি।‘উদ্যম:দুই’-এ দেখা গেল সেই ধারণাকে কাজে লাগাচ্ছেন না।‘প্রয়োজনীয় একক ও সংজ্ঞা নির্দেশ’ শিরোনামে পরম্পরাগত ব্যাকরণের পরিভাষাগুলোরই ব্যাখ্যা করেছেন।৩৩০সেখানে ‘উদ্দেশ্য ও বিধেয়’ কাকে বলে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সেই সংজ্ঞারও উল্লেখ করেছেন।এবং পুরো আলোচনাতে NP,VP ধারণার বদলে ‘উদ্দেশ-বিধেয়’ তত্ত্বের সঙ্গে চমস্কিতত্ত্বের একটি মিশ্রণ ঘটাচ্ছেন।চমস্কির উলম্ব কাঠামোর ƩF ব্যাকরণের পদ্ধতিকে হয়ত কাজে লাগাচ্ছেন,সেখানে মূল ধারণার সঙ্গে সামান্য পরিচিতি থাকলেই যে কারো নজরে বিসঙ্গতিটি পড়বে।ফলে আমাদের মনে হয়েছে রূপান্তরমূলক সৃজনমূলক ব্যাকরণ পরম্পরাগত ব্যাকরণের কাছে ঋণী হবার বদলে,ঘটনা উলটো ঘটেছে। পরম্পরাগত ব্যাকরণে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের পরত চড়েছে সেই ‘পরত’-কে তাত্ত্বিক বিকাশ বলা যাবে না এর জন্যে যে তাতে পরম্পরাগত ব্যাকরণের ত্রুটিগুলোর থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নি।ফলে তত্ত্ব তাঁকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতেও বহু সময় সাহায্য করে নি।আমরা একটি উদাহরণ দিলে কথাটি স্পষ্ট হবে।‘সম্বন্ধ পদের অর্থান্তর বিন্যাস’ উপশিরোনামে তিনি একটি সূত্র দিচ্ছেন,“অনুসিদ্ধান্ত ১২:এখানে সম্বন্ধ পদের উপাদানের অর্থাৎ ‘বিশেষ্য+সম্বন্ধক’ এবং সম্বন্ধিত পদের স্থান পরিবর্তনে বাক্যের অর্থও বদলে যায়।‘রেখাচিত্র-৭’এ তা দেখানো হলো।”৩৩১‘রেখাচিত্র -৭’ এ তিনি ‘তুমার ঘরর ধারর পুকইর’, ‘তুমার পুকরির ধারর ঘর’,‘তুমার ধারর ঘরর পুকইর’ এই তিন খণ্ডবাক্যে পদবিন্যাস পাল্টাবার সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে অর্থ পালটে গেছে সঠিক ভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন।কিন্তু এর পরেই একটি ‘রেখাচিত্র-৮’ দিয়েছেন। সেখানেও তিনটি খণ্ডবাক্য বা আসন্ন সঙ্গ আছে,‘তাইর চুঙা পিঠা’,‘আমার চিঠি’,‘কানচনমালার বই’এগুলোর দুটি করে অর্থভেদেরও উল্লেখ করেছেন। যেমন—‘আমার চিঠি’ মানে---‘আমার লেখা চিঠি’ এবং ‘আমার উদ্দেশ্য অন্য কারো লেখা চিঠি’ ইত্যাদিকিন্তু এর কোনো ব্যাখ্যা কোথাও নেই যে ‘সম্বন্ধিত পদে’র কোনো রকম স্থান পরিবর্তন ছাড়াই এখানে অর্থ পালটে যাচ্ছে কী করে?এর মূল কারণটি আমাদের যা মনে হয়েছে তা এই যে---তিনি ‘বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা’-তে পদবিন্যাসের সূত্র সন্ধানে নেমেছিলেনএমনিতেও ‘বাক্যং স্যাদ যোগ্যতাকাঙ্ক্ষাসত্তিযুক্তঃ পদোচ্চয়ঃ” সূত্র অনুসারে তাঁকে তা করতেই হতসেই সঙ্গে তিনি  মুহাম্মদ দানীউল হকের ‘ভাষাবিজ্ঞানের সূক্ষ্মতর প্রসঙ্গ’ বই থেকে কিছু কথা এক জায়গাতে তুলে দিয়েছেন,“...দেখা গেছে যে,প্রত্যেক শিশুরই বেড়ে উঠার প্রত্যেকটি পর্যায়ে একটা নিজস্ব ভাষা ব্যাকরণ থাকে,যার আবার নিজস্ব কিছু সূত্র থাকে।শিশু সেই সূত্র দ্বারাই শাসিত হয়ে তার ভাষার স্বরূপ প্রকাশ করে৩৩২ এবারে, মুহাম্মদ দানীউল হক যেখানে শিশুর সৃজনশীলতার কথা বলছিলেন,সেখানেই সেই তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে জগন্নাথ চক্রবর্তী ‘আঞ্চলিক বাংলা’ যেসব ‘সূত্র শাসিত’ সেগুলোর সন্ধানে নেমে সৃজনমূলক ব্যাকরণের বিপরীত পথে হেঁটেছেন। আমরা এ ব্যাপারে সতর্ক বলেই নিজেদের সীমাবদ্ধতার জায়গাটি শুরুতেই স্পষ্ট করে এগোতে চাই।

রামেশ্বর শ’ যেভাবে শুরু করেছেন,“আমাদের বাক-প্রবাহকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রথম আমরা যে বৃহত্তম এককগুলি (units) পাই সেই এককগুলিই বাক্য।”৩৩৩সেই একককে  কাঠামো বা অবয়ব-ও বলতে পারি।ইংরেজি পরিভাষা formএকটি অবয়ব কখনো নিজেই স্বয়ং সম্পূর্ণ,আবার কখনো আরো বড় এক অবয়বের অংশ হতে পারে। যেমন:

অ। প্রশ্ন: লজেন্স কে নেবে? 

   উত্তর: আমি।

            কর্ম ক্রিয়ার উল্লেখ না থাকলেও এই সংলাপে ‘আমি’ কথাটির অর্থ স্পষ্ট।বলা হচ্ছে,‘আমি লজেন্স নেব’সুতরাং ‘আমি’ এখানে পূর্ণ অবয়ব বা বাক্য।কিন্তু যদি বাক্যটি হয় ‘আমি আজ পড়াশোনা করব না’,তবে আমি এই বৃহত্তম অবয়বের অংশ মাত্র।অর্থাৎ এই ‘অংশ’ আর ‘সম্পূর্ণতার ধারণাটি আপেক্ষিকএকটি অবয়ব যখন বৃহত্তর অবয়বের অংশ হয়ে আছে তখন বলা হয় অন্তর্গত অবস্থানে (included position) আছে।অবয়বটি যখন নিজেই সম্পূর্ণ –তখন বলা হয় স্বয়ং সম্পূর্ণ অবস্থানে (absolute position) আছে।উপরের প্রশ্ন-উত্তরের দুটি অবয়বেরই অবস্থান স্বয়ং সম্পূর্ণ। কিন্তু ‘আমি আজ পড়াশোনা করবো না’—বাক্যে একই বাক্য ‘আমি’ একটি শব্দমাত্র হয়ে আছে অন্তর্গত অবস্থানে। আরেকটি ধারণা স্পষ্ট হওয়া জরুরি।আমরা যেগুলোকে বাক্যাংশ বা পদগুচ্ছ বলে এসেছিলাম সেগুলোর অর্থবহ সব এককই এক একটি ‘গঠন’-ও (construction) বলে।‘আসন্ন সঙ্গ’,‘খণ্ডবাক্য’ এবং ‘গর্ভবাক্য’ এবং ‘পূর্ণবাক্য’টি সবই এক একটি গঠন।

যে সব উপাদানে একটি গঠন গড়ে ওঠে তাকে বলে গঠনগত উপাদান (Constituent)সবচাইতে ক্ষুদ্র একক ‘শব্দ’ বা রূপিমসমষ্টি,যাকে ভাঙলে আর বিষয়টি বাক্যতত্ত্বের অংশ না থেকে রূপতত্ত্বের বিষয় হয়ে পড়ে সেগুলো গঠন নয়।কিন্তু সবচাইতে ছোট অর্থপূর্ণ একক যেহেতু,এবং সেগুলো মিলেই গঠনগুলো গড়ে ওঠে তাই এগুলো হচ্ছে সবচাইতে ছোট গঠনগত উপাদান।বৃহত্তম থেকে ক্ষুদ্রতম এককে সাজালে ‘বাক্য’,‘গর্ভবাক্য’,‘খণ্ডবাক্য’,‘আসন্ন সঙ্গ’ ---সবই এক একটি গঠন।ক্ষুদ্রতম থেকে সাজালে ‘শব্দ’,‘আসন্ন সঙ্গ’,‘খণ্ডবাক্য’,‘গর্ভবাক্য’ এক একটি গঠনগত উপাদান। প্রথম সজ্জাতে ‘শব্দ’ নেই,দ্বিতীয় সজ্জাতে ‘বাক্য’ নেই।নিচে অসমিয়া–বাংলা দুই বাক্যকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে ‘গঠন’ এবং ‘গঠনগত উপাদান’ বোঝা যাক।

            আ। সবদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের যথার্থ ভাল ছাত্ররা খুব মনোযোগ সহকারে মূল বই পড়ে

            ই। মধ্যযুগত নিয়ম আছিল যে যি সকলে অধ্যাপনাৰ ব্রত গ্রহণ কৰে, তেওঁলোকে কৌমার্য ব্রত অৱলম্বন কৰিব।

‘আ-বাক্য’-এ

 ১) ‘সব’,‘দেশের’,‘বিশ্ববিদ্যালয়ের’ এই প্রতিটি শব্দ এক একটি গঠনগত উপাদান

 ২) ‘সব দেশের’,‘যথার্থ ভালো’,‘ভালো ছাত্ররা’,‘মনোযোগ সহকারে’,‘মূল বই’,‘বই পড়ে’ –এগুলো আসন্ন

      সঙ্গ।অর্থাৎ টুকরো হলেও একটা অর্থ আছে। সুতরাং এক একটি গঠন এবং বৃহত্তর গঠনের গঠনগত

      উপাদান 

 ৩)‘সবদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের’,‘যথার্থ ভালো ছাত্ররা’,‘খুব মনোযোগ সহকারে’,‘মূল বই পড়ে’,‘সবদেশের

     বিশ্ববিদ্যালয়ের যথার্থ ভাল ছাত্ররা’ এবং ‘খুব মনোযোগ সহকারে মূল বই পড়ে’ –এই খণ্ডবাক্যগুলোও

     এক একটি গঠন এবং বৃহত্তর গঠনের গঠনগত উপাদান। 

৪) ‘সবদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের যথার্থ ভাল ছাত্ররা’ এবং ‘খুব মনোযোগ সহকারে মূল বই পড়ে’ এই দুই

     খণ্ডবাক্যও গঠন এবং বৃহত্তর গঠনের গঠনগত উপাদান। 

৫)  পুরো বাক্যটি একটি গঠন।কারো গঠনগত উপাদান নয়।

৬) ‘সবদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের যথার্থ’,‘যথার্থ ভাল ছাত্ররা খুব মনোযোগ’,‘খুব মনোযোগ সহকারে মূল’

     এগুলো পদের যথেচ্ছ সমাবেশ।আংশিক হলেও কোনো অর্থ স্পষ্ট করে না।তাই গঠন কিংবা এবং  গঠনগত

     উপাদান নয়।

‘ই-বাক্য’-এ

১) ‘মধ্যযুগত’, ‘নিয়ম’, ‘আছিল’, ‘যে’, ‘যি’ এমন প্রতিটি পদ এক একটি  গঠনগত উপাদান।

২) ‘নিয়ম আছিল’, ‘যি সকলে’, ‘অধ্যাপনাৰ ব্রত’, ‘গ্রহণ কৰে’, ‘কৌমার্য ব্রত’, ‘অৱলম্বন কৰিব’---এগুলোও

    এক একটি গঠন এবং বৃহত্তর গঠনের গঠনগত উপাদান। 

৩) ‘মধ্যযুগত নিয়ম আছিল’, ‘ অধ্যাপনাৰ ব্রত গ্রহণ কৰে’, ‘কৌমার্য ব্রত অৱলম্বন কৰিব’---এগুলোও গঠন

     এবং বৃহত্তর গঠনের গঠনগত উপাদান।   

৪) ‘মধ্যযুগত নিয়ম আছিল যে’,‘যি সকলে অধ্যাপনাৰ ব্রত গ্রহণ কৰে’, ‘তেওঁলোকে কৌমার্য ব্রত অৱলম্বন

     কৰিব’—এই গর্ভবাক্যগুলোও গঠন এবং বৃহত্তর গঠনের গঠনগত উপাদান। 

৫) পুরো বাক্যটি একটি গঠন।কারো গঠনগত উপাদান নয়।

৬) কিন্তু ‘মধ্যযুগত নিয়ম আছিল যে যি সকলে’, ‘অধ্যাপনাৰ ব্রত গ্রহণ কৰে তেওঁলোকে’ এগুলো যথেচ্ছ পদ

    সমাবেশ।সুতরাং কোনো গঠন কিংবা গঠনগত উপাদান  নয়।

বোঝা যাচ্ছে ‘বৃহত্তর গঠন’ একটি সমস্যার দিক।ক্ষুদ্রতর গঠনগুলো সবই তার উপাদান,কিন্তু যেকোনো উপাদানে একটি গঠন হচ্ছে না।সম্পর্কটি বোঝার জন্যে আমাদের স্তরে স্তরে এগোতে হচ্ছে।একটি গঠনকে সবচাইতে বড় যে দুই অর্থপূর্ণ এককে ভাঙা যাবে সেগুলোই সেই নির্দিষ্ট গঠনের গঠনগত উপাদান।এই স্তরঘনিষ্ঠতাটিকে বোঝাবার জন্যে  একে বলে ‘অব্যবহিত গঠনগত উপাদান’ (Immediate Constituent)ইংরেজিতে একে IC বলে।  

গোলোকচন্দ্র গোস্বামী ‘আসত্তি’ বোঝাতে গিয়ে ‘আসত্তি গাঢ়’,‘আসত্তি অঙ্গ’ ইত্যাদি পারিভাষিক শব্দে তাই যেমন এই IC-র ধারণাকেই কাজে লাগিয়েছিলেন বলেই যেমন মনে হয়।ভাষাবিজ্ঞানে যেমন রেখাচিত্র দিয়ে IC বোঝানো হয়,তিনিও সেরকম রেখাচিত্রের সাহায্য নিয়েছিলেন।কিন্তু তিনি পদজোড়ের বেশি এগোন নি।দুয়ের বেশি পদজোড় সম্পর্কে এইটুকুনই লিখেছিলেন,“কেতিয়াবা দুটাতকৈ অধিক শব্দ বা পদও পরস্পরে আসন্ন অঙ্গ হ’ব পারে।”৩৩৪তিনি যে নজিরগুলো দিয়েছিলেন,তার একটি তিনি যেভাবে রেখাচিত্র দিয়ে বোঝাচ্ছিলেন,আমরা তাই দেখাচ্ছি:

 

একাধিক খণ্ডবাক্য মিলে যখন বৃহত্তর খণ্ডবাক্য গড়ে উঠে তখন সেগুলোর সম্পর্কে লিখছেন,“এনে দীঘল খণ্ডবাক্যত লগ লগা খণ্ডবাক্যবোর পরস্পরে আসন্ন অঙ্গ হ’ব লাগে।”৩৩৫ যেমন:

            উ। জীৱনৰ শেষভাগত এই অনুপম ঘোষাগ্রন্থ ৰচনা কৰে।

এর বেশি তিনি গর্ভবাক্য বা বাক্য অব্দি এগোন নি।পারস্পরিক সম্পর্কটি গুরুত্বপূর্ণ বটে।কিন্তু ‘অঙ্গ’ কথাটি পারস্পরিক সম্পর্কের বেলা খাটে না বলেই আমরা ‘সঙ্গ’ শব্দটির প্রস্তাব করেছিলাম।যাই হোক,প্রায় নিশ্চিত হয়েই বোঝা যায় তিনি এই IC-র ধারণাকেই কাজে লাগাচ্ছিলেন।এবং তাঁর রেখাচিত্রের ধারণাও ভাষাবিজ্ঞান থেকেই নেয়া।কিন্তু যেহেতু বিশ্লেষণ তিনি করছিলেন পরম্পরাগত ব্যাকরণের পথেই,ফলে ‘আসন্ন অঙ্গ’-এর ধারণাটি থেকে গেছে ভিন্ন এবং অপ্রশস্ত।ভিন্ন এর জন্যে যে IC আনুভূমিক এবং উলম্ব দু’দিক থেকেই পারস্পরিক সম্পর্কের কথা মনে রাখে।অপ্রশস্ত এর জন্যে যে IC-র ধারণা শব্দ থেকে বাক্য অব্দি ছড়ানো।অন্যথা ‘আসন্ন অঙ্গ’-এর ধারণাটিকে আমরা IC-র অনুবাদে ব্যবহার করতে পারতাম।সেটি যখন হচ্ছে না এর পরে ইংরেজি IC-র বদলে সংক্ষেপে অ.গ.উ. ব্যবহার করছি।




আমরা যদি ‘আ-বাক্য’টি নিই তবে প্রথম যে দুই অ.গ.উ.-তে সেটিকে ভাঙা যাবে সেটি এরকম: সবদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের যথার্থ ভাল ছাত্ররা এবং খুব মনোযোগ সহকারে মূল বই পড়েতেমনি ১নং অ.গ.উ.-কে গঠন ধরে নিয়ে যদি আবার দু’ভাগে ভাগ করি,সেটি দাঁড়াবে এরকম:সবদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং  যথার্থ ভাল ছাত্ররাএভাবে এক একটি পদ অব্দি পৌঁছুনো যাবে। তেমনি যদি ‘ই-বাক্য’টি নিই,তবে প্রথম যে দুই ...-তে সেটিকে ভাঙা যাবে সেটি এরকম: মধ্যযুগত নিয়ম আছিল যে এবং যি সকলে অধ্যাপনাৰ ব্রত গ্রহণ কৰে,তেওঁলোকে কৌমার্য ব্রত অৱলম্বন কৰিব। তেমনি ২নং অ.গ.উ.-কে গঠন ধরে নিয়ে যদি আবার দু’ভাগে ভাগ করি,সেটি দাঁড়াবে এরকম:যি সকলে অধ্যাপনাৰ ব্রত গ্রহণ কৰে,তেওঁলোকে কৌমার্য ব্রত অৱলম্বন কৰিব।ভাষাবিজ্ঞানে এই অ.গ.উ. বিশ্লেষণ করে দেখাতে এরকম চিত্র ৭ এবং ৮-এ যেভাবে দেখাচ্ছি সেরকম কিছু রেখাচিত্রের সাহায্য নেয়া হয়।

এভাবে বড় থেকে ছোট অব্দি ধাপে ধাপে যেতে যেতে শেষ ধাপে যে শব্দগুলো পাওয়া গেল,সেগুলোকে ভাঙলেই চলে যাবো রূপিম স্তরে। সেগুলোও ভাষাবিজ্ঞানের বাক্যতত্ত্বে আলোচনা করে আমরা লিখে এসেছি।কিন্তু বাক্যতত্ত্বের মূল বিষয় এই অব্দিই।তাই এই সবচাইতে ক্ষুদ্রতম উপাদানগুলোকে বলে চরম গঠনগত উপাদান (Ultimate Constituent)সংক্ষেপে UCআমরা বাংলাতে বলতে পারি চ...

এই পদ্ধতিটি কালিক ভাষাবিজ্ঞানের সুপরিচিত পদ্ধতি।কিন্তু খুব জটিল দীর্ঘবাক্যে বা ইংরেজি-বাংলা- অসমিয়ার মতো নয় এমন কিছু ভাষারূপেও বহু সময় রেখাচিত্র আঁকাটাই সমস্যা।তাই চার্লস হকেট লিখেছিলেন,“Diagramming is not an end in itself,but a convenient means of revealing hierarchical structure.For this,it is useful to have diagrammatic conventions.But where the structure is unusual,diagramming may become excessively complex.In such instances,we shall avoid diagrams and resort to verbal description.৩৩৬

অব্যবহিত গঠনগত উপাদান বিশ্লেষণ পদ্ধতি: স্বনিম বা রূপিম বিশ্লেষণের মতোই অ.গ.উ. বিশ্লেষণের কিছু পদ্ধতি রয়েছে। সেরকম কোনো পদ্ধতি ছাড়াই আমরা ‘আ’ এবং ‘ই’ বাক্য বিশ্লেষণ করে এলাম।ফলে মান অসমিয়া –বাংলার মতো চেনা ভাষাতে একটি গঠন এবং তার অ.গ.উ. চেনাটা মনে হতে পারে যে এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। রূপিম বিশ্লেষণের মতোই পদ্ধতিটি আসলে কার্যকরী অচেনা বা কম চেনা ভাষা কিংবা ভাষাবৈচিত্র্য বিশ্লেষণে। অসমিয়া-বাংলারই বহু ভাষাবৈচিত্র্যের সঙ্গে যদি আমাদের পরিচয় ভালো না থাকে,সেখানেও দরকার পড়তে পারে।এমন কি বহু সময় চেনা বাক্যেও সংশয় দেখা দেয়। যেমন ‘ই-বাক্য’টিকে বিশ্লেষণ করতে গেলে এমন নানা ভাবে করা যেতে পারে বলে মনে হতে পারে:

        ই.১) মধ্যযুগত নিয়ম আছিল যে/ যি সকলে অধ্যাপনাৰ ব্রত গ্রহণ কৰে,তেওঁলোকে কৌমার্য ব্রত অৱলম্বন কৰিব।

            ২) মধ্যযুগত নিয়ম আছিল যে যি সকলে /অধ্যাপনাৰ ব্রত গ্রহণ কৰে,তেওঁলোকে কৌমার্য ব্রত অৱলম্বন কৰিব।

            ৩) মধ্যযুগত নিয়ম আছিল যে যি সকলে অধ্যাপনাৰ ব্রত গ্রহণ কৰে,/তেওঁলোকে কৌমার্য ব্রত অৱলম্বন কৰিব।

            ৪) মধ্যযুগত নিয়ম আছিল যে যি সকলে অধ্যাপনাৰ ব্রত গ্রহণ কৰে,তেওঁলোকে কৌমার্য ব্রত/ অৱলম্বন কৰিব।

৫) মধ্যযুগত নিয়ম আছিল যে যি সকলে অধ্যাপনাৰ ব্রত গ্রহণ কৰে, তেওঁলোকে কৌমার্য ব্রত অৱলম্বন/ কৰিব।

ইত্যাদি

যদি ‘মধ্যযুগত নিয়ম আছিল যে’-কে একটি অ.গ.উ. ধরা হয় তবে সেরকম আরো বহু বাক্যেই পাওয়া যেতে পারে। যেমন:

            ৬) মধ্যযুগত নিয়ম আছিল যে ৰজাই কিবা নির্দেশ দিলে প্রজাই মানিব লাগে।

            ৭) মধ্যযুগত নিয়ম আছিল যে  লিখাপঢ়া অকল পুৰুষ মানুহেই কৰিব লাগে,সেয়াও মূলত উচ্চবর্ণৰ পুৰুষ

            ৮) মধ্যযুগত নিয়ম আছিল যে ৰজাক উৎপাদিত ফচলেৰে কৰ দিব লাগে।

এমন অসংখ্য ‘মধ্যযুগীয় নিয়ম’-এর কথা এই বাক্যের শেষাংশে জুড়া যেতে পারে।কিন্তু যদি অ.গ.উ.  ধরা হয় এই বাক্যাংশটিকে ‘মধ্যযুগত নিয়ম আছিল যে যি সকলে অধ্যাপনাৰ ব্রত গ্রহণ কৰে’ তাহলে সেই সুযোগ অনেক কমে যাবে।শুধু অধ্যাপকদের সম্পর্কেই যা বলার বলে অন্য অ.গ.উ. তৈরি হতে পারে। তেমনি ৪ এবং ৫ নং বিভাজনে দ্বিতীয় অ.গ.উ. সংখ্যা আরো কমে যাবে। ৬,৭ এবং ৮ নং বাক্যে যে সব দ্বিতীয় অ.গ.উ.-র সম্ভাবনা দেখানো হলো,সেরকম একই পরিবেশে বসতে পারে সেগুলোকে ‘গঠনগত শ্রেণি’ (Contituent Class) বলে।কিন্তু আমাদের ‘ই-বাক্য’টি ছিল একটি জটিল বাক্য।এতে অন্তত তিনটি গর্ভবাক্য ছিল।প্রাথমিক স্তরে আমাদের হয় শুধু তার প্রধান গর্ভবাক্য অথবা ‘আ-বাক্য’-এর মতো সরল বাক্য নিলে সুবিধে।‘আ-বাক্য’-এর বিকল্প সম্ভাবনাগুলো দেখা যাক।

            আ.১)  সবদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের যথার্থ ভাল ছাত্ররা/খুব মনোযোগ সহকারে মূল বই পড়ে

                ২)  সবদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের যথার্থ ভাল ছাত্ররা/সামাজিক ভাবেও খুব দায়বদ্ধ হয়।

                ৩)  সবদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের যথার্থ ভাল ছাত্ররা/পরে গিয়ে জ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

            পূর্বাংশকে পালটে দিয়েও দেখা যেতে পারে যে অ.গ.উ.-গুলো পাওয়া গেল,সেগুলো অনুরূপ পরিবেশে বসে কি না।

                ৪) ভাল ছাত্ররা/সামাজিক ভাবেও খুব দায় বদ্ধ হয়।

            তেমনি যদি দেখা যায় যে সব অ.গ.উ. পাওয়া গেল তার যে কোনো একটিকে একটি মাত্র পদ বা শব্দদিয়েও প্রতিস্থাপিত করলেও বাকি অ.গ.উ.-র সঙ্গে বসে যাচ্ছে,তবে বুঝতে হবে বিভাজনটি ঠিক আছে।এমন কি যদি দুই অবস্থানেই  একটি মাত্র শব্দ বসিয়ে দিলেও বাক্যটি একটি গঠন হতে পারে,অর্থাৎ ব্যাকরণের দিক থেকে অশুদ্ধ না হয় তাহলে আরো ভালো বোঝা যাবে যে বিভাজনটি ঠিক আছেযেমন:

               ৫) ছাত্ররা/খুব মনোযোগ সহকারে মূল বই পড়ে

               ৬) ছাত্ররা/মনোযোগ সহকারে পড়ে।

               ৭) ছাত্ররা/পড়ে।

এই যে ‘সবদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের যথার্থ ভাল ছাত্ররা’ পদগুচ্ছের বদলে ‘ছাত্ররা’ এই একটি শব্দ বসিয়ে দেবার পরেও ‘আ.৫’-এ বাকি দ্বিতীয় পদগুচ্ছটিকে একই রাখা গেল এবং তাতে বোঝা গেল আমরা ঠিকঠাক অ.গ.উ. নির্ণয় করে উঠতে পেরেছি।অন্যথা ৬,৭ অব্দি এগুনোও কঠিন হতো।একটি গঠনকে অ.গ.উ.-তে বিভাজিত করবার এটাই হচ্ছে মূল নীতি।এই দুই অ.গ.উ.-কে আমরা অন্যান্য পদ দিয়েও প্রতিস্থাপিত করে দেখতে পারি।যদি সেটি সম্ভব হয় তবে সেই নির্ণয়  যথার্থ।

সেটি একটি ছকে করে দেখানো যাক। চিত্র -০৯-এর মতো।


 

একটি জিনিস তো বেশ বোঝা যাচ্ছে গঠন কিংবা অ.গ.উ. নির্ণয়ে পদ-বাক্যের অর্থ বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। অথচ,সেই অর্থই কালিক ভাষাবিজ্ঞানে থেকেছে সবচাইতে উপেক্ষিত।পরম্পরাগত ব্যাকরণের পরিভাষা বা ধারণাগুলোকে অস্বীকার করলে কী হবে,সেগুলোকেই  কাজে লাগিয়ে এগুচ্ছে কালিক ভাষাবিজ্ঞান।এমন কি ‘আসন্ন সঙ্গ’- এর ধারণাটিকে আমরা পদজোড়ে সীমাবদ্ধ রেখেছি, সেটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।এই ধারণাটির বরং বাক্য অব্দি বিস্তার ঘটাবার কথা ভাবাই যেতে পারে।আসন্ন সঙ্গগুলোকে জুড়ে জুড়ে একেবারে ছোট অ.গ.উ. থেকে সব চাইতে বড় গঠন তথা বাক্য অব্দি পৌঁছুতে পারি। সেভাবেও সংশ্লেষণ করে দেখানো হয় ভাষাবিজ্ঞানে।আমরা চিত্র-১০-এ ‘ই-বাক্য’টি করে দেখাচ্ছি।এই বাক্যে

 

দেখা যাচ্ছে ‘যি’-র সঙ্গে ‘সকলে’-র সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ,কেননা ‘সকলে’ হচ্ছে ‘যি’ সর্বনামের বহুবচন বোঝাবার অনুপদ। তেমনি ‘অধ্যাপনাৰ’ পদের সঙ্গে ‘ব্রত’,‘গ্রহণ’-এর সঙ্গে ‘কৰে’,‘কৌমার্য’ পদের সঙ্গে আবার ‘ব্রত’ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে বাঁধা। ‘অধ্যাপনাৰ’ এবং ‘কৌমার্য’ পদের পরসর্গ থাক চাই নাই থাক ‘ব্রত’ কথাটির বিশেষণের ভূমিকা পালন করেছে।‘গ্রহণ’ ‘কৰে’-র সঙ্গে মিলে যৌগিক ক্রিয়া নির্মাণ করেছে।এই ভাবে আপেক্ষিক ঘনিষ্ঠতার ভিত্তিতে ধাপে ধাপে এক একটি খণ্ডবাক্য,খণ্ডবাক্য মিলে গর্ভবাক্য,এবং শেষে প্রধান বাক্য তথা বাক্য-গঠনটি তৈরি হচ্ছে।

এই চিত্র-১০এ হয়তো পদ তথা অ.গ.উ.-গুলোর পারস্পরিক সাদৃশ্য-তারতম্য,দূরত্ব-নৈকট্য ইত্যাদি দেখানো যাচ্ছে।কিন্তু বাক্যের বন্ধনটি বোঝাবার জন্যে সেই পরম্পরাগত ব্যাকরণের কাছে ফিরে ফিরে যেতে হচ্ছে।এরকম দুই পদ্ধতির মধ্যে মধ্যে গোলপাকানো  সমস্যার সামনে আমরা আরো পড়ব 

গঠনের প্রকার ভেদ: গঠন তথা construction দু’রকম।অন্তঃকেন্দ্রিক (Endocentric Construction) এবং বহিঃকেন্দ্রিক(Exocentric Construction)খুব সংক্ষেপে বললে যতক্ষণ একটি গঠনের বদলে তার অব্যবহিত গঠনগত উপাদান এমন কি একটি শব্দমাত্রকেও বসিয়ে দিলে অর্থের সামান্য হের ফের হলেও গঠনে সেটি বাক্যই থাকে,ব্যাকরণের দিক থেকে ভুল হয় না,তাকে অন্তঃকেন্দ্রিক গঠন বলে।যেমন:

                          ঊ। ভালো ছেলেরা পড়াশোনা করে।

এতে ‘ভালো ছেলেরা’ এবং ‘পড়াশোনা করে’ দুটোই অ.গ.উ.এই দু’টোর বদলে যদি শুধু ‘ছেলেরা’ এবং  ‘করে’ বসিয়ে দেয়া যায় তাহলেও ‘ছেলেরা করে’ একটি বাক্য হবে।সুতরাং এই অ.গ.উ. দুটিই হচ্ছে ‘উ-বাক্য’-এ অন্তঃকেন্দ্রিক গঠন।রামেশ্বর শ’ এটি স্পষ্ট করেন নি,পুরো ‘ভালো ছেলেরা পড়াশোনা করে’ বাক্যটি কী হবে?এই জটিলতাটি আছে। সেরকম অধিকাংশ বাক্যের বদলেই কোনো একটি মাত্র শব্দ বসিয়ে দেয়া যাবে না।আর না গেলে কি তাদের বহিঃকেন্দ্রিক গঠন বলা হবে,তার কোনো স্পষ্ট জবাব নেই।তিনি শুধু লিখেছেন,‘তুমি পড়ো’ এই ছোট বাক্যটি একটি বহিঃকেন্দ্রিক গঠন।৩৩৭কেন না,এর বদলে শুধু ‘তুমি’ বা ‘পড়ো’ বসিয়ে দিলে কোনো বাক্যার্থ  বেরোবে না।কিন্তু একই বাক্য যদি বিবৃতিমূলক বাক্য না হয়ে আদেশ তথা অনুজ্ঞা বাচক হয় তবে সেটি হবে ‘অন্তঃকেন্দ্রিক’কেননা,তখন শুধু ‘পড়ো’ শব্দেই পুরো বাক্যটির অর্থ নির্দেশ করবে। সেদিক থেকে ‘ছেলেরা করে’ একটি ‘অন্তঃকেন্দ্রিক’ গঠন হবার কোনো সম্ভাবনা নেই।রামেশ্বর শ’ তাই বলছেন, ‘তুমি পড়ো!’ অনুজ্ঞা বাক্যের এমন কিছু,“বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া বাংলা, ইংরেজি, জার্মান,ফরাসী ভাষায় সাধারণত সংক্ষিপ্ত,সরল বিবৃতিমূলক বাক্য হলো বহিঃকেন্দ্রিক গঠন।”৩৩৮অসমীয়া সম্পর্কেও কথাটি সত্য না হবার আমরা কোনো কারণ দেখছি না।

অন্তঃকেন্দ্রিক গঠনও দু’রকমের হয়।সমানাধিকারজ্ঞাপক(Co-ordinative) এবং অধীনতাজ্ঞাপক(Sub-ordinative) যেমন:

ঋ। শ্রীকান্ত ও রাজলক্ষী শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র।

এতে ‘শ্রীকান্ত’ ও ‘রাজলক্ষী’ এই দুই উপাদানের কেউ কারো উপরে নির্ভরশীল নয়।এদের যে কাউকে সরিয়ে দিয়েও বাক্যটি নির্ভুল হবে।ফলে ‘শ্রীকান্ত ও রাজলক্ষ্মী’ হচ্ছে সমানাধিকারজ্ঞাপক গঠন।অন্যদিকে ‘ঊ-বাক্য’-এ ‘ভালো ছেলেরা’ গঠনে ‘ছেলেরা’ হলো প্রধান (Head) উপাদান,‘ভালো’ হচ্ছে গৌণ বা অধীনস্থ (Subordinate) উপাদান ‘ভালো’ ‘ছেলেরা’-কে বিশেষায়িত করেছে। গৌণটিকে দিয়ে পুরো গঠনকে প্রতিস্থাপিত করা যাবে না।ফলে এটি হচ্ছে অধীনতাজ্ঞাপক গঠন। 

গঠনের প্রযুক্তি:একে প্রযুক্তিই লিখেছেন রামেশ্বর শ’অর্থাৎ কী ভাবে একটি একটি গঠন গড়ে উঠে তার প্রক্রিয়া। 

           ১) ছোট বাক্য বা গঠনকে দীর্ঘ করবার দুরকম প্রযুক্তি রয়েছে।সমানাধিকার সংযোগ (Coordination

              /Conjoining) এবং অধীনস্থ সংযোগ ( Subordination/Embedding)

সমানাধিকার সংযোগ: দুই বা তারচেয়ে বেশি পদ,বাক্যাংশ বা বাক্যের গুরুত্ব সমান রেখে যখন পরস্পর জুড়ে দেয়া হয় তখন তাকে সমানাধিকার সংযোগ বলে।আমরা যে সরল,জটিল,যৌগিক বাক্যের কথা জেনে এসেছি,এই ধারণা তার থেকে সামান্য ভিন্ন। সেই তিনরকমের বাক্যেই সমানাধিকার সংযোগ ঘটতে পারে এবং সেটি হতে পারে কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া তিন অবস্থানেই। যেমন:

                                    এ.১শ্রীকান্ত শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের একটি প্রধান চরিত্র।

                                       রাজলক্ষ্মী শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের একটি প্রধান চরিত্র।

            এই দুই বাক্যে পৃথক হচ্ছে তাদের কর্তা অংশটিই---শ্রীকান্ত এবং রাজলক্ষ্মীবাকি সবই এক। ফলে এই পৃথক দুই অংশকে সংযোজক অব্যয় ‘ও’ দিয়ে জুড়ে এক বাক্য করে ফেলা যায়,যেরকম ‘ঋ-বাক্য’-এ রয়েছে--শ্রীকান্ত ও রাজলক্ষ্মী শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র।লক্ষ করবার বিষয় এখানে ‘একটি’ শব্দ তুলে দেয়া হয়েছে। কেননা কর্তা এখানে ‘দুটি’ হয়ে গেছে।অথবা ‘একটি’র জায়গাতে ‘এক একটি’ জুড়েও কর্ম ‘প্রধান চরিত্র’-এ বহুত্বের বোধ আনা যায়।অসমীয়াতেও রীতি একই। শুধু ‘ও’-এর বদলে হবে ‘আৰু’,‘এক একটি’-ৰ বদলে ‘একো একোটা’

            তেমনি কয়েকটি অসমিয়া বাক্য নেয়া যাক:

                                  ঐ.১  শ্রীকৃষ্ণই পাঞ্চজন্য নামৰ শঙ্খ বজালে

  কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠিৰে অনন্ত বিজয় নামৰ শঙ্খ বজালে

  ভীমকর্মা বৃকোদৰে পৌণ্ড্র নামৰ শঙ্খ বজালে

              ধনঞ্জয়ে দেৱদত্ত নামৰ শঙ্খ বজালে

  নকুলে সুঘোষ নামৰ শঙ্খ বজালে

   সহদেৱে মণিপুষ্পক নামৰ শঙ্খ বজালে

এই ছটি বাক্যে কর্ম-ক্রিয়া অংশ একই।শুধু কর্তা পুরোটাই ভিন্ন,কর্মের সম্প্রসারকের অংশ বিশেষ তথা ‘কর্ম’ শঙ্খের নামগুলো আলাদা।ফলে শেষাংশ এক রেখে বাকিটা জুড়ে দিয়ে এক বাক্যে পরিণত করা হয় এভাবে:

                        শ্রীকৃষ্ণই পাঞ্চজন্য,কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠিৰে অনন্ত বিজয়,ভীমকর্মা বৃকোদৰে পৌণ্ড্র,ধনঞ্জয়ে

                                     দেৱদত্ত,নকুলে সুঘোষ আৰু সহদেৱে মণিপুষ্পক নামৰ শঙ্খ বজালে

‘ঋ-বাক্য’-এর সঙ্গে এখানে তফাৎ হলো কর্তার সঙ্গে কর্মেরও খানিকটা আলাদা,সেই অংশটুকু এক সঙ্গে নিয়ে নেয়া হয়েছে।তার উপর সংখ্যাতে সেগুলো দুইয়ের বেশি।তাই শুধু শেষটির আগে ‘আৰু’ যোগ করা হয়েছে, বাকিগুলোর আগে কমা (,) বসিয়ে জুড়ে দেয়া হয়েছে।বাংলাতেও তাই রীতি।লক্ষ করবার বিষয় আমরা যে দুই বাক্যের উদাহরণ দিলাম,এই দুটিই কিন্তু সরল বাক্য।

অধীনস্থ সংযোগ: এর বিকল্প নাম অন্তর্বিন্যাস।কখনো বা যে দুই অংশ জুড়ে দেয়া হলো সেগুলো সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়।অর্থাৎ এদের যে কোনো একটি বসিয়ে বাক্য পুরো হয় না।একটি অংশ প্রধান,আর অংশটি তাকে ব্যাখ্যা করে বা বিশেষায়িত করে। যেমন:

            ও। যে বিভূতিভূষণ প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন তিনি পথের পাঁচালি লিখতে পেরেছেন

এই বাক্যে ‘যে বিভূতিভূষণ প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন’ এই অংশটি বাকি অংশের সঙ্গে সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়। একে যোগ করা হয়েছে বাকি অংশের ‘তিনি’ কর্তার বিশেষণ হিসেবে।না করলেও চলত,গঠনের দিক থেকে বাকি অংশটি সম্পূর্ণ হতো।এভাবে জুড়বার প্রক্রিয়াটির নাম অধীনস্থ সংযোগ।জুড়ে দেয়া অংশটিকে বলে গুণবাচক অংশ (Attribute)তিনি’-র মতো যে অংশটির গুণের বোধ জাগায় সেই অংশকে বলে প্রধান অংশ (Head)আর যে পুরো  গর্ভবাক্যে গুণবাচক অংশটি জুড়ে দেয়া হয়,তাকে বলে আধাতৃ গর্ভবাক্য (Matrix Clause)

পরিভাষা ভিন্ন,কিন্তু মূল কথা আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় আমরা ‘জটিল বাক্য’-তে যা জেনে এসেছি,সেরকম একই।কিন্তু সব ধরণের ‘জটিল বাক্য’ এই গুণবাচক অংশ তথা Attribute-এর কথাতে স্পষ্ট হয় না।উদাহরণ স্বরূপ নিচ্ছি এই অসমিয়া বাক্যটি,যার বাংলা প্রতিরূপও গঠনের দিক থেকে ভিন্ন হবে না,---

  ঔ।  তুমি আজি আহিবা বুলি মই জানিছিলোঁ।

            এখানে ‘তুমি আজি আহিবা’ পুরো বাক্যটি অধীনস্থ সংযোগ বলে বোঝা যাচ্ছে,পুরোটাই আধাতৃ গর্ভবাক্য ‘মই জানিছিলোঁ’-র কর্ম।কিন্তু এর ‘প্রধান’ এবং ‘গুণবাচক অংশ’ কই?সুতরাং ‘জটিল বাক্য’-এর সঙ্গে অধীনস্থ সংযোগের ধারণাটি অনেকটা ভিন্নও।

২) প্রতিস্থাপন (Substutution) ও প্রতিরূপ (Pro-form): পরপর কয়েকটি বাক্যে বা দীর্ঘ জটিল বা যৌগিক বাক্যে বহু সময় একই পদ বা পদগুচ্ছের বারবার উল্লেখ বিরক্তিকর ঠেকে বলে অন্য কোনো ছোট বা সংক্ষিপ্ত পদ বা পদগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়।এই প্রক্রিয়াকে বলে প্রতিস্থাপন। যে ভিন্ন পদ বা পদগুচ্ছে বদলটি ঘটে সেটিকে বলে প্রতিরূপ। সুতরাং ‘প্রতিরূপ’ কোনো প্রক্রিয়ার নাম নয়। যেমন ‘ও-বাক্য’-এর আধাতৃ গর্ভবাক্যের ‘তিনি’ গুণবাচক অংশের ‘বিভূতিভূষণ’-এর প্রতিরূপ।এতে দুই বাক্য জুড়েছে।প্রথমাংশের ‘বিভূতিভূষণ’-এর দ্বিতীয়াংশে পুনরাবৃত্তি না করে ‘তিনি’ সর্বনাম বসিয়ে কাজ চালানো হয়েছেসর্বনাম প্রসঙ্গে এই ‘প্রতিস্থাপন’-এর ধারণার সঙ্গে আমরা পরম্পরাগত ব্যাকরণেই পরিচিত।কিন্তু কালিক ভাষাবিজ্ঞানে এই ‘প্রতিস্থাপন’-এর ধারণাটি ব্যাপক।বাক্যের যে কোনো অংশই এমন প্রতিরূপ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হতে পারে। যেমন:

ক। প্রশ্ন: ইয়াক অনবৰতে  মোবাইলত  কথা পাতি থকা দেখিলে তোমাৰ ভাল লাগে নে?

               উত্তর: নাই, নে লাগে।

এখানে উত্তরে ‘ভাল লাগে’-র বদলে সংক্ষেপে প্রতিরূপ শুধুই ‘লাগে’ বসেছে।‘ভাল’ কথাটির পুনরাবৃত্তি ঘটেনি।পরম্পরাগত ব্যাকরণের কথা হলে আমরা ‘ভাল’-এর এই পুনরাবৃত্তি না করাকে ‘কর্ম’-এর উল্লেখ না করা বা বাদ দেয়া বলে বুঝিয়ে দিতাম। যেভাবে উত্তরে ‘কর্তা’-রও কোনো উল্লেখ নেই।‘ভাল’ পদটি কর্ম না যৌগিক ক্রিয়ার পূর্বাংশ এই নিয়েও একটা দ্বিধা তৈরি হতো।কালিক ভাষাবিজ্ঞান সেসব নিয়ে ভাবল না,পারিভাষিক শব্দ ‘প্রতিরূপ’ দিয়েই যেন জটিলতার মুক্তি ঘটিয়ে দিলইংরেজিতে ‘pronoun’-আদলে এর ‘Pro-form’-এর অনেক রকমফেরও রয়েছে। pro-adjective, pro-adverb, pro-verbদরকারে এগুলোরও বাংলা পরিভাষা আমরা তৈরি করে যেতে পারি। যদি কেউ করেছেন,আমাদের জানা নেই।কিন্তু ‘কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া’দি বা পরম্পরাগত ব্যাকরণের ধারণাগুলো নিয়েও যে বেশ ভাবে কালিক ভাষাবিজ্ঞান আমরা দেখে এলাম।

শব্দ,শব্দসঙ্গতি এবং কালিক বাক্যতত্ত্ব:  

            প্রকার্য শব্দ (Function word) এবং পূর্ণার্থ শব্দ ( Content word): এই অব্দি কথাগুলো হয়েছে গঠনের এবং গঠনগত উপাদানের স্তরে।কিন্তু ‘চরম গঠনগত উপাদান’ তথা শব্দের স্তরেও এমন কিছু ঘটনা ঘটে যেগুলো পুরো গঠনকে নিয়ন্ত্রণ করেচার্লস হকেট যেভাবে বলেছিলেন,শব্দ গড়ে উঠবার প্রক্রিয়াটি রূপতত্ত্বের বিষয়---সে ঠিকই আছে।কিন্তু শব্দ এবং রূপিমগুলো কীভাবে বিন্যস্ত হয়ে বাক্য গড়ে তুলে সেসব বাক্যতত্ত্বের আলোচনার বিষয়। পরম্পরাগত ব্যাকরণে আমরা যেভাবে নাম এবং ক্রিয়াপদ এই দুই মূলভাগে পদগুলোকে বিভাজিত করেছিলাম,বা নামপদগুলোকেও কখনো কেউ কেউ অব্যয়-সব্যয় ভাগে ভাগ করেছেন, কালিক ভাষাবিজ্ঞান সেভাবে শব্দ মাত্রকে প্রকার্য এবং পূর্ণার্থ শব্দ --- এই দুই ভাগে ভাগ করে।বাংলার ‘এবং,ও,কিন্তু,যদি,উপরে,নিচে,মাঝে ইত্যাদি’,অসমিয়ার ‘আৰু,কিন্তু,যদি,পিচে,ওপৰত,তলত,মাজত ইত্যাদি’ সমস্ত অব্যয় প্রকার্য শব্দএগুলোর প্রেক্ষিত বিচ্ছিন্ন অবস্থাতে বিশেষ কোনো অর্থ নেই।কিন্তু যখন কোনো পদ বা পদগুচ্ছকে জুড়ে তখন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। যে পদগুলোকে এরা জুড়ে সে নামপদ কিংবা ক্রিয়াপদই হোক সেগুলোকে বলে পূর্ণার্থ শব্দ।ইংরেজিতে নির্দেশক বা article গুলো স্বতন্ত্র শব্দকিন্তু বাংলা অসমিয়াতে বেশকিছু অনুপদ তথা মুক্তরূপিম যেমন ব্যবহৃত হয় তেমনি -টি,-টা,-টে,-টো’ আদি বেশ কিছু বদ্ধরূপিমও যুক্ত হয়। সেসবও প্রকার্য শব্দেরই রকমফের।কালিক ভাষাবিজ্ঞানে এগুলোর বাংলা পরিভাষা রামেশ্বর শ’ লিখেছেন ‘স্পষ্টনির্দেশক’৩৩৯ 

            সঙ্গতি (Concord) ও নিয়ন্ত্রণ( Government ): ‘সঙ্গতি’ কথাটা আমরা পরম্পরাগত ব্যাকরণে যেভাবে জেনে এসেছি তাই,সেখানে নিয়ন্ত্রণকেও আমরা তার অংশ বলেই জেনেছি।এখানে আলাদা করা হচ্ছে।আমাদের বর্তমান অধ্যয়নে রূপতত্ত্বের আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা বাক্যে পদ হবার যোগ্যতা অর্জন করতে গিয়ে প্রতিটি নামশব্দ কারক, বচন,লিঙ্গ এবং ক্রিয়াশব্দ ভাব,পুরুষ,লিঙ্গ অনুসারে কীভাবে নিজের রূপপাল্টায় অথবা পাল্টায় না সেসব আলোচনা করে এসেছিএগুলো হয় সে সঙ্গতি রক্ষা করবার দরকারেই।আমরা এমনকি কর্তার সম্ভ্রমার্থ-তুচ্ছার্থ ভেদে ক্রিয়ার পুরুষভেদ, প্রাণী-অপ্রাণীভেদে কর্তা-কর্মের বচন-লিঙ্গ নিশ্চয়ার্থক নির্দেশকভেদ ইত্যাদির কথাও জেনে এসেছি। সেই ‘সঙ্গতি’টিই কালিক ভাষাবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।তবে কিছু সঙ্গতি রয়েছে যেগুলো এই বৈয়াকরণিক সংবর্গগুলো নিয়ন্ত্রণ করে তো বটেই,তার অতিরিক্ত একটি ঘটনাও ঘটেএকই কারকে,বচনে ইত্যাদিতে বিশেষ করে জটিল বা যৌগিক পদে একটি অংশে বিকল্প রূপ বসালে একটির রূপ আরটির রূপকে প্রভাবিত করছে। যেমন: বাং.রামকে দিয়ে।কিন্তু রামের দ্বারা। অসমিয়াতে ৰামক দি।কিন্তু ৰামৰ দ্বাৰা।সিলেটিতে রামরে দি।কিন্তু রামর দ্বারা। ‘দিয়ে/দি’ পালটে ‘দ্বারা/দ্বাৰা’ হতেই পূর্বপদের কর্মের পরসর্গ ‘-কে/-ক̖ /-রে ’ পালটে সম্বন্ধের পরসর্গ ‘-এর/-অৰ̖/-অর̖’ হয়ে গেল।একে বলে নিয়ন্ত্রণ বা নিয়মন। 

               ।। রূপান্তরমূলক সৃজনমূলক ব্যাকরণ এবং বাংলা-অসমিয়া ভাষা ও সিলেটি সহ ভাষাবৈচিত্র্য গুলো ।।

          বিশশতকের মাঝামাঝিতে ভাষা নিয়ে পড়তে পড়তেই কালিক ভাষাবিজ্ঞান তথা গঠনবাদ নিয়ে চমস্কির মনে প্রশ্ন দেখা দেয়।গঠনবাদ যেভাবে বাক্য তথা ভাষামাত্রকে ‘গঠনে’ নামিয়ে এনেছিল নোয়াম চমস্কি যেন তাকেই প্রত্যাহ্বান জানালেনতাঁর গবেষণা নিবন্ধের নাম ছিল,‘The Logical Structure of Linguistic Theory’ সংক্ষেপে LSLT বলে এখন সুখ্যাত।এর পরে তাঁর চিন্তা অনুগামীদের হাতে ধ্বনিতত্ত্ব অব্দি এগোয়।কিন্তু তিনি শুরু করেছিলেন, বাক্যতত্ত্ব দিয়েই।এর পরে একটি বিখ্যাত বই দিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু,নাম ছিল,‘Syntactic  Structuresসেই বইয়ের সূচনা অংশে তিনি কাকে বলে বাক্যতত্ত্ব,নিজের মতো ব্যাখ্যা করছেন এইভাবে,“Syntax is the study of the principles and process by which sentences are constructed in particular languages. Syntactic investigation of a given language has its goal the construction of a grammar that can be viewed as a device of some sort for producing the sentences of the language under analysis.More generally,linguists must be concerned with the problem of determining the fundamental underlying properties of successful grammars.The ultimate outcome of these investigations should be theory of linguistic structure in which the descriptive devices utilized in particular grammars are presented and studied abstractly, with no specific reference to particular languages.One function of this theory is to provide a general method for selecting grammar for each language given a corpus of sentences of this language.৩৪০ অর্থাৎ তিনি কোনো এক বিশেষ ভাষা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না,সব ভাষারই বাক্যনির্মাণ রহস্য উন্মোচনের এক বিশ্বজনীন তত্ত্বের কথা ভাবছিলেন।সামান্য পরেই তিনি ভাষার সংজ্ঞা দিচ্ছিলেন এরকম,যদিও তা তখনকার মতো বাক্যতত্ত্বে কাজ চালানোর জন্যেই যে ছিল সেটি পরিষ্কার,“from now on I will consider language to be a set (finit or infinite) of sentences,each finite in length and constructed out of a finite set of elements.All natural languages in thier spoken or written form are languages in this sense, since each natural language has a finit number of phonemes (or letters in its alphabet) and each sentence is representable as a finit sequence of these phonemes (or letters),though there are infinitely many sentences.৩৪১ অর্থাৎ ধ্বনিরূপ আদি সসীম উপকরণ নিয়ে সসীম দৈর্ঘ্যের অসীম বাক্যের সংহতি হিসেবে একটি ভাষা কীভাবে কাজ করে;উলটো দিক থেকে বললে,মানুষ এতো অসীম বাক্য তৈরি করে ভাষাব্যবহার করে যায় কী করে--- সেই ছিল তাঁর সন্ধানের বিষয়।গঠনবাদের সমালোচনা দিয়ে যদিও শুরু হয়,তার সব অর্জনকে তিনি বাতিল করেন নি। যে দুই প্রথম রচনার নাম করা গেল তাতেই ‘গঠন’ তথা ‘Structure’ কথাটি রয়েছে। সেরকম তাঁর পুরো তাত্ত্বিক কাঠামোতে গঠনবাদের বহু পারিভাষিক ধারণাকে কাজে লাগাতে দেখা যাবে।তাঁর তত্ত্ব পূর্ণ প্রতিষ্ঠা পায়,১৯৬৫তে প্রকাশিত ‘Aspects of the theory of Syntax’বইতেভাষার পটুতা (competence) এবং ভাষাকৃতি (performance) এর ধারণা এই বইতেই প্রতিষ্ঠিত হয়।ইতিমধ্যে তাঁর অনুগামীরা দেখা দিচ্ছিলেন,অনেকে অর্থতত্ত্বও দাঁড় করাচ্ছিলেন,সেসব আমরা আগের অধ্যায়ে লিখে এসেছি।রামেশ্বর শ’ লিখেছেন,“ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান অধ্যয়নের ক্ষেত্রেও এই নতুন তত্ত্বের প্রয়োগ হচ্ছে।”৩৪২যদিও তাঁর পরেও গ্লীসন,হকেটরা কালিক ভাষাবিজ্ঞানের বিকাশ ঘটিয়ে গেছেন বা যাচ্ছেন ভাষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে চমস্কিতত্ত্ব এর পরে এখন অব্দি অপ্রতিদ্বন্দ্বী বললেই চলে।ইংরেজিতে তাঁর চিন্তাপ্রস্থানটি ‘Transformational-Generative Grammar’বলে পরিচিতি পায়।চমস্কি নিজে একে ‘Universal Grammar’ তথা বিশ্বজনীন ব্যাকরণ বলেও দাবি করেছেন তাঁর তৃতীয় বইটিতে।৩৪৩ 

চমস্কির পুরো ভাষা জিজ্ঞাসার শুরু হয় ‘প্লেটোর সমস্যা’ সমাধান করবার বাসনা দিয়ে।‘Plato’s problem’ পরিভাষাটি তিনি উল্লেখ করেন ১৯৮৬তে প্রকাশিত বই ‘Knowledge of Language:Its Nature,Origin,and Use’-এএর তৃতীয় অধ্যায়ের নামই হচ্ছে ‘Facing Plato’s problem’৩৪৪ প্লেটো সমস্যাটি তুলে ধরেছিলেন তাঁর ‘মেনো’ বইতে। সেখানে সক্রেটিস,তাঁর এক অনুরাগী মেনো,মেনোর এক নাবালক ক্রীতদাস এবং এ্যনিটাস বলে একটি চরিত্র পরস্পরের মধ্যে কথা বলছে। মেনো সক্রেটিসকে জিজ্ঞেস করেন,নৈতিকতার শিক্ষা কী করে দেয়া যায়।সক্রেটিস জানালেন,তিনি জানেন না ‘নৈতিকতা’ বলে কাকে। মেনো নৈতিক মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরলে সক্রেটিস বললেন,হতে পারে নৈতিকতার বলে মানুষ সেসব গুণ অর্জন করে,তাতে এটা স্পষ্ট হলো না নৈতিকতা বলে কাকে? মেনো সেটি স্বীকার করে নিলেন। মেনো আসলে বৈশিষ্ট্য বলতে গিয়ে ‘নৈতিকতা’র আরো কিছু প্রতিশব্দের ব্যবহার করছিলেনসক্রেটিস বললেন,সংজ্ঞাগুলো হওয়া উচিত যাতে লোকে তার সাধারণ জ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারে।আর সেই জ্ঞান সবারই রয়েছে।এইভাবে সরাসরি জবাব না দিয়ে প্রশ্নকর্তার থেকেই জবাব আদায় করবার পদ্ধতি নিচ্ছিলেন,যে পদ্ধতি পরে দর্শনে ‘সক্রেটিসের পদ্ধতি’ বলে খ্যাত হয়।এক সময়ে তিনি বললেন,লোককে কিছুই শেখানো যায় না। ‘শিক্ষা’ বলে সেরকম কোনো জিনিস নেই।শুধু অতীত জীবন থেকে জ্ঞানের ‘পুনঃসংগ্রহ’ (recollection) করা চলে। সক্রেটিস তখন ঐ নাবালক ক্রীতদাস,যার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই,তাকে দেখিয়ে বললেন,এই ছেলেটি জ্যামিতির জটিল তত্ত্ব জানে। ছেলেটিকে তিনি বেশ কিছু জ্যামিতি সংক্রান্ত প্রশ্ন করলেন এবং ক্রমে ওকে সঙ্গে নিয়ে এক বর্গক্ষেত্রকে দ্বিগুণ করে দেখালেনছেলেটি নিশ্চয় অনেক কিছুই জানতো না,বা বুঝতো না।কিন্তু সব শেষে দেখা গেল,ছেলেটি বলছে,এসব সে আগেই জানতো।কিন্তু জানতো বলে জানতো না।এই হচ্ছে চমস্কির ‘প্লেটোর সমস্যা’র মোদ্দা কথা, কী করে ছেলেটি জানে?

 পরিভাষাটি তাঁর শুরুর দিককার বইপত্রে মেলে না।তাঁর মনের মধ্যে ছিল,পরে আরো বিস্তৃত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ১৯৮৬র বইটিতে ব্যবহার করেন,এবং এটি পরে অন্যদেরও গবেষণার বিষয় হয়ে যায়।কিন্তু কী করে একটি শিশু ভাষা শেখে,ভাষা নির্মাণ করে?এই সব প্রশ্ন তাঁকে গোড়া থেকেই ভাবাচ্ছিল।চমস্কি নিয়ে যেকোনো অধ্যয়নেই এই কথাগুলো শুরুতেই মেলে।প্রশ্নগুলো তার আগে বার্টাণ্ড রাসেলও করেছিলেন বলে চমস্কি উল্লেখ করেছেন,“How comes it that human beings,whose contacts with the world are brief and personal and limited, are nevertheless able to know as much as they do know?৩৪৫

            কেউ না শেখালেও দিব্বি শিশুরা মাতৃভাষা শিখে ফেলে।নতুন নতুন শব্দ-বাক্য হয়তো কিছুটা সে শোনে  শেখে।কিন্তু তার থেকেই এক অন্তর্নিহিত ক্ষমতা বলে নতুন নতুন পদ বাক্য সৃষ্টি করে চলে।শুরুতে সে হয়তো ‘যাইছিলাম’,‘গেতেছ’,এমন সব ভুল নির্মাণ করে।কিন্তু নির্মাণটি করে সে শেখা শব্দ বাক্যগুলোর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে।কিছু তার বড়রা ঠিকও করে  দেয়কিন্তু অধিকাংশই সে শিখে ফেলে।বড় হয়ে একই প্রক্রিয়া সে কাজে লাগায় দ্বিতীয় ভাষা রপ্ত করতে।এই যে শিশুর ভাষা রপ্ত করবার এবং নতুন নতুন বাক্য তৈরির ক্ষমতা –কিংবা অন্যে বললে তার অর্থ বোঝে নেবার ক্ষমতা--- চমস্কির কাছে সেই ‘ক্ষমতা’টিই একটি জটিল প্রশ্ন।বলতে গেলে তাঁর জীবনভর কাজের জিজ্ঞাসা।তারই উত্তর সন্ধানে জন্ম নিয়েছে এবং বিকশিত হয়েছে Transformational-Generative Grammarবাংলাতে কেউ কেউ একে ‘সংবর্তনী সঞ্জননী ব্যাকরণ’ বলে অনুবাদ করেছেন। সে এমন অনুবাদ যে ব্যাখ্যা করে না দিলে বাংলা জানা কারো পক্ষেই এই পরিভাষার অর্থোদ্ধার ইংরেজিটির থেকে কঠিন হবে।রামেশ্বর শ’ লিখেছেন ‘রূপান্তরমূলক সৃজনমূলক ব্যাকরণ’এটি বরং বাংলাতে বোঝা সহজ।হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন,‘রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ’৩৪৬ ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া অসমিয়াতে একে লিখেছেন,‘রূপান্তর স্ফোট ব্যাকরণ’৩৪৭‘স্ফোট’ কথাটার অর্থ সেই একই৩৪৮,যা রামেশ্বর শ’ বা হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন।আমরা  রামেশ্বর শ’য়ের পারিভাষিক নামটিই রেখে ড ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া যেভাবে সংক্ষেপে উপস্থাপন করেছেন তারই আদলে পুনরুস্থাপন এবং পুনর্বিন্যাস  করছি।ঘনঘন পুনরুক্তি এড়াতে আমরা কখনো বা তিন পদের পুরো নামের বদলে শুধুই ‘রূপান্তরমূলক ব্যাকরণ বলে’ও কাজ চালাবতিনি বা রামেশ্বর শ’ কেউই সেরকম অসমিয়া বা বাংলা ভাষা বিশ্লেষণ করেন নি।চমস্কিও তাঁর ব্যাকরণকে ভাষাগুলোকে বিশ্লেষণ করবার ‘device’ বলেছেন।আপাতত আমরা যেটি পারছি,সেটি হলো সেই ‘device’ বা যন্ত্রটির সঙ্গে একেবারেই প্রাথমিক একটি পরিচিতি ঘটাতে। সেটি করতে গিয়ে যদি ভাষাগুলোর কোনো স্বভাব আমাদের সামনে আসে,তবে সেটি বাড়তি পাওনা মাত্র।

            ভাষা মানে বাক্যের সংহতি।চমস্কি সেরকমই বলেছিলেন।সসীম উপকরণে তৈরি উপকরণ দিয়ে,সসীম দৈর্ঘ্যের অসীম বাক্য তৈরি করে চলে মানুষ।লক্ষ্য করলে দেখা যাবে রূপগত ভাবে পরস্পর সম্পৃক্ত।এর মধ্যে কিছু যেন সংক্ষিপ্ত তথা সার বাক্য।ইংরাজিতে বলে kernel sentenceবাকি বাক্যগুলো সেই সারবাক্যের থেকে কিছু নির্ধারিত নিয়ম অনুসরণ করে তৈরি করা তথা রূপান্তরিত।ইংরেজিতে বলে derivedযেমন:

                                      অ।অস.মই কাইলৈ ঘৰলৈ নাযাওঁ। 

                                           বাং.আমি কাল বাড়ি যাব না।

                                          সিল.আমি কাইল বাড়িত যাইতাম নায়।

                        বোঝাই যাচ্ছে এটি রূপান্তরিত নঞর্থক বাক্য। মূলে বাক্যটি এরকম:

                                       অ।অস.মই কাইলৈ ঘৰলৈ যাম। 

                                           বাং.আমি কাল বাড়ি যাব ।

                                          সিল.আমি কাইল বাড়িত যাইমু।

                        তেমনি আরেকটি বাক্য:

                                       আ।অস.কাইলৈ  পৰীক্ষা হ’ব নে?  

                                            বাং.কাল কি পরীক্ষা হবে?

                                           সিল.কাইল (কিতা) পরীক্ষা অইবো নি?

                        রূপান্তরমূলক সৃজনমূলক ব্যাকরণ এই রূপান্তরের নিয়মগুলোর সন্ধান করে।করতে গিয়ে ইত্যাদি বলে কোনো বিষয় ছেড়ে রাখে না,বা ব্যতিক্রম বলেও কোনো প্রশ্নকে এড়িয়ে যায় না। সেটি করতে গিয়ে এই ব্যাকরণ পূর্বতন সব ব্যাকরণের পরিভাষাগুলোরই ব্যবহার করে,নিজেও অনেক কিছু তৈরি করে।কিন্তু তার পদ্ধতিটিই এমন যে পরিভাষাগুলোর এক সংক্ষিপ্তিকরণ তার দরকার পড়ে। কেন,সেটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হবে। যেমন রূপান্তরের নিয়ম কথাটিকেও সে সংক্ষেপে বোঝায় T-rules বলে।ড ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া এর অসমিয়া করেছেন ‘রূপা নিয়ম’আমরা বাংলাতেও চালতে পারি।এর পরে থেকে যদি কোনোটির জন্যে বাংলাতে স্বতন্ত্র সংকেতের দরকার পড়ে উল্লেখ করে যাবঅন্যথা অসমিয়া সংকেতগুলোই বাংলাতেও গ্রহণ করা চলে বলে বুঝে নেব আমরা।এর আগে আমরা কালিক ভাষাবিজ্ঞানে ‘গঠন’ কথাটির কথা জেনে এসেছি।রূপান্তরবাদ শুরুতেই সেই গঠনের দুই ভাগ করে,---১)বাহ্যিক গঠন (surface structure)এবং ২)আভ্যন্তরীণ গঠন (deep structure)ভারতীয় অলঙ্কার শাস্ত্রের অভিধেয়ার্থ,লক্ষণার্থ, ব্যাঙ্গার্থ বা ব্যঞ্জনার্থের কথা এই প্রসঙ্গে মনে পড়বে।বাক্যে ব্যবহৃত শব্দ এবং সেগুলোর বৈয়াকরণিক অন্বয়ে যে রূপটি বাইরে থেকে শোনা বা পড়া যায় সেটি বাহ্যিক গঠন।আর সেই গঠনের ভেতরে আরেকটি অর্থ লুকিয়ে থাকতে পারে,যে অর্থকে সামনে আনতে গিয়ে বাক্যটির রূপান্তর সম্ভব।এই দ্বিতীয় রূপ যেন প্রথমটির ভেতরে লুকিয়ে থাকে। যেমন:

                                    ই।অস.পাগলে নকয় কি?

                                        বাং.পাগলে কী না বলে?

                                       সিল.পাগলে কিতা না কয়? 

            গঠনের দিক থেকে এটি নঞর্থক প্রশ্নবোধক বাক্য।কিন্তু যে শোনে সে কোনো জবাব দেবার দরকার মনে করে না। সে এর একটা সদর্থক বিবৃতিমূলক বাক্যের অর্থ ধরে নেয় এরকম:

                                    ঈ। অস.পাগলে যি মন যায় তাকে কয়

                                         বাং.পাগলে যা ইচ্ছে তাই বলে 

                                        সিল.পাগলে যেতা ইচ্চা অতা কয়

            এই ‘ই-বাক্য’ হচ্ছে বাহ্যিক গঠন,আর ‘ঈ-বাক্য’ হচ্ছে আভ্যন্তরীণ গঠন।বহু সময় এই দুই গঠনের মধ্যে ভেদ করা মুশকিল হয়।কিন্তু রূপান্তরমূলক ব্যাকরণ সর্বাবস্থাতে সেটি মনে রাখে।কারণ লোকে বাকবিনিময় করবার সময় সেটি মনে রাখে।এই বাক্যটি যেমন:

                                    উ। অস.তাই তালৈ গ’ল।

                                         বাং.সে ওখানে গেছে।

                                        সিল.তাই হিনো গেছে।

            এর দু’রকম অর্থ হতে পারে অসমিয়াতে ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া সেরকমই লিখেছেন।৩৪৯

                                    .অস. তাই সেই ঠাইলৈ গ’ল।

                                           বাং. ও সে জায়গাতে গেছে।

                                            সি. তাই হ জাগাত গেছে।

                                    .অস. তাই সেইজন মানুহলৈ (ঘৈণীয়েক) গ’ল।

                                           বাং. ও ওদের ওখানে গেছে।

                                            সি. তাই তারার হিনো গেছে।

            ভ্যন্তরীণ অর্থ ধরতে গেলে প্রেক্ষিত বোঝা দরকার। আর প্রেক্ষিত শুধু ব্যক্তি নয় ভাষাভেদেও ভিন্ন হতে পারে, সে ‘ঊ-২’ বাক্যের বাংলা এবং সিলেটি যে অনুবাদ আমরা করলাম তাতে বোঝা গেল।প্রথমত মান বাংলাতে ‘তাই’ নেই। সুতরাং সে স্বামী ঘরে গেছে কিনা--সেরকম অর্থ করবার কোনো সুযোগই নেই।সিলেটিতে যদিও বা ‘তাই/সে’ ভেদ রয়েছে,সরাসরি কেউ বরের বাড়ি গেছে--এমন অর্থ করা কঠিন।যাই হোক,আপাতত সেসব কোনো সমস্যা নয়।অসমিয়া অভ্যন্তরীণ অর্থ সেরকম হতেই পারে।ড ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া সেরকমই লিখেছেন।৩৫০ তিনি লিখেছেন ‘উ- বাক্য’-এর ,“... ‘তালৈ’ শব্দ ব্যক্তি বুজুয়া (+মানুহ) হয় নে নহয় তার ওপরত নির্ভর করি বাক্যটোর অন্তর্নিহিত অর্থ নিরূপিত হ’ব।”৩৫১ফলে এই বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ রূপের মধ্যে স্পষ্ট ভেদ বোঝাটি রূপান্তরমূলক  ব্যাকরণের জন্যে খুব দরকারি বিষয়।তাই এই দুই শব্দগুচ্ছের ব্যবহারও ঘন ঘন করতে দেখা যায়।পুরো শব্দ এই ব্যাকরণে ব্যবহৃত হয় খুবই কম।তাই ড ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া লিখেছেন অসমিয়াতেও,“খুব সম্ভব বাহ্যিক গঠন বুজাবলৈ ‘অভিধা রূপ/গঢ়’ আরু আভ্যন্তরীণ গঠন বুজাবলৈ ‘ব্যঞ্জনা রূপ/গঢ়’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করিলে আপত্তির কোনো থল নাথাকিব।”৩৫২   বাংলাতে আমরা ‘গঢ়’-এর বদলে ‘গঠন’ লিখতে পারি। 

 তিনি আরো লিখেছেন,“রূপান্তর স্ফোট ব্যাকরণে প্রতিজন আদর্শ মাতৃভাষা-ভাষীর নিজর মাতৃভাষাত থকা ভাষা-পটুতা(competence) আরু ভাষাকৃতি(performance)-র মাজতো এটা সুস্পষ্ট ভেদ নির্ণয় করিব বিচারে।”৩৫৩  এই ‘ভাষা-পটুতা’ বিষয়টি আমাদের কাছে সামান্য অস্পষ্ট এর জন্যে যে,এটি কি ভাষার মান রূপ?ব্যাকরণ নির্দেশিত রূপ?ব্যক্তির ‘ভাষা-কৃতি’-র কথা তার থেকে আলাদা করে ভাবা হচ্ছে,কারণ  কথা বলবার সময় ব্যক্তি উচ্চারণে,পদ বিন্যাসে বাক্যের গঠনে সামান্য ভুলভাল করেই থাকে। কিন্তু তাতে শ্রোতার মর্মার্থ বুঝতে অসুবিধে হয় না।রূপান্তরমূলক ব্যাকরণ ভাষাব্যবহারের সেই রূপকেও নিজের বিবেচনাতে নেয়।কিন্তু প্রশ্ন তো থেকেই যায় ব্যক্তি যে ব্যক্তির ভাষার ‘ভুল’ কীসে ঠিক হবে?ফণীন্দ্র নারায়ণ লিখেছেন,“আদর্শ মাতৃভাষা-ভাষীয়ে সদায় ভাষা পটুতার স্তরত বিচরণ করে।”৩৫৪ ‘Aspects’-এ চমস্কিও এরকমই আদর্শ বক্তা-শ্রোতার কথা লিখেছেন।৩৫৫আমরা এর এক আভ্যন্তরীণ অর্থ বুঝে নিতে পারি এরকম যে তিনি মানভাষা বা ব্যাকরণ নির্দেশিত ভাষার কথা বলছেন না। সেক্ষেত্রে সিলেটি সহ ভাষাবৈচিত্র্যগুলো নিয়ে আমাদের সমস্যাতে পড়তে হবে।আসলে বলছেন ভাষার একটি সর্বজনগ্রাহ্যরূপের কথা যাকে মোটামুটি সবাই সঠিক বলে মনে করেনব্যক্তি বহু সময় ভাষা ব্যবহারে সেই রূপের থেকে বেরিয়ে পড়েন,যাকে বলা হচ্ছে ব্যক্তির ভাষাকৃতি।ভাষার এই দুই রূপই রূপান্তরমূলক সৃজনমূলক ব্যাকরণের অধ্যয়নের বিষয়।

রূপান্তরমূলক সৃজনমূলক ব্যাকরণের পারিভাষিক প্রতীক:

            ব্যাকরণে পরিভাষার বিকল্পে সংক্ষিপ্ত চিহ্নায়ন পাণিনিতেই দেখা গেছিল।‘অষ্টাধ্যায়ী’-তে অচ̖ বললে স্বরবর্ণ, হল̖ বললে ব্যঞ্জনবর্ণ,সুবন্ত মানে শব্দরূপ,তিঙন্ত মানে ধাতুরূপ—এই সব পারিভাষিক সূত্রের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে।পরম্পরাগত বাংলা অসমিয়া ব্যাকরণে এই সব সংক্ষিপ্ত সূত্র নেই বটে,কিন্তু অভিধানে প্রায়ই ব্যাকরণিক সংবর্গগুলোকে সংক্ষেপে হাজির করা হয়,শব্দের ধর্ম বোঝাতে।স্যসুর এবং চমস্কি পাণিনির সঙ্গে শুধু পরিচিতই নন, দুজনেই তাঁর দ্বারা গভীর ভাবে অনুপ্রাণিত।আমরা নিশ্চিত নই,চমস্কি তাঁর সংক্ষিপ্ত চিহ্নায়নের ধারণা সেখান থেকেই নিয়েছেন কিনা।কিন্তু পরম্পরাগত ইংরেজি ব্যাকরণে যেসব পারিভাষিক শব্দের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে,সেগুলো, আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের তাবৎ পরিভাষা যেগুলো এই ব্যাকরণে কাজে লাগে,এবং রূপান্তর মূলক ব্যাকরণের নিজস্ব পরিভাষাগুলোর এক একটা সংক্ষিপ্ত রূপের এবং সেই সঙ্গে বীজগণিতের বহু চিহ্নকে এই ব্যাকরণ কাজে লাগায়।বলতে পারি এই ব্যাকরণ হচ্ছে ভাষা বিশ্লেষণের এই সব চিহ্ন নির্মিত যন্ত্র বিশেষ।ফলে চিহ্নগুলোকে চেনা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

            ক) প্রথমেই দু’রকম পদ প্রতীক---১) বর্গ প্রতীক(class Symbols),২) রূপ প্রতীক(morpheme symbol)

১) বর্গ প্রতীক:পরম্পরাগত ব্যাকরণে পদ মাত্রেরই কিছু বর্গের সঙ্গে আমরা পরিচিত। যেমন ---বিশেষ্য, বিশেষণ,অব্যয়,সর্বনাম,ক্রিয়া ইত্যাদি।ইংরেজিতে শব্দ-পদ নির্বিশেষে word কথাটি ব্যবহৃত হয়।ফণীন্দ্র নারায়ণ word কথাটির অসমিয়া অনুবাদ ‘শব্দ’ করে গেছেন বলেই মনে হয়।অথচ,বাংলা অসমিয়াতে বাক্যে ব্যবহৃত হলেই শব্দকে পদ বলবার পরম্পরা রয়েছে।আমরা ‘পদ’ কথাটিই ব্যবহার করে যাবঅভিধানে প্রথম এক বা দুই বর্ণে সংক্ষিপ্ত রূপ দিয়ে পদের বর্গ বোঝানো হয়। যেমন---বি মানে বিশেষ্য,বিণ মানে বিশেষণ ইত্যাদি।রূপান্তরমূলক ব্যাকরণ সেই সব সংক্ষিপ্ত চিহ্নগুলোকে কাজে লাগায়।তবে পারিভাষিক নাম ইত্যাদির বেলা ‘শব্দ’-কেই সংক্ষিপ্ত করা হয় বটে। যেমন ‘পদ’-এর বদলে ‘প’,‘বাক্য’-এর বদলে ‘বা’ ইত্যাদি।তদুপরি,বাক্যে ব্যবহৃত পদগুচ্ছকে মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করে বিশেষ্য পদগুচ্ছ (noun phrase) এবং ক্রিয়া পদগুচ্ছ(verb phrase)সংক্ষেপে NP এবং VPবাংলা অসমিয়াতে সংক্ষেপে লেখা চলে বি. এবং ক্রি. যেমন:

                                                ঋ।অস. ৰাম আহিল

                                                    বাং. রাম এলো।

                                                   সিল. রাম আইলো।

            এই বাক্যগুলোকে বর্গপ্রতীকে এভাবে লেখা চলে

                                                এ। বি.প (NP)+ক্রি. (VP)

                        ২) রূপ প্রতীকঃ রূপ মানে রূপিম।আমরা মুক্ত রূপিম,বদ্ধ রূপিমের কথা জেনে এসেছি।সরাসরি রূপিমটিকে না বুঝিয়ে তার বর্গ চিহ্নিত করা হয় বলেই মনে হয় এখানে ‘রূপিম’ (morpheme) না বলে সরাসরি ‘রূপ’ (form) কথাটিই ব্যবহার করা হয়।মুক্তরূপ(free form) পুরোটাই উল্লেখ করে বোঝানো হয়,কিন্তু বদ্ধরূপ (bound form) তারা যেসব ব্যাকরণিক সংবর্গগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে সেগুলোকেই সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়। যেমন:

                                                ঐ.১অস.ৰাম আহিল

                                                       বাং.রাম এলো।

                                                      সিল.রাম আইল।

                                                   অস.যদু আহিব

                                                       বাং.যদু আসবে।

                                                      সিল.যদু আইব।

            ‘ঐ-১ এবং ২’ বাক্য একই।শুধু তাদের মধ্যে ক্রিয়ার কালের তফাৎ।সুতরাং বি.প ‘রাম’ এবং ‘যদু’ এবং অসমিয়া আহ̖ ,বাংলা আস̖ (~এস̖),সিলেটি আ মুক্তরূপএগুলোকে পুরোটাই উল্লেখ করা হবে।কিন্তু অসমিয়া –ইল̖ এবং –ইব,বাংলা –লো এবং –বে,সিলেটি –ইল এবং -ইব বদ্ধরূপ।এগুলো যথাক্রমে অতীত এবং ভবিষ্যৎ কাল বুঝিয়েছে।ফলে সংক্ষেপে রূপ গুলো না দেখিয়ে +অতী (+past) এবং +ভবি (+fut) লিখে বোঝানো হয়। যেমন:

                                                ও।১অস.ৰাম আহ +অতী

                                                       বাং.রাম আস+অতী

                                                      সিল.রাম আ +অতী

                                                   অস.যদু আহ +ভবি

                                                       বাং.যদু আস+ভবি

                                                      সিল.যদু আ +ভবি

            খ) গ্রন্থি/ গাঁঠ (String): পদগুচ্ছের আলোচনাতে এক বা একাধিক পদ প্রতীককে গ্রন্থি বলে বোঝানো হয়। ফণীন্দ্র নারায়ণ ‘সূত্র’ লিখেছেন।‘সূত্র’ লিখলে ইংরেজি formula বা rule বলে ভ্রম হয়।string কথাটির যথার্থ বাংলা হবে গ্রন্থি বা গাঁঠ।শব্দগুলো অসমিয়াতেও রয়েছে,শুধু তদ্ভব শব্দটি ‘গাঁঠি’আমরা তাই লিখলাম।উপরে ‘এ’ পুরোটাকে আমরা বলতে পারি ‘এ-সূত্র’কিন্তু তার অংশ গুলো,বি.প এবং ক্রি. দুটি স্বতন্ত্র গ্রন্থি।তবে সম্ভবত stringএবং rule তথা গ্রন্থি এবং সূত্রের মধ্য তফাত সব সময় স্পষ্ট রাখা হয় না।তবে চমস্কি stringএবং rule শব্দ দুটি অধিকাংশ সময় দুই ভিন্ন অর্থেই ব্যবহার করেছেন।

            গ) + (যোগ) চিহ্ন: চিহ্নটির ব্যবহার ইতিমধ্যে আমরা করে এসেছি+ চিহ্ন দিয়ে একাধিক গ্রন্থিকে জুড়ে এসেছি।এই চিহ্নে দুই গ্রন্থির সংযোগ বোঝায়।

            ঘ) # (হ্যাস) চিহ্ন:এর ইংরেজি ‘হ্যাস’ (hash) নামটি একটি পুরোনো ফরাসী নাম শব্দ hachete থেকে এসছে।এর কোনো ভারতীয় নাম থাকবার কথা নয়।ইতিহাসের বেশ কিছু সংযোগ এই চিহ্নে এসে মিলেছে।ফ্রান্সে কুঠার এবং হাতুড়ির মিশ্রণ ঘটালে যেমন দেখাবে সেরকম এক কাঠ কাটা এবং আকার দেবার যন্ত্রের নাম ছিল। অন্যদিকে চতুর্দশ শতকে ওজনে পাউন্ড বোঝাতে lb লেখা হতো,লাতিন libra pondo কথাটির সংক্ষিপ্তরূপ।lb হাতের লেখাতে কেটে অনেকটা এরকম  আকার নিয়ে থাকে।তার থেকে একদিকে ব্রিটিশ £ এবং মার্কিন # চিহ্ন দেখা দেয়।স্বাভাবিক ভাবেই গণিতেও ব্যবহার হতে শুরু করে।মার্কিনিরা #10 লিখলে বোঝাতেন শুধুই সংখ্যা,10# লিখে বোঝাতেন সেই পরিমাণ পাউণ্ড। টেলিপ্রিন্টার প্রচলিত হলে ব্রিটিশ £ এবং মার্কিন #  নিয়ে দীর্ঘ বিবাদের কাহিনি আছে।এখন কম্প্যুটার,বিশেষ করে আন্তর্জাল জমানাতে এই # একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় চিহ্ন। কোনো দীর্ঘ বক্তব্যের থেকে কোনো এক পদ বা পদগুচ্ছকে আলাদা করে অন্যের সংলাপের সঙ্গে যুক্ত করতে গেলে চিহ্নটি ব্যবহার করা হয়এ যেন অনেকটা ঐ ফরাসী  hachete দিয়ে  জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে ছেঁটে আলগা করে ব্যবহারোপযোগী করবার মতো ব্যাপার।রূপান্তর তত্ত্বে অনেকটা এই প্রয়োজনেই একে ব্যবহার করা হয়।সুতরাং একে অসমিয়াতে ফণীন্দ্র নারায়ণ  যেভাবে ‘দ্বিত্ব পূরণ চিন’ বলে অনুবাদ করেছেন,৩৫৬সেরকম করা যায় কিনা,আমাদের সংশয় আছে।আমরা তার ইংরেজি নামেই রাখলাম। 

যখন একটি বাক্যকে বিভিন্ন প্রতীকে অনুবাদ করে দেখানো হচ্ছে তখন সেই বাক্য বা পদগুচ্ছের সীমা নিয়ে কোন বিভ্রান্তি না দেখা দেয়,তাই এই  # (হ্যাস) চিহ্ন তার দু’দিকে বসিয়ে সীমা চিহ্নিত করা হয়। যেমন #বা# (#s#) মানে হচ্ছে একটি পরিপূর্ণ বাক্য।যদি # বি.+ ক্রি.প #  (#NP +VP#) লেখা হয় তবে বুঝতে হবে বি.প এবং  ক্রি.প এই দুই গ্রন্থি জুড়ে এক পরিপূর্ণ বাক্য তৈরি হয়েছে। 

ঙ) ---> ( ডান মুখো তির বা পুনর লেখন) চিহ্ন: ফণীন্দ্র নারায়ণ  লিখেছেন,“ রূপান্তর স্ফোট ব্যাকরণত কাঁড় চিনর অর্থ এয়ে যে কাঁড়ত বাওঁফালে থকা কথাখিনি সোঁফালে দিয়ার দরে লিখিব লাগে।”৩৫৭ ‘লিখিব লাগে’ বা লিখতে হবে বলে কথা নেই।আসলে বোঝায় এভাবেও লেখা চলে।ডান দিকে সাধারণত বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়।অর্থাৎ বিশ্লেষিত রূপটি দেখানো হয়। যেমন: বা---> বি.প + ক্রি.বিণ+ ক্রি.প ।

চ) * (তারা) চিহ্ন: কোন পদ বা পদগুচ্ছের বায়ে উপরে এই * চিহ্ন থাকবার মানে হচ্ছে,এটি ব্যাকরণ সিদ্ধ নয়। যেমন: বাং.-অস.-সিল. *যাইছিল, বাং.*গেতেন ইত্যাদি

ছ) () (প্রথম বন্ধনী) চিহ্ন: এটি ‘ইচ্ছা’র দ্যোতক।এর ভেতরে কোনো গ্রন্থির উল্লেখ করবার মানে সেটি ব্যবহার করা না করা বক্তা বা লেখকের ইচ্ছাধীন। যেমন:

যদি লেখা হয়       ক ---> খ (গ)

এর অর্থ              ক ---> খ  হতেই হবে।

কিন্তু এটা ইচ্ছাধীন ক ---> খ +গ

           

            জ) {} (দ্বিতীয় বন্ধনী) চিহ্ন: দুই বা ততোধিক নিময় বা সূত্রকে একত্রে উল্লেখ করতে গিয়ে এই চিহ্নের ব্যবহার করা হয়। যেমন: 




         ঝ) [ ] (তৃতীয় বন্ধনী) চিহ্ন:দুই বা ততোধিক গ্রন্থী বা সূত্র  সদৃশ হলেও যদি কোনো আভ্যন্তরীণ বৈসাদৃশ্য নির্দেশ করতে হয় তবে এই তৃতীয় বন্ধনীর ব্যবহার করা হয়যদি কোনো ভাষাতে

                                    ক+গ+স -->   ক +গ + স

                                    খ+গ+স -->  খ +গ + স হয়,দৃশ্যত ডানে বামে গ্রন্থিগুলো একই মনে হচ্ছে।কিন্তু ক এবং খ-এর মধ্যে তফাৎ আছে,সেটি দেখাতে হবে।দেখানো এই ভাবে যায়,সংক্ষেপে


ডান দিকের ক এবং খ-কে ফণীন্দ্র নারায়ণ কেন ঊর্ধ্বরেখ করেছেন উল্লেখ করেন নি,৩৫৮আমরা না করেই রাখলাম।

       ঞ) => (দ্বিরেখ তির) চিহ্ন: দুই বাক্যের মাঝে এই চিহ্ন ব্যবহারের মানে হচ্ছে বামের বাক্যকে রূপান্তরিত করে ডানের বাক্য তৈরি হয়েছে।  

 

রূপান্তরমূলক সৃজনমূলক ব্যাকরণে উপাদান বিশ্লেষণ:চমস্কি অব্যবহিত গঠনগত উপাদান বিশ্লেষণের কাঠামোবাদী ছক বাতিল করেছিলেন।তিনি যে ছকগুলো দাঁড় করাচ্ছিলেন তার মধ্যে প্রথমটিকে ‘Syntactic Structures’-এ তিনি ‘State Diagram’ বলে লিখেছিলেন।৩৫৯ আমরা এর বাংলা করতে পারি ‘অবস্থান চিত্র’কিন্তু সেখানেই সেটিকে তিনি খুব কাজের নয় বলে বাতিল করে,পদগুচ্ছ ব্যাকরণ (phrase structure grammar) তথা ƩF ব্যাকরণ পদ্ধতির আশ্রয় নেন।এর দু’রকম ছক।একটি উলম্বে স্তরীভূত সজ্জা,আরটি পতিতবৃক্ষচিত্রের ছক।ƩF এর Ʃ হচ্ছে বাক্য- সংহতি তথা ভাষা,কখনোবা একটিই বাক্য,F হচ্ছে তাদের পুনর্লিখন নিয়ম তথা সূত্র।

এই খানে এসে আমাদের সামান্য সমস্যাতে পড়তে হচ্ছে।আমাদের কাছে ড ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়ার যে উপস্থাপনাটি রয়েছে,সেটিতে সামান্য ছাপাভুল,অথবা অস্পষ্ট উপস্থাপনা রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।কী সেটি আমরা যথাস্থানে উল্লেখ করে যাবো।বিকল্পে আমাদের কাছে স্বয়ং চমস্কির ‘Syntactic Structures’ বইটিই রয়েছে যার বর্তমান অংশটি অনেক সরল এবং সহজতো বটে।কিন্তু পরবর্তী অংশগুলো ফণীন্দ্র নারায়ণকে ছাড়িয়ে গেছেযেহেতু তিনি পুরো তাত্ত্বিক স্বরূপটিই রচনা করছেন,আমাদের মতো সংক্ষিপ্তসার উপস্থিত করছেন না।অন্যদিকে যে উদাহরণ বাক্য দিয়ে এই অংশটি ফণীন্দ্র নারায়ণ উপস্থিত করছেন,তিনি পরবর্তী অংশেও ব্যাখ্যার সুবিধের জন্যে সেটিকে টেনে নিয়ে গেছেন,যেখানে চমস্কি নতুন নতুন বাক্যও ব্যবহার করছেন।ফলে আমাদের সামনে থাকছে দু’টি পথ: ১) আমাদের প্রয়োজনীয় সংশয় সংকেতভাষ্যসহ ফণীন্দ্র নারায়ণকেই অনুসরণ করা।২) স্বাধীনভাবে চমস্কির সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করা।আমরা প্রথমটিই সহজ এবং আমাদের বর্তমান অধ্যয়ন আদলে সম্ভব বলে করে এগোচ্ছি।শুধু সম্ভবত সেখানে বাড়তি ভুল সংযোজনের সম্ভাবনা নাকচ করতে মান বাংলা কিংবা সিলেটি বাক্যে নজির আর থাকবে না।

         

ধরা যাক একটি আদল ব্যাকরণ অ দেয়া থাকল এরকম:

                                   

# বা #

                                    . বা ---> বি.শ + ক্রি.

                                    . বি. ---> নি+ বি

. ক্রি. --->  বি.শ+ ক্রি.

. বি.শ --->   নি + (বিণ) +বি

. ক্রি. --->  ক্রি.বিণ +ক্রি. + অতী

. ক্রি. ---> ক্রি. + অতী

. নি ---> সৌজন, এখন

. বি ---> মানুহ, গাড়ী

                                    . ক্রি ---> আন + অতী

                                    ১০. বিণ --->  নতুন

                                    ১১. ক্রি.বিণ ---> যোৱাকালি।

                     এই ‘অ ব্যাকরণ’-এ যে সার বাক্যটিকে বিশ্লেষণ করা হলো সেটি এই:

                                     ঔ।  সৌজন মানুহে  এখন নতুন গাড়ী যোৱাকালি আনিলে। 

 

এখানে অধ্যাপক ফণীন্দ্র নারায়ণ৩৬০থেকে আমরা সরে এসেছি মূলত তিনটি জায়গাতে---১) সূত্র বা গ্রন্থি যাই বলি,প্রথম পাঁচটি আমাদের সজ্জা। শেষ ছটি তাঁর।আমাদের গ্রন্থি সংখ্যা দুটি বেড়েছে।তিনি ১ নংটি লিখেছিলেন, বি.শ + ক্রি.বিণ+ ক্রি.শ।অথচ আমরা জেনে এসেছি বাক্যমাত্রকেই সরাসরি বি.শ এবং  ক্রি.শ –মোটা দাগে এই দুই ভাগেই ভাগ করা হয়,এবং ক্রমান্বয়ে ক্রি.শ-এর অংশ হিসেবে যদি বি.শ রয়েছে,--- সকর্মক বাক্যে যা অবশ্যই থাকে এবং যেগুলোকে একত্রে ‘বিধেয়’ বলাই ইংরেজি ব্যাকরণের পরম্পরা---সেই বি.শ-কেও আলগে যেতে হয়।তিনিও ২নং সূত্র সেভাবেই রেখেছিলেন,‘ক্রি. ---> বি.শ+ ক্রি’সেখানে তাঁর ১ নং গ্রন্থিতেই ক্রি.বিণ বসিয়ে দেয়াটা বিসদৃশ ঠেকেছে। ১নং সূত্রে একে আলাদা দেখাবার কারণটি স্পষ্ট নয়। সেটিকে যথাস্থানে আনতে গিয়ে তাঁর ১ থেকে ৫ অব্দি গ্রন্থি বা সূত্রে যেটুকু পরিবর্তন আনতে হয়েছে,আমরা এনেছি আমাদের প্রথম পাঁচ সূত্রেতাঁর ৩ নং সূত্রটি ছিল ‘ক্রি.শ---> নি + (বিণ)+বি’ডানদিকে কোনো ক্রিয়ার উল্লেখ নেইআসলে তিনি কর্ম অংশের তথা তাঁর ২নং সূত্রের বি. বিশ্লেষণ করছিলেনসুতরাং তির চিহ্নের বা দিকে বি.শ বসিয়ে আমরা ৪নং গ্রন্থিতে দেখালাম।(বিণ) বর্গরূপটিকে এখানে তিনিও বন্ধনীতে রেখেছেন,হয়তো ইচ্ছাধীনতার কথা বোঝাতে।আমরাও তাই রাখলাম।২) তিনি ‘+ অতী’ অংশটুকু প্রথম বন্ধনীর ভেতরে দেখাচ্ছিলেন।প্রথম বন্ধনীর একটি অন্য অর্থের কথা তাঁর থেকেই জেনে এসেছি।এখানে +অতী ইচ্ছাধীন বিষয় নয়।ফলে আমরা বন্ধনী সরিয়ে দিয়েছি।চমস্কি এসব অংশকে বন্ধনী ছাড়াই লিখেছেন,অথবা মুক্ত রূপের গায়ে লাগিয়ে সামান্য নিচেও লিখে গেছেন যোগ চিহ্নটি ছাড়াই। ৩) ‘যোৱাকালি’ অধিকরণ কারকের পদ এবং সাধারণত কর্মের আগে বসে।তিনি সেখানেই বসিয়েছিলেন।কিন্তু ক্রিয়া পদের পাশাপাশি বসে নি বলেই মনে হয় তাঁর একে নিয়ে শুধু এখানেই নয়,পরেও সমস্যা হচ্ছিল,আমরা পরে দেখাবএখানে কারক চিহ্নিত করে দেখানো হয় নি,পদ চিহ্নিত করে যাওয়া হয়েছে।এবং পদ হিসেবে এটি ক্রিয়াবিশেষণই বটে।ইংরেজি বাক্যে সাধারণত এই পদ ক্রিয়ার পরে বসে।ফলে NP+VP বিশ্লেষণে সমস্যা হবার কথা নয়।বাংলা অসমিয়া বাক্যে এটি দরকারে কর্তার আগেও যেতে পারে। সেসব জটিলতা আপাতত এড়াবার জন্যে,আমার একে ক্রিয়ার কাছাকাছি নিয়ে এলাম৪) আরেকটি গৌণ পরিবর্তন আমরা করেছি।বিশ্লেষণে তিনি ক্রিয়া দেখিয়ে গেছেন ‘আন̖ + (অতী)’,কিন্তু সার বাক্যে লিখেছেন ‘কিনিলে’একে আমাদের ছাপাভুল বলেই মনে হয়েছে। 

            এবারে ‘অ-ব্যাকরণ’ ব্যবহার করে তার ডানদিকের গ্রন্থিগুলো নিয়ে কীভাবে বাক্য গড়ে উঠেছে তথা একে ঔ বাক্যের সাধনস্তরগুলো  দেখানো যেতে পারে এভাবেও,--

     

# বা #

                                    .   বি.শ + ক্রি.

                                    .   নি+ বি+  ক্রি.

.   নি+ বি+ বি.শ+ ক্রি

.   নি+ বি+নি + বিণ+বি +ক্রি

.   নি+ বি+নি + বিণ+বি + ক্রি.বিণ +ক্রি. + অতী

.   নি+ বি+নি + বিণ+গাড়ী + ক্রি.বিণ +ক্রি. + অতী

.   নি+ বি+নি + নতুন +গাড়ী + ক্রি.বিণ +ক্রি. + অতী

                                    .   নি+ বি+ এখন + নতুন +গাড়ী + ক্রি.বিণ +ক্রি. + অতী

                                    .   নি+ বি+ এখন + নতুন +গাড়ী + ক্রি.বিণ  +আনিলে

                                    ১০. নি+ মানুহে+ এখন + নতুন +গাড়ী +  ক্রি.বিণ +আনিলে

                                    ১১. সৌজন+ মানুহে+ এখন + নতুন +গাড়ী + ক্রি.বিণ +আনিলে

                                    ১২. সৌজন+ মানুহে+ এখন + নতুন +গাড়ী +যোৱাকালি+আনিলে

 

                 

যেহেতু আমরা আগেই ‘অ-ব্যাকরণ’-এ কিছু রদবদল ঘটিয়েছি,স্বাভাবিক ভাবেই এখানেও ঘটেছে।এবং সূত্র সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২তে,যেখানে ফণীন্দ্র নারায়ণের সংখ্যাটি ছিল ১১অনেক কিছুই বোঝা যাচ্ছে না,কেন কী হয়েছে।এই নিয়ে চমস্কিও সচেতন ছিলেন,যার জন্যে তিনি পতিত গাছের (fallen tree)ছক অব্দি এগিয়েছিলেন।কিন্তু একটা জিনিস বোঝা যাচ্ছে বর্গপ্রতীকগুলো হটিয়ে ক্রমান্বয়ে রূপ প্রতীক গুলো জায়গা জুড়েছে।আমাদের কাছে এখনি স্পষ্ট জবাব নেই ৬নং সূত্রে ‘কর্ম’ গাড়ির রূপপ্রতীকটিই কেন,প্রথম বর্গপ্রতীক একটিকে প্রতিস্থাপিত করল।যাই হোক,এই ১ থেকে ১১ অব্দি গ্রন্থিগুলোকে কোনো না কোনো ভাবে বিশেষণ,নির্দেশক ইত্যাদি জুড়ে সম্প্রসারিত করা গেছে।কিন্তু ১২ নং এর পরে আর পারা যাবে না।এই ১২ নং গ্রন্থিটিকে বলে অন্তিম গ্রন্থি (terminal string),তার আগেকার ১ থেকে ১১ অব্দি গ্রন্থিগুলোকে বলে অনন্তিম গ্রন্থি (terminal string)

            এই পুরো সাধন প্রক্রিয়াকে একটি সাধন বৃক্ষচিত্রে (derivational tree) এভাবেও দেখানো যায়। নিচে যেমন দেখাচ্ছি, সেটি বরং অনেক স্পষ্ট।একে পদগুচ্ছ সূচক ( phrase marker) বা সংক্ষেপে প-সূচক (P-marker)-ও বলে।

এই বৃক্ষচিত্রে ফণীন্দ্র নারায়ণ ক্রি.বিণকে যথারীতি রেখেছিলেন বিচ্ছিন্ন করে @ চিহ্নিত বিন্দুতে যার সঙ্গে বি.শ কিংবা ক্রি.শ কোনো বিন্দুতেই কোনো যোগ ছিল না।আমরা একে ক্রি-গুচ্ছে  জোড়া উচিত ভেবে সেখানে রাখলাম।

পদগুচ্ছের গঠন নিয়মাবলী:এই উলম্বে স্তরীভূত সজ্জা,এবং  পতিতবৃক্ষচিত্রের ছক এই দুটোকেই একত্রে পদগুচ্ছের গঠন নিয়মাবলী বলে কিনা ফণীন্দ্র নারায়ণ সেটি স্পষ্ট করেন নি।শুধু অনুচ্ছেদ ৫.৪-এ  লিখেছেন,“রূপান্তর স্ফোট ব্যাকরণত শব্দগুচ্ছর গঠন নিয়মর সঘন উল্লেখ দেখিবলৈ পোয়া যায়।”৩৬০তবে ব্যাখ্যা তিনি ‘অ-ব্যাকরণ’-এর সূত্রগুলোরই করেছেন।আরো লিখেছেন,“ ই শুনাত জটিল যেন লাগিলেও প্রকৃততে তেনেই উজু ধারণা।ই সাধারণতে তিনিটা কথা সামরে। যেনে,শব্দাবলী,শব্দাবলীর পরস্পর সহগমন সম্বন্ধ (co-occurrence reletion) আরু শব্দাবলীর বর্গীকরণ।”৩৬১‘সহগমন’ ঠিক ‘আসন্ন সঙ্গ’-এর যে ধারণা পেয়েছিলাম,সেরকম নয়।তবে সঙ্গতিতো বটেই।‘যোৱাকালি’ থাকাতে ‘আন̖’ ধাতুতে অতীতের রূপপ্রতীক যুক্ত হলো,বা উলটে বললে অতীতের রূপপ্রতীক ব্যবহৃত হলো বলে ক্রিয়া বিশেষণ ‘যোৱাকালি’ যুক্ত হলো।একে বলে সহগমন।বাক্যে এটি কর্তার বা কর্মের আগেও বসতে পারত,অর্থাৎ ক্রিয়ার থেকে দূরে,সে কথা আগে লিখে এসেছি।   

 

 
 

রূপান্তর নিয়মাবলী:একে সংক্ষেপে রূপা নিয়ম(T-rule) বলে আগে লিখে এসেছি।পদগুচ্ছ নিয়মাবলীর মতো এও একরকমের পুনর্লিখন নিয়ম।রূপান্তর ব্যাকরণের এ হচ্ছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ নিয়মগুলোর একটি।সাধারণত ব্যঞ্জনারূপ গঠনের থেকে অবিধারূপ গঠন তৈরি তথা সৃজন করবার জন্যে এই নিয়ম প্রয়োগ কথা হয়।কখনো বা এক অবিধারূপ গঠন থেকে আরেক অবিধারূপ গঠন তৈরিতেও এই রূপানিয়ম কাজে লাগানো হয়।ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়ার মতে পদগুচ্ছ গঠন নিয়মাবলীর সঙ্গে এর তফাৎ এতোটুকুই যে পদগুচ্ছ নিয়মাবলী এককে সূত্রের সাধন (derivation) বর্ণনা করে,কিন্তু রূপানিয়মাবলী এক সমষ্টির থেকে আরেক সমষ্টির সাধন বিধি বর্ণনা করে।৩৬২  উদাহরণ স্বরূপ বর্গপ্রতীক ‘বিণ’-এর জায়গাতে রূপপ্রতীক বিশেষণ পদ ‘নতুন’ বা সেরকম কিছু বসানো পদগুচ্ছ নিয়মাবলীর বিষয়,কিন্তু

                                   ক।অস.তেঁও এখন গাড়ী কিনিলে ।

                                       বাং.তিনি একখানা নতুন গাড়ি কিনলেন।

                                      সিল.তাইন এখান নতুন গাড়ি কিনলা ।

            এই বাক্যের বদলে  খ।   অস.তেঁও এখন গাড়ী নিকিনিলে ।

                                           বাং.তিনি একখানা নতুন গাড়ি কিনলেন না।

                                          সিল.তাইন এখান নতুন গাড়ি কিনলা না।

            ব্যবহার করাটি রূপা নিয়মের বিষয়।

            রূপা নিয়মের সব কিছুর প্রয়োগ বাধ্যতামূলক নয়।কিছু তার প্রয়োগকর্তার ইচ্ছাধীন। যে নিয়মে ‘ইচ্ছাধীন’ বা ‘বাধ্যতামূলক’ কথাটি লিখে বোঝাতে হয় তার আগে ‘রূপা’ লিখে শেষে নিচে সংক্ষেপে ‘বাধ্য’ বা ‘ইচ্ছা’ কথাটি লিখে দেয়া হয়।উদাহরণ দিয়ে এটি বোঝাতে গিয়ে ফণীন্দ্র নারায়ণ আগে উল্লেখ করা ‘অ-ব্যাকরণ’-এর আশ্রয় নিয়ে ‘আ-ব্যাকরণ’ তৈরি করিয়ে দেখিয়েছেন।আদলটি একই,তাই আমরা আবার লিখছি না।তাছাড়া খানিক সমস্যাও আছে। সেটি লিখছি।তিনি ‘অ-ব্যাকরণ’-এর আদলটি পুরো উল্লেখ করে,শুধু আরেকটি ১০ নং সূত্র লিখছেন এরকম:

                                    ১০. রূপা

                                    বি. + ক্রি.বিণ+ ক্রি.শ => ক্রি.বিণ+ বি. + ক্রি.

                                    (ইচ্ছা)

            এবারে,তাঁর ‘অ-ব্যাকরণ’-এই গ্রন্থি সজ্জাটি প্রথম তথা ১ নং সূত্র ছিল,--বি. + ক্রি.বিণ+ ক্রি.শ।আমরা সেই ক্রম পালটে ফেলেছি,এবং ক্রিয়া বিশেষণটি যে কর্তারও আগে যেতে পারে,সে কথা উল্লেখ করে এসেছি।কিন্তু আমরা যেভাবে ‘অ-ব্যাকরণ’ আদল দাঁড় করিয়েছি,সেখানে সেটি প্রয়োগ করে দেখাবার দক্ষতা আমাদের নেই।চমস্কি বা অন্যদের ইংরেজি বাক্যের নজিরও এই ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করেনা।তবে ‘অ-ব্যাকরণ’-এর যে সাধন স্তর গুলো ১২টি সূত্রে  তির (--->) চিহ্ন ছাড়া দেখিয়ে এসেছি সেটির  ৫ বা ৬ নং সূত্র যদি আমাদের কোনো সাহায্য করে আমরা এভাবে দেখাতে পারি।

            ১৩. রূপা

             নি+ বি+নি + বিণ+বি + ক্রি.বিণ +ক্রি. + অতী => ক্রি.বিণ + নি+ বি+নি + বিণ+বি + ক্রি. + অতী

            (ইচ্ছা)

            তিনি

            ‘আ-ব্যাকরণ’-কে প-সূচক তথা পতিত বৃক্ষচিত্রেও দেখিয়েছেন ফণীন্দ্র নারায়ণ৩৬৩আমরা এখানে বাহুল্য ভেবে বাদ দিলাম।‘অ-ব্যাকরণ’-এ দ্বিতীয় সূত্রে ‘নি+ বি’-র জায়গাতে যদি মানুষের নাম ব্যবহার করতে হয়,তবে দ্বিতীয় বন্ধনীর ব্যবহার করতে হবে। সেটি করে ‘ই-ব্যাকরণ’ তৈরি করা যাবে এরকম:                       

 


                   ইচ্ছা নিয়ম প্রয়োগ করে এই বাক্যগুলোও তৈরি করা যেতে পারে।

                                    ঙ। যোৱাকালি দিলীপে এখন নতুন গাড়ী  আনিলে।

                                    চ। যোৱাকালি গীতাই এখন নতুন গাড়ী আনিলে।

কিন্তু আমাদের কাছে স্পষ্ট নয় ‘ই-ব্যাকরণ’-এ ‘গাড়ি,এখন,নতুন’ শব্দ থাকতে এই বাক্যগুলো কী করে তৈরি হবে:

                                    ছ। যোৱাকালি দিলীপে গীতাক  আনিলে।

                                    চ। যোৱাকালি গীতাই দিলীপক আনিলে।

            ফণীন্দ্র নারায়ণ এরকম বারোটি বাক্যের সম্ভাবনার কথা লিখেছেন।৩৬৪মোদ্দা কথা,সিদ্ধান্ত এই যে রূপা নিয়ম প্রয়োগ করে এমন অজস্র ভিন্নার্থক বাক্য তৈরি করা যেতে পারে।

            বাধ্য নিয়ম প্রয়োগ করেও এমন অজস্র বাক্য তৈরি করা যেতে পারে।ফণীন্দ্র নারায়ণ লিখেছেন,“রূপা (বাধ্য) নিয়মর প্রয়োগ হোয়া কেইটামান সাধারণ ক্ষেত্র হ’ল---ইতিবাচক=> নেতিবাচক রূপান্তর,ইতিবাচক=> প্রশ্নবাচক রূপান্তর আরু কর্তৃবাচ্য=> কর্মবাচ্য রূপান্তর।”৩৬৫ তিনি দু’টি নজির দিয়েছেন এরকম:

                                    ছ। ভিতৰত কোনোবা আছে।

                                    জ। ভিতৰত কোনো নাই।

            ‘ছ-বাক্য’-এর থেকে ‘জ-বাক্য’ তৈরি করা হয়েছে।এর পদ্ধতি সম্পর্কে লিখেছেন,“ইয়ার শব্দগুচ্ছ গঠন নিয়মাবলী পূর্বতে ‘ব্যাকরণ ই’ত ব্যবহার করা নিয়ম (1) – (10)  লৈ একেই। কেবল মাত্র (11) নম্বর রূপান্তর (বাধ্য) নিয়মটো বেলেগ আরু এইটো এনে ধরণর হ’ব--

                                    রূপা

                                    বি + বি+ ক্রি =>বি+ বি (নেতিবাচক) +  ক্রি. (নেতিবাচক)

                                    (বাধ্য)”৩৬৬ 

            ‘ব্যাকরণ ই’ কিংবা ‘ব্যাকরণ আ’-তে তাঁর ইচ্ছা নিয়মটি ছিল এরকম:

                                    রূপা

                                    বি. + ক্রি.বিণ+ ক্রি.শ => ক্রি.বিণ+ বি. + ক্রি.

                                    (ইচ্ছা)

            এবারে,আমাদের কাছে দু’টো বিষয় স্পষ্ট নয়,--১) ‘ব্যাকরণ আ’-তে যদি ‘যোৱাকালি’ ক্রিয়া বিশেষণ হয়, ‘ছ,জ-বাক্য’ দুটিতে ‘ভিতৰত’ ক্রিয়া বিশেষণ নয় কেন?প্রথমটি ক্রিয়ার কাল বোঝাচ্ছিল,দ্বিতীয়টি ক্রিয়ার স্থান।কারকের বিচারে দু’টিই অধিকরণ।২) বি (নেতিবাচক) হতে যাবে কেন?এই দুই সংশয় বাদ দিলে নিয়মটি এরকমই।

            ফণীন্দ্র নারায়ণ এই বাধ্য নিয়মেরও বৃক্ষচিত্রে উপস্থাপন করে দেখিয়েছেন।আমরা এখানে এও বাহুল্য ভেবে বাদ দিলাম।তাতে আমাদের বোধের জায়গা যে খানিক স্পষ্ট হবে সেরকম কোনো সম্ভাবনা নেই।আমরা এই অব্দি এসে রামেশ্বর শ’ আবার পড়েও দেখলাম,এর থেকে স্পষ্ট হতে আমাদের সাহায্য করে নাতিনিও দুই একটি নজিরে ক্রিয়া বিশেষণের অবস্থান দেখিয়েছেন,সেই উপস্থাপন পদ্ধতি ভিন্ন।৩৬৭কর্মকে তিনি কর্ম বলেই দেখিয়েছেনআমরা বাঙলা প্রশ্নবোধক৩৬৮এবং নঞর্থক উপাদান৩৬৯ নিয়ে পবিত্র সরকারের দুটি নিবন্ধ আবার পড়ে গেলাম ‘বাংলা ব্যাকরণ প্রসঙ্গ’-এ। সেগুলোতে তিনি এই ইচ্ছা এবং বাধ্য নিয়ম নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করলেও তাঁর উপস্থাপন পদ্ধতি অনেক বেশি পরিণত বা অন্যরকম।ফলে প্রাথমিক ধারণাগুলো স্পষ্ট করতে সাহায্য করে নাবস্তুত আমরা যখন প্রাথমিক ধারণা নিয়েই কথা বলছি,ব্যাকরণটি ইতিমধ্যে বহু বিতর্ক এবং বিকাশের ভেতর দিয়ে চলে এসেছে।ফলে,কাজটি এত সহজ নয়,অনেকে যেভাবে বিশেষ প্রশিক্ষণ ছাড়াই করে ফেলবার চেষ্টা করেন---এই সত্য দেখাতে আমাদের এই দুরূহ উপস্থাপন কাজে দেবে।অন্যথা,গোটাটাই বাদ দিলেও চলত।অধ্যাপক ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া শেষে লিখেছেন,“ভারতীয় ভাষাবোররো রূপান্তর স্ফোট ব্যাকরণর পটভূমিত বহল আলোচনা তেনেকৈ ওলোয়া নাই।ভারতীয় ভাষাবোরর স্বরূপ রূপান্তর স্ফোট ব্যাকরণর গণ্ডীর ভিতরত আলোচনা করিব পারি নে নোয়ারি সিও এটা বিবদমান বিষয়।”৩৭০ এই সব কথাও আমাদের মনে রেখে এগুনো উচিত বলে উল্লেখ করে রাখা গেল।                                  

                      ।। সিলেটি বাক্যতত্ত্ব   এবং  বাংলা - অসমিয়া ভাষা বিতর্ক ।।

 

এই অব্দি এসে আমরা বাক্যতাত্ত্বিক এমন কোনো কারণ পেলাম না যাতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে যে অসমিয়া এবং বাংলা বাক্যগঠন রীতিতে মৌলিক কিছু বড়সড় তফাত রয়েছেকিংবা  সিলেটি বাক্যরীতির সঙ্গে অসমিয়ার আলাদা করে কোনো ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।দুটিই মাত্র তফাত পাওয়া গেল,একটি নঞর্থক বাক্যের আরটি নৈর্ব্যক্তিক কর্মবাচ্যের ক্রিয়াপদের গঠনে, -- যেখানে বাংলার থেকে অসমিয়া আলাদা।নঞর্থক বাক্যের গঠনে ‘না’ পদটি ক্রিয়ার শেষে চলে যাওয়াটা আধুনিক বাংলার নিজস্ব,সেও আমরা দেখালামআর সিলেটিও দেখা গেল বাংলাকেই অনুসরণ করে, অসমিয়াকে নয়।বাচ্যে অতি সামান্যই বাংলার থেকে আলাদা তা গোলোকচন্দ্র গোস্বামী,বাণীকান্ত কাকতি লিখেছেন দেখালাম। সে ওই  যেখানে নৈর্ব্যক্তিক কর্মবাচ্যে ক্রিয়াপদের রূপ হচ্ছে,‘দেখি, শুনি,পাৰি’ ইত্যাদি।অন্যত্র বাংলার মতোই ‘যৌগিক ক্রিয়া’-র শেষ  পদ ‘যায়’ দিয়ে শেষ হলো।এবং সিলেটি এখানে কিছুতেই অসমিয়াকে অনুসরণ করে না। সুতরাং এর পরে আর এই নিয়ে আলোচনা বাড়াবার কিছুই থাকে না।

কিন্তু ড উপেন রাভা হাকাছাম এই সব তাত্ত্বিক কোনো আলোচনা না করেই ‘বাক্যতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য’ শিরোনামে বেশ কিছু পৃষ্ঠা ব্যয় করেছেন অসমিয়া এবং সিলেটির নৈকট্য দেখাতেতিনি শুরুতে কিছু বাগবিধি তথা ‘জতুয়া ঠাঁচ’-এর নজির দিয়েছেন।৩৭১ তার পরে বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রচুর  কথোপকথন,প্রবাদ প্রবচন,গীতিকবিতার নজির নানা সূত্রের থেকে সংগ্রহ করে দিয়ে দিয়েছেন। বেণুধর রাজখোয়া ছাড়াও অধ্যাপক অমলেন্দু চক্রবর্তী,অধ্যাপক নিখিলেশ পুরকাইত,তুষার কান্তি নাথ,এমনকি হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বিভিন্ন রচনা থেকে সংগ্রহ করেছেন।কিন্তু যথারীতি প্রচুর ভুল উল্লেখ করেছেন। যেমন: সিলেটি গদ্যের নমুনাতে লিখেছেন ‘খাইছিল বোলে’৩৭২পাশে বসিয়েছেন অসমিয়া ‘খাইছিল বোলে’সেটি যে সিলেটিতে ‘বুলে’ --- এটি ধরতে পারেন নি।শব্দটির রহস্য এবং বাক্যতত্ত্বের ব্যবহার বিধিতে সিলেটি ‘বুলে’-র সঙ্গে অসমিয়া বাংলার সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য আমরা অনেক বিস্তৃত ব্যাখ্যা এই অধ্যায়তেই করেছি।তিনিও মান বাংলা যে নজির দিয়েছেন,সেটিতেও ‘বলে’ রয়েছে।বাকি যে ‘ব/বু/বো-লে’-র  সমস্যা সেটি একেবারেই ধ্বনিতাত্ত্বিক সমস্যা।তাও যদি তিনি সঠিক তুলে দিতেন। তেমনি আরেকটি জোর করে অসমিয়া বানানো সিলেটি বাক্য হচ্ছে,‘খেতর কাম নীচ কাম নহয়’অসমিয়া এবং মান বাংলা প্রতিতুলনার বাক্য দুটি হচ্ছে যথাক্রমে,---‘ খেতির কাম নীচ কাম নহয়’ এবং ‘কৃষি কর্ম হেয় কাম নহে।’এর পরেই আছে,“খেত বাদে যখন আমরার জান বাঁচিবার উপায় নাই,তখন ঘিন্না করিয়া তাকে এড়িয়া দেওয়া ভাল নয়।”৩৭৩‘নহয়’ কোনো কারণেই সিলেটি নঞর্থক ক্রিয়া হতেই পারে না,আর ‘নহে’ ক্রিয়াতে মান বাংলা বাক্যটি কোনো বাঙালিরই মুখের ভাষা নয়।এই ক্রমে সিলেটি ‘নীচ’ শব্দটিকে তিনি নিম্নরেখ করেছেনঅর্থাৎ শব্দটিকে তাঁর কিছুতেই বাংলা বলে মনে হয় নি।দ্বিতীয় সিলেটি বাক্যটি মান বাংলার সঙ্গে মিশে ‘গুরুচণ্ডালী’র আদর্শ নজির।এই বাক্যে ‘আমরার’ এবং ‘এড়িয়া’ শব্দ দুটিকে নিম্নরেখ করেছেন মান বাংলার সঙ্গে আলাদা দেখাতে।দুটিই সিলেটির নিজস্ব বটেকিন্তু প্রথমটির ধারেকাছেও কোনো শব্দ অসমিয়াতে নেই।এটি বহুবচনের সর্বনাম।অসমিয়া শব্দটি ‘আমাৰ’একই শব্দ মান বাংলা এবং সিলেটিতে একবচন।আর দ্বিতীয়টির অসমিয়া প্রতিরূপটি ‘এৰা’,‘ড়’/ɽ/ নয়। মান বাংলা শব্দটি ‘এড়িয়ে’এমনিতেও এই সব ধ্বনিতত্ত্ব,রূপতত্ত্বের বিষয়বাক্যতত্ত্বের বিষয়ই নয়।

এরকমই,তাঁর মতে যেগুলো বাংলার থেকে স্বতন্ত্র বা অসমিয়ার সঙ্গে সদৃশ শব্দ বা শব্দগুচ্ছ বলে মনে হয়েছে,-- যার অনেকগুলোই আমরা যেভাবে দেখিয়ে এলাম হয় ভুল নির্মাণও,নতুবা অযত্নের উল্লেখ ---সেগুলোকে নিম্নরেখ করে গেছেন।প্রায় প্রতিটিতে প্রচুর ভুল চিহ্ন দিয়ে গেছেন।এই যেমন,‘ডুব দিয়া খাই পানী--- আল্লা জানে আর আমি জানি’এই প্রবাদ বাক্যে তিনি ‘পানি’ শব্দটি নিম্নরেখ করেছেন।পানি সিলেটি-কাছাড়ি ভাষাবৈচিত্র্যে বহুল ব্যবহৃত শব্দ বটে।কিন্তু এই শব্দটির ব্যবহার বাংলাদেশে এতো ব্যাপক যে সেখানকার মান বাংলাতেও ব্যবহৃত হয়।সাধারণত ‘জল’ নয়।এই সব আমরা লিখে এসেছি‘টেকার নাম জয়রাম—টেকা অইলে হকল কাম’--এই বাক্যে ‘টেকা’ নিম্নরেখ করেছেন।‘টাকা’র থেকে ‘ট’কা’ আর ‘টেকা’ দুটিই সমান দূরের দুই শব্দএকটিতে স্বরধ্বনিটি স্রেফ লোপ পেয়েছে,অন্যটিতে পালটে গেছে।আর আমরা দেখিয়ে এসছি,সামান্য ধ্বনিলোপের তফাৎ সহ ‘ট্যায়া’ বা ‘টেয়া’(টেকা ) শব্দটি নোয়াখালি-চট্টগ্রামীতেও আছে।

এরকম তিনি প্রায় কোথাও কোনো ভাষাবৈজ্ঞানিক সূত্র অনুসরণ করে নিবিড় অধ্যয়ন করেন নি বলে সত্যের থেকে বহু দূরে থেকে গেছেন।এমন অধ্যয়ন ভ্রান্তি নিরসনে সাহায্য করবার বদলে বাড়িয়ে তুলে মাত্র।ষষ্ঠীবর দত্ত সহ অনেকের মনসা মঙ্গল থেকে টুকরো তুলে দিয়েছেন আর একই রকম কিছু শব্দ নিম্নরেখ করে দিয়েছেন।অথচ, এগুলোতেই খোলা নজরেই প্রাক-ঔপনিবেশিক কালের বাংলা ‘সাধুরূপ’টি নজরে পড়ে।এই যেমন,“বিশ্বকর্মা পূজি দিল ছাগ বলিদান।/পুঞ্জে ২ লুহা দিল দুকানে দুকান।।/গড়িয়া করিল খাজ পাছে কৈল পাড়ি/বানাইয়া ঘরের পাট লৈয়া জায় গাথি।।/পাষানের স্তম্ব করিল সারি/ উপরে তুলিয়া বান্ধে লুহার চারি পারি।” নিম্নরেখগুলো তাঁর।নিম্নরেখ শব্দগুলোর কোনোটিই মান বা সাধু বাংলাতে অপরিচিত নয়সিলেটিতে বরং শব্দগুলো ‘থাম,হাইর,বানদ্, চাইর’কিন্তু তার চেয়েও যেটি গুরুত্বপূর্ণ,সিলেটে রচিত গীতিসাহিত্যের ভাষাতে বাকি বাংলার মতোই  সাহিত্যের ‘সাধু বাংলা’ ভাষাটি নির্মাণের প্রবণতা।এই সব গীতি সাহিত্য স্পষ্ট প্রমাণ করে বেণুধর রাজখোয়ার আগেও সিলেটি কখনোই অসমিয়া ‘মান ভাষা’ নির্মাণের কোনো প্রবণতা দেখায় নি,তথা অসমিয়া ছিল নাএই সব গীতি সাহিত্যের অধিকাংশে ভাষা যে সিলেটির মুখের ভাষা নয়,তার জন্যে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণের দরকার নেই।তার অনেক শব্দরূপের সঙ্গে প্রাক-ঔপনিবেশিক অসমিয়া সাহিত্যের ভাষারও মিল আরো বেশি দেখানো যাবেবিশেষ করে ‘গড়িয়া’,‘তুলিয়া’-র মতো অসমাপিকাগুলোতে।কিন্তু সেরকম মিল যে কোনো প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলা সাহিত্যকৃতির সঙ্গে হুবহু দেখানো যাবে।এমন কি রাজা রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথের আধুনিক বাংলা সাধুভাষার সাহিত্যেও।এর রহস্যভেদ করতে গেলে বাংলা সাধুভাষার গড়ে ওঠার ইতিবৃত্তের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে,যার একটি সংক্ষিপ্ত  উল্লেখ আমরা প্রথম অধ্যায়ে করে এসেছি।বিস্তৃত অধ্যয়নই আমরা করতে পারতাম,তাতে ‘বাংলা সাধু তথা বাংলা অসমিয়া সাহিত্যের ভাষার বিকাশের ইতিহাস’ নামে আরেকটি অধ্যায় বাড়াবার শ্রম স্বীকার করতে হত বলে আমরা বিরত থেকেছি।কিন্তু এই অধ্যায়েও ভারতচন্দ্র সহ এরকম বেশকিছু লেখকের পদ তুলে দিয়েছি।এছাড়াও নানা অধ্যায়ে প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে সিলেটে প্রচলিত নানা সাহিত্যের থেকেও নজির দিয়ে বোধ করি দেখাতে পেরেছি যে আমাদের অভিমতটি সঠিক। বেণুধর রাজখোয়া,ড রমেশ পাঠক কিংবা ড উপেন রাভা হাকাচাম কেউ সেসব অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে যান নি।ফলে ড রমেশ পাঠককের মতো বিদ্বানকেও সিলেটি প্রসঙ্গ আসতেই তথ্যকে ভুল উদ্ধার করে নিজের সিদ্ধান্ত দাঁড় করাতে হয়,আমরা দ্বিতীয়  অধ্যায়ে তার একটি চিত্তাকর্ষক নজির দিয়েছিলাম।তিনি উপেন্দ্র চন্দ্র গুহের ‘কাছাড়ের ইতিবৃত্ত’ বইতে এই কথা লেখা আছে বলে দাবি করেছিলেন,কাছারী দিগের মাতৃভাষা কাছারী।ইহা বাংলা হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন৩৭৪প্রথমত এই কথা উপেন্দ্র চন্দ্র গুহ লেখেন নিদ্বিতীয়ত লিখলেও এই ‘কাছাড়ি’ বলে যে উপেন্দ্র গুহ ‘ডিমাছা কাছাড়ি’ ভাষাই বুঝিয়েছেন,সেটুকুও রমেশ পাঠক তলিয়ে দেখেন নি।     

এই সব গীতিকাব্য ছাড়াও তিনি যেসব প্রবাদ-প্রবচন বা বাগ্বিধির নজির তুলে দিয়েছেন,সেসব নিয়েও এখানে আলোচনা করা বাহুল্য মাত্র। কেননা,পদগুচ্ছ বা বাক্যের গঠনে নতুন কিছুই দেখানো যাবে না।আমরা সংখ্যাতে কম হলেও এই অধ্যায়েই সেরকম কিছু প্রবচনের উল্লেখ উদাহরণ হিসেবে করে এসেছি।অন্যত্রও করেছি,সেখানে চট্টগ্রামী নোয়াখালি প্রবচনও রয়েছে।রইলো বাকি,তাদের অন্তর্বস্তুর কথা---সেসব ভাষাবিজ্ঞানের বিষয় নয়,লোক সংস্কৃতি আর সাহিত্যের ইতিহাসের অধ্যয়নের বিষয়। সে এমন এক বিষয় যা কোনো এক নির্দিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীর একেবারেই নিজস্ব হতেই পারে না।কারণ ভাষাগোষ্ঠী আর নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্তর্বস্তুর আদান প্রদান এতোটাই ব্যাপক এবং বিস্তৃত আকারে ঘটে যে বহু সময় মহাদেশের সীমাও অতিক্রম করে।সুতরাং তাঁর যেগুলোকে অসমিয়া মনে হচ্ছে,সেগুলোকেও মান বাংলাতে সহজেও দেখানো যেতে পারে।উদাহরণ স্বরূপ –‘চলিহাই ধৰ,দুতলীয়া,বছর-বিয়নি’=> মান বাংলা চালশেতে ধরা,দো-তালা,বছর বিয়োনো।কিছু সিলেটি প্রবাদের উল্লেখ করেছেন,যেগুলো শুধু অনুবাদ করে নিলেই মান বাংলা রূপটি মেলে। যেমন:উস্তাদর মার হের রাইত (মাঝে শব্দ দুটো এভাবেই আছে,ছাপা ভুল।); সুখএ থাকতে ভূতে কিলায়;বাঘে/বাগে ছইলে আটারো ঘা;পাপে বাপার  ছাড়ে না (বাপার –এমনই ভুল ছাপা);জানিয়া হুনিয়া সাপর গাত আত দেওয়া ইত্যাদি=> মান বাংলা:উস্তাদের মার শেষ রাতে;সুখে থাকতে ভুতে কিলোয়;বাঘে ছুলে আঠারো ঘা;পাপে বাপকে ছাড়ে না;জেনেশুনে সাপের গায়ে হাত দেয়া ইত্যাদি।

বাক্যতত্ত্বের আলোচনাতে প্রবাদ-প্রবচন,বাগ্বিধির সমাজবৈজ্ঞানিক আলোচনার অবতারণা করবার অর্থ হচ্ছে একেবারেই প্রসঙ্গের বাইরে চলে যাওয়া।আমরা তবু অসমিয়া প্রবাদ-প্রবচন তথা ‘ফকরা-যোজনা’-র সন্ধান করেছিলাম, যতগুলো ভাষাবিজ্ঞানের অসমিয়া বইয়ের উল্লেখ করলাম তার কোনোটিই আমাদের সাহায্য করল না,ড উপেন রাভা হাকাচামের বইগুলো ছাড়া।তার মানে ভাষাবিজ্ঞানে এই সব নিয়ে স্বতন্ত্র আলোচনার অধিকাংশ ভাষাবিজ্ঞানীই দরকার মনে করেন নি।সুতরাং আমরাও করছি না।তবে সাধারণত ব্যাকরণের বইতে এসব থাকে।অধ্যাপক নির্মল দাশের ‘ভাষাবীথি’তেও পরিমাণে প্রচুর আছে৩৭৫ কিন্তু মূল ব্যকরণ ভাগে নয়।দ্বিতীয় খণ্ড ‘রচনা’ ভাগে।সত্যনাথ বরার ‘বহল ব্যাকরণ’-এও কিছু বাগ্বিধি তথা ‘জতুয়া ঠাঁচ’-এর কথা রয়েছে।৩৭৬সেখানেও দ্বিতীয় ভাগ ‘ওপরঞ্চি’-তেই।অর্থাৎ ‘অতিরিক্ত’ হিসেবেই।যার অধিকাংশই মান বাংলার সঙ্গে একই। যেমন—


‘তেল মাৰা’ অসমিয়াতেও তোষামোদ অর্থেই প্রচলিত আছে,হতেও পারে সত্যনাথ বরার কালে সেটি সেরকম প্রচলিত ছিল না।তার জন্যে সামাজিক ইতিহাসের সন্ধান করতে হবে।‘কথা ক’-তে মনে পড়বে বাংলাতে একটি পাখির লৌকিক নামই ‘বৌ কথা কও’এরকম এক দীর্ঘ তালিকা আমরা তৈরি করতে পারি,আর দেখাতে পারি অধিকাংশেরই বাংলা প্রতিরূপ রয়েছে।আর যেগুলোই বাংলাতে রয়েছে তার প্রতিটিরই সিলেটি প্রতিরূপ একই অর্থে রয়েছে। সেগুলোর উল্লেখ এখানে বাহুল্য মনে করছি,এর জন্যে যে আমাদের প্রমাণ করবার নেই যে সিলেটির সঙ্গে এই প্রশ্নে অসমিয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।ধ্বনি তাত্ত্বিক বা রূপতাত্ত্বিক যেসব কারণে সম্পর্ক আরেকটু ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সম্ভব সেসব যথাস্থানে দেখিয়ে এসেছি।

উপেন রাভা হাকাচাম এই পর্বে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘অসম আরু বঙ্গর লোক সঙ্গীত সমীক্ষা’ বইটির থেকে বেশ কিছু গীতের উল্লেখ করেছেন। হেমাঙ্গ বিশ্বাস মূলত সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন করতে গিয়ে সিলেটি বিয়ের গানের সঙ্গে অসমিয়া বিয়ানামের আত্মীয়তা দেখিয়েছিলেনসুতরাং সেসব পাদটীকাতে অহেতুক উল্লেখ করেছেন।৩৭৭ ‘অহেতুক’ এর জন্যে যে কথা গুলো ছিল সুর নিয়ে,ভাষাতত্ত্ব নিয়ে নয়।এ হচ্ছে প্রেক্ষিতবিচ্ছিন্ন করে দিয়ে এক বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিত্বের বক্তব্যকে নিজের মতো করে ব্যবহারের নজির।নিশ্চয়ই হেমাঙ্গ বিশ্বাস অসমিয়া বাঙালির উগ্রজাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এক নিবিড় ঐক্য চাইতেন।তাঁর সেই বাসনা বইটির পরতে পরতে রয়েছে।কিন্তু তাই বলে একাকার করে দেবার বাসনা রাখতেন,সেরকমটি কোত্থাও ছিল না।এর সামান্য আগেই হেমাঙ্গ শুরু করেছেন এরকম,“ শ্রীহট্টর মহিলার আন এটি উল্লেখ যোগ্য দান হ’ল –বিয়াগীতবংগর প্রায় প্রত্যেক জিলারেই বিবাহ উপলক্ষে গীত আছে।কিন্তু শ্রীহট্টর কইনা-চোয়া,মংগলাচরণ ‘পানখিলি’ (তামোল পান?),পানী-তোলা,অধিবাস,সোহাগ মাগা (সেন্দুর পিন্ধোয়া, ফোঁটা দিয়া?) দধি মঙ্গল,বিবাহ,কন্যা যাত্রা প্রত্যেকরে ভাগে ভাগে এনে গীতর লহরি বংগদেশর অন্য ক’রবাত আছে বুলি নাজানে।গাতে লাগি থকা ‘অসমর বিয়ানাম’ত হে কেবল এনে ধরণর ঐশ্বর্য শালী বৈচিত্র্যর সন্ধান পাওঁ।”৩৭৮এর পরের টুকুন উপেন রাভা হাকাচাম তুলে দিয়েছেন,“ শ্রীহট্ট জিলাত বিয়াত ধামাইল অপরিহার্য হ’লেও কেবল বিবাহ অনুষ্ঠান অনুসারে যি বিশেষ গীতর ধারা তাত সুরর ফালর পরা কোনো কোনো গীতত এক সম্পূর্ণ নতুন ধারার সন্ধান পোয়া যায়:সি হৈছে অসমীয়া বিয়া নামর সুস্পষ্ট ছাপ।”৩৭৯ এর পরের টুকুন উপেন রাভা তিনটি ডট চিহ্ন (...) দিয়ে ছেড়ে গেছেন,যেখানে রবীন্দ্রনাথ এবং সিলেটি ভাষাকে যে হেমাঙ্গ বাংলাই বলছেন সেসব প্রসঙ্গও রয়েছে,“ঐতিহাসিক বিচারত শ্রীহট্টর তদানীন্তন (লাউর,গৌর আরু জয়ন্তীয়া রাজ্যর)এটা বৃহৎ অংশ অসমর প্রাগজ্যোতিষপুরর কোচ রজাসকলর অধীনত আছিল।তারোপরি,আধুনিক যুগতো বৃটিছর শাসনাধীনত থকা কালতো শ্রীহট্ট ভাষা আরু সংস্কৃতি বঙালী হৈয়ো অসমর ভৌগোলিক অংশ হৈ আছিল।রবীন্দ্রনাথরো সেই আক্ষেপ:মমতাবিহীন কালস্রোতে/বাঙলার রাষ্ট্রসীমা হতে/নির্বাসিতা তুমি/সুন্দরী শ্রীভূমি৩৮০এই মমতাবিহীনতার কথাগুলো ‘মমতাবিহীন’ভাবে ছেঁটে দিয়ে উপেন রাভা হাকাচাম আবার পরের কথাগুলো লিখছেন,“শ্রীহট্টর কথ্যভাষা আরু গীতর সুরতো সেয়ে অসমীয়া প্রভাব দেখি আঁচরিত হোয়ার কথা নাহে।কিন্তু,লক্ষ্য করিবলগীয়া যে শ্রীহট্টর মহিলার গীততহে কেবল এই অসমীয়া প্রভাব পরিস্ফুট।”৩৮১এর পরে হেমাঙ্গ যেভাবে গানের স্বরলিপি সহযোগে সুর বোঝাচ্ছিলেন,সেসব ভাষাবিজ্ঞান নয়,সঙ্গীতবিদ্যার (musicology) বিষয়। সুতরাং আমরা আলোচনাতে না আনলেও পারিকিন্তু যেটি লক্ষণীয়,সে হচ্ছে হেমাঙ্গ সিলেটির বাংলার পরিচয়কে মোটেও অস্বীকার করছেন না।উপেন রাভা যেভাবে তুলে দিয়েছেন,তাতে মনে হবে,তাইই বোধহয় করেছেন।দ্বিতীয়ত ‘ছাপ’ বা ‘প্রভাব’টি সব গানেও নয়,‘কোনো কোনো গীতত’ হে।সিলেটির বাঙালিয়ানা নিয়ে হেমাঙ্গর মনে কোনো সংশয় ছিল না।বরং উপেন রাভা হাকাচাম যাকে বাংলার একমাত্র রূপ বলে চিনিয়ে এসেছেন সে কতদূর ‘বাংলা’ সেই নিয়ে তিনি বইটির অন্য এক অধ্যায়ের শুরুতেই প্রশ্ন তুলেছিলেন এইভাবে,“বহুদিন আগর কথা।কলিকতার এগরাকী বাগ্মী নেতাই আমার জিলার এখন কৃষক সমাবেশত সুদীর্ঘ ভাষণ দিয়ার পিছত সমবেত বৃদ্ধ কৃষক এজনক সুধিলোঁ---কেনে লাগিল?উত্তরত তেওঁ ক’লে---‘নেতায়তো কইছইন ভালা,খালি অত কইল্কাত্তি না কইয়া এট্টু বংগ ভাষাত কইতা।’ অর্থাৎ নেতাইতো ভালেই কৈছে,কেবল ইমান কলিকতীয়া ভাষাত নকৈ যদি কিছু বঙ্গ ভাষাত ক’লেহেঁতেন!বাংলার মান্যভাষাটো আমার পূর্ববংগর মানুহর মানত ‘কলিকতীয়া’ ভাষা আরু তেওঁলোকর নিজর কথিত ভাষাহে প্রকৃত ‘বংগভাষা’এনে ধারণা জানো ভিত্তিহীন?ঐতিহাসিক দিশরপরা বিচার করিলে দেখা যায় যে বংগ বুলিলে চিরদিনেই পূর্ববংগকেই বুজাইছিল। পূর্ববংগ আরু উত্তরবংগ’র উপভাষাত যে অপূর্ব সম্পদেই সিঁচরতি হৈ আছে!আমার মান্য বা সাধুভাষাই জানো এই আটাইবোর আহরণ করিবলৈ সমর্থ হৈছে?এই কেবল নিজক ঐশ্বর্যশালী করার প্রশ্নই নহয়,ই হ’ল এটা ভাষাক শ্রমজীবি মানুহর ভাব আরু উপলব্ধি প্রকাশর মাধ্যমরূপে গঢ়ি তোলার প্রশ্নও।”৩৮২এই নিবন্ধে তিনি বাংলা এবং অসমিয়া ভাষার এক মৌলিক স্বভাব পার্থক্যের কথা লিখেছিলেন এরকম,“অসমীয়া ভাষাত বঙালী ভাষার দরে সাধু আরু কথ্য ভাষা বা বিদগ্ধ আরু গাঁওলীয়া ভাষার মাজত বিশেষ ব্যবধান গঢ় লৈ উঠিব পরা নাই।তাত অসমীয়া ভাষা সমগ্র জনগণরেই ভাষা। সুদূর উত্তর লক্ষ্মীমপুরর আওহতীয়া গাঁওর পরা বিহুর দল আহি গুয়াহাটী চহরর মঞ্চত বিহু নৃত্য-গীত পরিবেশন করিলে, চহরর শিক্ষিত শ্রেণীর কারণে সেই গীতর এটা শব্দও অপরিচিত হৈ না থাকে।কিন্তু উত্তরবংগর কোচবেহার বা রংপুরর কোনো ভাওয়াইয়া গায়ক কলিকতালৈ আহিলে,তেওঁর গানর প্রায় প্রতিটো কলি সাধুভাষাত বুজাই নিদিলে,কলিকতীয়া শিক্ষিতসকলর কারণে সেই গানর মর্ম উদ্ধার করা টান হৈ পরে৩৮৩এখানে ‘সাধুভাষা’ বলতে তিনি ‘সাধু’ এবং ‘চলিত’ দুইই বুঝিয়েছেন,যেগুলো রবীন্দ্রনাথের আগে পরে বাংলা লেখাপড়ার ভাষা হয়ে উঠে।দুই ভাষার এই যে ‘মৌলিক প্রভেদ’ ---এই নিয়ে অসমিয়া ভাষাবিজ্ঞানীরা ভেবেছেন বলে দেখা যায় না।এই প্রশ্নটি নিয়ে সমাজভাষা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে দুই ভাষাতেই অধ্যয়ন হতে পারতো,যা অসমিয়াতেও দেখা যায় না।অসমের বাংলাতেতো না-ইঅসমিয়া ভাষাবিজ্ঞানীরা তাকেই বাংলা বলে জেনে এবং বুঝে এসেছেন,যার ‘বাংলাত্ব’ নিয়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রশ্ন তুলে গেছেন। সেই ‘বাংলাত্ব’-র কথা মনে রেখেই চর্যার কবি লিখেছিলেন,‘আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী’ (চর্যাঃ৪৯)

যেরকম হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বক্তব্যের রবীন্দ্রপ্রসঙ্গকে উপেন রাভা হাকাচাম বাদ দিয়ে গেছেন,সেরকম নিখিলেশ পুরকাইতের ‘বাংলা অসমীয়া ও উড়িয়া উপভাষার ভৌগোলিক জরিপ’ থেকেও তিনি চতুর্থ অধ্যায়ের শুরুতে উল্লেখ করা বেশ কিছু ছড়ার কয়েকটি তুলে দিয়েছেন।কিন্তু সম্ভবত বাংলার সঙ্গে সাংস্কৃতিক যোগটি সহজেই নজরে পড়বে বলে এটি বাদ দিয়ে গেছেন,৩৮৪“হে কবি রবি (রবীন্দ্রনাথ)/তুমি আকতা (হঠাৎ) গেলায় চলি/কাহারেও না বলি।/দেওয়ালে দেওয়ালে লটকি (ঝুলি) রইসে/তুমার গুণ্ডা (গুণ্ডা) ছবি।”৩৮৫এর একটি অন্যপাঠ এমনটা রয়েছে বলেও আমরা জেনেছি,“হে কবি,হে রবি/তুমি আখতা গেলায় চলি/বাড়িত অখনো লটকাইল আছে/তোমার গাট্টা গাট্টা ছবি।৩৮৬ ‘গুণ্ডা’ শব্দের বিকল্প অর্থও সিলেটিতে ‘গাট্টা   

 তিনি অধ্যাপক অমলেন্দু চক্রবর্তীর একটি নিবন্ধকে বাক্যতত্ত্বের নমুনার তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেনসিলেটি প্রবাদ প্রবচন সম্পর্কে সেই অমলেন্দু চক্রবর্তীর একটি মন্তব্য এখানে তুলে দেয়া সমীচীন হবে বলে মনে করি             উপেন রাভা হাকাচাম যে নিবন্ধটি ব্যবহার করেছিলেন,সেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৬তে দীপ্তি ফুকন পাটগিরি সম্পাদিত গ্রন্থ ‘ভাষাতত্ত্বর বিচিত্র কথা’ নামের সংকলন গ্রন্থে।নাম ছিল,‘ব্রহ্মপুত্র আরু বরাক উপত্যকার ব্যবহৃত শব্দর উৎস আরু ভৌগোলিক জরিপ’৩৮৭ আমাদের সেটি দেখবার সুযোগ হয় নি।কিন্তু তাঁরই অনুপ্রেরণাতে অধ্যাপক আবিদ রাজা মজুমদার,যার অভিধান আমরা আদ্যন্ত ব্যবহার করে এলাম এই সন্দর্ভে,বরাক উপত্যকার প্রবাদ প্রবচন এবং ছড়ার তিনখানা সংগ্রহ বই আকারে ছেপে বের করেছেন যথাক্রমে ২০০৭,২০১২ এবং ২০১৩-তে।তারই দ্বিতীয়টির নাম ‘বরাক উপত্যকার প্রবাদ ও প্রবচন (প্রথম পর্যায় ) ও খেলার ছড়া’সেটিতে মুখবন্ধ লিখে দিয়েছেন অধ্যাপক চক্রবর্তী। সেখানে তিনি লিখছেন এক জায়গাতে,“বরাক উপত্যকায় ব্যবহৃত জনগণের ভাষা নিয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে অজ্ঞতা প্রসূত একটি মন্তব্য অনেকেই করেছেন যে,এই ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার সম্পর্ক অতি সামান্যই এবং অসমিয়া ভাষার সঙ্গে এই ভাষার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রমাণ করে যে,এটি অসমিয়া ভাষারই একটি উপভাষা।১৯৮৮-এর ৫ই মার্চের The Assam Tribune পত্রিকায় প্রকাশিত সত্যপ্রসাদ বরুয়ার একটি প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে,তিনি এই উপত্যকার লোকেদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন এবং ‘They seemed to be convinced when I told that they did not speak Bengali in their homes and that they actually spoke a language different from Bengali and this was what we might call Baraki Language.I told them that cultivate and developed this language they would soon find that it had more affinities with Assamese than Bengali.’মাননীয় বরুয়ার সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন এই উপত্যকারই বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রাক্তন মন্ত্রী শহীদুল আলম চৌধুরী মহাশয়ও।অসম সাহিত্য সভার ৫৪তম অধিবেশনে হাইলাকান্দিতে অসমিয়া ভাষায় লিখিত ভাষণে শহীদুল আলম মহাশয় বলেছিলেন,‘এই উপত্যকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে যদিও বাংলা ভাষায় শিক্ষাদান করা হয়,প্রকৃতপক্ষে গ্রাম্য মানুষেরা ঘরে যে ভাষা ব্যবহার করেন,তা বাংলা নয়। ---অসমিয়া আর বাংলার সংমিশ্রণে ঐ ভাষা গড়ে উঠেছে’ এ ধরনের মন্তব্যকে ভাষাতাত্ত্বিক অজ্ঞতা-প্রসূত ভ্রান্তি বা বিজ্ঞতা প্রসূত গোঁড়ামি যা-ই বলি না কেন,অধ্যাপক মজুমদার মহাশয় এই উপত্যকার গার্হস্থ্য জীবনের অন্দরমহল থেকে তাদের ব্যবহৃত বাগভঙ্গিমা,তথা প্রৌঢ়ক্তি উদ্ধার করে এই অশিক্ষাজনিত ভ্রান্তির মোক্ষম উত্তরটি দিয়েছেন।আমরা এই প্রবাদ বাক্যগুলোর কোথাও অসমিয়া বাচনভঙ্গির স্পর্শও খুঁজে পাইনি।মজুমদার মহাশয় অজানিত ভাবেই এই সংকলনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এই অঞ্চলের ভাষা, তার ধ্বনিতত্ত্ব এবং রূপতত্ত্ব গবেষণার নতুন দিগন্তকে উন্মোচন করে দিয়েছেন—এজন্য তিনি ধন্যবাদার্হ।”৩৮৮ এর পরে আর বাক্য সংযোজন বৃথা।আমরা শুধু তথ্য হিসেবে লিখতে চাই যে ‘অসমিয়া বাচন ভঙ্গির স্পর্শও খুঁজে পাইনি।’-- এটি একটু অতিশয়োক্তি।প্রতিবেশী ভাষা এবং ভাষাবৈচিত্র্যের মধ্যে এক আধটু স্পর্শ পাওয়াটাই স্বাভাবিক।শুধু সেই স্পর্শ বাংলা-অসমিয়া মান ভাষা এবং ভাষাবৈচিত্র্যগুলোর উত্তরাধিকার সূত্রেই সাধারণ সম্পদ, ---এইটুকুন মেনে নিলেই সমস্যা থাকে না। সেই উত্তরাধিকার এতই প্রবল যে বাক্যতত্ত্বের আলোচনাতে বাংলা এবং অসমিয়া বাক্যের গঠনরীতিতে আমরা তফাত বলতে গেলে পেলামই না।প্রবাদে প্রবচনে সেরকম একটি তুলনামূলক অধ্যয়ন দুই ভাষারই লোক সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের অধ্যয়নে নতুন আলো ফেলবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।দ্বিতীয় তথ্যটি এই যে প্রাক্তন মন্ত্রী শহীদুল আলম চৌধুরী এখন প্রয়াত।১৯৮৮তে তিনি যে কথাগুলো বলেছিলেন,সেসব কথা হয়েই ছিল।প্রয়োগে আনবার কোনো চেষ্টাই তাঁকে করতে দেখা যায় নি,যতদিন তিনি জীবিত ছিলেন।বরং বাংলা ভাষা শহিদের বেদিতে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনে জীবনের শেষের বছর গুলোতে তাঁকে দেখা গেছে।অর্থাৎ যে কথাটি তিনি বলেছিলেন,একেবারেই রাজনৈতিক কারণে,তাতে কোনো জনসমর্থন তাঁকে পেতে দেখা যায় নি। এবং তাঁর নিজেরও আত্ম-উপলব্ধিটি হয়েছিল।

কিন্তু সম্প্রতি আবার কোনো কোনো মহল থেকে আসামেই এই দাবি উঠছে,‘সিলেটি’ স্বতন্ত্র ভাষা,বাংলার সঙ্গে এর সম্পর্কচ্ছেদ করতেই হবে।সংবাদ পত্রেও এই সব বিতর্ক এসছে।এ হচ্ছে ভাষাগোষ্ঠীর ভেতরের দ্বন্দ্ব।বিলেতে এবং মার্কিন দেশে রীতিমত স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে পঠন পাঠনই হয় প্রাথমিক স্তরে।এই সব এখন জানা কথা।অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্য এই নিয়ে নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথাও লিখেছেন এক জায়গাতে।চট্টগ্রামীরাও অনেকে বাংলাদেশেই দাবি তুলেন তাদের ভাষা বাংলা নয়।তপোধীর ভট্টাচার্য একে ব্যাখ্যা করেছেন এই ভাবে,“বলা বাহুল্য এর পেছনে সক্রিয় থাকে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের নানা জটিল পাটিগণিত এবং আন্তর্জাতিক প্রভুত্ববাদের ভূরাজনীতির দাবা খেলা। আরাকান সংলগ্ন নোয়াখালি ও চট্টগ্রামে উপভাষা ও বিভাষার সীমান্ত–স্বভাব খুবই কৌতূহল ব্যঞ্জক।তবে প্রতাপের কৃৎকৌশল ও সাংস্কৃতিক রাজনীতি সেখানে এমন পর্যায় পায় নি যে উপভাষা ও বিভাষার টানাপোড়েনে বিভ্রান্ত হয়ে জনগণ মূল ভাষারূপের সঙ্গে নিজেদের ব্যবধান কল্পনা করে নিতে পারেন।সিলেটি কি উপভাষা নাকি স্বতন্ত্র ভাষা: এই অকারণ সংশয় নিতান্ত সাম্প্রতিক কালে তৈরি করা হয়েছে কিছুটা অজ্ঞতাবশত আর কিছুটা দূরভিসন্ধিতে।”৩৮৯কিন্তু কোনো সুঅভিসন্ধিতেই কি কোনো বাঙালি ভাষাবিজ্ঞানী কখনোই এই প্রশ্ন তুললেন,যে আরাকানের রোহিঙ্গিয়াদের ভাষাটি কি সত্যি বাংলা?কোত্থাও কোনো আলোচনা পাওয়া যাবে না।অথচ,রোহিঙ্গিয়ার সঙ্গে চট্টগ্রামীর তফাত ততটাই যতটা চট্টগ্রামীর নোয়াখালির সঙ্গে।কিংবা কাছাড়ের সিলেটির সঙ্গে হবিগঞ্জের সিলেটির। যে হবিগঞ্জের সিলেটিকে অধ্যাপক জন্মজিৎ রায় একটি লেখাতে ‘পশ্চিম সিলেটি’৩৯০ বলে লিখেছেন।বাঙালি ভাষাবিজ্ঞানী তাদের ‘বাঙালি’ বললেও যে রোহিঙ্গিয়ারা মেনে নেবেন,সেরকম সম্ভাবনাও নেই।কারণ বর্মী শাসক শ্রেণি তাদের ভাষার দোহাই দিয়েই, ন্যূনতম সাংবিধানিক নাগরিক অধিকারটুকু না দিয়ে রেখেছে।সারা দুনিয়াতে এরকম দেশহীন জনগোষ্ঠী মনে হয় না আর দ্বিতীয় মিলবে।ফলে তাদেরকে শাসক শ্রেণির দেয়া ‘বাঙালি’ পরিচয় অস্বীকার করেই লড়তে হচ্ছে,সেই দেশের উপরে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। দেশটির সঙ্গে ভাষার দিক থেকেও তাদের কয়েক শতকের সংযোগ।আরাকানের রাজসভা এক সময় বাংলা ভাষা সাহিত্য চর্চার উজ্জ্বল কেন্দ্র ছিল।সাহিত্যের ইতিহাসের ছাত্রমাত্রেরই জানা।সৈয়দ আলাওল,দৌলত কাজিরা সেই রাজসভার উজ্জ্বল সব নক্ষত্র।আর নৃগোষ্ঠীগতভাবে  সম্ভবত রোহিঙ্গিয়ারা সেদেশে ততটাই ‘খিলঞ্জিয়া’ যতটা চট্টগ্রামীরা চট্টগ্রামে।ভাষাবিজ্ঞানের কি সাধ্য আছে তাদের ‘ভাষাপরিচয়’ নির্ধারণ করে? অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্য লিখেছেন,“ভাষাবিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুযায়ী উপভাষার সংজ্ঞা নির্ণয় করতে হবে—এই হলো বিধি।”৩৯১ সেই বিধি কি প্রযোজ্য হবে ‘রোহিঙ্গিয়া’দের বেলা?

অন্যদিকে বিলেতে যারা সিলেটিকে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন তাঁদের পাশেও দাঁড়িয়েছেন, সেদেশ এবং অন্যদেশের বাঘা বাঘা সব ভাষাবিদ।২০১৬তেই  ১২মে তারিখে লন্ডনে একটি ‘সিলেটি ভাষা সম্মেলন’ হয়েছে,এর আয়োজকদের নাম দেখে কাউকে সিলেটি বলে মনে হয় নি।নামগুলো এরকম:ক্যাণ্ডিড সিমার্ড(Candide Simard),ম্যারি থাউট(Marie Thaut),এমিলি গ্রেফ(Emily Gref),আন্দ্রিয়ানা কৌমবারো(Andriana Koumbarou),আনা ক্রোনিন(Anna Cronin),অনু ভাস্কররমন(Anu Bhaskararaman),ব্রেন্না ল্যিউস (Breanna Lewis),কাওইস গ্রাভে(Caoife Garvey), ডানিয়েল ভিনসেন্ট (Daniel Vincent),ইভেলিং ভিল্লা (Eveling Villa),হ্যারি উইলোবি(Harry Willoughby),জিন রোলেডার (Jean Rohleder),জন লাউ (Jonas Lau),মার্থা সুসই (Martha Tsutsui),রেবেকা ওরফোর্ড (Rebecca Orford),রবার্ট লাউব(Robert Laub),সারা ডোপিয়েরালা (Sarah Dopierala),ওয়ারেন কাঙ্গেয়ান(Waran Kangeyan),এবং জুরাব বারাতাশভিলি( Zurab Baratashvili).সেই সম্মেলনে বীজভাষণটি দিয়েছিলেন ল্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড মার্ক সেব্বা( Dr. Mark Sebba)এটি কোনো বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ নয়।সম্মেলনের বিস্তৃত তথ্য রয়েছে ‘International Linguistic Community’বলে একটি সংগঠনের ওয়েবসাইট http://linguistlist.org/ এ।৩৯২ যদিও ধরেও নিই এই সব ‘প্রতাপে’র আয়োজন তবু এই সব সত্য যে সেদিকেও ভাষাবিজ্ঞান রয়েছে।ব্যক্তিগতভাবে আমাদের ম্যারি থাউটের সঙ্গে আন্তর্জালে কিছু বাকবিনিময় করবার সুযোগ হয়েছে।তিনি সম্ভবত থাই ভদ্রমহিলা এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজে’র গবেষিকা। যেভাবে তাঁর তর্ক উপস্থিত করেন,তাতে মনে হয় তিনি ‘প্রতাপ’-এর হাতে বিপন্ন বিশ্বের অবদমিত ভাষাগুলো নিয়ে বেশ চিন্তিত। সেই সব ভাষার মধ্যে সিলেটি অন্যতম।যদিও বাংলাদেশ বা অসমের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে এখনি সচেতন বলে মনে হলো না। এইটুকুন উল্লেখ করবার কারণ হলো,সিলেটিতে যারা আলাদা দেখতে চাইছেন তাদের দিকেও রয়েছে ‘প্রতাপ’ বিরোধিতা এবং ভাষাবিজ্ঞানের যুক্তি। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সেই বৃদ্ধ কৃষকের কথাটিতে যেমন,‘---‘নেতায়তো কইছইন ভালা,খালি অত কইল্কাত্তি না কইয়া এট্টু বংগ ভাষাত কইতা।’ সেই বৃদ্ধ সিলেটিকে ‘বঙ্গভাষা’ বলে ভাবলেও,মানভাষার নিয়ে বাস্তব বেদনাটি জানিয়েছেন।এই সমস্যাতো ভাববারই জিনিস।সুতরাং সাধারণ ভাষাবিজ্ঞানের যুক্তিতেই একটি ভাষা বা উপভাষার সংজ্ঞা নির্ধারণ সম্ভব---এরকম ধারণার থেকে আমাদের এবারে বেরিয়ে আসতে হচ্ছেই।‘সমাজ ভাষাবিজ্ঞানে’র আরো গভীরে অধ্যয়ন না করে এই সবের সদুত্তর মেলা কঠিন।লন্ডনে এরকম একটা সম্মেলন সম্ভব হয়েছে কেননা,সেখানকার বাঙালিদের সিংহভাগ সিলেটি।তারা জনগোষ্ঠী হিসেবে যদি কোনো সামাজিক কারণে ‘বাঙালি’ বলে পরিচয় দিতে নাই চান,সিলেটি হিসেবেই নিজেদের দাঁড় করাতে চান,তাতে আভ্যন্তরীণ ব্রিটিশ রাজনীতি এবং সমাজ-কাঠামোর কোনো তফাত-ভেদ ঘটে না।বরং এহেন প্রয়াসকে সেখানকার সমাজে একটি প্রান্তীয় এশীয় ভাষাকে স্বীকৃতি দেবার মর্যাদাবাহক প্রয়াস হিসেবে দেখাটাই খুবই স্বাভাবিক।কিন্তু একই সম্মেলন বাংলাদেশে কিংবা অসম–ত্রিপুরাতে কি এই মুহূর্তে করা সম্ভব?সাধারণ ভাষাবিজ্ঞানের যুক্তি যতই প্রবল হোক?এখানকার সিলেটিদেরই এক বড়ভাগ এরও বিরোধিতা করবেন।এবং সেই বিরোধিতার এক বড় কারণ হবে ভাষাবিজ্ঞান বহির্ভূত—সামাজিক-রাজনৈতিক।রাজনীতি এদিকেও থাকে,ওদিকেও থাকে।অন্তত এই দাবি আর করা যাচ্ছে না যে প্রতিপক্ষেই রাজনীতি রয়েছে,আর স্বপক্ষে আছে শুধুই ভাষাবিজ্ঞান।সুতরাং ‘দুরভিসন্ধি’-র তত্ত্ব ছেড়ে আমাদের এগোতে হচ্ছে। ‘অভিসন্ধি’-র স্বরূপ বুঝে নিতে ‘সমাজভাষাবিজ্ঞান’-এ পা দিতে হচ্ছে।আর সেখানে বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের মতো ঐকমত্য প্রায় অসম্ভব।কিছু বাস্তব সামাজিক সমস্যার সমাধান না করতে পারলে বিতর্কগুলো থেকে থেকে আসবে।

শহীদুল আলম চৌধুরী যখন বলেছিলেন বরাকের ভাষা ‘বরাকী’ তিনি কিন্তু শুধু ‘বাংলা’ নামটি এবং মানবাংলাকেই ছেড়ে দিতে চাইছিলেন।উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া তাঁর ভাষাবৈচিত্র্যটি নয়।অন্যদিকে কয়েক শতক আগে আরেক সিলেটি শ্রীচৈতন্য প্রভু যখন,‘বঙ্গদেশী বাক্য অনুকরণ করিয়া/বাঙ্গলেরে কদর্থেন হাসিয়া হাসিয়া’ তখন ‘বঙ্গদেশী’র ভাষা হিসেবেই ‘সিলেটি’ ভাষাবৈচিত্র্যটিকেই ছেড়ে দিতে চাইছিলেন।কারণ নবদ্বীপের সামাজিক পরিবেশে এটা করাই ছিল তাঁর কাছে সামাজিকভাবে সম্মানজনক।আর এই প্রবণতা এখনো বহু শহুরে সিলেটির মধ্যে বিদ্যমান। সেই ‘বঙ্গদেশ’ আজকের বাংলা নয়,এটি অসমিয়া তাত্ত্বিকদের লক্ষ রাখা ভালো,সেটি ‘সিলেট’অন্যদিকে তখন ‘সিলেটি’ নামটিও দাঁড়ায় নি,সেটি ‘সিলেটি’দের খেয়াল করা ভালো।তার পরেও এই সব সত্য যে এই সব নাম আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের জন্মের আগেই ইতিহাসের নানান জটিল প্রক্রিয়াতে স্থির হয়েছে।আর সেখানে মধ্যবিত্ত বিদ্বানদের ভূমিকা নিশ্চয় ছিলকিন্তু তাই যদি একমাত্র হত তা হলে রবীন্দ্রনাথের মতো বিরাট প্রতিভার কথাতে অসমিয়া হয়ে যেতে পারত বাংলা।আর বেণুধর রাজখোয়ার মতো অসম সাহিত্যসভার প্রাক্তন সভাপতির মতো ব্যক্তিত্বের কথাতে সিলেটি সেই কবেই হয়ে যেতে পারত অসমিয়া। সেসব কিছু হয় নি,অসমিয়া তাত্ত্বিকদের তাই আক্ষেপই করতে হয়।ভাষানাম পরিচয় স্থির করতে বিদ্বানদের অতিরিক্ত,রাষ্ট্র এবং সাধারণ জনতার ইচ্ছের সমন্বয় ছাড়া কিছুই সম্ভব হয় নি।আর সেই রাষ্ট্র এবং জনতার স্থির সিদ্ধান্ত বলে সমাজে কিছু নেই। সেখানে সমন্বয় যদি আছে,সংঘাতও আছে।চর্যা কিংবা চৈতন্য মহাপ্রভুর সময় ‘বাংলা’ ‘দেশ’ এবং ‘ভাষা’ দুইই ভিন্ন ছিল।সংঘাত তখনো ছিল,এখনো আছে।তখন এদিককার ভাষা-দেশনাম ‘বঙালি’ ‘বঙ্গ’ ছিল।এখন ভারতে অন্তত ওদিককার নাম ‘পশ্চিম বঙ্গ’ একেও পালটে ‘বাংলা’ করবার আয়োজন চলছেসেখানকার দক্ষিণ প্রান্তের ভাষাই মূলত মান ভাষার ভিত্তি।যার সঙ্গে সিলেটির ‘ভাষাবৈজ্ঞানিক’ কালিক এবং কালানুক্রমিক ঐক্য যতই দেখানো যাক,অনৈক্য দেখানোও খুব কঠিন কিছু নয়।আমরাও দুটোই দেখিয়ে এসেছি। সেই অনৈক্য দেখাতে বরং বহুসময় কোনো অধ্যয়নের দরকারও পড়ে না।অধিকাংশ সিলেটি জনতাই সেই অধ্যয়ন পরিসরের বাইরের মানুষ।যারা স্কুলের গণ্ডিও অতিক্রম করতে পারেন না।যারা পারেন তারা ইংরেজিতে ঝুঁকছেন।বাংলাতে বিয়ের চিঠি লিখতে হলেও তারাও ছোটেন ‘বাংলার মাস্টারে’র কাছে।যারা পারেন না,তারা যদি স্কুলে গিয়ে দেখেন,পড়ানো হচ্ছে ‘অ-এ অজগর আসছে তেড়ে’, ‘উট চলেছে মুখটি তুলে’,‘ঋষি মশাই বসেন পূজায়’ ---যা কিছু চারধারের জীবনে কোত্থাও দেখেন না,শোনেন না---তবে তাঁর হীনমন্যতা অবধারিত। সেসব অবশ্য এককালে পড়ানো হতযোগীন্দ্রনাথ সরকার নিজেও কবি ছিলেন‘হাসিখুশি’ যেকালে এবং যেস্থানে লেখা হয়েছিল তার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলবার অবকাশ খুব কমই আছে।তিনি অন্তত বুঝেছিলেন ছন্দে শেখালেই শিশু শেখে সহজে।এখন তো ছন্দের পাট তুলেই দেয়া হয়েছে। এখনকার আসামে প্রচলিত ‘নতুনপাঠ’-এ নজর বুলাবার সুযোগ আমাদের হয়েছিল। যোগোন্দ্রনাথ সরকারেরই অনেকটা নকলে তৈরি। সেই ‘অজগর,আম,উট,ঋষি’-তেই শুরু।কিন্তু ছড়া আর ছন্দের পাট চুকিয়ে দেয়া হয়েছেযোগীন্দ্রনাথ সরকারেও ‘আ-কার’ শেখানো হয়েছিল এই লিখে,“শশা আর কলা খাও/খাও পাকা আম,/আনারস ডাব আতা/আর কাল জাম।”৩৯৩এখন ‘আধুনিকততর পাঠ’ শেখানো হচ্ছে,“কাক ঘাস ঝাল বাঘ/গান জাম ধান সাত/আতা পাতা উমা একা/ আদা উহা ঊষা ওরা...”৩৯৪---শিক্ষকেরও দাঁত উপড়ে যাবার পক্ষে যথেষ্ট।‘শাড়ী,বাড়ী’ সেই পুরোনো বানানেই আছে‘কি পড়’-তে৩৯৫যে ‘কী’ বানানটি রবীন্দ্রনাথেই স্থির হয়ে গেছিল সেসব ‘শব্দবোধ’-এই আশুতোষ দেব লিখে রেখেছেন।৩৯৬ আর কিছু ঘাটতেই হয় না। বোঝা যায় ভাষা আর ছাত্রদের প্রতি কী আন্তরিকতা আর ভালোবাসা নিয়ে আমরা ভাষাপাঠ শেখাচ্ছি।কিন্তু ‘কিংশুক’-এর মতো অদরকারি শব্দটি ‘পলাশ’-এর বদলে থাকতেই হবে।উপরে ছবি থাকবে ‘ছাগল’-এর,যাতে ছাত্রদের ভ্রান্তপাঠ শেখার ষোলকলা পূর্ণ হয়।৩৯৭ কিন্তু ‘তৎসম’ সাধুরীতি প্রীতিটি ঠিক চাপানো যায়।তার বদলে ‘শুটকি’,‘শুক্ত’,‘শুক্রবার’,‘শুদ্ধ’,শুকুর আলি কিংবা অংশুমান--- কত কি চেনা শব্দের বানান শেখানো যেতওদিকে পশ্চিম বাংলাতে পড়ানো হয় ‘সহজ পাঠ’সে তো শুধু পাঠ ছিল না,রীতিমত এক শিক্ষা এবং ভাষাদর্শন ছিল।তাতে পদ্যে ঋষি মশাই সেই কবেই পূজা করা বন্ধ করেছিলেন।তার বদলে পাঠ ছিল,‘ঘন মেঘ বলে ঋ,দিন বড় বিশ্রী’৩৯৮তাতে আছে,“ডাক পাড়ে ও ঔ/ভাত আনো বড় বৌ।”৩৯৯ আছে “চরে বসে রাঁধে ঙ। চোখে তার লাগে ধোঁয়া৪০০চরে এখনো ‘ঙ’-রা রাঁধে আর,চোখে এখনো তার ধোঁয়া লাগে।এই কথাটি মনে না রাখলে চরের ছাত্রদের বাংলা শেখানো যাবে কী করে?‘সহজপাঠ’-এ পদ্যে আছে,“...হাট বসেছে শুক্রবারে।বকশিগঞ্জে পদ্মাপারে।জিনিস পত্র জুটিয়ে এনে।গ্রামের মানুষ বেচে কেনে...৪০১ গদ্যে আছে,“তাঁর এক ভাই ধৌম্যনাথ কলেজে পড়ে আর রম্যনাথ ইস্কুলে পড়ে৪০২ আমাদের অসমের স্কুলে ‘কিংশুক’ পড়িয়ে হলেও ভাষার পবিত্রতা রক্ষা করা হবে,কিন্তু সিলেটি শব্দ ‘ইস্কুলে’ পড়িয়ে ছাত্রকে ‘সহজপাঠ’ দেবার অন্যায়টি কিছুতেই  করা হবে না। সেখানে অন্তত বাংলাটাও এরকম করে তো পড়ানো যেতই,‘উপত্যকায় থাকি/বরাক নামে ডাকি’,‘একের পিঠে নয়/ঊনিশ তারে কয়’,‘কাছাড়েতে খাসপুর/ গগনেতে ঘুড়ি/লাঙটিং হল এক স্টেশন পাহাড়ি’৪০৩ তাকে ছড়া যদি পড়ানো হতো এরকম ‘আগরতলা আগরতলা/যাবার জন্য মন উতলা/দেখব কবে নীরমহল?জলের মধ্যে রাজার ভেলা...”৪০৪ অথবা পড়ানো যেতো গদ্য এরকম,“সেখানে থাকে নদীজিরি নদীও না।চিরি নদীও না।বরাক নদীও নাতার নাম খালি নদী...৪০৫ সঙ্গে চেনানো যেত,সিলেটি কী, কাছাড়ি কী,কাকে বলে ঢাকাইয়া ভাষা,কাকে বলে চট্টগ্রামীঅন্তত সব ভাষাবৈচিত্র্যকে না ধরলেও পূর্বোত্তর ভারতে প্রচলিত বাংলার বৈচিত্রগুলোকেতো স্কুলেই চেনানো যায়। সেসব কিছুই না করলে,তিনি এই প্রশ্ন করতেই পারেন,আমার ভাষা যদি বাংলাই হয়,সেই বাংলা কেন পাঠশালাতে পড়ানো হয় না? সেই বাংলার কথা কেন ব্যাকরণে লেখে না? সেই বাংলার কেন অভিধান মেলে না!আমার বাড়ি,আমার শহর আর গ্রামের কথা কেন বইতে লেখে না---তাঁকে এই কথা বলে শান্ত করানো দুষ্কর যে সবই পড়ানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরে,সাহিত্য আর ভাষাবিজ্ঞানের ক্লাসে।তিনি তখন অত্যন্ত সংগত সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন,সেই বিশ্ববিদ্যালয়ও আমার নয়,সেই ভাষাও আমার নয়।কারণ আমার সেখানে যাওয়া হবে না।অর্থাৎ ‘ভাষাবিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি’-তে ভাষা কিংবা ভাষাবৈচিত্রের সংজ্ঞা বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে অধ্যাপকেরা স্থির করতে থাকুন।কিন্তু ভাষাবৈচিত্র্যগুলোর মর্যাদা পাঠশালা স্তরেই প্রতিষ্ঠা করবার প্রয়াস হোক,তখন বিদ্বজ্জনেরা বললে হবে না,---‘সিলেটি,নোয়াখালি,চট্টগ্রামী বাংলার পাঠ্যক্রমে শেষ ‘পঙ্গতে’ও  প্রবেশ করবার যোগ্য না।’অস্বীকার করলে বিচ্ছিন্নতা বাড়ে,স্বীকার করে নিলেই মিলনের পথ প্রশস্ত হয়---এই কথা ‘বিদ্বানে’রা না মেনে নিলে ‘অবিদ্বানে’রা নিজেদের পথ ঠিকই বেছে নেবেন।ইতিহাসে এমন নজির প্রচুর আছে।স্বীকরণের সেই লড়াই শুরু করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। 

                                           

।। উল্লেখপঞ্জি।।

১) ব্রজদয়াল বিদ্যাবিনোদ:শ্রীহট্টীয় কথ্যভাষা;প্রকাশক ব্রজদয়াল বিদ্যাবিনোদ;বড়লেখা, শ্রীহট্ট;   

    ১১৩৬ বাংলা।বইটির একটি প্রতিলিপি কলকাতার বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অন্তর্গত 

    ‘যতীন্দ্রমোহন সংগ্রহশালা’ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন শিলচর গুরুচরণ কলেজের অবসর প্রাপ্ত

     অধ্যাপক,সুপরিচিত লোক সাহিত্যের গবেষক এবং বর্তমান গবেষকের শিক্ষক অমলেন্দু ভট্টাচার্য। 

     তিনিও আমাদেরও একটি প্রতিলিপি করে দেন।

২) Benudhar Rajkhowa:Notes on the Sylheti Dialects;‘শ্রীহট্টীয় কথ্যভাষাবইতে

    যেভাবে উল্লেখ করেছেন ব্রজদয়াল বিদ্যাবিনোদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ০১

৩) ব্রজদয়াল বিদ্যাবিনোদ:শ্রীহট্টীয় কথ্যভাষা;প্রাগুক্ত পৃঃ ০১

৪) ড রমেশ পাঠক:অসমত উপভাষার চর্চা;তৃতীয় অধ্যায়;উপভাষা বিজ্ঞানর ভূমিকা;অশোক

    বুকস্টল,গুয়াহাটি-০১;প্রথম প্রকাশ,২০০৮;পৃ: ১৬৪

৫) ড রমেশ পাঠক;প্রাগুক্ত;পৃ: ১১০

৬) ড রমেশ পাঠক;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৪

৭) সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়:ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ;পৃ: ৪২৮; ‘বাক্য ও বাক্যতত্ত্ব’ অধ্যায়ে 

     রামেশ্বর শ’-এর উদ্ধৃতি;সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা;পুস্তক বিপণি,কলকাতা -৯;অখণ্ড

     দ্বিতীয় সংস্করণ,৩০শে শ্রাবণ,১৩৯৯;পৃ: ৪০২

৮) সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়:সরল ভাষা প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ;পৃ: ২৮৪;রামেশ্বর শ’-এর উদ্ধৃতি;

    প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০২

৯) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০২

১০) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৩

১১)  রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৩

১২)  নির্মল দাশ:বাক্য প্রকরণ;একবিংশ অধ্যায়;প্রথম খণ্ড,ব্যাকরণ;ভাষাবীথি;ওরিয়েন্টাল বুক

      কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড;গুয়াহাটি-০১;প্রথম প্রকাশ-ফেব্রুয়ারি, ২০০১;পৃ: ৩২০

১৩) ড নির্মল দাশ:বাক্য প্রকরণ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২০

১৪) নির্মল দাশ:বাক্যের প্রকারভেদ ও বাক্য পরিবর্তন;দ্বাবিংশ অধ্যায়; প্রাগুক্ত; পৃ: ৩৩১  

১৫) নির্মল দাশ :উক্তি পরিবর্তন;ত্রয়োবিংশ অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৫৬  

১৬) নির্মল দাশ : বাক্য-বিশ্লেষণ;চতুর্বিংশ অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৬৪

১৭) নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৬৪

১৮) নির্মল দাশ : ক্রিয়ার বাচ্য;সপ্তদশ অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৪

১৯) সুকুমার সেন:পদবিধি;ষোড়শ অধ্যায়;ভাষার ইতিবৃত্ত;আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড,

      কলকাতা-৯; প্রথম আনন্দ  সংস্করণ,তৃতীয় মুদ্রণ,নভেম্বর,১৯৯৪;পৃ: ২৬৪

২০) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৬৪

২১) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৬৪

২২) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৮০

২৩) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৫

২৪) সুকুমার সেন:বাঙ্গালা রূপপ্রক্রিয়া;চতুর্দশ অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪২

২৫) অতীন্দ্র মজুমদার:বাচ্য:ক্রিয়াপদের কাল;ভাষাতত্ত্ব;নয়া প্রকাশ,কলকাতা;দ্বিতীয় সংস্করণ,

      ১৯৮৭;পৃ: ২৬০

২৬) সত্যনাথ বরা: দ্বাদশ অধ্যায়;বাক্য বিন্যাস প্রকরণ;বহল ব্যাকরণ;বরুয়া এজেন্সি,গুয়াহাটি-;

      সেপ্টেম্বর,১৯৯২;পৃ:২১৭

২৭) সত্যনাথ বরা:দ্বাদশ অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ২১৭

২৮) সত্যনাথ বরা;প্রাগুক্ত;পৃ:২১৭

২৯) সত্যনাথ বরা:সূচীপত্র;প্রাগুক্ত;পৃ: xi

৩০) ড গোলোকচন্দ্র গোস্বামী: বাক্যবিশ্লেষণ;অসমীয়া ব্যাকরণ প্রবেশ;বীণা লাইব্রেরী;গুয়াহাটি;

      দ্বিতীয় সংস্করণ,২০০৩;পৃ: ৩৫৩

৩১) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী:বাক্য প্রকরণ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩১৮

৩২) ড গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩১৮

৩৩) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:৩২৭

৩৪) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৩৫

৩৫) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৪৬

৩৬) ড গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৪১

৩৭) ড গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪৮

৩৮) ড গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৪৮

৩৯) ড গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৪৮

৪০) ড গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৪৯

৪১) ড গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৫৩

     ৪২) উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী:সংযোজন;অধ্যায় চারি;ভাষা-বিজ্ঞান;মণি-মাণিক প্রকাশ;গুয়াহাটি-০১;

      একবিংশতিতম সংস্করণ,২০১৪;পৃ:  ১৬৯

৪৩) দীপ্তি ফুকন পাটগিরি:অসমীয়া,বাংলা আরু উড়িয়া ভাষাতুলনামূলক অধ্যয়ন;বনলতা,গুয়াহাটি

     ডিব্রুগড়;প্রথম প্রকাশ,এপ্রিল ২০০৪;পৃ: ১১৮,১২৭ এবং ১৩৫

৪৪) হুমায়ুন আজাদ:অবতরণিকা;বাঙলা ভাষা,প্রথম খণ্ড;সম্পাদনা: হুমায়ুন আজাদ;আগামী প্রকাশনী,

                            ঢাকা; ২০০৯;পৃ: ৪৫

৪৫) হুমায়ুন আজাদ:বাঙলা বিশেষ্যপদ;বাঙলা ভাষা,প্রথম খণ্ড; প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৬৩

৪৬) হুমায়ুন আজাদ:অবতরণিকা;বাঙলা ভাষা,প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৫

৪৭) হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৫

৪৮) হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৫

৪৯) হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৫

৫০) হুমায়ুন আজাদ:প্রথাগত বাক্যতত্ত্ব;বাংলা একাডেমী পত্রিকা, মাঘ-চৈত্র,১৩৮৯,পৃ: ৫৭ থেকে

      রামেশ্বর শ’এর উদ্ধৃতি;সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪২৯

৫১) রামেশ্বর শ’:ভাষাবিজ্ঞানের ক্রমবিকাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬০

৫২) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬০

৫৩) দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়:এই যে আমার ভাষার রক্তাক্ত শরীর---ব্যাকরণ!;প্রসঙ্গ বাংলা ব্যাকরণ 

      ২;পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি;কলকাতা;পৃ: ১২৪

৫৪) হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৪

৫৫) হুমায়ুন আজাদ:অষ্টম পরিচ্ছদ;রূপতাত্ত্বিক ও বাক্যিক পরিবর্তন;তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক

      ভাষাবিজ্ঞান;আগামী প্রকাশনী;ঢাকা;দ্বিতীয় সংস্করণ,ষষ্ঠ মুদ্রণ,মে ২০১০;পৃ: ১২৫

৫৬) রামেশ্বর শ’:বাক্য ও বাক্যতত্ত্ব;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৪

৫৭) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৪

৫৮) Gleason, H.A.Jr.: An Introduction to Descriptive Linguistics, 1976,

      p.128 থেকে রামেশ্বর শ’ এর ব্যবহৃত উদ্ধৃতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৫

৫৯) ড ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া: রূপান্তর স্ফোট ব্যাকরণর পরিচয়;ভাষার তত্ত্ব-কথা;সম্পাদক

      নাহেন্দ্র পাদুন;বাণী মন্দির;ডিব্রুগড় ০১;২০০৪;পৃ: ১৩২

৬০) ড ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪৯

৬১) রামেশ্বর শ’:ঐতিহ্যগত ব্যাকরণে বাক্যতত্ত্ব ও বাংলা বাক্য;প্রাগুক্ত;পৃ:৪০৬

৬২) ড নির্মল দাশ :বাক্য-প্রকরণ; একবিংশ অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২০

৬৩) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী:বাক্য প্রকরণ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩১৮

৬৪) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৯

৬৫) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ:৩২২

৬৬) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২৪

৬৭) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২০

৬৮) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২২

৬৯) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২২

৭০) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২৪

৭১) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৯

৭২) স্টিফেন হকিং:দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন: [অধ্যায় ২]; বাংলা অনুবাদ- তানভীর; মুক্তমনা বাংলা ব্লগ;

      সম্পাদক অভিজিৎ রায়; https://blog.mukto- mona.com/2010/10/12/10847/

৭৩) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২৩

৭৪) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ:৩২১

৭৫) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩১৮

৭৬) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২১

৭৭) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৯

৭৮) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৯

৭৯) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২১

৮০) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২১

৮১) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২৭

৮২) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২৭

৮৩) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪১০

৮৪) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪১০

৮৫) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪১০

৮৬) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪১০

৮৭) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪১০

৮৮) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:ত্রয়োদশ অধ্যায়;বাংলাভাষা পরিচয়; অধ্যায় -১২; রবীন্দ্র-

       রচনাবলী;১২৫তম জন্মজয়ন্তী  উপলক্ষে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ, বিশ্বভারতী;১৯৮৫;১৩শ

       খণ্ড;পৃ: ৬২২

৮৯) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২০

৯০) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২২

৯১) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২২

৯২) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪১১

৯৩) জগন্নাথ চক্রবর্তী: কথার নির্মাণ বা বাক্যতত্ত্ব;বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান ও

       ভাষাতত্ত্ব; ভাষা-সংস্কৃতি আকাদেমি অসম,হাফলং;প্রথম প্রকাশ- বৈশাখ,১৪২২বঙ্গাব্দ;পৃ: ৫১৮

৯৪) হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ:  ৪৬

৯৫) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী:বাক্য বিশ্লেষণ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৫৩

৯৬) নির্মল দাশ :বাক্য-বিশ্লেষণ;চতুর্বিংশ অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৬৪

৯৭) ললিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়:ব্যাকরণ- বিভীষিকা; বাঙলা ভাষা; প্রথম খণ্ড; সম্পাদক হুমায়ুন

      আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪১০

৯৮) বিধুশেখর ভট্টাচার্য্য:ব্যাকরণ- বিভীষিকা;বাঙলা ভাষা;প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৩৭

৯৯) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:বাংলা ভাষা পরিচয়,২২;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬২২

১০০) হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৬

১০১) রামেশ্বর শ’:ঐতিহ্যগত ব্যাকরণে বাক্যতত্ত্ব ও বাংলা বাক্য;প্রাগুক্ত; পৃ: ৪১১

১০২) নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৬৪

১০৩) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৫৩

১০৪) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫১৯

১০৫) নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৬৪

১০৬) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৭

১০৭) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৫৩

১০৮) গোলোক চন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৫৩

১০৯) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৭

১১০) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৭

১১১) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী:বাক্য প্রকরণ;প্রাগুক্ত;পৃ:৩২৭

১১২) গোলোক চন্দ্র গোস্বামী:বাক্য বিশ্লেষণ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৫৭

১১৩) গোলোক চন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৫৯

১১৪) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ:৫২২

১১৫) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫২২

১১৬) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫২৩

১১৭) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫২৪

১১৮) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত; পৃ: ৫২৩

১১৯) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত; পৃ: ৫২৩

১২০) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত; পৃ: ৫২৫

১২১) সুকুমার সেন:বাঙ্গালা পদবিধি; ষোড়শ অধ্যায় ;প্রাগুক্ত;পৃ:২৭৫

১২২) নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২২

১২৩) নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ:৩২২

১২৪) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬২২

১২৫) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬২২

১২৬) রামেশ্বর শ’:ঐতিহ্যগত ব্যাকরণে বাক্যতত্ত্ব ও বাংলা বাক্য;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪১২

১২৭) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫২৯

১২৮) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৩০

১২৯) নিখিলেশ পুরকাইত:রাঢ় উপভাষাগুচ্ছ; প্রথমখণ্ড; বাংলা অসমীয়া ও ওড়িয়ার উপভাষার

        ভৌগোলিক জরিপ;সুবর্ণ রেখা,কলকাতা-৯;প্রথম প্রকাশ,জুন,১৯৮৯;পৃ:

১৩০) নিখিলেশ পুরকাইত:বঙ্গ উপভাষাগুচ্ছ;তৃতীয় খণ্ড; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬৩ 

১৩১) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৭৬

১৩২) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮৪

১৩৩) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯০

১৩৪) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯৭

১৩৫) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০২

১৩৬) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২১০

১৩৭) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী:বাক্য বিশ্লেষণ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৫৯

১৩৮) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৬১

১৩৯) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৬০

১৪০) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৬১

১৪১) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৬৩

১৪২) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৬৪

১৪৩) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৬৫

১৪৪) গোলোক চন্দ্র গোস্বামী:বাক্য প্রকরণ; প্রাগুক্ত;পৃ:৩৪০

১৪৫) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৬

১৪৬) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩০

১৪৭) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩০

১৪৮) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৬

১৪৯) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৭

১৫০) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৭

১৫১) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫২০

১৫২) গোলোক চন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩৫

১৫৩) গোলোক চন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩৬

১৫৪) গোলোক চন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩৬

১৫৫) গোলোক চন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩৭

১৫৬) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৯

১৫৭) গোলোক চন্দ্র গোস্বামী:ক্রিয়াপদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৯৭

১৫৮) স্বপ্নময় চক্রবর্তী: নোয়াখালিয় ভাষা:এক অ-বিশেষজ্ঞের বয়ান;কোরক –সাহিত্য পত্রিকা;প্রাক

        শারদ ১৪১৮;সম্পাদক তাপস ভৌমিক;কলকাতা ৫৯;পৃ: ৫৩

১৫৯) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৮

১৬০) ড নির্মল দাশ : বাক্যের প্রকারভেদ ও বাক্য পরিবর্তন; দ্বাবিংশ অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩২

১৬১) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৮

১৬২) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩২

১৬৩) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৮

১৬৪) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩৩

১৬৫) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩৩

১৬৬) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৮

১৬৭) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৮

১৬৮) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩২

১৬৯) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫২০

১৭০) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩২

১৭১) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী:বাক্য প্রকরণ; প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩৯

১৭২) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২৭

১৭৩) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২৯

১৭৪) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩১

১৭৫) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩১

১৭৬) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩১

১৭৭) P.K Dey Sarkar:Phrases; Chapter XXIX; A Text Book of Higher

        English Grammar & Composition;Book Sundicate (P) Etd;Calutta

        09;1982;pg:198.

১৭৮) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৩৩

১৭৯) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩২

১৮০) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৩২

১৮১) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩২

১৮২) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩২

১৮৩) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩৮

১৮৪) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩৮

১৮৫) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩৮

১৮৬) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৩৮

১৮৭) P.K Dey Sarkar:Clasuses; ChapterXXX;ibid; pg:200.

১৮৮) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৮

১৮৯) নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩৩

১৯০) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩৭

১৯১) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩৭

১৯২) নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩৩

১৯৩) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫২০

১৯৪) স্বপ্নময় চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত; পৃ: ৫৭

১৯৫) মাহবুবুল হক:চট্টগ্রামের উপভাষা;কোরক –সাহিত্য পত্রিকা;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৮

১৯৬) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:  ৩৪০

১৯৭) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:  ৩৪০

১৯৮) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪১

১৯৯) P.K Dey Sarkar:Sentences:Simple,Complex,Compound; ibid;pg:209.

২০০) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৯

২০১) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩৪

২০২) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪৬

২০৩) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫২০

২০৪) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪১১

২০৫) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪৫

২০৬) নির্মল দাশ : উক্তি পরিবর্তন; ত্রয়োবিংশ অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৫৬

২০৭) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪১

২০৮) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪১

২০৯) মাহবুবুল হক:চট্টগ্রামের উপভাষা; প্রাগুক্ত; পৃ: ৪৮

২১০) স্বপ্নময় চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত; পৃ: ৫৭

২১১) রবীন্দ্র কুমার দত্ত:নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের উপভাষায় বাক্যের ব্যবহারগত প্রয়োগবিধি;

        নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের উপভাষাএকটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ; প্রগ্রেসিভ পাব্লিশার্স,

        কলকাতা-৭৩;মার্চ,২০১২;পৃ: ২৩১

২১২) স্বপ্নময় চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৩

২১৩) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪১৩

২১৪) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৪৭

২১৫) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৪৭

২১৬) স্বপ্নময় চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৫

২১৭) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২২৯

২১৮) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ২২৯

২১৯) স্বপ্নময় চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৩

২২০) স্বপ্নময় চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ:৫২ 

২২১) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২২৯

২২২) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ:২২৯

২২৩) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ:২২৯

২২৪) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ:৪১৮

২২৫) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:  ৩৪৭

২২৬) নির্মল দাশ : বাক্যের প্রকারভেদ ও বাক্য পরিবর্তন; দ্বাবিংশ অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩৫

২২৭) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫২১

২২৮) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪১

২২৯) নির্মল দাশ : উক্তি পরিবর্তন;ত্রয়োবিংশ অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৫৬

২৩০) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪২-৪৩

২৩১) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪৩

২৩২) সুজিৎ চৌধুরী:ধর্ম, রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকতা- উৎস ও পটভুমি; প্রবন্ধ একাদশ; সম্পাদনা

        জয়দীপ বিশ্বাস;অক্ষর;আগরতলা ০১;২০১০;পৃ: ৬৩

২৩৩) দীনেশ চন্দ্র গোস্বামী: আশা আকাঙ্ক্ষার কুসুম বুটলি;প্রকাশজুন, ২০১৬ সংখ্যা;সম্পাদনা

        মিহির চৌধুরী; প্রকাশক অসম প্রকাশন পরিষদ, গুয়াহাটি -২১;পৃ: ৯১

২৩৪) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৫৭

২৩৫) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:  ৩৪৪

২৩৬) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:  ৩৪৪

২৩৭) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৫৭

২৩৮) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:  ৩৪৫

২৩৯) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪৫

২৪০) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:  ৩৪৫

২৪১) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৫৫ এবং ৩৬১

২৪২) P.K Dey Sarkar: Voice;ibid; pg:  68.

২৪৩) সুকুমার সেন : বাঙ্গালা রূপপ্রক্রিয়া;চতুর্দশ অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ:২৪২

২৪৪) ড নির্মল দাশ : ক্রিয়ার বাচ্য;সপ্তদশ অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৪

২৪৫) সত্যনাথ বরা : দ্বাদশ অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ২১৭

২৪৬) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪৮

২৪৭) রফিকুল ইসলাম (.) ও পবিত্র সরকার(.):সূচীপত্র;প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ১ম

        খণ্ড;বাংলা একাডেমী,ঢাকা;প্রথম প্রকাশ ডিসেম্বর,২০১১,পুনর্মুদ্রণডিসেম্বর২০১২;

        http://www.porua.com.bd/books/প্রমিত-বাংলা-ভাষার- ব্যাকরণ-১ম-খণ্ড

২৪৮) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৪

২৪৯) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ:২৭৪

২৫০) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ:২৭৪

২৫১) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ:২৭৪

২৫২) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৪

২৫৩) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৫

২৫৪) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৬

২৫৫) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:  ৩৪৮

২৫৬) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:  ৩৪৮

২৫৭) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪৮

২৫৮) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:  ৩৪৮

২৫৯) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪৯

২৬০) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪৯

২৬১) গুণ্ডরীপাদ: চর্যা ৪;চর্যাপদ ভাষা পাঠ রূপান্তর;মৃণাল নাথ;এবং মুশায়েরা;কলকাতা ৭৩;

        এপ্রিল ২০১১;পৃ: ৫২

২৬২) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪৩

২৬৩) গুণ্ডরীপাদ:চর্যা ৪;চর্যাপদ;সম্পাদনা-অতীন্দ্র মজুমদার;নয়াপ্রকাশ;কলিকাতা ৬;২য় বর্ধিত

        সংস্করণ,৪র্থ মুদ্রণ;১৩৮৮ বাং.;পৃ: ১২২

২৬৪) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪৯

২৬৫) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৫২

২৬৬) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৫২

২৬৭) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৫২

২৬৮) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:  ৩৫২

২৬৯) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৫২

২৭০) ড নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৫

২৭১) বাণীকান্ত কাকতি : ক্রিয়ার রূপকরণ; সপ্তদশ অধ্যায়; অসমীয়া ভাষার গঠন আরু বিকাশ;

        বিশ্বেশ্বর হাজরিকার অনুবাদ; বাণীকান্ত কাকতি  জন্মশতবার্ষিকী উদˎযাপন সমিতি,

        বরপেটা;অক্টোবর,১৯৯৬;পৃ: ৩০১

২৭২) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪২

২৭৩) বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০২

২৭৪) বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০৩

২৭৫) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪৩

২৭৬) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪৩

২৭৭) বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০৩

২৭৮) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪৩

২৭৯) ড বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০৪

২৮০) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪৪

২৮১) ড বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০৪

২৮২) ড বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০৩

২৮৩) Suniti Kumar Chatterji: Morphology; Chapter V; The Origin and

        Development of the Bengali Language; Rupa & Co, Kolkata; 1993;

        pg: 919.

২৮৪) ড গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪৮

২৮৫) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪২

২৮৬) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪৩

২৮৭) নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৫

২৮৮) সত্যনাথ বরা : দ্বাদশ অধ্যায় প্রকরণ;প্রাগুক্ত;পৃ:২১৮

২৮৯) সত্যনাথ বরা;প্রাগুক্ত;পৃ: ২১৮

২৯০) স্বপ্নময় চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৭

২৯১) স্বপ্নময় চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৪

২৯২) স্বপ্নময় চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৫

২৯৩) স্বপ্নময় চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৫

২৯৪) স্বপ্নময় চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৫

২৯৫) পবিত্র সরকার: বাংলা বাচ্য;বাংলা ব্যাকরণ প্রসঙ্গ;দেজ পাবলিশিং,কলকাতা-৭৩;প্রথম

        প্রকাশ- জানুয়ারি,২০০৬;পৃ: ১৬০

২৯৬) পবিত্র সরকার: বাংলা বাচ্য;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬০

২৯৭) পবিত্র সরকার; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬০

২৯৮) পবিত্র সরকার; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬১

২৯৯) জগন্নাথ চক্রবর্তী: বাচ্য;রূপতত্ত্ব;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৭৯

৩০০) পবিত্র সরকার; প্রাগুক্ত;পৃ:১৬১

৩০১) পবিত্র সরকার; প্রাগুক্ত;পৃ:১৬২

৩০২) পবিত্র সরকার; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬৪ 

৩০৩) পবিত্র সরকার; প্রাগুক্ত;পৃ:১৬৫

৩০৪) পবিত্র সরকার; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬৭

৩০৫) পবিত্র সরকার; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬৭

৩০৬) পবিত্র সরকার; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬৭

৩০৭) রবীন্দ্র কুমার দত্ত: উপভাষাগত আদর্শঃ একটি গল্পের তুলনামূলক রূপ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৬০

৩০৮) রবীন্দ্র কুমার দত্ত: নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের উপভাষায় বাক্যের ব্যবহারগত প্রয়োগ

        বিধি;প্রাগুক্ত; পৃ: ২২৮

৩০৯) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২২৮

৩১০) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৬

৩১১) Gleason, H.A.Jr.: An Introduction to Descriptive Linguistics, 1976,

        p.128 থেকে রামেশ্বর শ’ এর ব্যবহৃত উদ্ধৃতি। রামেশ্বর শ’: বাক্য ও  বাক্যতত্ত্ব ;প্রাগুক্ত;

        পৃ: ৪০৫

৩১২) Leonard Bloomfield: - syntax ; chapter 12;Language; George Allane

        & Unwin Ltd, London,UK; First Published in 1935, 1973 Edition; pg

        184.

৩১৩) Charles F. Hockett: Idiolect: Morphology and Syntax; A Course in

        Modern Linguistics; Oxford & IBH Publishing Co. New   

        Delhi. Calcutta.Bombay;Indian Edition 1973 pg: 321

৩১৪) জগন্নাথ চক্রবর্তী:কথার নির্মাণ বা বাক্যতত্ত্ব;প্রাগুক্ত;পৃ:৫১৫

৩১৫) Ferdinand De Saussure: Static and Evolutionary Linguistics; chapter

        III;Course in General Linguistics; Edited by Charles Bally and Albert

        Sechehaye, in collaboration with Albert Reidlinger; Translede from

        French by Wade Baskin; Philosophical Library, New York,159; 

         pg:99.

৩১৬) Ferdinand De Saussure: Static and Evolutionary Linguistics; ibid;

        pg:81.

৩১৭) Leonard Bloomfield:The Comparative Method; chapter12;   

        Language;ibid;pg 184.

৩১৮) Charles F. Hockett:Idiolect,Dialect,Language;Synchronic

        Dialectology;A Course in  Modern Linguistics;ibid; pg: 321

৩১৯) ড দয়ানন্দ পাঠক:বর্ণনাত্মক ভাষাবিজ্ঞানের চমু পরিচয়; ভাষার তত্ত্ব–কথা; সম্পাদক- নাহেন্দ্র

        পাদুন;প্রাগুক্ত;পৃ:২৪

৩২০) Ferdinand De Saussure :Course in General Linguistics;ibid;pg:80.

৩২১) রামেশ্বর শ’: বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানে বাক্যতত্ত্ব ও বাংলা বাক্য;প্রাগুক্ত; পৃ: ৪২১

৩২২) Leonard Bloomfield:Contents; Language;ibid; pg ix.

৩২৩) Charles F. Hockett:Grammatical Systems; Synchronic

        Dialectology;ibid;pg:147.

৩২৪) Noam Chomsky:Syntactic Structures;Mouton De Druyter,  Berlin-

        NewYork ; Mouton De  Druyter 2nd edition 2002.

৩২৫) Noam Chimsky:The Aspects of the Theory of Syntax; The M.I.T

        Press,Massachusatts Institute of Technology, Cambridge,  

        Massachusatts;1965;pg.ix.

৩২৬) রামেশ্বর শ’:ভাষাবিজ্ঞানের ক্রমবিকাশ;প্রাগুক্ত;পৃ:১০৯

৩২৭) ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩২

৩২৮) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫১৫

৩২৯) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫১৫

৩৩০) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫১৮

৩৩১) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৩০

৩৩২) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫২২

৩৩৩) রামেশ্বর শ’: বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানে বাক্যতত্ত্ব ও বাংলা বাক্য;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪২১

৩৩৪) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩১

৩৩৫) গোলোকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩২

৩৩৬) Charles F. Hockett:immediate constituensts;Grammatical Systems;

        ibid;pg:156.

৩৩৭) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৩০

৩৩৮) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৩১

৩৩৯) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৩৭

৩৪০) Noam Chomsky:Introduction;Syntactic Structures; ibid; pg: 11.

৩৪১) Noam Chomsky: the independence of grammar; Syntactic Structures;

        ibid;pg: 13.

৩৪২) রামেশ্বর শ’:ভাষাবিজ্ঞানের ক্রমবিকাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১১১

৩৪৩) Noam Chomsky;Generative Grammar and Linguistic Competence;

        Aspects of the theory of Syntax;ibid; pg:5.

৩৪৪) Noam Chomsky:Contents; Knowledge of Language: Its Nature,

        Origin,and Use; Praeger; Westport.Connecticut.London; 1986pg ix.

৩৪৫) Bertrand Russell,As quoted by Noam Chomsky:Preface; Knowledge

        of  Language:Its  Nature,Origin, and Use; ibid; pg xxv.

৩৪৬) হুমায়ুন আজাদ:বাংলা বিশেষ্যপদ;বাক্যতত্ত্ব;প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৬৩

৩৪৭) ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া: রূপান্তর স্ফোট ব্যাকরণর পরিচয়;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩২

৩৪৮) ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৭

৩৪৯) ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৬

৩৫০) ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৭

৩৫১) ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৭

৩৫২) ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৭

৩৫৩) ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৭

৩৫৪) ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৭

৩৫৫) Noam Chomsky; Generative Grammars as Theories of Linguistic 

        Competence; Aspects of the theory of Syntax; ibid; pg:3.

৩৫৬) ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৯

৩৫৭) ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪০

৩৫৮) ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪১

৩৫৯) Noam  Chomosky: An Elemenrary Linguistic Theory; Syntactic

        Structures; ibid; pg:19.

৩৬০) ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪২

৩৬১) ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪৩

৩৬২) ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪৪

৩৬৩) ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪৫

৩৬৪) ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪৭

৩৬৫) ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪৭

৩৬৬) ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪৭

৩৬৭) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ১১৮

৩৬৮) পবিত্র সরকার: প্রশ্ন ও বাংলা ভাষায় প্রশ্ন বাক্যের গঠন;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৭২

৩৬৯) পবিত্র সরকার:  বাংলা ভাষায় নিষেধাত্মক (Negative) উপাদান;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮৭

৩৭০)  ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্ত বরুয়া;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪৯

৩৭১)   উপেন রাভা  হাকাচাম:অসমীয়ার জাতিগত/সামাজিক শ্রেণীগত উপভাষা; অধ্যায়: ৫;

         অসমীয়া আরু অসমর ভাষা-উপভাষা;জ্যোতি প্রকাশন, গুয়াহাটি; জুলাই ২০০৯;পৃ:  ২৮৪

৩৭২) ড উপেন রাভা  হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৮৫

৩৭৩) উপেন রাভা  হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৮৫

৩৭৪) ড রমেশ পাঠক;প্রাগুক্ত;পৃ:  ১৭০

৩৭৫) ড নির্মল দাশ:তৃতীয় এবং চতুর্থ অধ্যায়; দ্বিতীয় খণ্ড; ভাষাবীথি; প্রাগুক্ত;পৃ: ৪২৭ এবং ৪৪৬

৩৭৬) সত্যনাথ বরা:প্রথম অধ্যায়;ওপরঞ্চি;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪৫

৩৭৭) উপেন রাভা  হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৯৮

৩৭৮) হেমাঙ্গ বিশ্বাস:শ্রীহট্টর লোক-সংগীতর সুরবিচার;অসম  আরু বঙ্গর লোক-সঙ্গীত সমীক্ষা;

        হেমাঙ্গ বিশ্বাস রচনাবলী; সম্পাদনা—পরমানন্দ মজুমদার;অসম প্রকাশন পরিষদ;গুয়াহাটী ২১;

        ডিচেম্বর,২০০৮;পৃ: ২০৬

৩৭৯) উপেন রাভা  হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৯৮

৩৮০) হেমাঙ্গ বিশ্বাস;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০৬

৩৮১) উপেন রাভা  হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৯৮

৩৮২) হেমাঙ্গ বিশ্বাস: লোক-সংগীত,উপভাষা,উপমা আরু উচ্চারণ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৫

৩৮৩) হেমাঙ্গ বিশ্বাস;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৬

৩৮৪) উপেন রাভা  হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৯১

৩৮৫) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮২

৩৮৬) ডাঃ মৃন্ময় দেব নিলাম বাজার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রধান। অসমের একজন সুপরিচিত

        লেখক এবং সমালোচক। তিনি এক আন্তর্জালীয় আলাপে এই তথ্য জানিয়েছেন।

৩৮৭) উপেন রাভা  হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৯৮

৩৮৮) অমলেন্দু চক্রবর্তী:মুখবন্ধ;বরাক উপত্যকার প্রবাদ ও প্রবচন (প্রথম পর্যায়) ও খেলার ছড়া;

        আবিদ রাজা মজুমদার;কলংমা প্রকাশনী; জয়পুর কাছাড়; ২০০৩

৩৮৯) তপোধীর ভট্টাচার্য:সিলেটি উপভাষা: প্রসঙ্গ ও অনুসঙ্গ; কোরক সাহিত্য পত্রিকা; প্রাকশারদ

        সংখ্যা,১৪১৮;প্রাগুক্ত;পৃ: ১১৪

৩৯০) জন্মজিৎ রায়:সিলেটি উপভাষা:ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিত;শ্রীহট্ট কাছাড়ের প্রাচীন

        ইতিহাস ও সংস্কৃতির রূপরেখা;সম্পাদনা—জ্যোতিরিন্দ্রনাথ চৌধুরী;সুনির্মল দত্ত চৌধুরী;

        অমলেন্দু ভট্টাচার্য,মানবেন্দ্র ভট্টাচার্য;রবীন্দ্র স্মৃতিগ্রন্থাগার এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ;শিলং

        ১৯৯৬;পৃ: ১৯২

৩৯১) তপোধীর ভট্টাচার্য;প্রাগুক্ত;পৃ: ১১৫

৩৯২) The Sylheti Language Conference; 12th May, 2016;Conference

        Information; The School of Oriental and African Studies

        (SOAS),University of London,London, United Kingdom; 

        International Linguistic Community Online; The Linguist List;

        http://linguistlist.org/callconf/browse-conf-

        action.cfm?Submissionid=36161177

৩৯৩) যোগীন্দ্রনাথ সরকার; হাসিখুশি;নির্মল বুক এজেন্সি;কলকাতা;পৃ: ১৬

৩৯৪) জালাল উদ্দীন মজুমদার ও অসীমা ভট্টাচার্য:নতুন পাঠ; ক-মান শ্রেণী;আসাম পাব্লিশার্স;

        শিলচর;২০০২;পৃ: ২১

৩৯৫) জালাল উদ্দীন মজুমদার ও অসীমা ভট্টাচার্য;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩

৩৯৬) শব্দবোধ অভিধান:আশুতোষ দেব; দেব সাহিত্য কুটির;কলকাতা-০৯;জানুয়ারি,১৯৭৬;                  

        পৃ: ২৫৩

৩৯৭) জালাল উদ্দীন মজুমদার ও অসীমা ভট্টাচার্য;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২

৩৯৮) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:সহজ পাঠ;প্রথম ভাগ;বিদ্যালয় শিক্ষা দপ্তর;পশ্চিমবঙ্গ সরকার;কলকাতা

         ৯১; পৃ:

৩৯৯) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর;প্রাগুক্ত;পৃ:

৪০০) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর;প্রাগুক্ত;পৃ:

৪০১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:সহজ পাঠ;দ্বিতীয় ভাগ;প্রাগুক্ত;পৃ:

৪০২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর;প্রাগুক্ত;পৃ:

৪০৩) অমিতাভ দেবচৌধুরী: হা রে রে রে রে রে; জ্ঞান বিচিত্রা প্রকাশনী;আগরতলা ০১;জানুয়ারি

        ২০০৮;পৃ: ১৭

৪০৪) অমিতাভ দেবচৌধুরী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২২

৪০৫) অমিতাভ দেবচৌধুরী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪

 

~***~

 

 

Comments

Popular posts from this blog

।।রোমান হরফে বাংলা লেখার পুরাকথা । ।

।। অসমিয়া-বাংলা- সিলেটি লিপি ।। সপ্তম অধ্যায় ৷৷

।। অসমিয়া,মানবাংলা,সিলেটি এবং দু’একটি প্রতিবেশী ভাষা ও ভাষাবৈচিত্র্যের ধ্বনিতাত্ত্বিক তুলনা ।। তৃতীয় অধ্যায় ৷৷