।। অসমিয়া,মান বাংলা,সিলেটি এবং দু’একটি প্রতিবেশী ভাষা ও ভাষাবৈচিত্র্যের শব্দার্থতাত্ত্বিক তুলনা ।। পঞ্চম অধ্যায় ৷৷
৷৷ অসমিয়া ভাষা এবং বাংলার সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্যের পারস্পরিক সম্পর্ক ৷৷
৷৷ একটি কালানুক্রমিক এবং কালিক অনুসন্ধান ৷৷ পঞ্চম অধ্যায় ৷৷
📚📚📚📚📚📚📚
(মূল গবেষণা অভিসন্দর্ভে ‘উপভাষা’ শব্দটিই ছিল, ‘ভাষাবৈচিত্র্য’ ছিল না । আই পি এ (IPA) হরফগুলো যদি বা এখানে নাও পড়তে পারেন এখানে ক্লিক করে বা একেবারে নিচে গোগোল ড্রাইভে পিডিএফে পড়ুন। আগে পরের অধ্যায়গুলোর জন্যে এখানে ক্লিক করুন।)
এমনকি যে রামেশ্বর শ’ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সীমাবদ্ধতার কথাটি লিখলেন,তিনিও বাক্যতত্ত্ব প্রসঙ্গে কিছু বা গঠনবাদী তত্ত্বের পরিচয় রাখলেও,চমস্কি প্রবর্তিত রূপান্তরমূলক সৃজনমূলক ব্যাকরণের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরছেন শুধু যেখানে অন্যান্য পশ্চিমা ভাষাবিজ্ঞানীদের সঙ্গে চমস্কির জীবন এবং কর্মের পরিচয় তুলে ধরছেন সেখানে।১৭ তাতে করে তত্ত্বটি সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা হয়,কিন্তু বাংলা ভাষা-বিশ্লেষণে তত্ত্বটির প্রয়োগ পদ্ধতি অস্পষ্টই থেকে যায়। বাকি শব্দার্থতত্ত্ব এবং বাক্যতত্ত্ব সম্পর্কে তিনিও মূলত সেগুলোই পুনরালোচনা করছেন যেগুলো ঐতিহাসিক ভাষাবিদেরা করে এসেছেন।তাতে দোষের কিছু হয় নি।স্যোসুর পরবর্তীকালে লিওনার্দো ব্লুমফিল্ড এবং তাঁর উত্তরসূরীদের কেউ কেউ ‘অর্থতত্ত্ব’ এবং ‘ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান’-এর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে চাইলেও ব্লুমফিল্ডের মার্কিন স্কুলের সহযোগী এডওয়ার্ড স্যাপীরইতো সাংস্কৃতিক ভাষাতত্ত্বের উত্তরাধিকার অস্বীকার করতে চান নি।করাটা মনে হয় না উচিতও হবে। দুই ধারাকে এর পরে আর পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে পরিপূরক ভাবাই সমীচীন এমটাই লিখেছেন রামেশ্বর শ’।১৮ তিনি শুধু সতর্ক করে দিয়েছেন,“বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের তথ্যের প্রতিষ্ঠার আগেই ভাষাবিজ্ঞানীর অন্বেষা যেন ঐতিহাসিক তথ্যের দ্বারা চালিত না হয়।”১৯ আমরা কথাটিকে আরেকটু স্পষ্ট করতে চাই।ভাষাবিজ্ঞানের বর্ণনামূলক এবং ঐতিহাসিক অধ্যয়ন শুধুই দুই ‘দৃষ্টিভঙ্গি’র প্রশ্ন নয়।বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের সব অর্জনই কি বৈজ্ঞানিক ভাবে সঠিক? যদি তাই হবে তবে ব্লুমফিল্ডের ‘কাঠামোবাদ’-এর সঙ্গে চমস্কির ‘সৃজনমূলক ব্যাকরণ’-এর বিরোধ বাঁধবে কেন?এ আসলে দুই পরিপূরক অধ্যয়ন পদ্ধতি।সত্য বটে,ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের বিকাশের কালে বহু অবৈজ্ঞানিক ধ্যান ধারণাও প্রশ্রয় পেয়েছিল,বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের কালে সেই প্রশ্রয় সম্পর্কে ভাষাবিজ্ঞানীরা অনেক বেশি সতর্ক।কিন্তু সচেতনভাবেই হোক,কিংবা অচেতন বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের আগের কালেও পরম্পরাগত ভাষাবিদ্যার বহু বৈজ্ঞানিক অর্জন ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
কিন্তু তারপরেও আমাদের প্রশ্ন থেকে যায়,‘শব্দার্থতত্ত্ব’-এর ভাষাবৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন কি সেগুলোই যেগুলোর আলোচনা রামেশ্বর শ’ বা তাঁর পূর্বসূরিরা করেছেন?নোয়াম চমস্কিকে ধরে এগুলে ‘শব্দার্থতত্ত্ব’-এর কি ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের জায়গা থেকে এগোনো সম্ভব ছিল?নোয়াম চমস্কিও তাঁর ভাষাবৈজ্ঞানিক গবেষণা জীবনের শুরুর দিকে ‘শব্দার্থতত্ত্ব’ নিয়ে খুব নিঃসংশয়ী ছিলেন না।পঞ্চাশের দশকের গবেষণা নিবন্ধ ‘The Logical Structure of Linguistic Theory’ দিয়ে বা এর পরের ‘Syntactic Structures’-এ যখন চমস্কি ভাষাবিজ্ঞানে তাঁর নতুন ভাবনার সূচনা ঘটাচ্ছেন,তখন এবং তার আগে অব্দি ভাষাবিজ্ঞানের স্থিতি কী ছিল সেসব কথা খুব সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানী বারবারা এইচ পার্তী (Barbara H. Partee),চমস্কিরই অর্জনের পঞ্চাশ বছরে প্রকাশিত একটি সংকলনে।আমরা তাঁর কথার অনেকখানি তুলে দিচ্ছি, তাতে পশ্চিমা বিশ্বের ভাষাচর্চার গতিবিধির সঙ্গে বাংলা তথা ভারতের গতিবিধির সমান্তরাল সম্পর্কটিও সুন্দর বোঝা যাবে,“In the century before Syntactic Structures,linguistics became at least in part a science,but semantics was not part of that development.Linguistics began to emerge as a science in the nineteenth century with the German Junggrammatiker’s breakthrough discoveries about sound changes and the evolutionary history of the Indo-European languages.Darwin in his Origin of Species said that ‘linguistics,as practiced by the leading exponents of comparative Indo-European philology, offers the paradigm of scientific method’ (Harris and Taylor, 1997,p.187).And in both Europe and the U.S.,there was a self -conscious drive to view linguistics as a science in the 1930’s; linguistics was part of the Vienna Circle’s ‘unified science’ movement,with the semiotician Charles Morris as one of its leaders.As for semantics,there was a mixture of negative attitudes and neglect in American linguistics in the 20th century.There had been rather little semantics in early American anthropological linguistics,since linguistic field work generally had to start with phonetics,then phonology,then morphology,then perhaps a little syntax;any work on semantics was limited to dictionary –making and semantic features for the structural analysis of kinship terms and other such lexical domains.The behaviorists viewed meaning as an unobservable aspect of language,not fit for scientific study,and that had some influence on the Bloomfieldians.Quine had strong philosophical skepticism about the concept of meaning,and his and Goodman’s influence on Chomsky is acknowledged in the preface to Syntactic Structures.”২০এর পরেই লিখছেন,“Chomsky has frequently expressed ambivalence about semantics as a science and about the relation between syntax and semantics.This is evident even before Syntactic Structures in The Logical Structure of Linguistic Theory (LSLT;Chomsky,1975b).”২১
কিন্তু কয়েক বছর পরেই আরো দুই ভাষাবিজ্ঞানী জেরল কা’জ (Jerrol Katz) এবং জেরি ফডোর( Jerry Fodor) শব্দার্থতত্ত্বকে রূপান্তরমূলক ব্যাকরণের বিষয় করবার জন্যে কাজে নামেন।১৯৬৩-তে Language পত্রিকাতে প্রকাশিত তাদের যৌথ নিবন্ধের নাম ছিল,‘The Structure of a Semantic Theory’।সেখানে তাদের দাবি “As a rule,the meaning of a word is a compositional function of meanings of its parts, and we would like to be able to capture this compositionality.”২২ তাঁরা চেয়েছিলেন ‘শব্দার্থতত্ত্ব’-কে রূপান্তরমূলক সৃজনমূলক ভাষাবিজ্ঞানেরই অংশ হিসেবেই বিকশিত করতে। তাতে বহু নতুন ভাবনার বিকাশ ঘটে। স্বয়ং চমস্কিও তাঁদের কাছে নিজের ঋণ স্বীকার করেছিলেন পরের বছরেই প্রকাশিত তাঁর ‘The Aspects Of The Theory Of Syntax’ বইতে,বিশেষ করে তৃতীয় অধ্যায়ে।তারপরে থেকেই ‘শব্দার্থতত্ত্ব’ ভাষাবিজ্ঞানের ভেতরে জায়গা করে নেয়।বহু তর্ক বহু বিবাদের জন্ম দেয়।চকস্কির বহু সিদ্ধান্তকে ভ্রান্তও প্রমাণ করে।তারপরেও এই বিতর্ক যা রেখে যায় তার সুন্দর বর্ণনা করেছেন বারবারা পূর্বোক্ত নিবন্ধের শেষে,“The Aspects model did not survive -no theory does-but the elegance of its architecture of syntax,semantics and phonology sometimes evoke dreams of a lost paradise;a nice dream while it lasted.Actually, fortunately,has been at least as interesting,and the many directions that syntax and semantics have gone in since Aspects,and the many discoveries that have been made, have made the syntax -semantics interface one of the most richly flourishing subfields of linguistics.”২৩
চমস্কি তত্ত্ব নিয়ে পবিত্র সরকার কিছু কাজ করেছেন বলে রামেশ্বর শ’ উল্লেখ করেছিলেন।রবীন্দ্রভারতী পত্রিকার ষোড়শ বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যাতে ‘সংবর্তনী সঞ্জননী ভাষাতত্ত্ব ও বাংলা ভাষা বিচারে তার প্রয়োগ’ নামে একটি নিবন্ধের কথা লিখেছিলেন।২৪ফলে আমরা সামান্য সতর্ক হয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছিলাম।ভাষা নিয়ে তাঁর অনেকগুলো বই রয়েছে,তার মধ্যে স্কুলপাঠ্য তিন খণ্ডের বই ‘ভাষা-জিজ্ঞাসা’ কিংবা সম্প্রতি ২০১২-তে ঢাকার বাংলা একাদেমীর থেকে রফিকুল ইসলামের সঙ্গে একত্রে লিখে প্রকাশিত ‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ বইটি রয়েছে।তাঁর পিএচডি গবেষণা সন্দর্ভের নাম ছিল ‘The Segmental Phonology of Standard Colloquial Bengali’।সেখানে ধ্বনিতত্ত্বে সৃজন মূলক ব্যাকরণের প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন।শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি গবেষণাটি করেন ১৯৭৫-এ।সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি,“This dissertation is the first generative treatment of the Standard Colloquial Bengali phonology,identifying the major synchronic rules that obtain in the dialect.”২৫কিন্তু এর একটিও আমাদের সংগ্রহে নেই।তবে তিনখানা প্রধান বইতে নজর ফেরাবার সুযোগ আমাদের হয়েছে।‘ভাষা দেশ কাল’ (১৯৮৪),‘ভাষাপ্রেম ভাষাবিরোধ’(২০০৩) এবং ‘বাংলা ব্যাকরণ প্রসঙ্গ’(২০০৬)।এই তিনখানাকেই যদি একটা চিহ্নায়ক হিসেবে পড়ি তবে যে ‘চিহ্নায়িত’-এর মুখোমুখি হব তাতে দেখব এগুলো বিচ্ছিন্ন ভাবে ভাষার নানা প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রবন্ধের সংকলন। তার মধ্যে প্রথমটির প্রথম প্রবন্ধের নামই ‘ভাষাবিজ্ঞান এবং মার্ক্সবাদ’।যেখানে তিনি মার্ক্সবাদের প্রতিষ্ঠাতারা কবে কোথায় ভাষা প্রসঙ্গে কী সব বলেছেন,লিখেছেন সেই সব তথ্যের সঙ্গে স্তালিনের ‘মার্ক্সবাদ এবং ভাষাবিজ্ঞানের সমস্যা’ বইটির ঐতিহাসিক গুরুত্বের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেন।কিন্তু চমস্কিতত্ত্ব নিয়ে ‘রবীন্দ্রভারতী’র সেই প্রবন্ধটি না থাক সেরকম এমন কিছু নেই,যাতে মনে হতে পারে চমস্কির পদ্ধতিতত্ত্বকে তিনি আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠা দিতে চাইছেন।তাঁর যে গ্রন্থতালিকা এই বইগুলোতে রয়েছে সেখানেও কোনো গ্রন্থনাম পাচ্ছি না,যাতে মনে হতে পারে চমস্কিতত্ত্ব নিয়ে আলাদা কিছু ভাবাতে চাইছেন।তবে এই তিনটি পড়লেও বোঝা যায় তত্ত্বটির সঙ্গে তাঁর পরিচয় আছে,যেমন অন্য আরো বহু তাত্ত্বিক অবস্থানের সঙ্গেও রয়েছে।সেগুলোর আলোকে তিনি ভাষাবিজ্ঞানের কথাগুলো লেখেন খুবই সাধারণ ভাষাতে সাধারণ জিজ্ঞাসুর কথা মাথাতে রেখে।পূর্বপরম্পরার কোনোটিরই উত্তরাধিকার অস্বীকার করবার কোনো প্রয়াস নেই,তা সে ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানেরও না।আবার যেখানেই তাঁর মনে হয়েছে সংস্কৃত বা বিলেতি ধারণার থেকে বেরিয়ে না এলে বাংলা ভাষাকে ঠিক ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না সেখানে বেরিয়েও আসছেন।সেটি করতে গিয়ে কিছু পুরোনো পরিভাষা বা ধারণাকে ধরে রাখছেন,যেমন আমরা আগের অধ্যায়ে লিখেছি তিনি ‘প্রত্যয়’-এর ধারণাকে ত্যাগ করতে প্রস্তুত নন,আবার পুরুষের বদলে পাঁচটি ‘পক্ষ’-এর প্রস্তাব করছেন। তাঁর ‘বানান বিধি’ নিয়ে পূর্বোত্তরে-বাংলাদেশে-পশ্চিমবাংলাতে বহু বাদ বিবাদের কথা আমরা জানি।সেরকম এক বিতর্কে সুজিত চৌধুরীও যোগ দিয়েছিলেন।২৬ সেটি খুবই স্বাভাবিক।কিন্তু তাঁর কোনো প্রবন্ধ বা বই নিয়ে বাংলাতে বা ভারতে কোনো ‘ভাষাযুদ্ধ’-এর অবতারণা হয়েছে বলে শুনিনি।চকস্কির ভাষাতত্ত্ব নিয়ে পশ্চিমে হয়েছিল।তার বিবরণ দিতে গিয়ে ‘The Linguistics Wars’ নিয়ে একখানা বইও লিখে ফেলেছিলেন রাণ্ডি এ্যালেন হ্যারিস।‘বাংলা ব্যাকরণ প্রসঙ্গ’-তে ‘প্রশ্ন ও বাংলা প্রশ্নবাক্যের গঠন’২৭ এবং ‘বাংলা ভাষায় নিষেধাত্মক (negative) উপাদান’২৮ অধ্যায় দু’টিতে এবং অন্যান্য কিছু প্রবন্ধে চমস্কি পদ্ধতির প্রয়োগ করছেন বোঝা যায়।কিন্তু ‘ভাষা প্রেম ভাষাবিরোধ’-এর ‘বাংলা শব্দভাণ্ডার ও সাহিত্য শৈলী:সম্প্রীতির দলিল’-এ২৯ সেরকম কিছু আঁচ করবার উপায় নেই।পড়ে মনে হয় না দরকারও ছিল বলে।এটি একটি চিন্তা-সমৃদ্ধ সমাজভাষাবৈজ্ঞানিক নিবন্ধ বলে দাবি করা যেতে পারে।তিনি হিন্দু মুসলমান সমাজে প্রচলিত শব্দাবলী নিয়ে আলোচনা করেছেন।আমাদের অসমিয়া-বাংলা-সিলেটি শব্দাবলী নিয়ে কাজ করতে এই রূপকল্প কাজে আসতে পারে।কিন্তু এধরণের রচনাও বাংলাভাষাতে দুর্লভ কিছু নয়।অধ্যাপক নিশীথ রঞ্জন দাসের লেখা ‘বরাক উপত্যকার লৌকিক বাংলা ভাষা-প্রথম খণ্ড’ (২০১৪) বইটিতে সিলেটি এবং প্রতিবেশী ভাষার শব্দাবলী নিয়ে বেশ সমৃদ্ধ আলোচনা রয়েছে।এমনটাও সম্ভব আমরা ভুলপথেই অনুসন্ধান করছি।রামেশ্বর শ’-এর যে রূপকল্প ধরে আমরা গোটা সন্দর্ভটি দাঁড় করাচ্ছি,তার সঙ্গে খাপ খায় সেরকম কিছুর সন্ধান করছি।সেরকম কিছু নেই।ফলে আমাদের কাছে যেটি গুরুতর সমস্যা থেকে গেল সেটি হল --- শব্দার্থ এবং বাক্যতত্ত্ব নিয়ে আমাদের পথ প্রায় অন্ধকারেই চলতে হচ্ছে।
ভাষাবিজ্ঞানের বিলেতি,মার্কিন,জার্মান,চেক,রুশি,ডেনিয়,ফরাসী এত বিচিত্র স্কুল এবং মতভেদ যে সবক’টিকে কিংবা যথেচ্ছ একটি স্কুলকে বেছে নিয়ে তাকে অনুসরণ করে কাজ শুধু ইউরোকেন্দ্রিক মোহে আচ্ছন্ন হলেই করাটা সম্ভব।সবক’টি স্কুল কিংবা তাদের সব সিদ্ধান্ত সর্বজনীন বিজ্ঞানের মর্যাদা পেতেও পারে না।কোনটিকে অনুসরণ করা উচিত এবং কোনটিকে বর্জন--- সেটি নিজেও এক তুলনামূলক অধ্যয়ন পরবর্তী সিদ্ধান্ত হতে পারে।যা বর্তমান পরিসরে দুরূহ কাজ।ফলে আমরাও ভেবে নিয়েছি,আমাদের যথাপ্রাপ্ত বাস্তবতাকে ধরে এগোনোই হবে সঠিক পদ্ধতি।
শব্দার্থতত্ত্বকে আমরাও বাদ দিতেই পারতাম।রামেশ্বর শ’ রূপতত্ত্বের পরেই বাক্যতত্ত্বের আলোচনাতে চলে গেছিলেন।কিন্তু বিষয়টিকে একেবারে বাদ তিনিও দেন নি।মেনেও নিয়েছেন,“... ভাষাবিজ্ঞানের একটি অপরিহার্য অঙ্গ হলো শব্দার্থতত্ত্ব বা Semantics.”৩০ তার উপরে ধ্বনিতত্ত্ব-রূপতত্ত্বের আলোচনাতেই আমরা দেখেছি অর্থ এবং বাক্য প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে সেগুলোও আদৌ আলোচনা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনা।সুনীতিকুমার কিংবা বাণীকান্তকেও তাই রূপতত্ত্বের প্রসঙ্গেই বাক্যের গঠনকে ছুঁয়ে যেতে হয়েছিল।তার উপরে রামেশ্বর শ’যদিও বা লিখেছেন,‘শব্দের অর্থ পরিবর্তন অনেকটাই মানবমনের খেয়ালখুশির উপরে নির্ভর করে’---সেই মানবমনকে ব্যক্তিমন বলে মনে হয় না তিনি নিজেও বুঝিয়েছেন।কারণ দুই ব্যক্তি মুখোমুখি না হলে কোনো ভাষার কাজ শুরু হয় না।আজকের সমুন্নত সমাজে একক ব্যক্তি কারো নীরবে চিন্তা করতে,কিংবা নিজের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ভাষার ব্যবহার করতে পারে।কিন্তু সেটি পারে আবাল্য সমাজে বেড়ে উঠে অপরের সঙ্গে কথা বলবার অভ্যাস তাঁর আছে বলেই।এই সম্পর্কে আমরা এক ব্রিটিশ শব্দার্থতাত্ত্বিক ড্যানিয়েল স্যাডলার (Daniel Chandler)-এর কিছু কথা এখানে তুলে দিতে পারি, “Even in the case of the ‘arbitrary’ colours of traffic lights,the original choice of red for ‘stop’ was not entirely arbitrary,since it already carried relevant associations with danger.As Lévi-Strauss noted, the sign is arbitrary a priori but ceases to be arbitrary a posteriori - after the sign has come into historical existence it cannot be arbitrarily changed (Lévi-Strauss 1972, 91). As part of its social use within a code (a term which became fundamental amongst post-Saussurean semioticians),every sign acquires a history and connotations of its own which are familiar to members of the ‘sign-users’ culture.Saussure remarked that although the signifier ‘may seem to be freely chosen’,from the point of view of the linguistic community it is ‘imposed rather than freely chosen’ because ‘a language is always an inheritance from the past’ which its users have ‘no choice but to accept’ (Saussure 1983,71-72;Saussure 1974,71).”৩১ মানুষের উৎপাদন প্রক্রিয়াতে ভাষা বিকশিত হয় এবং নিজেও সক্রিয় ভূমিকা নেয় ঠিক এর জন্যেই যে ভাষা শুধু কিছু চিহ্ন সমষ্টি নয়।তার ‘চিহ্নায়কে’র ভূমিকা রয়েছে এবং সে বস্তুবিশ্বের বিবিধ বস্তু এবং মানবমনের ভাবকে তথা ‘চিহ্নায়িত’-কে ‘চিহ্নিত’ করতে পারে বলেই।সেখান থেকেই তার যে সুবিশাল সামাজিক ভূমিকা তৈরি হয় তাকে মনে হয় না স্তালিনের মতো কেউ ব্যাখ্যা করতে পেরেছেন বলে, “Language, ...,is connected with man’s productive activity directly,and not only with man's productive activity, but with all his other activity in all his spheres of work,from production to the base, and from the base to the superstructure.For this reason language reflects changes in production immediately and directly,without waiting for changes in the base.For this reason the sphere of action of language,which embraces all fields of man's activity,is far broader and more comprehensive than the sphere of action of the superstructure.More,it is practically unlimited.”৩২ যে বিষয়টি মানুষকে পশুর থেকে আলাদা করে এবং যার পরিসর মানুষের সৃষ্ট শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,বিজ্ঞান,দর্শনের চেয়েও বহু বেশি,বস্তুত সীমাহীন এবং যে উৎপাদন ব্যবস্থা তথা সম্পর্কের ছোটখাটো পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে নিজেও ক্রমান্বয়ে পালটে পালটে যাবার ক্ষমতা রাখে,কোনো মৌলিক পরিবর্তনের অপেক্ষা রাখে না---তার নামই ভাষা।অর্থ ছাড়া তার অস্তিত্বই সেখানে কল্পনা করা যায় না,অর্থের ভেতরেই সে ধরে রাখে সমস্ত সমাজের প্রগতি কিংবা অধোগতির কাহিনি – সেই অর্থকে বাদ দিয়ে তো ভাষাবিজ্ঞানের কোনো আলোচনা সম্পূর্ণ হতেই পারে না।সে হোক শব্দের কিংবা বাক্যের অর্থ।বস্তুত এখানেই শুরু হতে পারে ভাষাবিজ্ঞানের আসল চিত্তাকর্ষক অভিযান।এই অর্থকেই ধরে রাখবার যোগ্যতা অর্জন করবে বলেই পালটে পালটে যায় তার বাইরের কাঠামো,ধ্বনিতত্ত্বে বা রূপতত্ত্বে যা আমরা আলোচনা করে এলাম।বাক্যতত্ত্বেও যা হয়তো আমাদের স্পর্শ করতে হবে।এ হচ্ছে বিষয়টি বেছে নেবার পক্ষে আমাদের তাত্ত্বিক প্রেরণার দিক।আর বাস্তব কারণটি হচ্ছে, সিলেটির সঙ্গে অসমিয়ার মিল দেখাতে গিয়ে ড০ উপেন রাভা হাকাচাম প্রচুর শব্দ তুলে দিয়েছেন।যদিও উপশিরোনামটি তাঁরও নয় ‘শব্দতত্ত্ব’,‘শব্দার্থতত্ত্ব’ বা সেরকম কিছু।নিছক ‘সাদৃশ্যধর্মী শব্দর উদাহরণ’।৩৩ জগন্নাথ চক্রবর্তীর অধ্যায়টির নাম ‘শব্দার্থতত্ত্ব’-ই।৩৪ কিন্তু আলোচনার রূপকল্প সুকুমার সেন বা রামেশ্বর শ’এর থেকে স্বতন্ত্র কিছু নয়।‘শব্দভাণ্ডার’ নামে ঠিক পরেই একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় রয়েছে।সুধাংশু শেখর তুঙ্গের অধ্যায়টির নাম ‘Vocabulary’৩৫,রবীন্দ্র দত্তের অধ্যায়টির নাম যদিও ‘নোয়াখালি ও চট্টগ্রামী উপভাষায় শব্দার্থগত বিভিন্ন দিক’৩৬,দুই ভাষাবৈচিত্র্যের শব্দ এবং তাদের অর্থের দীর্ঘ তালিকা রয়েছে।অর্থাৎ প্রত্যেকেই নিজের মতো করে শব্দের বিষয়টিকে ছুঁয়ে গেছেন।সুতরাং সেগুলোর তুলনামূলক অধ্যয়ন কিছু নতুন দিকের সন্ধান দিলেও দিতে পারে।ব্যতিক্রম শুধু নিখিলেশ পুরকাইত।তাঁর ‘উপভাষার ভৌগোলিক জরিপ’ বইটিতে প্রতিটি ভাষা বৈচিত্র্যের আলোচনা ধ্বনিতত্ত্ব,রূপতত্ত্বেই শেষ।
সুকুমার সেন আরো লিখেছিলেন,“...শব্দার্থতত্ত্ব বা শব্দার্থপরিবর্তন (Semantics) ভাষাবিজ্ঞানের একটি বিশেষ আলোচ্য বিষয়।তবে শব্দার্থতত্ত্ব ঠিক ব্যাকরণের অঙ্গ নয়।তবে ভাষাবিজ্ঞানের আলোচনায় ইহা আবশ্যিক অনুষঙ্গ।”৩৭বোঝা যায় তিনি ব্যাকরণ বলতে পরম্পরাগত ব্যাকরণের কথা লিখছেন।তখনো ‘সৃজনমূলক ব্যাকরণ’ (generative grammar)-এর সঙ্গে ভাষাবিজ্ঞানের আলাপ হয় নি।তিনি ছিলেন ভাষা এবং সাহিত্যের ঐতিহাসিক। এবং সেদিক থেকে শব্দার্থতত্ত্বের গুরুত্বটি সঠিক ভাবেই লিখেছেন,“সুদূর প্রাচীন কাল,যাহার চিহ্নমাত্র এমন কি হাড়ের টুকরো কিংবা ইটের খণ্ডটুকুও বিদ্যমান নাই,সেকালের এক আধটু ইতিহাসের আভাস শব্দার্থতত্ত্বের সাহায্যেই পাওয়া যায়।”৩৮তিনি আরো লেখেন,“সুদূর অতীত ইতিহাসের জীর্ণোদ্ধারেই নয় বর্তমান কালের প্রাত্যহিক ব্যবহারেও শব্দার্থতত্ত্বের প্রয়োজনীয়তা প্রকট।সাহিত্য সভ্য মানুষের মনের খাদ্যভাণ্ডার।সাহিত্যের প্রধান কাজ বাকশিল্প সৃষ্টি।সে সৃষ্টির প্রাণ হইল অলঙ্কার।অলঙ্কার শব্দার্থেরই বিষয়।”৩৯ এবং সেই সাহিত্য করতে গেলেও শুধু অভিধানের শব্দ সংগ্রহে কাজ চলে না।“মাতৃভাষায় শব্দ সাধারণত অভিধান হইতে সংগৃহীত হয় না...বিদেশী ভাষা শিক্ষাতেও শুধু অভিধানের উপরে নির্ভর করা চলে না, ...”৪০ প্রাচীন বা অধুনা অপ্রচলিত ভাষা শিখতে গেলে অভিধান ছাড়া উপায় না থাকতে পারে,কিন্তু“কানে শুনিয়াই মাতৃভাষা এবং ভালো করিয়া শিখিতে গেলে যে-কোনো কথ্যভাষা শিখিতে হয়।এই রূপ কানে যে শব্দ শিখি তাহার অধিকাংশের অর্থ সমগ্র বাক্যের তাৎপর্য হইতে নিষ্কালিত হয়,কেহ বলিয়া দেয় না।একই শব্দ বিভিন্ন বাক্যে ব্যবহৃত হইয়া যে সব অর্থ জ্ঞাপন করে,ভাষা ব্যবহারকারীর মনে সেই শব্দের সঙ্গে সেই সেই অর্থ সমষ্টির অচ্ছেদ্য জোড় লাগিয়া যায়।”৪১‘কেহ বলিয়া দেয় না’ কথাটি তো সঠিক হতে পারে না।নিশ্চয় মানুষের কোনো অপ্রাকৃতিক ক্ষমতা নেই।শব্দের গঠন এবং অর্থের সম্পর্কটি যে দ্বান্দ্বিক সেই কথা অস্বীকার করবার জো নেই।দৃশ্যত যদিও গঠন মাত্ররই একটি অর্থ থাকে,সেই কাঠামোই অর্থকে নিয়ন্ত্রণ করে না বলে,একই কাঠামোর একাধিক অর্থ থাকে।এবং স্থানে কালে কখনো বা আদি অর্থটি বেমালুম পালটে যায়।যেমন অধুনা জনপ্রিয় শব্দ ‘মোবাইল’ (mobile) মূলে ইংরেজি।কিন্তু এখন বাংলা সহ যেকোনো ভারতীয় ভাষার জনপ্রিয় শব্দ।যে কেউ জিজ্ঞেস করলেই বলবেন,এর অর্থ ‘হাতের মুঠোতে ঘুরে বেড়ানো দূরভাষ’।অথচ অভিধানে এর প্রধান অর্থটি পাওয়া যাবে এরকম ‘Able to move or be moved freely or easily’।অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে অন্য বহু অর্থের সঙ্গে এই অর্থও রয়েছে,‘(Of a military or police unit) equipped and prepared to move quickly to any place it is needed।’ঠিক এই অর্থেই দুই দশক আগেও আসামের জনজীবন ‘মোবাইল’ কথাটার সঙ্গে পরিচিত ছিল।অন্যথা কতজনই বা ইংরেজি শব্দটির মূল অর্থটির মানে জানতেন।রেলে চড়ে যদি কেউ বললেন যে,‘আজ মোবাইল আছে।’—নিরক্ষর যাত্রীটিও বুঝে যেতেন,সেদিন বিনা টিকিটে যাত্রীদের বিপদ আছে।রেলের বাইরে বাক্যটি কেউ বলবেনই না। কিন্তু এখন যেখানে সেখানে এই বাক্য শুনতে পেলে কেউ এর অর্থ করে নেবেন,হয় বলা হচ্ছে ‘আজ মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করছে।কথা বলা যাবে।’ অথবা ‘যে ব্যক্তিটি বলছেন,তিনি রোজ মোবাইল সঙ্গে রাখেন না,আজ রেখেছেন।সুতরাং তাঁর সঙ্গে কথা বলা যাবে।’তাঁর মানে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে,অর্থের উপরে একটি নির্দিষ্ট গঠনের বিশেষ কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই,অর্থ ঠিক করছে সে কোন গঠনকে বেছে নেবে।আর সেই অর্থবৈচিত্র্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে আর্থসামাজিক বিকাশের বাস্তবতা তথা তার স্থান-কাল।স্থান-কাল ভেদে একই অর্থ বিভিন্ন গঠন বেছে নিতে পারে।যেমন বাংলাতে মোটা দাগে একই সময়ে তৎসম অর্ধ-তৎসম-তদ্ভব এই তিন রূপেই ‘কৃষ্ণ-কেষ্ট-কালা’ শব্দগুলো প্রচলিত রয়েছে।লক্ষ করলে দেখা যাবে,সেই গঠনগুলোরও সূক্ষ্ম স্থান-কাল ভেদ রয়েছে।অর্থাৎ একই পরিবেশে এই তিন শব্দের ব্যবহার আমাদের মতো কোনো তাত্ত্বিক অধ্যয়ন ছাড়া সাধারণ সংলাপে ব্যবহারের সম্ভাবনা খুবই কম।শব্দগুলোর মধ্যে সূক্ষ্ম হলেও অর্থভেদও রয়েছে।‘কৃষ্ণ’ কথাটার সঙ্গে যে গাম্ভীর্য আর শ্রদ্ধাবোধ জড়িয়ে থাকে,‘কেষ্ট’ কথাটার সঙ্গে ঠিক তার বিপরীতে একটি অবজ্ঞার ভাব।‘কালা’ কথাটির সঙ্গে যেন নিজের সগোত্রীয় আপনার জন হিসেবে বোঝাবার একটা চেষ্টা রয়েছে।সেই চেষ্টা বা ইচ্ছেই ব্যক্তিকে আগাম সংকেত প্রদান করে ঠিক কোন শব্দটি সে বেছে নেবে।কাঙ্ক্ষিত অর্থটি না বোঝাতে পারলে ব্যক্তি বিকল্প শব্দ বা শব্দগুলো ব্যবহার করবে,যাকে ‘প্রতিশব্দ’ বলে।অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট ধ্বনিকাঠামোতে ব্যক্তি নিজেকে আটকে রাখবে না।তাই সুকুমার সেন এক জায়গাতে সঠিক লিখেছিলেন,“শব্দার্থ ধ্বনিপরিবর্তন-নিরপেক্ষ,একথা সত্য।তবে ধ্বনিপরিবর্তন সব সময় শব্দার্থ পরিবর্তন-নিরপেক্ষ নাও হইতে পারে।”৪২ এই কথার মানে এরকম,শব্দের অর্থ পরিবর্তনের জন্যে ধ্বনির পরিবর্তন হতেও পারে,নাও হতে পারে।একই গঠন বিভিন্ন অর্থ বহন করবার ক্ষমতা রাখে।কিন্তু ধ্বনি পরিবর্তিত হলে এক নির্দিষ্ট ভাষাতে অর্থের পরিবর্তন হওয়াই সম্ভব।তিনি অবশ্য বাংলা ‘ভোগ’ আর ‘ভুগ’ শব্দের গঠন এবং অর্থভেদের নজির দিয়েছিলেন।আমরা ‘মোবাইল’ নিয়ে কথা বলছিলাম।সেটির থেকেই আরেকটি ইংরেজি এবং ভারতীয় ভাষাগুলোতে সুপরিচিত শব্দ ‘মব̖’ (mob)-এর কথা পাড়তে পারি।সেটিও mobile শব্দটিকে বিগড়েই তৈরি করা।কিন্তু লাতিনে যখন শব্দটি তৈরি হচ্ছিল---‘mobile telephone’-এর মতো সেও ছিল আদতে একটি শব্দজোড় ‘mōbile vulgus’।মূলে সম্ভবত প্রথম শব্দটি ‘mobilis’-ও ছিল।অর্থ ‘সাধারণ মানুষ’।ইউরোপে ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের সময় ষোড়শ শতকের ফরাসী রোমান ক্যাথলিক ধর্মযাজক উইলিয়াম ওয়াটসন কথাটির যখন ব্যবহার করেন,তখন এর একটি রাজনৈতিক মতাদর্শগত অর্থও দাঁড়িয়েছিল,‘সংখ্যাগুরুবাদ’।কিন্তু এখন কথাটি ‘আক্রামক ভিড়’-কে বোঝায়।শব্দটি থেকে গেছে,ধর্ম সংস্কারের পশ্চিমা বাস্তবতা নেই।এখনকার বাস্তবতা তাকে যে অর্থ দিয়েছে, শব্দটি তাকেই প্রধান করে ধরে রেখেছে।কিন্তু ‘সাধারণ মানুষ’ বা ‘সংখ্যাগুরুবাদ’-এর আদি অর্থের সঙ্গে দূরগামী হলেও একটি সম্পর্ক যেন ‘মব̖’ শব্দে এখনো অন্তর্লীন।সুতরাং এক ‘মাথা’ শব্দ বিভিন্ন বাক্যে ব্যবহার করে এর বিভিন্ন অর্থের উল্লেখ করে যখন সুকুমার সেন ‘অর্থ’-এর মুখ্য-গৌণ দুই ভাগের কথা উল্লেখ করেছিলেন,তখন সেই বিভাজনের কথা যে বিশেষ এক স্থানে-কালে হচ্ছে,সেই কথাটি মনে রাখা উচিত।সেই কাল মুহূর্তে পালটে যেতে পারে।যেমন,এই সংলাপে।
১ম বক্তা: আমরা বাসে করে যাচ্ছি,তোমরা পরে গাড়ি করে চলে এসো।
২য় বক্তা: সামান্য দাঁড়াও।যাবই যখন আমরা সবাই বাসেই যাই।
এই দুই বাক্যের ‘আমরা’ কথাটির অর্থ কিন্তু এক নয়।১ম বক্তা দ্বিতীয় বক্তা এবং আরো অনেককে বাদ দিয়ে যে সর্বনামের ব্যবহার করেছেন,২য় বক্তা তার বিপরীতে ১ম বক্তা এবং তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে একই সর্বনামের ব্যবহার করেছেন।তেমনি একটি শব্দের অর্থ পাল্টাতে কয়েক শতকও লাগতে পারে।‘হিন্দু’ শব্দের অর্থ নিয়ে গেল দেড় শতক জুড়ে সম্ভবত ভারতীয় সব ভাষাতেই বিতর্কের অন্ত নেই।যেমন নেই ‘অসমিয়া’ শব্দের অর্থ নিয়েও।অতি সম্প্রতি ‘অসমিয়া’-র অর্থ স্থির করবার জন্যে বিধান সভার অধ্যক্ষকেও উদ্যোগী হয়ে সভাসমিতি করতে দেখা গিয়েছিল।তবু, হয়তো আজকের ভারতে যে কোনো বাঙালি বা অসমিয়া বলবেন,যে ‘হিন্দু’ শব্দের মুখ্য অর্থ একটি ধর্ম সম্প্রদায়,গৌণ অর্থ ‘ভারতীয়’।এককালে সেই গৌণ অর্থটিই যে প্রধান ছিল সেই নিয়েও মনে হয় না কোনো তর্ক উঠবে।কিন্তু উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী পার্শি কবি হাফিজের একটি পঙক্তি তুলে দিয়েছেন,এরকম,“বখালে হিন্দ মি বখশম,সমরকন্দও বোখারারা।”৪৩ ‘-উ’ যোগ করে ‘হিন্দু’ শব্দটি সম্ভবত পার্শিতে তখনও দেখা দেয় নি,দেশ (সিন্ধু উপত্যকা) এবং দেশের মানুষ---দুই অর্থেই ‘হিন্দ̖’ বোঝানো হয়ে থাকবে।সায়েরিটির অর্থ --- তাঁর গালের কালো তিলটির জন্যে আমি সমরখন্দ,বোখারাও দান করে দিতে পারি।‘হিন্দ’ কথাটার অর্থ উপেন্দ্রনাথ লিখছেন ‘ক’লা তিল’।কেন? কারণ,“সিন্ধু নদীর পারত বাস করা লোক সকল আপেক্ষিকভাবে ক’লা হোয়া কারণে হিন্দু শব্দই ক’লা অর্থও প্রকাশ করিছিল।”৪৪এই তথ্য তিনি ভাষাতাত্ত্বিক আই জে এস তারাপুরওয়ালার থেকে পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন।আরো লিখেছেন,“প্রথম অবস্থাত মুছলমান বিজেতাসকলে ভারতীয় মানুহক দাসরূপে বেচিবলৈ লৈ যোৱা হেতুকে হিন্দু- শব্দ ‘দাস’র অর্থতো ব্যবহার হৈছিল।”৪৫ অনুমান করা যেতেই পারে যে বিশ শতকের ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক পরিবেশের চাপে,এমনও যে একটি অর্থ এককালে ছিল শব্দটির সেই তথ্য বিদ্যায়তনিক ক্ষেত্রতেও বেমালুম চেপে যাওয়া হয়েছে।
স্থান-কালের বদলের সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন ধ্বনিকাঠামোর শব্দের সমরূপ দাঁড়িয়ে গেলে সেরকম শব্দ একটি ভাষাতে খুব বেশি থাকে না বলে সুকুমার সেন লিখেছেন।তাতে ভাবপ্রকাশে অসুবিধে হয়।এদের মধ্যে কম ব্যবহৃত কোনো শব্দ লোপ পায়,নতুবা পরসর্গাদি যোগ করে রূপটি পালটে ফেলা হয়।তিনি সংস্কৃত ‘গত,গদ,গজ’ শব্দের নজির দিয়েছেন। তিনটিই প্রাকৃতে দাঁড়িয়েছিল ‘গঅ’।এদের মধ্যে ক্রিয়াপদ বলে প্রথমটির ব্যবহার বেশি ছিল বলে “... ইহাতে ‘ইল্ল’ প্রত্যয় যোগ করিয়া ‘গইল্ল’ রূপ দেওয়া হইয়াছিল।”৪৬সামাজিক মন কাঙ্ক্ষিত অর্থ বহনে সক্ষম ধ্বনিকাঠামো গড়ে তুলবার এটি একটি ভালো নজির--যা সুকুমার সেন দিয়েছেন।অর্থাৎ ভাবপ্রকাশ বা অর্থই হচ্ছে শব্দের মূল ভিত্তি।সেটিই যখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে তখন প্রচুর শব্দ ভাষার থেকে বিদেয়ও নেয়।তথা লোপ পায়।আবার প্রচুর নতুন শব্দ অন্যভাষার থেকেও আসে,বা ভাষাতে তৈরি হয়।যেমন ধরা যাক,প্রশাসনিক,বাণিজ্যিক এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠার ভাষা ইংরেজি বাংলা ‘মামা-কাকা,মাসি-পিসি,ফুলদা,মেজদা,ন’দা’,অসমিয়া ‘মামা-খুৰা,খুৰাদেউ,জেঠাই,মাহী,পেহী,মহাদেউ, পেহাদেউ’ ইত্যাদি শব্দকে প্রতিস্থাপন করে ফেলছে ‘Uncle-Aunty’দিয়ে।শুধু ইংরেজির জনপ্রিয়তার ফলেই এসব হচ্ছে না।সেই সঙ্গে বাস্তবে পুরোনো একান্নবর্তী পরিবারগুলোও ভেঙে পড়ছে।ছোট্ট পরিবারে একজন দাদা থাকাই যেখানে যথেষ্ট সেখানে ‘ফুলদা,ন’দা’-দের দরকারই পড়ছে না।দীর্ঘদিন গিয়ে মামার বাড়ি ছুটি কাটানোও হচ্ছে না।তাই এখন প্রতিবেশী মামা-ই ‘uncle’,প্রতিবেশী পিসিই ‘aunty’।সেই প্রতিবেশীও খুব স্থায়ী কেউ নন।কোনো একপক্ষের বাসা বদলে অচিরেই নতুন ‘uncle- aunty’তাদের প্রতিস্থাপিত করছেন।সুতরাং সমস্যা হচ্ছে না।অন্য দিকে ‘সহস্র’ শব্দটিকে এককালে রাজভাষা হবার সুবাদে পার্শির ‘হাজার’ শব্দটি অনেকটাই প্রতিস্থাপিত করে ফেলেছিল।সম্ভবত এর একটি কারণ ছিল রাজার দেয়া উপাধি ‘হাজারি’,এবং আনুষঙ্গিক ব্যবহার বৈচিত্র্যের জন্যে।কিন্তু ইংরেজি ‘thousand’-এর সেরকম কোনো বাড়তি সামাজিক ব্যবহার বেশি নেই।অতি সম্প্রতি শুধু ‘হাজার টাকার নোট’-এর চলন বেড়েছে। তাই ‘হাজার’ শব্দটি থেকে গেছে। অন্যদিকে ‘শত/শ’,‘লক্ষ/লাখ’অসমিয়া ‘শ’ ইত্যাদি শব্দ তার তৎসম-তদ্ভব রূপে এখনো আছে।আহোম রাজারা রাজকীয় আধিকারিকদের ‘শইকীয়া’ উপাধি দিতেন,সেই অধিকার না থাকলেও বংশ উপাধি হিসেবে শব্দটি এখনো আছে।রাজারা এক হাজার পাইকের প্রধান রাজকর্মচারীকে ‘হাজৰিকা’ উপাধি দিয়েছিলেন।এক হাজার পদ নিয়ে মাধবদেবের একটি কাব্যগ্রন্থের নাম ‘হেজাৰী-ঘোষা’।ফলে অসমিয়াতেও সংখ্যা শব্দ ‘হেজাৰ’ থেকে গেছে।এবং থেকে যাবার একটি কালিক এবং কালানুক্রমিক বাস্তব সামাজিক ভিত্তির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। তেমনি ‘পালকি’ এখন সিনেমার বাইরে দেখবার উপায় নেই,‘রথে’ করে শুধু জগন্নাথই বছরে একবার শুধু পাড়া বেড়ান। রাজা বাদসারা চড়েন না।অন্যদিকে ‘বেতার’ বিশ শতকে প্রচলিত হতে হতে একুশ শতকে এসে ভাষা থেকে প্রায় বিদেয় নিয়েছে বললেই চলে।কিন্তু বাস্তবে ‘হাতঘড়ি’ আছে বলেই ইংরেজি ‘wristwatch’-এর অনুবাদে বাংলাতে নতুন সৃষ্ট শব্দটি এখনো আছে।ভাষাবিদেরা অর্থপরিবর্তনের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই সবের অনেক কিছুই উল্লেখ করলেও, আমরা দেখব,অর্থান্তরের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই সব কথা আলোচনাতে আনছেন না।
রামেশ্বর শ’ অর্থপরিবর্তনের কারণগুলোকে প্রথমত স্থূল এবং সূক্ষ্ম এই দুইভাগে ভাগ করেছেন।স্থূল কারণগুলোকে আবার তিনভাগে ভাগ করেছেন -- ক) ভৌগোলিক, খ) ঐতিহাসিক, গ) উপকরণগত।তেমনি সূক্ষ্ম কারণগুলোকে নানা উপভাগে ভাগ করেছেন -- ক) সাদৃশ্য, খ) মানসিক বিশ্বাস ও ধর্মীয় সংস্কার, গ) শৈথিল্য ও আরামপ্রিয়তা, ঘ)আলঙ্করিক প্রয়োগ ইত্যাদি।৪৭ আমরা একে একে দেখছি কে বিষয়টিকে কী ভাবে ব্যাখ্যা করছেন।
অর্থপরিবর্তনের স্থূল কারণ:
ভৌগোলিক কারণ: একই শব্দ ভিন্ন ভৌগোলিক পরিবেশে ভিন্ন অর্থ বহন করে।রামেশ্বর শ’ মনে করেন, ‘অভিমান’ শব্দটি বাংলার স্নিগ্ধ শ্যামল কোমল প্রকৃতিতে যে অর্থ বহন করে তাতে কোমল ‘স্নেহ-মিশ্রিত অনুযোগে’র ভাব আছে।কিন্তু পশ্চিম ভারতের শুষ্ক কঠিন কঠোর প্রকৃতিতে বোঝায় ‘অহংকার।’
ঐতিহাসিক কারণ: ‘আর্য’ শব্দটি এসেছে √ঋ (অর̖) থেকে।এর মানে ‘গমন করা।’ √ঋ + ন্যৎ= আর্য মানে ‘গমনধর্মী।’ ভারতে আসবার আগে আর্যরা স্থায়ী কৃষি রপ্ত করে এক জায়গাতে স্থায়ী বসবাস রপ্ত করে নি।এক জায়গা থেকে অন্যত্র ঘুরে বেড়াত,তাই এই নাম।সহজ করে বললে গতিশীল বা যাযাবর গোষ্ঠী।পরে স্থায়ীভাবে বসবাস রপ্ত করলেও মূল শব্দ ‘আর্য’ থেকে যায়,কিন্তু অর্থ দাঁড়ায় একটি বিশেষ ভাষা-সংস্কৃতির অধিকারী নৃগোষ্ঠী।এখন ইন্দো-ইউরোপীয় বংশের নৃগোষ্ঠী।‘বিবাহ’ কথাটির মূল অর্থ ছিল বিশেষ করে বহন করা।পুরুষেরা সেই ভাবেই হরণ করে ঘোড়ার পিঠে বয়ে মেয়ে নিয়ে চলে যেত।এখন সেরকম মেয়ে বা কনে বয়ে নিয়ে যাবার প্রথা নেই।শব্দটি থেকে গেছে।বর স্ত্রী-র বাড়িতে বাস করলেও যে অনুষ্ঠানে তাদের সম্পর্কটি সামাজিক স্বীকৃতি পায় সেই ‘পরিণয় অনুষ্ঠান’-এর অর্থেই বাংলাতেও শব্দটি প্রচলিত রয়েছে।অনুষ্ঠানের পবিত্রতা রক্ষার যেখানে দরকার নেই,আগে বা পরে অনুষ্ঠানটির প্রসঙ্গে কথা উঠলে বরং শব্দটির তদ্ভব রূপ ‘বিয়ে’,অসমিয়া-সিলেটি বা পুব বাংলার অন্যান্য ভাষাবৈচিত্র্যে ‘বিয়া’ কথাটিই বেশি ব্যবহৃত হয়।
উপকরণগত: বহু সময় কোনো বস্তু যে উপকরণে তৈরি হয় শুরুতে সেই উপকরণের নাম বা ধর্ম অনুসারে বস্তুটির নাম পড়ে।পরে সেই উপকরণ বা ধর্ম পালটে গেলেও বস্তুর নামটি থেকেই যায়।অর্থাৎ নতুন বস্তুটির নামে বা ধর্মে আর পুরোনো উপকরণ খোঁজে ফিরলে মেলে না।যেমন আগে কালো তরলে লেখার কালি তৈরি হতো বলে এমন নাম ছিল। এখন তার রং নীল,সবুজ যাই হোক লেখার তরলের নাম কালিই থেকে গেল।তেমনি ইংরেজি ‘পেপার’ বললে এখন কাগজ বোঝায়,এখন সেটি বাঁশের মণ্ডে তৈরি হয়।কিন্তু এককালে মিশরে প্যাপিরাস গাছের ছালে কাগজ তৈরি হতো বলে ‘পেপার’ নাম পড়ে যায়।‘পলিথিন’ আসলে একটি রাসায়নিক যৌগের নাম।এর রাসায়নিক সূত্র এরকম (C2H4)n। এতে আজকাল থলে ছাড়াও বোতল,পাইপ,যন্ত্রানুসঙ্গ ইত্যাদি অনেককিছুই তৈরি হয়।কিন্তু থলেটাই এত বেশি লোকের ব্যবহারে আসে যে পলিথিন বললে বাংলা-অসমিয়া প্রায় সব ভারতীয় ভাষাতেই এখন প্লাস্টিকে তৈরি হালকা থলেকে বোঝায়।
আমাদের কাছে এগুলো স্পষ্টতই উৎপাদন পদ্ধতির বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে হচ্ছে।এমনিতেও অর্থপরিবর্তনের ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক কারণের উল্লেখের পরে ‘উপকরণগত’ কথাটি সঙ্গত মনে হয় না।বরং উৎপাদন পদ্ধতির বিকাশ তথা অর্থনৈতিক কারকের কথা স্বীকার করে নিলে, আমরা এই ধরণের শব্দ ছাড়াও ‘মোবাইল’, ‘বিশ্বায়ন’, ‘মুক্তবাজার’, ‘পরিবেশ দূষণ’ এমন বহু শব্দের ভাষায় প্রবেশ এবং অর্থান্তরের কারণ ব্যাখ্যা করে উঠতে পারব।তেমনি ‘সংসদ̖’ (</=সংসৎ) শব্দের অর্থ ঋগ্বেদে ছিল ‘গৃহ’।৪৮ স্ত্রী লিঙ্গের শব্দ।পরে সামাজিক বর্গ বোঝাতেও শব্দটি ব্যবহৃত হলেও,এখন এর মুখ্য অর্থ দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।ফার্সি শব্দ ‘সরকার’ যখন বাংলাভাষাতে প্রবেশ করে তখন ব্যক্তি রাজা,জমিদার অর্থের ব্যবহৃত হত।এখন নির্বাচিত বা অনির্বাচিত একাধিক ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীকে বোঝায়।আবার বহু একেবারেই নিঃস্ব প্রজার উপাধিও বোঝায়।এই সব অর্থান্তরের কারক শুধুই ‘ঐতিহাসিক’ বলাটা কি যথেষ্ট?রাজনৈতিক কারকের উল্লেখ কি স্বতন্ত্র ভাবে করবার অপেক্ষা রাখে না?
এইখানে একটি কথার উল্লেখ থাকা ভালো।উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী অর্থপরিবর্তনের কারণের কোনো স্থূল সূক্ষ্ম বিভাজন করেন নি।শব্দার্থতত্ত্ব নিয়ে তাঁর আলোচনার রূপকল্পটি সামান্য অন্যরকম।তিনি ক্রমান্বয়ে শব্দার্থের পরিবর্তন, শব্দের লোপ এবং নতুন শব্দের সৃষ্টির বৈচিত্র্য নিয়ে আলোচনা করে গেছেন।তাতে যে খুব একটা জটিলতামুক্তি ঘটেছে-- এমনটা আমাদের মনে হয় নি।কিন্তু আমরা যে স্থূল কারণ তিনটির আলোচনা করে এলাম,তিনি এগুলোকে একত্রে ‘পরিবেশ পরিবর্তন’ উপবিভাজনে আলোচনা করেছেন।এবং ‘পরিবেশ পরিবর্তনে’র মধ্যে তিনি স্থান পরিবর্তন সহ ‘সমাজ- ব্যবস্থার পরিবর্তন,সমাজর ভৌতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন’-কেও হিসেবে রাখছেন।৪৯ ফলে অনেক গুলো তালপাতা গেঁথে রাখা ‘গ্রন্থ’ কীভাবে কাগজে ছাপা একটি মাত্র ‘বই’-এর অর্থকেও বহন করছে,কিংবা ঘরের দিদি ‘বাইদেও’ কীভাবে স্কুলের শিক্ষিকা ‘বাইদেও’ হচ্ছেন--- সবই একত্রে ব্যাখ্যা করতে পারছেন।যদিও পরে যখন ‘ছিয়াহী’ শব্দে কালো কালি,কিন্তু এখন সব রঙের কালিকে বোঝায় ---এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘শব্দার্থর এটা তত্ত্বপ্রমুখতা’ উপবিভাজনের আশ্রয় নিচ্ছেন,তখন আবার সব জটিল হয়ে পড়ে।এর মধ্যে তিনি কংগ্রেসি অর্থে ‘গান্ধী-টুপী’,পুলিশ অর্থে ‘ৰঙা-টুপী’ এগুলোকেও ধরছেন।৫০কিন্তু এগুলোর তো ঐতিহাসিক ব্যবহার ছিল।এককালের পুলিশ কনেস্টবল মাত্রেরই টুপি ছিল লাল। আর গান্ধি প্রথম জীবনে সেরকম সাদাটুপি পরেছিলেন।
অর্থ পরিবর্তনের সূক্ষ্ম কারণ:
সাদৃশ্য: বৈদিক ভাষাতে ‘রোদসী’ শব্দের মানে ছিল স্বর্গ-মর্ত্য দুই জগৎ,তার থেকে আকাশ বা অন্তরীক্ষ।‘ক্রন্দসী’ শব্দের অর্থ ছিল ‘গর্জনকারী প্রতিদ্বন্দ্বী দুই সৈন্য’।দুই শব্দের ধ্বনিগত মিল দেখে রবীন্দ্রনাথ ‘ক্রন্দসী’ শব্দ ব্যবহার করেছিলেন ‘আকাশ’ অর্থেই।আবার ‘ক্রন্দন’ > কান্না অর্থেও ব্যক্তির বিশেষণ তথা বিশেষ্য বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন ‘ক্রন্দসী’।যেমন—‘ক্রন্দসী কাঁদিয়া ওঠে বহ্নিভরা মেঘে/আলোকের তীব্রচ্ছটা বিচ্ছুরিয়া উঠে বর্ণস্রোতে/ধাবমান অন্ধকার হতে’(বলাকা:০৮) “একটা জগৎজোড়া কলক্রন্দন শুনতে পাচ্ছি বটে,সেই ক্রন্দন ভরিয়ে তুলছে অন্তরীক্ষকে, যে-অন্তরীক্ষের উপর বিশ্বরচনার ভূমিকা,যে-অন্তরীক্ষকে বৈদিক ভারত নাম দিয়েছে ক্রন্দসী।এ কিন্তু শ্রান্তিভারাতুর পরাভবের ক্রন্দন নয়।এ নবজাত শিশুর ক্রন্দন,যে-শিশু ঊর্ধ্বস্বরে বিশ্বদ্বারে আপন অস্তিত্ব ঘোষণা করে তার প্রথমক্রন্দিত নিশ্বাসেই জানায়,“অয়মহং ভো।” (জাভা যাত্রীর পত্র:০২)তেমনি মানুষের গায়ের ‘তিল’ কথাটি এসেছে তেল হয় যে ‘তিলে’ সেই শস্যের আকার এবং রঙের সঙ্গে সাদৃশ্য দেখে।সিলেটিতে ‘গাইয়াড়ি’ মানে মাটিতে তৈরি নিচে ছিদ্রযুক্ত হাড়ি যাতে সেদ্ধ পিঠে তৈরি হয়।হাড়িটি ভারি হয়।ফলে নাড়তে চাড়তে সাবধানে ধীরে ধীরে করতে হয়।মূলত নারীরাই ব্যবহার করেন।সেই থেকে যে নারী ধীরে ধীরে নড়েন চড়েন কাজ করেন,তাদেরকেও ‘গাইয়াড়ি’ বলা হয়।জগন্নাথ চক্রবর্তী শব্দের মুখ্য-গৌণ অর্থ দেখাতে গিয়ে সেরকম বেশ কিছু সিলেটি শব্দের নজির দিয়েছেন।৫১
ধর্মীয় বা সামাজিক সংস্কার: সাধারণ লোকের ধারণা -- অশুভ বিষয় বা বস্তুর নাম করতে নেই।ফলে কোনো বস্তুর শুভ বা শোভন নাম দিয়ে দেয়া হয়।একে সুভাষণ বলে।যেমন ---মৃত্যু না বলে লোকে বলে ‘গঙ্গা লাভ করা’, ‘পরলোকে গমন করা’,মৃত্যুতে দেহের নাশকে বলে ‘দেহরক্ষা করা’ ইত্যাদি।তেমনি সাপকে বলে ‘লতা’।বহু সন্তানের মা-বাবা বহু সময় শেষ মেয়ে সন্তানের নাম রাখেন ‘আর সন্তান দিও না মা কালী’ অর্থ বোঝাতে ‘আন্নাকালি’ ইত্যাদি। এখনো বহু সংক্রামক রোগের নাম নেয় না লোকে।বসন্তকে বলেন ‘মা শীতলার দয়া’,তেমনি অসমিয়াতে বলেন ‘আইসকল আহিলে’ বা ‘আই ওলাল।’
শৈথিল্য ও আরামপ্রিয়তা: উচ্চারণ শৈথিল্যের বশে পুরো শব্দ বা শব্দগুচ্ছ ব্যবহার না করে আমরা তার অংশ দিয়ে কাজ চালিয়ে নিই।যেমন –সন্ধ্যার সময় ঠাকুরের সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ দেয়া অর্থে ‘সন্ধ্যা দেয়া’,চা-এর সঙ্গে জলখাবারের কথা স্পষ্ট করে না বলে ‘চা-টা’ দিয়ে কাজ চালানো,‘টা’ মানে জলখাবার।
আলঙ্করিক প্রয়োগ: আলঙ্করিক অর্থে শুরুতে একটি শব্দ ব্যবহৃত হতে থাকলে কালে সেই আলঙ্করিক তাৎপর্যটি হারিয়ে গিয়ে গতানুগতিক অর্থই প্রচলিত থেকে যায়।যেমন সন্ধ্যায় ফোটে বলে সন্ধ্যার মণি কল্পনা করে যে ফুলের প্রথমে নাম দেয়া হয়েছিল ‘সন্ধ্যামণি’।এখন এটি এক ফুলের সাধারণ নাম মাত্র।তেমনি,রাতের চারপাশের প্রকৃতিতে নিজের গন্ধ ছড়ায় বহু ফুলই।কিন্তু আদর করে একটিই ফুলের কেউ কখনো নাম রেখেছিল ‘রজনীগন্ধা’।এখন এই নামে সেই বিশেষ ফুলটিকেই বোঝায়,তা সে কোনো কারণে গন্ধ বিশেষ না ছড়ালেও।সেরকমই কিছু শব্দ বা শব্দগুচ্ছ ব্যবসা ডুবে যাওয়া অর্থে ‘গণেশ ওলটানো’,বানিয়ে মিথ্যে বলা অর্থে ‘গুলমারা’ ইত্যাদি।সুকুমার সেন লিখেছেন ‘ছাতা,হাতা, পায়া,মুখা’ ইত্যাদি শব্দও রূপক অলঙ্কারের প্রয়োগে তৈরি।৫২এমন কি বই বা লেখালেখি সংক্রান্ত শব্দাবলী ইংরেজি ‘book, biblos’,বাংলা ‘পত্র,পল্লব,কাণ্ড,স্কন্ধ,সর্গ, কলম’ ইত্যাদিরও কাহিনি একই।
অর্থপরিবর্তনের প্রকৃতি:
অর্থ তিন রকম বা ধারাতে পরিবর্তিত হয়ে থাকে,সেই নিয়ে ভাষাবিদদের মধ্যে মতবিরোধ নেই বললেই চলে। উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীও লিখেছেন,“শব্দর অর্থর এনে পরিবর্তনক তিনিটা ভাগত বিভক্ত করিব পারি।”৫৩নাম ও তিনি একই রেখেছেন,বাংলাতে ভাষাবিদেরা যা ব্যবহার করেন।—১) অর্থবিস্তার বা প্রসার,২) অর্থ সংকোচ,এবং ৩) অর্থসংক্রম বা সংশ্লেষ।
১) অর্থবিস্তার বা প্রসার: প্রথমে কোনো সংকীর্ণ ভাব বা সীমাবদ্ধ বস্তুকে বুঝিয়ে পরে যদি ব্যাপক ভাব বা অধিকতর বস্তুকে বোঝায় তবে সেই প্রক্রিয়াকে বলে অর্থবিস্তার।যেমন সংস্কৃতে ‘বর্ষ’ বলতে শুরুতে একটিই ঋতু ‘বর্ষা’-কে বোঝাত,কিন্তু সংস্কৃতেই এর অর্থের বিস্তার ঘটে পুরো বৎসরকে বোঝাতে শুরু করে।তেমনি সংস্কৃতে ‘পরস্ব:’ বলতে বোঝাত ‘আগামী কালের পরের দিন’।বাংলাতে তার থেকে এলো ‘পরশু’।পরশু গতকালকের আগের দিনকেও বুঝিয়ে থাকে।আমরা এর আগে লেখার ‘কালি’,‘তিল’-এর কথা লিখে এসেছি,সেগুলোও এরকম অর্থবিস্তারেরই নজির।‘গঙ্গা’ শব্দে প্রাচীন ভারতীয় আর্যে এই নামের নদীই বোঝাতো।কিন্তু তার থেকে আসা ‘গাঙ’ শব্দে বাংলা-অসমিয়া-সিলেটিতে সব নদীকেই বোঝায়।যেমন—সুরমা গাঙর পানি।অসমিয়া ‘জোন’ (< জোণহা< জ্যোৎস্না ) শব্দটিকে উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী অর্থবিস্তারের নজির বলে লিখেছেন।কেননা,‘জ্যোৎস্না’-তে চাঁদের কিরণ,ষোলকলার একটি বোঝাতো,অসমিয়াতে ‘জোন’ পুরো চাঁদকেই বোঝায়।৫৪ কিন্তু ‘জ্যোৎস্না’-তো বোঝাচ্ছে না।তার জন্যে স্বতন্ত্র অসমিয়া শব্দ ‘জোনাক’।তাই একে অর্থ সংক্রমের নিদর্শন বলেই মনে হয়।
২) অর্থসংকোচ: অর্থবিস্তারের বিপরীত প্রক্রিয়ার নাম অর্থ সংকোচ।প্রথমে কোনো শব্দের অর্থ যদি একাধিক বস্তুকে বা ব্যাপক ভাবকে বুঝিয়ে পরে কোনো স্থানে কালে যদি তার চেয়ে সংকীর্ণ ভাব,বা অনধিক বস্তুকে বুঝিয়ে থাকে তবে সেই প্রক্রিয়াকে বলে অর্থসংকোচ।যেমন সংস্কৃতে ‘প্রদীপ’ বললে সব রকমের আলোই বোঝাতো।কিন্তু পরে বাংলাতে যখন শব্দটির প্রচলন হলো পেতল বা মাটির তৈরি পাত্রে তেল-সলতে জ্বালিয়ে পাওয়া আলোকে বোঝাতে শুরু করে।আর এখন বৈদ্যুতিক আলোর যুগে প্রদীপ বললে,ঠাকুর ঘরের আলোকে বোঝানো হয়ে থাকে,যাতে বিদ্যুতের ব্যবহার হয় না।এক কালে ‘মৃগ’ বলতে সব পশুকেই বোঝাত।সংস্কৃতে তাই ‘মৃগেন্দ্র’ মানে পশুর রাজা সিংহ।৫৫ কালে সংস্কৃতেই এটি শুধু ‘হরিণ’ বোঝাতে শুরু করে।অন্যদিকে অসমিয়াতে ‘পশু’/pɔxu/ বাংলার মতোই সব ‘পশু’-কে বোঝালেও সামান্য ধ্বনি পালটানো শব্দ ‘পহু’/pɔɦu/-তে মূলত হরিণই বোঝায়।‘ভক্ত’ শব্দটির অর্থ সংস্কৃতেও তাই ছিল, যা বাংলাতে আছে।শ্রদ্ধাশীল,অনুরাগী।সে ‘ভক্ত’ যেকোনো দেবদেবীর,গুরুর,বিদ্বান বা শিল্পী ব্যক্তিত্বের হতে পারে।কিন্তু তার থেকে জাত অসমিয়া ‘ভকত̖’ শব্দে শঙ্করদেব প্রচারিত ‘এক শরণ নাম ধর্ম’-এর অনুরাগী বা সেবককেই বোঝায়।
৩) অর্থসংক্রম: স্থান এবং কালান্তরে শব্দের এমন সব পরিবর্তন হয় যে আদি অর্থের সঙ্গে যোগ খোঁজে পাওয়া কঠিন হয়।এই ধরণের পরিবর্তনকে অর্থসংক্রম বা সংশ্লেষ বলে।যেমন সংস্কৃতে ‘ঘর্ম’ বলতে ‘গরম’ বোঝাতো।এখন বাংলাতে বোঝায় ঘাম,তথা স্বেদ।‘সন্দেশ’ শব্দটি মূলে বোঝাতো সংবাদ।কৃত্তিবাসী রামায়ণেও আছে,“ইন্দ্র মালা দিয়াছেন পুত্রের সন্দেশ।সুগ্ৰীবেরে দিই যে,দেখহ এই দেশ।।” ডাকব্যবস্থা যখন ছিল না লোকে আত্মীয় বাড়ি বার্তা বিনিময় করতে লোক পাঠালে সঙ্গে মিষ্টি নিয়ে যেত।সেই থেকে এখন এক বিশেষ ধরণের শুকনো মিষ্টিকেও ‘সন্দেশ’ বলে।আমরা এর আগে দূরভাষ অর্থে ‘মোবাইল’ বা আক্রামক ভিড় অর্থে ‘মব̖’ কথাটির উল্লেখ করেছিলাম।সেও এরকমই অর্থ সংক্রমের নজির।‘মায়া’ শব্দটির মূলে অর্থ ছিল ময় দানবের তৈরি কুহক।ছদ্ম কপট।‘এ সংসার মায়াময়’ এমন কথার অন্য অর্থ হতে পারে ‘এ সংসার ছলনাময়।’ ‘ছলনা’ ভালোবাসারও সদর্থক অর্থেই অংশ বটে।ফলে বাংলা অসমিয়া দুই ভাষাতেই স্নেহ-মমতা অর্থেও শব্দটি প্রচলিত।কিন্তু নেপালিতে তো ‘মায়া’ মানে ‘প্রেম’,‘ভালোবাসা’।‘মি তিমিলাই মায়া গরছু’ এই নেপালি বাক্যের বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ তেমনি ‘প্রেম’ শব্দের প্রতিশব্দ সংস্কৃতে ‘রাগ’, বাংলা-অসমিয়া-সিলেটি সবেতেই এখন এই শব্দে ‘ক্রোধ’ বোঝায়।‘অনুরাগ’ শব্দটিতে বরং প্রেম,স্নেহ বোঝায়।সংস্কৃতে ‘ভরিত্র’ শব্দে ‘বাহু’ বোঝাত।তার থেকে আসা অসমিয়া ‘ভৰি’৫৬ এবং চট্টগ্রামী ‘ভ̣ইর’ বা ‘ব’ইর’-এর ৫৭ অর্থ ‘পা’।
অর্থোন্নতি এবং অর্থাবনতি বলে অর্থ পরিবর্তনের আরো দুই ধারার কথা অনেকে বলেন।উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী লিখেছেন,‘অর্থোৎকর্ষ’ এবং ‘অর্থাপকর্ষ’।৫৮জগন্নাথ চক্রবর্তী সরাসরিই দাবি করেছেন ‘শব্দার্থ পরিবর্তনের পঞ্চধারা’। শেষ দুটি ‘অর্থ উৎকর্ষ’ এবং ‘অর্থ অবনতি’।৫৯ কিন্তু রামেশ্বর শ’ সেরকম বিভাজনের দরকার আছে বলে মনে করেন না, দৃষ্টান্তগুলি লক্ষ করলে বোঝা যায় এগুলি কোনো –না-কোনো ধারায় পড়ে,অধিকাংশই আংশিক বা পূর্ণ অর্থ সংক্রম মাত্র।৬০তিনি বাতুল থেকে ‘বাউল’,শ্যালক থেকে ‘শালা’—এরকম কিছু দৃষ্টান্তের কথা লিখেছিলেন।‘বাতুল’ শব্দে বোঝাতো উন্মাদ,পাগল।এখন তার থেকে আসা ‘বাউল’ শব্দে বোঝায় এক বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়।এটি অর্থোন্নতির নজির। অন্যদিকে স্ত্রীর ছোট ভাই হচ্ছে শ্যালক।কিন্তু এর থেকে আসা শব্দ ‘শালা’ কখনো বা গালি অর্থেও ব্যবহৃত হয়।এ হচ্ছে অর্থাবনতি।এগুলো রূপতত্ত্বের সম্ভ্রমার্থ–তুচ্ছার্থ পক্ষভেদের মতো।অর্থ পরিবর্তনের প্রক্রিয়াগত ভেদ নয় এই দুটি। উপবিভাজন করতে হলে অর্থের সামাজিক মর্যাদাগত বিভাজন বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে।প্রক্রিয়ার প্রশ্ন উঠলে এগুলোকে আমাদেরও মনে হয় ওই তিন ধারার ভেতরেই ধরা যায়।জগন্নাথ নজির দিয়েছেন সংস্কৃত ‘অখট্টি’ মানে ছিল ‘অসদ্ব্যবহার’ তার থেকে বরাক উপত্যকার বাংলার ‘আকুটালি’ শিশুসুলভ দৌরাত্ম্য বোঝায়।মানে,সামান্য অর্থোন্নতি হয়েছে।অন্যদিকে প্রাকৃত ‘অদভূয়া’ মানে বিস্ময়জনক,তার থেকে ‘অজোভূত’ মানে বিধঘুটে।অর্থাবনতি হয়েছে।কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই যে অর্থসংক্রম ঘটেছে কী করে অস্বীকার করা যাবে? আরেকটি কথা স্পষ্ট যে অর্থবিস্তারাদি ঘটছে আনুভূমিক, অর্থোৎকর্ষাদি ঘটছে ‘উলম্বে’।অর্থবিস্তারাদিতে ‘চিহ্নায়িতে’র পরিমাণকে নির্দেশ করছে,তো ‘অর্থোৎকর্ষাদিতে গুণ। সুতরাং দুটি অর্থের দু’রকম পরিবর্তন।একটি আরটির বিকল্প নয়।একই সঙ্গে দুই ঘটনাই ঘটতে পারে।
বরং ‘শব্দ লোপ’,‘শব্দের আগম’ এবং ‘শব্দ সৃষ্টি’-কে এই প্রক্রিয়াতে ভাবা যেতে পারে।উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী ‘প্রাচীন শব্দর লোপ’ এবং ‘নতুন শব্দর সৃষ্টি’ বলেও দুটি বিষয়ের আলোচনা পরে পরে করে গেছেন।৬১রামেশ্বর শ’ সেরকম কিছু কথা ‘শব্দভাণ্ডারের অবক্ষয় ও নতুন শব্দ সৃষ্টির পরিসংখ্যান’ অধ্যায়ে স্বতন্ত্র আলোচনা করেছেন।৬২ বাকিরা এগুলো ‘শব্দভাণ্ডারে’ কিছু আলোচনা করেছেন।বাকিটা ‘সাদৃশ্য’ প্রসঙ্গে।কিন্তু যদি অধ্যয়নের পুরো রূপকল্পটিই পালটে ফেলা যায়,যদি এইভাবে আলোচনা করা যায়,আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার চাপে কী ভাবে অর্থ,এবং অর্থের দাবিতে কীভাবে শব্দের গঠন কিংবা অর্থ এবং গঠন মিলে পুরো শব্দটাই পালটে যাচ্ছে,তাহলে এই তিনটিকেও এই ক্রমে নিয়ে আসা যায়।অন্যথা আমরা আগে দেখিয়ে এসেছি,‘হাজার’ কিংবা ‘হাতঘড়ি’র প্রচলন এবং ‘রথ’,‘পালকি’ বা ‘বেতার’-এর মতো শব্দের লোপ শব্দার্থতত্ত্বে ব্যাখ্যা করা যায় না।অতীন্দ্র মজুমদার স্বতন্ত্র অধ্যায়ে ‘শব্দপ্রভাবিত ও অর্থানুমোদিত পরিবর্তন’ বলে কিছু আলোচনা করেছিলেন,কিন্তু সেগুলো আসলে শুধু ‘সাদৃশ্যে’র ফলে শব্দের পরিবর্তনকেই ব্যাখ্যা করে,বাকি পরিবর্তন ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়।
সাদৃশ্য এবং শব্দের পরিবর্তন:
বিষয়টি সুকুমার সেন কিংবা রামেশ্বর শ’ ধ্বনি পরিবর্তন প্রসঙ্গে আলোচনা করে এসেছিলেন।কেবল অতীন্দ্র মজুমদার একে আলাদা অধ্যায়ে রেখেছিলেন ‘শব্দপ্রভাবিত ও অর্থানুমোদিত পরিবর্তন’ -এই নামে।কিন্তু ঠিক কিসের পরিবর্তন ---ধ্বনির না অর্থের সেটি তাঁর শিরোনামে স্পষ্ট নয়।ভেতরে বোঝা যায় তিনি আসলে সামগ্রিকভাবে ‘শব্দ’-এর পরিবর্তনের কথা লিখছেন,“এইভাবে কোন পদ বা পদসমষ্টির সাদৃশ্যে অন্য কোন পদ বা পদসমষ্টির সৃষ্টি হলে তাতে বলা হয় সাদৃশ্য (Analogy)।”৬৩এবং রামেশ্বর শ’ যেখানে বিমিশ্রণ,জোড়কলম শব্দ,সঙ্কর শব্দ,লোকনিরুক্তি ইত্যাদিকে ‘সাদৃশ্য’-এর থেকে স্বতন্ত্র শিরোনামে আলোচনা করেছেন অতীন্দ্র মজুমদার তার প্রত্যেকটিকে সাদৃশ্যেরই রকমফের হিসেবে দেখিয়েছেন।তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে সুকুমার সেনও এই সবগুলোকে সাদৃশ্যেরই রকমফের বলে দেখিয়েছেন।কিন্তু সাদৃশ্যের সংজ্ঞাটি সামান্য অন্যরকম লিখেছেন,“...কোনো শব্দের ও পদের ধ্বনি অথবা অর্থপরিবর্তন ঘটিলে তাহাকে সাদৃশ্য (Analogy) বলে।”৬৪‘অর্থপরিবর্তন’-এর কথা লিখছেন,কিন্তু আলোচনা সেরে ফেলছেন ধ্বনিপরিবর্তন প্রসঙ্গে।ফলে আমাদের আগেই মনে হয়েছিল,বিষয়টি নিয়ে ভাষাবিদদের মধ্যে স্পষ্ট ধারণার অভাব আছে।আর রামেশ্বর শ’ বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখেন নি।এই বিষয়টি ‘ঘোষীভবন,মহাপ্রাণীভবন,অপিনিহিতি’ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে করতে এসে হঠাৎ ধ্বনিপরিবর্তন প্রসঙ্গে আলোচনা করে ফেলা বেমানান।ধ্বনি এবং রূপতাত্ত্বিক পরিবর্তনটি হয় বটে।কিন্তু সেসব একটি মাত্র শব্দ বা রূপের ক্ষেত্রেই সত্য।যেমন ধরা যাক ‘টাকার কুবের’ থেকে ‘টাকার কুমীর’ হলো।তার মানে এই নয় যে ‘ব’-এর মতো একই রকম ধ্বনি সমাবেশে থাকলে বর্গের তৃতীয় ধ্বনির এই শব্দে ‘ম’–এর মতো নাসিক্যীভবন হবেই।তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে এই সমস্ত ক্ষেত্রে অর্থ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।সুকুমার সেনই লিখছেন,“কথা বলিবার সময়ে ধ্বনিগুলি ছাড়া-ছাড়া ভাবে এক একটি করিয়া উচ্চারিত হয় না,ধ্বনিগুচ্ছরূপে অর্থাৎ পৃথক পৃথক পদসত্তায় প্রবাহিত হয়। বাক্যের সমগ্র অর্থের প্রতি মনোযোগ রাখিয়াই পদ অর্থাৎ অর্থবান ধ্বনি সমষ্টি উচ্চারিত হয়।বক্তা ও শ্রোতার মনে বাক্যবদ্ধ পদগুলির পৃথক পৃথক সত্তাবোধ আছে বটে, কিন্তু সেগুলি মনের ভাণ্ডারে এলোমেলো ছড়ানো থাকে না, যেন থাকে থাকে বা খোপে খোপে গোছানো থাকে।বাঙ্ময় মানুষের মনের অত্যন্ত স্বাভাবিক ধর্ম হইতেছে পদভাণ্ডারকে অর্থের দিক দিয়া যেন থাকে থাকে বা খোপে খোপে গুছাইয়া রাখা।সুতরাং কোন খোপের সব পদ এক-একটি করিয়া মনে রাখিতে হয় না,প্রত্যেক খোপের বা থাকের দুই চারিটি পদ মনে রাখিলেই হয়।আবশ্যকমতো সেই পদগুলির সাদৃশ্যে অর্থাৎ ছাঁচে বা ছাপে অপর পদ ইচ্ছামত গড়িয়া নেওয়া যায়।”৬৫আমরা দীর্ঘ কথাটা তুলে দিলাম,নিজেরা পুনরুচ্চারণ করবার দরকার নেই ভেবে।তিনি যে নজিরগুলো দিয়েছেন, তার কিছু এরকম-- ‘নাপিতিনী’,‘ধোপানী’-র সাদৃশ্যে ‘মাজুরানী’,‘মাস্টারনী’ ইত্যাদি।স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে এখানে অর্থের সাদৃশ্য ধ্বনির সাদৃশ্যকে নির্মাণ তথা নিয়ন্ত্রণ করছে। সুতরাং বিষয়টির আলোচনার যথার্থ স্থান ‘শব্দার্থতত্ত্ব’-এই।আমরা অতীন্দ্র মজুমদারকে অনুসরণ করে প্রসঙ্গটি স্পষ্ট করছি।উদাহরণগুলোতে তিনিও সুকুমার সেনকেও অনুসরণ করেছেন, আমরাও তাই করছি।তিনি লিখছেন,“পৃথিবীর অধুনা-প্রচলিত কোন ভাষারই আদিমতম স্তরে ব্যাকরণের শৃঙ্খলা ছিল না।...কিন্তু পরে মানব মন যত পরিণত হয়েছে,যে তার জীবন ও ভাষাকে তত শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং সামঞ্জস্য যুক্ত করেছে। উচ্চারণের দোষে,শোনার দোষে এবং অন্যান্য নানা প্রাকৃতিক কারণে ভাষার মধ্যে পরিবর্তনের যে বহুবিধ প্রবাহ চলছে তাকে কিছুটা পরিমাণে প্রতিরোধ করেছে সাদৃশ্যবোধ।”৬৬ আমরা কথাটাকে এইভাবে ঘুরিয়ে লিখতে চাই ‘পরিবর্তনের বিশৃঙ্খল প্রবাহে শৃঙ্খলা নিয়ে আসতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এই ‘সাদৃশ্য’বোধ।
সাদৃশ্য তিন রকমের কাজ করেঃ ১) নতুন শব্দ বা পদ সৃষ্টি,২) পুরোনো শব্দ বা পদের আকৃতি পরিবর্তন,৩) পুরোনো শব্দের বা পদের অর্থ বদলে দেওয়া।এই দ্বিতীয়টিকে ‘ধ্বনি পরিবর্তন’ এবং ‘রূপপরিবর্তন’ এই দুই ভাগে ভাগ করে রামেশ্বর শ’ সাদৃশ্যের চাররকম কাজের কথা লিখেছেন।৬৭
১) নতুন শব্দ বা পদ সৃষ্টি: সংস্কৃতের মিত্রতা (মিত্রতার ভাব),দেবতা(দেবের ভাব),সখ্যতা (সখ্যের ভাব) ইত্যাদির সাদৃশ্যে আত্মপরতা বোঝাতে বাংলাতে নতুন শব্দ হয়েছে ‘মমতা’।সংস্কৃত বধূটী থেকে এসেছে > প্রাকৃত ‘বহুড়ী’ > তার থেকে প্রাচীন বাংলা ‘বহুড়ি’।তার অনুসরণে বাংলা ‘শাশুড়ি’,‘ঝিয়ড়ি’,‘ঝিওরি’,অসমিয়াতে ‘জীয়রী’,‘জিয়ারী’ ইত্যাদি।
২) পুরোনো শব্দ ও পদের আকৃতি পরিবর্তন: সংস্কৃত স্বরান্ত শব্দের ষষ্ঠীর একবচনে শব্দের শেষ স্বরধ্বনি অনুযায়ী বিভিন্ন রূপ হয়।যেমন,অ-কারান্ত ‘দেব’-শব্দের হয় ‘দেবস্য’,উ-কারান্ত ‘সাধু’ শব্দের হয় ‘সাধোঃ’,ই-কারান্ত ‘মুনি’ শব্দের হয় ‘মুনেঃ’,ই-কারান্ত ‘সখি’ শব্দের ‘সখ্যুঃ’,ঈ-কারান্ত ‘সুধী’ শব্দের ‘সুধীয়’,ঋ-কারান্ত ‘দাতৃঃ’ শব্দের ‘দাতুঃ’ ইত্যাদি নানা রূপ হয়।কিন্তু প্রাকৃতেই অ-কারান্ত ‘দেবস্য’ শব্দের সাদৃশ্যে এই শব্দগুলোর রূপ দাঁড়িয়েছিল সাধুস̖স,মুণিস̖স, সখিস̖স,সুধিস̖স,দাতাস̖স ইত্যাদি।সেখানে পদের শেষের স্বরধ্বনি অনুযায়ী শব্দরূপের সংস্কৃত-নির্দিষ্ট আকৃতি আসছে না।বাংলা ‘আমার’,‘তোমার’ সাদৃশ্যে চট্টগ্রামীতে ‘তাহার’ অর্থে ‘তারার’ হয় লিখেছেন অতীন্দ্র মজুমদার।‘তাহার’ নয়, ‘তাদের’ অর্থে ‘হিতারার’,সম্ভ্রমার্থে ‘তাঁদের’ অর্থে আছে ‘তাঁরার’।বরং সিলেটিতে আছে ‘তারার’।সামান্য-সম্ভ্রমার্থে একই রূপ।তেমনি ‘আমরা’,‘তোমরা’-র সাদৃশ্যে মান বাংলাতে বিশেষ্য পদেও ‘-রা’ জুড়ে বহুবচনের অর্থ বোঝানো হয়।যেমন ---রামেরা,শ্যামেরা,বাঙালিরা ইত্যাদি।
৩) পুরোনো শব্দের বা পদের অর্থ বদলে দেওয়া: এই প্রসঙ্গটি আমরা আগেই আলোচনা করে এসেছি।‘বৈদিক’ ‘রোদসী’-র অর্থে রবীন্দ্রনাথের হাতে ‘ক্রন্দসী’ হয়ে যাবার কথা সুকুমার সেন ধ্বনিপরিবর্তন প্রসঙ্গে লিখেছেন।রামেশ্বর শ’ ধ্বনি এবং অর্থ পরিবর্তন প্রসঙ্গে পুনরাবৃত্তি করেছেন।
“সাদৃশ্যের প্রভাবে মোটামোটি উপরের তিনটি হলেও সাদৃশ্য-প্রভাবে অন্য নানাবিধ শব্দ গঠিত হতে পারে।” লিখেছেন,অতীন্দ্র মজুমদার।৬৮অধিকাংশই এই ঘটনা ঘটে ঋণশব্দ বা শব্দাংশকে চেনা মাতৃভাষার রূপ দিতে গিয়ে।এবং তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে উপরের তিন ঘটনাই এগুলোতেও ঘটছে।কিন্তু আনুষঙ্গিক বেশ কিছু জটিলতা আছে বলেই স্বতন্ত্র শ্রেণিবিভাজন করা। এইভাবে পরিবর্তিত শব্দগুলোর নির্দিষ্ট নাম আছে পরম্পরাগত ভাষাবিদ্যাতে।যেমন, —
বিমিশ্রণ: পোর্তুগীজ –আনানস> বাংলা আনারস।বাংলা ‘রসে’র সঙ্গে ধ্বনি সাম্য রয়েছে,সেই সঙ্গে ফলটিও রসে ভরা বলে,অর্থসাম্যের কথাও সহজে মনে আসাতেই এমন নাম হয়েছে অনুমান করাই যেতে পারে।পর্তুগিজ শব্দটি ‘নস̖’ (nas) অংশের সেরকম কোনো অর্থ নেই।মূলে ফলটি লাতিন আমেরিকার,এবং পেরুতে এর নাম nanas।এর বৈজ্ঞানিক নাম এখনো ‘Ananas comosus’।সুতরাং বাংলাতে শব্দটি যথেচ্ছ ভেঙে আধা অংশে বাংলা ‘রস’ জুড়ে বাংলা গঠন এবং অর্থ আনবার চেষ্টা হয়েছে।সেভাবেই প্রচলিত।সুকুমার সেই ‘তড়িৎ’ শব্দের সাদৃশ্যে রবীন্দ্রনাথের ‘ঝটিৎ’ এবং সেরকম আরো কিছু শব্দকেও বিমিশ্রণের নজির বলে দেখিয়েছেন --ঝড়ের মেঘ ঝটিৎ এসে/দাঁড়িয়ে থাকে এলোকেশে (পুরোনো বট:শিশু)।আমরা আগে যে শাশুড়ি,ঝিওরি এই সব শব্দ নির্মাণের কথা লিখে এসেছি,দেখা যাচ্ছে ওখানে অনেকগুলো প্রায় সদৃশ অর্থবহ শব্দের গঠন এক হচ্ছিল,আর এখানে বিচ্ছিন্ন অন্যভাষার শব্দ অর্থে এবং গঠনে বাংলার মতো হয়ে উঠছে।
জোড়-কলম: আরবি মিন্নৎ+সংস্কৃত বিজ্ঞপ্তি মিলে বাংলা মিনতি।সুকুমার সেন এমন আরো কিছু নজির দিয়েছেন--রবীন্দ্রনাথের তৈরি নিশ্চল+চুপ=নিশ্চুপ,জেদী+তেজালো =জেদালো(জেদালো দুষ্টুমি-ভরা প্রিয়দর্শন চেহারা: চারঅধ্যায়)। সুকুমার সেন লিখেছেন,বিমিশ্রণ আর জোড়কলম একই ব্যাপার।শুধু প্রথমটির দুই অংশ ‘তুল্যমূল্য’ নয়, শেষেরটির দুই অংশ ‘তুল্যমূল্য।’৬৯অর্থাৎ অংশ দুইটির মধ্যেও একটা মিল রয়েছে অর্থের।একেও আমরা নতুন শব্দ সৃষ্টি প্রক্রিয়ার ভেতরে ধরতে পারি।
লোকনিরুক্তি: এগুলোকেও বিমিশ্রণের সঙ্গে তফাৎ করা কঠিন।লোকনিরুক্তি বলা হয়,কেননা ‘লোক’ অভ্যাসই এই সব শব্দের উৎস।অসমিয়াতে উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী লেখেন ‘লোক-বুৎপত্তি’।৭০ এই সবে পুরো শব্দই অভ্যস্ত শব্দের গঠন অনুযায়ী পালটে যায়।যেমন হাসপাতাল < ইংরেজি Hospital।বাংলা চেনা শব্দ ‘হাস̖’ (হাঁস?) এবং ‘পাতাল’-এর অনুসরণে পালটে গেলেও পুরো শব্দটি উৎস শব্দের অর্থ অপরিবর্তিত এতে।কিন্তু প্রাচীন বৈদিক ঊর্ণবাভ > যখন বাংলা ঊর্ণনাভ হয়—তখন কিন্তু শেষাংশই পরিবর্তিত হলো।আর মূল প্রাণীটি একই থেকে গেলেও সেই অংশের অর্থ সামান্য হলেও পাল্টায়।‘বাভ’-তে মাকড়শা ‘বয়ন’ করে সেটিই বোঝাতো,‘নাভ’তে বোঝায় নাভি থেকে তন্তু বের করে জাল বয়ন করে।তেমনি টাকার কুবের-- মানে ধনের দেবতা।কিন্তু সেই শব্দজোড় যখন > ‘টাকার কুমীর’ হয় তখনো শেষাংশই পাল্টায়।এবং অর্থও খানিক পাল্টায়।কুমীরের মতো পেটে জলের তলাতে টাকা লুকিয়ে রাখে—এমন একটা অর্থই মনে আসে।তেমনি ইংরেজি arm-chair মানে কিন্তু যেকোনো হাতলসহ চেয়ার।কিন্তু বাংলা ‘বাহু’ অর্থে ইংরেজি ‘arm’ শব্দটি পালটে যখন বাংলা ‘আরাম কেদারা’ বা অসমিয়া ‘আৰামীচকী’ করা হলো,তখন আসলে পুরো অর্থই পালটে গেল। ‘আরাম কেদারা’ বা ‘আৰামীচকী’ সব হাতলসহ চেয়ার নয়,এক বিশেষ গঠনের চেয়ারই বোঝায়।অর্থাৎ অর্থ সংকোচ হচ্ছে।তেমনি ‘ডাক্তার’ ওই সেদিনও বোতলে তরল ঔষধ দিয়ে দাগ দিয়ে রোগীকে খেতে দিতেন বলে,ডাক্তার <Doctor> অসমিয়া বহু মানুষের মুখে হয়েছে ‘দাগদার’---দাগ দেন যিনি!৭১
বিষমচ্ছেদঃ একে স্বতন্ত্র নামে চিহ্নিত করা হলেও, সুকুমার সেন এবং অতীন্দ্র মজুমদার দু’জনেই লোকনিরুক্তি প্রসঙ্গেই আলোচনা করেছেন।বিমিশ্রণে বা জোড় কলমে যেমন দুই শব্দ বা শব্দাংশ জুড়ে যায়,এখানে একটি শব্দ ভুল শোনে বা ভুল ভেবে শুদ্ধ করতে করতে গিয়ে লোকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন।তাতে মূল শব্দের গঠন পাল্টায়,নতুন শব্দও তৈরি হয়।যেমন—সংস্কৃত নবরঙ্গ> ফার্সি নারাঙ্গ> আরবি নারাঞ্জ> পুরোনো ইংরেজি a norange।এই অব্দি ঠিক ছিল। কিন্তু আধুনিক ইংরেজিতে মনে করা হলো মূলে শব্দটির শুরু ‘o’ দিয়ে,নিশ্চয়ার্থক পূর্বপদটি ভুল করে ‘a’ রয়েছে।এটি হবে ‘an’।শব্দজোড়ের গঠন হয়ে গেল ‘an orange’।কমলা অর্থে ইংরেজি ‘orange’ শব্দটি এলো।মূলে ফার্সি শব্দ ছিল ‘মুহুরির’,‘বর্গির’ ইত্যাদি।বাংলাতে মনে করা হলো,শেষে অহেতুক সম্বন্ধের ‘-র’ রয়েছে।সুতরাং সেটি বাদ দিয়ে ক্রমে দুই শব্দ তৈরি হলো বাংলাতে ‘মুহুরি,বর্গি’।
ভুয়া শব্দ: এও একাধারে সাদৃশ্য এবং লোকনিরুক্তির ফলেই হয়ে থাকে।বাংলা ‘পোতা’ শব্দে শব্দের পূর্বরূপ ভেবে না পেয়ে একটি ভুয়া সংস্কৃত ধাতু ‘প্রোথ̖’ কল্পনা করে নিয়েছেন কেউ কেউ।সেরকম সাধুবাংলা ‘নিরঞ্জন’ শব্দটির প্রাকৃত রূপ ‘নীরঁজ্জন’।মূলে সংস্কৃত নীরাজন,এবং নীরমজ্জন।এই দুয়ের মধ্যে সুকুমার সেন ভেদ স্পষ্ট করেন নি বলেই মনে হয়।লিখেছেন,“সংস্কৃত নীরাজন (--প্রাচীন কালে আশ্বিন অথবা কার্তিক মাসে যুদ্ধযাত্রার প্রারম্ভে রাজারা অস্ত্রশস্ত্র আনুষ্ঠানিকভাবে ধুইয়া মাজিয়া লইতেন এবং হাতিঘোড়াকে জলাভিষিক্ত করিতেন।সেই অনুষ্ঠান,) নীরমজ্জন > প্রাকৃত নীরঁজ্জন...।”৭২ বোঝা কঠিন,ভুয়া শব্দ কোনটি? নীরাজন,না নীরমজ্জন? কিন্তু যদি যুদ্ধযাত্রার আগেকার জল আচরণের নাম ‘নীরমজ্জন’ > ‘নীরঁজ্জন’ হয়েই থাকে,সেটি একেবারে ভুয়া বলেও তো মনে হয় না।বরং এর মধ্যে ‘অঞ্জন’ তথা কালিমা,কলঙ্ক মুক্তির একটি ভাব আছে,যা বাংলা ‘নিরঞ্জন’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ।‘জল’ অর্থে ‘নীর’ না-বোধক পুরোসর্গ ‘নির-’ দিয়ে কোনো এক সময় প্রতিস্থাপিত হয়েছে।আর ‘মজ্জন’ অংশটি ‘অঞ্জন’ দিয়ে।সেই আক্ষরিক অর্থটির কালে আলঙ্করিক প্রয়োগ শুরু হলো –সমস্ত কালিমা তথা দোষ মুক্ত যিনি –সেই বুদ্ধ,ধর্মঠাকুর,শিব,কিংবা বিষ্ণুর অর্থেও।সেদিক থেকে কোনো ভুয়া নয়,নতুন সৃষ্ট তৎসমরূপ শব্দ ‘নিরঞ্জন’-কেই বলতে পারি।অর্থাৎ ‘আনানস’কে যদি বাংলা করে ‘আনারসে’ বাংলা করে ফেলা হয়েছে,‘নিরঞ্জন’-এ তাই প্রাকৃতরূপকে আবার নতুন তৎসমপ্রায় বাংলা শব্দরূপে পুনর্গঠন করে ফেলা হয়েছে।তেমনি বিদেশী শব্দ ‘তুরুক্ক’-কে ভদ্রজনোচিত তৎসমপ্রায় বাংলা করে ফেলা হয়েছে ‘তুরস্ক’। একে সুকুমার সেন লিখেছেন,“বলিতে পারি পুনর্গঠন।”৭৩
এত সব বিভাজন তাই অহেতুক বলেই মনে হয়।যে বিষয়টি স্পষ্ট,শব্দের গঠন পাল্টাক কিংবা না পাল্টাক অর্থ গোটা বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করছে কোনো এক বিশেষ স্থানে-কালে ব্যবহারকারীর ‘অর্থ’ বোঝাবার ইচ্ছে বা আগ্রহ।শুধু আভিধানিক অর্থই নয়,ভারতীয় অলঙ্কার শাস্ত্র অনুসরণ করে বলা যেতে পারে,লক্ষণার্থ,ব্যঙ্গার্থও।এই আরেকটি বিষয় ‘লক্ষণার্থ’ আদি ছুঁয়ে গেছেন অধ্যাপক নিশীথ রঞ্জন দাস।৭৪ আমরা বিস্তৃতি প্রতিরোধ করতে বিষয়টির অবতারণা করিনি। তাতে আরেকটি উপ-অধ্যায়ই যুক্ত করতে হতো।এই সব পরিঘটনাতে পুরোনো রূপ অথবা অর্থ দুইকেই ব্যবহারী ব্যক্তি বা তার সমাজ ত্যাগ করছে।রূপ না পাল্টালেও অর্থ পাল্টাচ্ছে।কিন্তু অর্থ না পাল্টালেও রূপ পাল্টাচ্ছে সরাসরি দাবি করা যাবে না।দেখা যাবে সেই রূপবদলের মধ্যেও ব্যবহারকারী তার স্থান-কাল,সামাজিক-সাংস্কৃতিক আবহের ছাপ রেখে দিতে চাইছে। রূপগুলো কথা বলে।যখন Hospital হয় ‘হাসপাতাল’ এর সামাজিক স্থান নির্ধারিত হয় সাধারণে,শব্দটি বাংলা তদ্ভব রূপ নেয়। যখন ‘নীরঁজ্জন’ হয় ‘নিরঞ্জন’ কিংবা ‘তুরুক্ক’ হয় ‘তুরস্ক’-- তখন শব্দটির সামাজিক স্থান হয় অভিজাত বিদ্বজ্জনে। শৃঙ্খলা এটাই। অন্যথা এই সব পরিবর্তন আদৌ কোনো ইতিহাসের বা ব্যাকরণের নির্দিষ্ট ক্রম বা নিয়ম মেনে পরিবর্তিত হয় না। তাছাড়া, এই সব শব্দ আরো একটি বিষয় স্পষ্ট করে,ভাষার ব্যবহারে ইতিহাস কিংবা ব্যাকরণের ‘ভুল’ শুদ্ধ করে ফেলে সামাজিক মন--- এবং সেই মন ভাষাকে সমৃদ্ধ করে নিজের নিয়মে।সেখানে ব্যাকরণের অনুশাসন বিশেষ কাজে না এলেও একটি সামাজিক অনুশাসন তথা সংস্কৃতি কাজ করে ।
।। শব্দ,অর্থ এবং সামাজিক অনুশাসন।।
অনুশাসন যেখানে,সেখানে সামাজিক সংঘাত এবং ঐক্য নিজের ভূমিকা পালন করে।সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানের আলোচনার বিষয়ই সেই সব।আমরা দু’একটি নজির উল্লেখ করতে চাই –আমাদের সিদ্ধান্তকে আরো পাকা করবে। বাংলা ভাষাতে ‘জল’ এবং ‘পানি’কে নিয়ে একটি বিতর্ক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মাত্রেরই মধ্যে বেশ পরিচিত।সাদৃশ্য প্রসঙ্গে অর্থের পরিবর্তনের কারক হিসেবে ধর্মীয় সংস্কারের কথাটি আলোচিত হয়ে এলেও এমন বিষয়গুলো আলোচিত হয় না। মনে হয় বুঝিবা সংস্কার-দুষ্ট হবার সমস্যাটি মূলত সংস্কার-দুষ্ট অশিক্ষিত মানুষেরই।আভিধানিক অর্থের দিক থেকে দুটোই এক।তারপরেও এটি ঠিক যে ‘জল’ মূলত পশ্চিম বাংলাতে এবং ‘পানি’ পূর্ববাংলাতেই হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে প্রচলিত,অথবা প্রচলিত ছিল এই সেদিন অব্দি।সিলেটি মাত্রেই ‘পানি’ কথাটিই ব্যবহার করতেন।কিন্তু ইতিহাসের ঘটনাচক্রে আধুনিক বাংলা ভাষা এবং বুদ্ধি চর্চার কেন্দ্র হয়েছে পশ্চিম বাংলা,যেটি হিন্দু প্রধান।এবং পরিধির দিকে সেই কেন্দ্রের বাইরের এলাকার বেশিটাই পুব বাংলা,যেখানকার অধিকাংশ মানুষ মুসলমান।ফলে অনেকরই ধারণা ‘পানি’ কথাটিতে শুধু ‘জল’ই বোঝায় না।মুসলমানের সম্প্রদায় প্রীতিটিও বোঝায়।যার ফলে,এখন অসমেও সিলেটি মধ্যবিত্তের মুখের ভাষা থেকেও ‘পানি’ বিদেয় নিয়েছে।সম্প্রতি প্রকাশিত রণবীর পুরকায়স্থের একটি উপন্যাসের নাম ‘সুরমা গাঙর পানি’,ইমাদ উদ্দিন বুলবুলের লেখা উপন্যাসের নাম ‘সুরমা নদীর চোখের জল’।ভাষাবৈচিত্র্যের অভ্যাস থেকে দু’জনেই দৃশ্যত সঠিক।প্রথম নামটি সিলেটি ভাষার,সুতরাং সঠিকভাবেই ‘পানি’ আছে।দ্বিতীয় নামটি মান বাংলার, সুতরাং সঠিক ভাবেই আছে ‘জল’।কিন্তু অতীতে না হলেও একুশ শতকের অসম তথা ভারতে মনে হবে,কোথাও বুঝিবা দু’জনেই এমন ব্যঞ্জনার্থও বোঝালেন যে লেখক হিসেবে তারা ‘অসাম্প্রদায়িক’।তারপরেও ‘পানি’ মান বাংলাতে প্রবেশ করতে পারবে না,এমন কোনো বিধি নিষেধ সংস্কার ভিন্ন ভাষাবিজ্ঞানের নিজস্ব যুক্তিতে থাকতেই পারে না।এই দুই লেখকই সেরকম কোনো অযুক্তি ভেতরে মেনেও চলেন নি।এই নিয়ে এক চিত্তাকর্ষক নজির দিয়ে পবিত্র সরকারের কিছু কথা আমরা বিস্তৃত তুলে দিচ্ছি, যাতে বিতর্কের ধরন এবং স্তরটি বোঝা যাবে।“এটি বাংলাভাষী বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর মুখের শব্দ।ঘটনাচক্রে তাঁদের অধিকাংশ মুসলমান---কিন্তু বেশ কিছু বাঙালি হিন্দু ও আসামের সম্প্রদায় নির্বিশেষে প্রায় সকলেই ‘পানি’ কথাটিই ব্যবহার করেন,জল নয়।এবং এটাও বোধ হয় আজকাল সকলেই জানেন যে,‘জল’ যেমন সংস্কৃত উৎসের তৎসম শব্দ,‘পানি’ও তেমনই সংস্কৃত উৎসের---তবে তদ্ভব।‘পানীয়’ থেকে ‘পানি’।তা সত্ত্বেও এক শ্রেণীর হিন্দু বাঙালির ধারণা এটি ‘মুসলমানি’ শব্দ।এ সম্বন্ধে সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় জনৈক দয়াল প্রসাদ সান্যাল-এর পত্রটি পড়ে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম।তিনি বাংলাদেশের মুসলমান কবি ও লেখকদের অনেক বইপত্র পড়ে কৃতনিশ্চয় হয়েছেন যে,তাঁরা ‘পানি’-র চেয়ে ‘জল’-ই বেশি ব্যবহার করছেন,ফলে তাঁরা ‘অসাম্প্রদায়িকতা’র দিকে বেশ এগিয়ে যাচ্ছেন। অর্থাৎ তাঁরও মতে ‘পানি’ একটি ‘মুসলমানি’ (অতএব স্বতঃসিদ্ধভাবে সাম্প্রদায়িক) শব্দ।পত্র লেখক নিশ্চয়ই অজ্ঞাত ও প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িকতার শিকার,নইলে সজ্ঞানে একথা বলা বিপজ্জনক।এবং তা বিজ্ঞান সম্মতও নয়।সাহিত্যে প্রতিটি শব্দের নির্দিষ্ট ক্ষেত্র আছে,তার বাইরে তার ব্যবহার সচরাচর হয় না।‘জল’ ও ‘পানি’-র ক্ষেত্র সমসীমাবদ্ধ নয়,অর্থাৎ এক নয়,বলতে পারি পরস্পর অনুস্যুত বা mutually overlapping।পূর্ব বাংলার সাধারণ মুসলমান ও সিলেট-চট্টগ্রাম-নোয়াখালি-কুমিল্লা অঞ্চলের বেশ কিছু গ্রামীণ হিন্দুর সংলাপে ‘পানি’ থাকতেই হবে---তাকে ‘জল’ দিয়ে উৎখাত করলে বাস্তবের অন্যথা ঘটবে।দ্বিতীয়ত,বর্ণনার ভাষাতেও ‘পানি’ আনা যায়,যদি প্রতিবেশ তা দাবি করে,যদিও বাংলার যা মূল বর্ণনীয় (descriptive) গদ্যভাষা,তাতে ‘পানি’ নয় ‘জল’-ই গৃহীত।এর কারণ এই যে,এই গদ্য ভাষা মূলত হিন্দু লেখকদের সৃষ্টি এবং মুসলমান লেখকেরা অধিকাংশত তাকে স্বীকার করেছেন এবং আরও সমৃদ্ধ করেছেন।”৭৫
তেমনি ‘সাথে’ এবং ‘সঙ্গে’-কে নিয়ে আরেকটি বিতর্কের উল্লেখ করেছেন প্রশান্ত চক্রবর্তী।আমরা নিজেদের কথা না বাড়িয়ে,তাঁরও পুরো কথাটা তুলে দিই,“বাংলা মৌখিক ভাষায় ‘সাথে’ শব্দটি চলে,যদিও লেখ্য গদ্যে ওটা প্রায় অচ্ছুত।শব্দটিকে কবিতায় রাখা হয়;কবিতার সাত খুন মাফ।এদিকে ‘একসাথে’ লিখতে আপত্তি নেই।পশ্চিমবঙ্গের একটি মহিলা সম্পাদিত বামপন্থী ধারার পত্রিকার নামই ‘একসাথে’।পশ্চিমবঙ্গীয় গদ্যভাষায় মান্যরীতিতে প্রায় সর্বত্র ‘সঙ্গে’ ব্যবহৃত হয়।যদিও বাংলাদেশের গদ্যে ‘সাথে’ আকছার নজরে পড়ে।‘পানি’ যেমন বাংলাদেশে মান্য,পশ্চিমবঙ্গে বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ঠিক কুলীন নয়।বাংলাদেশের কাগজ অনায়াসের ‘গঙ্গার পানিবন্টন’ হেডলাইন করতে পারে।‘সাথে’ও মূলত পূর্ববঙ্গীয়।প্রমথ চৌধুরীর আমল থেকে বাংলা গদ্যকে মুখের কাছাকাছি আনার আন্দোলন চলছে।তা সত্ত্বেও ‘সাথে’ এ-যাবৎ ব্রাত্য।মুজতবা এক জায়গায় ‘সাথে’ প্রসঙ্গে লিখেছেন--- বাঙাল ‘সাথে’ বলে এবং গদ্যেও লেখে ‘সাথে’; রবীন্দ্রনাথ শেষ বয়সে সেটা কিঞ্চিৎ অনিচ্ছায় স্বীকার করে নেন।”৭৬
এইগুলো নিছক সংস্কার বললে মনে হয় কম হয়।শ্রেণি-বর্ণ-জাতি- অঞ্চলের আধিপত্যের আর্থ-সামাজিক স্বার্থও এর পেছনে কাজ করে।‘জল’-এর প্রতিশব্দ হিসেবে অনেক অভিধান প্রণেতারা ‘সলিল’,‘বারি’ ইত্যাদি শব্দের উল্লেখ করলেও ‘পানি’র উল্লেখ করেন না বলে পবিত্র সরকার অত্যন্ত নম্রভাবেই লিখেছেন,“এটা সচেতন বর্জন নয়।কিন্তু এই যে অচেতনতা---এটাই বিপজ্জনক।অর্থাৎ আমরা কখন কোথায় সাম্প্রদায়িক আচরণ করছি সে সম্বন্ধে আমাদের নিজেদেরই স্পষ্ট ধারণা নেই।”৭৭
কিন্তু মাত্র বছর কয় আগে প্রকাশিত ‘অসমিয়া জাতীয় অভিধান’-এর সম্পাদক দেবব্রত শর্মা এত নম্র হতে প্রস্তুত নন।অভিধানটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সারা আসামেই বৌদ্ধিক মহল থেকে শুরু করে আমজনতার মধ্যে বিশাল বিবাদ আলোচনার সভা থেকে শুরু করে রাজপথ অব্দি নেমেছিল।কোথাও প্রতিবাদকারীরা বহু জনগোষ্ঠীকে অপমান করেছেন এই নবোন্মেষিত চেতনার থেকে সুবিখ্যাত ‘হেমকোষ’ নিষিদ্ধ করবার দাবি তুলেছিলেন,তো অনেকে ‘অসমিয়া জাতীয় অভিধান’ খানাই বহু জনগোষ্ঠী এবং অঞ্চলের লোকের মুখের শব্দকে অভিধানে ঠাই দিয়ে অসমিয়া জাতির প্রতিষ্ঠাকেই প্রত্যাহ্বান জানাচ্ছে অভিযোগ এনে এর প্রকাশের বিরোধিতা করেছিলেন।অভিধানটি প্রকাশ পাবার আগে কর্মীবাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে এবং পরে কৈফিয়ত দিতে গিয়ে ‘জাতীয় অভিধান’ প্রণেতাদের নানা সভাসমিতি,প্রচার পত্র এবং পুস্তিকার আশ্রয় নিতে হয়েছিল।সেরকমই এক পুস্তিকা ‘জাতীয় অভিধান প্রসঙ্গ।’সেটি একটি প্রবন্ধ সংকলন।জাতীয় অভিধান কেন চাইছেন,কীভাবে চাইছেন সেই ব্যাখ্যা করে অসমিয়া ভাষাবিদ এবং বিজ্ঞানীরা লিখেছেন।‘হেমকোষ’ প্রসঙ্গে সম্পাদক দেবব্রত শর্মার দীর্ঘ আলোচনার একটি বিশেষ জায়গা আমাদের বেছে নেবার কারণ হলো,এখানে ‘বাঙালি’ সমাজের শ্রেণি-বর্ণ ভেদকে অসমিয়া সমাজ এবং অভিধানপ্রণেতারা কীভাবে দেখেন তার একটি চিত্তাকর্ষক নজির পাওয়া যাবে। আমরা সেটিও অনেকটাই তুলে দিচ্ছি,“এইবার ৬৪৮ পৃষ্ঠার ‘প্রৱর্তা’ শব্দটোলৈ আহোঁ।ইয়ার অর্থ দিবলৈ গৈ ধনীর গরিমা প্রচার করা হৈছে।ইয়াত উদাহরণ দি কোয়া হৈছে,‘যেনে ধনীয়ে দুখীয়াক প্রৱর্তায়।’ অথচ আটাইতকৈ সহজ উদাহরণ এটা জানো এনে হ’ব নোয়ারিলেহেতেনঃ ‘দুখীয়াই কটনা কাটি পেট প্রৱর্তায়’?একেটা জাতি বা সম্প্রদায়র ভিতরতো সেইদরে বরুয়াই শ্রেণী বিভাজন স্পষ্ট করি দেখুৱাইছে।ভদ্রশ্রেণীর আহোম আরু সামান্য শ্রেণীর আহোম তেখেতর দৃষ্টিত বেলেগ,তেনেকৈ বেলেগ বঙালী আরু বঙাল-বঙালনীও।৬৭৩ পৃষ্ঠাত তেখেতে সেয়েহে কৈছে, ‘বঙালঃ বংগদেশৰ ইতৰ মানুহ।’ ‘বঙালীঃ... বঙালী ভদ্রলোক।’ একে পৃষ্ঠাতে ‘বঙহৰ দেও’ শব্দ এটা দেখুওয়া হৈছে ‘ওপৰৰ শ্রেণীৰ আহমৰ ভার্যাই স্বামীক মতা মাত’ বুলি।অবশ্যে এই কথা অনস্বীকার্য যে,এই শাণিত শ্রেণী চেতনার রেপ যে অকল ‘বঙাল-বঙালনী’ বা সাধারণ শ্রেণির লোকেহে সহ্য করিবলগীয়া হৈছে এনে নহয়।নিচলা বামুণরো তার পরা নিস্তার নাই।উদাহরণ স্বরূপে ‘দেৱ’ শব্দই ‘দেৱতা,ঈশ্বৰ,স্বর্গলোক,মান্যৱন্ত বা ব্রাহ্মণ আদিক সন্মানেরে মতা মাত,যেনে, স্বর্গদেৱ,গোঁসাইদেৱ,বাপুদেৱ ইত্যাদি বুজায়।(পৃষ্ঠা ৫১৬)কিন্তু তার বিপরীতে ‘দেৱল’ শব্দই ‘দেৱলীয়া ঠাকুৰ,লোকৰ নিমিত্তে মূর্তী পূজা কৰি জীৱিকা কৰা বামুণ’ক বুজায়।ইয়ার পাছতো এওঁলোকর শ্রেণী চরিত্র লৈ কারোবার মনত সন্দেহ থাকি যাবো পারে বুলি ভাবিয়েই বোধহয় অভিধান প্রণেতাজনে বন্ধনীর ভিতরত জলজল পটপটকৈ বুজাই দিছে ‘এনে বামুণ নীহ’(পৃষ্ঠা ৫১৭)।‘দ্বিজবন্ধু’ শব্দর অর্থ দিবলৈ গৈয়ো তেখেতে নিত্যকর্ম নকরা বামুণক ‘অধম বামুণ’ আখ্যা দিছে (পৃষ্ঠা ৫২৫)।”৭৮ ( বড় হরফগুলো মূল লেখকের।--গবেষক )
।। শব্দভাণ্ডার ।।
ভাষাগুলোতে শব্দের পরিবর্তন,গ্রহণ,সৃজনের গতিবিধি তথা হার অধ্যয়ন এক চিত্তাকর্ষক বিষয়।তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের সেই জন্যে একটি শাখারই সূচনা করেছিলেন মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানী মরিস স্বদেশ (Morris Swadesh)। প্রচুর প্রায়োগিক এবং গাণিতিক দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণ ছাড়া এদিকটাতে পা বাড়ানো কঠিন বলেই সম্ভবত বাংলাতে এই ধারার অধ্যয়ন মেলেও কম।যুতসই পারিভাষিক শব্দেরও অভাব।রামেশ্বর শ’ লিখেছেন,শব্দভাণ্ডারের অবক্ষয় ও নতুন শব্দ সৃষ্টির পরিসংখ্যান।ইংরেজিতে বলে ‘Glottochronology’ এবং ‘Lexico-Statistics’।৭৯ তবে সুনীতি চট্টোপাধ্যায় যে সূচনা অংশের পরিশিষ্টে কিছু স্থাননাম,শব্দভাণ্ডার নিয়ে কথা বলেছেন,আমরা উল্লেখ করে এসেছি।তিনি নিছক কিছু শব্দতালিকা ধরিয়ে দেন নি।তিনি যেভাবে ‘শব্দভাণ্ডার’ বিষয়টি আলোচনা করেছেন,সে শুধু Vocabulary বা lexicon নয়,এযে ‘etymology’ বা নৃ-ভাষাবিজ্ঞানও --- তাঁর লেখাতেই স্পষ্ট।‘etymology’ কথাটি তিনি নিজেও অনেকবার ব্যবহার করেছেন।জ্ঞানেন্দ্র মোহন দাসের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’-এর আশ্রয় নিয়ে তিনি বেশ সংখ্যাতাত্ত্বিক এক হিসেব বের করে দেখিয়েছেন অভিধানটিতে বাংলার নিজস্ব শব্দের হার ৫১.৪৫ %। এর মধ্যে তিনি ধরেছেন তদ্ভব,অর্ধ-তৎসম,প্রতিবেশী ভাষা এমন কি অনার্য উৎস থেকে আসা শব্দগুলোকেও।তৎসম ৪৪%।বিদেশী ঋণ শব্দের মধ্যে শুধু পার্শির পরিমাণ ৩.৩০%।বাদ বাকি ইংরেজি,পোর্তুগীজ সব সব বিদেশি শব্দ ১.২৫ শতাংশ।৮ ০ এছাড়াও তিনি বাংলা শব্দ,প্রত্যয়,বিভক্তি আদির প্রতি পদক্ষেপে হিসেব বের করে করে এগিয়েছেন।সারা বইতেই তার উল্লেখ আছে যথাস্থানে।যেমন ৬২০ নং সূত্রে লিখছেন,“there are slightly over 50 roots in Bengali which were originally causative in OIA.”৮১ এখন এই পঞ্চাশটিই প্রাচীন ভারতীয় আর্যে ‘ণিজন্ত’ ধাতু ছিল কি কম বা বেশি ছিল---সেসব প্রশ্ন উঠতেই পারে।কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হলো সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তার একটা হিসেব বের করবার শ্রমটুকু স্বীকার করেছিলেন।যা পরের কালে আর খুব একটা দেখা যাবে না।এমন কি শব্দভাণ্ডারের আলোচনাকে অনেকে শব্দের তালিকাতেই নামিয়ে এনেছেন।আমরা যেভাবে তৎসম,তদ্ভব,দেশী,বিদেশী শব্দের সংজ্ঞা এবং তালিকা শিখে এসেছি সুনীতিকুমারের উপস্থাপনা ততটা ছাত্রবান্ধব না হতে পারে,কিন্তু জিজ্ঞাসুবান্ধব অবশ্যই ছিল।তিনি যখন তৎসম শব্দের কথা আলোচনা করেন,তখন সেগুলো ঠিক কতটা খাটি তৎসম সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন।‘তৎসম,তদ্ভব’ ইত্যাদি কথাগুলোতে প্রাকৃত ব্যাকরণ থেকে বাংলাতে ধার করা পরিভাষা সেই সত্যের সন্ধানও তিনিই দেন।কিছু তৎসম প্রাকৃত হয়েই বাংলা অব্দি এসেছে।সেগুলো সবাই লেখে একরকম,উচ্চারণ করেন আর রকম।বাঙালিরা কী করেন,সেই নিয়ে আমরা সুনীতিকুমারেরই কিছু কথা আগে তুলে দিয়েছি।সেরকম কিছু শব্দকেইও অর্ধ-তৎসম বলে গ্রহণ করেছিলেন গ্রিয়ার্সন এবং সেরকম কোনো কোনো পশ্চিমা তাত্ত্বিক।৮২সুনীতিকুমার সেগুলোকে ‘তদ্ভব’-র সমতুল্য বিবেচনা করতেই পরামর্শ দেন,“It is sometimes convenient to treat the semi-tatsamas,especially the older ones,along with tadbhavas.”৮৩ বহু তৎসম আসলে বাংলাতে কেরির পাঠশালা থেকে শিখে নবীন আমদানি।তদ্ভবগুলোও কিছু প্রাকৃতেই তদ্ভব রূপ পেয়েছিল,বাংলাতে আসতে আসতে আরো পাল্টায়।কিছু প্রতিবেশী ভাষাতে পালটে বাংলাতে এসেছে।কিছু অনার্য বা অভারতীয় ভাষাতে এসে নিজের রূপ পালটে এসে বাংলাতে প্রবেশ করে অক্ষত থাকে,অথবা বাংলাতে আরো পালটে যায়।আরবি শব্দগুলোতো অধিকাংশই বাংলাতে এসেছে ফার্সি হয়ে। এসে এমন চেহারা পাল্টেছে যে উনিশ শতকে যারা আরবি ফার্সি শব্দ বাংলার থেকে বাদ দেবার আয়োজন করছিলেন তারাও শব্দগুলোর সন্ধান পেয়ে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন।শব্দভাণ্ডারের তৎসম-তদ্ভব বিভাজন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বহুভাবে বহু জায়গাতে বলেছেন,লিখেছেন।আমরা তার একটি তুলে দিচ্ছি এখানে,“বলা বাহুল্য বাংলা ভাষার বেশিরভাগ শব্দই সংস্কৃত থেকে পাওয়া।এই শব্দের কোনোটাকে বলি তৎসম,কোনোটাকে তদ্ভব।ছাপার অক্ষরে বাংলা পড়ে পড়ে একটা কথা ভুলেছি যে,সংস্কৃতের তৎসম শব্দ বাংলায় প্রায় নেই বললেই হয়।‘অক্ষর’ তৎসম বলে গণ্য করি ছাপার বইয়ে;অন্য ব্যবহারে নয়।রোমান অক্ষরে ‘অক্ষর’ শব্দের সংস্কৃত চেহারা akshara বাংলায় okkhar।মরাঠি সংস্কৃত শব্দ প্রায় সংস্কৃতেরই মতো,বাংলায় তা নয়।বাংলার নিজের উচ্চারণের ছাঁদ আছে,তার সমস্ত আমদানি শব্দ সেই ছাঁদে সে আপন করে নিয়েছে।”৮৪অন্যত্র লিখছেন,“বাংলা ভাষার উচ্চারণে তৎসম শব্দের মর্যাদা রক্ষা হয় বলে আমি জানি নে। কেবলমাত্র অক্ষর বিন্যাসেই তৎসমতার ভান করা হয় মাত্র,সেটা সহজ কাজ।বাংলা লেখায় অক্ষর বানানের নির্জীব বাহন—কিন্তু রসনা নির্জীব নয়—অক্ষর যাই লিখুক,রসনা আপন সংস্কারমতই উচ্চারণ করে চলে।সে দিকে লক্ষ করে দেখলে বলতেই হবে যে,অক্ষরের দোহাই দিয়ে যাদের তৎসম খেতাব দিয়ে থাকি,সেই সকল শব্দের প্রায় ষোলো আনাই অপভ্রংশ।যদি প্রাচীন ব্যাকরণকর্তাদের সাহস ও অধিকার আমার থাকত,এই ছদ্মবেশীদের উপাধি লোপ করে দিয়ে সত্য বানানে এদের স্বরূপ প্রকাশ করবার চেষ্টা করতে পারতুম।প্রাকৃত বাংলা ব্যাকরণের কামাল পাশা হবার দুরাশা আমার নেই কিন্তু কালোহ্যয়ং নিরবধিঃ।উক্ত পাশা এ দেশেও দেহান্তর গ্রহণ করতে পারেন।”৮৫ আমরা সুনীতিকুমার থেকেই কিছু শব্দের নজির দিতে পারি,যেগুলো মনে হয় তৎসম,আসলে অর্ধ-তৎসম বা তদ্ভব।যেমন সৃজন,পাশ্চাত্য, কিংবা,পিতৃমাতৃহীন ইত্যাদি।এগুলোকে শুদ্ধ সংস্কৃত করবার আয়োজন কেউ কেউ করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন।৮৬অথচ সুকুমার সেন তাঁদের বিপরীতে গিয়ে লিখেছেন,“বাঙ্গালা ভাষায় তৎসম শব্দের মূল্য তদ̖ভব শব্দের তুলনায় বেশি ছাড়া কম নয়।যে কোনো বাঙ্গালা অভিধানের পাতা উলটাইলে একথা সহজেই জানা যায় যে এ ভাষার প্রধান মূলধন তৎসম শব্দভাণ্ডার।”৮৭অতীন্দ্র মজুমদার লিখেছেন,“সাধু বাংলায় তৎসম শব্দ ব্যবহৃত হয় শতকরা ৭৫ ভাগ আর চলতি বাংলায় শতকরা ৪০ ভাগ।”৮৮
অসমিয়া ভাষাবিজ্ঞানীরাও শব্দভাণ্ডারের বিভাজন একইরকম করে থাকেন।গোলকচন্দ্র গোস্বামী কিন্তু লিখেছেন, “তৎসম শব্দর লিখিত রূপটোহে সংস্কৃত আখর-জোঁটনির সৈতে সম্পূর্ণ একে।উচ্চারণত সংস্কৃতর লগত ইহঁত সমূলি নিমিলে।”৮৯ অর্ধতৎসম সম্পর্কে লিখেছেন,“কিছুমান তৎসম শব্দত সংযুক্ত ব্যঞ্জনর মাজত স্বরবর্ণ সুমুয়াই শব্দবোর ভাঙি উচ্চারণ করা হয়,আরু লিখোঁতেও সেইবোর শব্দ অসমীয়া উচ্চারণ মতে লিখা হয়।”৯০ তিনি শব্দভাণ্ডারকে সংস্কৃত মূলীয়,দেশী এবং বিদেশী এই তিনভাগে ভাগ করেন।বাংলাতে শব্দভাণ্ডারকে প্রথমত মৌলিক এবং আগন্তুক বলে ভাগ করা হয়।সেই বিভাজনও খুব প্রশ্নাতীত নয়।‘মৌলিক’ মানে হচ্ছে যেগুলো প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা হয়ে সরাসরি বাংলাতে এসেছে।তার মূলত দুই ভাগ -- তৎসম এবং তদ্ভব।‘আগন্তুক’-এর আবার দুই ভাগ দেশী এবং বিদেশী।দেশী শব্দ সেগুলোই যেগুলো অনার্য দ্রাবিড়,মোঙ্গল,অস্ট্রিক আদি ভাষাগুচ্ছের থেকে এসেছে।বিদেশী মানে যেগুলো মধ্যপ্রাচ্য বা পশ্চিমা বিভিন্ন ভাষা---তার মধ্যে ইংরেজি সহ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলোও আছে—সেসব ভাষার থেকে আসা শব্দ।এখন,বাঙালি নৃগোষ্ঠীটিকেই যদি বহু অনার্য জনগোষ্ঠী মিলে তৈরি করেছেন বলে মানছি তাহলে পুরো বাংলা ভাষাটিই কিন্তু তার কাছে আগন্তুক।পরভাষাকে নৃগোষ্ঠীগুলো এককালে মাতৃভাষা বলে গ্রহণ করেছিল।ফলে ভাষান্তর-পূর্ব পর্যায়ের কিছু শব্দ,বাক্য গঠন এবং উচ্চারণ বিধি সঙ্গে নিয়েই বাঙালি সত্তাতে প্রবেশ করেছিল।সেগুলোই তার নৃগোষ্ঠীগতভাবে মৌলিক শব্দ বলে বিবেচনা করা যেত হয়ত বা।অথচ এগুলো যদি সংস্কৃতেই গৃহীত হয়েছে তবে সেগুলোকে তদ্ভব,এবং সেজন্যেই বাংলার মৌলিক শব্দ বলে গ্রহণ করা হচ্ছে।যেমন-- তামিল কাল̖ > সংস্কৃত-প্রাকৃত খল্ল̖ > বাংলা খাল̖।এমন কি,পশ্চিমা গ্রীক দ্রাখমে > সংস্কৃত দ্রম্য> প্রাকৃত দম্ম> বাংলা দাম—এহেন শব্দকেও বাংলাতে তদ্ভব,সুতরাং মৌলিক বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।এর মধ্যে সঙ্গতি কিছু নেই নয়,সংস্কৃতেই যদি এসব ভাষার নিজস্ব শব্দ হয়েছে এবং প্রাকৃত হয়ে বাংলাতে পালটে অথবা না পালটে এসেছে সেদিক থেকে বাংলাতে এগুলো প্রাচীন আর্যভাষারই উত্তরাধিকার।সুতরাং তদ্ভব বলা যেতেই পারে।কিন্তু ভুলেভালে হলেও যে প্রচুর সংস্কৃত পালি প্রাকৃত শব্দকে বাংলা পরে এমন কি অতি সম্প্রতি গ্রহণ করেছে সেগুলোকে সুনীতিকুমার ঋণশব্দের ধরলেও পরের কেউ ঋণ শব্দে ধরেন নি দেখে আমাদের কৌতূহল বাড়ে---কারণটি কী?তিনি নব্যভারতীয় আর্যের শব্দগুলোর শ্রেণিবিভাজন করেছিলেন এরকম:৯১
[1] Inherited words,forming the ‘speech commodity’ of MIA,which changed into NIA.,and consisting of—a) tadbhava words;b) borrowed Sanskrit words,or old tatsamas and semi-tatsamas;c) aboriginal borrowings, and words unexplained by Aryan roots: the deshi words;and d) a few foreign words,like the Persian and Greek.
[2] Borrowed words: a) Indian: Aryan.(i) From OIA. And MIA,(ii) From NIA. sister speeches,(b) From the non-Aryan Languages of India,and from extra-Indian non-Aryan speeches belonging to groups represented in India,(c) Extra-Indian (i) Persian (= Persian;and Arabic and Turki coming through Persian),and other Iranian,(ii) European and other foreign .
আমরা তাঁর উদাহরণগুলো বাদ দিয়ে শুধু বিভাজন এবং ব্যবহৃত পরিভাষাগুলো দেখালাম।দেখা যাচ্ছে যে তাঁর ‘Inherited’ কথারই বাংলা সুকুমার সেন বা পরবর্তীরা ‘উত্তরাধিকারী’ না করে ‘মৌলিক’ করছেন।তার মধ্যে ‘Sanskrit words,or old tatsamas’ –ও ‘borrowed’।এই কথাটি লক্ষণীয়, যা পরে ভাষাবিদ্যাতে চাপা পড়ে যাচ্ছে।‘দেশী’ মানে হচ্ছে ‘aboriginal’ borrowings।এটাও লক্ষ করবার মতো।দ্বিতীয় বিভাজন ‘ঋণ শব্দ’ তথা Borrowed words এর শুরুতেই আছে Indian:Aryan,তাও প্রথমেই From OIA. And MIA।তাও সংখ্যাটা খুব কম নয়,“a very large number of recent tatsamas and semi-tatsamas;from Pali and other Prakrit…”।৯২ আমাদের অনুমান বাংলা ব্যাকরণের পরিভাষাগুলোও হচ্ছে সেরকম সম্প্রতি আগন্তুক তৎসম বা অর্ধ-তৎসম ঋণশব্দ।প্রাক-ঔপনিবেশিক গীতিকবিতা,মঙ্গলকাব্য,সুফি গান কিংবা পালাগানের জমানাতে এগুলোর বাংলাভাষাতে প্রবেশ কঠিন ছিল।বাংলা ব্যাকরণ যখন সংস্কৃত ব্যাকরণের ধাঁচে লেখা শুরু হচ্ছে তখনই এগুলোর বাংলাতে প্রবেশাধিকার মেলা সম্ভব।এমনকি তৎসম-তদ্ভবাদি শব্দমালা যে প্রাকৃত ব্যকরণবিদেরাই ব্যবহার করেছিলেন, সে তো সুনীতিকুমার উল্লেখই করেছিলেন।৯৩সংস্কৃত ব্যাকরণবিদদের এসব শব্দ ব্যবহারের কোনো কারণ ছিল না। অন্যদিকে ‘বিদেশী’ শব্দগুলো হচ্ছে ‘Extra-Indian’।অর্থাৎ এগুলোও এককালে বিদেশী ছিল,কিন্তু কালে এখানে থেকে থেকে ভারতীয়ই হয়ে গেছে।তাই ‘অতি-ভারতীয়’ বা সম্প্রসারিত ভারতীয় ভাষাগুলোর শব্দ।তাঁর পূর্বসূরি বহু ভারতীয় ভাষাবিদের যে অহৈতুকী সংস্কৃত বা প্রাচীন ভারতীয় আর্যপ্রীতি ছিল—তাকে যে তিনি প্রত্যাহ্বান জানাচ্ছিলেন তার এটি এক বড় নজির বলেই মনে হচ্ছে।
বাংলাতে ‘তৎসম’ শব্দটি যখন প্রাকৃত ব্যাকরণ থেকে নিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে,তখন তার অর্থের বিস্তার ঘটাচ্ছেন সুনীতিকুমার।এ অনেকটা কাজ চালানো গোছের পরিভাষা।তিনি লিখছেন,“...this is rather a loose use of the word,which is only allowable on the ground that it is used with reference to the form of a word,and not with time or manner of its inclusion or admission in to the language.”৯৪ ‘time or manner’ ধরে শব্দগুলোকে চেনার কাজ সম্ভবত ‘Glottochronology’-ই করতে পারে।এবং সেটি হবে এক স্বতন্ত্র অধ্যয়নের বিষয়।আমরাও প্রশ্নগুলো শুধু তুলে রাখলাম পরবর্তী সেই অধ্যয়নের গুরুত্বটি উপলব্ধিতে রাখতে।আপাতত পারম্পরিক পথ ধরেই বাংলা-অসমিয়া-সিলেটি শব্দভাণ্ডারগুলো চেনার চেষ্টা করছি।
উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মৌলিক:
তৎসম শব্দ: মান বাংলা: সত্য,মিথ্যা,যোগ,পদ্ম,অক্ষ,দীক্ষিত,বন্য,চক্ষু,চন্দ্র,সূর্য,আশ্চর্য,অমৃত,ক্ষমা,ক্ষমতা,অন্ন, পানীয়,খাদ্য,ক্ষুধা,বৃক্ষ,গৃহ,নক্ষত্র,নিমন্ত্রণ,স্বামী,পুত্র,কন্যা ইত্যাদি।মান অসমিয়া তৎসম শব্দগুলোও একই।সেটিই স্বাভাবিক।‘অসম’ প্রদেশের নামটিও তৎসম শব্দ।যদিও উচ্চারণ স্বতন্ত্র।সিলেটিতে তৎসম শব্দের ব্যবহার কম বলেই জগন্নাথ চক্রবর্তী লিখেছেন।আমরা দ্বিমত পোষণের কারণ দেখি না।লেখার ভাষা নয় বলেই তৎসম শব্দের দরকার পড়েছে কম।তবে যখনই কোনো পালা বা গীত লেখা হয়েছে,যেকোনো প্রাক-ঔপনিবেশিক সাহিত্যের ভাষার মতো সিলেটের সেসব সাহিত্যের ভাষাও ‘সাধু’ হবার দিকে প্রবণতা দেখিয়েছে।আর সেখানে সিলেটি তদ্ভবের পাশে দিব্যি ঠাই করে নিয়েছে তৎসম শব্দাবলী।যেমন--- ধুড়া গিয়া সামাইল দিয়ড়ের ভিতর।মৎস খাইয়া ধুড়ার বাড়িল উদর।।৯৫ পিতা মাতা পির মুরশিদ মান শরব জন।বেহেশত পাইবে জান শেবিলে চরণ।৯৬এই সব কাব্যের সাধু বাংলা হয়ে উঠবার প্রবণতা আছে ঠিকই।সেদিন থেকে শুদ্ধাশুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।কিন্তু লেখকদের সিলেটি শব্দ এবং উচ্চারণ অনুসরণ প্রবণতাও সমানই সত্য।তাই সবটা অস্বীকার করা যাবে না।
অর্ধ-তৎসম শব্দ: কেষ্ট < কৃষ্ণ,চন্দর < চন্দ্র,পত্তর < পত্র,নেমতন্ন < নিমন্ত্রণ,গিন্নি < গৃহীনি,মাগ̖গি < মহার্ঘ,ছেরাদ্ধ < শ্রাদ্ধ,পুরুত < পুরোহিত,খিদে < ক্ষুধা,সুরুজ < সূর্য,পিরীতি < প্রীতি,মোচ্ছব < মহোৎসব,যজ্ঞি < যজ্ঞ,পরশ < স্পর্শ, যতন< যত্ন,রতন < রত্ন,জোছনা < জ্যোৎস্না,ধৈরজ < ধৈর্য,মরম < মর্ম,করম < কর্ম ইত্যাদি।অসমিয়া অর্ধতৎসম শব্দ অনেকগুলোই একই।যেমন-- পীৰিতি,ভকতি।কিছু শব্দের উচ্চারণ তথা বানান বাংলার থেকে ভিন্ন।যেমন-- সুৰুজ, চেনেহ,বৰষা।কিছু শব্দের গঠনও বাংলার থেকে ভিন্ন।যেমন-- বাইক < বাক্য,শইচ < শস্য,শৱদ < শব্দ ইত্যাদি।
তদ্ভব,সংস্কৃত থেকে: আধ < প্রা.অদ্ধ < সং.অর্ধ,আড়াই < অডঢ̖তইঅ < অর্ধ তৃতীয়,ইঁদারা< ইন্দ্রাআর < ইন্দ্রাগার,হাত< হত্থ<হস্ত,ওঝা =অস.ওজা/অজা< উবজ̖ঝাঅ < উপাধ্যায়,উনান < উণ̖হাবণ< ঊষ্ণাপন,আসে(< আইসে)=অস.আহে,আবিসই <আবিশতি,ষোল<সোলহ<ষোড়শ।তেমনি আরো কিছু তদ্ভব গা, চোখ, বুক, কনুই, মা, দেওর, বিয়ে, তেল, তিতির, লোহা, তামা, কাপড়, পাখা, ভালো, মিছা, মুই, আমি, তুই, সাড়ে, আর ইত্যাদি। খুব স্বাভাবিক যে অসমিয়া শব্দগুলোর কিছু বাংলার মতো একই।যেমন—মা,হাত,হাতী,আজি।কিছু বানানে বা উচ্চারণে ভিন্ন যেমন---ষোল /xolɔ/,দহ̖।কিছু গঠনেই ভিন্ন।যেমন—চকু,সঁচা,দাপোণ।
তদ্ভব,অস্ট্রিক থেকে: ঢাক < ঢক্ক < ঢক্ক,টং < টঙ্ক< টঙ্ক।
তদ্ভব,দ্রাবিড় ভাষাগুচ্ছ থেকে: মোট < প্রা.মুডঅ < সং.মুটক < তামিল মুটই,ঘড়া < ঘড় < ঘট < কন্নড় কোড, তামিল-মালয়ালম কুটম,খাল < খল্ল < খল্ল < কাল,পিলে(ছেলেপিলে,ছেলেপুলে) < পিলুঅ < পিল্লিক < তামিল পিল্লৈ, উলু (খড়) < উলুঅ < উলুপ < তা.উলবৈ, ইঁচলা/ইচা (মাছ) < ইঞ্চঅ < ঈঞ্চক< তা.ইরবু।
তদ্ভব,ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুচ্ছ থেকে: বাং.-অস.-সিল.দাম < দম্ম < দ্রম্য < গ্রীক দ্রাখমে,সিমুই (ময়দা) < সমিতা < সমিতা < গ্রী.দেমিদালিস,বাং.-অস.-সিল.পুথি < পুত্থিঅ < পুস্তিকা < পহ্লবী পোস্ত,সুড়ং/ সুড়ঙ্গ=সিল.সুরুং < সুরঙ্গ< সুরুঙ্গ < গ্রী.সুরিংকস,কাহন (খড় গুণবার একক) < কাহাবণ < কার্ষাপণ < প্রাচীন ফার্সি কর্শ।
তদ্ভব,তুর্ক-মোঙ্গল মাঞ্চু ভাষাগুচ্ছ থেকে: তুরুক < তুরুক্ক < তুর্কী তুর্ক,ঠাকুর < ঠক্কুর < ঠক্কুর < তু. তিগির।
অন্য ভাষার থেকে আগন্তুক:
দেশী,অস্ট্রিক উৎস থেকে: উচ্ছে,ঝিঙ্গা,ডাঙর,ডিঙ্গি,খোকা,খুকি,... ।
বিদেশী,আরবি:আদমি,একতিয়ার,উশুল,খাজনা,খারিজ,জমি,জমা,তালুক,তহশীল,নাজির,বাং.-অস.-সিল. মহকুমা, হদ্দ, হিসাব=অস.হিচাপ, বাং.-অস.-সিল.আইন, বাং.-অস.-সিল.আদালত, বাং.-অস.-সিল.উকিল, বাং.-অস. -সিল.খাতা, বাসন, বাং.-অস.-সিল.আল্লা, বাং.-অস.-সিল.ইমান, বাং.-অস.-সিল.ঈদ, বাং.-অস.-সিল.কবর, বাং.-অস.সিল. মশজিদ, বাং.-অস.-সিল.নমাজ/নামাজ, আমীর, উজীর, দৌলত, আদব, কায়দা, এলেম, কেচ্ছা=সিল.কিচ্ছা, হরফ, আসল, ওজন, কদম, দখল, ইহুদি, হাবসি ইত্যাদি।
বিদেশী,ফার্সি: সিপাই/সিপাহী, গোমস্তা, দপ্তর, পেয়াদা/পিয়াদা, পেশকার, পেশা, বাজেয়াপ্ত, দরবেশ, শিকার,হিম্মত, বাহাদুর, আয়না, আচকান, কিশমিশ—সিল.কিছমিছ, খানসামা, আঙুর, দস্তানা, মশলা, মুহুরী, মীনা, মিছরি, রুমাল, রেশম, শাল,শানাই, বাং.-অস.-সিল.বাগিচা, বাং.-অস.-সিল.বাদাম, দালান, তক্তা, পোলাও, হালুয়া, পায়জামা, গোলাপ, সেতার, মুন্সী, শাকরেদ, আওয়াজ, আবহাওয়া, অন্দর, আসমান, ইয়ার, দরকার, বজ্জাত, কম, তাজা, দোকান, দানা, চাকর, চাঁদা, গরম, জাহাজ, ইংরেজ, হিন্দু ইত্যাদি।
বিদেশী,ফার্সি-আরবি: আদমশুমারি,দস্তখত,নাবালক,বাং.-অস.-সিল.দারোগা ইত্যাদি।
বিদেশী,ফার্সি-তুর্কী: গালিচা,কাবু,কাঁচি,কোর্মা,খাতুন,খাঁ,বিবি,বেগম,মুচলেকা,লাশ ইত্যাদি।
বিদেশী,পোর্তুগীজ:ক্রুশ,গরাদ,জানলা,নোনা,বালতি,যিশু,পেঁপে,তোয়ালে,সাবান,বোতাম,মিস্ত্রী,নিলাম,ফিতা,কাবার, কামিজ, সেমিজ, গামলা, কপি, মার্ক্স, আলপিন, আলমারী, পেয়ারা, বেহালা, পেরেক, পাচার, বারান্দা ইত্যাদি।
এই বিদেশী ঋণ শব্দগুলো সামান্য দুই একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে অসমিয়াতেও একই।বানানে বা উচ্চারণে যা কিছু ভিন্নতা নিয়ে রয়েছে।যেমন-- অসমিয়াতে ‘চাহাব’ বাংলাতে ‘সাহাব’/sɐɦɐb/ এবং /ʃɐɦɐb/।‘তোয়ালে,পেয়ারা, কেচ্ছা’ এমন কিছু শব্দ অসমিয়াতে ব্যবহৃত হয় না।এই মাত্র।
এছাড়াও কিছু ফরাসী,দাচ ইত্যাদি ব্যাকরণে পরিচিত শব্দ আছে।ইংরেজি থেকে নিত্য নতুন শব্দ আসছে। এগুলোর তালিকা বাহুল্য ভেবে বাদ দেয়া গেল।ইংরেজির সূত্রে পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার শব্দও ভাষাতে নিত্য আসছে। বহুদিন ধরে বাংলাতে প্রবেশ করে রূপ পালটে ফেলেছে এমন ইংরেজি শব্দও বাংলা–অসমিয়াতে কম নেই।যেমন---হাসপাতাল,লণ্ঠন,গেলাস ইত্যাদি।অসমিয়াতে হাসপাতাল,গিলাচ,বাকচ ইত্যাদি।কিছু বাংলা-অসমিয়া শব্দ ইংরেজির বাচন অভ্যাসের প্রভাবে অনুবাদে তৈরি হয়েছে।যেমন– দুঃখিত <sorry, বাধিত <indebted, সুপ্রভাত < good morning, হাতঘড়ি < wristwatch, অতিসাম্প্রতিক শব্দ দূরভাষ < Telephone।একটি সাম্প্রতিক বাংলা মিশ্র বা সঙ্কর শব্দ ‘মুঠোফোন’-এর তো সরাসরি কোনো ইংরেজি রূপও নেই।এছাড়াও আছে প্রচুর ভারতীয় ভাষার থেকে সম্প্রতি আসা শব্দ।যেমন হিন্দি থেকে অসমিয়া বাংলা দুই ভাষাতেই এসেছে---বন্ধ̖,মজ̖দুর̖;তিব্বতি –লামা ইত্যাদি।হিন্দি লাগাতার̖ বা গুজরাটি—হর̖তাল̖ অবশ্য বাংলাতে এলেও অসমিয়াতে আসে নি।অসমিয়াতে বাংলার থেকেও ঋণ শব্দ আছে—তিচি, লুচি,গজা ইত্যাদি।তেমনি সাম্প্রতিক অসমে বাংলাতেও বেশ কিছু অসমিয়ার থেকে ঋণ শব্দ প্রবেশ করছে।যেমন-- উপায়ুক্ত,বিহু,ফুলাম গামোছা ইত্যাদি।গোলোকচন্দ্র লিখেছেন,“বিশ,একৈশ,বাইশ,ত্রিশ,চল্লিশ আদি সংখ্যাবাচক শব্দবোর হিন্দী-হিন্দীস্থানী ভাষার পরা আহিছে।”৯৭ সুনীতিকুমার সংখ্যাশব্দের আলোচনা করতে গিয়ে বাকি আর্যভাষাগুলোর সঙ্গে অসমিয়ার আলোচনাও করেছেন।৯৮ তাতে এই সংখ্যাশব্দগুলোকে তদ্ভব না বলে হিন্দির থেকে সাম্প্রতিক ঋণ বলবার আমরা কোনো কারণ খোঁজে পাইনি।গোলকচন্দ্র গোস্বামীও বিশেষ কোনো ব্যাখ্যা করেন নি।বাণীকান্ত কাকতি করেছেন,“সংস্কৃত উষ্ম ধ্বনিবোরর উচ্চারণ অসমীয়াত সমবেশভাবে স হৈ পরাগুণে সং উষ্ম ধ্বনির ঠাইত (অসমীয়াত) উষ্মধ্বনি রক্ষা করা সংস্কৃতমূলর শব্দবোর হিন্দুস্তানী বা আন পশ্চিমীয়া উপভাষার পরা অহা।”৯৯ তিনি উদাহরণগুলো দেখিয়েছেন এইভাবে ‘বাইচ্,একুৰি দুই;তেইচ্,একুৰি তিনি’।অসমিয়াতে ‘বাইচ্’-এর বদলে ‘একুৰি দুই’ বলাটি লৌকিক অসমীয়ার স্বাভাবিক প্রবণতা বটে।কিন্তু সে কারণেই তিনি ‘বাইচ̖,তেইচ̖’-কে পশ্চিমাভাষার থেকে ঋণ বলেন নি।এর পরেই লিখেছেন,“উষ্মধ্বনি বুজাবলৈ অসমীয়া আখর জোঁটনিত চ ব্যবহার করা হয়।”১০০ অর্থাৎ শব্দের শেষে একক ‘শ’ ধ্বনিটির উচ্চারণ /x/ না হয়ে /s/ থেকে যাওয়াতেই এগুলোকে অসমিয়াতে ঋণশব্দ বলছেন।এইখানে আসলে সমস্যাটি সরল হবার চেয়ে জটিল হয়ে পড়ে।কারণ শব্দগুলো বাংলাতেও আছে।আমরা কি মেনে নেবো,সেখানেও শব্দগুলো হিন্দুস্তানীর থেকে ঋণ করা?চর্যাপদেও এমন সংখ্যাশব্দ রয়েছে—‘বত্তিস জোইণি তসু অঙ্গ উল্লসিউ’(চর্যা:২৭)।এর থেকে অসমিয়াতে আসে নি কেন?বাণীকান্ত ধ্বনি প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে পরে লিখছেন,“সংখ্যাবোৰৰ এক বিশেষত্ব আছে।শ-ৰে জোঁটালেও সেইবোৰে উষ্ণধ্বনি রক্ষা করিছে।”১০১ অসমিয়া,“প্রাচীন সাহিত্যত হাতেলিখা পুথির জোঁটনি বিভিন্নরূপী;যেনে দস̖,দষ̖,দহ̖;পঞ্চাস̖,পঞ্চাশ̖;চবিচ̖,পঞ্চিস̖ ইত্যাদি।সংখ্যাবোরর শ-র চ/स/ উচ্চারণ খুব সম্ভব এটা আমদানীকৃত উচ্চারণ আরু ই হিন্দুস্তানী প্রভাবর ফল।”১০২ তাঁর ‘খুব সম্ভব’ কথাটি লক্ষণীয়,তার মানে তিনি নিশ্চিত নন। প্রশ্ন হলো,বহু উত্তর ভারতীয় ভাষার সমন্বয়ে গড়ে উঠা ‘হিন্দুস্তানী’ ভাষা বলে এখন যাদের চিনি তার বয়স এত প্রাচীন ছিল কি না।কবির দাস কিংবা তুলসিদাসেরা তো নিজেদের সাহিত্য রচনা করেছিলেন দুই ভিন্ন ভাষাতে।প্রথমটি যদি ‘সাধুক্কড় বোলী’ বা ‘ব্রজভাষা’ বলে পরিচিত ছিল,দ্বিতীয়টি তবে কোসলী বা অবধি।‘খড়ি বোলী’র থেকে যে আধুনিক হিন্দি ভাষা এবং সাহিত্য দাঁড়িয়েছে সুনীতিকুমার লিখেছেন,“১৮৫০এর পূর্বে এই ‘খড়ি বোলী’ হিন্দি সাহিত্যিক অস্তিত্ব একরকম ছিল না বলা চলে।”১০৩ সুতরাং ‘হিন্দুস্তানী’ বলবো কাকে? আর বললে পরে মনে হবে শব্দগুলো সম্প্রতি এসেছে অসমিয়াতে।এমনটাতো নয়।অসমিয়াতে শংকরদেব ‘ব্রজবুলি’- পদ লিখেছিলেন।সেগুলো অসমিয়া জনসমাজে নিত্য গান করা হত। সে কারণে শ/স-এর সংখ্যাশব্দগুলোতে এই ‘চ’-এর উচ্চারণ অভ্যাসটি থেকে যাওয়া সম্ভব। এমনিতেও দশ কিন্তু প্রায়ই ‘দহ̖’ হচ্ছে।
জগন্নাথ চক্রবর্তী সিলেটি শব্দের ‘মৌলিক’,‘কৃতঋণ’ ছাড়াও তৃতীয় আরেক ভাগের কথা লিখেছিলেন ‘স্থানিক’ শব্দ। এগুলো কিন্তু ‘দেশী’ নয়।তিনি এগুলোর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লিখেছেন এইভাবে,“বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলায় অনেকগুলি শব্দের সন্ধান পেয়েছি যেগুলি মৌলিক বা আগন্তুক কোনো শ্রেণীতেই পড়ে না।এ জাতীয় শব্দকে অনেকে অজ্ঞাত মূল বলে আখ্যায়িত করেন।আমি কিন্তু এগুলির মূল পেয়েছি এই অঞ্চলের মাটিতেই।এই শব্দগুলি সৃষ্টি হয়েছে তিনটি প্রক্রিয়ায়: এক,মৌলিক বা কৃতঋণ শব্দের ঐতিহ্যলব্ধ শব্দার্থ জ্ঞানের আধারে প্রবর্তিত।দুই,গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় বিশেষের পারিভাষিক ও পরিবার বিশেষের নিভাষিক শব্দের অন্তর্ভুক্তি।তিন,বিষয় বা বস্তুর ধর্ম অথবা ধ্বনি ইত্যাদি থেকে তাৎক্ষণিক আবিষ্কৃত।”১০৪ তিনি অচিলা,আউজ,ইচিলা,উছানি,ঘাড়ুয়া,চিকা,ছুবে,টনটনি,ঠনা,ডমকা,ডরি,ঢেরি,তখইল,থুনি,ধুড়া,দুলানি,নিআরি,পালই,বরালি,বুচি,মচা,লাই,শাইর,হিজা,হেদা---এরকম প্রায় একশত শব্দের একটি তালিকা দিয়েছেন।যে তিনটি প্রক্রিয়াতে শব্দগুলো এসেছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন সেগুলোই বলে দেয়,সেগুলোকে ‘মৌলিক’ বা ‘কৃতঋণ’ থেকে আলাদা করবার মানে হয় না।তিনি প্রতিবেশী ভাষাবৈচিত্র্য কিংবা ভাষাতে শব্দগুলো আছে কিনা তার কোনো তুলনামূলক অধ্যয়ন করেন নি।অন্য যারা এগুলোকে ‘অজ্ঞাতমূল’ বলেছিলেন তারাও করেন নি বলেই আমাদের মনে হয়।ফলে একরকম জোর করেই এগুলোকে একটি উপত্যকার নিজস্ব সম্পদ বলে দাবি করে ফেলবার মতো হয়েছে।‘হিজা’ শব্দটির অসমিয়াতেও অর্থ একই-- ‘সেদ্ধ হওয়া’।শুধু বানান এবং উচ্চারণ ভিন্ন ‘সিজা’ /xijɐ/। ‘সিদ্ধ’-র থেকে আসা তদ্ভব শব্দ এটি।তৎসম বুদ্ধয়তি > বুঝে,সম্বুদ্ধয়তি > সমঝে,তেমনি সিদ্ধয়তি> সিঝে> সিজে =হিজে=>হিজা ইত্যাদি।তেমনি ‘লাই’ অসমিয়াতেও একরকমের ‘শাক’ এবং তিওয়া ভাষাতে ‘লাই’ বললে সম্ভবত সমস্ত পাতাকেই বোঝায়।১০৫ককবরকেও তাই বোঝায়।১০৬ বডোতে চিঠি অর্থে পত্রকে বলে ‘লাইজাম’১০৭ ‘হালি’ কিংবা ‘আলি’ ধানের চারা অর্থে কোনোভাবেই অভিধানে শব্দটিকে রাখবার সুযোগ নেননি জগন্নাথ।কিন্তু ‘বরালি’ লিখেছেন বড়+হালি (ধানের চারা)।১০৮ ‘হালি’ সংস্কৃত ‘হরিৎ’ থেকে আসা তদ্ভব শব্দ,এইভাবেই দেখিয়েছেন আবিদ রাজা মজুমদার।১০৯ সুতরাং এটি স্পষ্ট যে এটি তদ্ভব শব্দ এবং অর্থ সংক্রমিত হয়েছে।অসমিয়াতে ‘বৰালি’ শব্দে এক বিশেষ ধরণের মাছ বোঝায়।সেই থেকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলাতেও মাছনামটি ঢুকে গেছে।তেমনি ‘নিআরি’ শব্দটিও অসমিয়াতে আছে ভিন্নার্থে ‘সোজা’,‘সুশৃঙ্খল’,‘লোহার তৈরি হাতুড়ে যন্ত্র’ ইত্যাদি।১১০সিলেটিতে ‘নিআরি’ শব্দের অর্থ মৃদঙ্গ,পাখোয়াজ ইত্যাদি গলায় ঝোলাবার জন্যে ব্যবহৃত কাপড়।‘ধুড়া’ অসমিয়াতে ‘ধোঁৰা’ বা ‘ঢোঁৰা’ --একটি নিরীহ সাপের নাম।মান বাংলাতে শব্দটি ‘ধোড়া’ বা ‘ঢোঁড়া’।রবীন্দ্ররচনাতে আছে,“হায় হায়!জন্মেজয় যখন সর্পসত্র করিয়াছিলেন তখন কি গোটাকতক ঢোঁড়া সাপই মরিয়াছিল,তোমাদের মত বিষাক্ত বুদ্ধিমান সাপগুলা ছিল কোথায়?”১১১ শব্দটি ‘দ্রোণ’ শব্দ থেকে এলেও আসতে পারে।বঙ্গীয় শব্দকোষে ‘ধোড়াকাক’ শব্দের ব্যাখ্যাতে লেখা আছে, সং.দ্রোণকাক,ত্রিপুরাতে ‘ধুড়াকাক’,অর্থ দাঁড়কাক।১১২‘ডরি’ অসমিয়াতে সামান্য ধ্বনিরূপ বদল করে ‘দোৰা’ বা ‘ডোৰা’১১৩ দুটোই মাছ ধরবার উপকরণ।প্রথমটি আকারে ছোট, বাঁশে তৈরি।দ্বিতীয়টি সুতোয় তৈরি বড় জাল,দু’জনে ধরে টানতে হয়।সুতরাং শব্দগুলো স্থানীয় যদিও বা হয়---সেগুলোর স্থান বড়াইলের দক্ষিণে মাত্র নয় উত্তরেও বিস্তৃত।আর শুধু বরাক নয় সুরমা পেরিয়ে কর্ণফুলি অব্দি এগোলেও এগোনো যাবে বলেই মনে হয়।তবে কিনা সবগুলো না হলেও ‘ডরি, হিজা’র মতো কিছু শব্দতো আছেই যেগুলো মান বাংলাতে মেলে না।সেগুলোকে নিয়ে সমস্যা একটি আছেই।সমস্যাটি সুধাংশু শেখর তুঙ্গকেও ভাবিয়েছিল।তিনি তাই গোড়াতেই সিলেটি শব্দকে,অর্থকে নয় সুকুমার সেনের মতো,--- মুখ্য এবং গৌণ এই দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন।ইংরেজিতে লিখেছেন ‘Primary’ এবং ‘Secondary’।১১৪ প্রাথমিক বা মুখ্য সেগুলো যেগুলো মোটের উপরে সমস্ত আর্যভাষাতেই অবিকৃত মেলে।এবং গৌণ সেগুলোই---যেগুলো সিলেটি এবং প্রতিবেশী ভাষাতে মেলে—সেগুলো আসতে পারে আর্য বা অনার্য যেকোনো ভাষামূল থেকেই।তিনি এর পরে প্রচুর ‘Secondary’ তথা গৌণ শব্দের তালিকা দিয়েছেন।‘Primary’ বা মুখ্য শব্দকে স্পর্শ মাত্র করেন নি।আমাদের ধারণা,স্পর্শ করলে দেখা যেতো,তৎসম শব্দাবলীর কিছু বাদ দিলে গুজরাটি পাঞ্জাবি সহ সব আর্যভাষাতে সাধারণ শব্দ বলে সেরকম কিছু নেই,আবার ‘কাছাড়ি’ (তিনি সমগ্র সিলেটিকে হিসেবে নেন নি) শব্দগুলো শুধু কাছাড়ি বা প্রতিবেশী ভাষাতেই নেই,প্রতিবেশী অঞ্চলেও রয়েছে।
জগন্নাথ চক্রবর্তী তেমনি ‘ভাষা-উপাদানের সংরক্ষণ’ নামে উপ অধ্যায় একটি সংযোজন করেছেন।যে ভাষাবৈচিত্র্য লেখার ভাষা নয় তাতে যে ভাষার প্রাচীন ঐতিহ্য এবং উপাদান সংরক্ষিত থাকে সেসব জানা কথাই। সিলেটিতে সেরকম বেশ কিছু সংরক্ষিত শব্দের একটি চিত্তাকর্ষক তালিকা দিয়েছেন জগন্নাথ চক্রবর্তী।পালি-প্রাকৃত, দ্রাবিড়,আরবি –ফার্সি,পোর্তুগিজ,ইংরেজি কিছুই বাকি যায় নি।যেমন দেঅর (=প্রাকৃত দেঅর > মান বাং. দেওর),মিচ̖ছা (=প্রাকৃত মিচ্ছা > মান বাং. মিছা),পন̖দ̖র̖অ (=প্রা. পন্নরঅ),তখ̖তা (=ফার্সি তখ̖তা > মান বাং. তক্তা ),জিদ̖ (আরবি জিদ̖ > মান বাং. জেদ̖),আনানস̖ (= পোর্তুগিজ আনানস̖ > মান বাং. আনারস)। কিন্তু সেখানেও বেশ কিছু গোলমেলে ব্যাপার আছে।যেমন ‘আনারস’-ও একটি সিলেটি শব্দ।তেমনি দক̖খিন (=প্রাকৃত দক̖খিন > মান বাং. দক্ষিণ) কষ্ট কল্পনা বলেই মনে হয়।উচ্চারণে মান বাংলা শব্দটিও একই।সেরকমই কষ্ট কল্পনা কামার (< দ্রাবিড়.কম্মার > মান বাং.কর্মকার)।প্রথমত শব্দটি দ্রাবিড় হতে যাবে কেন?তদ্ভব হতে অসুবিধে কী,ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে।দ্বিতীয়ত কামার এবং কর্মকার –দুই রূপেই শব্দটি সিলেটি এবং মান বাংলাতে রয়েছে।সুতরাং সংরক্ষিত হলে দুই ভাষাবৈচিত্র্যেই হয়েছে। ‘কুড়ি’-কে তিনি অস্ট্রিক নয়,বলছেন দ্রাবিড় শব্দ।এবং তার থেকে জাত সিলেটি এবং মান বাংলা দুইয়েতেই শব্দটি যে ‘কুড়ি’-- নিজেই লিখেছেন।তেমনি ইংরেজি film যদি সিলেটিতে ‘ফিলিম̖’ আর মান বাংলাতে ‘ফিল̖ম̖’ হয়েছে।তার মানে সংরক্ষিত মান বাংলাতেই হয়েছে,সিলেটিতে শব্দটি স্বরভক্তির শিকার হলো।সুতরাং অধ্যায় শিরোনাম আমাদের বিশেষ কোনো কাজে আসে না,একটি বাড়তি শব্দ তালিকা পাবার বাইরে।
।। দেশী শব্দ এবং উৎসের অনিশ্চয়তা ।।
দেশী শব্দগুলো নিয়ে একটি বড় সমস্যা আছে।বাংলাতে প্রায় সমস্ত ভাষাবিজ্ঞানের বইতে একই শব্দগুলো ঘুরে ফিরে এসে থাকে।এবং কোনটি অস্ট্রিক,কোনটি দ্রাবিড়,কোনটিবা তিব্বতবর্মী উৎসের থেকে আসা---সেই নিয়ে নানা মুনির নানা মত।যেমন অতীন্দ্র মজুমদার “বাংলাদেশের বহু গ্রাম নামে এই অস্ট্রিক বা দ্রাবিড় বর্গের ভাষার ছাপ আছে”১১৫ লিখে বেতড়,বালুটে এমন কিছু স্থান নামের সঙ্গে উচ্ছে ঝিঙ্গা আদি কিছু শব্দ তুলে দিয়েছেন।স্পষ্ট করেন নি কোনটির কী উৎস।তিব্বত বর্মীর কোনো উল্লেখই নেই।সুকুমার সেনও এই শব্দগুলোই উল্লেখ করেছেন ‘আর্যেতর ভাষার শব্দ’ বলে।১১৬মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সিলেটি সহ পুব বাংলার ভাষাগুলোর ঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনিগুলোর ‘মধ্যপ্রাণী’ভবন তিব্বত-বর্মী ভাষার প্রভাবে বলে স্বীকার করলেও লিখেছেন,“কিন্তু বাঙ্গালা ভাষার গঠনে একমাত্র মুণ্ডা বা কোল ভাষা ভিন্ন অন্য অনার্য ভাষার প্রভাব নাই বলিলেই চলে।”১১৭ এই ধারণার থেকে তিনি একটি মুণ্ডারি,সান্তালি উৎসের শব্দের তালিকা দিয়েছেন।কিন্তু উপযুক্ত অধ্যয়নের অভাবে সেটিকেও ‘পরীক্ষামূলক’ বলেই উল্লেখ করেছেন।১১৮ আমরা তার শব্দগুলো এখানে তুলে দিচ্ছি : সান্তালি--- আকাল,আখড়া,বড়শী,বট(গাছ), বয়ার, বেঁটে। মুণ্ডারি--- চাউল, ডোঙ্গা। মুণ্ডারি-সান্তালি, চুলা, ডেলা, ঢাল, হাঁ, হুড়কা, কালা(বধির), খচ্চর, খুঁটি, মোট, মোটা, নেঙ্গা, রাঁড়(বিধবা, বেশ্যা), লড়াই, ঢোঙ্গা, তোতলা।এইসব তথ্য অনেকটাই তিনি সংগ্রহ করেছেন সেপ্টেম্বর,১৯২৩শে ক্যালকেটা রিভ্যুতে প্রকাশিত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নিবন্ধ ‘The Study of Kōl’ প্রবন্ধ থেকে।প্রবন্ধটির উল্লেখ ওবিডিএল-এ স্বয়ং সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ও করেছেন প্রাসঙ্গিক পাঠ্য হিসেবে।দেখা যাচ্ছে ধ্বনি এবং রূপতত্ত্বে এই সব অনার্যভাষার প্রভাব নিয়ে কিছু বিতর্ক বাদ দিলেও সংশয়টি কম।প্রাচীন আর্যভাষাতে অনার্য শব্দ নিয়েও সংশয় ততটা নেই যতটা আছে নবীন আর্যভাষা নিয়ে।সুনীতিকুমার স্পষ্টই লিখছেন ওবিডিএল-এ “Quite a number of words in IA. have been traced to a Dravidian origin.A great many are undoubtedly Kōl or Austro-Asiatic.”১১৯কিন্তু পরবর্তী ঋণ নিয়ে স্পষ্ট কোনো দিশাও তিনিও দেখাতে পারেন নি।এমনকি দ্রাবিড় আর্যভাষার তুলনামূলক অধ্যয়ন করছেন যে পরিশিষ্ট অংশে সেটিরও নামে ‘probable’কথাটি লক্ষ করবার মতো,“Points of Similarity Between Indo-Aryan And Dravidian, Showing Probable Influence of The Latter.”১২০ ফলে এই সব শব্দের কোনটি বা অনার্য ভাষার থেকেই এসেছে,কোনটি বা আর্যভাষার থেকেই সেই সব ভাষাতে গেছে এই নিয়ে অসমিয়া –বাংলা দুই ভাষাতেই ভাষাবিদদের মধ্যে সংশয়ের অন্ত নেই।
গোলকচন্দ্র গোস্বামীর স্থিতিও একই।তিনি ‘চাউল,সোলেং,তেঁতেলী,ঘোঁৰা,লাউ,তামোল,ক’লা,ম’ৰা,কপাহ’ এমন কিছু শব্দকে ‘দেশী’ বলেছেন।১২১কিন্তু সেগুলো অসমিয়াতে ‘সংস্কৃত আরু প্রাকৃত-অপভ্রংশ স্তরতে সোমোয়া’ বলে উল্লেখও করেছেন।তার মানে এগুলো তদ্ভব।কোল,মুণ্ডা,ভোটবর্মী বডো-কছারী,তাই-আহোম শব্দাবলী অসমিয়া ভাষাতে প্রবেশ করবার কথা তিনি অস্বীকার করেন নি।কিন্তু “তেনে শব্দবোৰৰ স্পষ্ট সম্ভেদ এতিয়ালৈকে উদ্ধাৰ হোৱা নাই।”১২২ অনেকেই যে অমুক শব্দ তমুক ভাষা বা ভাষাগুচ্ছের থেকে এসেছে বলে দাবি করেন,এই প্রবণতাকে খানিকটা কড়া ভাষাতেই সমালোচনা করে লিখেছেন,“তোমালোকে এই বিষয়ে মনত রাখিবা,অসমীয়া বহুতো জনা-বুজা লোকেও কোলারী,মুণ্ডারী,খাচী,মালয়ান আদি ভাষার পরা কিছুমান শব্দ অসমীয়ালৈ অহা বুলি দেখুয়াই ডঃ বাণীকান্ত কাকতির দোহাই দিয়ে।ডঃ কাকতিয়ে তেখেতর ‘অসমীয়া ভাষার উদ্ভব আরু বিকাশ’ গ্রন্থত তেনেবোর শব্দর উৎসর কথা খাটাংকৈ কোয়া নাই;মাথোন ধ্বনি আরু অর্থর মিল থকা শব্দ কিছুমানর তালিকাহে দাঙি ধরিছে।”১২৩ বস্তুত তাঁর এই সতর্কবাণীই আমাদেরকেও বাংলার দিকে তাকাতে বাধ্য করে এবং আমরাও লক্ষ করি যে কথাগুলো বাংলার সম্পর্কেও সত্য। বাণীকান্ত কাকতি তাই বিষয়টির আলোচনা ‘অসমীয়া শব্দসম্ভার’ অধ্যায়ে করেনই নি।স্বতন্ত্র যে অধ্যায়ে করেছেন তার নামটাই হলো ‘অসমীয়া শব্দসম্ভারত অনার্য শাব্দিক সমরূপতা’ অধ্যায়ের শুরুতেই স্পষ্ট লিখেছেন,“এই ছেদ আগ বঢ়াওঁতে দিয়া বর্ণনার কিছু পরিমাণে সীমিতকরণর প্রয়োজন আছে।অনার্য ভাষাবোরর তুলনামূলক ব্যাকরণ এতিয়াও সম্পূর্ণকৈ স্থিরীকৃত হোয়া নাই আরু সেইবোরত পোয়া যি কোনো শব্দর সঠিক মূল সম্পর্কে কোনো নিশ্চিত হব নোয়ারে। তলর তালিকাখনত থকা অজ্ঞাত মূলর অসমীয়া শব্দবোরেরে সৈতে তুলনা করিবলৈ অনার্য শব্দবোর বাছোঁতে ধ্বনির আরু অর্থর সদৃশতাকে একমাত্র পথপ্রদর্শক নীতি করি লোয়া হৈছে (যিটো কাম অবশ্যে ব্যুৎপত্তির নিশ্চিত নীতি নহয়)। কেবল তুলনার বাহিরে,সেই কারণে,আন একো ইঙ্গিত দিব খোজা নাই আরু অনার্য অন্তর্ভুক্তির প্রত্যেকটো মন্তব্যকে এই সীমিতকরণর উক্তির অধীন বুলি ধরিব লাগিব।”১২৪এর পরে তিনি আলাদা করে খাচী,বডো,আহোম ইত্যাদি ভাষাগুচ্ছের প্রচুর অসমিয়া সমরূপ শব্দের তালিকা তুলে ধরেছেন।একেবারে শেষে এই বলে সর্তক করে দিয়েছেন,“অনার্য ভাষাবোরে অসমীয়ার পরা ইমানকৈ ঋণ লৈছে যে সজাতীয় অনার্য ভাষাবোরত তেনে শব্দ আছে নে নাই তাক নিশ্চয় নকরাকৈ কোনো এটা শব্দ অনার্য ভাষার বুলি কোয়া টান।অনার্য ভাষাবোরর পরা (অসমীয়াই) লোয়া ঋণকৃত শব্দ বর বেছি যেন নালাগে।আটাইখিনি অনার্য ভাষার সম্পূর্ণ অনুসন্ধান নকরালৈকে (অসমীয়াত) সিহঁতর প্রভাব শুদ্ধকৈ নির্ণয় করিব নোয়ারি।”১২৫অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের বিকাশে ছ’শ বছরের আহোম শাসনের বিশাল ভূমিকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।তার পরেও বাণীকান্ত কাকতির সিদ্ধান্ত আহোমেরা “অসমীয়া শব্দসম্ভারলৈ কেইটামান শব্দহে অবদান আগবঢ়ালে।”১২৬
এর মানে এই নয় যে ভাষাগুলোর কোনধরণেরই ঋণ নেই অসমিয়াতে,এতটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি আর্য ভাষা।এই ধরণের ঋণের শুরু হয় অবিভাজ্য ধ্বনি স্বরে।কারণ বহু বক্তা স্বয়ং অন্যভাষার বাচন অভ্যাসে প্রবেশ করছেন।অসমিয়া বা সিলেটি যখন নতুন ইংরেজি বলতে শুরু করেন,তখনই এসব সহজেই নজরে পড়ে।সিলেটি স্বরে ইংরেজি শোনার অভিজ্ঞতা অনেকরই থাকবে।বস্তুত মান বাংলা বলবার সময়েও সিলেটি সহজে তার স্বরের বাচন অভ্যাসটি সহজে ছাড়তে পারেন না।তারপরে বা একই সময়ে ঋণ,অথবা নবার্জিত ভাষাতে একে ‘দেনা’ও বলা যেতে পারে--সেসব ঘটে বিভাজ্য ধ্বনিতে এবং তদের উচ্চারণ রীতিতে,রূপতত্ত্বে এবং সম্ভবত বাক্যগঠন রীতিতেও।সংস্কৃত বাক্যের শব্দের অবস্থান তত গুরুত্বপূর্ণ নয়, রূপতাত্ত্বিক গঠনই মূল কথা।অন্যদিকে চীনা ভাষাতে রূপতাত্ত্বিক গঠন নিরর্থক,শব্দের অবস্থান ভিন্ন বাক্যের অর্থ বোঝা কঠিন।বাংলা সহ আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলো যে এর মাঝামাঝি রীতি অনুসরণ করে সেই প্রবণতা আদি মধ্যভারতীয় আর্যভাষাগুলো থেকেই দেখা যায়।এবং এ ব্যাপারে দ্রাবিড় ভাষার সঙ্গে সাদৃশ্য নিয়ে এক চিত্তাকর্ষক মন্তব্য করেছিলেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়,“A sentence in a Dravidian language like Tamil or Kannaḍa becomes ordinarily good Bengali of Hindi by substituting Bengali or Hindi equivalents for the Dravidian words and forms,without modifying the word-order,but the same thing is not possible in rendering a Persian or English sentence into a NIA. language.The most fundamental agreements are thus found between NIA.And Dravidian,and all this began from early MIA.,as is seen from a comparison of the syntax of Pali and the Prakrits with that of modern vernaculars.”১২৭ সুনীতিকুমার লিখলেন বলেই একে পাকাকথা বলে মেনে নেবার কোনো কারণ নেই।জে ডি এণ্ডারসন ‘ Postulated Bodo influence on Bengali Syntax and accentuation’ বইতে বাংলা পদবিন্যাসে বডো তথা ভোটবর্মী ভাষার প্রভাব দাবি করেছিলেন। অধ্যাপক দীপক রায় দুইভাষাতে মিল থাকা দুই বাক্য তুলে দিয়েছেন এরকম —বডো—আং অৗংখাম জাবায়;বাংলা---আমি ভাত খাবো।এই নজিরে তাঁর সিদ্ধান্তটি আবার বিপরীত,“এই সাদৃশ্যের নিরিখে বলা যায় বড়ো ভাষার বাক্যরীতিতে বাংলা তথা আর্যভাষাগোষ্ঠীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।”১২৮ এগুলো ভাষার শরীরে মিশে একীকৃত হয়ে যায় বলে সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ দাবি করে।সম্ভবত ভাষার বাইরে সামাজিক ইতিহাসেরও গভীর অধ্যয়ন ছাড়া কথা বলা কঠিন। অন্যদিকে শব্দগুলো ভাষাসমূহের মধ্যে দ্রুত সঞ্চরণশীল বলে শব্দের ঐতিহাসিক গতিমুখের সূক্ষ্ম অনুসরণ না করে নিশ্চিত হয়ে কিছু দাবি করা ঠিক নয়।
এক ‘বাংলা’ (<বঙ্গ) শব্দটির উৎস নিয়েই দুই প্রধান বিদ্বান ব্যক্তির দুই মত।‘বাঙালীর ইতিহাসে’ নীহার রঞ্জন রায়ের দাবি,“বাঙলার প্রাচীন জনপদবিভাগের মধ্যে পুণ্ড্র-পৌণ্ড্র,তামলিত্তি-তাম্রলিপ্তি-দামলিপ্তি এবং বোধ হয় গঙ্গা (নদী) ও বঙ্গ –এই দু’টি নামও এই একই অস্ট্রিক ভাষাগোষ্ঠীর ভাষার দান।কপোতাক্ষ ও দামোদর,অন্তত এই দুটি নদীর নামও কোল কব-দাক̖ এবং দাম-দাক̖ হইতে গৃহীত।কোল দা বা দা̖ক=জল এবং দা বা দাক̖ হইতেই সংস্কৃত উদক। অস্ট্রিকভাষাভাষী লোকেরা নিজেদের ভাষার কথা দিয়াই দেশের পাহাড় পর্বত নদনদী গ্রাম জনপদ ইত্যাদির নামকরণ করিয়াছিল,এই অনুমানই তো যুক্তি ও ইতিহাস সম্মত।”১২৯ বিচ্ছিন্নভাবে ভাষা এবং সাহিত্যের ইতিহাসের যুক্তির থেকে তাঁর সামাজিক ইতিহাসের যুক্তি আমাদের মানতেই ইচ্ছে করে।কিন্তু এখানে এসেই খটকা লাগে,যখন লেখেন, “ভারতীয়, তথা বাঙলাদেশের মানস-সংস্কৃতিতে মোঙ্গলীয় ভোটব্রহ্ম বা চৈনিক বা অন্য কোনো নরগোষ্ঠীর স্পর্শ বিশেষ কিছু লাগে নাই।লাগিলেও তাহা এতো ক্ষীণ যে,আর আর তাহা ধরিবার কোনও উপায় নাই।”১৩০ অথচ,এই নৃগোষ্ঠীই আসলে ভারতে প্রব্রজিত সবচাইতে নবীন জনগোষ্ঠী,সম্ভবত আর্যদেরই সমকালীন।এই কথা ‘কিরাত জনকৃতি’-তে লিখেছেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়,“We may be permitted to reconstruct the picture of the Kirata of Early Mongoloid on the soil of India right down to the beginning of the Christian era. They entered the country probably through Assam, and their advent in the east might have been as old as that of Aryans in the west, at the same period before 1000 BC.” ১৩১ ঋগ্বেদে না হলেও যজুর্বেদে বা অথর্ববেদে ‘কিরাত’দের কথা উল্লেখ আছে,রামায়ণ মহাভারতে তো আছেই। মুকুন্দরামের চণ্ডীতেও ফুল্লরা বুঝি হাহাকার করছিল এই বলে,“কিরাত পাড়াতে বসি না মেলে উধার”।সনৎ কুমার নস্কর সম্পাদিত কলকাতার রত্নাবলী সম্পাদিত সংস্করণের এই পাঠের উল্লেখ করেছেন অধ্যাপক রমাকান্ত দাস।১৩২ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিশ্বপতি চৌধুরী এর একটি অর্থহীন পাঠ পড়েছিলেন এরকম,“ফিরাত পাড়াতে বসি না মেলে উধার।”১৩৩ সুতরাং ‘কিরাত’টিই সম্ভব।তবে প্রব্রজিত কোনো জনগোষ্ঠীই কোনো এক সময়ে কোনো এক পথে প্রবেশ করে নি।পূর্ববাংলাতে যেমন আর্যব্রাহ্মণদের প্রবেশ গুপ্তদের আগে সেরকম ঘটেই নি,কিন্তু ডেকে আনছেন যারা তারা অনেকেই কিন্তু এই মোঙ্গল নৃগোষ্ঠীর রাজা।প্রাক-ব্রিটিশ ডিমাছা,ত্রিপুর,কোচ রাজাদের কথা তো সাধারণ্যেও জানা কথাই, ভাস্করবর্মার কামরূপের আদ্ধেকটাও যে সিলেট সহ পূর্ববাংলার অনেকখানি এই সত্য এখনো বিদ্বজ্জনের বাইরে সাধারণ্যে খুব প্রচারিত নয়।ত্রয়োদশ শতকের সিলেটের ভাটেরা লিপির দানকর্তা রাজা গোবিন্দকেশব দেব এবং ঈশান দেবেরা মোঙ্গল ছিলেন এবং পরবর্তী ডিমাছাদের মতোই নিজেদের ঘটোৎকচের উত্তরসূরি বলে দাবি করতেন।সেসব থেকে সুনীতিকুমার তাদেরকেও বৃহত্তর বডো জনজাতির রাজা বলেই দাবি করেন।১৩৪ সুজিত চৌধুরী সেসব কথা উল্লেখ করেছেন ‘শ্রীহট্ট –কাছাড়ের প্রাচীন ইতিহাসে’ এবং কীভাবে সেই বডো জনজাতির মানুষ স্থায়ী কৃষিতে প্রবেশ করে বাঙালি হয়ে গেলেন বলে তাদের আর স্বতন্ত্র সন্ধান করে খোঁজে পাওয়া যায় না--- তার ব্যাখ্যা করেছেন।১৩৫ তাঁর ব্যাখ্যার সারাৎসারটি তুলে দিলে স্পষ্ট হবে যে ভাষাঋণ সবসময় দুই ভিন্ন ভাষিক গোষ্ঠীর মধ্যে হয় না,বহু নৃগোষ্ঠীর সমন্বয়ে একটি ভাষিকগোষ্ঠীর গড়ে উঠবার প্রক্রিয়াতেও হয়,“নিধনপুর লিপি বা সমজাতীয় দানপত্রের সাহায্যে পশ্চিমাগত ব্রাহ্মণেরা যখন ভূমির মালিক হয়ে নূতন জমিকে কৃষিকাজের আওতায় আনছিলেন,তখন এই অঞ্চলের সমাজদেহের মধ্যে কী বিবর্তন প্রক্রিয়া চলছিল তার অবয়ব এবারে স্পষ্ট হচ্ছে।এ অঞ্চলে অস্ট্রিকভাষী খাসি ও অন্য উপজাতি যাঁরা ছিলেন এবং পরবর্তী ভোটব্রহ্ম বা মোঙ্গোলয়েড উপজাতি যাঁরা এখানে বিচরণশীল ছিলেন,তাদের বড় একটা অংশ নূতন ধরণের কৃষিকাজ ও তৎসংশ্লিষ্ট অন্যান্য বৃত্তিসমূহ শিখে নিয়েছিলেন,বা তাদের শিখিয়ে নেওয়া হয়েছিল।ব্রাহ্মণ ভূমিমালিকদের কৃষিশ্রমিক সংগ্রহের সমস্যা এভাবেই মিটেছিল।সেই সঙ্গে ঐ নবসৃষ্ট কৃষক ও শ্রমিকদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল বর্ণাশ্রম ধর্মের মধ্যে,শূদ্র হিসাবে।... এভাবে নূতন ব্রাহ্মণ্য সমাজ যা মূলত একটি সমন্বিত সমাজ, তার যাত্রা শুরু করেছিল শ্রীহট্ট-কাছাড় অঞ্চলে।যারা এই সমন্বয়ের বাইরে রয়ে গেল,তারাই সন্নিহিত পার্বত্যঅঞ্চলে উপজাতি হিসাবে এখনো বিচরণ করছেন।”১৩৬‘পরবর্তী ভোটব্রহ্ম বা মোঙ্গোলয়েড উপজাতি’-দের সম্পর্কে তিনি খানিকটা উচ্ছ্বসিত,“সুনীতিকুমার বলছেন শ্রীহট্ট অঞ্চলে মঙ্গোলয়েড সংমিশ্রণ বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের চাইতে একটু বেশিই হয়েছে এবং এই অঞ্চলের মানুষের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অনেকটাই এই সংস্রবের অবদান।এই তথ্যটি এই অঞ্চলের মানুষের আত্মোপলবব্ধির জন্য কিঞ্চিৎ সহায়ক হওয়ার কথা।”১৩৭ তিনি শ্রীহট্ট –কাছাড়ের ইতিহাস প্রসঙ্গে এই কথা লিখেছেন,কিন্তু কথাগুলো উত্তরবাংলার থেকে আরাকান অব্দি সত্য।রোহিঙ্গিয়াদের আমরা বাঙালি না বলি,আর্যভাষী তো বটেই।এমনকি খাসিয়াদের সম্পর্কেও বলা হয় এরা নৃগোষ্ঠীগত ভাবে বৃহত্তর ভোট-বর্মী জনগোষ্ঠীর অংশ, শুধু ভাষাটিই অস্ট্রিক।তাদের মধ্যে সেই সংস্রব নেই, কী করে দাবি করা যাবে!কিন্তু একটি কথা মনে হয় উল্লেখ করা দরকার যে অস্ট্রিক দ্রাবিড়দের বাংলাতে প্রবেশের শুরুটা যতটা প্রাচীন মোঙ্গলদের ততটাই নবীন।এবং সব পক্ষেরই সেই প্রবেশ বা আগমনের প্রক্রিয়া এখনো সজীব চলমান।কোনো কোনো গোষ্ঠী আবার নানান রাজনৈতিক এবং সামাজিক কারণে নির্গমনের প্রক্রিয়াতেও আছেন,সেটিও সত্য।
বাংলাতে ইসলামের প্রবেশ নিয়ে পরিচিত দুই তত্ত্ব আছে।এক হচ্ছে-- তলোয়ারের জোরে রাজধর্ম হিসেবে। অনেকেই প্রশ্ন করেন,তাহলে রাজন্যবর্গের দখল যেখানে সবচাইতে শিথিল ছিল সেই একেবারে পশ্চিমে এবং একেবারে ভারতের পূবেই এত ধর্মান্তরণ কেন? কেন নয় মধ্যভারতে? দ্বিতীয় তত্ত্ব আছে-- হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে।সেখানেও প্রশ্ন একই । আর্যাবর্তেই তাহলে ধর্মান্তরণ সবচাইতে বেশি হবার কথা ছিল।পুব বাংলাতে কেন, যেখানে প্রাক-তুর্কী সেন রাজাদেরও দখল সেরকম তীব্র ছিল না বলে দীনেশ সেন সহ অনেকেই উল্লেখ করে গেছেন। যার জন্যে পুব বাংলাতে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বা ‘ধর্মসম্পর্ক শূন্য’ গীতিসাহিত্য গড়ে উঠতে পেরেছিল তাও,মূলত মুসলমান লেখকদের হাতে ---দাবি করেছিলেন দীনেশ সেন।এসব নিশ্চয় কিছু কিছু ধর্মান্তরণ ঘটিয়েছিল,বা সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলেছিল।কিন্তু সম্প্রতি তৃতীয় আরেকটি তত্ত্বের উপরে জোর দিচ্ছেন মার্কিন ভারত-ইতিহাসবিদ রিচার্ড ঈটন।সেটি হচ্ছে,সুফি পীরদের নেতৃত্বে গত সহস্রাব্দে আরেক দফা আর্যায়ন,সেই আর্যব্রাহ্মণদেরই মতো।১৯৯৩তে তাঁর প্রকাশিত বই ‘The Rise of Islam and The Bengal Frontier,1240-1760760’ এবং পরবর্তী বহু প্রকাশনাতে তিনি যেটি দাবি করছেন,সে হলো সুফি পীরেরা সহস্রাব্দের শুরুর দিকেই চট্টগ্রামের পথে এসে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন। পরে হয়ত অনেকে সেনা এবং বণিকদের পথ ধরে স্থলপথেও এসে প্রবেশ করেছেন।সিলেটের শাহজালাল পরিচিত নাম।প্রথম সেরকম সুফি পীর সম্ভবত শেখ জালাল আল দীন তাবরিজি।এমন বহু সুফি গুরুরা বন কেটে বসত বিস্তার করতে স্থানীয় জনজাতিদের উৎসাহিত করেছিলেন।একদিকে সাগরদ্বীপে আর দিকে পাহাড়ের নিচে।কালকেতুর নগর নির্মাণের সময় মুসলমানেরা কী করছিলেন স্মরণ করত পারি,“পশ্চিমের বেরুণিয়া আইল দফর মিয়া/সঙ্গে চঙ্গ বাইস হাজার।/ছোলেমানী মালা করে জপে পীর পেগম্বরে/বন কাট্যা পাতয়ে বাজার।।”১৩৮মোঘল শাসকেরা ভূমি রাজস্ব বৃদ্ধির জন্যে এই কাজে উৎসাহ জোগালে রাষ্ট্রীয় প্রেরণাতে তাদের শাসনের শেষের দিকে ইসলামের ব্যাপক প্রসার হয়।কিন্তু এমন নয় যে ‘হিন্দু বাঙালিরা’ মুসলমান হলেন,সেই অনার্য জনজাতিরাই যুগপৎ স্থায়ী চাষাবাদে যোগ দিলেন।মুসলমান এবং বাঙালি হলেন।ধর্মান্তর এবং ভাষান্তর হলো একই সঙ্গে।যারা ভাষা-ধর্মকে মেলাতে চাননা,তারা চিন্তার পুনর্বিচার করতে পারেন।বা অনেকে বাঙালি হলেনও না,কিন্তু রোহিঙ্গিয়াদের মতো আর্যভাষীতে পরিণত হলেন।আরাকানে, যেখানে মোগল এবং প্রাকমোগলদের রাষ্ট্রব্যবস্থার দখল কিংবা হিন্দু ব্রাহ্মণ্যব্যবস্থার বিস্তার প্রায় ছিলনা বললেই চলে সেখানে এই রোহিঙ্গিয়াদের মধ্যে অন্যধর্মাবলম্বী লোকের অনস্তিত্ব রিচার্ড ঈটনের তৃতীয় তত্ত্ব নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।
এই জনজাতিদের অনেকেই খাসি জয়ন্তীয়া ছিলেন নিশ্চয়।কিন্তু অধিকাংশই সেকালে ভোটবর্মী জনগোষ্ঠীর লোকজন ছিলেন প্রতিবেশী রয়ে যাওয়া জনজাতিদের দেখলে এমনটা না ভাববার কোনো কারণ নেই।ইসলাম ছাড়াও গৌড়ীও বৈষ্ণব ধর্মও কাছাড় মণিপুর অব্দি একই কাজ করতে গিয়ে নিজেও আবার ব্রাহ্মণ্য পরম্পরাতে ফিরে গেছে। শ্রীচৈতন্যের জীবৎকালেই এসব শুরু হয়েছিল।ঢাকাদক্ষিণের জগন্নাথ মিশ্রের সন্তানেরা একে একে গৃহত্যাগী হলে কি হবে,তাদের বিশেষ করে শ্রীচৈতন্যের ভাবমূর্তি ব্যবহার করে পরিবারের লোকেরা ঢাকাদক্ষিণে ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বিগ্রহ’ স্থাপন করে কীভাবে আর্থিক দুর্দশার থেকে নিজেদের মুক্ত করে ফেলছেন অচ্যুতচরণ তত্ত্বনিধি সেই বর্ণনা করেছেন।১৩৯ এগুলো এবং আনুষঙ্গিক বৃত্তান্তগুলো তলিয়ে দেখলে সহজেই বোঝা যায় কীভাবে বৈষ্ণব ধর্মও তখনই উদ্বৃত্ত আহরণের ব্রাহ্মণ্যপথই অনুসরণ করছিল।সেই জনজাতিরা সবাই সুজিত চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনাতে উল্লেখ করবার মতো উত্তরে-পুবে এবং দক্ষিণের পাহাড়েতো থাকেনই,অনেকেই সমতলে অর্ধজনজাতি স্তরে এখনও আছেন।সুতরাং বাংলা ভাষাতে ভোটবর্মী উপাদান বিশেষ নেই বলে নীহার রঞ্জন রায় কিংবা মুহম্মদ শহীদুল্লাহের অভিমতকে আমরা এখন আর গ্রহণ না করলেও পারি।কিন্তু তাতেই আমাদের ‘দেশী’ শব্দ নিয়ে সমস্যা মিটছে না।
‘বঙ্গ’ শব্দটিকে নীহার রঞ্জনের আগেই কেউ কেউ ভোটবর্মী উৎসের শব্দ বলে উল্লেখ করেছিলেন।তাই সুকুমার সেনও সেই কথার উল্লেখ করেছেন।“কেহ কেহ মনে করেন,নামটির মূলে ছিল চীন-তিব্বতী-গোষ্ঠীর কোন শব্দ।ইঁহারা শব্দটির ‘অং’ অংশের সঙ্গে ‘গঙ্গা’,‘হোয়াংহো’,‘ইয়াংসিকিয়াং’ ইত্যাদি নদী নামের ‘অং’ অংশের সমত্ব ধরিয়া অনুমান করিয়াছেন যে শব্দটির মৌলিক অর্থ ছিল জলাভূমি।”১৪০সে সময় যে বাংলাদেশের বেশিটাই ছিল জলাভূমি সেই সত্য সুকুমার সেন মানছেন।কিন্তু হঠাৎ করে লিখলেন,“এ অর্থ অত্যন্ত আনুমানিক,আসল অর্থ ‘কাপাস’।”১৪১ ‘কাপাস’-এর কোনো ব্যাখ্যা দেন নি।পরে লিখছেন,ঋগ্বেদে শব্দটি নেই।এর প্রথম উল্লেখ মিলছে ঐতরেয় ব্রাহ্মণে।সেখানে ‘প্রজা হ তিস্রো অত্যায়মান̖’--ঋগ্বেদের একটি শ্লোকের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লেখা হচ্ছে,“‘যা বৈ তা ইমাঃ প্রজাস্তিস্রোঅত্যায়মায়ংস্তানীমানি বয়াংসি বঙ্গা বগদাশ্চেরাপাদাঃ’ অর্থাৎ ‘এই যে তিনটি জাতি নষ্ট হইয়াছিল তাহারা এই সব পাখি---বঙ্গেরা, বগধেরা, চেরপাদেরা (অথবা,এবং ইরপাদেরা)।’”১৪২এই শ্লোক এবং শ্লোকার্থটি বাংলাবিদ্যার ছাত্রদের কাছে প্রবাদের মতো জনপ্রিয় এবং পরিচিত।আর্যদের বাঙালি বিদ্বেষের নজির হিসেবে এটি বহুবার বহুভাবে উদ্ধৃত হয়েছে।কিন্তু এই ‘বঙ্গেরা’ যে ভোটবর্মীই,আর্য নন---সেই কথা সরাসরি সুকুমার সেন মানতে প্রস্তুত নন।একটি সংশয়ের জায়গা রেখেই দিয়েছেন এই লিখে,“এখানে সোজাসুজি মানে হইতে পারে এই যে,তিন (আর্যভাষী?) জাতির মানুষ বন্য বনিয়া গিয়া পাখির মতো যাযাবর হইয়াছিল।”১৪৩ তাহলে আমরা দাঁড়াই কোথায়?
সেরকমই এক তর্ক আছে ‘কামাখ্যা’ এবং ‘কামরূপ’ শব্দের উৎস নিয়ে।এ দুটির পেছনকার পৌরাণিক কাহিনি আমাদের জানা।সতীর দেহত্যাগের পরে ‘কামাখ্যা’তে দেবীর জননেন্দ্রিয় পড়েছিল।আর কামরূপে রূপ পেয়েছিলেন শিবের অভিশাপে ভস্মীভূত মদন।বেশ কিছু তুলনীয় অস্ট্রিক শব্দের উল্লেখ করেছেন বাণীকান্ত কাকতি—“কে-মোয়̖দ̖, কে-মুইত̖,প্রেতাত্মা (চেম.);কে-মুত,কে মুয়̖ত̖,মৰিশালি,(বেচ̖,চেপ̖.);খমোচ̖,শ.প্রেতাত্মা (খ̖মেৰ̖);কোমুওচ̖,শ (স্তিএং); কমোই,ৰাক্ষস (প্রাচীন খমেৰ);কমোইত̖,ভূত (চম);কমুই,মৰিশালী (তৰেং),ক-মেত̖,শ (খাচী);কম্ব্রু,কম্রু,চাওঁতালসকলে উপাসনা কৰা এজন ক্ষুদ্র দেৱতা।”১৪৪তারপরে লিখেছেন,“কামাখ্যা বা কামাক্ষী শব্দটো খ̖মোচ̖,কোমোওচ̖-অর দরে অনার্য শব্দর সংস্কৃতকরণ হব পারে।”১৪৫ এই শব্দদুটোর কথাই বলছেন, কেন না শব্দগুলো ধ্বনিসাম্য ছাড়াও ‘শ’ তথা শবদেহ এবং ‘মৰিশালি’ তথা শ্মশান বা সমাধিক্ষেত্রের অর্থ বহন করে।আর পৌরাণিক কাহিনিতেও কামাখ্যাকে সতীর মৃতদেহেরই এক অংশের সমাধিক্ষেত্র বলে বর্ণনা করা আছে।তেমনি হিউএন চাঙ ক-মো-লু-পো বলে লিখলেও আলবেরুনি বা অন্য অনেক বিদেশী পরিব্রাজকেরা ‘কামরূপ’-কে কাম্ব্রু বা কাম্রু-দ বলে উল্লেখ করছেন,দেখে তিনি অনুমান করছেন,“সম্ভৱত মানুহৰ মাজত দেশখন কাম্ব্রু বা কাম্ব্রু-দ̖ বুলি জনাজাত আছিল।”১৪৬কামরূপে তান্ত্রিকাচারের প্রচলন,পৌরাণিক কাহিনিতেও মৃত-মানুষের পুনর্জীবন প্রাপ্তির প্রসঙ্গ—এসব মিলিয়ে তিনি অনুমান করেন কাম্রু-ত̖-এর সঙ্গে যাদুবিদ্যার কোনো সম্পর্ক আছে।‘কাম-’ থাকা আরো কিছু স্থাননামের নজির তিনি দিয়েছেন,“...তান্ত্রিক দেবালয় থকা কোচবিহারর কাম-তা,উত্তর বঙ্গর কোমিল্লা (কাম-লঙ্কা)।আরু (?) কম্বোজ।”১৪৭এরকম দাবি আরো অনেকে করেছেন।অস্ট্রিকদের কম্বোজ মালয়েশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়া,পাপুয়া নিউগিনি,ন্যুজিল্যাণ্ড আদি দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে পড়বার কাহিনিও সত্য। কোমিল্লা বা কুমিল্লা এবং কাম-লঙ্কা দুই ভিন্ন ঠাই।কোনোটাই উত্তর বাংলার নয়। প্রথমটি সিলেটের নিচে দক্ষিণ-পুব বাংলার একটি জেলার নাম,আর দ্বিতীয়টি মায়ান্মারের একেবারে দক্ষিণে এখনকার ‘বাগো’ বা ‘পেগু’-র পূর্ব নাম।‘কাম-লঙ্কা’-কে সম্ভবত কেউ কেউ ‘কমলাঙ্ক’ বলেও লিখতেন।১৪৮বাণীকান্ত যদিও অনুমানই করেছেন,তবু তাঁর যুক্তি পরম্পরাতে এই পুরো এলাকার অস্ট্রিক নৃগোষ্ঠী এবং সংস্কৃতির সংযোগ যেমন অস্বীকার করবার উপায় নেই,তেমনি স্থাননামের সংযোগও মেনে নিতেই ইচ্ছে করে।কিন্তু ড০ প্রমোদচন্দ্র ভট্টাচার্য সহ অনেকে ভিন্ন প্রস্তাব এগিয়ে দিয়েছেন।তাঁদের মতে ‘কামরূপ’ < বডো খাম (পোৰ̖)+ব্রু/গাব্রু (টানি দীঘল কৰা)> খামরুদ (stretch of burnt land)।অবশ্য তাঁরা কেউ এতটা নিশ্চিত হয়ে লিখেছেন কিনা,আমাদের জানা নেই।উল্লেখটি করেছেন ড০ উপেন রাভা হাকাচাম।তিনি প্রমোদচন্দ্র ভট্টাচার্য বা অন্য কেউ নিশ্চিত হয়ে লিখেছেন না বিকল্প অনুমান করেছেন মাত্র সেই সংবাদ দেন নি।বাণীকান্ত কাকতিকেও যখন নাকচ করছেন তখন বাণীকান্তেরও যে এসব নিশ্চিত দাবি নয়--অনুমান মাত্র-- সেই সংকেতটুকুও রাখেন নি।‘আসাম’ নামের উৎপত্তি সম্পর্কেও তিনি যে যুক্তি দিচ্ছেন তাতে কোনো আহোম সংস্রবের সুযোগই রাখেন নি।তিনি লিখছেন,“তুলনীয় হা-খাম (hasam̄=পোৰা মাটি)> আখাম (Proto Bodo-Garo)* hakham> a’k͡ham̄>as̄am̄।”১৪৯ এই তথ্যটি তিনি নিয়েছেন বেণুধর শর্মার ‘Sino-Tibetan Boro Elements in Indo-Aryan Assamese’ বই বা নিবন্ধের থেকে।এর পরেই তিনি ‘কামাখ্যা’-র উৎস ব্যাখ্যা করছেন এই ভাবে, “তদ্রূপ খাম-আই-খা (পোৰ –মাতৃ-বান্ধ/সৃষ্টি কৰ) অর্থাৎ যিগরাকী মাতৃয়ে পোরা মাটির পরা জগত সৃষ্টি করিলে তেওঁ খামাইখা অর্থাৎ আই কামাখ্যা।”১৫০ আমাদের কাছে বাণীকান্ত কাকতির যুক্তি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে।কারণ, কৌম যাদুবিদ্যা,তান্ত্রিক সংস্কৃতি,পৌরাণিক কাহিনি এবং ভূগোল ইতিহাসের অনেক বিস্তৃত এবং গভীরে অনুসন্ধানের পরে তিনি কথাগুলো লিখছেন।সেরকম কোনো সংযোগ ‘পোৰামাটি’ এবং ‘কামরূপ-কামাখ্যা-আসামে’ আমরা পেলাম না। কিন্তু তারপরেও আমরা কোনো পক্ষ না নেয়াই সমীচীন বলে মনে করছি।সে ‘বঙ্গ’ কিংবা ‘কামরূপ’ যে শব্দেরই উৎস বিতর্ক হোক না কেন!আমরা যে বিষয়টিতে নিশ্চিত হতে পারি,তা এই যে সংশ্লিষ্ট নৃগোষ্ঠীগুলোর ইতিহাস,ভাষাবৈচিত্র্যের সুগভীর তুলনামূলক অধ্যয়ন না করে যথেষ্ট তথ্য এবং যুক্তি সহকারে অন্য নৃগোষ্ঠী এবং ভাষাবৈচিত্র্যের দাবি এবং প্রতিপক্ষ ভাষাবিদদের দাবিকে খণ্ডন না করে কোনো এক শব্দ এই নৃগোষ্ঠীর থেকে বাংলা বা অসমিয়াতে এসেছে,ওই গোষ্ঠীর থেকে আসেনি,এমনটা নিশ্চিত দাবি করা প্রায় অসম্ভব কাজ।এবং সেটি এক বিশাল পরিসরের স্বতন্ত্র কাজ হবে। ইতিমধ্যে সমাজভাষাবিজ্ঞানে এই নিয়ে কিছু কিছু কাজ হলেও বাংলাতে হয়েছে বলে আমরা সেরকম সন্ধান পাইনি। আর সেখানেও অনুসন্ধান পদ্ধতি নিয়ে স্বাভাবিক বিতর্কটি রয়েইছে।
এমন কি বহু শোনা সাম্প্রতিক প্রতিবেশী ভাষার শব্দও যদি বাংলা বা অসমিয়াতে শোনে দাবি করা হয় যে অমুক ভাষার থেকেই শব্দটি ভাষাতে এসেছে---সেখানেও এই সন্দেহ জাগিয়ে রাখতেই হবে যে উৎস ভাষাতেও শব্দটি একটি ঋণ শব্দই হতে পারে।যেমন সংস্কৃতেও ‘কামাখ্যা’ বা ‘বঙ্গ’ শব্দগুলো যে ঋণ শব্দ সেই নিয়ে কিন্তু কোনো তর্ক নেই। বাংলা বা অসমিয়া সেগুলো পেয়েছে সংস্কৃতেরই সূত্রে।সেরকম বহু আরবি শব্দ বাংলা পেয়েছে পার্শির থেকে।আরবি ভাষাটির অধ্যয়ন ব্যাপক আকারে হয়ে থাকে বলে সেগুলো চেনা সহজ হয়েছে।ড০ উপেন রাভা হাকাচাম ‘অসমীয়া ভাষাত তিব্বত –বর্মীয় উপাদান:কিছু নতুন চিন্তার উন্মেষ’ নিয়ে বিস্তৃত অনুসন্ধান করেছেন এবং লিখেছেন।এই সম্পর্কে তাঁকে সাম্প্রতিক আসামে একজন বিশেষজ্ঞই মনে করা হয়।তাঁর অধ্যয়নে তিনি দীপংকর মরলের ‘উপভাষাবিজ্ঞান’ বই থেকে সমাজভাষাবৈজ্ঞানিক পরিব্যাপ্তি (Socio-linguistic Diffusion),শাব্দিক পরিব্যাপ্তি (Lexical Diffusion) ইত্যাদি ধারণার থেকে দিশানির্দেশ নিয়েছেন বোঝা যায়।এক জায়গাতে স্পষ্টই লিখেছেন,“ড০ দীপঙ্কর মরলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলর ভাষাগত ক্ষেত্র সম্বন্ধে বিস্তারিত সামগ্রীসহ এইটো প্রতীয়মান করিছে যে ---অসমীয়া ভাষার এই বৈশিষ্ট্য কারো নিজাববীয়া নহয়;কিয়োনো এইটো সমাজ ভাষা- বৈজ্ঞানিক-পরিব্যাপ্তি (Socio-linguistic Diffusion)-র ফলত লাভ করা ভাষাগত ক্ষেত্রর উমৈহতীয়া উপাদানহে।”১৫১ আমাদের যেটুকু মনে হলো এই সমাজ ভাষা-বৈজ্ঞানিক- পরিব্যাপ্তি-র ধারণাটি বেশ চমৎকার।এই ধারণার পশ্চিমা উৎস এবং পশ্চিমে ধারণাটির আভ্যন্তরীণ বিতর্ক নিয়ে পরিসরের জন্যেই আমরা কথা বাড়াব না।ধারণাটি এক জটিল প্যাঁচকে এক হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেলে।যদি ধরে নেয়া হয় যে এই সব নৃগোষ্ঠীগত উৎসগুলোকে এখন আর স্পষ্ট করে চিহ্নিত করা যাবে না।ভাষাগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিনিময়ের ফলে এরা নিজেদের মূল উৎসটি হারিয়ে ফেলে এক নির্দিষ্ট ভূগোলের সব ভাষাগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পত্তি তথা ‘উমৈহতীয়া উপাদান’ হয়ে গেছে তবে ভাষাবিজ্ঞানের অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু তাতে করে বাণীকান্ত কাকতি বা সেরকম আরো অনেকে ‘কামরূপ’ শব্দের উৎসের সন্ধানে ‘কম্বোজ’ কিংবা ‘কামলঙ্কা’ অব্দি পাড়ি দিলেন তাতে যে সমাজ সংস্কৃতির ইতিহাসের আরো কিছু চিত্তাকর্ষক সত্যের উদ্ঘাটন হলো তার থেকে ভাষাবিজ্ঞানী কিংবা ঐতিহাসিকেরাই বঞ্চিত থাকবেন কেন? তারপরেও,এইভাবে দীপংকর মরলকে নাকচ কিংবা গ্রহণ কোনোটাই করা কঠিন। তিনি যে খুব একটা ‘বিস্তারিত সামগ্রীসহ’ কিছু সিদ্ধান্তে গেছেন,আমাদের তাও মনে হলো না।তিনি আসলে ‘উপভাষাবিজ্ঞানে’র কিছু তাত্ত্বিক দিকের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেবার কাজ করেছেন তাঁর বইটিতে।এবং ‘ভাষাগত ক্ষেত্র’ বলে যে ত্রয়োদশ অধ্যায়ে তিনি এসব আলোচনা করছিলেন,তার বিস্তার উপেন রাভা হাকাচামের বিস্তার থেকে অনেক কম।১৫২
উপেন রাভা হাকাচাম তাত্ত্বিক অবস্থানটি স্পষ্ট করবার পরে তাঁর অধ্যায়টিকে ‘বিতর্কিত আর্যভিন্ন উপাদান’ এবং ‘অবিতর্কিত তিব্বত বর্মীয় উপাদান’ এইভাবে মোটা দাগে দুইভাগে ভাগ করেছেন।এবং প্রথমভাগের শুরুতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা লিখেছেন,যা শুধু অসমিয়া নয় বাংলা ভাষাবিদ্যার জিজ্ঞাসুদের জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ ভেবে আমরা বাংলা অনুবাদে সেগুলো উপস্থিত করছি,“অসমিয়া ভাষাতে এমন কতকগুলো ধ্বনিগত,রূপগত এবং শব্দগত উপাদান আছে যার উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন মত পাওয়া গেছে।বিশেষ করে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছাড়াও কিছু শব্দঋণ একটি ভাষা পেতে পারে, লোক-বুৎপত্তি দিয়েও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে---সেরকম কিছু শব্দ পণ্ডিতদের বেশ সমস্যাতে ফেলতে দেখা গেছে।সে জন্যে ইতিপূর্বে যে পণ্ডিতেরা আলোচনাতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন শুধু শুধু ঝামেলা না বাড়িয়ে(নলগা জেঙত লাগি নাথাকি) সম্ভাব্য প্রভাব বা শব্দগত সাদৃশ্যের (Lexical Correspondences) একটি দীর্ঘ তালিকা দিয়ে সেইসব আলোচনা সেরেছেন।যার ফলে একটি সমাধান সূত্র বেরোনোর চেয়ে এ ক্রমেই জটিল থেকে আরো জটিলতর রূপ ধারণ করেছে।”১৫৩এই অব্দি তিনি ছবিটির একটি সঠিক বর্ণনাই দিয়েছেন। কিন্তু অনেকেই যে সেই তালিকা ধরে “ভাষা-বিজ্ঞানের সহজ-সূত্রে নিজেদের সীমাবদ্ধ না রেখে”১৫৪ একটি অবৈজ্ঞানিক কিন্তু ভাষারাজনৈতিক মোহের শিকার হচ্ছেন সেই কথাও তিনি লিখেছেন স্পষ্টই,“দুটো ভাষার আংশিক সাদৃশ্য দেখলেই এই ভাষার থেকে ঐ ভাষাতে ভাষাগত উপাদান রপ্তানির তত্ত্বের প্রয়োগ এবং এই ভাষা ঐ ভাষার থেকে বেশি সমৃদ্ধ ---এসব জাহির করবার প্রবণতা নির্মোহ আলোচনাতে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে।”১৫৫
সুনীতিকুমার কিংবা বাণীকান্তকে অনুসরণ করে যারা এগিয়েছেন তারা অনেকেই সঠিক ভাবেই এই সমালোচনার অধিকারী।অনেকে ‘সম্ভব’ শব্দটিরও ব্যবহার না করেই কোনো প্রাসঙ্গিক যুক্তি তুলে না ধরেই একটা নিশ্চিত সিদ্ধান্তও জানাতে চান।তাই বলে স্বয়ং সুনীতিকুমার বা বাণীকান্ত সম্পর্কে কথাগুলো বলা যাবে না।কিন্তু সামান্য এগিয়ে স্পষ্টই দেখা যাবে উপেন রাভা হাকাচাম স্পষ্টই বাণীকান্তের বিরুদ্ধেই এই অভিযোগ আনছেন।অথচ,আমরা আগেই দেখালাম তাঁর যুক্তিগুলো বাণীকান্তের থেকে দুর্বল।তাঁর ‘বিতর্কিত আর্য-ভিন্ন উপাদান’ উপশিরোনামে এবং পরবর্তী বেশ কিছু সূত্র বিতর্কের অবসান করল বলে আমাদের মনে হলো না।বরং পূর্বসূরিরা যে শব্দ বা শব্দাংশ তথা রূপিমগুলোকে অস্ট্রিক,দ্রাবিড় এমন কি সংস্কৃত বা বিদেশী উৎস জাত বলে লিখেছেন বা অনুমান করেছেন সেগুলোর তিব্বত-বর্মী সমরূপের দিকে তিনি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন কেবল।এবং সূত্র সংখ্যা ৪.১ থেকে শুরু করে সূত্র সংখ্যা ৫.৪ অব্দি বহু তর্কের অবকাশ রেখেছেন।‘আসাম’ শব্দেরই একটি অর্থ ‘পোড়ামাটি’ করেছেন আমরা দেখলাম।অন্যত্র লিখছেন,“তিব্বত–বর্মীয় বিভিন্ন ভাষাত অসমখনক আছাম/হাছাম নামেরে আরু ইয়ার বাসিন্দা সকলক হাছামছা/আছামছা বুলি কোয়া হয়।হা-/আ’- তিব্বত-বর্মীয় বড়ো ভাষাগোষ্ঠীর মাটিবাচক সাধারণ অনুপদ আরু ছাম/ছম শব্দটোয়ে ঘাঁহ,সেউজীয়া,ঔষধি গছ অর্থ বুজায়।সেয়ে হ’লে অসমর সমার্থক আছাম শব্দটোয়ে ‘চিরসেউজীয়ার দেশ বা যাদুমন্ত্রর দেশ’ বুজায় আরু অসমীয়া সকল হ’ল সেই দেশর সন্তান (-ছা< ফিছা)।”১৫৬এইটুকুনে ‘সম্ভব’,‘সম্ভাব্য’, ‘বিকল্প’ বলে কোনো শব্দই নেই।সুতরাং বিতর্ক আর নেই,সিদ্ধান্ত হিসেবেই পাঠক নিতে পারেন।কিন্তু বোঝা মুস্কিল ‘পোরা মাটি’ কী করে ‘চিরসেউজীয়ার দেশ’ হয়ে গেল।তাও যদি বা কল্পনা করা গেল,‘চিরসেউজীয়ার দেশ’ কী করে ‘যাদুমন্ত্রর দেশ’ হল,বোঝা খুবই কঠিন।সুতরাং তাঁর আলোচনাটিও যে ‘নির্মোহ’ কিছু রইল তা আর মনে হয় না।যদিও তিনি যে বিকল্প তথ্যগুলো দিয়েছেন,সেগুলো পরবর্তী যে কোনো ভাষাবিজ্ঞানীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যভাণ্ডার বলেই বিবেচিত হবে।তাঁর ‘অবিতর্কিত তিব্বত-বর্মীয় উপাদান’ উপশিরোনাম এই আলোচনারই বিস্তার।সেখানে বরং ‘সম্ভব’, ‘অনুমান’ ইত্যাদি শব্দের বহুল ব্যবহার আছে।এবং একেবারে শেষে তিনিও স্বীকার করে নিচ্ছেন,এবং যথার্থ দিশা দিচ্ছেন,“প্রকৃতার্থত নিরপেক্ষ দৃষ্টিভংগীরে চাবলৈ গ’লে অসমীয়া ভাষাত তিব্বত–বর্মীয় উপাদান সন্দর্ভত বিতর্কর অবকাশ আছে---অন্ততঃ কিছুমান দিশত।অবশ্যে অন্যান্য আর্য-ভিন্ন উপাদানর দরে অসমীয়াত তিব্বত বর্মী উপাদান নাই বুলিবও নোয়ারি।তিব্বত বর্মীয় উপাদান অন্বেষণর বাবে আরু অধিক সমলর প্রয়োজন আছে,তেতিয়াহে খাটাং সিদ্ধান্ত এটা দিব পরা হৈ উঠিব।এই ক্ষেত্রত নতুন নতুন দৃষ্টিভংগীরো ওয়াদানি হ’ব লাগিব;সেইবাবেই নতুন নতুন চিন্তার উন্মেষ হোয়া উচিত।”১৫৭ তাহলে,ড০ উপেন রাভা হাকাচাম পড়তে পড়তে এই প্রশ্ন দেখা দেয়ই,উপশিরোনামের একটিতে ‘বিতর্কিত’ এবং আরটিতে ‘অবিতর্কিত’ শব্দ ব্যবহার করছেন কেন?‘বিতর্কিত’ অংশে তিনি অনেক বেশি নিশ্চিত,অথচ ‘অবিতর্কিত’ অংশে অনিশ্চিত কেন?উত্তর এই যে,প্রথম ভাগে তিনি বাণীকান্ত কাকতির থেকে শুরু করে অনেকে যেসব শব্দের তিব্বত বর্মী ভিন্ন উপাদানের সম্ভাবনার কথা লিখছেন,সেগুলো খণ্ডন করে তিব্বত বর্মী বিকল্প সম্ভাবনার কথাই লিখছেন।এবং দ্বিতীয়ভাগে বাণীকান্ত সহ পূর্বসূরীরাও যেহেতু তিব্বত-বর্মী উৎসের সম্ভাবনার কথা লিখেছেন,তিনি সেগুলো সমর্থন করে আরো কিছু সংযোজন করছেন।তাঁর অধ্যায়টিকে এইভাবে পড়তে হবে।তাতে আমাদের মূল সমস্যার সমাধান বিশেষ হয় না।অর্থাৎ আমরা নিশ্চিত হয়ে বলতে তারপরেও পারছি না,কোন শব্দের উৎস কোন নৃগোষ্ঠীগত ভাষাগুচ্ছের থেকে।তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীও এই ব্যাপারে আমাদের বিশেষ সাহায্য করে না।কিন্তু বহু তিব্বত বর্মী বিকল্প সম্ভাবনার কথা ভাবতে পারছি,এবং শব্দের সঙ্গেও পরিচিত হচ্ছি।উপেন রাভা হাকাচামের প্রতি আমরা সেটুকুর জন্যে ঋণী।
এইখানে ‘অসমীয়া জাতীয় অভিধান’-এর অভিজ্ঞতার কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি।অভিধানটি এই অর্থেই ‘জাতীয়’ যে যাদেরকেই ‘বৃহত্তর অসমিয়া জাতি’র অংশ বলে মনে করা হয় সেই সমস্ত আর্য-অনার্য জনগোষ্ঠীগুলোর যা কিছু শব্দ কোনো না কোনোভাবে মৌখিক অসমিয়া ভাষাতে ব্যবহৃত হয় তার সবই প্রায় অভিধানে নিয়ে আসবার চেষ্টা রয়েছে।তাতে বরাক উপত্যকাতে প্রচলিত বহু শব্দ এবং স্থাননামও রয়েছে।মূলস্রোতের ‘জাতীয়তাবাদী’রা সেই প্রয়াসের প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন। সেই বিতর্কের দলিল গুলো দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ খণ্ডের শুরুর দিকে তাঁরা ছেপে দিয়েছেন--যা কিনা আসামে বাংলা ভাষাচর্চার ক্ষেত্রেও দিকদর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে।তাঁরা যেভাবে অসমিয়া জাতিকে দেখেছেন,সেটি এই বাক্যেই স্পষ্ট যা মুখ্য সম্পাদক দেবব্রত শর্মা প্রথম খণ্ডেই লিখেছিলেন,“আমি ক’ব খোজো যে আমি বড়ো ‘আই’র বুকুর মিচিমি ‘গাখীৰ’ খোয়া নাগা ‘তেজ’র অসমীয়া।”১৫৮ কিন্তু সেই তারাও যখন প্রতিবেশী ভাষাগুলো এবং অসমিয়ার সাধারণ শব্দগুলো অভিধানে নিচ্ছেন,তখন ‘সম্ভাব্যতা’র নীতি ত্যাগ করেন নি।দ্বিতীয় খণ্ডে ‘সম্পাদকর আগকথা’তে লিখছেন,“যি বোর শব্দ প্রায় একে ধরণে অসমীয়া ভাষাতো আছে,কোনো জনজাতীয় ভাষাতো আছে;কোনো কোনো ক্ষেত্রত সেইবোর হয়তো জনজাতীয় ভাষার পরা অসমীয়ালৈ আহিছে,আকৌ কোনো কোনো ক্ষেত্রত হয়তো অসমীয়ার পরাহে উক্ত ভাষাবোলৈ গৈছে।আমি বেছিভাগ ক্ষেত্রতেই অসমীয়ালৈ অহা উক্ত শব্দটোর ব্যুৎপত্তি সম্পর্কে নিশিচত হ’ব পারিলে উৎস হিচাপে,নহ’লে অন্ততঃ ‘তুল্য’ বুলি উক্ত জনজাতীয় ভাষাটোর কথা উল্লেখ করিছোঁ।উদাহরণ স্বরূপে বৰদৈচিলাৰ উৎস যে বড়ো বাৰদৈচিখলা তাত সন্দেহ নাই।কিন্তু অসমীয়া ‘কাকত’ শব্দটো নাগা ভাষাতো যে আছে,অসমীয়া ‘আই’ যে বড়ো (লগতে মুণ্ডারী আরু মারাঠী) ভাষাতো আছে,‘গাখীৰ’ শব্দটো যে মিচিমি ভাষাতো পোয়া যায় (কিন্তু কোনো সংস্কৃতমূলীয় ভাষাত পোয়া নাযায়),‘তেজ’ শব্দটো সেই একেই অর্থত এটা নাগা ভাষার আছে কিন্তু আন আর্যমূলীয় ভাষাত নাই সেই কথাৰ উল্লেখ অভিধানখনৰ ব্যুৎপত্তির ঘরত দিয়ার কথা ভবা হৈছে। কিন্তু সমান্তরাল ভাবে আমি কেতিয়াবা জনজাতীয় ভাষার সেইবোর শব্দও অন্তর্ভুক্ত করিছো,যিবোর অসমীয়ার সৈতে প্রায় একে আরু উৎস অসমীয়াও হ’ব পারে,উক্ত ভাষাও হ’ব পারে।”১৫৯
জগন্নাথ চক্রবর্তী সিলেটি তথা দেশী শব্দের তালিকাতে নির্দিষ্ট করে বেশ কিছু ডিমাছা,বডো,ককবরক,মণিপুরি, লুসাই,শান বা তাই আহোম শব্দের তালিকা দিয়েছেন।যেমন আনুয়া (< ডিমাছা আনোয়া),আলং (< গারো আলাঙ),হুঙ্গা (<আহোম হুংগ),বেং(কাঠের ছিটকিনি<ককবরক বেঙ̖),লাইসেমপি(< মণিপুরি লাশেমফি),হচা(বডো সছু )ইত্যাদি।১৬০এগুলো সেই সব ভাষাতে আছে হয়তো বা।লাইসেমপি যে মণিপুরি শব্দ এই নিয়ে কোনো সংশয় নেই।কিন্তু সেই সব ভাষারই একক সম্পদ কি না সেই নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ তাঁর নজিরগুলোই দেয়।যেমন ধরা যাক –মানকচু < লিখেছেন আহোম ‘ফাক̖মান’ থেকে এসেছে।এটি কষ্ট কল্পনা বলেই মনে হয়।আলং একবার লিখেছেন < গারো আলাঙ থেকে এসেছে।সেখানে শব্দটির কোনো অর্থ দেন নি।আবার লিখেছেন বাংলাতে এর অর্থ অস্থায়ী মণ্ডপ, ককবরকেও শব্দটি আলং ---অর্থ দুর্গ।এটি যে তৎসম ‘আলম্বন’ থেকে আসেনি,তার কিসের নিশ্চিতি? তেমনি সিলেটি হচা < বডো সছু দুটোই তৎসম ‘শৌচ’ থেকে আসা এমন কি কঠিন?
সিলেটি শব্দভাণ্ডার নিয়ে সম্প্রতি দু’খানা ভালো কাজ হয়েছে আসামে। প্রথমখানা নবীন অধ্যাপক রমাকান্ত দাসের গবেষণা সন্দর্ভ ‘বরাক উপত্যকার স্থাননাম’(২০০৯) এবং দ্বিতীয়টি প্রবীণ অধ্যাপক নিশীথ রঞ্জন দাসের ‘বরাক উপত্যকার লৌকিক বাংলা ভাষা’(২০১৪)।দ্বিতীয়টির নামে যদিও বা আছে ‘বাংলা ভাষা’,শুরু থেকেই লেখকের প্রবণতা শব্দের গঠন এবং অর্থের পেছনের ইতিহাস,সমাজ-সংস্কার ইত্যাদি ব্যাখ্যা করবার।মাঝে মাঝে যেন হঠাৎ করে ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্বের অন্যান্য বিষয়গুলো ঢুকে গেছে।স্থাননাম নিয়ে তিনিও বিস্তৃত অনুসন্ধান করেছেন এবং বিশাল তালিকা দিয়েছেন,যেগুলো যেকোনো অনুসন্ধানকারীর কাছেই উত্তম আকর হিসেবে বিবেচিত হবে।তার উপরে ব্যক্তিনাম,শাক-সবজি,বস্তু নামের উৎস ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করেছেন।সেই সুবাদে প্রতিবেশী ভাষা এবং নৃগোষ্ঠীগুলোর থেকে ঋণ এবং সেইসব ভাষাতে দেনা নিয়েও আলোচনা করেছেন।বহু জায়গাতে তাঁর সিদ্ধান্তগুলো বিশ্বাসযোগ্যই মনে হয়।কিন্তু বিষয়বিন্যাস তারপরেও সুচিন্তিত,সুশৃঙ্খল এবং বহু জায়গাতে সুপরীক্ষিত নয় বলেই মনে হয়।যেমন--‘কাগজ’ শব্দটি মূলে ফার্সি।তিনি অনুমান করেছেন,সেটি সিলেট থেকে মেঘালয়ে গিয়ে হয়েছে ‘কাকট।’স্পষ্টই লিখেছেন,“বরাক উপত্যকার মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে খাসিয়া–জয়ন্তীয়া পাহাড়ে কাগজ নিয়ে গেলে খাসিয়া ভাষায় কাগজ হলো ‘কাকট’।”১৬১ ‘জ’ ধ্বনি খাসিয়া ভাষাতে ‘ট’ ধ্বনিতে পরিণত হয় বলে কাগজ> কাকট হয়েছে।তার থেকে অসমিয়াতেও ‘কাকত’ এবং উপাধি ‘কাকতি’। যেহেতু,“অসমীয়া শিক্ষিত মানুষ খাসিয়া রাজা অর্থাৎ সিয়েমের লেখাপড়ার কাজ করতেন বলে তাদের বলা হতো ‘কাকটি’।অসমিয়া ভাষায় ‘ট’ ধ্বনি সাধারণত ‘ত’ হওয়ায় ‘কাকটি’ হয়েছে ‘কাকতি’।বরাকের কাগজ খাসিয়া পাহাড় হয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় গিয়ে কাগজ হয়েছে ‘কাকত’... ।”১৬২ আমরা আগে, দেখালাম ‘অসমীয়া জাতীয় অভিধান’-এর দাবি শব্দটি নাগাদের কোনো ভাষাতেও রয়েছে।‘কাকতি’ আহোম রাজপ্রশাসনের আধিকারিকের উপাধি,যিনি হিসেবপত্র রাখেন।১৬৩তারপরেও এটা ঠিক,‘কাকতি’ পূর্বপ্রচলিত শব্দ হতে পারে,যেটি আহোম রাজারা বেছে নিয়েছেন।এও হতে পারে,শব্দটি অসমিয়া হয়েই নাগাতে গেছে।বিশেষ করে ‘অসমীয়া জাতীয় অভিধান’ শব্দটির নাগা সংস্রবের সম্পর্কে যত উৎসাহী,ফার্সি সংযোগ সম্পর্কে ততটাই নীরব।কিন্তু পরে যখন আলাদা করে ‘কাগজ’ শব্দের সঙ্গে পরিচয় ঘটাচ্ছেন,তখন আবার তার ফার্সিমূল এবং ‘কাকত’ প্রতিশব্দের কথা উল্লেখ করছেন।১৬৪ এই ফার্সি শব্দটির পথের সূচনা যে ‘বরাক উপত্যকা’র থেকেই হয়েছে সেটি মানবার জন্যে আরো বহু নিশ্চিতি চাই।উদাহরণস্বরূপ,‘বরাক উপত্যকা’ কথাটিই তো সাম্প্রতিক। আমরা কি বিশ শতকের আশির দশকে জনপ্রিয় শব্দকে বা ১৯৪৭এ গড়ে ওঠা রাজনৈতিক সীমাকে প্রাক-ঔপনিবেশিক ইতিহাসেও আরোপ করছি? ১৯৪৭এর আগে কি সুরমা উপত্যকার সঙ্গেও মেঘালয়ের সংযোগ অনেক বেশি সজীব ছিল না? ময়মন সিং? রংপুর? গোয়ালপাড়া বা কামরূপ দিয়েই যে ফার্সি শব্দটি খাসিয়াতে প্রবেশ করেনি,আমাদের সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে আগে।তারপরেই শুধু এরকম কোনো সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করতে পারি।তিনদিকের এই পুরো সমতল এলাকাতেই তুর্কি-পাঠান-আফগান-মোঘল সংস্রবের বয়স তো প্রায় একই। এবং তিনদিক থেকেই যুদ্ধ,বাণিজ্য কিংবা ধর্মীয় কারণে লোক যাতায়াত ছিলই।তিনি যখন লেখেন,“অস্ট্রিকভাষীরা প্রাচীন কাল থেকেই ‘গুয়া’র ব্যবহার করতেন।তাদের ভাষায় গুয়ার নাম কুয়াই”১৬৫-- তখন আমাদের অভিজ্ঞতাও বলে তিনি সঠিক লিখছেন।কিন্তু লিখছেন আসলে খাসিয়াদের কথাই।সব অস্ট্রিকরা ‘কুয়াই’ বলেন বা বলতেন,এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।তাদেরওতো ভাষাবৈচিত্র্য থাকবে।যাই হোক,একে উপেক্ষা করেও যদি পড়ি,“অস্ট্রিক-এর ‘ক’ ধ্বনি ‘গ’ ধ্বনিরূপে আবির্ভূত হয় হওয়ায় কুয়াই হয়েছে গুয়াই,পদান্ত ‘ই’ ধ্বনি লুপ্ত হওয়ায় গুয়াই হয়েছে ‘গুয়া’।এই গুয়া গণনার বিশেষ রীতি অস্ট্রিক ভাষা থেকে বরাক উপত্যকায় এখনো প্রচলিত হয়েছে ১১টি সুপারিয়ে হয় এক ঘা,৪০ ঘায়ে হয় এক ভি, ১৬ ভিয়ে হয় এক লতি।”১৬৬ -- তখন তাঁর যুক্তিগুলো অনেক দৃঢ়ভিত্তির উপরে দাঁড়ায়।কিন্তু যখন লেখেন,“ফার্সি ‘সেতু’ শব্দ বরাকে ‘পুল’ হয়েছে একই অর্থে ককবরক ভাষায় ‘পুল’ শব্দ বিরাজ করছে।”১৬৭তখন সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হয়ে যায়।অধ্যায়টির শিরোনাম ‘তিপ্রা ককবরক ভাষার উপর বরাকের কথ্য ভাষার প্রভাব’।ফলে মনে হবে,‘সেতু’ কোনো উপায়ে ‘বরাকে’ ‘পুল’ হয়েছে আর এখান থেকে শব্দটি ককবরকে গেছে।কেন কুমিল্লা,নোয়াখালি,চট্টগ্রাম বা সুরমা উপত্যকার থেকে সেখানে যায় নি,বা ককবরক থেকেই ‘বরাকের’ ভাষাতে শব্দটি আসেনি সেরকম কোনো ব্যাখ্যা নেই।শুধু অন্যত্র অনুসন্ধান করেই আমাদের জানতে হয় যে আসলে ‘সেতু’ নয় ‘পুল’ শব্দটিই ফার্সি।১৬৮এবং ফার্সি থেকেই সিলেটি এবং ককবরকে শব্দটি গেছে।‘সেতু’ শব্দটি প্রাচীন বৈদিক শব্দ।√সি ধাতুর থেকে এসেছে।১৬৯বৃহত্তর বডো নৃগোষ্ঠীর একটি শাখা ‘ককবরক’-এ তবুও সন্ধান করলে বরাক তথা সিলেটের ধ্বনি,রূপ,শব্দ তথা ভাষারীতির প্রভাব সন্ধান করবার ঐতিহাসিক যুক্তি থাকলেও এই শিরোনাম মেনে নেয়াই কঠিন,“বডো ভাষার উপর বরাক উপত্যকার কথ্য বাংলার প্রভাব’।১৭০সংস্কৃত ‘উপাধ্যায়’ > প্রা. ‘উওজঝাঅ> বাং.ওঝা> সিলেটি ‘উজা’ > গিয়ে বডোতে ‘ওজা’ হয়েছে১৭১ ---শব্দটি অসমিয়া বা রাজবংশী বা ময়মন সিংহ,রংপুর,দিনাজপুরের বাংলা ভাষাবৈচিত্র্যের থেকে বডোতে যায় নি--- এই সিদ্ধান্ত নিতে গেলে ইতিহাসের জটিল পথপরিক্রমা না করে কোনো বিশ্বাসযোগ্যতাই প্রতিষ্ঠিত হয় না।এসব কারণে তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্তও পুনর্বিচার না করে গ্রহণ করা সঠিক হবে না।
সেদিক থেকে গবেষণা সন্দর্ভ বলেই রমাকান্ত দাসের উপস্থাপনার শৃঙ্খলা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।স্থান নামের যেহেতু স্থানান্তর এবং কালান্তরের গতি খুবই ধীর তার পেছনকার ইতিহাস এবং নৃগোষ্ঠীগত সংযোগও অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য।বিশেষ করে এখনো যে সব নাম বা শব্দগুলো প্রতিবেশী ভাষাগুলোতে মেলে সেগুলো নিয়ে সংশয়ের অবকাশ কম।যেমন তিনি লেখেন,‘লাল’ শব্দে মিজো ভাষাতে প্রধান রাজকীয় ব্যক্তি বোঝায় তার থেকে ‘লালা’ নাম হয়েছে।১৭২তার বিপরীতে ১৮২৪শে মণিপুর রাজ গম্ভীর সিংহ ব্রহ্মসেনাদের প্রতিরোধ করতে যেখানে যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়েছিলেন সেই জায়গাটির নাম ‘লালাং’।মণিপুরি ভাষাতে ‘লালাং’ মানে ‘যুদ্ধের প্রস্তুতি’।প্রথমটি ছোট শহরের নাম, আছে মিজোরাম সীমান্তে হাইলাকান্দি জেলার দক্ষিণে।দ্বিতীয়টি ছোট চা-বাগানের নাম,আছে কাছাড়ের উত্তরে পুবে মণিপুর সীমান্তে।সুতরাং সেসব যুক্তিতে এগুলো বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়।কিন্তু খাসিয়া ভাষাতে ‘পুঞ্জি’ শব্দটি আছে বলেই,মেঘালয়ের ‘চেরাপুঞ্জি’র আদলে খাসিয়া বসতিগুলোর নামের শেষে ‘পুঞ্জি’ আছে বলেই বিনা তর্কে সেগুলো অস্ট্রিক বা খাসিয়া শব্দ --- মেনে নেয়া যায় কী করে?১৭৩ শব্দটি যে বাংলা ‘পুঞ্জ’ (স্তূপ) থেকে আসে নি তার নিশ্চয়তা কী? ভানু সিংহের পদাবলীতে আছে,“ফুটল সজনি,পুঞ্জে পুঞ্জে বকুল যূথি জাতি রে।” অবশ্য অস্ট্রিক মূলের কোনো শব্দকে বাংলার মতো করে ফেলাও হতে পারে।খোদ ‘চেরাপুঞ্জি’ই তো বাংলা শোনায়। যে পুঞ্জিতে কাঠ চেরা হয়? এর মূল নামে ‘পুঞ্জি’ ছিল বলে খাসিয়ারা দাবি করেন না। মূলে স্থাননামটি ‘সোহরা’ > তার থেকে চেরা+পুঞ্জি=চেরাপুঞ্জি। তেমনি বরাক উপত্যকাতে ‘ডহর’ শেষে নিয়ে বেশ কিছু স্থাননাম আছে।এই নিয়ে যে ভাষাবিদদের মধ্যে তর্ক আছে রমাকান্ত দাস তার উল্লেখ করেছেন।সুহৃৎ কুমার ভৌমিক মনে করেন কোল বা মুণ্ডারি ভাষার ‘দাঃক’ থেকে জলবাচক ‘দহ’ এসেছে,সুকুমার সেনের মতে ‘হ্রদ’ থেকে।১৭৪আমরা আগেই লিখেছি,নীহার রঞ্জনও মনে করেন,সংস্কৃত ‘উদক’ শব্দটিই এসেছে এই কোল ‘দাক̖’ থেকে।সুতরাং দুটোই সত্য।‘হ্রদ’ শব্দের মূলেও এই ‘দাক’ হওয়াই সম্ভব।এবং তারই তদ্ভব রূপ এই ‘ডহর’ বা ‘ডর’। শ্রী কৃষ্ণকীর্তনে আছে ‘পশার নাম্বায়া থোহ ডহরার মাঝে।/পাণি ফুটি সিঞ্চ তোহ্মে না করিহ লাজে।।’ (নৌকাখণ্ড) খুলনা,বাখরগঞ্জের ভাষাবৈচিত্র্যেও কিন্তু ‘ডর̖’ রয়েছে।যেমন—ডরের ভুইত ভালো ধান হয়।১৭৫ বাখেরগঞ্জে ‘ডহর’-ও রয়েছে।১৭৬ অসমিয়াতে জলাজমি,গভীর ঠাই বোঝাতে তার থেকেই বহুল প্রচলিত শব্দটিই ‘দহ̖’। তেমনি ‘ফাকুয়াগ্রাম’ নাম যে প্রাচীন ত্রিপুর রাজাদের উপাধি ‘ফা’ (<ফ্রা) থেকেই এসছে১৭৭ ‘ফাগুয়া’ (> ফাকুয়া <ফগ̖গু< ফল্গু) থেকে হয় নি তার নিশ্চয়তা কী? বৈষ্ণব পদে আছে,“ফাগুনে মধুপুর নাগরী নাগর বিলসই ফাগুক রঙ্গে।” তেমনি নদী বা স্থান নামের আগে বরে ‘ডি’ থাকলেই আমাদের সহজেই সেগুলোকে ডিমাছা বা বডো নৃগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে ফেলবার প্রবণতা আছে। সত্য বটে ‘ডিমাছা’ জনজাতি নাম থেকে শুরু করে তাদের প্রাচীন বসতি এলাকা জুড়ে এমন প্রচুর নদী বা স্থাননামে তাই আছে।পূর্ব আসামের দিহিং নদী থেকে ডিগবয় শহর অব্দি। সুনীতিকুমারও সেরকম সম্ভাবনার দিকে সংকেত করেছেন।কিন্তু সেই সম্ভাবনাই। তিনি আলেকজান্ডার কানিংহামের ‘Archeological Survey of India’-র অনুসন্ধানের উল্লেখ করেছেন,যেখানে নদী নামের শেষে ‘-তি’,‘-দি’ দুটোতেই তিব্বত বর্মী এবং অস্ট্রিক কোল উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন।তিনি এমন কি উত্তর ভারতের নদী রেবতি,গোমতি,ইরাবতী’ সব নদী নামের শেষেই এই ‘-তি’-এর তিব্বত-বর্মী উৎসের কথা লিখেছেন।সুনীতিকুমার লিখেছেন,“This suggestion is certainly wide of the mark, but the possibility of Tibeto-Burman –ti is not to be entirely excluded in studying toponomastics in North India.”১৭৮ বাণীকান্ত কাকতি কিন্তু উত্তর বাংলার করতোয়া,আসাম—পুববাংলার ‘লোহিত’ (< তি-লাও) থেকে শুরু করে তিহু,তিপাম,তিয়ক,দিহোং,দিবং,দিচং,নামতি, তিরাপ –এই সমস্ত স্থান ও নদীনামের মূল অস্ট্রিক নৃগোষ্ঠীতে অনুমান করেছেন।১৭৯
সুতরাং আমরা যে সিদ্ধান্তে যেতে চাই,তা এরকম যে এমন নয় সবাই ভুল দাবি করছেন। এমনও নয় যে সবাই সঠিক দাবি করছেন। বিশেষ করে যারা বিশেষ কোনো যুক্তিপরম্পরা দাঁড় না করিয়ে কিছু দাবি করছেন,তাদের সঠিক হবার সম্ভাবনা খুবই কম।যেটি দরকার,তা হলো বিষয়টির এক আগাগোড়া স্বতন্ত্র পদ্ধতিতে স্বতন্ত্র অনুসন্ধান।তার আগে সব সিদ্ধান্তই সম্ভাবনারই অধীন।একত্রে দ্রাবিড়, আর্য, অস্ট্রিক, মোঙ্গল—ভারতের এই চারটি প্রধান নৃ-ভাষাবংশের কালিক এবং কালানুক্রমিক তুলনামূলক অধ্যয়ন এই ব্যাপারে অনেকটা সাহায্য করতে পারে।
।। সিলেটি শব্দার্থতত্ত্ব এবং বাংলা - অসমিয়া ভাষা বিতর্ক ।।
এই উপশিরোনামের আলোচ্যবিষয়গুলো ইতিমধ্যে আমরা মোটের উপরে সেরেই এসেছি।যদি ‘শব্দভাণ্ডার’কে আমরা শব্দার্থতত্ত্বের অধীনে ধরি,তবে এই উপঅধ্যায়ে সেরকমই কিছু আলোচনার বিস্তার ঘটানো হবে।ড০ উপেন রাভা হাকচাম অসমিয়া-সিলেটির সাদৃশ্য দেখাতে গিয়ে,আমরা আগেই লিখেছি,শব্দার্থতত্ত্বের প্রসঙ্গের অবতারণা করেন নি। শুধু ‘সাদৃশ্য ধর্মী শব্দের উদাহরণ’ দিয়েছেন।১৮০ এবং সেই সব শব্দের সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক।এগারোটি ভাগে তিনি সেগুলো শ্রেণিবদ্ধ করেছেন। তার মধ্যে বিশেষ্য,বিশেষণ,ক্রিয়া বিশেষণ,ক্রিয়া আরু সংযুক্ত ক্রিয়া (জতুয়া ঠাঁচ-খণ্ডবাক্য) ইত্যাদিও আছে।শেষের দিকের এই শব্দগুলোকে আমরা আলোচনার বাইরে রাখছি,কেননা অযথা আবার ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্বের প্রসঙ্গ টানতে হবে এবং আলোচনা অহেতুক দীর্ঘতর হবে। যেটকুন আমরা আলোচনা করব,মনে হয় তাতেই আমাদের অভিমতের প্রতিষ্ঠা দিতে অসুবিধে হবে না।তথ্যগুলো তিনি কোত্থেকে নিয়েছেন সরাসরি উল্লেখ করেন নি। ‘প্রসঙ্গ-সূচী আরু পাদটীকা’-র একেবারে শেষের একটি মন্তব্যের থেকে মনে হয় অধিকাংশই নিয়েছেন বেণুধর রাজখোয়ার ‘Notes on Shlhetee Dialects’ এবং অসম সাহিত্য সভার ১৯৮৮তে হাইলাকান্দিতে অনুষ্ঠিত স্মরণিকা এবং অন্যান্য কিছু প্রকাশনা থেকে।সর্বত্র শব্দক্রমগুলোও এক নয়।তবে অনুমান করতে পারি,প্রথমে সিলেটি শব্দ বসিয়েছেন,তারপরে বন্ধনীতে অসমিয়া শব্দ রয়েছে,এবং শেষে মান বাংলা শব্দ বসিয়েছেন।সর্বত্র এই অসমিয়া বা মান বাংলা প্রতিশব্দ নেই।নির্ভুল উপস্থাপনার স্বার্থে আমরা অসমিয়া শব্দগুলোকেই অসমিয়া লিপিতে রাখছি। বাকি সব বাংলা লিপিতে।
ক) “সংখ্যাবাচক / সমষ্টিবাচক শব্দ:
চাইর(চাৰি) তু.বাংলা:চার,ঊনইশ(ঊনৈছ) তু.বাংলা: ঊনিশ,একইশ(একৈছ) তু.বাংলা: একুশ,আঠায়ন্ন (আঠাৱন) তু. বাংলা:আঠান্ন,ষাইঠ(ষাঠি)তু.বাংলা:ষাঠ,একহত্তর(একসত্তৰ)তু.বাংলা:একাত্তর,ছহত্তর(ছয়সত্তর)তু.বাংলা:ছিয়াত্তর,ছয়ান্নবই(ছয়ান্নবৈ) তু.বাংলা:ছিয়ান্নবই,গুইট(গোট),হাল তু.বাংলা:জোড়া, আলি(অঁৰা/হালি) তু.বাংলা:গণ্ডা।”১৮১
সিলেটি চাইর-এর প্রতিতুলনাতে অসমিয়া চারি-র উল্লেখ করে এখানে মান বাংলা ‘চার’ লিখেছেন। অথচ সাধু বাংলাতে নির্দেশাত্মক পরসর্গ যুক্ত হলেই শব্দটি অসমিয়ার মতই ‘চারি’ হয়ে যায়।যেমন চারিটি,চারিজন।সিলেটিতে সেরকম পরিবর্তন হয় না।অসমিয়া ‘উনৈছ’,‘একৈছ’-এর সদৃশ সিলেটি শব্দ ‘উনৈশ’,‘একৈশ’-এর উল্লেখ করেছেন। মোটের উপরে এটা সঠিক।কিন্তু এই সব ‘ছ’ অন্ত সংখ্যাশব্দমাত্রকেই তো অসমীয়া ভাষাবিদেরা অসমিয়াতে ঋণশব্দ বলছেন,সে কথা আগে আমরা লিখে এসেছি।তার উপরে,কখনো বা মাঝের ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব তাঁর নজর এড়িয়ে গেছে।শব্দ দুটি হয়—উন্নইশ,এক্কইশ।আবার ‘উনিশবিশে’ কিন্তু মান বাংলা রূপের থেকে সামান্যও উনিশবিশ হয় না।অসমিয়া আঠাঅন,একসত্তর,ছয়সত্তরের প্রতিতুলনাতে তিনি সিলেটি আঠায়ন্ন,একহত্তর,ছহত্তর-- কষ্টকল্পনা করেছেন বলেই আমাদের অভিমত। শব্দগুলো হবে আ́টা’ন্ন,আটপইঞ্চাশ,একাত্তইর,ছয়ত্তইর বা ছিয়াত্তইর। ‘হ’ লোপ প্রসঙ্গ প্রায় সর্বত্রই তিনি ভুলে যাচ্ছেন,কেননা তাতে ভাষাটি অসমিয়ার থেকে এক ধাপ অন্তত দূরে সরে যায়।তেমনি ছয়ান্নব্বই আছে বটে, কিন্তু ‘ছিয়ান্নব্বই’ও আছে যাতে মান বাংলার সঙ্গে শুধু ‘ছ’-এর উচ্চারণে তফাৎ /siɐnnbɔi/।
‘গুইট-গোট’ প্রসঙ্গ আমরা রূপতত্ত্বে বিস্তৃত ছুঁয়ে এসেছি।কিন্তু সিলেটিতে মান অসমিয়ার মতো ‘গোট’ও আছে, মান বাংলার মতো ‘গোটা’ও আছে,শুধু ‘ও’ উচ্চারণে ‘উ’ হয়ে যায়---গুট,গুটা।১৮২
মান বাংলা ‘জোড়া’ (জোড়+আ < যুগ্ম) অর্থে সিলেটি ‘হাল’ আমরা শুনিনি,‘জুড়া’ (জুড়+আ) নিশ্চয় আছে।১৮৩ এর অসমিয়া প্রতিশব্দ ‘যোৰ’।১৮৪ সেজন্যেই অসমিয়াতে বিয়েতে বর কনে পক্ষের পরস্পরে পরস্পরকে নিয়ে রসিকতা করে গাওয়া গানের নাম ‘যোৰা-নাম’।কিন্তু এর সুপ্রচলিত অসমিয়া প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘হাল’।১৮৫এর থেকেই মান বাংলা ‘জোড়া’ এবং সিলেটি ‘জুড়া’র আরেকটি অর্থ দুই বস্তু যোগ করে একটি করা।অসমিয়াতেও এর প্রতিশব্দ ‘জোৰা’।১৮৬
চারটি জিনিসের সমাহার বোঝাতে ‘হালি’ শব্দটি ময়মনসিংহেও ব্যবহৃত হয় সেই কথা বঙ্গীয় শব্দকোষেও আছে।১৮৭পুববাংলার পাশাপাশি মান বাংলাতেও শব্দটি এখন বহুল প্রচলিত।একটি সংবাদ শিরোনাম এরকম,‘ইলিশে আগুন,হালি ৪০ হাজার টাকা’১৮৮।তাই বলে সেই শব্দটি ‘গণ্ডা’র সমার্থক আর ‘গণ্ডা’ শব্দটি সিলেটি বা অসমিয়াতে নেই এমনটাও নয়। অসমিয়াতে ‘গণ্ডা’ দিব্যি আছে,অর্থ ‘লেখত চারিটা একেলগে’১৮৯ আর বাংলাতে এর অর্থ যেকোনো জিনিসের চারটি নয়, বরং পুরোনো আমলের টাকা কড়ির হিসেব।চার কড়ায় এক গণ্ডা।লোকে বলতে বলে,কড়ায়-গণ্ডায়।১৯০সিলেটিতেও শব্দটির এটাই অর্থ।১৯১ সিলেটিতে এবং পুব বাংলার বেশ কিছু ভাষাবৈচিত্র্যে সংখ্যাশব্দের প্রাচীন রূপ সংরক্ষণের প্রবণতাও বেশ রয়েছে,যেমন—আটপঞ্চাইশ(আঠান্ন),আসটো(আট)।
খ) “ বার মাহর নাম:
বৈহাগ(ব’হাগ) তু.বাং:বৈশাখ, জেঠ তু.বাং:জৈষ্ঠ, আহার তু.বাং:আষাঢ়, হাওন(শাওন) তু.বাং:শ্রাবণ, ভাদ তু.বাং:ভাদ্র,কাতি তু.বাং:কার্ত্তিক,আঘন(আঘোণ) তু.বাং: অগ্রহায়ন।”১৯২
বাংলামাসের নামে যে সাদৃশ্যগুলো দেখিয়েছেন তাতে আমাদের বিশেষ আপত্তির কারণ দেখিনা।জেঠ,আহার, হাওন,ভাদ,কাতি,আঘন এই সিলেটি নামগুলোর উল্লেখ করেছেন।কিন্তু ‘আহার’ হবে ‘আ́ড়’ (< আʔআড়)।হ লোপ পেয়ে আগের ‘আ’ রুদ্ধ-স্বরপথধ্বনিতে পরিণত হবে।‘আঘন’এর ‘ঘ’ মধ্যপ্রাণ হয়ে হবে ‘আগ’ন’।‘কাতি’ শব্দটি শ্বাসাঘাতের ধাক্কাতে হয় ‘কাত্তি’।বাক্যতত্ত্বের আলোচনাতে তিনি নিজেই একটি লৌকিক ছড়া উদ্ধার করেছেন,যেখানে একটি চরণ এরকম,‘আশ্বিন যাইতে কাত্তি হামাইতে...’। ‘আশ্বিন’টাও সিলেটিতে > ‘আশিন’> ‘আ́ইন’ হয়ে পড়ে বহু সময়।
কিন্তু যে খবরটি নেয়া হয় নি,সে হলো পুব বাংলার আর কোনো ভাষাতে এমনতর মাস নামের হদিশ মেলে কিনা।স্বাভাবিক ভাবেই আমরা কিছু ‘বারোমাস্যা’ গীতের সন্ধান করেছিলাম।‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’-তে ‘বগুলার বারমাসী’ গীতটি ময়মন সিংহ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন চন্দ্র কুমার দে।“বগুলার বারমাসীতে সামাজিক যে সকল চিত্র দেওয়া আছে,তাহা চণ্ডীদাসের যুগের...” লিখেছেন দীনেশ চন্দ্র সেন।১৯৩সেই গীতের কিছু পঙক্তি আমরা পর পর তুলে দিচ্ছি: “এই মত কান্দিয়া কন্যার এক মাস যায়।/সুমুখে আগুন মাস আইল নয়া বায়।।”১৯৪,‘এহিত না ফাগুন সকল মাসের রাজা।/রূপে ভইরা গন্ধে ভইরা পুষ্পকলি তাজা।।”১৯৫,“আইল চৈতের হাওয়া মন হইল পাগলা।/অঙ্গ জ্বলিয়া যায় মদনের জ্বালা।।”১৯৬,“শাওন বাওনা মাস আথাল পাথাল পানি।/মনসা পূজিতে কন্যা হইল উৎযোগিনী।।”১৯৭এই পালার ‘বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ,আষাঢ়,আশ্বিন,কার্তিক,পৌষ’ মাসের নাম কিন্তু আবার মান বাংলারই মতো।এরকম পালা গান সম্পর্কে যে কথাটি মনে রাখা ভালো যে লেখার এবং মুখের ভাষারূপ এগুলোতে মিলে মিশে থাকে।সুতরাং স্বভাষী কিংবা পরভাষী কারো পক্ষেই সূক্ষ্ম পরীক্ষা না করে বলা সম্ভব নয় লেখা শব্দগুলোর মুখেও প্রচলন রয়েছে কি নেই।কিন্তু ‘আগুন,ফাগুন,শাওন, চৈত’ নিয়ে মনে হয় কোনো সংশয় থাকবার কথা নয়—আর এগুলো তদ্ভব রূপে অনেকটাই অসমিয়ারই মতো।‘হাতী-খেদার গান’ চট্টগ্রামের পালা। সেখানে আছে,“আহন মাসে খোয়া ঝরের ধানে লৈল পাক।/করলডেঁয়ার মুড়ার মাঝে শুইন̖লুম হাতীর ডাক।।”১৯৮‘আহন’ শব্দটিকে কী বলা যাবে? অসমিয়া ‘আঘোণ’ এর ‘হকারী ভবন’?
গ) “গছ-গছনি, ফল-মূল, শাক-পাচলি আদির নামঃ
হালুক (সেলুক) তু.বাং:রক্ত-কম্বল,কুহিয়ার তু.বাং:আঁক,হফ̖রি (সফুৰি) তু.বাং:পেয়ারা,উর্হি (উৰহী) তু.বাং:শিম̖, বিন্না (বিৰিণা) তু.বাং:খড়,খের তু.বাং:খড়,চাম তু.বাং:চাম্বল,জাই (জাতি) তু.বাং:জাওয়া,গুয়া (গুৱা) তু.বাং:সুপারি,টেঙ্গা (টেঙা) তু.বাং:টক,জির-বট (জরি-বট) তু.বাং:পিপল,বাকল (বাকলি),এমরা (অমৰা/গ্রাম্যরূপ:এমেৰা) তু.বাং:আম̖ড়া, গন্ধৰই (গন্ধসৰই),পুমা (পমা),গাম্বারি (গমাৰি),মুলি (মকাল বাঁহ),ডলু (ডলৌ বাঁহ),বাজাইল (বিজুলী বাঁহ),সোণতাৰা (সুমথিৰা),শাক (শাক=পাচলি)।”১৯৯
শালুক এবং রক্তকম্বল---দুইই পদ্মপ্রজাতির ফুল।টাকার কুবের যেভাবে সাদৃশ্যের প্রভাবে টাকার কুমীর হয়ে যায়,সেভাবেই রক্ত-কমল বাংলাতে রক্তকম্বল।শব্দটি সম্ভবত সংস্কৃতেই এই রূপ নিয়েছিল। নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত ‘বিশ্বকোষে’ এই ফুল সম্পর্কে লেখা আছে, “কম্বলং জলমাশ্ৰয়ত্বেনাস্ত্যস্তেতি অৰ্শ আল্পচ,রক্তং রক্তবর্ণং কম্বলমুৎপলমিতি। রক্তোৎপল। এই স্বনামপ্রসিদ্ধ জলজ পুষ্প (Nymphoea Lotus) রক্তনাল নামে প্রচলিত।বিল,পুষ্করিণী প্রভৃতি পুরাতন জলাশয়ে পদ্মের ন্যায় এই লতা জন্মে।স্থানবিশেষে ইহা স্বতন্ত্র নামে পরিচিত।পশ্চিমভারতে কম্বল,ছোট কম্বল; বাঙ্গালায়—শালুক, নাল, রক্তকম্বল, ছোট সুঁদী; উড়িষ্যায়— ধবলর্কৈ, রঙ্গর্কৈ; সিন্ধু—কুনি, পুনি; দাক্ষিণাত্য—অগ্নিকুল; গুঞ্জরাতী—কম্বল, নীলোপল;তামিল-অল্পী তমরৈ, অম্বল; তেলগু—অল্লিতমর, তেল্প-কলব, কোতেক,এরকলুব(লালমাল), কলহারম্; কণাড়া—নদলেহবু,মলয়ালম্— অম্পল; ব্রহ্মদেশে—কাছ-ফুল্য-কিয়ানি; সিংহল-ওলু;সংস্কৃত পৰ্য্যায়--কমল, কুমুদ,কহলার,হল্পক(হেলা?), সন্ধ্যক, আরব ও পারস্ত—নীলুফর।” ২০০ তার মানে ‘শালুক’ মান বাংলাতে নেই তা নয়। তবে কিনা তার রঙ কেবলি লালও নয়। নজরুলের গানের কলি আছে,“ভোরে ঝিলের জলে শালুক-পদ্ম তোলে কে...” সুতরাং সিলেটিতে ‘স’ ধ্বনির যা হয় ‘হ’ হয়েছে,এর বেশি পরিবর্তন নজরে পড়ে না,বরং অসমীয়াতে প্রথম স্বরধ্বনিও পরিবর্তিত হয়ে ‘এ’ হয়েছে।
‘কুহিআৰ’ (< কোষকার?) শব্দটি অসমিয়া।২০১ সিলেটিতে শব্দটি ‘কুশিয়ার’/kuʃiɐr/,নদীনাম ‘কুশিয়ারা’তে বা ‘কুশিয়ার’-এ যেমন--‘শ’ ধ্বনিটি সুরক্ষিত।অথবা একেবারেই লুপ্ত ‘কুইয়ার’।সত্য বটে,ফল কিংবা এই তৃণটি অসমিয়া এবং সিলেটিতে এই নামেই জনপ্রিয়।মান বাংলা শব্দটি ‘আক’ (< ইক্ষু)২০২,অথবা ‘আখ’-- ‘আঁক’ নয়।রবীন্দ্র উপন্যাসে আছে ‘ক’বছর ধরে জাভা মরিশস থেকে আখ আনিয়ে চাষ করালুম’(ঘরেবাইরে;পরিচ্ছেদ১৫)।কিন্তু শব্দটি নোয়াখালিতে কিন্তু সিলেটির মতোই অনেকটা ‘কুঁইয়ার’ বা ‘কুঁইর’,চট্টগ্রামীতে ‘কুইশশাল’,সুন্দরবনে ‘কুশোর’ এবং চাকমা ভাষাতে ‘কুচ্যাল’।২০৩
‘সফরি’ বা ‘হফরি’ অসমিয়াতে ‘সফুৰি’,‘সঁফুৰি’২০৪,‘সফৰি আম’২০৫।তবে জনপ্রিয় ‘মধুৰি আম’ নামেই। ‘সফরি’ কথাটি মান বাংলাতে নেই নয়,‘সফরি কলা’ সিলেটিতে যা মান বাংলাতেও তাই।আরবি ‘সফর’ শব্দের থাকে এসেছে।২০৬‘সফর’ শব্দে এখন ভ্রমণ করা বোঝালেও,এক কালে সম্ভবত বাংলাতে ‘বিদেশ’ বা বাসস্থান ভিন্ন অন্য জায়গাও বোঝাতো।বাংলা পদ্মাপুরাণে আছে,“বানিজ্যেতে ছিলা সাধু উত্তর সফর।/রাত্রিকালে পদ্মা গেলা চম্পকনগর।।’২০৭বিশেষণে ‘সফরী’ ---যে ঘুরে বেড়ায় বা বিদেশী।অন্যদিকে ‘পেয়ারা’ শব্দটির উৎস পোর্তুগিজ ‘পেরা’ /perā/।পোর্তুগাল থেকে আসা ফল,বা পোর্তুগিজ নৌবণিকদের নিয়ে আসা ফল তাই শুরুতে ‘সফরি আম’,পরে শুধুই ‘সফরি’।দিনাজ পুরের বাংলাতেও কিছু অসমিয়া ভাষাবৈচিত্র্যের মতো এই ফলের নাম ‘সফরি আম’-ই।২০৮ যে সারাক্ষণ ঘুরে বেড়ায় তার চাঞ্চল্যের সাদৃশ্যে রবীন্দ্রনাথ ‘চঞ্চল মানুষ’ অর্থেও শব্দটির ব্যবহার করেছিলেন,“এমন সফরী অপেক্ষা রোহিত মৎস্যের মূল্য অধিক।”২০৯সুতরাং শব্দ হিসেবে ‘সফরি’ তিন ভাষাতে থাকলেও ফলের নাম হিসেবে তিন ভাষাতে তিন নাম জনপ্রিয়।সিলেটিতে ‘সফরি’ বা ‘হফরি’,অসমিয়াতে ‘মধুরি আম’,মান বাংলাতে ‘পেয়ারা’।
‘শিম’(< শিম্বী)২১০ শব্দটি সিলেটিতে অপরিচিত বা অপ্রচলিত কোনটিই নয়,তবে জনপ্রিয় ‘উরি’/উʔরি/।মোটের উপর সঠিক উচ্চারণেই ধরতে গিয়ে উপেন রাভা হাকাচাম ‘উর্হি’ লিখেছেন।এর কাছাকাছি শব্দ অসমিয়া ‘উৰহী’।কিন্তু ‘হ’টি লোপ পেয়ে সিলেটিতে পূর্ব স্বরকে রুদ্ধধ্বনিতে রূপান্তরিত করে।তাই ‘হ’ উচ্চারিত হয় না।সম্ভবত বুকে বীজ ধরে রাখে বলে তৎসম ‘উরসি’২১১ থেকে শব্দটি তদ্ভব হয়েছে। ‘কুশিয়ার’-এর মতো এটিও সিলেটিতে বহুল প্রচলিত শব্দ বটে, কিন্তু ‘আখে’র মতো অপ্রচলিত শব্দ নয় সিলেটিতে ‘শিম’ ।
‘বিন্না’ বা অসমিয়া ‘বিৰিণা’ কেন মান বাংলাতে ‘খড়’ হতে যাবে আমরা বুঝি নি।রবীন্দ্রকবিতাতে কতবার কতভাবে আছে ‘বেণু’—“ওই বেণুবন দুলে ঘনঘন পথপাশে দেখ্ চাহি রে।”২১২শব্দটি বাংলাতে ‘বীরণ’ বা ‘বেণা’ বলেও পরিচিত।২১৩এর পরিচিত নাম ‘কাশ’(< কুশ)।অসমিয়াতে ‘কঁহুৱা’।‘বেণুবন’ অসমিয়াতে ‘কঁহুৱাবন’ বা ‘কাঁহিবন’২১৪ ভূপেন হাজরিকার গানে আছে,‘কঁহুৱা বন মোৰ অশান্ত মন আলফুল হাতেৰে লোৱা সাৱটি...’।সিলেটি শহুরেদের মধ্যে ‘কাশ’ পরিচিত শব্দ,গ্রামীণ জনতার মধ্যে ‘বিন্না’ প্রচলিত হলেও ‘কাশ’ একেবারে অপরিচিত শব্দ নয়। তা যদি হতো মাছের নাম হতে পারত না ‘কাশখাউরি’।‘ইতা লাগত নায়।দাড়কিনা কাশখাউরি ইতা হিন্দুয়ে খায় না।রউ ঘাঘট দিবানি।’(সু.গা.পা.; পঁয়ত্রিশ) মান বাংলা ‘খড়’-এর সিলেটি –অসমিয়া প্রতিশব্দ একই ‘খের’।শব্দটি তিনি এর পরেই লিখেছেন কিন্তু সেখানে অসমিয়া ‘খেৰ’ লিখবার সুযোগটি নেন নি।
মান বাংলা ‘চাম্বল’ শব্দটি আমরা বহু সন্ধানেও পাইনি।বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালি উপজেলাতে ‘চাম্বল’ বা ‘চম্বল’ নামে একটি ‘ইউনিয়ন’ আছে।এই ‘ইউনিয়ন’ সেদেশে পুরসভা,মৌজার মতো প্রশাসনিক এলাকাকে বলে।ময়মন সিংহে এই নামে একটি দুর্লভ গাছ আছে।“আকারে ছোট কাঁঠালের মতো দেখতে চাম্বলের ফল স্বাদে টক”২১৫ সুতরাং এই শব্দ ‘চর্ম’ থেকে আসা সিলেটি ‘চাম’ নয়।সম্ভবত ‘চম্পা’/‘চম্পক’ থেকে আসা ‘চাম’ কাঠের কথা হচ্ছে।মান বাংলা শব্দটি ‘চাঁপা’-ও।‘চাম্বল’ নয়।এই ‘চম্পক’ থেকেই মনসামঙ্গলের চন্দ্রধর বণিকের নগরের নাম ‘চম্পকনগর’।সেইক্ষেত্রে সিলেটি –অসমিয়া দুই ভাষাতেই ‘চাম̖’২১৬ শব্দটি আছে বটে।কিন্তু মান বাংলা ‘চামড়া’ (< চর্ম) অসমিয়া-সিলেটি দুই ভাষাতেই শেষ ধ্বনি সামান্য পালটে ‘চামৰা’।২১৭সিলেটিতে তদুপরি আছে ‘চাম̖’।২১৮ ‘চামরা’ বললে সিলেটিতে কখনো পায়ের তলার চর্মরোগকেও বোঝায়।‘চাম’ (< চর্ম) সাদ্রি ভাষাতেও আছে,বিখ্যাত সাদ্রি গানে আছে,‘সাহিব বুলে লিব পিঠের চাম। রে যদুরাম, ফাঁকি দিয়া পঠাইলি আসাম ।।’
‘জাই–জাতি-জাওয়া’ একটি অশ্রুতপূর্ব নজির।নৃগোষ্ঠী,ভাষাগোষ্ঠী হিসেবে ‘জাতি’ সিলেটি,মান বাংলা এবং অসমিয়া সবেতেই সুপ্রচলিত শব্দ।সিলেটিতে ‘জাই’ এবং মানবাংলা ‘জাওয়া’ আমরা বহু অনুসন্ধানেও অন্তত ‘জাতি’ অর্থে পাই নি।বঙ্গীয় শব্দকোষে পাচ্ছি ‘জাতি’ প্রাকৃতে ‘জাই’ হয়েছিল বটে।বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলে ‘কুটজকাঞ্চন জাই’ বলে একটি ফুলের নাম আছে।২১৯‘জাঁওয়াতি’ বলে আরেকটি শব্দ পাচ্ছি,সম্ভবত ‘জাতক’ শব্দের থেকে তৈরি—অর্থ জন্মপত্রিকা বা কোষ্ঠী।আবিদ রাজা মজুমদারের অভিধানে ‘জা̇’ই’ বলে একটি শব্দ পাচ্ছি-- অর্থ থলথলে কাদা,নষ্ট বা নোংরা।তিনি লিখেছেন শব্দটি যবাগু > যাউ হয়ে এসেছে।আরেকটি শব্দ পাচ্ছি ‘জা̇’ওয়া’,এসেছে ঝামক> ঝামা হয়ে। অর্থ বিশেষভাবে পোড়া ইট।২২০
গুয়া এবং সুপারি দুই শব্দই মানবাংলা এবং সিলেটিতে আছে।‘গুয়া’ যে মান বাংলাতে বা সাধারণভাবে বাংলা ভাষাতে অপ্রচলিত বা অচেনা শব্দ নয়,দেখাতে আমরা আগে উপেন্দ্রকিশোর থেকে একটি নজির দিয়েছিলাম।এবারে কবিকঙ্কন চণ্ডীর একটি বিকল্প পাঠে পাচ্ছি,“গুয়া নারিকল বড়ি নগরে তুলিল বড়ি/দেখিতে দেখিতে চিত্র সারি সারি।”২২১ বস্তুত ‘সুপারি’ শব্দটি বাংলাতে নবীন,সিলেটিতেও প্রচলিত শব্দ। সেও ‘সফরি’ শব্দের রূপান্তর।২২২ কিন্তু অসমিয়াতে তো এর কোনোটাই নয়,তৃতীয় তদ্ভব শব্দ ‘তামোল’২২৩ সুপ্রচলিত শব্দ।অসমিয়াতে এর অর্থ যদিও ‘সুপারি’২২৪ সাধু বাংলাতে এর তৎসম রূপ ‘তাম্বুল’ শব্দের অর্থ চুন সুপারি দিয়ে সাজানো পান।২২৫ রবীন্দ্র গল্পে আছে,‘জামাতা সুস্থচিত্তে তাম্বুল চর্বণ করিতে করিতে প্রসন্নহাস্যমুখে আলস্যমন্থরগমনে ভূমিলুণ্ঠ্যমান চাদরে অন্তঃপুরে যাত্রা করিলেন।’(প্রায়শ্চিত্ত; গল্পগুচ্ছ)আরাকান রাজসভার কবি আলাওলের কাব্যে আছে,‘অধর রাতুল কৈল তাম্বুল রসে’ (পদ্মাবতী)।
‘টেঙ্গা’ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।অসমিয়া –সিলেটিতে শব্দটি একই।বানানে যাই থাক।আবিদ রাজা মজুমদার লিখেছেন ‘টেংগা’,সঙ্গে এটি যে অসমিয়া ‘টেঙ্গা’ তাও উল্লেখ করেছেন।মান বাংলাতে তাই ‘টক̖’।অর্বাচীন সিলেটিতেও স্বাদ অর্থে ‘টক̖’ রয়েছে,কিন্তু প্রাচীন অর্থ এর ‘নেশা’।বঙ্গীয় শব্দকোষের মতে সংস্কৃত তক্রু> প্রাকৃত তক্ক> বাংলা টক্ক> টক।২২৬সুতরাং ‘টেঙ্গা’ ভিন্ন উৎস থেকে আসতেও পারে।উপেন রাভা হাকাচামের সুযোগ ছিল শব্দগুলোর ভোট-বর্মী বিকল্প থাকলে তার উল্লেখ করা। কেননা,এই সম্পর্কে তিনি বিশেষজ্ঞ।
‘জির-বট’(জরি-বট)‘পিপল’ কোনোভাবেই বাংলা শব্দ নয়।হিন্দিতে ‘অশ্বত্থ’-কে ‘পিপল’ বলে। তেমনি ‘জির-বট’ একটি কষ্ট কল্পিত শব্দ। সিলেটিতে ‘বট̖’ বললে প্রথমে সবাই ‘অশ্বত্থ’-কেই বোঝেন।তারপরে আলাদা করবার দরকার পড়লে ‘কাঠাল’ ইত্যাদি পূর্ব পদ যোগ করে প্রজাতি বোঝান মান বাংলারই মতো।‘জির’(<জীর্ণ) কেঁচো জাতীয় একরকম পোকার নাম।২২৭অসমিয়াতে ‘অশ্বত্থ’-কে ‘আঁহত̖’ বলে।২২৮তবে ‘অশ্বত্থ’ বটের শেকড় ঝুলে পড়ে আবার সেখান থেকে গাছ গজিয়ে বহুদূর ছড়ায় বলে সেই ঝুলন্ত শেকড়কে সিলেটিতেও২২৯ এবং মান বাংলাতেও ‘ঝুরি’২৩০ বলে,‘জির’ নয়। অসমিয়াতে ‘আঁহত’ কে ‘জরি’ বলেও বটে।২৩১ এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘ficus rumphii blume’।
সিলেটি ‘বাকল̖’ অসমিয়াতে ‘বাকলি’ বটে।তদ্ভব শব্দটি বল্কল থেকে আসা।কিন্তু এ তো মান বাংলাতেও প্রচলিত শব্দ।রবীন্দ্র কবিতাতে আছে ‘পরিনু সে পুরাতন গাছের বাকল!’ (নাটক:বন-ফুল) তবে রবীন্দ্রনাথ মূল অর্থ গাছের ছাল, বড়জোড় তার থেকে তৈরি পোশাক সেই প্রাচীন অর্থেই ব্যবহার করলেও,অসমিয়া শব্দটির অর্থ বিস্তৃত হয়ে ফলমূল, মাছের ছাল অব্দি এগিয়েছে।২৩২সিলেটিতে আরেক ধাপ এগিয়ে মানুষের গায়ের ‘ত্বক’ অব্দি এগিয়েছে,তাও গালিগালাজের সময়।২৩৩যেমন –পিটিয়া ছাল-বাকল তুলি দিমু!ফলমূল শাক সবজির ‘বাকল’ থাকলেও,মাছ-মাংসের সিলেটিতে ‘বাকল’ হয় না।সেদিক থেকে সিলেটিতেও শব্দটি গাছের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
‘আমড়া’ সংস্কৃত আম্রাতক> প্রাকৃত অংবাডর হয়ে বাংলাতে এসেছে,বঙ্গীয় শব্দকোষের তাই অভিমত।২৩৪ অসমিয়াতে শব্দটি অমৰা/এমেৰা-ই বটে।কিন্তু সিলেটিতে ‘আমড়া’-ই সুপ্রচলিত শব্দ,‘এমরা’,‘এওলা’(আমলকি)-র সাদৃশ্যে ক্বচিৎ কদাচিৎ উচ্চারণ বৈচিত্র্য হিসেবে শোনা যায়।‘আমড়া’ দিয়ে সিলেটি গালি অব্দি আছে,‘তুমি আমার আমড়া করবায়!’ সিলেটে প্রচলিত পদ্মাপুরাণে আছে,“আমড়া ডেউয়া কাঠল,তাতে ধরে বহু ফল/কমলা,লেচু আর লুকলুকি”২৩৫ যদিও আমরা যে দুই অভিধানের কথা লিখে আসছি তার দুটির কোনোটিতেই ‘আমড়া’ বা ‘এমরা’ কোনোটিই নেই।
আবিদ রাজা মজুমদার এবং জগন্নাথ চক্রবর্তীর দুই অভিধানেই ‘গন্ধরই’ বলে কোনো শব্দ পাইনি,‘গনরোই’ রয়েছে। শেষের এই ‘রোই’ বুঝি ‘√র’ ‘আছে’ অর্থ বোঝায় লিখেছেন জগন্নাথ চক্রবর্তী।তিনি বৈজ্ঞানিক নাম লিখেছেন Ginnamomum Glandiliferum।২৩৬সম্ভবত প্রথম শব্দটির প্রথম বর্ণ ‘C’-এর বদলে ভুল করে ‘G’ ছাপা হয়েছে,হবে ‘cinnamomum glanduliferum’।যদি তাই হয় তবে এটি ‘কর্পূর’ জাতীয় গাছের নাম।এর মান বাংলা প্রতিশব্দ আমরা পাই নি।
‘পুমা’ সম্ভবত মান বাংলা নাম।নলিনীকান্ত চক্রবর্তীর থেকে গাছটির পুরো বর্ণনা দিয়েছেন জগন্নাথ চক্রবর্তী।এক ধরণের চিরসবুজ বুনো গাছ।বর্ষাতে বীজ পাকে,বীজে পাখা থাকে যা তাদের বংশ বিস্তারে সাহায্য করে।জগন্নাথ এর ‘আঞ্চলিক’ বানান লিখেছেন ‘পোমা’।অর্থাৎ ‘উ’ এখানে উলটো ‘ও’ হচ্ছে,অসমিয়াতে সেটিও লোপ পেয়ে ‘পমা’ হয়েছে হয়তো,আমাদের কাছের কোনো অভিধানে শব্দটি পাই নি।
সংস্কৃত ‘গম্ভারিকা’ থেকে >‘গাম্ভারী’তো মনে হয় সাধুবাংলার পরিচিত শব্দ,বঙ্গীয় শব্দকোষে তাই পাচ্ছি।২৩৭ মান বাংলা২৩৮এবং সিলেটিতে ‘গামারি’ও ২৩৯বলে।কিন্তু ‘গাম্বারি’ আমরা পাইনি।বরং আরো ধ্বনি পরিবর্তিত হয়ে শব্দটি ‘গা’মাই’ হয়ে যায় কখনো বা।সিলেট-কাছাড়ের প্রচলিত পদ্মাপুরাণে আছে,“এওলা হরীতকী আম,বেল বউল চাইর চাম/সেগুন , বনাক, ঘামাই,আর সুন্ধি।”২৪০ অসমিয়া ‘গমাৰি’২৪১ সেদিক থেকে মান বাংলা ‘গামারি’-র কাছাকাছি শব্দ।
বাঁশের এতো বিচিত্র প্রজাতি যে সব বাঁশ সর্বত্র নাও থাকতে পারে।তবু,‘মুলি’ ‘বাঁশ’ এবং ‘বাস’ দুই বানানেই একই অর্থে বঙ্গীয় শব্দকোষে আছে।২৪২শুধু সিলেটিতেই নয়,এই নামে বাঁশটি অবিভক্ত বাংলাদেশেই সুপরিচিত। অসমিয়াতে এর নাম ‘মকাল বাঁহ’।‘ডলু’ সম্ভবত পাহাড় বা ছোট টিলার গায়ে হয় বলে সারা পূর্বোত্তরেই মেলে,সিলেট- ত্রিপুরা,চট্টগ্রামেও বাঁশটি একই নামে পরিচিত।অসমিয়াতে এটি ‘ডলৌ বাঁহ’।‘দৈনিক ইত্তেফাকে’র একটি প্রতিবেদনে পাচ্ছি চট্টগ্রামের এই বাঁশগুলোর নাম,‘মূলী বাঁশ,ডলু বাঁশ,নিতিয়া বাঁশ,ওরা বাঁশ,বাইজ্জা বাঁশ,মহাল বাঁশ’।২৪৩ ‘বাজাইল’ সিলেটিতে একটি বাঁশের নাম বটে,তাঁর থেকে অসমিয়া ‘বিজুলী বাঁহ’-এর নাম খুব ঘনিষ্ট শোনায় না,বরং চট্টগ্রামের ‘বাইজ্জা’ নামশব্দটি খুব কাছের শোনায়।
‘সোণতাৰা’(<স্বর্ণতারা)আসলে ‘কমলা’র স্বল্পপ্রচলিত অসমিয়া নাম,ব্যাপক প্রচলিত নাম ‘সুমথিৰা’।২৪৪ সিলেটিতে ‘কমলা’ই প্রচলিত নাম,আমরা আগেই তার স্বপক্ষে পদ্মাপুরাণের একটি কলি তুলে দিয়েছি।বরং বঙ্গীয় শব্দকোষের মতো বিশাল অভিধানে শব্দটি নেই দেখে আমরা কিঞ্চিৎ অবাক হয়েছি।কিন্তু শব্দবোধ অভিধানে রয়েছে।২৪৫ চট্টগ্রামীতে শব্দটি ‘ক’অলা’।২৪৬
‘শাক’ আর অসমিয়া ‘শাক=পাচলি’ নিয়ে কোনো অনুসন্ধান করাই বৃথা।যেকোনো বাংলা দৈনিক কাগজ খুললেই ‘শাক-সবজি’ কথাটি পাওয়াই যাবে।সিলেটিতে বরং শব্দটি প্রায়ই ‘শাগ’ হয়।২৪৭
ঘ) “জীব-জন্তু, চরাই –চিরিকতি, মাছ-কাছর নাম:
মেকুর(মেকুৰী) তু.বাং:বিড়াল, নেউল তু.বাং:বেজি,দামা(দমৰা) তু.বাং:এঁড়ে, ডাউক তু.বাং:ডাক, সরালি (শৰালি) তু.বাং:নেরুল, উদ তু.বাং:উদ-বিড়াল, ঘরিয়াল তু.বাং:কুম্ভীর, লাচ(লাচন), ভাঙ্গা(ভাঙন), ঘনিয়া(ঘরিয়া), শিঙ্গরি (শিঙৰা), তু.বাং:টেংৰা, বামি তু.বাং:বাম, রৌ তু.বাং: রুই,কান্ধ̖লা(কান্ধুলি) তু.বাং:ফলুই,বাউ(বাহু) তু.বাং:কাতলা, ইচা (মিছা) তু.বাং:চিংড়ি,মির্গা(মিৰিকা) তু.বাং:মৃগেল, পাণী খাউরি(পানী কাউৰী), বগা/বগুড়া(বগ/বগলী), লিক(লেখি ওকণি), চ’রা(চরাই)।”২৪৮
‘মেকুর’ একটি ধ্বন্যাত্বক নাম।‘মেউ করে’ থেকে---মেকুর।২৪৯সিলেট-কাছাড়ে ‘মেউক̖রা-মেউক̖রি’ প্রতিশব্দে নামটির ধ্বন্যাত্মক উৎস আরো স্পষ্ট।অসমিয়াতে এটি ‘মেকুৰী’।কিন্তু বেড়াল এই নামে শুধু সিলেট–কাছাড়ের বা অসমিয়া ভাষাতেই নয় ময়মন সিংহ থেকে চট্টগ্রাম অব্দি এটি কোথাও ‘মেকুড়’,কোথাও ‘মেউর’ উচ্চারিত হয়।অর্থাৎ নামটির একটি আঞ্চলিক চরিত্র স্পষ্ট।
‘সাপে-নেউলে’ কথাটি সিলেটি বটে,মান বাংলা বাগবিধির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।এই যেমন শরৎ উপন্যাসে আছে, “লোকে যে বলে স্ত্রী-পুরুষের ধর্ম এক না হলে চলে না,কিন্তু ধর্মেকর্মে তোমার-আমার ত সাপে-নেউলে সম্পর্ক। আমাদের তবে চলে কি করে?”(শ্রীকান্ত:চতুর্থপর্ব)‘বেজ’ ‘ বৈদ্য’-এর থেকে আসা তদ্ভব শব্দ।তার থেকে ‘বেজি’ অনুমান করা যায়।২৫০অসমিয়াতেও ‘নেউল’ থাকলেও২৫১ ‘নকুল’ থেকে আসা তদ্ভব শব্দ এটি।‘বেজি’ও একেবারেই অপ্রচলিত শব্দ নয়।গোয়ালপাড়ার ভাষাবৈচিত্র্যগুলোতে তো আছেই।২৫২
মান বাংলা ‘এঁড়ে’ মানে অণ্ডকোষ আছে যার। অর্থাৎ পুরুষ।‘এঁড়ে বাছুর’ বললে পরে বাচ্চাবলদ বোঝায়,অন্যথা এ মানুষ থেকে শুয়োর সবেতেই বিশেষণ হিসেবে বসে।২৫৩সিলেটিতে পুরুষ বলদ বাচ্চার প্রতিশব্দ ‘দামা’(<সং.দম্য) ও আছে ‘ডেকা’ও আছে।অসমিয়া ‘দমৰা’র কাছাকাছি বরং বাংলা মান বাংলা ‘দামড়া’।“শ্রীরামকৃষ্ণ -- বড় বেলায় দামড়া হয়েছে,আমি বর্ধমানে দেখেছিলাম।একটা দামড়া,গাই গরুর কাছে যেতে দেখে আমি জিজ্ঞেস কল্লুম,এ কি হল?এ তো দামড়া!তখন গাড়োয়ান বললে,মশাই এ বেশি বয়সে দামড়া হয়েছিল।তাই আগেকার সংস্কার যায় নাই।”(শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত) চট্টগ্রামী বাংলাতে প্রবাদ আছে,“ন-বারির গোত্র দামরা ছা বিয়ায়”।২৫৪অন্যদিকে নোয়াখালিতে বাচ্চা বলদকে ‘আবাল̣’ বলে লিখেছেন রবীন্দ্র কুমার দত্ত।বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধানে আছে নোয়াখালি,চট্টগ্রামী,ঢাকার ভাষাতে নপুংসক বলদকে ‘আবাল’ (<আ+বাল কিংবা আ+বয়ল< বলীবর্দ) বলে।২৫৫
মানবাংলাতে ‘ডাক’ আছে বটে,কিন্তু পাখিটির সুপ্রচলিত নাম ‘ডাহুক’।২৫৬ শ্রীকান্ত উপন্যাসে আছে “সম্ভবত: আমারি ন্যায় বিক্ষুব্ধ কোন একটা ডাহুক নদীর কল্মীদলের উপরে বসিয়া ততোধিক কঠিনকণ্ঠে ইহাদের বার বার তিরস্কার করিয়াও স্তব্ধ করিতে পারে নাই।”(চতুর্থপর্ব:৮) ‘হ’ লোপ পেয়ে অসমিয়া২৫৭ এবং সিলেটি দুয়েতেই ‘ডাউক’। পাবনার বাংলাতে ‘ক’ লোপ পেয়ে শব্দটি ‘ডাহু’।২৫৮
‘সরালি’ তো সিলেটিতে থাকবার কথা নয়,নামটি আসলে ‘হরালি’২৫৯ অসমিয়াতে ‘শৰালি’।‘বুনোহাঁস’ বললে সহজে বোঝা যায়।এগুলো পরিভ্রমী পাখি,সম্ভবত উত্তর আমেরিকার থেকে পূর্বভারত দিয়েই প্রবেশ করে।মানবাংলাতে পাখিটি ‘শরাল’২৬০। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্যে আছে,“কিবা নদী গর্ভ ময়,চরিত কদম্বচয়,চক্রবাক সারস শরাল।” (কাঞ্চীকাবেরী) আমরা কোথাও খোঁজে মান বাংলাতে ‘নেরুল’ বলে কোনো পাখি নাম পাইনি,শব্দটি কষ্টকল্পিত বলেই মনে হচ্ছে।
‘উদ̖’ তো সিলেটিতেও বন্য বেড়ালের নাম।মান বাংলা ‘উদ-বিড়াল’–এর সঙ্গে এর ধ্বনিতাত্ত্বিক,রূপতাত্ত্বিক বা অন্যকোনোরকম স্বাতন্ত্র্য তো নজরে আসে না। বরং মান বাংলাতে এর একটি স্বতন্ত্র নাম আছে ‘ভোদড়’২৬১। বিখ্যাত এক বাংলা ছড়ায় আছে ‘ না’ নিয়ে গেল বোয়াল মাছে।/তাই না দেখে ভোঁদড় নাচে’।
‘ঘরিয়াল’ এবং ‘কুম্ভীর’ দুই ভিন্ন প্রাণী যদিও দুটোই জলজ সরিসৃপ।ঘড়িয়ালের মুখ দীর্ঘ লম্বাটে হয়।সুতরাং একে অন্যের বিপরীতে দুই ভিন্ন ভাষাবৈচিত্র্যে বসানো বিভ্রান্তিকর।সিলেটিতে ‘কুমীর’ শব্দটি নেই,‘কুম্ভীর’ আকছার শোনা যায়।একে ‘কুমইর’ও২৬২বলে।‘ঘরিয়াল’ সিলেটিতে ‘গ’ড়ইল’।২৬৩ অসমিয়াতে ‘ঘঁৰিয়াল’২৬৪ কুম্ভীৰ আর ‘ঘঁৰিয়াল’-এর প্রজাতি যে এক নয় সে অসমিয়া অভিধান ঘাটলেও আঁচ করা যায়।২৬৫
সিলেটিতে মাছের নাম ‘লাচো’।২৬৬ ‘লাচ’-ও লেখা যেতে পারে,কিন্তু ‘লাচ̖’ নয়। আমরা ‘লাচন’ শব্দটি মিশিং উপাধি২৬৭ সহ আরো অন্যান্য অর্থে পেলেও মাছ অর্থে পেলাম না।তবে তিনি যখন লিখেছেন,থাকবে নিশ্চয়।তবে একটি কথা মনে রাখা ভালো --- পশু-পাখি-মাছ-শাক–সবজি-ফল ইত্যাদির নাম স্থান ভেদে একই ভাষার ভেতরেই পালটে যায়।যেমন ‘লাচো’কেই অন্যত্র অনেকে ‘ভাঙন’ বলেন।‘খারিশ’,ফারিশ’ও বলেন।এগুলো আমরা নানা জনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি।
‘ভাঙ্গা’ বহু অনুসন্ধানেও সিলেটিতে কোনো মাছের নাম পাই নি,অসমিয়াতে ‘ভাঙন’ আছে।বঙ্গীয় শব্দকোষেও ‘ভাঙ্গন’ আছে।২৬৮তার মানে সাধারণ ভাবে বাংলাতে এটি পরিচিত নাম।‘বরেন্দ্ররন্ধন’ বলে একটি বইতেও মাছটির নাম পেলাম।২৬৯ বিভূতি ভূষণের উপন্যাসে আছে,“অপর্ণা রাগ করিতে গিয়া হাসিয়া ফেলিল,বলিল---তুমি ভাঙন মাছ খাও নি?আমাদের এ নোনা গাঙের ভাঙন মাছ ভারী মিষ্টি।কাল মাকে বলে তোমাকে খাওয়াবো।”(অপরাজিত) পশ্চিম বাংলাতে এর আরেক নাম ‘বাটা’ মাছও বটে।তবে সিলেটিতে ‘বা’ঙন’/ɓɐŋɔn/থাকতেও পারে।“ইলিশা বোয়াল ভাজে বাছা বাঙ্গিনা/বড় বড় ইচা রান্ধে সউল মৎসের পনা।।”২৭০ অবশ্য এই ‘বাঙ্গিনা’ ‘বাইঙ’-ও হতে পারে,সেটি লম্বাটে আঁশহীন অন্য মাছ।
‘ঘনিয়া’ বা ‘গ’নিয়া’ সিলেটিতে রয়েছে।২৭১বাংলাদেশের অন্যত্রও এই নামেই মাছটি পরিচিত।অসমিয়াতে এটি ‘ঘৰিয়া’ বা ‘ঘঁৰিয়া’।২৭২ মানবাংলা রূপটি অসমিয়ার বেশি কাছের-- নাম ‘গরই’ বা ‘গড়ুই’২৭৩।
টেংরা২৭৪এবং হিঙ্গি বা শিঙ্গি২৭৫দুই স্বতন্ত্র মাছের নাম।প্রথমটি সামান্য আকারে ছোট,রঙে সাদা।দ্বিতীয়টি আকারে বড়,রঙে বাদামী।দুটোতেই কানের নিচে কাঁটা আছে,আঁশ নেই।পদ্মাপুরাণে আছে,“আরেক অংশ বিষ রাখিলা জলে আর স্থলে/তাহা পাইয়া গিলিলেক টেংরা-সিঙ্গীয়ে।।”২৭৬ সিলেটিতে ‘শিঙ্গরি’ বলে কোনো মাছ আমরা পাইনি।সিলেটি ‘হিঙ্গি’ মান বাংলাতেও ‘শিঙ্গি’-ই।২৭৭ সংক্ষেপে ‘হিং’,‘শিং’ বলেও পরিচিত।সম্ভবত একেই অসমিয়াতে ‘শিঙৰা’ বলে।২৭৮
‘বাম’ বলে কোনো মাছের নাম আমরা মান বাংলাতে পাই নি।সম্ভবত সিলেটি ‘বাবাশ’২৭৯ বা ‘বাবাশি’২৮০ অথবা ‘বাইং’২৮১ মাছকে ‘বামি’ বলে লিখেছেন।অসমিয়াতে এই ‘বাইং’কে ‘বামি’ বলে।২৮২ অন্তত বর্ণনা দেখে তাই মনে হয়।
মান বাংলা ‘রুই’কে সিলেটিতে ‘রৌ’ বলে বটে,অসমিয়াতে ‘ৰৌ’।
অসমিয়া ‘কান্ধুলি’-র২৮৩ বিকল্পে সিলেটিতে আমরা ‘কান্ধলা’ খোঁজে পাই নি।সিলেটিতে এবং পুব বাংলাতে সাধারণভাবে বরং মাছটির নাম ‘কানলা’ বা ‘কাংলা’।ধ্বনি বিপর্যয়ে কেউ কেউ ‘কালনা’-ও বলে।অবশ্য নাম দু’টি যে ‘কান্ধ̖লা’-রই রূপান্তর সহজেই অনুমান করা যায়।“আর কত কিছিমর মাছ,ঘনিয়া গজার শউল পাবিয়া বাচা মাগুর কই চেঙ রানি টেংরা পুটিমকা কাংলা মহাশউল আর বাঘমাছ তো আপনারার ইখানো দেখিউ না।”(সু.গা.পা.; উজান পর্ব; তিন) মাছটি দেখতে ‘চিতল’-এরই মতো শুধু আকারে ছোট।পশ্চিম বাংলার কোথাও কোথাও ‘কানলা’কে ‘ফলুই’২৮৪ বা ‘ফলি’ বলে।উজান আসামেও অসমিয়াদের অনেকেই মাছটিকে ‘কান্দুলি’ বলবার সঙ্গে সঙ্গে ‘ফলি’ বা ‘পলি’-ও বলেন।
শব্দবোধের মতে ‘চিংড়ি’র পূর্ব রূপ ‘চিঙড়’২৮৫,বঙ্গীয় শব্দকোষের মতে ‘ইচা’র পূর্ব রূপ ‘ইঞ্চাক’২৮৬।আবিদ রাজা মজুমদারে মতে ‘চিংড়ি’-র পূর্ব রূপ ‘চিঙ্গট’,আর ‘ইচা’ রূপান্তর এরকম ইঁচলা < ইঞ্চঅ < ইঞ্চক।জগন্নাথ চক্রবর্তীর অনুমান প্রাকৃত ‘ইঞ্চঅ’-র মুলে তামিল ‘ইরবু’।দিনাজ পুরের বাংলাতে ‘ইচিলা’,রংপুরে ‘ইচ̖লা’।২৮৭ সুতরাং স্পষ্ট যে সিলেটি ‘ইচা’তে ‘ল’টি লুপ্ত,আর অসমিয়া ‘মিছা’তে একটি ‘ম’ ধ্বনির আগম হয়েছে।এমনিতে অসমিয়া ‘মিছা’ বা পুব বাংলাতে ‘ইচা’ বললে যে জলপোকাকে বোঝায় পশ্চিম বাংলাতে ‘চিঙড়ি’ বললে আকারে বড় সামুদ্রিক পোকাকে বোঝায়---তার অন্য নাম ‘গলদা’,‘বাগদা’ ইত্যাদি।চিংড়ির প্রায় পাঁচশতাধিক প্রজাতি আছে।স্বাভাবিক ভাবেই অসম ত্রিপুরার স্থানীয় মাছ নয় এই সব গলদা,বাগদা।
‘মির্গা’ বা ‘মিরগা’ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই,মান বাংলাতে এটি মৃগেল,অসমিয়াতে ‘মিৰিকা’-ই বটে।
‘পানী কাউৰী’ বলে কোনো পাখির সন্ধান আমরা পাইনি।অসমীয়াতে যা পেলাম,তা হলো ‘পানী হাঁহ’২৮৮ এবং ‘পানী শালিক’ এবং ‘পানী পিয়া’।২৮৯ পানী-পিয়ার অন্য নাম ‘চাতক’।২৯০ চাতক বাংলাতেও সুপরিচিত পাখির নাম। যাই হোক,‘পানি কাউৰী’ তার পরেও অসমিয়াতে থাকতেই পারে।সিলেটিতে ‘পানী খাউরী’ আছে বটে।পদ্মাপুরাণ সংগ্রহে চম্পক নগরের পাখির বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি ষষ্ঠীবর লিখছেন,“পানি খাউরী টিমটিম,হরালিতে পাড়ে ডিম/ কাঠল পাখী সদায় নাইয়র যায়।।”২৯১কিন্তু ‘খাউরি’ এবং ‘কাউৰী’-র ধ্বনি সাম্য থাকলেও অর্থ ভিন্ন-- ‘খাউরী’ মানে যে খায়, ‘কাউৰী’ মানে ‘কাক’।তাতে অবশ্য দুই নাম একই পাখির হওয়া আটকায় না।কিন্তু বাংলাতে সেরকমই আছে ‘পানকৌড়ি’।২৯২ রবীন্দ্রনাথের ছেলেভুলানো ছড়ায় আছে ‘পানকৌড়ি পানকৌড়ি ডাঙায় ওঠো’সে।/তোমার শাশুড়ি বলে গেছে বেগুন কোটো’সে॥’ দেখতে পাখিটি কালচে,খুব সুন্দরও নয়।এবং অনেকটা কাকের মতো।জলের গভীরে ছোঁ মেরে ডুব দিয়ে মাছ ধরে খেয়েই বেঁচে থাকে।ফ্যালাক্রোকোরাসিডি(Phalacrocoracidae) গোত্রের ফ্যালাক্রোকোরাক্স (Phalacrocorax) গণের অন্তর্ভুক্ত পাখিটি।এই তিনটি একই পাখি কিনা,আমরা নিশ্চিত নই।কিন্তু নামেতো ধ্বনিসাম্য রয়েছে, চরিত্রেও।
‘ বগা/বগুড়া’ এবং ‘বগ/বগলী’ নিয়ে আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে বিস্তৃত লিখেছি।এখানে শুধু এইটুকুন জুড়ে দেয়া যথেষ্ট যে মান বাংলাতে পাখিটির নাম ‘বক’,অসমিয়া নামে শেষ ধ্বনিটি ঘোষে রূপান্তরিত হয়েছে মাত্র।
‘ওকণি’ (< উৎকুন)২৯৩ আর ‘লেখি’ (<লিক্ষা)২৯৪ অসমিয়াতেও এক নয়,দুটো পরস্পরের প্রতিশব্দ নয়।সুতরাং সিলেটিতেও ‘লিক’ দুই শব্দের একত্র প্রতিশব্দ হতেই পারে না।প্রথমটি মাথার চুলে বাস করা অতি ক্ষুদ্র পোকা,এবং দ্বিতীয়টি তার ডিম।মান বাংলা এবং সিলেটি দুইয়েতেই শব্দ দু’টি রয়েছে।শুধু প্রথমটি মান বাংলাতে উকুন২৯৫ সিলেটিতে অপিনিহিতির ফলে ‘উকইন’২৯৬ এবং লিক২৯৭।মান বাংলাতে ‘লিকে’র প্রতিশব্দ হিসেবে ‘নিক’,‘লিক্কা’ও রয়েছে।২৯৮নোয়াখালিতে অসমিয়া ‘ওকণি’ আর সিলেটি ‘উকইন’ হয় ‘উগইন’ বা ‘উইনু’,চট্টগ্রামীতে ‘উইনু’২৯৯ বা ‘উইন’৩০০।
সিলেটিতে ‘চরা’ বা ‘চড়া’৩০১ অথবা ‘চরাই’,‘চড়াই’ অসমিয়ার মতো সব পাখিকে৩০২বোঝায় না।মান বাংলার মতোই শুধু ঘরের ছাদে বাসা করে,যাকে অসমিয়াতে বলে ‘ঘনচিৰিকা’৩০৩।রাজশাহীতে আবার ‘চড়াই’ মানে মোরগ। ‘মুই চড়াইর̖ গোস্ত̖ দি ভাত খাইছোঁ̖।’৩০৪ শব্দ-বাক্যের গঠনটি একেবারেই অসমিয়ার মতো এটি লক্ষ করবার মতো।
ঙ) “শরীরর অংগ-প্রত্যঙ্গঃ
পাণীপেট (তলপেট)তু.বাং: বগল, আড় (হাড়)তু.বাং: হাড়া, গা তু.বাং: শরীর, লেঙুর (নেগুৰ)তু.বাং: লাঙ্গুল, পিলা(পিলাই)।”৩০৫
‘পানী পেট’,‘পানী-পেটা’ এসব বিশুদ্ধ অসমিয়া শব্দ।প্রথমটির অর্থ মানুষ বা জন্তুর পেটের ডান দিক।দ্বিতীয়টির মানে,কচি শিশু।৩০৬নাভির নিচের অংশকে অসমিয়া৩০৭বাংলা৩০৮ দুই ভাষাতেই ‘তলপেট’ বলে।সিলেটিতেও তাই বলে। একে মান বাংলাতে কোনোভাবেই আর যাই বলুক ‘বগল’ বলে না।‘বগল’ অসমিয়াতে আছে,অর্থ ‘কাষলতি,দাঁতি, কাষৰ’।৩০৯ বাংলাতেও তাই।৩১০তদুপরি কাঁধ এবং বাহুর সন্ধিস্থলের নিচের দিকটাকেও বগল বলে।বস্তুত এর ‘কাছ, পাশ,কোল’ ইত্যাদি অর্থের সূত্রপাতই সেখান থেকে।বাংলাতে জোরে ধরে নিয়ে যাওয়া অর্থে ‘বগল-দাবা’ একটি বিশিষ্টার্থক শব্দজোড়।‘বগল’ শব্দের সিলেটি অর্থও তাই।৩১১ সিলেটি প্রবাদে আছে,‘বগলর তলো দা থইয়া তুকানি’।
অসমিয়া ‘হাড়’ সিলেটিতে ‘আড়’-ই হবে।উচ্চারণ বোঝাতে ‘ʔআড়’।এ তো যেকোনো ‘হ’ দিয়ে শুরু শব্দেরই সিলেটিতে স্বাভাবিক পরিণতি।কিন্তু এত সুন্দর শব্দটি মানবাংলাতে না পেয়ে ‘হাড়া’ কোত্থেকে পেলেন,আমরা ভেবে পাইনি।‘বাঘের গলায় হাড়’ নীতিগল্পটি যে কোনো বাংলার ছাত্রকে পাঠশালাতে পড়তে হয়।
‘শরীর’ সিলেটিতে রয়েছে,প্রায়শই ‘শরিল’ বা ‘শইল’ হয়ে যায়।সিলেটি প্রবাদে আছে, ‘শইল̖লর নাম মআশয়, জেতা শআইবায় অতা শয়।’৩১২ ‘সুরমা গাঙর পানি’তে আছে,‘না বেটা,তোর খুব পানিতরাস।শরীল দেখিয়াউ বুঝিয়ার। পানিত নামতে নি।’ তেমনি ‘গা’ মানবাংলাতে জনপ্রিয় শব্দগুলোর একটি।বঙ্কিমের হাত পাকানো গোছের কিছু পদের একটিতে আছে,“দ্বিতীয়দশাদিনে,আঁখি মেলি হেরল,শেজ ছাড়ি গা ভাঙ্গিল উঠি।।”(বিরহিণীর দশ দশা) ‘গা’৩১৩ এবং ‘শৰীৰ’৩১৪ অসমিয়াতেও অর্থ একই এবং সুপ্রচলিত।শুধু অসমিয়া উচ্চারণে ‘শ’/x/,সিলেটিতে কখনো বা /ɦ/।
‘লেঙুর’ শব্দটি সিলেটিতে আছে।৩১৫তৎসম ‘লাঙুল’ থেকে হয়েছে বলে জগন্নাথ লিখেছেন।‘লেঞ্জুর’,‘লেনজ̖’, ‘লেঙ্গইর’৩১৬ এবং ‘লেজ’ও।সব ক’টিই সংস্কৃত ‘লঞ্জ’ থেকে আসা শব্দ।‘লাঙুলে’-রও মূলে তাই হবে,শব্দবোধ লিখেছে,“লন̖গ̖+উলচ̖ কর্তৃ নিপা”৩১৭।মান বাংলাতে ‘ল্যাজ’,‘ন্যাজ’ও আছে।শরৎ উপন্যাসে যেমন,“গৌরী সেন বলে, ন্যাজ চুলকে দিয়েচে—তারা বলে আর হেসে লুটোপুটি!”(বামুনের মেয়ে:১)অসমিয়াতেও রয়েছে ‘য-ফলা’ বিহীন ‘নেজ’৩১৮।‘নেগুৰ’-তো আছেই।কিন্তু তাই বলে মান বাংলাতে ‘লাঙুল’ই প্রধান শব্দ বলবার মানে হচ্ছে,সে ভাষাতে ‘ঘর’ নয় ‘গৃহ’,‘কাছ’ নয় ‘কক্ষ’,পাখা’ নয় ‘পক্ষ’ সুপ্রচলিত শব্দ।এই সব তৎসম শব্দের অধিকাংশই সাধু বাংলাতে ব্যবহৃত হয়।তাও ‘লাঙুল’ অতি অল্পই হাস্যরস রচনাতেই নজরে পড়ে।লোকে কথা বলবার সময় কক্ষনো এই শব্দ ব্যবহার করেন না।সেরকম এক রাবীন্দ্রিক রসরচনাতে আছে,“কিন্তু বনুবংশীয়দের কী আনন্দ!আমরা কি গৌরবের সহিত আমাদের লাঙুল আস্ফালন করিতে পারি!”(বানরের শ্রেষ্ঠত্ব)
অসমিয়াতে ‘পিলাই’ মানে ‘প্লিহা’৩১৯ বা যকৃত।সিলেটিতে ‘পিলা’ এবং ‘পিলই’ দুটোই আছে।৩২০ কিন্তু মানবাংলাতেই বা তদ্ভব রূপটি সিলেটি ‘পিলা’র থেকে খুব একটা তফাতকিসের? ‘পীলে’৩২১ বা ‘পিলে’ মানবাংলাতে সুপ্রচলিত শব্দ।তিনি সেটি উল্লেখ করলে ভালো করতেন।করলে স্বাতন্ত্র্য যে খুব একটা নেই – দেখা যেতো।‘পিলে চমকানো’ বাংলার এক পরিচিত বাগবিধি।রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধে আছে,“শোনা যায় ভারতবর্ষীয়ের পিলে যন্ত্রটাই কিছু খারাপ হয়ে আছে,এই জন্য তারা পেটের উপরে ইংরেজ প্রভুর নিতান্ত ‘পেটার্নাল ট্রীট্মেন্ট’-টুকুরও ভর সইতে পারে না।”(য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি)
চ) “সম্বন্ধবাচক শব্দ:
পোয়া(পো,পোৱালি), তু.বাং:ছেলে,তিরী (তিৰোতা) তু.বাং: স্ত্রী/মেয়ে মানুষ,কন্যা(কইনা) তু.বাং:ক’নে, নায়র (নেউৰি),ডেকা(গরু আদি,কিন্তু অসমীয়াত মানুহ),ছাওয়াল (ছৱাল তু.ছোৱালী) তু.বাং:মেয়ে,পিহী(পেহী)পিসী,বান্ধ তু.বাং:বন্ধু,নাতি-পুতি।”৩২২
‘পো’ অসমিয়াতে পুত্র বোঝায়৩২৩,যদিও মান অসমিয়াতে কম প্রচলিত।‘পোৱালি’ শব্দটির উৎস এক হলেও অর্থ ভিন্ন।মানুষ কিংবা যেকোনো জন্তুর শিশু সন্তান কে বোঝায়।৩২৪ সিলেটি ‘পোয়া’,ততোধিক প্রচলিত ‘পুয়া’ (< পুত্র) ছেলে সন্তানকেই বোঝায়।সিলেটিতে ‘পুত্র’ তিনভাবে ভাবে বিবর্তিত হয়েছে।প্রাকৃত ‘পুত্তঅ’ থেকে ‘তঅ’ অংশটি বাদ দিয়ে ‘পুত̖’৩২৫ এবং ‘ত্ত’ অংশটি বাদ দিয়ে ‘পুঅ’ > ‘পুয়া’৩২৬ এবং ‘র’> ‘ল’ হয়ে ‘পুলা’ বা ‘পোলা’,কিন্তু ‘পুড়ি’ (<পুত্রী)। সিলেটি প্রবাদে আছে,“পুড়ির হাই মাউগর ভাই,এর বাড়া কুটুম নাই।’৩২৭ এর একটিও কিন্তু সিলেটির একার সম্পদ নয়। পুব বাংলার প্রায় সব ভাষাবৈচিত্র্যে এগুলো মেলে।এমন কি ‘পোলাপান’,‘পুত’ এসব তো মানবাংলাতেও মেলে। রবীন্দ্রনাথের সংগৃহীত ছেলেভোলানো ছড়ায় আছে,“ঘুঘু মতি সই/পুত কই।/হাটে গেছে॥/হাট কই।” ‘পুত’ বা ‘পুতাই’ অবশ্য অসমিয়াতেও রয়েছে।৩২৮অসমিয়া এবং বাংলার সাধারণ পূর্বাধিকারের দাবি যার সেই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ছিল, “মোঞঁ তাক মানো বড়ায়ি যেহ্ন যমদূত।/এ দুখ খণ্ডিব কবেঁ যশোদার পুত।” কিন্তু ‘পোয়া,পোলা,পুড়ি’ অসমিয়াতে নেই। অসমিয়া ‘পোৱালি’র বিপরীতে সিলেটিতে ‘ছাবাল’ সুপ্রচলিত শব্দ।তার সাদৃশ্যে ভিন্নার্থে সাম্প্রতিক শহুরে সিলেটিতে ‘ছেলে’ একটি সুপ্রচলিত শব্দ।যেমন মান অসমিয়াতে সুপ্রচলিত শব্দ ‘ল’ৰা’।সিলেটি ‘পোলা’র সদৃশ শব্দ নোয়াখালিতে ‘হোলা’,‘পুত’-এর সদৃশ হুত’৩২৯,‘পুয়া’র সদৃশ চট্টগ্রামী ‘ফো̣য়া’৩৩০।
‘তিরি’ শব্দটি সিলেটিতে দুর্লভ।আমরা শুনিও নি,পাইও নি।অসমিয়াতে আছে।৩৩১সিলেটিতে বরং ‘ইস্ত্রী’ সম্ভব।৩৩২ সিলেটিতে বহুল প্রচলিত শব্দটি হলো ‘বউ’৩৩৩ সুরমা গাঙ্গর পানিতে আছে,“তর বৌ এ আমরার লগে মাতে না।অত কিতা ফুটানি।”(সু.গা.পা.:এগারো) এমনিতেও অসমিয়া ‘তিৰোতা’ শব্দের মূলে যদিও ‘স্ত্রী’-ই,বাচন অভ্যাসে এটি যেকোনো বিবাহিত নারীকে,কখনো বা আরো বিস্তৃত হয়ে যে কোনো নারীকেই বোঝায়।৩৩৪ লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার গদ্যে আছে,“সেই সাতজনীৰ ভিতৰত নিচেই নুমলীয়াজনী বৰ লখিমী তিৰোতা আছিল৷।”(লখিমী তিৰোতা) বাংলাতে কিন্তু সেরকম বোঝাতে গেলে ‘স্ত্রীলোক’ বলতে হয়,সিলেটিতে ‘বেটি’,‘বেটিন’ ৩৩৫ বা ‘বেটিমানুষ’ বলতে হয়।
‘কন্যা’ এবং ‘ক’নে’ দুটোই মান বাংলা শব্দ।সিলেটি শব্দ ‘কইনা’৩৩৬।এই নিয়ে তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা বিস্তৃত লিখেছি।
‘নেউৰি’ অসমিয়া কামরূপী ভাষাবৈচিত্র্যের শব্দ।যে কোনো আত্মীয় বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে পানভোজনকে বোঝায়।“মিতিৰৰ ঘৰলৈ গৈ ভোজন পান।যেনে ---সি নেউৰি খাবলৈ গৈছিলে।”৩৩৭ সংস্কৃতে মূলে সম্ভবত এই অর্থই বোঝাতো।জ্ঞাতিঘর> নাইঘর > নাইওর/নাইঅর।সিলেটিতে অর্থ সংকোচন হয়ে বিবাহিতা ‘কইনা’র স্বামী ঘর থেকে ‘বাপরবাড়ি’ বেড়াতে আসা বোঝায়।৩৩৮শব্দটি যে সিলেটিতে ‘নাইয়র’-ও তা আমরা ‘কাঠল পাখির নাইয়র যাবা’ পদ্মাপুরাণের পদে দেখিয়ে এলাম।তিপেরা তথা কুমিল্লার বাংলাতে শচীন দেববর্মণের একটি বিখ্যাত গান আছে,“কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া/ আমার ভাইধন রে কইয়ো, নাইওর নিতো আইয়া।” শব্দটি একই অর্থে সামান্য ভিন্নরূপে হিন্দি তথা অবধীতেও আছে।নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের একটি গানের কলি আছে, “बाबुल मोरा नैहर छूटो ही जाये’’।
‘ডেকা’ অসমিয়াতে উপাধিও আছে।তার বাইরে এটি ‘তরুণ’ বা ‘যুবক’ বোঝায়।স্ত্রী লিঙ্গে ‘ডেকেৰী’৩৩৯,যদিও শব্দটির ব্যবহার কম।বেশি ব্যবহৃত শব্দ ‘গাভৰু’(<গর্ভবতী)।বাংলা তরুণ–তরুণী,যুবক-যুবতী-র বিপরীতে অসমিয়াতে সুপ্রচলিত শব্দজোড় হচ্ছে ‘ডেকা-গাভৰু’।সিলেটিতে ‘ডেকা’তে পুরুষ গো-সন্তান বোঝায়।স্ত্রী লিঙ্গে শব্দটি ‘ডেকি’- যেটি অসমিয়াতে নেই।ব্যঙ্গার্থে কখনো বা ‘ডেকা’ শব্দে ‘তরুণ’ও বোঝায়।উপেন রাভা হাকাচাম প্রতিবেশী কিছু ভাষাতে সমরূপ শব্দের নজির দিয়েছেন এরকম,‘দেকাণ্ড(দেউরি),দে ফান্তে(গারো।অর্থ শিশু?)ডেকেরা (রাজবংশী)’।তিনি লিখেছেন,এগুলোর সংস্কৃত বা সমরূপ ভাষাতে মূল মেলে না।“তেনে কিছুমান বিশেষণ শব্দ নিসন্দেহে থলুয়া ভাষার পরা বিভিন্ন প্রক্রিয়ারে আহরিত হোয়া;যাক পোনপটীয়াকৈ ঋণকৃত শব্দ বোলা না যায়।”৩৪০ প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলাতে কিন্তু ‘তরুণ’ বা বিদ্রূপার্থে ‘বুড়ো’,সিলেটিতে যেমন ‘বুড়াবেটা’,বোঝাতে ‘ডেগরা’ কথার ব্যবহার রয়েছে।ভারত চন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’-এ মালিনী আর কোটালের সংলাপে আছে, “কি বলে ডেগরা বড় যে চেগরা/ঐ কথা ফিরা ফিরা।” তৎসম ‘ডিঙ্গর’ থেকে বাংলার কোথাও কোথাও ‘ডোকর’ শব্দটি আছে,স্ত্রী লিঙ্গে ‘ডোকরি’।‘ডেকরা’,‘ডেগরা’-ও রয়েছে।অর্থ বুড়ো –বুড়ি।চট্টগ্রামী বাংলাতে আছে ‘ডিঙ্গরা’,দিনাজপুরে ‘ডিংরা’।দিনাজপুরে এর অর্থ ধূর্ত,দুষ্টও বটে।৩৪১সুতরাং সিলেটি ‘ডেকা’ বা ‘ডেকি’ শব্দে যখন বাছুর বোঝায় তখন তা ‘ডিঙ্গর’ শব্দেরই অর্থ সংক্রম বলেই মনে হয়।সেরকমই সংক্রমিত শব্দ অসমিয়া ‘গাভৰু’।৩৪২মূলে শব্দটি ‘গর্ভবতী’ বা ‘গর্ভিনী’।অসমিয়াতে কুমারি তরুণীকে বোঝায়।একই উৎসের থেকে মান অসমিয়া এবং বাংলা শব্দ ‘গাভী’।৩৪৩ যেকোনো স্ত্রী গরুকে ‘গাভী’ বলে।অসমিয়া সিলেটিতে ‘গাই’-ও আছে।৩৪৪ কিন্তু গর্ভবতী গরুকে বলে ‘গাভিনী’।সিলেটিতে ‘গাবি’ন’।৩৪৫ খুব কম প্রচলিত হলে অসমিয়া ‘গাভরু’র বিপরীত শব্দ ‘গাভুর’ প্রচলিত আছে বাংলাতে।৩৪৬একেবারে একালের স্বপ্নময় চক্রবর্তীর উপন্যাসে আছে,“এই কালাচাঁদকে মাইনে দিয়ে রাখবার কোনই প্রয়োজন ছিল না,যেখানে মানিকের মতো একটা গাভুর ছেলে রয়েছে।” (চতুষ্পাঠী) ‘হিন্দি’র কিছু ভাষাবৈচিত্র্যে,পাঞ্জাবীতে ‘गबरू’ সুপ্রচলিত শব্দ।অর্থ হচ্ছে ‘तेजबान युवा’। ‘শোলে’ ছায়াছবির ‘গব্বর সিং’ নামটির উৎস সম্ভবত এই ‘গবরু।’
‘ছাওয়াল’ বাংলাতে প্রাচীন শব্দ।শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে আছে ,“আবুধ ছাওয়াল কাহ্নাঞিঁ মাঙ্গসি দান।/আইহন জানাআঁ তোর লইবোঁ পরাণ।।” তার থেকে অসমিয়া ‘ছোৱালী’ আসা সম্ভব।কিন্তু শব্দটি সেই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেই ‘ছেলে’ অর্থ পেয়েছিল,আর বাংলাতেও ‘ছেলে’ আছে।তার থেকে সাম্প্রতিক সিলেটিতেও ‘ছাওয়াল’তো ছিলই,‘ছেলে’ও এসেছে বলে আমরা সামান্য আগে লিখলাম।খুব জোরে মেলাতে না গেলে কেউ কল্পনাও করবেন না,যে সিলেটি ‘ছাওয়াল’ মান বাংলাতে ‘মেয়ে’ বোঝায়।বরং সিলেটিতে শব্দটির অর্থ যখন উভয় লিঙ্গ ‘শিশু’ –তখনই ‘মেয়ে’র সম্পর্কে শব্দটি ব্যবহৃত হলেও হতে পারে।‘সুরমা গাঙর পানি’ থেকে একটি সংলাপ তুলে দিলে কথাটি স্পষ্ট হবে,
“ --- মা ভালা অইলে বাইচ্চা মানুষ হয় এমনেউ।আমার পুয়াপুড়ি ভালা।তারার মাও ভালা ।
--- অয় আমরার ছিলেটি কথাত আছে,তামাকাসা মাজলে চিকন,লোহা চিকন তায়,আর ছাওয়াল চিকন মায়।”
ডিমাছা সহ বহু ভোট বর্মী ভাষাতেও ‘ছা’/tsa/ কথাটির অর্থ উভয়লিঙ্গ ‘সন্তান’---এই কথা বহু ভাষাবিদেরাই বলেন।উপেন রাভা হাকাচামও লিখেছেন।কিন্তু তিনি তদ্ভব ‘বাছা’ (<বৎস) শব্দটিও মনে রেখেছেন।৩৪৭ ‘বাছা’ বা ডিমাছা ‘ছা’ যে উৎসই হোক--- দুই প্রধান প্রতিবেশী ভাষাতে সেটি লিঙ্গভেদ করে দুই শাখাতে বিকশিত হয়েছে এটি বেশ চিত্তাকর্ষক তথ্য।মান বাংলাতে হয়েছে ‘ছেলে’ এবং মান অসমিয়া ‘ছোৱালী’।অন্যদিকে ‘ছাওয়াল’ সিলেটিতে প্রায়ই ‘ছাবাল’ হয়।৩৪৮এর অসমিয়া প্রতিশব্দ বরং ‘ছ’লি।কামরূপী সহ অসমীয়ার কিছু কিছু ভাষাবৈচিত্র্যে শব্দটির অর্থ সিলেটি ‘ছাওয়াল’।৩৪৯ তবে বরিশালের বাংলাতে ‘ছাওয়ালু’ উভয় লিঙ্গ নয়,ছেলে বোঝায়।খুলনাতে ‘ছঅলু’।৩৫০এসব নজিরে ‘ছাওয়াল’ থেকে ‘ছেলে’ অব্দি বিবর্তনটি ধরা যায়।
সিলেটি ‘পিহী’,অসমিয়া ‘পেহী’ আর মান বাংলা ‘পিসী’ অর্থে এক।আর ধ্বনি পরিবর্তন মান বাংলার থেকে সিলেটিতে কম অসমিয়াতে বরং সামান্য বেশিই।‘পি’-টিও ‘পে’ হয়েছে।সিলেটিতে ‘স’ যা হয় ‘হ’ হয়েছে।বহুসময় তাও লোপ পেয়ে হয় ‘পি’।৩৫১উল্টোদিকে নোয়াখালি-চট্টগ্রামীতে ‘প’ লোপ পেয়ে হয় ‘হি’।৩৫২
‘বান্ধ’ নয়, সিলেটিতে শব্দটি ‘বান̖দ’ ৩৫৩,অর্থ অসমিয়া ‘বান্ধ̖’ ৩৫৪।মান বাংলা ‘বাঁধ’।যেমন—অস.নদী বান্ধ।বাং.নদী বাঁধ।অসমিয়াতে ‘বান্ধ̖’ কথাতে ক্বচিৎ বন্ধু বোঝায় বটে।লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার গল্পে আছে,“সিদিনা বান্ধ গিৰীন্দ্ৰ বৰা ফোপাই-জোপাই আহি মোৰ আগত উপস্থিত।”(প্ৰথম দৰ্শনত ওপজা প্ৰেম) কিন্তু সিলেটি সহ পুব বাংলার বহু ভাষাবৈচিত্র্যে ‘বন্ধু’ কখনো ‘বন̖দ’ হয়,‘বান্ধ’ হয় না।লোক গানে আছে,‘সোনা বন্দে আমারে দেওয়ানা বানাইলো।’ এই ‘বন্দে’ প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলা বৈষ্ণব পদে ‘বঁধু’,‘বধুঁয়া’ও ছিল।চণ্ডীদাসের পদে আছে,“সই,কেমনে ধরিব হিয়া?/ আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়/আমার আঙিনা দিয়া!/সে বঁধু কালিয়া না চায় ফিরিয়া,/এ মতি করিল কে?” জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের আধুনিক বাংলা গানে,‘বঁধুয়া আমার চোখে জল এনেছে/হায়,বিনা কারণে...’।তবে কিনা ‘বান্ধৱ’ এর মতোই মান বাংলা এবং সিলেটিতে ‘বান্ধব’ একটি সুপ্রচলিত শব্দ।অসমিয়াতে একই শব্দ ‘বান্ধৈ’ হলেও সিলেটিতে ‘বান্ধবী’ কখনো বা ‘বান্ধই’ উচ্চারিত হয়।
নাতি-পুতি পরস্পর প্রতিশব্দ নয়।‘পুতি’ কথাটি আসলে পৌত্র-প্রপৌত্র ক্রম বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।‘পৌত্রী’ কথাটির থেকেই আসতে পারে।সিলেটি এবং অসমিয়া৩৫৫ দুই ভাষাতেই রয়েছে।“অউত্ত তুই আচছ শান্তির মা,বছই আপদ ইগুইন্ত থাকলেও শান্তির নাতিপুতি।...” (সু.গা.পা.;১৪) সিলেটিতে ‘নাতি-পন্তি’ও হয়।৩৫৬ মান বাংলাতে ‘নাতি-পুতি’ও হয়, ‘নাতি-পতি’ও হয়।৩৫৭ যেমন—“শূন্য ভিটেয় চেয়ার পাতিয়ে বসে দিন যাপন করছেন ঘরের বউ-ঝি,ছেলে,নাতিপতি মিলে পরিবারের ১৫ সদস্য।”৩৫৮ রবীন্দ্রনাথ এ ধরনের শব্দগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ‘নাতিপুতি’র উল্লেখ করেছিলেন,“‘হাঁড়িকুঁড়ি’ শব্দ সংক্ষেপে পাকশালার বহুবিধ আয়োজনের ছবি এনে দেয়।এরকম স্থলে তন্নতন্ন বর্ণনার চেয়ে অস্পষ্ট বর্ণনার প্রভাব বেশি।‘মামলা-মকদ্দমা’ শব্দটা ব্রিটিশ আদালদের দীর্ঘপ্রলম্বিত বিপত্তির দ্বিপদী প্রতীক। এইজাতীয় শব্দের কতকগুলি নমুনা দেওয়া গেল : মাথামুণ্ডু মালমসলা গোনাগুন্তি চালচলন বাঁধাছাঁদা হাসিতামাশা বিয়েথাওয়া দেওয়াথোওয়া বেঁটেখাটো পাকাপোক্ত মায়াদয়া ছুটোছুটি কুটোকাটা কাঁটাখোঁচা ঘোরাফেরা নাচাকোঁদা জাঁকজমক গড়াপেটা জানাশোনা চাষাভুষো দাবিদাওয়া অদলবদল ছেলেপুলে নাতিপুতি।”৩৫৯ একে অনুকার শব্দ ভেবে বহু সময় দ্বিতীয় ভাগে ‘প’টি লোপ পেয়ে হয় ‘নাতি-উতি’।মান বাংলাতে এরকম অনুকার শব্দের দ্বিতীয়ভাগ ভিন্ন,আমরা রূপতত্ত্বে কিছু আলোচনা করে এসেছি।শব্দটি হবে ‘নাতি-টাতি’।অসমিয়াতে সম্ভবত এমন ক্ষেত্রে ‘নাতি-চাতি’-ই হয়।
ছ) “ গৃহস্থালীর সা-সঁজুলি/সাজ-পার:
বাত্তি(বতিয়া) তু.বাং:সুতা,পাটা(পটা) তু.বাং:শিল,মালাই(মলা) তু.বাং:মাল̖সা,বিচন/বিছনৈ(বিচনী) তু.বাং: পাঙ্খা,ঢারা(ঢৰা) তু.বাং:দর্মা,লোহারা(লুহিয়া) তু.বাং:কড়া,ছরতা(ছোৰতা) তু.বাং:জাঁতি,ডাবৰ তু.বাং:গামলা,বর-জাল, বের জাল,কাত্তি-জাল(কাঠি-জাল),পেলইন জাল (পেলনি- জাল),তেনা(টনা,টঙালি),পাগা/পাঘা(পঘা) তু.বাং:দড়া,কাচ্ছুটি (কাছুটি),কাঁচুলি,লগুণ তু.বাং:পৈতা,ছিক্কা/ছিকি (শিকা/শিকিয়া),মারলি,(ৰুৱা)।”৩৬০
‘সূতা’ অসমিয়াতেও আছে,‘বতিয়া’ হচ্ছে শক্ত সুতা।৩৬১ অবশ্য এক ধরণের ছোট মাছের নামও ‘বতিয়া’।এর সিলেটি প্রতিশব্দ বলে ‘বাত্তি’ আমরা শুনিনি,পাইও নি।প্রদীপ অর্থে সংস্কৃত ‘বর্তিকা’ থেকে > ‘বাতি’কে কখনো বা ‘বাত্তি’৩৬২ বলে।কার্তিক থেকে যেমন ‘কাত্তি’।যেমন—“কইয়াউ হাগে দি চায়,দেখে বিজলিবাত্তির তার,টরেটক্কার তার”(সু.গা.পা.;একুশ)।চট্টগ্রামীতেও ‘বাত্তি’৩৬৩ অবশ্য কাছাকাছি ‘বতা’ বলে একটি শব্দ রয়েছে।এর অর্থ বাঁশ,বেত বা মূরতা গাছের পাতলা বেত-- যা দিয়ে এককালে দোকানে দোকানে পোটলা বাঁধা হতো।মোড়া আদি তৈরিতেও কাজে লাগত।যেমন ---একগেছা বতা ল।হুকনির মচাগু বানদি।৩৬৪‘সুতা’ বরং স্বাভাবিক ভাবেই সিলেটি উচ্চারণে ‘হুতা’৩৬৫ ছোট নদীর উপমাতে ‘সুতা’র ব্যবহার অসমিয়া –বাংলা দুইয়েতেই নজরে পড়ে।সিলেটিও ব্যতিক্রম নয়।‘সুরমা গাঙর পানি’-তে আছে “--- অউ হুতার নালির দিকে চাইও না।এইন এক তেড়াভেড়া নদী।এইন মা নায় আমরার সৎ -মা।”
মানবাংলাতে ‘শিল-নোড়া’র ব্যবহার আছে বটে,কিন্তু ‘পাটা-পোতা’ও রয়েছে বিকল্পে।‘শিল’ শব্দের অর্থ পাথর। অসমিয়াতে শিল/xil/,সিলেটিতে ‘হিল’/ɦil/।রবীন্দ্রনাথের গল্পে আছে,“একদিন যখন বেলা দশটা-- অন্তঃপুরে যখন বাটি,বারকোষ,ধামা,চুপড়ি,শিলনোড়া ও পানের বাক্সের ভিড় জমাইয়া ঘরকন্নার বেগ প্রবল হইয়া উঠিয়াছে-...”(তপস্বিনী)।পশ্চিম বঙ্গীয় প্রবাদে আছে,‘যার শিল যার নোড়া,তার ভাঙি দাঁতের গোড়া।’ কিন্তু প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলা ‘গোরক্ষবিজয়ে’ আছে,“পোলা যোগী পাইলে পাটাতে তুলি বাটে।”৩৬৬ এক আধুনিক উপন্যাসে,“গোপনে গোপনে জগ,গ্লাস,পাটা-পোতা,হারিকেন ইত্যাদি সব বিক্রি করে দিয়েছে।”(কাক-জ্যোৎস্নায় কাক-ভোর:শাশ্বত স্বপন)তবে সিলেটিতে ‘শিল-নোড়া’র ব্যবহার নেই,এই কথা সত্য।সুরমা গাঙর পানিতে এই নিয়ে একটি ‘পই’ আছে,“‘রাজার বাড়ির মেনা গাই/মেন মেনাইয়া ডাকে/হাজার টেকার মরিচ খাইয়া/আরো খাইত চায় ।’--- পাটা পুতাইল।ই পইর কথা কইয়ার না রেবা।কইয়ার ধাঁধা,ধান্দা লাগি গেলে কেমনে বার অইবায়।”(অধ্যায় আঠাশ)।–নোয়াখালির প্রবাদে আছে, “পাটা পুতায় ঘষাঘষি মইচ্চের বংশ নাশ।” সব পাটা সমতল হয় না।কিছু আছে নিচের অংশটি অনেকটা বড় বাটির মতো হয়,‘পুতা’টি খাঁড়া রেখে বাটতে হয়।দেখে মনে হয় যেন মাটিতে গাছ ‘পোতা’ হচ্ছে।তার থেকে ‘পুতা’ বা ‘পুʔতাইল’ আসতে পারে।অসমিয়াতে শব্দজোড়টি ‘পটা-গুটি’।৩৬৭
‘মাল̖সা’ মাটিতে তৈরি বাটি।এককালে খাবার কাজে ব্যবহৃত হলেও এখন মূলত দেবতার উদ্দেশ্যে ফল-মূলাদি খাবার নিবেদনের কাজে ব্যবহৃত পাত্রের নাম।৩৬৮ রবীন্দ্র উপন্যাসে আছে,“গাছতলায় মস্ত মস্ত উনন পাতা;রান্নার জন্যে নানা আয়তনের হাঁড়ি হাঁড়া মালসা কলসী জালা;সারবন্দি গোরুর গাড়িতে এল আলু বেগুন কাঁচ-কলা শাকসব্জি।” (যোগাযোগ) অসমিয়াতে তাকেই ‘মলা’ বলে।৩৬৯মান বাংলাতে নারকেলের ‘খোল’কে বিকল্পে ‘মালা’ বলে। সিলেটিতে সেই ‘মালা’কে ‘মালই’ বলে।৩৭০ আমরা ‘মালাই’ বলে কোনো সিলেটি শব্দের সন্ধান পাই নি।যদ্দূর জানি, মাটির বাটিকে সিলেটিতেও ‘মাল̖সা’-ই বলে।
প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলাতে ‘পাঙ্খা’ ছিল।ব্রিটিশ ভারতে অফিসে আদালতে ছাদে ঝোলানো এরকম হাতে টানা ‘পাখা’কে ‘পাঙ্খা’ বলত।তার বাইরে মান বাংলাতে শব্দটি ‘পাখা’-ই।যে কোনো পাখার বিজ্ঞাপনে শব্দটি এভাবেই নজরে আসবে।একটি বিখ্যাত রবীন্দ্র কবিতার পঙক্তি এরকম,‘এখনি,অন্ধ,বন্ধ কোরো না পাখা।’ (দুঃসময়:কল্পনা) সিলেটিতে শব্দটি ‘বিচইন।৩৭১অসমিয়া ‘বিচনী’তে অপিনিহিতি হলে সিলেটি শব্দটি মেলে।‘বিচন’ কিংবা ‘বিছনৈ’ নয়। ‘সুরমা গাঙর পানি’-তে আছে,“--- আইচ্ছা করমুনে,অখন একটু হাওয়া কর দেখি।বিচইন খান আনো।”(সু.গা.পা.:এগারো) তৎসম ‘বীজন’-এর তদ্ভব রূপ এটি।অমিতাভ দেবচৌধুরীর কবিতাতে আছে,“তোমার বিজনে হাত না রাখার উজ্জ্বল বিরহ/আমার হত না” (অঝোর)। তবে সিলেটিতে বিকল্পে ‘পাখা’ সুপ্রচলিত শব্দ।পাখির ‘পাখা’কে তো আর ‘বিচইন’ বলে না।
দর̖মা> দা’রা=ঢৰা মোটের উপরে ঠিকই আছে,বাঁশে তৈরি চাটাইর নাম।জগন্নাথ চক্রবর্তী ‘ধাড়া’ এবং ‘ধাড়াই’ লিখেছেন।৩৭২ ‘সুরমা গাঙর পানি’-তেও তাই আছে,“বৈতলের আর ভাল লাগে না এই সরকারি নরক,বাঁশের খাপ বাঁধা ধাড়ার ঘর।”(সু.গা.পা.:পনেরো) উচ্চারণে শব্দটি মধ্যপ্রাণীভবনের ফলে ‘দা’রা’ হতে পারে,‘ঢারা’ হবে না।একে সিলেটিতে ‘ডাম’-ও বলে।
তেমনি ‘লোহারা’,‘লুহিয়া’,‘কড়া’-ও মোটের উপরে সঠিক।কিন্তু সিলেটি শব্দটি ‘লোহারা’ নয়,‘লোআড়া’৩৭৩ < লোহা+কড়া মিলে তৈরি শব্দ।জগন্নাথ চক্রবর্তী লিখেছেন,অন্যধাতুতে তৈরি ‘কড়াই’কে ‘লোআড়া’ বলে না।৩৭৪ তাই শব্দটি যে খুব বহুল প্রচলিত তাও নয়।প্রচলিত শব্দটি সিলেটিতে এবং মানবাংলাতেও ‘কড়াই’ (<কডাহী < কটাহ)৩৭৫ ‘সুরমা গাঙর পানি’তে আছে,“কড়াই থেকে পাতে গিয়েও কি শেষ হয়।”(সু.গা.পা.:বিশ) তবে মটর ভাজাকেও মান বাংলাতে ‘কড়াই’ বলে।‘লোহারা’র কাছাকাছি শব্দটি আসলে অসমিয়াতে আছে।‘লুহিয়া’ আছে,এ ছাড়াও আছে ‘লোহোৰা’।এবং ‘কড়াই’র কাছাকাছি ‘কেৰাহি’।৩৭৬মান অসমিয়াতে এই ‘কেৰাহি’ই সুপ্রচলিত শব্দ।যেমন—“সি কেৰাহিখনৰ সমান চাইজত বাতৰি কাকত এখন ফালি উতলি থকা মাংস খিনিৰ ওপৰত দি দিলে।”৩৭৭ এর আবার বিকল্প অর্থ ‘কটাক্ষ’।
‘ছরতা’/sɔrtɐ/ নয়,সিলেটিতে শব্দটাই ‘শরতা’/ʃɔrtɐ/।৩৭৮অসমিয়াতে ‘ছোৰতা’ আমরা সন্ধান করে পাইনি। থাকলেও কামরূপ-গোয়ালপাড়ার ভাষাবৈচিত্র্যের শব্দ হবে।কেননা,অসমিয়া এবং সিলেটি বা বাঙালিদের পান খাবার সংস্কৃতিই ভিন্ন।অসমিয়ারা যে ভেজা নরম ‘তামোল’ পান-চুনের সঙ্গে খেয়ে থাকেন,সেটি কাটবার জন্যে ‘ছোৰতা’ নয় ‘কটাৰী’ বা ‘কটাৰি’-র দরকার পড়ে।৩৭৯এটি দিয়ে তারা সবজিও কাটেন।হাতের তালুতে নিয়ে আঙুলের চাপে কাটা যায়।দুই অংশের মাঝে রেখে চাপ দিতে হয়না।শক্ত সুপারি বা গুয়া কাটার সংস্কৃতি সিলেটি সহ সব বাঙালির এবং ভাটি অসমের অনেক অসমিয়ার রয়েছে।শব্দটি সম্ভবত হিন্দি ‘সরোতা’ থেকে এসেছে।অন্তত জগন্নাথ চক্রবর্তী তাই লিখেছেন।আর সুপারি কাটার হিন্দি বলয়ের সংস্কৃতও একই।শব্দটি মান বাংলাতে নেই।সেখানে শব্দটি ‘যাঁতি’ বা ‘জাঁতি’-ই বটে।৩৮০ ‘যন্ত্র’ থেকে তদ্ভব।একই তৎসম রূপ থেকে আরেকটি তদ্ভব ‘যাঁতা’ বা ‘জাঁতা’ হচ্ছে পেষণ যন্ত্র।সাধারণত পাথরে তৈরি গোল দু’খানা চাকতি।মাঝে গম ফেলে পিষে আটা বানানো হয়।অসমিয়ার গোয়ালপাড়ার ভাষাবৈচিত্র্যে এবং রাজবংশীতেও শব্দটির অর্থ একই।৩৮১ মান অসমিয়াতে শব্দটি ‘জাঁত শিল’।
সিলেটি ‘ডাবর’ আর ‘গামলা’ এক নয়।‘ডাবর’ মানে হচ্ছে মাঝারি বা বড় আকারের বাটি,পেয়ালা কিংবা যেকোনো বাসন,তাও মাটিতে তৈরি।৩৮২বড় আকারের ‘গামলা’-কে ‘চাড়া’,আকারে ছোট হলে ‘চাড়ি’ বলে।৩৮৩ এর অন্য নাম ‘তাগারা’-ও বটে।অসমিয়াতে ‘তাগৰি’।৩৮৪শব্দটি মূলে তুর্কি।তবে সব ‘চাড়ি’কে ‘তাগড়া’ বলে না।রাজমিস্ত্রিরা সিমেন্ট বালি মেশাতে এটি ব্যবহার করে।মিঠাই কারিগরেরা ছানা-ময়দা ডলতে।মান বাংলাতে ‘গামলা’ই প্রচলিত শব্দ। যেমন---‘ফ্যানে-জলে দে না এক গামলা খাক।’(মহেশ: শরৎচন্দ্র)।কিন্তু সে তো অসমিয়াতেও আছে।৩৮৫তিনি এটি লেখেন নি কেন,ভেবে পাইনি।তেমনি সিলেটি ‘চাড়ি’র অসমিয়া প্রতিশব্দ ‘চৰিয়া’।৩৮৬ সেদিক থেকে অসমিয়ার আত্মীয়তা সিলেটি এবং মানবাংলা দুয়েরই সঙ্গে সমানে সমানে।রংপুরের ভাষাতেও শব্দটি ‘চাড়ি’ই।৩৮৭
মাছ ধরবার জালের তিনি অনেকগুলো নাম দিয়েছেন।‘বর-জাল,বের জাল,কাত্তি-জাল (কাঠি-জাল),পেলইন জাল (পেলনি- জাল)’ এগুলোর আসলে জেলায় জেলায় শতাধিক স্বতন্ত্র নাম অসমে এবং অবিভক্ত বাংলাদেশে পাওয়া সম্ভব। এবং প্রায়শই প্রতিবেশী ভাষা বা ভাষাবৈচিত্র্যগুলো পরস্পর থেকে নাম ধার করে থাকে।ফলে ভিন্ন ভাষাতে একই নামে থাকা সম্ভব।তিনিও যে সব নামের অসমিয়া প্রতিরূপ দেন নি,এবং কোনোটিরই মান বাংলা রূপ বলে কিছু দেন নি এর কারণ মনে হয় এই।তবে একটি মূল সিদ্ধান্তে মনে হয় না দ্বিমত হবে যে ‘জাল’ শব্দটি সিলেটি,অসমিয়া এবং মানবাংলাতে অপরিবর্তিত রূপেই আছে।তফাত শুধু বিশেষণ স্বরূপ তার পূর্ব পদে।সব অভিধানে সেই বিশেষণগুলোর সন্ধান পাওয়াও কঠিন,যদি বিশ্বকোষ জাতীয় কিছু না হয়।সেরকমই এক অভিধান ‘অসমীয়া জাতীয় অভিধানেও৩৮৮ আমরা ‘জাল’ এবং তার পরে পরপদ যোগ করে দুই কুড়ির বেশি শব্দ পেলেও পূর্বপদ যোগ করে মাছ,পাখি বা পশু ধরবার ‘জাল’ বৈচিত্র্য কিছু পেলাম না।নানা জনের সঙ্গে কথা বলে,বিচ্ছিন্ন ভাবে নানা বই এবং আন্তর্জাল ঘেটে অবিভক্ত বাংলা দেশে প্রচলিত আরো বেশ কিছু জালের বাংলা এবং অসমিয়া নাম পেলাম।বাংলা নামগুলো এরকম:ব্যাগজাল, টানাজাল/ঠেলাজাল,মইয়াজাল,বড় ছাঁকিজাল,ভাসাজাল,বেড়জাল,জগৎবেড় জাল,ঝাঁকিজাল,ধর্মজাল,খড়াজাল, কোনাঘরজাল,ফলিং নেট,ওথেড় জাল,ছবিজাল,চাকজাল,ফাঁসজাল,কইজাল,ছাঁদন-জাল,খোটু জাল,খুতুনী জাল, জামহাজাল,ছারইন জাল,ঢেকি জাল,খুটি জাল,ফস জাল,ঝিমটি জাল,চারুন জাল,ছাট জাল,কারেন্ট জাল, হুরা জাল,ফাঁস জাল,উড়াল জাল,দড়ি জাল,পেলইন জাল ইত্যাদি।অসমিয়া নামগুলো এরকম: ফাঁচি জাল,ঘোঁকা জাল,চোঁচা জাল,খেৱলি জাল,ৰাঙি জাল,টনি জাল,চিপ জাল।এগুলোর অনেকটাই একই জালের ভিন্ন নাম,কিছুবা ধ্বনিপরিবর্তিত নাম,কিছু সাদৃশ্যের প্রভাবে পরিবর্তিত নাম---সহজেই অনুমান করা যায়।‘সুরমা গাঙর পানি’-তে সেরকম দু’খানার নাম রয়েছে, “দশ দিনে ঝাঁকিজাল একবার গোল করে ফেলতে পেরেছে। হুরাজাল টেনে পুঁটি মকা ধরেছে দুই বন্ধু।”(সু.গা.পা.:তিন) উপেন রাভা হাকাচামের ‘বরজাল,বেরজাল’কে সহজেই মান বাংলা ‘বড় জাল,বেড় জাল’ বলে পড়া যায়।যদিও আমরা নিশ্চিত নই,এই নামে আদৌ কোনো জাল আছে কিনা।এবং জালনামের গতিবিধি দেখে মনেও হয় না যে এর কোনো সর্ববঙ্গীয় একক নাম থাকতে পারে বলে।অসমিয়া ‘কাঠি জাল’৩৮৯ রয়েছে বটে,কিন্তু সেটি সিলেটি ‘কাত্তি’ হওয়া কঠিন বলেই মনে হয়।হলে ‘কা’টি,খুটি,খোটু’ হতে পারে।‘পেলনি’ শব্দের অর্থ অসমীয়া জাতীয় অভিধানে ‘ফেলে দেয়া জিনিস’,‘অসূচী’ আদি বেশ কিছু অর্থ পেলেও৩৯০ জালের নাম পেলাম না।তার পরেও এই নামে ‘জাল’ থাকতেই পারে এবং সিলেটি ‘পেলইন’ তারই ধ্বনি পরিবর্তিত (অপিনিহিতি) রূপ হওয়া সম্ভব বটে।তবে সিলেটি ‘পেলইন কোণ’ অর্থ ‘ত্রিকোণ ক্ষেত্র’ও বটে।তিনটা বাঁশকে ত্রিভূজাকার করে বেঁধে তাতে জাল আটকে হাতে করে বাঁশের বর্ধিত অংশে ঠেলে জলে ডোবানো হয়,টেনে তোলা হয়।অসমিয়াতে ‘কাঁৱৈ লাঙি জাল’৩৯১ রয়েছে।সিলেটিতে একেই বলে ‘ফাঁস জাল’ বা ‘পাতান জাল।আমরা আরেকটি জালের নাম আগে লিখেছিলাম,‘ডোৰা’।
অসমিয়া ‘তঙালি’ বা ‘টঙালি’ মানে কোমরে বাঁধা লম্বা কাপড়।৩৯২সাধারণত যোদ্ধা বা চাষারা ধুতি আটকাতে এটি ব্যবহার করেন,যাতে কাজের চাপে ধুতি খানা খুলে গিয়ে কাজে ব্যাঘাত না ঘটায়।সেই থেকে ‘টঙালি বান্ধা’ অসমিয়া বাগবিধির তথা ‘জতুৱা ঠাঁচ’-এর অংশ হয়ে গেছে।তার মানে ‘মনে প্রাণে কাজে লেগে পড়া’।ফলে বিহুতে যদিও সবাই গামছা বাঁধেন কোমরে তার পরেও এক লেখক লিখছেন,“আমি কাটাৰৰ অসম সমাজে বিহু পাতিবলৈ বুলি কঁকালত টঙালি বান্ধি সাজু হলোঁ।”৩৯৩সেরকম আরো আছে,“ওলাই আহা সমনীয়া,আগবাঢ়ি যাওঁ,/কঁকালত টঙালি বান্ধি যুঁজিবলৈ যাওঁ..”৩৯৪এখন বাস্তবে ‘গামছা’ অসমীয়া জাতীয় প্রতীক হবার পরে সবাই কোমরে সাদা কাপড়ে লাল-সবুজ সুতোর কাজে অলঙ্কৃত ‘গামছা’ই বাঁধেন,তথাপি লোকে বলতে বলেন,‘টঙালি বান্ধি’।‘গামছা’ নিয়ে লেখা একটি প্রবন্ধে লেখক লিখছেন,“মাঝি দাঁড় বায়,গুন টানে কোমরে গামছা বেঁধে।শরীরের শক্তিকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর জন্যই কোমরে এই গামছা বাঁধা।কোনো কাজ করার আগে আমরা যেমন বলি,কোমরে গামছা বেঁধে লেগে যাও।তার মানে,শক্তিকে পুরোপুরি কাজে লাগাও।”৩৯৫ অন্যদিকে তেনা নিতান্তই একটি পুরনো ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো যা কোমরে বা মাথায় বাঁধবারতো প্রশ্নই নেই,শরীর ছাড়া আর সবই মুছবার কাছে আসে।যেমন- কড়াই মুছবার তেনা ল।হরুতার তেনাছেচড়া লইয়া নালাত যা গি,ধইয়া আইবে।৩৯৬ সুতরাং ‘তেনা’র সঙ্গে টঙালি’ বসালে ‘টঙালি’র মান ঠিক থাকে না।
সিলেটি ‘পাগা’৩৯৭ অসমিয়া ‘পঘা’৩৯৮ শব্দের অর্থ একই।গরু ছাগল বাঁধবার লম্বা দড়ি।সুতরাং মান বাংলাতে ‘দড়ি’ বা ‘দড়া’ বললে যেভাবে যেকোনো দড়িকে বোঝায়,‘পাগা’ সেরকম কিছু নয়,এক বিশেষ কাজে ব্যবহৃত দড়ি। যাতে গরু বা ছাগল এক বিশেষ এলাকার বা ‘প্রাকার’-এর বাইরে না যেতে পারে।মান বাংলাতে ‘পালানো’ অর্থে ‘পগার পার’ কথাটি আছে।যেমন---‘আঁচল খুলে একদাপটে পগার হলো পার।’(হেমচন্দ্র) ‘পগার’ ‘প্রাকার’-এর তদ্ভব রূপ।৩৯৯সেখান থেকে অর্থ সংক্রমিত হয়ে সিলেটি ‘পাগা’,অসমিয়া ‘পঘা’ আসাটাই সম্ভব।সিলেটিতে সেরকম হাতি বা নৌকা বাঁধবার শক্ত দড়ির আলাদা নাম ‘কাছি’৪০০। মান বাংলাতে যে কোনো শক্ত দড়ির নাম ‘কাছি’৪০১ হলেও নৌকার কাছি কথাটি পরিচিত।রবীন্দ্র কবিতাতে আছে,“পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি,/ ছিন্ন পালের কাছি...।”(নির্ভয়; মহুয়া) এই কাছিও কিন্তু তৎসম ‘কক্ষ’ থেকে অর্থ সংক্রমিত হয়ে আসা শব্দ।এর অন্য রূপ ‘কাছে’,‘কোলে’।
‘কাচ্ছুটি’ আমরা সিলেটিতে পাইনি,তার বদলে ‘কাচ̖লি/কাচুলি’ পাওয়া গেল।অর্থ নাপিতের জল রাখার বাটি।৪০২ অন্যদিকে অসমিয়াতে ‘কাছুটি’ এবং ‘কাঁচুলি’ দুটোই আছে দুই ভিন্ন অর্থে।প্রথমটির অর্থ ‘কটি-বস্ত্র’৪০৩,দ্বিতীয়টির অর্থ নারীর স্তনাবরণ।৪০৪বাংলাতে প্রথমটি নেই,দ্বিতীয়টি আছে,এবং অর্থ অসমিয়ার সঙ্গে একই।সুতরাং ‘কাছুটি’ তার সঙ্গে বসে না।
‘লগুণ’ অসমিয়া–সিলেটি সাধারণ শব্দ।‘নবগুণ’ থেকে এসেছে,লিখেছেন আবিদ রাজা মজুমদার।৪০৫ মান বাংলা শব্দটি ‘পৈতা’।
‘শিকা’,‘সিকা’ বা ‘শিকিয়া’ শব্দটি মান বাংলাতেও অত্যন্ত সুপ্রচলিত শব্দ।এবং অসমিয়া ‘শিকা’র মতোই তার অর্থ উপরে কিছু ঝুলিয়ে রাখবার জন্যে রশিতে তৈরি ঝুলনার মতো উপকরণ।৪০৬ তার থেকে মান বাংলাতে পরিচিত বাগবিধি আছে ‘শিকেয় তোলা’।তার মানে অকাজে ফেলে রাখা।রবীন্দ্রনাথের গদ্যে যেমন- “চারটে অতি জীর্ণ উপদেশ পুরোনো তেঁতুলের সহিত শিকেয় তোলা থাকে-- বুদ্ধির ডোবা হইতে এক ঘটি জল তুলিয়া তাহাতে ঢালিয়া দিলে তাহাই অনেকটা হইয়া ওঠে এবং তাহাতেই গুজ্রান্ চলিয়া যায়।”(অকাল কুষ্মাণ্ড:সমাজ) তাঁর সংগৃহীত ছেলেভুলানো ছড়ায় আছে, “তোমার শিকেয় তোলা ননি।/তুমি খাও না সারা দিনই॥” সিলেটিতেও শব্দটি একই।শুধু /ʃ/ এর বদলে উচ্চারণে/s/। তাই লিখে বোঝাতে গেলে ‘ছিকা’, ‘ছিক্কা’ বা ‘ছিকিয়া’।৪০৭‘সুরমা গাঙর পানি’তে একটি গানের কলি এরকম—“--- ছিকা লড়ে ছিকা লড়ে ঝন্ঝনাইয়া টেকা পড়ে।”(সু.গা.পা.:এগারো)
‘মাৰলি’ শব্দটি সিলেটি নয়,অসমিয়া।৪০৮এর অর্থ হচ্ছে বাঁশ কাঠের ঘরের ছাদ বা চাল ধরে রাখবার জন্যে খোটার উপরে আনুভূমিক যে বাঁশ বা কাঠ থাকে,সেটি।সিলেটিতে শব্দটি ‘মাড়ইল’৪০৯‘সুরমা গাঙর পানি’তে লেখকের বিবরণ অংশটি মান বাংলার হলেও সিলেটি বহু শব্দকেও অনায়াসে ব্যবহার করেছেন লেখক।সেরকমই একটি বাক্য হচ্ছে,“মায়ের সঞ্চয় দু-চার পয়সা ছিকির ভিতর নারকেল মালায় থাকে বড়ঘরের মাড়ইলএ”(সু.গা.পা.:দুই)।মাড়ইল কথাটির অন্য অর্থ ‘মেরুদণ্ড’ও।‘সুরমা গাঙর পানিতে’ আছে,“হে ভাবল অউ মউকা।হিন্দুর মাড়ইল হাড্ডি ভাঙ্গি লাওয়ার।”(সু.গা.পা.:পঁয়ত্রিশ) শব্দটি মান বাংলাতেও ‘মাড়লি’ বা ‘মারুলি’ (<মারুল্ল< মারুণ্ড)।যেমন—মাড়লি খাইল ঘুনে খসি পড়ে পালা।’৪১০গোপীচন্দ্রের গানে আছে,“মারুলি বান্দি নইব আমি ডারাইপুর সহরে ৷ হাড়ি বলে হারে বিধি মোর করমের ফল”৪১১।
অসমিয়া ‘ৰুৱা’ শব্দটি সম্ভবত ‘ৰোপণ’,‘ৰোৱন’৪১২ অর্থে লিখেছেন।অন্য কোনোভাবে আমরা শব্দটি খোঁজে পাইনি।সিলেটিতে তার থেকে শব্দটি ‘রুআ’ (< রুঅ> রুহ)।অর্থাৎ উচ্চারণে অসমিয়ার মতো প্রায় একই।যেমন –রুআ আবো হমলিছে না।৪১৩ মান বাংলাতে শব্দটি ‘রোয়া’।৪১৪তারাশঙ্করের উপন্যাসে আছে,“আজ্ঞে,আজ ওদের ‘রোয়া’ পরব।মানে,চাষের জল তো লেগে গেল,তা ধান রুইবার আগে ওরা পূজো-টুজো দেবে।তারপর চাষে লাগবে।”(কালিন্দী) তার মানে সিলেটি এবং অসমিয়াতে ‘র’-এ ‘ও’-কারটি ‘উ’ কার হয়েছে মাত্র।
এই অব্দি এসে একটি কথা তো নিশ্চিত যে উপেন রাভা হাকাচাম সঠিক সিলেটি,অসমিয়া এবং মান বাংলা শব্দগুলোর পরস্পর তুলনা করেছেন খুবই কম।বহু জায়গাতে হয় তিন ভাষার সমরূপ শব্দগুলোর কোনো একটি রূপের উল্লেখ করেন নি।যেমন--রুয়া(ৰুৱা)।অসমিয়া শব্দকে ভুল করেই বহু সময় সিলেটি শব্দ বলে লেখা হয়েছে এবং ভুল মানবাংলা শব্দ বসানো হয়েছে।যাতে মনে হয় যে সিলেটি-অসমিয়া শব্দদুটি প্রায় একই।মান বাংলা তার থেকে বহুদূর। যেমন--পাণীপেট (তলপেট) তু.বাং:বগল।অন্যদিকে বহু সময় কাছের বাংলা শব্দ এড়িয়ে এমন সব শব্দ বসানো হয়েছে যেগুলো হয় কষ্টকল্পিত বা এমন প্রতিশব্দ যেগুলো সিলেটি অসমিয়াতেও রয়েছে,কিন্তু সেই সিলেটি অসমিয়া শব্দের তুলনা করে দেখানো হয় নি।তাতে মনে হয় যেন মান বাংলা সেগুলোর থেকে বহু ভিন্ন।যেমন--আড় (হাড়) তু.বাং:হাড়া, গা তু.বাং:শরীর।যদি কোথাও সঠিক ভাবেই সিলেটি অসমিয়া সমরূপ শব্দগুলো রয়েছে অন্যান্য প্রতিবেশী ভাষাবৈচিত্র্যেও সেগুলো আছে কিনা সেগুলো সন্ধান করে দেখা হয় নি।সুতরাং সেই ভাষাগুলোর সংগে অসমিয়ার সম্পর্ক কী হবে সেই প্রশ্ন করাও হয় নি,উত্তর সন্ধানতো না-ই।যেমন:লিক(লেখি ওকণি),চ’রা (চরাই), বগা/বগুড়া (বগ/ বগলী), কুহিয়ার তু.বাং:আঁক,ইত্যাদি।এবং সবচাইতে যেটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দসন্ধানে,সেটি হলো পেছনের ভূগোল আর সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের বৈচিত্র্যের কথাটি মনে রাখা।যা ছাড়া জাল,শরতা,গুয়া,সুপারি,সফরি ইত্যাদি শব্দের সমস্যার স্বরূপ বোঝা দুষ্কর।এমন কি আমরা দেখালাম,‘ঊনৈছ,একৈছ’-এর মতো দুই একটি সংখ্যা শব্দ-- যেগুলোকে অসমিয়াতেও বলা হচ্ছে ঋণশব্দ--সেগুলোরও সিলেটি সমরূপকে এমন ভাবে দেখানো হচ্ছে,বুঝিবা সেগুলো অসমিয়ার থেকে সিলেটি পেয়েছে,বাংলার ভাষাগুচ্ছগুলোর উত্তরাধিকারসূত্রে নয়।এহেন তুলনা দিয়ে এই সিদ্ধান্তে মোটেই যাওয়া যায় না যে সিলেটি সামগ্রিকভাবে বাংলা এবং তার তাবৎ ভাষাবৈচিত্র্যগুলোর থেকে দূরের কিন্তু শুধু অসমিয়ারই খুব কাছের ভাষা। উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী বুঝি ‘অসমীয়া ভাষা আরু উপভাষা’ বইতে প্রমোদ চন্দ্র ভট্টাচার্যের ‘সুরতে সুর মিলাই ক’বলৈ অকণো সংকোচ বোধ করা নাই’ যে ‘কাছারী উপভাষা’ এবং ‘অসমীয়া মান্যভাষা’-র ‘প্রায় পয়সত্তরটা শব্দ সজাতীয় শব্দ’।এই কথার উল্লেখ করেছেন উপেন রাভা হাকাচাম।৪১৫আমাদেরও এমনটা বলতে কোনো ‘সংকোচ’ হবে না।বহু শব্দ যে এক,আমরাও দেখিয়ে এলাম।এটি সত্য হতে পারে,সংখ্যাটা আরো বেশিও হতে পারে।কিন্তু সেই ‘সজাতীয়’তার পরীক্ষা কি এই উপায়ে হবে যেভাবে হলো বলে আমরা দেখিয়ে এলাম?এর থেকে বিশুদ্ধ পরীক্ষা হয়ে থাকলে নিশ্চয় তিনি তথ্যসহ উল্লেখ করতেন।আর যদি সব ঠিকঠাকও থাকে,সেতো মান বাংলা অসমিয়ার সম্পর্কেও সত্য হতে পারে। মান বাংলা আর সিলেটির মধ্যেও যে এই অনুপাতটাই সত্য নয় --সেই হিসেবটাও করে দেখাতে হবে।কিংবা অসমিয়ার সঙ্গে হিসেব হতে হবে চট্টগ্রামী বা কুমিল্লা বা ঢাকা বা ময়মনসিংহের ভাষারও।সেই সব পরীক্ষা করা হলো কবে? আমরাতো দেখালাম,অসমিয়া ‘ভরি’ শব্দটি সিলেটিতে নেই,কিন্তু চট্টগ্রামীতে রয়েছে।সেরকম প্রচুর শব্দ দেখানো যেতে পারে,তার থেকে কি সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে যে চট্টগ্রামী বৃহত্তর অসমিয়া ভাষারই বিস্তার,অথবা অসমিয়া বৃহত্তর চট্টগ্রামী নোয়াখালি বা রোহিঙ্গিয়ার সঙ্গে একই?শব্দ কি এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমাদের কোনো সাহায্য করতে পারে? বাংলা ‘গভরু’,হিন্দি ‘গবরু’ আর অসমিয়া ‘গাভৰু’,কিংবা সিলেট-কুমিল্লার ‘নাইয়র’,অবধীর ‘नैहर’ এবং অসমিয়া ‘নেউৰি’,কিংবা অসমিয়া বাংলা সিলেটি ‘শিকা’(ʃika/ sika) সম্পর্কে আমাদের সিদ্ধান্ত কী হবে?আমাদের মতে এই সব শুধু ভাষা,সমাজ এবং সাহিত্যের ঐতিহাসিক গতিপথের সংকেত হিসেবে কাজ করতে পারে।আজকের ভাষারূপের সংজ্ঞা নির্ধারণের কাজ শব্দ-সংখ্যানুপাতের নয়।আমরাও তাই অনুপাতটি বের করবার চেষ্টা করিনি।আমাদের কাছে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সংকলিত ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’,মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের আঞ্চলিক বাংলার অভিধান’ এবং দেবব্রত শর্মা সম্পাদিত ‘অসমীয়া জাতীয় অভিধান’-এর মতো বিশাল তিনখানা অভিধান থাকা সত্ত্বেও সেটি করিনি।কারণ আমাদের মনে হয়েছে বিশ্বাসযোগ্য উপস্থাপনার জন্যে শুধু সেটিই এক স্বতন্ত্র গবেষণার কাজ হতে পারে।যে শব্দগুলো নিয়ে আমরা কথা বলে এলাম সেগুলোরও সব ক’টির প্রতিশব্দ এই তিন অভিধানেও নেই।যার জন্যে আমরা ধ্বনি তত্ত্ব বা রূপতত্ত্বের আলোচনাতে যেভাবে নোয়াখালি চট্টগ্রামী রূপ নিয়ে সমান্তরাল আলোচনা করে এসেছি, এখানে সব শব্দের প্রতিশব্দ তুলে দিতে পারিনি।রবীন্দ্র দত্তও যে তালিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন,সেগুলো উপেন রাভা হাকাচামের শব্দতালিকার থেকে অনেকটাই ভিন্ন।সেই ভিন্ন তালিকা দিয়েও আমরা অবশ্য আলাদা করে সিলেটি আর অসমিয়ার সঙ্গে সেই দুটি ভাষাবৈচিত্র্য নোয়াখালি এবং চট্টগ্রামীর ঘনিষ্ঠতা দেখাতে পারতাম।কিন্তু সেও বাহুল্যমাত্র হতো। আশা করছি,যেটুকু করা গেছে তাতেই সেসব অনেকটাই দেখানো গেছে।শুধু তথ্য হিসেবে এটি উল্লেখ করে রাখা ভালো যে বাংলা ভাষার ইতিহাসে একখানা সুখ্যাত অভিধান ‘জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস’-এর ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’-এর উপরে ভিত্তি করে যে সংখ্যাতাত্ত্বিক অধ্যয়ন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় করেছিলেন,সেটিকেও পবিত্র সরকার বলেছিলেন, ‘বিভ্রান্তিকর’।কারণ তাতে মুখের কথার শব্দাবলী ছিল না বললেই চলে।৪১৬অথচ,এর বেশি কিছু তখন সুনীতিকুমারের করবার উপায় ছিল না।সুতরাং কাজটি এতো সহজ নয়।যিনিই করবেন,সে অসমিয়াতেই করুন,তিনি প্রতিবেশী ভাষাতেও পথ প্রদর্শক হবেন।
আমরা উপেন রাভা হাকাচামেরই একটি মন্তব্য আবার স্মরণে আনতে পারি,“দুটো ভাষার আংশিক সাদৃশ্য দেখলেই এই ভাষার থেকে ঐ ভাষাতে ভাষাগত উপাদান রপ্তানির তত্ত্বের প্রয়োগ এবং এই ভাষা ঐ ভাষার থেকে বেশি সমৃদ্ধ ---এসব জাহির করবার প্রবণতা নির্মোহ আলোচনাতে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে।” শুধু ‘এই ভাষা ঐ ভাষার থেকে বেশি সমৃদ্ধ’ কথা ক’টি পালটে ‘এই ভাষা ঐ ভাষার উপভাষা’ কথা ক’টি বসিয়ে দিতে পারি।
।। উল্লেখপঞ্জি ।।
১) সুকুমার সেন:ব্যাকরণের প্রকার ও শাখা; তৃতীয় অধ্যায়;ভাষার ইতিবৃত্ত; আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট
লিমিটেড, কলকাতা-৯;প্রথম আনন্দ সংস্করণ, তৃতীয় মুদ্রণ,নভেম্বর,১৯৯৪;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩১।
২) নির্মল দাশ:সূচিপত্র;ভাষাবীথি;অরিয়েণ্টাল বুক কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড;গুয়াহাটি-০১;প্রথম
প্রকাশ ফেব্রুয়ারি,২০০১;পৃ:VIII।
৩) সুকুমার সেন:বিষয়-সূচী;ভাষার ইতিবৃত্ত;প্রাগুক্ত।
৪) দেবেশ রায়:নতুন পাঠোদ্ধারের প্রস্তাব: ও-ডি-বি-এল;জাহির- বাতুন;অপর ভাষা;অক্ষর
পাবলিকেশনস, আগরতলা;২০০৩;পৃ: ৫৫।
৫) Suniti Kumar Chatterji:Introduction;AppendixC; The Origin and
Development of the Bengali Language;Rupa & Co, Kolkata;1993;
pg.:179.
৬) S.K. Chatterji;Introduction;Appendix D;ibid.;pg.:189.
৭) S.K. Chatterji;ibid.; pg.: 200.
৮) S.K. Chatterji:Preface;ibid.;pg.: xiii.
৯) George A.Grierson: Forward;ODBL:S.K.Chatterji;ibid.; pg.: vii.
১০) দেবেশ রায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৫ ।
১১) রামেশ্বর শ’:ভাষাবিজ্ঞানের ক্রমবিকাশ;সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা;পুস্তক বিপণি,
কলকাতা -৯;অখণ্ড দ্বিতীয় সংস্করণ,৩০শে শ্রাবণ,১৩৯৯;পৃ: ১৬৪।
১২) হুমায়ুন আজাদ:অবতরণিকা;বাঙলা ভাষা,প্রথম খণ্ড;সম্পাদক হুমায়ুন আজাদ;আগামী
প্রকাশনী,ঢাকা;২০০৯;পৃ: ৪৭
১৩) বসন্ত কুমার ভট্টাচার্য: অসমত ভাষা চর্চার ইতিহাস;প্রথম খণ্ড;ভাষার তত্ত্ব-কথা;সম্পাদক.নাহেন্দ্র
পাদুন;বাণীমন্দির ডিব্রুগড়-গুয়াহাটি-তেজপুর; ১৯৯৩;পৃ: ১৫।
১৪) ড০ উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;অধ্যায় তিনি;ভাষা-বিজ্ঞান;মণি-মাণিক প্রকাশ; গুয়াহাটি-০১;
একবিংশতিতম সংস্করণ,২০১৪;পৃ: ১৫৩।
১৫) ড০ ভীমকান্ত বরুয়া:অসমীয়া ভাষা;বনলতা,ডিব্রুগড় ও গুয়াহাটি-০১;দ্বিতীয় সংশোধিত প্রকাশ,
২০০৬;পৃ: ১৩৬ এবং ১৪৩।
১৬) দীপ্তি ফুকন পাটগিরি:শব্দমালা;অসমীয়া,বাংলা,উড়িয়া ভাষা-তুলনামূলক অধ্যয়ন;পৃ: ১৩৮।
১৭) রামেশ্বর শ’: ভাষাবিজ্ঞানের ক্রমবিকাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১১৭।
১৮) রামেশ্বর শ’: এককালিক/বর্ণনামূলক ও কালক্রমিক/ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান;প্রাগুক্ত;পৃ:৩১।
১৯) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩।
২০) Barbara H.Partee:The Garden Of Eden Period For Deep Structure And
Semantics;50 Years Later: Reflections On Chomsky’s Aspects;Á.
Gallego & D. Ott (Eds.);Cambridge;2015; Ma: Mitwpl. Pg.: 187.
২১) ibid.
২২) The Structure of a Semantic Theory:Jerrold J. Katz and Jerry A. Fodor;
Language;ol.39,No. 2.(Apr. - Jun., 1963);Linguistic Society of
America;pg.: 191;DOI:
10.2307/411200; http://www.jstor.org/stable/411200.
২৩) Barbara H.Partee;ibid;Pg.: 196.
২৪) রামেশ্বর শ’: ভাষাবিজ্ঞানের ক্রমবিকাশ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮৪।
২৫) The University of Chicago;
http://southasiadissertations.uchicago.edu/content/sarkar-
pabitrabhushan.
২৬) সুজিৎ চৌধুরী:বাংলা ভাষার নতুন বিপ্লব আর আসামের বাঙালিরা;ভাষা ও সাহিত্য;সম্পাদনা
বিবেকানন্দ মোহন্ত;স্রোত প্রকাশনা;আগরতলা,২০১৩;পৃ:৬৭।
২৭) পবিত্র সরকার:প্রশ্ন ও বাংলা প্রশ্নবাক্যের গঠন;বাংলা ব্যাকরণ প্রসঙ্গ;দে’জ পাবলিশিং,কলকাতা-
৭৩;প্রথম প্রকাশ- জানুয়ারি,২০০৬;পৃ:১৭২।
২৮) পবিত্র সরকার:বাংলা ভাষায় নিষেধাত্মক (negative) উপাদান;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮৭।
২৯) পবিত্র সরকার:বাংলা শব্দভাণ্ডার ও সাহিত্য শৈলী: সম্প্রীতির দলিল;ভাষা প্রেম ভাষাবিরোধ;দে’জ
পাবলিশিং;কলকাতা-৭৩;২০০৩;পৃ: ৮১।
৩০) রামেশ্বর শ’: শব্দার্থ তত্ত্ব এবং অর্থপরিবর্তনের ধারা;প্রাগুক্ত;পৃ:৫২৪।
৩১) Daniel Chandler: Signs; Semiotics for Beginners;
http://visualmemory.co.uk/daniel/Documents/S4B/sem02.html.
৩২) J.V. Stalin:Marxism and Problems of Linguistics;Foreign Languages
Publishing House;Moscow; Stalin Reference Archive (marxists.org)
2000.
৩৩) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম: বরাক উপত্যকার চিলেটীয়া (কাছারী) উপভাষা;অসমীয়া জাতিগত
আরু শ্রেণীগত উপভাষা;অসমীয়া আরু অসমর ভাষা উপভাষা;জ্যোতি প্রকাশন,গুয়াহাটি;জুলাই
২০০৯;পৃ: ২৮১।
৩৪) জগন্নাথ চক্রবর্তী:শব্দার্থতত্ত্ব;বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান ও ভাষাতত্ত্ব;ভাষা-
সংস্কৃতি আকাদেমি অসম,হাফলং;প্রথম প্রকাশ- বৈশাখ,১৪২২বঙ্গাব্দ;পৃ: ৪৮১।
৩৫) Sudhāṃśu Śekhara Tuṅga: Vocabulary;Bengali and Other Related
Dialects of South Assam;Mittal Publications;New Delhi-59;first
Edition,1995;pg.: 320.
৩৬) রবীন্দ্র কুমার দত্ত:নোয়াখালি ও চট্টগ্রামী উপভাষায় শব্দার্থগত বিভিন্ন দিক; নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের
উপভাষা—একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ;প্রগ্রেসিভ পাব্লিশার্স;কলকাতা-৭৩;মার্চ, ২০১২;পৃ: ২১০।
৩৭) সুকুমার সেন:শব্দের অর্থচাঞ্চল্য;পঞ্চম অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৬।
৩৮) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ:৫৬।
৩৯) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ:৫৬।
৪০) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ:৫৬।
৪১) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ:৫৬।
৪২) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ:৬৫।
৪৩) ড০ উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬২।
৪৪) ড০ উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬২।
৪৫) ড০ উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬২।
৪৬) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ:৫৭।
৪৭) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ:৫২৪।
৪৮) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়:বঙ্গীয় শব্দকোষ;দ্বিতীয় খণ্ড;সাহিত্য অকাদেমি; নতুন দিল্লি-০১;অষ্টম মুদ্রণ
– ২০১১; পৃ: ২০৮৬
৪৯) ড০ উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬১।
৫০) ড০ উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬২।
৫১) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ:৪৮১।
৫২) সুকুমার সেন:শব্দার্থ ও ইতিহাস-উপাদান;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৯।
৫৩) ড০ উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫৬।
৫৪) ড০ উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫৭।
৫৫) ড০ উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫৭।
৫৬) ড০ উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫৮।
৫৭) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ:২১৭।
৫৮) ড০ উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫৮।
৫৯) জগন্নাথ চক্রবর্তী; প্রাগুক্ত;পৃ:৪৮৭।
৬০) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫২৯।
৬১) ড০ উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত; পৃ: ১৬৪।
৬২) রামেশ্বর শ’: শব্দভাণ্ডারের অবক্ষয় ও নতুন শব্দ সৃষ্টির পরিসংখ্যান;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৬৭।
৬৩) অতীন্দ্র মজুমদার: শব্দপ্রভাবিত ও অর্থানুমোদিত পরিবর্তন;ভাষাতত্ত্ব;নয়াপ্রকাশ;কলকাতা-
০৬;দ্বিতীয় সংস্করণ,১৯৮৭;পৃ: ১৫৯।
৬৪) সুকুমার সেন: ধ্বনিপরিবর্তনের প্রকৃতি;শব্দপ্রভাবিত ও অর্থানুগত; চতুর্থ অধ্যায়; প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৮।
৬৫) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত; পৃ:৪৮।
৬৬) অতীন্দ্র মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:১৫৯।
৬৭) রামেশ্বর শ’:ধ্বনিপরিবর্তন;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫১৬।
৬৮) অতীন্দ্র মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:১৬১
৬৯) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ:৫০।
৭০) ড০ উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত; পৃ: ১৬৩।
৭১) ড০ উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী;প্রাগুক্ত; পৃ: ১৬৩।
৭২) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ:৫২।
৭৩) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ:৫২।
৭৪) নিশীথ রঞ্জন দাস:বরাক উপত্যকার লৌকিক বাংলা ভাষা, প্রথম খণ্ড; বিবলিয়া;কলকাতা-৬৪;
২০১৪;পৃ:৭৪।
৭৫) পবিত্র সরকার:বাংলা শব্দভাণ্ডার ও সাহিত্য শৈলী:সম্প্রীতির দলিল;ভাষাপ্রেম ভাষাবিরোধ;
প্রাগুক্ত;পৃ: ৮৩।
৭৬) প্রশান্ত চক্রবর্তী:সৈয়দ মুজতবা আলীর গদ্যভাষাঃপূর্ববঙ্গীয় শেকড়;কোরক সাহিত্য
পত্রিকা;সম্পাদক- তাপস ভৌমিক;কলকাতা-৫৯;প্রাক শারদ ১৪১৮ সংখ্যা;পৃ: ২১৩।
৭৭) পবিত্র সরকার: বাংলা শব্দভাণ্ডার ও সাহিত্য শৈলী: সম্প্রীতির দলিল; ভাষাপ্রেম ভাষাবিরোধ;
প্রাগুক্ত;পৃ: ৮৪।
৭৮) ড০ দেবব্রত শর্মা: হেমকোষত নিহিত শ্রেণী-জাতি-বর্ণ চেতনা আরু অসমীয়া জাতীয় অভিধান
প্রসঙ্গ;জাতীয় অভিধান প্রসঙ্গ;সম্পাদক- ড০ বেণু গগৈ,ড০ দেবব্রত শর্মা;অসম জাতীয় শিক্ষা
সমন্বয় প্রসঙ্গ;যোরহাট;পৃ:৩২।
৭৯) রামেশ্বর শ’: শব্দভাণ্ডারের অবক্ষয় ও নতুন শব্দ সৃষ্টির পরিসংখ্যান;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৬৭।
৮০) S.K. Chatterji: Introduction;Appendix D;ibid.; pg.:218.
৮১) S.K. Chatterji: Morphology; Chapter V;ibid.;pg.:876
৮২) S.K. Chatterji:Introduction;Appendix D; ibid.; pg.:190.
৮৩) S.K. Chatterji;ibid.;pg.:191.
৮৪) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:কৃষ্ণবিহারী সেন;ব্যক্তি প্রসঙ্গ;রবীন্দ্র রচনাবলী;ভাষাপ্রযুক্তি গবেষণা
পরিষদ,কলকাতা পরিবেশিত বৈদ্যুতিন সংস্করণ;
http://www.rabindra-rachanabali.nltr.org/node/9933
৮৫) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:বানান-বিধি ২;বাংলা শব্দতত্ত্ব;রবীন্দ্র রচনাবলী;ভাষাপ্রযুক্তি গবেষণা
পরিষদ,কলকাতা পরিবেশিত বৈদ্যুতিন সংস্করণ;
http://www.rabindra-rachanabali.nltr.org/node/8741
৮৬) S.K. Chatterji; ibid.; pg.:201.
৮৭) সুকুমার সেন:বাঙ্গালা শব্দভাণ্ডার; দ্বাদশ অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫৭।
৮৮) অতীন্দ্র মজুমদার:বাংলা শব্দভাণ্ডার;প্রাগুক্ত;পৃ: ১২৬
৮৯) ড০ গোলকচন্দ্র গোস্বামী;অসমীয়া ব্যাকরণ প্রবেশ;বীণা লাইব্রেরী, গুয়াহাটি -০১;দ্বিতীয় সংস্করণ,
২০০৩;পৃ:১৫৯।
৯০) ড০ গোলকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:১৫৯।
৯১) S.K. Chatterji;ibid.;pg.:195.
৯২) S.K. Chatterji;ibid.;pg.:196.
৯৩) S.K. Chatterji;ibid.;pg.:189
৯৪) S.K. Chatterji;ibid.;pg.:189
৯৫) দিলীপ কুমার মালাকার (সং.):পদ্মাপুরাণ সংগ্রহ লীলা কীর্ত্তণমালা;প্রকাশক:নীলোৎপল দাস;
করিমগঞ্জ;২০১২;পৃ:১০৩।
৯৬) দইখুরা: সিলেটি নাগরির পহেলা কেতাব ও দুইখুরার রাগ;সম্পাদনা –অনুরাধা চন্দ;দে’জ
পাবলিশিং;কলকাতা-৭৩ ও স্কুল অফ কালচারাল টেক্সটস অ্যান্ড রেকর্ডস,যাদবপুর
বিশ্ববিদ্যালয়;২০০৬;:১২।
৯৭) ড০ গোলকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬২।
৯৮) S.K. Chatterji: The Numetals;Chapter III;ibid.; pg.:782.
৯৯) ড০ বাণীকান্ত কাকতি: অসমীয়া শব্দসম্ভার; অসমীয়া ভাষার গঠন আরু বিকাশ; বিশ্বেশ্বর
হাজরিকার অনুবাদ;ড০ বাণীকান্ত কাকতি জন্মশতবার্ষিকী উদ̖যাপন সমিতি,
বরপেটা;অক্টোবর,১৯৯৬;পৃ: ১৭।
১০০) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ:১৭।
১০১) ড০ বাণীকান্ত কাকতি:ধ্বনিতত্ত্ব;প্রাগুক্ত; পৃ:৫৬।
১০২) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ:৫৬।
১০৩) সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়:ভাষা-সংকট;অগ্রন্থিত সুনীতিকুমার;সম্পাদনা-বারিদবরণ ঘোষ;দীপ
প্রকাশন,কলকাতা- ৬৭;২০০৯;পৃ: ৯০।
১০৪) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৯৭।
১০৫) শব্দ ডট অর্গ-A Multilingual Online Dictionary;
http://www.xobdo.org/tiwa/lai
১০৬) নিশীথ রঞ্জন দাস;প্রাগুক্ত;পৃ: ৯০।
১০৭) শব্দ ডট অর্গ-A Multilingual Online Dictionary;
http://www.xobdo.org/adic/index.php
১০৮) জগন্নাথ চক্রবর্তী:অভিধান;প্রাগুক্ত;পৃ:২৫৭।
১০৯) আবিদ রাজা মজুমদার:বরাক উপত্যকার কথ্য বাংলার অভিধান;সৃজন,শিলচর -০১;প্রথম
প্রকাশ,২০১১;পৃ: ২৫।
১১০) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.):আধুনিক অসমীয়া
অভিধান;অসম প্রকাশন পরিষদ;গুয়াহাটি;চতুর্থ পুনর্মুদ্রণ-মে’ ১৯৮৯;পৃ: ২৮২।
১১১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর;বিজ্ঞতা;সমালোচনা;রবীন্দ্ররচনাবলী;১২৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত
সুলভ সংস্করণ,বিশ্বভারতী;১৯৮৫;পঞ্চদশ খণ্ড;পৃ: ৬৪।
১১২) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ১০৬৬।
১১৩) ড০ দেবব্রত শর্মা(স.):অসমীয়া জাতীয় অভিধান;তৃতীয় খণ্ড;অসম জাতীয় প্রকাশ; যোরহাট;
পৃ:৪২৬।
১১৪) S.S. Tunga: Phonoilogy;Chapter II;ibid;pg.:320.
১১৫) অতীন্দ্র মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:১২৭
১১৬) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫৭।
১১৭) ড০ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ:বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত;মাওলা ব্রাদার্স;ঢাকা,বাংলাদেশ;প্রথম মাওলা
ব্রাদার্স সংস্করণ;পঞ্চম মুদ্রণ;জানুয়ারি ২০১০;পৃ: ৫১।
১১৮) ড০ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ:বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৭।
১১৯) S.K. Chatterji:Introduction;ibid.; pg.:199
১২০) S.K. Chatterji: Introduction;Appendix B;ibid.; pg.:170.
১২১) ড০ গোলকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬১।
১২২) ড০ গোলকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬১।
১২৩) ড০ গোলকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬১।
১২৪) ড০ বাণীকান্ত কাকতি: অসমীয়া শব্দসম্ভারত অনার্য শাব্দিক সমরূপতা;প্রাগুক্ত;পৃ:২৮।
১২৫) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ:৪৬
১২৬) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ:৪৭
১২৭) S.K. Chatterji; ibid.; pg.:177.
১২৮) দীপককুমার রায়: বাংলা ভাষায় ভোটবর্মী উপাদান;উত্তর বঙ্গের ভাষা;সম্পাদক রতন বিশ্বাস;
বইওয়ালা,কলকাতা- ৪৮;প্রথম প্রকাশ,দ্বিতীয় মুদ্রণ- অক্টোবর,২০০৫;পৃ: ৩৪৭।
১২৯) নীহাররঞ্জন রায়: বাঙ্গালীর ইতিহাস,আদিপর্ব;দে’জ পাবলিশিং;কলকাতা-৭৩;প্রথম দে’জ
সংস্করণ,বৈশাখ ১৪০০;পৃ: ৪৪।
১৩০) নীহাররঞ্জন রায়;প্রাগুক্ত;পৃ:৫৭।
১৩১) S.K. Chatterji: Reconstruction of Early Mongoloid (Kirāta)
Movements in India;Kirata-Jana-Krti,The Indo-Mongoloids,Their
Contribution to the History and Culture of India;The Royal Asiatic
Society of Bengal; Calcutta;1950;pg.:22.
১৩২) ড০ রমাকান্ত দাস:বরাক উপত্যকার স্থান নাম;অক্ষর পাবলিকেশনস,আগরতলা;জুলাই,২০০৯;
পৃ: ৮৫।
১৩৩) শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিশ্বপতি চৌধুরী (স.): কবিকঙ্কন চণ্ডী;কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়,
কলিকাতা;১৯৭৪;পৃ: ২৫৯।
১৩৪) S.K. Chatterji:KJK;ibid.;pg.: 22.
১৩৫) সুজিৎ চৌধুরী:আদিপর্ব;শ্রীহট্ট- কাছাড়ের প্রাচীন ইতিহাস;দিনকাল প্রেস
লিমিটেড;শিলচর;২০০৬;পৃ: ১৯।
১৩৬) সুজিৎ চৌধুরী:আর্যব্রাহ্মণ্য প্রভাবের বিস্তার ও প্রতিষ্ঠা-২,নিধনপুর লিপি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৭।
১৩৭) সুজিৎ চৌধুরী:উপসংহার;প্রাগুক্ত;পৃ: ২২০।
১৩৮) শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিশ্বপতি চৌধুরী (স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০০।
১৩৯) অচ্যুৎচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত,উত্তরাংশ;কথা (সংস্করণ),কলকাতা-৪৭;২০১০;
পৃ: ৪৪।
১৪০) সুকুমার সেন:উপক্রমণিকা;বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস;প্রথম খণ্ড;আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট
লিমিটেড,কলকাতা ৯;দ্বিতীয় মুদ্রণ ১৯৯৩;পৃ: ৩।
১৪১) সুকুমার সেন:প্রাগুক্ত;পৃ: ৩।
১৪২) সুকুমার সেন:প্রাগুক্ত;পৃ: ৩।
১৪৩) সুকুমার সেন:প্রাগুক্ত;পৃ: ৩।
১৪৪) ড০ বাণীকান্ত কাকতি; প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৭।
১৪৫) ড০ বাণীকান্ত কাকতি; প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৭।
১৪৬) ড০ বাণীকান্ত কাকতি; প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৭।
১৪৭) ড০ বাণীকান্ত কাকতি; প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৭।
১৪৮) রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়:বাঙ্গালার ইতিহাস; প্রথম খণ্ড;মনোমোহন প্রকাশনী;কলকাতা-৭৩;
দ্বিতীয় সংস্করণ,১৯৬০;পৃ: ৯২।
১৪৯) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম:অসমীয়া ভাষাত তিব্বত –বর্মীয় উপাদানঃ কিছু নতুন চিন্তার উন্মেষ;
সূত্রপাত;অসমীয়া আরু অসমর তিব্বত-বর্মীয় ভাষা;প্রকাশিকা শ্রীমতী মঞ্জুলা রাভা
হাকাচামজাক;ধূপধরা,গোয়ালপারা;তৃতীয় আরু সংশোধিত সংস্করণ,এপ্রিল ২০০৭;পৃ: ৪২।
১৫০) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪২।
১৫১) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম:অসমীয়া ভাষাত তিব্বত –বর্মীয় উপাদান: কিছু নতুন চিন্তার উন্মেষ;
প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৭.
১৫২) দীপঙ্কর মরল: উপভাষা বিজ্ঞান;বনলতা-গুয়াহাটি-ডিব্রুগড়-০১;তৃতীয় পরিবর্ধিত প্রকাশ-২০০৭;
পৃ: ৯৯।
১৫৩) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম:অসমীয়া ভাষাত তিব্বত –বর্মীয় উপাদান: কিছু নতুন চিন্তার উন্মেষ;
প্রাগুক্ত;পৃ: ৪১।
১৫৪) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪১।
১৫৫) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪১।
১৫৬) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৭।
১৫৭) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৯।
১৫৮) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ:১৯।
১৫৯) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ:৫৬।
১৬০) জগন্নাথ চক্রবর্তী:শব্দভাণ্ডার;প্রাগুক্ত;পৃ:৫০৯।
১৬১) নিশীথ রঞ্জন দাস;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৮।
১৬২) নিশীথ রঞ্জন দাস;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮।
১৬৩) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);প্রথম খণ্ড; প্রাগুক্ত;পৃ: ৮০০।
১৬৪) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);প্রথম খণ্ড; প্রাগুক্ত; পৃ:৮০৩।
১৬৫) নিশীথ রঞ্জন দাস;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬১।
১৬৬) নিশীথ রঞ্জন দাস;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬১।
১৬৭) নিশীথ রঞ্জন দাস;প্রাগুক্ত;পৃ: ৮৯।
১৬৮) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;দ্বিতীয় খণ্ড; প্রাগুক্ত;পৃ:১৩৪৮।
১৬৯) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;দ্বিতীয় খণ্ড; প্রাগুক্ত;পৃ:২২৫৯।
১৭০) নিশীথ রঞ্জন দাস; প্রাগুক্ত; পৃ: ৮৪।
১৭১) নিশীথ রঞ্জন দাস; প্রাগুক্ত; পৃ: ৮৫।
১৭২) ড০ রমাকান্ত দাস; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫১।
১৭৩) ড০ রমাকান্ত দাস; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪৯.
১৭৪) ড০ রমাকান্ত দাস; প্রাগুক্ত;পৃ:১৪৯।
১৭৫) ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (স.): বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান;প্রথম খণ্ড;বাংলা
একাডেমী;ঢাকা;দ্বিতীয় মুদ্রণ, ১৯৭৩; পৃ: ব্যঞ্জনবর্ণ অংশ, ৪৩৫।
১৭৬) ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (স.);প্রাগুক্ত; পৃ:৪৩৬।
১৭৭) ড০ রমাকান্ত দাস; প্রাগুক্ত;পৃ:১৫১।
১৭৮) S.K. Chatterji:KJK;ibid.;pg.:26.
১৭৯) ড০ বাণীকান্ত কাকতি; প্রাগুক্ত; পৃ: ৪৮।
১৮০) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম: বরাক উপত্যকার চিলেটীয়া (কাছারী) উপভাষা;অসমীয়া জাতিগত
আরু শ্রেণীগত উপভাষা;অসমীয়া আরু অসমর ভাষা উপভাষা প্রাগুক্ত;পৃ:২৮১।
১৮১) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম; প্রাগুক্ত;পৃ:২৮১।
১৮২) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:১১০।
১৮৩) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:১৬৭
১৮৪) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ:৪৫৭।
১৮৫) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ:৫৬১।
১৮৬) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ:২০৩।
১৮৭) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৩৫৮।
১৮৮) সকালের খবর;৩জুন, ২০১৬;শুক্রবার;
http://www.shokalerkhobor24.com/details.php?id=24353
১৮৯) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৪।
১৯০) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৭৬২।
১৯১) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:১০০।
১৯২) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ:২৮১।
১৯৩) দীনেশ চন্দ্র সেন:ভূমিকা;বগুলার বারমাসী;পূর্ববঙ্গ গীতিকা,২য়খণ্ড;সম্পাদক দীনেশ চন্দ্র সেন;
পৃ: ১৫৯৬।
১৯৪) দীনেশ চন্দ্র সেন (স.):বগুলার বারমাসী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৭৮।
১৯৫) দীনেশ চন্দ্র সেন (স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৮০।
১৯৬) দীনেশ চন্দ্র সেন (স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৮১।
১৯৭) দীনেশ চন্দ্র সেন (স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৮৩।
১৯৮) দীনেশ চন্দ্র সেন (স.):হাতি-খেদার গান;প্রাগুক্ত;পৃ: ৯২৫।
১৯৯) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ:২৮১।
২০০) নগেন্দ্রনাথ বসু প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব:বিশ্বকোষ; ষোড়শ খণ্ড;বিশ্বকোষ কার্যালয়;কলকাতা; ১৯০৫;
পৃ: ১৭;
https://bn.wikisource.org/wiki/পাতা:বিশ্বকোষ ষোড়শ খণ্ড.djvu/১০৭
২০১) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ:৯২৮।
২০২) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৪০।
২০৩) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২২৫।
২০৪) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);চতুর্থ খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ:৬৫৭।
২০৫) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);চতুর্থ খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ:১৩৩০।
২০৬) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;দ্বিতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ২১২৭।
২০৭) দিলীপ কুমার মালাকার (সং.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৮।
২০৮) ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ব্যঞ্জন বর্ণ অংশ,৯৭।
২০৯) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:বাঙালি কবি নয় কেন?; সাহিত্য;রবীন্দ্র রচনাবলী; ভাষাপ্রযুক্তি গবেষণা
পরিষদ,কলকাতা পরিবেশিত বৈদ্যুতিন সংস্করণ;
http://www.rabindra-rachanabali.nltr.org/node/15913
২১০) জগন্নাথ চক্রবর্তী:অভিধান;প্রাগুক্ত;পৃ:৬৯।
২১১) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ:৪৪৫।
২১২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:আষাঢ়;ক্ষণিকা;রবীন্দ্ররচনাবলী;প্রাগুক্ত;চতুর্থ খণ্ড;পৃ: ২২৯।
২১৩) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;দ্বিতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫১৯।
২১৪) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ:১০৩।
২১৫) মনোনেশ দাস:চাম্বল ময়মনসিংহে এখন বিলীয়মান গাছ; দৈনিক ময়মন সিংহ বার্তা; ১জুলাই,
২০১৪;
http://www.mymensinghbarta.com/?p=11494
২১৬) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬৫।
২১৭) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);দ্বিতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৯৪।
২১৮) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৩।
২১৯) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রথম খণ্ড; প্রাগুক্ত;পৃ: ৯৩২।
২২০) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:১৫৮।
২২১) কবি কঙ্কন চণ্ডী,প্রাগুক্ত;পৃ: ৩১৪।
২২২) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;দ্বিতীয় খণ্ড; প্রাগুক্ত;পৃ: ২২৩৪।
২২৩) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.); প্রাগুক্ত; পৃ:২৩১।
২২৪) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);তৃতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮০।
২২৫) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ১০৩৮।
২২৬) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৯৭৩।
২২৭) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:১৬৪।
২২৮) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ:৪৪৫।
২২৯) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:১৭৩।
২৩০) আশুতোষ দেব:শব্দবোধ অভিধান;দেব সাহিত্য কুটির; কলকাতা-০৯;জানুয়ারি,১৯৭৬;
পৃ: ৪০০।
২৩১) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);দ্বিতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৮২০।
২৩২) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);চতুর্থ খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ২১১।
২৩৩) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩১২।
২৩৪) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৯৬।
২৩৫) দিলীপ কুমার মালাকার (সং.);প্রাগুক্ত; পৃ:৬২।
২৩৬) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ:১১৫।
২৩৭) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রথম খণ্ড; প্রাগুক্ত;পৃ: ৭৯০।
২৩৮) আশুতোষ দেব;প্রাগুক্ত;পৃ:৩১৩।
২৩৯) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ১০৭।
২৪০) দিলীপ কুমার মালাকার (সং.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৬২ ।
২৪১) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ:১৩৫।
২৪২) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;দ্বিতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮০৯।
২৪৩) আবুল কাসেম ভুঁইয়া:পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঁশের উত্পাদন কমে যাচ্ছে;৩১ অক্টোবর, ২০১৫;
দৈনিক ইত্তেফাক;
http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/econo/2015/10/31/80740.html
২৪৪) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৩৬।
২৪৫) আশুতোষ দেব;প্রাগুক্ত;পৃ:২২২।
২৪৬) ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ব্যঞ্জন বর্ণ অংশ ০১।
২৪৭) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:৪০২।
২৪৮) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম; প্রাগুক্ত;পৃ:২৮১।
২৪৯) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;দ্বিতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ:১৮২২।
২৫০) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;দ্বিতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ:১৬১১।
২৫১) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.); প্রাগুক্ত; পৃ:২৮৬।
২৫২) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);চতুর্থ খণ্ড;প্রাগুক্ত; পৃ:৪১৯।
২৫৩) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ:৪৬৬।
২৫৪) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ১০৯৮।
২৫৫) ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (স.);প্রাগুক্ত;পৃ: স্বরবর্ণ অংশ ৮৮।
২৫৬) আশুতোষ দেব;প্রাগুক্ত;পৃ:৪১১।
২৫৭) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ২১৮।
২৫৮) ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ব্যঞ্জন বর্ণ অংশ ৪৪৫।
২৫৯) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:৪২২।
২৬০) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;দ্বিতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯৯৬।
২৬১) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪।
২৬২) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৭৭।
২৬৩) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ:১২৯।
২৬৪) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত; পৃ:১৫১।
২৬৫) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত; পৃ:১০৮।
২৬৬) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৯১।
২৬৭) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);চতুর্থ খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ১১২৬।
২৬৮) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;দ্বিতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬৬৬।
২৬৯) কিরণলেখা রায়:বরেন্দ্ররন্ধন, ভারতমিহির প্রেস,১৯২১ কলকাতা; পৃ: ৷৴৹
২৭০) দিলীপ কুমার মালাকার (সং.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৬।
২৭১) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ১১৮।
২৭২) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫১।
২৭৩) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৭৭১।
২৭৪) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮১।
২৭৫) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৩০।
২৭৬) দিলীপ কুমার মালাকার (সং.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৫০।
২৭৭) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;দ্বিতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০২০।
২৭৮) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৯৭।
২৭৯) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৬৯।
২৮০) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২০।
২৮১) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৬০।
২৮২) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৬৫।
২৮৩) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৯৯।
২৮৪) আশুতোষ দেব;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬১০।
২৮৫) আশুতোষ দেব;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৫৪।
২৮৬) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪২।
২৮৭) ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (স.);প্রাগুক্ত;পৃ: স্বর বর্ণ অংশ,১২২।
২৮৮) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০৯।
২৮৯) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);তৃতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৭৪১-৪২।
২৯০) আশুতোষ দেব;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৫০।
২৯১) দিলীপ কুমার মালাকার (সং.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৫।
২৯২) আশুতোষ দেব;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৫৯।
২৯৩) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ:৭৭।
২৯৪) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ:৪৮৫।
২৯৫) আশুতোষ দেব;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬০।
২৯৬) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২।
২৯৭) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩১৯।
২৯৮) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;দ্বিতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯৬০।
২৯৯) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২২২।
৩০০) ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (স.);প্রাগুক্ত;পৃ: স্বর বর্ণ অংশ,১৩১।
৩০১) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ১২৮।
৩০২) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬১।
৩০৩) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);দ্বিতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৩৫।
৩০৪) ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ব্যঞ্জন বর্ণ অংশ,২৫৯।
৩০৫) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৮২।
৩০৬) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০৯।
৩০৭) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);তৃতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫৯।
৩০৮) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ১০২৮।
৩০৯) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪৬।
৩১০) আশুতোষ দেব;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬১৮।
৩১১) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০১।
৩১২) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৭৫।
৩১৩) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৮।
৩১৪) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৯৩।
৩১৫) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ:৩২৪।
৩১৬) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ:৩২২-৩।
৩১৭) আশুতোষ দেব; প্রাগুক্ত;পৃ:৭৭৬।
৩১৮) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ২৮৯।
৩১৯) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৩১৫।
৩২০) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৭।
৩২১) আশুতোষ দেব;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৬৭।
৩২২) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ:২৮২।
৩২৩) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২২।
৩২৪) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২৩।
৩২৫) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৯।
৩২৬) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৮০।
৩২৭) জগন্নাথ চক্রবর্তী; প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৭২।
৩২৮) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৩১৬।
৩২৯) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২১৭।
৩৩০) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২২১।
৩৩১) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ২৩৩।
৩৩২) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০।
৩৩৩) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৯৯।
৩৩৪) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);দ্বিতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০৫।
৩৩৫) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৩৪।
৩৩৬) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:৫৪।
৩৩৭) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);তৃতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ:৬৩৬।
৩৩৮) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:২৫০।
৩৩৯) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ:২২০।
৩৪০) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম:অসমীয়া জতুয়া শব্দত তিব্বত-বর্মীয় উপাদান; অসমীয়া আরু অসমর
তিব্বত-বর্মীয় ভাষা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১০৩।
৩৪১) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ:১০০২।
৩৪২) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);তৃতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৯৩।
৩৪৩) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);দ্বিতীয় খণ্ড; প্রাগুক্ত; পৃ: ২৯৪।
৩৪৪) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ১০৩।
৩৪৫) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ১০৭।
৩৪৬) আশুতোষ দেব;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩১৩।
৩৪৭) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম:অসমীয়া ভাষাত তিব্বত –বর্মীয় উপাদান: কিছু নতুন চিন্তার উন্মেষ;
প্রাগুক্ত;পৃ: ৫২ ।
৩৪৮) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:১৪৯।
৩৪৯) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);দ্বিতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৭৭৪।
৩৫০) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২২২।
৩৫১) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৩৩।
৩৫২) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২১৩।
৩৫৩) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৬৮।
৩৫৪) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৬৫।
৩৫৫) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৫।
৩৫৬) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৫২।
৩৫৭) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ১১৮৯।
৩৫৮) বাবা এখনো জানেন না ছেলের মৃত্যুর খবর,বাকরুদ্ধ মা এনায়েত হোসেন;সংবাদ
প্রতিবেদন;দৈনিক পূর্বকোণ;চট্টগ্রাম;বাংলাদেশ;৫ফেব্রুয়ারি,২০১৫;
http://www.dainikpurbokone.net/8528/বাবা-এখনো-জানেন- না- ছেলের-ম/
৩৫৯) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:বাংলা ভাষা পরিচয়,২১;রবীন্দ্ররচনাবলী;১২৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে
প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ;বিশ্বভারতী;১৯৮৫;ত্রয়োদশ খণ্ড;পৃ: ৬২২।
৩৬০) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম: বরাক উপত্যকার চিলেটীয়া (কাছারী) উপভাষা;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৮২।
৩৬১) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);চতুর্থ খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৯৯।
৩৬২) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩১৭।
৩৬৩) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত; পৃ: ২১৮।
৩৬৪) জগন্নাথ চক্রবর্তী; প্রাগুক্ত;পৃ: ২৫৪।
৩৬৫) জগন্নাথ চক্রবর্তী; প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪৭।
৩৬৬) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;দ্বিতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩০৩।
৩৬৭) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ২৯৪।
৩৬৮) আশুতোষ দেব;প্রাগুক্ত;পৃ: ৭৩১।
৩৬৯) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৪২৪।
৩৭০) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৬২।
৩৭১) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২৩।
৩৭২) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২১১।
৩৭৩) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৯৪।
৩৭৪) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩১৯।
৩৭৫) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রথম খণ্ড; প্রাগুক্ত;পৃ: ৫২১।
৩৭৬) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.); প্রাগুক্ত; পৃ:৪৮৪।
৩৭৭) রাতুল বেজবরুয়া:মিচন গাহৰি; ব্লগ: অনুরণন;
https://ratulbezbaruah.wordpress.com/2013/11/24/মিচন-গাহৰি/
৩৭৮) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ:৩২৫।
৩৭৯) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৮৩।
৩৮০) আশুতোষ দেব;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮৪।
৩৮১) ড০ দেবব্রত শর্মা(স.);দ্বিতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৮৮৬।
৩৮২) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮৮।
৩৮৩) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:১৩২।
৩৮৪) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);দ্বিতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৭১।
৩৮৫) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪০।
৩৮৬) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬১।
৩৮৭) ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ব্যঞ্জন বর্ণ অংশ,২৬১।
৩৮৮) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.); দ্বিতীয় খণ্ড; প্রাগুক্ত; পৃ:৮৭৬।
৩৮৯) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.); প্রাগুক্ত; পৃ:৯৮।
৩৯০) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.); তৃতীয় খণ্ড; প্রাগুক্ত; পৃ: ৮১৩।
৩৯১) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.); প্রাগুক্ত; পৃ:১০৩।
৩৯২) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.); প্রাগুক্ত; পৃ:২০৫।
৩৯৩) ড০ ভূপেন শইকীয়া:কাটারর ডায়েরী- ২৭;
http://www.xahitya.org/2013/05/14/কাটাৰৰ-ডায়েৰী-২৭-ডা০-ভূপে/
৩৯৪) লিজা লাহন:ফান টাই; ব্লগ- খ্বন-মৌঙ;
http://www.taiahom.in/2015/08/blog-post_31.html
৩৯৫) আবুরেজা:গামছা- সকল কাজের কাজী;ব্লগ- সচলায়তন;০৭-০৮-২০০৮;
http://www.sachalayatan.com/abu_reza/17409।
৩৯৬) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯৭-৮।
৩৯৭) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২২৮।
৩৯৮) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);তৃতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৫৯।
৩৯৯) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রাগুক্ত;দ্বিতীয়;পৃ: ১২৫০।
৪০০) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৮৫।
৪০১) আশুতোষ দেব;প্রাগুক্ত;পৃ:২৩৮।
৪০২) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৩।
৪০৩) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত; পৃ: ৯৬।
৪০৪) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৯৬।
৪০৫) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৮৬।
৪০৬) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;দ্বিতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০১৭।
৪০৭) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪৯।
৪০৮) ড০ মহেশ্বর নেওগ(স.),রজনীকান্ত দেবশর্মা(স.),নবকান্ত বরুয়া(স.);প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৩৩।
৪০৯) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৫৯।
৪১০) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৭৬২।
৪১১) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রথম খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৭৭৮।
৪১২) ড০ দেবব্রত শর্মা (স.);চতুর্থ খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ১০৭১।
৪১৩) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩১০।
৪১৪) আশুতোষ দেব;প্রাগুক্ত;পৃ:৭৭১।
৪১৫) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম: কাছারীয় বা দেয়ান বা চিলেটীয়া উপভাষা;সূত্রপাত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১১।
৪১৬) পবিত্র সরকার:বাংলা ভাষা;বাংলা ব্যাকরণ প্রসঙ্গ; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৭।
~***~
Comments