।। অসমিয়া ও বাংলা ভাষা অধ্যয়নের ইতিহাস ৷৷ বিশ্ববীক্ষার বৈচিত্র্য ও মতপার্থক্যের রূপরেখা ।। প্রথম অধ্যায়

  ৷৷ অসমিয়া ভাষা এবং বাংলার সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্যের পারস্পরিক সম্পর্ক ৷৷

 ৷৷ একটি কালানুক্রমিক এবং কালিক অনুসন্ধান ৷৷ প্রথম অধ্যায় ৷৷

📚📚📚📚📚📚📚📚📚📚

(মূল গবেষণা  অভিসন্দর্ভে ‘উপভাষা’ শব্দটিই ছিল, ‘ভাষাবৈচিত্র্য’ ছিল না )


 


বাংলা এবং অসমিয়া ভাষাতে ভাষা অধ্যয়নের ইতিহাসের প্রণালীবদ্ধ অধ্যয়ন বর্তমান অধ্যায়ের উপজীব্য।তা নইলে আমরা সিলেটি নিয়ে দুই ভাষাতে বিতর্কের বৌদ্ধিক স্তর বা স্বরূপটি ভালো ধরতে পারব না। যেখানে বিতর্কের চেহারাটাই এমন যে সিলেটি’ একটি স্বতন্ত্র ভাষা না,বাংলারই একটি উপভাষা তথা ভাষাবৈচিত্র্য,না তার উপরে অসমিয়ার দাবিটিই যৌক্তিক সেখানে কাকে বলব বাংলা ভাষা বা কাকে বলব অসমিয়াসেই প্রশ্নটাও শুরুতেই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে বাধ্য।এমন সহজ জবাব দেবারও তো উপায় নেই,যে বাংলাদেশের ভাষা বাংলা,আর অসমের ভাষা অসমিয়া।তাই যদি হতো তবে সিলেটি নিয়ে বিতর্ক দেখা দেবার কোনো সুযোগই থাকত না।রবীন্দ্রনাথ যখন ১৯০৫এ গেয়ে উঠেছিলেন,“আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি/তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!--তখন শুধু পুববাংলা নয়,অসম বিহার ওড়িশাকেও ব্রিটিশের নিজের তৈরি বাংলা প্রেসিডেন্সি থেকে বের করে দেবার পরিকল্পনা হয়েছিল। সেই অভিমানে অপৌত্তলিক রবীন্দ্রনাথেরও বাংলাদেশের মধ্যে শ্যামা-মাকে দেখতে বাঁধছে না।গানে লিখছেন,“ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে,বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ,দুই নয়নে স্নেহের হাসি,ললাটনেত্র আগুনবরণ ১৯০৫এর পরে আমরা উগ্রজাতীয়তাবাদ বিরোধী রবীন্দ্রনাথকে পাবকিন্তু সেই সময় বা তার আগে অব্দি যে রবীন্দ্রনাথ,তিনি  বাংলা ১৩০৫,ইংরেজি ১৮৯৮তে ভাষাবিচ্ছেদ’ নামে প্রবন্ধ লিখে অসমিয়াকে বাংলার থেকে আলাদা ভাষা বলে দাবি করবার বিরুদ্ধে রীতিমত উষ্মা প্রকাশ করছেন।প্রবন্ধটি শুরুতে তিনি কোনো বইতে রাখেন নি,পরে ঐতিহাসিকতার স্বার্থে মনে হয় রবীন্দ্ররচনাবলীতে শব্দতত্ত্ব’-এর পরিশিষ্টে জুড়েছিলেন।পরে তিনি ভাষাটির স্বাতন্ত্র্য মেনে নিয়েও দুই ভাষার তুলনামূলক অধ্যয়নেরও সূচনা করেছিলেন।কিন্তু তবু অসমিয়াকে যারা এককালে বাংলার উপভাষা মাত্র বলে দাবি করেছিলেন,তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নাম জুড়ে যাবার তথ্যকে অস্বীকার তো করা যাবে না। তেমনি যে দেশটাকে বাংলাদেশ বলে তার অপরূপ রূপ’-এর প্রশস্তি গীত গাইছেন,সেটি গান রচনার আগের পরের বছরেও এক ছিল না।১৯১১র পরেও এক ছিল নাছিল না ১৯৪৭ বা ১৯৭১এর পরেও।প্রাক-ব্রিটিশ কালে তো নয়ই।সম্ভবত তখন একে বাংলাদেশ’ বলে কেউ ডাকতই না।এই নামটির ব্যবহার  রবীন্দ্রনাথেই শুরু করেন।এই মাত্র চারদশক আগে একটি দেশ সাংবিধানিক ভাবে নামটি গ্রহণ করল বটে,সে কিন্তু নয় সেই রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশ।তবে এই কথাটি সত্য যে প্রাক-ঐতিহাসিক বঙ্গ’ দেশটি আজকের বাংলাদেশেরই এক ছোট ভূখণ্ড ছিল। 

            একই কথা অসম’ সম্পর্কেও সত্য।অসমের প্রাচীন নাম কামরূপসে একটা কথার কথা।এভাবে বললে,অসমিয়ার মর্যাদাও খুব বাড়ে না।কারণ,কামরূপ তার থেকে বহু বড় ছিল। যে দেশের নামের থেকে আসাম’ তার সঙ্গে কামরূপের সম্পর্ক আদৌ খুব ঘনিষ্ঠ নয়।আহোমদের বাকিরা অসম,অহম,আহোম বলতেন। সেই থেকে আহোম রাজাদের শাসিত দেশের নাম আসাম’ বা আচাম’কিন্তু সেতো মূলত সদিয়া থেকে বড়জোর গুয়াহাটি অব্দি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার ভূখণ্ড।রুদ্রসিংহের দিনে বাংলাহ সুবাহ’-র ঢাকা অব্দি সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা একটা হয়েছিল বটে,বা দরঙের কোচ রাজ্যকেও বহু সময় করদ রাজ্যে পরিণত করেছিলেন---কিন্তু মোটা দাগে অধিকাংশ সময় এই অব্দিই ছিল আচাম’ রাজ্য সীমা।গুয়াহাটি থেকে আহোম রাজ্য সুরক্ষার জন্যে প্রতাপসিংহের দিনে বরফুকন’ বলে একটি পদ সৃষ্টি করা হয়।ইতিহাসে দুই বরফুকনকে আমরা ভালো রকম চিনি,একজন,মোঘলকে হারিয়েছিলেন যুদ্ধে তিনি লাচিত বরফুকন--যিনি বীর বলে বন্দিত।অন্যজন বদন বরফুকন---মীরজাফরের মতো বিশ্বাসঘাতক বলে নিন্দিত।তিনি আহোম রাজ্যের সিংহাসনে বসবার লোভে ব্রহ্মদেশ থেকে মানেদের ডেকে নিয়ে এসেছিলেন অসমে।গুয়াহাটির প্রাচীন নাম প্রাগজ্যোতিষপুর বলে মোটামুটি এক ঐকমত্য আছে।কিন্তু সেই রাজ্যের সীমা অনিশ্চিত হলেও মনে করা হয়,মোটের উপরে এই এলাকাগুলো নিয়েই পরে কামরূপ রাজ্যের পত্তন হয়মহাকাব্যগুলোতে প্রাগজ্যোতিষপুর’-এর নামোল্লেখ থাকলেও  কামরূপ নামটি অর্বাচীন।পুরাণ এবং তন্ত্র সাহিত্যগুলোর আগে কোথাও কামরূপ নামের উল্লেখ নেই। ইতিহাসের কামরূপের রাজধানী নিয়েও মতভেদ আছে। কেউ কেউ সেই রাজধানী আজকের উত্তর বাংলাতে ছিল বলেও দাবি করেন।এর পশ্চিম সীমাতে বিহারে পূর্ণিয়া জেলা ছিল বলেও অভিমত,দক্ষিণে সিলেট ত্রিপুরা অব্দি আর পরের কালের কামতাপুরের ভেতরে তো উত্তরবাংলার পুরোটাই ছিল আর গুয়াহাটি অব্দি পশ্চিম অসমেরও সবটাই ছিল নানা সময়ে।কামরূপের উত্তর-পূবে ছিল শোনিতপুর রাজ্য। নর-নারায়ণ চিলা রায়ের পরে কোচ রাজ্য আবার দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়।মাঝে বারো ভূঞাদেরও বহু ছোট ছোট রাজ্য ছিল এই এলাকাতে। বডোদের একটি শাখা বহু আগেই বড়াইল পাহাড় হয়ে কাছাড় সমতলে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন,পরে ত্রিপুরা গিয়ে ত্রিপুরি’ রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন-- এই তথ্য আমাদের জানা।পরে এই উপত্যকাতে উত্তর থেকে কোচ, ডিমাছারা এসে রাজ্য বিস্তার করেন।পশ্চিম থেকে মণিপুরিরাও আসেন,পুব থেকে কারা কখন আসেন সেই প্রসঙ্গ আপাতত আমরা ছেড়ে যাচ্ছি।কিন্তু একটা কথা স্পষ্ট যে ব্রিটিশ আসবার আগে আসাম’ খুবই ছোট এক ভূখণ্ডের নাম ছিল।বর অহম’-এর স্রষ্টা ব্রিটিশই।আসাম’ নামটি সরকারি ভাবে ব্রিটিশই প্রথম ব্যবহার করে।ইংরাজর দিনতে আসাম হল’তাতে প্রাচীন কামরূপের সামান্য পশ্চিমাংশ ছাড়াও সিলেট,মিজো পাহাড় থেকে বর্তমান অরুণাচল সহ আরো বহু নতুন ভূখণ্ড জুড়ে যায়।১৮২৬এর  মায়ান্মারের ইয়াণ্ডাবুতে মানের সঙ্গে করা চুক্তির পরে এই ঘটনা ঘটতে থাকে।তার পরেও এই অসমের মানচিত্র বহু বার পাল্টেছে,যেমন পাল্টেছে বাংলাদেশ’-এর।এবং ভবিষ্যতেও পাল্টাবার  সম্ভাবনা নেই এই কথা জোর দিয়ে বলাই যাবে না।এই যখন বাস্তবতা তখন অসমের ভাষা অসমিয়া, বাংলার ভাষা বাংলা --- একথা বললে একটা কাজ চালাবার গোছের ব্যাপার হয়,সত্যের অনেকটাই চাপা পড়ে।কথাগুলো বেশ জট পাকানো।আমাদের তাই ইতিহাসের এই জটগুলো খুলে খুলেই বুঝতে হবে ভাষা এবং জনগোষ্ঠী দুটো গড়ে উঠল কীভাবে,কবে,কোথায়।পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত হলো কীসে,স্বাতন্ত্র্যই বা অর্জিত হলো কোন পথে।রাজতন্ত্রের ধারাবাহিকতা দিয়ে যে ইতিহাসের কিছুই বোঝা যায় না, সে আজ আর নতুন করে বলবার কিছু নেই।কিন্তু তবু দেখা যায়, বিদগ্ধজনেরা কোন রাজসভাতে কোন ভাষা প্রচলিত ছিল এই নিয়ে এখনো বেশ তর্ক করেন।ত্রিপুরি রাজদরবারে রচিত রাজমালা’র ভাষাকেও অসমিয়ারা চেষ্টা করেন অসমিয়া বলে দাবি করতে, বাঙালির দাবি এর ভাষা বাংলা।আহোমদের সম্পর্কে যদিবা গৌরব করে বলাও যায়, এরা প্রাচীন ভাষা ছেড়ে দিয়ে শুধু রাজসভার ভাষা হিসেবেই অসমিয়াকে গ্রহণ করেন নি,নিজেরাও অসমিয়া হয়ে উঠেন,বাকিদের সম্পর্কে এই কথা কিছুতেই বলা যাবে না। কোচ-রাজবংশীদের ভাষা বিতর্ক তাই একটা অমীমাংসিত বিষয় হিসেবে এখনও থেকে গেছে।প্রাচীন কামরূপ বা পরের কালের কোচ-কামতাপুরের অধীনস্থ সবাই যদি অসমিয়াই হতেন, তবে অসমিয়াদের উচিত ছিল বরাক উপত্যকা বা বডোল্যাণ্ডের মতো স্বতন্ত্র সরকারি ভাষার মতো,উত্তর বাংলার সরকারি ভাষা হিসেবে অসমিয়ার স্বীকৃতির জন্যে দাবি তোলা।তা না করে সেখানে এখন রাজবংশী ভাষা এবং ভিন্ন প্রদেশের দাবিটিই প্রবল।তারপরেও,এভাবে ভাবার একটি প্রবণতা তো আছেই,যেন কোচ, ডিমাছা, ত্রিপুরি রাজাদের শাসনে যেন বাঙালি’ বলে কোনো জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বই ছিল না। বাঙালিকে তাই অসমে খিলঞ্জিয়া’ বলে ভাবা হয় না,ত্রিপুরাকে মনে করা হয় বাঙালি এবং বাংলা ভাষার উপনিবেশ’অথচ,সিলেট,কুমিল্লা,নোয়াখালি,পার্বত্য চট্টগ্রামও নানা সময়ে ত্রিপুরা রাজাদের শাসনাধীন ছিল। সেকালের প্রজারাও সবাই ত্রিপুরি ছিলেন ভাবাটাইতো অস্বাভাবিক,অপ্রাকৃতিক এবং অবশ্যই অনৈতিহাসিক।বরঞ্চ, কিংবদন্তীর ইতিহাস ছেড়ে এইসব ভোট-বর্মী রাজ শাসনাধীন ভূখণ্ডেও অসমিয়া’ বা বাঙালি’র উদ্ভব  ইতিহাসের বিজ্ঞান বুঝবার চেষ্টা করাটাই বেশি চিত্তাকর্ষক হয়।

           নীহার রঞ্জন রায়কে  তাই বাঙ্গালির ইতিহাস’-এর শুরুর দিকেই ব্যাখ্যা করতে হয়েছিল,বাংলা আর বাঙালির ইতিহাস কেন আলাদা! শেষের দিকে তিনি একটি অতি মূল্যবান কথা লিখেছেন,যার জন্যে বইটির মূল্য এখনো অস্বীকার করবার জো নেই।তা এই,“ ইতিহাসের প্রথম পর্বে আদিবাসী জীবন একান্ত কোমবদ্ধ।সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এই সব কোম ধীরে ধীরে এক একটি  কোম সভ্যতার অধিকার পাইয়াছে এবং সভ্যতা সংস্কৃতির এক একটি স্তর অতিক্রম করিয়া অগ্রসর হইয়াছে তাহার ফলে বাংলা দেশের সর্বত্র এবং সমগ্র বাঙালি জীবন ব্যাপিয়া সভ্যতা ও সংস্কৃতির একই স্তর বা ক্রম বিস্তৃত নয়;এমন কি একই সভ্যতা এবং সংস্কৃতিও নয়;আজও নয়,প্রাচীন কালেও ছিল না।সুবিস্তৃত বাঙালী সমাজের একটি অংশ যখন উন্নত প্রণালীর কৃষিকার্যে নিরত,আর একটি অংশ হয়তো তখনো কাঠের ফলার লাঙলে বা হাত-খুরপির সাহায্যে পাহাড়ের ঢালু গাত্র ধাপে ধাপে কাটিয়া সেখানে ধান চাষ করিতেছে।একটি অংশ যখন বৈদেশিক সামুদ্রিক বাণিজ্যে নিরত,উচ্চশ্রেণির ধাতব মুদ্রায় কেনাবেচায় অভ্যস্ত,তখন হয়তো আর একটি অংশে মুদ্রা প্রচলিতই নয়, দ্রব্য-বিনিময়ে কেনাবেচা চলিতেছে, অথবা খুব বড় জোর কড়ির সাহায্যে।একটি অংশে যখন ঔপনিষদিক ব্রহ্মবাদের প্রচলন,উচ্চশ্রেণীর মনন ও কল্পনার প্রসার,আর একটি অংশে তখনো ভূতপ্রেতবাদ,যাদুশক্তিতে বিশ্বাস,গাছপূজা,পাথর পূজা প্রভৃতি নিরঙ্কুশভাবে চলিতেছে। অথবা,পাশাপাশি বাস করিবার দরুন,একই সমন্বিত সমাজে বাস করবার দরুন,একই সঙ্গে উন্নত ও আদিম কৃষি,ধাতব মুদ্রা ও বিনিময়ে কেনাবেচা,স্বর্ণমুদ্রা ও কড়ি,ব্রহ্মবাদ ও ম্যাজিক এমন অব্যাহত ও সহজ ভাবে চলিতেছে যেন ইহাদের মধ্যে বিরোধ কোথাও কিছু নাই।আজও যেমন প্রাচীন বাঙলায়ও তেমনি ছিল, বরং বেশি ছিল।... ভাষা বা সমাজের বিকাশের এই ছবিকে কোনো আদলে ধরাটা খুবই কঠিন।কিন্তু আমরা সাধারণত স্থান বিচ্ছিন্ন করে,কালের এক সরলরৈখিক আদলে একে ধরতে অভ্যস্ত। কোন ভাষা বা সমাজ কতটা প্রাচীন এবং একই সঙ্গে আধুনিক প্রমাণ করবার প্রতিযোগিতাতেও মাতি।এই সত্য ভুলে গিয়েও যে ভাষা খুব প্রাচীন সে ততটা আধুনিক নাও হতে পারে,আবার সে ভাষা খুব আধুনিক সে খুব প্রাচীন নাও হতে পারে।নীহার রঞ্জনও উপরের কথাতে বাংলাদেশ’ কথাটা ব্যবহার করলেও আমরা জানি তিনি আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কথা বলছেন না,তেমনি শুধু বাঙালির কথাও বলছেন না,‘এমন কি একই সভ্যতা এবং সংস্কৃতিও নয়;আজও নয়’একই কথা অসম এবং অসমিয়া সম্পর্কেও প্রযোজ্য।ইতিহাসের গতিপথ তাই সরলরৈখিক তো নয়ই,বহতা নদীর মতো তার আদলকে কল্পনা করা যায় কিনা,তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। তবে নদী একটা বড় প্রভাব ফেলে।তার মূল কারণ,উৎপাদন পদ্ধতিতে নদীর একটি বড় ভূমিকা আছে। তেমনি মাগধী উৎস ভাষার জাতক হওয়া সত্তেও বাংলা এবং  অসমিয়ার  স্বাতন্ত্র্যের কারণ সন্ধান করতে গিয়ে   বাণীকান্ত কাকতি গ্রিয়ার্সনকে অনুসরণ করেই বিহার থেকে আর্যদের অসমের দিকে পুবমুখী এবং পুব বাংলার দিকে দক্ষিণমুখী স্রোত কল্পনা করেছিলেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহও বাংলাদেশি বাংলার আদর্শ অভিধানের ভূমিকা’-তে তেমনি অসম থেকে বহুদূরের চট্টগ্রামের বাংলার সঙ্গে অসমিয়ার নৈকট্যের কারণ সন্ধান করতে গিয়ে লিখেছেন,“হইতে পারে প্রাচীন বাংলা ভাষার একটি স্রোত উত্তরবঙ্গ হইতে পূর্ব অভিমুখে আসামে প্রবেশ করে।পরে সেই স্রোত আসাম হইতে দক্ষিণ অভিমুখে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।এককালে বাঙ্গালা দেশের এই পূর্ব প্রান্তের ভাষা বোধহয় আসামীর সহিত একরূপ ছিল,কিন্তু পূর্ববঙ্গের উপভাষার প্রভাবে তাহার বৈশিষ্ট্য লোপ হইয়া পূর্ববঙ্গের উপভাষা গোষ্ঠীর শামিল হইয়াছে শহীদুল্লাহ ভোটবর্মী ভাষাগুলোর সম্পর্কে প্রায় নীরব।আমরা যারা সিলেট কাছাড় বা অসমের ইতিহাস অধ্যয়ন করেছি,জানি এই পথে,প্রাচীন বাংলাই নয়,আজকের অসমিয়া বহু জনগোষ্ঠীর মানুষও যাতায়াত করেছেন।রাজাসভাগুলোর মধ্যে আদানপ্রদানের ইতিহাস এই পথে বহু পুরোনো এবং এই দুই ভাষাতে ভাববিনিময়ের প্রমাণ স্বরূপ এই দুই ভাষাতেই পত্রবিনিময়ের নজির ইত্যাদি আছে।কিন্তু তার থেকেও যেটি প্রাচীন পরম্পরা,তা হলো এই পথেই আজকের ত্রিপুরিরা ত্রিপুরা অব্দি এসে পার্বত্য চট্টগ্রাম অব্দি যাত্রা করে,আরাকান অব্দি সম্পর্ক গড়েছিলেন।এই পথগুলোর ভাঙা গড়ার ইতিবৃত্ত বোঝাও জরুরি।আরাকানের রোহিঙ্গিয়া ভাষার সঙ্গেও তাই অসমিয়া ভাষার  সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা নির্ণয় এমন কোনো কঠিন কাজ  হবে না। বহু সময় দেখা যাবে,তা সিলেটির থেকেও নিবিড়তর।ইতিহাসের এই জটিলতাগুলোকে আমরা এই অধ্যায়ে ধরবার চেষ্টা করেছি।এই অধ্যায়েই অবশ্য তার সবটা ধরা সম্ভবও হবে না।প্রতিটি অধ্যায়েই সুনির্দিষ্ট বিষয়কে আশ্রয় করেই ইতিহাসের কথাগুলোও এগোবে।তাই এই প্রসঙ্গ রেখে,আমরা ভাষা চিন্তার ইতিবৃত্তটাকে বুঝবার চেষ্টা করি এবং সেই জায়গাতে পৌঁছুবার যেখানে সিলেটি’ নিয়ে মতভেদগুলো দেখা দিচ্ছে।

           বাংলা ও অসমিয়া ভাষার বয়স হাজার বছর অতিক্রম করলেও প্রাক-ঔপনিবেশিক কালে বাংলা ভাষাতে ব্যাকরণ-অভিধান রচনার কোনো নজির নেই।ভাষা নিয়ে যত টীকা-ভাষ্য কিংবা বিতর্ক-- সবই হচ্ছে সংস্কৃতে।বাংলাতে লিখলে প্রসাদ গুণ’ থাকে,রচনা রসাল’ও হয়তবু আমরা জানি রাজসভার কবি বলে অভিজাতদের ভয়ে ভারত চন্দ্রকেও কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে কেন তিনি ব্যবহার করবেন,‘ভাষা যাবনী মিশাল।’কারণ একটি শাস্ত্র নির্দেশ ছিল,“অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানি চ।/ভাষায় মানব শ্রুত্বা রৌরব নরকং ব্রজেৎ একই কথা ইসলামী শাস্ত্রজ্ঞদের সম্পর্কেও।পৃথিবীর বহু দেশে ইসলামের শুরু থেকেই কোরানের অনুবাদ হয়ে গেলেও ভারতীয় কোন ভাষাতে প্রথম কোরান অনুবাদ হয়েছিল মাত্র আঠারো শতকে।করেছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহের পুত্র আব্দুল কাদির ঊর্দুতে।বাংলাতে কোরান-হাদিসের ভাবানুবাদ জাতীয় কাজ করতে গিয়েও কবিদের কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে এরকম,“মুসলমানী শাস্ত্রকথা বাঙ্গালা করিলুঁ/ বহু পাপ হৈল মোর নিশ্চয় জানিলুঁ১০এই দাবি গোলাম মুরশিদ মেনে নেন নি,তাঁর বক্তব্য মনোএল দ্য আসসুম্পসাউ প্রথম ভাষা নাম বেঙ্গালা’ ব্যবহার করছেন।হ্যালহেডের ব্যাকরণ প্রকাশের ছ বছর পরে জোনাথান ডানকান কোম্পানির একখানা আইনের বই অনুবাদ করেন,সেখানে তিনি ভাষার নাম বাঙ্গলা’ বলে অনুবাদ করেছেন,ইংরেজিতে কথাটা তখনো Bengal languageবাংলা’ কথাটা আসলে রবীন্দ্রনাথই প্রথম ব্যবহার করেন।তারপরেও শব্দটি প্রচলিত হতে বহু সময় নেয়।তার নজির,সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত একটি বইয়ের নাম ‘বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা’সুকুমার সেনের সুপরিচিত বইটির নাম বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’মূল কথা প্রাক-ঔপনিবেশিক কালে ভাষা কিম্বা জনগোষ্ঠী বোঝাতে নাম হিসেবে বাংলা’ কথাটার কোনো প্রচলনই নেই।রাষ্ট্র বিভাগ বোঝাতে আছে।

            চোদ্দ-পনের শতকে বাংলার শাসক সামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ প্রথম শাহে বাঙ্গালিয়ান’ বলে নিজের উপাধি নিয়েছিলেন।কিন্তু কথাটি বহু প্রচলিত হয় নি। মোঘল সুবাহর নাম ছিল বাঙ্গলাহ’তাতে প্রথম দেশ নাম জনপ্রিয় হতে শুরু করে।ভুসুকুতে যে বঙ্গালী’ শব্দের উল্লেখ আছে,কিম্বা  মুকুন্দরামে ---কান্দেরে বাঙ্গাল ভাই বাফোই বাফোই’---সে আসলে পূর্ববাংলার লোকজনকে বোঝাতেই১১ভারতচন্দ্রই প্রথম পুরো বাংলার অধিবাসী বলতে বাঙালি’ কথাটার ব্যবহার করেছেন-- বাঙালিরা কত ভালো পশ্চিমার ঘরে১২ তিনিও ভাষা বলতে ঐ রৌরব নরকের ভয় দেখানো শাস্ত্রবাক্যের মতো ভাষা’ই ব্যবহার করছেন। কেউ কেউ তাঁর আগে দেশি ভাষা’ ব্যবহার করছেন। ষোড়শ শতকের কবি আবদুল হাকিম বঙ্গ বাণী’ কথাটা ব্যবহার করছেন বটে,“যেসব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী”১৩ভাষা বোঝাতে তিনিও জনপ্রিয় দেশী ভাষা’ কথাটারই ব্যবহার করছেন---দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়১৪ দাঁড়ালো এই যে ভাষার কোনো নাম নেই,তার আকার প্রকার  নিয়েও কোনো নিশ্চয়তা নেই, কোনো তর্কও নেই। ব্যাকরণ-অভিধান রচিত হবে, আমরা আশা করতে পারি না। 

 

         ।। বাংলা ভাষা অধ্যয়নের ইতিবৃত্ত ।।

           পোর্তুগীজ পাদ্রি মনোএল দ্য আসসুম্পসাউর ভোকাবুলারিও এম ইদিওমা বেনগল্লা,ই পোর্তুগিজ: দিভিদিদো এম দুয়াস পার্তেস’ ১৭৪৩এ পর্তুগালের রাজধানী থেকে ছেপে বেরোয়।বাংলা ভাষাতে এটিই  ভাষাচিন্তারও প্রথম বই।এটি মূলত একটি অভিধান,সঙ্গে সামান্য ব্যাকরণ ছিল।অভিধান লিখতে গিয়ে ধ্বনি,শব্দ এবং বাক্যের অভ্যন্তরীণ সূত্র নির্ণয় করতে হয়েছিল তাঁকে।তাতেই বাংলা ভাষাচিন্তার সূচনা হলো।তাঁর আরেকটি বই ছিল ধর্মগ্রন্থ ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’আজকের পরিচিত মান বাংলাভাষাতে লেখা নয় বই দুটি বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকার অদূরে বর্তমানে গাজীপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত,তৎকালীন ভাওয়াল পরগণার বাংলা ভাষার উপর ভিত্তি করেই মনোএল লিখেছিলেন এ দুটো বই।কিন্তু লিখবার জন্যে যে হরফের ব্যবহার করেছিলেন,সেটি বাংলা ছিল না।ছিল রোমান।সম্ভবত এই কারণেই বইগুলো খুব প্রচার পায় নি।তাঁর কাছে রোমানে লেখাটা ছিল এক বাধ্যবাধকতাকারণ ছাপা বইয়ের জন্যে উপযোগী যে প্রায়োগিক হরফের দরকার ছিল সেটি কী হবে, কেমন হবে-- তা স্থির করতে আমাদের অপেক্ষা করত হয়েছিল আরো চার দশক।১৭৭৮ সালে প্রকাশিত ইংরেজিতে লেখা নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডের ‘A Grammar of the Bengal Language বইতেই বাংলা হরফ প্রথম ব্যবহৃত হয়।চার্লস উইলকিন্সনস এবং তার সহকারী পঞ্চানন কর্মকার গুটেনবার্গের উদ্ভাবিত মুদ্রণ প্রযুক্তিটিকে বাংলার উপযোগী করে তুলেন এবং প্রথমবারের মত প্রয়োগসম্ভব করেন।ধাতুর ব্লকে ঢালাই করা একই আকৃতি একই হরফের জন্য একাধিক পাতাতে ব্যবহার করা যায় বলে বাংলা ছাপা হরফে একটা স্থায়ী, বৈষম্যহীন রূপ এসেছিল।বছর দশের পরে ১৭৮৮তে  লন্ডনে প্রকাশিত আরেক অজ্ঞাত সংকলকের দি ইন্ডিয়ান ভোকাবুলারি’-তে হাজার দেড়েকের মতো বাংলা শব্দ ছিল।১৭৯৩তে আপজন’ বলে কেউ প্রকাশ করেন,‘ইঙ্গরাজি ও বাঙ্গালি বোকাবিলরি’ হ্যালহেডের পরে উল্লেখযোগ্য বই আসলে হেনরি পিটস্ ফরস্টারের ‘এ ভোকাবুলারি,ইন টু পার্টস,ইংলিশ  অ্যান্ড বোঙ্গালি অ্যান্ড ভাইস ভার্সা’ নামের অভিধানের প্রথম খণ্ড।আঠারো শতকে বাংলা ভাষা চিন্তার এই পাঁচ বই।সব ক’টাই বিদেশিদের লেখা১৫এই ফরস্টারের বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড দিয়ে উনিশ শতকের শুরু।সময় ১৮০২ হ্যালহেড এবং ফরস্টারের বই দু’টি বহুপঠিত এবং অন্যদের প্রেরণার স্রোত হিসেবেও কাজ করে।ইতিমধ্যে শ্রীরামপুর মিশন ইত্যাদি এবং তার বাইরেও বিচিত্র সব বাংলা ও অন্যান্য ভাষাতে বই পত্রিকা ছাপা হতে শুরু করেফলে ভাষা বিতর্কেও জোয়ার আসে।প্রচুর অভিধান,ব্যাকরণ রচিত হতে থাকে।পুরো উনিশ শতক এই অভিধান-ব্যাকরণ রচনারই শতক মূলত।অধিকাংশই দ্বিভাষিক।হুমায়ুন আজাদ লিখছেন,“উনিশ শতকের শেষ দশকে তুলনামূলক-কালানুক্রমিক পদ্ধতির কিছুটা প্রয়োগ দেখা যায় সবার আগে রবীন্দ্রনাথের বাঙলা ভাষা বিষয়ক রচনায়।উনিশ শতকের প্রথম ন দশকে ভ’রে বাঙলা ভাষাতাত্ত্বিকেরা প্রধানত রচনা করেন প্রথাগত-আনুশাসনিক অভিধান ও ব্যাকরণ;এবং গৌণত লিপ্ত হন বিশুদ্ধ বাঙলার শুদ্ধরূপ বিষয়ক কলহে,সাধু চলতির বিতর্কে;কিন্তু মোটামুটি ভাবে এগোতে থাকেন তাঁরা প্রথাসম্মত পথ ধ’রেই যতদিন না প্রকাশিত হয় বঙ্গীয়- সাহিত্য- পরিষদের অদ্বিতীয় গবেষণা পত্রিকা...১৬ সুনীতিকুমারও রবীন্দ্রনাথ এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের কথা বলতে গিয়ে তাঁর প্রথম বিখ্যাত গ্রন্থের (ODBL) মুখবন্ধেই লিখেছেন,“ ...But the first Bengali with a scientific insight in to attack the problems of the language was the poet Rabindranath Tagore…”১৭সুকুমার সেন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লিখেছেন,“ ভাষাবিজ্ঞানের সূত্র ধরিয়াই রবীন্দ্রনাথ আধুনিক বাঙ্গালা ভাষার উচ্চারণরীতির এবং ব্যাকরণের কোনো জটিল সমস্যার বিশ্লেষণ ও সমাধান করিয়াছিলেন। ...এই প্রবন্ধগুলির কথা মনে রাখিলে রবীন্দ্রনাথকে বাঙ্গালী ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রথম বলিতেই   হয়১৮

           আঠারো শতকের শেষের দিকে ভারতের রাজধানী শহর কলকাতাতে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠার সভাতে উইলিয়াম জোনসের বক্তৃতাতে যদিও কালানুক্রমিক ভাষাতত্ত্বের সূচনা হয়েছিল এই ধারা এরপরে দীর্ঘদিন কেবল ইউরোপেই সমৃদ্ধ হয়।এর কিছু উড়ো উড়ো খবর বরং বাঙালিদের মধ্যে এই বিশ্বাসকে দৃঢ় করছিল যে সংস্কৃত বাংলা ভাষার জননী’  উনিশ শতকের শেষের দিকে জন বীমস,জ্যুল ব্লক,গ্রিয়ার্সন আর হ্যর্নলের কাজগুলোর মধ্য দিয়েই শুধু বাঙালি প্রথম এর সঙ্গে পরিচিত হয়।রবীন্দ্রনাথ এদের আদি পুরুষ।সুনীতিকুমার এরপর পূর্ণ প্রথম পুরুষ।এর আগেকার সংস্কৃতের মানসপুত্রদের  কাছে আদর্শ ছিল সংস্কৃত,ইংরেজি,এমন কি লাতিন অভিধান ব্যাকরণও। হুমায়ুন এক দীর্ঘ নামের তালিকা দিয়েছেনতাতে বোঝা যাচ্ছে প্রথম বাঙালি অভিধান প্রণেতা পীতাম্বর মুখোপাধ্যায় এবং মোহন প্রসাদ ঠাকুর।১৮০৯ এবং ১৮১০ পরপর দুই বছরে দুই জনের অভিধান বেরোয়।উইলিয়াম কেরির অভিধান ফরস্টারের পরে বড় উদ্যোগ।দীর্ঘ নামটি ছিল এ ডিকশনারি অফ দি বেংগলি ল্যাংগুয়েজ,ইন হুইচ দি ওয়ার্ডস আর ট্রেসড টু দেয়ার অরিজিন,অ্যান্ড দেয়ার ভেরিয়াস মিনিংস গিভেন’প্রথম খণ্ড বেরোয় ১৮১৫তে,দ্বিতীয় খণ্ড বেরোয় ১৮২৫এ।এই বইতে তিনি আশা প্রকাশ করেন,বাংলা অচিরেই একটি প্রধান ভাষা হয়ে উঠবে।এই আশার দরকার কী ছিল আমরা বুঝিনি।জন মার্সম্যানের বই বেরোয় ১৮২৭এ। ১৮৩৩এ রাজা রামমোহন রায়ের বিখ্যাত গৌড়ীয় ব্যাকরণ’-এ সংস্কৃতের সঙ্গে  বাংলার তফাতের দিকে অঙুলি নির্দেশ করা হলেও,বিতর্ক খুব জমে নি।একই বছরে বেরোয় জি সি হটনের এ ডিকশনারি, বেংগলি অ্যান্ড স্যান্সক্রিট/অ্যাকসপ্লেইণ্ড ইন ইংলিশ’ সেকালে এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল তিন হাজার।বিদ্যাসাগরের লিপি নিয়ে কিছু কাজ ছিল,বর্ণপরিচয় নামে বিখ্যাত বইটিরও তিনি প্রণেতাদুই একটি পুরোনো বর্ণ বাদ দিয়ে,নতুন বর্ণের আমদানিও করেন তিনি।পুরোনো লিপির রূপান্তরও ঘটান।তবু ভাষা-ব্যাকরণ-অভিধান নিয়ে ১৩০০ সালে প্রতিষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে যে প্রয়াস শুরু হয় তাঁদের জার্মান ইয়ুংগ্রাম্মাতিকারএর প্রতিতুলনাতে,“‘নবব্যাকরণবিদ অভিধা দিলে অত্যুক্তি হয় না” বলে লিখেছেন হুমায়ুন আজাদ।১৯বাংলা ভাষার ধ্বনি,রূপ,বাংলা ব্যাকরণ কাঠামো,পরিভাষা,আঞ্চলিক উপভাষা ইত্যাদি নিয়ে সাহিত্য পরিষদ পত্রিকাতে প্রচুর রচনা প্রকাশিত হতে থাকে।নিয়মিত বৈঠকেও সেগুলো নিয়ে তর্ক বিতর্ক হতে থাকে। সেই বিতর্কের ঢেউ কখনো সমকালীন অন্য কাগজেও গিয়ে পৌঁছোয়।তবে সেখানেও প্রাচীনপন্থী ছিলেন যারা সংস্কৃতের আধিপত্যে আস্থা রাখতেন। তাদের মধ্যে ছিলেন শরচ্চন্দ্র শাস্ত্রী,সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ,শ্রীনাথ সেন এমন অনেকে।পরবর্তী কাল এঁদের মনে রাখবার কারণ খোঁজে পায় নি।বাংলার স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠাতে যারা সোচ্চার ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ঠাকুর ভাতৃদ্বয়দ্বিজেন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ।দ্বিজেন্দ্রনাথের উপসর্গ নিয়ে আলোচনা এবং বিরোধীদের জবাবে রবীন্দ্রনাথের রচনাতে বাংলাভাষাতে আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানের সূচনা হয়েছিল বললে অত্যুক্তি হয় না।মূলত দুটি বই ১৯১৫তে প্রকাশিত শব্দতত্ত্ব’ এবং প্রায় চারদশক পর ১৯৩৮এ বাংলা ভাষা পরিচয়’-এ রবীন্দ্রনাথের ভাষা চিন্তার প্রবন্ধগুলো ধরে রাখা আছে। তেইশটি অধ্যায়ে সম্পূর্ণ বাংলাভাষা পরিচয়’ একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ।১৯৩৮এ এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছেপে বের করে।ততোদিনে ভাষাচার্য রূপে স্বীকৃত সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়কে উৎসর্গ করেন এটি বইটি নিজেই একটা অসামান্য ব্যাকরণ বলে বিবেচিত হতে পারত।কিন্তু সেটি, প্রণালীবদ্ধ ছিলনা। বিজনবিহারী ভট্টাচার্য তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন এই বইটিকে ভাষাবিজ্ঞানের ভূমিকা হিসেবে নিয়ে যেন তিনি সেই পথে কাজ আরম্ভ করেন।তিনি সেটি করেন নি।এই বইতে দেখা মিলবে ভারতের প্রথম সমাজ ভাষাবিজ্ঞানীরও বটে।এছাড়াও তখন ছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী,হরপ্রসাদ শাস্ত্রী,বিধুশেখর ভট্টাচার্য,যোগেশচন্দ্র রায় প্রমুখ অনেকে।এঁদের প্রায় সবার হাতেই বাংলা বর্ণনামূলক ভাষা বিজ্ঞানের সূচনা হয়েছিল স্যসুর না জেনে -- তার আগে বা সমকালেইষাটের দশকের আগে আর এদিকে কেউ তাকান নি তেমন।অভিধান সংকলনেও তাই এই সময়ে কিছু নতুন দৃষ্টিভঙ্গি জুড়েছিল।এই অভিধানগুলোকে আমরা এখনো মনে এবং ব্যবহারে রেখেছি।যেমন ১৩২৩এ প্রকাশিত জ্ঞানেন্দ্র মোহন দাসেরবাঙ্গালা ভাষার অভিধান’, ১৩৪০-৫৩তে প্রকাশিত বিশালাকার বঙ্গীয় শব্দকোষ’;রাজশেখর বসুর চলন্তিকা’ এবং ১৯৫৫তে প্রকাশিত শৈলেন্দ্র বিশ্বাসের ‘সংসদ বাঙ্গালা অভিধান’ফরস্টারের অভিধানেই বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত প্রায় করে তুলে শুদ্ধ’ করে তুলবার একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কেরিতে এসে সেই প্রয়াস আরো জোরালো হয়।তার উপরে,সাহেব বা বাঙালি আভিধানিক,সবার সামনে ছিল জনসনের আনুশাসনিক ইংরাজি অভিধান আদর্শ স্বরূপ।তাঁরা ঐ পথেই হাঁটেন।১৮৭২এ জন বীমস অন্য পথে হাঁটার প্রস্তাব করেন।বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রতিষ্ঠার পেছনেও তাঁর সদর্থক ভূমিকা ছিলতিনি নিজেও একখানা বাংলা ব্যাকরণ লিখেছিলেন ১৮৭২এ।হ্যালহেড,উইলিয়াম কেরিরা যে যথেচ্ছে সংস্কৃতাধিপত্য  করেছিলেন,বাংলা ভাষাকে তাঁর বিপরীতে মোড় ফিরিয়ে দিতে বীমস উদ্যোগী হন।বাংলা-সংস্কৃত সম্পর্ক নিয়ে তিনি এক মজার রূপক ব্যবহার করেছিলেন। মায়ের আঁচলে বাঁধা এক বুড়ো খোকা যে সারাক্ষণ যেকোনো দরকারেই মাকে ডাকে,যখন কিনা সে নিজেই নিজেকে সাহায্য করা উচিত।কথাটার উল্লেখ করেছিলেন গ্রিয়ার্সন২০বঙ্কিমের বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধের প্রেরণাও আসলে তিনিই ছিলেন। ভাষাকে অদরকারি সংস্কৃতের চাপমুক্ত করবার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় এবং অশালীন শব্দমালার থেকে মুক্ত করবার প্রস্তাবও তাঁরই ছিল।বঙ্কিম যে আলালের ভাষাকে গ্রহণ করলেও হুতোমী ভাষার আদর করেন নি তা এরই জন্যে।রবীন্দ্রনাথ যে তৎসম ভারবহুল সাধু’ বাংলাকে ছেড়ে সুললিত চলিত বাংলা’কে প্রতিষ্ঠা দিতে উঠে পড়ে লাগলেন তাঁর প্রেরণাও জন বীমস,বললে অত্যুক্তি হয় না।যদিও তাতে প্রাক-ঔপনিবেশিক কালে সারা বাংলাতে ভাষার যাবনী মিশাল’ যে সাধারণ রূপটি গড়ে উঠেছিল,যার উপরে ভিত্তি করে সাধু’ বাংলা গড়ে উঠেছিলসেই ভাষাটি অকারণে মার খেল।সব কিছুর পরেও হুমায়ুন আজাদেরও যেন কেরি কিংবা বীমসএই সব পাশ্চাত্য ভাষা পরিকল্পকদের প্রতি আনুগত্যটি যেন প্রশ্নাতীত।তিনি লিখছেন,“অভিধানপ্রণেতাদের ও গদ্যরচয়িতাদের সংস্কৃতায়নপ্রক্রিয়া উনিশশতকের দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই তিরস্কারের বিষয় হয়ে উঠেছে, এবং অনেকে একে বিবেচনা করেন চক্রান্ত ব’লেও;কিন্তু এ প্রক্রিয়া নিন্দাযোগ্য নয়,প্রশংসাই তাঁদের প্রাপ্য।এসব অভিধান যখন প্রণীত হয়,তখন বাঙলা ছিল নিতান্তই একটি আঞ্চলিক গরিব ভাষাতাতে যে সমস্ত শব্দ ব্যবহৃত হতো প্রাত্যহিক জীবনে,শুধু তা আশ্রয় ক’রে থাকলে বাঙলা ভাষার বিকাশ ঘটা অসম্ভব ছিল।”২১বুঝিবা এতোটাই দুর্বল ছিল বাংলা।এমনও নয়,যে নদীয়া-মুর্শিদাবাদ-ঢাকা-সিলেট-আরাকানে যে এক সাধারণ সাহিত্যের ভাষা সেকালেই গড়ে উঠেছিল এই নিয়ে তিনি জ্ঞাত ছিলেন না। তিনি নিজেও লিখছেন,“মধ্যযুগের পদ্য ও গদ্যের ক্রিয়ারূপ,সর্বনাম ও অন্যান্য রূপ,ও বাক্যিক সংগঠন পর্যবেক্ষণ করলে ধরা পড়ে যে একটি সর্ববঙ্গীয় প্রয়াস চলছিল সাধুরীতি সৃষ্টির।”২২ সাধুরীতির সম্পর্কে মোটাদাগে বলা চলে যে নামপদগুলো সে নিয়েছিল সারাবাংলাতে প্রচলিত প্রায় সমস্ত ভাষাবৈচিত্র্য থেকেই।যাবনী মিশেলও তাতেই হতে পেরেছিল।কিন্তু সমাজে ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য থাকার ফলে এবং সংস্কৃতের চর্চা প্রবল থাকার ফলে সংস্কৃত তৎসম শব্দগুলো আপনাতেই কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই ভাষাতে এসেছিল।কিন্তু ক্রিয়াপদের পরসর্গগুলো স্পষ্টতই পূর্ববাংলা বা বাংলার বৃহত্তর অংশের থেকে আমদানি।এ সম্পর্কে চলিতরীতি’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাপকেরও সুগভীর ভাবনা ছিল বলে মনে হয় না।প্রমথ চৌধুরী ভেবেছিলেন,নদীয়া-শান্তিপুরের ভাষাবৈচিত্র্যই সাধু’র ভিত্তি।চলিত’ রীতির ভিত্তি অঞ্চলও প্রায় একই।২৩ এবং এই অভিমত এমন প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়,যে মনে হয় যেন বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠাতে উত্তর বা পুববাংলার কোনোদিনই কোনো সবল ভূমিকা ছিল না। তার উপরে যদি স্বাধীন বাংলাদেশের ভাষাবিজ্ঞানী লেখেন,“ঠিক কোন উপভাষা(টি-গুলো) ভিত্তি ক’রে সৃষ্ট হয়েছিল সাধুভাষা,তার সুনিশ্চিত ভাষাতাত্ত্বিক বিবরণ আজও অনুদ্ঘাটিত২৪তবে তো সোনায় সোহাগা। তিনি নিজে যখন সাধুর রূপতাত্ত্বিক আলোচনা করেন,ক্রিয়াপদ গুলোর পূর্ববঙ্গীয় স্বরবাহুল্য বা দীর্ঘায়ন প্রবণতা আশ্চর্যরকম তাঁর নজর এড়িয়ে যায়।অথচ জানেন,‘ক্রিয়া সহায়কের ভিন্নতাই এ-রীতি দুটির মৌল ভিন্নতা২৫ ‘ক্রিয়াসহায়ক’ বলতে তিনি শেষে যুক্ত ‘সর্গ’ বা বিভক্তিগুলোকেই বুঝিয়েছেন।যার নাম ছিল দেশীভাষা’,সেই সাধারণ রূপটিকে উনিশ শতকের শুরুতে এমন রিসাইকেল’ বা সংস্কৃতায়ন  করতে শুরু করলেন কেরিরা যে পরের শতকে গামলার জলের সঙ্গে বাচ্চাটিকেই ছুঁড়ে ফেলবার মতো কাজ হয়ে গেলআমরা যে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছিলাম তার বড় নজির এই একটি। আমরা যদিও বলি বাংলা ভাষার বয়স হাজার বছরের,ঘটনা হলো সবুজপত্রের’ কথা মনে রাখলে আজকের মান বাংলা’র বয়স শত বর্ষ পার করছে মাত্র।‘দেশী ভাষা’র সঙ্গে সাধু রীতি’র যদি বা কিছু সম্পর্ক ছিল,‘চলিত মান বাংলা’ মোটেও তার ধারাবাহিক উত্তরাধিকার বহন করে না।অথচ,সবগুলোই মূলত লেখার ভাষা।হ্যালহেড,কেরিরা বাংলাকে আরবি ফার্সি মুক্ত করবার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন।বীমস পরবর্তী কালে গ্রিয়ার্সন থেকে রবীন্দ্রনাথ আবার বিপরীত অভিমত দাঁড় করাতে শুরু করেন।বীমসই প্রথম অক্সফোর্ড অভিধানকে আদর্শ করে নিয়ে অভিধান রচনাতে হাত দিতে পরিষদকে প্রস্তাব দেন।বিশ শতকের যে ক’টি অভিধানের নাম আমরা উল্লেখ করলাম, সেগুলোতেই এই পথে হাঁটা শুরু হয়েছিল।জ্ঞানেন্দ্রমোহন তাঁর অভিধানে পূর্বতন সমস্ত অভিধানকে ‘বিভক্তি-বিহীন সংস্কৃত শব্দবাহুল্যে’ ভরা বলে অভিযুক্ত করেছেন।অভিধান চিন্তার সঙ্গে ওতোপ্রতো জড়িত বানান সংস্কার।অবশ্য তাঁর সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রণ যন্ত্রের বিকাশ এবং প্রচলনেরও একটা অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা আছে।যার জন্যে অভিধানে এতো এতো লোক আগ্রহ দেখিয়েছিলেন।উনিশ শতকে তৎসম শব্দবাহুল্যের সঙ্গে সঙ্গে তদ্ভব বাংলা বানানকেও সংস্কৃতের মতো ব্যুৎপত্তি নির্ভর করে ফেলবার চেষ্টা করা দেখে,রবীন্দ্রনাথও বিরক্ত হয়ে বাংলা ভাষা পরিচয়’-এ লিখেছিলেন,“বানানের ছদ্মবেশ ঘুচিয়ে দিলেই দেখা যাবে বাংলায় তত তৎসম শব্দ নেই বললেই চলে২৬

         চর্যাগান ইত্যাদির আবিষ্কারের পেছনেও এই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এবং তাদের পত্রিকার প্রেরণাদায়ী ভূমিকা ছিল।কিন্তু সেগুলোর আবিষ্কার ভাষাবিজ্ঞানের পুরো দৃষ্টিকেই কালানুক্রমিক তথা ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের দিকে নিয়ে যায়।এবং এই পরিস্থিতিতেই তিন খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানী বাংলা ভাষাবিদ্যার কালানুক্রমিক চর্চার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।সুনীতি চট্টোপাধ্যায়,মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং সুকুমার সেন।তাঁদের কাজে ভাষার এবং সাহিত্যের ইতিহাসের বহু অজানা দিক উন্মোচিত হয়েছে বটে,তার থেকে আমরা এখনো লাভান্বিত হচ্ছি,কিন্তু একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে ইতিহাসের সূত্র আবিষ্কারই ভাষা বিজ্ঞানের কাজ।তাঁরা যখন ব্যাকরণ লিখেছেন,তখন সেগুলোতে,“...স’রে যেতে পারেন নি প্রথাগত পথ থেকে: তাঁরা অনুসরণ করেছেন প্রথাগত ইংরেজি ও সংস্কৃত ব্যাকরণপ্রণেতাদের;এবং কালানুক্রমিক উপাত্তের সাহায্য নিয়েছেন সমকালীন বাঙলা ভাষা ব্যাখ্যা বর্ণনায়২৭হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বাঙ্গালা ব্যাকরণ’-এ (১৩০৮) মন্তব্য করেছিলেন যে তাঁদের আগে পর্যন্ত  বাংলা ভাষাতে প্রায় আড়াইশত ব্যাকরণ লেখা হয়েছিল। কিন্তু যোগেশ চন্দ্র রায় রামমোহনের বইটি সহ চারখানাকে মাত্র পাতে নেবার যোগ্য মনে করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথতো স্পষ্টই লিখে ফেললেন,“প্রকৃত বাংলা ব্যাকরণ একখানিও প্রকাশিত হয় নাই।সংস্কৃত ব্যাকরণের একটু ইতস্তত করিয়া তাহাকে বাংলা ব্যাকরণ নাম দেওয়া হয়।”২৮ রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীর ১৩০৮এ লেখা বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ প্রবন্ধে বর্ণনামূলক ব্যাকরণে দিশা নির্দেশ ছিল শুধু তাই নয়,তিনি বহু পরে প্রবর্তিত চমস্কির রূপান্তরমূলক সৃজনী ভাষাবিজ্ঞানের ভাবনারও কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন বলে হুমায়ুন আজাদ দাবি করেছেন।কিন্তু তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই এই বিচ্ছিন্ন কিছু রচনাই লিখেছেন। উদ্যোগ নেননি,গভীরে গিয়ে আদর্শ কোনো ব্যাকরণ রচনার।ফলে বিশশতকে যখন ভাষার ইতিহাস সন্ধানের জোয়ার উঠে, ব্যাকরণে বইতে থাকে সেই পুরোনো স্রোত। মুহম্মদ শহীদুল্লাহের বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ আমরা দেখেছি,আজাদের মতোই আমাদেরও মনে হয় নি এই বই কোনো ভাষাবিজ্ঞানীর রচনা বলে।এই ঘরানা থেকে প্রথম বেরিয়ে আসেন পূর্ব-পাকিস্তানের ভাষাবিজ্ঞানী মুহম্মদ আব্দুল হাই তাঁর সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা’ এবং বাংলা একাডেমী পত্রিকা’- তে ধ্বনি নিয়ে বিভিন্ন রচনাতে। দুই পত্রিকারই প্রকাশনা শুরু হয় ১৯৫৭তে। ১৯৫০ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে ভাষাতত্ত্বে গবেষণার জন্য যান। সেখানে অধ্যাপক জে আর ফার্থের নির্দেশনায় ‘A Study of Nasals and Nasalization in Bengali শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করেন। তিনি ধ্বনিবিজ্ঞানে পূর্ব-পাকিস্তানের ছাত্রদের এতোটাই উদ্বুদ্ধ করেন যে ষাটের দশকে প্রচুর ছাত্র বিদেশে গিয়ে ধ্বনি বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে ফেরেন।তার মধ্যে অধ্যাপক মুনির চৌধুরী অন্যতম।ভাষাবিজ্ঞানে পুব-পাকিস্তান তথা এখনকার বাংলাদেশের এই ভূমিকার কথা রামেশ্বর শ’ও স্বীকার করেছেন।তিনি লিখেছেন শহীদুল্লাহের পরে বাংলাদেশের ভাষা বিদ্যাচর্চার সবটাই এই বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানে।“এ (ভাষাবিজ্ঞানে) ক্ষেত্রে বাংলাদেশে’র (পূর্ব বাংলা) গবেষণাও বিশেষ ভাবে সমৃদ্ধ। সে তুলনায় পশ্চিম বাংলায় এ ক্ষেত্রে গবেষণার ফলশ্রুতি (output) অপেক্ষাকৃত কম২৯

            উনিশ-বিশ শতকে বাংলা ভাষা বিদ্যা চর্চার জোয়ার এলেও একটি বড় দুর্বলতা হলো এগুলোর অধিকাংশই  বিদেশি এবং দেশি গবেষকদের দ্বারা ইংরেজিতেই লেখা হয়েছে। সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ‘অডিবিএল’ ইংরেজিতেই লেখা।এবং এর আজ অব্দি কোনো বাংলা অনুবাদ হয় নি।সর্বোপরি এটি তাঁর গবেষণা সন্দর্ভ।বাংলা বা ভারতীয় ভাষাগুলো নিয়ে  বিদেশে ইংরেজিতে এমন বহু গবেষণা কর্ম বাঙালিরা গিয়ে করলেও,পরের কালে বাংলা ভাষাতে  কোনো কাজে  সেরকম আন্তরিকতা দেখান নি। ফলে বাংলা ভাষাতে ভাষা বিজ্ঞান চর্চার ধারাটি যথেষ্ট সবল হবার সমস্ত সম্ভাবনা নিয়েও হয়ে উঠতে পারে নি।এই নিয়ে হুমায়ুন আহমেদ আক্ষেপ করেছেন।তাঁর সেই আক্ষেপ করবার অধিকার ছিল।কেননা তিনি সেই মনোএলের থেকে শুরু করে আড়াইশ বছরে প্রকাশিত রচনার বাছাই সংকলন সম্পাদনা করেছেন। উনিশ শতকের প্রথমার্ধের ভাষাতে সংস্কৃতের স্বৈরাচার চলছিল বলে যিনি শুধু অভিযোগই করেন নি,‘সংস্কৃত বাংলার জননী ভাষা’ ইতিহাস আশ্রয় করে এই তত্ত্বের প্রথম ভ্রান্তি নির্দেশ করেন সেই সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ১৩৬৬তে প্রকাশিত সরল ভাষা প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ থেকে নজির টেনে হুমায়ুন আজাদের বক্তব্যের কিছুটা তুলে ধরলে এই দুর্বলতার অনেকটাই ধরা পড়বে,“সুনীতি কুমার উত্তরপদের স্ত্রী বাচক প্রত্যয় লোপ’ সূত্রের সাহায্যে গঠন করেছেন দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ’ সলজ্জ’ শব্দ দুটি। তাঁর বিশ্লেষণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা যাহার’ সহ লজ্জা যাহার’ বাক্যাংশ (প্রথাগত পরিভাষায় সমস্যমান পদ’) দু’টি প্রতিজ্ঞা’ লজ্জা’ শব্দের আ’ (যাহার’) বর্জন ক’রে পরিণত হয়েছে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ’ সলজ্জ’ শব্দে।কিন্তু এমন রূপান্তরের আর্থ ও রৌপ্য সূত্র আরো অনেক জটিল-সূক্ষ্ম, তা শুধু উল্লিখিত সূত্রের সাহায্যেই উদ্ঘাটিত হতে পারে না। তাই প্রথাগত ব্যাকরণে সমাসের যে-সব বিধি প্রদত্ত হয়, তা নানা রকম ইঙ্গিত দেয় মাত্র, ব্যাপারটি স্পষ্টভাবে-আর্থ ও রৌপ্য উভয় দিক থেকেই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে না।এমন বিশৃঙ্খলা দেখা যায় প্রত্যয় ও উপসর্গযোগে শব্দ গঠনের সূত্রেও। প্রাত্যয়িক রূপতত্ত্বের কাজ হচ্ছে বাক্যে ব্যবহৃত হওয়ার সময় শব্দরাশির যে-সমস্ত রৌপ্য পরিবর্তন হয়, তার শৃঙ্খলা বর্ণনা করা।  প্রথাগত বাঙলা ব্যাকরণে এ-সব পরিবর্তিত রূপের ব্যাখ্যা বিস্তৃত ভাবে, যদিও অনেকাংশে ভ্রান্তভাবে, করা হয়ে থাকে৩০ আমরা সেই ভ্রান্তির একটির দিকে নজর টেনে সহজেই লিখতে পারি, ‘সহ লজ্জা যাহার’ সহজ এবং বোধ্য বাংলা বাক্যই নয়।

 সুনীতিকুমারের পরে অধিকাংশই মন দিয়েছেন,কে কার থেকে সঠিকতর সমগ্র ভাষার ইতিবৃত্ত’ লিখতে পারেন। ফলে আলাদা করে নিবিড় ভাষাবৈচিত্র্য চর্চাও খুব বেশি এগোয় নি বাংলা ভাষাতে। ১৯৪০ অব্দিতোতন্ন তন্ন করিয়া কোনো বাঙ্গালা উপভাষার ভৌগোলিক জরিপ (Dialect Geography) ... প্রস্তুত হয় নাই৩১ আগের বছরে প্রকাশিত বিখ্যাত ইতিবৃত্ত’-এ লিখেছিলেন সুকুমার সেন।বাংলার সুপরিচিত পাঁচটি উপভাষা রাঢ়ি, বরেন্দ্রি, ঝাড়খণ্ডি, বঙ্গালি এবং কামরূপীর আলোচনা করলেও বইটিতে সুকুমার সেন লিখেছেন এগুলো আসলে উপভাষাগুচ্ছ’৩২  বলতে গেলে উপভাষা চর্চার শুরু বাংলা ভাষাবিদ্যার আদিগ্রন্থ মনোএলের অভিধানেই। কিন্তু এর তো কোনো ধারাবাহিকতা রইল না। শতবর্ষেরও বহু পরে ১৮৬৭তে সরকারি উদ্যোগে সিলেট কাছাড় সহ পুব বাংলার কিছু জেলার আলাদা আলাদা ইতিহাস এবং পরিসংখ্যান’ প্রকাশিত হয় তাতে বেশ কিছু জেলাগুলোতে প্রচলিত ভাষাবৈচিত্র্যের শব্দ সংকলিত হয়।এর পরে বড় কাজটি অবশ্যই গ্রিয়ার্সনের ভাষা সমীক্ষা। সুনীতি চট্টোপাধ্যায় গ্রিয়ার্সনের উপভাষা বিভাজনে কিছু রদবদল ঘটান। প্রতিষ্ঠিত প্রায় সমস্ত বইতে এগুলোই সামান্য আলোচিত হয়ে এসেছে। বীমস-এর পরামর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে  বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্যরা সারা বাংলার শব্দ সংগ্রহে নামেন। রবীন্দ্রনাথ তাতে নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন, আমরা আগেই লিখেছি। অনেকে সেগুলো নিয়ে বিচ্ছিন্ন প্রবন্ধাবলীও লিখেছিলেন। কিন্তু গভীরে গিয়ে প্রণালীবদ্ধ কাজ কিছু হয় নি।যদিও এই সময় এক সাহেব পার্জিটার ভোকাব্যুলারি অফ পিক্যুলার ভারনাকুলার বেংগলি ওয়ার্ডস’ নামে এক ঔপভাষিক শব্দকোষ রচনা করেন। কিন্তু বাংলাতে  প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৬৫তেপূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ সংকলন করে। একই রকম অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এমন এক কাজ খণ্ডে খণ্ডে সম্প্রতি প্রকাশ করেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। নাম আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান’ 

                 সুনীতিকুমার ভাষা বিজ্ঞানের গবেষণা করতে গিয়েছিলেন বিলেতে,শহীদুল্লাহ গেছিলেন প্যারিসে।ততদিনে ভাষাবিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক কেন্দ্র সরে যাচ্ছিল আমেরিকাতে।কিছুদিন পরে  সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা সোভিয়েত প্রভাবিত পূর্ব ইউরোপে।১৯২৪শে আমেরিকান লিঙ্গুইস্টিক সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হলে সোসাইটির কাগজ ল্যাঙ্গুয়েজ’ দুনিয়া জুড়েই ভাষা বিজ্ঞানীদের প্রধান মুখপত্রে পরিণত হয়।অনেকটা গোষ্ঠীবদ্ধ ভাষাবিজ্ঞান চর্চার শুরু তখন থেকেই।এই গোষ্ঠীর নেতৃত্বে ছিলেন এডোয়ার্ড স্যাপীর এবং লিওটার্ড ব্লুমফিল্ড।সুইস ভাষাবিজ্ঞানী স্যসুরের ভাষাচিন্তাকে আশ্রয় করে কাঠামোবাদের মূল প্রতিষ্ঠাপকই এই ব্লুমফিল্ড।অন্যদিকে তখন চেকোশ্লোভাকিয়ার প্রাগ-গোষ্ঠীও স্যসুর প্রবর্তিত বর্ণনামূলক ভাষা বিজ্ঞান নিয়ে উৎসাহী হয়ে পড়েছিলেন।এই গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নিকোলাই ত্রুবেৎস্কয়।এছাড়াও রুশ ফর্মালিস্ট’ এবং মার্ক্সবাদীদের বিভিন্ন শাখাও বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠছিলেন।এই পরিস্থিতিতে রাশিয়াতে যে যান্ত্রিক মার্ক্সবাদীরা ভাষার শ্রেণিচরিত্র আবিষ্কারে অত্যুৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন,তাঁদের বিরুদ্ধে সরব হতে হয়েছিল জোসেফ স্তালিনকেও।মার্ক্সবাদ এবং ভাষাবিজ্ঞানের সমস্যা’ শিরোনামে ১৯৫০এর জুন,জুলাই,আগস্টে তাঁর একগুচ্ছ সাক্ষাৎকার এবং লেখালেখি প্রকাশিত হয় প্রাভদা’তে। যেগুলো পরে বই আকারে বেরোয়।ভাষাবিজ্ঞান নিয়ে সম্ভবত প্রথম পূর্ণাঙ্গ এক মার্ক্সীয় গ্রন্থ এটি। এই পরিবেশ বাংলা ভাষা বিজ্ঞান চর্চাতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তাতে ইন্ধন যোগায় বাংলাদেশের ভাষা পরিস্থিতি তথা ভাষা আন্দোলন। কালানুক্রমিক ভাষাবিদ্যা থেকে এককালিক ভাষাবিজ্ঞানে আগেভাগে বাংলাদেশে মোড় ফেরার রহস্যই এই। ১৯৪৪-৪৬ এ আমেরিকার পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চার্লস ফার্গুসন এবং তাঁর সহযোগীদের নেতৃত্বে বাংলা পাঠ্যক্রম শুরু হয়।ফার্গুসন এর পরে বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের পদ্ধতিতে দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে বাংলা ভাষা নিয়ে প্রচুর কাজ করেন। সোভিয়েতের ভাষা চর্চা সম্পর্কেও তিনি বেশ ওয়াকিবহাল ছিলেন। মস্কোর ইন্সটিটিউট অফ দি পিপলস অফ এশিয়া’ বাংলা ভাষা চর্চার এক প্রধান কেন্দ্র ছিল। সম্ভবত অসমিয়ারও। লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ও বাংলা ভাষা চর্চার আরেক কেন্দ্র ছিল। বহু রুশি বই বাংলাতে বা ইংরেজিতে অনুবাদ হলেও ভাষাবিজ্ঞানের বইগুলো সম্ভবত কমই হয়েছে। সেগুলো আমাদের কাছে কম পরিচিত থেকেছে।কিন্তু মার্কিনীদের সেই সমস্যা ছিল না। আব্দুল হাই নিজে লন্ডনে গেলেও তাঁর  ছাত্র এবং সমকালে  বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষাবিজ্ঞানী মুনির চৌধুরী ফার্গুসনের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। দু’জনে মিলে দি ফোনিমস অফ বেংগলি’ লিখেছিলেন ১৯৬০এই।একই বছরে আব্দুল হাইর বই এ ফোনেটিক এন্ড ফোনোলোজিক্যাল স্টাডি অব ন্যাসালস্‌ এন্ড ন্যাসালাইজেশন ইন বেঙ্গলি’ও প্রকাশ পায়।এভাবেই রবীন্দ্রনাথ এবং সমকালীন নব্যব্যাকরণবিদদের বহু পরে কোনো বাঙালির দ্বারা ভাষাবিজ্ঞানের পুনর্জন্ম হয়। কিন্তু সেগুলোও লেখা হয়েছিল ইংরেজিতে। ১৯৬৪তে প্রকাশিত মুহম্মদ আব্দুল হাই-র ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব’ই আসলে বাংলা ভাষাতে   আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের প্রথম বই।এর পরে ধ্বনিতত্ত্ব,রূপতত্ত্ব,অর্থ-বাক্যতত্ত্ব,এমন কি মার্কিন ইহুদী ভাষা বিজ্ঞানি চমস্কির রূপান্তরমূলক-সৃজনী ভাষাবিজ্ঞানেও বাঙালির আগ্রহে জোয়ার আসে। ভারতে তথা পশ্চিম বাংলাতে তাঁর ছোঁয়া লাগতে আরো এক দশক অপেক্ষা করতে হয়। ভাষাবৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশী ভাষাগুলো নিয়ে আগ্রহের জোয়ারও এই সময়েরই ঘটনাঅন্যথা এর আগে প্রত্যয়-উপসর্গ-কারক-বিভক্তি –কাল’ ইত্যাদি নিয়ে প্রথাগত পথেই অধ্যয়ন সীমাবদ্ধ ছিল।অথবা সংস্কৃত- পালি- প্রাকৃত এই সব ইতিমধ্যে মর্যাদা সম্পন্ন ভাষা নিয়েই আগ্রহ ছিল ব্যাপক।  

আমরা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের কথা বলে এসেছি। বলিনি একই সময়ে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভাষা বিজ্ঞান বিভাগ’-এর সূচনা হলে তার অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন গুজরাটি ভাষাবিজ্ঞানী জে এস তারাপুরওয়ালা সুনীতি চট্টোপাধ্যায় এই বিভাগেরই ছাত্র ছিলেন। লন্ডন গিয়ে তাঁর গবেষণা কর্ম করবার আগে পরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। এবং তাঁর মহাগ্রন্থ দি অরিজিন এন্ড ডেভেলপম্যান্ট অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’ এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯২৬শে ছেপে বেরোয়।এই গ্রন্থে বাংলাকে কেন্দ্র করে বলতে গেলে প্রধান ভারতীয় ভাষাগুলো নিয়েই,বিশেষ করে পূর্বভারতীয় আর্য-অনার্য ভাষাগুলো নিয়েও ব্যাপক তুলনামূলক অধ্যয়ন সেরে রেখেছিলেন। এতো বিশালাকার কাজ বাংলা ভাষা নিয়ে আর কেউ করেন নি। সংস্কৃত যে বাংলার জননী ভাষা নয়,সে ভাষা প্রাকৃত --এই কথা প্রথম উল্লেখ করেছিলেন জন বীমস। এর পরে এই তত্ত্বকে তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন,প্রাকৃত তথা মধ্যভারতীয় আর্য নিয়ে প্রথম বিস্তৃত আলোচনা করেন সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ই।সুতরাং তাঁকে শুধু বাংলার উপভাষা বা ভাষাবৈচিত্র্য নিয়েই পরে কথা বলতে হয় নি,আর্য ভাষার সব ক’টা স্তরের ঔপভাষিক চরিত্র নিয়ে বিস্তৃত অধ্যয়ন করতে হয়েছিল। আমাদের মনে রাখতে হবে কোনো ভারতীয় ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস ভারতীয় হিসেবে তিনিই প্রথম লিখছেন। প্রাচীন ইন্দোইউরোপীয় ভাষাগুলোর কেন্তুম ও সতম গুচ্ছ বিভাজন যে ভৌগোলিক এবং জাতিগতও এটা তাঁরই আবিষ্কার। আর্যরা অবিমিশ্র জাতি নয় এই তত্ত্বকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করে বাঙালির আর্য অহমিকাকে জোর ধাক্কা দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে  বাংলা ভাষার সঙ্গে মোঙ্গল নৃগোষ্ঠীয় ভাষাগুলোর সম্পর্কের দিকে তিনিই প্রথম নজর কেড়েছিলেন।বহুদিন তাঁর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না,এ দিকটাতে।এখনো এই নিয়ে ত্রিপুরা বা উত্তরবঙ্গ বাদ দিলে কাজ বিশেষ এগোয় নি।কিন্তু এর পরেই তাঁর মূল আগ্রহ গিয়ে পড়ে সাংস্কৃতিক ইতিহাস অধ্যয়নে। ‘কিরাত জনকৃতি’ বা ‘দ্য পিপল,লাঙ্গুয়েজ এ্যাণ্ড কালচার অফ ওড়িশা’সেরকমই বই। হিন্দি,দ্রাবিড় ভাষা নিয়েও আলাদা রচনা আছে তাঁর। কিন্তু সেসবই ইংরেজিতে। তাঁর ইংরেজি রচনা বিশের বেশি।বাংলাতে অতি সামান্যই।তাতে একটা লাভ এই হয়েছে যে তাঁর রচনাবলী গোটা ভারতেই  ঐতিহাসিক ভাষা বিজ্ঞান চর্চাতে ব্যাপক উৎসাহের সৃষ্টি করে। বহু ভারতীয় আপন আপন ভাষাতে অনুরূপ কাজ করতে এগিয়ে আসেন।তাঁদের মধ্যে সুনীতিকুমারের ছাত্র বাণীকান্ত কাকতিও আছেন।যার সম্পর্কে আমরা অসমিয়া সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলব। সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের বইটি ছাড়াও,তারাপুরওয়ালার ১৯৩১-এ প্রকাশিত বই এলিমেন্টস অফ দ্য সাইন্স অফ ল্যাঙ্গুয়েজ’ তখন বাঙালি তথা ভারতীয় ভাষা জিজ্ঞাসুদের পথ দেখাচ্ছে।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছে সারা ভারতেই ভাষাবিজ্ঞানের কেন্দ্র। মুহম্মদ শহীদুল্লাহও এই বিভাগের প্রথম ছাত্র এবং পরে অধ্যাপক ছিলেন।তিনি মাগধীর বদলে গৌড়ীয় প্রাকৃত’বলে একটি স্তরের কল্পনা করেছিলেন,যদিও এই অভিমত খুব বেশি স্বীকৃতি পায় নি। শহীদুল্লাহের মূল খ্যাতি আঞ্চলিক ভাষা বৈচিত্র্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণে--- যা তিনি করেছিলেন,তাঁর অভিধানে।একই বিভাগে অধ্যয়ন এবং অধ্যাপনা করে খ্যাত তৃতীয়জন অবশ্যই সুকুমার সেন। ১৯৩৯এ প্রকাশিত তাঁর ভাষার ইতিবৃত্ত’ অনেকটাই আসলে সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের মহাগ্রন্থের বাংলা ভাষাতে অনুসৃতি। শহীদুল্লাহের বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত’  ইচ্ছে করলেই এই ব্যাপারে প্রথম বই হতে পারত। কিন্তু সেটি প্রকাশিত হয় বহু পরে,ঢাকাতে ১৯৬৫তে। ততদিনে আব্দুল হাইদের নেতৃত্বে ভাষাবিজ্ঞানের চেহারা পালটে যাচ্ছে। সুনীতি চট্টোপাধ্যায় অর্থ ও বাক্যতত্ত্ব স্পর্শ করেন নি। সুকুমার সেন করেছেন। এছাড়াও বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্য’ তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভাষা বিষয়ক বই। বাদবাকি আগ্রহ তিনিও দেখিয়েছেন সেই বৈদিক গদ্যে,প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতে,মধ্য ভারতীয় আর্যে। তাঁর মহাগ্রন্থ  আসলে বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’বোঝা যায় ভাষার ইতিহাস লিখতে গিয়ে এঁরা প্রত্যেকেই সাহিত্য,জাতি,ধর্ম-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েছিলেন।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং পরে কাশি হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সত্যস্বরূপ মিশ্র ইন্দোইউরোপীয় ভাষাগুলো নিয়ে বেশ গভীরে গিয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন। ১৯৬৮তে প্রকাশিত তাঁর এ কোম্পারেটিভ গ্রামার অফ স্যান্সকৃত,গ্রীক,হিট্টাইট’ বই। হিত্তিয় ভাষা বিশ শতকেই আবিষ্কৃত হয়েছিল।সেদিক থেকে তাঁর বইটি মূল্যবান।তার উপরে একজন ভারতীয় ভাষাবিজ্ঞানী অভারতীয় ভাষা নিয়ে গবেষণা করছেন। সংস্কৃত ব্যারকরণকে টীকা ভাষ্যে যে জটিল করে তুলে ছিলেন প্রথাগত বৈয়াকরণিকেরা,সেই জটিলতাকে নতুন ঢঙে সহজ করে তোলেন সত্যস্বরূপ মিশ্র। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মধ্যে আরেকটি তেমনি গুরুত্বপূর্ণ নাম পরেশচন্দ্র মজুমদার।ভারতীয় প্রায় সমস্ত আর্য ভাষাগুলো নিয়ে ধারণা পেতে যাঁর গবেষণাদি এখনো অবিকল্প।এরকম আরো কিছু নাম, নির্মল দাশ, মৃণাল নাথ প্রমুখ।চর্যাপদ নিয়ে অধ্যাপক মৃণাল নাথের সাম্প্রতিক গবেষণাতে তিনি দাবি করেন,চর্যার পদগুলো যদি বাংলা-অসমিয়া-ওড়িয়া ইত্যাদি একাধিক পূর্বভারতীয় ভাষার আদিরূপ হয়েই থাকে,তবে সেগুলোকে প্রাচীন বাংলা, প্রাচীন অসমিয়া ইত্যাদি বলবার কোনো মানে হয় না।আসলে চর্যার ভাষা এই সমস্ত ভাষার এক সাধারণ প্রত্নরূপ। এছাড়াও তিনি সর্বানন্দের টীকা সর্বস্ব’ এবং শ্রী কৃষ্ণকীর্তনের সংস্কৃতমূল যাবতীয় শব্দের বাগর্থমূলক অধ্যয়ন করেছিলেন।

            সুনীতিকুমারের ১৯২৮শে লন্ডনে প্রকাশিত এ বেঙ্গলি ফোনেটিক রিডার’-এর  প্রথম ভারতীয় সংস্করণ বেরোয় মাত্র সেদিন ১৯৮৬তে।১৯২১শে প্রকাশিত তাঁর এ ব্রিফ স্কেচ অফ বেঙ্গলি ফোনেটিক্স’ এরই পূর্বসূরি।এমন কিছু বিচ্ছিন্ন প্রয়াস আরও ছিল। বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের পরিভাষার সঙ্গে পরিচিত না হয়েও অধ্যাপক বিজন বিহারী ভট্টাচার্য ১৯৫০এ বাগর্থ’ নামে একটি বই লেখেন যেখানে চলিত  বাংলা ও তার বানান,মদিনীপুরের আঞ্চলিক ভাষার উচ্চারণ প্রণালী ইত্যাদি আলোচনা করতে গিয়ে ইতিহাস প্রসঙ্গ টানেন নি। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের কিছু পরিচয় প্রথম দেবার চেষ্টা করেছিলেন গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক সুকুমার বিশ্বাস ১৯৬৮তে প্রকাশিত তাঁর ভাষাবিজ্ঞান পরিচয়’ গ্রন্থে। কিন্তু ভারতে মার্কিন দেশে গিয়ে ভাষাবিজ্ঞানী গ্লীসনের থেকে দীক্ষা নিয়ে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের যথার্থ সূচনা করেন সুহাস চট্টোপাধ্যায়।লেখ্য ও কথ্য বাংলার সম্পর্ক’ নিয়ে তিনি গবেষণা করেন। ১৯৭২এ প্রকাশিত তাঁর ত্রিপুরার কগবরক ভাষার লিখিতরূপে উত্তরণ’ বইটি আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাভাষাতে কোনো ভোটবর্মী ভাষা নিয়েও প্রথম বই।তাঁরই ছাত্র ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কুমুদ কুণ্ডু চৌধুরী ত্রিপুরাতে থেকে কগবরক’ এবং সম্পর্কিত অন্যান্য ভাষাতে গবেষণা করে প্রায় প্রবাদপুরুষে পরিণত হয়েছেন।বাংলা ভিন্ন পূর্বোত্তরীয় ভাষাগুলো  নিয়ে এতো বিশাল মাপের গবেষণাদি বাংলাভাষাতে প্রায় নেই বললেই চলে। তাঁর ককবরক ভাষা ও সাহিত্য’ বইটিকে ত্রিপুরা সরকার শ্রেষ্ঠ বইয়ের পুরস্কার দিয়ে সম্মান জানিয়েছে। প্রায় একই সময়ে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিশির কুমার দাশও এই পথে বেশ কিছু কাজে হাত দেন।১৯৭৩এ প্রকাশিত তাঁর স্ট্রাকচার অফ মাল্টো : এ দ্রাবিড়িয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ’ এবং এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা রয়েছে।এই সময়ে তিনি চতুষ্কোণ’ পত্রিকার জন্যেও ভাষাজিজ্ঞাসা’ নামে বাংলাতে একগুচ্ছ প্রবন্ধ লিখে এই নতুন বিদ্যার সম্পর্কে ধারণা দেবার চেষ্টা করেন।১৯৭৫এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের খয়রা অধ্যাপক দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু একই রকম কাজ করেন ১৯৭৫এ প্রকাশিত বাংলা ভাষার আধুনিক তত্ত্ব ও ইতিকথা’ গ্রন্থে। তিনি ছিলেন মূলত ঐতিহাসিক-তুলনামূলক ভাষা বিজ্ঞানের ছাত্র।ফলে দুই পথের এক সমন্বয়ের প্রয়াস তাঁর মধ্যেও দেখা যায়।তবে এই ধরণের ভাষাবিজ্ঞানের পদ্ধতি-তত্ত্ব সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনার দিকে থেকেও বাংলাদেশই অগ্রণী। ১৯৭০-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ভাষাতত্ত্ব’ গ্রন্থে সামগ্রিক আলোচনা করেন। এই দশকে প্রণবেশ সিংহরায়  এরকম কিছু কাজ করেন। ১৯৭৬এ প্রকাশিত তাঁর লিঙ্গুইস্টিক স্কেচ অফ আ সান্তালি ইডিওলেক্ট’ সম্ভবত কোনো জনজাতীয় ভাষা নিয়ে বাঙালি ভাষাবিজ্ঞানীর দ্বিতীয় রচনা। কিন্তু ইংরেজিতে। এই সময়েই চমস্কি প্রবর্তিত রূপান্তরমূলক সৃজনীমূলক ভাষা বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় ঘটান পবিত্র সরকার তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থাবলীতে। পবিত্র সরকারের নেতৃত্বে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি’ বাংলা বানানে সমতা বিধানের কথা মাথাতে রেখে একটি নতুন অভিধান সংকলন করে এবং প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বেশ কিছু লিপি সংস্কারের পরামর্শ দিয়ে রেখেছে, আমরা সবাই জানি।রামেশ্বর শ’  দাবি করেন, ভাষাবিজ্ঞানের নীতি পদ্ধতি নিয়ে বাংলায় পূর্ণাঙ্গ আলোচনা তিনিই করেন,১৯৮৪-৮৮তে প্রকাশিত তাঁর সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলাভাষাত’-তে কেবল নীতি পদ্ধতি নয়,বইটিতে তিনি ভারত এবং পশ্চিমাবিশ্বে ভাষাবিদ্যা চর্চার শুরু থেকে আজ অব্দি ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে শতাধিক পৃষ্ঠার বেশি ব্যয় করে মূল্যবান কাজ করেছেন বলে আমাদের মনে হয়েছে।বাংলাদেশে একই বছরে এর সমতুল্য এবং অথচ স্বতন্ত্র চরিত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন হুমায়ুন আজাদ তাঁর দুই খণ্ডে বিশাল বাংলা ভাষা’ সংকলনে। রামেশ্বর শ’ তাঁর বইতে প্রথাগত এবং আধুনিক ভাষা-বৈজ্ঞানিক দুই দৃষ্টিতেই বাংলা ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব থেকে বাক্যতত্ত্ব অব্দি আলোচনা করেছেন।অন্যদিকে, হুমায়ুন আজাদ  দুষ্প্রাপ্য সেই মনোএলের অভিধান থেকে শুরু করে একেবারেই একালের ভাষাবিজ্ঞানের গবেষকদের,প্রায় আড়াইশত বছরের বাছাই করা রচনাকে দুই মলাটে ধরে ফেলবার চেষ্টা করেছেন। সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের মহাগ্রন্থের পরে বাংলাভাষার যে কোনো ছাত্র-গবেষকদের কাছে এই দুই মহাগ্রন্থ অবশ্য পাঠ্য বলে বিবেচিত হওয়া উচিত বলে আমাদের মনে হয়।হুমায়ুন আজাদের একই বছরে প্রকাশিত বাক্যতত্ত্ব’ সম্পর্কে রামেশ্বর শ’ সপ্রশংস মন্তব্য করে লিখেছেন,“...বাক্যতত্ত্বে এমন পূর্ণাঙ্গ আলোচনা শুধু বাংলা ভাষায় কেন;অন্য কোনো ভাষা হয়েছে কিনা সন্দেহ”৩৩ ষাটের দশকের পরে ভাষাবিজ্ঞানে বৈচিত্র্য প্রচুর বেড়েছে শৈলীবিজ্ঞান, সমাজ ভাষাবিজ্ঞান,ছন্দবিজ্ঞান ইত্যাদি নানা শাখাতে কাজ হয়েছে। গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বীরেন্দ্র রক্ষিত যেমন ১৯৭৩এ অসমীয়া ছন্দের উৎস’ নিয়ে কাজ করেছেন।একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের বাংলা অভিধান গ্রন্থের পরিচয়’ গবেষকদের সহায়ক একটি মূল্যবান গ্রন্থ। রামেশ্বর শ’ তাঁর গ্রন্থের শেষের দিকে ভারতে এখনো ভাষাবিজ্ঞান গবেষণাতে  খামতি আছে এমন কিছু দিকের একটি তালিকা দিয়েছেন। সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়। কিন্তু ভাষাবৈচিত্র্য নিয়ে অধ্যয়ন করতে গিয়ে আমাদের মনে হয়েছে,বাংলার প্রতিবেশী ভাষা,বিশেষ করে খাসিয়া’,‘বডো’ ইত্যাদির মতো অনেকগুলোই আসলে  নৃগোষ্ঠীর হিসেবে বাঙালির নানা অংশের এককালে মাতৃভাষাই ছিল সেগুলো নিয়ে বাংলা ভাষাতে অধ্যয়ন এখনো অতি অল্পই হয়েছে।বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, চাকমা, হাজং, রাজবংশী এমন বেশ কিছু ভাষা আছেসেগুলো পাশাপাশি অধ্যয়ন না করলে প্রাচীন মোঙ্গল, দ্রাবিড়, অষ্ট্রিক ভাষাগুলোর থেকে আধুনিক আর্য ভাষা হিসেবে বাংলার উঠে আসার মধ্যবর্তী পর্যায়কেও ভালো করে বোঝা প্রায় অসম্ভব। এই প্রসঙ্গে ১৯৯৫তে প্রকাশিত গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সুধাংশু শেখর তুঙ্গের ‘Bengali and Other Related Dialects of South Assamবইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

             ইতিহাসও ঐতিহাসিক ভাষা বিজ্ঞান যেখানে একটা বড় প্রেক্ষাপটের দিকে তাকাতে ভাষাবিজ্ঞানীদের অনুপ্রাণিত করত, আধুনিক বর্ণনামূলক ভাষা বিজ্ঞান ছোট এলাকার দিকে তাকানোকেও মর্যাদাসম্পন্ন করে তোলে। বোধ করি তাই, বাংলা ভাষাতে উপভাষাবিজ্ঞানেও এই সময়েই আগ্রহ বাড়ে। সুনীতি চট্টোপাধ্যায়,সুকুমার সেন,মুহম্মদ শহীদুল্লাহের উপভাষা বিভাজনকে অস্বীকার করেই শিবপ্রসন্ন লাহিড়ি ১৯৬১তেই ঢাকা থেকে প্রকাশ করেন সিলেটি ভাষা তত্ত্বের ভূমিকা’ অবশ্য,আমরা আগেই লিখেছি,আমরা যেগুলোকে বাংলার উপভাষা বলি,সুকুমার সেন সেগুলোকে উপভাষাগুচ্ছ’ লিখেছিলেন। শহীদুল্লাহ বাংলাদেশের আঞ্চলিক বাংলা’র অভিধান’ সংকলন করতে গিয়ে প্রায় প্রতি জেলার এক বা একাধিক ভাষাবৈচিত্র্যকে উপভাষা’ নাম দিয়ে আলাদা চিহ্নিত করেছেন।ষাটের দশকের আগে অব্দি ভাষাবৈচিত্র্যগুলোর শব্দ সংকলন ছাড়া কাজ বিশেষ হয় নি। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে সেই শব্দ সংগ্রহের উৎসাহ এতো ব্যাপক বেড়েছিল যে সুনীতি চট্টোপাধ্যায় গ্রাম্য শব্দ সংকলন’ বলে এক প্রবন্ধে ভাষাবৈচিত্র্য চর্চার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে শব্দসংকলনের নীতি বেঁধে দেবার চেষ্টা করেছিলেন, আর বলেছিলেন গ্রিয়ার্সনের বিহার পেজেন্ট লাইফ’ বইটি সংগ্রাহক এবং সংকলকদের আদর্শ হতে পারে। যাই হোক,ষাটের দশকের পরেই দেখা যাচ্ছে শব্দ সংকলনের অতিরিক্ত উপভাষার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাষাবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তথা তুলনামূলক আলোচনাতে গবেষকেরা আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছেন। যথারীতি ঢাকার ভাষাবৈচিত্র্য নিয়ে আব্দুল হাই-র একাধিক রচনা ছাড়াও  মুনির চৌধুরী,মনিরুজ্জামান,রফিকুল ইসলাম প্রমুখ অনেকেই এই কাজে হাত দেন। উপভাষা নিয়ে  চর্চার এক দীর্ঘতালিকার উল্লেখ করেছেন রামেশ্বর শ’ তাঁর ‘সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা’ বইতেতিন দশক আগে অব্দি উপভাষা গবেষকদের দীর্ঘ তালিকা দিয়েছেন, তাঁর মধ্যে কামরূপী ভাষাবৈচিত্র্য নিয়ে  অরুণ কান্তি মুখোপাধ্যায়, প্রান্ত-উত্তর বঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য নিয়ে নির্মলেন্দু ভৌমিক,নির্মল দাশ,ঝাড়খণ্ডী ভাষাবৈচিত্র্য নিয়ে ধীরেন্দ্রনাথ সাহা কাজ করেছেন।সম্প্রতি অসমে জগন্নাথ চক্রবর্তী এবং আবিদ রাজা মজুমদারের অভিধান দু’খানা গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। হাফলং থেকে ১৪১২ বাংলাতে প্রকাশিত জগন্নাথের বইয়ের নাম বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান ও ভাষাতত্ত্ব’ এতে তিনি একটি ব্যাকরণও জুড়েছেন। শিলচর থেকে ২০১১তে প্রকাশিত আবিদ রাজা মজুমদারের বই বরাক উপত্যকার কথ্য বাংলার অভিধান’এই দুই গ্রন্থের মাপে অসমে এর আগে কোনো কাজ হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। কিন্তু দু’জনের কেউই বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা বা কথ্য বাংলাকে সিলেটি’ বা কাছাড়ি’ কোনো নামেই চিহ্নিত না করে ভবিষ্যতের গবেষকদের জন্যে প্রশ্ন চিহ্ন তুলে রেখেছেন বলে আমাদের অভিমত।যার মোকাবেলা না করে আমাদের কাজও সম্পন্ন হতে পারে না। আগরতলার রামঠাকুর কলেজের অধ্যাপক রবীন্দ্র কুমার দত্তের নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের উপভাষা: একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ’ কাজটি ১৯৯৮তে করা তাঁর গবেষণা সন্দর্ভ। ২০১১তে বই হিসেবে বেরিয়েছে।সিলেটি’র প্রতিবেশী ভাষাবৈচিত্র্য বলে তাঁর বইটি আমাদের অধ্যয়নে মূল্যবান ২০০৪এর ১৯শে মে ভাষা শহীদ দিবসে রতন বিশ্বাসের সম্পাদনাতে প্রকাশিত হয়েছে উত্তর বঙ্গের ভাষা’ নামে একটি প্রবন্ধ সংকলন। সেখানকার প্রতিবেশী ভাষাগুলোর সঙ্গে বাংলার বিচিত্র ভাষাবৈচিত্র্য নিয়ে এই বইটি একটি মূল্যবান সংযোজন বলে আমাদের মনে হয়েছে। তেমনি ১৪১৮ বাংলাতে কলকাতা থেকে প্রকাশিত কোরক’ সাহিত্য পত্রিকার প্রাক-শারদ সংখ্যা আমাদের সংগ্রহে এসেছে,যে সংখ্যাটির বিষয় হিসেবেই তাঁরা বেছে নিয়েছেন,‘পূর্ববঙ্গীয় কথ্য ভাষা’সুকুমার সেন যে উপভাষা জরিপের অভাব নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন, সেই আক্ষেপ দূর করতেও এগিয়ে এসেছিলেন গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপক নিখিলেশ পুরকাইত।১৯৮৯তে লিখে প্রকাশ করেছিলেন ‘বাংলা অসমীয়া ও ওড়িয়ার উপভাষার ভৌগোলিক জরিপ’ গ্রিয়ার্সনের ভারতীয় ভাষা সমীক্ষার প্রায় শতবর্ষ পরে ২০১০ সনে  বরোদার ভাষা গবেষণা এবং প্রকাশন কেন্দ্রে’র নেতৃত্বে আরেকটি সারা ভারত ভাষা সমীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।এর নাম দেয়া হয়েছে,‘ভারতীয় জন ভাষা জরিপ’ (Peoples Linguistic Survey of India:PLSI)এর মুখ্য সম্পাদনার দায়িত্বে রয়েছেন,অধ্যাপক গণেশ নারায়ণ ডেভী। ইতিমধ্যে এদের কিছু কিছু প্রাথমিক প্রকাশনা বাজারে এসেছে।এরা প্রতিটি প্রদেশের জন্যে আলাদা দলকে দায়িত্ব দিয়েছেন।ফলে একই ভাষা যদি একাধিক প্রদেশে রয়েছে,সেই ভাষাগুলোর একাধিক গবেষক দিয়ে একাধিক অনুসন্ধানও হচ্ছে। তথা প্রাদেশিক বৈচিত্র্যও বেরিয়ে আসছে। এমনকি প্রতিটি খণ্ড ইংরেজিতে এবং প্রাদেশিক প্রধান ভাষাতেও অনুদিত হচ্ছে।যেমন অসমের প্রকাশনাটি পঞ্চম খণ্ড। এবং এর অসমিয়া অনুবাদ রয়েছে। তাতে অসমের বাংলা ভাষাও সন্নিবেশিত হয়েছে।এর সম্পাদনা সহযোগী হিসেবে রয়েছেন বিভা ভরালি এবং বনানী চক্রবর্তী।তেমনি পশ্চিম বাংলারটি হবে ত্রয়োদশ খণ্ড;ত্রিপুরার  অষ্টাবিংশ খণ্ড।এদের আন্তর্জালিক সাইট রয়েছে: http://peopleslinguisticsurvey.org এই কাজটি সম্পূর্ণ হলে ভারতীয় ভাষাগুলো সম্পর্কে বহু নতুন কথা সামনে আসবে বলে আমাদের মনে হয়।

লিপিবিজ্ঞান ভাষাবিজ্ঞানের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলেও খুব কম ভাষাবিজ্ঞানীই এই প্রশ্নে আগ্রহ দেখিয়েছেন। অথচ, অতীতের ভাষার সমস্ত নমুনার জন্যেই আমাদের লিপিবদ্ধ দলিলের কাছেই ফিরে ফিরে যেতে হয়।এমনিতেও ভাষার দুই রূপ — বলে এবং লিখে এই দুই রূপ আত্মপ্রকাশ করে। দুই রূপ পরস্পরকে প্রভাবিতও করে। মুখের ভাষা বুঝতে গেলে যেভাবে উচ্চারণ বোঝাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ,লেখা ভাষা বুঝতে গেলে লিপির ধরণ জানাটিও সমানই দরকারি বিষয়। তারপরেও বিষয়টি ঐতিহাসিকদের কাছে যতটা গুরুত্ব পেয়েছে,বাংলা ভাষাবিজ্ঞানে পেতে দেখা যায় নি। বাংলা তথা ভারতে এই নিয়ে প্রথম কাজটি যিনি করেছিলেন,তিনি ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্বের মানুষ রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯১৯শে প্রকাশিত তাঁর The origin of the Bengali script’ এই প্রশ্নে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সুনীতিকুমার তখন নিজেও গবেষণাতে রত।সম্ভবত তাই প্রসঙ্গটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ে আসে নি।এসেছে অডিবিএল-এর ভূমিকা অংশের পরিশিষ্টে।কিন্তু পরে প্রকাশিত হলেও সুকুমার সেনে লিপি প্রসঙ্গটি আরো সংক্ষিপ্ত।এবং পরবর্তী অধিকাংশ ভাষাবিজ্ঞানীই বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।যদিও  প্রাচীন সাহিত্য এবং সমাজের ইতিহাসের অনুসন্ধিৎসুরা স্বতন্ত্রভাবে এই নিয়ে অধ্যয়ন করেছেন। সেই সব বিচিত্র কথা আমরা এক স্বতন্ত্র অধ্যায়েই তুলে ধরব।

 

।। অসমিয়া ভাষা অধ্যয়নের ইতিবৃত্ত ।।

 এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যে বাংলা এবং অসমিয়া ভারতীয় উপমহাদেশের দুই গুরুত্বপূর্ণ আর্যভাষার প্রথম অভিধান লেখা হয়েছিল একই শতাব্দীতে কয়েক দশকের তফাতে মাত্র। আর দুটোই ছিল দ্বিভাষিক। পর্তুগিজ পাদ্রি মনোএল দ্য আসসুম্পসাউর অভিধান বেরোয় ১৭৪৩তে।অন্যদিকে ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে আহোম পুরোহিত শ্রেণির প্রখ্যাত মহন পরিবারের টেঙাই পণ্ডিত বরঅম্র,লতিঅম্র’ নামে একটি আহোম-অসমিয়া দ্বিভাষিক অভিধান লিখেছিলেন,মতান্তরে সংগ্রহ করেছিলেন।আহোম রাজদরবারে অ-আহোম রাজকর্মচারীদের স্থানীয় আহোম ভাষা শেখার দরকার পড়ছিল এরকম এক পরিস্থিতিতে অথবা বিলুপ্তির মুখে পড়া আহোম ভাষাকে অসমিয়ার ধাঁচে ধরে রাখবার দরকার থেকে হয়তো এটি লেখা হয়েছিল। এখনো স্পষ্ট নয় কারণটি কী! দুটো মতই রয়েছে।

                সাধারণত আমাদের আধুনিক ভাষার চিন্তার ইতিহাস নিয়ে যে বোধ,তা শুরু হয় কলকাতার শ্রীরামপুরের আর শিবসাগরের মার্কিন ব্যাপটিস্ট মিশনারিদের নিয়ে। আমাদের চিন্তাতে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ একদিকে,অন্যদিকে অরুণোদয়’ কাগজ বড় জায়গা নিয়ে বসে আছে।তাতে কোনো সমস্যা ছিল না।মনে হয় যেন তারাই বাংলা আর অসমিয়া ভাষাকে নতুন করে উদ্ধার করলেন,গড়ে তুললেন। তা করলেন বটে। সে যে ভাষা ইতিহাসের এক রাজনৈতিক বাঁক-- সেটি চাপা পড়ে যায় এবং আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সত্য চাপা পড়ে যায় যদি তার আগের ইতিহাসে আমরা চোখ না ফেলি। বাংলাতে অবশ্য হ্যালহেডের ব্যাকরণের কথাটাও আমরা ভুলিনা,সম্ভবত তাঁর নামের সঙ্গে মুদ্রণযন্ত্র এবং পঞ্চানন কর্মকারের হাতে লিপি খোদাইর ইতিবৃত্ত জড়িয়ে আছে বলে।অন্যথা মনোএল দ্য আসসুম্পসাউ-এর নাম আমরা তাঁর প্রথম ছাপা বাংলা গদ্যগ্রন্থের প্রসঙ্গে মনে রাখি তাও সেই কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’ প্রসঙ্গে

            মনোএলের ব্যাকরণ এবং অভিধানটি কিন্তু লেখা হয়েছিল ঢাকার অদূরে বর্তমানে গাজীপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত,তৎকালীন ভাওয়াল পরগণার বাংলা ভাষার উপর ভিত্তি করেই।অর্থাৎ উপভাষাচর্চা যা পরে দীর্ঘদিন চাপা পড়ে যাবে তাই দিয়েই শুরু হয়েছিল আধুনিক বাংলা ভাষাতত্ত্বের চর্চার ইতিহাস।অন্যদিকে বরঅম্র,লতিঅম্র’-এর যুগে আধুনিক মান অসমিয়া গড়ে উঠেনি। সেটির শুরু শিবসাগরে মার্কিন ব্যাপটিস্ট মিশনে অরুণোদয়’ প্রকাশের মধ্য দিয়েঅথবা তাকে যদি আত্মারামের অনুদিত বাইবেল’-এর কাল ১৮১৩ অব্দি টেনে নিয়ে যাই তবে শ্রীরামপুর মিশন এবং উইলিয়াম কেরির ভাষা-কর্মযজ্ঞের সঙ্গে জুড়ে দিতেও পারি।কারণ কেরির প্রেরণাতেই এটি অনুদিত এবং প্রকাশিত হয়েছিল।কিন্তু তার আগেই অম্র’ গ্রন্থটি লেখা হয়ে গেছে।বইটি সম্ভবত গোটা ভারতের ভাষাচিন্তার ইতিহাসেই এর জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ যে সাহেবি কোনও সংসর্গ ছাড়াই এক বা একাধিক ভারতীয় এটি লিখছেন। যে অসমিয়া ব্যবহার করেছেন সেটি শিবসাগর অঞ্চলের উপভাষা হওয়াই সম্ভব।কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁরা তাই-আহোমে’র মতো এমন একটি ভাষাও লিপিবদ্ধ করছেন যেটি তখন বিলোপোন্মুখ।আহোমেরা ততদিনে অসমিয়া ভাষা গড়ে তুলতে এবং আয়ত্ত করতে বহুদূর এগিয়ে গেছেন।

              অসমিয়া ভাষাচিন্তার গৌরবের কাহিনিটি এখানেই শেষ নয়। ১৮১০এ রুচিনাথ কামরূপী (বা বরগোঁহাই)র অভিধান ত্রিভাষিকসংস্কৃতের সঙ্গে সেখানে আলাদা করে জায়গা করেছিল কামরূপী এবং উজানের অসমিয়া।তৃতীয় আরেকখানা অভিধানের সংবাদ সম্প্রতি মিলেছে ‘অসমীয়া জাতীয় অভিধানের প্রকাশকদের সূত্রে। ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিল্টনের ‘Comparative Vocabularies of 10-languages of North East India’ নামের বহুভাষিক অভিধান। এতে বাংলা মণিপুরি ইত্যাদি ভাষার শব্দও ছিল। সম্ভবত এটি ১৮১৪-তে লেখাই হয়েছিল,প্রকাশিত হয় নি। হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিটিই দুই শতক পরে ২০১৪-তে ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকে উদ্ধার করে অধ্যাপক দেবব্রত শর্মার সম্পাদনাতে ছেপে বের করে যোরহাটের ‘অসম জাতীয় প্রকাশ’চতুর্থ আরেকখানা অভিধানের সংবাদটি পাওয়া গেছিল নাথান ব্রাউনের Grammatical Notices of the Assamese Language-এর ভূমিকাতেইযাদুরাম ডেকাবরুয়ার লেখা এবং ১৮৩৯এ প্রকাশিত A Manuscript Bengali Dictionary with Assamese Definitions৩৪ জানিনা কোনো বাঙালি ভাষাচিন্তক এই অমূল্য বইদুটির কোনো খবর কোনদিনই নিলেন না কেন!কোনো বাংলা বইতে এর উল্লেখ মেলে না যাদুরামের বইটি এখন মেলেনা,জাতীয় অভিধান দলটি এর সন্ধানে আছেন।আমরাও করতে পারি। দুই ভাষার তুলনামূলক ইতিহাসে বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলো ফেলতেই পারে।বস্তুত বইটি সেই যুগে বসে লেখা যখন অসমিয়া বৌদ্ধিক সমাজ সানন্দে বাংলা চর্চা করতেন।ড প্রফুল্ল মহন্ত যে যুগটি সম্পর্কে তাঁর অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির ইতিহাস গ্রন্থে' লিখেছেন,“অসমত বাঙালী সকলেই আছিল আধুনিকতার অগ্রদূত আরু বৃটিশর পিছতে তেওঁলোকেও এক সামাজিক মর্যাদা লাভ করিছিল।সেইকালত নিশ্চয় (অসমিয়া) অভিজাত সকলে বাংলা ভাষার জ্ঞান আয়ত্ব্ব করাটো আরু বাঙ্গালিক অনুকরণ করাটোক আধুনিক আভিজাত্য বা সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিচাপে গণ্য করিছিল৩৫ এটা সেই যুগও বটে, যখন প্রথমবারের মতো ব্রিটিশের ভাষানীতি গোটা ভারত বিশেষ করে পূর্ব ভারতে সংঘাতের বীজও বপন করে।যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য পাওয়া যায় অসমীয়া জাতীয় অভিধান’-এর ভূমিকা অংশে।সম্পাদক লিখছেন,“নিজ মাতৃভাষার নির্বাসনর বাবে দায়ী বৃতিচ সাম্রাজ্যবাদক চিনাক্ত করিব নোয়ারি ই অসমীয়ার ঠাইত বাংলা জাপি দিয়া বাবে কেবল বাঙালি কেরাণী মহরীক দায়ী কৰিছিল।ফলস্বরূপে অসমিয়া ভাষার অস্তিত্বর বাবে ভাবুকি স্বরূপ বৃতিচ সাম্রাজ্যবাদ নেপথ্যতে থাকি গৈছিল আরু পরবর্তী প্রায় দের শতিকা কাল অসমীয়া-বঙালী সংঘর্ষই অসমর এক প্রধান জনসংঘাতর রূপ ধারণ করিছিল।বৃতিচ সাম্রাজ্যবাদ যে প্রকৃততে বাংলা ভাষার প্রতি দরদি নাছিল,সেই কথার প্রমাণ হৈছিল এই কথার পরা যে যি সময়ত বৃতিচে অসম আরু উরিষ্যাত বাংলা ভাষা জাপি দিছিল,ঠিক সেই সময়ত খোদ বংগত কিন্তু ফার্চী ভাষাহে জাপি দিছিল। তাৰ কারণ আছিল এই যে জনসংখ্যার প্রায় আধা আধা হিন্দু মুছলমান জনবসতি থকা তেতিয়ার অবিভক্ত বংগত মুছলমান সকলর ভাষা বুলি অভিহিত বা জনাজাত ফার্চী ভাষা বলবৎ কৰিলে হিন্দু সকল জাঙুর খাই উঠিব আরু তার ফল হ'ব দীর্ঘস্থায়ী হিন্দু-মুছলমান সংঘর্ষ। বৃতিচর সেই ষড়যন্ত্র যে বহুদূর ফলিয়ালে তার প্রমাণ পরবর্তী কালত হিন্দু মুছলমান সংঘাতক কেন্দ্র করি বাংলা ভাষা, বাঙ্গালী জাতি আনকি বংগদেশতে উলম্ব বিভাজন৩৬ শুধু একটি তথ্যগত ভুল রয়েছে এই গোটা বক্তব্যে।ফার্সিকে বাংলার সরকারী ভাষা হিসেবে ব্রিটিশ তখন বলবত করেনি।এটি ছিলই সরকারি ভাষা ১৮৩৭ অব্দি। অর্থাৎ অসমে এবং উড়িষ্যাতে বাংলা ভাষা বলবৎ করবার পরের বছরেই শুধু বাংলাদেশে বাংলা বলবত হয়।এর পরেই ভাষাগুলো নিয়ে বিভ্রান্তি যেমন বাড়তে থাকে সেই বিভ্রান্তি দূর করতে গিয়ে ভাষা এবং ভাষাচিন্তার বিকাশও কিন্তু হতে থাকে দ্রুত গতিতে।অসমিয়া বাংলার ভাষাবৈচিত্র্য কিনা,কিংবা সিলেটি অসমিয়ার ভাষাবৈচিত্র্য কিনা এই তর্কের গোড়ার কথাটিও কিন্তু এই ইতিহাস এবং ভাষা-রাজনীতিএক দশকের ব্যবধানে প্রকাশিত রবিনসন এবং নাথান ব্রাউনের ব্যাকরণেই আমরা এই ভাষা-রাজনীতির প্রকট চেহারাটি দেখতে পাব।প্রথমজন ছিলেন কেরির অনুগত ব্রিটিশ মিশনারি।সুতরাং তাঁর বক্তব্য ছিল অসমিয়া হচ্ছে বাঙালি বামুনদের প্রচলিত বাংলারই ভিন্ন রূপ।দ্বিতীয়জন ব্রহ্মদেশ হয়ে অসমে আসা মার্কিন মিশনারি। প্রথমজন অসমের স্কুলে অসমিয়া ভাষা প্রচলনেরও তীব্র বিরোধী ছিলেন,দ্বিতীয়জন অসমিয়াকে প্রতিষ্ঠা দেবার লড়াই লড়েছিলেন।৩৭ এ অনেকটা হ্যালহেড-কেরির ভাষা প্রস্থানের সঙ্গে জন বীমসের ভাষা প্রস্থানের বিরোধের মতোই।কিন্তু বাংলাতে যে বিরোধ দেখা দিতে প্রায় শতাব্দী লেগেছিল, অসমিয়াতে তা হয়েছিল কাছাকাছি সময়ে।রবীন্দ্রনাথ নাথান ব্রাউনের ব্যাকরণের সঙ্গে পরিচিত থাকা সত্ত্বেও প্রথম জীবনে অসমিয়ার স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে রবিনসনেরই অনুসারী ছিলেন।৩৮ এই ভাষা-রাজনীতির দৌড়ে যাদুরামকে ইচ্ছে করেই প্রায় লুকিয়ে ফেলা হল যার কিছু বিবরণ মেলে অসমীয়া জাতীয় অভিধান’-এর প্রথম খণ্ডে।আপাতত সেই বিষয় এক পাশে সরিয়ে রেখে আমরা এ পর্যন্ত ভাষাদুটোতে ভাষা নিয়ে যা কিছু চিন্তন এবং মনন হয়েছে তার এক সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত তুলে ধরবার চেষ্টা নেব।

রবিনসন নাথান ব্রাউনের অভিধান,ব্যাকরণ হয়ে ভাষাতত্ত্বে প্রবেশিকা:

            ভাষাচর্চার ধারাবাহিক ইতিহাস অসমিয়াতে একত্রে এখনো সুলভ নয়।বিভিন্ন বইয়ের ভূমিকা ইত্যাদিতে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।ড মৃণাল কুমার গগৈর মতো কেউ কেউ কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্ন ভাবে সেই ইতিবৃত্ত নিয়ে অধ্যয়ন করেছেন।৩৯ শ্রীগগৈ আলোচনার সুবিধার্থে গোটা সময়টাকে তিন ভাগে ভাগ করে নিয়েছেন। ১) অসমত ভাষা অধ্যয়ন(১৮৩৬-১৮৭৩ খৃঃ),২) ভাষাতত্ত্বমূলক অধ্যয়ন(১৮৭৪-১৯৪০),৩)ভাষাবৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন (১৯৪১অদ্যাপি)

             ১৮৩৬-টা তিনি শুরুর কাল ধরে নিয়েছেন কেন স্পষ্ট নয়।অসমে সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলা চালু করবার হিসেব ধরলে হওয়া উচিত ছিল ১৮৩৩এর পরে সংগঠিত ভাবে অসমিয়ার স্বাতন্ত্র্যবোধ জাগতে শুরু করে।কিন্তু আমরা ইতিমধ্যে দেখালাম বোধটা ছিল না নয়,আর অভিধান রচনার কালটা আসলে ১৭৯৫ থেকে শুরু।এই সময়ের মধ্যে চারটি অভিধান অসমিয়া ভাষা নিয়ে লেখা হয়ে গেছে।বর অম্র,লতি অম্র’-এর কথা জানা সত্ত্বেও তিনি হিসেব থেকে বাদ যে দিলেন তার কারণটি বুঝবার অপেক্ষা রাখে।যাদুরাম ডেকাবরুয়ার অভিধানের কথা আমরা লিখলামই।আর তাই আসলে ১৮৩৬ও নয়,১৮৩৯এর উইলিয়াম রবিনসনের লেখা ‘A Grammar of the Assamese Language বইটির কথাই আমাদের মনে আসে বেশি।প্রথম অসমিয়া ব্যাকরণ বলে এটিই এখন অব্দি খ্যাত।এটিও কিন্তু ছাপা হয়েছিল সেই শ্রীরামপুর মিশন কলকাতা থেকে।একদিকে যখন প্রশাসন বলে যাচ্ছিল অসমের ভাষা বাংলা,রবিনসন তাকেই সবল ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে গেছিলেন।তাঁর সামনে আর কোনো আদর্শ ছিল না বলে তিনি প্রচলিত লাতিন ব্যাকরণ এবং কেরির বাংলা ব্যাকরণের আদর্শে বইটি রচনা করেন।

       ১৮৪৬এ শিবসাগর মিশন থেকে অরুণোদয়’ কাগজ বের করে ব্রহ্মদেশ হয়ে অসমে আসা মার্কিন মিশনারিরা আন্তরিকতার সঙ্গে অসমিয়া ভাষার প্রচারে প্রসারে মন দিলেন।তাদের কাজগুলো কলকাতার শ্রীরামপুরের মিশনের মতোই আন্তরিক হলেও গুণগতভাবে স্বতন্ত্র ছিল।শ্রীরামপুরীদের মতো এরা সংস্কৃতকরণের দিকেও ঝোঁকেননি।এই কাগজটি করতে গিয়ে যেমন যেমন তাদের ভাষা চিন্তা দেখা দিচ্ছিল তেমন তেমন সেগুলো লিখিয়ে নিচ্ছিলেন নানাজনকে দিয়ে, আর নিজেরাও নেমে পড়েছিলেন ব্যাকরণ অভিধানের কাজে।নাথান ব্রাউন ১৮৪৮এ লিখলেন দ্বিতীয় ব্যাকরণ ‘Grammatical Notices of the Assamese Languageএই বইটি ‘Grammatical Notes on the Assamese Language নামেও মেলে। ১৮৯৩তে যখন পি এইচ মুর এর তৃতীয় সংশোধন করেন তখন এই নাম সহ অহেতুক অনেক বিষয় ছেঁটে ফেলেন,যার মধ্যে যাদুরাম ডেকাবরুয়া প্রসঙ্গও ছিল।যা পরবর্তী গবেষকদের কাছে এখনো বেশ সংগত উষ্মার কারণ হয়ে আছে। ব্রাউন যেভাবে শিবসাগর অঞ্চলের ভাষাবৈচিত্র্যকে ভিত্তি করেছিলেন তাকে অনেকটাই শুধরে ফেলেছিলেন মুর।এ অনেকটাই বাংলার সাধুভাষা নির্মাণের মতো ব্যাপার।অকৃত্রিম বানান টানানও পালটে ফেলা হয়।তাতে অসমিয়াকে অনেকটাই অহেতুক বাংলার কাছাকাছি নিয়ে আসা হয় বলে অনেকেই সংগত অভিযোগ উত্থাপন করে থাকেন।৪০ অথচ,ব্যাকরণটির ভূমিকাতে ব্রাউন অসমিয়া ভাষাতত্ত্ব বিশেষ করে ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে বেশ গভীরে গিয়ে আলোচনা করে এক জায়গাতে বেশ গর্বের সঙ্গেই লিখেছিলেন,“For beauty and softness the Assamese language is much superior to the Bengali”৪১গোলকচন্দ্র গোস্বামী এই বইটির সম্পর্কে লিখছিলেন, “...পরবর্তীকালর কুরি শতিকাৰ শেষার্দ্ধত খাচ অসমীয়া লোকে,পণ্ডিত সকলে লিখা বৈজ্ঞানিক বুলি দাবী করিবলৈ যোয়া কোনো এখন ব্যাকরণে তাক আজিলৈকে চের পেলাব পরা নাই৪২ আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকন যিনি বাংলা,সংস্কৃত ভাষাতেও বেশ সুলেখক ছিলেন ১৮৫৫তে একটি ছোট্ট বই লেখেন ‘A Native ছদ্মনামে। বইটির নাম,A Few Remarks on the Assamese Language and Vernacular Education in Assamতার আগে ১৮৪৯তে আরো দুটি বই ছেপে বেরোয় F.O.Poviotti-র ‘An Assamese Grammar with Vocabulary and Exerciseঅন্যটি দেবেশ্বর চালিহার ‘Origin and Growth of The Assamese Language এগুলোর উদ্দেশ্য ছিল,সেই যাদুরাম ডেকাবরুয়ার মতোই অনসমীয়াদের অসমিয়া ভাষার সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দেয়াওকিন্তু সে যুগেই অসমিয়া ভাষার ইতিহাস লেখার প্রয়াস হচ্ছে এটি চালিহার বইটির নামেই স্পষ্ট।কিন্তু যে ব্যাকরণ সেসময়ে লেখা হয়ে এখনো অসমিয়া ব্যাকরণ চিন্তাকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে যাচ্ছে সেটি হেমচন্দ্র বরুয়ার লেখা এবং ১৮৫৯তে প্রকাশিত অসমীয়া ভাষার ব্যাকরণ’এর দ্বিতীয় সংশোধিত সংস্করণ বেরোয় ১৮৭৩এ।এবং এখনো এটি অনেকের কাছেই অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ।ভাষাচার্য গোলকচন্দ্র গোস্বামী লিখেছেন এক জায়গাতে,“হেমচন্দ্র বরুয়ার ব্যাকরণখনেই আছিল অসমীয়া ব্যাকরণর সুদৃঢ় আরু সুনির্মিত বুনিয়াদ...তেখেতর ব্যাকরণখনেই আছিল অসমীয়া ভাষার লিখা অসমীয়া ব্যাকরণর এটা প্রথম প্রধান আরু উল্লেখনীয় মাইলর খুঁটি৪৩  কিন্তু তিনি প্রচলিত ভাষাটির বিশ্লেষণের পরিবর্তে লিখিত অসমিয়ার রূপকে পরিশীলিত এবং মার্জিত করবার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। যে কাজগুলো তখন কিন্তু বাংলাতেও হচ্ছিল।তাঁর বিরুদ্ধেও আজকাল ভাষাটিকে সংস্কৃত এবং বাংলাগন্ধী করে ফেলবার অভিযোগও শোনা যায়।৪৪ ১৯০০তে প্রকাশিত তাঁর রচিত অভিধান হেমকোষ’-- যেটি গেল প্রায় এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে অসমিয়া লেখক,শিক্ষক,ছাত্র সমাজে প্রায় বেদের মর্যাদা পেয়ে আসছে,যেটি এই এক শতাব্দী লিখিত ভাষাটিকে প্রায় শাসন করে গড়ে তুলেছে বললে অত্যুক্তি করা হয় না,-- সেটি সম্পর্কেই এই অভিযোগগুলো শোনা যাচ্ছে সম্প্রতি।

         ১৮৭৩এ অসমে প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে অসমিয়া স্বীকৃতি পাবার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যালয়গুলোতে এবং অফিস-কাছাড়িতে ব্যাকরণের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যায়। হেমচন্দ্রের ব্যাকরণটির সংশোধিত সংস্করণ বেরিয়েছিল সেই প্রেক্ষাপটে।ওই সময়ে আরো বেশ ক’টি ব্যাকরণও বেরিয়েছিল। যেমন ১৮৭৪এ দীনবন্ধু তর্কালঙ্কারের অসমীয়া ল’রার ব্যাকরণ’,১৮৮৭তে নারায়ণ শর্মা বিদ্যাভূষণের আশুবোধ ব্যাকরণ’ ইত্যাদি আরো বেশ ক’টি কিন্তু এগুলোর প্রায় সবক’টিই হেমচন্দ্রের ব্যাকরণকে অনুসরণ করে। মৌলিকতা বিশেষ আছে বলে পরবর্তী কেউ মনে করেন না। কিন্তু ঐ সময়ে আরো একটি বই অসমিয়া বাংলার তুলনামূলক আলোচনার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৯৪তে সেটি লেখেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জি এফ নিকল।বইটির নাম ‘Manual of the Bengali Language Compromising a Bengali Grammar and Lessons with Various Appendix including Assamese Grammarএই বইটির সন্ধান পাওয়া জরুরি। নামে মনে হয় এটিতে দুটো ভাষার তুলনামূলক অধ্যয়ন কিছু হয়েছিল। আমাদের মনে পড়বে এই বছরেই শুরু হয়ে গ্রিয়ার্সনের ভারতীয় ভাষা সমীক্ষার কাজ, শেষ হয়েছিল তিন দশক পরে ১৯২৮এ।

          ব্যাকরণের এর পরের গুরুত্বপূর্ণ রচনা হচ্ছে-- ১৯২৫এর সত্যেন্দ্রনাথ বরার বহল ব্যাকরণ’এই বইতে ব্যাকরণ রচনা ভাষাবিজ্ঞানকে স্পর্শ করছে গিয়ে।ভূমিকাতে সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ব্যাকরণ ভাষা শেখায় না, ভাষাটিকে ছিঁড়ে ফুড়ে ভেতরের স্বরূপ চেনায়।৪৫ অন্য আরো দু’টি ১৯৩৩এ প্রকাশিত শরৎ চন্দ্রগোস্বামীর সরল ব্যাকরণ’ রেফ চিহ্নের পর অসমিয়া বানানে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব পরিহার করবার ভাবনা তাঁর থেকেই প্রচলিত হতে শুরু করে।অন্যটি,১৯৩৬এ প্রকাশিত কালীরাম মেধির ‘Assamese Grammar and Origin of the Assamese Languageএর একটি অসমিয়া সংস্করণও রয়েছে অসমীয়া ব্যাকরণ আৰু ভাষাতত্ত্ব’তিনিও সত্যেন্দ্রনাথের পথে হেঁটেছেন সেই সঙ্গে ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান অধ্যয়নের দিকেও পা ফেলেছেন,অনেকটাই। অবশ্য বাণীকান্ত কাকতির বেশ আগেই গ্রিয়ার্সন এবং অধ্যাপক নিকলকে বাদ দিলে কোনো অসমিয়া বিজ্ঞানীর হাতে ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের সূচনা হয়েছিল দেবানন্দ ভরালির অসমীয়া ভাষার মৌলিক বিচার আরু সাহিত্যর চিনাকি’ (১৯১২) বইটি দিয়ে।কুড়ি বছর পরে এর এক সমৃদ্ধ দ্বিতীয় সংস্করণও বেরিয়েছিল।তিনিই প্রথম অসমিয়া ভাষার উৎপত্তি,ব্যাকরণের উপকরণের উৎপত্তি এসব নিয়ে ভাবেন এবং আধুনিক ব্যাকরণ কেমন হবে তার ধারণা দেবার প্রয়াস করেন।এর পরেই সত্যেন্দ্রনাথের ব্যাকরণটিও লেখা সম্ভব হয়ে উঠে।এঁরা তখনই গ্রিয়ার্সনের বইটি দেখেছিলেন বলে মনে হয় না। কারণ বইটি ছাপা যদিও শুরু হয়েছিল ১৯০৩এ সব ক’টা খণ্ডের কাজ শেষ হয়েছিল ১৯২৮এ।

 ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের পথে যাত্রা:

১৯৪১এ বাণীকান্ত কাকতির বহুখ্যাত ‘Assamese : Its Formation and Development বইটি বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে চিত্রটি একেবারেই পালটে যায়। যেমন পালটে যায় সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ODBL বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষাবিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস।এর আগে অব্দি  দেখা যাবে বাংলা এবং অসমিয়া ভাষা অধ্যয়ন প্রায় একই খাতে বইছে। দুই ভাষাতেই উনিশ শতককে অভিধান এবং ব্যাকরণ রচনার শতক বলা যেতে পারে।সেই সঙ্গে মান ভাষার আদর্শ সন্ধানের শতক।প্রাক-ঔপনিবেশিক ভাষাদর্শ থেকে সরে আসার শতক। বাংলাতে যেমন এই সময় নব্যব্যাকরণদল দেখা দিচ্ছিলেন, অসমিয়াতেও প্রায় একই ঘটনা ঘটছিল।সত্যেন্দ্রনাথ,শরৎচন্দ্র,কালীরাম মেধী,দেবানন্দরা এই দলের বৈয়াকরণ।বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ এবং সেই সূত্রে রবীন্দ্রনাথ,রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীদের ভাষাবিজ্ঞান চর্চার সঙ্গে অসমিয়া বিদ্বজ্জনেরাও পরিচিত ছিলেন। অসমে সেই সময় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের শাখা গড়বার প্রয়াস হয়েছিল এবং পরে এরই ধারাবাহিকতাতে  কামরূপ অনুসন্ধান সমিতি তথা অসম সাহিত্য সভা গড়ে উঠেছিল। ওদিকে যখন রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষা নিয়ে নানান বিতর্কে নেতৃত্ব দিচ্ছেন,এদিকে তখন লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া অসমিয়ার প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিতর্কে জড়াচ্ছেন। পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ,পদ্মনাথ গোহাঞি বরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিভিন্ন আন্দোলনে,গবেষণা কর্মে এবং অনুসন্ধানের কাজে। এর মধ্যে পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ যদিও সিলেটের বাঙালি ছিলেন,অসম এবং অসমিয়া নিয়েও তিনি সমান আগ্রহী ছিলেন।এই সব কাজ ছাড়া  আসলে বাণীকান্ত কাকতির আবির্ভাব রহস্য এবং গুরুত্ব অনুধাবন করা মুস্কিল হবে।এই সময়েই অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি বেণুধর রাজখোয়ার ‘Notes on the Sylhetee Dialect বইটি প্রকাশ পায়। বইটিতে তিনি সিলেটিকে অসমিয়া ভাষা বলে প্রথম দাবি করেন এবং এক দীর্ঘ ঔপভাষিক বা ভাষারাজনৈতিক বিতর্কের সূচনা করেন। সম্ভবত ভাষাবৈচিত্র্যতত্ত্ব নিয়ে এইটিই প্রথম কোনো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।এর আগে আমরা কয়েকটি অভিধানে ভাষাবৈচিত্র্যকে গুরুত্ব দেবার কথা উত্থাপন করেছি।কিন্তু সেগুলো ছিল অভিধান বা ব্যাকরণ মাত্রবেণুধর রাজখোয়ার বইটি এখন আলাদাভাবে দুষ্প্রাপ্য।কিন্তু নানান ভাষাবিদের রচনাতে তার প্রচুর উল্লেখ থাকাতে অনেকটাই পুনরুদ্ধার সম্ভব।এবং যথাসময়ে আমাদের তা করতে হবে।

            বাণীকান্ত কাকতির পথ অনুসরণ করে কিন্তু তাঁকে অতিক্রম করে পরের দশকে বিরিঞ্চি কুমার বরুয়া লেখেন ভাষা আরু সংস্কৃতি’১৯৫৭তে বইটি প্রকাশ পায়।একই বছরে বেরোয় ডিম্বেশ্বর নেওগের ‘New Light on the history of Growth of Assamese Language বইটি। এর অনেক বছর পর আমরা ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে লেখা আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বই পাচ্ছি ১৮৮৫তে লেখা বিশ্বেশ্বর হাজরিকার ‘Assamese language: Origin and Developmentতিনি পরে  জন্ম শতবর্ষে বাণীকান্ত কাকতির বইটিরও অসমিয়া অনুবাদ করেন। বাণীকান্তের পরে  এই তিনটি বেশ তথ্য এবং তত্ত্ব সমৃদ্ধ অসমিয়া ভাষার ইতিহাসের গ্রন্থ।

ভাষাতত্ত্ব থেকে ভাষাবিজ্ঞানে উত্তরণ: ব্যাকরণ,অভিধান রচনার নতুন ধারা:

            এই সময়ের মধ্যেও ব্যাকরণ রচনার ধারা অব্যাহত ছিল। প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষাতাত্ত্বিক এক একখানা ব্যাকরণ লিখলেও কে সঠিক ব্যাকরণ লিখতে পারলেন এই নিয়ে তর্কও বাংলার মতোই তীব্র ছিল।ডিম্বেশ্বর নেওগ, উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী,ভগবান মরল,বাপচন্দ্র মহন্তের মতো খ্যাতনামা ভাষাবিজ্ঞানীরাও ব্যাকরণ রচনাতে হাত দিয়েছিলেন কিন্তু ১৯৭২এ লেখা গোলকচন্দ্র গোস্বামীর অসমীয়া গোলক ব্যাকরণ- সুবোধ এবং প্রবোধ ভাগ’ খুব ধীরে হলেও অসমিয়া ভাষা চিন্তার জগৎখানাই পালটে দেয়। ১৯৮৭তে প্রকাশিত তাঁর আরো একখানা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ অসমীয়া ব্যাকরণর মৌলিক বিচার।( প্রথম ভাগ) ২০০০এ তৃতীয় আরেকখানা লেখেন অসমীয়া ব্যাকরণ প্রবেশ’ ব্যাকরণ রচনাতে গতানুগতিক পথে যারা হাঁটছিলেন তাদের প্রায় প্রত্যেককেই এক প্রত্যাহ্বানের মুখে ঠেলে দেয় তাঁর এই বইগুলো এবং অন্যান্য ভাষাবৈজ্ঞানিক রচনা।১৯৫৬তে প্রকাশিত দেবানন্দ ভরালির ‘A study of Phonology and Vocabulary of the Assamese Language বইটিতে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে অসমিয়া ধ্বনিতত্ত্ব এবং শব্দভাণ্ডার নিয়ে অধ্যয়নের সূচনা হয়েছিল যদিও সিদ্ধি জুটেছিল ভাষাচার্য গোলকচন্দ্র গোস্বামীর ১৯৬৬তে লেখা ‘An Introduction of Assamese Phonology বইটিতেই।একই বছরে বেরোয় তাঁর অসমিয়া বই ধ্বনি-বিজ্ঞানর ভূমিকা’ ১৯৬৯এ অসমীয়া বর্ণপ্রকাশ’ ১৯৭২এ অসমীয়া আখর জোঁটনি’ বলা যেতেই পারে বাংলাদেশের মতোই  আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানে অসমিয়া ভাষারও দীক্ষা সেই ষাটের দশকেই।এবং দুই ভাষাতেই কাজটি শুরু হয় ধ্বনিতত্ত্ব দিয়েই।এ এক কৌতূহল উদ্রেককারী  সংযোগ বটে অসমিয়া ভাষা চিন্তাতে গোলকচন্দ্র গোস্বামীর  প্রভাব এতোটাই সুদূর প্রসারী হলো যে দেবব্রত শর্মার মুখ্য সম্পাদনাতে ২০১০এর ১ জানুয়ারি থেকে পরের তিন বছরে কয়েক হাজার পৃষ্ঠার চারটি সুবৃহৎ খণ্ডে বেরিয়ে অসমীয়া জাতীয় অভিধান’ রীতিমত এক জাতীয় ভাষা আন্দোলনের জন্ম দিয়ে দিয়েছে সমগ্র অসমে।এর শুধু শেষ খণ্ডটিরই পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৭০০! যার প্রায় দ্বিতীয় কোনো তুলনা সমগ্র ভারতে আমাদের মনে পড়ে না। রবীন্দ্রনাথ যে সামগ্রিক বাংলা অভিধানের স্বপ্ন দেখেছিলেন সেরকমতো ভারতে হয়েছে বলে শুনিনি,কিম্বা মহম্মদ শহীদুল্লাহ যেভাবে বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান রচনা করেছিলেন বা করিয়েছিলেন সেটিও রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতার জন্যে সামগ্রিক বাংলার অভিধান হয়ে উঠতে পারল না।একই কথা অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত অভিধান সম্পর্কেও বলা যেতে পারে। অসমিয়াতে সেটিই সম্ভব করে তুললেন দুই অধ্যাপক মদন শর্মা এবং দেবব্রত শর্মার নেতৃত্বে অসমীয়া জাতীয় প্রকাশন’-এর এক বিশাল ভাষাকর্মীবৃন্দ। এঁদের মূল ভাষাচিন্তার গুরু কিন্তু ভাষাচার্য গোলক চন্দ্র গোস্বামী। যিনি গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম যুগে বাংলাও পড়িয়েছেন এবং পারিবারিক সূত্রে ধর্মবিপ্লবী শ্রীচৈতন্যের পরিবারের উত্তর পুরুষ। অর্থাৎ কোথাও স্রোতের বিরুদ্ধে হাঁটার প্রেরণা তিনি পরিবার থেকে পেলেও পেতে পারেন। ভাষাচার্যের পরে থেকেই মূলত অসমিয়া ভাষা তথা ব্যাকরণ চর্চাতে আধুনিক ভাষাবৈজ্ঞানিক চিন্তা গুরুত্ব পেতে শুরু করে। নামে ব্যাকরণ হলেও অনেক গুলো বই আসলে ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে অসমিয়া ভাষার স্বরূপ বিশ্লেষণ। যেমন ১৯৯১তে প্রকাশিত দীপ্তি ফুকন পাটগিরির আধুনিক অসমীয়া ব্যাকরণ, কিম্বা ঐ একই বছরে নরনারায়ণ শর্মার অসমীয়া ভাষার রূপতত্ত্ব আরু ব্যাকরণ, কিম্বা ১৯৯৫তে প্রকাশিত রুণিমা চৌধুরীর Assamese Verbs: A study in the Structural Paradigm’এই সারিতে সবচে গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্মানিত গ্রন্থ বোধকরি ভীমকান্ত বরুয়ার ১৯৯৬তে প্রকাশিত অসমীয়া ভাষা বইটি।

ভাষাতত্ত্ব থেকে ভাষাবিজ্ঞানে উত্তরণ: তাত্ত্বিক অনুসন্ধান:

বস্তুত এই সময়েই অসমিয়া ভাষাতে ভাষাবিজ্ঞান চর্চারও জোয়ার আসেআধুনিক বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের চর্চা ভারতীয় বাংলাতেও সত্তর আশির দশকের আগে খুব বেশি হয় নি।আমরা ইতিমধ্যে দেখিয়েছি।স্যসুরকে না জেনেই আগেই রবীন্দ্রনাথের হাতে বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের সূচনা হলেও পরবর্তী প্রায় সবাই হাঁটছিলেন সুনীতিকুমার, সুকুমার সেনের পথ ধরে। গোলকচন্দ্র গোস্বামীর ধ্বনিতাত্ত্বিক বইটির এক দশক পরে বেরোয় উপেন্দ্র নাথ গোস্বামীর ভাষাবিজ্ঞান’(১৯৭৬) বইটি আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের পদ্ধতি তত্ত্ব নিয়ে প্রথম বই।এই পথে পরে লিখেছেন ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্তবরুয়া আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান পরিচয়’( ১৯৯০);ভগবান মরলের ভাষার্থ বিজ্ঞান’ (১৯৮৮);রমেশ পাঠকের ভাষা বিজ্ঞান ভূমিকা( ১৯৮৫),‘ব্যাকরণ আরু প্রাকৃতি বিজ্ঞান’ ( প্রকৃতি নয় লেখক) ( ১৯৮৮),দীপ্তি ফুকন পাটগিরির ভাষাতত্ত্ব( ১৯৯১) এবং ভাষাতত্ত্বর বিচিত্র কথা( ১৯৯৬);দীপঙ্কর মরলের উপভাষা বিজ্ঞান(১৯৯১)এছাড়াও কটন কলেজের শতবার্ষিকীতে প্রকাশিত চিন্তন আরু মনন (২০০০) এবং নাহেন্দ্র পাদুন সম্পাদিত দুখানা প্রবন্ধ সংকলনের একটি ভাষার তত্ত্বকথা( ১৯৯৩) এবং চিন্তা-প্রবাহ( ১৯৯৬-৯৭) সাক্ষ্য দেয় যে ভাষাবিজ্ঞানের একেবারে শেষচিন্তা চমস্কি এবং চমস্কি উত্তর বিকাশের ধারা নিয়েও অসমিয়া ভাষাকর্মীরা রীতিমত চিন্তিত,মানে ওয়াকিবহাল।   

ভাষাতত্ত্ব থেকে ভাষাবিজ্ঞানে উত্তরণ: উপভাষাবিজ্ঞান এবং তুলনামূলক অধ্যয়নে  মনোনিবেশ:

উপভাষা তথা ভাষাবৈচিত্র্য চর্চা দিয়েই অসমিয়া অভিধানের যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই ১৭৯৫তে। বা বেণুধর রাজখোয়ার Notes on the Sylhetee Dialect’ বইটির কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। এমন দুচারটি বই খবর করলে এদিকে ওদিকে আরো পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু যথার্থ ভাষাবৈজ্ঞানিক ভাষাবৈচিত্র্যচর্চারও সূচনা করেন উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী ১৯৭০এ তাঁর A Study on Kamrupi: A Dialect of Assamese’ বইটির মধ্য দিয়ে।এই ধারাতে পরের গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হলো দীপঙ্কর মরলের Phonology of Assamese Dialect: Contemporary Standard and Mayong’(1992);ধীরেন্দ্র নাথ দাসেরThe Dialect of Goalpara and Kamrupi:A Comparative Analysis (1999),বিভা ভরালির কামরূপী উপভাষা : এটি অধ্যয়ন( ২০০৪) এবং জীবন চন্দ্র পাঠকের দরঙী উপভাষা অধ্যয়ন (২০০৫) বোঝাই যাচ্ছে এখনো ভাষাবৈচিত্র্যগুলোর এক বিশাল ক্ষেত্র অনধিত থেকে গেছে। যদিও ২০০৯-তে প্রকাশিত উপেন রাভা হাকাচামের অসমীয়া আরু অসমর ভাষা-উপভাষা বইটি এই বিষয়টি নিয়ে এক উল্লম্ফন বলে বিবেচিত হতে পারে। বইটিতে তিনি অসমিয়ার সমস্ত স্বীকৃত ভাষাবৈচিত্র্যের আলোচনা করেছেন। এমন কি স্বীকৃত/অস্বীকৃত ভাষাবৈচিত্র্যের তালিকাতে হাজং,বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি (মায়াং)এর আলোচনাও যেমন সেরে নিয়েছেন অসমিয়ার জাতিগত/সামাজিক শ্রেণিগত উপভাষার তালিকা ধরে ঝাড়খণ্ডি আদিবাসীদের,ময়মন সিংহ মূলীয়দের সঙ্গে সিলেটির আলোচনাও করেছেন। সেদিক থেকে এই বইটির বিষয় বৈচিত্র্য এবং এবং অধ্যয়ন ক্ষেত্র অনেক ব্যাপক।

          ভাষাবৈচিত্র্য অধ্যয়নের পাশাপাশি উপেন রাভা হাকাচামের এই বইটি অবশ্য ১৯৭৭এ প্রমোদ চন্দ্র ভট্টাচার্য প্রতিবেশী ভাষাগুলো, বিশেষ করে ভোটবর্মী ভাষাগুলো অধ্যয়নের যে ধারার সূচনা করেছিলেন সেই ধারাতেও এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।তিনি অসমিয়ার সঙ্গে প্রতিবেশী ভোটবর্মী ভাষাগুলোরও এক বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।এই বিষয়ে তাঁর আরেকটি স্বতন্ত্র বইয়ের নাম অসমীয়া আরু অসমর তিব্বত-বর্মীয় ভাষা’(২০০০)১৯৯৭তে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে করা তাঁর গবেষণা সন্দর্ভের নামই ছিল Rabha and Assamese Language: A Comparative Study’সুতরাং আমাদের পরবর্তী অসমিয়া বাংলা ভাষা এবং ভাষাবৈচিত্র্যগুলোর যে কোনো অধ্যয়নেও এই নবীন ভাষাবিজ্ঞানীকে বারে বারে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে মনে রাখতে হবে।এটি এর জন্যেও যে বাংলাতে সেই ১৯৫১তে কিরাত জনকৃতি’ দিয়ে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় যে মহান কাজটির সূচনা করেছিলেন তাও অসমের মাটিতে যোরহাট জগন্নাথ বরুয়া কলেজের এক সম্মেলনে বসে,বিচ্ছিন্ন কিছু কাজ বাদ দিলে তাঁর আর প্রায় কোনো গুরুত্বপূর্ণ উত্তরাধিকার নেই। অথচ, অসম তথা পূর্ববাংলাতে প্রচলিত বাংলা ভাষার অধ্যয়নে এই দিকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যয়নের বিষয় বলে বিবেচিত হওয়াই উচিত।

              অসমিয়াতে ১৯৮৮র সত্যেন্দ্রনারায়ণ গোস্বামীর ‘Studies in Sino-Tibetan Language,ভীমকান্ত বরুয়ার অসমর ভাষা’( ১৯৯০),একই লেখকের ‘Nagamese:The Language of Nagaland( ১৯৯৩), উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীর ‘An introduction to the Deuri Language (1994),এম আর বড়োর ‘The Bodo Structure(1991),টাবু টাইডের ‘A Dictionary of the Missing Language (1995)95,অপর্ণা কোঁয়রের ‘Karbi People and Their Language:A Critical Study (1991) ইত্যাদি বইয়ের প্রত্যেকটিই এই ভোট-বর্মী ভাষাগুলো বা তাদের মধ্যে প্রচলিত নাগামীজের মতো আর্যভাষাগুলোর অধ্যয়ন করেছে ব্যাপক গভীরে গিয়ে।

 

          ।। অসমিয়া ভাষা অধ্যয়নে বাংলা প্রসঙ্গ ।।

              সেই যাদুরাম ডেকাবরুয়ার অভিধানেই অসমিয়া-বাংলার তুলনামূলক অধ্যয়নের সূচনা হয়েছিল।এর পরে প্রায় কোনো অসমিয়া ভাষা বিজ্ঞানের বই নেই যেখানে কোনো না কোনো ভাবে বাংলা ভাষার প্রসঙ্গ আসেনি।বাণীকান্ত কাকতির বিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থটিতেতো বটেই। সে অবশ্যি বাংলা ভাষাতত্ত্বের বই সম্পর্কেও সত্য।বাংলাতে সম্ভবত অসমিয়া ভাষাতত্ত্ব চর্চার শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর শব্দতত্ত্ব’ বইতে ভাষাবিচ্ছেদ’ ছাড়াও বাংলা বহুবচন’ প্রবন্ধে তার সাক্ষ্য রয়েছে। সুনীতি চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থটিতে সেই কাজ করেছেন বেশ গভীরে প্রবেশ করেই। তাঁর ছাত্রই ছিলেন বাণীকান্ত। সাহিত্যের ইতিহাসও লেখা সম্ভব হয় নি বাংলা অসমিয়া ওড়িয়া ইত্যাদি মাগধি অপভ্রংশজাত ভাষাগুলোর তুলনামূলক আলোচনা ছাড়া। বিশেষ করে চর্যাপদ এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মতো গ্রন্থগুলো আলোচনাতে তো বটেই।অসমিয়া জাতীয়তা নিয়ে যেকোনো আলোচনাতেও বাংলা প্রসঙ্গ এসেই থাকে।এগুলি বাংলা সম্পর্কে অসমিয়া ভাষাবিজ্ঞানী বা তাত্ত্বিকদের দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে বুঝতে সাহায্য করবে। আমরা তা করব পরে যথাসময়ে।কিন্তু ১৯৭৮এ ফণীন্দ্র কুমার দত্তবরুয়ার গবেষণাগ্রন্থ ‘A Comparative Analysis of the Morphological Aspects of Assamese and Oriyaতে যেন বিশেষ জোর দিয়েই আলাদা করে প্রতিবেশী আর্যভাষাগুলো নিয়ে ভাষাবৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন শুরু হলো। তেমনি আরেকটি সুপরিচিত বই দীপ্তি ফুকন পাটগিরির অসমীয়া বাংলা আরু উরিয়া ভাষা’(২০০৪)ভারতীয় আর্যভাষাগুলোর স্তরগুলো নিয়ে তুলনামূলক আলোচনার জন্যে দু’টো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ নগেন ঠাকুরের পালি প্রাকৃত অপভ্রংশ ভাষা আরু সাহিত্য’( ১৯৯২) এবং সুবাসনা মহন্তর ভারতীয় আর্যভাষার পরম্পরাত উদ্ভবকালীন অসমীয়া ভাষার গঠন’(২০০০) এ ছাড়াও,বিশ্বজিৎ দাস এবং ফুকন চন্দ্র বসুমাতারির সম্পাদনাতে ২০১০এ প্রকাশিত অসমিয়া এবং অসমর ভাষা’ নামের সংকলন গ্রন্থটিও এই সারিতে এক নতুন সংযোজন।

এখনো বাকি বহু পথ পরিক্রমা:

পুরো আলোচনাকে গুটিয়ে আনলে আমরা দেখব অসমিয়া ভাষা চর্চার শুরুটা অসমিয়াদের হাতেই। উপভাষার চর্চা দিয়েই। রবিনসনের ব্যাকরণ যে ভাষাকে বাংলা করে তুলতে চাইছিল নাথান ব্রাউনের ব্যাকরণ তাকে আবার স্রোতে দাঁড় করালো। কিন্তু ব্রাউনের ব্যাকরণে মুরের হস্তক্ষেপ থেকে বোঝা যায় রবিনসনের ধারাটিও সমানে সজীব ছিল।পরবর্তীতে হেমচন্দ্র বরুয়া নিজের লেখা ব্যাকরণ এবং অভিধানে অসমিয়ার স্বাতন্ত্র্যকে আরো প্রতিষ্ঠা দিলেন অসমিয়ার প্রচারেও তিনি ছিলেন আন্তরিক।তাঁর আদর্শ এতোটাই প্রতিষ্ঠা পায় যে পরবর্তী প্রায় এক শতাব্দী তা অসমিয়া লিখিত ভাষাকে রীতিমত শাসন করে। অতি সম্প্রতিই শুধু ভাষাবিজ্ঞানী গোলকচন্দ্র গোস্বামী,উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী,ভীমকান্ত বরুয়া,রমেশ পাঠক,অপর্ণা কোঁয়রদের যুগেই তাঁর বিরুদ্ধে সংস্কৃত এবং বাংলাকে অনুসরণ করবার অভিযোগ উঠছে। হেমচন্দ্র বরুয়ার ১৯০০তে মৃত্যুর তিনবছরের মধ্যেই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের আন্দোলন শুরু হয়েছিল,যার ঢেউ অবিভক্ত অসমেও পৌঁছেছিল। এখানেও এর শাখা গড়ে তুলবার আয়োজন চলছিল।যার পরিণতি একদিকে ছিল কামরূপ অনুসন্ধান সমিতি অন্যদিকে অসম সাহিত্য সভার সূচনা। তাই সত্যেন্দ্রনাথের বহল ব্যাকরণ’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থও লেখা হয়েছিল যা ছিল নির্দেশ দেবার বিপরীতে ভাষার নিয়ম অনুসন্ধানের প্রথম প্রয়াস। দেবানন্দ ভরালির অসমীয়া ভাষার মৌলিক বিচার আরু সাহিত্যর চিনাকি’ (১৯১২) বইটি দিয়ে ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের সূচনাও এই পরিবেশেই সম্ভব হয়েছিল।

                  অন্যদিকে ভাষাতত্ত্বের চর্চাতে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে অসমিয়া ভাষাবিজ্ঞানীরা কিন্তু বাঙালি বিশেষ করে ভারতীয় বাঙালিদের থেকে এগিয়ে পা ফেলেছেন। টেঙাই পণ্ডিত বা রুচিনাথ কামরূপীর সময় কোনো বাঙালি অভিধান রচনাতে হাত দেন নি,আর কোনো সাহেবও অসমে পা ফেলেন নি। ফ্রান্সিস বুকানন থাকলেও ব্যতিক্রম। তাঁর বইটি প্রকাশিত হয় নি।পরিচিতও মনে হয় ছিল না। গোলকচন্দ্র গোস্বামী,উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীরা যখন আধুনিক বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞান চর্চা করছেন ভারতীয় বাঙালিরা তখন সুনীতি চট্টোপাধ্যায়,সুকুমার সেনের শাসনে পরাধীন’,স্বাধীন পদক্ষেপ নেবার কথা ভাবছেনই না। ভোট-বর্মী ভাষাগুলোতে কিরাত জনকৃতি’র পথে বাঙালিরা বিশেষ পা বাড়াননি। অতি সম্প্রতি উত্তর বাংলা বা ত্রিপুরাতে কিছু অধ্যয়নের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু অসমিয়াতে এই শাখার অধ্যয়ন বহুদূর এগিয়ে গেছে।

          তারপরেও এটি ঠিক যে ব্যাকরণ এবং অভিধান বাক্যতত্ত্ব নিয়ে,ভাষাবৈচিত্র্যগুলো নিয়ে,অনসমীয়া আর্য,অনার্য ভাষাগুলো নিয়ে সুগভীর কাজকর্ম এখনো অনেক করার আছে।ঐ সেদিন ২০১০এ গ্রেগরি এণ্ডারসন,ডেভিড হ্যারিসন এবং গণেশ মুর্মুর নেতৃত্বাধীন এক গবেষক দল অরুণাচল প্রদেশে কেরো’ বলে এক নতুন ভাষা খুঁজে বের করলেন। এমন প্রচুর কাজ এখানে অসমিয়া,বাংলা,হিন্দি যেকোনো ভাষাতেই করবার বাকি আছে।উজান অসমের বিভিন্ন জেলার অসমিয়া ভাষাবৈচিত্র্যগুলো নিয়ে অধ্যয়ন প্রায় নেইই। বাংলার সঙ্গে অসমিয়ার তুলনামূলক অধ্যয়ন এখনো গভীরে গিয়ে প্রবেশ করে নি। সাধুবাংলা বা কলকাতার মান বাংলার সঙ্গে অসমিয়ার সম্পর্ক তুলনা করতে গিয়ে প্রতিবেশী বাংলা ভাষাবৈচিত্র্য নিয়ে অনেক সত্যই আড়ালে থেকে যায়,যেগুলোর অনুসন্ধান হয়তো দুটো ভাষার সম্পর্কেই অনেক নতুন তথ্য এবং সত্যের মুখোমুখি করতে পারত।উপেন রাভা হাকাচাম অসমীয়া আরু অসমর ভাষা-উপভাষা’ বইয়ের মুখবন্ধে অসমের বেশ কিছু সামাজিক শ্রেণি উপভাষার নাম করেছেন ,“নেপালী সকলর নেপালী- অসমীয়া,অভিবাসী সম্প্রদায়র উজানী (দেশী) আরু ভাটিয়া (ময়মন সিঙীয়া) অসমীয়া,কাছারর বাঙালীসকলর চিলেটীয়া (কাছারীয়) অসমীয়া,অভিজাত আরু শিক্ষিত বাঙালী পরিয়ালর ঔপনিবেশিক অসমীয়া (ব্রিটিছর দিনত মফচলীয় আমোলাপট্টিত আরু সম্প্রতি রেলোয়ে কলনিত এনে ভাষার নমুনা পোয়া যায়),নগর-মহানগর কেন্দ্রিক মাড়োয়ারী সম্প্রদায়র হিন্দী মিশ্রিত বজরুয়া অসমীয়া (Broken Assamese),কুলি-নাপিত-ধোবা-রিক্সাওয়ালা আদি বৃত্তিজীবি লোকর দেশোয়ালী অসমীয়া ইত্যাদি এই শ্রেণীর অসমীয়ারূপে অতি সম্প্রতি বহুভাষিক অসমীয়া মাতৃভাষী চাকরিজীবি,ব্যবসায়,গৃহীণী আরু ছাত্র-ছাত্রীকো প্রভাবান্বিত করি চলতি অসমীয়া বা জনপ্রিয় অসমীয়া ভাষার প্রচলনত ইন্ধন যোগাইছে.”৪৬ এর থেকে স্পষ্ট তিনি চিলেটীয়া অসমীয়াদের অসমীয়া মাতৃভাষীদের সঙ্গে একাকার করছেন না। বরং সিলেটিকে অসমের ভাষা অর্থেই অসমিয়া বলছেন।তাহলে এই ভাষাগুলোকে তিনি উপভাষা কেন বলছেন এই প্রশ্ন উঠতেই পারেএই প্রশ্নও অনুসন্ধানের বিষয় হতে পারে যে মূল অধ্যায়ে তিনি মারোয়াড়ি বা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার রেলওয়ে কলোনির বাংলাকে নিয়ে আলোচনা করতে উৎসাহ দেখালেন না কেন? শুধু তিনিই নন,প্রায় কোনো অসমিয়া ভাষাবিদকেই এদের নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করতে দেখা যাবে না। এগুলো না করবার ফলে বিভ্রান্তি কেমন বাড়ে তার আরেকটি নজির প্রখ্যাত অসমিয়া ভাষাবিদ অধ্যাপক ড রমেশ পাঠকের এই মন্তব্য।তিনি এক্কেবারে সন তারিখ দিয়ে দাবি করেছেন,“চিলেটর ভাষার সৈতে অসমীয়া ভাষার সম্পর্ক বর্তমান অবস্থাত বিচারিবলৈ যোয়াটো পর্বতত কাছকণী বিচারিবলৈ যোৱাৰ দরে হ,কারণ বাংলা ভাষাই চিলেটী ভাষার রূপ এনেদরে সলাই পেলাইছে যে চিলেটী এতিয়া বাংলা ভাষারে আঞ্চলিক রূপ মাথোন।অথচ, ১৯১৩ চনলৈকে চিলেটী ভাষা অসমীয়া ভাষার সৈতে অদ্ভুত ধরণে মিলিছিল।... ১৯১৩ চনত ওলোয়া বেণুধর রাজখোয়ার Notes on Sylhetee Dialect বোলা গ্রন্থখনর পরা তথ্যবোর দিয়া হৈছে। ...৪৭তার মানে ১৯১৩তে যেহেতু বেণুধর রাজখোয়ার বইটি বেরিয়েছিল সুতরাং ওই পর্যন্ত ভাষাটি প্রায় অসমিয়াই ছিল।তারপর থেকে একে বাংলা গ্রাস করেছেএরকম ভাষাগ্রাস করা সম্ভব কি না,সিলেটির মধ্যে আদৌ তেমন অস্বাভাবিক কিছু পরিবর্তন হয়েছে কিনা এই সব ভাষাতাত্ত্বিক প্রশ্ন এক পাশে সরিয়ে রেখেও যে বিপজ্জনক আশঙ্কাটি তাঁর লেখাতেও স্পষ্ট যে এমন ভাষাতত্ত্ব অহেতুক সাধারণ অসমিয়াদের মনে বাংলা সম্পর্কে এক আতঙ্ককে লালন করতে সাহায্য করে। ড রমেশ পাঠকেরও মন্তব্যেরই মাঝের অংশে রয়েছে,“চিলেটত যি ঘটিছিল বা ঘটিল তেনে ঘটনার প্রক্রিয়া কাছারতো আরম্ভ হৈছে....”৪৮ রমেশ চন্দ্র পাঠকের এই মন্তব্য আমাদের আবার মনে করিয়ে দেবে কাছাড়’ নিয়ে আমাদের আলাদা করে ভাবতেই হচ্ছে।এর আগে জগন্নাথ এবং আবিদ রাজার অভিধান প্রসঙ্গে আমরা কথাটা বলেছিলাম। আমরা কিন্তু এখনো ড রমেশ পাঠকের মতো এতোটা হতাশ হয়ে মনে করিনা যে সিলেটির সঙ্গে অসমিয়ার সম্পর্ক সন্ধান করতে যাওয়াটা পর্বতে কচ্ছপের ডিম সন্ধানের মতো ব্যাপার।এতোটা মৌলিক পরিবর্তন দুই ভাষার কোনোটিরই ঘটেনি। তার সঠিক স্বরূপ তুলে ধরতে আমাদের ব্রিটিশ কিম্বা বর্তমান অসমের মানচিত্রের বাইরে বেরুতে হবেপ্রাচীন কামরূপের মানচিত্র,তথা ব্রহ্মপুত্র নদীর সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব তীর অনুসরণ করতে হবে।

                ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলা নিয়ে এখনো প্রায় কোনো কাজ নেই অসমিয়াতে।বাংলাতেও বিচ্ছিন্ন দুই একটি প্রবন্ধের বাইরে নেই।সাদরি ভাষার সম্পর্কে কিছু অনুসন্ধান হয়ে থাকলেও সাওঁতালি,মুণ্ডারি কিম্বা খাসিয়ার মতো পূর্বোত্তরীয় জীবন্ত অষ্ট্রমূলীয় ভাষা সম্পর্কে অধ্যয়নও অনেক নতুন আলোর সন্ধান দিতে পারত।ভীমকান্ত বরুয়ার অসমর ভাষা’তে পূর্বোত্তরের সমস্ত ভাষা নিয়েও আলোচনা আছে।৪৯ মণিপুরি থেকে ককবরক,নাগামিজ এবং নেফামিজ নিয়ে ইনি অন্যতম বিশেষজ্ঞ পূর্বোত্তরে।কিন্তু মেঘালয়ের ভাষা প্রসঙ্গেও তিনি খাসি ভাষা নিয়ে আমরা সুনীতি চট্টোপাধ্যায় বা বাণীকান্ত কাকতির দিন থেকে যা জেনে এসছি তার থেকে একটিও বেশি বাক্য ব্যয় করেন নি অথচ ক্ষুদ্র হলেও খাসিয়া কিন্তু বর্তমান অসমেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা।রাষ্ট্রীয় এবং ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন এগুলোর পথে বাঁধা, তেমনি ভাষা-রাজনৈতিক পরিবেশও জটিলতা বাড়িয়ে রেখেছে। সেই পরিবেশ কাটিয়ে উঠতেও ভাষার অধ্যয়ন এক অন্যতম উপায় বলে বিবেচিত হতেই পারে।বিজ্ঞানবোধের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণার সংঘাত বেঁধে যাবার ভয়েও অনেকে অধ্যয়নে বিরত থাকেন। এই কথা অসমিয়ার সম্পর্কে তো বটেই,বাংলার সম্পর্কেও সমান সত্য।

 

।।  উল্লেখপঞ্জি ।।

১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:২১ নং গান, সংকলন: স্বদেশ;গীতবিতান;

     https://rabindra-rachanabali.nltr.org/node/4743

২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; প্রাগুক্ত।

৩) শ্রীচন্দ্র কান্ত মহন্ত:অসমর চমু ইতিহাস;ডিব্রুগড় বিশ্ববিদ্যালয়; প্রথম সংস্করণ; ১৯৭২;পৃ: ৭

৪) শ্রীচন্দ্র কান্ত মহন্ত; প্রাগুক্ত;পৃ: ৬

৫) নীহার রঞ্জন রায়:বাঙ্গালির ইতিহাস;প্রথম দেজ সংস্করণ;বৈশাখ,১৪০০ বাংলা;পৃ: ৬৯৮

৬) ড বাণীকান্ত কাকতি;অসমীয়া ভাষার গঠন আরু বিকাশ;বিশ্বেশ্বর হাজরিকার অনুবাদ;

    বাণীকান্ত কাকতি জন্মশতবার্ষিকী উদ̖যাপন সমিতি,বরপেটা;অক্টোবর,১৯৯৬;পৃ: ৪

৭) ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ: প্রথম সংস্করণের ভূমিকা;বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান; প্রধান

    সম্পাদক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ;প্রথম খণ্ড;বাংলা একাডেমী,ঢাকা,দ্বিতীয় মুদ্রণ,১৯৭৩;পৃ: ঢ।

৮) ভারত চন্দ্র রায় গুণাকর: অন্নদামঙ্গল; গুলাম মুরশিদের লেখা হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিগ্রন্থে

    সূচনা অংশে ব্যবহৃত উদ্ধৃতি;অবসর প্রকাশনা;জুন ২০০৬;ঢাকা;পৃ: ২৫

৯) অজ্ঞাত উৎস। ভাষা ও সাহিত্যের বহু ইতিহাসেই উদ্ধৃত হয়। আমরা নিয়েছি গুলাম মুরশিদের লেখা

    হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিগ্রন্থে সূচনা অংশের থেকে;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৩

১০) আহমদ শরীফের দাবি এই পঙক্তিগুলো কবি মুত্তালিব লিখেছেন ১৬৩৯-এ;গোলাম মুরশিদ মনে

      করেন,এটি কবি মুত্তালিবের কাব্যে এই কথাগুলো প্রক্ষিপ্ত হওয়াই সম্ভব। তাঁর মতে বাঙ্গালা

      কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন ভারত চন্দ্র) মুত্তালিবের কোনো গ্রন্থের সংবাদ নেই। গোলাম

      মুরশিদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৫

১১) কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম: চণ্ডীমঙ্গল;গোলাম মুরশিদের ব্যবহৃত উদ্ধৃতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ২২

১২) ভারত চন্দ্র  রায়গুণাকর;প্রাগুক্ত;পৃ: ২২

১৩) আব্দুল হাকিম:নূরনামা;গোলাম মুরশিদের ব্যবহৃত উদ্ধৃতি; প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪

১৪) আব্দুল হাকিম;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪

১৫) হুমায়ুন আজাদ:অবতরণিকা;বাঙালা ভাষাতত্ত্ব;বাঙলা ভাষা,প্রথম খণ্ড;আগামী প্রকাশনী;ঢাকা;

      ফেব্রুয়ারি,১৯৯৭;পৃ:১৮

১৬) হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯ 

১৭) Suniti Kumar Chatterji: Preface;The Origin and Development of the

      Bengali Language; Rupa & Co, Kolkata;1993;pg:xvi.

১৮) সুকুমার সেন:প্রবন্ধ; বিংশ পরিচ্ছেদ;বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস;চতুর্থ খণ্ড;আনন্দ প্রকাশনী;

      পৃ: ৪১৫

১৯) হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০

২০) George Abraham Grierson: Linguistic survey of India; Vol-V,Pt.1;

      Compiled and Edited by George Abraham Grierson; Calcutta : Office of

      the Superintendent of Government Printing, India, 1903-1928;pg:14;  

      http://dsal.uchicago.edu/books/lsi/

২১) হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২

২২) হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৮১

২৩) হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৮১

২৪)  হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৮১

২৫)  হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৮৮

২৬)  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:বাংলা ভাষা পরিচয়, ২১;রবীন্দ্ররচনাবলী;ত্রয়োদশ খণ্ড; ১২৫তম জন্মজয়ন্তী

       উপলক্ষে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ,বিশ্বভারতী;১৯৮৫;পৃ: ৫৯৯

২৭)  হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২১

২৮) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:শব্দতত্ত্ব;রবীন্দ্ররচনাবলী;ষষ্ঠ খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬০৮

২৯) রামেশ্বর শ’:ভাষাবিজ্ঞানে সাম্প্রতিক গবেষণার গতিপ্রকৃতি;সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা;

     পুস্তক বিপণি;কলকাতা০৯;১৩৯০ বাংলা;পৃ:৭২৪

৩০) হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৪

৩১) সুকুমার সেন:ভাষার ইতিবৃত্ত;আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড,কলকাতা-;প্রথম আনন্দ

      সংস্করণ,তৃতীয় মুদ্রণ,নভেম্বর,১৯৯৪;পৃ: ১৪৮

৩২) সুকুমার সেন; প্রাগুক্ত;পৃ:১৪৮

৩৩) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ:৭১২

৩৪) ড দেবব্রত শর্মা: (আগকথা)বৃহত্তর আরু মহত্তর অসমীয়া জাতি গঠনর অভিজ্ঞান;অসমীয়া জাতীয়

      অভিধান,প্রথম খণ্ড;সম্পাদনা ড দেবব্রত শর্মা;অসম জাতীয় প্রকাশ;যোরহাট; ২০১০;পৃ: ২৪

৩৫) ড প্রফুল্ল মহন্ত:মধ্যবিত্ত শ্রেণী আরু অসমর ভাষিক দুর্যোগ;লয়ার্স বুক স্টল;গুয়াহাটি ০১;দ্বিতীয়

      প্রকাশ,২০০৯;পৃ: ১৯২

৩৬) ড দেবব্রত শর্মা;প্রাগুক্ত;পৃ: 

৩৭) ড ভীমকান্ত বরুয়া:অসমীয়া ভাষাত রবিন্সন আরু ব্রাউনর ব্যাকরণ: লক্ষ্য আরু উদ্দেশ্য;অসমীয়া

      ভাষা;বনলতা,ডিব্রুগড়;দ্বিতীয় সংশোধিত প্রকাশ,২০০৬;পৃ:  ১৫৭

৩৮) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:ভাষাবিচ্ছেদ;শব্দতত্ত্ব;প্রাগুক্ত;পৃ: ৭৩৯

৩৯) ড মৃণাল কুমার গগৈ:অসমত ভাষা অধ্যয়নর ইতিহাস;এটি আভাস;ভাষা বিজ্ঞান আরু অসমীয়া

      ভাষার পরিচয়;শরাই ঘাট প্রিন্টার্স প্রকাশন; গুয়াহাটি;২০০৭; পৃ: ৯২

৪০) ড দেবব্রত শর্মা;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৫

৪১) Nathan Brown: Grammatical Notices of the Assamese Language;

     ‘অসমীয়া ভাষাত রবিন্সন আরু ব্রাউনর ব্যাকরণ : লক্ষ্য আরু উদ্দেশ্য’ অধ্যায়ে ডভীমকান্ত

      বরুয়ার উদ্ধৃতি;অসমীয়া ভাষা;প্রাগুক্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫৮

৪২) ড গোলক চন্দ্র গোস্বামী:অসমীয়া ব্যাকরণর মৌলিক বিচার;দ্বিতীয় সংস্করণ;বীণা লাইব্রেরী;  

      ১৯৯০;পৃ: ১০

৪৩) ড গোলকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৫৪

৪৪) ড ভগবান মৰল:অসমীয়া জাতীয় অভিধান আৰু বিকল্প বানান;আমাৰ অসম;৯ মার্চ, ২০১০;

                 অসমীয়া জাতীয় অভিধান,দ্বিতীয় খণ্ডে পুনর্মুদ্রিত;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৫

৪৫) সত্যনাথ বরা:পাতনি;বহল ব্যাকরণ; বরুয়া এজেন্সি,গুয়াহাটি-১;সেপ্টেম্বর,১৯৯২;পৃ: iii

৪৬) ডউপেন রাভা হাকাচাম: উত্তর-পূর্বাঞ্চলর ভাষাগত ক্ষেত্রত অসমর ভাষাসমূহর সহ-অবস্থান আরু

      অসমীয়া ভাষার  সমৃদ্ধি  সাধনত ইবিলাকর ভূমিকা;১ম অধ্যায়;অসমীয়া আরু অসমর ভাষা-

      উপভাষা;জ্যোতিপ্রকাশন;গুয়াহাটি- ০১;জুলাই  ২০০৯;পৃ: ৩

৪৭) ড রমেশ পাঠক:উপভাষা বিজ্ঞানের ভূমিকা;অসমত উপভাষার চর্চা;তৃতীয় অধ্যায়;উপভাষা

      বিজ্ঞানর ভূমিকা;অশোক বুকস্টল,গুয়াহাটি-০১;প্রথম প্রকাশ,২০০৮;পৃ: ১৫৯

৪৮) ড রমেশ পাঠক;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫৯

৪৯)  ভীমকান্ত বরুয়া: অসমর ভাষা;পঞ্চম পরিবর্ধিত সংস্করণ;জানুয়ারি ২০১০;বনলতা,ডিব্রুগড়।

 

~***~

 

 

Comments

Popular posts from this blog

।।রোমান হরফে বাংলা লেখার পুরাকথা । ।

।। অসমিয়া-বাংলা- সিলেটি লিপি ।। সপ্তম অধ্যায় ৷৷

।। অসমিয়া,মানবাংলা,সিলেটি এবং দু’একটি প্রতিবেশী ভাষা ও ভাষাবৈচিত্র্যের ধ্বনিতাত্ত্বিক তুলনা ।। তৃতীয় অধ্যায় ৷৷