।। ভাষাবৈচিত্র্য তথা উপভাষা বিজ্ঞানের আলোকে অসমিয়া ও বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপ বৈচিত্র্য ।। দ্বিতীয় অধ্যায় ৷৷

 ৷৷ অসমিয়া ভাষা এবং বাংলার সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্যের পারস্পরিক সম্পর্ক ৷৷
 ৷৷ একটি কালানুক্রমিক এবং কালিক অনুসন্ধান ৷৷ দ্বিতীয় অধ্যায় ৷৷

📚📚📚📚📚📚📚📚📚📚📚📚📚📚📚


(মূল গবেষণা  অভিসন্দর্ভে ‘উপভাষা’ শব্দটিই ছিল, ‘ভাষাবৈচিত্র্য’ ছিল না )

       


লিঙ্গুইস্টিক ডাইভার্সিটি ইন সাউথ এশিয়া(১৯৬০)বইতে ফার্গুসন উপভাষার একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন,         উপভাষা হচ্ছে কোনো ভাষার এক বা একাধিক বৈচিত্র্যের গুচ্ছ,যেগুলোতে বিদ্যমান থাকে একটি বা একগুচ্ছ সাধারণ বৈশিষ্ট্য,যা তাদের স্বতন্ত্র করে দেয় ভাষার অন্যান্য বৈচিত্র্য থেকে;এবং ঐ বৈশিষ্ট্যগুলোকে ভাষিক বা অভাষিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় একক রূপে(হুমায়ুন আজাদের অনুবাদ)পারিভাষিক শব্দ হিসেবে উপভাষা’ উনিশ শতকের আগে বাংলা বা কোনো ভারতীয় ভাষাতেই আসে নি।এটি গ্রীক ডায়ালেক্ট’ শব্দের ইংরেজি থেকে পেয়ে বাংলাতে অনুবাদ করে নেয়া হয়েছে।প্রাকৃতের বিভিন্ন বৈচিত্র্য সম্পর্কে অবহিত থাকলেও ভারতীয় বৈয়াকরণেরা সেগুলোকে উপভাষা’ বলে চিহ্নিত করবার দরকার মনে করেন নি।মাগধী,শৌরসেনী ইত্যাদি নামে প্রাকৃত’কে চিহ্নিত করতে দেখেছি।তবে আমাদের  মনে হয় এই প্রাকৃত’ বা প্রাক-ঔপনিবেশিক কালে বাংলা অসমিয়া পাঠে ব্যবহৃত ভাষা’,‘দেশী ভাষা’কেই উপভাষা’ শব্দের পূর্বসূরি বলে দাবি করতে পারি।যদিও তখন মানভাষা বলে একই ভাষা পরিবারের কিছু ছিল না।ছিল শুধুই ‘সংস্কৃত’‘সংস্কৃত’ আর ‘দেশীভাষা’ আজকের ধারণা অনুযায়ী দুই ভিন্ন ভাষা।উনিশ শতকের শেষে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রেরণাতে যেসব লেখালেখি হচ্ছে,সেখানে বহু রচনাতে আমরা দেশী’ বা গ্রাম্য’ কথাটার ব্যবহার দেখছি।ভারত চন্দ্র যখন ভাষা’ বলছেন তখন আদৌ সারা বাংলার ভূখণ্ডকে মনে রাখছেন না।ভূখণ্ড সম্পর্কে তাদের ভালো ধারণা ছিল কিনা সেই প্রশ্নও রয়েছে।তাঁরা নিজের বসত অঞ্চলের,বিশেষ করে যে সামন্ত শাসকের অধীনে থাকতেন তাঁর শাসনাধীন অঞ্চলে প্রচলিত ভাষা’র কথাই ভাবতেন।প্রাকৃত’ বা দেশী ভাষা’র সাহিত্যিক বা শোভন পরিবেশে ব্যবহারে তাঁদের দ্বিধা বা বাধার কথাটা আমরা বলে এসেছি।উপভাষা’ সম্পর্কেও আমাদের অবস্থান এরকমই এখনো।তাই সম্প্রতি উপজাতি’র মতো এই উপভাষা’ শব্দ ব্যবহারেও প্রতিবাদ হচ্ছে।উপজাতি শব্দের বিপরীতে জনজাতি’ শব্দটি হিন্দি অসমিয়াতে ব্যবহৃত হচ্ছে।বাংলাতেও অনেকে ব্যবহার করছেন। আমরা উপভাষা’র বিকল্প এখনো ভেবে পাই নি বলে ব্যবহার করব।তবে,ফার্গুসনের সংজ্ঞা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ভাষাবৈচিত্র্য’ বলে একটি সম্মানজনক শব্দজোড়ের কথা আমরা ভেবে রেখেছি,যে শব্দজোড় প্রায়ই ব্যবহার করব। 

আমরা সাহিত্যিক প্রাকৃতের কথা জানি,তেমনি ভারত চন্দ্রেরা যাকে ভাষা’ বলতেন তারও আঞ্চলিক বৈচিত্র্য সহ একটি সাহিত্যিক প্রতিরূপ সারা বাংলাতেই গড়ে উঠছিল।পাশাপাশি পূর্ববঙ্গ গীতিকা’তে সংকলিত পালাগান তথা মৌখিক সাহিত্য পরম্পরার কথা মনে রাখলে দেখব আঞ্চলিক ভাষাবৈচিত্র্য বেশ স্পষ্ট রেখেই সৃজনী সাহিত্যে হাত দিতে লেখকদের বাঁধছে না।সিলেটি নাগরিতে বেশ বড়সড় এক গীতি সাহিত্যের পরম্পরাও আমাদের মনে রাখতে হবে।‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’র কথা আমরা জানি।বঙ্কিমের এই বইয়ের ভাষাকে অনাদরের কথাও জানি।জানি,কেননা সেটি কলকাতাতে রচিত হয়েছিল।এবং বঙ্কিম যখন এর বিরোধিতা করেন তখন মান বাংলা’র আদর্শ স্থির করবার ভাবনা চিন্তা চলছে। সেখানে আলালের ঘরের দুলাল এবং হুতোম প্যাঁচার নকশাদুই বিকল্প আদর্শ বলে বিবেচিত হচ্ছিল। লেখক হিসেবেও হুতোম তথা কালিপ্রসন্ন সিংহ সেকালের অগ্রণী লেখকদের অন্যতম ছিলেনসেরকম ভাষাবৈচিত্র্য বহু রচনাতেই আজও নজরে আসে।নাটক,গল্প,উপন্যাসের সংলাপে এগুলোর ব্যবহার শুরু থেকেই হয়ে এসেছে।আমরা কিছু কিছু গুরুগম্ভীর সিলেটি কবিতারও সন্ধান পেয়েছি।বরাক উপত্যকাতে সম্ভবত বহু বিরতির পরে আইজও আন্ধাইর’ নাটকে সিলেটি সংলাপের ব্যবহার হয়েছিল।ত্রিপুরাতে ধর্মনগরে তার আগেই সত্তর আশির দশকেই রামকৃষ্ণ দেবনাথ দু’খানা নাটক লিখেছিলেন তুলে মূলে বিনাশ’ এবং হকুনর ছাও’দু’খানা নাটকই ছিল মঞ্চ সফল।সম্প্রতি আসামের দুটি উপন্যাসে অন্তত সংলাপভাগ সিলেটিতে রাখবার চেষ্টা হয়েছে।এর মধ্যে একটির নামই সুরমা গাঙর পানি’,অন্যটি সুরমা নদীর চোখের জল’এর মধ্যে প্রথমটি বেশ সার্থক রচনা বলে আমাদের মনে হয়েছে।দ্বিতীয়টির ভাষা অবিমিশ্র থাকে নি। যেরকম অবিমিশ্র থাকেনি সিলেটি নাগরি লিপিতে লেখা বিভিন্ন গীত বা আখ্যানকাব্যের ভাষা।তবু এই দুই উপন্যাস আমাদের অধ্যয়নে কাজে আসবে।আমরা ব্যবহার করব।এই উপন্যাস দু’টিকে আমাদের মনে হয়েছে অসমে সিলেটি’ ভাষা বৈচিত্র্য নিয়ে নতুন উৎসাহের চিহ্নায়ক।

বাংলার  সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্য নিয়ে অসমের বাঙালি যত না চর্চা করেছেন,বিদগ্ধ অসমিয়া পণ্ডিতেরা তার চেয়ে বেশি আলোচনা করেছেন আমরা ইতিমধ্যে দেখিয়েছি। সেপ্টেম্বর ২০১০এ প্রকাশিত ‘বাঙ্গালনামা’র দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যাতে প্রকাশিত ‘প্রসঙ্গ সিলেটি ভাষা’ নিবন্ধে সঞ্জীব দেব লস্কর লিখেছেন,“ইতিমধ্যে সিলেট মদনমোহন কলেজের প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ প্রণব সিংহ,বরাক উপত্যকার জন্মজিৎ রায়,আবুল হোসেন মজুমদার,উষারঞ্জন ভট্টাচার্য কিছু কাজ করেছেন,একটি সম্পূর্ণ অভিধান,বলা চলে কোষগ্রন্থই রচনা করেছেন জগন্নাথ চক্রবর্তী,আর আবিদরাজা মজুমদারের আরেকটি অভিধানও প্রকাশের পথেসঞ্জীব যাদের নাম করেছেন তাদের মধ্যে প্রণব সিংহের সঙ্গে বর্তমান লেখকের পরিচয় নেই।বাকিরা প্রত্যেকেই গবেষক-অধ্যাপক তথা শিক্ষক এবং বহু গ্রন্থের লেখক বটে।উষারঞ্জন অনুবাদ সাহিত্যে সাহিত্য একাদেমি পুরস্কারও পেয়েছেন এবং বর্তমান গবেষকের শিক্ষক।কিন্তু সম্ভবত কেউই পূর্ণকালীন ভাষা গবেষক নন। কেবলমাত্র ১৯৯৫তে প্রকাশিত  অধ্যাপক সুধাংশু শেখর তুঙ্গের লেখা ‘Bengali and Other Related Dialects of South Assam’একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।বইখানাতে তিনি কাছাড়ি বিভাষা,সঙ্গে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি,ধেয়ানি,হিন্দুস্তানী ইত্যাদি কাছাড়ে প্রচলিত বিভিন্ন ভাষার এক তুলনামূলক অধ্যয়ন করেছেন।এছাড়া,সম্প্রতি প্রকাশিত জগন্নাথ চক্রবর্তীর অভিধান দেখায় গুণগত ভাবে প্রয়াসগুলো যাই হোক না কেন,পরিমাণগত দিক থেকে তাঁর ভাষা অধ্যয়ন বেশ সুগভীর এবং আন্তরিক।যদিও তিনি বরাক বাংলা’ বলতে ঠিক কোনটিকে বোঝাতে চেয়েছেন সেই প্রশ্নটি অস্পষ্ট থেকেই গেছে।আবিদ রাজা মজুমদারের অভিধান বরাক উপত্যকার কথ্য বাংলার অভিধান’ ইতিমধ্যে বেরিয়েছে।তিনিও বইটির শুরুতে যে ভূমিকা লিখেছেন,সেখানে বরাক উপত্যকাতে প্রচলিত বাংলার ভাষা বৈচিত্র্যকে সিলেটি’ নামে চিহ্নিত করেন নি।এই দু’জন অভিধানপ্রণেতাই এই উপত্যকার প্রাক-বিভাজন সম্ভবত প্রাক-ঔপনিবেশিক  বাঙালি’ পরিবারের জাতক।এবং দু’জনেরই এই সিলেটি’ শব্দ ব্যবহারে অনীহা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।

          কোরক’ পত্রিকার প্রাক শারদ ১৪১৮ সংখ্যাতে  অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্য সিলেটি উপভাষা:প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ’ নামে একটি লেখাতে লিখেছেন,“…মনসুর মুসা,শিবপ্রসন্ন লাহিড়ি,আছদ্দর আলী,সৈয়দ মুর্তজা আলী,গোলাম কাদির প্রমুখ গবেষকেরা সিলেটি উপভাষা নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন।এমনকি প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী এবং অমিতাভ চৌধুরীও সিলেটি উপভাষা নিয়ে সুচিন্তিত প্রবন্ধ লিখেছেন।এছাড়া মুহম্মদ আব্দুল হাই-ও ‘Journal of the Asiatic Society of Pakistan’-এ(১৯৬৪) সিলেটি উপভাষা নিয়ে আলোকপাত করেছেনএই লেখক-গবেষকেরা প্রখ্যাত সব ব্যক্তিত্ব হলেও শিবপ্রসন্ন লাহিড়ি বা আব্দুল হাই-র মতো সবাই ভাষাবিজ্ঞানী নন।আমরা অমিতাভ চৌধুরীর একটি বাদ দিলে,বাকি রচনাগুলোর সন্ধান ভারতে করে উঠতে পারিনি। এঁদের অনেকেই বাংলাদেশের লেখক,এটাও একটা কারণ বটে।এছাড়াও  সুজিৎ চৌধুরীর বিখ্যাত সমাজ ভাষাবৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ বরাক উপত্যকার ভাষা:সত্য ও তথ্য’-এর উল্লেখ করতে পারিগুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিখিলেশ পুরকাইতের একটি রচনা আছে বাংলা অসমীয়া ও ওড়িয়ার উপভাষার ভৌগোলিক জরিপ’,যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৯তেসেটিও একটি দুর্লভ রচনা।সুকুমার সেন যে বাংলার উপভাষা জরিপ হয়নি’ বলে আক্ষেপ করেছিলেন,সেটি দূর করেছে এই বই।তাতে সিলেটি এবং কাছাড়ি ভাষাবৈচিত্র্য নিয়ে আলাদা করেই আলোচনা আছে।সিলেটি ভাষা বৈচিত্র্য নিয়ে বাংলা ভাষাতে হয়ে যাওয়া অধ্যয়নের একটা রূপ রেখা এতে পাওয়া যাচ্ছে।তবে একক ভাষা অধ্যয়নের নজির হিসেবে,অসমে অভিধান দু’টো ছাড়া বড়মাপের কাজ সেরকম নেই এটা স্পষ্ট।জগন্নাথের বইটির এক বড় অংশ জুড়ে আছে ব্যাকরণও। সুতরাং সেদিক থেকে এটি আমাদের অনেক কাজে আসছে বা আসবে।

            অবশ্য ইতিমধ্যে সঞ্জীব সঙ্গতকারণেই “...এ সময়ের কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে” অভিযোগ জানিয়ে লিখেছেন, “... এ উপভাষাকে একটা ভাষার স্খলন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতেও প্রয়াসী তিনি বেশ উৎসাহ ভরে লিখেছেন,                 “... এখন শিল্প সংস্কৃতির রাজধানী কলিকাতায় জিন্স পরা ইলেকট্রনিক যন্ত্র হাতে নাগরিক ব্যান্ডের শিল্পীরা (দোহার: বর্তমান গবেষক) দুনিয়ার যত বাঙাল কবির পদ গেয়ে আসর জমিয়ে রাখছে।সিলেটি হাসন রাজাকে তো কবিগুরু অনেক আগেই জগৎ সভায় প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন। ...আমাদের ভাষাপৃথিবীর এই যে বিস্তৃতির সূচনা,এটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে বিভিন্ন ঔপভাষিক অঞ্চলের বাঙালিদের সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজনকিন্তু এর পরেই লিখলেন,“এ অবস্থায় বরাক উপত্যকার বাঙালিরা সিলেটি ভাষা,অর্থাৎ উপভাষা নিয়ে অতি উৎসাহী হলে,এদের ভাষিক অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে সদা সচেষ্ট এক শ্রেণির অসমিয়া নেতৃত্ব একটা বিশেষ মওকা পেয়ে যেতে পারেন এই শেষোক্ত মন্তব্য একটি ধোঁয়াশা তৈরি করেএটি বরাক উপত্যকার বিদ্যায়তনিক মহলে একটি প্রতিষ্ঠিত অভিমত।এক গড়ে তোলা চিহ্ন বিশেষ।এই ভয়ের স্পষ্ট কারণ হলো,সিলেটি আর অসমিয়ার মধ্যেকার মিলগুলো খুবই চোখে পড়বার মতোসেই জন্যেই সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ছাত্র বাণীকান্ত কাকতি বাদে প্রায় সমস্ত অসমিয়া ভাষাতাত্ত্বিক সিলেটিকে অসমিয়া বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করেন।এই তালিকাতে শেষতম সংযোজন ড উপেন রাভা হাকাচাম 

             অসমিয়ারা উপভাষাটিকে দখল করে নেবেন এই ভয়ে সিলেটি নিয়ে বেশি চর্চা না করবার,নাটকে,গল্পের সংলাপে সিলেটি ব্যবহার না করবার,রেডিও,টিভিতে সিলেটি ব্যবহার না করবার পরামর্শ বরাক উপত্যকার বেশ খ্যাতনামা বিদগ্ধজনেরা দীর্ঘদিন ধরে দিয়ে আসছেন। যে চিহ্নায়নের প্রতাপেই অসম তথা বরাক উপত্যকাতেই,শুধু যে এই ভাষাবৈচিত্র্য নিয়ে তাই নয়,সামগ্রিক ভাবেই ভাষা নিয়ে বাংলাতে অধ্যয়ন হয়েছে অতি অল্প।১৯শের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস কতটা সঠিক ভাবে কে লিখলেন তাই নিয়ে সেখানে রীতিমত প্রতিযোগিতা চলে,হয় না শুধু ভাষা নিয়ে কোনো অধ্যয়নের প্রয়াস।অথচ,গোটা পূর্বোত্তরের অঙ্গ হিসেবে বরাক উপত্যকাও যেহেতু এক বহু ভাষিক অঞ্চল ভাষা গবেষণার পক্ষে অঞ্চলটি প্রায় অনাবিষ্কৃত সোনার খনি।ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতেও গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কারো কারো বাইরে বাংলা ভাষাবৈচিত্র্য নিয়ে এবং সাধারণ ভাবেই বাংলাভাষাতে অধ্যয়ন অতি সামান্যই। 

এই যে সঞ্জীব লিখলেন,‘এক শ্রেণির অসমিয়া নেতৃত্ব একটা বিশেষ মওকা পেয়ে যেতে পারেন’--- চিহ্নায়নের এমন প্রক্রিয়াতে আমরা যে অসমিয়া ভাষাতাত্ত্বিকদের এমন মওকা’ দিয়েই বসে আছি,এই সত্যও মনে হয় না বরাকের অনেকে জানেন।বর্তমান লেখকের ধারণা সিলেটে যারা সিলেটিকে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছেন তারাও ভাষাটি নিয়ে বেশ গভীরে গিয়ে কিছু কাজ করছেন। দেশে না পারুন,বিলেতে তারা স্কুলে কলেজেও ভাষাটাকে শেখাবার কাজ করে ফেলছেন।সঞ্জীব,এদের পেছনে কিছু সন্দেহজনক চক্রও সক্রিয়” থাকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।অথচ সঠিক অবস্থান হতো,এই প্রবণতার সমাজতাত্ত্বিক কারণ অনুসন্ধান করা।সংশয়বাদ নতুন চিন্তার পথ খুলে দেয় বটে,কিন্তু সেই সংশয় যদি জিজ্ঞাসাকেই না জাগালো,তবে তা নতুন চিন্তার পথ রুদ্ধও করে দেয়কোনো চক্র’ নিয়ে সন্দেহটা চরিত্রগত দিক থেকে ভাষাতাত্ত্বিক নয়,রাজনৈতিক।এমন বৈদগ্ধ্য যেমন নিজের দৌর্বল্যকে প্রকাশ করে,তেমনি যার সঙ্গে মিতালি করে নিজের পথ করে নেয়াটা খুবই সহজ তাকেই ঠেলে দেয় অহেতুক শত্রু পক্ষে।একটা অবৈরি দ্বন্দ্বকে করে রাখে বৈরি।  

কিছু অসমিয়া ভাষাতাত্ত্বিক সিলেটিকে অসমিয়া বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করেন,যদি এইমাত্র অপরাধে তাঁদের আমরা সুযোগসন্ধানী’ বলে ঔদাসীন্য প্রকাশ করে থাকি,তবে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেও একই কাজ করতে হয়।বিশেষ করে অসমিয়ারা তাঁর সম্পর্কে এই ধারণা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করতেই পারেন।তিনি একবার লিখেছিলেন,“সেইজন্য বলিতেছিলাম,আসাম ও উড়িষ্যায় বাংলা যদি লিখন পঠনের ভাষা হয় তবে তাহা যেমন বাংলাসাহিত্যের পক্ষে শুভজনক হইবে তেমনিই সেই দেশের পক্ষেও।কিন্তু ইংরেজের কৃত্রিম উৎসাহে বাংলার এই দুই উপকণ্ঠবিভাগের একদল শিক্ষিত যুবক বাংলাপ্রচলনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহধ্বজা তুলিয়া স্থানীয় ভাষার জয়কীর্তন করিতেছেনএই পর্যন্ত মনে হবে রবীন্দ্রনাথ নির্ভেজাল বাংলার পক্ষে বলছেন,আর কারো বিরুদ্ধে নয়।তার পরেই লিখছেন,“এ কথা আমাদের স্মরণ রাখা উচিত যে, দেশীয় ভাষা আমাদের রাজভাষা নহে,যে-ভাষার সাহায্যে বিদ্যালয়ের উপাধি বা মোটা বেতন লাভের আশা নাই।অতএব দেশীয় সাহিত্যের একমাত্র ভরসা তাহার প্রজাসংখ্যা,তাহার লেখক ও পাঠক-সাধারণের ব্যাপ্তি।খণ্ড বিচ্ছিন্ন দেশে কখনোই মহৎ সাহিত্য জন্মিতে পারে নাতাহা সংকীর্ণ গ্রাম্য প্রাদেশিক আকার ধারণ করেতাহা ঘোরো এবং আটপৌরে হইয়া উঠে,তাহা মানব-রাজদরবারের উপযুক্ত নয়১০ অর্থাৎ তিনি অসমিয়া ওড়িয়ার মত ভাষাকে সাহিত্য চর্চার ভাষা বলেই ভাবছেন নারচনাটি অবশ্যি পরে পরিত্যক্ত হয়ে শব্দতত্ত্ব’-এর পরিশিষ্টে যুক্ত হয়েছে। আমরা,মনে হয় না একুশ শতকে এসেও,রবীন্দ্রনাথের ফেলে আসা চিন্তার থেকে বেশি এগোতে পেরেছি বলেএইখানে একটি কথা লক্ষ্য করবার মতো, রবীন্দ্রনাথ ‘দেশীয় ভাষা’ কথাটি ‘উপভাষা’ বা ‘ভাষাবৈচিত্র্য অর্থেই ব্যবহার করছেন।দুটো ভাষার মধ্যে মিল দেখে যদি,অসমিয়ারা বলতে শুরু করেন যে সিলেটি অসমিয়ারই ভাষাবৈচিত্র্য তবে ওই একই যুক্তিতে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের দাবিটিও দিব্বি দাঁড়িয়ে যায়।আর অসমিয়া হয়ে যায় বাংলা ভাষা,বাংলা হয়ে যায় হিন্দি, হিন্দি হয়ে যায় উর্দু!উর্দু হয়ে যায় পার্শি।এমন হালকা যুক্তি,এক করে না।সাময়িক ভাবে ভয়ে আতঙ্কে একাকার করে রাখতে পারে।কিন্তু ভেতরে ভেতরে এই যুক্তিগুলো যে কেমন প্রবল বিভেদের বীজ বপন করে তা আমরা অসম,বাংলাদেশ,পশ্চিম বাংলা তথা উপমহাদেশের রাজনীতিতে বহুবার দেখেছি,আগামী দিনগুলোতেও আরো অনেক দেখতে পাব।

         একালের এক বিদগ্ধ বাঙালি ভাষাবিদ পবিত্র সরকার এক জায়গাতে লিখেছেন,“যারা মনে করে,যে ভাষাটা বলছি সেটা বাংলা,সেটা আমার পরিচয়,তারাই বাঙালি১১ কিন্তু এর পরেই তিনিই আবার উলটো লিখেছেন,“কেউ কেউ বাংলা’ নামটা জানেন না,কিন্তু তাঁদের ভাষা যদি পণ্ডিতের বিচারে ব্যাপক বাংলার অন্তর্গত হয়,তাঁরাও বাঙালি১২ সেই কেউ কেউ যদি ব্যক্তি বা শ্রেণি হন,তবে আমাদের আপত্তি করবার কিছু থাকে না।কিন্তু যখন একটি পুরো জনগোষ্ঠী হয়, সমস্যা তখনই দাঁড়ায়।রাজবংশীদের বাংলাভাষা বৃত্তের থেকে আলাদা হয়ে যাবার প্রবণতাকে অন্যত্র তিনি শিক্ষবিস্তারের অসম্পূর্ণতার প্রমাণ’১৩ হিসাবে দেখিয়েছেন।একই কথা কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অসমিয়ার সম্পর্কেও বলতে পারতেন।রাজবংশী সম্পর্কে অধিকাংশ বাঙালি গবেষকের অবস্থান এখনো একই রকম।এই যে অসমিয়া,বাংলা,হিন্দি,উর্দু কিংবা পার্শি ---এগুলোর আলাদা ভাষানাম হবার কারণটাই তো এই যে ওদের মধ্যে প্রচুর মিল থাকা সত্ত্বেও কিছু অমিল রয়েছে যেগুলো নির্ধারক।এদের কেবল গঠন নয়,ভূগোল এবং ব্যবহারকারীদের সাংস্কৃতিক,রাজনৈতিক ইতিহাস নির্ধারণ করে ওরা স্বতন্ত্র নামে পরিচিত হবে না একই নামে।অসমীয়া আরু তিব্বত বর্মীয় ভাষা' বইতে উপেন রাভা হাকাচাম লিখেছেন,“ভাষা-বিজ্ঞানর সহজ-সূত্রতে সীমাবদ্ধ না থাকি দুটা ভাষার আংশিক সাদৃশ্য দেখিলেই ইটো ভাষা যে সিটোতকৈ অধিক সমৃদ্ধশালী তাক জাহির করার প্রবণতাই নির্মোহ আলোচনার ব্যাঘাত ঘটাইছে১৪এই একই কথা তো কেবল ভাষাগত গঠন দেখিয়ে দুটো ভাষার এক নামে চিহ্নিত করে ফেলবার প্রয়াস যারা করেন তাদের বেলায়ও খাটে।এমন প্রয়াস কেবল ভাষাতত্ত্বেরই বিরোধী নয়,এই প্রয়াস রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক এবং ভৌগোলিক ইতিহাসেরও বিরোধী বটে।পবিত্র সরকার কথিত ‘পণ্ডিতি বিচার’ দুই ভাষার শব্দের সাদৃশ্যে শেষ হয় না।সংস্কৃতের থেকে বাংলার তথা বাংলা ব্যাকরণের তফাত প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,“বস্তুত প্রত্যেক ভাষার নিজের একটা ছাঁচ আছে।উপকরণ যেখান হইতেই সে সংগ্রহ করুক,নিজের ছাঁচে ঢালিয়া সে তাহাকে আপনার সুবিধামত বানাইয়া লয়। সেই ছাঁচটাই তাহার প্রকৃতিগত,সেই ছাঁচেই তাহার পরিচয়।উর্দুভাষায় পারসি আরবি কথা ঢের আছে,কিন্তু সে কেবল আপনার ছাঁচেই চতুর ভাষাতত্ত্ববিদের কাছে হিন্দির বৈমাত্র সহোদর বলিয়া ধরা পড়িয়া গেছে।আমাদের বাঙালি কেহ যদি মাথায় হ্যাট,পায়ে বুট,গলায় কলার এবং সর্বাঙ্গে বিলাতি পোশাক পরেন,তবু তাঁহার রঙে এবং দেহের ছাঁচে কুললক্ষণ প্রকাশ হইয়া পড়ে। ভাষার সেই প্রকৃতিগত ছাঁচটা বাহির করাই ব্যাকরণকারের কাজ।বাংলায় সংস্কৃতশব্দ ক’টা আছে, তাহার তালিকা করিয়া বাংলাকে চেনা যায় না,কিন্তু কোন বিশেষ ছাঁচে পড়িয়া সে বিশেষরূপে বাংলা হইয়া উঠিয়াছে,তাহা সংস্কৃত ও অন্য ভাষার আমদানিকে কী ছাঁচে ঢালিয়া আপনার করিয়া লয়,তাহাই নির্ণয় করিবার জন্য বাংলা ব্যাকরণ১৫

রবীন্দ্রনাথ যে ভাষার ছাঁচ’-এর কথা লিখেছেন,সেখানেও কিন্তু ব্যাকরণের সমস্যার সমাধান হলেও অনেক সময় মূল ভাষা-রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয় না।কারণ ভাষা-উপভাষার  মধ্যে প্রভেদরেখাটি সত্যি এক বিশেষ স্থানে কালে মনে হয় যেন যে কোনো সাধারণ ভাষাবৈজ্ঞানিক বিতর্কের বাইরে বেরিয়ে যায়।এক বিশেষ সময়ে দাঁড়িয়ে ভাষার দিকে তাকালে ‘ভাষা-উপভাষা’র প্রভেদটি যতটা স্পষ্ট বলে মনে হয়,কালক্রমের দিকে তাকালে কিন্তু ততটাই অস্পষ্ট হয়ে পড়েঅন্যথা,এই অব্দি যে তর্কগুলোর কথা লিখে এলাম সেসব কোনো সমস্যাই হত না।এমন কি,মনোএল দ্য আসসুম্পসাউ যখন প্রথম অভিধান তৈরি করেন,তিনিও আজকের মান বাংলা বা সাহিত্যের সাধারণ সাধু বাংলা ছেড়ে ঢাকার ভাষাকে আশ্রয় করতেন না।কাকে বলা হবে মান বাংলা,কী হবে তার রূপ এই নিয়ে গোটা উনিশ শতকে এবং বিশ শতকের প্রথমভাগের সংগ্রাম এবং প্রয়াসগুলোর কথা আমরা লিখে এসেছি। ভেবে দেখলে দেখা যাবে,যে ছিল ‘দেশীভাষা’ বলে উপেক্ষিত একটি ভাষার মর্যাদার জায়গাটিও আসলে তখন তৈরি করা হচ্ছে।তাই ‘সাধু’,‘চলতি’ ছাড়াও ‘মান’,‘মান্য’ কি ‘প্রমিত’ কোন বিশেষণটি তার আগে ব্যবহৃত হবে এই নিয়েও একটি তর্ক লেগেই ছিল।প্রতিটি শব্দের ব্যঞ্জনাও ভিন্ন।বিশেষ করে ‘মান’ বললে যদিও বা বুঝি বৃহত্তর পরিসরে ব্যবহৃত একটি সাধারণ ভাষা,মান্য বললে বুঝি মর্যাদাসম্পন্ন ভাষাও।অর্থাৎ ‘দেশী ভাষা’ বলে তাকে আর উপেক্ষা করা যাবে না।সভায় সমিতিতে,শিক্ষায়-সাহিত্যে, অফিসে আদালতেও এই ভাষাটি শুধু ব্যবহার করা হবে তাই নয়,ব্যবহার করাতে লজ্জারও কিছু থাকবে না।আরেকভাবে বললে,বলবার ভাষা হিসেবে বাকি ভাষাবৈচিত্র্যগুলো থাকলেও লেখার ভাষা হিসেবে এই ভাষাটিই চলবে।এটি একটি নির্মাণ।এই নির্মাণগুলোর পাশাপাশিই আসলে গড়ে উঠেছিল নির্মাণ-তত্ত্বগুলোওবাংলাতে,অসমিয়াতে এবং বাকি বিশ্বের অন্যভাষাতেও।তাতে অপেক্ষা-উপেক্ষার পুরোনো সংস্কারগুলোও কাজ করছিল।ফলে মান বাংলা যখন গড়ে তোলা হচ্ছিল তার জন্যে সম্মানের জায়গাটি তৈরি করবার সঙ্গে সঙ্গে যে কিছু ভাষাবৈচিত্র্যের সে সাধারণ প্রতিনিধিত্ব করবে তার জন্যে একটি অসম্মানের জায়গাও তৈরি করবার ফাঁদ থেকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেন নি। রবীন্দ্রনাথের এই সামান্য কথাতেই আমরা দেখব নানা জটিলতা,“নানা জেলায় ভাষার নানা রূপ।এক জেলার ভিন্ন অংশেও ভাষার বৈচিত্র্য আছে।এমন অবস্থায় কোথাকার ভাষা সাহিত্যে প্রবেশ লাভ করবে তা কোনো কৃত্রিম শাসনে স্থির হয় না,স্বতই সে আপনার স্থান আপনি করে।কলকাতা সমগ্র বাংলার রাজধানী।এখানে নানা উপলক্ষে সকল জেলার লোকের সমাবেশ ঘটে আসচে।তাই কলকাতার ভাষা কোনো বিশেষ জেলার নয়।স্বভাবতই এই অঞ্চলের ভাষাই সাহিত্য দখল করে বসেচে।যেটাকে লেখ্য ভাষা বলি সেটা কৃত্রিম,তাতে প্রাণপদার্থের অভাব,তার চলৎশক্তি আড়ষ্ট,সে বদ্ধ জলের মতো,সে ধারা জল নয়।তাতে কাজ চলে বটে কিন্তু সাহিত্য শুধু কাজ চলবার জন্যে নয়,তাতে মন আপনার বিচিত্র লীলার বাহন চায়।এই লীলাবৈচিত্র্য বাঁধা ভাষায় সম্ভব হয় না।এইজন্যেই কলকাতা অঞ্চলের চলতি ভাষাই সাহিত্যের আশ্রয় হয়ে উঠেচে।একদা যখন সাধু ভাষার একাধিপত্য ছিল তখনো যে কোনো জেলার লেখক নাটক প্রভৃতিতে কলকাতার কথাবার্তা ব্যবহার করেচেন,কখনোই পূর্ব বা উত্তর বঙ্গের উপভাষা ব্যবহার করেন নিস্বভাবতই কলকাতার চলতি ভাষা তাঁরা গ্রহণ করেচেন।এর থেকে বুঝবে সাহিত্য স্বভাবতই কোন্‌ প্রণালী অবলম্বন করেচে।”১৬ তিনি যখন  কলকাতার কথা লিখছেন,শহরটির বয়স দুই শতকের বেশি নয়।এটি নতুন উপনিবেশের রাজধানী।বাংলার আগেকার রাজধানী বা প্রাচীনতর শহরগুলোরও এ শহর নয় কোনো ধারাবাহিকতাকয়েকটি গ্রাম মিলে ব্রিটিশ সওদাগরদের তৈরি শহর। রাজধানী হবার সুবাদে সারা বাংলার মানুষ এই শহরে যাতায়াত করেন।সুতরাং এই শহরের কোনো নিজস্ব-ভাষারূপ নেই-- বলে বিবাদভঞ্জনের একটি প্রয়াস আছে।কিন্তু তিনি ‘কৃত্রিম’ বলে একটি ‘লেখ্যভাষা’কে বাতিলও করছেন। সেটি যে উনিশ শতকে গড়ে তোলা ‘সাধু ভাষা’ সেই ইঙ্গিত এখানেই রয়েছে।মনে হবে বুঝিবা তিনি মুখের ভাষার জয় ঘোষণা করছেন।কারণ ‘লেখ্য ভাষা’তে তো ‘প্রাণপদার্থের অভাব,তার চলৎশক্তি আড়ষ্ট,সে বদ্ধ জলের মতো’ কিন্তু গোটা কথার ব্যঞ্জনার্থটি এই যে তিনি আসলে পুরোনো লেখার ভাষাকে নতুন কলকাতার মুখের ভাষা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে চাইছেন।এখানে প্রতিপক্ষটি আগেকার সাধুভাষা।স্বপক্ষ এবং মর্যাদাসম্পন্ন ভাষাটি হচ্ছে কলকাতার লোকের মুখের ভাষা, যে কলকাতাতে নানা জেলার নানা ভাষারূপের সমাবেশ ঘটছে।যদিও এখানেও পূর্ব এবং উত্তর বঙ্গের ভাষারূপগুলোকে বাতিল করছেন,সাহিত্যে ব্যবহারের ভাষা হিসেবে।কিন্তু অন্যত্র দেখব তিনি ‘নির্মাণ’ কথাটি সরাসরিই ব্যবহার করছেন,এবং সেই নির্মাণে তাঁর সমস্যা হচ্ছে সেই সব মুখের ভাষাগুলো নিয়েই। সেগুলো এখানে তাঁর প্রতিপক্ষ।তিনি লিখছেন,“আমাদের চলিত ভাষামূলক আধুনিক সাহিত্য ভাষার আদর্শ এখনো পাকা হয় নি বলে লেখকদের রুচি ও অভ্যাস-ভেদবশত শব্দব্যবহার সম্বন্ধে যথেচ্ছাচার আছে।আরো কিছুকাল পরে তবে এর নির্মাণকার্য সমাধা হবে।তবু আপাতত আমি নিজের মনে একটা নিয়ম অনুসরণ করি।আমার কানে যেটা অপভাষা বলে ঠেকে সেটাকে আমি বর্জন করি।‘ভিতর’ এবং ‘ভেতর’ ‘উপর’ এবং ‘ওপর’ ‘ঘুমতে’ এবং ‘ঘুমুতে’ এই দুইরকমেরই ব্যবহার কলকাতায় আছেকিন্তু শেষোক্তগুলিকে আমি অপভাষা বলি।‘দুয়োর’ কথার জায়গায় ‘দোর’ কথা ব্যবহার করতে আমার কলমে ঠেকে।কলকাতার ‘ভাইয়ের বিয়ে’ না বলে কেউ কেউ ‘ভেয়ের বে’ কিংবা ‘করলুম’--এর জায়গায় ‘কন্নু’ বলে,কিন্তু এগুলিকে সাহিত্যে স্বীকার করতে পারি নে।গুছুতে,রেতের বেলা প্রভৃতি ব্যবহার আজকাল দেখি,কিন্তু এগুলিকে স্বীকার করে নিতে পারি নে১৭‘দেশীয় ভাষা’,‘উপভাষা’র বদলে এবারে ব্যবহার করলেন ‘অপভাষা’এভাবেই ‘উপভাষা’ সম্পর্কে নানা অপমানজনক ধারণা বাংলাতেও অন্যত্রও গড়ে ওঠে।‘বিকৃতভাষা’,‘হীনতরভাষা’ এই সব ধারণাও সাধারণ্যে জায়গা পেতে থাকে।এমন কি অনেকে তো এমন ধারণাও পোষণ করতে শুরু করেন যেন ‘উপভাষা’গুলোর উৎপত্তি এই সব মান ভাষার থেকেই।অর্থাৎ মান বাংলার থেকেই যেন ভাষা-বিকৃতির ফলে সিলেটি,ঢাকাইয়া ইত্যাদি ভাষারূপ এসেছে,যখন কিনা বাস্তবে ঘটনাক্রম তার বিপরীতেই ঘটে থাকে।অর্থাৎ মানভাষাটিকেই আসলে গড়ে তুলে তার ‘উপভাষারূপ’গুলো।রবীন্দ্রনাথের কথাতে সেই ইঙ্গিতটিই রয়েছে।একটি ভাষারূপকে সে ভিত্তি হিসেবে বেছে নেয়,বাকিগুলো তাকে নানা সাজে নানা সময় ধরে সাজাতে থাকে।বাংলা বা মান অসমিয়ার ক্ষেত্রেও ঘটনা এরকমই ঘটেছে।‘উপভাষা’গুলোকে তাই বলা চলে ‘সহযোগী ভাষা’তবে মান ভাষার থেকে উপভাষার উদ্ভবের ধারণাও একেবারে ভিত্তিহীন নয়। সেটি সাধারণত ঘটে বিস্তৃততর স্থানান্তরে এবং দীর্ঘতর কালান্তরে।তারও অনেক কিছুই ধারণানির্ভর। যেমন আমরা যখন বলি মাগধী অবহঠ̖টের থেকে বাংলা-অসমিয়া-বিষ্ণুপ্রিয়া-ওড়িয়া ইত্যাদি ভাষারূপ এসেছে তখন আসলে মান ভাষার থেকে উপভাষা উদ্ভবের ধারণাটিই সমর্থিত হয়,এর উল্টোটা নয়।বাংলা-অসমিয়া আদি হচ্ছে মাগধী অবহঠ̖টের উপভাষা।অথচ তার মানভাষারূপটির সঙ্গে কিন্তু আমাদের কোনো পরিচয় নেই।এটি ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের অনুমান মাত্র।ফলে সাধারণ্যে উদ্ভবের এই দ্বিমুখী তত্ত্ব গুলিয়ে যায়,সেই ঘটনা যখন বৌদ্ধিক স্তরে ঘটে সমস্যা তখনই দেখা দেয়।এমনতর গুলিয়ে যাওয়া ভাবনার বিস্তারেই বহু বিদগ্ধ বাঙালিও এখনো বিশ্বাস করেন,বাংলার থেকেই অসমিয়া এসেছে।তাদের মধ্যে তর্ক থাকে শুধু আসবার সময়টি নিয়ে। সেটি দশম শতকে না ষোড়শ শতকে না উনিশ শতকে।

গ্রীক ভাষার ‘dialektos’ কথাটিকে অনুবাদে উপভাষা’ করে নেয়া হয়েছিল।কিন্তু ডায়ালেক্টোস’ কথাটির উৎপত্তিকালে তার সম্পর্কে গ্রীকদের যে ধারণা ছিল তার সঙ্গে আজকের ধারণার কোনো মিল নেই।প্রাচীন গ্রীসের এক এক অঞ্চলের নামে এক এক ভাষারূপ প্রচলিত ছিল,আর সবগুলোতেই সাহিত্য তৈরি হত।মূলে সেগুলো মুখের ভাষা হওয়াই সম্ভব,যদিও হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন সেগুলো মুখের ভাষা ছিল না।এক এক রকমের রচনাতে এক এক ভাষা ব্যবহৃত হত।১৮ ইতিহাস লিখতে ইওনিক’, গীতিকবিতা লিখতে দোরিক’, ট্র্যাজেডিতে আত̖তিক’ ইত্যাদি।কিন্তু কালে সেই সব ভাষাবৈচিত্র্য সাহিত্যের থেকে বিদেয় নেয়।এথেন্সের ভাষার উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠে কোইনি’ ভাষারীতি। হেলেনীয় কালে সেটিই গ্রীকভাষা বলে পরিচিতি পায়।বুঝা যায় এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এথেন্সের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সংগ্রামেও বিজয়ের একটি কাহিনি।তাতে করে কি বলা যাবে আগেকার সেই উপভাষাগুলো দুর্বল ছিল? সবগুলোই তো ছিল সাহিত্যের ভাষা।আমাদের দেশের সাহিত্যিক প্রাকৃতের কাহিনিও অনেকটাই তাই।এক একটি অঞ্চলের নামে পরিচিত হলেও সেই অঞ্চলেই সেগুলোর ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিল না।সংস্কৃত সাহিত্যেই শিক্ষিতা (বলা ভালো উচ্চবর্ণের) নারী,বিদূষক ও অশিক্ষিত পুরুষ চরিত্রের মুখে শৌরসেনী ব্যবহার করতেন,অশিক্ষিত অব্রাহ্মণ, অক্ষত্রিয় চরিত্রের মুখে বসাতেন মাগধী প্রাকৃত ইত্যাদি।এগুলোরও ছিল আরো ভাষাবৈচিত্র্য।সুকুমার সেন লিখেছেন, শাকারী,চাণ্ডালী,শাবরী ইত্যাদি ছিল মাগধীর বিভাষা।১৯ মাহারাষ্ট্রীর আবার সংস্কৃত সাহিত্যের শ্রেণি বিশেষের বাইরেও স্বতন্ত্র সাহিত্যের ভাষা হিসেবে ব্যাপক ব্যবহার ছিল।একে মান ভাষার মর্যাদাই দেওয়া হত।২০এগুলো তো উপভাষা’ই ছিল,যে গুলোর থেকে কিনা আবার আধুনিক ভারতীয় মান ভাষাগুলো এসেছে। সেগুলোকে দুর্বল,হীনতর,বিকৃত ভাষা কী করে বলা চলে? তাই আধুনিক ভাষা বিজ্ঞান এমন কোনো ভাষারূপের অস্তিত্ব স্বীকার করে না,যা সহজাতভাবেই বা আন্তরশক্তিতেই দুর্বল।কিন্তু মান ভাষামাত্রেই যে বিকাশের সমান স্তরে নেই,সেই কথাই বা অস্বীকার করা যাবে কী করে? সাম্প্রতিক বিশ্বে যে ফরাসী বা ইংরাজির সঙ্গে বিকাশের সমান স্তরে বাংলা বা অসমিয়া নেইএই সত্য মনে হয় যে কোনো অসমিয়া বা বাঙালিও স্বীকার করবেন।কিম্বা অসমেই এমন বহু স্বতন্ত্র ভাষা আছে যেগুলো প্রশাসনিক কাজেকর্মে বা শিক্ষার প্রসারে ব্যবহৃত হওয়া তো দূর,সাহিত্যিক সম্পদও বাংলা বা অসমিয়ার সমানে নেই।এই ঘটনাগুলোর জন্যে ভাষার অভ্যন্তরীণ কোনো দোষ কিম্বা গুণ দায়ী নয়।এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নানা আর্থ-রাজনৈতিক এবং সামাজিক ইতিহাসের অনুষঙ্গ।অসমের সরকারি ভাষাবিবাদগুলোর কথা মনে আনলেই আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট হবে।ভাষা-উপভাষার যে বিতর্কগুলো ভাষাবিজ্ঞানের সীমা অতিক্রম করে সাধারণ্যে বেরিয়ে পড়ে, সেখানেও সেই সব অনুষঙ্গই সক্রিয় হয়।

মাগধীর থেকে বাংলা অসমিয়া ভাষারূপগুলো আসবার প্রক্রিয়াতে আজ আর আমরা কোনোরকম হস্তক্ষেপ করতে পারি না।একটি মান ভাষার থেকে একে বলতে পারি নিম্নমুখী উদ্ভবের প্রক্রিয়া।এ অনেকটা বংশ বিস্তারের মতো বিষয়,আমরা স্থির করতে পারি না আমাদের পূর্বসুরি কে বা কারা হবেন।যদিও মাগধি না কামরূপীর থেকে বাংলা অসমিয়া এসেছে,সেই নিয়ে একটি তর্ক আছে,সে নিতান্তই নামবিতর্ক।ভাষারূপের বিতর্ক নয়।কিন্তু অসমিয়া বাংলার থেকে এসেছিল কিনা,সিলেটি অসমিয়া হয় কিনা এই যে বিতর্ক---এটা সম্ভব হয় মান ভাষারূপের ঊর্ধ্বমুখী উদ্ভবের প্রক্রিয়ার ফলে।এ অনেকটা পরিবার গড়ে তুলবার স্বেচ্ছাপ্রয়াসের মতো।অর্থাৎ বহু সময় ভাষাবৈচিত্র্যগুলোর ব্যবহারী মানুষজনই ঠিক করেন তারা কোনো এবং কোন ভাষাপরিবারের সদস্য হয়ে থাকবেন,কি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে নিজের অস্তিত্বকে ঘোষণা করবেন।হুমায়ুন আজাদ তাই লিখেছিলেন,“তাই প্রত্যেক উপভাষাই ভাষা,কিন্তু ভাষামাত্রেই উপভাষা নয়২১ অসমিয়াকে যে বাংলার উপভাষা’ হিসেবে কেউ কেউ চেষ্টা করেও ধরে রাখতে পারলেন না,বা সিলেটিকে অসমিয়া পরিবারে টেনে নিতে পারলেন না,অথবা সম্প্রতি যে কেউ কেউ সিলেটিকে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে দেখতে চাইছেন---সেসব ঘটছে এরই জন্যে।সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান এসব স্থির করে দিতে পারে না।ভাষাবিজ্ঞানের যে শাখা এগুলোকে ব্যাখ্যা করতে এবং দিশা নির্দেশ করতে পারে তার নাম সমাজ ভাষাবিজ্ঞান।

পাল গারভিন এবং মেডেলিন ম্যাথিঅট বলে দুই ভাষাবিজ্ঞানী মান ভাষার এক সংজ্ঞা দেবার চেষ্টা করেছিলেন। হুমায়ুন আজাদ এর বাংলা করেছিলেন এরকম,“যে-বিধিবদ্ধ ভাষিক রূপ, বৃহৎ কোনো ভাষাসমাজ কর্তৃক গৃহীত ও আদর্শ কাঠামোরূপে ব্যবহৃত,তাই মান ভাষা।২২তাঁরা বিধিবদ্ধতার কথা বললেন বটে,কিন্তু সেই বিধিকে হতে হবে একাধারে নমনীয় সুস্থিত২৩স্থিতিটা এর জন্যে যাতে বাকি ভাষাবৈচিত্র্যের থেকে নিজেকে স্বতন্ত্র রাখতে পারে,নমনীয় যাতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের মান উন্নতও করতে পারে।তাঁরা মান ভাষার মান অর্জনের জন্যে তিনরকম মানদণ্ডের কথা লিখেছিলেন: ক) মান ভাষার আন্তর বা সহজাত বৈশিষ্ট্য,খ) বিশেষ ভাষাসমাজে মানভাষার ভূমিকা,এবং গ) মানভাষা সম্পর্কে ভাষাসমাজের মনোভাব।২৪ আমাদের বর্তমান অধ্যয়নে শেষটির কথা বিশেষভাবে মনে রাখা জরুরি। কারণ সেই ভাষা সমাজের ভেতরে সিলেটিও রয়েছেন,যারা মান বাংলাকে নিজের ভাষা হিসেবে ঐতিহাসিকভাবেই মেনে নিয়েছেন।মানভাষার তাঁরা চাররকমের ভূমিকার কথা লিখেছিলেন:সংহতিসাধক,স্বাতন্ত্র্যনির্দেশক,মর্যাদাজ্ঞাপক ও আদর্শরূপনির্দেশক ভূমিকা।২৫মানভাষার প্রতি ভাষাসমাজের মনোভাবের মধ্যে পড়ে ভাষানুগত্য,গৌরববোধ,ও মানভাষা-সতেনতা।২৬ লিখেছেন হুমায়ুন আজাদ।তাই, শেষমেশ এই ভালো হয় যদি সিদ্ধান্ত নেয়া যায়, ---কার ভাষাটি যে কী,তা ঠিক করবেন শুধু তারাই যারা যে ঐ ভাষাটিতে কথা বলেন।অন্যে নয়।কারণ ভাষানুগত্য,গৌরববোধ ইত্যাদি তাদের নিজস্ব বিষয়।

          এত সবের পরেও সিলেটি তথা পুব বাংলার ভাষাগুলো যে অসমিয়ার বেশ ঘনিষ্ঠ ভাষা এমন চিন্তার পথিকৃৎ কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সরাসরি লিখেই ফেলেছেন,“The Bengali Dialects of the Extream east and south-east (Sylhet, Chittagong) are certainly more removed from Standard Bengali than is Assamese.”২৭ ভাষা-রাজনীতি ছেড়ে ভাষা দুটোর তুলনামূলক ভাষাতাত্ত্বিক অধ্যয়ন করলে কিন্তু অনেক অনুন্মোচিত তত্ত্ব আর তথ্য বেরিয়ে আসবার সম্ভাবনা এখনো প্রবল।শুধু অসমিয়াই কেন,চাকমা,হাজং,বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি,রাজবংশী ইত্যাদি ভাষার সঙ্গেও তুলনামূলক আলোচনা হতেই পারে।

 

 ।। সিলেটিকে অসমিয়া’ বলে দাবি করবার বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিত ।।

  সেই ১৯১৩ সনে বেণুধর রাজখোয়া তাঁর নোটে’ সিলেটিকে অসমীয়া বলে দাবি করা শুরু করেছেন।তাতে শেষতম সংযোজন ড উপেন রাভা হাকাচাম।কে অসমিয়া’ ( অসমিয়া কোন) এই নিয়ে অসম চুক্তির পর থেকেই মাঝে মধ্যে অসমের আলো-হাওয়া রৌদ্র বেশ সরগরম হয়ে থাকে।কারণ,চুক্তিতে অসমিয়া’র বিশেষাধিকার সহ কিছু সংরক্ষণের কথা বলা আছে।অনেকে অনেক কথা বলেছেন,এখনো কেউ কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেন নি।এই বিতর্কে দুটো প্রবণতা লক্ষ করা গেছেএকদল রয়েছেন যারা মনে করেন,যার মাতৃভাষা অসমিয়া,যিনি শয়নে স্বপনে অসমিয়া ভাষা -সংস্কৃতি তথা জাতির উন্নতির জন্যে ভাবেন এবং কাজ করেন তিনিই অসমিয়া।অন্য প্রবণতাটি অল্প শিথিল।এই দ্বিতীয় দল মনে করেন মাতৃভাষা অসমিয়া হতেই হবে এমন কোনো কথা নেইকিন্তু অসমের মাটিকে যিনি আপনার করে নিয়েছেন অসমের ভাষা সংস্কৃতি সম্পদের প্রতি যার ভাব ভালোবাসা আছে তিনিই,যিনি আর কোনো রাজ্য বা দেশকে তার নিজের রাজ্য বলে ভাবেন না তিনিই অসমিয়া।এই অবস্থান থেকে ২০১৫তে বিধান সভার অধ্যক্ষ যখন নতুন করে অসমিয়ার সংজ্ঞা নির্ণয়ের চেষ্টা করেছিলেন,অসম সাহিত্য সভা বলেছিল,রাজ্যের যাদের প্রথম,দ্বিতীয়,তৃতীয় এবং চতুর্থ ভাষা অসমিয়া তাঁরাই অসমিয়া।২০০৯ সনে তিনসুকিয়া মহাবিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ড হাকাচামের বক্তৃতা শুনবার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেখানে তিনি স্পষ্টই বলেছিলেন,তিনি অসমিয়া বটে,কিন্তু অসমিয়া তাঁর মাতৃভাষা নয়,ধাত্রীভাষাতাঁর মাতৃভাষা রাভাকিন্তু মুশকিল হলো,এই দুই প্রবণতার মধ্যেকার জলবিভাজন রেখাটি প্রায়ই অস্পষ্ট।তাছাড়া,যেখানে ভারতের অধিকাংশ লোকই দেশপ্রেমের কোনো পরীক্ষা না দিয়েই,অথবা অনেক সময় তেমন কোনো পরীক্ষাতে ব্যর্থ হলেও ভারতীয় থেকে যান,সেখানে একজন ব্যক্তি যার মাতৃভাষা অসমিয়া নয় তাকে যদি সারাক্ষণ অসম প্রেমের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করতে হয় তবে জীবন যে কত স্পর্শকাতর আর দুর্বিসহ হয় সে প্রশ্নের উত্তর কখনো কোনো অন্যভাষীদের থেকে জানতে চাইলে জানা যেত।কিন্তু, সেই চাওয়াটাই হয়ে ওঠে না।  

         এমন এক জটিল সামাজিক স্থিতিতেই উপেন রাভাকেও লিখতে হয়েছে এটি তাঁর বই পড়লেই বোঝা যায়।তাই তিনিও অসমীয়া’ অভিধার ওই দুই প্রবণতাতেই যাতায়াত করেছেন।অসমীয়া আরু অসমর ভাষা-উপভাষা’ বইয়ের মুখবন্ধে তিনি লিখেছেন,“ইয়াত আলোচিত ভাষার সমলরাজি দরাচলতে উপভাষা (আঞ্চলিক),স্থানীয় উপভাষা নে নৃগোষ্ঠীয় উপভাষা--ইয়াক চিহ্নিত আরু নামকরণ করাটো অতিশয় স্পর্শকাতর বিষয়২৮ তাঁর এই স্বীকারোক্তি কিংবা সঞ্জীবের পূর্বোক্ত সংশয় এটিও প্রমাণ করে যে ভারত তথা অসমে নিরাসক্ত নিরপেক্ষ সমাজবৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জন্যে সামাজিক পরিবেশ এখনো তেমন অনুকূল নয়।         

উপেন রাভা হাকাচাম কেবল অসমেরই নন,তিব্বত বর্মীয় ভাষাগোষ্ঠীর উপর তিনি এখন গোটা উত্তর পূর্বাঞ্চলেই একজন খ্যাতনামা এবং নির্ভরযোগ্য বিশেষজ্ঞ।গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অসমিয়া বিভাগের অধ্যাপক ডহাকাচাম তিব্বত বর্মী ভাষা এবং ভাষাতত্ত্ব পড়িয়ে থাকেন।বাংলাতে ভোট বর্মী বা অষ্ট্রিক মূলীয় ভাষাগোষ্ঠীদের নিয়ে বিস্তৃত অধ্যয়ন এখনো দুর্লভ।অসমীয়াদের মধ্যে ডপ্রমোদ চন্দ্র ভট্টাচার্য ‘A Descriptive Analysis of the Bodo Langauage নিয়ে সেই ১৯৬৫তে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করেছিলেন। সেটি বই হিসেবে বেরোয় ১৯৭৭এ।তিনি এর পরেও কিছু কিছু কাজ করলেও ঠিক দুই দশক পর ১৯৯৭তে লেখা হলো আরেকটি দিকদর্শক বই ‘Rabha and Assamese Languages: A Comparative Studies’,ড উপেন রাভা হাকাচামের পি এইচডি গবেষণা পত্র।তাঁর পরে তিনি রাভা,অসমিয়া এবং ইংরেজি ভাষাতে এই পথে নিরলস কাজ করে চলেছেন।তার মধ্যে অসমিয়াতে লেখা দু’টো বই আমাদের বর্তমান নিবন্ধের জন্যে বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য।একটি অসমীয়া আরু অসমর তিব্বত-বর্মীয় ভাষা’ এবং দ্বিতীয়টি অসমীয়া আরু অসমর ভাষা উপভাষা’এই দুটিতেই তিনি অসমের প্রায় সমস্ত ভাষাগুলোকে ছুঁয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন।শুধু হিন্দি এবং বাংলা ছাড়াসম্ভবত এটি ধরে নিয়েছেন যে এ দুটো অসমের বাইরের ভাষাকিন্তু হিসেব মেলে না যখন দেখি,নেপালি আর সাদরি ভাষার সঙ্গে বইগুলোতে সিলেটি আর বাংলার মৈমন সিং উপভাষাদিব্বি জায়গা করে নিয়েছে।কারণটি বোঝা যায় যদি ভেবে নিই আসলে তিনি অসমে প্রচলিত ভাষাগুলো নয়,ঠিক সেই ভাষাগুলো নিয়েই অধ্যয়ন করেছেন যেগুলোকে কোনো না কোনো ভাবে অসমিয়া ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে এনে ফেলে দেয়া যায়।সিলেটিকেও অসমিয়ার একটি উপভাষা বলতে বলতে থেমে গেছেন। জোর দিয়ে বলতে যে পারছেন না,তাই নিয়ে তাঁর আক্ষেপও অস্পষ্ট নয়। কেন আর কেমনতর আক্ষেপ   --- সে নিয়ে আমরা যথা স্থানে লিখব। কিন্তু এই তথ্য জানিয়ে দেওয়া ভালো যে এই দুটো বইয়ের প্রথমটিতে ২৭৬ থেকে ৩০০ অব্দি ২৫ পৃষ্ঠা এবং দ্বিতীয়টিতে ১০ থেকে ১৩ অব্দি ৩ পৃষ্ঠা তিনি সিলেটির জন্যে বরাদ্দ করেছেন।আলাদা করে লিখলে শুধু এইগুলো নিয়েই একটি ছোট্ট কিন্তু মূল্যবান পুস্তক হয়ে যেতে পারেআমরা তাই,মূলত তাঁর বই থেকেই অসমিয়া দৃষ্টিকোণ বুঝবার চেষ্টা করব। বাকিদের কথা প্রসঙ্গক্রমে আসবে।

যে মুখবন্ধের কথা আমরা লিখছিলাম সেখানেই তিনি খানিক পরে লিখছেন,“সেইদরে হাজং, মৈমনসিঙীয়া,চিলটীয়া (কাছারী),দেহান,রাজবংশী আদি বাংলা বা অসমীয়ার একোটা উপভাষা হিচাপেহে বিবেচিত হৈ আহিছে যদিও বর্তমান স্বতন্ত্র ভাষা হিচাপে স্বীকৃতি প্রদানর ক্ষেত্রত সেই সেই ভাষা-ভাষীর মাজত রাজনৈতিক আরু বিদ্যায়তনিক তৎপরতা বৃদ্ধি পাইছে২৯ তথ্য হিসেবে কথাগুলো মোটের উপর সঠিক।শুধু, ‘দেহান’ রাজবংশীরই একটি ভাষাবৈচিত্র্য হলেও এখনো তাদের মধ্যে ভাটি অসমের রাজবংশীর মতো অসমিয়ার থেকে বেরোবার তাগিদ নেই।আর সিলেটি’দের অতি ক্ষুদ্র এক বাংলাদেশি অংশই এখনো ওই স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার।মৈমনসিংহমূলীয়দের যারা অসমিয়া বলে এককালে লিখিয়েছিলেন তাদের মধ্যে এখন বাংলা মূলে ফিরে আসবার প্রবণতা বাড়ছেহাজং এবং রাজবংশীদের দাবিটা বোধহয় বিশুদ্ধ,কিন্তু স্বীকৃতি মিলছে না

সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্য নিয়ে তিনি এই বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। সে অধ্যায়ের নাম ‘অসমীয়ার জাতিগত/ সামাজিক শ্রেণিগত উপভাষা’এর উপ-অধ্যায় বিভাজনও বেশ চিত্তাকর্ষক--১)চাহ জনগোষ্ঠীর কথিত ভাষাঃসাদরি বা বাগানীয়া;২)অভিবাসী মুসলমানর কথিত ভাষা(ভাটিয়া) আরু বাংলার মৈমন সিং উপভাষা;৩)নেপালী সকলরর কথিত অসমীয়া আরু অসমর নেপালী ভাষা;৪)বরাক উপত্যকার চিলেটিয়া (কাছারী) উপভাষা;৫) কাছারর দেহান বা ধেয়ান উপভাষা।

প্রথম অধ্যায়েও তিনি অসমের বেশ কিছু সামাজিক শ্রেণি উপভাষার নাম করেছেন,“নেপালী সকলর নেপালী-অসমীয়া,অভিবাসী সম্প্রদায়র উজানী(দেশী)আরু ভাটিয়া (ময়মন সিঙীয়া)অসমীয়া,কাছারর বাঙালী সকলর চিলেটীয়া(কাছারীয়) অসমীয়া,অভিজাত আরু শিক্ষিত বাঙালী পরিয়ালর ঔপনিবেশিক অসমীয়া(ব্রিটিছর দিনত মফচলীয় আমোলাপট্টিত আরু সম্প্রতি রেলোয়ে কলনিত এনে ভাষার নমুনা পোয়া যায়),নগর-মহানগর কেন্দ্রিক মাড়োয়ারী সম্প্রদায়র হিন্দী মিশ্রিত বজরুয়া অসমীয়া (broken Assamese),কুলি-নাপিত-ধোবা-রিক্সাওয়ালা আদি বৃত্তিজীবি লোকর দেশোয়ালী অসমীয়া ইত্যাদি এই শ্রেণীর অসমীয়ারূপে অতি সম্প্রতি বহুভাষিক অসমীয়া মাতৃভাষী চাকরিজীবী ,ব্যবসায়, গৃহীণী আরু ছাত্র-ছাত্রীকো প্রভাবান্বিত করি ‘চলতি অসমীয়া’ বা ‘জনপ্রিয় অসমীয়া ভাষা'র প্রচলনত ইন্ধন যোগাইছে৩০ এর থেকে স্পষ্ট তিনি ‘চিলেটীয়া অসমীয়া’দের ‘অসমীয়া মাতৃভাষী’দের সঙ্গে একাকার করছেন না। বরং সিলেটিকে অসমের ভাষা অর্থেই অসমিয়া বলছেন।তাহলে এই ভাষাগুলোকে তিনি উপভাষা কেন বলছেন এই প্রশ্ন উঠতেই পারেএই প্রশ্নও অনুসন্ধানের বিষয় হতে পারে যে মূল অধ্যায়ে তিনি মারোয়াড়ি বা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার রেলওয়ে কলোনির বাংলাকে নিয়ে আলোচনা করতে উৎসাহ দেখালেন না কেন?শুধু তিনিই নন,প্রায় কোনো অসমিয়া ভাষাবিদকেই এদের নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করতে দেখা যাবে না।অতিসম্প্রতি শুধু ড বিশ্বজিৎ দাস এবং ড ফুকন চন্দ্র বসুমতারী সম্পাদিত ‘অসমীয়া আরু অসমর ভাষা’ সংকলনে ‘ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলা ভাষা: এটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা’ শীর্ষক ড জয়ন্তী সাহার একটি নিবন্ধ সংকলিত হয়েছে।৩১

সাদরি ভাষাকে যে তাদের ভাষাবিশেষজ্ঞরা স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে দাবি করেন সেটি তিনি মূল অধ্যায়ে বেশ সম্মানের সঙ্গেই উল্লেখ করেছেন উপেন রাভা হাকাচাম, “সাদরি ভাষার বিশেষজ্ঞসকলর মতে ই এটা স্বতন্ত্র আরু পূর্ণাঙ্গ ভাষা , ই কারো মিশ্রিত ভাষা নহয়৩২ সাদরিকেই সুকুমার সেন প্রমুখ অনেকেই বাংলার ঝাড়খণ্ডী উপভাষা বলবার ভুল করেছিলেন যেমন কামরূপী ভাষাবৈচিত্র্যের মধ্যে রাজবংশী’কেও ধরে নিয়েই অধ্যয়ন করা হয়ে থাকে।উপেন রাভা হাকাচামও কিন্তু লিখেছেন,...সেইবাবে বহুতে সাদরিক বাংলার ভগ্নীভাষা বুলিহে ক’ব বিচারে......সামাজিক আরু রাজনৈতিক কারণত বাংলা ভাষাই যিমান দ্রুতবেগত বিকাশ আরু বিবর্তন লাভ করিবলৈ সক্ষম হৈছে;তার বিপরীতে সাদরি ভাষার এটা বিশেষ সময়লৈকে বিকাশর ধারা আছিল তেনেই স্তিমিত। সেই কারণে বাংলার ভগ্নীভাষা হোয়া সত্ত্বেও দুয়োটার মাজত দূরত্ব বাঢ়ি গৈছে...৩৩ অসমে এর উপর অসমিয়ার ব্যাপক প্রভাব পড়বার বিষয়ে তিনি এর পর বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।এতে ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যেত যে এখানে সাদরির আরো এক বা একাধিক উপভাষা গড়ে উঠেছে।কিন্তু,সিদ্ধান্ত ভাষাতাত্ত্বিক না হয়ে হয়ে পড়ে ভাষারাজনৈতিক।তিনি এর পরে লেখেন,“...যেতিয়ারে পরা অসমর চাহ-বাগিচাসমূহত শিক্ষার মাধ্যম হিচাপে অসমীয়া ভাষা সাহিত্যর পঠন-পাঠন হ'বলৈ ধরিলে,আনকি বহু প্রাক্তন চাহ-বনুয়াই ঘাই অসমীয়া জনজীবনর লগত মিলি জীবন নির্বাহ করার (বৈবাহিক আরু সামাজিক ভাবেও) পরিবেশ রচনা করিলে তেতিয়াই অসমীয়ার এই স্থানীয় উপভাষা বা মান্য অসমীয়াই তেওঁলোকরো মাতৃভাষার মর্যাদা লাভ করিবলৈ ধরিলে৩৪একটি স্বাধীন স্বতন্ত্র ভাষার একাংশ কালে গিয়ে আরেকটি স্বাধীন স্বতন্ত্র ভাষার উপভাষা হয়ে উঠতে পারে কিনা সেই ভাষাতাত্ত্বিক প্রশ্ন তোলাই রইল।তাঁর কিন্তু বিশ্বাস,স্বাধীন স্বতন্ত্র অসমিয়া ভাষার একাংশ সিলেটি ভাষাটিও কালক্রমে বাংলার ভাষাবৈচিত্র্য হয়ে পড়েছেকীভাবে---- সে কথাটি আমরা পরে আবার পাড়ব। কিন্তু,এমন এক সিদ্ধান্ত যা একেবারেই ভাষাবিজ্ঞানের বিষয় তাই নিয়ে আলোচনা করবার কোনো মুক্ত পরিবেশ আছে কিনা সেই প্রশ্ন কিন্তু আমাদের মনে তীব্রভাবেই রয়েছেপ্রশ্নটি তুলতে চাইলেই সঞ্জীবের মতো বলে দেয়া হতে পারে,আর সেটি অসমিয়া হতে চাওয়া বা হয়ে যাওয়া সাদরিরাও বলতে পারেন,“এদের পেছনে কিছু সন্দেহজনক চক্রও সক্রিয়,যারা অসম আর অসমীয়াকে ভাগ করতে চায়”এই কথাও আমাদের মনে রাখা ভালো যে সাদরিকে বাংলার কিংবা হিন্দির ভাষাবৈচিত্র্য বলে চালিয়ে দেবার মতো লোকের অভাবও কিন্তু এই অসমেও কম নেই।বরাক উপত্যকাতে এদের হিন্দিভাষী বলে চালিয়ে দিয়েই ভোটের রাজনীতিটি হয়ে থাকে। ১৫ জন ভাষা শহিদের উপত্যকাতে কেউ এখনো এ নিয়ে প্রশ্ন তুলবার সাহস করে উঠতে পারেন নি।এমনকি পশ্চিম বাংলাতে আজকাল ‘আঞ্চলিক বাংলা ভাষার কবিতা’ লেখা এবং আবৃত্তি করবার ধুম উঠেছে।যারা লেখেন,আবৃত্তি করেন,তাদের অধিকাংশই কিন্তু কোনো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ নন।সবাই প্রায় বন্দ্যোপাধ্যায়,চট্টোপাধ্যায়,গোস্বামী,সিংহ উপাধির মানুষ।তাঁদের অনেকেই মনে করেন,এই ভাবে তাঁরা বাংলার একটি ‘প্রত্যাখ্যাত অপর’ জনগোষ্ঠীর ভাষাকে বাংলার মূল স্রোতের অংশ করে নিচ্ছেন।অথচ সেই ভাষার লেখকেরা উঠে আসছেন,সেরকম কোনো সংবাদ নেই।এই নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনা চক্রও আয়োজিত হয়ে থাকে। রেডিও,টিভিতেও শোনা যায়।কিন্তু এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর মেলে না,যে বাংলা ভাষার এই ‘আঞ্চলিক’রূপটির নাম কী? নিদেন পক্ষে ‘ঝাড়খণ্ডী’ বললেও কিছু বোঝা যেতকারণ এই নামে একটি ‘উপভাষা’-কে তো চিহ্নিত করা হয়েছিল। সেরকমও করা হচ্ছে না। আবার  অন্য ‘আঞ্চলিক বাংলা ভাষা’গুলো,যেমন ‘সিলেটি’,‘ঢাকাইয়া’,‘চট্টগ্রামী’ ইত্যাদি কী অন্যায় করল, তারও কোনো প্রশ্নও নেই,উত্তরও নেই

মৌখিক ভাবে দুই উপত্যকাতেই সাদরি চা-জনজাতির’ বা বাগানীয়া’ ভাষা হিসেবেই অত্যন্ত অপমানজনক ভাবে পরিচিত।সাধারণ লোকে এদের কুলি’,‘লেবার’ও বলে থাকেন,তা ব্যক্তিটি যদি কলেজ অধ্যাপক হন তবুও।উপেন রাভাও ‘বাগানীয়া’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।তাই,সাদরি ভাষার একাংশ অসমে নিজেদের ঝাড়খণ্ডী জনজাতি হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে দীর্ঘদিন ধরেই লড়ছেন।সাদরিতে আজকাল রেডিও টিভিতে স্বতন্ত্র অনুষ্ঠান হয়েই থাকেঅদূর ভবিষ্যতে তারাও সেই প্রয়োজনীয় প্রশ্নগুলো তুলতেই পারেন।অবশ্যি এই প্রবণতাও দেখবার মতো যে অসমিয়ার এক ভাষাবৈচিত্র্য বলে প্রচারিত হওয়া সত্ত্বেও সাদরিতে অসমে যত গান,চলচ্চিত্র ইত্যাদি তৈরি হয়েছে সম্ভবত বাংলাকেও সেখানে পেছনে ফেলে দিয়েছে। ‘চামেলি মেমসাহেব’-এর মতো সাদরি -অসমিয়া মিশ্রিত ধ্রুপদী ছায়াছবি অসমেই তৈরি হয়ে ভারত বিজয় করতে সমর্থ হয়েছিল। পরে এর বাংলা ও হিন্দি সংস্করণও বেরিয়ে দর্শক মন মোহিত করেছিল।

এতো কথা আমরা লিখলাম এই কথা স্পষ্ট করতে যে,বিবাদটি নেহাতই অসমিয়া বনাম সিলেটি বাংলার নয়। বিবাদটি ভাষাবিজ্ঞান বনাম ভাষারাজনীতিরও বটেএই বিবাদ ভাষানিরপেক্ষভাবে জাতীয়তাবাদ’-এর ধারণার অভ্যন্তরীণ বিসঙ্গতিরও পরিণাম বটে,শুধু মাত্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদের নয়।শুধু সিলেটি-অসমিয়ার তুলনা করে অথবা না করে বিষয়ের সমগ্রতাকে বোঝা যায় না মোটেও।আমাদের উচিৎ কেবল বর্তমান অসম কিংবা পূর্বোত্তর ভারত নয় প্রাচীন কামরূপ এবং তার সংলগ্ন এলাকা তথা বর্তমান বাংলাদেশের দিকেও দৃষ্টি দেওয়া।তাতে,এ অঞ্চলের ভাষাগুলোর আরো অনেক অনেক নতুন দিক সামনে চলে আসবে।ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের ভাষাবৈচিত্র্যগুলোর সঙ্গেও অসমিয়া ভাষার মিল খুব একটা কম পাওয়া যাবে না। সেগুলোরও অধ্যয়ন করলে হয়তো ‘সিলেটি’রা কেন নিজেদের অসমিয়া বলে না এই নিয়ে অধ্যাপক হাকাচামের আর কোনো আক্ষেপ থাকতো না।অসমিয়া তাত্ত্বিকেরা প্রাচীন কামরূপের দিকে তাকান,শুধু ‘সিলেটি’কে অসমিয়া বলে দেখাবার জন্যেই,এর পরেই সেই কামরূপের বাকি ভূগোল থেকে একেবারেই বেরিয়ে আসেন।সিলেটি যদি অসমিয়া হয়,তবে সমগ্র পুববাংলার ভাষাকেও তাই হতে হয় বৈকি কেননা সেই সমস্ত উপভাষা /স/ কে /হ/ উচ্চারণ করে আর বর্গীয় সমস্ত অঘোষ অল্পপ্রাণকে মহাপ্রাণ-

প্রায় করে ফেলে।পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা বিশুদ্ধ বাংলা /ক,,,,প/ উচ্চারণ করতে পারেন না।আর চাটগেঁয়েরা অসমিয়াদের মতোই নঞর্থক অব্যয় ক্রিয়াপদের আগে ---‘নাযাও’,‘নাখাও’ ইত্যাদি শব্দে যেমন----উপসর্গের মত ব্যবহার করেন। এখন,যদি এই তর্ক করি যে সিলেটিরা অসমে থাকেন বলেই অসমিয়া, আর অন্যেরা যেহেতু অসমে থাকেননা,তাই তাদের ভাষাগুলোর সঙ্গে অসমিয়ার মিল আশি শতাংশ থাকলেও সেগুলোকে অসমিয়া বলা যাবে না--তবে স্পষ্টতই সে তর্ক ভাষাবিজ্ঞানের পরিচিত সীমার থেকে বেরিয়ে পড়ে।উপেন রাভা হাকাচামের নিজের জনগোষ্ঠী ‘রাভা’রা এই যুক্তিতে অসমে হয়ে পড়েন অসমিয়া, বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি।এরকম একটা সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান বহির্ভূত দৃষ্টিভঙ্গি আছে বলেই তাই সিলেটি বনাম অসমিয়ার নিয়ে আলোচনা সেই ১৯১৩র বেণুধর রাজখোয়ার  নোট’-এর বাইরে যায়ই না। সব্বাই ঐ ওখান থেকেই শুরু করেন। ড হাকাচামও তাই করেছেন।

 

।। সিলেটি বনাম কাছাড়ি ভাষাবৈচিত্র্য ।।

সিলেটি ভাষা এবং তার ভাষা এলাকার সম্পর্কে শুরুর তথ্যগুলো উপেন রাভা গ্রিয়ার্সন আর সুনীতি চট্টোপাধ্যায় থেকে নিয়েছেন।গ্রিয়ার্সনেই উল্লেখ আছে এর এক স্থানীয় বৈচিত্র্য কাছাড়ি’ বলেও পরিচিত,ওখানকার লোকেরা ওই নামেই ওকে চেনে।তিনি Western Sylhet,Sylhet এবং Cachar বলে মোটা দাগে তিন ভাষা বৈচিত্র্যের আলোচনা করেছিলেন।৩৫পশ্চিম সিলেটে সুনাম গঞ্জের ভাষারূপ নিয়ে আলোচনা করেন।সিলেট ভাষা বিভাগেরও Eastern বা পূর্বী বলে আরেক ভাষারূপের স্বতন্ত্র আলোচনা করেন।৩৬সঞ্জীব বাঙ্গালনামা’তে প্রকাশিত প্রবন্ধে লিখেছেন,“এর মধ্যে আবার কাছাড়ের সিলেটি উপভাষার সঙ্গে সদর সিলেটের ভাষার কিছু পার্থক্য রয়েছে।এ পার্থক্য মূলত: উচ্চারণগত৩৭ "তুই কিতা কররে’ আর তুইন কিতা করিতরে’ এই দুই বাক্যের পার্থক্য কেবল উচ্চারণের নয় রূপতত্ত্বেরও বটে।সঞ্জীবের মতো উপেন রাভা এ কে বৈশ্যের ‘Case Marker in Sylheti প্রবন্ধের উল্লেখ করে পাদটীকাতে লিখেছেন,“স্থানীয় লোকে ইয়াক অকল ছিলটি (Sileti) বুলিয়ে চিনাকি দিয়ে৩৮ কেন অমনটি লিখলেন এটি আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয়সত্য হলো,শুধু মাত্র সিলেটিরাই কাছাড়ি’র অস্তিত্বকেও অস্বীকার করবার চেষ্টা করেন।

          অনেকে কাছাড়’-এর সংস্কৃত উৎসের সন্ধান করবার চেষ্টা নানা সময় করেছেন,‘কাছাড়ি’ শব্দটি কিন্তু স্পষ্টতই বডো কাছাড়িদের সঙ্গে সম্পৃক্ত সেটি যে স্থানীয় ভাবে প্রচলিত নাম এই তথ্যের উল্লেখ উপেন রাভার পক্ষে সুবিধে জনক হতএই সুবিধের কথাটি পাদটীকাতে তাঁর দাবিটি থেকেও স্পষ্ট, যেখানে তিনি জানাচ্ছেন,শব্দটি প্রথমে ভোলানাথ তিওয়ারি ব্যবহার করেনপরে ড উপেন্দ্র নাথ গোস্বামী তাঁর অসমিয়া ভাষা আরু উপভাষা’ এবং ড প্রমোদ চন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর অসমর অবিভক্ত কাছাড় জিলার ভাষা উপভাষা' বইতে কাছাড়ি’ নামটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। সিলেটি অসমিয়া বিতর্কে এই কাছাড়ি প্রসঙ্গও আরেক চিত্তাকর্ষক বিষয়। ১৯৮৮তে হাইলাকান্দিতে অনুষ্ঠিত অসম সাহিত্য সভার অধিবেশনে এই কাছাড়িকেই বরাকি’ ভাষা নাম দিয়ে এই চেষ্টা হয়েছিল যদি ওই টুকরোকে অন্তত অসমিয়ার অনুগত ভাষা করে ফেলা যায়।জগন্নাথ চক্রবর্তী এই উপভাষাকেই বরাক বাংলা’ নাম দিয়ে তাঁর অভিধান লিখেছেন বলে আমাদের ধারণা।অভিধানে এর সংজ্ঞাটি অনেকটাই অস্পষ্ট।তিনি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন,তখন তাঁর এক আত্মীয় এসে তাঁর মুখে গ্রাম্য বাংলা’ শুনে ভর্তসনা করেছেন বলে এক সংবাদ তিনি দিয়ে রেখেছেন।৩৯ঐটেই আসলে কাছাড়ি’ বাংলা।বরাক উপত্যকাতে বাস করে অভ্যস্ত এমন যে কেউ শুনলেই বোঝেন কে কাছাড়িতে আর কে সিলেটিতে কথা বলছেন।গ্রিয়ার্সনও উল্লেখ করেছেন,স্থানীয় সিলেটিরা একে মুসলমানি’ বাংলাও বলে থাকেন,এটা না জেনেই যে এই ভাষাতে ওখানকার প্রাচীন হিন্দুরাও,যারা মূলত গ্রামে থাকেন,কথা বলেন।এই প্রাচীনদের বাসভূমি ও ভাষাঞ্চলকে সঠিক ভাবেই জগন্নাথ বরাক উপত্যকার মূল ভাষাঞ্চলের বাংলা বলছেন।সিলেটিকে তিনি অন্য নব্য আগন্তুক নোয়াখালি, চট্টগ্রাম,ঢাকা,কুমিল্লা আদি জেলা থেকে আসা মানুষের সঙ্গে আগন্তুক ভাষাঞ্চলের বাংলা বলে স্বতন্ত্র করেছেন।৪০ সিলেটিরা যে এই ভাষাবৈচিত্রের অস্তিত্ব অস্বীকার করবার চেষ্টা করেন,জগন্নাথ চক্রবর্তী এবং আবিদ রাজা মজুমদার অভিধান দু’টিতে বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষাবৈচিত্র্যকে সিলেটি’ বা কাছাড়ি’ নাম না দিয়ে আসলে এই অস্বীকৃতির বিরুদ্ধেই নীরব প্রতিবাদ জানিয়েছেন বলেই আমাদের মনে হয়ফার্গুসনের সংজ্ঞাটির দিকে যদি আমরা তাকাই,তবে দেখব তিনি ‘উপভাষা’কে এক বা একাধিক বৈচিত্র্যের গুচ্ছ’ বলছেন।কাছাড়ি’র বৈচিত্র্যকে আমাদের অস্বীকার করবার কোনো কারণ নেই,করলে সিলেটির ভেতরে আরো যেসব বৈচিত্র্য সুনাম গঞ্জে,সদর সিলেটে,করিমগঞ্জে শুরুতেই ছিল এবং এখনো উত্তর ত্রিপুরা,মেঘালয় এবং নওগাঁ জেলাতে নজরে পড়ে ---সেগুলোও আমাদের নজরের বাইরে থেকে যাবে।রণবীর পুরকায়স্থ সুরমা গাঙর পানি’ উপন্যাসে এই সব বৈচিত্র্যের কথা ভুলেন নি,তাঁর দুই  চরিত্রের একটি সংলাপ এরকম,“---তুমি তো সুনামগঞ্জি নানি।তুমার মাতে বুজা যায়।সিলেটি মাতর আছে তিন রকম।সুনামগঞ্জর মাইনষে একেবারে নদী আর মাটির লগে মিলাইয়া মাতইন।করিমগঞ্জর মানুষও অলাখান।সদর সিলেটর মাইনষে ভাবইন তারাউ আসল সিলেটি,মাতো মিঠা নাই।কিন্তু তারা আছইন দুনিয়ার হক্কলখানো।কত বড় বড় মানুষ। আর হবিগঞ্জি তারা কুনু সিলেটি নি।কি রকম গুলগুল করিয়া মাতইন।যাইতান নাতা,খাইতান নাতা।তারা আর বাইন্যাচঙি,সিলেটি অইয়াও সিলেটির লাখান লাগে না।একটু বেশি মিঠা।

---আপনেও কিতা সুনামগঞ্জি নি।

---নারেবা আমি কাছাড়ি।আমার নদী আলাদা,তাইন ও পাহাড়ি,খুব গুসা তান।আমরার গাউর উপরেউ তান গুমগুমি।কুনদিন নিশ্চিহ্ন হই যাইব আমার বড়খলা জাটিঙার যাতাত।জঙ্গল উঙ্গল সাফ,কত হাত্তি আছিল,হাত্তির খলা আছিল।অখন নাই৪১ আমরা সিলেটি’র ভেতরের এইসব ভাষাবৈচিত্র্যকে বিভাষা’ বললেও বলতে পারি।ভাষা বিজ্ঞানে শব্দটির ব্যবহার আছে।বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ শব্দটির একটি শোভন অর্থ আছে-- বিকল্প ভাষা’সংসদ অভিধানেও তাই আছে।অন্যথা সিলেটির ভাষাবৈচিত্র্য’ বলে কাজ চালাতে পারি।এই খানে উল্লেখ করা উচিত হবে অধ্যাপক জন্মজিৎ রায় সিলেটি উপভাষা: ঐতিহাসিক এবং ভাষাতাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে গোপাল হালদারকে অনুসরণ করে সিলেটির দুই ভাগ করেছিলেন।পূর্ব সিলেটি এবং পশ্চিম সিলেটি।৪২পশ্চিম সিলেটি হচ্ছে হবিগঞ্জ আর সুনামগঞ্জের ভাষারূপ।পূর্ব সিলেটি হচ্ছে সদর সিলেট,মৌলবীবাজার এবং বরাক উপত্যকা। সেখানে উত্তর ত্রিপুরা একেবারেই অনুপস্থিত।অন্যদিকে অধ্যাপক সুধাংশু শেখর তুঙ্গ তাঁর ‘Bengali and Other Related Dialects of South Assam’ বইতে ‘Cachar Bengali নিয়েই আলোচনা করেছেন।৪৩ আর কিছুকে স্পর্শই করেন নি।আমাদের সমস্ত অধ্যয়ন এবং ক্ষেত্র অনুসন্ধান করেও মনে হয়েছে,এই প্রতিটি অঞ্চলজুড়েই সিলেটির স্বতন্ত্র বিভাষা রয়েছে।হবিগঞ্জ আর মৌলবি বাজারের ভাষারূপকে যদিও বা এক গুচ্ছে ফেলা যায়,হবিগঞ্জের ভাষারূপকে সুনামগঞ্জের সঙ্গে জোড়া যায় না।ধর্মনগরে এবং শিলচরে আমরা সুনামগঞ্জ,হবিগঞ্জ,মৌলবিবাজার এবং সদরসিলেটের অনেক প্রাচীনার সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি। ক্ষেত্রসমীক্ষার সময় ধর্মনগরের সাংস্কৃতিক কর্মী এবং অভিনেতা দীপ্তেন্দু নাগ জানিয়েছিলেন, ‘হকুনর ছাও’ নাটকের নাট্যকার রামকৃষ্ণ দেবনাথ বুঝি তাঁর নাটকের ভাষারূপটিকে ‘সিলেটি’ বলেন না, বলেন ‘সিলেটি আঞ্চলিক’তার মানে সেও আরেক বৈচিত্র্য।ফলে ওই এই চার স্থাননামের সঙ্গে জুড়ে দেয়া যাক ধর্মনগর এবং পূর্বতন কাছাড়কে।তবে সিলেটির অন্তত ছটি ভাষারূপ তথা বিভাষা মেলা সম্ভব।যদিও আমরা যেহেতু সিলেটি নিয়েই স্বতন্ত্র অধ্যয়ন করছি না,স্বাতন্ত্র্য চিহ্নের তুলনামূলক অধ্যয়ন তথা বিবরণ দেয়া থেকে বিরত থাকব। 

            গ্রিয়ার্সন মাগধী প্রাকৃতের চারটি ঔপভাষিক বৈচিত্র্যের কথা লিখে গেছেন।তার মধ্যে কামরূপী’ প্রাকৃতের মধ্যে পূর্বী শাখাতে রয়েছে অসমিয়া,পশ্চিমা শাখাতে রয়েছে উত্তর বাংলার কোচবিহার জলপাইগুড়ির বাংলা ভাষা,রাজবংশী সহ। সিলেটি বঙ্গ-প্রাকৃত’-এর পূর্বী শাখার অংশ।পরে কী করে এই সিলেটি কামরূপী’ ভাষাবৈচিত্র্যের অঙ্গ হয়ে গেল এটিও আমাদের কাছে বেশ ধোঁয়াশা।সুকুমার সেনও এমন ঔপভাষিক বিভাজন টেনেছেন।যদিও তিনি স্বীকার করেছেন যথার্থ ভৌগোলিক ভাষা জরিপ তখনো হয় নি।এমন কিছু তথ্য সূত্র থেকে উপেন রাভা হাকাচাম এও দাবি করেছেন যে,“অসমিয়ার গোয়ালপরীয়া বা রাজবংশী উপভাষার সৈতে বিশেষ সম্পর্ক থকা দেহান বা ধেয়ান উপভাষারো বিশেষ বরঙণি নথকা নহয়৪৪ চিলারায়ের সেনা বাহিনীর সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র নদী,বড়াইল পাহাড় অতিক্রম করে গিয়ে কোচ সেনাদের পরিবারেদের কেউ কেউ ওখানে থেকে গিয়ে ধ্যানী’ হয়ে গেছিলেন।এই ঘটনা ঘটেছে মাত্র এই সেদিন সতেরো শতকে।তাদের থেকে বাংলা কিছু শব্দ বাক্যের ঋণ নিয়েছে বটে।তাই বলে সেই ঋণ প্রাচীনতর বাসিন্দা কাছাড়ি -সিলেটিদের ভাষাকেই গড়ে তুলবে এ একটু কষ্ট কল্পনাই।অথচ তিনি দাবি করেছেন,“সেইবাবেই এই উপভাষাটোত প্রচলিত আরু কামরূপী উপভাষা বা অসমীয়া মান্যরূপত প্রচলিত প্রায় শতকরা ৭৫টা শব্দই সজাতীয় (cognate) বুলি শব্দর সংখ্যানুপাতিক বিচারত ধরা পরে৪৫ তিনি কোনো সংখ্যানুপাতিক বিচার করেন নি।এই কথাগুলো তিনি নিয়েছেন ড উপেন্দ্র নাথ গোস্বামী এবং ড প্রমোদ চন্দ্র ভট্টাচার্যের উপরোক্ত দুটি গ্রন্থের থেকে।আমাদের এই সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচার নিয়ে কোনো আপত্তি নেই।এটি সঠিক হবার সম্ভাবনাই বেশি।শতাংশের পরিমাণটা আর একটু বেশি হলেও আমাদের আনন্দিত বৈ আতঙ্কিত হবার কোনো কারণ দেখি না।বরং বড়াইল পাহাড়,বরাক সুরমা নদী অতিক্রম করে সহস্রাব্দেরও বেশি সময় ধরে তিব্বত-বর্মী জনগোষ্ঠীগুলোর প্রব্রজনের সঙ্গে প্রাচীন কামরূপের সঙ্গে সম্পর্কিত করে এই সাদৃশ্যের সন্ধান করলে আরো অনেক পাকা ভিতের উপর তাঁর যুক্তি দাঁড়িয়ে যেত।বর্তমান মেঘালয়ের পশ্চিম পাশে ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকা জুড়ে রংপুর,দিনাজপুর,ময়মন সিংহ,জয়ন্তিয়া ইত্যাদি এলাকা যেখানে এখনো বড়ো,গারো,রাভা,রাজবংশীরা ব্যাপক সংখ্যাতে বাস করেন সেগুলোকে উপেন রাভা তাঁর অধ্যয়ন থেকে একেবারেই বাদ দিয়েছেন।তিনি কাছাড়ি বা সিলেটিদেরকে বাংলাদেশের ওই জেলা বা মহকুমাগুলোর থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন করে বুঝবার চেষ্টা করেছেন।বস্তুত প্রায় সমস্ত অসমিয়া ভাষাতাত্ত্বিকেরা এই ভুল গুলো করে আসছেন বলে আমাদের মনে হয়।এমন কি অবিভক্ত সিলেটের দক্ষিণ এবং পশ্চিম ভাগের হবিগঞ্জ,সুনাম গঞ্জের ভাষাকেও তাঁরা কেউ হিসেবে নেন নি। কেন,এটি বোঝা খুব কঠিন নয়। যে বেণুধর রাজখোয়ার নোটকে তাঁরা বেদতুল্য’ মর্যাদাতে তুলে রেখেছেন সেই বেণুধর রাজখোয়া সিলেট মহকুমার প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন। সেই সময়ে ঐ নোটটি লিখেছিলেন।তিনিও সমগ্র জেলাকে অধ্যয়ন করেন নি।অথচ হবিগঞ্জি, সুনামগঞ্জি উপভাষাগুলোও সে সময়ের অসমের ভেতরের সিলেটের ভাষা ছিল।

রংপুর থেকে সিলেট -- এই সমগ্র এলাকার ঠিক মাঝখানটিতে এখনো বাস করেন খাসিয়ারা যাদের ভাষাটি তো অষ্ট্রিক বটেই,শারীরিক গঠনেও অষ্ট্রিক মিশেল ব্যাপক।বরাক নদীর তীরে বদরপুরের সিদ্ধেশ্বর শিব মন্দির,যেখানে প্রতি বসন্তে বারুণী মেলা বসে এবং ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে কামাখ্যা মন্দির,যেখানে প্রতি বর্ষাতে অম্বুবাচি মেলা বসে ---ওই দুটোই আদতে অষ্ট্রিক নরগোষ্ঠীর তীর্থভূমি ছিল এই উল্লেখ বহু ঐতিহাসিক করে গেছেন।তাদের মধ্যে বাণীকান্ত কাকতিও রয়েছেন।তাঁর মতে কামরূপ একটি অষ্ট্রিক মূলীয় শব্দ।দুটোই কিন্তু এখন বাঙালিদের প্রধান তীর্থ ক্ষেত্র।অসমীয়াদেরও বটে।কিন্তু বৈষ্ণব ধর্মের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের পর অসমীয়াদের মধ্যে কামাখ্যার গুরুত্ব সত্রগুলোর তুলনাতে কমে গেছে।বর্তমান উত্তর কাছাড়ের জেলা সদরের নাম হাফলং,আর ওদিকে মেঘালয় সিলেট সীমান্তে তেমনি এক শৈলশহরের নাম জাফলং।প্রথমটির মূল বাসিন্দারা এখন যদিও ডিমাসা কাছাড়িরা,দ্বিতীয়টির মূল বাসিন্দা কিন্তু সেই খাসিয়ারা। কোথাও তো এই দুই নরগোষ্ঠীর ইতিহাস এসে মিলে গেছে,নতুবা দুইপ্রান্তের দুই শহরের নামে এতো সুন্দর সাদৃশ্য হবে কেন?তেমনি কাছাড় জেলা সদর শিলচরের নামের সদৃশ বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি উপজেলার একটি গ্রামের নাম এখনো শিলচরি বা শিলচারি (Shilchari)গ্রামটি ভারতের ত্রিপুরা-মিজোরাম সীমান্তের খুব কাছাকাছি। যেখানে ত্রিপুরির মতো সেইসব জনজাতিরাই এখনো বাস করেন যারা ত্রিপুরা-কাছাড়েরও প্রাচীন বাসিন্দা। নীহার রঞ্জন যেমন বাঙালিদের বেলা বডো মিশ্রণ প্রায় নেই বলে বলেছিলেন,বাণীকান্ত কাকতি অসমিয়াদের ক্ষেত্রেও ওই একই কথা লিখে গেছেন--- সেই তথ্যের উল্লেখ উপেন রাভা নিজেই করেছেন।তার মানে অসমিয়া-সিলেটিদের মধ্যে অষ্ট্রিক মিশেলটাকে অন্তত  অস্বীকার করা একেবারেই যাবে না।এই সমস্ত উপকরণই যে সমগ্র পুব বাংলার লোকেদের অসমিয়াদের ঘনিষ্ঠ করেছে সেদিকে দৃষ্টি দিলে লাভ বই ক্ষতিটা কোথায় বোঝা আপাত দৃষ্টিতে কঠিন হলেও,এই অনুমান আমরা করতেই পারি যে এতে না বাঙালিরা অসমিয়াকেই বাংলা বলে ফেলবার মওকা’ পেয়ে যান এই আতঙ্ক কোথাও না কোথাও তো রয়েইছে। মেঘালয়ের পুবে শুধু বড়াইলের দিকে চোখ না ফেলে পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্রের যে অংশটি বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে গেছে সেদিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে,ওখানে রাভা,বডো,গারোদের ভাষার স্বতন্ত্র স্বীকৃতি নেই।সত্যিই ওখানে তাদের বাঙালির অংশ করে ফেলবার দুষ্প্রয়াস চলছে!সেই নিয়ে বর্তমান গবেষকের ‘বাঙালি ও বাংলা ভাষার ভোটবর্মী আত্মীয়তার সন্ধানে’ শীর্ষক একটি স্বতন্ত্র অধ্যয়ন রয়েছে।৪৬অসমে সিলেটি কেন অসমিয়া হলো না সেই আক্ষেপ না করে বাংলাদেশে রাভা’ কেন বাংলা হতে যাবে,--- সেই প্রশ্নটি তোলা তাঁর পক্ষে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দায়বদ্ধতার কাজ হবে ভাষাতত্ত্বের দিক থেকেও প্রশ্নটি বেশ সঙ্গতিপূর্ণ।

         অসমিয়া সিলেটির সাদৃশ্য দেখাতে গিয়ে অধ্যাপক উপেন রাভা হাকাচাম বেণুধর রাজখোয়ার উল্লেখ শুরুতেই করেছেন। বেণুধর রাজখোয়ার নোটে পাওয়া যায়,“সিলেট অঞ্চলতো অসমর দরে প্রাতঃস্নান করি মেজি জ্বলাই চুঙা-পিঠা আরু অন্যান্য পিঠা-পনারে মাঘবিহু উদযাপন করা,পথারত নরাবিলাক রৈ যোয়াকৈ মুঠি বান্ধি (গুরির পরা কাটি আঁটি বন্ধার বিপরীতে) ধান দোয়া-চপোয়া করা,আই-বাইসকলর নাম গোয়া (সংকীর্তন) আদি দেখা পোয়া যায়।বিভিন্ন জাতি, বৃত্তি,খেল,ফৈদর বা বিষয়বোরর লগত জড়িত উপাধি (শর্মা, দাস, ডোম-পাটনি);...৪৭ --এ পর্যন্ত বিশেষ কোনো সমস্যা নেই।কিন্তু,“চিলেটর প্রাচীন নাম গোর ( গৌড়)র লগত অসমীয়া মুসলমানসকলক সূচোয়া গরিয়া শব্দর সাদৃশ্যতা--ফা প্রত্যয়ান্ত রাজবংশীয় লোকর নামর সমাহার (সুধর্মফা,জনকফা,রত্নফা);সাধারণ লোকর নামকরণত রাম শব্দর সমাহার (জয়রাম,কালীরাম,কানাইরাম,লখাইরাম,ধনীরাম,লবরাম);অসমীয়ারে বিশ্লেষণ করিব পরা স্থান নামর প্রাধান্য (বুঢ়া গোঁহাই বা বুড়া গোয়াইনর লগত জড়িত গোয়াইন ঘাট,কোঁয়রর লগত জড়িত কুয়রগড়,হাজারিকীয়া বা হাজরিকার লগত জড়িত হাজারকী অঞ্চল,বরুয়ার লগত জড়িত বরুয়া (পাহার),অসম বা আসামর লগত জড়িত আসামপাড়া,আসামপুর আদি স্থান,বগা বা বোকা আরু পানীর লগত জড়িত বগাপানী ইত্যাদি স্থাননাম) অসমীয়ার সৈতেহে তুলনীয়,বাংলা বা অইন ভাষা গোষ্ঠীর লগত নহয়৪৮ অসমিয়া মুসলমানদের একাংশ গৌড়ের নবাব হুসেন শাহের আমলে গৌড় বাংলা থেকে এসছিলেন বলে তাদের গরিয়া মুসলমান’ বলা হয়ে থাকে বটে।এখন,এই গরিয়া’দের দেখিয়ে যদি কাউকে অসমিয়া বলে দাবি করা যায় তবে সে গৌড়বাংলার সমস্ত মানুষকে।খামোখা সিলেটিদের নিয়ে এই অযৌক্তিক টানাটানি কেন? শুধু এই মাত্র তথ্যই প্রমাণ যে বেণুধর রাজখোয়ার নোটস’ খুব একটা নির্ভর যোগ্য গ্রন্থ হতে পারে না। কোনো সিলেটি বইটি পড়ে সন্তুষ্ট হয়ে অসমিয়া হতে চাইবেন,এই সম্ভাবনা দূর অস্ত।যদিও এই সমস্যাগুলো শব্দতত্ত্বের বিষয়,এই নোটটি যে মোটেও নির্ভরযোগ্য ভাষাবৈজ্ঞানিক নয় আমরা শুরুতেই সেটি বুঝে নিলে,আমাদের বাকি আলোচনা মনে হয় শক্ত ভিতের উপরে দাঁড়াবে।আমরা তাই এই কাজটাই করব।

            সিলেট ইতিহাসের কোনো এক কালে খুব অল্প সময়,গৌড়গোবিন্দের রাজ্যের অধীনে ছিল বটে কিন্তু এর প্রাচীন নাম সমতট,হারিকেল,বঙ্গ এমন কি সরাসরি কামরূপ ছিল বললেও মেনে নেয়া যায়,গৌড় ছিল না কখনোই!রাম শব্দের সমাহার দেখিয়ে অসমিয়াদের সঙ্গে আত্মীয়তা দাঁড়ায় না কিছুতেই।বছর তিনেক আগে নোবেল জয়ী রসায়নবিদ বেঙ্কটরমন রামকৃষ্ণন থেকে শুরু করে শাক্ত বাঙালিদের পরম আদরের রামকৃষ্ণ পরমহংস অব্দি সবার সম্পর্কে তবে বলতে হয়,তাদের নামের সম্পর্ক অসমিয়া ভাষার সঙ্গে ‘অইন ভাষা গোষ্ঠীর লগত নহয়।আসাম পাড়া’,‘আসাম পুর’ স্থাননাম থাকা এমন কোনো অসম্ভব নয়,এরকম ব্রহ্মপুত্র এলাকাতে বঙালি পাড়া’,‘বঙালমারা’ ইত্যাদি স্থান নাম প্রচুর রয়েছে।আর শুধু সিলেট কেন,পার্বত্য রাঙামাটি উপজেলার সদর শহর রাঙামাটিতে একটি পাড়ার এখনো নাম আছে আসামবস্তি’সুধর্মফা,জনকফা,রত্নফা ইত্যাদি ফা-প্রত্যয়ান্ত নাম আসলে প্রাচীন ত্রিপুর রাজাদের নাম।অনেক নামই পৌরাণিক এবং কিংবদন্তীর অংশ।ত্রিপুরিরা যে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে প্রথমে কাছাড়,পরে সিলেট হয়ে ত্রিপুরা গিয়ে প্রবেশ করেন এ মোটামুটি প্রায় সব ঐতিহাসিকই স্বীকার করেন।সম্ভবত ভাস্কর বর্মণের পরবর্তী খ্রিস্টিয় অষ্টম-নবম শতকে এরা সিলেটে মিথিলা থেকে এনে ব্রাহ্মণ বসতি করিয়েছিলেন।৪৯সেই স্থানগুলোর মধ্যে বর্তমান সিলেটের ‘পঞ্চখণ্ড’-ও রয়েছে। সেই সূত্রে এই রাজবংশ এবং ত্রিপুরিদের উত্তরাধিকার এখনকার সিলেটিদের উপরে অনেকটাই বর্তায় এইমাত্র।এর সঙ্গে বহুপরে ত্রয়োদশ শতকে অসমে প্রবেশ করা আহোম রাজাদের ‘ফা’ অন্ত নামের কোনো প্রত্যক্ষ সংযোগ নেই।গোয়াইন ঘাট’ আছে মেঘালয় সীমান্তে।কিন্তু এটি দ্রুত উচ্চারণে য়-শ্রুতির নিদর্শন বলেই মনে হচ্ছে। গোয়াইন’ব্যাপক প্রচলিত শব্দ নয়। মেঘালয় সীমান্তের এই স্থান নামে গারো বা খাসিয়া উচ্চারণের প্রভাব থাকাও অসম্ভব নয়।অন্যথা সিলেটিরা /স/-কে /হ/ উচ্চারণ করেন বটে কিন্তু শব্দের মাঝে থাকলে স্পষ্ট /শ/ উচ্চারণ করেন--- গোঁসাই’,‘বাঁশকান্দি’আদিতেও সর্বত্র /শ/ ধ্বনিটি বাদ দেন না-- সুনামগঞ্জ,সুরমানদী।কুয়র’ সিলেটিতে প্রচলিত শব্দ নয় বলেই জানি।‘কুয়রগড়’ বলে কোনো স্থান নাম আমরা পাইনি।সম্ভবত ‘কৈলাড়গড়’-এর কথা বলা হচ্ছে।‘কৈলাড়গড়’ কৈলাশহরের প্রাচীন নাম।এবং ত্রিপুরাতে প্রবেশের পরে ত্রিপুর রাজাদের প্রথমদিককার রাজধানী।৫০ হাজার’ একটি বিশুদ্ধ বাংলা শব্দ।(হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি...;বনলতা সেন:জীবনানন্দ দাস।) অসমিয়া শব্দটি হেজার’তার থেকেই অসমিয়া উপাধি ‘হাজারিকীয়া বা হাজরিকা’‘আধুনিক অসমীয়া অভিধান’ অনুযায়ী এই উপাধির ইতিহাস হলো,“আহোম রাজত্বর পাইক-প্রথাত এহেজার পাইকর ওপরর মুখিয়াল।”৫১এই থেকে বুঝি বুঝতে হবে,সিলেটের হাজরকীঅঞ্চল নামটি অসম থেকে গেছে!হাজার শব্দটিতো অসমীয়া বাংলা দুই ভাষাতেই এসছে ফার্সি থেকে।বাংলাদেশের বগুড়া জেলার নন্দীগ্রাম উপজেলার এক স্থাননামও হাজরকি’সেই বগুড়া জেলার সঙ্গে তবে অসমের কোনো সম্পর্ক নেই কেন?কাছাড়ের মুসলমানদের মধ্যেও হাজারি’উপাধি রয়েছে।ভুঁইয়া,বড়ভূঁইয়া,লস্কর,বড় লস্কর ইত্যাদির মতো এই উপাধিও কাছাড়ি রাজাদের আমলে প্রচলিত হওয়া সম্ভব।যদিও উপেন্দ্রচন্দ্র গুহ কাছাড়ি রাজাদের দেয়া উপাধির যে তালিকা দিয়েছেন,তাতে ‘হাজারি’ নেই।৫২ কিন্তু মোগল সম্রাটদের সেনা নায়কদের মধ্যে ‘মনসবদার’ বলে একটি উপাধি ছিল।একজন মনসবদারের অধীনে যত সৈন্য ও ঘোড়া থাকত,সেই সংখ্যা অনুসারে তাকে তত হাজারি মনসবদার বলা হত।বঙ্কিম চন্দ্রের রাজসিংহ উপন্যাসে আছে,“তার পর ঔরঙ্গজেব একজন বিশ্বাসী দূতের দ্বারা দিলীর খাঁর নিকট এক লিপি প্রেরণ করিলেন।পত্রের মর্‍ম এই যে,মবারক খাঁকে দুইহাজারি মনসবদার করিয়া তোমার নিকট পাঠাইয়াছি। সে যেন একদিনও জীবিত না থাকে।”৫৩সেখান থেকে ‘এক হাজারি মনসবদার’ তথা ‘হাজারি’ উপাধিটি এসে থাকবে।অসমিয়া বড়ুয়া’ উপাধিটি আহোম রাজাদের দেয়া।বাংলাদেশে এদিক থেকে শব্দটি যায়নি।বরং আহোম রাজারাও বৌদ্ধ ঐতিহ্য থেকে শব্দটি পাওয়া সম্ভব।সিলেটি নয়,বরং চাটগেঁয়ে বাঙালি বৌদ্ধদের মধ্যে বড়ুয়া বহুল প্রচলিত উপাধি।বাঙালি দিব্যেন্দু বড়ুয়া একজন বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশকুন্তলা বড়ুয়া বাংলা ছায়াছবির এক খ্যাতনামা অভিনেত্রী।সুকুমার বড়ুয়া,বেণীমাধব বড়ুয়া বাংলাদেশের খ্যাতনামা লেখক।চিত্রপরিচালক প্রমথেশ বড়ুয়াকে বাঙালি বাঙালি বলেই চেনে। গোয়ালপাড়ার গৌরীপুরের এই রাজা যদিও বর্তমান অসমের লোক ছিলেন,তাঁর পৈত্রিক উপাধিটি আহোম রাজাদের থেকে পাবার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না।চট্টগ্রামের দিকে এগুলে বড়ুয়া’ শব্দযোগে আরো বহু স্থান নাম পাওয়া যাবে।সিলেট কাছাড়ে এক ধরণের মোটা শক্ত বাঁশের নাম বড়ুয়া’,বরো ধানকেও অনেকে বড়ুয়া’ ধান বলে।সংস্কৃতে শ্রেষ্ঠ অর্থে বর’ অথবা বুদ্ধ’ দুটো শব্দ থেকেই বড়ুয়া’ এসে থাকতে পারে।অধ্যাপক উপেন রাভা হাকাচাম প্রথমটির দিকে ইঙ্গিত করেন৫৪ সিলেটি আর অসমিয়া উচ্চারণটি অবশ্যি একইসিলেটিরাও বরুয়া’ উচ্চারণ করেন।সম্ভবত পুব বাংলার কোনো ভাষাবৈচিত্র্যের মানুষই বড়ুয়া’ লিখলেও উচ্চারণ করতে পারেন না।তার মানে বড়ুয়া’ উপাধিটিতেও যদি আত্মীয়তা করতেই হয় তবে শুধু অসমিয়া সিলেটিতে কেন,গোটা পুববাঙালিদের সঙ্গেই করবে। বোকা’ (কাদা) আর বগা’ (সাদা) শব্দদুটোর অসমিয়া অর্থও এক নয়।বগাপানি’ যেমন অসমেও আছে,তেমনি আছে মেঘালয়েও। মেঘালয় পাহাড় থেকে বয়ে যাওয়া এক উপনদীর নাম বগানদী’বগা’ শব্দটির সঙ্গে খাসিয়া ভাষার কোনো সম্পর্ক রয়েছে কিনা সেটি দেখা যেতে পারে।উপেন রাভা নিজেই তাঁর বইতে বগা’ শব্দের এক মালয় উৎসের সংবাদ দিচ্ছেন।বক,বিওগ।৫৫ মালয়েশিয়ার ভাষা মালয় একটি অস্ট্রিক ভাষা।সংস্কৃতে শব্দটি ‘বলক্ষ’,আহোমে পুক,রাভাতে বকা,গারোতে গিপক,লেপচাতে আ-বকঅবশ্যি এগুলো তাঁর মতে বিতর্কিত তথ্য।অর্থাৎ,আর্য ভাষা থেকে তিব্বত বর্মী ভাষাগুলোতে গেছে না,উল্টোটা হয়েছে এ নিয়ে সংশয় থেকে গেছে।বাংলা বক’ পাখি নামের উৎসও এই মালয় কিংবা ভোট বর্মী শব্দ কিনা এও ভাবা যেতে পারে।এই পাখি নাম থেকেও রঙ নামটি আসতেই পারে,পুরুষ ‘বক’ পাখিকে সিলেটিতে বলে,‘বগা’,(কাছাড়িতে) বগুড়া’ (ফান্দো পড়িয়া বগায় কান্দে রে !)অসমিয়াতে পাখি নামটি বগ' এবং বগলি'কিন্তু সবচে বিশ্বাসযোগ্য উৎসের সন্ধান চট্টগ্রামের বান্দরবানের কাছে বাংলাদেশের সবচে’ উঁচু উষ্ণ প্রস্রবণ বগাকাইন বা বগা লেক অব্দি গিয়ে পৌঁছুনো যেতে পারে।বগালেকের পাশে বম,মুরং বা ম্রো,তঞ্চংগ্যা এবং ত্রিপুরা ইত্যাদি ভোট বর্মী জনজাতীয়রা বাস করেন।স্থানীয় জনজাতীয় উপকথা অনুযায়ী,অনেক আগে ওখানে পাহাড়ের গুহায় একটি ড্রাগন বাস করতো।বম ভাষায় ড্রাগনকে বলে বগা’ড্রাগন-দেবতাকে তুষ্ট করতে স্থানীয়রা গবাদি পশু উৎসর্গ করতেন।কিন্তু একবার কিছু লোকে মিলে এই ড্রাগন দেবতাকে হত্যা করলে চূড়াটি জলমগ্ন হ্রদে পরিণত হয় এবং গ্রামগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে।ভূতাত্ত্বিকদের মতে ওখানে হয় কখনো কোনো আগ্নেয়গিরি ছিল,নতুবা প্রকাণ্ড উল্কাপাত হয়েছিল।তাতেই ঐ হ্রদ তৈরি হয়েছে।উপকথার আগুন উদগীরণকারী ড্রাগন বা বগার থেকে নাম পড়েছে বগা হ্রদ’৫৬ এই হ্রদের থেকেও একটি ছোট্ট ঝর্ণা নিচে নেমে গেছে তার নাম বগাছড়া’এর থেকে এটি বেশ স্পষ্টই বোঝা যায় তিব্বত বর্মী ভাষাগুলো থেকেই বগা’ শব্দটি বাংলাতে এসে থাকবেঅসমিয়াতেও সেখান থেকেই এসে থাকবে।সিলেটির থেকে এর প্রচলন অসমিয়াতে বেশি।চাটগেঁয়ে বাংলাতে শব্দটি বক পাখি অর্থেই ‘বোগা’৫৭ জগন্নাথ চক্রবর্তী তাঁর অভিধানে বগা’,‘বগুড়া’ শব্দের সংস্কৃত বক’ উৎসের উল্লেখ করেছেন।-ড়া’টি তাঁর মতে স্বার্থিক প্রত্যয়।৫৮

উপেন রাভা হাকাচামও এর পরে বাংলা-সিলেটি এবং অসমীয়ার এক দীর্ঘ তুলনা মূলক আলোচনা করেছেন। কিন্তু,সিলেটি বলে তিনি যে শব্দ বাক্য গুলো তুলে দিয়েছেন তার সঙ্গে সম্প্রতি শারদীয়া আনন্দবাজারে প্রকাশিত সমরেশ মজুমদারের গল্প ছায়া শরীর’-এর৫৯ সিলেটির মিল আছে।অর্থাৎ সেগুলোও বেশির ভাগ সময়ে সিলেটি নয়।বাংলা বলে তিনি যে শব্দবাক্যের উল্লেখ করেছেন সেগুলোও অতি বিশুদ্ধ বাংলা।অর্থাৎ সাধু বাংলা’ নামের কৃত্রিম ভাষাটি।ওই ভাষাতে কেউ কথা বলে না।অবশ্যি তিনি যে এটি ইচ্ছে করে করেছেন তা নাও হতে পারে।গ্রিয়ার্সনের বিশাল গ্রন্থেও এই ত্রুটি ছিল।তাঁকে যে সিলেটিরা উপকরণ গুটিয়েছিলেন তাঁরা সেই দলের লোক যাদের সম্পর্কে সঞ্জীব লিখেছেন,“যারা সিলেটি বলেন অথচ শিষ্ট সমাজে এটা গোপন রাখতে চেষ্টা করেন৬০নিখিলেশ পুরকাইতও তাঁর গ্রন্থে গ্রিয়ার্সনের এই সব ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন।৬১গ্রিয়ার্সনের তুলে দেয়া একটা গল্পে অমন অদ্ভুত মজাদার সিলেটি বাক্য প্রচুর আছে,“... আর সে তাহারে হূয়র রাখিতে বন্ধে পাঠাইল৬২ আমরা সেই উদাহরণগুলোর অনেকটাই এই অধ্যায়ের শেষে যোগ করছি,সমস্যাটির স্বরূপ অনুধাবনের জন্যে।কারণ অনেকেই কোনো প্রশ্ন বিনাই তাঁর উদাহরণগুলো এখনো ব্যবহার করে চলেন।জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সনের এই ত্রুটি না বুঝেই উপেন রাভা ভেবেছেন,“যিহর দ্বারাই ই যে অসমীয়ারহে অতি ঘনিষ্ঠ তাক প্রমাণ করিব পরা যায়৬৩ তাঁর এই দাবিটি মিথ্যে নয়,কিন্তু অসমীয়া’ শব্দের পরে যুক্ত -হে' প্রত্যয়টি অর্থবহ। বেণুধর রাজখোয়ার মতো আসলে তিনিও বলতে চাইছেন,“বাংলা বা অইন ভাষা গোষ্ঠীর লগত নহয়

          প্রখ্যাত অসমিয়া ভাষাবিদ কটন কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ডরমেশ পাঠকও এক্কেবারে সন তারিখ দিয়ে যেসব দাবি করেছিলেন সেসব কথা আমরা আগের অধ্যায়ে লিখে এসেছি।তিনি এক জায়াগাতে লিখেছেন,“‘কাছারের ইতিবৃত্তে’র লেখক উপেন্দ্র চন্দ্র গুহর ভাষাতে---“কাছারী দিগের মাতৃভাষা কাছারী।ইহা বাংলা হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন।”৬৪ কোন অধ্যায়ের কত পৃষ্ঠা ---সেসবের উল্লেখ করেন নি।আমরা ‘অসম প্রকাশন পরিষদ’ প্রকাশিত ‘কাছাড়ের ইতিবৃত্ত’ খুঁজে কোথাও এহেন বাক্য পেলাম না।তবে যে ‘কাছাড়ী ভাষা’ –র পরিচয় দিয়ে গিয়ে তিনি বাংলার বিপরীতে যে শব্দগুলো বসিয়েছেন সেগুলো আসলে কাছাড়ে প্রচলিত ডিমাছা ভাষার শব্দাবলী।যেমন ‘কাম,ঠু,ফাই,ছালাম̖কম রিনাং, রেপ’ ইত্যাদি।৬৫কিছু বাক্য আছে যেমন-‘ন্যং টাং ডুটি?’,‘আং টাং ডু’৬৬ বরং তিনি বিপরীতে স্পষ্টতই আলাদা একটি অধ্যায় ‘সপ্তম অধ্যায়ে’ ‘উত্তর কাছাড়ে বাঙ্গালা সাহিত্য’৬৭ নিয়ে বেশ বিস্তৃত আলোচনা করেছেন,যেখানে রাজদরবারে এবং রাজাদেরও বাংলা সাহিত্য চর্চার দলিল তুলে দিয়েছেন।অর্থাৎ স্পষ্টতই আমরা যাকে বাংলার ‘কাছাড়ি বিভাষা’ বলছি সেসব নিয়ে তিনি বিশেষ কোনো মন্তব্য করেন নি,করলেও তার যে খুব একটা ভাষা বৈজ্ঞানিক দক্ষতা আছে সেটি অন্তত এই বই পড়ে আঁচ করা যায় না।তিনি কোত্থাও কোনো ভাষা বিশ্লেষণ করেন নি।অধ্যাপক রমেশ পাঠক উপেন্দ্র চন্দ্র গুহের ‘কাছাড়ি’ শব্দটির মানে অনুসন্ধান করেন নি।

যে বেণুধর রাজখোয়ার নোট’-এর  উপর তাঁদের এতো আস্থা,তিনি ওই গ্রন্থটি রচনার তের বছর পরেই অসম সাহিত্য সভার নবম ধুবড়ি অধিবেশনের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।ওখানে যা ঘটেছিল তা খুব গৌরবজনক ছিল নাতখনো অসমে অসমিয়া বাঙালি বিভাজন ততটা স্পষ্ট ছিল না।অসমিয়াদের অনেকেই যেমন সানন্দে বাংলা ভাষা সাহিত্য চর্চা করতেন,বাঙালিদের অনেকেও তেমনি অসমিয়াদের যেকোনো সাংস্কৃতিক উদ্যোগে সহায় সম্বল জোটাতেন। সেই সম্পর্কে যারা ভাঙন আনতে চাইছিলেন তাঁদের অন্যতম গোয়ালপাড়াতে অনুষ্ঠিত ধুবড়ি অধিবেশনের সভাপতি বেণুধর রাজখোয়া দেবব্রত শর্মা লিখছেন,“রাজখোয়াই বঙালি লিখকর কিবা যুক্তির দোষ দেখুয়াই এটা কথা লিখিছিল।এই কথাত উপস্থিত বঙালী লোক সকলে অতি বেয়া পালেইয়ার প্রতিবাদত বাঙালী ভদ্রলোক এজনে কথা ক’বলৈ উঠিলৎ সভাপতি রাজখোয়াই ক'বলৈ নিদি বহুয়াই থ’লে৬৮ তাতে বেশির ভাগ মানুষ সভা ছেড়ে বেরিয়ে গেছিলেন।সভা নেতৃত্ব এতে বিব্রত বোধ করলেন এবং পরদিন যাতে বেণুধর রাজখোয়া নিজের মন্তব্যের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দেন তার ব্যবস্থা করেন।খসড়া বিবৃতিটি সেখানে উপস্থিত বাঙালি নেতৃত্বকে দেখিয়েও অনুমোদন নেয়া হয়েছিল।কিন্তু সেই বিবৃতি পাঠ করতে গিয়ে বেণুধর রাজখোয়া যা বললেন নিজের ভাষ্যতে দেবব্রত শর্মা লিখছেন,“বাঙালি সকলে নিজকে জাপানীসকলর লগত তুলনা করার সম্পর্কে ইতিকিং করি রাজখোয়াই ক’লে জাপানী আরু বাঙালি দুয়ো জাতিয়ে মাছ খায় বুলিয়েই বাঙালি জাপানী হ'ব নোয়ারে;কারণ তেনেহ’লে মেকুরী আরু বাঙালী দুয়ো মাছ খায় বাবে বাঙালী মেকুরী হ'ব লাগিব৬৯এর পরের ঘটনাবলী থামাতে রীতিমতো পুলিশ ডাকতে হয়েছিল।শরৎচন্দ্র গোস্বামী আক্ষেপ করে লিখেছেন,“তার ফল থাকিল বহুদিন প্রকৃততে আজিলৈ। ...সাহিত্য সন্মিলনর পাছত অসমীয়ার বিপক্ষে এটা ডাঙর দল হ’ল৭০ সুতরাং ‘Notes on Sylhetee Dialect এর লেখক যে অন্যকে অসমিয়ার কাছে টেনে আনবার কলা খুব ভালো জানতেন না,তথ্য তা প্রমাণ করে। যে যুক্তিতে একটু কটু ভাষাতে বললেও তিনি বাঙালী’র মেকুরী’ হবার সম্ভাবনা নাকচ করছেন সেইসব যুক্তি কিন্তু তিনি নিজেই ঐ নোট’  লিখবার বেলা ভুলে বসেছিলেন।বস্তুত,অধ্যাপক রমেশ পাঠক যেভাবে লিখেছেন,সিলেটিকে বাংলা ভাষা গ্রাস করেনি।যদিও বা সিলেটির অসমীয়ার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনা ছিল সেই সম্ভাবনার চারা গাছকে মেরে ফেলার রাজনৈতিক আয়োজনও কিন্তু শুরু হয়েছিল ১৯২৬ থেকেই। সে বছরের অসম বিধান পরিষদের নির্বাচনেই অন্যতম দাবি ছিল শ্রীহট্টকে অসম থেকে বাদ দেয়াত্রিশের দশকে গোপীনাথ বরদলৈ যখন আসাম এসোসিয়েসন নতুন করে গড়ে তোলেন তখন থেকেই তাঁর অন্যতম প্রয়াস ছিল সিলেটকে অসম থেকে বের করে দেওয়াএরকম দাবির জন্যেই দেশ ভাগের সময় একমাত্র অসমেই সিলেটে গণভোট হয়েছিল।আর তাতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ ওই ঘটনা অসমে থেকে যাওয়া অংশের সিলেটিদের মনেও যে গভীর বিয়োগান্তক দাগ বসিয়ে দিয়েছে সেই তথ্যকে গোপন করে সিলেটি কেন বাংলা হয়ে গেল তার দায় বাংলা ভাষার উপর চাপিয়ে দেয়া এক্কেবারেই ঐতিহাসিক সত্যও নয়,শুভফলদায়কও নয়। অবশ্য সিলেটি মধ্যবিত্তদেরও আসাম অন্তর্ভুক্তির দিনগুলো থেকেই আসাম থেকে বেরিয়ে যাবার পক্ষে চাপ ক্রমেই বাড়ছিল।এটাও ঘটনা। দেশভাগের সামান্য কিছু দিন আগে থেকেই শুধু তারা পাকিস্তানে যাবেন না বলে আসামে থেকে যাবার যোগাড়যন্ত্র শুরু করে আদ্ধেক ব্যর্থ হয়েছিলেন।কিন্তু সেসব ছিল বাঙালি হিসেবেই সিলেটিদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বেরও পরিণাম।অসমিয়া ভাষার সঙ্গে জুড়ে যাবার তাগিদ থেকে তারা কোনোদিনই অসমে জুড়তে চান নি।

          সিলেটিকে কিছু ভাষাতাত্ত্বিকেরা অসমিয়া বলে দাবি করলেও রাজনীতির মধ্যবিত্ত লোকেরা বাংলা বলেই জেনে এবং মেনে এসেছিলেন।এবং তাদের ভয় ছিল সিলেট অসমে থাকলে অসমীয়া মধ্যবিত্তকে বাঙালির অধীনস্থ হয়ে থাকতে হবেআজ আমরা কল্পনা করতে পারি,সিলেট ভারতে থেকে গেলে এতোদিনে কম করেও এক কোটি মানুষের আলাদা প্রদেশ হয়ে যেতে পারত।কিন্তু তখন সেটি কল্পনা করা মুশকিল ছিল।বরং ব্রিটিশ প্রশাসনে সিলেটিদের আধিপত্য যেরকম ছিল তাতে অসমিয়া মধ্যবিত্তের সেই আশঙ্কা একেবারেই অমূলক ছিল না

            অসমিয়াদের সম্পর্কে এরকম উক্তি কোনো বাঙালি লেখক বুদ্ধিজীবী করেছেন কিনা আমরা বহু সন্ধান করেও এ অব্দি পাই নি। সেরকম কিছু থাকলে অন্তত দেবব্রত শর্মার ঐ বহু অধীত গ্রন্থ কিংবা ড প্রফুল্ল মহন্তের অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির ইতিহাস গ্রন্থ’-এ পাওয়া যেত।ডপ্রফুল্ল মহন্ত বরং গৌরবের সঙ্গেই লিখেছেন,“অসমত বাঙালী সকলেই আছিল আধুনিকতার অগ্রদূত আরু বৃটিশর পিছতে তেওঁলোকেও এক সামাজিক মর্যাদা লাভ করিছিল। সেইকালত নিশ্চয় (অসমিয়া) অভিজাত সকলে বাংলা ভাষার জ্ঞান আয়ত্ত্ব করাটো আরু বাঙ্গালিক অনুকরণ করাটোক আধুনিক আভিজাত্য বা সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিচাপে গণ্য করিছিল৭১ কিন্তু বিশ শতকের শুরু থেকেই উদীয়মান অসমিয়া মধ্যবিত্ত বাঙালি উন্নাসিকতার আঁচও পেতে শুরু করেছিলেন--এও তেমনি সত্যস্বাধীনতার পরবর্তী কালে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পঠনপাঠনের অধিকার লড়াই করে আদায় করতে হয়েছিল,শিলচরের অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাও বহু লড়াইয়ের ফলেই সম্ভব হয়েছে।এ নিয়ে অসমের সিলেটিদের ক্ষোভ ব্যাপক।কিন্তু এই বিরোধের উত্তরাধিকার কিন্তু বাঙালিদের থেকেই পাওয়াকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অসমিয়া ভাষা সাহিত্য অধ্যয়নের বিরোধীদের অন্যতম ছিলেন একজন ঢাকাইয়া দীনেশ চন্দ্র সেন।কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালির এক বড় অংশ যেমন ঢাকা,তেমনি গুয়াহাটিতেও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধী ছিল।গুয়াহাটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গ উঠলে সিলেটিদের একাংশ দাবি তুলেছিলেন সেটি স্থাপিত হওয়া উচিত সিলেটেআশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বদান্যতাতেই অসমিয়া ভাষা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল,তেমনি গুয়াহাটিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল।

           সেইকালত নিশ্চয় (অসমিয়া) অভিজাত সকলে বাংলা ভাষার জ্ঞান আয়ত্ত করাটো আরু বাঙ্গালিক অনুকরণ করাটোক আধুনিক আভিজাত্য বা সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিচাপে গণ্য করিছিল”-- প্রফুল্ল মহন্তের এই উক্তি কিন্তু ড রমেশ পাঠকের এই উক্তিকে ঐতিহাসিকভাবেই নাকচ করে --- বাংলা ভাষাই চিলেটী ভাষার রূপ এনেদরে সলাই পেলাইছে যে চিলেটী এতিয়া বাংলা ভাষারে আঞ্চলিক রূপ মাথোন৭২ বস্তুত বেণুধর রাজখোয়ার নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত অসম সাহিত্য সভার ধুবড়ি অধিবেশন অব্দি আজকের অনেক ভাটি অসমের অসমিয়ারাও বাঙালি হতে চাইছিলেন।শরৎচন্দ্র গোস্বামী লিখেছেন,“অসমীয়া ভাষার সঙ্কীর্ণতা ইমান বাঢ়িছিল যে শিবসাগরত নোকোয়া শব্দ এটা ব্যবহার করিলেই ভাষা চুয়া হ'ল বুলি কিছুমান উজনীয়া লোকে আটাহ পারি ফুরিছিল।কামরূপীয়া বা গোয়ালপরীয়া মাত কথাতো বঙলুয়াই।যি বিশিষ্ট ভাষার বহির্ভূত।এনে সংকীর্ণতার ফলত নামনি অসমর অনেকেই অসমীয়া লিখিবলৈ ভয় করিছিল।এনে অবস্থাত কামরূপত তেতিয়াও কেইজনমান ক্ষমতাসম্পন্ন লোক আছিল,যে ভাবিছিল যে কামরূপীয়া মানুহে উজনীয়ার ইমানবিলাক অত্যাচার আরু অবিচার ( ভাষা বিষয়ত) সহ্য করাত করি তেওঁলোকে বঙালী ভাষাকে গ্রহণ করা ভাল৭৩  আর বেণুধর রাজখোয়ার মতো কারো কারো যে মানসিকতার পরিচয় আমরা তুলে দিলাম তাতে রাজবংশী,বডোদের মতো বহু জনগোষ্ঠীই আজ অসমিয়ার থেকে হয় বেরিয়ে গেছেন নতুবা বেরিয়ে যাবার প্রক্রিয়াতে রয়েছেন। সেখানে সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্যের বাংলা হয়ে যাবার দায় বাঙালিদের কাঁধে চাপিয়ে দেয়ার প্রয়াসটি মোটেও সঠিক নয়।

তার জন্যে কিন্তু সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্যের সঙ্গে অসমিয়া ভাষার ঘনিষ্ঠতার সত্যটি কিছুতেই নাকচ হয়ে যায় না।এ মোটেও পর্বতে কচ্ছপের ডিম খোঁজার মতো ব্যাপার নয়।এবারে আমরা সেটিই করে দেখাব।সুবিধের জন্যে আমাদের পরবর্তী অধ্যায়গুলো যে ছকে এগোবে তার এখানে উল্লেখ করে রাখা ভালো।প্রতিটি অধ্যায়ে প্রথমার্ধে,যেহেতু ভাষা বিজ্ঞানের বিষয়টি বেশ জটিল,সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তথ্য ও সিদ্ধান্তের হের ফের করে দেয় প্রতিটি ধ্বনি,রূপতত্ত্বের প্রতিটি ব্যাকরণিক সংবর্গ,ভাষার বহুল ব্যবহৃত নাম এবং ক্রিয়াপদের বৈচিত্র্য এবং বাক্য গঠন রীতি নিয়ে কথা বলা হবেদ্বিতীয়ার্ধে যেহেতু অসমিয়া তাত্ত্বিক,বিশেষ করে উপেন রাভা হাকাচামই বিষয়টি নিয়ে সবচাইতে বিস্তৃত অধ্যয়ন করেছেন,তাই তাঁর বক্তব্য তুলে ধরে একাধারে কালিক এবং কালানুক্রমিক তথা ঐতিহাসিক-তুলনামূলক পদ্ধতিতে  পর্যালোচনা উপস্থিত করা হবে।এই দুই কাজেই,আমরা প্রতিবেশী আর্য-অনার্য ভাষা-এবং ভাষাবৈচিত্র্য তথা উপভাষাগুলোর সাহায্য নেব সবার শেষে লিপি নিয়ে আলোচনা থাকবে।কিন্তু সেই অধ্যায়ে যাবার আগে, ইতিমধ্যে ভাষাবিদদের মধ্যে ব্যবহৃত ভাষাননমুনা নিয়ে কিছু কথা স্পষ্ট করা জরুরি।

 

।। জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সন সহ পূর্বতনদের ভাষা নমুনা এবং আমাদের বিকল্প।।

বেণুধর রাজখোয়া ছাড়াও অধ্যাপক উপেন রাভা হাকাচাম সহ অনেকেই জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সনের ব্যবহৃত ভাষা নমুনা,এবং সেগুলোর উপরে ভিত্তি করে করা ভাষা বিশ্লেষণে ভরসা করেছিলেন।যথার্থ নমুনা সংগ্রহ একটি কঠিন কাজ। কেন,সেটিই এবারে আমরা ব্যাখ্যা করছি।বিশেষ কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই বোঝা যাবে গ্রিয়ার্সনের নমুনা অবিমিশ্র সিলেটি নয়।বাংলা,এবং বহুদূর অসমিয়া ভাষাবিজ্ঞান অধ্যয়নেও ঔপভাষিক অধ্যয়নে তাঁর ব্যবহৃত একটি বাইবেলের গল্প বারে বারে ব্যবহার করে এসেছেন, ভাষাবিদেররা।এর সিলেটি প্রতিরূপটি যুগিয়েছিলেন বাবু গিরিশ চন্দ্র নাগ১৮৯৮ সনে। সেটি ছিল এরকম:৭৪

কোন মানুষর দুই পুয়া আছিল্। তাহাদের মধ্যে ছোটটী বাপরে কহিল্, বাবা, বিষয়ের যে অংশ আমার বাটে পড়ে আমারে দেও।তাহাতে সে তাহাদের মধ্যে বিষয় বাটিয়া দিল।তার পর বেশী দিন না যাইতেই ছোট পুয়া হকল বিষয় জমাইয়া বিদেশ চলিয়া গেল্। সেখানে যাইয়া ধুমধাম করিয়া হকল সম্পত্তি খুয়াই লাইল্। হকল টেকা খরচ হইলে,ঐখানে বড় আকাল হইল্,তাহাতে তার টানা টানি পড়িল।পরে সে সেই দেশর এক গৃহস্তর সাথে যাইয়া মিলিল্;আর সে তাহারে হূয়র রাখিতে বন্ধে পাঠাইল্। আর সে হূয়র যে তুষ খায় তাহা দিয়া পেট ভরিতে খুশি হইত,কিন্তু কেহই তারে দিত না। পরে তার হুশ হইলে কহিল্ আমার বাপর বাড়িতে যত মজুর মানুষে যত ইচ্ছা খায় আর ফেলায়, আর আমি খিদায় মরতেছি। আমি বাবার কাছে যাইমু, আর কহিমু যে, বাবা, আমি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে আর তুমার নিকট দুষ কর̖ছিআমি পুত্র বলিয়া চিন দিবার যুগ্য নহি,আমারে তুমার একজন মজুরের মত রাখ।পরে সে উঠিয়া তার বাপর কাছে আইল্,কিন্তু দূরে থাকতেই বাপ তারে দেখিয়া মায়া করল,আর দৌড়িয়া তার গলত ধরিয়া চুমা দিল।তখন বেটা বাপরে কহিল্,“বাবা,আমি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে তুমার সামনে পাপ করছি,আমি আর পুত্র বলিয়া চিন দিবার যুগ্য নই।কিন্তু বাপ তাহার চাকর হকলরে কহিল ভাল পুষাক আনিয়া তারে পিন্ধাও,তার হাতে একটা আঙ্গটী আর পায়ে জুতা পিন্ধাও,আর আমরা খাইয়া মজা করি। কেননা,আমার পুয়া মরছিল্ আরবার জিয়াইছে।হারাইছিল্,আরবার পাওয়া গেল্তাহাতে তারা খুব আমোদ আহ্লাদ করতে লাগল।

তখন তার বড় পুয়া খেতে ছিল। সে বাড়ীর নিকট আইলে নাচ গাওনার সব্দ হুনল। সে একজন চাকররে ডাকিয়া জিঘাইল্,এ হকল কিয়র?সে তাহাতে কহিল্ ,তুমার ভাই বাড়ীত আইছে,তাতে তুমার বাপ বড় খানি দিছন,কেননা তারে সুস্থ অবস্থায় পাইছন। সে রাগিয়া ভিতরে যাইতে রাজি হইল না।পরে তার বাপ বাহিরে আসিয়া তাকে সাধিতে লাগল। তখন সে জওয়াব দিয়া বাপরে কহিল্এত বছর ধরিয়া আমি তুমার সেবা করছি,তুমার কুনু কথা কুনু দিনও ফিরাই নাই, তথাপি তুমি  কুনু দিনও আমারে একটা ছাগল বাচ্ছাও দেও নাই,যে আমার বন্ধু হকলরে লইয়া আমোদ করি।কিন্তু তুমার এই পুয়া তুমার বিষয় আশয় বেশ্যাদের নিয়া খাইয়া ফেলিয়াছে,সে আসতেই তখন তুমি তার জন্য বড় খানি দিছ।তাহাতে সে তারে কহিল্,বাপু তুমি সর্বদাই আমার সঙ্গে আছ,আর আমার যাহা আছে হকলই ত তুমার।

      কিন্তু এখন আমোদ করা ও খুশি হওয়া উচিত হইছে,কারণ তুমার এই ভাই মরিয়া গেছিল্,বাঁচি উঠল,হারাই গেছিল্, পাওয়া গেল্।

সুনামগঞ্জের একটি লোককাহিনির প্রতিরূপ যুগিয়েছিলেন পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ ১৮৯৭ সনে সেটি এরকম:৭৫

         সিলট্ জিলার সুনামগঞ্জ মোহকুমার মাঝে কালীসুরী গাও।ঐ খানে এক খনকার থাক̖ত।এক স্ত্রী আর এক ছাইলা ছাড়া তার ঘর আর কেউ আছিল্ না।তার বাড়ীত এক দিন রাইত জন কয়েক কুটুম আসিয়া উপস্থিত হইছিল্পাকশাকের পর তার স্ত্রী তারে কহিল্,ঘরের থালে ত সকলের কুলিয়াবার না,খান কয়েক পাতা কাটিয়া আন।সে কহিল্,অত রাইত পাতা কই পাইমু?তার পর তার স্ত্রী ঘর থাকিয়াই হাত বাড়াইয়া প্রায় দণ্ড দুয়েকের পথ মামুদপুর গাওএর এক কলা গাছ থাকিয়া পাতা কাটিয়া আনিল্।খনকার স্ত্রীর এই কাণ্ড দেখিয়া বড় ভয় পাইল্পর দিন কুটুম সকল গেলে পর সে তার স্ত্রীরে কহিল্,তোমার বাপের বাড়ীত যাইবার খবর আস̖ছে,এখনই যাইতে হইবএই কথা কহিয়া সে তার স্ত্রী আর ছাইলারে লইয়া,এই নাও করিয়া বাড়ী থাকিয়া রোওয়ানা হইল্কত দূর গিয়া এক গাঙ্গের মাঝ খানে এক চর পাইল্খনকার তখন তার স্ত্রীরে কহিল্,তুমি চরের উপরে উঠিয়া পাকশাকের জোগাড় কর,আমরা মাছ লইয়া আসি।এই কথা কহিয়া তার স্ত্রীরে চরের উপরে রাখিয়া,সে তার ছাইলারে লইয়া নাওএ বহুৎ দূর চলিয়া গেল্।তখন তার স্ত্রী তার মতলব বুঝতে পারিল্।আর ডাকিয়া কহিতে লাগিল্,ওরে মুখপোড়া খনকার,ছাইলার মায়ায় তোর আইজ প্রাণ রাখ্লাম,না হইলে তাম্ সা দেখাইতাম; যা বাড়ী যা কিন্তু তোর ভিটার যারা থাক্ ব তারাই নির্বংশ হইব।আইজ ও পর্যন্ত ঐ খনকার ভিটা খালি পড়িয়া আছে।                                  

বাইবেলের গল্পটির ‘কাছাড়ি’ প্রতিরূপও রয়েছে।এছাড়াও আরো দুই একটি লোককাহিনি এবং কথোপকথনের নজির তুলে গ্রিয়ার্সন কাজ করেছেন।৭৬আমরা যে দুই প্রতিরূপ তুলে দিলাম তাতে যেকেউ বুঝবেন,লেখকদের সিলেটিকে ‘সাধু’বাংলা করে ফেলবার প্রবণতা ব্যাপক।এমন কি পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদের মতো বিদ্বজ্জনও এর ব্যতিক্রম নন।‘কহিল’ ক্রিয়াপদের ব্যবহার সিলেটিতে নেই,আছে ‘কইল’পদমধ্যে ‘হ’ থাকবে আর লোপ পাবে না, সিলেটিতে এ প্রায় দেখাই যায় না।তার উপরে আবার এমন বেশ কিছু ক্রিয়াপদ অহেতুক ব্যঞ্জনান্ত।হস চিহ্ন সহ ছাপা হয়েছে, আর এগুলো মোটেও ছাপার ভুল নয়,আন্তর্জাতিক ধ্বনি বর্ণমালাতে যে প্রতিরূপ দেয়া হয়েছে সেখানেও ব্যঞ্জনান্তই লেখা হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে গ্রিয়ার্সনের নমুনা প্রেরকরা খুব বিশ্বাসযোগ্যভাবে কাজ করেন নি।তাই উপেন রাভা হাকাচাম বা সেরকম অসমিয়া ভাষাবিজ্ঞানীরা যখন গ্রিয়ার্সনে নির্ভর করেছেন তাঁদেরও বিভ্রান্তির শিকার  হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।বিকল্প একটি ভাষা-নমুনা নিয়েও উপেনরাভা হাকাচাম কাজ করেছেন সেটি গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধ্যাপক নিখিলেশ পুরকাইতের গবেষণা গ্রন্থ ‘বাংলা অসমীয়া ও ওড়িয়ার উপভাষার ভৌগোলিক জরিপ’–এ রয়েছে। সেটিতে নিখিলেশ পুরকাইত নিজে মানবাংলাতে একটি পাঠ রচনা করে তিন ভাষারই প্রায় সমস্ত ভাষাবৈচিত্র্যে এর অনুবাদ করিয়েছেন। যেহেতু সিলেটি বর্তমান গবেষকের মাতৃভাষা তাই আমরা দাবি করতে পারি অধ্যাপক নিখিলেশ পুরকাইতের নমুনা গ্রিয়ার্সন থেকে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য।আমরা মান বাংলার,মান অসমিয়ার এবং সিলেটি-কাছাড়ি সহ বঙ্গ ভাষাবৈচিত্র্যগুচ্ছের কয়েকটি ভাষা থেকে নমুনা বেছে নিলাম। যেগুলো আমরা পুরো অধ্যয়নে বহুবার ব্যবহার করব। সেগুলো এখানে রইল।

।। মান বাংলা।।৭৭

১) ভারতের চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনের সময় আমি প্রিসাইডিং অফিসার’ ছিলাম। ভোটদানের ব্যাপারটি আমার কাছে বড়ই কৌতুককর বলে মনে হয়েছিল।অশিক্ষিত মানুষ যে কত অসহায় তা সেদিন দেখলাম। এক ভদ্রমহিলা ভোট দিতে এলেন।পোলিং অফিসারদের কাছ থেকে ব্যালট পেপার’--গুলি নিয়ে ভোটিং কম্পার্টমেণ্টের’ টেবিলের নিচে ঢুকে পড়লেন।তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলেন মনের কোনো ঈপসিত বস্তু। ভঙ্গীটা অনেকটা জাল চেপে মাছ ধরার মতো।তাড়াতাড়ি চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম---টেবিলের নিচে কি খুঁজছেন?” ভদ্রমহিলা সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।চোখে মুখে হতাশার ভাব।আমায় বললেন,“আমার ছেলে বলেছে ভোট ঘরে দিতে। ঘর কোথায় পাবো রে বাবা?”

২) লোক সঙ্গীত সংগ্রহের জন্য এক ছাত্রবন্ধুকে নিয়ে বেরিয়েছি পাড়াগাঁয়ে।গাঁয়ের ধূসর পরিবেশের মাঝখানে দুই চকচকে বাবু গিয়ে হাজির।সবাই কৌতূহলের দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।ভাবছে এরা কোথা থেকে এলো।আমার ছাত্র একজন ছেলেকে ডেকে বললো“ও খোকা,দেখত রামবাবু বাড়িতে আছে কিনা। শোন,কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবে,ধুবড়ী থেকে একজন লোক রামবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।”

কিছুক্ষণ পরে দেখি রামবাবু দু’হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলছেন---আসুন,আসুন।ঘরের ভিতরে এসে বসুন।”

প্রথমে পান,তারপর চা এলো।আশান্বিত হয়ে বললাম---শুনলাম আপনি একজন সংগীত রসিক।আপনার কাছে অনেক সংগীত আছে।আমি এগুলির একটা সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করতে চাই।এ ব্যাপারে আপনার সহযোগিতা কামনা করি।”

রামবাবু মিষ্টি হাসি হেসে বললেন“দেখুন,এর আগে অনেকেই আমার কাছে এসেছেন।কিন্তু একবারের বেশি কেউ দু-বার আসেন নি।আপনাকে পরের বার দেখতে পাবো কিনা সন্দেহ।বুঝলেন,এসব কাজ সহজ নয়।এর জন্য অসীম ধৈর্য চাই, প্রতীক্ষা করে থাকতে হয়। নচেৎ লোকের বিশ্বাস ভঙ্গ হয়

আমি হেসে বললাম“আপনি ঠিকই বলেছেন।অনুরাগ না থাকলে মানুষ কোনো কাজেই সফল হতে পারে না

৩) তুমি কোথায় যাচ্ছ?

    আমি কলকাতা যাচ্ছি।

    কলকাতা এক আজব শহরপৃথিবীর সব দেশের মানুষ সেখানে দেখতে পাবে।সব রাস্তা অলগলি শেষ পর্যন্ত গিয়ে মিশেছে দুটি প্রশস্ত পথে।এদের একটি স্বর্গের,অপরটি নরকের।যে যে পথের পথিক,যে যে রসের রসিক,সে ঠিক তাইই পেয়ে যায়। চোর,খুনী,বদমায়েশ,লম্পট,দুরাচার,ধনী,দরিদ্র,জ্ঞানী, গুণী,উদার, মহৎ সব মিলে এক তাজ্জব ব্যাপার। যাকগে,এসব কথার আর দরকার নেই। আসছ কবে?

    বছর দেড়েক পরে।

    চিনতে পারবে তো? দেখো সবটা বদলে যেয়ো না। আমাদের কথাও মাঝে মাঝে মনে করো।

    সময় যায় সেই সঙ্গে মানুষের রূপ,গুণ,খ্যাতি,ঐশ্বর্য সব নিয়ে যায়। আমি কোন ছার।

 

।। ময়মন সিংহ।।৭৮  

১) ভারতের চতুত্থ গণভুটের সময় আমি প্রিসাইডিং অফিসার’ আছ̖লাম̖ ভুট দেওয়ার বেপারটা আমার কাছে খুব মজার মনে হইছিল̖ অশিক্ষিত মানুষ যে কত নিরুপায় হেই দিন দেখ̖লাম̖ একটা মেয়েলুক ভুট দিবার আইল। পুলিং অফিসারে’ কাছ থাইক্যা কাগজ লইয়া ভুটিং কম্পাটমেণ্টের টেবিলের তলে গিয়া ঢুক̖ল।পাতি পাতি কইর‍্যা  বিচরাইতে লাগল মনের মতন কুন জিনিস।ভঙ্গিটা অনেকটা জাল ছাইকা মাছ ধরার মতন। তাড়াতাড়ি চেয়ারের থাইক্যা উইঠ্যা গিয়া জিগ̖গাস̖ করলামটেবিলের –“টেবিলের তলে কি বিচরাইতেছেন?” মেয়েলুকটা সিধা হয়া খারৈল।চক্ষে-মুখে হতাশ হয়া যাওয়ার ভাব আমারে কইল---আমার ছাইল্যায় কৈছে ঘরো ভুট দিবার।ঘর কৈ পাইয়ামরে বা?”

২) লুকসংগীত জুগার করার লাইগ্যা এক ছাত্রবন্ধুরে লইয়া বাইর̖ হইছি পাড়াগেরামে। গেরামের ময়লা অবস্থার মইদ্দে দুই ফুলবাবু গিয়া হাজির।সবেই মজা কইর‍্যা চাইয়া দেখ̖তাছে।ভাবতাছে এরা কৈ থাইক্যা আইল।আমার ছাত্র একটা ছ্যারাকে ডাইক্যা জিগগাস করল---এ ছ্যারা,দেহত রামবাবু বারিত আছে নি।হুন,কেউ জিগগাস করলে কইবে, ধুবরি থাইক্যা একজন লুক রামবাবুর লগে দেহা করতে আইছে

কিছুক্ষণ পরে দেহি রামবাবু হাত জুর কইরা কপালো ঠেকাইয়া কইতাছে---আউহাইন̖ আউহাইন̖ ঘরের ভিত̖রে আইয়া বউহাইন̖

পরথমে পান,তারপরে চা আইন্যা দিল।আশা পাইয়া কইলাম---শুনছি আপনে একজন গানের ভক্ত।আপনের কাছে নাকি অনেক গান জমা আছে।আমি এই গুলির একটা বই ল্যাকতে চাই। এই বিষয়ে আপনের সাহায্য চাই

রামবাবু মুচকি হাইস্যা বললেন“দেহেন অ্যার আগে অনেকে আমার কাছে আইছেন।কিন্তুক̖ একবারের বেশি দুইবার কেউ আসেন নাই।আপনেরে ফির দেখতে পারব কিনা সন্দে।বুজলাইন এই সব কাম সহজ না।এই কারণে খুব ধৈর্য লাগে,অনেক অপেক্ষা করতে হয়।না হইলে মাইন̖ষে বিশ্বাস করে না

আমি হাইস্যা কইলাম“আপনে ঠিকই কইছেন̖খুব জুর ইচ্ছা না থাকলে মাইন̖ষের কুন কাম হয় না

৩)  তুমি কৈ যাইতাছ?

                 আমি কইলকাতা যাইতাছি।

                 কইলকাতা এক আজব শহর।পিরথিমির সব জাগার মানুষ হেইহানো দেকপার পার̖বা।সব রাস্তা অলিগলি শেষ পর্যন্ত গিয়া মিশছে দুইটা বর রাস্তায়। তার একটা স্বর্গের,আর একটা নরকের। যে যে পথের পথিক, যে যে রসের রসিক হি ঠিক তাই পায়। চুর,খুনী,বদমাইস̖,লম্পট,দুরাচার,ধনী,গরিব,জ্ঞানী,গুণী,উদার,মহৎ সব মিল্যা এক তাইজ্জব ব্যাপার।  যাউগগা, এই সব কথার আর দরকার নাই। আইবা কবে?

                বছর দেরেক পরে।

                চিন̖বার পারবা তো? দেহ সবটা বদলাইয়া যাইয়ো না। আমরার কথা মইদ̖দে মইদ̖দ মনো কইরবা।

        সময় যায়। লগে লগে মাইন̖ষের রূপ,গুণ,সুখ্যাতি,ঐশ্বর্য, নাম যশ,সব লইয়া যায়। আমিতো সামাইন̖

 

[মহেন্দ্র চন্দ্র দাস, গ্রাম রণকান্দা, পোঃ তারাকান্দা বাজার, থানা---ফুলপুর, জেলাময়মন সিংহ]

 

।। ঢাকা।।৭৯

১) ভারতের চাইর বারের বার ভোটের সময় আমি পিসাইডিং অপিসার’ আছিলাম।ভোট দ্যাওনের সময় বিষয়টা আমার কাছে বর মজার বইল্যা মনে হইছিল।মূর্খ লোক যে নিরুপায় এটা ঐদিন দেখছিলাম।এক মেয়েলোক ভোট দিতে আইছিল।পুলিং অফিসারগুলির কাছ থাইক্যা বলট কাগজগুলি নিয়া ভোটের ঘরের মইদ্দে গিয়া টেবিলের তলায় ঢুইক্যা পরল।তন্ন তন্ন কইর‍্যা খোজদে লাগল মনের কোন বাসনার বস্তু।ভাবটা একেবারে জাল চাইপ্যা মাছ ধরনের মতন।তাড়াতাড়ি চেয়ার থাইক্যা উইঠ্যা গিয়া জিগাইলাম,“টেবিলের তলায় কি এমন খুজদে আছেন?”মেয়েলোকটা খারা হইয়া দারাইল।চোকে-মুকে হতাশের ভাব।আমারে কইল“আমার পোলায় কইছে ভোটটা ঘরে দিতে। ঘর কই পাইমু রে বাবা?”

২)লোকগীত জোগারের লাইগ্যা এক ছাত্রবন্ধুরে নিয়া গেরামে/গায়ে বাইর হইছি।গায়ের ধূলার মইদ্দখানে দুইজন চকচকা বাবু গিয়া হাজির হইল। হগলই হা কইর‍্যা চাইয়া চাইয়া দেখতে লাগল। ভাবত্যাছে এই মানুষগুলা কৈ থিক্যা আইল।আমার ছাত্র একজন পোলাকে/ছেইলাকে ডাইক্যা কইল---ঐ কোকা,দেখত রামবাবু বাড়ীতে আছে কিনা।হোন কেউ জিগাইলে কবি, ধুবড়ী থাইক্যা একজন লোক রামবাবুর লগে দেখা/ দেহা করতে আইছেন

কতক্ষণ পরে দেখি/দেহি দুইহাত জোর কইর‍্যা কপালে ঠেকাইয়া কইলেন---আহেন আহেন।ঘরে মইদ্দে বহেন

আগে পানসুপারি,পরে চা আইল।আশা পাইয়া কইলাম“হুনলাম, আপনে একজন গীতভক্ত। আপনের কাছে মেলা গান জমা আছে।আমি ঐগুলির একটি বই বাহির করতে চাই।এই বিষয়ে আপনের সাহায্য চাই

রামবাবু মিষ্টি হাসি হাইস্যা কইলেন “দ্যাখেন/দ্যাহেন, অ্যার আগে অনেকেই আমার কাছে আইছিল। কিন্তু একবারেই আইছে, দুইবার কেউই আহে নাই।আপনেরে পরের বার দেখতে পামু কিনা কে জানে। বুজছেন এই হগল কাম সোজা না।অ্যার লাইগ্যা খুব ধৈর্য চাই, অনেক মুখ চাইয়া থাকতে হয়। নাইলে মাইনষে বিশ্বাস করে না

আমি হাইস্যা কইলাম“আপনে ঠিকই কইছেন।আগ্রহ না থাকলে মাইনষে কোনো কামেই সফল হইতে পারে না

৩) তুমি কই যাও?

    আমি কইলকাত্তায় যাই।

    কইলকাত্তা এক আজব শহর। পিথিবির/ দুনিয়ার হগল দ্যাশের লোক সেইখানে দেখতে পাইবা।হগল রাস্তা অলিগলি শ্যাষম্যাষ গিয়া দুইটা বর রাস্তায় মিশ্যা গেছে।এইগুলির একটা সগগের,আর একটা নরকের। যে যে পথের মানুষ যে যে রসের রসিক হে ঠিক ঐটারই পায়।চোর,খুনী,বদমাইশ,লম্পট,দুরাচার,ধনী,গরিব,জ্ঞানী,গুণী,উদার,মহৎ সব মিল্যা এক তাইজ্জব কান্ড।যাউকগা,এই সব কথার আর দরকার নাই। আইত্যাছ কবে?

   বছর দ্যারেক পরে।

   চিনবা তো? দেইখ̖খো, এক্কেবারে বইদ̖ল্যা যাইও না। আমাগো কথাও মইদ্দে মইদ্দে মনে কইরো।

   সময় যায়। সেই সঙ্গে মাইন̖ষের রূপ, গুণ, খেতি, ঐশয্য সব নিয়া যায়। আমি কুন ছার।

 

[মদনগোপাল মণ্ডল, গ্রামআবদুল্লাহপুর, পোঃ মীরকাদিম, থানা---টঙ্গিবাড়ী, জেলা --    ঢাকা]

 

 

।। সিলেটি।।৮০

১) বারতের চাইর নম্বর সাদারণ বুটের সময় আমি প্রিসাইডিং অফিসার’আছলাম।বুট দেওয়ার ব্যাফারটা আমার কাছে বড়উ আসির মনে অইছিল। অশিক্ষিত মানুষ যে কত অসহায় ইটা হিদিন দেখলাম। অ্যাক বদ্রমইলা বুট দিতা আইলা। পুলিং অফিসাররার কাচ তাকিয়া/ তনে/ তাইক্যা ব্যালটপেপার টাইন (হকল) লইয়া বুটিং কম্পার্টমেন্টের টেবুলের তলে ঢুকি পরলা/গেলা। বালা করিয়া খুজতা লাগলা মনর কুনু ফাওয়ার জিনিস বঙ্গিটা অনেকটা আছিল জাল চাপিয়া মাছ দরার লাখান। লগে লগে চেয়ার তাকিয়া/ তনে উটিয়া গিয়া জিগাইলাম“টেবুলের তলে কিতা খুজরা?” বদ্রমইলা সুজা অইয়া দারাইল সউকো-মুকো অতাশার বাব। আমারে কইলা---আমার সেলেয় কইসে বুট গরো দিতে কইসে। গর কই ফাইমুরে বাবা?”

২) গীত জুগার করার লাগি/লাগিয়া/লাইগ্যা এক ছাত্রবন্ধুরে লইয়া গাউও বারইছি।গাউর দুসর পরিবেশর মাজ্যে দুই ফিটফাট বাবু গিয়া আজির।হকলেউ আউয়ার মত চাইয়া চাইয়া দ্যাখের /দেখর।বাবের/বাবরা এরা কইত তাকি আইলা।আমার ছাত্র এক সেলেরে ডাকিয়া/ডাকি কইল ---ওরে বা, দ্যাখ̖সাইন̖ রামবাবু বাসাত আসইন̖নি। হুন কেউ জিগাইলে কইও দুবরীত তাকি/তিকিয়া একজনে রামবাবুর লগে দেখা করতা আইসইন

 কিছু পরে দেকি, রামবাবু দুই আত জুর কইরা /করিয়া কপালো ঠেকাইয়া কইরা---আইন আইন গরর বিত̖রে আইয়া বইন

পয়লা গুয়াপান,তারফরে চা আইল।আশা পাইয়া কইলাম̖---“হুনলাম , আফনে একজন গানরসিক। আফনার কাছে বউত গান জমা আছে। আমি ইতার একটা বই ছাপাইতাম চাই। ঐ ব্যাফারো আফনার সাহাইয̖য চাই

রামবাবু মিটা আসি আসিয়া কইলা –“দেখইন এর আগে বউতেওই আমার কাছে দুইবার কেউ আইসইন̖ না।আফনারে পরের বার দেখতাম ফারমু কিনা সন্দেঅ।বুজলা ইতা কাজ সঅজ নয় (সুজা নায়)এর লাগি/লাগিয়া খুব দৈর্য চাই, বউত অপেক্ষাত থাকতে অয়। নাইলে মানুষের বিশ্বাস ভাঙ্গি যায়

আমি আসিয়া কইলাম---“আফনে ঠিকই/ ঠিকৌ কইসইন।ইচ্ছা না থাকলে মানুষ কুন কামৌ হফল তাইতো পারে না

৩) তুমি কই যাও/ যাইবায়?

    আমি কইলকাতার যাইয়ার/ যাইরাম। কইলকাতা এক আজব জেগা।হকল দেশর মানুষ হিখানো দেখতায় ফাইবায়।হকল সরক অলিগলি শেষ পর্যন্ত গিয়া মিশচে দুই বর রাস্তাত। ইটাইনের একটা হর্গর,আর একটা নরকর।যে যে পতের পতিক, যে যেতা বালা পার হে ঠিক হউতাউ /হটাউ ফাইলার/ফার। চুর,খুনী,বদমাইস,লম্ফট,দুরাচার,দনী,গরিব, গেয়ানী,গুণী হগলে মিলিয়া এক তাইজ্জব ব্যাফার। যাউক গিয়া /যাউগগি ইতা কতার আর দরকার নাই। আইরায় কবে?

     বছর দেরেক ফরে।

     চিনতায় পারবায় তো? দেখ, হকলটাই বদলাইই যাইও না। আমরার কতাও মইদ্দে মইদ্দে মনে করিয়ো।

     সময় যায়। তার লগে মানুষের রূফ,গুণ,খেয়াতি,ঐশর্য হকলতা লইয়া যায়। আমি কুন ছার।

 

[জহর কান্তি দেব; গ্রাম তিলাশীজুড়া, থানা কুলাউড়া, মহকুমা মৌলবী বাজার , জেলা শ্রীহট্ট ও অভিজিত

দাস,গ্রাম মেওয়া; পোঃ- শেওলা; থানা---করিমগঞ্জ , জেলা ---শ্রীহট্ট।]

 

।। কাছাড় ।। ৮১

১) বারতর চাইর নম্বর বুটর সময় মুই প্রিচাইডিং অপিচার আছলাম। বুটর কাম বড় মজার মনো অইছিল। লেখাপড়া নাজানা মানুষ কত যে বিপদো পড়ে হোদিন দেইক̖লাম। এক বেটী মানুষ বুট দিতা আইলা। পুলিং অপিচারর খাসতনে বুটর কাগজ লইয়া বুট দেওয়ার কুটার টেবুলর তলে হোমাইলা। কি জিনিস পাওয়ার লাগি পাতি পাতি খুজা আরম্ব কইরলা। মনে অইল যেমন জাল দিয়া মাছ ধর̖̖রা উড়া-উড়ি করি চেয়ারতনে উটিয়া গিয়া জিগাইলাম“ইন কিতা তুকাইন?” বেটী সিদা অইয়া উট̖লা। চিউক-মুক পাংশা আমারে কইলা ---আমার পুআয় কইসে গরো বুট দিতান। গর ক্যান পাইতামরে বাবা?”

২) গাওর গান জোগাড় করার লাগি এক ছাত্রবন্দুরে লইয়া গাওত বারইছি। গাওর মাটির দুই চক̖চকা বাবু আইআ আজির। হকলে আচানক অইয়া চাইয়া দেইক̖̖রা। চিন্তা করের এরা ক্যানতনে আইলা। আমার ছাত্রয় অ্যাখ̖জনরে ডাকিয়া কইল“ও খুকা, হুন, রামবাবু, বাড়ীত আছইননি? হুন,কেঅ জিগাইলে কইও দুবড়ীত্তনে অ্যাখজন মানষে রামবাবুর লগে দেখা করতা চাইন̖

 কত সময় বাদে দেখি, রামবাবুয়ে দুই আত জোড় করিয়া কপালো লাগাইয়া কইত্রা---আউকা আউকা। গরত বিত̖রে আইয়া বউক্কা

ফইলা গুয়া,তার বাদের চা আইল। খুশি অইয়া কইলাম“হুনচি, আফনে অ্যাখজন গানৰ সমজদার। আফনার খাসে বউত গান জমা আছে। আমি অউতার অ্যাখ বই বার করতাম চাই। ই কামো আফনার সাইয্যর দরকার

রামবাবু মিটা আইয়া কইলা ---দেখইন,এর আগে বউত মানুষ আমার খাসে আইস̖লা। কিন্তু অ্যাখবারর বেশ আর দুইবার আইন̖না।আফনারেও পরর বার দেখা যাইবোনি? বুজছইন ইতা সঅজ নায়। ইতার লাগি বউত দইরয   লাইগব; আর বউত অপেক্ষা করা লাইগব। নাইলে মানষর বিশ্বাস পাইতা নাই

আমি আসিয়া কইলাম“আফনে ঠিক কইছইন। কাম করার মন না থাইকলে কুন কাম ঠিক ঠিক করা যায় না

৩) তুমি কান যাও?

    আমি কইলকাত্তা যাই।

    কইলকাত্তা বড় তাজ̖জব শহর। দুনিয়াইর̖ হকল দেশের মানুষ হন দেখা যায়।হকল পত অল্লিগল্লি হেষে গিয়া বড়সড়কো মিল̖ছে।এর একটা স্বর্গর, আর একটা নরকর। যে যে পতর,যে যে রসর রসিক হে ঠিক হটাউ দেখে।চুর,খুনী,বদমাস̖,লম্ফট,দনী,গরিব,পণ্ডিত,গুণী,উদার,বড় মনর মানুষ হকলে মিলিয়া এক তাজ̖জব বেফার। যাউক ইতা কতা, আর কাম নাই। আইবায় কুন দিন?

    দেড়বচর বাদে।

    চিন্তায় পারবায় নি। দেকিয়ো একেবারে বদলি যাইয়ো না। আমার কতা কুন কুন সময় মন করিয়ো।

    সময় যায়। লগে লগে মানুষে রূপ,গুণ,খ্যাতি,ধনসম্পত্তি স্মৃতি, শ্রুতি হকলতা লই যায়।আমি আর কিতা!

 

  [ শ্রী মহেশ চন্দ্র দাস, গ্রামচন্দ্রপুর, পো: মেহেরপুর, থানা---শিলচর, জেল --কাছাড়]

 

।। কুমিল্লা ।। ৮২

১) ভারতের চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনের সময় আমি প্রিসাইডিং অফিসার’ আছিলাম। ভুটদানের ব্যাপারটা আমার কাছে বড় কৌতুককর বইল্যা মনে হইছিল। অশিক্ষিত মানুষ যে কত অসহায় তাহা হেইদিন দেখলাম। এক ভদ্রমহিলা ভুট দিয়ে আইসিলেন।পোলিং অফিসার’দের কাছ থাইক্যা ব্যালট পেপার’গুলি নিয়া ভুটিং কম্পাটমেণ্টের টেবিলের নিচে ঢুইক্যা পড়চেন। তন্ন তন্ন কইরা খুজতে লাগলেন মনের কুন ঈপ্সিত বস্তু। ভঙ্গীটা অনেকটা জাল চাইপ্যা মাছ ধরার মতো। তাড়াতাড়ি চেয়ার থাইক্যা উইঠ্যা গিয়া জিগাইলাম—“টেবিলের নিচে কিতা খুজত্যাছেন?” ভদ্রমহিলা সুজা হইয়া দাড়াইছেন। চুখে-মুখে হতাশার ভাব। আমারে কইলেন“আমার পোলা কইছে ভুট ঘরো দিত। ঘর কোথায় পাইবো রে বাবা?”

২) লোকগীত জুগাড়ের লাইগ্যা এক ছাত্রবন্ধুরে  লইয়া বাইরইয়াছি পাড়াগ্রামে। গায়ের ধূসর পরিবেশের মইধ্যে দুই চকচইক্যা বাবু গিয়া হাজির।হগলই তাকাইয়া চাইছে।ভাবচে এরা কুনখান থাইক্যা আইল। হগলই আমার ছাত্র একজন পোলারে ডাইক্যা কইল“ওরে পোলা,চাছে রামবাবু বাড়ীতে আছেনি।হুন,কেহই জিগাইলে বলবি ধুবড়ী থাইক্যা একজন মানুষ রামবাবুর লগে দেখা করতে আইছে

কেছুক্ষণ পরে দেখলাম,রামবাবু দুইহাত জুড় কইর‍্যা কপালো হাত দিয়া কইছে---আইয়েন আইয়েন। ঘরের মধ্যে আইয়্যা বন̖

পইলা পান,তারপর চা আইল।আশা পাইয়্যা কইলাম---হুনলাম,আপনে একজন সংগীত রসিক। আপনার কাছে অনেক গান জমা আছে।আমি এইগুলির একটা বই বাইর করতাম চাই।এই ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই।এই ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই রামবাবু মিঠা হাইস্যা কইলেন -- চান এর আগে আমার কাছে অনেকে আইসাছিল।কিন্তু কেহই দুইবার আইয়ে নাই।আপনারে পরের বার দেখতে পামু কিনা সন্দেহ।বুঝলেন এই সব কাম সুজা না।এর লাইগ্যা খুব ধৈর্য,আর খুব আশায় থাকতে হয়। নতুবা মানুষের বিশ্বাস ভাইঙ্গা যায়

আমি হাইস্যা কইলাম---আপনে ঠিকই কইছেন।আগ্রহ না থাকলে মানুষ কুন কামেই আগগাইতে পারে না

 ৩)  তুমি কই চলছ?

      আমি কলিকাতায় যাইতে আছি/ হামু।

      কলিকাতা এক আজব শহর।পৃথিবীর হগল দ্যাশের মানুষ ঐখানে দেখতে পাইবা।হগল রাস্তা অলিগলি শ্যাষে গিয়া মিশছে দুইটা চওড়া পথে।এইগুলির একটা স্বর্গের,আরেকটা নরকের।যে যে পথে পথিক, যে যে রসের রসিক হে ঠিকই তাই পাইয়া যায়।চুর,খুনী,বদমাইস,লম্ফট,দুরাচার,ধনী,গরিব,সব মিল্যা এক আজব কান্ড। যাউক গা,এই সব কথার আর দরকার নাই। আসবা কবে?”

    বছড় দেড়েক পরে।

    চিনতে পারবাতো? দেইখ্য হগলডা বদলাইয়া যাইও না। আমরার কথাও মইধ্যে মইধ্যে মনে কইর।

    সময় ধায়। হেইলগে মানুষের রূপ, গুণ, খ্যাতি , ঐশ্বর্য সব নিয়া যায়। আমি কি আর!

 

    [অনিল চন্দ্র দেব গ্রাম---খারেরা , পো: ফকির বাজার, থানা---বুড়ি চঙ্গ, মহকুমা কুমিল্লা , জেলা

    কুমিল্লা]

 

 

।। নোয়াখালি।। ৮৩

১) ভারতের চতুত্থ সাধারণ নির্বাচনের সময় আঁই প্রিসাইডিং অফিসার’ আছিলাম। ভোট̖ দেওয়নের ব্যাপারটা আঁর কাছে বড়  মজার বুলি মনে অইছিল̖ লেআহড়া নাজানা মানুষ যে কত অসহায় হেইটা (হিয়ান̖)   হেইদিন দেইখ̖লাম। একজন ভদ্রমইলা ভোট̖ দিত আইসে। ফোলিং  অফিসারগো কাছেতুন্ ব্যালট ফেফারগুন লই ভোটিং  কম্পার্টমেণ্টের টেবিলের নীচে ঢুকি ফইড়লেন। তন্ন তন্ন করি খুইজ̖দে লাইগ̖লেন̖ মন̖মত  কন জিনিস। ফন্দিটা একরকুম জাল চাবি দি মাছ ধরনের  আরি তাড়াতাড়ি চেয়ারতুন̖ উডি যাই জিগ̖গাইলাই---আমনে টেবিলের নিচে কিআ খোজেন?” ভদ্রমইলা সোজা অই খাড়াইলেন̖ চোএ-মুএ হতাশের ভাব। আঁরে কইলেন---আর ফোলায় কইছে ভোট ঘরে দিতাম̖  ঘর কনানে পামুরে বা?”

২) লোকসংগীত জোগাড় কইরবার লাই আঁর এক ছাত্র লই গেরামে বাইর অইছি। গেরামের ধূলাবালুর মইধ্যে দুই একজন  চক̖চইক্যা  বাবু যাই হাজির অইছে। ব্যাগগুনে আশ্চজ্জ তাই চাইতো লাইগঝে। ভাইবতেছে  এতারা আবার কোতুন আইল̖আঁর ছাত্র ইজ্ঞা ফোলারে ডাক দি কইলো---এরে খোকা, এক̖কানা চহ̖-চাই রামবাবু বাড়ীতে আছে নি কন।এরই হুন, কেঅয় জিজ্ঞাইলে কইও, ধুবড়ীতুন̖  একজন মানুষ রামবাবুর হঙে দেআ করতো আইছে

কতক্ষণ ফরে দেহি যে,রামবাবু দুই আত জোড় করি কফালে ঠেকাই কইতেছে---আইএন̖, আইএন̖ ঘরেইত্তে আই বইএন̖ 

ফইলা ফান,তারপর চা আইস̖লো।আশা ফাই কইলাম---“হুইন̖লাম,আম̖নে একজন সঙ্গীত রসিক। আম̖নের কাছে নাকি অনেক গান জমা আছে।আঁই এগুনের এক̖কান̖ বই ছাপাইতাম̖ চাই।এই ব্যাপারে আঁই আম̖নের সাহায্য চাই 

রামবাবু মিষ্ট মিষ্ট আঁসি কইলো---দ্যাখেন,ইয়ার আগে অনেকজন আঁর কাছে আইছে।কিন্তু এক̖বারের বেশি দুইবার কেঅ আইএ না/ আসে না” আম̖নেরে ইয়ার ফর আর দেইখমু কিনা সন্দেঅ। বুইঝ̖তে ফাইচ্ছেন̖ , এই সমস্ত কাম সোজা ন।ইয়াত খুব ধৈজ̖জের দরকার,অনেক অপেক্ষা করি থাক̖তে অয়। ন অইলে মাইন̖ষের বিশ্বাস যায় না আঁই আঁইস̖তে আঁইস̖তে কইলাম ---আম̖নে ঠিক কতাই কইছেন।দরদ̖ না থাইক̖লে মানুষ কোনো কামই হাঁসিল কইরতো ফারে না

৩)  তুঁউই কন̖ডে যঅর ?

     আঁই কইল̖কাতা যাইয়ের।

     কইল̖কাতা এক আজব শঅর। দুনিয়ার হককল দেশের মানুষ হিআনে দেইখ̖তা ফাইবা।হককল রাস্তা অলিগলি শেষ পর্যন্ত যাই মিশ̖ছে দুইআন̖ মঅস্ত রাস্তায়।এক̖কান̖ গেছে স্বগ̖গের দিগে, আর এক̖কান̖ নরকের  দিগে। যেতে যেই ফতের ফথিক, যেতে যেই রসের রসিক হেতে/হেইতে ঠিক হিআন̖ ফাই যায়।চোর,খুনী, বদমাইস̖,লম্ফট,দুষ্ট,ধনী,গরীব,গোয়ানী,গুণী,উদার,বড়লোক,ব্যাগ̖গুনে মিলি এক তাইজ্জব ব্যাফার। (আচ্ছা) যঅক̖ গৈ। এইসব কতার আর দরকার নাই। আইবা কন সময়/সমে ?

            বছর দ্যাড়েক ফরে।

চিনতা ফাইর̖বা তো? চাইও এককরে বদলাই যাইও না।    আঙগো কতাঅ মাজে মি আলে মনে রাহিও।

দিন চলি যায় গৈ মাইন̖ষের রূপ , গুণ, নাম, কাম , ধন , দোলত বাইগ̖গিন̖ লই যায়গৈ। আঁই কন̖

ছার। 

[দক্ষিণারঞ্জন কর চৌধুরী, গ্রাম---ধুম; পোঃমহাজনহাট, থানা---মীরেরশ্বরাই, জেলাচট্টগ্রাম। এবং

রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, গ্রাম বসন্তপুর, পোঃ আমজাদঘাট,  জেলা --নোয়াখালি]

 

।। চট্টগ্রাম ।।৮৪

১) ভারতর চৌত্তবার ভুট হনর সমত আঁই প্রিসাইডিং অফিসারে’ আছিলাম। ভুট দিয়নর কাম̖মান আঁর কাচে হাঁসনর  জিনিস বুলি মনত হইল̖ লেখাপড়া নাজানইন্যা মানুষ যে কত দিশায়ারা হইয়ান এদিনাই দেইলাম। উগ̖গোয়া ভালা ঘরর মাঁয়াপোয়া ভুট দিতে আইস̖সে। পোলিং অফিসার’রতুন ব্যালট  কঅস̖সান লইয়ারে       ভুট দিয়নর ঘরর মইদ্দে টেবিলর নিচে টুকি গেলগৈ।খুব ভালগরিয়ারে চাইতো লাইগ̖গে নিজর মনর আশার জিনিসসোয়া।ভাবপান অনেককান জাল দিয়ারে মাছ ধরনর মতো।তাড়াতাড়ি চেয়ারতুন উডি যাইয়ারে জিগ̖গাইলাম---“টেবিলর নিচে কি খুঁজতন? মাঁয়াপোয়াইবা সোজা হইয়ারে থিআইল। ছোগত̖-মুত̖ হতাশার চিন্ন। আঁরে কইলেন“আর ফুআ কইয়ে যে ভুট ঘরইতর দিতাম। ঘর কোডে ফাইয়ম̖রে বাবা?

২) দেশইত্তা গয়ন জোগাড় গড়িবার লাই উগগোয়া ক্লাসর হঙ্গীয়ারে লইয়ারে বাইর হই পাঁড়াগঁত। গঙর নিরিবিলি জাগার মাইদ্দান্দি দুবা চকচইক্কা বও যাইয়ারে পৈঁছে ব্যাজ্ঞুন আগ্রহ করিয়ারে এক̖কানা এক̖কানা চার। ভাবেরর যে ইতারা কৌতুন আইসসে।আঁর ছাত্রইবা উগগোয়া ফুয়ারে ডাইয়ারে কৈল---ওড়া চাত রামবও ঘরত আছে না নাই। হুন, কেঅ জিজ্ঞাইলে কোবি,ধুবড়ীর তুন উগগোয়া মানুষ রামবওর হঙ্গে দেখা কইরতো আইসসে

কতঅন ফরে দেইরযে,রামবও হাতদুনান̖ জোড়গরি কোয়ালত লাগাই কইলেন যে আস্তক আস্তক।ঘরর ভিতরত আইয়ারে বস্তক̖

ফোইলা সোয়ারি,ইতার ফরে আইল̖ চা।বড় আশা গরি কইলাম“হুন্নি যে অনে উগ̖গোয়া গান ভালা ফইন্না মানুষ।অনর কাছে বউত গয়ন রাইকখন̖আঁই উনরতুন উগ̖গোয়া মিলাইয়ারে বই বাইর̖ গোইর̖তাম চাইর̖ আঁই আশা গরি একামত যোগ দিবাক̖

রামবও এককানা মিডা হাঁসিয়ারে কইলেন---চাতক ইতার আগে বউত মানুষ আঁর কাছে আস̖সিল̖ কিন্তু একবারর বেশি দুইবার কেঅ নোয়াইয়ে।আঁর সইন্দেঅ হজ্জে অনরে ফররবার দেইত ফাইর̖গম̖ কিনা। বুঝিলাক এই খামিন এব্বারে সোজা ন।এতাই লাই দস্তুরমতো ধৈর্য চাই,গোইর আশা থম ফরিবো।নইলে মানুষর বিশ্বাস ভাঙি যাগই

আঁই হাঁসিয়ারে কইলাম---“অনে ঠিকই কইয়ন̖আশা না থাইলে মানুষ কন কামক ভালা গরিত নপারে 

৩) তুঁই কোডে যঅজ্জে ?

    আঁই কইলকাতাত যাইর̖বে।

    কইল̖কাতা একখান আজব শঅর। পৃথিবীর হক্কল̖ যাইয়ারে বড় রাস্তা দুবার হঙ্গে মিল্লেগৈ। এডের উগ̖গোয়া স্বর্গর,আর উগ̖গোয়া নরগর। যিবা যে রাস্তার মানুষ,যি যিয়ান ফাইতোচা ইতে ঠিক হিয়ানেই ফায় যাগৈ। চোর,খুনী, বদমাইস̖,লম্ফট̖ ,অসৎ,থইয়া,নথইয়া,জ্ঞানী,গুণী,মনঘোলা,মহৎ,ব্যাগগিন মিলিয়ারে এক্কেবারে একখান তাজ্জব কাণ্ড। যাগগৈ , এতিন কতার কয়নর দরকার নাই। আইয়র কঁঅতে?

   বছর দেরেগ ফরে।

   ছিনিত ফারিবা তো? চাইয়ো গোডা বদলাই ন যাইয়োগৈ। আঁরার কতাও মইদ্দে মইদ্দে মনত কইরগো।

  সময় যার গোই। হিতার হঙ্গে মানুষর চেয়াঁআ , গুণ, যশ, টেঁয়াপয়সা, ব্যাগগিন লই যাগৈ। আঁর কতা বালাই

  দিঅ।

 

  [মুকুন্দ প্রসাদ দাস, গ্রাম, পো: অ: ও থানা---পটীয়া , জেলা---চট্টগ্রাম]

 

।। অসমিয়া।। ৮৫

১) ভারতর চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনর সময়ত মই প্রিসাইডিং  অফিচার’ আছিলো। ভোট দিয়া বিষয়টো মোর বাবে এটা কৌতুহলপূর্ণ ঘটনা বুলি বিবেচিত হৈছিল। অশিক্ষিত মানুহ যে কিমান অসহায় সেইটো সিদিনা উপলব̖ধি করিলো।এজনী ভদ্রমহিলাই ভোট দিবলৈ আহিল̖ পোলিং অফিচার’ বিলাকর পরা ব্যালটপেপার’ লৈ ভোটিং কম্পার্টমেণ্টের’ (কম্পার্টমেণ্টর ) টেবুলের (টেবুলর) তলত সোমাই পরিল̖ পাট̖ পাট̖ কৈ বিচারিব ধরিলে তেঁওর মনর কোনো এটি বাঞ্ছিত বস্তু।ভঙ্গীটো ঠিক জাল চেপি মাধ মাছ ধরার দরেই।তৎক্ষণাৎ চেয়ারর/চকির পরা উঠি সুধিলো---টেবুলর তলত কি করিছে?” ভদ্রমহিলাই পোন হৈ থিয় হল̖ চকুবে̖-মুখে হতাশার ভাব। মোক কলে –“মোর লরাই ভোট ঘরত দিব কৈছে। বোপাই ঘর ক’ত আছে?”

২) লোক সঙ্গীত সংগ্রহর কারণে এজন ছাত্রবন্ধুক লাগত (লগত) লৈ এখন গাঁওলৈ ওলাই ছিঁলো। গাঁওর ধূলিময় পরিবেশর মাজত দুজন চাফ̖চিকুন বাবু গৈ উপস্থিত।সকলোবে কৌতূহলেরে জুমি জুমি চাব ধরিলে। ভাবিছে এঁওলোক নো কর পরা আহিল̖ মোর ছাত্র এজনে (ছাত্রই।কারণ, ছাত্র  একাধিক ছিলনা, তাই এজনে’ বাহুল্য মাত্র ---বর্তমান গবেষক ) এটা লরাক মাতি কলে“হেরা লরা রামবাবু ঘরত আছে নে চোবা̖চোন? শুনা, কোনেবাই সুধিলে কবা ধুবুরীর পরা এজন মানুহে রামবাবুর লাগত (লগত) দেখা করিব আহিছে

অলপ পিছতে দেখিলোঁ দুই হাত কপালত থৈ রামবাবুবে̖ কৈছে“আহক আহক।ঘরর ভিতরত আহি বহক

প্রথমতে তামোল,তার পিছতে আহিল চাহ̖ আশান্বিত হৈ  সুধিলোঁ---আপনি (আপুনি) হেনো এজন সংগীতপ্রেমী।আপোনার ওচরত বহুত গীত সংগ্রহ করা আছে। মই এই বিলাকর এখন সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করিবর ইচ্ছা করিলে এই ক্ষেত্রত আপোনার সহযোগিতা কামনা করিলোঁ

রামবাবুবে̖ মিচিকিয়া হাঁহিরে কলে ---চাওক ইয়ার আগতে অনেকে মোর ওচরলৈ আহিছিল̖কিন্তু এবারত কৈ বেছি দুবার অহা নাই।আপোনাকে দ্বিতীয়বার দেখা পাঁও নে নেপাঁও  সন্দেহ̖ বুজিছে, এইবিলাক কাম সহজ নহয়।ইয়ার বাবে অসীম ধৈর্যর প্রয়োজন,খুব অপেক্ষা করি থাকিব লাগে। নহলে মানুহর বিশ্বাস হেরুবা̖ব লগা হয়

মই হাঁহি কলোঁ---“আপনি ঠিকেই কৈছে। অনুরাগ নেথাকিলে মানুহে কোনো কামতেই কৃতকার্যতা লাভ করিব নোবা̖রে

৩) তুমি কলৈ যোবা̖ ?

    মই কলিকাতালৈ যাঁও।

    কলিকতা এখন অদ্ভূৎ চহর। পৃথিবীর সকলো দেশর মানুহ̖  তাত দেখিবলৈ পাবা। সকলো সরু-ডাঙর রাস্তা গৈ শেষত লগ লাগিছে দুটা ডাঙর আলিত। ইয়ার এটা হৈছে স্বর্গর , আনটো নরকর। যিয়ে যি-পথর পথিক, যিয়ে যি-রসর রসিক সিয়ে ঠিক সৈইয়ে পায়।চোর,ডকাইত̖,বদমাইচ,লম্পট,দুরাচার,ধনী,দুখিয়া,জ্ঞানী,গুণী, উদার,মহৎ সকলোবে̖ মিলি এক আচরিত কাণ্ড।যাব দিয়া,এইবিলাক কথার দরকারেই নাই। আকৌ কেতিয়ালৈ আহিবা? দেড় বছরমানর পিছত।

চিনিব পারিবা তো? চোবা একেবারে বদলি নেযাবা। আমার কথাও মাজে মাজে মনত পেলাবা।

সময় যায়।আরু তার লগে লগে মানুহর রূপ,গুণ,খ্যাতি,ঐশ্বর্য সকলো লৈ যায়। মই তো নগণ্য।

 

[উদ্ধব চন্দ্র কলিতা, প্রধান অধ্যাপক, অসমীয়া বিভাগ, ভোলানাথ কলেজ, ধুবড়ী, আসাম যোগেন্দ্রনাথ ফুকন, প্রাধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, গৌহাটী বিশ্ববিদ্যালয়, আসাম] 

 

এই অসমিয়া নজিরে মারাত্মক কিছু ত্রুটি আছে। কিছু ছাপার ভুল হতে পারে,আমরা সেগুলো নিম্নরেখ করে শুদ্ধ গুলো বন্ধনীতে দিলাম।তদুপরি অসমিয়া অন্তস্থ-ব এর লিপ্যন্তর বিভ্রান্তিকর বলে আমাদের মনে হয়েছে,‘চকুবে̖-মুখে’ -তে যেমন।হলন্ত চিহ্নের( ̖ ) পরে স্বরের চিহ্ন বেমানান।বাংলাতে য়/য়া/অ/আ’ দিয়ে সেগুলো প্রকাশ করলেই সঠিক হয়।আমরা এর পরে কোথাও এমন শব্দের উল্লেখ দরকার পড়লে তাই  করবো।চকুয়ে-মুখে’,‘চোআচোন’,‘যোআ’ ইত্যাদি।এমনিতে অসমিয়া নমুনাটি আমরা বিশেষ ব্যবহার করব না।কিন্তু একই নমুনার অসমিয়া রূপ ভাষার বৈচিত্র্য বুঝতে সহায়ক হবে বলে এটিও সঙ্গে রইল।

এমন কিছু কিছু পাঠ বিভ্রান্তি সিলেটি কাছাড়ি নমুনাতেও আছে।যেহেতু শেষ পর্যন্ত পুরো নির্ভর করা যাচ্ছে না, তাই এটি এবং এর সঙ্গে সুরমা গাঙর পানি’ উপন্যাস থেকে নিচের অংশটি আমরা বেছে নিয়ে আসাম ত্রিপুরার বিভিন্ন গ্রাম শহরে গেছিলাম।আমাদের ভ্রমণ শুরু হয়েছিল ধর্মনগর থেকে, এছাড়াও করিমগঞ্জ জেলার শ্রীগৌরী, বদরপুর, কাছাড়ের শিলচর শহরের কাছে চেঙকুড়ি, মাছিমপুরে নানা বৃত্তি, বর্ণ, শিক্ষা এবং বয়সের নারী-পুরুষের সঙ্গে দেখা করে কিছু সাধারণ বার্তালাপ রেকর্ড করে এনেছি।সেগুলো যথাসম্ভব বিশ্লেষণ করে ব্যবহার করব।এছাড়াও ধর্মনগর থেকে ড রামকৃষ্ণ দেবনাথের ১৯৮০তে (বাংলা ১৩৮৭) প্রকাশিত নাটক হকুনর ছাও’ নাটকের একটি প্রতিলিপিও আমাদের সংগ্রহে এলো। দুই একজন কে আমরা নিখিলেশ পুরকাইত এবং রণবীর পুরকায়স্থের সিলেটি কাছাড়ি নমুনার পাঠ দিয়ে বলেছিলাম,‘আপনি যেভাবে কথা বলেন সেই অনুযায়ী যদি মনে হয় এই পাঠে কোনো ভুল আছে তবে শোধরে নিন সেরকম দুই সংশোধনীই আমরা জোগাড় করেছি। একটি ধর্মনগরের বাসিন্দা আমার আত্মীয়প্রবর হিমাদ্রি দেব আর অন্যজন শিলচর শহরের কাছাড়ি মূলের বন্ধুবর নীলকণ্ঠ দাস।কিন্তু দুই জনের বেলাতেই দেখা গেল তাঁরা পাঠদুটোকে উলটো মুখে শোধরে দিতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। অর্থাৎ একটা সিলেটি মানের দিকে আসবার প্রবণতা দেখাচ্ছিলেন,যে সিলেটির সঙ্গে শিলচর শহরের মানুষ পরিচিত। হিমাদ্রি দেবকে বারংবার বলা হচ্ছিল,আপনারা কইর‍্যা’,‘ইটি’ এমন ক্রিয়া সর্বনাম ব্যবহার করেনতিনি বলছিলেন সে তো ধর্মনগরে থাকতে থাকতে হয়ে গেছে।আমাদের বলে বোঝাতে হয়েছে এটাই আমাদের চাই।ধর্মনগরের অধিকাংশ বাসিন্দাই সিলেটি এবং মৌলবী বাজার নতুবা হবিগঞ্জ থেকে নানা সময়ে এসেছেন বা ইতিহাসের বিভিন্ন সময় সিলেট যখন ত্রিপুরা রাজ্যের অধীনেও ছিল তখন এই সব ভূখণ্ডকে আলাদা করা মুশকিল ছিল।তাই সেখানকার ভাষা সদর সিলেট কিম্বা করিমগঞ্জ থেকেও অনেক ভিন্ন,কাছাড় থেকে তো বটেই।আমরা হকুনের ছাও’ দেখেও যথাস্থানে নজির দেখাব সেরকম অভিজ্ঞতা আমরা প্রায় যাদের সঙ্গেই কথা বলছিলাম,হচ্ছিল।মাছিমপুরের নিজজয় নগরে সুশীল দাসের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলছিলাম।বাইরে তখন মহিষ দিয়ে ধান মাড়াই হচ্ছে। তিনিও বার্তালাপে ‘মহিষ’,wife ইত্যাদি ব্যবহার করছিলেন।এক সময় বাইরে এসে শুনলাম,যারা ধান মাড়াইতে ব্যস্ত ছিলেন,তারা বলছেন,‘বয়ারর মড়াই’তখন ভেতরে গিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম,আপনিতো ‘মহিষ’ অনেকবার বললেন,‘বয়ার’ বললেন না।তখন তিনি বললেন,‘অলা কইতাম নি?অয় তো তখন যেন তাঁর প্রাণ কথা বলে উঠল,তিনি তাঁর এক প্রতিবেশীকে নকল করে নিজেই এক কথোপকথন রেকর্ড করলেন।এই পুরো পরিক্রমাতে আমাদের মনে হল প্রতিটি থানা ধরে নমুনা নিলেও ভাষার বৈচিত্র্য ধরা দেবে।আমাদের কাজ যদি হতো শুধুই সিলেটি ভাষার একটি সামগ্রিক অধ্যয়ন তবে সেটা করাই উচিত।দরকারে মানুষজনের এই অধ্যয়ন সম্পর্কে অসচেতন মুহূর্তে বার্তালাপ ধরে আনতে পারলে আরো ভালো হতো।ভাষাবিজ্ঞানীরা সেইভাবেই কাজ করেন।তবু, আমরা যেটুকু পেলাম মনে হয় খুব কম কিছু নয়।বাংলাদেশের সিলেট,মেঘালয়ের শিলং,ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার হোজাই,লংকার মতো সিলেটি অধ্যুষিত অঞ্চলে আমরা যেতে পারিনিকিন্তু,চেনা বন্ধুদের থেকে নানা ভাবে সাহায্য পেয়েছি। কেউ পাঠানো পাঠ অনুবাদ করে দিয়েছেন।তাদের মধ্যে সিলেটের কথাশিল্পী ইকবাল তাজোলি,শিলঙের কবি সুমিতা দাস রয়েছেন। কেউ বা সংলাপ রেকর্ড করে পাঠিয়েছেন।এ ছাড়াও আন্তর্জালে আজকাল সিলেটি গান,নাটক,কৌতুক নকসা সহজ লভ্য। সেগুলোও আমরা কাজে লাগিয়েছি।

‘সুরমা গাঙর পানি’ উপন্যাসের নমুনা কয়েকটি এরকম:

 ১) প্রসঙ্গ শাহজালাল৮৬

--তাই আর কেউ নায় বেটা, তাইন হজরত শাহজালাল। নাম হুনচছনি।

--হুনতামনা কেনে? তাইন আনছিলা জালালি কইতর, আল্লায় দিছলা তানে।

--অয় হক্কলতাউ আল্লায় দেইন। তান বাড়ি কই আছিল জানছ নি। তান বাড়ি কই আছিল জানছ নি। নবিজির দেশ কই জানছ নি? আরব, আরব থাকি আইছলা, এমেন বুলে আছিল তান দেশ। তুরুক হকলর লগে থাকতা। তানে একবার তান গুরুয়ে কইলা, যাও হিন্দুস্থান। হিন্দুস্থানো গিয়া আল্লার নাম জপ করবায়। কইয়া তানে এক কটাত এক মুইঠ মাটি ভরি দিলা, কইলা, অউ মাটি যে মাটির লগে মিলব হনোউ তুমার কাম। দিল্লি দাল্লি বউত ঘুরলা, মাটি আর মিলে না, বউত শিষ্যসাবুত অইল। তিনশ জনরে লইয়া আইলা চান্দনি ঘাটো। তখন ছিলট এক গাউ, গাউর এক টিল্লাত আইয়া বানাইলা ছাপটা। থাকলা, আবার তো যাওয়ার সময় অইল, আকতা তান মনো অইল মাটির কটার কতা। মিলাইবা, মারহাবা, মিলি গেল। অউটিল্লাত দরগা বানাইলা, ইন্দারা পানির লাগি। অউ ইন্দারার পানিত জানছ নি কিতা আছে, খাইলে কুনু অসুখ বিসুখ থাকে না। মস্ত মস্ত গজার মাছে ভর্তি। অউ কুয়া আর মক্কার জমজম বুলে একঅউ পানি, তলে তলে আইছে।

২) প্রসঙ্গ মঙ্গলচন্ডীর বর্ত৮৭

--- আইজ আবার কিতার বর্ত।

--- আইজ মঙ্গলবার নানি। মঙ্গলচন্ডীর বর্ত।

--- এ হিদিন নু দিলায় একবার।

--- হি ত আছিল বিপদনাশিনী।

--- না না আরো কিতা আছিল। বর্তর কথাও সুনাইলায়। অউ যে এক রানিয়ে কইলা গরুর মাংস দেখতা, তান দাসীয়ে দেখাইলা। রাজায় গরুর মাংস দেখাত গিয়া দেখইন এক থাল ফুল পড়ি রইছে থালো। তেউ আর রানিরও মরা অইল না দেবীর বরে। তাইন কে?

---তাইন অউও সঙ্কটা।

---তে আর এক গপ আছে আর এক বেটির। এক  দুধ আলিয়ে করছিল বর্ত। তাইর বউত পয়সা অই গেল দুধ বেচিয়া। পয়সা অওয়ায় তাইর ঘুম অয় না। তাই ধারোর বাড়ির বেটিরে কইল, আমারে খামচাই দেও দেখি, একটু কান্দতাম। কান্দিয়া হুপাই হুপাই ঘুমাইতাম।

---না না। বর্তর কথা ইলাখান কয় না। সুন্দর করিয়া সাজাইয়া কওন লাগে। আমি কই হুনো। না, অখন কইতাম নায়। যেদিন বর্ত করমু, চান উন করিয়া ঘুমটা দিয়া পড়মু, হুনিও। অখন হাচা কথা খান কইলাও।

---হাচা মিছার কিচ্ছু নাই। সীতা মারি রাবণ আনলা, অউত্ত রামায়ণ।

৩) প্রসঙ্গ বরাক৮৮

---ওরেবা, সুরমা তো অইলা পরে। যার পরসাদে রামর মা তারেউ তুমি চিন না। অউ যে দেখরায় নীল নীল বাতাসর রঙর পাহাড় ওখান তাকি বার অইছইন বরাক, একটু আউজ্ঞাইয়া অইছইন কুশিয়ারা, সিলেটো গিয়া অইছইন সুরমা। এনে ইখানো বন্ধ করি দেও, কও আর যাইতায় পারতায় নায়, দেখবায় তুমার গাউত পানি নাই। কিতা নাম নানি তুমার গাউর।

---বইয়াখাউরি।

---তুমি তো সুনামগঞ্জি নানি। তুমার মাতে বুজা যায়। সিলেটি মাতর আছে তিন রকম। সুনাম গঞ্জর মাইনষে একেবারে নদী আর মাটির লগে মিলাইয়া মাতইন। করিমগঞ্জর মানুষও অলাখান। সদর সিলেটর মাইনষে ভাবইন তারাউ আসল সিলেটি, মাতো মিঠা নাই। কিন্তু তারা আছইন দুনিয়ার হক্কলখানো। কত বড় বড় মানুষ। আর হবিগঞ্জি তারা কুনু সিলেটি নি। কি রকম গুলগুল করিয়া মাতইন। যাইতান নাতা, খাইতান নাতা। তারা আর বাইন্যাচঙি, সিলেটি অইয়াও সিলেটির লাখান লাগে না। একটু বেশি মিঠা।

---আপনেও কিতা সুনামগঞ্জি নি।

---নারেবা আমি কাছাড়ি। আমার নদী আলাদা, তাইন ও পাহাড়ি, খুব গুসা তান। আমরার গাউর উপরেউ তান গুমগুমি। কুনদিন নিশ্চিহ্ন হই যাইব আমার বড়খলা জাটিঙার যাতাত। জঙ্গল উঙ্গল সাফ, কত হাত্তি আছিল,  হাত্তির খলা আছিল। অখন নাই।

 

।। উল্লেখ পঞ্জি ।।

১) চার্লস ফার্গুসন:লিঙ্গুইস্টিক ডাইভার্সিটি ইন সাউথ এশিয়া(১৯৬০); হুমায়ুন আজাদ বাংলা অনুবাদ করে

    উদ্ধৃতিটি ব্যবহার করেছেন ‘অবতরণিকা’-তে; বাঙালা ভাষাতত্ত্ব;বাঙলা ভাষা,প্রথম খণ্ড;আগামী

    প্রকাশনী;ঢাকা;ফেব্রুয়ারি,১৯৯৭;পৃ:90 ৯০

২) সঞ্জীব দেবলস্কর: প্রসঙ্গ সিলেটি ভাষা;বাঙালনামা,দ্বিতীয় বর্ষ,দ্বিতীয় সংখ্যা;

                http://bangalnama.wordpress.com/2010/09/13/prasango-sylheti-

                bhasha/

৩) তপোধীর ভট্টাচার্য : সিলেটি উপভাষা: প্রসঙ্গ অনুষঙ্গ;কোরক সাহিত্য পত্রিকা, প্রাক শারদ 

    ১৪১৮ সংখ্যা;সম্পাদক তাপস ভৌমিক;কলকাতা;পৃ: ১১৫

৪) সঞ্জীব দেবলস্কর;প্রাগুক্ত।

৫) সঞ্জীব দেবলস্কর;প্রাগুক্ত।

৬) সঞ্জীব দেবলস্কর;প্রাগুক্ত।

৭) সঞ্জীব দেবলস্কর;প্রাগুক্ত।

৮) সঞ্জীব দেবলস্কর;প্রাগুক্ত।

৯) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:ভাষাবিচ্ছেদ;পরিশিষ্ট,শব্দতত্ত্ব;রবীন্দ্ররচনাবলী,৬ষ্ঠ খণ্ড;১২৫তম

    জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বিশ্বভারতী প্রকাশিত  সুলভ সংস্করণ;পৃ: ৭৪১

১০) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর;প্রাগুক্ত;পৃ: ৭৪১

১১) পবিত্র সরকার:বাঙালি কে?; ভাষাপ্রেম ভাষাবিরোধ;দেজ পাবলিশিং,কলকাতা ৭৩;

      জানুয়ারি,২০০৩;পৃ: ৯৩

১২) পবিত্র সরকার;প্রাগুক্ত;পৃ:৯৩

১৩) পবিত্র সরকার:ভাষাপ্রেম ভাষাবিরোধ;প্রাগুক্ত;পৃ:১৩

১৪) ড উপেন রাভা হাকাচাম:অসমীয়া ভাষাত তিব্বত-বর্মীয় উপাদান: কিছু নতুন চিন্তার

      উন্মেষ; অসমীয়া আরু অসমর তীব্বত -বর্মীয় ভাষা; প্রকাশিকা: শ্রীমতি মঞ্জুলা রাভা

      হাকাচামজাক;তৃতীয় সংশোধিত সংস্করণ;এপ্রিল,২০০৭;পৃ: ৪১

১৫) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: বাংলা ব্যাকরণ;শব্দতত্ত্ব;প্রাগুক্ত;পৃ: ৭৫৩

           ১৬) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: চলতি ভাষার রূপ;বাংলা শব্দতত্ত্ব;রবীন্দ্র রচনাবলী; ভাষাপ্রযুক্তি গবেষণা   

                 পরিষদ,কলকাতা পরিবেশিত বৈদ্যুতিন সংস্করণ;

                 http://www.rabindra-rachanabali.nltr.org/node/8633

১৭) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:বিবিধ;বাংলা শব্দতত্ত্ব;প্রাগুক্ত।

১৮) হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৭

           ১৯) সুকুমার সেন:মধ্য ভারতীয় আর্য;নবম অধ্যায়;ভাষার ইতিবৃত্ত;আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট

      লিমিটেড, কলকাতা-৯;প্রথম আনন্দ সংস্করণ,তৃতীয় মুদ্রণ;নভেম্বর,১৯৯৪;প্রাগুক্ত;পৃ: ১০৭

২০) রামেশ্বর শ:মধ্যভারতীয় আর্যভাষাঃ দ্বিতীয় স্তর;সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা;পুস্তক

      বিপণি,কলকাতা– ৯;অখণ্ড দ্বিতীয় সংস্করণ;৩০শে শ্রাবণ,১৩৯৯;পৃ: ৫৮২

২১) হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৮

২২) হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫০

২৩) হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫০

২৪) হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫০

২৫) হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫০

২৬) হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫০

২৭) Suniti Kumar Chatterji:Introdcution;The Origin and

Development of the Bengali Language; Rupa & Co, Kolkata;1993;pg.:108.

২৮) ড উপেন রাভা হাকাচাম: গ্রন্থকারর আষারচারেক;অসমীয়া আরু অসমর ভাষা-

      উপভাষা;জ্যোতিপ্রকাশন;গুয়াহাটি-০১;জুলাই ২০০৯

২৯) ড উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত।

৩০) ড উপেন রাভা হাকাচাম: উত্তর-পূর্বাঞ্চলর ভাষাগত ক্ষেত্রত অসমর ভাষাসমূহর সহ-

      অবস্থান আরু অসমীয়া ভাষা সমৃদ্ধি সাধনত ইবিলাকর ভূমিকা; অধ্যায়ঃ১;প্রাগুক্ত;পৃ: ১

৩১) জয়ন্তী সাহা:ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলা ভাষা: এটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা;অসমীয়া আরু

      অসমর ভাষা; সম্পাদনা--ড বিশ্বজিৎ দাস এবং ড ফুকন চন্দ্র বসুমতারী;আঁক-বাক;

      গুয়াহাটি;২০১০;পৃ: ৫০

৩২) ড উপেন রাভা হাকাচাম: অসমীয়ার জাতিগত আরু সামাজিক শ্রেণীগত উপভাষা;

      অধ্যায়ঃ ৫;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮১

৩৩) ড উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮১

৩৪) ড উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০৭

৩৫) George Abraham Grierson: Eastern Bengali; Indo-Aryan Family,

      Eastern Group;Vol-V ,Part I;Linguistic survey of India;

      compiled and edited by George Abraham Grierson;Calcutta :

      Office of the Superintendent of Government Printing, India,

      1903-1928.pg.:222,292222229, and 234.

                 http://dsal.uchicago.edu/books/lsi/lsi.php?volume=5-1

                 &pages=463#page/237/mode/1up

৩৬) George Abraham Grierson; ibid.;pg.:232.

৩৭) সঞ্জীব দেবলস্কর;প্রাগুক্ত।

৩৮) উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ:২৯৮

৩৯) জগন্নাথ চক্রবর্তী:লেখকের নিবেদন;জগন্নাথ চক্রবর্তী; বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা

       ভাষার অভিধান ও  ভাষাতত্ত্ব; ভাষা-সংস্কৃতি আকাদেমি অসম, হাফলং; প্রথম প্রকাশ-

       বৈশাখ, ১৪২২বঙ্গাব্দ

৪০) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত।

৪১) রণবীর পুরকায়স্থ: উজান পর্ব,ছয়; সুরমা গাঙর পানি;একুশ শতক, কলকাতা-৭৩;

      অক্টোবর, ২০১২;পৃ: ১০২

৪২) সিলেটি উপভাষা: ঐতিহাসিক এবং ভাষাতাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিত; শ্রীহট্ট-কাছাড়ের প্রাচীন

      ইতিহাস ও সংস্কৃতির রূপরেখা; সম্পাদনা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ চৌধুরী, সুনির্মল দত্ত চৌধুরী,

      অমলেন্দু ভট্টাচার্য, মানবেন্দ্র ভট্টাচার্য;বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ,শিলং;১৯৯৬;পৃ: ১৯২

৪৩) Sudhāṃśu Śekhara Tuṅga; Bengali and Other Related Dialects

      of South Assam; Mittal Publications, New Delhi-59; first

      Edition, 1995.

৪৪) উপেন রাভা হাকাচাম; প্রাগুক্ত;পৃ:২৭৬

৪৫) ড উপেন রাভা হাকাচাম; প্রাগুক্ত;পৃ:২৭৬

৪৬) সুশান্ত কর:বাঙালি ও বাংলা ভাষার ভোটবর্মী আত্মীয়তার সন্ধানে;সালনাম,বড়দিন এবং

      নববর্ষ সংখ্যা; ২০১০;গারো স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (গাসু), বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয়

     পরিষদের মুখপত্র;সম্পাদক—জনি মানখিন; পৃ: ৪

      http://ishankonerkotha.blogspot.in/2010/11/blog-post.html

৪৭) ড উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ:২৭৬

৪৮) ড উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ:২৭৬

৪৯) অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি: ত্রিপুর বংশীয় রাজগণ; শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত;পূর্বাংশ;

      কথা;কলকাতা;২০১০;পৃ:১৪৪

৫০) অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি;প্রাগুক্ত;পৃ:১৪২

  ৫১) আধুনিক অসমীয়া অভিধান:সম্পাদক ড মহেশ্বর নেওগ, রজনীকান্ত দেবশর্মা,নবকান্ত

        বরুয়া; অসম প্রকাশন পরিষদ;গুয়াহাটি;চতুর্থ পুনর্মুদ্রণ-মে১৯৮৯;পৃ:৫৫৭

৫২) উপেন্দ্রচন্দ্র গুহ: কাছাড়ের ইতিবৃত্ত; অসম প্রকাশন পরিষদ;গুয়াহাটি; ২০০৪;পৃ: ৮৪

৫৩) বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়:রাজসিংহ; ষষ্ঠ খণ্ড, দ্বাদশ পরিচ্ছেদ;বঙ্কিম উপন্যাস

      সংগ্রহ;রিফ্লেক্ট পাবলিকেশন; কলিকাতা ০৯;পৃ:৫৭৪

৫৪) ড উপেন রাভা হাকাচাম;অসমীয়া আরু অসমর তীব্বত -বর্মীয় ভাষা;প্রকাশিকা:

      শ্রীমতি মঞ্জুলা রাভা হাকাচামজাক;তৃতীয় সংশোধিত সংস্করণ;এপ্রিল,২০০৭;পৃঃ৯৬

৫৫) ড উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ:৬৭

৫৬) বগাকাইন হ্রদ:উইকিপেডিয়া,মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে;

      https://bn.wikipedia.org/wiki/বগাকাইন_হ্রদ

৫৭) রবীন্দ্র কুমার দত্ত:পরিশিষ্টঃ১;নির্বাচিত শব্দকোষ;নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের উপভাষা

      একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ;প্রগ্রেসিভ পাব্লিশার্স;কলকাতা-৭৩;মার্চ,২০১২;   

      পৃ: ২৫৭

৫৮) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ:২৫৩

৫৯) সমরেশ মজুমদার: ছায়ার শরীর;আনন্দবাজার পত্রিকা,শারদীয়া ১৪১৭;সম্পাদক

      অভিক সরকার;এবিপি প্রা: লিমিটেড;কলকাতা ৬০;পৃ: ১২৭

৬০) সঞ্জীব দেবলস্কর;প্রাগুক্ত।

৬১) নিখিলেশ পুরকাইত: লেখকের কথা; বাংলা অসমীয়া ও ওড়িয়ার উপভাষার ভৌগোলিক

      জরিপ;সুবর্ণ রেখা,কলকাতা-৯;প্রথম প্রকাশ,জুন,১৯৮৯;পৃ: vii

৬২) George Abraham Grierson;ibid.;pg.:229.

৬৩) উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৭

৬৪) ড রমেশ পাঠক:অসমীয়া আরু চিলেটী ভাষা;তৃতীয় অধ্যায়; উপভাষা বিজ্ঞানর

      ভূমিকা;অশোক বুকস্টল,গুয়াহাটি-০১;প্রথম প্রকাশ,২০০৮;পৃ: ১৭০

৬৫) উপেন্দ্র চন্দ্র গুহ ; প্রাগুক্ত;পৃ:৩৮

৬৬) উপেন্দ্র চন্দ্র গুহ ; প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০

৬৭) উপেন্দ্র চন্দ্র গুহ; প্রাগুক্ত;পৃ:৫৪

৬৮) ড দেবব্রত শর্মা:অসম সাহিত্য সভা: ভাষার রাজনীতি—রাজনীতির ভাষা;অসমীয়া জাতি

      গঠন প্রক্রিয়া আরু জাতীয় জনগোষ্ঠীগত অনুষ্ঠান সমূহ;একলব্য প্রকাশন;যোরহাট;

      ফেব্রুয়ারি,২০০৭;পৃ: ২৫০

৬৯) ড দেবব্রত শর্মা;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৫১

৭০) শরৎ চন্দ্র গোস্বামী:শরৎ চন্দ্র গোস্বামী রচনাবলী;পৃ: ১৮০; দেবব্রত শর্মা ব্যবহৃত

      উদ্ধৃতি; প্রাগুক্ত;পৃ: ২৫১

৭১) ড প্রফুল্ল মহন্ত:মধ্যবিত্তর আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম;অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির ইতিহাস;

      লয়ার্স বুক স্টলচ গুয়াহাটি;২০০৯;পৃ: ১৯২

৭২) ড রমেশ পাঠক; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫৯

৭৩) শরৎ চন্দ্র গোস্বামী:সাহিত্য সভার কথা;শরৎ চন্দ্র গোস্বামী রচনাবলী;পৃ: ২৪৮;             

      দেবব্রত শর্মা ব্যবহৃত উদ্ধৃতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫০-৫১

৭৪) George Abraham Grierson;ibid.;pg.:229.

৭৫) George Abraham Grierson;ibid.;pg.:222.

৭৬) George Abraham Grierson;ibid.;pg.:227, 231 and 238.

৭৭) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২

৭৮) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ:১৬৩

৭৯) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ:১৭৬

৮০) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮৪

৮১) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯০

৮২) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯৭

৮৩) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০২

৮৪) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২১০

৮৫) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৩৪

৮৬) রণবীর পুরকায়স্থ:উজান পর্ব,একত্রিশ;সুরমা গাঙর পানি;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৮১

৮৭) রণবীর পুরকায়স্থ:উজান পর্ব,পনেরো; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯১

৮৮) রণবীর পুরকায়স্থ:উজান পর্ব,ছয়;প্রাগুক্ত;পৃ:১০২

 

~***~

 

Comments

Popular posts from this blog

।।রোমান হরফে বাংলা লেখার পুরাকথা । ।

।। অসমিয়া-বাংলা- সিলেটি লিপি ।। সপ্তম অধ্যায় ৷৷

।। অসমিয়া,মানবাংলা,সিলেটি এবং দু’একটি প্রতিবেশী ভাষা ও ভাষাবৈচিত্র্যের ধ্বনিতাত্ত্বিক তুলনা ।। তৃতীয় অধ্যায় ৷৷