।। অসমিয়া,মান বাংলা,সিলেটি এবং দু’একটি প্রতিবেশী ভাষা ও ভাষাবৈচিত্র্যের রূপতাত্ত্বিক তুলনা ।। চতুর্থ অধ্যায় ৷৷
৷৷ অসমিয়া ভাষা এবং বাংলার সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্যের পারস্পরিক সম্পর্ক ৷৷
৷৷ একটি কালানুক্রমিক এবং কালিক অনুসন্ধান ৷৷ চতুর্থ অধ্যায় ৷৷
📚📚📚📚📚📚📚
(মূল গবেষণা অভিসন্দর্ভে ‘উপভাষা’ শব্দটিই ছিল, ‘ভাষাবৈচিত্র্য’ ছিল না । ছবি ভালো পড়তে না পারলে দুবার ক্লিক করে বড় করুন। তাতেও না পারলে এখানে ক্লিক করে বা একেবারে নিচে গোগোল ড্রাইভে পিডিএফে পড়ুন। আগে পরের অধ্যায়গুলোর জন্যে এখানে ক্লিক করুন।)
পরম্পরাগত ব্যাকরণ বা ভাষাতত্ত্বের বইতে ব্যাকরণিক সংবর্গের আলোচনাতে শৃঙ্খলা খুবই কম আছে। যেমন আমাদের হাতে আছে ড০ নির্মল দাশের ‘ভাষাবীথি’।ধ্বনি ও বর্ণ,ধ্বনি পরিবর্তনের আলোচনার পরে আছে,সাধুভাষা এবং চলিত ভাষার আলোচনা।এর পরে শব্দ প্রকরণ,ধ্বন্যাত্মক শব্দ,ণত্ব-বিধি –ষত্ব-বিধি ইত্যাদি।এর পরে মাঝে লিঙ্গ-বচন-পুরুষ। তারপরে আবার শব্দভাণ্ডার।তারপরে সামান্য প্রত্যয়,উপসর্গ,অনুসর্গ ইত্যাদি ডিঙিয়ে সমাস,অশুদ্ধি সংশোধন ইত্যাদি।এত দূর পথ অতিক্রমের পরে পদ-প্রকরণ ক্রিয়া ইত্যাদি।এই সব সারবার বহু পরে মনে হয়েছে কারক নিয়ে এবারে কিছু কথা বলতে হবে।অথচ কারক বুঝবার আগে কোনো ছাত্রের পক্ষে সমাস বোঝা কঠিন,বিশেষ করে তৎপুরুষ সমাস।পদ বিভাগ বুঝবার আগে তার লিঙ্গ-বচন-পুরুষ কী করে বোঝা যায়,যে কোনো সাধারণ ছাত্র তো বটেই,আমাদের মতো সামান্য অধ্যয়নশীলদের পক্ষেও বোঝা কঠিন।তার মানে এইসব বৈয়াকরণিক সংবর্গগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে সুগভীর ধারণা বৈয়াকরণদের নিজেদেরও খুব ভালো নেই।ব্যাকরণ পড়তে এবং পড়াতে তাই ছাত্র-শিক্ষক কারো কোনো আগ্রহ দেখা যায় না।
সুকুমার সেনের ‘ভাষার ইতিবৃত্ত’ বাংলা ভাষা জিজ্ঞাসার ইতিহাসে নিশ্চয়ই অত্যন্ত মূল্যবান গ্রন্থ।বলতে গেলে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সুবিখ্যাত ইংরেজি গ্রন্থটির এটিই বাংলা সারাৎসার।তাঁকেও দেখা যাবে তৃতীয় অধ্যায়ে তিনি ‘ব্যাকরণের প্রকার ও শাখা’ নিয়ে কথা বলছেন।সেখানে লিখছেন,“ভাষাবিজ্ঞান অনুসারে ব্যাকরণের আলোচনার চারটি প্রধান বিষয়—১) ধ্বনি বিজ্ঞান( Phonetics),ধ্বনি বিচার (Phonemics) ও ধ্বনিতত্ত্ব (Phonology);২) রূপবিচার (Morphology);৩) পদবিধি বা বাক্যরীতি(Syntax) এবং ৪) শব্দার্থতত্ত্ব (Semantics)।”১এর পরেই তিনি একই অধ্যায়ে ধ্বনিবিজ্ঞান ও ধ্বনিবিচার নিয়ে আলোচনা শুরু তো করলেন বটে।পরের চতুর্থ অধ্যায়েও ধ্বনিপরিবর্তন নিয়ে কথা বললেন।তৃতীয় অধ্যায়ের নামকরণের অসঙ্গতি নিয়েও তাঁর মনে কেন প্রশ্ন দেখা দিল না,বোঝা কঠিন।মাঝে তিনি ভাষার ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে বহু কথা সেরে গেছেন।রূপবিচার নিয়ে কথা বললেন বটে,সেটি অনেক পরে-- চতুর্দশ অধ্যায়ে।মাঝে আবার ত্রয়োদশ অধ্যায়ে ‘বাঙ্গালা ধ্বনি বিচার’ নিয়ে আলোচনা করেছেন।চতুর্দশ অধ্যায়ে যেভাবে রূপতত্ত্বের আলোচনা শুরু করেছেন,তাতে শৃঙ্খলার একটা সূচনা আছে ভূমিকা অংশে,যেখানে তিনি লিখছেন,বাংলা ইত্যাদি ভাষাতে ‘সমীচীন পদবিভাগ হইল আমাদের সবচেয়ে প্রাচীন বৈয়াকরণ পাণিনির’।কারণ,‘পাণিনি পদকে দুইভাগে ভাগ করিয়াছেন –সুবন্ত ও তিঙন্ত’।২এর পরে তিনি মোটের উপরে এই শৃঙ্খলা অনুসরণ করলেও,হঠাৎ করে কেন বিশেষণ,ক্রিয়াবিশেষণ আলোচনা করে লিঙ্গতে গেলেন সাধারণত পাঠে বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে।কেন বিশেষ্য–সর্বনাম নয়।জগন্নাথ চক্রবর্তীকেও দেখা যাবে এক অস্থির ক্রম অনুসরণ করেছেন।রূপতত্ত্বের আলোচনা মনে হবে শব্দরূপ নাম দিয়ে কারক,বচন দিয়ে শুরু করেছেন,এর পরেই ধাতুরূপ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।কিন্তু এরপরেই প্রত্যয়,সন্ধি নিয়ে আলোচনা সেরে সমাস প্রসঙ্গে দেখা যাবে আবার পদ লিঙ্গ,বচন ইত্যাদি আলোচনা করছেন।পদ এবং শব্দের বিচিত্র বৈয়াকরণিক সংবর্গ নিয়ে আলোচনা সেরে আবার সর্বনাম নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করছেন,তার পরে আবার ক্রিয়া প্রসঙ্গ টেনে কারক দিয়ে শেষ করছেন।এগুলো যে সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুসরণেই সম্ভব হয়েছে তা সমগ্র ব্যাকরণ কৌমুদীতে সামান্য নজর বোলালেই বোঝা যায়।পাণিনির ব্যাকরণের নিজস্ব শৃঙ্খলা ছিল।সেই শৃঙ্খলা সংস্কৃত ভাষারও নয়,পাণিনির নিজস্ব।সেই নিজস্বতা নিয়ে বাংলার বৈয়াকরণেরাতো বটেই ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানীরাও কম ভেবেছেন।সেদিক থেকে অবশ্য ‘ভাষাতত্ত্ব’-এ অতীন্দ্র মজুমদার ব্যতিক্রম।তিনি অনেকটাই সুশৃঙ্খল ভাবে নামপদ,ক্রিয়াপদের আলোচনা করেছেন।ক্রিয়াপদের আলোচনার পরে কারক আনেন নি,আর কারক বোঝাবার আগে সমাস নিয়ে পড়েন নি।তবু সবচাইতে সুবিধেজনক কাঠামোটি রামেশ্বর শ’য়েরই। সম্ভবত এই সব জটিলতা এড়াতেই অন্য প্রসঙ্গে তিনি পরম্পরাগত ব্যাকরণ যেভাবে আলোচনা হয় সেগুলোও পাশাপাশি রাখলেও রূপতত্ত্বের আলোচনা পুরোটাই সেরেছেন আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে।শুরুই করেছেন রূপিম বা মূল রূপ কী,এবং কতপ্রকার,কী করে তাকে সনাক্ত করতে হয়---এই সব প্রশ্ন দিয়ে।আমরাও তাঁকেই অনুসরণ করব।অন্যথা,উপস্থাপনা খুবই জটিল এবং বিরক্তিকর হবে বলেই মনে হয়।
এক বা একাধিক ধ্বনিগুচ্ছ দিয়ে তৈরি অর্থবহ একককে শব্দ বলে,শব্দ যখন বাক্যে ব্যবহৃত হয় তখন তাকে পদ বলে---সংক্ষেপে আমরা তাই জেনে এসেছি।কিন্তু সেই শব্দ গড়ে তোলবার জন্যে ধ্বনিগুলো কিছু প্রক্রিয়া মেনে জোটবদ্ধ হয়।ধ্বনিগুচ্ছ সরাসরি মিলে শব্দ তৈরি হয় না,আগে অক্ষর তৈরি হয়।অক্ষরগুলো মিলে শব্দ তৈরি হয়।অক্ষরের নিজের কোনো অর্থ থাকতেও পারে,কিন্তু থাকাটা বাধ্যতামূলক নয়।এক শ্বাসে শব্দের যতটা উচ্চারিত হতে পারে সেটুকুই অক্ষর। একে আর ভাঙা যায় না,আর গেলেও সব অংশ উচ্চারণ করা যায় না।যেমন ‘আমরা’ শব্দের দুই অক্ষর ‘আম̖’ এবং ‘রা’-এর কোনোটাকেই আর ভেঙে যথার্থ উচ্চারণ করা যাবে না।‘আম̖’ থেকে ‘ম̖’-কে আলাদা করতে হলে একটি ‘+অ’ যোগ করতে হবে।তেমনি ‘রা’ থেকে ‘আ’-কে আলাদা করলেও ‘র̖’এর সঙ্গে একটি ‘+অ’ যোগ না করলে উচ্চারণ করে বোঝানো যাবে না দাঁড়ালোটা কী?সেই যুক্ত ধ্বনিটি কিন্তু শব্দটিতে নেই।এ হচ্ছে শব্দের শুধুই উচ্চারণের দিক থেকে গঠনগত ক্ষুদ্রতম একক।কিন্তু অর্থবহ ক্ষুদ্রতম এককও থাকে।সংস্কৃত ব্যাকরণে শব্দকে বলা হয়েছে ‘প্রকৃতি’,তার ক্ষুদ্রতর একককে বলা হয়েছে ধাতু,প্রাতিপদিক,প্রত্যয়,বিভক্তি ইত্যাদি।ভাষাবিজ্ঞানে এই ক্ষুদ্রতর এককগুলোকেই ‘রূপিম’ বা ‘রূপমূল’ বলে।প্রত্যয়- বিভক্তির দৃশ্যত: নিজস্ব কোনো অর্থ নেই,কিন্তু ধাতু প্রাতিপদিকের সঙ্গে জুড়ে প্রত্যয় নতুন নতুন অর্থবহ শব্দ গঠন করে। বিভক্তি শব্দগুলোকে বাক্যে ব্যবহারোপযোগী করে তোলে।সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুযায়ী ক্রিয়াপদের সঙ্গে বাকি নাম শব্দগুলোর সম্পর্ক নির্দেশ করে।প্রত্যয় বিভক্তি আদি জুড়ে নতুন শব্দের কী বা কেমন অর্থ হবে তা একরকম ভাষা-বিশেষে সুনির্দিষ্ট। যেমন অনামা,অসার,অকাজ,অস্পষ্ট---শব্দ চারটির শুরুতে যুক্ত উপসর্গ প্রতিটিরই অর্থ বাংলাতে ‘নাই’। সেজন্যে বলতে পারা যায়,স্পষ্ট অর্থ না থাকলেও অর্থের একটা আভাস প্রত্যয়-বিভক্তি-উপসর্গগুলোতে থাকেই।কিন্তু সম্পর্ক নির্দেশ করতে গিয়ে কি শুধুই অস্পষ্ট অর্থের বা আভাস থাকা ধ্বনিগুচ্ছকেই ব্যবহার করে?বহু সময় স্পষ্ট অর্থবহ শব্দও ব্যবহার করে,যাকে প্রচলিত বাংলা ব্যাকরণেও অনুসর্গ বলে।অথচ,উপসর্গ হলো শব্দের শুরুতে যুক্ত ধ্বনিগুচ্ছ।নতুন শব্দ গঠন সেগুলোরও কাজ। সেখানেও বৈদিকে তো হতো বটেই,বাংলাতেও পূর্ণ অর্থবহ শব্দ যুক্ত হয়,এই যেমন ‘মাঝ̖+দরিয়া’।পরম্পরাগত ব্যাকরণে বিষয়টি এমনটাই গোলমেলে।
ভাষাবিজ্ঞানে তাই স্পষ্ট অর্থবহ ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছকে মুক্ত রূপিম,অস্পষ্ট অর্থবহ ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছকে বদ্ধ রূপিম বলা হয়।মুক্ত রূপিম স্বাধীনভাবেও ব্যবহৃত হতে পারে,বদ্ধ রূপিম অন্য রূপিমের সঙ্গে জুড়েই শুধু নিজের এবং সম্পূর্ণ শব্দের অর্থ স্পষ্ট করে।যেমন ‘আমরা’ শব্দে ‘আম̖’ শব্দের বাংলাতে একটি অর্থ আছে।তাতে ফল বোঝায়,তাই মুক্তরূপিম। কিন্তু ‘-রা’-এর আলাদা অর্থ নেই।‘আম̖’-এর সঙ্গে জুড়ে সেটি ‘আমরা’ শব্দকে বহু ব্যক্তির সমাহার জাতীয় কিছু অর্থ করে ফেলল। শব্দটির সঙ্গে ‘-ই’ যুক্ত হলে একক ব্যক্তিকেই বোঝাতো।সাময়িকভাবে বলতে পারি,বাংলাতে এটি বচন নির্দেশক প্রত্যয়। কিন্তু তাই বলে সব শব্দের পরে এই ধ্বনিগুচ্ছগুলোকে জুড়লেই বচন পালটে যাবে না,সর্বত্র বাংলাতে কোনো অর্থও বহন করবে না।যেমন ‘সে’ একটি বাংলা একবচন বোধক মুক্তরূপিম।তার সঙ্গে ‘রা’ যোগ করে ‘সেরা’ বহুবচন হবে না। যা অর্থ দাঁড়াবে এর সঙ্গে বচনের কোনো সম্পর্ক নেই। সেসব কারণে এগুলো বদ্ধ রূপিম।
রূপিম হতে গেলে ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছকে চারটি শর্ত পূরণ করতে হয় বলে রামেশ্বর শ’ উল্লেখ করেছেন: ৩
১) সেটি এক বা একাধিক ধ্বনির সমন্বয়ে গঠিত ক্ষুদ্রতম একক হওয়া চাই।
২) সেই এককটির অর্থ থাকা চাই।
৩) সেই এককটি ভাষার মধ্যে বারবার আসা চাই।
৪) সেই এককটির অংশ বিশেষের সঙ্গে অন্য এককের ধ্বনিগত বা অর্থগত মিল থাকবে না।
‘মাতৃচরণ’ এবং ‘মায়ের চরণ’ এই দুই শব্দ বা শব্দগুচ্ছে ‘চরণ’ অংশটি আছেই।যেহেতু প্রথম শব্দের ‘চরণ’ অংশের সঙ্গে দ্বিতীয় শব্দগুচ্ছে ‘চরণ’ অংশের ধ্বনি এবং অর্থগত মিল আছে,তাই ‘মাতৃচরণ’ পুরো শব্দটি রূপিম নয়।তেমনি ‘চরণ’ এর পাশে ‘চলন’,‘স্খলন’ ইত্যাদি শব্দ তুলনা করলেই দেখা যাবে শব্দগুলোতে সদৃশ ‘-অন’ একটি অংশ আছে।অর্থাৎ বিভিন্ন শব্দে বারে বারে ফিরে আসছে।তার মানে ‘-অন̖’ রূপিম হলেও হতে পারে,কিন্তু শব্দ তিনটির একটিও রূপিম নয়, ক্ষুদ্রতম একক নয়।
এখন,‘-অন̖’ রূপিম কি না --- সেই প্রশ্নের মীমাংসা করতে গেলে স্বনিম সনাক্ত করবার মতো রূপিম সনাক্ত পদ্ধতির সঙ্গেও আমাদের পরিচিতি দরকার।স্বনিম সনাক্ত করতে গিয়ে ভাষার যথাসম্ভব ছোট শব্দজোড় নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হয় কোন একটি মাত্র ধ্বনির উচ্চারণ-পার্থক্যের জন্যে শব্দদুটির অর্থ আলাদা হয়ে গেল।বিপরীতে রূপিম সনাক্ত করতে গেলে বেছে নেওয়া শব্দ দুটিই হতে হবে এমন কোনো কথা নেই,যথাসম্ভব ছোট হতে হবে এমনটাও কোনো কথা নেই।কিন্তু যে শব্দগুলোকেই নেওয়া হোক সেগুলোর মধ্যেকার এমন ক্ষুদ্রতম একক সন্ধান করে বের করতে হবে যাদের মধ্যে ধ্বনি এবং অর্থের মিল আছে।যেমন কাল এবং খাল শব্দদুটি নিয়ে আমরা নির্ণয় করেছিলাম ‘ক’ এবং ‘খ’ দুই ভিন্ন স্বনিম।কিন্তু যদি শব্দ দুটি হয় ‘কালের’ এবং ‘খালের’ তবে দেখা যাবে শেষে ‘-এর̖’ অংশটির শুধু উচ্চারণ নয় একটা অর্থ সাম্যও আছে।দুই শব্দেই এই ধ্বনিগুচ্ছ অন্য নাম শব্দের সঙ্গে সম্বন্ধের সম্পর্ক নির্দেশ করছে।এই ‘-এর̖’ একটি রূপিম।যদি শুধুই ধ্বনিগত সাম্য থাকে,অর্থগত নয় তা হলেও কোনো ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ রূপিম বলে বিবেচিত হবে না।যেমন ‘কালের’,‘খালের’,‘বছর’ ‘অপর’ শব্দ চারটির শেষ ধ্বনি ‘র’ অংশে মিল থাকলেও এর কোনো আলাদা অর্থ নেই তাই সেটি এই তুলনাতে রূপিম নয়। কিন্তু ‘মালার’,‘বাবার’ এমন শব্দের শেষ ‘আর̖’ অংশে মিল দেখা যাবে এবং মনে হবে এতো পূর্বতন ‘-এর̖’ রূপিমের অর্থই নির্দেশ করছে।কিন্তু যদি তুলনার শব্দ আরো বাড়িয়ে চলি,‘পাখির’,‘চাকুর’ তবে দেখা যাবে শেষ ‘-র’ ধ্বনিটিই শুধু ‘-এর̖’-এর অর্থ নির্দেশ করছে।আবার ‘বছর’,‘অপর’ শব্দের ‘-র’-তে যে সেরকম কিছু ঘটল না,আমরা দেখলাম।এতে দুটো বিষয় স্পষ্ট হয়।এক,রূপিম নির্ণয়ে যথাসম্ভব বেশি শব্দের তুলনা করে যাওয়াটাই নিরাপদ যতক্ষণ একটা অংশকে আর ক্ষুদ্রতম এককে ভাঙা অসম্ভব হয়ে পড়বে।এবং যেটি ‘রূপিম’ বলে নির্ণীত হবে সেটি এক শব্দে বিশেষ অর্থ বোঝালেই ভাষাবিশেষে রূপিম বলে বিবেচিত হবে।অন্যথা নয়।অর্থাৎ এমনটা বলা যাবে না ‘-র’ বাংলা ভাষার একটি রূপিম।বড়জোর বলা যাবে বাংলাতে সম্বন্ধ পদের একটি রূপিম হলো ‘-র̖’।এবং এর প্রতিরূপ হচ্ছে ‘-এর̖’।এই রূপবৈচিত্র্যগুলো ধ্বনিতাত্ত্বিক কারণে ঘটে থাকে।যেমন ব্যঞ্জনান্ত শব্দের শেষে মান বাংলাতে সরাসরি ‘-র’ যুক্ত করে সম্বন্ধ পদ গঠন করা যায় না।তার আগে ‘এ’ স্বরধ্বনি এনে তাকে শব্দমূলের সঙ্গে জুড়ে দিতে হয়।প্রতিরূপগুলোকে ‘উপরূপ’ বলে।যে রূপটির ব্যবহার বেশি রূপিমের নাম সেই রূপেই হয়ে থাকে।বহু সময় এরকম ধ্বনিতাত্ত্বিক কারণ খোঁজে পাওয়াও মুশকিল হয়,কিন্তু দেখা যাবে অর্থগত মিল আছে,এবং একে অন্যের পরিপূরক।অর্থাৎ একের জায়গাতে অন্যে বসে না।এর কারণ হিসেবে ভাষাবিশেষের ইতিহাস এবং সামাজিক প্রেক্ষিত বিবেচনাতে নিয়ে আসতে হয়।যেমন কোকিলা,ময়ূরী, রুদ্রাণী---শব্দ তিনটিকে শেষাংশের জায়গা বদল করে কোকিলী,ময়ূরাণী,রুদ্রা এইভাবে বাংলাতে পাওয়া যাবে না,লেখা কিংবা বলা যাবে না।অথচ ‘-আ, -ঈ, আনী’ এই শেষাংশ যুক্ত হয়ে মূল শব্দ কোকিল,ময়ূর,রুদ্রকে স্ত্রী লিঙ্গে পরিণত করেছে।এগুলো প্রত্যকটিই রূপিম এবং পরস্পর উপরূপ। তবে কি না সাধারণত একটি ভাষাতে মুক্তরূপিম সংখ্যাতে এত বেশি হয় যে সব রূপিমকে শনাক্ত করা প্রায় অসাধ্য কাজ হয়ে উঠবে।বদ্ধরূপিম বরং তুলনাতে কমই হয়।কিন্তু সেগুলোও সংখ্যাতে এত বেশি যে প্রেক্ষিত ছাড়া এগুলোর সন্ধান বিরক্তিকর কাজ হতে পারে।তার উপরে আমাদের আলোচ্য ভাষা বা ভাষাবৈচিত্র্যগুলো যেহেতু অচেনা ভাষা নয় তাই সব রূপিম সনাক্ত করে যাওটা বাহুল্যমাত্র হবে।আমরা সেই কাজ করব যদি কোথাও অপরিচিতি সমস্যা হয়ে দেখা দেয়।অন্যথা, রূপিমগুলোর প্রকৃতি এবং ভূমিকা জানাটাই যথেষ্ট হবে।
বাংলা সহ সমস্ত ভাষার শব্দই এই মুক্ত এবং বদ্ধ রূপিমগুলোর বিভিন্ন সমাবেশে তৈরি হয়।
১) একটি মাত্র মুক্তরূপিমে তৈরি শব্দকে বলে মৌলিক শব্দ।যেমন,মা,ভাই,আম ইত্যাদি।
২) একটি মুক্তরূপিম বা বদ্ধরূপিম এবং তার সঙ্গে এক বা একাধিক বদ্ধ রূপিম যুক্ত করে তৈরি শব্দকে বলে জটিল
শব্দ।যেমন,ভাঙ̖+ছি= ভাঙছি,ভাঙ̖+ আ+চ্ছি= ভাঙাচ্ছি,রাত+এর̖= রাতের ইত্যাদি।
৩) একাধিক মুক্তরূপিম যোগ করে তৈরি হয় যৌগিক বা সমাসবদ্ধ শব্দ।যেমন দিন+রাত=দিনরাত,ভাই+বোন=
ভাইবোন।
পরম্পরাগত ব্যাকরণে মৌলিক শব্দকে সিদ্ধ এবং বাকি দুই ধরনের শব্দকে সাধিত শব্দ বলে বিভাজিত করা হয়েছে।
খুব জরুরি নয় যে বদ্ধ রূপিম মুক্ত রূপিমের পরেই যুক্ত হতে হবে।শব্দের সেগুলো শুরুতে,মাঝে এবং শেষে --এই তিন অবস্থানেই যুক্ত হতে পারে।পরম্পরাগত ব্যাকরণে পরে যুক্ত হয়ে নতুন শব্দগঠন করলে প্রত্যয় এবং অন্যসময় বিভক্তি বলা হয়,আগে যুক্ত হলে উপসর্গ বলে।এগুলোকে পুরোসর্গ (Prefix),মধ্যসর্গ (infix),পরসর্গ (Suffix) বললেই আসলে জটিলতা মুক্ত হয়।পবিত্র সরকার লেখেন,“প্রত্যয়গুলির মধ্যে উপসর্গগুলিকে ধরতে হবে...।”৪ ধরতেই যদি পারি তবে ‘সর্গ’ বলে সব ক’টিকে এই তিনশ্রেণিতে ভাগ করলে দোষেরই বা কী হবে?তিনি ‘পুরোসর্গ’,‘পরসর্গ’ ব্যবহার করেন নি,কিন্তু ‘মধ্যসর্গ’ পারিভাষিক শব্দটি ব্যবহার করেছেন।“...মাঝখানে জুড়ে যাওয়া উপাদানকে মধ্যসর্গ (infix) বলতে পারি।”৫কিন্তু যে কোনো উপাদানকে কি?কথাটা স্পষ্ট নয়।তাঁর আগেকার কথা কিছু তুলে ধরা যাক,“...‘প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব’-তে‘প্রতি+উৎ+পদˎ+ত+মনˎ+তি+ত্ব’ এই এতগুলি উপাদান আছে,unpretentiousness-এ আছে অন্তত un+pre+tend+ious+ness—এই পাঁচটি উপাদান।উপাদান আগে পরে মাঝখানে সব জায়গাতেই জুড়তে পারে।যেমন বাংলায় ‘গিয়ে-ই-ছি-তো’ কথাটাতে -ই- এসে মাঝখানে বসেছে।আগে বসার উপাদান সংস্কৃত ব্যাকরণে উপসর্গ (prefix),শেষে জুড়ে যাওয়া উপাদান প্রত্যয় ও বিভক্তি ( suffix)।পাশ্চাত্য ব্যাকরণে বর্ণনাপন্থীরা প্রত্যয় ও বিভক্তির সেভাবে তফাত করেন না।আর মাঝখানে জুড়ে যাওয়া উপাদানকে মধ্যসর্গ (infix)বলতে পারি।”৬‘গিয়েইছিতো’ শব্দে ‘-ই’-কে মাঝে জুড়ে যাওয়া উপাদান বললেন,‘-ছি’-কে নয় কেন? বা √গ –এর সঙ্গেও আছে আরেকটি ‘-ইয়ে’ --সেটিকে নয় কেন? আমাদের সংশয় এরই জন্যে। তিনি কি তবে মাঝে জুড়লেই তাকে ‘মধ্যসর্গ’ বলছেন না? মনে হয় না।রামেশ্বর শ’ লিখেছেন,“মধ্যসর্গ(infix) যোগের উদাহরণ বিরল হলেও পাওয়া যায়। ইন্দোনেশিয়ার ভাষায় মধ্যসর্গ যোগের প্রবণতা লক্ষ্য করেছিলেন মাক্সম্যূলরঃ তগল (Tagala) ভাষায় ‘Sulat’ শব্দের অর্থ লিপি। এতে ‘–un-’ মধ্য সর্গ যোগ করে হবে S-un-ulat=‘লেখা’,‘-u-ng-m’ মধ্যসর্গ যোগ করে হবে ‘S-u-ng-m-ulat’।”৭যেটি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো ভারতীয় ভাষাতে তথা বাংলা ভাষাতে এর নজির খোঁজে পেলেন না কেন?আর পবিত্র সরকারকেই বা এমন এক নজির দিতে কেন হলো,যা কিনা আসলে শব্দের ছদ্মবেশে বাক্যাংশ। অর্থ অনেকটা এই-- ‘নিশ্চিত গিয়েছি,কেউ চায় নি তবু।’ এর আগের যে সংস্কৃত এবং ইংরেজি শব্দের নজির দিলেন তার এতোগুলো উপাদানের মাঝের উপাদান গুলোও কি তবে মধ্যসর্গ নয়? কেন? উত্তর নেই।এবারে রামেশ্বর শ’ যে তগল ভাষার নজিরটি দিলেন,তাতে দেখা যাচ্ছে প্রথম মধ্যসর্গটি যদিও বা একটি শব্দের অর্থ পালটে দিচ্ছে যেমনটা বাংলাতে প্রত্যয় করে থাকে,দ্বিতীয়টি(গুলো?) কিন্তু একে ক্রিয়াপদেও পরিণত করছে, সঙ্গে কাল পক্ষের অর্থও নির্দিষ্ট করছে ---অর্থাৎ বাংলাতে যে কাজ বিভক্তি করে থাকে।পরম্পরাগত ব্যাকরণের মতে সেসব শব্দের শেষে বসে।দেখা যাচ্ছে, রামেশ্বর শ’ও ‘পুরোসর্গ’ নামটি ব্যবহারে দ্বিধান্বিত।তিনি উপসর্গই লিখছেন। এবং পবিত্র সরকার যেন প্রত্যয় বিভক্তি দুই পারিভাষিক নামই রাখবার পক্ষে। এর একটি সঙ্গত যুক্তি আছে।তিনি এর আগে স্পষ্টই ব্যাখ্যা করেছেন এই উপাদানগুলোর কিছু নতুন শব্দ গঠন করে,কিন্তু শব্দকে বাক্যে ব্যাবহারপোযোগী করে,অর্থাৎ পদ গঠন করে।তাই তিনি বদ্ধ রূপিমগুলো শব্দনির্মাণ এবং পদনির্মাণ এই দুই প্রক্রিয়াতে অংশ নেয় বলে এই স্বাতন্ত্র্য রাখবার পক্ষে।৮ এর জন্যে তিনি বচন,লিঙ্গের সঙ্গেও বিভক্তি কথাটি যোগ করবার বিরুদ্ধে,কেননা তাতে যে শব্দগুলো তৈরি হয় সেগুলোকে বাক্যের বাইরেও স্বাধীন শব্দ হিসেবে অভিধানে নিয়ে নেয়া যায়।অর্থাৎ সেগুলোকেও তিনি প্রত্যয় বলবারই পক্ষে।আমরা এই দুই ভূমিকা অনুযায়ী বদ্ধ রূপিমগুলোকে শব্দনির্মাতা এবং পদনির্মাতা –এই দুই ভাগে ভাগ করবার পক্ষে। তত্ত্বটি তাঁর, বিস্তারটি আমাদের।এবং আমরা বাংলাতে এই দুই ধরনের বদ্ধ রূপিমেরই ‘মধ্যসর্গ’ হিসেবে অস্তিত্ব স্বীকার করবারও পক্ষে। তাই শুধু ‘প্রত্যয়-বিভক্তি’ নামে আমাদের কাজ চলবার নয়। বহুল পরিচিত পরিভাষা বলে যদিও বা আমরা কখনো এগুলো ব্যবহার করে যাব। বড়জোড় পরসর্গকেই এই দুইভাগে ভাগ করা চলে। শব্দনির্মাতা হলে প্রত্যয়, পদনির্মাতা হলে বিভক্তি—এই স্পষ্ট বিভাজন।লীলাবতী শইকীয়া বরা এভাবেই অসমিয়া সর্গগুলোর দুই ভাগ করেছেন,নাম দিয়েছেন শব্দসাধনমূলক এবং বিভক্তিমূলক।বিভক্তিমূলকের আবার দুই নাম দিয়েছেন,বাক্যবিন্যাসগত কার্যসাধক এবং ব্যাকরণগত বিশেষ অর্থপ্রকাশক সর্গ।৯এই ব্যাকরণগত বিশেষ অর্থপ্রকাশক সর্গ বলতে তিনি ঐ বচন-লিঙ্গ বোধক বদ্ধরূপিমের কথাই বলছেন, যাকে পবিত্র সরকার ‘প্রত্যয়’ বলবার পক্ষে।এই রূপিমগুলোকে শব্দের থেকে সরিয়ে দিলেও বাক্য গঠনে এরা কোনো ‘আউল’ লাগাবে না। কাঙ্ক্ষিত অর্থ বহন করতে না পারলেও একটা স্পষ্ট অর্থ বোঝাতে বাক্যের কোনো সমস্যা হবে না।তিনি উদাহরণ দিয়েছেন,যেমন- ১) গৰুৱে ঘাঁহ খায়।এবং ২) দেউতাহঁত আহিছে।প্রথম বাক্যের ‘গৰু’ থেকে ‘এ’ সরিয়ে দিলে বাক্যটি অসমিয়াতে কোনো অর্থ বোঝাবে না।অথচ দ্বিতীয় বাক্যের ‘দেউতাহঁত’ শব্দের থেকে ‘হঁত’ সরিয়ে দিলেও বাবা যে এসেছেন সে ঠিক বোঝা যাবে,অসমিয়া বাক্যও হবে। শুধু সঙ্গে আরো অনেকে এসেছেন এই অর্থটি বোঝানো হবে না। তাঁর পারিভাষিক নামগুলো বড় বেশি ব্যাখ্যাত্মক এবং দীর্ঘ,অথচ ধারণা সেই,আমরা যা প্রকাশ করতে চাইছি।আমরা তাই বদ্ধ রূপিমগুলোর গুণ বা ভূমিকা অনুযায়ী শব্দনির্মাতা এবং পদনির্মাতা -- এই দুই নামে বিভাজনই যথেষ্ট মনে করছি। তিনি কিন্তু অসমিয়াতে সর্গ বা প্রত্যয় শব্দ দিয়ে ‘উপসর্গ,প্রত্যয় এবং বিভক্তি’ সবই বোঝাবার পক্ষে,“ ...সামগ্রিকভাবে অসমীয়াত সর্গ বা প্রত্যয় শব্দই ইংরাজী affix-র দরে উপসর্গ,প্রত্যয় আরু বিভক্তি,এই তিনিওবিধ বদ্ধ রূপকে সামরি লয়।সেই হিচাপে অসমীয়া সর্গ বা প্রত্যয় ইংরাজী affix-র সমার্থক।”১০ব্যাকরণে যা অসমিয়ার জন্যে সত্য,বাংলার জন্যে তা ভিন্ন হবার কোনো যুক্তি নেই।তিনি ‘পূর্বসর্গ’ এবং ‘পরসর্গ’ পরিভাষা দুটি ব্যবহার করছেন। মধ্যসর্গের কথা লিখছেন,একে ‘অন্তঃসর্গ’ও বলছেন বিকল্পে।কিন্তু “আন ভারতীয় আর্য ভাষার দরে অসমীয়া ভাষাতো অন্তঃসর্গর ব্যবহার দেখা নাযায়।”১১ সুতরাং আমাদের সমস্যা যে তিমিরে ছিল,সেই তিমিরেই রইল।যুক্তিটা কী?“অন্তঃসর্গই মূল ধাতু বা শব্দর কোনো অক্ষর বা স্বররে পরিবর্তন নঘটাই মাত্র মূল শব্দটো(root) ফালি তার মাজত বহে।উদাহরণ স্বরূপ গ্রীক ভাষার ‘lambanj’ শব্দটোলৈ আঙুলিয়াব পারি।এই শব্দটার মূল হৈছে /lab-/ ধাতু।এই ধাতুটোর আদ্যক্ষরর লগতে থকা ‘a’ স্বরর কোনো পরিবর্তন নকরি ‘m’-টো অন্তঃসর্গ হিচাপে তার মাজত সোমাইছে।গতিকে অসমীয়া ভাষার কিছুমান শব্দত আদ্যক্ষরর ‘অ’-র ঠাইত বহা ‘আ’-টোক অন্তঃসর্গ বুলি নধরি সেই ধ্বনি পরিবর্তনর প্রক্রিয়াটোক ইংরাজী ভাষার foot,goose আদি শব্দর বহুবচনর feet, gees হোয়া প্রক্রিয়ার দরে স্বরর সলনি প্রক্রিয়া (vowel repleacement) বা স্বরর দীর্ঘীভবন(vowel lenghthening) বুলিহে ধরা উচিত।”১২ ইংরেজি foot শব্দের ‘oo’ এবং feet শব্দের ‘ee’ পরস্পর কি উপরূপই? কেবলি স্বরের দীর্ঘীভবন?অর্থ তথা বচন পাল্টালো না?ধ্বনি পরিবর্তন এবং বদ্ধ রূপিমের বিভ্রান্তিটি বাংলাতেও হয়—যেমন √যা+ই=যাই,কিন্তু √যা+তে (~ইতে)=যেতে (যাইতে)।অর্থাৎ এই যে ‘-এতে’ বলে কোনো আলাদা রূপিমের কথা ভাবছি না,তার কারণ ‘এ’টি এখানে স্বরসঙ্গতির পরিণাম।কিন্তু ‘ই’ এবং ‘তে’-কে আলাদা পরসর্গ বা প্রত্যয় বলতে তো কারো দ্বিধা হবে না।তবে ‘oo’,‘ee’ নিয়ে দ্বিধা কেন?এভাবে বিচার করলে তো,নর–নাৰী,ভালুক-ভালুকী,ফাগুন-ফাগুনা---এই শব্দকেও স্বরাগমের সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করতে হয়।অথচ তখন আমরা স্বীকার করছি,এগুলো স্ত্রী-লিঙ্গ বোঝাবার পরসর্গ বা প্রত্যয়।তিনি অসমিয়াতে যেসব ধ্বনি পরিবর্তনের নজির দেখিয়েছেন সেগুলো এরকম: অকর্মক ক্রিয়া-- গৰু চৰে,কিন্তু সকর্মক--গৰখীয়াই গৰু চাৰে।তেমনি একই উৎসের শব্দগুলোর ধ্বনি পালটে যখন অর্থ পালটে ফেলে সেরকম কিছু শব্দজোড়,নল-নাল,ঢল-ঢাল,ফল-ফাল,গল-গাল ইত্যাদি। এগুলোকে নিছক ধ্বনি পরিবর্তন বলে মেনে নেব কেন? এরকম শব্দজোড় এবং শব্দভেদ বাংলাতেও আছে। পবিত্র সরকার প্রযোজক বা প্রেরণার্থক অর্থে চল থেকে চাল,নড় থেকে নাড়,পড় থেকে পাড়,মর থেকে মার এমন সব নজির দিয়েছেন প্রত্যয়ের আলোচনা করতে গিয়েই। আর লিখেছেন,“...সেগুলি পদ, শব্দ নয়।”১৩ লীলাবতী শইকীয়া বরার দেয়া গ্রীক নজিরটি এবং রামেশ্বর শ’এর তগল ভাষার নজিরটি কিংবা পবিত্র সরকারের বাংলা নজিরে একটি মিল অবশ্যই আছে।সে হলো বাকি রূপিমেরও কোনো ধ্বনিগত পরিবর্তন হয় নি। সেরকম ঘটনা বাংলাতেও শব্দনির্মাতা পুরোসর্গ তথা উপসর্গ এবং পরসর্গ তথা প্রত্যয় জুড়লে অধিকাংশ সময় ঘটে না বটে। কিন্তু একেবারে ঘটে না তাও নয়।পবিত্র সরকারের তৎসম তথা সংস্কৃত শব্দ ‘প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব’তেই ‘প্রতি’ পুরোসর্গটি অক্ষত থাকেনি।তেমনি, পরসর্গ যোগে বাংলাতেও পুটলি,ক্ষেমি,ভোলানো,ঘোমানো,সাধিকা,সেবিকা শব্দ পাওয়া কঠিন হত।আমাদের বলবার বিষয় হচ্ছে পুরোসর্গ বা পরসর্গে যদি ধাতু বা প্রাতিপদিকের রূপ পালটে দিতে পারে,মধ্যসর্গে পালটে ফেলা যাবে না এমন রীতি বাংলাতে বা অসমিয়াতে বাধ্যতামূলক করা কেন? আর মধ্যসর্গ হতে গেলে একটা রূপিমকে শব্দনির্মাতাই হতে হবে,পদনির্মাতা হতেই পারবে না,সেই নিয়মই বা বাধ্যতামূলক করা কেন? কেবল গ্লীসন বা নিদা বলেন নি বলে? সুতরাং মাঝে বসে কোনো রূপিম যদি নতুন শব্দ বা পদ দু’য়ের কোনো একটিই তৈরি করছে,আমরা সেগুলোকে ‘মধ্যসর্গ’ বলব। তাতে বহু জটিলতা কমবে। ‘কিতাপকেইখনর’ এই অসমিয়া শব্দের অন্তত ‘কেই’ অংশটিকে উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী তাঁর ‘অসমীয়া ভাষার ব্যাকরণ’ (১৯৯৭; পৃ: ১১) বইতে ‘মধ্যসর্গ’ বলে গ্রহণ করেছেন এই তথ্য,লীলাবতী শইকীয়া বরা আমাদের দিচ্ছেন,যদিও নিজে এই তত্ত্ব খণ্ডন করেছেন।১৪ উপসর্গকে পুরোসর্গ বলে কাজ চালাতে পারলেও,অনুসর্গকে পরসর্গ বলে কাজ চালানো কঠিন।যদিও অসমিয়াতে অনুসর্গগুলো এত বেশি মূল শব্দের সঙ্গে মিশে যায় যে বাস্তবেও পরসর্গের সঙ্গে তফাত করা কঠিন হয়।সর্গ কথাটিকে আমরা যেভাবে নিচ্ছি তার সঙ্গে তফাত রাখতে অনুসর্গের বদলে ‘অনুপদ’ কথাটা ব্যবহার করবো। গোলোকচন্দ্র গোস্বামী এবং লীলাবতী শইকীয়া বরা নিয়মিত ভাবে এটা করেছেন।
আমরা পরিসরের কথা ভেবে অসমিয়া এবং বাংলার বিভিন্ন ভাষাবৈচিত্র্যে রূপিমের যতরকমের বৈচিত্র্য রয়েছে তার সবগুলো নিয়ে আলোচনা করবো না। তাতে অসুবিধে বিশেষ হবে বলেও মনে হয় না। কারণ কমবেশি কিছু জিনিস আমাদের পরিচিত।এই পরিচিতির ভাষাবৈজ্ঞানিক কারণও আছে।একটি ভাষার মৌলিক শব্দগুলো হচ্ছে সেই বিশেষ ভাষার শব্দের মূল শব্দভাণ্ডার।পবিত্র সরকার লিখেছেন,“সেগুলির নির্মাণ ব্যাকরণে হয় না,কারণ সেসব শব্দ সিদ্ধ বা সম্পন্ন শব্দ,আগেই তৈরি হয়ে আছে;সেগুলি নতুন করে নির্মাণ করার কিছু নেই।”১৫তিনি এও লিখেছেন,“...শব্দ-নির্মাণ একটি কমবেশি ধীর ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া,ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তা প্রতিমুহূর্তে দৈনন্দিন ঘটছে এমন ব্যাপার নয়।কিন্তু পদনির্মাণ একেবারে প্রতি মুহূর্তে প্রতি বক্তার প্রতিটি বাক্য ব্যবহারেই ঘটেছে---বাক্য সৃষ্টির অনন্ত অব্যাহত প্রক্রিয়ার তা অঙ্গ।”১৬ সুতরাং ব্যবহারিক দিক থেকে এই পদনির্মাণ প্রক্রিয়াটি বোঝাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভবত তাই,রামেশ্বর শ’ও এই দিকটি নিয়েই বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তিনি স্পষ্টই লিখেছেন,“ বাক্যমধ্যে শব্দ কি ভূমিকা গ্রহণ করে এবং তার সেই ভূমিকা কিভাবে চিহ্নিত হয়,তা-ই রূপতত্ত্বের প্রধান আলোচ্য বিষয়।”১৭ লীলাবতী শইকীয়া বরা কথাটিকে সামান্য অন্যভাবে লিখেছেন,“মুক্তরূপতকৈ বদ্ধরূপবোরহে রূপতত্ত্বর প্রধান আলোচ্য বিষয়।শব্দ-গঠন আরু শব্দরূপ- ধাতুরূপগত বদ্ধরূপবোরর ভূমিকা আরু সেইবোরর প্রয়োগ বিশ্লেষণেই আচলতে রূপতত্ত্বর মূল কথা।”১৮
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি বাংলাতে পদ পাঁচপ্রকার পড়ে এলেও সর্বনাম বিশেষ্যের বিকল্পে বসে বিশেষণ বিশেষ্যেরই গুণ ব্যাখ্যা করে আর অব্যয়ও ব্যবহৃত হয় একটি বিশেষ্যের অন্য বিশেষ্য বা ক্রিয়াপদের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে।তাই একত্রে এগুলোর সঙ্গে যে বদ্ধ রূপিম যুক্ত হয় তাকে সংস্কৃতেই ‘সুপ̖’ এবং ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত বদ্ধ রূপিম বা বিভক্তিকে ‘তিঙ̖’ বলে সংস্কৃত ব্যাকরণেই আলাদা করা হয়েছিল।অব্যয়ের যেহেতু রূপ বদল হয়না---সেগুলোকে ‘নিপাত’ বলে আলাদা করেছিলেন পাণিনি।১৯ বাংলাতেও অব্যয়ের কোনো রূপভেদ হয় না,বিশেষ্যের সঙ্গে যুক্ত হলে বিশেষণেরও হয় না,বদল হয় শুধু বিশেষ্য সর্বনাম এবং ক্রিয়ার।সুতরাং ‘সুপ̖’,‘তিঙ̖’-এর অনুসরণে আমরাও নাম এবং ক্রিয়াপদের রূপবৈচিত্র্য নিয়েই আলোচনা সারতে পারি।যে ছয়টি বিষয় এই নাম এবং ক্রিয়াপদের রূপকে নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলো হলো বচন,লিঙ্গ,কারক,পুরুষ,কাল এবং ভাব।এরা সব ভাষাকে সমান ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে না,যেমন সংস্কৃতে এবং হিন্দিতে লিঙ্গ নাম এবং ক্রিয়াপদ দুয়েরই রূপবদল করে,কিন্তু বাংলাতে কেবল নামপদে সামান্য ভূমিকা পালন করে।বস্তুত বাংলা নামপদের রূপনিয়ন্ত্রণ করে প্রথম তিনটি –বচন,লিঙ্গ এবং কাল;ক্রিয়া পদের রূপ নিয়ন্ত্রণ করে শেষ তিনটি ---পুরুষ,কাল এবং ভাব।আমরা ক্রমান্বয়ে এই শৃঙ্খলা ধরে এগোবো এবং বিষয়গুলো স্পষ্ট করব।‘নামরূপ’ এবং ‘ক্রিয়ারূপ’কে সংস্কৃত ব্যাকরণে ‘শব্দরূপ’ এবং ‘ধাতুরূপ’ বলে পরিভাষিত করা হয়েছে।দৃশ্যত: কোনো সমস্যা নেই,নামে কীই বা এসে যায়? কিন্তু এই প্রশ্ন তো উঠতেই পারে ক্রিয়াপদগুলো কি তবে শব্দ নয়?অথবা শব্দের মূলেও কি ধাতু নেই?আমরা তাই সেসব জটিলতাতে না গিয়ে নামরূপ এবং ক্রিয়ারূপ এই দুই বিভাগে রূপতাত্ত্বিক আলোচনা করব।লীলাবতী শইকীয়া বরা অসমীয়াতেও লিখেছেন ‘ক্রিয়াপদ’ এবং ‘নামপদ’।তিনি অবশ্য অব্যয়গুলোকে নামপদের বাইরে রেখেছেন।শুরুতেই পদের দুই ভাগ করেছেন ‘অব্যয় পদ’ এবং ‘সব্যয়পদ’। নাম-ক্রিয়া বিভাজন এই সব্যয় পদেরই।২০
।। নামরূপ (declension) ।।
লিঙ্গ:অসমিয়া-বাংলাতে লিঙ্গের ধারণা খুবই সহজ।পুরুষ প্রাণী হলে পুং লিঙ্গ,স্ত্রী প্রাণী হলে স্ত্রী লিঙ্গ।বাণীকান্ত কাকতি লিখেছেন,“অস.,বং.,আরু উ.ভাষার পরা ব্যাকরণগত লিঙ্গ লোপ হল।”২১ লিঙ্গ ভেদে আলাদা শব্দ আছে,যেমন বাংলাতে ছেলে মেয়ে,বাবা মা ইত্যাদি।অসমিয়াতে ককা-আইতা,মা-দেউতা ইত্যাদি।যেখানে নেই হয় স্ত্রীবোধক পরসর্গ যোগ দিতে হয় অথবা আগে বা পরে আলাদা করে স্ত্রীলিঙ্গের বিশেষ্য বা বিশেষণ শব্দ বসাতে হয় অনেকটাই বিশেষণের মতো। যেমন বাং.-অস.বাঘ-- বাঘিনী,বাং.পুরুষ মানুষ -- মেয়ে মানুষ,অস.মতা মানুহ --মাইকি মানুহ।ঠাকুরপো-- ঠাকুরঝি-র মতো নজির বাংলাতেই মেলে।অসমিয়াতে তেমনি গৰুটো-- গৰুজনী। অন্য সব জড় পদার্থের লিঙ্গ বাংলা অসমিয়া দুই ভাষাতেই ক্লীব।সেগুলোর কোনো রূপভেদ নেই।গোলকচন্দ্র গোস্বামী তো এতো দূরও এগিয়েছেন,“আমার ভাষাত লিঙ্গ দুটা... অসমীয়া ভাষাত নির্জীব পদার্থর লিঙ্গর কোনো বিচার করা নহয়। কারণ, এইবোর স্বাভাবিক লিঙ্গহীন, ক্লীবলিঙ্গ বাচক: এইবোৰৰ মতা বা মাইকীর কোনো চিন নাথাকে।”২২ লীলাবতী শইকীয়া বরা কেন যে ক্লীব সম্পর্কে লিখলেন বুঝিনি,“পুংলিঙ্গর আকৃতিয়ে তার আকৃতি আরু পুংলিঙ্গর রূপেই তার রূপ।”২৩ এই উক্তি আমাদের বাহুল্য বলেই মনে হচ্ছে। সংস্কৃতে ‘কলত্র’ ক্লীব,বাংলা অসমিয়াতে স্ত্রী।কিন্তু বাংলা ‘টেবিল,চেয়ার,সোনা’ কিংবা অসমিয়া ‘চকি,মেজ,সোণ’-এর রূপ যে পুংলিঙ্গের রূপ সেটি কী করে বোঝা যাবে?সংস্কৃতেও লিঙ্গ এই তিনটি হলেও সব সময় অর্থ নির্ভর নয়,কতকটা গঠন নির্ভর,কতকটা প্রথা নির্ভর।চলে আসছে বলেই চলে,কেন চলে সর্বত্র ব্যাখ্যা দেয়া কঠিন।হিন্দিতেও তাই,সেই ভাষাতে তো ক্লীব লিঙ্গ বলেই কিছু নেই।
মূলত দুটো ‘-ঈ,-নী’ ইত্যাদি পরসর্গ যুক্ত হয়ে কিছু বাংলা শব্দের লিঙ্গভেদ হয়ে থাকে।‘-নী’-এর কয়েকটি উপরূপ আছে‘~ইনী,~উন̖,~আইন̖’।যেমন:ঈ=ভাগিনেয়—ভাগিনেয়ী,রাক্ষস–রাক্ষসী;নি=মজুর–মজুরনি;ইনী=বাঘ—বাঘিনী; উন=ঠাকুর-ঠাকুরুন;সিলেটি.আইন= ঠাকুর- ঠাকুরাইন। রবীন্দ্র কুমার দত্ত লিখেছেন,নোয়াখালি-চট্টগ্রামীতে ‘-ন̖’ যোগ করে স্ত্রী লিঙ্গের পদ গঠন করা হয়।২৪সেও আসলে এই ‘-নী’-এরই উপরূপ।‘নাতি’-র বিপরীতে ‘নাতিনী’ মান বাংলার এবং অসমিয়ার পরিচিত শব্দ।তার থেকে শেষের ‘-ঈ’-টি বাদ পড়ে যায় শুধু।হয় ‘নাতিন’,‘বেয়াইন’ ইত্যাদি। শব্দগুলো সিলেটিতেও একই।
আরেকটি পরসর্গ ‘-আ’ বাংলাতে স্ত্রী লিঙ্গ বোঝাবার পরসর্গ আছে বলে মনে করা হয়। লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে---সেগুলোর অধিকাংশই আসলে তৎসম শব্দ।যেমন:বৃদ্ধ–বৃদ্ধা,শিষ্য-শিষ্যা,আধুনিক-আধুনিকা,প্রথম –প্রথমা ইত্যাদি।এগুলো হুবহু অসমিয়াতেও আছে।শুধু বাংলাতে বগ-বগা,সুলতান-সুলতানা ইত্যাদি তদ্ভব এবং দেশী-বিদেশীমূলের শব্দেও তৎসমের অনুসরণে সামান্য কিছু শব্দে ‘-আ’ যোগ হয়। অসমিয়াতেও আছে---চুলতান-চুলতানা।
অধিকাংশ সময়ই এই পরসর্গগুলো যুক্ত হতে গিয়ে আগের অংশের ধ্বনিপরিবর্তন করে দেয় বহু সময় অথবা স্ত্রীলিঙ্গ পুংলিঙ্গে আলাদা পরসর্গ ব্যবহৃত হয়।সেসবের অধিকাংশই অসমিয়া বাংলা দুই ভাষাতেই তৎসম শব্দ এবং সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম মেনে চলে।যেমন সত্যবান হয় সত্যবতী।সাধক হয় সাধিকা।নেতা হয় নেত্রী,সম্রাট হয় সম্রাজ্ঞী। কিছু তৎসম শব্দের বাংলা অসমিয়াতে দুই ভিন্ন স্ত্রী লিঙ্গ তৎসম পরসর্গ জনপ্রিয় হয়েছে।যেমন-- শিক্ষক-বাংলাতে শিক্ষিকা,কিন্তু অসমিয়াতে শিক্ষয়ত্রী।এসবের জন্যে সংস্কৃত ব্যাকরণ তথা পরম্পরাগত বাংলা ব্যাকরণে সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে।কিন্তু বাংলা তদ্ভব বা নিজস্ব শব্দগুলোতে যে লিঙ্গ বোঝাবার পরসর্গ কোনো নিয়ম মেনে বসে না সেদিকে রবীন্দ্রনাথ বহু আগেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।লিখেছিলেন,“এই প্রত্যয়যোগের নিয়ম কী তাহা বলিবার কোনো প্রয়োজন নাই কারণ এ প্রত্যয়টি কেবলমাত্র কয়েকটি শব্দেই আবদ্ধ,তাহার বাহিরে প্রয়োজন হইলেও ব্যবহার হয় না।পাঞ্জাবি সম্বন্ধে পাঞ্জাবিনি,মারাঠা সম্বন্ধে মারাঠনি,গুজরাটি সম্বন্ধে গুজরাট্নি প্রয়োগ নাই।উড়েনি আছে কিন্তু শিখ্নি মগ্নি মাদ্রাজিনী নাই।ময়ূর জাতির স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে দৃশ্যত বিশেষ পার্থক্য থাকাতে ভাষায় ময়ূর ময়ূরী ব্যবহৃত হয় কিন্তু চিল সম্বন্ধে এরূপ ব্যবহার নাই।”২৫
অসমিয়াতে মূল পরসর্গগুলো বাংলার মতো একই ‘-ঈ,-আনী’।বাণীকান্ত কাকতি তাই লিখেছেন।লীলাবতী শইকীয়া বরাও লিখেছেন,অসমিয়াতেও ‘-নী’ রয়েছে এবং এর তিনটি সম্প্রসারিত রূপ ‘–অনী,~ইনী,~উনী’ রয়েছে। আর আছে ‘-ৰী’।তারও তিন সম্প্রসারিত রূপ ‘-অৰী,~ এৰী,~উৰী’।সবমিলিয়ে অসমিয়াতে লীলাবতী শইকীয়া লিখেছেন,“স্ত্রী প্রত্যয়র নটা রূপ।”২৬ কিন্তু ‘–অনী,- অৰী’-কে সম্প্রসারিত রূপ বলবার মানেতো,এগুলো উপরূপই। আলাদা করে গুণবার মানে কী? সেদিক থেকে তবে স্ত্রী পরসর্গ দাঁড়ায় তিনটিই। ব্যঞ্জনান্ত পুংলিঙ্গ শব্দে ‘-ঈ’ জুড়ে স্ত্রী লিঙ্গ করাটা বাংলার মতো একই। যেমন, কোঁৱৰ-কুঁৱৰী,ভালুক-ভালুকী,ৰূপহ—ৰূপহী।‘ৰূপহ’ শব্দটি দেখে মনে হতে পারে,বাংলাতে তবে ‘-সী’ বলেও একটি পরসর্গ আছে নিশ্চয়।আসলে বাংলাতেও পুংলিঙ্গ শব্দটি মূলে ‘রূপস̖’। কৃত্তিবাসী রামায়ণে আছে,‘উষিমিষি করে সব দেখিতে রূপস।’ পূর্বাংশ তথা পুংলিঙ্গরূপটি ‘আ’ বা ‘ই’-কারান্ত হলে ‘-নী’ যুক্ত হয়।যেমন,বৰুৱা–বৰুৱানী,নাতি-নাতিনী ইত্যাদি।পূর্বাংশ ব্যঞ্জনান্ত হলে কখনো ‘-অনী’ যুক্ত হয়।যেমন– ফুকন—ফুকননী।কখনো ‘-ইনী’ যুক্ত হয়। যেমন—বাঘ-বাঘিনী।তেমনি ডোম-ডুমুনী।
‘-ৰী’-এর সমস্যাটি সামান্য জটিল।এর উপরূপগুলো ব্যবহারের নজির তিনি দিয়েছেন এরকম: কলা-কালৰী, ডেকা---ডেকেৰী;বেঙা—বেঙুরী।‘ডুমুনী’ ইত্যাদি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন,“আদ্যক্ষরত ‘উ/ও’র কারণে ‘উনী’ প্রত্যয় লগলাগি ক্রমে ডুমুনী,কুঁচুনি,ভুতুনী,চুৰুণী হয়।’ আসলে স্বরধ্বনিপরিবর্তন তথা স্বরসঙ্গতির ইঙ্গিত করছেন।পরসর্গটি ‘নী’ বললেই যথেষ্ট।তেমনি–‘-অৰী,~ এৰী,~উৰী’ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখছেন পরসর্গগুলো ‘রূপসাপেক্ষ’।আমরা রূপতত্ত্বেরই আলোচনা করছি,সেখানে এহেন ব্যাখ্যার দরকারই বা কী?তা ছাড়া ‘কলা’র ‘ক’ অক্ষরটিও ‘কা’ হচ্ছে। শুধু পরসর্গ ‘-অৰী’তে এর ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না।গোলকচন্দ্র তো স্পষ্টই লিখছেন,‘-এৰী’ অসমিয়াতে বিরল।একটিই শব্দ ঐ ‘ডেকেৰী’ পাওয়া যাচ্ছে। আর ‘–অৰী,আৰী,-উৰী’ রূপের “প্রয়োগর কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম জনা নাযায়।”২৭ সামান্য লক্ষ করলেই স্পষ্ট বোঝা যাবে,যেসব ক্ষেত্রে পরসর্গ ‘-ৰী’ যুক্ত হচ্ছে,তাতে পূর্বাংশেরও ধ্বনি পরিবর্তিত হচ্ছে।কিন্তু আরো কিছু শব্দের সঙ্গে তুলনা করলে ‘-ৰী’ আদৌ স্ত্রীলিঙ্গ বোধক পরসর্গ কিনা এই প্রশ্নটিই মনে আসে।আরো ক্ষুদ্রতম এককও দুর্লভ নয়।কালৰী,ডেকেৰী ইত্যাদি শব্দগুলো কিন্তু বিশেষণ।সেরকম পুরুষ বিশেষণও আছে।যেমন-কান্দুৰা,কাহুৰা,দাহুৰা ইত্যাদি।তারমানে ‘-ৰ’ পরসর্গটি বিশেষ্য বা ক্রিয়াপদকে বিশেষণে রূপান্তরিত করছে।তার পরে ‘আ’ যোগ করলেই শব্দটি পুং-লিঙ্গ,‘-ঈ’ যোগ করলেই স্ত্রীলিঙ্গ হয়ে যাবে এভাবেও বলা যাবে না। ‘কাউৰী’ মানে ‘কোৱা’ (কাক),কিন্তু ‘কাঁউৰা’ মানে কামাতুর।আসলে শব্দগুলো বিশেষণই।কিন্তু কিছু তার শুধুই স্ত্রী লিঙ্গ।কিছু শুধুই পুংলিঙ্গ।ভাষাটির সাম্প্রতিক প্রবণতা হলো এগুলোকে উভয় লিঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করা।গোলকচন্দ্র তাই নজির দিয়েছেন-- ‘মতা কাউৰী---মাইকী কাউৰী’,কাউৰীটো—কাউৰীজনী।তার মানে পরসর্গটি ‘-ৰী’ নয় ‘ঈ’।এবং ‘-আ’ একেবারে নেই নয়।কোথাও কোথাও তো আছে।
তেমনি আরেকটি সমস্যা ‘-জন,~টো,--জনী’-কে নিয়ে।‘-টো’ বদ্ধরূপিম।কিন্তু ‘জন’ মুক্তরূপিম।তৎসম।এর সঙ্গে পরসর্গ ‘-তা’ যোগ করে বাংলা অসমিয়া দুই ভাষাতেই ক্লীব লিঙ্গের শব্দ ‘জনতা’ হয়।কিন্তু অন্যক্লীবের পরে যোগ করে বাংলাতেও অনির্দিষ্ট বহুত্ব বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।যেমন—লোকজন।বহুবচনে কিন্তু ‘লোকগুলি’।স্ত্রী লিঙ্গে ‘মেয়েলোকগুলি’। কিন্তু অসমিয়াতে মানুহজন-মানুহজনী,গৰুটো—গৰুজনী-সবই একবচন।বাংলা ‘ঠাকুরঝি-ঠাকুরপো’র মতোও নয়।প্রথমত: পূর্বাংশ ‘মানুষ’ বা ‘গৰু’ ক্লীব লিঙ্গের শব্দ,‘ঠাকুর’-এর মতো পুংলিঙ্গ নয়। ‘জন’ মূলে পূর্ণ শব্দ হলেও অসমিয়াতে পূর্বাংশের সঙ্গে একাধারে নির্দিষ্টতা এবং একবচন বোঝাবার প্রত্যয়।এর সঙ্গেই ‘ঈ’ প্রত্যয় যোগ করে অসমিয়াতে স্ত্রী লিঙ্গের অর্থ প্রকাশ করলেও,‘জন’ রূপিমে সর্বত্র পুংলিঙ্গ বোঝায় না।মানবেতর প্রাণীতেতো নয়ই,তাই মানুহজন,কিন্তু গৰুটো।‘-টো’ কখনো বা মানুষ বোঝালেও ব্যবহৃত হয়,কিন্তু তুচ্ছার্থে।‘জন’-এর মতোই আরেকটি মুক্তরূপিম ‘গৰাকী’ আছে বলে গোলকচন্দ্র লিখেছেন।অতিসম্ভ্রমার্থেই এটি ব্যবহৃত হয়।কিন্তু তাঁর নজিরেই স্পষ্ট এটি যতটা বচনকে নির্দেশ করে ততটা মোটেও লিঙ্গকে নয়।যেমন অধ্যাপকগৰাকী---অধ্যাপিকাগৰাকী।২৮
বুঢ়া-বুঢ়ি, খুৰা-খুৰি,ক’লা-ক’লী এমন বিপরীত শব্দ দেখেও অনেকে মনে করেন ‘-ঈ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়েছে।পুংলিঙ্গ শব্দটিতেও যে ‘আ-কার’ যুক্ত আছে সেদিকটিতে নজর ফেলেন না।লীলাবতী শইকীয়া বৰা এই ‘-ঈ’ প্রত্যয়কে লিখেছেন ‘ধ্বনি সাপেক্ষ’।২৯আমরা এইভাবে বলবার কারণ দেখি না।এমন বিপরীত লিঙ্গ শব্দজোড় বাংলাতেও আছে প্রচুর পরিমাণে। এই সব শব্দে কোনো পরসর্গ বা রূপিম যুক্ত হয়েছে বললে,পূর্বাংশ বুঢ়ˎ,খুৰˎ,ক’লˎ,তেমনি বাংলাতেও বুড়ˎ(বুড়া--বুড়ি),কাকˎ(কাকা-কাকি),কালˎ(কালা-কালি) এমন সব অদ্ভুত রূপিম কল্পনা করতে হয়।আসলে এগুলো নিজেরাই একক মুক্তরূপিম।লিঙ্গভেদে অন্ত্য স্বর ভিন্ন হয়।জগন্নাথ চক্রবর্তীও এটি ধরতে না পেরেই লিখেছেন,“ স্ত্রী প্রত্যয় রূপে চিহ্নিত ‘আ’ বরাক বাংলায় পুংলিঙ্গও নির্মাণ করে।”৩০ তাঁর--বান̖দ̖রি-বান̖দ̖রা,মাদ̖দি-মাদ̖দা,চড়ি –চড়া’ ইত্যাদি নজিরে এই ঘটনাই ঘটেছে।মান বাংলা জল/পানিওয়ালা,রিক্সাওয়ালা,অসমিয়া পানীৱালা,ৰিক্সাৱালা,সিলেটি পানিআলা,রিক্সাআলা যখন পানিওয়ালি,পানিৱালী,পানিআলি ইত্যাদি হয় তখনও ঘটনা একই ঘটে ‘আলা’ পরসর্গ মোটেও পদনির্মাতা পরসর্গ নয়,তথা লিঙ্গার্থ বহন করে না।‘মালিকানা সম্বন্ধে’র অর্থ যোগ করে নতুন নামশব্দ তৈরি করে,তথা শব্দনির্মাতা পরসর্গ।তবে কিনা বাংলা কিংবা অসমিয়া ‘কাল’ শব্দে ঠিকই ‘-ঈ’ যুক্ত হয়ে দেবী ‘কালী’ হয়।‘ক’লি’ এবং ‘কালি’র পাশাপাশি এই কথাটাও মনে রাখা ভালো। তফাতটিও স্পষ্ট হবে বোঝা যাবে তাতে।
সুতরাং কোন শব্দের লিঙ্গভেদ কী করে হবে রবীন্দ্রনাথ যেমন বাংলার সম্পর্কে লিখেছেন,অসমিয়াতেও সর্বত্র সুনির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল।কিছু সাংস্কৃতিক-সামাজিক সমস্যাও আছে।বৰুৱা উপাধি অসমিয়াতে স্ত্রী লিঙ্গে বৰুৱানী হবেই---এটা আর আজকাল নিশ্চিত করে বলা যাবে না,কেউ সেরকম ব্যবহার করেন না।বাংলার মতোই ব্যক্তির নামেই সেই লিঙ্গভেদ সম্পূর্ণ হয় তথা লিঙ্গ অনুযায়ী নাম গুলো ভিন্ন হয়।তবে জাতি,সম্প্রদায় বা পেশাজীবী মহিলা বোঝাতে অসমিয়াতে ‘কলিতানী’,‘কেওটনী’,‘ধুবুনী’,‘কুমাৰণী’ শব্দগুলো এখনো শ্রেণি বিশেষে ব্যবহারে আছে।ফাগুন-ফাগুনা,গাইমূৰ-গাইমুৱা, ভাদ ---ভদীয়া,ক’লা—কলীয়া এমন কিছু শব্দে ‘-আ,~ঈয়া’ যোগ করে পুংলিঙ্গ শব্দ গঠন করা হয় বলে লীলাবতী শইকীয়া বরা লিখেছেন।এগুলো কতটা লিঙ্গ ভেদ আর কতটা পদান্তর আমাদের সংশয় আছে।‘গাইমুৱা’তো অসমিয়াতে গালি। ‘কলীয়া ডাৱৰ’ (কালো মেঘ)বললে কি কোনো কালো পুরুষের কথা মনে আসে?
কিছু বাংলা–অসমিয়া শব্দের স্ত্রী লিঙ্গ নেই,যেমন পুরোহিত;অসমিয়াতে হালোৱা,পাইক।কিছু শব্দের পুং লিঙ্গ নেই, যেমন অসমিয়া-বাংলাতে সধবা,বাং.সতীন;অসমিয়াতে সতিনী,নাচনী,শিপিনী। ‘বিধবা’ অর্থে সিলেটিতে পুংলিঙ্গ শব্দ ‘রাড়া’ ও ‘লাড়ি’ রয়েছে বলে জগন্নাথ লিখেছেন।৩১ সেগুলো ব্যতিক্রম বলেই মনে হয়। মান বাংলা ‘বিধবা’র বিপরীতে মান বাংলা এবং অসমিয়াতে ‘বিপত্নীক’ শব্দটি মনে পড়বে বটে,কিন্তু ‘বিপতিক’ বলে কিছু নেই।অর্থাৎ দুই শব্দে কোনো গঠনগত ঐক্য নেই।গোলোকচন্দ্র গোস্বামী ‘দেউতা,পিতা’-ইত্যাদি শব্দকেও ‘নিত্য পুংলিঙ্গবাচক’ এবং ‘আইতা,মা ’ ইত্যাদি শব্দকে ‘নিত্য স্ত্রী লিঙ্গবাচক’ শব্দ বলেছেন।৩২সত্য বটে।কিন্তু এগুলোকে ‘পাইক,নাচনী’-র সারিতে বসানো যাবে না।কারণ,এগুলোর বিপরীত লিঙ্গে স্বতন্ত্র শব্দ আছে।
আজকাল কিছু কিছু প্রাণীবাচক ক্লীব লিঙ্গ শব্দকে ইংরেজির নকলে বাংলাতেও উভয় লিঙ্গ বলা হয়।যেমন ডাক্তার, শিশু,বাচ্চা,কবি,সাংবাদিক ইত্যাদি। অসমিয়াতেও এই শব্দগুলো আছে,‘বাচ্চা’র প্রতিশব্দ ‘কেঁচুৱা’ও আছে।গোলকচন্দ্র এদের ‘লিঙ্গ নিরপেক্ষ’ শব্দ বলছেন“যিবোৰে মতা বা মাইকী উভয়কে বুজায়”।৩৩ স্পষ্ট যে বাংলার মতোই এদের উভয় লিঙ্গ বলা যেতে পারে। লিঙ্গনিরপেক্ষ শব্দগুলো প্রাণী বোঝালে ‘উভয় লিঙ্গ’,অপ্রাণী বোঝালে ‘ক্লীব লিঙ্গ’ এইভাবে দরকারে ভাগ করা যেতে পারে।বহু সময় এই সব উভয় লিঙ্গ শব্দের আগে পূর্ণ শব্দ জুড়ে অসমিয়া –বাংলা দুই ভাষাতেই লিঙ্গ ভেদ করা হয়। যেমন মহিলা ডাক্তার---পুরুষ ডাক্তার,পুরুষ কবি---মহিলা কবি।অসমিয়াতে মতা মানুহ-মাইকী মানুহ। সিলেটি,চট্টগ্রামী আদি পূর্ববঙ্গীয় ভাষাবৈচিত্র্যগুলো এবং অসমিয়ার প্রথম পুরুষের একবচন বাদ দিলে বাকি সর্বনামগুলোরও কোনো লিঙ্গভেদ হয় না।সেগুলো উভয় লিঙ্গই।
সিলেটি এবং অসমিয়াতে লিঙ্গভেদে প্রথম পুরুষের স্পষ্টতই দুই ভিন্ন শব্দ রয়েছে—হে/ সি এবং তাই,~এই। অসমিয়াতে ‘তাই’ দূরের মহিলা,‘এই’ কাছের মহিলা বোঝায়।৩৪সিলেটিতে এই বিভাজন নেই।নোয়াখালি,চট্টগ্রামীতে সব সময় আবার মূল শব্দটি ভিন্ন নয়।শুধু লিঙ্গপরসর্গগুলো ভিন্ন।যেমন নোয়া: পুং--হেতে,হ্যেতে,ত্যে,হেইতে,তে;স্ত্রী—হেতি, হেইতি,হিতাই,হিতি এবং তাই।চট্ট.পুং—হিতে,তে,ই́তে(ই-র উপরে ঊর্ধ্ব স্বরাঘাত আছে) স্ত্রী—হিতি,হিতাই,ই́তি,তেই,এবং তাই।৩৫ সে-র সঙ্গে ‘তে’ কোত্থেকে এলো এ একটা প্রশ্ন বটে।এই আসাটা দুই লিঙ্গেই হচ্ছে এখানে।‘সেতে’ যে ‘হেতে’ হয়েছে এটা বোঝা যাচ্ছে,তার পরে সবই ধ্বনি পরিবর্তনের খেলা।‘হ’ এখানেও লোপ পেয়ে প্রথমে ই́তি এবং পরে স্বর ব্যঞ্জনের স্থান বিপর্যয় হচ্ছে আর কেবল স্ত্রী লিঙ্গে ‘তাই’ শব্দ আসছে---এমন একটা অনুমান করা যাচ্ছে।অর্থাৎ চট্টগ্রামী এবং নোয়াখালিতে প্রচলিত বিভিন্নরূপের মধ্যে ‘তাই’ শব্দের উদ্ভবের ইতিবৃত্ত পাওয়া যাচ্ছে।সেই সঙ্গে এগুলো অসমিয়া শব্দ উৎসটিরও একটি ব্যাখ্যা দিচ্ছে।এটা দেখায় অসমিয়া ভাষা অধ্যয়নের জন্যেও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার পুব প্রান্তে চট্টগ্রাম অব্দি বাংলা ভাষা বৈচিত্র্যগুলো অধ্যয়ন কেন জরুরি।অবশ্য ‘তাই’ শব্দটির একটি স্বাধীন উৎসও থাকতে পারে।সুনীতিকুমার প্রাচীন ভারতীয় আর্য করণের রূপ ‘তয়া’র থেকে মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষাতেই ‘তাই’ এসেছে বলে অনুমান করেছেন।৩৬জগন্নাথ চক্রবর্তী এই তথ্যের উল্লেখ করেও সঠিক উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন নি। তিনি লিখেছেন,“বরাক বাংলায় মুখ্য কারকের পুং ‘হি’ বা ‘হে’ এবং স্ত্রী লিঙ্গ ‘তাই’ এর সম্ভ্রমাত্মক ‘তাইন’ রূপটির উৎস অপভ্রংশ ‘তানং+ তেহিং’ কেই ধরে নিচ্ছি। তবে এতে ঔপভাষিক স্ত্রীলিঙ্গ রূপ ‘তাই’ এবং আধুনিক বাংলার সম্ভ্রমাত্মক রূপ ‘তিনি’ এর প্রভাব থাকাও বিচিত্র নয়।’৩৭ সুনীতিকুমারও সেরকম ভেবেছেন।‘তাইন’ শব্দটি ক্ষয় পেয়ে ‘তাই’ হতে পারে।কিন্তু ‘তিনি’র উলটো গতির প্রভাবে ‘তাই’ হয়নি এটা নিশ্চিত হয়েই বলা যায়।প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলা সাহিত্যে নির্দেশক সর্বনাম ‘সে’-র বদলে প্রাচীন ভারতীয় আর্যের করণের পরসর্গ ‘-তেন’-র থেকে আসা ‘-তে’ মেলে।যেমন---তে কারণে রাধা ধরিতে নারো মনে(শ্রী কৃষ্ণকীর্তন)।‘তাই’ শব্দটি ঢাকাইয়ারও কিছু ভাষাবৈচিত্র্যে রয়েছে।সেখানে পুংলিঙ্গ শব্দটি ‘হ্যায়’।লিখেছেন আব্দুল হাই।
সংস্কৃতের অনুসরণে বাংলাতে নদ-নদী,বাটা বাটি---এমন কিছু বিশেষ্যে এবং দুই ভাষাতেই সুন্দর-সুন্দরী,মহান মহীয়সী এমন কিছু তৎসম এবং পাগলা-পাগলি,কানা–কানি,অসমিয়াতে প’গলা-পাগলী,কণা-কাণী---এমন কিছু তদ্ভব বিশেষণে দুই ভাষাতেই লিঙ্গভেদ আছে বলে মনে হলেও অধিকাংশ সময় বিশেষ্যগুলোতে ব্যবহৃত পরসর্গ ছোটবড় অর্থই বুঝিয়ে থাকে।জগন্নাথ চক্রবর্তী লিখেছেন,সিলেটি ‘ঢাকনা-ঢাকনি’,‘ছাত̖তা-ছাত̖তি’ ছোট-বড় বোঝায় না,দুটোই ছোট কিংবা বড় বোঝাতে পারে।কিন্তু এমনও তো নয় যে ছেলের ছাত̖তা,মেয়ের ছাত̖তি। একে নিতান্তই স্বার্থিক প্রত্যয় হিসেবে নেয়া যেতে পারে।বস্তুটির প্রতি বক্তার ‘যত্ন’ কিংবা ‘মায়া’ও বোঝায়।সেরকম করে দেখলে মান বাংলাতেও আছে ‘ঢাকুনি’,‘ছাতি’।সুতরাং একে ‘বরাক বাংলা’র আলাদা ব্যাপার বলে মনে করবার কোনো কারণ নেই।তেমনি ‘পাগলি’ বললে সামান্য আদর,‘কানি’ বললে সামান্য গালি শব্দের অর্থের সঙ্গে জুড়ে যায়।অন্যথা,বিশেষণেতো ভেদ করাই হয় না।বাংলাতে সুন্দর মেয়ে—সুন্দর ছেলে,মেজো কাকা-মেজো কাকি,পাগল ছেলে–পাগল মেয়ে-ই সঠিক বাংলা।অসমিয়াতে ধুনীয়া ল’ৰা- ধুনীয়া চোৱালী, মাজু খুড়া,মাজু খুড়ি,প’গলা ল’ৰা-প’গলা চোৱালী।তবে অসমিয়াতে ৰূপহ গাভৰু হয় না,গাভৰুকে ৰপহী-ই হতে হবে। এমন সামান্য কিছু ব্যতিক্রম রয়েছ।
বচন:
বাংলাতে বচন দুটি—একবচন এবং বহুবচন।সংস্কৃতের ‘দ্বিবচন’ বাংলা,অসমিয়া কোনো ভাষাতেই নেই। ইংরেজি Number কথাটির অর্থ আমরা বাংলাতে করে রেখেছি ‘বচন’।অথচ এই তৎসম শব্দটির মানে হচ্ছে ‘বোধক’,‘কথা’ বা ‘উক্তি’।‘সংখ্যাবচন’ বললে তথাপি খানিকটা সঠিক বোধ গড়ে উঠে।সংস্কৃতে সাত কারকে তিন বচনে আলাদা বিভক্তি ছিল। প্রথমার একবচনে ‘সু’ আর সপ্তমীর বহুবচনে ‘সুপ̖’ –একুশটি বিভক্তিকে একত্রে ‘সুপ̖’ বলা হয়।ফলে সেখানে সমস্যা হয় না। কিন্তু বাংলা বা অসমিয়াতে এত শত বিভক্তি বা পরসর্গ নেই,তাই কিছু সমস্যা হয়।‘নর:,নরৌ,নরাঃ’ বললে সংস্কৃতে বোঝা যায় একটি,দুটি,বহু মানুষের কথা বলা হচ্ছে।কিন্তু বাংলা ‘মানুষ’ কিংবা অসমিয়া ‘মানুহ’ কথাটার কী বচন?বহুবচন যদি বলি, তবে ‘মানুষগুলি’ বা ‘মানুহবোৰ' অথবা একবচনে ‘মানুষটি’ বা ‘মানুহটো’ বলবার দরকার পড়ে কেন?অথবা ‘চাবির গোছা’র কী বচন?বহুবচন?‘চাবির গোছাটা’ কিংবা ‘চাবির গোছাগুলো’-র কী বচন?এই সব সমস্যা হয়।আমরা ক্রমান্বয়ে এর সমাধান করবার চেষ্টা করে যাব।
বাংলাতে বচন বোঝাতে বিশুদ্ধ পরসর্গ মূলত একটিই ‘-রা’।এর উপরূপ হিসেবে ‘~গুলো,~গুলি,~গুনো’ আছে। কিন্তু সেটি মূলত নির্দেশক পরসর্গ।তাই ‘-রা’-এর থেকে এর ব্যবহার বিস্তৃতি বেশি।যেমন- ছেলেরা ~গুলো,মেয়েরা~গুলো। ‘পাতারা,‘দুধেরা’ হয় না,কিন্তু ‘পাতাগুলো,দুধগুলো’ হয়।‘টা,~টি’ একবচনের পরসর্গ বলে ভ্রম হয়।কিন্তু সেটি আসলে নির্দেশক পরসর্গ।‘লোকটি,একটি’ বলতেও ব্যবহার হয়,মনে হয়ে বুঝিবা একবচন বোঝানো হলো।কিন্তু ‘অনেকটি,কয়েকটি’ শব্দেও ‘-টি,~টা’ কিন্তু থাকে।এ দু’টো একের বিকল্পে আরটি যদিও বা বসে ‘-টো,~টে’ কিন্তু বসে না।‘দু’টো, চারটে’ হবে ‘চারটো,দু’টে’ হবে না।তেমনি ‘সেইটে’ যদিও বা একবচনের বোধ একটা জন্মায়, ‘-টো’ দিয়ে তো কিছুতেই না।রবীন্দ্রনাথ একটি ধ্বনিতাত্ত্বিক সূত্র বের করেছিলেন,আগে ‘উ’ থাকলে পরের ‘আ’ ‘ও’ হয়ে যায়।কিন্তু বাংলাতে ‘গরুটা,~টি’ কিছুতেই অসমিয়ার মতো ‘গরুটো’ হবে না।সুতরাং শেষ পর্যন্ত ঐ ‘টা,~টি’ বা ‘-টো,~টে’ পরসর্গ হিসেবে যুক্ত থাকলেও বচনের অর্থ সমগ্র শব্দটিই বহন করে।কোনো পরসর্গ নয়।এই খানে আরেকটি কথা আছে,‘চার-পাঁচটা, কয়েকটা’ --- কি বহুবচন? ‘কতকগুলো’ তবে কী?‘দুধটুকু’ কি একবচন? ব্যাকরণের কোত্থাও সেরকম বলা নেই।কিন্তু ‘দুধগুলো’?এই সমস্যার দিকে রামেশ্বর শ’ও বিশেষ দৃষ্টি দেন নি।milk ইংরেজিতে uncountable noun।বাংলা বা অসমিয়া ব্যাকরণে সেরকম কিছু নেই।‘দুধ’ও যা,‘ কলা’-ও তাই।বাংলাতে ‘বস্তুবাচক’৩৮ বিশেষ্য এবং অসমিয়াতে ‘সংজ্ঞাবাচক’৩৯ বিশেষ্য।দুটোই পরিমাণে কম বেশি হয়।তাই গোলকচন্দ্র অসমিয়াতে ‘পরিমাণবাচক’ বলে একটি উপবিভাগের কথা ভেবেছেন।কিন্তু এর একটি সংখ্যাতে গোণা যায় অর্থাৎ ‘গণনাসম্ভব’, আরটি গণনার সমস্ত সম্ভাবনাকে অতিক্রম করে,এই অর্থে –‘গণনাতীত’।আমরা এই নামে দুই বিশেষ্যের কথা মনে রাখলে অন্তত ‘দুধটুকু-দুধগুলো’র সমস্যার সমাধান করতে পারি। ব্যাকরণ স্বীকার না করুক, ভাষাটি যারা ব্যবহার করেন তাদের চিন্তাতে এই ‘গণনাতীত’ বিশেষ্যের সংখ্যা না হলেও পরিমাণভেদ কাজ করে।আর তাই, ব্যাকরণে পরিচিত ‘সংখ্যাতে বহুত্ববোধক’ পরসর্গ ‘-গুলো’,তাঁরা পরিমাণে বহুত্ব বোঝাতেও ব্যবহার করেন।শুধু ‘দুধগুলো’ নয়,‘জলগুলো,ঘাসগুলো’ এমন অনেকগুলো শব্দ মিলবে।বিপরীতে পরিমাণে অতিসামান্য বোঝাতে ‘দুধটুকু,জলটুকু, ঘাসটুকু’ ইত্যাদি।এর জন্যে ব্যাকরণে আলাদা কোনো সংবর্গ রাখা হয় নি।কেন? অথচ সংস্কৃত ব্যাকরণে ‘সুবন্ত’ প্রকরণের এমন কোনো শব্দ নেই যার বচন ভেদ করা হয় নি।যেমন---‘উদকম-উদকে-উদকানি’,‘বারি-বারিণী বারীণি’,‘মধু-মধুনী-মধুনি’।৪০এগুলো বাক্যে ব্যবহৃত হচ্ছে এরকম-- বয়ং দধিনা চিপিটং খাদামঃ;পবিত্রং গঙ্গায়াঃ উদকঃ।তার মানে আমরা ‘বচন’ কথাটি নিয়েছি তো সংস্কৃত থেকেই,কিন্তু এর অর্থটি নিয়েছি ইংরেজি থেকে।সমস্যা সেখানেই হয়েছে।এবং এই বৈপরীত্য নিয়েই বাংলা-অসমিয়া বচনের আলোচনা করতে গিয়ে পরম্পরাগত ভাষাবিজ্ঞানে বা ব্যাকরণে বেশ কিছু জটিলতাও তৈরি হয়েছে,আমরা ক্রমে দেখাব।
‘কতকটা-কতকগুলো’ দেখাচ্ছে বাংলাতে এই সব শব্দের পরসর্গগুলো প্রথমত ‘নির্দেশক’ প্রত্যয়।বচনটা সমগ্র অর্থ আর ব্যবহারের প্রেক্ষিতে ধরা পড়ে।বাণীকান্ত কাকতির অনুবাদে বিশ্বেশ্বর হাজরিকা ‘প্রৱণার্থী নিশ্চয়ার্থক’ কথাটি ব্যবহার করেছেন।৪১আমাদের কাছে সংক্ষেপে ‘নিশ্চয়ার্থক’ কথাটি বেশ মানানসই বলে মনে হয়।এর বিপরীতে ‘অনির্দেশক’ কথাটি দুর্বোধ্য ঠেকে,‘অনিশ্চয়ার্থক’বেশ মানায়।লীলাবতী শইকীয়া বরা অবশ্য বাণীকান্তেরও এইভাবে নতুন নামকরণের বিরোধিতা করে লিখেছেন,ভাষাতে বহুদিন ধরে চলে আসা পরিভাষা পাল্টালে পাঠক বিশেষ করে ছাত্রেরা বিভ্রান্ত হতে পারেন। সেরকম পুরোনো পরিভাষার উল্লেখ আমরাও সংগত কারণেই করছি।কিন্তু যদি পুরোনো পরিভাষা নতুন ধারণাকে স্পষ্ট না করতে পারে তাহলে কী হবে?তিনি অসমিয়া ভাষার ক্ষেত্রে পূর্বসূরিরা বিভিন্ন পরিভাষাতে এই পরসর্গকে চিহ্নিত করবার কথা লিখেছেন।বাংলাতে সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ও ‘ভাষাপ্রকাশ বাংলা ব্যাকরণে’ ‘পদাশ্রিত নির্দেশক’ কথাটির ব্যবহার করেছেন বলে নিজে উল্লেখ করে সেটি বরং গ্রহণযোগ্য বলে অভিমত দিয়েছেন।৪২ইংরেজিতে কথাটি ‘enclitic definitive’।সুনীতিকুমার বিকল্পে numarative এবং article-ও ব্যবহার করেছেন।৪৩ এবারে, ‘enclitic’ মানে হচ্ছে যে শব্দ সংক্ষিপ্ত হয়ে আগেকার শব্দে জুড়ে যাবে।যেমন ইংরেজি can’t-এ জুড়ে গেছে not শব্দটি।বাংলা- অসমিয়াতে তাই হলেও সর্বত্র সংক্ষিপ্তও হয় না,পরেও জুড়ে না।যেমন—গোটা চারেক দাও না;জনা পাঁচেকে এই কাজটি হয়ে যাবে।তবু যদি সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পরিভাষাটি নিয়েও নিই সেইক্ষেত্রেও কিন্তু আমাদের আরেকটি দীর্ঘ পরিভাষার দরকার পড়বে ‘পদাশ্রিত অনিশ্চয়ার্থক নির্দেশক’ বলে–এইসব শব্দের জন্যে কতকগুলো,কয়েকটা,গোটাচারেক,তিলমাত্র ইত্যাদি।শব্দগুলোতে পরিমাণটা নিশ্চিত করে বোঝানো কঠিন।সুতরাং সংক্ষেপে আমরা ‘নিশ্চয়ার্থক-অনিশ্চয়ার্থক’ পরসর্গের এই বিভাজনটা নিচ্ছি আপাতত শুধু এই অধ্যয়নের কাজ চালাতে। যেহেতু শব্দনির্মাতা সর্গ বা ‘প্রত্যয়’ নিয়ে আমরা আলাদা করে আলোচনা করছিনা,তাই সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আকারে এগোনো সঠিক হবে না। এ নিয়ে বাকি কথা ক্রমে স্পষ্ট হবে।তার আগে বচন নিয়ে আরো কিছু জট ছাড়ানো যাক।
ব্যক্তির ক্ষেত্রে বাংলাতে সম্ভ্রমার্থে বৃদ্ধটি-বৃদ্ধগুলো চলবে না।মাঝে ‘লোক,~মানুষ,~মহিলা’ আদি পূর্ণ শব্দের সঙ্গে পরসর্গ বসিয়ে দিতে হবে,মূল শব্দটি তখন বিশেষণের ভূমিকাতে আলাদাও হয়ে যাতে পারে।যেমন--বৃদ্ধ লোকটি,~বৃদ্ধা মহিলারা।
অসমিয়াতে এমনই বহুবচনে ‘-বোৰ,~বিলাক̖,~হঁত̖’ এই বদ্ধ রূপিমগুলো যুক্ত হয়।একবচনে ‘টো,~টা,~টি’ যুক্ত হয় বলে ব্যাকরণে বলা হয়ে থাকে।৪৪কিন্তু এই একবচনের রূপগুলো যে ‘নির্দিষ্টতাও বুঝায়’ এই কথাও অসমিয়া ভাষাবিজ্ঞানীরা লিখেছেন।৪৫ যেমন-মানুহটো,মানুহবোৰ,~বিলাক,সিহঁত।এর প্রত্যেকটাই মূলে মুক্ত রূপিম ছিল।গোলকচন্দ্র গোস্বামী তাই এদের ‘উপশব্দ’ বলেন।এমন কি বাংলা ‘-টা’ সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথের সূত্র এরকম,“... ‘গোটা’ শব্দের অর্থ সমগ্র।বাংলায় যেখানে বলে ‘একটা’,উড়িয়া ভাষায় সেখানে বলে গোটা।এবং এই গোটা শব্দের ‘-টা’ অংশই বাংলা বিশেষ বিশেষ্যে ব্যবহৃত হয়।”৪৬ অসমিয়া ‘-টো’-এর উৎস অন্য কিছু বলে মনে হয় না।তৎসম ‘গুটিকা’৪৭ বা ‘গোত্র’ যেকোনো একটার থেকে তদ্ভব ‘গোট’ এসে থাকতে পারে,অসমিয়াতেও এটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ এবং নির্দিষ্টতাবোধক মুক্তরূপিম। গোট মানে একাধারে ‘একক’ এবং সমাবেশ।---যেমন শিক্ষক গোট,গোট খা,গোট গোট,তিনিগোটা,গোটাচেৰেক।বাংলাতেও এই ‘গোটা’র ব্যবহার আছে যদিও পরিমাণে অসমিয়ার থেকে কমই,‘গোটাও’,গুটিয়ে আনো। সুনির্দিষ্ট করে বোঝাতে গোটা কয়,গোটা চারেক বাংলাতে আকছার ‘কয়েকটা,চারটা’-র বিকল্পে ব্যবহৃত হয়।অসমিয়াতেও তাই।তখন আবার বহুবচন বোঝাতে ‘মান’ যোগ করে ফেলা হয়।যেমন কেইটামান,চাৰিটামান ইত্যাদি।প্রাচীন অসমিয়াতে বহুবচনে ‘মান’ পরসর্গের স্বাধীন ব্যবহার ছিল।যেমন পদ্মিনী মানে,কটক মানে।৪৮ পশ্চিম এবং দক্ষিণ পশ্চিম বাংলারও কিছু ভাষাবৈচিত্র্যে ‘-মীনা,~মন’ এবং হাজং ভাষাতে ‘মান’ পরসর্গের উল্লেখ সুনীতি কুমারও করেছেন।৪৯ ‘-টো’ আমরা আগেই লিখেছি মানবেতর প্রাণীতে ব্যবহৃত হয়,মানুষের বেলা ব্যবহৃত হলেও হয় তুচ্ছার্থে।সম্ভ্রমার্থে পুংলিঙ্গে ‘-জন’।এর আবার ‘-ঈ’ যোগ করে লিঙ্গ ভেদ আছে,আমরা আগেই লিখেছি।স্ত্রী লিঙ্গে ‘-টো’-এর কোনো উপরূপেরও ব্যবহার নেই।‘টা,~টি’ মূলত ক্লীব লিঙ্গেই যুক্ত হয়।
সিলেটিতে ‘গোটা,~গুইট’ অনুপদ হিসেবে মেলে,কিন্তু পরসর্গ মূলত ‘-টা’ মেলে।ক্বচিৎ উত্তর ত্রিপুরাতে ‘-টি’ও। যেমন ইটা,হিটা;ইটি,হিটি(এটা,ওটা)।কিন্তু এর বিচিত্র প্রয়োগ আছে। কখনো বা মাঝে একটি ‘-ক̖’ জুড়ে যায়।যেমন--‘ইক̖টা, হিক̖টা,অক̖টা,হক̖টা’।এই ‘-ক̖’ নিশ্চয়ার্থে জোর দিতেই এটা জুড়ে যায়,সেই অর্থে স্বার্থিক প্রত্যয়।দুই উৎস থেকে আসতে পারে।এক,‘একটা’-র সাদৃশ্যে।দুই,‘গোটা’-র রূপান্তর।‘গোটা’র ‘-গ’ যে সিলেটিতে একেবারেই লোপ পায় না সেতো এর থেকেও বোঝা যায় যে ‘ইগু,হিগু,করগু(কে/কেটা),এগু(একটা)’ ইত্যাদি শব্দে নজর ফেরালে।দৃশ্যত শব্দগুলো ক্লীবলিঙ্গ মনে হলেও তুচ্ছার্থে পুং-স্ত্রী লিঙ্গ শব্দও বটে।এসবে পূর্বাংশ সর্বনাম।বিশেষ্যে মূলতঃ মান বাংলার মতো ‘-টা’ জুড়ে।যেমন ---মানুষটা,আমটা,গাড়িটা। এখানে সিলেটির একটি নিজস্ব প্রবণতার দিকে আমরা নজর ফেরাতে চাই। সে হলো ক্লীব সর্বনামের সঙ্গে নিশ্চয়ার্থক পরসর্গ জুড়ে যে পদটি নির্মিত হয় তার পুরোটাই বিশেষ্যের পরে অনুপদের মতো জুড়ে সিলেটিতে একাধারে সুনির্দেশ করবার এবং বচন বোঝানোর রীতি।যেমন --মানুষ ইগু,আম ইগু,শ্যাম ইগু।ই লুলা ইগু বেইমান (সু.গা.পা.:৬)। মান বাংলাতেও এভাবে অনুপদ জুড়ে দেবার রীতি আছে,কিন্তু এত ব্যাপক নয়।আম ওটা ওখানে পড়ে আছে কেন?--- বললে যত ভালো শোনায় ‘শ্যাম এটা’ না বলে ‘শ্যামটা এখানে শুয়ে আছে কেন?---প্রশ্ন করলেই সংগত হয়।‘-টা’ কিংবা ‘-গু’ এর পরে আবার ‘-ইন̖’ জুড়ে বহুবচন হয়ে যায়।এই প্রসঙ্গে আসছি।তার আগে ‘গুলো’ সমস্যা নিয়েও কিছু জটিলতা ছাড়াতে হচ্ছে।
বাংলা ‘গুলো’ পরসর্গেরও মূলে ‘কুল’ লিখেছেন
সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়।৫০বাংলা তৎসম শব্দের বহুবচনে মুক্তরূপিম
হিসেবে এর ব্যবহার এখনো আছে।যেমন
অলিকুল,পাখিকুল।পশ্চিম আসামের অসমিয়া
ভাষাবৈচিত্র্যগুলোতে এই ‘-গুলো’ এবং এর উপরূপগুলোর কাছাকাছি রূপ আছে। সেখানে এর উপরূপগুলো এরকম ‘-গিলা,~গিলাক̖,~গিলান̖,~ঙ্গলা,~ঙ্গলান̖’। যেমন গোৰুগিলান,ইঙ্গলা (এগুলো) ইত্যাদি। তবে বাণীকান্ত কাকতি এই অসমিয়া উপরূপগুলো
অনার্য অষ্ট্রিকমূলের হতে পারে বলেও অনুমান করেছেন,নিশ্চিত কিছু লেখেন নি।৫১ বাংলা রূপগুলোর থেকে উৎস ভিন্ন।হলে বাংলা শব্দের
উৎসগুলোও কেন অনার্য হবে না,সেই কথা স্পষ্ট নয়।তিনি ‘বহু,অনেক এবং কত’ অর্থে কয়েকটি অষ্ট্রিক রূপের নজির দিয়েছেন,সবগুলোই
সম্ভবত পূর্ণ শব্দ:‘-লু,~লো’,‘-বিগ̖,~বিগা,~বি গা’,‘ম’-গিত,~মু-গিত’,‘জ্ঞ̖গোয়’।প্রথমটি বাদ দিলে বাকিগুলোর থেকে
‘গিলাক’-এর আগমন কষ্ট করেই কল্পনা করতে হয়।উত্তর বাংলার কিছু
ভাষাতে ‘গু’ অংশটি লোপ পেয়েছে।‘গুঁড়ি’ সেরকমই
একটি ভাষা।নৃগোষ্ঠীগতভাবে এরা দ্রাবিড় ‘গোন্দ’
জনজাতিরই শাখা মনে হয়,কিন্তু ভাষাটি পূর্বী আর্যভাষা।এককালে ওড়িশার বাসিন্দা ছিলেন,ব্রিটিশ ভারতে পশ্চিম বাংলার দিনাজপুরে আসেন।সেই ভাষাতে বহুবচনের রূপ আছে এরকম: লোকলা (লোকগুলো),গাইলা (গাইগুলো),বেকরিলা (ছাগলগুলো) ইত্যাদি।৫২ অন্যদিকে ধীমল বলে একটি ছোট্ট মঙ্গোলীয়
জনগোষ্ঠীও আছে উত্তর বাংলাতে।নেপালেও এদের কিছু
মানুষ আছেন।তাদের ভাষাতেও বহুবচনের রূপ এরকম: কিয়া
গিলাই,নিলাই,ইবলাই ইত্যাদি।৫৩সেদিক থেকে পরসর্গগুলোর মঙ্গোলীয় উৎস
দাবি অনুমান করা তুলনাতে সহজ। অধ্যাপক দীপক রায়
সেরকমই দাবি করেন,“বাংলা উপভাষায় (প্রান্ত উত্তর বঙ্গ) লা,গিলা---এই বহুবচন
প্রত্যয় দু’টির মূল উৎস ভোটবর্মী উপাদান।যেমন---
মানষিলা,লোকলা,মানষিগিলা,লোকগিলা ইত্যাদি।”৫৪তাই
নিশ্চিত করে উৎস বিচার খুবই কঠিন।কিন্তু
বাংলা-অসমিয়া পরসর্গ পরস্পর সম্পর্ক-শূন্য বলে দাবি করাটা মনে হয় আরো কঠিন।বিশেষ করে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের একটি তর্ক মনে হয় সবার নজর এড়িয়ে গেছে।সিলেটি চট্টগ্রামী ইত্যাদি ভাষাবৈচিত্র্য নিয়ে কথা বলতে গেলে সেই নজর এড়াবার
কোনো উপায় বাকি থাকে না।সংস্কৃতে
সম্বন্ধের বহুবচনের পরসর্গ ছিল ‘-আম̖’।৫৫ এর বিচিত্র উপরূপ সংস্কৃতে নজরে পড়বে।যেমন,নরাণাম,পাদানাম,পদাম,বিশ্বপাম,সাধুনাম ইত্যাদি। এই ‘-আনাম’ রূপটি সম্পর্কে সুনীতিকুমার লিখেছেন,“The genitive plural affix «
-ānām > -ṇă, nă
» is better preserved in Bengali.It is found(though as a rare form) in nouns in
dialectal M.B. and N.B.,also occurs in the pronouns;but in the noun,its proper
genitive force is now lost. It is used mainly as a secondary affix added to the
nouns of multitude which are used to form the plural: e.g., Standard Bengali গুলিন,গুলান « -gul-i-na,-gul-ā-na » beside গুলি,গুলা « -gul-i,-gul-ā »,plural affix(Skt.kula);dialectical(East
Vaŋga) Bengali আইন<আনি« -āin<-āni»
as in সক্কলাইন,
হক্কলাইন...”৫৬ কথাটি অনেক দীর্ঘ এবং জটিল। আমরা
বিশ্বাসযোগ্যতার জন্যে যতটুকু নইলে নয়, সেটুকুনি তুলে আনলাম। এমন কি বাংলা ক্রিয়াপদ করেন,গেলেন,করিলাই,দিলাই-এর শেষাংশের উৎস সন্ধানেও
তিনি এই
«-ṇă,nă» অব্দি পৌঁছেছেন।সুধাংশু শেখর তুঙ্গও এই সূত্র সমর্থন করে সিলেটি সর্বনাম ‘তাইন’,ক্রিয়াপদ
‘যাইন’-এও এর সন্ধান করেছেন।৫৭
সুতরাং পশ্চিম অসমিয়া ‘-গিলাক̖’ তো বটেই,‘~গিলান̖,~ঙ্গলান̖’ অনুপদনির্মাণও এরকমই এক ঐতিহাসিক ক্রমপ্রক্রিয়ার পরিণাম বলেই তো মনে হয়।শুধু তাই নয় ‘গুলি’-র উপরূপের পরে আবার এই ‘-আনম’ জাত পরসর্গ যুক্ত হয়ে পশ্চিম
অসমিয়ার ভাষাবৈচিত্র্য শুধু পশ্চিম বাংলাই নয়,সিলেটি সহ পূর্ববঙ্গীয়
ভাষাবৈচিত্র্যগুলোর সঙ্গেও নিজের আত্মীয়তা ঘোষণা করে।সিলেটি ‘ইগুইন,হিগুইন’ আদি বহুবচন শব্দের
জটিল পরসর্গ ‘-গুইন̖’–এর উৎস সন্ধানে আর কোথায়ই বা আমরা বিশ্বাসযোগ্যভাবে পৌঁছুতে পারি?
জগন্নাথ চক্রবর্তী লিখেছেন,“বরাক বাংলাতে আরো খাটি বহুত্ববোধক প্রত্যয় ‘ন̖’ এবং ‘ইন̖’ পাচ্ছি।”৫৮ তিনি যে নজির গুলো দিয়েছেন,তাতে দেখা যাবে মূল শব্দের শেষে ‘ই’ থাকলে ‘-ন’,‘আ’ থাকলে ‘-ইন’ যুক্ত হচ্ছে।যেমন-- গাড়িন, বুড়াইন ইত্যাদি।তার মানে ‘-ন̖,~ইন̖’ পরস্পর উপরূপ।আসলে এ দু’টোই ‘-গুইন’-এর উপরূপ।ক্লীব সর্বনামের নিশ্চয়ার্থক পরসর্গে সাধারণত ‘গু’ অক্ষত থাকছে,অন্যত্র লোপ পেয়ে যাচ্ছে। ‘-রা’ এবং ‘-গু’ সর্বনামের সঙ্গ ছাড়া সিলেটিতে টেকে না।
ক্লীব সর্বনামের সঙ্গে নিশ্চয়ার্থক পরসর্গ জুড়ে যে পদটি নির্মিত হয় তার পুরোটাই বিশেষ্যের পরে অনুপদের মতো জুড়ে সিলেটিতে বচন বোঝানোর রীতির কথাটি লিখে এসেছি।এটা বহুবচনেও হয়।যেমন--গাড়ি ইগুইন,বুড়া ইটাইন।এই ‘-ইন’ না জুড়লেই যৌগিক শব্দগুলো হয়ে যাবে এক বচনের।যেমন গাড়ি ইগু,বুড়া ইটা ইত্যাদি।এখানে এসেই মনে হয় সিলেটি এই ‘গু’ সর্গটির উৎস শুধুই ‘কুল’(> গুলি) নাও হতে পারে।তৎসম ‘গুটিকা’ বা ‘গোত্র’ হলেও হতে পারে।অথবা দুই উৎসই সিলেটিতে মিলেমিশে গেছে।কোথাও ‘গোটা’র পূর্বাংশ থেকে গেছে।যেমন---ইগু-ইগুইন।কোথাও ‘টা’ শেষাংশ।যেমন -ইটা,~ইতা।বহুবচনে –ইটাইন,ইতাইন।এই আরো একটি পরসর্গ বা মধ্যসর্গ রয়েছে ‘-তা’।এই প্রসঙ্গে পরে আসছি।তার আগে নোয়াখালি- চট্টগ্রামী নিয়ে কিছু কথা বলা যাক।‘গু,~গুইন̖, ~ন̖,~ইন̖’ সমস্যা আরো স্পষ্ট হবে।
এই দুই উপভাষাতে বচন বোঝাতে সুনির্দিষ্ট কোনো পরসর্গ আছে বলেই মনে করেন না রবীন্দ্র কুমার দত্ত।তিনি নিজের সমর্থনে গোপাল হালদারের একটি উক্তির উল্লেখ করেছেন,সেটি কিন্তু ক্লীব লিঙ্গ প্রসঙ্গেই,“How to form the plural of inanimate object is a problem.There is hardly any pure dialectical means for the purpose.”৫৯ দেখা যাক,আমরা কোনো সূত্র বের করতে পারি কিনা।সিলেটির মতো সর্বনাম ছাড়া নোয়াখালি –চট্টগ্রামীতেও ‘-রা’ নেই।‘-টা’ কখনো বা ব্যবহৃত হয়,কিন্তু ধ্বনি পরিবর্তিত হয়ে সেটি ‘-ডা’ হয়ে যায়।যেমন –এইডা।সেদিক থাকে সিলেটি বরং মান বাংলার কাছাকাছি,অসমিয়ারও বলা যেতে পারে।কিন্তু অধিকাংশ সময়েই ‘গোটা’ শব্দের ‘-গা’ অবশিষ্ট থাকে। নোয়াখালিতে যেমন--- এগ̖গা,ওগ̖গা,উগ̖গা < একটা,মাইয়াগা < মেয়েটা,কলমগা < কলমটা ইত্যাদি।অন্যদিকে চট্টগ্রামীতে ‘গোটা’র রূপান্তর হয় এই ক্রমে ‘গুয়া>গোয়া>উয়া> বা’।এবং এই সবক’টি রূপান্তরই চট্টগ্রামীতে ব্যবহৃত হয়। যেমন-ওগ̖গোয়া,ওউগ̖গোয়া,মাইয়াগোয়া,সাইরগোয়া < চারটা,উন্দুরগোয়া < ইঁদুরটা,তিন̖নুয়া < তিনটা,শতান̖নুয়া < শয়তানটা,লাডিবা < লাঠিটা,বাঁশিবা < বাঁশিটা ইত্যাদি।বহুবচনে আবার ‘গুলি’ সক্রিয় হয়ে ‘-গুন̖,~উন̖’ জুড়ে যায়।চট্টগ্রামীতে ‘-গু’ ধ্বনিটি এখানেও লোপ পায়।রবীন্দ্র কুমার দত্ত লিখেছেন,নোয়াখালিতে ‘উন̖’ ব্যবহৃত হয় কাছের জিনিস বোঝাতে।দূরের বোঝালে‘-গুন̖’।যেমন-গরুউন̖,গরুগুন̖। চট্টগ্রামীতে আবার ‘গরুউন’-এ বোঝায় দূরের গরু,কাছের বোঝালে হয় ‘গরু এইউন̖’।সিলেটির ‘গরু ইগুইন’-এর মতো মাঝে নির্দেশক সর্বনাম জুড়ে যাচ্ছে। ‘সবগুলো’-র সমার্থক ‘বেয়াগগিন/ ব্যেগগিন’(< বেবাকগুলো)-এর মতো দুই একটি শব্দে অবশ্য ‘-গু’-টি থাকে।গণনাতীত- গণনাসম্ভবেও নোয়াখালি চট্টগ্রামীতে পরসর্গের রূপভেদ হয়ে থাকে।গণনাতীতে ‘-গুন̖,~উন̖’-এর বদলে জুড়ে ‘-গিন̖, ~ইন̖’।যেমন--- গণনাসম্ভব গোটা মাছ বোঝাতে নোয়াখালিতে মাছ̖গুন,চট্টগ্রামীতে মাচ̖ছুন। কিন্তু গণনাতীত কাটামাছ নোয়াখালিতে মাছ̖গিন,চট্টগ্রামীতে মাচ̖ছিন।
কিন্তু নোয়াখালিতে ‘মানুশ̖গোরে,মাইনশের̖গো’ বহুবচনের এমনও রূপ আছে,যেগুলো দেখলে সহজেই মনে হতে পারে ‘-গুন̖’-এর শেষাংশ লোপ পেয়ে ‘-গো’ হয়ে গেছে।বিষয়টি সেরকম নয়।এই ‘-গো’ ‘–রা’-এর দূরগামী উপরূপ বললে কিছু অবাক লাগবারই কথা।কিন্তু সুনীতিকুমার সেরকমই লিখেছেন।৬০ বর্তমান প্রসঙ্গে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে আমরা বিস্তৃত যাচ্ছি না,একেবারে শেষের দিকে ‘তুমর্থ’ তথা অসমাপিকা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে সেই আলোচনাতে আবার ফিরে যাব।আপাতত এটুকুনই লেখা ভালো যে প্রাচীন ভারতীয় আর্য √কৃ থেকে একদিকে বাংলা কর্মকারকের‘-কে’,সিলেটি,নোয়াখালি ‘-রে’ আদি যেভাবে এসছে,সে ভাবেই অর্বাচীন বাংলা এবং সিলেটি,নোয়াখালি আদি ভাআষাবৈচিত্র্যের সম্বন্ধের ‘-র’- এর প্রাচীন বাংলা, এমন কি প্রত্ন বাংলা বিকল্প রূপ ছিল ‘-ক’।যেমন প্রাকৃতপৈঙ্গলে আছে,“ওগ্গর ভত্তা রম্ভঅ পত্তা/গাইক ঘিত্তা...”। হিন্দিতে এই ‘-ক’ ‘-কে,~কী’ হয়ে এখনো সম্বন্ধের অর্থ বহন করে। যেমন-- लोगों की,इंसान की,गाय का ইত্যাদি।সেই ‘-ক’ নোয়াখালিতে ‘-গো’ হয়েছে এবং ‘-গুন̖’-এর সঙ্গে মিলে মিশে একাধারে সম্বন্ধের এবং বহুবচনের অর্থ বোঝাতে শুরু করেছে বলেই মনে করবার সঙ্গত কারণ রয়েছে।‘মাইনশের̖গো’ পদে সম্বন্ধের পরসর্গ ‘-এর’ থাকবার পরেও,কিংবা ‘মানুশ̖গোরে’ পদটি কর্মকারকের অর্থ বহন করবার পরেও আমাদের তাই মনে হয়। শুধু ‘-গো’ থাকলে কিন্তু বহুবচনের সঙ্গে সম্বন্ধের অর্থই বহন করে। কারক প্রসঙ্গে তার কিছুটা স্পষ্ট হবে,বাকিটা একেবারে শেষের দিকে।
সিলেটিতে ‘-তা’ যেখানেই জুড়ে বহুবচনের অর্থ নিয়ে আসে।যেমন- ইতা,হিতা,কিতা,সাবুইতা ইত্যাদি।এই ‘-তা’ নিয়ে স্পষ্ট কোনো কথা আমরা কোত্থাও পাই নি।এর ব্যবহার প্রতিবেশী বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষাতেও আছে সিলেটির মতো প্রায় একই রকম।কখনো একক বদ্ধরূপিম,কখনো অনুপদে জুড়ে।যেমন--- ঠারহানরে ইজ্জু করিয়া ধরলে সিলেটী অতারেউ অ-বাঙালি বুলানি লাগের;কিন্তু এ তত্ত্ব এগো বহুত আগেই আধুনিক গবেষণাত গ্রহণ যোগ্য নায়া বাতিল অসে।৬১ এই দুই বাক্যে ‘সিলেটী অতারেউ’ (সিলেটিদেরে) বহুবচন,‘তত্ত্ব এগো’ (তত্ত্বটি) একবচন।সিলেটিতে লিখলে শব্দজোড়গুলো হবে ‘সিলেটি অতারেউ’,‘তত্ত্ব ইগু’।নিকট বোঝাতে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরিতে জুড়ে নিশ্চয়ার্থক ‘এগো-এতা’,দূর বোঝাতে ‘ঔগো,~উগো--,ঔতা,~উতা।’৬২ ‘অগো-অতা’ও যে রয়েছে উদ্ধৃত বাক্য সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।এই ‘-তা’-এর উৎস যে প্রাচীন ভারতীয় আর্য সেই নিয়ে সংশয় নেই।কিন্তু সুধাংশু শেখর তুঙ্গ যেভাবে ‘একতা (ঐক্য),বড়তা,সরুতা’ সব এক করে দেখেছেন,সেরকম মনে হয় নয়।সেরকম হলে সমতা,মমতা ইত্যাদি সব বিশেষ্য নির্মাতা পরসর্গের সংগে সিলেটি ‘একতা (সদৃশ),বড়তা,হরুতা’-কে এক করে দিতে হয়।সত্য বটে ‘হরুতা,বড়তা’-ও বিশেষণ থেকে বিশেষ্য হয়ে যায়, কিন্তু এগুলো আবার বহুবচনও বোঝায় যা ‘সমতা,মমতা’ বোঝায় না।এরকম ‘-তা’ যোগে ক্রিয়াবিশেষ্য তৈরির রীতি অসমিয়াতে রয়েছে। যেমন---খাওতা,দেখোতা ইত্যাদি।কিন্তু সেগুলোও বহুবচন বোঝায় না।সুধাংশু শেখর পরে আবার লিখেছেন,“This /ta/ may not come from the Sans. tā but is a new development from ṭā,a definite particle used widely in Bengali and Assamese.”৬৩এটা হওয়া অসম্ভব নয়।‘-তা’-কে দৃশ্যত মনে হয় ‘-টা’ এর পরিবর্তিত ধ্বনিরূপ।কিন্তু এর অর্থও পরিবর্তিত।তার থেকে সংস্কৃত ‘এতদ̖’-এর বহুবচনের থেকে আসা সম্ভব বলেই মনে হয়। এমনিতেও মান বাংলাতে ‘যত,তত,কত,এত’ আদি সর্বনাম রয়েছে। কিন্তু এগুলো সিলেটিতেও আছে।এবং ‘অনেকগুলো’ বোঝাতে মান বাংলাতে যদি ‘এতটা-ওতটা’ আছে,সিলেটিতে আছে ‘অতটা-অততা’।এই দ্বিতীয়টিতে আবার পরিমাণ একটু বেশিই বোঝায়।এর থেকে মনে হয় ‘তদ̖’-এর ক্লীব কিংবা পুংলিঙ্গের বহুবচনের রূপের অবশেষ এই ‘-তা’।এর ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার প্রসঙ্গ বাদ দিয়েও সিলেটির সমকালীন রূপ দেখলেও তাই মনে হয়।বিশেষ করে মান বাংলাতে ব্যক্তিনামের শেষে ‘-রা,-এরা’ যোগে যেখানে বহুবচনের রীতি আছে।সিলেটিতে ‘তারা’(ওরা,তাহারা) সর্বনামটি সরাসরিই অনুপদের মতো জুড়ে বহুবচন বোঝাচ্ছে।যেমন--ভাটির দেশ তারা ঘরো থাকইন পানিত থাকইন পথেঘাটে থাকইন(সু.গা.পা.:সাত)। সিলেটির সঙ্গে মান বাংলার এই তফাতের কথা জগন্নাথ চক্রবর্তী সঠিকভাবেই উল্লেখ করেছেন বলে মনে হয়।তাঁরই দেয়া কিছু উদাহরণ,যেমন--- মতি ও অন্যান্যরা—মতিতারা,রানি ও অন্যান্য মেয়েরা—রানিতারা।৬৪ এই ‘তারা’ জুড়ে যাবে কি স্বতন্ত্র থাকবে,সে বক্তার ইচ্ছেতে ঠিক হয়।তবে জুড়বার প্রবণতাই অধিক।এবং তাতে অন্য সব পদে ‘-রা’ অংশটি বাদ পড়ে যায় ভাববার সংগত কারণ আছে।‘মনিতারা,রানিতারা’ বিকল্পে ‘মনিইতা,রানিইতা’ হতেও কোনো অসুবিধে নেই। অর্থাৎ ‘-তা’(< তারা) আর আগে ‘-ই’ (~অ,~হি,~হ) নির্দেশক তথা ক্লীব সর্বনাম জুড়ছে।এই ‘-ইতা’-র (এসব) তখন ব্যবহার বৈচিত্র্য ব্যাপক।লিঙ্গ নিরপেক্ষ ভাবে নামপদের পড়ে জুড়ছে—যেমন মানুষ ইতা,পাখি ইতা,স্কুল ইতা,বই ইতা ইত্যাদি। ‘-ইতা,~অতা, ~ হতা,~হিতা’ নামপদের পুরোপদ অথবা পরপদ ---দু’ভাবেই জুড়ে বহুবচনের অর্থ বোঝায়।কখনো বা জোরটা বোঝাতে একই বাক্যে আগে পরে জুড়ে যায়। যেমন- ইতা পুলাইন ইতার মাত মাতিও না।পুলাইন ইতা,মানাইন ইতা—র পরে যখন আবার কারকের পরসর্গ জুড়ে তখন তখন পদটি সংকুচিত হয়ে দাঁড়ায় এরকম ---পুলাইন্তর,মামাইন্তে।জগন্নাথ চক্রবর্তী ‘মামাইন̖তে’ শব্দটি বহুবচনের রূপ বলে উল্লেখ করে ‘-ইনতে প্রত্যয়’ লিখেছেন।কিন্তু এতে আসলে তিনটি সর্গ মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে ‘-ইন̖-ত̖-এ’।শেষের ‘-এ’ আসলে কর্তৃ কারকের পরসর্গ এবং ‘-ত̖’-টি ‘-তা,~ইতা’-র অবশেষ।
মান অসমিয়াতে বহুবচন রূপে তিনটিই বদ্ধরূপিম যুক্ত হয়।‘-বোৰ̖,~বিলাক̖,~হঁত̖’।‘-বোৰ’ অবজ্ঞার্থে আর সম্মানার্থে ‘-বিলাক’ এবং সামান্য পরিমাণে ‘-হঁত’ ব্যবহৃত হয় বলে বাণীকান্ত লিখেছেন।৬৫গোলকচন্দ্রও সেরকমই লিখেছেন।৬৬আমাদের অধ্যয়ন বলে ‘-বিলাক’-ও সর্বত্র সম্মানার্থে ব্যবহৃত হয় না।তার বদলে মুক্ত রূপিম ‘সকল’ ব্যবহৃত হয়।‘আহোম বিলাক’ লেখার চাইতে ‘আহোম সকল’ বলা বা লেখাই বেশি সঙ্গত এবং সম্মানজনক।অন্যদিকে ‘-হঁত’ ক্লীব লিঙ্গে ব্যবহৃত হয় না,মানবেতর কোনো প্রাণীতে ব্যবহৃত হলে গালি দেয়া বোঝাবে।যেমন –গৰুহঁত।এই পরসর্গ আত্মীয়তা বোঝাতে বা জাতি,শ্রেণি,বৃত্তিধারী মানুষের বহুবচন বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,“...এই হঁত শব্দ রাজপুত হংদো শব্দের ন্যায় ভবন্ত বা সন্ত শব্দানুসারী,তাহা মনে করিবার একটা কারণ আছে।আসামিতে হঁওতা শব্দের অর্থ হওয়া।...বিলাক এবং বোর শব্দের উৎপত্তি নির্ণয় সুকঠিন।”৬৭বাকি দু’টির মধ্যে ‘-বিলাক’ যে অর্বাচীন পরসর্গ সেই কথা বাণীকান্ত এবং সুনীতি চট্টোপাধ্যায় দু’জনেই উল্লেখ করেছেন।৬৮১৮৪৬এ প্রকাশিত মাসিক ‘অরুণোদয়’ কাগজে এর ব্যবহার প্রথম দেখা যায় বলে লিখেছেন বাণীকান্ত কাকতি।সর্গটির উৎস অজানা-- লিখেছেন সুনীতিকুমার।কেউ কেউ বাংলা ‘-গুলা’,পশ্চিম অসমিয়া ‘-গিলাক’ থেকে সর্গটি এসছে বলে অনুমান করেছেন হয়তো।সুনীতিকুমার ‘-গি-’ > ‘-বি-’ হয়েছে ---এমনটা মানতেও পারেন নি।না মানতে পারবার আরেক যুক্তি হলো প্রাচীন অসমিয়াতেও ‘-গিলাক’ নেই।দেবানন্দ ভরালী তৎসম ‘ভিলোক’ থেকে আসতে পারে বলে লিখলে সুনীতিকুমার তাও নাকচ করেন।বাণীকান্ত কাকতিও দুটো উৎস সম্ভাবনার কথা বলে ছেড়ে দিয়েছেন।প্রথমটি তিনি লিখেছেন ‘ৱিশাল+বহুল’-এর মিশ্রণ হতে পারে।অথবা খাসি ভাষা ‘বাল্লাই’ থেকে আসতে পারে।‘-বোৰ’ শব্দের উৎস হিসেবে দেবানন্দ ভরালী তৎসম ‘ভুরি’ শব্দ অনুমান করলেও সুনীতিকুমার দুই সম্ভাবনার কথা লিখেছেন।প্রথমটি তৎসম ‘বহুল’,দ্বিতীয়টি কোনো তিব্বত বর্মী শব্দ। বডো বহুবচনের পরসর্গ ফ্রা>ফুর-এর উল্লেখ করেছেন। কিন্তু নিশ্চিত কিছু বলেন নি।বাণীকান্ত মনে করেন,প্রথমটি হওয়াই সম্ভব।সংস্কৃত √আহ̖ ধাতুই বাংলা ‘হইতে,হতে’ অব্যয়ের উৎস বলে সুনীতিকুমারের অভিমত।পূর্বী মাগধিতে এটি সম্বন্ধ এবং অপাদানের অর্থ বহন করত,অসমিয়াতে সেটিই বহুবচনের ‘-হঁত’ বলে তিনি অভিমত দিয়েছেন। বাণীকান্ত নামোল্লেখ না করেও রবীন্দ্রনাথ এবং সুনীতি চট্টোপাধ্যায় দু’জনকেই সমর্থন করে কিছু বিস্তৃত ব্যাখ্যা এগিয়ে দিয়েছেন,“-হঁত মূলতঃ কৃদন্ত শব্দ এটাই প্রথমে সম্পর্কবাচক প্রবণার্থী সর্গ হিচাপে কাম করি পাচত বহুবচনর সর্গ হোয়ার এ এটা উদাহরণ।”৬৯ তিনি আরো লিখেছেন,“প্রা.অস.র সন্ত (হন্ত) মারোয়াড়ী হন্দ,সিন্ধী সন্দো আরু কাশ্মীরী হন্দু-র সৈতে জড়িত যেন লাগে।”৭০নিশ্চিত করে তিনিও কিছু লেখেন নি।এতজন যখন একই কথা লিখছেন তখন ভরসাতো জাগেই।এর বেশি পরীক্ষা করাও আপাতত বাহুল্য।আমাদের যেটি বলবার ছিল, সে এই যে পরসর্গগুলো মূলে স্বাধীন শব্দ তথা মুক্ত রূপিম ছিল,এখন অসমিয়াতে বহুবচনের বদ্ধরূপিম।
বাংলাতে বহুবচনে অধিকাংশ সময় মূল শব্দটির কোনো রূপভেদ হয় না,আগে বচন বোধক পূর্ণ শব্দ যুক্ত হয়। যেমন অনেক ছেলে,অনেক বই,বহু মানুষ ইত্যাদি।অসমিয়াতেও আছে---অনেক ল’ৰা,বহুতো কিতাপ,বহু মানুহ,অগণন দর্শক।মোটের উপর বাংলার মতো একই।সিলেটিতে ---পারা মানু,অলা খিরা,যতো বিচি ইত্যাদি। চট্টগ্রামী,নোয়াখালিতেও রয়েছে এই রীতি।কখনোবা বহুত্বের বোধ বাড়াবার দরকার পড়লে এই সব সর্মনামের সঙ্গেই বহুবচনের নিশ্চয়ার্থক জুড়ে যায়।সে মান বাংলা,সিলেটি,চট্টগ্রামী সবেতে হয়।যেমন –অনেকগুলো লোক,বহুত্তা মানুষ,কতউন মানুশ̖,কদুন মানুশ ইত্যাদি।পরেও বচন বোধক শব্দ যোগ হয় এবং সেক্ষেত্রে দুই শব্দজুড়ে এক শব্দে পরিণত হয়।তবে সেগুলোর অধিকাংশই সংস্কৃত রীতি।তৎসম শব্দে যুক্ত হয়।যেমন শিল্পীবৃন্দ।তবে রবীন্দ্রনাথ এদের অনেককেই বহুবচনের চিহ্ন হিসেবে গ্রহণ করতে নারাজ,“গণ,দল,সমূহ,বৃন্দ,বর্গ,কুল,চয়,মালা,শ্রেণী,পঙক্তি প্রভৃতি শব্দযোগে বিশেষ্যপদ বহুত্ব অর্থ গ্রহণ করে।কিন্তু ইহা সংস্কৃত রীতি।এইজন্য অবিকৃত সংস্কৃত শব্দ ছাড়া অন্যত্র ইহার ব্যবহার নাই।বস্তুত ইহাদিগকে বহুবচনের চিহ্ন বলাই চলে না। কারণ ইহাদের সম্বন্ধেও বহুবচনের প্রয়োগ হইতে পারে—যেমন সৈন্যগণেরা,পদাতিক দলেরা ইত্যাদি।ইহারা সমষ্টিবোধক।”৭১তবে কিনা,“ইহাদের মধ্যে ‘গণ’ শব্দ প্রাকৃত বাংলার অন্তর্গত হইয়াছে।এইজন্যে ‘পদাতিকগণ’ এবং ‘পাইকগণ’দুই বলা চলে।কিন্তু ‘লাঠিয়ালবৃন্দ’ কলুকুল’ বা ‘আটচালাচয়’ বলা চলে না।”৭২ শুধু গণ নয়,‘পত্র’ শব্দযোগেও বাংলাতে প্রচুর বহুবচন শব্দ গড়া হয়।যেমন বিছানাপত্র,বইপত্র ইত্যাদি।মজাটি হচ্ছে এই শব্দদু’টিতে অনেকগুলো বিছানা,অনেকগুলো বই কিন্তু বোঝাচ্ছে না।বিছানা,বই এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র।বিছানার সঙ্গে পোশাক আসাকও বোঝাচ্ছে,তেমনি বইয়ের সঙ্গে পেন্সিল,কলম,স্কুলের টিফিনও বোঝাতে পারে।একক শব্দে নয়,সমগ্র বাক্যে শব্দটির অর্থ স্পষ্ট হবে। দুই একটি ব্যতিক্রম বাদে এই সংস্কৃতরীতি অসমিয়াতেও আছে।সিলেটিতে এই সব তৎসম অনুপদের ব্যবহার খুবই কম। ‘জনগণ’,‘বিছানাপত্র’ ইত্যাদি কিছুর প্রচলন আছে।‘-তা,~ইতা’ এদের সবাইকে প্রতিস্থাপিত করে দিয়েছে।কিছুতে আবার ‘ন̖,~ইন̖’ যোগে সিলেটি রূপান্তর ঘটে গেছে।যেমন--- তারে ক,আলি গেছাইন লইয়া আইত।৭৩তেমনি একটি অনুপদ সিলেটিতে খুব অল্পব্যবহৃত হলেও আছে ‘-গুরো’।যেমন- জামাইগুরো,কামলাগুরো,হগুরো ইত্যাদি।গুলো > গুরো অসম্ভব কিছু নয়।কিন্তু সিলেটিতে শরীর > শরিল তথা র > ল হবার নজির থাকলেও উলটো বেশি নেই।তাই মনে হয় এর উৎস অন্যত্র।গুলো+র,~এর—এই সংযোগও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না স্বরধ্বনি ‘ও’-এর জন্যে।থাকলে এই স্বরধ্বনি আরো দুই এক সমগোত্রীয় পরসর্গে থাকতে পারতো।তার থেকে এর উৎস আরবি ‘ৱগয়রহ’ শব্দে সন্ধান করা সুবিধের।এর হিন্দি রূপান্তর ‘गैर’।সিলেটিতে ‘গয়ের̖’ মুসলমান জনমানসেতো বটেই,গ্রামীণ কাছাড়েও ‘অপর, ভিন্ন’ অর্থে প্রচলিত।এর থেকে আসা সিলেটি ‘গয়রো’ শব্দের অর্থ আদি,ইত্যাদি,অনির্দিষ্ট ।৭৪
‘-সকল’ পরে যোগ করা বাংলাতে ভুল রীতি,অসমিয়াতে এই পরসর্গটি বাংলা ‘-গণ’-এর জায়গা দখল করেছে। ‘দেৱ-দৈত্যগণ,অপ্সৰা-গন্ধর্ভগণ’ প্রাচীন অসমিয়াতে থাকলেও অর্বাচীন অসমিয়াতে ‘জনগণ’ দুর্লভ,সুলভ শব্দটি হচ্ছে ‘ৰাইজসকল’।‘-পত্র’-এর দেখা অসমিয়াতে মেলে না।অন্যথা অসমিয়াতেও আছে ‘দ্বীপপুঞ্জ,নক্ষত্রৰাশি,ৰচনাৰাজি,গল্পগুচ্ছ,সুধীবৃন্দ,ছাত্রসমাজ’ ইত্যাদি বহুবচনের শব্দ বাংলার মতো প্রায়শ: একই। ‘পদাতিকদলেরা’র মতো অসমিয়াতেও রয়েছে ‘সৈন্যৰদলবিলাক’,‘গৰুৰ পালবোৰ’ ইত্যাদি। নোয়াখালি-চট্টগ্রামীতে এই রীতি নিয়ে আমরা নিশ্চিত নই।থাকাটাই সম্ভব।কিন্তু রবীন্দ্র কুমার দত্ত কিছু উল্লেখ করেন নি।
বাকি যেগুলো বচন বোঝাতে ব্যবহৃত হয় তার অনেকগুলোই মুক্ত রূপিম।মূল শব্দের সঙ্গে জুড়ে যায়,কিংবা আলাদা থাকে।আগে কিংবা পরেও জুড়ে।বাংলাতে যেমন এইসব শব্দে ---রুটিখানা,একখানি,একজন।সিলেটিতে ‘খান’ এবং ‘জন’ রয়েছে,‘খানি’ নেই।যেমন-রুটিখান,ইখান,একজন।নোয়াখালিতে ‘খান’,চট্টগ্রামীতে ‘গান,~আন’ হয়ে যায়।যেমন--- চাইরখান,চাইরগান;দুইখান,দুইয়ান।‘জনমানব’,‘খানিক’ শব্দগুলো দেখায় শব্দগুলোর স্বাধীন ব্যবহারও আছে।আর চাইরখান, দুইয়ান—শব্দ দেখায় পরসর্গগুলো যতনা বচন বোঝায়,তারচে বেশি নিশ্চয়ার্থ।বচন নির্বিশেষে ব্যবহৃত হয়।অসমিয়াতে এই সব পরসর্গের বৈচিত্র্য বাংলা এবং বাংলার ভাষাবৈচিত্র্যগুলোর থেকে বেশি।একবচনে ক্লীব লিঙ্গে ‘-খন’ পুংলিঙ্গে ‘~জন’,স্ত্রী লিঙ্গে ‘~জনী’ যুক্ত হয় বলে বলা হয়ে থাকে।এগুলো সবই মুক্ত রূপিম এবং নিশ্চয়ার্থক পরসর্গ হিসেবে পূর্বাংশের সঙ্গে জুড়ে যায়।এর মধ্যে ‘-জনী’ যদিও বা মানবেতর প্রাণীতেও ব্যবহৃত হয়,‘-জন’ হয় না।যেমন কিতাপখন,শিক্ষকজন, গৰুজনী।‘-খন’এর সঙ্গে ‘-ই’ যোগ করে আকারে ছোট বস্তুকে বোঝানো হয়।তেমনি আরেকটি সর্গজোড় আছে ‘-কণ, -কণি’।যেমন পোৱালিকণ,পোৱালিকণি।‘-কণি’ জুড়লে শুধু আকারে ছোট নয়,আদরেও বেশি বোঝায়।সিলেটিতে ‘জন’ আছে, ‘জনী’ নেই,মান বাংলার মতো ‘খানা-খানি’ নেই---আছে শুধুই ‘-খান’। যেমন--- পইঞ্চাশ টেকার নুটখান ছিঁড়া।
রবীন্দ্রনাথ বাংলার সম্পর্কে লিখেছিলেন,ভঙ্গীপ্রধান ভাষা।অসমিয়ার সম্পর্কে বলা যেতে পারে ‘শৈলী প্রধান ভাষা’। বাংলাতে ‘মালা দিয়ে দাও।’ বললে কাজ চলে যায়।প্রেক্ষিত অনুযায়ী শ্রোতা বোঝে নেবেন,একটা না দশটা মালা দিতে হবে। আরেকটু স্পষ্ট করে ‘মালাটা দিয়ে দাও’ বললে তো কোনো সমস্যাই নেই।কিন্তু সুন্দর করে বলবার আরেকটি রীতি আছে ‘মালাগাছি দিয়ে দাও’।এবারে,এই রীতিও বাংলাতে খুব কম।অসমিয়াতে ব্যাপক।সংখ্যাতে কুড়িটিরও বেশি হবে বলে লীলাবতী শইকীয়া বরা উল্লেখ করেছেন।৭৫ব্যক্তি,বস্তু বা জাতির প্রকৃতি অনুযায়ী এমন মুক্তরূপিম একবচনে জুড়ে গিয়ে ভাষার বৈচিত্র্য তথা সৌন্দর্য বাড়িয়েছে বেশ।‘-জন,~জনী’ ছাড়াও ‘-গৰাকী’ স্ত্রী-পুংলিঙ্গ নির্বিশেষে সম্ভ্রমার্থে ব্যবহৃত হয় আমরা আগেই লিখেছি।সেরকমই আরো কিছু এরকম:
-খৰঃ সাপখৰ, জৰিখৰ।পশ্চিম অসমের ভাষাবৈচিত্র্যে এই পরসর্গ ব্যবহৃত হয়।
-ডাল,~ডালি: সাপডাল,জরিডাল।
-গছ,~গছি : ডোলগছ।
-চটা,~চটি,~ছিটা: বাঁহ চটা,কাঠচটা।
-ডোখৰ : কাঠডোখৰ।
-পাট: বোঠাপাট।
-মখা : ল’ৰামখা।
-খিলা: কাগজখিলা।
-ধাৰ : মণীধাৰ।
-পদ: এপদ বস্তু।
-দলি: দোৱাৰদলি।
সেরকমই কিছু গণনাতীত বিশেষ্যে পরিমাণে অতি সামান্য বোঝাবার পরসর্গ আছে।এগুলোকেই আমরা ‘অনিশ্চয়ার্থক’ পরসর্গ বলছি,কেননা পরিমাণটা ঠিক কতখানি সুস্পষ্ট বোঝানো কঠিন।
-ফেৰা : লোণফেৰা,গুৰফেৰা।
-টাঁৰ,~টাঁৰি : চুলিটাঁৰ।
-কোছা : চুলিকোছা।
-ষাৰ : কথাষাৰ।
-সাজ: ভাতসাজ, এসাজ।
কিছু পরসর্গ আবার ‘গণনাতীত’ এবং ‘গণনাসম্ভব’ দুই ধরণের বিশেষ্যের পরেই যুক্ত হয়।
-জাক : গৰুজাক,চৰাইজাক।
-সোপা : ভাতসোপা,কাপোৰসোপা।
বাংলাতে এসব ক্ষেত্রে ‘তিল,চিমটে’ ইত্যাদি মুক্তরূপিম আগে বা পরে স্বতন্ত্র শব্দ হিসেবেই যুক্ত হয়।যেমন ‘তিল ঠাইঁ আর নাহি রে।’‘ঝাঁক,গোচ্ছা,আঁটি,গ্রাস’ ইত্যাদি সমষ্টিবোধক শব্দ গণনাতীত বিশেষ্যের আগে বা পরে জুড়ে বহুত্বের ধারণা দেয়া হয়।তবে পরে যুক্ত হলে মূল শব্দে সম্বন্ধের পরসর্গ ‘-র’ যোগ করে নিয়ে শব্দগুলো বসানো হয়। এবং দুই শব্দে সমাস হয় না। যেমন ‘পাখির ঝাঁক,চাবির গোচ্ছা,ধানের আঁটি,ভাতের গ্রাস’ ইত্যাদি।কিন্তু যদি মূল শব্দের আগে বসে তবে তার নিয়ম অন্যরকম,সবার আগে একটি সংখ্যা-শব্দ তারপরে এই নিশ্চয়ার্থক মুক্ত রূপিম ‘ঝাঁক,গোচ্ছা,আঁটি, গ্রাস’ এবং সবার শেষে মূল শব্দ বসানো হয়।মোটের উপর বহুত্ববাচক একটি বাক্যাংশই তৈরি করে ফেলা হয়।যেমন,‘দুই ঝাঁক পাখি,এক গোচ্ছা চাবি,চার আঁটি ধান,দুই গ্রাস ভাত।’৭৬সিলেটি রীতিও একই রকম কিছু শব্দ শুধু ভিন্ন--- পাল,দল,ভাইশ, গুছা,ঝুমটা,ঝামটা,ছুবা,থুব ইত্যাদি।৭৭যেমন –পনার ভাইশ দেখিয়া খেও মারিছ;বালির থুব টুকতি দিব। চৌদ্দ পুড়া পিঠা খাইল বৌয়ে কুলা আউড় দিয়া।
‘সকল’ ‘সব’ দুটি বহুল ব্যবহৃত বচন বোধক শব্দ।এগুলো বিশেষ্যের আগে বসে।‘সকল’ শব্দটি পরে বসিয়ে ‘ভাইসকল’,‘লোকসকল’ অসমিয়াতে প্রচলিত হলেও বাংলাতে ভালো শোনায় না।সে রবীন্দ্রনাথই লিখে গেছেন,“বাংলা ভাষার প্রকৃতিবিরুদ্ধ এইরূপ প্রয়োগ সম্ভবত আধুনিককালে গদ্যরচনা সৃষ্টির সময়ে প্রবর্তিত হইয়াছে।”৭৮কিন্তু ‘সকল’ ব্যবহারের অসমিয়া রীতিটি সিলেট,কুমিল্লা,নোয়াখালি পার করে চট্টগ্রামীতে ব্যাপক।সকল সেখানে ‘-হল̖,~অল̖’।রবীন্দ্র কুমার দত্তের উচ্চারণ সংকেত দিয়ে লিখে দেখালে,‘-হ:ল̖,~অ́ল̖’।যেমন---মানুশ̖হল̖,মানুশ̖অল̖।‘সব’ শব্দ নিয়ে বাংলাতে দুটি বিখ্যাত পদ্য পঙক্তি আমাদের মনে পড়ে,‘পাখি সব করে রব’ এবং ‘সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী;ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন’।কালের দিক থেকেও প্রথম পঙক্তিটির বয়স বেশি,দ্বিতীয়টি একালের। এখন ‘সব’ শব্দও আগে ব্যবহারই রীতি।পরে ব্যবহার করলে মূল শব্দে বহুবচনের পরসর্গ ‘রা,~গুলো’ যুক্ত হয়। যেমন ছেলেরা সব,টেবিলগুলো সব ইত্যাদি।‘সব’ নিয়ে অসমিয়া রীতিও বাংলার মতো একই। যেমন সব̖ ছোৱালী,ছোৱালীবোৰ সব̖।সিলেটিতে ‘হকল’ (<সকল) কখনো বা পরে বসে যতনা বহুবচন বোঝাতে তারচে বেশি সম্বোধনে আদর বোঝাতে। ‘সব’ নিয়ে সিলেটি রীতিও মান বাংলা-অসমিয়ার মতো একই। যেমন--আর ই পাচালিত দেখছ নি মজার মজার সব মানুষ আর তারার গপ (সু.গা.পা: ষোল) একই শব্দ দুবার বলে,সমার্থক শব্দজুড়েও বাংলাতে বহুবচন বোঝানো হয়।যেমন-- বস্তাবস্তা,লোকজন ইত্যাদি। ‘ট’ধ্বনিতে তৈরি অনুকার শব্দেও বাংলা বহুবচন বোঝানো যায়।যেমন জিনিসটিনিস,ঘোড়াটোড়া।এগুলো ইত্যাদি অর্থও বোঝায়।৭৯সিলেটিতেও এই রীতি ব্যাপক।অসমিয়াতে সমার্থক শব্দজুড়ে বহুবচন হয় না,কিন্তু বাকিগুলো আছে।এবং বাংলার থেকে খানিক বেশিই আছে।যেমন –‘গছে গছে পাতি দিছে ফুলৰে শৰাই...’।‘ট/ত’ ধ্বনিতে তৈরি অনুকার শব্দে বহুবচনও হয়।যেমন –চাউল- তাউল,বিছা-তিছা।‘চ’-তেও তৈরি হয় বহুবচন।যেমন ভাত-চাত,টেবুল-চেবুল,মাছ-চাছ।শব্দ দিত্বে বহুবচন সিলেটি,নোয়াখালি চট্টগ্রামী সহ পুববাংলার ভাষাবৈচিত্র্যগুলোতেও ব্যাপক।সিলেটিতে যেমন---চুরে চুরে আলি,এক চুরে বিয়া করে আরেক চুরর হালি।‘ট’ ধ্বনিতে অনুকার শব্দে বহুবচন তৈরির রীতি মান বাংলার মতো সিলেটিতেও রয়েছে।কিন্তু সিলেটিতে জিনিস-উনিস,ঘোড়া-উড়া–ই মানায় ভালো।তার মানে ‘ট’-কে প্রতিস্থাপিত করে ‘উ’।তেমনি অসমিয়ার মতো ‘চ’-তেও হয়।তবে তাতে কিছুটা তাচ্ছিল্যও প্রকাশ পায়।যেমন বেগ-চেগ,বের –চের,পাততা-চাততা,নাতি -চাতি।
রূপবৈচিত্র্য বেশি নজরে পড়ে সর্বনামের ক্ষেত্রে।মান বাংলাতে সর্বনামে বচন বোঝাতে বাংলা ‘টা,~টি’ এবং ‘রা,~গুলো’-র বিকল্প নেই বললেই চলে।যেমন আমি–আমরা,তুমি –তোমরা,এটি-এগুলো ইত্যাদি।অসমিয়াতে ‘টো,~টি’ এবং ‘-বোৰ,~বিলাক,~হঁত’-ই ব্যবহৃত হয়।শুধু উত্তম পুরুষে ভিন্ন শব্দ আছে ‘মই,আমি’।আর বহুবচনে ‘-লোক’-এর ব্যবহারও কম নয়।যেমন ‘তুমি-তুমিবোৰ/তোমাবিলাক/তোমালোক’,‘এইটো—এইবোৰ’।সিলেটিতে ‘-রা’ শুধু মানুষ অর্থে সর্বনামেই যুক্ত হয়।একবচনে ‘-গু’ এবং বহুবচনে ‘-গুইন’ জোড়ে মানুষের বেলা তুচ্ছার্থে,অন্য সব ক্লীব সর্বনামে।সর্বনাম ছাড়া এদের অস্তিত্ব নেই।যেমন ---আমরা,তুমরা,তারা,হেরা,ইগুইন।মান বাংলার মতো ব্যক্তি-জাতি-প্রাণীবাচক অন্য বিশেষ্যে জুড়ে ‘মানুষেরা,রামেরা,পাখিরা’ করবার রীতি নেই।‘টা-তা’ নিশ্চয়ার্থক সর্বনামে জুড়ে আমরা দেখিয়ে এলাম।এমন কি ওজনে,সংখ্যাতে বা দূরত্বের পরিমাণে কম বেশি বোঝালে ‘-টা’ কখনো বহুত্ব বোঝাতেও ব্যবহৃত হয় যে না তা নয়,কখনো আবার পরে ‘-ইন̖’ জুড়ে দিয়ে বহুত্বকে আরো স্পষ্ট করে নেয়।যেমন অতোটা-অতোতা,ইটাইন-ইতাইন।‘-ইন̖’ যে ঠিক কই জুড়বে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।কাঙ্ক্ষিত অর্থই শুধু সেই নিশ্চয়তা নির্ধারণ করে।আমরা ‘পুলাইন ইতা’র কথা লিখে এসছি, কিছু সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্যে ‘পুলা ইতাইন’-ও দুর্লভ নয়।নোয়াখালি-চট্টগ্রামীতেও ‘-রা’ সর্বনামেই জোড়ে।যেমন –আঁ:রা, তোঁ:রা,আমনেরা,হিতাইনেরা ইত্যাদি।‘-গুন̖,~উ̖ন’সম্পর্কেও রীতি সিলেটির মতো একই।নোয়াখালিতে এগুন̖,এগিন̖, চট্টগ্রামীতে ইউন̖,ইইঁন̖ ইত্যাদি।
বাংলাতে বস্তু,জাতি বা সমষ্টিবাচক বিশেষ্য এমনিতেই বহুবচনের অর্থ বহন করে।যেমন --মানুষ যায়,পাখি ডাকে এরকম বাক্যে মানুষ এবং পাখি বহুবচন।ফলে তাদের একবচনের নিশ্চয়ার্থক পরসর্গ ‘টি,~টা’ যোগ করবার দরকার পড়ে। যেমন-মানুষটি যায়,পাখিটি ডাকে।তবে বহু সময় মানুষগুলো যায়,পাখিগুলো ডাকছে---এমন ব্যবহারও বাংলা বাক্যে দেখা যায়।অর্থাৎ সব মানুষ যায় না,সব পাখিও ডাকে না।কিছু বিশেষ মানুষ কিংবা পাখি কাজটি করছে।এভাবে নিশ্চয়ার্থে বহুবচন বোঝাতে সাধারণত প্রাণীবাচক বিশেষ্য বা সর্বনামের শেষে ‘-রা’,অপ্রাণীবাচক শব্দের শেষে ‘-গুলা,~গুলো,~গুনো’ ব্যবহৃত হয়।তবে লোকগুলো,মেয়েগুলো এসব যদিও বা চলে নৌকারা,টেবিলেরা চলবে না।‘এগুলো’ বললে বাংলাতে বিশেষ বস্তু সমষ্টিকেই বোঝাবে,‘এরা’ বললে বোঝাবে কিছু মানুষের কথা হচ্ছে।আমরা আগেই লিখেছি ‘-গুলো’র ব্যবহার বিস্তৃতি অনেক বেশি।গোলকচন্দ্র গোস্বামী এইসব ‘বস্তু,জাতি বা সমষ্টিবাচক বিশেষ্য’ –কে বচন নিরপেক্ষ পদ বলেছেন।৮০ লীলাবতী শইকীয়া বরাও একে সমর্থন করে লেখেন,“...এই দৃষ্টিভঙ্গীরে অসমীয়া ভাষাতো বচনর তিনিটা রূপ: একবচন,বহুবচন আরু বচনহীন নিরপেক্ষ রূপ।”৮১কিন্তু দু’জনেই এই ‘পদ’গুলোর আলোচনা করতে গিয়ে একবচনে ‘মানুহজন,গছজোপা,হাতীটো’ ইত্যাদি এবং বহুবচনে ‘মহিলাসকল,ভকতসকল,সমজুৱাসকল,গৰুজাক’ ইত্যাদি প্রচুর নজির দিয়েছেন।তার মানে এইসব শব্দেরও বচন বোঝাতে পরসর্গের দরকার পড়ে।আর সেই পরসর্গগুলো হয় একবচনের নতুবা বহুবচনের।সুতরাং পরসর্গের বিচারে অসমিয়াতেও দু’টিই বচন।এরকম ‘বচন নিরপেক্ষ’ শব্দ নিয়ে জগন্নাথ চক্রবর্তীও সমস্যাতে পড়েছিলেন।তিনি ‘মানে কইন,হিয়ালে ডাকের,মাছে খাইছে’ ইত্যাদি নজির দিয়ে লিখেছেন,“বিশেষ্য –কর্তার এক বচনে ‘এ’ ও ‘য়’ যুক্ত হয়।”৮২ এই কর্তার একটিও কি একবচন বলে মনে হয়?এগুলো তো জাতিবাচক বিশেষ্য।এবং ‘-এ’ যোগ করবার পরেও বোঝা যাচ্ছে না যে ‘কইন,ডাকের,খাইছে’ কাজটা একজনেই মাত্র করছে বা করে থাকে।এই ‘-এ’ কর্তৃকারকের পরসর্গ।এর সঙ্গে অসমিয়ার মিল আছে,আমরা পরে দেখাব।এই পরসর্গ ছাড়াও তিনি কিছু ব্যতিক্রমের নজির দিয়েছেন,“মাছ উজার,হিয়াল ভাগছে,কুটু যাইত।’ এগুলোতেও শেষেরটি বাদ দিলে একবচন বোঝাচ্ছে না।অর্থাৎ এগুলো কোনো পরসর্গ ছাড়াই এক বচন বা বহুবচন বুঝিয়ে থাকে।“এরূপ ক্ষেত্রে বাক্যের অর্থ ধরিয়া একবচন অথবা বহুবচন বুঝিতে হয়”সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের এই কথাটি উদ্ধৃত করে রবীন্দ্র কুমার দত্ত লিখেছেন,“নোয়াখালি ও চট্টগ্রামী উপভাষার বচন সম্পর্কেও কথাটা সত্য।”৮৩তাও সুনির্দিষ্ট করে বোঝাতে ‘-টা,-ইগু,~ওগু’ এবং ‘-ন̖,~ইন̖,-অতা,~ইতা,-গুইন’ এর বিচিত্র মিশ্রণের কোনো বিকল্প নেই।
মান বাংলাতে ‘দের/দিগের’ বলে বলে একটি ধ্বনিগুচ্ছ বহুবচনে ব্যবহৃত হয়।সেটি যদিও বহুল ব্যবহৃত,তবু সামান্য সমস্যা সংকুল।চলিত মান বাংলাতে যেমন,আমাদের,রামদের,রামেদের;সাধুবাংলাতে –আমাদিগের,রামদিগের ইত্যাদি। এগুলোও রূপিম সমাহার,একক রূপিম নয়।একেবারে শেষে যুক্ত ‘-র,~~এর’ আসলে সম্বন্ধ কারকের অর্থবহন করে।সম্বন্ধ কারকে বহুবচনের অর্থ বোঝাতে গিয়ে মধ্যসর্গ ‘দ’ যুক্ত হয় এই মাত্র।এবং পূর্বাংশটি হলন্ত না হলে তার আগে ‘আ,~এ’ মধ্যসর্গও জুড়ে যায়।ব্যাকরণে একে বিকিরণও বলে,অর্থাৎ প্রাতিপদিক নির্মাতা(stem formative)।অবশ্য অন্যভাবে এমনটাও লেখা চলে যে ‘দের/দিগের’ সম্বন্ধ এবং বহুবচনের মিশ্র প্রত্যয়।কিন্তু ভাষাবিজ্ঞান তো বটেই,ইতিহাসের বিচারেও ‘দ’ মধ্যসর্গটি এককভাবেই আসলে বহুবচনবোধক।এর উৎস প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলাতে বহুব্যবহৃত একটি বহুবচনবোধক অব্যয় ‘আদি’।৮৪কাশীদাসী মহাভারতে যেমন ছিল,“দ্রোণ গুরু আদি যত সুহৃদ সুজন।/সংহার করিনু আমি,রাজ্যের কারণ।।” সাধুবাংলাতে পার্শি অর্থে ‘দিগর’ শব্দের সঙ্গে পড়েও কিছু বিভ্রান্তি হয়েছিল।কিন্তু এখনো বিভ্রান্তি পুরো কাটে নি।বহুসময় ঐ সম্বন্ধের ‘-র,~~এর’ মিশ্রিতরূপটিকেই বহুবচনের প্রত্যয় বা পরসর্গ ভেবে নিয়ে তার পরে জোড়া হয় কর্মকারকের পরসর্গ ‘–কে’।যেমন-আমাদেরকে,তোমাদিগকে ইত্যাদি।প্রাচীন অসমিয়াতেও ছিল ‘আদি’ পরে √কৰ ধাতু জাত ‘কৰি’ অসমাপিকাটি নিয়ে ---ব্ৰহ্মা আদি কৰি জীৱ য'ত ৰাম ৰাম ৰাম ৰাম ৰাম/মায়া-শয্যা মাজে আছয় ঘুমটি যাই।অর্বাচীন অসমিয়াতেও শব্দজোড়টি একই অর্থে রয়েছে।যেমন--তাৰ লগতে বাতৰি-কাকতকে আদি কৰি বিভিন্ন ধৰণে তেওঁলোকে Free Basics ৰ প্ৰচাৰ অভিযান চলাইছে। এর প্রতিশব্দে অসমিয়াতে ‘প্রমুখ্যে’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।ক্রমান্বয়ে একাধিক নাম না নিয়ে এই শব্দটি ব্যবহার করে বোঝানো হয় -- আরো অনেকে আছেন।বাংলাতেও একই রকম ব্যবহৃত হয় ‘প্রমুখ’।সিলেটিতে এই ‘-দ’ নেই।সোজা আরেকখানা ‘-র,~অর’ জুড়ে দিলেই কাজ চলে যায়।যেমন- পুলা ইতার,বেটিন্তর,কামলা হিগুইন্তর,মনি তারার ইত্যাদি।‘সুরমা গাঙর পানি’তে আছে---ইতা কিতা কও,কত মানুষ তারার।সব গাউউতো তারার (সু.গা.পা: সতেরো)।বাংলা,অসমিয়া দুই ভাষাতেই বিশেষণের সেভাবে রূপভেদ হয় না।সিলেটিতেও তাই।নোয়াখালি,চট্টগ্রামী সহ অন্যান্য ভাষাবৈচিত্র্যগুলোতেও প্রক্রিয়াটি একই।একই রূপ বিশেষ্যের একবচন বহুবচনরূপের সঙ্গে জুড়ে।যেমন -- ভালো ছেলে –ভালো ছেলেরা;ভাল ল’ৰা- ভাল ল’ৰাবোৰ;বা’লা পুলা—বা’লা পুলাইন।কথা বলতে গিয়ে কখনোবা বিশেষ্য শব্দের উল্লেখ না করে পরসর্গগুলো বিশেষণের সঙ্গেই জুড়ে দেয়া হয়।যেমন ভালোগুলো,ভালবোৰ,বা’লাতা,বা’লাইতা।তখন আর এই শব্দগুলো বিশেষণ থাকেনা,বিশেষ্যতে পদান্তর ঘটে যায় এবং সেগুলোর সঙ্গে কারকের পরসর্গ যোগ করেও বাক্য গঠন সম্ভব হয়।যেমন –বাংলা: ভালোগুলোকে রেখে বাকি সব ফেলে দাও।অসমিয়া: -- মানুহৰ বেয়া বৃত্তিবোৰ কৰ্ষণ নকৰাকৈ আপোনা-আপুনি ফুঁটি ওলায়, কিন্তু ভালবোৰ জ্ঞান বুদ্ধি থিৰ হ'লেহে দেখা দিয়ে।(সারথী:সত্যনাথ বরা;পৃ:২১)। সিলেটি---বা’লাতা রাখিয়া বাকিতা পা’লাই দেও।বহু সময় বিশেষণেরও দ্বিত্ব করে বহুবচন বোঝানো হয়।বিশেষণের দ্বিত্ব হলে বিশেষ্য অপরিবর্তিত রাখলেও চলে।যেমন-- ভালো ভালো ছেলে;পাকা পাকা কথা; ইত্যাদি।অসমিয়াতে ‘বৰ বৰ মানুহৰ দোলা...’।
কারক:
‘ক্রিয়ান্বয়ী কারকম’ সংস্কৃতের এই সংজ্ঞাটি বাংলাতে প্রযোজ্য হবে কিনা,সেই তর্ক এখন প্রাচীন হয়ে গেছে।ক্রিয়ার সঙ্গে বাক্যে ব্যবহৃত নাম পদগুলোর সম্পর্ক তথা ‘কারক’ বোঝাতে গিয়ে যখনই বিভক্তির কথা আসে তখনই সম্বন্ধ আর সম্বোধনের কথাও পাড়া হয় বাংলা ব্যাকরণে,যেগুলোর কিনা ক্রিয়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্কই নেই।তার উপরে সম্প্রদান বলে এমন একখানা কারক রেখে দেয়া হয়েছে যেটি কিনা আসলে গৌণকর্ম বললেই চলে।রাখার কারণটিও ‘ক্রিয়ান্বয়ী কারকম’ সংজ্ঞা মেনে নয়,বলা হয়ে থাকে মালিকানা ছেড়ে কোনো কিছু দেয়া বোঝালে সম্প্রদান কারক হয়।এই নিয়ে শতাব্দীকাল আগেই রবীন্দ্রনাথ বেশ রসিকতা করেছিলেন,“‘তাহাকে দিলাম’ যদি সম্প্রদান-কারকের কোঠায় পড়ে,তবে ‘তাহাকে মারিলাম’ সন্তাড়ন-কারক;‘ছেলেকে কোলে লইলাম’ সংলালন-কারক;‘সন্দেশ খাইলাম’ সম্ভোজন-কারক;‘মাথা নাড়িলাম’ সঞ্চালন-কারক এবং এক বাংলা কর্ম-কারকের গর্ভ হইতে এমন সহস্র সঙের সৃষ্টি হইতে পারে।”৮৫সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ও এই কারকের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রাখার দরকার নেই বলে মত দিয়েছেন।এই সব দেখে কারকের বদলে ইংরেজি case-এর অনুবাদে বাংলাতে ‘প্রপাত’ প্রস্তাব করেন প্রবাল দাশগুপ্ত।৮৬এরই বিপরীত শব্দ সংস্কৃত ব্যাকরণের ‘নিপাত’। মানে ‘অব্যয়’—যার কোনো রূপভেদ হয় না।সুকুমার সেন অবশ্য সমস্ত বাংলা পদেরই দুটি ভাগ করেছিলেন এরকম—রূপগ্রহ এবং অরূপগ্রহ।৮৭ বাংলা কারকের সব পরসর্গ তথা বিভক্তিকে ‘কেতের̖’ ---এই ধ্বনিগুচ্ছে বেঁধে ফেলা যায়। এর জন্যে সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুসরণে যদিও বাংলা কারকের বিভক্তিকে কর্তৃ,কর্ম,সম্প্রদান,করণ,অপাদান,সম্বন্ধ,অধিকরণ কারকের এই ক্রম অনুসারে প্রথমা,দ্বিতীয়া,তৃতীয়া,চতুর্থী,পঞ্চমী,ষষ্ঠী,সপ্তমী এই ক’টি সংখ্যা শব্দ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে,বাস্তবে এগুলোকে বাহুল্য বলেও মনে হয়।বিশেষ করে প্রথমাতে বিভক্তি কিছু নেই,আর পঞ্চমীতে বিভক্তি নয়-- মূল শব্দের পরে পূর্ণ অব্যয় শব্দ তথা পরপদ দিয়ে অপাদান কারকের অর্থ নির্দেশ করা হয়।
বাংলাতে সম্বোধন এবং কর্তৃকারক এবং মুখ্য কর্মে সাধারণত কোনো পরসর্গ যুক্ত হয় না।গৌণকর্মে এবং সম্প্রদানে ‘-কে’ যুক্ত হয়।যেমন,মা, আমি কিন্তু বোনকে আম দেব।এই বাক্যে মোটা হরফের প্রথম,দ্বিতীয় এবং চতুর্থ শব্দ তিনটি সম্বোধন,কর্তৃ এবং মুখ্য কর্ম বোঝাচ্ছে,কিন্তু কোনো পরসর্গ বা বিভক্তি জোড়ে নি।একে পরম্পরাগত ব্যাকরণে শূন্যবিভক্তিও বলে। তৃতীয় শব্দটি গৌণকর্ম।সম্প্রদান বললেও চলে।কারণ,আমটি ঘুরিয়ে পাবার জন্যে দেবে না বোঝাই যাচ্ছে।
করণ–অধিকরণে ‘এ,~তে’,সম্বন্ধে ‘র̖,~এর̖’ যুক্ত হয়।সংক্ষেপে শব্দ স্বরান্ত হলে করণে অধিকরণে ‘-তে’ এবং সম্বন্ধে ‘-র’ যুক্ত হয়।যেমন-- করণ কারক---এই টাকাতে সংসার চলে?অধিকরণ--- ডিফুতে যাবো ভেবেছি।আটটাতে এসো।সম্বন্ধ--- তুমি মেয়ের জামা এনো।শব্দ ব্যঞ্জনান্ত তথা হলন্ত হলে করণে-অধিকরণে ‘-এ’ এবং সম্বন্ধে ‘-এর’।যেমন-- করণ কারক এই কলমে লেখে ভালো।অধিকরণ কারক---শিলচরে যেতে কতটা সময় নেয়? বিকেলে যাব।সম্বন্ধ ‘একের লাঠি দশের বোঝা।
তবে অধিকাংশ সময়েই বাংলা কারকে বিভক্তি জোড়ার কোনো বাঁধা ধরা নিয়ম নেই।এক কারকে অন্যের বিভক্তি আকছার ব্যবহৃত হয়।ব্যাকরণে একে বিভক্তির তির্যক প্রয়োগ বলে।
যেমন:
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে। (কর্তৃকারকে ‘-তে’ তথা সপ্তমী )
আমায় দুটো ভাত দাও। (কর্মকারকে ‘-এ’ তথা সপ্তমী )
একটা চড় মারবো,বলে দিচ্ছি। (করণে শূন্য তথা প্রথমা)
অন্ধজনে দেহ আলো। ( সম্প্রদানে ‘-এ’ তথা সপ্তমী)
বাবাকে বড় ভয় করে। (অপাদানে ‘-কে’ তথা দ্বিতীয়া)
মাইনে বাবদ কটাই বা টাকা। (সম্বন্ধে শূন্য তথা প্রথমা )
শিলচর যাচ্ছি। (অধিকরণে শূন্য তথা প্রথমা)
এই সব পরসর্গ ছাড়াও ‘জন্য’ ইত্যাদি দিয়ে কর্মকারক,তৎসম ‘দ্বারা’,তদ্ভব ‘দিয়ে’ কিংবা সমার্থক অব্যয় দিয়ে বাংলা করণ কারক,‘থেকে’ শব্দের সমার্থক অব্যয় দিয়ে অপাদান কারক,এবং ‘মাঝে’ ইত্যাদি দিয়ে অধিকরণ বোঝানো হয়ে থাকে। সেগুলোরও তির্যক প্রয়োগ হয়ে থাকে।যেমন--- কর্মে--- মেয়ের জন্য বই এনেছি।অপাদানে -- চোখ দিয়ে জল পড়ছে।কিংবা করণে-- ও আম থেকে ভালো আচার হবে না।এরকম পরপদ যোগ হলে পূর্বাংশে প্রায়শ: সম্বন্ধের ‘-র̖,~এর̖’ যুক্ত হয়।যেমন: তোমার দ্বারা কাজটি হবে না।অথবা---তোমাকে দিয়ে কাজটি হবে না।
বাংলার মতো অসমিয়াতেও পরম্পরাগত ব্যাকরণে কারক এবং বিভক্তি ঐ সাতটিই ধরা হয়।বাণীকান্ত কাকতিও তা-ই করেছেন।যদিও বা গোলোকচন্দ্র গোস্বামী সম্প্রদানকে কর্ম কারকই লিখেছেন।এবং স্পষ্টই লিখেছেন,“আমার অসমীয়া ভাষাই কর্ম আরু সম্প্রদানর ভেদ বিচার নকরে বুলি মনত রাখিবা।”৮৮তার বদলে তিনি নিমিত্তার্থক বলে আরেকটি কারক এবং বিভক্তির কথা আলোচনা করেছেন।কিন্তু সেই বিভক্তিগুলোর নাম প্রথমা,দ্বিতীয়া সেরকম কিছু উল্লেখ করেন নি।এরকম শ্রেণিভেদ বাণীকান্ত কাকতিও করেন নি।কিন্তু অসমিয়া ব্যাকরণে এই পরম্পরা আছে বলে লীলাবতী শইকীয়া করেছেন।তিনি ‘নিমিত্তার্থক’ কারকও মেনে নিয়েছেন।অপাদানে অসমিয়াতেও কোনো পরসর্গ যোগ হয় না।করণে বাংলার মতো পরসর্গ,বিকল্পে অনুপদ যোগ দু’টোই হয়।কর্তৃ কারকেও পরসর্গ যোগ হয়,করণে অধিকরণেও বাংলার মতো পরসর্গ এক নয়।তার উপরে এই নিমিত্তার্থক।সব মিলিয়ে অসমিয়া কারকের পরসর্গ ছ’টিই।এবং সব কারকেই কোনো না কোনো পরসর্গ যুক্ত হয়।সংক্ষেপে গোলোকচন্দ্র গোস্বামীকে অনুসরণ করলে একটি অর্থহীন ধ্বনিগুচ্ছ ‘একরেলৈরত’ –এ অসমিয়া কারকের পরসর্গগুলো বেঁধে ফেলা যায়।
কর্তা অসকর্মক ক্রিয়ার হলে অসমিয়াতে শূন্য বিভক্তিই হয়।যেমন--- চৰাই উৰে।সম্বোধনে এবং মুখ্যকর্মে কোনো পরসর্গ যোগ হয় না।যেমন--- শুনা বাপাই,(তুমি) কোনো মানুহক হিংসা নকৰিবা।কর্তা সকর্মক ক্রিয়ার হলে ‘-এ’,কর্ম দু’টি হলে গৌণকর্মে ‘-ক’।করণে ‘-ৰে’,নিমিত্তে ‘-লৈ’,সম্বন্ধে ‘-ৰ̖,~অৰ̖’ এবং অধিকরণে ‘-ত’ যোগ হয়।যেমন: মানুহে গৰুৰে হাল বায়;নিমিত্ত- আমাৰ পৰীক্ষালৈ আৰু বৰ বেছিদিন নাই;সম্বন্ধ—এইখন মোৰ কিতাপ;অধিকৰণ---ৰাতি পোৱা ন’বজাত আহিবা।মাছ পাণিত থাকে।পূর্বাংশের প্রাতিপদিকটি যদি ব্যঞ্জনান্ত হয় তবে মাঝে একটি স্বরধ্বনি এসে পড়ে।তার মধ্যে কর্তার পরসর্গ ‘-এ’ যেহেতু নিজেই স্বরধ্বনি সেটি অক্ষত থাকে,বরং স্বরান্ত পূর্বাংশের পরে ‘-য়,~ই’–তে পরিণত হয়। বাকি উপরূপগুলো হয় ক্রমান্বয়ে ‘-অক̖,-এৰে,-অলৈ,-অৰ̖,-অত̖’।
এবারে,বাণীকান্ত কাকতি অসমিয়াতে কর্মের গৌণ-মুখ্য দুই বিভাজনের কথা উল্লেখ করেন নি।বস্তুত তিনি কর্মের আলাদা আলোচনাই করেন নি।সেটি সুনীতি কুমারও করেন নি ওডিবিএল-এ।কিন্তু কর্তা সকর্মক ক্রিয়ার হলে তার সঙ্গে ‘-এ’ পরসর্গ যুক্ত হবার যে যুক্তি তিনি তুলে ধরেছেন,তার অর্থ ঐ কর্মের পরসর্গ বা বিভক্তিহীনতার ক্ষতিপূরণ যেন।তিনি লিখেছেন,“...কর্মত বিশেষ গুরুত্বারোপন নকরিলে সম্প্রদান-কর্মকারকৰ পরসর্গ –ক-র ব্যবহার নহয় কারণে কর্তা আৰু কর্মৰ মাজত থকা অনিশ্চয়তা আঁতরাবলৈ সকর্মক ক্রিয়ার কর্তাত কর্তাকারকর বিভক্তির একান্ত প্রয়োজন।”৮৯ লীলাবতী শইকীয়া বরা কারক অধ্যায়ের শুরুতেই একটি দীর্ঘবাক্য তুলে ধরেছেন,যেটি বাংলা প্রচলিত ব্যাকরণেও কারক বোঝাতে গিয়ে যে চেনা বাক্যটি থাকে,তারই অসমিয়া অনুবাদ বললেই চলে।“ৰজাই তেঁওৰ ৰাজ্যত ভঁৰালৰ পৰা ধন উলিয়াই নিজ হাতেৰে দুখীয়াক বিলাই দিলে।”৯০‘দুখীয়াক’ মানে ‘ভিকিরিকে’ শব্দটি পরম্পরাগত ব্যাকরণে সম্প্রদান ধরা হয়,আমরা গৌণকর্ম বললেও পারি।আসল কাজটি কিন্তু ‘ধন’ দেবার।সেটিতে কোনো পরসর্গ নেই।তাই বলেই কি ‘ৰজা’ কর্তাতে ‘-ই’ (~এ) যুক্ত হলো?কিন্তু ‘দুখীয়াক’ শব্দেতো ‘-ক̖’ রয়েছে।তা হলে এই ক্ষতিপূরণ কেন?অন্যদিকে লীলাবতী শইকীয়া বরা ‘ধন’-কে ‘কর্ম’ এবং ‘দুখীয়াক’-কে ‘নিমিত্ত’ স্পষ্টই লিখেছেন।৯১ অথচ যখন আলাদা করে কর্ম কারকের আলোচনা করছেন, সেখানে ‘আয়ে মগনিয়াটোক চাউল দিছে’ এই ‘নিমিত্ত’ বাক্যের নজির দিয়েছেন।এবং এখানেও ‘আই’ শব্দে ‘-এ’ জুড়েই কর্তা হয়েছে ‘আয়ে’।তিনি কর্মের দুই ভাগের কথা লিখেছেন প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষ।৯২সে ঐ ‘ক্রিয়ান্বয়ীকারকম’ সূত্র মেনেই। ‘মুখ্য-গৌণ’ বিভাজনের সঙ্গে এর তফাত খুব গুরুতর নয়।ধারণাটি নিয়েছেন গোলোকচন্দ্র গোস্বামীর থেকেই। তিনি ‘মুখ্য-গৌণ’কর্ম বোঝাতে গিয়ে কোন কর্মে ‘ক্রিয়ার কার্য’ ‘পরোক্ষ’,কোনটিতে ‘প্রত্যক্ষ’ –সেসব বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন।কিন্তু তাতেই আমাদের সমস্যা সমাধান হচ্ছে না।তিনিই ‘শিক্ষকে ছাত্রক পঢ়াইছে’ এই বাক্যের নজিরও দিয়েছেন।এখানে কর্ম দু’টি নেই।বাংলাতেও ‘শিক্ষক ছাত্রকে পড়াচ্ছেন’,‘মা ওকে বকেছেন’ –এমন অজস্র বাক্য হয় যার কর্ম দু’টি নেই। বিষয়টি বেশ জটিল।সুকুমার সেন লিখেছিলেন,“প্রাচীন বাংলায় কর্মকারকে বিভক্তি নাই”।৯৩ কিন্তু তখন অব্দি সম্ভবত তিনি ‘-রে’ পরসর্গ নিয়ে ভাবেন নি।পরের পাতাতেই লিখছেন, ‘বাংলায় [-র] প্রত্যয় জাত পদগুলিই প্রাচীনতর... ।”৯৪চর্যাতেই আছে ‘মতিএঁ ঠাকুরক পরিনিবিত্তা’ (চর্যাঃ১২) ‘কেহো কেহো তোহারে বিরুয়া বোলই’(চর্যা: ১৮)।এই ‘-অক’ অসমিয়াতে এবং ‘-রে’ সিলেটি সহ পূর্ববঙ্গীয় ভাষাতে এখনো বহুব্যবহৃত হয় দেখে অনেকেই ‘চর্যাগীতি’ কোষের অধিকার নিয়ে টানাটানি করেন।চর্যাতে প্রথমটি কম,দ্বিতীয়টি প্রচুর আছে।তাই বাংলা সম্পর্কে সুকুমার সেনের এই কথাটি নিতে পারি যে “...আধুনিক কালে সাধু ও চলিত ভাষায় [-র] প্রত্যয়ান্ত পদগুলি [-ক] প্রত্যয় জাত পদগুলির কাছে হটিয়া গিয়াছে।...তবে কোন কোন উপভাষায় এখনও বেশ সচল।”৯৫সচল তো বটেই।অষ্টাদশ চর্যাকে সিলেটি করে ফেললে হয়,‘কেউ কেউ তোমারে বাজে বেটি কইন।’ পরসর্গ দুটির মূলে সংস্কৃত ‘কৃ’ ধাতু হওয়াই সম্ভব,৯৬কোথাও এর ‘-ক̖’ থেকে গেছে,কোথাও ‘-র̖’।বাংলাতে তার সঙ্গে ‘-এ’ জুড়ে গেছে।অসমিয়াতে এই ‘-র̖’-তে যখন ‘-এ’ জুড়েছে তা করণের পরসর্গ হয়ে গেছে।তা হলে কোথায় এই পরসর্গ যুক্ত হয়,আর কই হয় না---সেই নিয়ে কি কোনো সূত্র আছে?সুকুমার সেন লিখেছেন,“আধুনিক বাংলায় মুখ্য কর্ম অনির্দিষ্ট (indefinite),জড়-বস্তু (inanimate) অথবা জাতিবাচক হইলেই বিভক্তিহীন হয়।”৯৭অর্থাৎ নির্দিষ্ট,প্রাণী বা ব্যক্তি বাচক হলে কর্ম কারকের পরসর্গটি যুক্ত হবে।এই অব্দি অসমিয়া-বাংলা যে ক’টি কর্মে পরসর্গ যুক্ত হবার নজির দেখে এলাম,সবগুলোতেই এই যুক্তি কিন্তু খাটছে।তিনি উদাহরণ দিয়েছেন,‘বাঘে মানুষ মারে’ ইত্যাদি আরো বেশ ক’টি।কিন্তু বাংলাতে বাক্যটি এমনটাও হতে পারে-- ‘বাঘ মানুষকে মারে’।এই দুই বাক্যের মধ্যে কি তফাত কিছুই নেই?দেখা যাবে,কর্তা বা কর্ম যেটির সঙ্গে পরসর্গ যুক্ত হচ্ছে সেটির উপরে জোরটা পড়ছে।তার মানে,এখানে ‘বাঘে’ই বেশি মানুষ মারে,অন্য কিছুতে নয়। আর দ্বিতীয় বাক্যে যেন বলবার চেষ্টা হচ্ছে,বাঘ যদি ‘মানুষকে’ না মারতো তবুও না হয় সহা যেতো।অবশ্য এভাবেও বলা চলে,‘মানুষ’ এখানে জাতিবাচক হলেও,সুনির্দিষ্ট---তাই ‘-কে’ জুড়েছে।অনেকটা বাক্য শ্বাসাঘাতের বিকল্পে কাজ করে এই পরসর্গের স্থিতি।যদি দুইয়েতেই পরসর্গ যুক্ত হয় অথবা কোনোটিতেই হয় না,তখন শ্বাসাঘাতই শব্দ তথা বাক্যের অর্থ নিয়ন্ত্রণ করবে।অর্থাৎ শব্দটিকে সুনির্দিষ্ট করে দেবে।এইবারে গিয়ে আমাদের বাণীকান্ত কাকতির সূত্রটি কিছু বোধগম্য হবার কথা। তিনি ‘কর্মত বিশেষ গুরুত্বারোপন’-এর কথা বলছিলেন।গুরুত্ব যদি কর্মে না পড়ে তবে কর্তাতেই পড়বে।তথা পরসর্গ যুক্ত হবে।
বাংলা অসমিয়া দুই ভাষাতেই সাধারণত কর্তার যেমন ক্লীব লিঙ্গ হয় না,পরসর্গ যুক্ত কর্মও ক্লীব লিঙ্গের হবে না। কিন্তু তির্যক প্রয়োগে সেটাও হয়,তখন ‘গুরুত্বারোপোন’-এর বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে পড়ে।পরসর্গগুলো কারকের সীমা থেকে বেরিয়ে যায়। যেমন বাংলা: আমরা বইকে ভালোবাসি।অসমিয়া: বাপেকে কিতাপকে লৈ আহিল।পরসর্গ যোগে কর্তা কিংবা কর্মে ‘গুরুত্বারোপন’-এর এই রীতিটি প্রাচীন অসমিয়া-বাংলাতেও ছিল।তাই চর্যাতে যেমন:রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাই;অইসনী চর্য্যা কুক্কুরীপা এঁ গাইল (চর্যা: ২)।কর্তাতে ‘–এ’ যোগ করে ‘গুরুত্বারোপন’-এর সেই রীতি মান বাংলাতে নেই, কিন্তু পুব বাংলার ভাষাগুলোতে তো বটেই অসমিয়াতেও সেই রীতি অক্ষত রয়েছে বলে সুনীতিকুমার লিখেছিলেন।৯৮ সুকুমার সেনও লিখেছেন,বাংলার ‘বঙ্গালী-কামরূপী’ ভাষাবৈচিত্র্যে সেটি রয়েছে।কিন্তু সাধু এবং চলিত বাংলাতে অনির্দিষ্ট কর্তাতেই শুধু রয়েছে।৯৯লিখে,মান বাংলার নজির তিনি যেগুলো দিয়েছেন তাতে ‘লোকে বলে’ যদিও বা সঠিক,‘ছাত্রে কিংবা শিক্ষকে বলে’ কিন্তু বাংলার কানে ভালো শোনাবে না।‘গরুতে দুধ দেয়’;‘ঘোড়ায় গাড়ি টানে।’ –এসবও তির্যক প্রয়োগ বলেই গ্রহণ করা ভালো।এসব অর্বাচীন বাংলাতে লোকে বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া লেখেও না,বলেও না।পরসর্গ বাদ দিয়েই লিখে, গরু দুধ দেয়।তা ছাড়া চর্যাতেও যে সব সময় কর্তাতে এই ‘-এ’ যুক্ত হতো সে নয়।যেমন--তা দেখি কাহ্ন বিমনা ভইলা (চর্যাঃ৭)।সুতরাং একটা জিনিস স্পষ্ট যে বাংলা –অসমিয়া দুই ভাষাতেই পরসর্গ ঠিক কোথায় বসবে সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুসরণে তার সুনির্দিষ্ট নিয়ম সন্ধান বৃথা।রামেশ্বর শ’ লিখেছেন,বাংলা পুরোপুরি ‘সংশ্লেষণাত্মক’ বা পুরোপুরি ‘বিশ্লেষণাত্মক’ নয়।১০০ অসমিয়াও আমরা দেখছি একই রকম।বাণীকান্ত কাকতি যেমন লিখেছেন,“রচনর প্রকৃতি আরু প্রেরণ করিব খোজা অর্থ অনুযায়ী পরসর্গবোর যোগ বা বিয়োগ দিয়া হয়”১০১ ---এই কথাই সত্য বলে মনে হয়। গোলকচন্দ্র গোস্বামীকেও দেখছি নির্দিষ্ট সূত্র নির্মাণে ব্যর্থ হচ্ছেন।‘কারক বাচক বিভক্তির স্থান’ উপশিরোনামে সাত-আটটি সূত্র নির্মাণের চেষ্টা করছেন,প্রায় সবক’টাই ‘কেতিয়াবা’ দিয়ে শুরু করছেন।এ জন্যেই অসমিয়াতেও বাক্যে পদগুলো একটি ক্রম মেনে বসাতে হয়,নতুবা অর্থ বিপর্যস্ত হয়।তবে যেহেতু একেবারেই বাদ দেয় নি পরসর্গ,কোনো কোনোটি বিশেষ কারকেই বেশি ব্যবহৃত হয়,এবং ভাষাভেদেও ভিন্ন ইতিহাস,ভিন্ন চরিত্র লাভ করেছে তাই সেগুলোকে মোটামুটিভাবেই শুধু চিহ্নিত করা যেতে পারে।
কিন্তু এই পুরো তর্ক বিশেষ্য নিয়ে।সর্বনাম অসমিয়াতে কর্তার উত্তম পুরুষে বহুবচনে,এবং তিন পুরুষেই এক বচনে কারকের পরসর্গ জুড়ে না।মধ্যম এবং উত্তম পুরুষের বহুবচনে কোনো স্থির রীতি নেই।যেমন ---আপুনি মোক নামাতিলে কিয়?বেচ সুন্দৰকৈয়েই সিহঁতে তেওঁক বুজাব পাৰিলে১০২;তোমালোক দেখোন যুদ্ধ কৰিবলৈ আহি সকলো পাহৰি মায়ামুগ্ধৰ দৰে বহি আছা(শোণিত কুঁয়রী:জ্যোতিপ্ৰসাদ আগরওয়ালা)।
সিলেটিতেও কর্তৃকারকে পরসর্গ না জুড়লেও চলে।কিন্তু অসমিয়ার মতো প্রায়ই ‘-এ,~য়’ পরসর্গ জুড়বার রীতিটিও ব্যাপক।অনির্দিষ্ট কর্তাতে ‘-এ’ জুড়বার প্রাচীন বাংলা রীতিটির অবশেষ আছে,কিন্তু প্রায়ই কারকের অর্থে নয় নিশ্চয়ার্থে। সুতরাং কই বসবে আর কই না,কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই।জগন্নাথ চক্রবর্তী সেরকম কিছু নজির দিয়েছেন।১০৩প্রাচীন বাংলা রীতির অবশেষ যেমন—মান̖শে কইন জাগা ভালা নায়। কিন্তু –বাজার তনে মানু আইতরা। আব্দুলে তার বাপর কথা মাতে নি? বাবুল ইফিরা গিয়া কামখান করছে।মনইর বউএ রুজ বারা ভানে।সারায় তারে ধরিয়া পিটিবা।সর্বনামে সাধারণত কোনো পরসর্গ জুড়ে না।কখনো বা নির্দেশক সর্বনামে মানুষে –বস্তুতে তফাত করতে জোড়া হয়।যেমন- ইগুনইন্তে/ইতায় ইনো কিতা করইন বে?সকর্মক অকর্মক ক্রিয়ার বালাই নেই বোঝাই যাচ্ছে।নোয়াখালি-চট্টগ্রামীতেও কখনো বা এরকম কর্তৃকারকে ‘-এ’ জোড়ে, অধিকাংশ সময় জোড়ে না। যেমন—নোয়াখালিঃ মাইন̖শে করে কানাকানি, তুঁ:́ই জান̣ আর আঁ:́ই জা̣নি।চট্টগ্রামী: বাইনদুয়ার দি ন আইশশ তুঁ:́ই নিশির কালে, মা-বাফ̣রে লাগাই দিব মাইনশে দেখিলে।
কর্মকারকে অসমিয়াতে প্রাচীন বাংলার ‘-ক̖,~অক̖’ এবং মান বাংলাতে তারই রূপান্তর ‘–কে’ থেকে গেলেও সিলেটি সহ পুব বাংলার ভাষাতে যে ‘-রে’ থেকে গেছে,ইতিমধ্যে লিখলাম।কিন্তু জগন্নাথ চক্রবর্তী লিখেছেন প্রাণীবাচক মুখ্য কর্মেও এটি সম্প্রসারিত হয়েছে।যে নজিরগুলো দিয়েছেন,সেগুলো মুখ্যকর্ম বলে মানা কঠিন।যেমন- আমি বয়াররে বনদো লইয়া যাইয়ার;কানো ধরি মতিরে লইয়া আয়;গুরুমারে কইয়া চল।প্রথম বাক্যে ‘বনদো ’-টা মুখ্য কর্ম নয় কেন? কারণ ‘বয়ার’ তো যাচ্ছে না,ওকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।এই বাক্যকে এভাবেও লেখা চলে---আমি বয়ার বনদো লইয়া যাইয়ার।দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বাক্যদু’টি আবার দুই বাক্যের সমাহার। জটিল বাক্য। তৃতীয়টি আবার যৌগিক বাক্যের জটিলে রূপান্তর।(তুই) কানো ধরি লইয়া আয়+(তুই) মতিরে লইয়া আয়; (তুই) গুরুমারে ক+ (তুই) চল।এ দু’টোকে এভাবেও লেখা যেত--- (তুই) মতিরে কানো ধরি লইয়া আয়;(তুই) গুরুমারে ক আর চল।ফলে স্পষ্ট বোঝা যায় ‘-রে’-র ভূমিকা ঐ ‘গুরুত্বারোপন’ ছাড়া আর কিছুই নয়।সর্বত্র ‘গৌণ-মুখ্য’ সন্ধান বৃথা।‘গুরুত্বারোপন’-এর জন্যেই ক্লীব লিঙ্গেও এই ‘-রে’ যুক্ত হয়।যেমন---ভাত ইটাইনরে ছানিতরে কেনে?ইতাইন্তে দেখো,নৌকা ইটারে টানিয়া তুলের।রবীন্দ্র কুমার দত্ত নোয়াখালি,চট্টগ্রামীতে কর্ম কারকের তিন পরসর্গের কথা লিখেছেন,“–রে,~গোরে,~ওরে’।‘গোরে’-র ‘-গো’ অংশটি এখানে একাধারে সম্বন্ধ এবং বহুবচনের পরসর্গ।সুতরাং কারকের পরসর্গটি ‘-রে’-ই। আর ‘-ওরে’-র ‘ও’ সমীভবনের তোড়ে আসা শ্রুতি ধ্বনি।মূলে পরসর্গটি সেই ‘-রে’।যেমন---নোয়াখালি: ‘দো’য়ারে খওড়̖ দিউম। বাউগোরে কইলেও লাব’̖ নাই। চট্টগ্রামী: ‘দো’য়ারে খওড়̖ দিয়ম।হিতে বওউওরে কিলাইয়ে।
অসমিয়াতে নিমিত্তার্থক কারকের প্রস্তাব দিতে গিয়ে গোলোকচন্দ্র গোস্বামীর যুক্তি ছিল এরকম,“উদ্দেশ্য,লক্ষ্য দিশ,নিমিত্ত আদি অর্থ বুজাবলৈ এই বিভক্তির প্রয়োগ হয়।”১০৪ অর্থাৎ শুধু ‘নিমিত্ত’ দিয়ে পুরো কারককে বোঝানো যাচ্ছে না। কিন্তু পরসর্গ একটিই ‘-লৈ’।যেমন--আমাৰ পৰীক্ষালৈ আৰু বৰ বেছিদিন নাই।বাংলাতেও বহু চেনা ‘লাগি’ মুক্ত রূপিমটি সংক্ষিপ্ত হয়ে অসমিয়াতে ‘–লৈ’ বদ্ধরূপিমে পরিণত হয়েছে।এর অর্থ এই নয় যে রূপিমটি বাংলা থেকেই অসমিয়াতে এসেছে।‘লাগি’ প্রাচীন বাংলা –অসমিয়াতে ছিল।যেমন- বাং.রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর (জ্ঞানদাস) অস.কৃষ্ণগুণ সুমৰন্তে হেৰাই চেতনা৷/মাৰিবাক লাগি স্তন দিলেক পুতনা৷৷ (কীর্তনঘোষা;শঙ্করদেব) পুব বাংলার ভাষাবৈচিত্র্যগুলোতে রূপটি এখনো আছে।সিলেটিতে যেমন--গীত জুগার করার লাগি/লাগিয়া/লাইগ্যা এক ছাত্রবন্ধুরে লইয়া গাউও বারইছি।একে সম্প্রদান থেকে আলাদা করবার প্রয়াস কেন বোঝা কঠিন।আসলে সম্প্রদানেরই রকমফের।বাংলাতেও কেউ কেউ প্রস্তাব করলেও জনপ্রিয় হয় নি।১০৫বাংলা পরম্পরাগত ব্যাকরণে কে যে কবে সম্প্রদানকে শুধু ‘দান’ কর্মের সঙ্গে সম্প্রদানকে জুড়ে দিলেন সে স্বতন্ত্র ইতিহাস অধ্যয়নের বিষয় হতে পারে।কিন্তু সংস্কৃত ব্যাকরণে সম্প্রদানের অন্তত সাতটি সূত্রতো আমরা পাচ্ছিই।তার মধ্যে ‘স্পৃহেরীপ্সিতঃ’,‘ক্রিয়য়া যমভিপ্রৈতি’ ইত্যাদি সূত্রও রয়েছে।১০৬‘লাগি’ পরপদ সাধারণত সেই ‘স্পৃহেরীপ্সিতঃ’ সূত্র অনুসরণ করে।মান বাংলাতে রবীন্দ্র সঙ্গীত অব্দি এই অব্যয়টির ব্যবহার হয়েছে,এর পরে ‘জন্যে’ শব্দটিকে প্রতিস্থাপিত করে ফেলেছে।‘এরা সুখের লাগি প্রেম চাহে’ না লিখে এখন লেখা হবে ‘এরা সুখের জন্যে প্রেম চায়’। দুই বাক্যেই সুখ শব্দে সম্বন্ধের ‘-এর̖’ পরসর্গ যোগ হয়েছে এটি স্পষ্ট। বহু সময় তাও হয় না।এরা সুখ পেতে প্রেম চায়—লিখলে সুখ হয়ে গেল পরসর্গ মুক্ত,আর √পা ধাতুতে করণ-অধিকরণের ‘-তে’ যুক্ত হয়ে ‘পেতে’ হয়ে গেল অসমাপিকা।ড০ মুহম্মদ শহীদুল্লাহও এই সম্প্রদান কারক নিয়ে সমস্যাতে পড়েছিলেন,‘যাহাকে কোনো বস্তু দান করা যায়,তাহাকে সম্প্রদান কারক বলে ---সম্প্রদানের এইরূপ সংকীর্ণ সংজ্ঞা বাঙ্গালা ভাষায় খাটে না।”১০৭কিন্তু এর পরে তিনি গোলোকচন্দ্রের মতো কারকের নাম না পালটে সংজ্ঞাই পালটে দিয়েছেন,“যাহাকে অভিপ্রায় করিয়া দান করা যায় কিংবা ক্রিয়া দ্বারা যাহা বা যাহাকে অভিপ্রায় করা যায় তাহাকে সম্প্রদান কারক বলে।” আরো লিখেছেন,“‘ক্রিয়া যমভিপ্রৈতি সোহপি সম্প্রদানম’ এই সংজ্ঞাটি এই ব্যাকরণে গ্রহণ করা হইয়াছে।”১০৮ কিন্তু ‘কর্ম্মণা যমভিপ্রৈতি স সম্প্রদানম’ এই সংজ্ঞাটি বাদ দিলেন কই? এর পরে তিনি গত্যর্থে,নিমিত্তার্থে ইত্যাদি একাধিক ‘-অর্থে’ সম্প্রদানের নজির দিয়েছেন।‘গত্যর্থ ক্রিয়ার কর্মে কখনও –এ,-য়,-তে বিভক্তি হয়’ লিখে যখন সম্প্রদানের উপবিভাজনে আটকে রাখেন তখন সব গুলিয়ে যায়।এমন কি বাংলা ‘জন্য’ অব্যয়টি সহজেই বোঝা যায় ‘নিমিত্তে’র অর্থ বহন করে,তবু শুধু এরই জন্যে ‘জন্যার্থক’ সম্প্রদানও নজির দিয়ে দেখিয়েছেন।অর্থাৎ যে কাজটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বিদ্রূপ করেছিলেন,‘সন্তাড়ন কারক’আদি প্রশ্ন তুলেছিলেন,মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সেটিই করেছিলেন। এই ‘জন্যার্থক’-এর নজিরে তিনি ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু।’---ধরনের নজির দিয়ে লিখেছেন,এতে ‘জন্যর্থক শব্দের যোগে ষষ্ঠী হয়।’এই উপভিভাজনের নজিরে পরে একটি ‘পরপদ’ থাকছে,‘জন্য,~তরে,~লাগি’ ইত্যাদি।কিন্তু মূল অংশের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ‘-র̖’।পরপদহীন বাকিগুলোতে কেবলি ‘-এ’ বা ‘-কে’ পরসর্গ।অর্থাৎ সে ঐ ‘কেতের̖’ গুচ্ছের সব ক’টিতেই কাজ হচ্ছে।ভিন্ন কিছু নয়।‘-কে’ পরসর্গকে কর্মের আলোচনাতে তিনি দ্বিতীয়া বলে লিখলেও ‘দরিদ্রকে ধন দাও’-এর মতো বাক্যে চতুর্থী বিভক্তি বলে লিখছেন।তিনি সম্প্রদানকে রাখার পক্ষে --- কেন না,“কর্মে বিভক্তি লোপ হইতে পারে,কিন্তু সম্প্রদানে হয় না।”১০৯ এই যুক্তি খুব প্রবল নয়।কেননা,তারপরেও বাংলাতে সম্প্রদানের জন্যে কোনো আলাদা পরসর্গ নেই।‘দরিদ্র ধনীকে ঈর্ষা করে।’-- এই বাক্যে ‘কী করে?’,‘কাকে করে?’ এভাবে প্রশ্ন করলে উত্তরে ‘ধনীকে’ এবং ‘ঈর্ষা’ শব্দদুটি মেলে। এবং এগুলোর কারক কর্ম বলতে বাংলাতে অসুবিধে থাকবার কোনো কথা নয়।‘কলকাতায় চলো’-- যদি বাংলাতে সম্প্রদান কারক বলে ধরতে হয়,তবে ‘বিকেলে চলো’-কেও সম্প্রদানই ধরতে হয়।তারপরেও অধিকরণ থাকবে না এমনটা নয়। যেমন-- ও কলকাতায় থাকে;বিকেলে বাড়িতেই থাকি।অর্থাৎ সম্প্রদানে কর্তার ইচ্ছে গুরুত্ব পাবে,অধিকরণে ক্রিয়ার স্থান কাল।দুই কারকে দুই যুক্তি।তখনো প্রশ্ন-- মা সন্তানে স্নেহ করেন।এর কী কারক হবে? সম্প্রদান? সংস্কৃত ব্যাকরণে কিন্তু অধিকরণ।যেমন: মাতা পুত্রে স্নিহ্যতি।১১০সংস্কৃত ব্যাকরণে এও অধিকরণ,এবং বিভক্তি ‘-এ’ —সমমব্রাহ্মণে দানম।তাই আমাদের মনে হয় বাংলাতে সম্প্রদানটি রাখা একেবারেই বাহুল্য।অসমিয়াতেও যেহেতু একটি স্বতন্ত্র ‘–লৈ’ পরসর্গটি আছে এবং সেটি মুহম্মদ শহীদুল্লাহের ‘জন্যার্থক’ বা নিমিত্তার্থ’-কেই নয় ‘গত্যর্থ’-আদিতেও সম্প্রসারিত হয় সেহেতু গোলোকচন্দ্র গোস্বামীর প্রস্তাবটি সঠিক বলে মনে হয়।‘লাগি’-- যে মুক্ত রূপিম তথা শব্দটির থেকে ‘-লৈ’ বদ্ধরূপিম এসেছে -- এর অর্থই বাংলা ‘জন্য’,অসমিয়া ‘বাবে’,তৎসম ‘নিমিত্ত’।যেমন--- ‘কলিকতালৈ বোলা’;‘আবেলিলৈ আহিবা’।অধিকরণে সেখানে পদের গঠন সম্পূর্ণ ভিন্ন: ই কলিকতাত থাকে।আবেলি সময়ত ঘৰতে থাকো।এই যে প্রাচীন প্রয়োগ-- ‘মাৰিবাক লাগি স্তন দিলেক পুতনা’ এমনটা কিন্তু অর্বাচীন অসমিয়া অন্যান্য ভাষাবৈচিত্র্যগুলোতেও আছে।যেমন বরপেটার ভাষাবৈচিত্র্যে—‘মানহোক লাগি’,‘মানুহগিলানোক লোগি’;১১১ উত্তর গৌহাটি তথা কামরূপী ভাষাবৈচিত্র্যে—‘আপনাক লাগি,আপনালোকক লাগি’১১২।‘-ক̖’ এখানে সম্বন্ধের ‘-ৰ̖’-এরই বিকল্পে ব্যবহৃত।মানঅসমিয়াতে এভাবেও লেখা চলে---‘আপোনাৰ বাবে’,‘খাবৰ বাবে’ ইত্যাদি।বাংলা ‘সুখের লাগিয়া’ বা ‘সুখের জন্যে’র থেকে এর গঠন খুব একটা ভিন্ন নয়।‘লাগি’-টি সংক্ষিপ্ত হয়ে ‘-লৈ’ হয়েছে,আর পূর্বাংশের সঙ্গে জুড়ে গেল বলে সম্বন্ধের ‘-র’-টি লোপ পেয়ে গেল।সুতরাং একে সম্বন্ধেরই পরসর্গ হয়তো বলা যেতো। ‘কলিকতালৈ বোলা’ এই বাক্যের পুনর্গঠন এই ভাবেও সম্ভব---‘কলিকতা যাবৰ বাবে বোলা’।একে যদি সম্বন্ধে না ধরি,তবে কিন্তু ‘-র’ পরসর্গ সহ এক পূর্বাংশের সঙ্গে ‘বাবে’ পরপদ যুক্ত হয়েও নিমিত্ত কারকের পদ তৈরি হয় সেই কথা স্বীকার করতে হয়।অথচ,এই প্রশ্নে গোলোক চন্দ্র গোস্বামী বা লীলাবতী শইকীয়া বরা –দু’জনেই নীরব।এই ধরণের সমস্যা অসমিয়াতে প্রচুর আছে।ব্যাকরণের দিক থেকে সমস্যা হলেও ভাষার দিক থেকে এগুলোই অসমিয়াকে স্বতন্ত্র করেছে।
সিলেটিতে একই ‘নিমিত্ত’ অর্থেই অসমিয়া ‘-লৈ’- পরসর্গের পূর্ণরূপ ‘-লাগি, ~লাগিয়া’-র ব্যবহার ব্যাপক।তার পরেও এই সব সমস্যার কথা মনে রেখে জগন্নাথ চক্রবর্তী এই কারকটিকে বাদ দিয়েছেন।এবং ‘-লাগি’ অনুপদ সহ পদগুচ্ছকে গৌণকর্মেই ধরেছেন।সমর্থনে তিনি সুনীতিকুমার এবং পরেশ চন্দ্র মজুমদারের যুক্তি তুলে ধরেছেন।সুনীতিকুমারের দেয়া ‘মুখ্য-গৌণকর্মে’র সংজ্ঞা উদ্ধার করেছেন,“যাহার সুবিধা বা অসুবিধার জন্য,অথবা ভালর বা মন্দর জন্য,কিংবা যাহাকে উদ্দেশ্য করিয়া,ক্রিয়াপদের কার্য্য করা হয়,তাহা গৌণ কর্ম (Indirect Object) এবং যে বস্তুকে অবলম্বন করিয়া কার্য্য ঘটে,তাহা মুখ্য কর্ম (Direct Object)।”১১৩ তার মানে এই বাক্যে মোটা হরফের শব্দগুচ্ছটি গৌণ কর্ম,আর বাঁকা হরফের শব্দগুচ্ছটি মুখ্য কর্ম — গীত জুগার করার লাগি/লাগিয়া/ লাইগ্যা এক ছাত্রবন্ধুরে লইয়া গাউও বারইছি।লক্ষ করবার বিষয় যে দুই অংশেই দুটি অনুপদ আছে,‘লাগিয়া’ আর ‘লইয়া’,দু’টি অনুপদেরই পূর্বপদে দুই পরসর্গ জুড়েছে।প্রথমটিতে সম্বন্ধের ‘-র’ এবং দ্বিতীয়টিতে কর্মের ‘-রে’।আরেকটি সহজ নজির,যেখানে মুখ্য বা প্রত্যক্ষ কর্মে কোনো পরসর্গ নেই ---তুইন বেটা মাইর লাগি কিতা করচছ (সু.গা.পা.:সতেরো)।সমস্যাটি নোয়াখালি,চট্টগ্রামীতেও একই।তবু রবীন্দ্র কুমার দত্ত বহু প্রশ্নে নতুন ভাবনার খোরাক জোগালেও সম্প্রদান সমস্যা নিয়ে কোনো কথাই লেখেন নি,কারকটিকে তিনি রেখেছেন।এবং সম্প্রদানে ‘-রে’ ছাড়াও ‘–লাই’ অনুসর্গ বিভক্তির উল্লেখ করেছেন।১১৪কিন্তু এই ভাষাবৈচিত্র্য দুটিতেও যেখানে ‘-লাই’ জুড়েছে তার আগে সম্বন্ধের ‘-র’ কিন্তু নজরে না পরে থাকে না।যেমন--- নোয়া.হেইতেনে আঁর̖ লাই দম̖ম –কম̖ম বেক̖ ছাড়ি দিচেন।‘আঁর̖ লাই’ মানে ‘আমার লাগি’।কখনো এই ‘র’-এ ‘ল’-এ সমীভবন হয় দুই ভাষাবৈচিত্র্যেই। চট্টগ্রামীতে অবশ্যই হয়,হয়ে দাঁড়ায় ‘আঁল̖লাই,তোল̖লাই,গরিবাল̖লাই(করিবার লাগি)’।কিন্তু সেসব গিয়ে ঐ অসমিয়া ‘আমালৈ,কৰিবলৈ’ -- অব্দি গড়ায় না।সুতরাং আলাদা করে ‘নিমিত্ত’ কারক প্রস্তাব করবারও কারণ দেখা যাচ্ছে না।এমনটা সমীভবন সিলেটিতেও আকছার দেখা যায়।যেমন এল্লাগিউ হিদিন তুমি আইলায় না,আমিও কই অইলটা কিতা!
দৃশ্যত বাংলা অসমিয়া করণে পরসর্গ ভিন্ন হলেও,খানিক মিলও আছে।বাংলা ‘চামচে করে খাও না’-এই বাক্যের অসমিয়া অনুবাদ দাঁড়াবে ‘চামুচেৰে খোৱা না।’ সিলেটি অনুবাদ হবে---চামুচো করি খাও না।অর্থাৎ যেটি হচ্ছে---সেই √কৰ̖ (<√কৃ) ধাতু জাত সম্বন্ধের ‘-র̖’–এর সঙ্গে অসমিয়াতেও আরেকটি পরসর্গ ‘-এ’ যুক্ত হচ্ছে।প্রাতিপদিকটি ব্যঞ্জনান্ত হলে আরেকটি ‘-এ’ শেষধ্বনিতে জুড়ে যাচ্ছে যাকে স্বরভক্তির খাতায় ধরতে পারি।পরসর্গটি যে মূলে ‘-এ’ এই কথা বাণীকান্ত লিখেছেন,“অসমীয়াত করণকারকর শব্দরূপর লক্ষণযুক্ত বিভক্তি –এ’।”১১৫প্রাচীন অসমিয়াতে ‘শিশুপালকেৰে মই দিবো বিয়া’ নজির টেনেছেন।এই ‘কেৰে’ বাংলা ‘-কার̖’ (< কার্য্য)-এর সঙ্গে সম্পর্কিত বলে দেখাতে গেলে আমাদের আলোচনা অহেতুক দীর্ঘ করতে হয়।বাংলা ‘এখনকার,কালকের’ শব্দগুলোতে ‘-কার’ যদিও সম্বন্ধেরই অর্থ বহন করে।যাই হোক, নিমিত্তের ‘লাগি’ থেকে যেমন ‘-লৈ’,করণের ‘-কেরে’ থেকে তেমনি ‘-রে,এরে’ এসেও থাকবে;তারপরেও ‘-এ’ ‘বাংলা’ ‘-এ’-র মতোই সংস্কৃত ‘-এন̖’ থেকে আসাই সম্ভব।১১৬ দুয়ে মিলেমিশে তারপরে ভেদরেখা চেনা কঠিন হয়ে গেছে।কথাটির পক্ষে আমাদের যুক্তি আরো এই যে ‘সহিতে’ (সৈতে),‘দ্বারা’ ‘দিয়ে’ আদি পরপদ যোগে বাংলার মতো অসমিয়াতেও করণ কারকের পদ তৈরি হয়।কিন্তু ‘দিয়ে’ সেই ‘–লৈ’-র মতো সংক্ষিপ্ত হয়ে ‘-দি’ হয় এবং যে পূর্বাংশের সঙ্গে জুড়ে যায় সেই প্রাতিপদিকে আগেই ‘-এ’ জুড়ে থাকে।সম্বন্ধের ‘-ৰ̖’-এর তখন কোনো কাজ থাকে না।এমনটা সিলেটি সহ পুব বাংলার বহু ভাষাবৈচিত্র্যেও হয়।যেমন –‘বাটেদি’,সিল.-অস.‘হাতেদি’ ইত্যাদি।সুতরাং ‘-লৈ’-কে যদি নিমিত্তের পরসর্গ বলে মেনে নিয়ে হয়,একই যুক্তিতে ‘-দি,~এদি’-কেও কিন্তু করণের পরসর্গ বলে মেনে নিতে হয়।বাণীকান্ত ‘হতুৱাই’ শব্দে কেন ‘-ই’ যুক্ত হয়েছে লিখলেন আমাদের কাছে অস্পষ্ট।১১৭‘আ+এ’ যোগ হলে যে অসমিয়াতে ‘-আই’ হয় আমরা ধ্বনি প্রসঙ্গেই দেখিয়ে এসেছি।কর্তৃ কারকের পরসর্গ প্রসঙ্গেও ‘ৰজাই’ শব্দ আমরা পেয়েছি।সব মিলিয়ে করণের পরসর্গ দাঁড়ালো তিনটি ‘-এ’,-ৰ̖,~ৰে এবং –দ্,~এদি’।
জগন্নাথ চক্রবর্তী সিলেটিতে ‘-দি’(<দিয়ে) যে পরসর্গের মতো জুড়ে যায় এটি লক্ষ করেছেন,“ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রয়োগ ব্যতিরেকেও করণ কারক নির্মাণের ব্যাপারে এই অনুসর্গগুলো সাধারণ বিভক্তির মতো ব্যবহৃত হচ্ছে অর্থাৎ যে-কোনো করণপদ এগুলি দিয়ে অনায়াসে তৈরি করা যায়।যেমন=> আনদাতর বাইচ্ছাদি আল ছইবায় কিলা? ই দা দিয়া আমরা হকলতা কাটি।”১১৮ তার মানে ‘দিয়া’ কখনো বা সংকুচিত হয়ে অসমিয়ার মতো পরসর্গ হয়ে পূর্বপদে মিশে যাচ্ছে।এই দুই উদাহরণেই পূর্বাংশে আর কোনো রূপিম যুক্ত হয় নি।কিন্তু বহু সময় সেটাও হয়।কর্তৃকারকের –এ’ জুড়ে অসমিয়ার মতো। যেমন ---ই কলমেদি লেখা যাইত নায়।কর্মকারকের ‘-রে,~নে’ জুড়ে।যেমন –-তোমারেদি/ তানেদি ই কাম করতাম পারতাম নায়;ছাগিরেদি ʔআল বাওয়াইতায় নি? ‘ছাগি’ এবং ‘কলমে’ অর্থাৎ মানবেতর প্রাণী এবং ক্লীব লিঙ্গে অবশ্য ‘-এ,~রে’ বাহুল্য মাত্র।না হলেও চলে---কলমদি,ছাগিদি।‘দোয়ারা,~দারা’(< দ্বারা) নোয়াখালি,চট্টগ্রামীতেও করণের অনুসর্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।কিন্তু অধিকাংশ সময়েই ‘-দি’ জুড়ে যায় সিলেটির মতো।যেমন—নোয়া.শিদা (সোজা) রাসতা দি শিদা (উপঢৌকন)লই হেইতারা রাজবাড়িত গেছে।চট্ট.শোনার জ̣ইবন ক্যেমনে রাইক̣খম গাম̣ছা দি বান̣দি।এই ‘-দি’ পূর্বপদে জুড়ে গেলে ‘-এ’ যুক্ত হয় কিনা সিলেটি বা অসমিয়ার মতো সে নিয়ে রবীন্দ্র কুমার দত্ত কিছু লেখেন নি।কিন্তু আগেকার ব্যঞ্জনকে সমীভূত করে ফেলে।যেমন ‘আঁদ̖দি,তোঁয়াদ̖দি’ < আঁর̖দি,তোঁয়ার̖দি (= সিলে.আমারে দি,তোমারে দি,অস.আমাকদি,তোমাকদি)।কিন্তু নিখিলেশ পুরকাইত পড়ে মনে হয় ‘দিয়া’ অনুপদ হিসেবে যুক্ত হলে ‘-এ,~রে’ পূর্ব-পর দুই পদেই যুক্ত হয়ে এক অনন্য গড়ন গড়ে তোলে চট্টগ্রামীতে।যেমন --তোয়াঁরে দিয়ারে,অনরে দিয়ারে (তোমাকে/আপনাকে দিয়ে)।১১৯ ঢাকাইয়াতে এই ‘-দি’ হয়ে যায় ‘-দা’।যেমন-- আমারে দা,তোমারে দা, হ্যাতায়রে দা,হ্যাতায়গো দা,আঙ্গো দা,তোঙ্গ দা ইত্যাদি।১২০
তেমনি চামুচো করি খাও না; গ্লাসো করি দেও না; গাড়িত করি যাইমু---এই সব বাক্যে ‘করি’ অনুপদটি স্পষ্ট,মান বাংলার ‘করে’,সাধু ‘করিয়া’-র মতো।অসমিয়াতে যেটি সংকুচিত হয়ে ‘-ৰে’ হয়েছে।কিন্তু পূর্বপদে ‘-ও’ এবং ‘-ত’ পরসর্গ যোগ হচ্ছে।পূর্বপদের প্রাতিপদিকের শেষ ধ্বনি স্বরান্ত হলে ‘-ত’,ব্যঞ্জনান্ত হলে ‘-ও’ যুক্ত হচ্ছে।এগুলো সিলেটি অধিকরণের পরসর্গের সঙ্গে একই।সম্বন্ধের ‘-র̖,~অর̖’ এর বিশেষ কোনো কাজ নেই,সিলেটি করণ কারকের পদগুচ্ছ তৈরিতে।জগন্নাথ একটি নজির দিয়েছেন,‘তান আতর রান̖দা’ (নিজের হাতে রানদা করা কাঠ) –এটি একটি বিশেষণ বাক্যাংশ মাত্র।পুরোটাই করণের পূর্বাংশ হতে পারে।পুরো বাক্য এমনও হতে পারে---তান ʔআতর রান্দা দি জিনিস বানাইলে কইবা।
কখনো বা এই সব পরপদ বাদ দিয়েও শুধু পরসর্গ জুড়ে করণের অর্থ বহন করে।জগন্নাথ চক্রবর্তী লিখেছেন,সেই পরসর্গ ‘-এ,~য়’।উদাহরণ দিয়েছেন, এরকম--- তুমার ই লাঠিএ সাফ মারা জাইত নায়;জলালর ছাত̖তায় মেঘ আটকিসে নি?বৈরাতি হকল গাড়িএ আইছইন।১২১এটি আছে।কিন্তু ‘-ও,~ত̖’-ও আছে ব্যাপক আকারে।এই বাক্যগুলোকেই এভাবে লেখা যেতে পারে--- তুমার ই লাঠিত সাফ মারা জাইত নায়; জলালর ছাতাত মেঘ আটকিসে নি?বৈরাতি হকল গাড়িত/ রেলো আইছইন। ‘-এ,~য়’ দিয়ে নোয়াখালি,চট্টগ্রামীতেও করণের পদ তৈরি হয়। যেমন--- নোয়া.আ́তে কর গ’রর̖ কাম, মুয়ে কর কিশ̖ন নাম।
‘ৰামতকৈ লক্ষণ সৰু’ এহেন তুলনামূলক বাক্যগুলোকে বাংলাতে আমরা অপাদান কারকের নজির হিসেবে জেনে এসেছি।১২২বাংলাতে বাক্যটি দাঁড়াতো ‘রামের চেয়ে লক্ষণ ছোট’।সেগুলোকে গোলোকচন্দ্র শুধু এই যুক্তিতেই অধিকরণের ভেতরে ধরছেন যে ‘-অত̖’ বদ্ধরূপিমটি এখানে রয়েছে।১২৩ বাণীকান্ত কিন্তু এগুলোতে অপাদানই লিখেছেন,“তুলনা ইঙ্গিত দিয়া প্রকাশবোরত এই –ত র এটা অপাদান অর্থ আছে ।”১২৪কিন্তু আলোচনা অধিকরণ প্রসঙ্গেই করেছেন।লীলাবতী এই নিয়ে নীরব।ফলে আমাদের সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন,আমরা কার দিকে দাঁড়াব।বাক্যটিকে এই ভাবেও পুনর্গঠন করা যেতে পারে,‘ৰামৰ তুলনাত লক্ষণ সৰু’।তাহলেও দ্বিতীয়াংশের সঙ্গে ‘-ত̖’ পাওয়া যাচ্ছে,কিন্তু পূর্বাংশের সঙ্গে সেই ‘-ৰ̖’ ---যা পরপদ যোগ হলে বাংলা কিংবা অসমিয়া দুই ভাষারই সাধারণ বৈশিষ্ট্য।‘ৰামতকৈ’ লিখলে যা হচ্ছে ‘-অত̖’ পূর্বাংশে জুড়ে যাচ্ছে,এবং তারপরে তুলনা বোঝাতে আরেকটি পরসর্গ ‘-কৈ’ বসছে।সেটিও কিন্তু মূলে একটি পরপদ।বাংলা ‘চামচে করে’ যদি অসমিয়াতে ‘চামুচেৰে’,‘ভালো করে’ কিন্তু অসমিয়াতে ‘ভালকৈ’।তেমনি ধুনিয়াকৈ,বেয়াকৈ,লাহেকে ক্রিয়াবিশেষণগুলো তৈরি হয়।প্রাচীন অসমিয়াতে পূর্ণ শব্দটি মেলে।যেমন—‘মোত কৰি তোহ্মাতে অধিক হৈবে মান৷’(কীর্তন ঘোষা)।বাংলাতেও মেলে,শুধু ‘করি’-টি নেই,কিন্তু স্বতন্ত্র পূর্বাংশে ‘-ত’-টি রয়েছে।‘আহ্মাত আধিক তোর কে করিবে হিত।’(শ্রীকৃষ্ণকীর্তন) শঙ্করদেবের ‘মোত কৰি’ অর্বাচীন অসমিয়াতে ‘মোতকৈ’।সুতরাং ‘-লৈ’-কে যদি নিমিত্তের পরসর্গ বলা যেতে পারে তবে ‘-কৈ’-কে অধিকরণ নয়,অপাদানের পরসর্গ বলাই সমীচীন।যার মধ্যসর্গে অধিকরণের পরসর্গ ‘-ত̖’-র তির্যক প্রয়োগ হচ্ছে—এইভাবে লিখলে একটা শৃঙ্খলা দাঁড়ায়।এই ‘-ত̖’ এসছে তৎসম ‘অন্ত’ (মাঝে) থেকে,সুনীতিকুমার সেরকমই লিখেছেন,“This « -t » would seem to be the word « -antaḥ » within: it was compounded with the noun-base…”১২৫ কিন্তু ---‘তোমার তনে হে বা’লা’ এরকম সিলেটি প্রয়োগ দেখলে অসমিয়াতেও অপাদানের এই পরসর্গটি তৎসম √স্থা ধাতু থেকে বিশেষ্য ‘স্থান> থান’ হয়ে এসেছে বলে অনুমান করতে ইচ্ছে হয়।১২৬বাংলার মতো পূর্বাংশে সম্বন্ধের ‘-ৰ,~অৰ’ যুক্ত করে বা না করে আরো বেশ কিছু পরপদ ব্যবহার করে অসমিয়া অপাদানের পদ তৈরি হয়। বাংলা ‘থেকে’-এর মতো অসমিয়াতে বহুল ব্যবহৃত পরপদ হচ্ছে ‘পৰা’।যেমন:‘পপীয়া তৰা আকাশৰ পৰা খহি পৰে’।
অপাদানে সিলেটিতেও মান বাংলার মতো কোনো নিজস্ব পরসর্গ নেই।পরপদ তথা অনুপদ জুড়ে অপাদানের অর্থ স্পষ্ট করে।পূর্বাংশে কখনো বা করণ-অধিকরণের পরসর্গ ‘-এ,~ত̖,~ও’ কিংবা সম্বন্ধের পরসর্গ ‘-র̖,~অর̖’ জুড়ে যায়; প্রায়শই তারও দরকার পড়ে না।সংস্কৃত √স্থা ধাতুর থেকে একদিকে বাংলা –অসমিয়া √থাক̖ ধাতু এবং বাংলা অসমাপিকা ‘থেকে’,অন্যদিকে বাংলা-অসমিয়া বিশেষ্য ‘স্থান, থান, ঠাই’ এসেছে জানা কথা। থান> থানে পরপদ জুড়ে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেই এমন অধিকরণ পদগুচ্ছ আছে,যেগুলোতে অপাদানের ভ্রম হয়। যেমন—ঈষত ফুটিত পদ্ম তোর নাভি থানে (ছত্রখণ্ড)।মান বাংলা থেকে> সিলেটিতে হয়েছে তাকি (~ত্তাকি,থাকি);অন্যদিকে স্থানে> থানে থেকে এসেছে ‘তনে’। যেমন - পুলিং অফিসাররার কাচ তাকিয়া/তনে/ তাইক্যা ব্যালটপেপার টাইন (হকল) লইয়া বুটিং কম্পার্টমেন্টের টেবুলের তলে ঢুকি পরলা/গেলা।১২৭ নোয়াখালি,চট্টগ্রামীতে এই ‘তনে’ দাঁড়ায় গিয়ে ‘তুন̖’,নোয়খালিতে কখনোবা ‘তোন̖’।এবং ভাষাবৈচিত্র্যদুটিতে অপাদানে এই অনুপদ ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হয়।‘তাকি’ (< থাকি,থেকে) সম্ভবত এই দুই ভাষাবৈচিত্র্যে শোনাই যায় না।যেমন: নোয়া.বাইত̖তুন̖ ইস̖কুল কদ̖দুর? চট্ট.নাতিন বরই খা বরই খা হাতে লইয়া নুন,ঠেইল̖ বা’ঙগি ফইজ̖জে নাতিন বরই গাছততুন।দেখা যাচ্ছে,এখানেও সম্বন্ধের ‘-র̖’ অনুপদের প্রথম ধ্বনি ‘ত̖’-এর প্রভাবে সমীভূত হয়ে যাচ্ছে।তেমনি মান বাংলা ‘হতে,~হইতে’-র সহোদরা সিলেটি ‘-অনে,~অন্তে’।যেমন – হরু অনে হি এক তাকাইয়া; শরম অন̖তে মরণ ভালা।১২৮অসমিয়া বহুবচনের পরসর্গ ‘-হঁত̖’-এর সগোত্রীয় সিলেটি অব্যয় তথা পরপদ। সংস্কৃত √ভূ এবং √অস̖ থেকে অপ্রভ্রংশেই ‘হোন্ত> হুন্ত’,‘সন্ত > হন্ত’ চেহারা নিয়েছিল বলে সুকুমার সেন উল্লেখ করেছেন।তিনি লিখেছিলেন, প্রাচীন বাংলাতে আর এটি মেলে না, অবধিতে ছিল ‘গাঁব হুঁত আব’। ১২৯তাহলে চর্যার ‘-হুঁ’ পরসর্গটির প্রাক অপভ্রষ্ট রূপটি কী ছিল উল্লেখ করেন নি।যেমন-- খেপহুঁ জোইনি লেপন জাই( চর্যা:০৪)।কিন্তু বাংলা ভাষাবৈচিত্র্যের ‘হনে’,মান বাংলার ‘হ’তে’ এবং সাধু বাংলার ‘হইতে’-র উৎস যে এই ‘হুন্ত,~হন্ত’ এই কথারও উল্লেখ করেছেন।প্রাচীন বাংলতে না থাক,পরের কালে প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলাতেই সঙ্গে ‘-এ’ পরসর্গ নিয়ে এই ধাতু দু’টি অব্যয়তে পরিণত হচ্ছে,এবং দুই বাংলাতে দুই ধারাতে রূপ নিচ্ছে।পুব বাংলাতে ‘-ন’ ধ্বনিটি অক্ষত থাকছে,পশ্চিমে পরের ধ্বনিকে অনুনাসিক করে দিয়ে লোপ পাচ্ছে। যেমন- ওস্তাদে প্রণাম করো পিতা হন্তে বাড়।দোসর জনম দিলা তিহ সে আম্বার ।।(শাহ মুহম্মদ সগীর);এবে হতেঁ দৈবকীর যত গর্ব্ভ হএ।মানুষ নিয়োজিল মারিবাক তাএ।।(শ্রীকৃষ্ণকীর্তন:জন্মখণ্ড) শুধু ধ্বনিপরিবর্তনের সিলেটি রীতি অনুযায়ী ‘-হ’টি লোপ পেয়ে গেছে।তেমনি আরেকটি পরপদ ‘মান̖তে’-র উল্লেখ করেছেন জগন্নাথ চক্রবর্তী।যেমন—গরম পড়ছে মান̖তে তাই শরিল ভালা জার না।১৩০একে মৌলিক পদ বলে মনে হয় না।‘মান’ অংশটি অসমিয়া বহুবচনের অনিশ্চয়ার্থক ‘মান’ (কেইটামান) এর সমগোত্রীয় বলেই মনে হয়।আবিদ রাজা মজুমদারেরও সেরকমই ইঙ্গিত।১৩১মান+ অন্তে= মান̖তে হওয়াই সম্ভব।
গোলোকচন্দ্র শুরুতে বিভিন্ন কারকের বিভক্তির যে নজির দিয়েছেন,সেখানে অধিকরণে ‘-এ’ নেই।১৩২মাঝে অধিকরণের আলোচনা করতে গিয়ে লিখছেন,“অধিকরণ কারকর আরু এটা চিন আছে: –এ”।১৩৩একে আসলে কর্তার পরসর্গের তির্যক প্রয়োগ বললেই চলে।যেমনটা করণেও আছে বলে আমরা দেখালাম।অধিকরণে অবশ্য করণের মতো সেরকম জটিল নয়।যেমন:অসমৰ উত্তৰে হিমালয় আছে।কিন্তু এর সঙ্গে করণের মতো ‘-দি’ যুক্ত হয়ে অধিকরণের পদও তৈরি হয় অসমিয়াতে।করণ প্রসঙ্গে তিনি এরও আলোচনা করেন নি,বাণীকান্ত করেছেন।অধিকরণের নজির যেমন-- ‘অসমৰ মাজেদি ব্রহ্মপুত্র বৈ গৈছে’।অর্থের দিক থেকে বাংলাতেও এগুলো অধিকরণই।কিন্তু ‘-এ’ কিংবা -দি’ কোনোটিকেই অসমিয়াতে অধিকরণের একার জিনিস নয়,করণের সঙ্গে তার যৌথ মালিকানা।‘মাজেদি,কোনফালেদি, যোৰাবাটেদি’ এসব অসমিয়াতে অধিকরণের পদ।এগুলোতে না হয় ‘-দি’ জুড়ে গেছে,কিন্তু যদি বাক্যটি হয় ‘দূৰৈৰ পৰা শুনো মহাসাগৰৰ গান’ ‘-পৰা’ আছে বলে কি একে অপাদান কারক ধরতে হবে?বাক্যটি অবশ্য আমরা বাংলার থেকে অনুবাদ করে নিয়েছি। অসমিয়াতে এমন প্রয়োগ আছে।এবং এই বাক্য অধিকরণের অর্থে অপাদানের পরপদের তির্যক প্রয়োগের নজির বললেই সঠিক বলা হয়।
এই পরপদগুলো জুড়ে যাবে কি না যাবে এটা একটা সমস্যা।গোলোক চন্দ্রের মতে এই “পৰা যিহেতু এটা সুকীয়া অব্যয় পদ,সেইদেখি ইয়াক সম্বন্ধবাচক –অৰ বিভক্তিযুক্ত পদর পরা মাজত ফাঁক রাখি লিখিবো লাগে।”১৩৪ যদি বাণীকান্তের যুক্তি মানি,তবে অসমিয়া ‘পাচৰ’ (বাংলা ‘পরের’) শব্দের রূপান্তর এই ‘পৰা’।অব্যয় হিসেবেও এর স্বতন্ত্র তথা মুক্ত ব্যবহার নেই।তা হলে এই ‘ফাঁক’ কেন?---সে নিয়ে লীলাবতী শইকীয়া বরা প্রশ্ন তুলেছেন।১৩৫ তাঁর মতে এগুলো আনুষঙ্গিক অব্যয় এবং ‘যদি’–র মতো স্বতন্ত্র নয়।“এনেবোর অনুপদ সম্পর্কযুক্ত পূর্বপদর গাতে লগাই লিখাটোহে যুক্তিসঙ্গত।কিয়োনো পৰা,হেতেঁন,চোন,দেখোন,সৈতে,দ্বাৰা,দৰে,নিচিনা আদি অনুপদে পূর্ব পদর সহায় নহ’লে অকলে অর্থ প্রকাশ করিব নোয়ারে।সেই দরে ভবিষ্যত কৃদন্ত করিবলগীয়া,যাবলগীয়া আদিতো বদ্ধরূপ লগীয়াটো ‘কৰিব’-র লগত গাতে লগাই লিখাটো বাঞ্ছনীয়।”১৩৬লীলাবতী শইকীয়া বরা এমনও কিছু নজির দিয়েছেন,যেগুলো ক্রিয়াপদেও জুড়ে।এবং সবক’টি একক পরসর্গ নয়।জটিল বদ্ধরূপিম।যেমন ‘দেখোন’।মূলে যে রূপিমটি √দেখ̖ সেতো স্পষ্ট।তার সঙ্গে ‘-ওন̖’ জুড়েছে।বাংলাতে ‘-ই’ জুড়ে । বাংলা: জ্বরটা কমল না দেখি। অসমিয়া: জ্বৰ নকমিল দেখোন।এই পরপদ না হলেও চলত।জুড়ে দিয়ে ক্রিয়াতে সামান্য জোর দিয়ে বক্তার উদ্বেগটুকু বোঝাচ্ছে।এগুলো স্বার্থিক প্রত্যয়।১৩৭এগুলোও একক বা জটিল রূপে পরপদ বা পরসর্গ হিসেবে শব্দে জুড়ে।জুড়ে যাবে না মুক্ত থাকবে,পরপদ না পরসর্গ হবে সেই বিষয়টি নিয়ে মনে হয় মনে হয় বৈয়াকরণদের বিবাদ করাই বৃথা।সে অনুশাসনের মতো শোনাবে।এগুলো মানুষের অভ্যাসের উপরে ছেড়ে দেয়াই উচিত।‘আহিবা দে,বহিবা দে’ ---এমন ক্রিয়াপদে বহু অসমিয়া ‘-দে’-টুকু বলেনও আলাদা,লেখেনও আলাদা।কখনো বা অনেক বিরতির পরে,আগের কথা যেন মনে করিয়ে দিয়ে শুধুই বলেন-- ‘দে’।‘-দি’ নিজেও অসমিয়াতে পূর্ণ অসমাপিকা শব্দ।এমন বাক্যে এর মুক্ত ব্যবহার আকছার নজরে পড়ে---‘আল্লাৰ নামত কিবা এটা দি দিওক’।এর বাংলা প্রতিরূপ ‘দিয়ে’।লীলাবতী শইকীয়া বরাও কোথাও কোথাও অভ্যাস বশেই সম্ভবত লিখেছেন,‘ঈশ্বৰত বিনে’,১৩৮‘সেই সম্পর্কে,কাম অনুসৰি’।১৩৯বাংলাতেও এমন পরপদগুলো বদ্ধ-মুক্ত বিভাজন করা যাবে।যেমন ‘দ্বারা,জন্য,বই’ এইগুলোর স্বতন্ত্র ব্যবহার নেই।কিন্তু ‘চেয়ে,আগে,কাছে, অপেক্ষা, করে’ এগুলোকে স্বাধীন শব্দ হিসেবেও ব্যবহার করা চলে।যেমন,চেয়ে আছি;আগে এসো ইত্যাদি।বাংলাতেও বদ্ধ পরপদ যে কোথাও কোথাও জুড়ে যায় না,সেরকম নয়।কিন্তু সেসব খুবই কম।যেমন, ‘সেজন্য,তোমাবই’। তারপরেও এটা ঠিক যে অসমিয়াতে জুড়ে যাবার প্রবণতাই অধিক।এবং এই প্রবণতাটির জন্যেই সন্ধির এবং ধ্বনিপরিবর্তনের সূত্র মেনে পরপদগুলো মূলরূপ এমনটাই হারিয়ে ফেলে যে চেনাই কঠিন হয়। ‘-কৈ,-লৈ, দি, -এদি,-ৰে,-এৰে’ বদ্ধ রূপিমগুলোতে তাই হয়েছে। মান বাংলার থেকে মানঅসমিয়ার এগুলো এক বড় তফাত চিহ্ন। আমরা লিখেছিলাম,‘একরেলৈরত̖’-এর কথা,এত দূর এগিয়ে আমরা সংশোধন করে একে লিখতে চাই এইভাবে--অসমিয়া কারকের সবক’টি পরসর্গকে বেঁধে ফেলা যায় এই ধ্বনি গুচ্ছে--‘একদিলৈকৈরত̖’ ।
মান বাংলা ‘-এ,~তে’,অসমিয়া ‘–ত̖,~অত̖’ যেমন করণের অধিকরণের সাধারণ পরসর্গ,সিলেটিতেও তেমনি ‘-ও,~ত̖’ দুই কারকের সাধারণ পরসর্গ।পূর্বাংশ স্বরান্ত হলে ‘-ত̖’, ব্যঞ্জনান্ত হলে ‘-ও’ যুক্ত হচ্ছে।যেমন --- সাতার দিতায় নি নদীত (সু.গা. পা.:পাঁচ) তুমি যে সিলেটো আছলায় কুনু কষ্ট আছিল নি?(সু.গা. পা.: ছয়)।নোয়াখালি চট্টগ্রামীতে স্বরান্ত –ব্যঞ্জনান্ত নির্বিশেষে অধিকরণে ‘-ত̖’-এর ব্যবহার ব্যাপক।যেমন—নোয়া.জামাই আইছে হউর বাড়িত̖ কইতর খাইবার আশে, বাংলা কচুর মুড়া দেই হুডুর হুডুর আঁ́শে।তেমনি আরেকটি—হউরি বউয়ে কতা কইলাম,বিলত̖ কেনে গেল̖? এই ‘বিলত̖’ কিংবা ‘ঘরত̖’,‘মনত̖’ ---অধিকরণের এই সব পদগুলো শোনায় অসমিয়া পদের মতোই।সিলেটিতে বরং পদগুলো হয় এরকম---‘বিলো,ঘরো,মনো’ ইত্যাদি।অধিকরণে এই দুই ভাষাবৈচিত্র্যে ‘-এ’-র ব্যবহারও রয়েছে।যেমন চট্ট.এইয়াঁনে কিল̖লাই আইশ̖শ? রবীন্দ্র দত্ত দুই উপভাষাতেই ‘আঁত̖তে টেঁয়া নাই’ বাক্যের নজির দিয়ে লিখবার চেষ্টা করেছেন,‘র̖+তে’ এই দুই অধিকরণের পরসর্গের যুগ্ম ব্যবহার হয়।১৪০ ‘আঁত̖তে’ মানে হচ্ছে ‘আঁর আ́তে’ (=আমার হাতে )।এত স্পষ্টই সম্বন্ধের ‘-র’ আর অধিকরণের ‘-এ’।‘আঁত̖তে’-র অর্থ ‘আমার কাছে’ লিখেই তিনি বিপাকে পড়েছেন বলেই মনে হচ্ছে।নোয়াখালি, চট্টগ্রামীতে করণে ‘-ত̖’-এর দেখা না মিললেও ‘-এ’ পরসর্গটি রয়েছে আমরা দেখেছি।রবীন্দ্র কুমার দত্ত এই ‘-এ’ অপাদানেও রয়েছে বলে লিখেছেন।যেমন--- চট্ট.বিফ̣দে আফ̣দে রক্ষা কইর̖গে।১৪১কিন্তু এমনটা তো মান বাংলাতেও রয়েছে--- বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা।এগুলো স্পষ্টই অপাদানে অধিকরণের পরসর্গের তির্যক প্রয়োগ।
মান বাংলা এবং অসমিয়ার মতো অধিকরণেও সিলেটিতে অনুপদের ব্যবহার আছে।‘মাজে,বি’তরে,পিছে’ ইত্যাদি। পূর্বপদে তখন সম্বন্ধের ‘-র̖,~অর̖’ যুক্ত হয়। সম্বন্ধের এই পরসর্গগুলো অসমিয়াকে এবং সিলেটি, নোয়াখালি, চট্টগ্রামী সহ পুব বাংলার বহু ভাষাবৈচিত্র্যকে নিকট সম্বন্ধে বেঁধেছে বটে। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিতেও পরসর্গগুলো তাইই। পূর্বাংশ স্বরান্ত হলে ‘-র̖’,ব্যঞ্জনান্ত হলে ‘-অর̖’ হবে।যেমন: তাইর মাজে একজরা বদদিয়ানত নাই;আমার মুড়র ভিতরে চিন্তাপুকে খুদের।কখনো বা এই সব পরপদের শেষেও অসমিয়ার মতো ‘-দি’ (< দিয়া) যুক্ত হয়ে যায়,এবং অসমিয়ার মতোই সেই পরপদের পূর্বাংশে ‘-এ’ জুড়ে যায়।যেমন - মন্দিরর পিছে দি গিয়া সুরমাত ঝাপ দেওন লাগব।(সু.গা. পা.: সতেরো)।স্পষ্ট যে সিলেটিতে এই ‘-দি’ পূর্বাংশে জুড়ে যাবার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।সব মিলিয়ে যে পরসর্গ এবং পরপদগুলো অধিকরণের অর্থ নির্মাণ করছে সেগুলো এই---অর̖+ পিছ̖+এ+দি।অধিকরণে এমন ‘-দি’ জুড়ে দেবার রীতি নোয়াখালি,চট্টগ্রামীতেও রয়েছে।যেমন-- নোয়া.হঁথদি জা̣ওনের শোমে হ্যেতে হ্যেতার̖ মার̣ কথা মতন মুয়রে মিডা কইবার̖ লাই ইগ̖গা হইশার̖ মিডাই কিনি লইল।চট্ট.বাইনদুয়ার দি ন আইশশ তুঁ:́ই নিশির কালে,মা-বাফ̣রে লাগাই দিব মাইনশে দেখিলে।
অধিকরণে “দু-একটি স্থলে ব্যত্যয় ব্যতিত বিভক্তিহীনতার প্রবণতা” নেই বলে লিখেছেন জগন্নাথ চক্রবর্তী।১৪২ মোটের উপরে কথাটি সঠিক।কিন্তু “কালবাচক অধিকরণে বিভক্তিহীনতা”-র কথা লিখেছেন।যেমন-- ‘কাইল আইবায়’, ‘হারাদিন মাছ মারছি’।কিন্তু ‘ কাইলকু আইবায়’,‘হারাদিনকু মাছ মারছি’ –এও যে হতে পারে,সেটি তিনি খেয়াল করেন নি। তাঁরই তুলে দেয়া দুই প্রবচন এরকম—১)কতর ভাংলা ঘরদুয়ার,এলকু তাইন অকৃতদার।২) কাইলকুর জুগি ভাতরে কয় অন̖ন।১৪৩এগুলো মান বাংলা ‘আজকে’,‘কালকে’র মতো।যতটা না কারকের অর্থ বহন করে তারচে বেশি নিশ্চয়ার্থ।তাই এগুলো ছাড়াও মূল শব্দ স্বাধীন ভাবেই অধিকরণের অর্থ বহনে সক্ষম। আবিদ রাজা মজুদার ‘বরাক উপত্যকার কথ্য বাংলার অভিধানে’ ‘এলকু’-র অর্থ লিখেছেন এই---এখন;এ সময়;এ বেলা। ক্রি বিণ। > এই বেলা কু।১৪৪কাইলকু এবং কাইলকুয়া দুই শব্দ রেখেছেন।অর্থ একই---‘কালকে,কল্যদিবসে,কালিকে।’১৪৫ ‘এলকু’ কোথাও বা ‘এবলাকু’,‘এবুলকু’-ও শোনা যায়। আবিদ রাজা মজুমদার তারও উল্লেখ করেছেন।স্পষ্টতই শব্দটি মূলে ‘এবেলাকে’।সম্বন্ধে ‘এবেলাকার’ হতেও অসুবিধে নেই। মান বাংলা কর্ম কারকের ‘-কে’,অসমিয়া ‘-ক’,অসমিয়া অপাদানের ‘-কৈ’ এবং এই সিলেটি কালাধিকরণে ‘-কু’-এর উৎস একই, ---সংস্কৃত √কৃ ধাতু-- এটি প্রায় নিশ্চিত হয়েই লিখতে পারি।ঢাকাইয়াতে এই পরসর্গ হয়ে যায় ‘-ক্যা,~গ্যা’ ---আইজক্যা,আইজগ্যা,কাইলক্যা ইত্যাদি।চট্টগ্রামীতেও সেরকমই হয়।কিন্তু সমীভবনের ফলে খোঁজে মেলা কঠিন হয়। আইজগ্যা > হয়ে যায় আইজ̖জা।প্রতিবেশী বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষাতেও আছে কালাধিকরণে ‘-কা’।যেমন-- গীতিস্বামী গিরকর কথা এহানি এবাকা ফ্যাশনহান ইসে;১৪৬ উহানে যেবাকা আত্মবিষ্মৃতি বারো অন্ধতালো সমাজ এহান নিশ্চিহ্ন অনার পথে সালসিলা।১৪৭ সুধাংশু শেখর তুঙ্গও এই মত সমর্থন করেন।তিনি আরো লিখেছেন,বিষ্ণুপ্রিয়াতে আগেকার,এবাকার (এখনকার),সেবাকার (তখনকার),যেবাকার (যখনকার) ইত্যাদি শব্দও মেলে।১৪৮ এগুলো যে পরস্পর সম্পর্কিত এ নিশ্চিত হয়েই বলা যায়।
কালাধিকরণে ‘-ত̖,~ও’-ও আকছার ব্যবহৃত হয়।আজকাল মান বাংলার প্রভাবে ‘-এ’-ও যুক্ত হচ্ছে।সকালে, বিকালে,দিনো,রাত্রে,আটটাত ইত্যাদি।যেমন- কাইল দিনো বারোটাত আইও।
‘-র̖,-অর̖’ ছাড়াও নোয়াখালিতে ‘-গো’,চট্টগ্রামীতে ‘-অরঅ’ বলে সম্বন্ধের দুই পরসর্গের কথা লিখেছেন রবীন্দ্র কুমার দত্ত।যেমন – নোয়া.আমগো,আঙগো(আমাদের),মাইয়াগো(মেয়েদের);চট্ট.রামর /rɐmɔrɔ/।এগুলো কি আদৌ সম্বন্ধের?না বহুবচনের? ঘটনাগুলো মূলত বহুবচনের সম্বন্ধেই ঘটছে।আর প্রতিবেশী অন্যান্য ভাষাবৈচিত্র্যেও ঘটে থাকে। ঢাকাইয়াতে যেমন-- আমাগো কথাও মইদ্দে মইদ্দে মনে কইরো ।১৪৯ আপাত দৃষ্টিতে এই দুয়েরই মূলে পরপদ ‘গুলি’ এবং ‘সকল’ আছে বলে মনে হয়।পূর্বপদের সঙ্গে মিশে ধ্বনির রূপান্তর এবং লোপের ফলে চেনা অসম্ভব করে তুলে।কিন্তু ‘-গো’ যে ‘-গুলি’ হয়ে না এসে সংস্কৃত √কৃ > কের> সম্বন্ধের ‘-ক’ হয়েও আসতে পারে,এবং ঘুরে ফিরে এটি ‘-র̖’-এর সগোত্রীয় হতে পারে--- সেরকম এক সম্ভাবনার কথা আমরা বচন প্রসঙ্গে লিখেছি।মনেতো হয় ‘-গুন̖’ (< গুলি)-র সঙ্গে মিলে মিশে গিয়ে ‘-গো’ একাধারে বহুবচন এবং সম্বন্ধের অর্থ বহন করছে।এই নিয়ে পরে আমরা আলাদা করে বিস্তৃত আলোচনা করব। কিন্তু চট্টগ্রামীতে ‘রাম সকলের’ কথাটি তো আর এই ভাবে উচ্চারিত হবে না।দাঁড়াবে অনেকটা এরকম---রামহলর̖, রামঅ́লর̖।এই ‘রামঅ́লর’ কয়েকবার দ্রুত উচ্চারণ করলেই দেখা যাবে ‘লো’ লোপ প্রবণতা দেখাচ্ছে,আর ‘-র̖’ ব্যঞ্জনান্ত উচ্চারণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।সুতরাং এভাবে লেখা যেতে পারে,নোয়াখালিতে সম্বন্ধের ‘-র̖’-এর উপরূপ ‘~অর̖, ~গো’ চট্টগ্রামীতে ‘~অর̖,~অরঅ’।
এই অব্দি এসে মান বাংলা ‘কেতের̖’ কিংবা অসমিয়া ‘একদিলৈকৈরত̖’-এর মতো মনে রাখবার সুবিধের জন্যে সিলেটি কারকের পরসর্গগুলোকে তবে আমরা এই সংক্ষিপ্ত ধ্বনিগুচ্ছটির মধ্যে বেঁধে ফেলতে পারি—‘এরেতর̖’।নোয়াখালি চট্টগ্রামীতে করণে ‘-ত̖’ নেই,তাই ক্রম পালটে ধ্বনিগুচ্ছটি হবে—‘এরেরত̖’।বাকি যা কিছু আছে সবই এগুলোর উপরূপ।
পুরুষ:
বাংলাতে পুরুষভেদে নামপদগুলো আলাদা।বদ্ধরূপিম জুড়ে কোনো রূপবৈচিত্র্য দেখা যায় না।সিলেটিতেও তাই। অসমিয়াতেও বিষয়টি মোটের উপরে এক।শুধু কর্তার যদি অন্য কারো সঙ্গে সম্বন্ধ বোঝায় তবে সেই সম্বন্ধপদের পুরুষ অনুযায়ী কর্তারও রূপ পালটে যায়।বিশেষ করে মধ্যম এবং নাম পুরুষে।গোলকচন্দ্র গোস্বামী প্রথম পুরুষকে লিখেছেন ‘নামপুরুষ’ বলে।১৫০ দুই ব্যক্তির সম্পর্কটি হবে বংশগত,বৈবাহিক,কিংবা সখি পাতার মতো কোনো আনুষ্ঠানিক ভাবে গড়ে তোলা। প্রথম পুরুষে কোনো রূপভেদ হবে না।যেমন— মোৰ দেউতা গুৱাহাটিলৈ গ’ল।মধ্যম পুরুষে মান,তুচ্ছার্থে রূপ ভিন্ন। পরসর্গ জুড়ে যথাক্রমে ‘-ৰা,~এৰা’ এবং ‘-ৰ̖,~এৰ̖’।যেমন---তোমাৰ দেউতাৰা গুৱাহাটিলৈ গ’ল।তোৰ দেউতাৰ গুৱাহাটিলৈ গ’ল।নামপুরুষে পরসর্গ জুড়ে ‘-ক̖,~এক̖’।যেমন--তাৰ দেউতাক গুৱাহাটিলৈ গ’ল।যেটি লক্ষ করবার জিনিস,পরসর্গগুলো স্বয়ং কর্তার গঠনভেদ ঘটালেও অর্থভেদ ঘটায় নি,পুরুষটি তার নয় যার সঙ্গে ‘দেউতা’ সম্বন্ধিত সেই ব্যক্তির।কর্তার পুরুষ এসব ক্ষেত্রে নামপুরুষই।তাই ক্রিয়াপদেও কোনো পুরুষ ভেদ নেই।কর্তা কার সঙ্গে সম্বন্ধিত সেটি যদি অনির্দিষ্ট হয় তা হলেও সেই কর্তার সঙ্গে নামপুরুষের সম্বন্ধবোধক পুরুষ পরসর্গ যুক্ত হয়।যেমন- বাপেক আৰু পুতেকৰ মাজত কাজিয়া লগাটো লাজৰ কথা;মাকবোৰ সদায় মৰমিয়াল;বায়েক হ’লে ভায়েকৰ আমনি সহিবই লাগিব।গোলোকচন্দ্র গোস্বামী বেশ সগৌরবেই লিখেছেন,“সম্বন্ধ বুজোয়া শব্দত বিভক্তি লগাই কথা কোয়াটো অসমীয়া ভাষার এটা ডাঙৰ বৈশিষ্ট্য।বঙলা,হিন্দী,মারাঠী, গুজরাটী আদি ভাষাত এনে বিভক্তি দিয়ার নিয়ম নাই।অসমর জনজাতীয় ভাষাবোৰত,অবশ্যে এই নিয়মটো আছে।”১৫১ গ্রিয়ার্সন ভেবেছিলেন এই প্রথাটি তিব্বতবর্মী ভাষার থেকে পেয়েছে অসমিয়া ভাষা।সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘-ৰা,~এৰা’ এবং ‘-ৰ̖,~এৰ̖’ –অজ্ঞাত মূল বলে লিখেও বডোমূলীয় হবার সম্ভাবনাকে একেবারে অস্বীকার করেন নি।১৫২কিন্তু ‘-ক̖,~এক̖’ –কে মনে করেন মাগধী সূত্রে অসমিয়াতে এসে পড়া স্বার্থিক প্রত্যয়।বাণীকান্ত কাকতি মোটের উপরে সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন।তিনি এগুলোকে নিশ্চয়ার্থক পরসর্গ বলেও চিহ্নিত করেন।বিশেষ করে ‘-ৰা,-ৰ̖’ এর উৎস সন্ধানে মধ্য ভারতীয় আর্যের ‘-কেৰ (কেল)’ অব্দি পৌঁছেছেন।১৫৩ কিন্তু অসমিয়াতেই এগুলো থেকে যাবার কারণ হিসেবে বডো প্রভাবের যুক্তিটি তিনি এই বলে নাকচ করেন যে বডোতে সেরকম সর্গগুলো পুরোসর্গ হিসেবেই যুক্ত হয়।বরং অস্ট্রোএশিয় কিছু ভাষাতে এরকম পরসর্গের নজির আছে।তিনি মুণ্ডা ভাষার কিছু নজির দিয়ে লিখেছেন,“ এঙ্গা-ঞ̖,মোৰ আই;এঙ্গা ত̖ তাৰ মাক,কিন্তু মাতৃ অর্থত এঙ্গা কেতিয়াবাহে অকলে হয়।”১৫৪ অবশ্য কথাগুলো তিনি গ্রিয়ার্সনেরই ভারতের ভাষা সমীক্ষা গ্রন্থের চতুর্থ খণ্ডের থেকে তুলে দিয়েছেন।সেখানে আরো লেখা আছে,“Many words denoting relationship are always combined with personal suffixes,viz.,n͂ for the first, m for the second and t for the third person.”১৫৫ লীলাবতী শইকীয়া বরাও এগুলোর বডো উৎস অস্বীকার করতে গিয়ে বেশ বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।বডোতে এমনটা হলেও সর্গগুলো পুরোসর্গ হিসেবে যুক্ত হয়।বডোতে বাবা মানে হচ্ছে ফা।এর আগে ‘-বি’ যোগ করলে পুরুষ ভেদ হয় না।শুধু অন্যের বাবা বোঝাচ্ছে এটা বোঝা যায়।যেমন-- আংনি বিফা---আমার বাবা;নৗংনি বিফা---তোর বাবা;বি বিফা –তার বাবা।এমনি করে তিনি রাভা,গারো আদি ভাষারও বেশ কিছু নমুনা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন অসমিয়ার সঙ্গে এগুলো ঠিক মেলে না।তিনিও এগুলোকে বাণীকান্ত কাকতির অনুসরণে অস্ট্রিকমূলীয় ভাষার প্রভাব বলে মনে করেন।মনে হয় এই সিদ্ধান্তই সঠিক।
।। ক্রিয়ারূপ (Conjugation)।।
নামশব্দমূলের মতো ক্রিয়াশব্দমূলেরও তিনরূপ।পরম্পরাগত ব্যাকরণে ক্রিয়ার মূলকে ধাতু বলে।সংস্কৃত ব্যাকরণে এদের ক্রিয়া-প্রকৃতিও বলে।
১) একটি মাত্র মুক্তরূপিমে তৈরি ধাতুকে মৌলিক ধাতু বলে।যেমন-- করˎ,খা ইত্যাদি।
২) একটি মুক্তরূপিম তথা ধাতু,নামশব্দ,অনুকার শব্দের সঙ্গে এক বা একাধিক বদ্ধ রূপিম যুক্ত করে তৈরি
ধাতুকে জটিল ধাতু বলে।যেমন-- ভাঙ̖+ আ= ভাঙা,খেল+আ=খেলা ইত্যাদি।
৩) একাধিক মুক্তরূপিম যোগ করে তৈরি হয় যৌগিক ধাতু।যৌগিক ধাতুর পূর্ব রূপিমটি জটিল ধাতুর মতো
বিশেষ্য,বিশেষণ বা ধ্বন্যাত্মক শব্দ হতে পারে। যেমন-- গান+ করˎ,দয়া+করˎইত্যাদি।
পরম্পরাগত ব্যাকরণে এদের ক্রমান্বয়ে সিদ্ধ ধাতু,সাধিত ধাতু এবং সংযোগমূলক ধাতুও বলে।তবে যৌগিক বা সংযোগমূলক ধাতু যেহেতু একাধিক শব্দে তৈরি হয় এবং ক্রিয়া হবার জন্যে দরকারি পরসর্গগুলো পরের অংশেই যুক্ত হয়, তাই অনেকে একে আলাদা ধাতু বলে মানতে নারাজ।মৌলিক এবং জটিল বা সিদ্ধ এবং সাধিত বাংলা ধাতুর এই দুই ভাগই স্বীকার করেন।পবিত্র সরকারের মতে সিদ্ধ ধাতু মাত্রেই একাক্ষর,সাধিত ধাতু বহ্বক্ষর।১৫৬
বাংলাতে ধাতুর রূপবৈচিত্র্য সম্ভব করে তিনটি বিষয় বা ব্যাকরণিক সংবর্গ।আমরা আগেই লিখেছি,ভাব,পুরুষ এবং কাল।অন্যান্য ভাষাতে বচন- লিঙ্গেরও কিছু ভূমিকা থাকে।কারক সম্পূর্ণতই নামরূপের বিষয়।
ভাব:
ভাব দিয়ে ক্রিয়াপদে বর্ণিত কাজটি কীভাবে হয় তাই বোঝানো হয়।কথাটি যে বলছে বা লিখছে তার মনোভাবটি ধরা পড়ে ‘ভাবে’।বৈদিকে ভাব ছিল পাঁচটি: ১) নির্দেশক,২)অনুজ্ঞা,৩)নির্বন্ধ,৪)সম্ভাবক বা অভিপ্রায়,৫)বিধিলিঙ।সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের মতে বাংলাতে ভাব তিনটি। ১)নির্দেশক বা বিবৃতিমূলক,২)নিয়োজক বা অনুজ্ঞা,৩)সংযোজক বা অপেক্ষিত (বা সম্ভাবক বা অভিপ্রায়)।সেই বিভাজন অর্থের দিক থেকে,গঠনগত বিচারে তথা রূপবৈচিত্র্যের দিক থেকে বাংলাতে ভাব রয়েছে আসলে দু’টি।১) নির্দেশক এবং ২)নিয়োজক।অর্থ বিচারে তিন ভাবের তিন বাক্য তুলনা করলে কথাটা স্পষ্ট হবে।
১) নির্দেশক বা বিবৃতিমূলক: সে পড়ে।
২) নিয়োজক বা অনুজ্ঞা: সে পড়ুক̖।
৩) সংযোজক বা অপেক্ষিত: সে যদি পড়ে, তবে আমি পড়ব।
এই তিন বাক্যে স্পষ্ট যে শেষটি যৌগিক বাক্য বটে,অর্থাৎ একাধিক বাক্যের সমাহার।কিন্তু সেই বাক্যগুলোর গড়ন নির্দেশক বাক্যের মতো,দুইয়ে মিলে একটা অপেক্ষিতের বা সম্ভাবকের অর্থ বহন করে।কিন্তু দুই বাক্যেরই ক্রিয়াপদ দুটির রূপ নির্দেশকেরই মতো।তাই বাংলাতে ভাব দু’টি।নির্দেশকে সাধারণ তথ্য নির্দেশ করে,নিয়োজকে অন্যে কাজটি করবে তার জন্যে ইচ্ছে প্রকাশ করা হচ্ছে বা তাকে আদেশ,হুমকি ইত্যাদি দেয়া হচ্ছে।তা করতে গিয়ে ‘-ও,~উক̖,~উন̖’ আদি পরসর্গ যোগ করা হচ্ছে ধাতুর সঙ্গে।পড়ুক শব্দে যেমন = √পড়+উকˎ।‘-উন̖’ সম্ভ্রমার্থে ব্যবহৃত হয়।কিন্তু বাংলাতে বহু সময় নির্দেশক নিয়োজকেও তফাত রাখা হয় না।নিয়োজক ভাবেও নির্দেশকের ক্রিয়ারূপ ব্যবহৃত হয়।যেমন নির্দেশক: তুমি কাল যাবে,শুনলাম।নিয়োজক: তুমি কাল যাবে,নইলে দেখে নেব।প্রথমটি তথ্যবিবরণ মাত্র,দ্বিতীয়টি রীতিমত হুমকি।কিন্তু ‘যাবে, নেব’ দুই ক্রিয়ারূপ দেখে তফাত করবার উপায় নেই।সমগ্র বাক্যেই অর্থটি স্পষ্ট হয়।ক্রিয়ারূপে নয়।অনুজ্ঞাতে উত্তম পুরুষ এবং অতীত কালের কোনো রূপ হয় না।মধ্যম পুরুষে এমনিতেই নির্দেশকের সঙ্গে রূপের তফাত করা কঠিন হয়।বাক্যের স্বরাঘাতে অর্থটি বোঝা যায়।
অসমিয়াতেও বাংলার মতোই ভাব এই দু’টিই। নির্দেশক এবং অনুজ্ঞা।১৫৭
১) নির্দেশক: সি পঢ়ে
২) অনুজ্ঞা: সি পঢ়ক̖।
সংযোজক বা অপেক্ষিত ভাবের স্বতন্ত্র কোনো রূপ অসমিয়াতেও নেই।লীলাবতী শইকীয়া বরা লিখেছেন,“ক্রিয়ার ছর্ত সাপেক্ষতা হৈছে সম্ভাব্য অতীত কাল (conditional tense)”১৫৮ কাল নিয়ে আলোচনাতে প্রসঙ্গটি স্পষ্ট হবে।সম্ভাব্য ভবিষ্যতই নয় কেন? –এই তর্কও রইল।তবে তাঁর কথার থেকে স্পষ্ট--- বাংলার মতো এগুলোরও রূপ নির্দেশকের মতো একই,“কোনো কোনোয়ে সম্ভাব্য অতীত আরু নিমিত্তার্থক ক্রিয়া বুজুয়া রূপবোরকো ক্রিয়াপদর ভাব (mood)বুলি ক’ব খোঁজে।দরাচলতে সেই দুয়োবিধ ক্রিয়াপদর একোটা ভাগহে।প্রথমটোয়ে ক্রিয়ার ছর্তসাপেক্ষতা আরু দ্বিতীয়টোয়ে নিমিত্ত অর্থ প্রকাশ করে।নিমিত্তার্থক ক্রিয়া অসমাপিকা ক্রিয়ারে এটা রূপ।”১৫৯
সিলেটিতেও ভাব এই দু’টিই।রূপবৈচিত্র্যও মান বাংলা এবং অসমিয়ার মতো।
১) নির্দেশক: হে পড়ে
২) অনুজ্ঞা: হে পড়উক̖।
স্বাভাবিক ভাবেই কর্তার মধ্যম এবং প্রথম পুরুষে মান্য-তুচ্ছার্থ বিভাজন বাংলাতেও হয়,অসমিয়াতেও হয়।কিন্তু অসমিয়াতে প্রথম পুরুষের অনুজ্ঞাতে মান্য-তুচ্ছার্থেও ভেদ একই,‘-অক̖,~ওক̖’।যেমন---তেওঁ পঢ়ক̖,তেখেতে পঢ়ক̖। বাংলাতে কিন্তু ভিন্ন।যেমন--- সে পড়ুক̖,তিনি পড়ুন̖।সিলেটিতেও ভিন্ন।প্রথমটিতে কেবল অপিনিহিতি হচ্ছে।দ্বিতীয়টিতে ‘-উক̖’-এর পরে আবার একটি ‘-কা’ যুক্ত হচ্ছে।আসলে যুক্ত হয় ‘–আ’,আতে আগেকার ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব হয়ে যায়।যেমন—হে পড়উক̖,তাইন পড়উক্কা।সম্ভ্রমার্থে মধ্যম এবং প্রথম পুরুষের ক্রিয়াপদের রূপ বাংলাতেও একই।যেমন---আপনি করুন̖,তিনি করুন̖। অসমিয়াতেও একই।যেমন-- আপুনি পঢ়ক̖, তেখেতে পঢ়ক̖। সিলেটিতে কিন্তু ভিন্ন। যেমন ---আপনে পড়ইন̖,তাইন পড়উক্কা।মধ্যম পুরুষে তুচ্ছার্থে বর্তমান কালে বাংলা অসমিয়া দুই ভাষারই ক্রিয়ারূপে কোনো পরসর্গই যোগ হয় না।যেমন বাংলা---তুই পড়̖।অসমিয়া-তই পঢ়̖।সিলেটিতেও তাই।যেমন—তুই পড়̖।কিন্তু মান কর্তার ক্রিয়ারূপে হয়,ভবিষ্যতের তুচ্ছার্থেও পরসর্গ যোগ হয়।যেমন বাং.তুমি পড়ো,অস.তুমি পঢ়া,সিল.তুমি পড়ো;বাং.তুই পড়̖বি,অস.তই পঢ়িবি,সিল.তুই পড়̖বে। এগুলো রূপের দিক থেকে নির্দেশক।লীলাবতী শইকীয়া বরা লিখেছেন,“...-আ বিভক্তিও দেখাত নির্দেশক ভাবর দরে।সেই দরে ভবিষ্যৎকালর –ইবি/-বি আরু –ইবা/-বা বিভক্তিও দেখাত নির্দেশক ভাবর দরে।”১৬০তিনি আরো লিখেছেন,“কেতিয়াবা অনুজ্ঞার দ্বিতীয় পুরুষর রূপর পাছত চোন̖ আরু দেই ব্যবহার করি আদেশ বা অনুরোধর অর্থ বেশি স্পষ্ট করা হয়।”১৬১ যেমন-- তুমি কামটো কৰাচোন,তুমি এতিয়া যোৱাদেই।এসব বাংলাতেও হয়।যেমন--- তুমি কাজটা করোতো,তুমি এখন যাওহে।সিলেটিতেও—তুমি কাজটা করোচাইন।তুমি অখন যাওবা।অসমিয়া ‘-চোন̖’ আর সিলেটি ‘-চাইন̖’-এর নৈকট্য লক্ষ করবার মতো।‘গিয়ে’ অনুপদটিতো মান বাংলা এবং অসমিয়া দুয়েতেই জুড়ে।যেমন--তুমি এখন করো গিয়ে/গে;তুমি এতিয়া কৰাগৈ।সিলেটিতে ---তুমি অখন করগি।কিন্তু নোয়াখালি,চট্টগ্রামীতে এই অনুপদ অসমিয়ার সঙ্গে হুবহু এক—করগ̖গই। বাংলাতে এবং সিলেটিতে কিন্তু অধিকাংশ সময় তার জন্যে স্বতন্ত্র শব্দ,এমনকি এক শব্দের বাক্যও জুড়ে দেয়া হয় পরে। যেমন: তুমি এখন যাও দেখি।কিংবা তুমি এখন যাও।কেমন? সিলেটিতে—তুমি অখন যাও,কেমন?এসব ভাবরূপ গঠনের বাধ্যবাধকতার অংশ নয়,বক্তার মন –মানসিকতা এবং পরিবেশের অভিব্যক্তি।
ভাব চট্টগ্রামী-নোয়াখালিতেও এই দু’টোই।এবং অনুজ্ঞার পরসর্গ ‘-অ,~অক̖,~এন̖’ ইত্যাদি।যেমন চট্টগ্রামীতে
১) নির্দেশক: হিতে ফ̣রে
২) অনুজ্ঞা: হিতে ফ̣রক̖ /ফ̣রউক̖
সিলেটিতে যে পরসর্গগুলো যুক্ত হয় সেগুলোও মান বাংলারই কাছাকাছি।অনুজ্ঞাতে মান বাংলাতে যেখানে পরসর্গ হচ্ছে ‘-ও,-উক̖,-উন̖’,সিলেটিতে হচ্ছে ‘-ও,-অউক̖,-অইন̖’।অসমিয়াতে সেখানে সামান্য অন্যরকম-- ‘-আ,-অক̖’ ইত্যাদি। নোয়াখালি,চট্টগ্রামীতে ‘-অক̖’ পরসর্গটি অসমিয়ার মতো একই,কিন্তু বিকল্পে ‘-উক̖’ ও রয়েছে।
কিন্তু মান বাংলা এবং সিলেটিতে ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞার আরেকটি স্বতন্ত্র রূপ আছে।যাতে সাধারণ আগ্রহ বা আমন্ত্রণ বোঝায় যার মান,সাধু বাংলা এবং সিলেটি কোনোটিতেই সাধারণ,তুচ্ছ এবং সম্ভ্রমার্থে এবং সব ধাতুতে নিয়মিত স্বতন্ত্র রূপ নেই।যেমন-- মধ্যম পুরুষ সাধারণ -- পড়ো < সাধু বাংলা পড়িও = সিলেটি পড়িও।তুচ্ছার্থে --- পড়িস̖ = সাধু বাংলা পড়িস̖= সিলেটি পড়িছ̖। মান বাংলা সাধারণ রূপটি দৃশ্যত এখানে মনে হচ্ছে নিত্য বর্তমানের রূপ।কিন্তু √যা বসালেই বোঝা যাবে কাজটি ভবিষ্যতে করতে বলা হচ্ছে।যেমন--- আমাদের বাড়ির কিন্তু তোমরা সবাই যেও (সাধু---যাইও,সিলেটি—যাইও)।তেমনি তুচ্ছার্থে নিত্যবর্তমানে সিলেটি √পড়̖ ধাতুর ক্রিয়া পদের রূপটি হচ্ছে ‘পড়ছ̖’। বর্তমান অনুজ্ঞার রূপটি হচ্ছে ---‘পড়̖’।যেমন—মান বাংলা নিত্য বর্তমান--- তুই দেখেছি,রোজ এই একটাই বই পড়িস̖।বর্তমান অনুজ্ঞা—‘সুরমা গাঙর পানি’ আর ‘সরাই ঘাট’ উপন্যাস দুটো পড়̖।ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞার বিকল্প রূপ —সময় পেলে কখনো ‘সুরমা গাঙর পানি’ আর ‘সরাই ঘাট’ উপন্যাস দুটো পড়িস̖।ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞার নিয়মিত রূপ --- তুই কাল থেকে এই বই দুটো পড়̖বি।সিলেটি নিত্য বর্তমান ---তুই দেখিয়ার,রোজ অউ একটাউ বই পড়ছ̖।বর্তমান অনুজ্ঞা ---‘সুরমা গাঙর পানি’ আর ‘সরাই ঘাট’ উপন্যাস দুইটা পড়̖।ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞার বিকল্প রূপ ---হময় পাইলে কুনুসময় ‘সুরমা গাঙর পানি’ আর ‘শরাই ঘাট’ উপন্যাস দুইটা পড়িছ̖।ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞার নিয়মিত রূপ—কাইলতনে ঔ বই দুইটা পড়̖বে।
পুরুষ বা পক্ষ:
পুরুষ দিয়ে মূলত বাক্যের কর্তার প্রকার ভেদ বোঝানো হয়।অর্থাৎ যে ক্রিয়াটি সম্পন্ন করে।যে বলছে,কাজটি সে করলে কর্তার উত্তম পুরুষ,দ্বিতীয় কেউ করলে মধ্যম পুরুষ,তৃতীয় কেউ করলে প্রথম পুরুষ।এখন,একে যে আবার আলাদা করে ‘পুরুষ’ কেন বলা হচ্ছে,এই প্রশ্ন কাউকে করতে দেখি না।বোঝা যায় ‘নারী’র ভূমিকা গৌণ ছিল যে সমাজে সেখানেই এই পরিভাষা সম্ভব।আমরা তাঁর বদলে ‘পক্ষ’ শব্দটি ব্যবহারের পক্ষে।বাংলাদেশে সরকারীভাবেই স্কুলপাঠ্যবইগুলোতে এই পারিভাষিক শব্দটি গ্রহণ করা হয়েছে।১৬২পবিত্র সরকারও একে গ্রহণ করেন।১৬৩ সমগ্র ব্যাকরণ কৌমুদীতে শুধু এইটুকুনই বলা আছে যে অস্মদ শব্দে উত্তম পুরুষ,যুস্মদ শব্দে মধ্যম পুরুষ,বাদবাকি সব প্রথম পুরুষ।‘অস্মদ্যুত্তমঃ’,‘যুস্মদ্যুপপদে সমানাধিকরণে স্থানিন্যপি মধ্যমঃ’,‘শেষে প্রথমঃ’১৬৪উত্তম মধ্যমের পরে ‘অধম’ শব্দটিই স্বাভাবিক ভাবে মনে আসে।সম্ভবত কাউকে অপমানিত করতে না চেয়ে পাণিনি ‘প্রথম’ শব্দটি বেছে নিয়েছেন,অথচ যুক্তি বলে ইংরেজির মতো তৃতীয় পুরুষ (third person)বললেই সঙ্গত হতো।অসঙ্গতিটির কথা মনে রেখেই বাংলাদেশের স্কুলপাঠ্য বইতে একে বহু আগে থেকেই ‘নামপুরুষ’ বলা হতো।১৬৫গোলকচন্দ্র গোস্বামী অসমিয়াতেও একে ‘নামপুরুষ’ লিখেছেন।বাকি দুটিকে ‘উত্তম’ এবং ‘মধ্যম’। আর সত্য বটে,উত্তম এবং মধ্যমপুরুষে কর্তা সর্বনাম হলেও ‘প্রথম’ পুরুষেই বিশেষ্যেরও প্রবেশাধিকার ঘটে।যেমন-- রাম ভাত খায়।বিশ্বেশ্বর হাজরিকা বাণীকান্তের অনুবাদ করতে গিয়ে১৬৬এবং লীলাবতী শইকীয়া বরা তাঁর বইতে১৬৭ উত্তম,মধ্যম,নামের বিপরীতে ‘প্রথম,দ্বিতীয়,তৃতীয়’ পুরুষ কথাগুলো ব্যবহার করেছেন।অসমিয়া মাধ্যমের স্কুলপাঠ্যবইগুলোও এমন বিভাজনের প্রচলন করেছে।পবিত্র সরকার আমি পক্ষ,তুমি পক্ষ,তুই পক্ষ,সে পক্ষ,এবং গুরুপক্ষ-- এই পাঁচ বিভাজনের প্রস্তাব করেন।তুচ্ছার্থ-সম্ভ্রমার্থকে ধরলে পক্ষ এই পাঁচটিই বটে।তবে কিনা নামগুলো সব ভাষা কিংবা ভাষাবৈচিত্র্যে গ্রহণযোগ্য করে তোলা কঠিন আছে।অসমিয়াতেই ‘সেপক্ষ,গুরুপক্ষে’ ক্রিয়াপদের রূপভেদ হচ্ছে না আমরা দেখাবো।‘আমি,তুমি,তুই,সে’ মান বাংলার সর্বনাম।অথচ ‘গুরু’ হচ্ছে বিশেষ্য।এখানেই অসঙ্গতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।আর ‘সে’ বললে মানুষই বোঝায়,অথচ ‘সে-পক্ষে’ যে শুধু মানুষই হবে এমন কোনো কথা নেই।মানবেতর প্রাণী বা বস্তুকেও বোঝাতে হবে।আরেকটি বিকল্প প্রস্তাব আছে বাংলাদেশের।২০১৩ থেকে বাংলাদেশের যে পাঠ্যপুস্তকগুলো পুরুষকে ‘পক্ষ’ বলছে,বলে আমরা লিখে এলাম, সেখানে তিন পক্ষ নাম দিয়েছেন তারা এই ভাবে --- বক্তা পক্ষ, শ্রোতা পক্ষ এবং অন্য পক্ষ।আমাদের মনে হয় এই বিভাজনই অনেক অসঙ্গতিমুক্ত।আমরা এই তিনটিকেই গ্রহণ করবার পক্ষে।পরম্পরাগত বাংলা ব্যাকরণে এবং ভাষাতত্ত্বের বইগুলোতেও পুরুষের তথা পক্ষের আলোচনা সাধারণত নামপদের রূপভেদ প্রসঙ্গেই আলোচিত হয়ে থাকে যদিও লক্ষ করলেই দেখা যাবে সেসব রূপবৈচিত্র্যের জন্যেও মূলত কারক,বচনের জন্যেই সম্ভব হয়ে থাকে।অন্যথা,প্রতি পক্ষে নামপদ আলাদা,যেমন আমি,তুমি,সে,এ –ইত্যাদি।অসমিয়াতে – মই,তুমি,সি,ই –ইত্যাদি।অসমিয়াতে সম্বন্ধ পদের পক্ষ অনুসারে কর্তার কখনো রূপবদল হলেও,সেই পরিবর্তিত কর্তার পক্ষ আরো স্পষ্টভাবেই ‘অন্য’ থাকে।যেমন-- তাৰ দেউতাক গুৱাহাটিলৈ গ’ল̖।‘মই’ বা ‘তুমি’ কর্তা এই কাজ করেনি।‘তাৰ̖ দেউতাক̖’-এই কর্তাকে শুধু ‘তেঁও’ বা ‘তেখেত̖’ সর্বানামই প্রতিস্থাপিত করতে পারে।
প্রত্যক্ষভাবে পক্ষের জন্যে বাংলাতে কেবল ক্রিয়ারূপই তাদের চেহারা পাল্টায়।যেমন-বক্তা পক্ষে ‘যাই’,শ্রোতা পক্ষে ‘যাও’,অন্য পক্ষে ‘যায়’।অসমিয়াতেও তাই।যেমন- বক্তা পক্ষে ‘যাওঁ’,শ্রোতা পক্ষে ‘যোৱা’,অন্য পক্ষে ‘যায়’।সিলেটিতে, নোয়খালি,চট্টগ্রামীতে,ঢাকাইয়াতেও এই ক্রিয়াপদগুলো মান বাংলার মতো একই।কর্তার অসমিয়া-বাংলাতে এবং সিলেটি সহ বাংলার সব ভাষাবৈচিত্র্যে শ্রোতা এবং অন্য পক্ষে তুচ্ছার্থে এবং সম্ভ্রমার্থে আরো দুই রকমফের থাকে।বিশেষ করে সর্বনামে তার জন্যে দুই ভাষাতেই স্বতন্ত্র রূপই আছে,বাংলা ‘তুই,আপনি,তিনি ইত্যাদি’,অসমিয়া ‘তই,আপুনি,তেঁও বা তেখেত’, সিলেটি ‘তুই,আপ̖নে,তাইন̖’।নোয়াখালিতে ‘তুই,আম̖নে,তাইন̖ /হ্যেতিন̖ /হিতাইন̖’,চট্টগ্রামীতে ‘তুই,অ́নে,তাঁই’।এরই সঙ্গে সঙ্গতি রেখে -ক্রিয়ারও তাই আরো দুই রূপ হয়---শ্রোতা পক্ষে বাংলাতে ‘যাস̖’,শ্রোতা এবং অন্য পক্ষে ‘যান̖’; অসমিয়াতে ‘যাঅ’,শ্রোতা এবং অন্য পক্ষে ‘যায়’;সিলেটি –শ্রোতা পক্ষে ‘যাছ̖’,শ্রোতা এবং অন্য পক্ষে যাইন̖।নোয়াখালিতে ‘-স̖ ,~অস̖’, চট্টগ্রামীতে ‘-শ̖,~অশ̖’।যেমন--- করস̖,করশ̖।সম্ভ্রমার্থে শ্রোতা ও অন্য পক্ষে নোয়াখালিতে ‘-এন̖’,চট্টগ্রামীতে ‘-অন̖’ জুড়ে। যেমন – নোয়া.করেন,চট্ট.করন̖,গরন̖।নোয়াখালি-চট্টগ্রামী রূপগুলো রবীন্দ্র কুমার দত্ত √কর̖ ধাতুতে দেখিয়েছেন। নোয়াখালিতে,বিশেষ করে চট্টগ্রামীতে বিচিত্র ধ্বনিপরিবর্তন হয়ে থাকে বলে √যা ধাতুতে পক্ষ বোঝাবার কাজটা যদিওবা করে ফেলতে পারি,পরে সব কালে পদগুলো পুনর্নির্মাণে আমরা অক্ষম।তাই রবীন্দ্র দত্তের নজিরগুলোই আমাদেরও আশ্রয়। তার উপরে পুরুষ নিয়ে তিনি আলাদা আলোচনাও করেন নি,কাল প্রসঙ্গেই রূপবৈচিত্র্যগুলো দেখিয়েছেন।১৬৮আমাদের সেখান থেকেই পুরুষ পরসর্গগুলোকে আলাদা করে চিনে নিতে হচ্ছে।এগুলোকে সাজালে দাঁড়াবে এরকম চিত্র ০১-এর মতো।
দেখা যাচ্ছে,অসমিয়াতে অন্য পক্ষে মান্য,তুচ্ছার্থ আদিতে ক্রিয়ার কোনো রূপভেদ হচ্ছে না।এবং সিলেটি সহ অন্যান্য ভাষা-বৈচিত্র্যগুলো মোটের উপর বাংলা রীতিই অনুসরণ করছে। শ্রোতা এবং অন্যপক্ষে সম্ভ্রমার্থে পরসর্গ একই
থাকছে।শুধু নোয়াখালিতে স্বল্প শিক্ষিতেরা কখনো বা অন্য পক্ষের ক্রিয়াতে সামান্য সম্ভ্রমার্থে তফাত করেন না।‘হ্যেতে’ এবং ‘হেতিন̖’ দুইয়ের পরেই ‘করে’ বলেন।√যা মুক্তরূপিম তথা ধাতুর পরে বাংলাতে পক্ষ-ক্রম ধরে এই ক’টি বদ্ধ রূপিম যুক্ত হচ্ছে ‘-ই,-ও,-য়,-স̖,-ন̖’।অসমিয়াতে যুক্ত বদ্ধ রূপিম হচ্ছে -- ‘-ওঁ (-ও),-ওৱা,-য়,-অ’।সিলেটি বদ্ধ রূপিমগুলো হচ্ছে -- ‘‘-ই,-ও,-য়,-ছ̖,-ইন̖’।√কর̖ ধাতুর পরে নোয়াখালিতে – ‘-ই,-অ,-এ,-স̖,-এন̖’ এবং চট্টগ্রামীতে যুক্ত বদ্ধ রূপিমগুলো হচ্ছে –‘-ই,-অ,-এ,-শ̖,-অন̖’।আর যা কিছু রূপবৈচিত্র্য নজরে পড়ে পূর্বাংশের ধ্বনির প্রভাবে।যেমন বাংলাতে √কর+ই,-ও,-এ,-০,-এন̖।
কিন্তু পক্ষ অনুসারে ক্রিয়ার এই রূপভেদের কথাটি সামান্য জটিল,এতটা সরল নয়। লক্ষ করলেই দেখা যাবে যে নজিরগুলো আমরা দিলাম,তার সবক’টিই আসলে সাধারণ বা নিত্য বর্তমানের।কাল পালটালেই এদের পক্ষ বোঝাবার পরসর্গগুলোও পালটে যাবে।বাংলাতেও নিত্যবৃত্ত(বা অভ্যাসগত) অতীতে ‘যাই’ হয়ে যাবে ‘যেতাম̖’।যেমন—আমি যেতাম̖। সাধারণ(বা অনির্দিষ্ট)ভবিষ্যতে শব্দটি হয়ে যাবে ‘যাব’।যেমন-- আমি যাব।অসমিয়া এবং সিলেটিতেও সেরকম পালটে যায়।দেখা যাবে,প্রায় প্রতিটি কালে পক্ষভেদে ক্রিয়ার পরসর্গগুলো পালটে পালটে গিয়ে একাধারে কর্তার পক্ষের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করছে।সেগুলোকে ধরলে অসমিয়া এবং বাংলাতে পক্ষ বোঝাবার পরসর্গ অনেক।পক্ষভেদে ‘-এতাম,-এতে,-এতো’এই তিনটি পরসর্গকেই নেয়া যাক।দেখা যাবে,সাধারণ অংশটি হচ্ছে ‘-এত̖’।পক্ষভেদ বোঝাতে যুক্ত হচ্ছে ‘-আম,-এ,-ও’। স্পষ্ট যে ‘-এত̖’ হচ্ছে নিত্য অতীত বোঝাবার পরসর্গ।পক্ষের এই বৈচিত্র্যের কথা মনে রেখেই জগন্নাথ চক্রবর্তী ‘ক্রিয়াবিভক্তি’ দেখাতে গিয়ে ‘পুরুষ’ বৈচিত্র্যে জোর দিয়েছেন।এবং একটি ছকে বিস্তৃত দেখিয়েছেন।১৬৯কিন্তু সেগুলোর মধ্যেকার সাদৃশ্য এড়িয়ে গেছেন,কিংবা বিভক্তির কোন অংশটির জন্যে কাল পালটে যাচ্ছে সেটি বোঝা যাচ্ছে না।ফলে সামান্য বেশিই বৈচিত্র্য দেখিয়ে ফেলেছেন বলে আমাদের মনে হয়েছে।তাঁর ছক গুনলে সেই সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৮৮ বা তার বেশি।রবীন্দ্র কুমার দত্তও অনেকটা তাইই করেছেন।এত ভয় পাবার মতো সংখ্যাটি নয়,আমরা দেখাব।তবে,কালের রূপভেদ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না করে তাই পক্ষের সব ক’টি পরসর্গ চিহ্নিত করে দেখানো কঠিন।
কাল:
ক্রিয়ার রূপনিয়ন্ত্রণে যেকোনো ভাষাতেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কাল।বাংলা,অসমিয়াও ব্যতিক্রম নয়। সংস্কৃতে ক্রিয়ার ছটিকাল ছিল লট,লঙ,লুঙ,লিট,লৃট এবং লৃঙ।এর প্রথমটি বর্তমান,পরের তিনটি অসম্পন্ন,অনির্দিষ্ট,এবং সম্পন্ন অতীত,পঞ্চমটি ভবিষ্যৎ এবং একেবারে শেষেরটি সম্ভাব্য অতীত।বাংলাতে কাল কত প্রকার এই নিয়ে তর্ক আছে।সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়১৭০,সুকুমার সেনরা১৭১ বাংলাতে কালকে প্রথমেই দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন সরল বা মৌলিক কাল এবং মিশ্র বা যৌগিক কাল বলে।তারপরে বহু ভাষাবিদ এই বিভাজনকে প্রশ্ন না করেই মেনে নিয়েছেন। রামেশ্বর শ’ এই বিভাজন অস্বীকার করেছেন।কিন্তু যেহেতু প্রথম দু’জনার অভিমত জনপ্রিয় এবং অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত তাই আমাদের পক্ষেও সোজা ডিঙিয়ে যাওয়া সমীচীন হবে না।একটি মাত্র ধাতুতে পরসর্গ যোগ করে যখন ক্রিয়া তৈরি হয়,যেমন -- √যা+ই= যাই,---তখন তাকে সরল কাল বলে।
সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের মতে সরল কাল চারটি:
১) সাধারণ (বা নিত্য,বা অনির্দিষ্ট) বর্তমান।যেমন –আমি যাই।
২) সাধারণ (বা অনির্দিষ্ট) অতীত।যেমন-আমি গেলাম।
৩) নিত্যবৃত্ত (বা অভ্যাসগত) অতীত।যেমন—আমি যেতাম।
৪) সাধারণ (বা অনির্দিষ্ট) ভবিষ্যৎ।যেমন--- আমি করব।
যখন একাধিক ধাতুতে মিলে একটি ক্রিয়াপদ তৈরি হয় তখন তাকে বলে যৌগিক কাল।যৌগিক কালের প্রথম ধাতুতে ‘-এ,~ইয়া’ এবং ‘-তে,~ইতে’ যোগ করে অসমাপিকা রূপ দেয়া হয়,তার সঙ্গে √আছˎ বা √থাকˎধাতু জুড়ে সেই ‘আছ̖,~থাক̖’-এর সঙ্গে কাল এবং পুরুষবাচক পরসর্গ তথা বিভক্তি জোড়া হয়।
যৌগিক কালের দশ রূপ:
১) ঘটমান বর্তমান।যেমন –আমি যাচ্ছি (=যাইতেছি)।
২) ঘটমান অতীত।যেমন—আমি যাচ্ছিলাম (=যাইতেছিলাম) ।
৩) ঘটমান ভবিষ্যত।যেমন—আমি যেতে থাকব (=যাইতে থাকিব)।
৪) পুরাঘটিত বর্তমান।যেমন –আমি গিয়েছি (=গিয়াছি)।
৫) পুরাঘটিত অতীত।যেমন –আমি গিয়েছিলাম (= গিয়াছিলাম)
৬) পুরাঘটিত ভবিষ্যত এবং সম্ভাব্য অতীত।যেমন ---আমি গিয়ে থাকব (= গিয়া থাকিব)।
৭) নিত্যবৃত্ত বর্তমান।যেমন-- আমি গিয়ে থাকি (= গিয়া থাকি)।
৮) নিত্যবৃত্ত ঘটমান বর্তমান।যেমন—আমি যেতে থাকি (=যাইতে থাকি)।
৯) ঘটমান পুরা নিত্যবৃত্ত অতীত।যেমন –আমি যেতে থাকতাম (= যাইতে থাকিতাম)।
১০) পুরাঘটিত নিত্যবৃত্তা বা পুরা সম্ভাব্য নিত্যবৃত্ত অতীত। যেমন –আমি গিয়ে থাকতাম (=গিয়া
থাকিতাম)।
রামেশ্বর শ’ লিখেছেন এহেন ক্রিয়াপদের গঠন বিচার করলে আরো দুটি যৌগিক কাল নজরে পড়ে।১৭২
১১) পুরাঘটিত ঘটমান বর্তমান। যেমন ---আমি গিয়ে আসছি (= গিয়া আসিতেছি)।
১২) পুরাঘটিত ঘটমান অতীত। যেমন—আমি গিয়ে আসছিলাম(= গিয়া আসিতেছিলাম) ।
এবারে,“যৌগিক কাল বলিতে” সুকুমার সেন লিখছেন,“সেই ধরণের দ্বৈত ক্রিয়াপদ (compound verb) অভিব্যক্ত হয় যাহার প্রথম অংশ ‘-ই(য়া)’,‘-(ই)ল’ যুক্ত অতীত অথবা ‘-ই(তে)’ যুক্ত বর্তমান,শেষ অংশ ‘আছ’ধাতুর সমাপিকা পদ,এবং দুই অংশের মধ্যে কোন ফাঁক (Juncture) অনুভূত নয়।যৌগিক ক্রিয়াপদের সঙ্গে যৌগিক কালের পার্থক্য সুস্পষ্ট। যৌগিক কাল এবং যৌগিক ক্রিয়া দুই-ই দ্বিপদময় তবে পার্থক্য আছে দুইটি বিষয়ে---(১)দুই অংশের সন্নিকর্ষের মাত্রায় এবং (২)‘আছ’ ধাতুর অর্থপ্রাধান্যে।...যেমন---গাছটা রাস্তার উপর পড়িয়া আছে(=পতিত: বর্ততে,ইংরাজি ---lies fallen)। কিন্তু যৌগিক কালে দুই অংশ বেমালুম জুড়িয়া যায়,এবং সেখানে ‘আছ’ ধাতু অর্থ নিতান্তই অস্পষ্ট,ইহা উদ্দেশ্য-বিধেয়র সংযোজক(Copula) মাত্র।যেমন ---গাছটা রাস্তার উপর পড়িয়াছে (=পতিত:,বৈদিক ‘পপাত’---ইংরেজি---has fallen)।”১৭৩ আমরা উপরে পুরাঘটিত ভবিষ্যৎ থেকে শুরু করে যেসব ক্রিয়াপদের নজির দিয়েছি,সেগুলোতে কিন্তু ‘√আছ̖ ,~থাক̖’ পূর্বাংশের সঙ্গে জুড়ে যায় নি।অন্যদিকে যৌগিক ক্রিয়ার তিনি আর যেসব নজির দিয়েছেন,তার সবগুলোতে কিন্তু শেষে ‘√আছ̖’ নেই।যেমন—দান-করা,ভালো-বাসা।১৭৪ বা,লাফ দেয়,ঝাঁপ খায়,দৌড় মারে,পার করে।১৭৫তর্কটা অবশ্য আমরা এই ভাবেও নিতে পারতাম,যৌগিক ক্রিয়ার শেষাংশে ‘√আছ’̖-ই থাকবে এমন কোনো কথা নেই,কিন্তু থাকলে জুড়ে যাবে না, কিন্তু যৌগিক কালে জুড়ে যাবেই।সেটাও হচ্ছে না,আমরা ইতিমধ্যে দেখালাম।অন্যদিকে যৌগিক ক্রিয়ার নজির যেমন তিনি ‘সসুরা নিদ গেল’ আদি চর্যার থেকে শুরু করেই দিতে পারছেন,যৌগিক কাল সম্পর্কে নিজেই লিখছেন,প্রাচীন বাংলায় “...কিন্তু যৌগিক কালের উদাহরণ মিলে নাই। ... যৌগিক কালের উদ্ভব মধ্য বাঙ্গালায় তবে ব্যবহার বেশি নাই। ... আধুনিক বাঙ্গালার ইহা একটি প্রধান বিশেষত্ব।”১৭৬এই তত্ত্বকে আমাদের কষ্টকল্পিত বলে মনে হয়।রামেশ্বর শ’এর মতো আমাদেরও অভিমত,“বস্তুত ড০ সুকুমার সেন যৌগিক কাল ও যৌগিক ক্রিয়ার মধ্যে যে পার্থক্য দেখাতে চেয়েছেন সেই পার্থক্য দেখানোই নিষ্প্রয়োজন।যৌগিক কাল ও যৌগিক ক্রিয়ার ধারণাটি দু’টি স্বতন্ত্র মানদণ্ডের উপরে প্রতিষ্ঠিত।এক্ষেত্রে পার্থক্য করাই অবান্তর।যেমন ---ফর্সা মানুষ ও লম্বা মানুষ---এই দুই শ্রেণীর মধ্যে পারস্পারিক পার্থক্য নির্ণয় করা যায় না,কারণ ফর্সার বোধটি ‘বর্ণ’ বা ‘রঙে’র মানদণ্ডের উপরে প্রতিষ্ঠিত আর ‘লম্বা’র বোধটি দৈর্ঘ্যের মানদণ্ডের উপরে প্রতিষ্ঠিত।”১৭৭ ‘যৌগিক ক্রিয়ার’ও ‘যৌগিক কালে’র রূপ হতে পারে।যেমন---তুমি গান গাইতে থাকবে।একাধিক ধাতুতে তৈরি এমন যৌগিক ক্রিয়ার অস্তিত্ব মেনে নিতেই হয়।কিন্তু একাধিক কাল কী করে হয়,আর হলেও এদের মিশ্রণ কী করে সম্ভব ? —সে এক মৌলিক প্রশ্ন। একাধারে বর্তমান–অতীত কাল বলেওতো কিছু হয় না।হয় বর্তমান হবে,নতুবা অতীত।অন্যদিকে ‘পড়েছে’,‘গিয়েছে’ এমন ক্রিয়াপদে যে দুই ধাতুর সমন্বয় ঘটেছে তাও সত্য।কিন্তু দ্বিতীয় ধাতু ‘√আছ̖’ যেখানে থাকে,সেখানেও তার পূর্ণরূপটি নয়, সুকুমার সেনও লিখেছেন,“যৌগিক কালে সর্বদা ‘আছ’ ধাতুর আদিস্বরলুপ্ত রূপ ‘ছ’ ব্যবহৃত হয়।”১৭৮ অর্থাৎ একটি বদ্ধ রূপিম তথা মধ্যসর্গ হিসেবেই যুক্ত হয়।এই নিয়ে আমাদের সমস্যা হওয়া উচিত নয়,আমরা ইতিমধ্যে ধাতুর ‘জটিল’ বা ‘সাধিত’ রূপের কথা লিখে এসেছি।বরং গঠনগত বিচারে ক্রিয়াকে একপদী ও বহুপদী এই দুই ভাগে ভাগ করেছেন রামেশ্বর শ’। সুকুমার সেনও এই ধারণার কাছাকাছি গেছিলেন।তিনি একপদময় ও দ্বিপদময় বলে দুই ভাগ করেন।দ্বিপদময়কে যৌগিক ক্রিয়াপদ বলে লিখেও যৌগিক কালে গিয়ে আটকে গেছেন,“যৌগিক ক্রিয়াপদ যদি বিশিষ্ট কালের অর্থ প্রকাশ করে তবে বলা হয় যৌগিক কালের পদ।”১৭৯ তবে কি ‘একপদময়’ যৌগিক কালের হয় না?তাছাড়া তিনি সমাপিকা ভাগেরই এই দুই প্রকার ভেদের কথা বলেছেন,অথচ একপদময় ক্রিয়ারও অসমাপিকা বলে কোনো অংশ আলাদা চেনাই যায় না।‘পড়েছে, গিয়েছে,যাচ্ছি’—এগুলোর অসমাপিকা অংশ কোনটি? বরং বহুপদী ক্রিয়ার অসমাপিকা অংশটি স্পষ্ট এবং তাতে সেই সব পরসর্গই যুক্ত হয় যেগুলোর কথা সুকুমার সেন লিখেছেন।কিন্তু কাল বোঝাবার জন্যে পরসর্গগুলো শেষের সমাপিকা অংশেই যুক্ত হয়।এই নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।আমরা তাই রামেশ্বর শ’এর বিভাজন মেনে নিচ্ছি।কিন্তু তারপরেও প্রশ্ন থাকল, ‘ঘটমান’,‘পুরাঘটিত’ আদি তাহলে কালের কীরূপ বিভাজন?এই প্রশ্নটি তিনি স্পষ্ট করেন নি।গঠন না হলে অর্থগত নিশ্চয়ই। কিন্তু তাতেও সবটা স্পষ্ট হয় না।অতীত- বর্তমান- ভবিষ্যতের পরেও কালের এই ‘অর্থে’র বিষয়টি অবশিষ্ট থাকছে কেন? একপদী-বহুপদী বিভাজন যদি ক্রিয়ার গঠন অনুযায়ী,তবে এই অবশিষ্ট বিভাজনগুলো কিন্তু ক্রিয়ার স্বরূপ,তথা ধরন অনুসারে হচ্ছে।যেমন,কাজটি একবারে হয়ে গেছিল,কি অনেকক্ষণ ধরে হচ্ছিল?হবার সম্ভাবনা ছিল কিনা,পরিণতি কিছু মিলল কি অবশিষ্ট আছে---এই সব প্রশ্নের উত্তরে ক্রিয়ার গঠন তথা রূপভেদ হয়।কিন্তু বহু সময় তাও হয় না ---গঠনের সঙ্গে অর্থের বিচ্ছেদ ঘটে।পুরো বাক্যেই অর্থটি বহন করে,এবং ক্রিয়ার উপরে কালরূপের তির্যক ব্যবহার সক্রিয় হয়-- আমরা ক্রমান্বয়ে দেখব। সুতরাং এই বিভাজনকে গঠনের সঙ্গে পাকাপাকি জুড়বার মানে হয় না।একে বলা যেতে পারে ক্রিয়ার স্বরূপ অনুযায়ী তিন কালের বিভাজন বা উপবিভাজন।
রামেশ্বর শ’ একপদী ক্রিয়ার কালের দশটি উপবিভাজনের কথা লিখেছেন।১৮০
১) সাধারণ বা অনির্দিষ্ট বর্তমান ( Present indefinite Tense)।যেমন – সে যায়।
২) ঘটমান বর্তমান (Present Continuous Tense)।যেমন- সে যাচ্ছে।
৩) পুরাঘটিত বর্তমান (Present Perfect Tense)।যেমন- সে গেছে ।
৪) সাধারণ বা অনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ (Future indefinite Tense)।যেমন- সে যাবে।
৫) সদ্য অতীত (Simple Past Tense)।যেমন –সে গেল।
৬) নিত্যবৃত্ত অতীত (Habitual Past Tense)।যেমন- সে যেত।
৭) ঘটমান অতীত (Past Continuous Tense)।যেমন—সে যাচ্ছিল।
৮)পুরাঘটিত অতীত (Past Perfect Tense)।যেমন—সে গিয়েছিল।
আর দু’টি অনুজ্ঞা ভাবের রূপ।
৯) বর্তমান অনুজ্ঞা (Present Imperative)।যেমন— সে যাক̖।
১০) ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞা (Future Imperative)।যেমন—সে যাবে।
বাংলা বহুপদী ক্রিয়ার কালরূপগুলো এরকম:
১) ঘটমান ভবিষ্যৎ (Future Continuous Tense)।যেমন—সে যেতে থাকবে।
২) পুরাঘটিত ভবিষ্যৎ বা সম্ভাব্য অতীত (Future Perfect or Doubtful Past Tense)।
যেমন – সে গিয়ে থাকবে।
৩) নিত্যবৃত্ত বর্তমান (Habitual Present Tense)।যেমন---সে গিয়ে থাকে।
৪) নিত্যবৃত্ত ঘটমান বর্তমান (Habitual Present Continuous Tense)।যেমন- সে যেতে
থাকে।
৫) ঘটমান পুরা নিত্যবৃত্ত অতীত (Habitual Past Continuous Tense)।সে যেতে থাকত।
৬) পুরাঘটিত নিত্যবৃত্ত অতীত বা পুরাসম্ভাব্য নিত্যবৃত্ত অতীত ( Habitual Past Perfect)।যেমন-
সে গিয়ে থাকত।
৭) পুরাঘটিত ঘটমান বর্তমান (Present Perfect Continuous Tense)।যেমন- সে গিয়ে
আসছে।
৮) পুরাঘটিত ঘটমান অতীত (Past Perfect Continuous Tense )।যেমন---সে গিয়ে
আসছিল।
এই অব্দি কাল বিভাজন রামেশ্বর শ’-এর।আমাদের প্রশ্ন,তা হলে পুরাঘটিত ঘটমান ভবিষ্যৎ বাদ পড়ে কেন?যেমন, এমন রূপ হবে না কেন--- সে গিয়ে আসতে থাকবে?√গম̖ ধাতু দিয়ে তৈরি ক্রিয়াপদে মনে হবে থাকাই উচিত।কিন্তু এগুলোর আরেক অর্থ এমনটাও হয়—বুঝিবা,একবার গিয়ে ফিরে আসবার কথা হচ্ছে।আসলে সেরকম কিছু নয়।রামেশ্বর শ’ √কর̖ ধাতু রূপে দেখিয়েছিলেন,‘কোরে আসছে,কোরে আসছিলাম’ ---এরকম।√আস̖ ধাতুতে এখানে ‘ফিরে আসবার’ বদলে ‘যাওয়া’ কাজটি বহুক্ষণ ধরে চলছে বা চলছিল এমন একটা অর্থ বোঝাচ্ছিল।তাই পুরাঘটিত ঘটমান কালের অর্থেও যে রূপটি হবে বাংলাতে সেটি ঘটমান ভবিষ্যৎ রূপের থেকে আলাদা কিছু হবে বলে হয়ত তাঁর মনে হয় নি।কিন্তু বাংলাতে তাত্ত্বিক ভাবে এমন বাক্য গঠন সম্ভব—আগামী ১লা জানুয়ারি থেকে ৩০ জানুয়ারি অব্দি সে ওখানে গিয়ে আসতে থাকবে। কিন্তু এরকম গঠনের ব্যবহার এতো দুর্লভ যে এর জন্যে আরেকটি কাল প্রস্তাব করা বাহুল্য বলেই মনে হয়।
আরেকটি পারিভাষিক প্রসঙ্গ এখানে উত্থাপন করা সমীচীন হবে।‘ঘটমান’কে ‘অসম্পন্ন’ এবং ‘পুরাঘটিত’কে ‘সম্পন্ন’ বলে লিখেছেন জগন্নাথ চক্রবর্তী।১৮১পুরাঘটিত বর্তমানকে ‘অচির সম্পন্ন’ লিখেছেন।পুরাঘটিত ভবিষ্যৎকে ‘সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ’।এহেন পারিভাষিক নাম সুকুমার সেনও ব্যবহার করেছেন।পুরাঘটিত অতীতকে লিখছেন ‘সুচিরসম্পন্ন’।১৮২তৎসম শব্দ জুড়ে তৈরি জটিল শব্দ হলেও পড়তে শোনতে দেখায় অসংস্কৃত বাংলার মতো।আমরাও এই পারিভাষিক নামগুলোই ব্যবহারের পক্ষে।এর পরে থেকে তাই করব।শুধু বিভ্রান্তি এড়াতে অন্যান্য ভাষাবিজ্ঞানীদের উদ্ধৃতিতে তাঁদের ব্যবহৃত পরিভাষা পাল্টানো হবে না। আর ‘অচির,সুচির,সম্ভাব্য’ বিশেষণ অংশটি বাদ দেয়া হবে।‘বর্তমান,অতীত,ভবিষ্যৎ’ই এগুলোর অর্থ বহন করবে।
বাংলাতে ‘গিয়েছি’ ইত্যাদি ক্রিয়াপদ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে মূলে ধাতুটি √গম̖।সত্য বটে,সেটিই উৎস।ধাতু থেকে বাংলাতে তো তৎসম ‘গমন’ শব্দটির বাইরে ‘গমিষ্যতি,গমিষ্যতঃ,গমিষ্যন্তি’ আদি রূপ নেইই।ফলে শব্দের ক্ষুদ্রাংশের সন্ধান যদি করতেই হয়,‘গ’ ছাড়া মেলেই বা কী? ‘-এছি,~এছো’ ইত্যাদি তো পক্ষ বোধক পরসর্গ।তাও একক নয়,সমাপিকা ক্রিয়াতে ‘ছ’ রূপিমটি থাকলেও অসমাপিকাতে সেটিও থাকে না,হয় চলিত বাংলাতে ‘-ইয়ে’, সাধু বাংলাতে ‘-ইয়া’।যেমন- গিয়ে,গিয়া।তাই √গম̖ -এর উপরূপ √গ̖।এর সব কালে রূপ হয় না,পরিপূরক রূপটি √যা।তেমনি,√থাক̖ ধাতুরও সব কালে রূপ নেই,পরিপূরক রূপটি √আস̖।পক্ষ এবং ভাববোধক পরসর্গগুলোও জুড়ে থাকে বলে স্পষ্ট করে বাংলা কালবোধক পরসর্গকে ‘ল̖,~ইল̖’,‘ত্,~ইতে,‘ব̖,~ইবে’ এভাবে এক কথাতে আলাদা করে চিহ্নিত করা সঠিক নয়।উপরের আঠারোটি ক্রিয়া পদকে বিশ্লেষণ করে দেখালে এই ভাবে চিত্র -২ এবং ৩-এর মতো দেখানো যাবে।প্রথম বন্ধনীর ভেতরের রূপগুলো সাধু বাংলার বিকল্প রূপ।আর তৃতীয় বন্ধনীর রূপগুলো স্বতন্ত্র নয়,যদি কাল স্তম্বে ‘+এ’ আছে, পক্ষ স্তম্ভে [+এ],তবে বুঝতে হবে একই রূপিমে কাল পক্ষ দুইই বোঝাচ্ছে।উপরূপগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা।বহুপদী ক্রিয়ার প্রথম পদের পরসর্গগুলো পাশের কোষে উপরে,এবং দ্বিতীয় পদের পরসর্গগুলো কে নিচের অবস্থানে পড়তে হবে।
দেখা যাবে, গঠন বিচারে বাংলা ক্রিয়ার কাল নির্ণয় করতে একপদী কিংবা বহুপদী ক্রিয়ার দ্বিতীয়াংশের সঙ্গে মাত্র এই দশটি রূপিমই যুক্ত হচ্ছে ‘+এ,+চ্ছ̖(~ছ̖),+ছ̖,+ব̖(~ইব̖),+ল̖,+ত̖,+চ্ছিল̖(~ছিল̖),+ছি্ল,+ক̖(~উক),+ক̖ (~কি)।’ এর মধ্যে ‘-চ্ছ,-চ্ছিল’ বলে বাস্তবে কোনো রূপ নেই।পূর্বাংশ ‘√যা-ধাতুর সঙ্গে সন্ধিতে ‘ছ’ ধ্বনিটির আংশিক দ্বিত্ব ঘটে।কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হলে বলে আমরা এইভাবে রেখেছি।শেষ দুটি ক্রিয়াপদ আবার তিনধাতুতে মিলে তৈরি বহুপদী।গঠনের সঙ্গে অর্থের সম্পর্কই দ্বান্দ্বিক।ক্রিয়াপদের অর্থ নিয়ন্ত্রণে একপদী ক্রিয়ার পূর্বাংশ কিংবা বহুপদী ক্রিয়ার অসমাপিকা রূপটিই নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে।এবং এগুলো অসমিয়ার মতো সহোদরা অন্যভাষাতেও পাওয়া সম্ভব।ধাতুর কোন উপরূপের সংগে যুক্ত হচ্ছে,অসমাপিকা রূপটি কী,সেটি জুড়ে গিয়ে একপদী ক্রিয়া তৈরি করছে না বহুপদী ক্রিয়া হচ্ছে সেসবের সঙ্গে পক্ষ বোধক কোন উপরূপগুচ্ছের থেকে একটি রূপিম বেছে নিচ্ছে তার উপরে সমগ্র কালের অর্থ স্পষ্ট হচ্ছে।এই শেষাংশ কিংবা সমাপিকা রূপের বৈচিত্র্য অতি অল্প।বহুপদী ক্রিয়ারূপে সেটি অনেক স্পষ্ট করে দেখা যাবে।এগুলোই একটি ভাষার নিজস্ব কাঠামো তথা চরিত্রকে নির্ধারণ করে।উদাহরণ স্বরূপ বহুপদী ক্রিয়ার ছক থেকে প্রথম দুটি ক্রিয়াপদ নিতে পারি।
যেতে থাকবে= √যা~/তে(~ইতে), √থাক̖/+ব̖(~ইব̖)/ +এ,~এন̖,~ই,~ও
গিয়ে থাকবে=√গম̖ (~গ̖) /+ইয়ে (+ইয়া),√থাক̖/+ব̖(~ইব̖)/ +এ,~এন̖,~ই,~ও
দ্বিতীয়াংশের ধাতু,কাল এবং পক্ষ বোধক রূপিমগুলো একই।শুধু প্রথম ভাগের ধাতু এবং অসমাপিকা বোঝাবার রূপটি স্বতন্ত্র বলেই প্রথমটি হয়ে গেল অসম্পন্ন ভবিষ্যতের রূপ আর দ্বিতীয়টি সম্পন্ন ভবিষ্যৎ অথবা সম্ভাব্য অতীতের ক্রিয়ারূপ।√যা ধাতুর পরে ‘-তে’ যুক্ত হলে স্বরসঙ্গতির ফলে ‘যা’ হচ্ছে √যে।√যা কিংবা √গম̖(~গ̖) ধাতুর সব কালে একরূপ থাকে না।√কর̖ কিংবা √পড়̖ ইত্যাদি যেসব ধাতুর সব কালের রূপ মেলে সেখানে এই গঠনগত বৈচিত্র্যও পাওয়া যেত না।অসম্পন্ন কিংবা পুরাঘটিত দুই রূপ একই হত।যেমন-- করে থাকবে।সেক্ষেত্রে বাক্যের প্রেক্ষিত দিয়েই কালের অর্থ স্পষ্ট হত।কালের এই গঠন এবং অর্থের বিরোধে অস্বাভাবিক কিছু নেই,কারকের মতোই এই দুইয়ের বিচ্ছেদই মান বাংলার সাধারণ প্রবণতা।এক কালে অন্যরূপ আকছার ব্যবহৃত হয়।রবীন্দ্রনাথ তাই বহু আগেই লিখেছিলেন ‘বাংলা ভাষার প্রধান লক্ষণ,তার ভঙ্গীর প্রাবল্য’।১৮৩ কয়েকটি নজির যেমন:
১) রবীন্দ্রনাথ ১৮৬১ সনে কলকাতাতে জন্মগ্রহণ করেন।-- অতীতের অর্থে সাধারণ বর্তমানের রূপ।
২) আগামী মাসে গুয়াহাটি যাচ্ছি। -- ভবিষ্যতের অর্থে সাধারণ বর্তমান রূপ।
এবারে দেখা যাক, ক্রমান্বয়ে অসমিয়া কোন কালের রূপ কিংবা নাম বাহুল্য অথবা ভুল বলে মনে হচ্ছে।বাংলার সঙ্গে তুলনা করতে কঠিন না হয়,তাই আমরা √যা ধাতু নিয়ে কাজ চালিয়েছি।এবং উদাহরণ বাক্যগুলো আমাদেরই নির্মাণ।নতুবা গোলোকচন্দ্র বা লীলাবতী শইকীয়া বরার ব্যবহৃত প্রধান ধাতুটি ছিল √পঢ়̖।অন্য ধাতুও নজির হিসেবে ব্যবহার করেছেন। লীলাবতী শইকীয়া বরার মতে তিনটিই মৌলিক কাল।
১) সাধারণ বা নিত্য বর্তমান: সি পঢ়ে,চৰাই উৰে।
২) সাধারণ অতীত: সি গান গালে।
৩) সাধারণ ভবিষ্যৎ: সি পঢ়িব।
চিত্র -০৪-এর ক্রমিক নং ১,৪ এবং ৫-এ তাই আছে--- সি যায়,সি গ’ল̖,সি যাব।মোটা হরফে এখানে এবং পরের উদাহরণে লীলাবতী শইকীয়া সহ অসমীয়া ভাষাবিজ্ঞানীদেরকেই অনুসরণ করেছি।
যৌগিক কালের প্রথমত দুই ভাগ:
ক) পুরাঘটিত তথা সম্পন্ন কাল (Perfect Tense)
খ) ঘটমান তথা অসম্পন্ন কাল (Progressive বা Continuous Tense)
সম্পন্ন কালের আবার দুই ভাগের কথা লিখেছেন: স্বরূপ বর্তমান এবং অপূর্ণভূত।এগুলোকে পুরাঘটিত বর্তমান এবং পুরাঘটিত অতীত বললেও চলে।তিনি নিজেও তাই করেছেন।পুরাঘটিত বর্তমান যেমন: সি পঢ়িছে।পুরাঘটিত অতীত: মই যোৱা বছৰ কলিকতালৈ গৈছিলোঁ। কিন্তু এখানে কিছু জটিলতা আছে।তিনি লিখছেন,“পঢ়িছোঁ,পঢ়িছ,পঢ়িছা,পঢ়িছে ক্রিয়াপদে পঢ়া কামটো অলপ আগতে আরম্ভ করি বর্তমানো পঢ়ি থকা বুজাইছে।গতিকে স্বরূপ বর্তমান কালত ক্রিয়ার অবিচ্ছিন্নতা ভাব (Continuity) এটাও লুকাই আছে।”১৮৯ আমরা আসলে একেই ঘটমান তথা অসম্পন্ন বুঝে এসেছি এই অব্দি।তিনি স্বরূপ বর্তমান বলেও আসলে একেই আলাদা করছেন।“কিন্তু আমি যদি কওঁ,”এর পরেই তিনি লিখছেন,“‘ধন্য নৰ তনু ভাল’ পঢ়িছানে? হয়, পঢ়িছোঁ। ইয়াত পঢ়িছানে আরু পঢ়িছোঁ ক্রিয়াপদে পঢ়া কামটো আগতে শেষহৈ বর্তমানো তার প্রভাব চলি থকা বুজাইছে।”১৯০ যদি এমন কিছু বোঝায় তবে তার কাল কী হবে? ---সেটি তিনি লেখেন নি।আমরা একেই পুরাঘটিত তথা সম্পন্ন বুঝে এসেছি।ইংরেজি ব্যাকরণে একেই perfect tense বলে এবং পূর্বতনটিকে বলে Continuous tense। সুতরাং আমরা ভাবতে পারি অসমিয়াতে অসম্পন্ন এবং সম্পন্ন বর্তমানে ক্রিয়ার রূপ একই।উপরের ছকে ক্রমিক নং ২ এবং ৩-এ তাই রেখেছি---সি গৈছে।তেমনি অপূর্ণভূত বা পুরাঘটিত অতীত সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লিখছেন,“ ...আছিল, গৈছিলো আর কৰিছিল ক্রিয়াপদে দূর অতীতত ক্রিয়ার কার্য সমাধা হোৱা বুজাইছে।”১৯১যেমন---মই যোৱা বছৰ গুৱাহাটীলৈ গৈছিলোঁ।পরে আবার লিখছেন,“কেতিয়াবা অপূর্ণভূত কালর ক্রিয়াই ইয়ার কার্য শেষ নহৈ চলি থকা অর্থাৎ অবিচ্ছিন্নতা ভাব প্রকাশ করে।যেনে,ভূমিকম্প আহোঁতে মই শুইছিলোঁ।”১৯২ আমরা আসলে পূর্বতনটিকে পুরাঘটিত তথা সম্পন্ন অতীত এবং দ্বিতীয়টিকে ঘটমান তথা অসম্পন্ন বুঝে এসেছি।অর্থাৎ অপূর্ণভূত বলতে ঘটমান অতীতকেই বোঝানো হচ্ছে।এবং এই দুই কালেও ক্রিয়ার রূপ একই।আমরা তাই উপরের ছকে ক্রমিক নং ৭ এবং ৮-এর রূপও একই রেখেছি---সি গৈছিল।
লীলাবতী শইকীয়া ঘটমান কাকে বলছেন এই মন্তব্যে বোঝা যাবে,“যৌগিক কালর আন এটা ভাগ হৈছে ঘটমান কাল।ইয়ার অর্থ ইংরাজী Perfect Continuous tense-র দরে;অর্থাৎ ক্রিয়ার অবিচ্ছিন্নতা বুজুয়া কালকে ঘটমান কাল বোলা হয়।অসমীয়া ভাষাত মই পঢ়ি আছোঁ, তুমি পঢ়ি আছিলা, সি পঢ়ি থাকিব---এনে ধরণর বাক্য প্রায়ে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু পঢ়ি আছোঁ, পঢ়ি আছিলা,পঢ়ি থাকিব আদি ক্রিয়াপদ কোন কালর সেই বিষয়র আলোচনা অসমীয়া ভাষার ব্যাকরণতে দেখা নাযায়।”১৯৩ তিনি এর পরে লিখেছেন,ড০ উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী ‘অসমীয়া ভাষার ব্যাকরণে’ বিষয়টি নিয়ে খুব সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন।ড০ গোলক চন্দ্র গোস্বামী ‘অসমীয়া ব্যাকরণ প্রবেশ’-এ কোনো আলোচনাই করেন নি।গিরিধর শর্মা ‘আধুনিক অসমীয়া ভাষার ব্যাকরণ’-এ যৌগিক কালের ক্রিয়াপদ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে শুরুতেই ঘটমান কালের কথা আলোচনা করেছেন।এবং “বঙলা ভাষার ব্যাকরণতো ক্রিয়াপদর এনেবোর রূপক ঘটমান কালর ভিতরত ধরি আলোচনা করা হৈছে।”১৯৪ অর্থাৎ তিনি বলতে চাইছেন বাংলাতে ‘আমি যাচ্ছি (=যাইতেছি),আমি যাচ্ছিলাম (=যাইতেছিলাম),আমি যেতে থাকবো (=যাইতে থাকিব)’ এই সব ক্রিয়ারূপের সমার্থক অসমিয়া পঢ়ি আছোঁ, পঢ়ি আছিলা,পঢ়ি থাকিব।দৃশ্যত তাই মনে হয়।আমরা তাই উপরের ছকে ক্রমিক নং ২ এবং ৭-এ বিকল্প নজির বসিয়ে এসেছি--সি গৈ আছে,সি গৈ আছিল।তবে কি একই কালের দুই রূপ হবে?দেখা যাবে,লীলাবতী শইকীয়া যেগুলোকে পুরাঘটিত বলছেন,সেগুলোর কোনো ভবিষ্যৎ রূপ নেই।কিন্তু ঘটমানের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর কোনো সমস্যা হয় নি।সি,তাই বা সিহঁতে কৰি থাকিবো---এমন তিন পক্ষে বাক্যের নজির তিনি দিয়েছেন।‘পুরাঘটিত’ তথা সম্পন্ন ভবিষ্যতের রূপ না পাবার কারণটি তাঁকে ভাবায় নি।কিন্তু সাধারণ ‘ঘটমান’ কাল নিয়েই অসমিয়া ব্যাকরণগুলো নীরব থাকার প্রথম কারণ,তিনি ভেবেছেন,“এই কাল তিনিওটার কারণে অসমীয়াত পৃথক ক্রিয়া বিভক্তির চিন নাই।”১৯৫দ্বিতীয় কারণ তিনি ভেবেছেন অনেকেই একে ইংরেজি ভাষার প্রভাবে অসমীয়াতে প্রচলিত বলে মনে করেন।তা যদি হয়ও,তিনি মনে করেন,“এনেবোর প্রয়োগে ভাষাটোর নিজস্ব কথন ভঙ্গীরে এক ভিন্ন রূপ দাঙি ধরে। গতিকে ভাষা একোটার রূপতত্ত্বর আলোচনাত এইবোর কালর আলোচনাইও ঠাই পোয়া উচিত।”১৯৬ ঠাই পাবার ঔচিত্যের সঙ্গে আমরা একমত।কিন্তু বেশ কিছু জট না ছাড়ালে ঠিক কী ঠাই পাবে --সেটি বোঝা কঠিন।তিনি বাংলার নজির দিয়েছেন। সুতরাং আমরা তুলনা করতেই পারি।তিনি বাংলাতেও এগুলোকে ‘ঘটমান’ বলে লিখেছেন।‘যাচ্ছি,যাচ্ছিলাম,যেতে থাকবো’ ইত্যাদি বাংলার ঘটমান রূপ।কিন্তু এগুলো ইংরেজি Perfect Continuous tense নয়।এই ইংরেজি কথাটির বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘পুরাঘটিত ঘটমান’ তথা আমাদের পরিভাষাতে ‘সম্পন্ন-অসম্পন্ন’এবং বর্তমান এবং অতীতে এর রূপ প্রথম রামেশ্বর শ’ প্রস্তাব করেন আমরা দেখিয়ে এসেছি।সেগুলোর নজির বাক্য যেগুলো তুলে দিয়েছি---সে গিয়ে আস̖ছে,সে গিয়ে আস̖ছিল ---এগুলোকে অসমিয়া অনুবাদ করলে দাঁড়াবে---সি গৈ আহিছে,সি গৈ আহিছিল̖।এরকম প্রয়োগ অসমিয়াতে আছে।যেমন --আমি সকলোৱে দেখি আহিছোঁ প্ৰকৃতি ধ্বংসৰ কুফল মানুহে কেনেদৰে ভোগ কৰি আহিছে;১৯৭ ধৰ্মপুৰোহিতসকলে সাধাৰণ মানুহক এই বুলি শিক্ষা দি আহিছিল̖ যে ঈশ্বৰৰ অস্থিৰতাৰ বাবেহে ‘চন্দ্ৰগ্ৰহণ’ সংঘটিত হয়।১৯৮ এধরণের গঠন নিয়ে লীলাবতী শইকীয়া বরাও ভাবেন নি।আমরা তাই অসমিয়া ভাষাতে এগুলোর জন্য ‘সম্পন্ন- অসম্পন্ন’ বর্তমান এবং অতীত প্রস্তাব করতে পারি।চিত্র -০৪-এ ক্রমিক নং ১৭ এবং ১৮তে অসমিয়া রূপের স্তম্ভে তাই এমন বাক্যের নজির দিয়েছি,আমাদের অধীত কোনো অসমিয়া ভাষাবিজ্ঞানের গ্রন্থে না পাওয়া সত্ত্বেও।
তাহলে অসমিয়াতে ‘পঢ়ি আছোঁ, পঢ়ি আছিলা,পঢ়ি থাকিব’ এই ক্রিয়ারূপগুলো কোন কালের?লক্ষ করলে দেখা যাবে এগুলো বহুপদী ক্রিয়ারূপ।কিন্তু এগুলো বাদ দিয়ে তিনি যে ক্রিয়ারূপগুলোর উদাহরণ দিয়েছেন,সেগুলো সব একপদী। একপদীরও কিছুতে বাংলার মতোই √আছ̖ ধাতু এবং তার উপরূপগুলোর থেকে জাত পরসর্গগুলো সংক্ষিপ্ত হয়ে যুক্ত হয়েছে।বহুপদী ক্রিয়ারূপে সেই ধাতুরূপগুলো একেবারেই স্পষ্ট।এবং পূর্বাংশ যথারীতি বাংলার মতোই অসমাপিকা।এই অসমাপিকাগুলোই ক্রিয়াপদের কালের অর্থকে নিয়ন্ত্রণ করছে।গোলকচন্দ্র গোস্বামী এমন এক দ্বিপদী ক্রিয়ারূপের নজির দিয়েছিলেন সমাপিকা ক্রিয়া বোঝাতে।অথচ দ্বিপদী বা বহুপদী ক্রিয়ারূপ নিয়ে কথাই বলেন নি।যেমন---ভাইটিয়ে গোটেই ৰাতিটো কান্দি থাকে।১৯৯এর অনুসরণে আমরা এমন ক্রিয়ারূপগুলো মনে করতে পারি---গৈ থাকে,কৰি থাকে,শুই থাকে, পঢ়ি থাকে।এবং একে নিত্যবৃত্ত বর্তমানের রূপ বলে সহজেই নিতে পারি।কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করব তিনি সেরকম কোনো কালের প্রস্তাবতো করেনই নি,দ্বিপদী বা বহুপদী কোনো ক্রিয়ারূপেরই কাল নিয়ে কথা বলেন নি।সম্ভবত তাই তিনি কালের মৌলিক-যৌগিক কোনো বিভাজন নিয়েই কথা বলেন নি।এমন কোনো ক্রিয়ারূপের উল্লেখ এবং আলোচনা লীলাবতী শইকীয়া বরাও করেন নি।কিন্তু যেহেতু গঠনটি আছে, আমরা অসমিয়াতেও বর্তমানে এবং অতীতের ‘নিত্যবৃত্ত’ রূপ প্রস্তাব করতেই পারি।সেই ভাবে চিত্র -০৪-এ ক্রমিক নং ১৩, ১৪, ১৫, ১৬তে অসমিয়া বাক্যে ক্রিয়ারূপের নজির রেখেছি।১৩,১৪ এবং ১৫,১৬-র সমরূপতা নিয়ে আমরা পরে কথা বলবো।কিন্তু নিত্যবৃত্ত অতীত কালের রূপ নিয়ে আমরা নিশ্চিত।যেমন--মামা আৰু মাহী হঁতে মাজে মাজে যোৰহাট গৈ থাকিছিল।২০০
গোলোকচন্দ্র গোস্বামীর পক্ষে বহুপদী ক্রিয়াগুলোকে একেবারে এড়িয়ে যাওয়াও কঠিন ছিল।সেগুলোকে অসমাপিকা ক্রিয়ারূপ প্রসঙ্গে আলাদা এবং বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।কাল প্রসঙ্গে নয়।অধিকাংশই এটা দেখাতে কীভাবে অসমাপিকা ব্যবহার করে জটিল বা যৌগিক বাক্য নির্মাণ করা হয়।২০১এক জায়গাতে ‘তুমি এতিয়া ব্যাকৰণ পঢ়ি আছা’ এমন তিনটি বাক্যের নজির দিয়ে লিখেছেন,“ইয়াত,এইবার শুনি,পঢ়ি আরু জিলিকি, ---এই অসমাপিকা ক্রিয়ার কার্য চলি থকাহে বুজাইছে।”২০২পরে তিনি আরো লিখেছেন,“অসমাপিকা ক্রিয়া আছ̖ বা থাক̖ ধাতুর ক্রিয়ার সহচর হ’লে অসমাপিকা ক্রিয়াটোর কাম চলি থকা,অর্থাৎ চলমান বা ঘটমান বুজায়।”২০৩ কিন্তু কালের কোনো রূপকে ‘ঘটমান’ বলে চিহ্নিত করেন নি।‘সাধারণ’ অতীত বলেও কোনো কালের কথা লেখেন নি।তাঁর কালবিভাজনগুলো এরকম---অনুজ্ঞা,নিত্য বর্তমান,স্বরূপ বর্তমান,স্বরূপ অতীত,অপূর্ণভূত অতীত এবং ভবিষ্যৎ। লীলাবতী শইকীয়া বরা যেগুলোকে সাধারণ অতীত বলে লিখেছেন,গোলকচন্দ্রের মতে এগুলোই স্বরূপ অতীত,“এনেকৈ,কৰিলোঁ,খালে,পালি,আহিল,মাতিলে,আনিলোঁ আদি ক্রিয়াপদে একোটা কাম ইতিমধ্যে শেষ কৰা বুজায়।এতেকে,এনে ক্রিয়াপদক স্বরূপভূত কালর ক্রিয়াপদ বোলে।”২০৪অপূর্ণভূত কালের রূপ হলো ‘পঢ়িছিলোঁ,পঢ়িছিলা,পঢ়িছিলি,পঢ়িছিল’ ইত্যাদি।তিনি সম্পন্ন কাল নিয়েও কোনো কথা বলেন নি।লীলাবতী শইকীয়া বরার মতো এদের দুই কালের অর্থেও ভাগ করবার চেষ্টা করেন নি।আমাদের মতে এই জটিলতাগুলো হয়েছে ‘মৌলিক কাল-যৌগিককালে’র ফাঁদে জড়িয়ে থাকবার জন্যেই।কাল একটাই।দুই কালের কোনো যৌগিক রূপ হতেই পারে না।এবং গোলোকচন্দ্র গোস্বামীর ‘‘তুমি এতিয়া ব্যাকৰণ পঢ়ি আছা’, লীলাবতী শইকীয়া বরার ‘মই পঢ়ি আছোঁ, তুমি পঢ়ি আছিলা,সি পঢ়ি থাকিব’ এই রূপগুলো অবশ্যই ঘটমান,যেভাবে লীলাবতী লিখেছেন।বাংলাতেও তাই।কিন্তু এর ইংরেজি অর্থ Perfect Continuous tense নয়।কেবলি Continuous tense।বাংলার সঙ্গে তফাত হলো অসমিয়াতে তিনকালেই রূপটি বহুপদী।যেখানে বাংলাতে শুধু ভবিষ্যতেই বহুপদী।তবে কখনো কখনো অসমীয়া কথন রীতিতে দুই পদ মিশে গিয়ে একপদী হয়ে সম্পন্ন ক্রিয়াপদের সঙ্গে সমরূপ দাঁড়াতে পারে।সেই নিয়ে অসমিয়া যাদের মাতৃভাষা তারাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারী।আমরা কোনো প্রস্তাব দিতে হলে আলাদা করে ইতিহাসের আলোচনা ফাঁদতে হবে এবং পরিসর বাড়বে বলে বিরত রইলাম।তবে বাণীকান্ত কাকতিও ‘এটাহে’ (একটাই) যৌগিক কালের কথা আলোচনা করতে গিয়ে এই সমরূপতার উল্লেখ করেছেন,অসমিয়াতে,“উভয় কালরে কাম চলোয়া কালর এটাহে রূপ আছে আরু স্থাপন করা পটভূমির যোগেদিহে ঘটমান নে ঘটিত এই অর্থর ইঙ্গিত বুজি ল’ব লাগে।”২০৫তিনিও লীলাবতী শইকীয়া বরার মতো বহুপদী রূপগুলো অসমিয়াতে সাম্প্রতিক অনুপ্রবেশ বলে লিখেছেন,সুকুমার সেনের মতো √আছ̖ ধাতুর প্রসঙ্গ টেনেছেন,এবং এদের কাল Perfect Continuous tense ই (ঘটিত ঘটমান)লিখেছেন,“ –ই (< -ইয়া)+ √আছ̖ যুক্ত রূপ আধুনিক অসমিয়ালৈও আহিছে।কিন্তু ইয়াত অর্থর পরিবর্তন ঘটিছে।‘বর্তমান (এখনকার) ঘটিতর ঠাইত ই ঘটিত ঘটমান অর্থ আহরণ করিছে;যেনে –কৰি আছোঁ, কৰা কার্য চলাই আছোঁ।”২০৬ আমরা আপাতত বিকল্প হিসেবে বাণীকান্ত কাকতি এবং লীলাবতী শইকীয়া বরার সমরূপতার মত মেনে নিয়েও ঘটমানের বহুপদী ভিন্নরূপের প্রস্তাব রাখলাম। এবং অসমিয়াতেও ঘটমান তথা অসম্পন্ন ভবিষ্যতের কালের প্রস্তাব দিলাম। ক্রমিক নং ১১-তে এর নজির আমরা রেখেছি।
আমরা আগেই লিখেছি,লীলাবতী শইকীয়া তাঁর মতো করে ‘ঘটমান ভবিষ্যৎ’ নিয়ে ভাবলেও,‘পুরাঘটিত ভবিষ্যৎ’ নিয়ে নীরব থেকেছেন।বর্তমান এবং অতীতের সম্পন্ন এবং অসম্পন্নের মতো অসমিয়াতে কালের এই দুই উপবিভাজনেও একই রূপ হতেই পারে--- ‘গৈ থাকিবো।’ আমরা ক্রমিক নং ১২-তে সম্পন্ন ভবিষ্যৎ কাল রূপটি রেখেছি।
বাংলাতে এটি সম্ভাব্য অতীতেরও রূপ।কখনোবা সম্ভাবনার অর্থ স্পষ্ট করতে ‘হয়ত’ বা এর প্রতিশব্দ জুড়ে দেয়া হয়।‘সে গিয়ে থাকবে,হয়ত’ বললে বাংলাতে এই বাক্যের সমার্থক গঠন হয়,‘সে হয়তো গিয়েছিল।’এই রূপটিকে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ কেন থাকবে না -- এই প্রশ্ন করাটা সংগত।কিন্তু ভবিষ্যতের সব কথাই তো সম্ভাবনার অধীন।তবু যদি বা সম্ভাবনাতেই জোর দিতে হয়,তবে লেখা সংগত,‘সে যেতে থাক̖বে হয়ত’।অর্থাৎ অসম্পন্ন রূপের পরে জোরটা পড়বে।অসমিয়াতে √গ̖ ধাতুতেও এই ভিন্নতা আনবার জো নেই।তাই ‘চাগে’ কিংবা এর প্রতিশব্দ ‘কিজানি,জানোচা’ ইত্যাদি জুড়ে অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ তিন কালেই সম্ভাবনার অর্থ বোঝাবার রীতি আছে।কিন্তু সম্ভাব্য অতীত বোঝাবার জন্যে একটি জটিল পরসর্গ ‘-হেঁতেন̖’ জুড়ে দেয়া হয়।কিন্তু এর অনুপদের ধর্ম ত্যাগ করেনা।কাল-পক্ষ বোঝাবার পরসর্গগুলো এর পরে নয়,বরং আগেই ক্রিয়ার সমাপিকা রূপে জুড়ে থাকে।মূলে প্রাচীন ভারতীয় আর্যে ধাতুটি ‘√অস̖> মধ্যভারতীয় আর্যে দাঁড়ালো সন্ত> নব্যভারতীয় আর্যে সন্ত,হন্ত।প্রাচীন বাংলাতেও এর ব্যবহার ছিল ‘হতে (হইতে);অর্থে।যেমন "ওস্তাদে প্রণাম করো পিতা হন্তে বাড় দোসর জনম দিলা তিহ সে আম্বার’(শাহ মুহম্মদ সগীর)।সিলেটি অপাদানের ‘-অনে,~অন্তে’ অনুপদের ইতিহাসও এই, আমরা আগে লিখে এসেছি।নব্য ভারতীয় আর্য থেকে “ হন্তের পরা আধুনিক অসমীয়াত বুৎপন্ন হোয়া হেঁতেন̖ অর অন্ত্য -ন̖ স্বার্থিক,আরু নাসিক্যর প্রভাবত পূর্ববর্তী –অ-ট –এ-লৈ ন্যূনীকৃত হৈ হন্তে> হেঁতে –হৈছে।”২০৭---লিখেছেন বাণীকান্ত কাকতি। তিনি একে অসমিয়া ‘সাপেক্ষ অতীতে’র রূপ বলেছেন।২০৮গোলকচন্দ্র গোস্বামী একেও অসমাপিকা প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন,কোনো কাল নাম নেন নি।২০৯সত্যনাথ বরা২১০এবং লীলাবতী শইকীয়া বরা২১১ স্পষ্টই একে ‘সম্ভাব্য ভূত কাল’ বলে লিখেছেন।লীলাবতীর অনেকগুলোর একটি নজির এরকম---মই গম পোৱা হ’লে গলোহেঁতেন।এই অসমিয়া সম্ভাব্য অতীতের রূপটি যেহেতু সম্পন্ন ভবিষ্যৎ থেকে ভিন্ন আমরা চিত্র -০৪-এ যদি ক্রমিক নং ১২তে রেখেছিলাম,একে আলাদা করে রাখাই সংগত।অন্যদিকে পুরাসম্ভাব্য নিত্যবৃত্ত অতীতের কথা কেউ উল্লেখ করেন নি,অথচ অসমীয়াতে এই রূপটিও রয়েছে।যেমন --লক্ষ্মীনাথ বেজবৰুৱাই যদি নিজে হাতত কলম তুলি অসমীয়া ভাষাৰ সাহিত্যৰ ভঁৰাল চহকী কৰাৰ সলনি ইংৰাজলৈ আবেদন লিখি থাকিলেহেঁতেন,তেতিয়া হ'লে অসমীয়া ভাষাই স্বকীয় মর্য্যাদা পাবলৈ আৰু দুটা দশক লাগিলেহেঁতেন।২১২আমরা ক্রমিক নং ১৬-তে রেখেছিলাম,আলাদা করাই উচিত হবে।
ক্রিয়ার ভাবরূপ বৈচিত্র্যের সমস্যা আমরা আগেই সমাধান করে এসেছি।যেহেতু এরও কালবৈচিত্র্য রয়েছে,আমরা সঠিক ভাবেই সে গুলোর অসমিয়া প্রতিরূপ ক্রমিক নং ৯ এবং ১০-এ দেখিয়েছি।রইল বাকি ক্রমিক নং ৬-এ নিত্যবৃত্ত অতীতের কথা।লীলাবতী শইকীয়া শুধু এইটুকুন লিখেছেন,“কেতিয়াবা দূর অতীতত সদায় ঘটি থকা কার্য বুজাবলৈও অপূর্ণভূত কালর ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হয়।যেনে, ল’ৰাটো সদায় স্কুললৈ গৈছিল।অশোকৰ দিনত প্রজাসকলে সুখেৰে বাস কৰিছিল।”২১৩একে নিত্যবৃত্ত অতীত ছাড়া আর কীই বা বলা যাবে!অথচ তিনি কিছুই বলেন নি।আমরা তবে সঠিক ভাবেই একে ক্রমিক নং ৬-তে রেখেছি।এবারে আমরা চিত্র -৪কে আবার শুধরে নিতে পারি।এবং আমাদের তরফে সিদ্ধান্ত হিসেবেই দেখাতে পারি অসমিয়া কালরূপগুলো এরকম চিত্র-০৫-এর মতো।চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত,তার পরেও লিখি,নেবার অধিকারী অসমিয়া ভাষাবিদেরাই।
দেখা যাচ্ছে বাংলাতে যেখানে একপদী এবং বহুপদী ক্রিয়ার কালরূপ যথাক্রমে দশ (১০ ) এবং আটটি (৮) অসমিয়াতে সেই সংখ্যা একটি করে বেশি,ক্রমে এগারো (১১) এবং নয়টি (৯)।তদুপরি অসম্পন্ন অতীত এবং বর্তমানের দুই বহুপদী বিকল্প রূপ রয়েছে। সেই নিয়ে এক এবং বহুপদী ক্রিয়ার কালরূপের সংখ্যা দাঁড়ায় সমান এগারোটি(১১)।সব মিলিয়ে অসমিয়া কালের সংখ্যা বাইশ (২২)। কিন্তু গঠনের দিক থেকে এতগুলো রূপ নেই।আছে মাত্র চৌদ্দ (১৪)। চিত্র-০৫-এ একপদী ক্রিয়াতে ক্রমিক নং ২এবং ৩,৪ এবং ১১, ৬,৭ এবং ৮-এর রূপ একই।বহুপদী ক্রিয়াতে ১২ এবং ১৩,১৪ এবং ১৫,১৬ এবং ১৭-র রূপ সমরূপ।বাকি নয়টি ক্রিয়ার কালরূপ ভিন্ন।
এবারে আমরা অসমিয়া ক্রিয়াপদগুলো ভাব,পক্ষ,কাল বোঝাতে যে পরসর্গগুলো জুড়ে সেগুলোকে বাংলার মতো আলাদা করে চিহ্নিত করবার মতো অবস্থাতে এসে গেছি।চিত্র-০৬-এ একপদী এবং চিত্র -০৭-এ বহুপদী ক্রিয়ারূপগুলো বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছি।বাংলার মতোই যদি কাল স্তম্বে ‘+এ’ আছে, পক্ষ স্তম্ভে [+এ],তবে বুঝতে হবে একই রূপিমে কাল পক্ষ দুইই বোঝাচ্ছে। উপরূপগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা।প্রথম বন্ধনীতে এভাবে থাকলে বিকল্প রূপ বোঝাবে (~এ)।বহুপদী ক্রিয়ার প্রথম পদের পরসর্গগুলো পাশের কোষে উপরে,এবং দ্বিতীয় পদের পরসর্গগুলোকে নিচের অবস্থানে পড়তে হবে।
এবারে স্পষ্ট যে গঠন বিচারে অসমিয়াতে ক্রিয়ার কাল নির্ণয় করতে একপদী কিংবা বহুপদী ক্রিয়ার দ্বিতীয়াংশের সঙ্গে মাত্র এই সাতটি রূপিমই যুক্ত হচ্ছে +এ,+ব̖ (~ম̖),+ ল̖,+ছিল̖,+ অক̖(~ওক̖),+ইব̖,(~ইম̖),+ইল̖।’ কয়েকটি বহুপদী বাংলারই মতো তিন ধাতুতে তৈরি।এগুলোর মধ্যে -ম̖ < আসলে –ব̖-এর ধ্বনিগত রূপান্তর।২১৪সে বাংলারও পূর্ববঙ্গীয় ভাষাবৈচিত্র্যগুলোতে হয়ে থাকে।শর্তজ্ঞাপক বাক্যেই সাধারণত ‘-হেঁতেন̖’ অনুপদটি জুড়ে যায় বলে কিছু অসমিয়া ব্যাকরণে ‘ভাব’-এর মধ্যে ধরা হয়েছিল।আমরা সেই বিভ্রান্তি এড়াতে ‘ভাব’ স্তম্ভে রাখিনি।তাছাড়া পদের অংশগুলো আমরা ক্রম মেনেই রেখেছি।তাই পক্ষ স্তম্ভে রেখেছি অতিরিক্ত সর্গ হিসেবে।এ শুধু ক্রিয়ার সম্ভাবনার অর্থই স্পষ্ট করে,কাল কিংবা পক্ষ নয়, ---আমরা আগেই লিখেছি।
বাংলার মতো অসমিয়াতে কালের তির্যক প্রয়োগ আছে বটে।কিন্তু ব্যবহারে থাকলেও অনেকেই শুদ্ধাশুদ্ধির অনুশাসন মেনে চলবার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।যেমন কারক প্রসঙ্গে আমরা ‘-পৰা’ অনুসর্গটি জুড়ে যাবে কি যাবে না এই নিয়ে দুই ভাষাবিজ্ঞানীর বিতর্কের কথা লিখেছি।তেমনি নঞর্থক ক্রিয়ার ভুল শুদ্ধ ব্যবহারের প্রয়োগ নিয়েও দেখছি গোলোকচন্দ্র নির্দেশিকা তুলে দিয়েছেন।২১৫‘অসমত আহোমসকলে ছশ বছৰ স্বাধীন ভাবে ৰাজত্ব কৰে’ আমরা বাংলাতে একে সাধারণ বর্তমানের তির্যক প্রয়োগ বলেই লিখে এসেছি।আসলে ঘটনা অসমিয়াতেও তাই ঘটেছে।‘বিভক্তিপ্রধান’ সংস্কৃতে এটা হতে পারত না।কিন্তু গোলকচন্দ্র গোস্বামী একে ‘নিত্য বর্তমান’ বলে লিখেছেন।ব্যাখ্যাটি এরকম দিয়েছেন,“নিত্য মানে স্থায়ী,যিটো নিতৌ ঘটিব পারে।সেই কারণেই বোধহয় নিত্য বর্তমান,অতীত আরু ভবিষ্যৎ,--এই তিনিওটা কালকে প্রসঙ্গ ক্রমে বুজাবো পারে।”২১৬তাঁর এই ‘বোধহয়’ শব্দটি ধরে লীলাবতী শইকীয়া বরা এগিয়ে গিয়ে একটা স্থির সিদ্ধান্তে যেতে পারতেন।তিনি বহু প্রশ্নেই গোলোকচন্দ্রের ধারণার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন।কিন্তু ‘নিত্য বর্তমানে’র এই ব্যাখ্যাটি মেনে নিয়েছেন।২১৭তবে অধ্যাপক উপেন রাভা হাকাচাম অসমিয়া ভাষার সমকালীন রূপে বহু প্রশ্নেই ভাষার ব্যবহারকারীরা যে তির্যক প্রয়োগ করছেন,এবং প্রতিবেশী ভাষাগুলোর দ্বারাও প্রভাবিত হচ্ছেন,সেরকম প্রচুর নজির দিয়েছেন।যেমন এক জায়গাতে লিখেছেন,“পূর্ণ-অপূর্ণ ভূতকালর –ইছিলে/-ইলে/-লে আদি বিভক্তি সকর্মকর দরে অকর্মক ক্রিয়াতো নতুন প্রজন্মই বরকৈ ব্যবহার করিবলৈ লৈছে।যেনে--- সি আহিলে ভাল̖ আছিলে...।’২১৮ ‘–ইছিলে/-ইলে/-লে’ লিখলে বিভ্রান্ত হতে হয়।আসলে তিনি পরসর্গ ‘-এ’ জুড়বার কথা লিখতে চেয়েছেন।তবে কিনা এই প্রয়োগ একা কালের নয়,মূলত পক্ষের।অসমিয়াতে নিয়ম হলো মূলত সাধারণ অতীতে অন্যপক্ষে সকর্মক ক্রিয়ার শেষে ‘-এ’ পরসর্গ যুক্ত হয়, অকর্মক ক্রিয়াতে হয় না।কিন্তু কোথাও কোথাও যে অকর্মক ক্রিয়াতেও হয় সেরকম নজির গোলোকচন্দ্র গোস্বামী দিয়েছেন। যেমন---ল’ৰাটি শুলে;ৰামে হাঁহিলে ইত্যাদি।কিন্তু কেন জুড়ে কোনো কারণ উল্লেখ করেন নি।‘অপূর্ণভূত’ তথা অসম্পন্ন, সম্পন্ন সম্পর্কে এমন কিছু তিনি লেখেন নি। তিনি আরো লিখেছেন,“আহ̖,থাক̖,আছ̖ অকর্মক ধাতুর পরা হোয়া ধাতু শব্দত বহুতে আজিকালি –এ যোগ দি কথা কোয়া শুনা যায়।যেনে,আপুনি কেতিয়া আহিলে? সি কলিকতাত ক’ত থাকিলে?সি তাত দহদিনমান আছিলে।ইত্যাদি।”২১৯ এর পরে আমরা এটা সিদ্ধান্ত হিসেবেই বলতে পারি যে পরসর্গের তির্যক প্রয়োগ বাংলার মতো অসমিয়াতেও একটি স্বাভাবিক প্রবণতা।কালও ব্যতিক্রম নয়।‘মই অহা মাহত গুৱাহাটিলৈ গৈ আছোঁ’ কিংবা ‘অহা মাহত এম.বি.এ.কৰিবলৈ মই আমেৰিকা গৈ আছো।’২২০এহেন ভবিষ্যৎ কালের বাক্যে অসম্পন্ন বর্তমান কালের ক্রিয়ারূপের প্রয়োগ কি আমরা শুনি না?এহেন গঠন কি সত্যি অসমিয়াতে ভুল গঠন? প্রশ্নটা তোলা থাকলো।
এই চিত্র-০৮-এর ছকে প্রথম বারোটিই জগন্নাথ চক্রবর্তীর ছকে রয়েছে।২২১‘অচিরসম্পন্ন’ আদি ছাড়াও কিছু পারিভাষিক শব্দের রকমফের থাকলেও ভাবার্থের দিক থেকে তিনি এই বারোটি কালেরই প্রস্তাব করেছেন।‘সম্ভাব্য’ তথা সম্পন্ন ভবিষ্যৎ কালের ব্যবহারটি বিরল,বলে লিখেছেন।সম্ভব্য অতীত বলে কোনো কালের উল্লেখ করেন নি।তেমনি আমরা যাকে সাধারণ বর্তমান বলে লিখেছি,তিনি তাকেই নিত্যবর্তমান বলে লিখেছেন।তার জন্যে ক্রমিক নং ১৩-তে যেভাবে দেখিয়েছি,সেরকম কোনো রূপের উল্লেখ করেন নি।তিনি √কর̖ ধাতুর নজির দিয়েছেন।আমরা √যা ধাতুতে তাঁর উল্লেখ করা ‘বিভক্তি’গুলোই বসিয়েছি।শুধু অসম্পন্ন এবং সম্পন্ন অতীতে তিনি ‘আশ̖লো,শ̖লো’ ইত্যাদি পরসর্গের কথা লিখেছেন,কাছাড়ি বিভাষাতে বহু সময় সেরকমই উচ্চারিত হয় বটে।কিন্তু বাকি বিভাষাগুলোতে এবং সেগুলোতেও কাছাড়িতেও এর উচ্চারণ /ʃ/ নয় বরং /s/হবে।অর্থাৎ /ɐslɔ/,বিকল্পে পদটি/ɐsil/-ও হবে।বাকি ক্রমিক নং ১৩ থেকে ১৮ অব্দি আমরা অনুবাদ করবার চেষ্টা করেছি।প্রথম বারোটির সপক্ষে জগন্নাথ প্রচুর উদাহরণ তুলে দিয়েছেন,তাই আমাদেরও অসুবিধে হবার কথা নয়।আমরা শুধু পরীক্ষা করে দেখছি কিছু বাকি রইল কিনা,অথবা আমাদের সেই অনুবাদগুলো কষ্ট কল্পিত হলো কিনা।তবে একটি সমস্যার কথা উল্লেখ থাকা ভালো,সিলেটি যেহেতু লেখার ভাষা নয়—ইতিমধ্যে প্রস্তুত লিখিত সাহিত্যিক নজির আমাদের পক্ষে যোগানো মুশকিল।সিলেটি নাগরিপুথির ভাষাও প্রায় একালের বললেই চলে,তাও অনেকটাই সাধু বাংলার মতো।সেগুলোও বিশেষ সাহায্য করে না।তাই অধিকাংশ উদাহরণই আমাদের স্বনির্মিত।বিশ্বাসযোগ্যতার সপক্ষে যুক্তি একটিই যে এটি বর্তমান গবেষকের ‘মাতৃভাষাবৈচিত্র্য’।আবাল্য পরিচিতিটাই ভরসার স্থল।
দেখা যাচ্ছে,জগন্নাথ যে কালরূপগুলোর কথা লিখেছেন তাতে অনুজ্ঞা বাদ দিলে সিলেটিতে দশটিই মাত্র কাল। বহুপদী ক্রিয়ারূপ মাত্র তিনটি –ক্রমিক নং ৭ এবং ১১,১২।বাকি ন’টিই একপদী।কালের তিনিও মৌলিক- যৌগিক বিভাজন করেছেন।এবং সেখানে যে পাঁচটিকে মৌলিক কাল বলে ভাগ করেছেন সেগুলো হচ্ছে: ১)নিত্য বর্তমান,২)সাধারণ অতীত, ৩)নিত্তবৃত্ত অতীত,৪) সাধারণ ভবিষ্যৎ এবং ৫)বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞা।সিলেটিতে ‘ঘটমান বর্তমান’কে তিনি মৌলিক কালে রাখবার পক্ষে,মান বাংলার মতো যৌগিক কালে নয়।একে ধরলে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ছয়।এবং দুই অনুজ্ঞাকে আলাদা ধরলে দাঁড়ায় সাত।অন্যদিকে যে ছ’টি যৌগিক কালের উল্লেখ করেছেন,সেগুলো হচ্ছে:১)পুরাঘটিত বর্তমান,২)ঘটমান অতীত,৩)ঘটমান ভবিষ্যৎ,৪)পুরাঘটিত অতীত,৫)পুরাঘটিত ভবিষ্যৎ,এবং ৬)পুরাঘটিত নিত্যবৃত্ত অতীত।সব মিলিয়ে অনুজ্ঞা বাদ দিলে কালরূপ এগারো (১১)।২২২এখানে আবার পরিভাষাগুলো ভিন্ন দেখে মনে হয়,কোথাও তাঁর অস্থিরতা কাজ করছিল।অন্যথা ‘সম্পন্ন’র বদলে ‘পুরাঘটিত’ কেন?কথাটা আমরা এমনি এমনি লিখিনি।তিনি যেখানে দশটি ধাতুরূপ এবং বিভক্তির কথা আলোচনা করছেন,সেখানে এই ‘পুরাঘটিত নিত্যবৃত্ত অতীত’ বলে কোনো রূপের কথা নেই।২২৩ সুতরাং আমরা আমাদের ছকে ক্রমিক নং ১৬-তে সম্পন্ন নিত্যবৃত্ত অতীতের উল্লেখ সঠিক ভাবেই করেছি।তাঁর উদাহরণে ক্রিয়ারূপটি এই---করি থাকতে = √ কর̖+ই,√থাক̖+তে।কথাটি এরকম বাক্যে স্পষ্ট হতে পারে---মাইয়ার হরুকালো,স্কুলতনে আইবো কইয়া তাইর মায়ে পথর দিকে চাই থাক̖তো।
তেমনি সম্পন্ন ভবিষ্যতের রূপ মান বাংলার মতো সম্ভাব্য অতীতের কোনো অর্থ বহন করে না বলে আদৌ এই কালরূপটি আছে কিনা সেটি তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে।এড়িয়ে গেছে সুধাংশু শেখর তুঙ্গেরও।বিষয়টি বেশ জটিল,আমরা জট ছাড়াবার চেষ্টা করছি।এই রূপটি আমাদেরও দৃষ্টিতে পড়ত না,যদি না অসমিয়া রূপের সঙ্গে তুলনার দরকার পড়ত।চিত্র -০৪-এ যে ছক আছে সেটিতে বাংলা রূপগুলো হটিয়ে অসমিয়ার পাশাপাশি সিলেটি রূপগুলো বসিয়ে পরীক্ষা করেছিলাম। এখানে সেটি পরিসর কমাতে করে দেখাচ্ছি না।তাতে কোনো অসুবিধে হবে না।এই বাক্য দু’টি নিয়ে দেখা যাক --মারি লিলাম নে হিদিন।(সু.গা.পা:তিন),ইতা জড়িবুটি গাছ গাছালি পাতালতা আনিয়া না দিলে অষুদ বানাইলাম নে কেমনে (সু.গা.পা: ষোল)।এই ‘-নে’ অসমিয়া ‘হেঁতেন’ অনুপদের সিলেটি রূপান্তর।এই প্রশ্নে আমরা নিঃসংশয়।এবং এর মুক্ত উপরূপ ‘-অনে’।কোনো বাধ্যবাধকতা নেই যে ব্যঞ্জনান্তের পরে ‘-নে’ এবং স্বরান্তের পরে ‘-অনে’ বসতে হবে,তবে সাধারণত এই রীতিই অনুসরণ করে।যেমন--হে ডাকলে তুমি ঠিক গেলায়ওনে।এগুলো সিলেটি সম্ভাব্য অতীতের রূপ।অসমিয়ার ‘হেঁতেন’-এর সঙ্গে এই ‘-নে’-র ব্যবহারে স্বাতন্ত্র্যের দিকটি হচ্ছে একে ব্যবহার করে সিলেটিতে সম্ভাব্য ভবিষ্যতের বিকল্প রূপও তৈরি হয়।যেমন-যাইমুনে তরে লইয়া একদিন (সু.গা.পা:দুই),দেখ̖বে নে তর কিতা হয় (সু.গা.পা: দুই)।জগন্নাথ চক্রবর্তী লিখেছেন,সিলেটিতে ‘সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ কালে’র ব্যবহার বিরল।২২৪ তিনি আসলে ‘সম্পন্ন ভবিষ্যৎ’-এর এই পারিভাষিক নাম ব্যবহার করছিলেন।কিন্তু আমরা যে ‘সম্ভাব্য ভবিষ্যতে’র রূপটি দেখালাম—তার ব্যবহার সিলেটিতে ব্যাপক।এই ‘-নে’-কে নিশ্চয়ার্থক পরসর্গও বলা যাবে না,অনিশ্চয়ার্থক অবশ্যই বলা যেতে পারে।এটি ছাড়াই বরং ‘যাইমু’ কথাটি অনেক বেশি নিশ্চিতি প্রদান করে।মান বাংলাতে এমন বাক্যে ‘নাহয়’ অনুপদের ব্যবহার হয়।যেমন ---যাব নাহয়, তোকে নিয়ে একদিন।এই ‘না-’-এর সঙ্গে সিলেটি ‘-ন’-এর কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই।তার চে’ সিলেটি অপাদানের অনুপদ ‘-অনে,~অন্তে’-র সে সগোত্রীয়।তেমনি সিলেটিতে অসমিয়া রূপের আক্ষরিক অনুবাদ করলে ‘পুরাসম্ভাব্য নিত্যবৃত্ত অতীত’-এরও স্বতন্ত্র রূপ দুর্লভ নয়।যেমন -- হে যাওয়াত̖ থাক̖লনে। কিন্তু যখনই অসমিয়াতে তুলে দেয়া উদাহরণ বাক্যটি সিলেটিতে অনুবাদ করতে যাচ্ছি,তার রূপ দাঁড়াচ্ছে এরকম----- লক্ষ্মীনাথ বেজবৰুয়ায় যদি নিজে হাতো কলম তুলিয়া অসমীয়া ভাষার সাহিত্যর ভাড়াল ভরানি বাদ দিয়া ইংরেজর কাছে আবেদন লেখাত̖ থাক̖তা (লিখি থাকিলেহেঁতেন),তে অইলে অসমীয়া ভাষার স্বকীয় মর্যাদা পাইতে আরো দুইটা দশক লাগ̖লনে (লাগিলেহেঁতেন)।তার মানে,সিলেটিতে প্রথম ক্রিয়াপদটি হচ্ছে ‘অসম্পন্ন পুরা নিত্যবৃত্ত অতীত’-এর।যেটি আমরা রেখেছি ক্রমিক নং ১৫-তে।আর দ্বিতীয়টি সম্ভাব্য অতীতের তির্যক রূপ। পাশাপাশি এই বাক্যটিকে নেয়া যাক --হে হিদিকে বাজার করাত̖ থাক̖ল নে,আর তুই তারার লগে দেখা করিয়া আই গেলেনে। ‘করাত থাকল নে’ ক্রিয়াপদে নিত্য ঘটমান কোনো ঘটনা বোঝাচ্ছে না,কিন্তু কোনো এক বিশেষ দিনে বা কালে বহু সময় ধরে ঘটতে থাকতে পারত ---সেই সম্ভাবনার কথা বোঝাচ্ছে।একে ‘পুরাসম্ভাব্য নিত্যবৃত্ত অতীত’-এর বদলে ‘অসম্পন্ন পুরাসম্ভাব্য অতীত’ বলা যেতে পারে।এই দুই বাক্যের দু’টিকেই বা যেকোনো একটিকে সম্ভাবনা মুক্ত করে দিলেই ‘অসম্পন্ন পুরা নিত্যবৃত্ত অতীত’ রূপটির তির্যক প্রয়োগ মেলে।যেমন - হে হিদিকে বাজার করাত থাকত,আর তুই তারার লগে দেখা করিয়া আই যাইতে।একে ‘তির্যক প্রয়োগ’ বলবার কারণটি হচ্ছে---এই বাক্যেও রোজকার কোনো ঘটনার কথা বলা হচ্ছে না।
কাল বা ধাতুরূপের আলোচনার সময় জগন্নাথ চক্রবর্তী ‘পুরাঘটিত ঘটমান’ তথা ‘সম্পন্ন অসম্পন্ন’ বর্তমান বা অতীতের কোনো কথা লেখেন নি।কিন্তু অস্ত্যর্থক ক্রিয়ার প্রসঙ্গে √থাক̖ ধাতুর কথা বলতে গিয়ে কিন্তু সেরকম দুটি কালের উল্লেখ করেওছেন,নজিরও দিয়েছেন।যেমন---তাইন বউত̖বিল থাক̖ছইন;বারিশা পড়ার আগে কয়দিন থাক̖লাম।২২৫ এটিও আরেকটি জটিল বিষয়।‘বউতবিল’ আর ‘কয়দিন’ শব্দের অর্থ এই ক্রিয়ারূপগুলোকেও ‘সম্পন্ন অসম্পন্ন’ কালের অর্থ দিয়েছে বটে---এতে কোনো দ্বিরুক্তি চলবে না।কিন্তু রূপের দিক থেকে প্রথমটি সম্পন্ন বর্তমান,আর দ্বিতীয়টি সাধারণ অতীতের তির্যক প্রয়োগের নজির।এবারে এই শব্দ দু’টিকে দুই অসমাপিকা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে বা না করে দেখা যাক---তাইন [বউত̖বিল] বই (বসে) থাক̖ছইন;বারিশা পড়ার আগে [কয়দিন] গিয়া থাক̖লাম।প্রথমটি স্পষ্টই একটি ক্রিয়ার অর্থ বোঝালেও, দ্বিতীয়টিতে ‘গিয়া’ একাধারে স্বতন্ত্র কাজ এবং সংযোজকের কাজ করেছে।যাওয়া এবং থাকা দুই ভিন্ন ক্রিয়ার সাধারণ অতীত কালেরই অর্থ বোঝাচ্ছে।তারচে বরং – ‘বারিশা পড়ার আগে [কয়দিন] গিয়া থাকিয়া আইলাম̖’ লিখলে স্পষ্টতই থাকাটা ‘কয়দিন’ ধরে যে হয়েছিল-- সেটি উল্লেখ না করলেও বোঝা যাচ্ছে।এই বাক্য থেকে ‘থাকিয়া’ তুলে দিলেও অর্থের বিশেষ হের ফের হচ্ছে না,ত্রিপদী ক্রিয়াটি বড়জোর দ্বিপদীতে পরিণত হবে।-- ‘বারিশা পড়ার আগে [কয়দিন] গিয়া আইলাম̖’।একে সম্পন্ন- অসম্পন্ন অতীতের কালরূপ বলা যেতেই পারে।একই বাক্যের পুনর্গঠন এভাবেও সম্ভব--- ‘বারিশা পড়ার আগে [কয়দিন] গিয়া আই’।সুতরাং আমাদের ছকের ক্রমিক নং ১৭ এবং ১৮-র সমস্যার সমাধান হচ্ছে।এই দুই কালরূপ সিলেটিতে রয়েছে।
রইল বাকি,নিত্যবৃত্ত বর্তমান এবং নিত্যবৃত্ত অসম্পন্ন বর্তমান,যে কালরূপ দুটির উল্লেখ রয়েছে ক্রমিক নং ১৩ এবং ১৪তে।মান বাংলাতেও সাধারণ বর্তমান কালের রূপটির বিকল্প নাম ‘অনির্দিষ্ট’ বর্তমান।মানুষ জন্মায়,কবিরা কবিতা লেখেন, পাখি উড়ে---এই সব বাক্যের কালরূপ তাই।এগুলোকেই গোলকচন্দ্র গোস্বামী অসমিয়াতে এবং জগন্নাথ চক্রবর্তী সিলেটিতে ‘নিত্য বর্তমান’ বলে লিখেছেন।সুনির্দিষ্ট করে রোজ ঘটা ঘটনার যে স্বতন্ত্র কাল তথা ক্রিয়ারূপ মেলে আমরা অসমিয়াতেও দেখিয়ে এসেছি।সিলেটিতে --হে গিয়া থাকে এবং হে যাওয়াত̖ থাকে ---এই দুই বাক্যের প্রথমটি বিসদৃশ শোনাতে পারে, দ্বিতীয়টি কিছুতেই নয়।ভাষাটিতে অভ্যস্ত যে কেউ তা স্বীকার করবেন।কিন্তু ---হে হ বাড়ির ছাতেদি চাই থাকে;রাস্তা দি মাইনশর যাওয়া আওয়া দেখি থাকে;না করি,তবু ইগুর পিছে লাগি থাকে;আম ইতা সারা গাছর তলে পড়ি থাকে;পানর দোকানো গিয়া বই থাকে ---সিলেটিতে এগুলো মোটেও বেখাপ্পা বা অচেনা বাক্য নয়।একেবারেই বেখাপ্পা শোনাবে যদি লিখি---হে ই রাস্তা দি যাই থাকে।তেমনি,তাইন--- ই সময় রোগী দেখাত থাকইন; দুফরে খাওয়ার পরে আমি শওয়াত̖ থাকি; তুমি যখন ঘুম তনে উঠো আমি কলেজো যাওয়াত̖ থাকি---এগুলোও বেখাপ্পা শোনাবে না।ভ্রম হতে পারে এই ভেবে যে এগুলো যৌগিক কালের ক্রিয়ারূপ নাই বা হোক,যৌগিক ক্রিয়া তো বটে।সুতরাং ‘থাকে’ যখন সাধারণ বা ‘নিত্য’ বর্তমানেরই রূপ তার জন্যে আলাদা কাল প্রস্তাব করা কেন?বস্তুত আমাদের কাল প্রস্তাবটি অর্থ ধরে নয়,রূপ ধরেই।এবং শুধু শুধু এই ‘থাকে’ ক্রিয়াপদটি দিয়ে পুরো কাজটির অর্থ বোঝাই যায় না।একক ‘থাকে’ কথাটির মানে হচ্ছে ‘বাস করে’।তার আগে জুড়ে দেয়া অসমাপিকা রূপটি ক্রিয়ার অর্থ নিয়ন্ত্রণ তো করছেই,সে যে কোনো ‘যৌগিক ক্রিয়া’তেই করে থাকে।কিন্তু কালভেদে তার নিজেরও রূপ পাল্টাচ্ছে।ক্রিয়ার যদি মৌলিক –যৌগিক বিভাজন সম্ভব তবে তা অসমাপিকা ক্রিয়ারও সম্ভব।সেই তর্ক জগন্নাথ চক্রবর্তী এড়িয়ে গেছেন।ফলে তিনি যখন ‘করে ফেলা’ অর্থে সিলেটি ‘করিলাওয়া’ যৌগিক ক্রিয়াটির যৌগিক কালরূপ আলাদা দেখাতে গেছেন,কাল সংখ্যা কমিয়ে এনেছেন ছ’টিতে।দুই অনুজ্ঞা ছাড়া আর যে কালগুলোর কথা লিখছেন,সেগুলো হচ্ছে---অসম্পন্ন বর্তমান,অচিরসম্পন্ন বর্তমান,অদ্যতন অতীত,সম্পন্ন অতীত,সামান্য ভবিষ্যৎ,নিকট ভবিষ্যত২২৬বেশ কিছু অসঙ্গতি এতে চোখে পড়বে।প্রথমত অসম্পন্ন বর্তমান,অদ্যতন অতীত,সামান্য (বা সাধারণ) ভবিষ্যৎ এবং অনুজ্ঞার রূপগুলো তাঁর মতেই যেখানে ছিল মৌলিক কাল২২৭সেগুলো এখানে যৌগিক কাল হলো কী যুক্তিতে?বাকি রূপগুলোর কী হবে?আগে যেগুলোকে তিনি যৌগিক কালের রূপ বলে লিখেছিলেন,তার মধ্যে ‘করিলাওয়া’ ক্রিয়াপদটির জন্যে কিনা পেলেন শুধুই দু’টি।সম্পন্ন অতীত এবং ভবিষ্যৎ।খুব জরুরি নয় যে একটি ক্রিয়াপদের সব কালে সব রূপ থাকবেই,কিন্তু এখানে তাঁর কাল কাঠামোর পুরোটাই ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে।এটা হয়েছে মূলত সেই ‘মৌলিক-যৌগিক’ কালের ফাঁদে ক্রিয়ারূপগুলোকে ধরে ফেলবার ইচ্ছে থেকে।এমন এক ক্রিয়াপদ যার কোনো ‘নিত্যবৃত্ত’ এমন কি ‘নিত্য’ (বা সাধারণ) বর্তমান রূপও নেই। অবশ্য বর্তমানের অনুজ্ঞা আর সাধারণের রূপ একই ধরলে আছে,--সেটি তিনি উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন।কিন্তু ‘করিলাওয়াত থাকমু,করিলাওয়াত থাকমুনে,করিলাওয়াত থাকলামনে’ এই রূপগুলোতো সিলেটিতে সম্ভব আর শোনাও যায়। যেমন ---কুয়ার পারো গেলেউ পাইবায় তাই হক্কলর আগে কাপড় ধইয়া শেষ করিলাওয়াত̖ থাক̖ব।এই √লা নিয়ে তিনি বেশ উৎসাহী।একটি চমৎকার আশ্রিত ক্রিয়া বলেছেন ‘বরাক উপত্যকার আশ্রিত বাংলা’তে।‘লাওয়া’ ক্রিয়াপদের এর বিচিত্র প্রয়োগের বেশ কিছু নজির দিয়েছেন।এই নিয়ে আমাদের কোনো সংশয় নেই। কিন্তু এই উক্তিটি সামান্য অতিশয়োক্তি বলেই মনে হয়েছে,“‘লাওয়া’ ক্রিয়াপদের তুলনা কোনো আঞ্চলিক বাংলায়তো নেই-ই,মান্য বাংলাতেও এরূপ চমৎকার সহায়ক বা আশ্রিতক্রিয়া দুর্লভ।”২২৮ পূর্ববঙ্গীয় প্রতিবেশী ভাষাবৈচিত্র্যে এমন বাক্য নিদর্শন খুবই সুলভ -- দুইন্যা ঘুইরা হ্যাশ কইর্যালাও; ঈধের খুশিতে একটা কইর্যা তুইল্যা লাও আর গপাইত কইর্যা গিল্যা লাও।ক্রিয়াপদটি সাধু বাংলা √লহ,~লও থেকে এসছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়।কিন্তু তৎসম √লাভ/labh/থেকে আসেনি বলে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন।২২৯ বেশ এক জটিল প্রক্রিয়ার কথা তিনি বিস্তৃত লিখেছেন।আমরা সেদিকে এগোচ্ছি না।মান বাংলাতে ধ্বনিরূপান্তরে ধাতুটি √নাও।করে নাও,করে নিই ইত্যাদি ক্রিয়াপদে যেমন।√লও সংকুচিত হয়ে সিলেটিতে আসতে পারে।আবার অর্থ একই রেখে বিকল্পে ‘ফেল’ অনুপদ যোগ করেও মান বাংলাতে দাঁড়ায় ---করে ফেল,~ ফেলো,~ ফেলি ইত্যাদি।এই ‘ফেলি’ থেকেও সিলেটিতে আসতে পারে।ফেলি> ফালাই> হালাই> লাই এই ক্রমে।কিন্তু তার জন্যে সিলেটির ঐতিহাসিক ক্রমটি জানা দরকার,যা আমাদের কাছে সুলভ নয়।কিন্তু প্রতিবেশী ভাষাবৈচিত্র্য হয়েও আসতে পারে।যেমন চট্টগ্রামীতে আছে--- করি ফেলাইয়ম,ফেলাইবা,ফেলাবি ইত্যাদি।নোয়াখালিতে আছে--করি হ্যেলাইবেন̖,~হ্যেলাইবি,~ হ্যেলাইবো।২৩০এর থেকে ‘হ্যে’ লোপ পেয়ে সিলেটি অব্দি পৌঁছুনো এমন কঠিন কিছু নয়।বিশেষত যখন এই ‘হ্যে’ –বিমুক্তরূপ ঢাকাইয়া অব্দি মেলে। যেমন— হেমিংওয়ের বই দুইটা আমার পড়াই হইতাসে না,নাহ !একদিন পইড়ালামু।২৩১ অসমিয়াতেও এই ক্রিয়ারূপগুলো খুব কাছাকাছি--- কৰি লওঁ,~ লম,~ল’বা কিংবা ককৰি পেলাও,পেলাম,~পেলাবা ইত্যাদি।যেমন--অহা তিনিবছৰত দেশৰ প্ৰায় ১৪ কোটি কৃষকক লক্ষ্য কৰি লোৱা হৈছে২৩২যেখান থেকেই আসুক,বোঝা যাচ্ছে,এই √লা পরসর্গের মতো জুড়ে যাওয়াতে এর স্বাধীনতা তথা ব্যবহার বৈচিত্র্য মান বাংলার থেকে সিলেটিতে বাড়ে,এই মাত্র।ক্রিয়া ‘শব্দনির্মাণ’ পদ্ধতির আলোচনাতে এর গুরুত্ব থাকতে পারে,কিন্তু ‘পদনির্মাণ’ তথা কালরূপ নির্মাণে এহেন ‘আশ্রিত’ ক্রিয়ার আলাদা কোনো গুরুত্ব আছে বলে আমাদের মনে হয় না।এই ধাতু যোগ করেও ক্রিয়ার একপদী-বহুপদী বিভাজন সম্ভব এবং সামগ্রিকভাবে সিলেটি কালরূপের রীতির এই ধাতুটিও অংশীদার।তার জন্যে কোনো স্বতন্ত্র কালরূপ দেখা দেয় না,দেবার দরকারও নেই।সুতরাং নিত্যবৃত্ত বর্তমান এবং নিত্যবৃত্ত অসম্পন্ন বর্তমান ---এই দু’টি কালরূপও আমরা সিলেটিতে স্বীকার করে নিচ্ছি।
তবে কিনা,‘নিকট ভবিষ্যৎ’ বলে যে একটি নতুন কালের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন,সেটিকে উপেক্ষা করা কঠিন। উদাহরণ দিয়েছেন এরকম---করিলাইতাম̖,করিলাইতায়,করিলাইতে,করিলাইতা।দৃশ্যত গঠনের দিক থেকে এগুলো নিত্যবৃত্ত অতীতের মতো একই।কিন্তু সিলেটিতে নিকট ভবিষ্যতে ক্রিয়ার নিশ্চিতি বোঝাতে এই রূপটি ব্যবহৃত হয়,কখনো বা আরেকটি সহায়ক ক্রিয়াও জুড়ে দেয়া হয় অনুপদের মতো।যেমন -- যাইতায় গিয়া।আমি অসতী এর লাগি।(সু.গা.পা.:আঠারো) ‘গিয়া’-টি বাড়তি নিশ্চয়ার্থক অনুপদ।অন্যত্রও ব্যবহৃত হয় আমরা ভাব প্রসঙ্গে দেখিয়েছি।মান বাংলাতে ---করে নিতাম̖,করে নিতে,করে নিতেন̖,যেতেন̖,যেতাম̖,করতাম̖,পড়তাম̖ –ইত্যাদি নিত্যবৃত্ত অতীতের রূপ।কিন্তু কোনো ভাবেই নিকট ভবিষ্যৎ বোঝাতে এই রূপগুলো ব্যবহৃত হয় না।‘সুরমা গাঙর পানি’ থেকে তুলে দেয়া বাক্যটিকে মান বাংলাতে অনুবাদ করলে দাঁড়াবে এরকম-- যাবে গে।আমি অসতী এর জন্যে।অসমিয়াতে অনুবাদ করলে দাঁড়াবে এরকম-- মই অসতী,সেই গতিকে যাবা গৈ।সুতরাং এই নিকটি ভবিষ্যৎ রূপটি সিলেটি এবং প্রতিবেশী কিছু ভাষা বৈচিত্র্যেরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।চট্টগ্রামীও ব্যতিক্রম নয়।যেমন---যাইবার জাগা যেডে যেডে আছে বেউগ্যা যাইতাম̖ চাই।হ টেঁয়া পরিব?
এই অব্দি আলোচনার পরে তাহলে সিলেটি যে ক’টি কাল পাচ্ছি,সেগুলোকে পুনর্বিন্যাস করে আবার এখানে এইভাবে চিত্র -৯-এর ছকে দেখাতে পারি:
দেখা যাচ্ছে, দুই অনুজ্ঞা নিয়ে সিলেটিতে একপদী ক্রিয়ার কালরূপ পাচ্ছি বারোটি (১২)।বহুপদী ক্রিয়ার কালরূপ দশটি (১০)।সব মিলিয়ে সিলেটিতে কালরূপ বাইশটি (২২)।চিত্র-০৯-এ একপদী ক্রিয়াতে অনুপদগুলো বাদ দিলে ক্রমিক নং ৪এবং ৫,৬ এবং ৭,আর ৯,১০ এবং ১২-র রূপ একই।বহুপদী ক্রিয়াতে সমরূপতা নেই বললেই চলে।এবারে আমরা সিলেটি ক্রিয়াপদগুলো ভাব,পক্ষ,কাল বোঝাতে যে পরসর্গগুলো জুড়ে সেগুলোকে মান বাংলা এবং অসমিয়ার মতো আলাদা করে চিহ্নিত করবার মতো অবস্থাতে এসে গেছি।চিত্র-১০-এ একপদী এবং চিত্র -১১-তে বহুপদী ক্রিয়ারূপগুলো বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছি।বাংলার মতোই যদি কাল স্তম্ভে ‘+এ’ আছে,পক্ষ স্তম্ভে [+এ],তবে বুঝতে হবে একই রূপিমে কাল পক্ষ দুইই বোঝাচ্ছে।উপরূপগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা।প্রথম বন্ধনীতে (+ই) থাকলে বিকল্প রূপ বোঝাবে।যথারীতি বহুপদী ক্রিয়ার প্রথম পদের পরসর্গগুলো পাশের কোষে উপরে,এবং দ্বিতীয় পদের পরসর্গগুলোকে নিচের অবস্থানে পড়তে হবে।
দেখা যাচ্ছে, ছকটি অসমিয়ার থেকেও সামান্য জটিল হয়ে পড়েছে।যেমন ক্রমিক নং ১১-তে শ্রোতা পক্ষে তুচ্ছার্থে ভাব বোঝাবার পরসর্গটির দরকার পড়ছে না,এবং আমাদের ‘-উক̖’ লিখেও কেটে দিতে হচ্ছে,শুধু ‘~০’ দিয়েই সেটি বোঝানো যাচ্ছে না।তেমনি ক্রমিক নং ২-তে √যা এবং ক্রমিক নং ৫-এ √আ ধাতুর পরে ‘-ই’ যোগ করে এবং না করে দুই বিকল্প রূপই রয়েছে।অর্থাৎ ‘যারা- যাইরা,আরা-আইরা’ দুটোই চলবে।কিন্তু অন্য পক্ষে কিছুতেই সেটি যুক্ত হবে না,সর্বাবস্থাতেই হবে ‘যার̖’ এবং ‘আর̖’।তেমনি এই ছকে উপস্থাপনে আরেকটি সমস্যা হচ্ছে বক্তা পক্ষে সাধারণ ভবিষ্যৎ,ভবিষ্যতের অনুজ্ঞা এবং আরো কিছু কাল রূপে ‘-ব̖’-এর বদলে ‘-ম̖’-এর পরে ‘-উ’ জোড়ে---সেটিকে নিয়ে।এই ব্যাপারটি অসমিয়াতেও দেখা যাচ্ছে।সেদিক থেকে দৃশ্যত মনে হয় সিলেটি এবং অসমিয়া মান বাংলার থেকে আলাদা।মান বাংলা যাবো = অসমিয়া যাম̖= সিলেটি যাইমু।বস্তুত এই সর্গটি মান বাংলাতেও নেই নয়,‘থাকতাম̖,দেখলাম̖’ ইত্যাদি ক্রিয়াপদে বহাল তবিয়তে আছে।এটি লোপ পেয়ে পূর্বস্বরকে অসমিয়াতে অনুনাসিক করে দেয়াতেই ‘গলোঁ,খালোঁ’ ক্রিয়াপদগুলো সম্ভব হয়েছে।মান বাংলাতে সেই অনুনাসিক রেশটকুও চলে গেছে,নইলে দক্ষিণ পশ্চিম বাংলার রাঢ় বাংলাতেও ‘-ইলুঁ, -ইলোঁ’ ইত্যাদি অনুনাসিক পরসর্গের রূপ বিরল নয়।সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সেরকম নজির দিয়েছেন।২৩৩এই প্রসঙ্গে তিনি মিথিলার থেকে ওড়িশা,দক্ষিণ বাংলা হয়ে উত্তর বাংলা এবং আসাম অব্দি প্রত্ন বাংলার বিভিন্ন বাক অভ্যাসের প্রব্রজন এবং রূপ গড়ে উঠবার,বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী এবং শ্রেণি ভাষার প্রভাবের বিচিত্র এবং চিত্তাকর্ষক কাহিনি বর্ণনা এবং কল্পনা করেছেন। সুকুমার সেনও এর উৎস সম্পর্কে নানা মত ব্যক্ত করেছেন।২৩৪ বাণীকান্ত কাকতি যে একে ধ্বনিগত রূপান্তর লিখেছেন, আমরা আগে উল্লেখ করেছি।সেসবে আপাতত বিস্তৃত যাচ্ছি না,শুধু এইটুকুন উল্লেখ থাকা জরুরি যে রূপটি মাগধী অবহঠ̖টেই ছিল,সেখান থেকে প্রাচীন বাংলাতে-অসমিয়াতেও এসেছিল।যেমন- পেখমি দহদিহ সর্ব্বই শুন(চর্যা:৩৫)।পুব বাংলার কিছু কিছু ভাষাবৈচিত্র্যে ‘-ইবাম̖’ রূপটিও মেলে।যেমন ময়মন সিংহ গীতিকাতে আছে---মা ছাড়̖বাম̖ বাপ ছাড়̖বাম̖ ছাড়̖বাম̖ ঘর বাড়ী।তোমারে লইয়া কইন্যা অইয়াম̖ দেশান্তরি।।আরেকটি এরকম--- কি কর̖বো ভাই বাড়ী ঘরে খাইবাম̖ ভিক্ষা মাগে।আমার কন্যা পাগল হইছে নদ্যার ঠাকুরের লাগে।।২৩৫একই স্তবকে সাধারণ ভবিষ্যৎ কালরূপে ধ্বনি পরিবর্তনের সুন্দর বৈচিত্র্য ধরা দিয়েছে।‘আইয়ম̖’- ‘ব’ লোপের প্রবণতা দেখাচ্ছে,‘য়’-শ্রুতি হয়েছে।আবার দ্বিতীয় স্তবকের ‘করবো’-তে ‘ম’-টিই নেই।এই লোপ প্রক্রিয়াতে ছন্দের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করবার যথেষ্ট সংগত কারণ আছে।‘করবো’কে ‘করবাম̖’ লিখলে ছন্দ পতনের সমূহ সম্ভাবনা ছিল সে কথা পল্লিকবিও মনে রেখেছেন।যাই হোক,এই সব জটিলতার কথা মনে রেখে ছকটি পড়তে হবে।
এবারে স্পষ্ট যে গঠন বিচারে সিলেটিতে ক্রিয়ার কাল নির্ণয় করতে একপদী এবং বহুপদী ক্রিয়ার দ্বিতীয়াংশের সঙ্গে মাত্র এই এগারটি রূপিমই যুক্ত হচ্ছে ‘+এ,+(-ই)র̖,+ছ̖,+ল̖,+ত̖,+ছ̖,+ইব̖(-ইম̖),[+উক̖],+(-ই)ল̖,+ইল̖,+ব̖(-ম̖)’। অসমিয়ার থেকে সংখ্যাটি চার বেশি,মান বাংলার থেকে এক।অসমিয়াতে ‘-হেঁতেন’ অনুপদটিকে যেভাবে রেখেছিলাম সিলেটি ‘-নে’ পরসর্গ বা বিকল্পে অনুপদটিকে সেই ভাবেই ক্রম মেনেই পক্ষ স্তম্ভে রেখেছি অতিরিক্ত সর্গ হিসেবে।এ শুধু ক্রিয়ার সম্ভাবনার অর্থই স্পষ্ট করে,কাল কিংবা পক্ষ নয়,---আমরা আগেই লিখেছি।তেমনি সিলেটিতে একটি নিশ্চয়ার্থক অনুপদ নিকট ভবিষ্যতে যুক্ত হয়।তাই একই ক্রম মেনেও একে রেখেছি।কিন্তু যুক্ত না করলেও হয় বলে সেটি আছে প্রথম বন্ধনীতে।
কাল প্রসঙ্গটি ইতিমধ্যে বেশ দীর্ঘ হয়েছে।অথচ দুই একটি প্রতিবেশী ভাষাবৈচিত্র্য না ছুঁয়ে গেলে সম্পর্কের বিস্তারটি বোঝা যাবে না।সুবিধের জন্যে আগে যদিও নোয়াখালি,চট্টগ্রামী দুই ভাষা বৈচিত্র্য নিয়েই আমরা আলোচনা করেছি,এখানে শুধুই চট্টগ্রামীকে তুলে নিচ্ছি।রবীন্দ্র কুমার দত্ত যথারীতি কালের মৌলিক-যৌগিক বিভাজন মেনে এগিয়েছেন।রামেশ্বর শ’ তিনি পড়েছেন,তার পরেও তাঁর যুক্তিকে কেন নাকচ করছেন,লিখলে সুবিধে হতো।যাই হোক,নোয়াখালি ও চট্টগ্রামীতে মৌলিক কাল তাঁর মতে চারটি— সাধারণ বর্তমান,সাধারণ অতীত,অভ্যাসগত বা নিত্যবৃত্ত অতীত এবং সাধারণ ভবিষ্যৎ। যৌগিক কাল ছ’টি--- ঘটমান বর্তমান,ঘটমান অতীত,ঘটমান ভবিষ্যৎ,পুরাঘটিত বর্তমান,পুরাঘটিত অতীত,পুরাঘটিত ভবিষ্যৎ বা সম্ভাব্য অতীত।অর্থাৎ মান বাংলার কাল সম্পর্কে সুনীতিকুমার যেগুলোর কথা লিখেছিলেন সেগুলোই রয়েছে।শুধু যৌগিক কালের চারটি ‘নিত্যবৃত্ত’ বিভাজন নেই।নেই রামেশ্বর শ’ প্রস্তাবিত ‘পুরাঘটিত ঘটমান’ বর্তমান এবং অতীত।আমরা আগেই লিখেছি তিনি কাল এবং পুরুষ এক সঙ্গে আলোচনা করেছেন।তিনি যে ছকটি তৈরি করেছেন সংগত কারণেই সেটি অনেক দীর্ঘ,তারপরেও আমাদের মতো কালের পরসর্গগুলো সুচিহ্নিত নয়,সেটি করতে গেলে কাজটি আরো দীর্ঘ হবে।আমরা তাই,সেখান থেকে চট্টগ্রামী ভাষা বৈচিত্র্যে সামান্য অন্য পক্ষের ক্রিয়ারূপগুলো তুলে নিয়ে নিজেদের মতো পুনর্বিন্যাস করে তাঁর কালভেদ বুঝবার চেষ্টা করছি:
এর চাইতে বেশি কালরূপের সন্ধান চট্টগ্রামীতে মিলছে কিনা সেই অনুসন্ধানে আমরা যাচ্ছি না।সঙ্গত কারণেই। কিন্তু একপদী-বহুপদী ক্রিয়াপদে বিভাজন করে দেখছি চেহারাটি দাঁড়ায় কেমন।সেই সঙ্গে এগুলোর সিলেটি প্রতিরূপ বসিয়ে দেখছি সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য কিছু ধরা দেয় কিনা।
আমরা সিলেটিতে স্বতন্ত্র সম্ভাব্য অতীতের আর নিকট ভবিষ্যতের রূপের কথা লিখেছিলাম।এই দু’টি একপদী রূপ নিয়ে সিলেটিতে সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছিল নয়।এখানে এগুলো বাদ দিয়ে সংখ্যাটি সাত দাঁড়ালেও কিছু ধ্বনি-দূরত্ব বাদ দিলে দুই ভাষাবৈচিত্র্যতেই একপদী ক্রিয়ার পরসর্গগুলো প্রায় একই।সিলেটিতে নিকট ভবিষ্যতের রূপ নিয়ে বলতে গিয়ে একটি চাঁটগেয়ে বাক্য তুলে দিয়ে আমরা দেখিয়েছি চট্টগ্রামীতেও ক্রিয়ার স্বরূপার্থে এই কালরূপটি সম্ভব।তেমনি,‘নে’ অনুপদ জুড়ে সম্ভাব্য অতীতের রূপও চট্টগ্রামী কিংবা নোয়াখালিতে দুর্লভ হবে বলে আমাদের মনে হয় না।রবীন্দ্র কুমার দত্ত যখন ‘ভাব’ নিয়ে কথা বলছেন,সেখানে রামেশ্বর শ’য়ের উদ্ধৃতি দিয়ে একাধিকবারেই লিখছেন,সেসব কথা চট্টগ্রামী-নোয়াখালি প্রসঙ্গেও ‘সুপ্রযুক্ত হতে পারে’।২৩৬অন্তত কোথাও লেখেন নি যে অন্যপক্ষে ভবিষ্যতের অনুজ্ঞার রূপ নেই।তবু কেন শুধুই শ্রোতা পক্ষের নজির দিয়ে সারলেন,আমরা বুঝিনি।যাই হোক,আমরা সঙ্গতির জন্যে সিলেটিতে যে রূপটি এখানে নিলাম,সেটি ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞার বিকল্প ক্রিয়ারূপ ---এ প্রসঙ্গেও আমরা আগে লিখে এসেছি।আরেকটু নিবিড় অনুসন্ধান করলে চট্টগ্রামীতেও বহুপদী কালরূপ সিলেটির সমানে না হলেও আরো কিছু মিলবে বলেই আমাদের অনুমান।সম্পন্ন ভবিষ্যতে ‘করি ফে̣লাইবো’ রূপটি দেখে আমরা প্রায় নিশ্চিতই যে তিনি এই নিয়ে ভাবেন নি বিশেষ।অনুমান করতে পারি এর এমন সব রূপও রয়েছে--- ‘করি ফে̣লাই’,‘করি ফে̣লাইয়ুম’,‘করি ফে̣লাইত̖ত’,‘করি ফে̣লাইজ̖জে’।অন্ততমান বাংলা বা সিলেটিতে তো এর প্রতিরূপ রয়েইছে। এগুলোর তবে কী কাল হত?আমাদের এই প্রশ্নের কারণটা এই যে আমাদের মতে ‘করি ফে̣লাইবো’ একটি ‘যৌগিক ক্রিয়া’ এবং সাধারণ ভবিষ্যতের রূপ।এমন কোনো কারণ নেই যে আমরা যেগুলোকে একপদী ক্রিয়ার কালরূপ বলেছি,সেগুলো ‘যৌগিক ক্রিয়া’র কালরূপ হতে পারবে না।রামেশ্বর শ’ লিখেছেন,“ ...মৌলিক ক্রিয়া ও যৌগিক ক্রিয়ার মধ্যে সূক্ষ্ম অর্থগত পার্থক্য আছে,কিন্তু ক্রিয়ারূপের অর্থাৎ বিভক্তির কোনো পার্থক্য নেই।”২৩৭তবু যেটুকু পাওয়া গেছে তাতে দুই ভাষাবৈচিত্র্যে বিরোধ বিশেষ কিছু নেই।বৈসাদৃশ্যের যেটুকুনি দেখা যাচ্ছে তার অধিকাংশই মূলত ধ্বনিতাত্ত্বিক কারণে হচ্ছে।এবারে আমরা রবীন্দ্র দত্তের ক্রিয়ারূপগুলোকেই ভেঙে পরসর্গগুলো চেনার চেষ্টা করি।ছকটি সিলেটির থেকেও অনেক জটিল হবে।এবং বিষয়গুলো যেটকুন স্পষ্ট রবীন্দ্র কুমার দত্ত করতে পেরেছিলেন,আমরা যে সেটুকুনও করতে পারব,সেরকম দাবি করি না। শুধু এই ভাষাবৈচিত্র্যের কিছু স্বতন্ত্র স্বভাব এবং নিজস্ব জটিলতার দিকে,সঙ্গে সঙ্গে মান বাংলা সহ প্রতিবেশী ভাষাবৈচিত্র্যগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের দিকে অনেকটা সাংকেতিক দৃষ্টি আকর্ষণের কাজটিই করতে পারব।গোটা বিষয়টি নিয়ে বিস্তৃত অধ্যয়ন অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক হতে পারত,এবং বেশ কিছু নতুন সূত্র নির্দেশ করা যেত কিংবা যাবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।কিন্তু এই মুহূর্তে এই ভাষাবৈচিত্র্যটি আমাদের অধ্যয়নের কেন্দ্রে নেই,তাই বিরত থাকছি।চিত্র-১৪-তে একত্রে একপদী বহুপদী ক্রিয়ারূপগুলো বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছি।বাংলার মতোই যদি কাল স্তম্ভে ‘+এ’ আছে,পক্ষ স্তম্ভে [+এ],তবে বুঝতে হবে একই রূপিমে কাল পক্ষ দুইই বোঝাচ্ছে।উপরূপগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা।প্রথম বন্ধনীতে (√গর̖) থাকলে বিকল্প রূপ বোঝাবে।যথারীতি বহুপদী ক্রিয়ার প্রথম পদের পরসর্গগুলো পাশের কোষে উপরে,এবং দ্বিতীয় পদের পরসর্গগুলো কে নিচের অবস্থানে পড়তে হবে।
স্পষ্ট যে,এই ছক দেখে ক্রিয়াপদগুলোর পূর্ণরূপ গড়ে তোলা কঠিন,যেটি সহজ ছিল মান বাংলাতে।সিলেটি বা অসমিয়াতেও সেরকম কঠিন ছিল না।তাও যদি কালের এক একটি উপবিভাজনে ক্রিয়ারূপ একটি থাকত।সম্পন্ন বর্তমানের রূপটিই নেয়া যাক।√কর̖ (√কইর̖,√গর̖)।ধাতু এখানে একটিই --√কর̖।তার সঙ্গে অসমাপিকার ‘-এ’ (~ইয়া) যুক্ত হচ্ছে। সাধুবাংলা রূপ ‘করিয়াছি’ ---মনে রাখা যাক।সেই ‘-ইয়া’-র ‘-ই’ অপিনিহিতির ফলে আগে চলে যাচ্ছে,‘য়’ লোপ পাচ্ছে। প্রকৃতি তথা ধাতুটি হচ্ছে ‘কই̖র’।তাও কখনো কখনো।কখনো বা প্রথম ধ্বনির ঘোষীভবন হচ্ছে।তাতে কখনোবা ধাতুটি হচ্ছে ‘গর̖’,কখনো বা ‘গইর̖’।এবারে তার সঙ্গে কাল বোঝাতে যে মধ্যসর্গটি যুক্ত হচ্ছে সেটিও আসলে ‘ছ̖’-ই।তারপরে যুক্ত হচ্ছে পক্ষ বোখাবার পরসর্গ ‘+এ,~অ,~অন̖,~অশ̖,~ই’।এগুলো এই কালরূপে স্পষ্ট।সে নিয়ে বেশি সমস্যা নেই।অন্যত্র সেগুলো নিয়েও রয়েছে,যেমন ক্রমিক নং ছ’য়ে(৬)সম্পন্ন অতীতের রূপে।কিন্তু সেই কাল বোঝাবার ‘ছ̖’ হয় নিজে সর্বত্র অক্ষত থাকছে না,অথবা আগে পরের ধ্বনিগুলোকে থাকতে দিচ্ছে না।যেমন –একা বক্তা পক্ষেই ক্রিয়ারূপটির পাঁচটি রকমফের দেখিয়েছেন রবীন্দ্র কুমার দত্ত এরকম---কইর̖গি,কর̖গি,গর̖গি̖,কর̖জি,কজ̖জি,কর̖ৎিস।তাই লিখছিলাম,এগুলো স্পষ্ট করতে স্বতন্ত্র পদ্ধতির দরকার।তেমনি অসম্পন্ন অতীত এবং ভবিষ্যতের রপগুলো নেয়া যাক।আমরা লিখে এসেছিলাম –কাল- পক্ষ- ভাব বোঝাবার পরসর্গগুলো সমাপিকা অংশেই জোড়ে।এখানেও তাইই হচ্ছে।কিন্তু অসমাপিকা অংশটুকুও যেন সেই সব সম্পদে জবর দখল কায়েম করছে,পক্ষভেদে তাদেরও পরসর্গের পোশাক চাই।ফলে সম্ভ্রমার্থে মান বাংলাতে যেখানে ‘কর̖ছিলেন’,সিলেটিতে যেখানে ‘করাত আছলা’ চট্টগ্রামীতে সেখানে ‘কইততেন আৎিসলেন’।এগুলোতে অবশ্য রবীন্দ্র কুমার দত্ত ‘কইত̖তেন লাগ̖জি̣লেন̖’ এরকম ত্রিপদী ক্রিয়ারও বিকল্প রূপের উল্লেখ করেছেন।সব পক্ষেই রয়েছে।আমরা জটিলতা বাড়াব না বলে সেটি এড়িয়ে গেছি।তাছাড়া এগুলো আদৌ বিকল্প,না- ‘করি ফে̣লাইবো’-র মতো যৌগিক ক্রিয়া নিয়ে বিভ্রান্তিবশত অহেতুক ভিন্ন ক্রিয়াপদের উদাহরণের ভার,অথবা কালের ভিন্নতর উপবিভাজনের রূপ এই নিয়ে আমাদের সংশয়ও আছে।যেমন আমরা নিঃসংশয় যে ক্রমিক নং ৯তে ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞার রূপে শ্রোতা ছাড়াও অন্যপক্ষের পরসর্গ থাকা উচিত ছিল।এবং সেগুলো মোটের উপরে সাধারণ ভবিষ্যতের মতো একই হতো।এই সব সমস্যাকে পাশে সরিয়ে রেখেও যদি এই ছক থেকে উপরূপগুলোকে বাদ দিয়ে চট্টগ্রামীতে কাল বোঝাবার সর্গগুলোকে আলাদা করতে চাই তবে সেগুলো হচ্ছে এই ক’টি মাত্র—‘+এ,+এর̖,+গ̖,+ল̖,+ত̖,+ইব̖,+উক̖,+ই,+ইল̖’।অনেকে একে অতিসরলীকরণ বলতেই পারেন।কিন্তু প্রাথমিক ধারণার জন্যে এহেন সরলীকরণের বিকল্পই বা কী?অন্যথা ব্যাকরণে বা ভাষাবিজ্ঞানে সাধারণের আগ্রহ বাড়বে কেন?বস্তুত এই অব্দি এগিয়ে আমাদের ধারণা হচ্ছে,আমরা যেভাবে মান বাংলার থেকে শুরু করে চট্টগ্রামী অব্দি এগিয়েছি তার বিপরীতে যদি ক্রমটি উলটে দিয়ে চট্টগ্রামী থেকে মান বাংলা -- সব ক’টি ভাষাবৈচিত্র্য নিয়ে একটি তুলনামূলক অধ্যয়ন করতে পারতাম তবে পদ্ধতিটি স্বতন্ত্র হত এবং সম্ভবত সূত্রায়িত করা অনেক সহজ হত।আমাদের সমস্যা হলো,আমরা মান বাংলা অধ্যয়নের পদ্ধতিটিকে আদর্শ (Model) হিসেবে নিয়ে কাজ শুরু করি,বর্তমান অধ্যয়নও তার ব্যতিক্রম নয়।
লিঙ্গ:
বাংলা কিংবা অসমিয়াতে ক্রিয়ারূপ নিয়ন্ত্রণে লিঙ্গের কোনো ভূমিকা নেই।কিন্তু অসমিয়াতে যেমন নামরূপের নিয়ন্ত্রণে ‘পক্ষ’-এর সামান্য হলেও একটি ভূমিকা আছে,সেরকম সিলেটি ক্রিয়ারূপে বিশেষ করে কাছাড়ি বিভাষাতে লিঙ্গের ভূমিকা আছে বলে জগন্নাথ চক্রবর্তী লিখেছেন।তবে কিনা বরাক উপত্যকার ভাষাটি কতটা খাটি বাংলা সেটি দেখাতে গিয়ে চর্যাপদ এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কতটা নিকট আত্মীয় সেটি দেখাবার মোহেও তিনি কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হয়েছেন বলেও আমাদের অনুমান।তাঁর গ্রন্থের শেষের দিকে আলাদা করে চর্যা এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সঙ্গে বরাক উপত্যকার বাংলার তুলনামূলক আলোচনা একটি বাড়তি প্রাপ্তি।তিনি লিখেছেন,“মধ্যবাংলা বা শ্রী কৃষ্ণকীর্তনের অনেক শব্দই বরাক বাংলায় প্রায় অপরিবর্তিতভাবে রয়েছে।শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের লিঙ্গানুশাসনের [কোঁঅলী পাতলী বালী = কোমল পাত̖লা বালিকা] ছাপ এখনো আছে;তবে শুধু ক্রিয়াপদে।যেমন--- ‘তাই (She) আবো আইলি না।’ ‘মণিএ তাইর হরু বইনরে বিয়াও দিলি।’ এখানে স্ত্রী প্রত্যয় ‘ই’ ক্রিয়াপদে যুক্ত হয়েছে।পাশাপাশি পুংলিঙ্গের একটি দৃষ্টান্ত দিলে ব্যাপারটা সুস্পষ্ট হবে।যেমন- হে (He) আবো আইল না।”২৩৮এই লিঙ্গ সঙ্গতির ব্যাপারটি প্রাচীন অপভ্রষ্টেই ছিল।এ যে শুধু ক্রিয়াপদেই হতো এমন নয়,কৃদন্ত বিশেষণেও হত,এবং প্রাচীন বাংলাতে ছিল লিখেছেন সুকুমার সেন।২৩৯চর্যাতে যেমন-সোণে ভরিলী করুণা নাবী(চর্যা:৮)। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও মেলে---উতরলী নহ রাধা মন কর থীর।কিন্তু তারপরেও ব্রজবুলি বাদ দিলে অপভ্রংশ–অবহট̖ঠের এই লিঙ্গ সঙ্গতির রীতি সেভাবে মাগধী কোনো ভাষাতে আসে নি বলেই সুকুমার সেন মনে করেন।‘রাধা মন কর’ এই অংশেই তা সত্য মনে হচ্ছে।এই পরসর্গ গুলো কর্মবাচ্য,ভাব এমন কি পক্ষ বোঝাতেও ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে।সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেন নি,তবে অতীত কালেই যে ব্যবহৃত হত এ নিশ্চিত হয়েই লিখেছেন।২৪০ জগন্নাথ চক্রবর্তী যে নজির গুলো দিয়েছেন সেগুলো কাছাড়ি বিভাষাতে কোথাও কোথাও শোনা যেতে পারে।তবে ব্যাপক তথা সাধারণ রীতি নয় বলে নিশ্চিত হয়েই বলা যায়।শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সঙ্গে সিলেটি পদনির্মাণ পদ্ধতির তুলনা দেখাতে গিয়ে এমন বাক্যের নজিরও তো তিনিই দিয়েছেন-- ‘বউনার লগে তাই ধামালি করের তে কিতা অইছে’;২৪১ তাই শরম পাইত কিতা উলটিয়া আসে।২৪২
ক্রিয়ারূপের আনুষঙ্গিক অন্যান্য প্রসঙ্গ:
বহুপদী ক্রিয়া গঠনের দরকার ছাড়াও আরো কয়েকটি অসমাপিকা ক্রিয়ার রূপ আছে,এগুলো নামপদেরই বিকল্পে ব্যবহৃত হয়।পক্ষ অনুযায়ী এই রূপের কোনো বদল ঘটে না।যেমন:
১) সংস্কৃত ব্যাকরণে যাকে বলে তুমর্থক,তথা নিমিত্তার্থক অসমাপিকা ক্রিয়া।যেমন—মানবাং.শিলচর যেতে বেশ টাকা লাগবে।‘যেতে’ অর্থাৎ যাবার জন্যে।এর সিলেটি প্রতিরূপ---শিলচর যাইতে বাক্কা টেকা লাগবো।√যা +তে (~ইতে)।এর অসমিয়া প্রতিরূপ হবে-- শিলচৰ যাবলৈ অনেক ট’কা লাগিবো।এগুলোকে ‘নিমিতার্থক ক্রিয়া’ লীলাবতী শইকীয়া বরাও লিখেছেন।তাঁর একটি নজির---তোমাৰ ওচৰত অংকটো শিকিবলৈ আহিছোঁ।চট্টগ্রামীতে--- হিতারে মাচ̖চুন দিত̖ ফা̖ইরবানে? এরকম অসমাপিকাতে একটি নোয়াখালি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্র কুমার দত্ত।সেখানে অসমাপিকাটির পক্ষ ভেদে রূপবদল হয়।যেমন—আঁ:́ই দেইখ̖তাম চাইতাম̖।অসমাপিকার এমন তির্যক গড়ন কিন্তু সিলেটিতেও দুর্লভ নয়।যেমন—তখন হুক্কুরবারে নতুন সিনেমা লাগাইলেঊ গিয়া দেখতাম চাইতাম!
২) সম্পন্ন সংযোজক ক্রিয়া।ওখানে গিয়ে তুমি কাজটা করো।বাক্যটি এভাবেও লেখা যেত—তুমি ওখানে যাও এবং কাজটা করো।‘এবং’-এর বিকল্পে অসমাপিকা ‘গিয়ে’ দিয়ে বাক্য দু’টি জুড়ে দেয়া হয়েছে।বাক্যটির অসমিয়া প্রতিরূপ হ’বে এরকম –তুমি তালৈ গৈ কামটো কৰা।তেমনি –--ৰামে কিতাপ পঢ়ি উঠি ভাত খালে।এগুলোর সিলেটি প্রতিরূপ---হখানো গিয়া তুমি কামটা করো;রামে বই পড়িয়া উঠিয়া ভাত খাইল। নোয়াখালি--আঁ:́ই বা’ত খা̣ই বাড়িত জা̣ইয়ের।চট্টগ্রামী--- আঁ:́ই বা’ত খা̣ই বারিত জা̣ইর।
৩) সর্তজ্ঞাপক সংযোজক ক্রিয়া।আমি গেলে (পরে/তবে) তুমিও এসো।√গ̖ (~গম̖)+লে।এর অসমিয়া প্রতিরূপ হতে পারে—মই গ’লে তুমিও আহিবা।তেমনি--- মাৰ খালত সি সঁচা কথাটো কৈ দিলে।এগুলোর সিলেটি প্রতিরূপ—আমি গেলে (পরে/তেউ) তুমিও আইও;মাইর খাইয়া হে হাচা কথাটা কৈ দিছে।
এগুলো ছাড়াও বাংলাতে -আ(~ওয়া),-অন̖(~ওন̖),-অনা(~না~ওনা),-আনি(~উনি),-- এমন কিছু পরসর্গ যোগ করে চটা,খাওয়া,চলন,দেনা,পাওনা,বাঁধুনি,শুনানি এরকম ক্রিয়াবিশেষ্য তৈরি করা হয়।কখনো বা একাধিক রূপিমও যোগ করা হয়,যেমন,~যা+ওয়া+র=যাবার।রামেশ্বর শ’ ‘ওয়া’র কথা লেখেন নি।লিখেছেন,‘-বা(~ইবা)’ প্রত্যয় যোগ করা হয়।২৪৩ এ আসলে ‘ওয়া’রই উপরূপ।‘-র’ যোগ করলে ব-শ্রুতি হয়।অসমিয়াতেও সেরকম-অন̖,-আ,-ইব পরসর্গ যোগে খাৱন, শোৱন,পঢ়া,খোৱা,খুৱাব,পঠিয়াব ইত্যাদি ক্রিয়াবিশেষ্য তৈরি হয়।২৪৪একাধিক রূপিমে ক্রিয়া বিশেষ্যের নজিরও অসমিয়াতে আছে।যেমন ‘-অন̖’ পরসর্গের পরে ‘–ই’ বা ‘-আ’ যোগে সাধারণ সংজ্ঞাবাচক ক্রিয়াবিশেষ্য তৈরি হয় বলে লিখেছেন গোলোকচন্দ্র গোস্বামী।যেমন খাৱনি(খাৱনি খৰছ),শোৱনি(শোৱনি ঘৰ) সেগুলো বাংলা ‘খাবার (খাবার খরচ),শোবার (শোবার ঘর)’ শব্দের প্রতিরূপ।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অসমিয়া ভাষা প্রসঙ্গে উত্থাপন না করলে ক্রিয়াপদের আলোচনাটি অসম্পূর্ণ বলে ঠেকবে। সেটি হলো -- নঞর্থক ক্রিয়ার নির্মাণ।এই অব্দি দুই ভাষাতেই যেসব ক্রিয়াপদের আলোচনা করে এলাম সবগুলোই সদর্থক বা অস্ত্যর্থক।তার মানে কাজগুলো হয়,হয়েছে বা হবে।সমাপিকা রূপগুলোর √আছ̖, (~থাক̖,~√ছিল) ধাতুর অর্থই তাই।এর মূলে প্রাচীন ভারতীয় আর্যের √অস̖ (> অস্তি> অচ্ছতি> অচ্ছই> আছি)।২৪৫কিন্তু কাজ না হবার অর্থ বোঝাতে প্রাচীন ভারতীয় আর্যেই পুরোসর্গ ‘ন’জুড়ে নঞর্থক ক্রিয়া তৈরি হয়েছিল (ন+ভূ,~অস̖)।প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলা অব্দি এই রীতিটি ছিল।২৪৬ রবীন্দ্র কবিতা অব্দি এর বহুল প্রয়োগ ছিল।যেমন—শরমে মরিয়া বলিতে নারিনু হায় (ভ্রষ্টলগ্ন; কল্পনা)।মান বাংলাতে এখন শুধু অসমাপিকাতেই আগে বসে,কিন্তু জুড়ে যায় না।যেমন-- না এলে,না গিয়ে।অন্যথা–নেই,(~না,~ নি) মান বাংলাতে পরেই বসে।অধিকাংশ ক্ষেত্রে জুড়ে যায়।যেমন যাইনি,দেখিনি,করিনি।কিন্তু নিষেধার্থক অনুজ্ঞা হলে স্বতন্ত্র বসালেই অর্থ স্পষ্ট হয়।যেমন করবে না,দেখবে না ইত্যাদি।এই সম্পর্কে সিলেটি রীতিও কিন্তু মান বাংলারই অনুসারি। ‘-না’ তো আছেই শুধু ‘-নি’ নেই,আর ওদিকে ক্রিয়ার পরে ‘নয়’ সিলেটিতে হয়ে যায় ‘নায়’।যেমন--- হে করছে না,আমিও করতাম নায়।করবার অইলে তুমি করো।কিন্তু অসমিয়াতে সেই প্রাচীন ভারতীয় আর্য রীতিটি এখনো প্রবহমান।এবং অদ্ভুত ভাবে এই অসমিয়া রীতির সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রেখে চলেছে বহু দূর,বহু দক্ষিণের বাংলা ভাষা বৈচিত্র্য চট্টগ্রামী।এমন কি নোয়াখালিতেও যদি একটি বাক্য হয় এরকম---আঁ:́ই খাই ন,চট্টগ্রামীতে তবে একই বাক্য হবে সাধারণত এরকম –আঁ:́ই ন খাই।আঁ:́ই ন ফা̣ইর̖গম̖।চট্টগ্রামী ছাড়িয়ে এই রীতি মায়ানমারের ‘রোহিঙিয়া’ অব্দি এগিয়েছে।যেমন –আঁরা রুইঙগ্যা অক্কলঅরে আচল বাচিন্দা বৌলি ১৯৬৫ চন ফইজজন্ত মানি লইল।এখনর হুকুমতে ইয়ান ন মানের।২৪৭ প্রতিবেশী বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষাতেও এই রীতিটি আছে।যেমন--তি লেইরিক না তামকরর।২৪৮তবে অসমিয়াতে আরেকটি সজীব এবং সুন্দর ঘটনা ঘটে।ক্রিয়ার আগে পুরোসর্গ হিসেবে জুড়েই শুধু যায় না,“ন-উপসর্গ যোগ হ’লে ক্রিয়াপদটোর আদিতে থকা ব্যঞ্জনর পিচর স্বরবর্ণটোর সৈতে একে হৈ মিলি যায়।”—লিখেছেন গোলকচন্দ্র গোস্বামী।২৪৯ব্যতিক্রম শুধু ‘অ’,ঐ,ঔ’-র বেলা।যেমন – নকৰোঁ,নগৈছিল,নিদিওঁ,নুনুমাল,নোধোৱক। কিন্তু ক্রিয়াপদটি নিজেই যদি স্বরধ্বনি দিয়ে শুরু হয় তবে ‘-ন̖-’ সেই স্বরের সঙ্গেই মিশে যায়।যেমন নাকোঁ (আঁকবো না), নোলোমে (ঝুলে না) ইত্যাদি।বাংলাতে ‘নইলে’,অসমিয়াতে ‘নহ’লে’ সর্তজ্ঞাপক সংযোজক ক্রিয়া হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। যেমন—বাং.ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র খাব (রফিক আজাদ);অস.দেশৰ বিহনে জনম নাই/জনম নহ'লে জীৱন নাই (অম্বিকাগিরি রায় চৌধুরী)।
।। সিলেটি রূপতত্ত্ব এবং বাংলা - অসমিয়া ভাষা বিতর্ক ।।
ধ্বনিতত্ত্ব প্রসঙ্গে যেভাবে করে এসেছিলাম এবারে রূপতত্ত্বের দিক থেকে ড০ উপেন রাভা হাকাচাম যেভাবে তর্কটিকে উপস্থিত করেছেন,আমরা সেগুলো নিয়ে এবারে আলোচনা করছি একে একে।
“রূপতাত্ত্বিক দিশত অসমীয়া বা বাংলাতকৈ চিলেটীয়া বা কাছাড়ি বহুখিনি ভিন্ন।বচন,শব্দ-রূপ,ক্রিয়া-রূপ আদি প্রায়বোর দিশতে ইয়াত স্বকীয়তা রক্ষিত হৈছে।বহুবচন বুজোয়া-টাইন,অপাদান কারকর –তনে,নিত্য বর্তমান কালর দ্বিতীয় পুরুষর মান্যার্থক –উকা/-অইন,ঘটমান (স্বরূপ) বর্তমানর প্রথম পুরুষর -ইয়ার,দ্বিতীয় পুরুষর মান্যার্থক –রায়/ ডায়,ঘটমান অতীত বা ঘটমান ভবিষ্যৎ কালর –আত প্রত্যয়ান্ত রূপর লগত আছ বা থাক রূপর সংযোগ –এই কেইটা চিলেটীয়া বা কাছারীর নিজস্ব রূপ” –এই ভাবেই উপেন রাভা হাকাচাম আরম্ভ করেছেন।২৫০
তাঁর প্রথম পুরুষ বাংলা ব্যাকরণে উত্তম পুরুষ এবং তৃতীয় পুরুষ আসলে প্রথম পুরুষ বলে পরিচিত।সে পরিচয় সংস্কৃত ব্যাকরণানুসারী।তিনি ইংরেজি ব্যাকরণ অনুসরণ করেছেন।উপরের উদ্ধৃতিতে অধ্যাপক নিখিলেশ পুরকাইতের ১৯৮৯র রচনা ‘বাংলা অসমীয়া ও ওড়িয়ার উপভাষার ভৌগোলিক জরিপ’ থেকে তথ্যগুলো তিনি ব্যবহার করেছেন।অথচ সেখানেই স্পষ্ট নজরে পড়ে,কাল বোঝাবার ‘-আত̖’ জটিল পরসর্গ সহ অসমাপিকা অংশটির পরে ‘√আছ̖’,‘√থাক̖’ ধাতুর সংযুক্তিতে সিলেটি বাংলা বা অসমিয়া-- কোনো ভাষারই মান রূপ থেকে মূলগতভাবে আলাদা হয় না।যেমন—সিল.‘করাত̖ আছ̖লাম̖’,মান বাং.কর̖ছিলাম̖,সাধু বাং.করিতে ছিলাম,অ.করি আছিলোঁ;সিল.করাত̖ থাকমু,মান বাং.কর̖তে থাক̖ব,সাধু বাং. করিতে থাকিবো,অস.করি থাকিম̖।নোয়া.কইত̖তে আৎিসলাম̖,চট্ট.কইত̖তাম আৎিসলাম̖ ২৫১--- এই নজিরগুলোও কিন্তু বাংলা অসমিয়ার থেকে আদৌ ভিন্ন কিছু নয়।যেটুকু ধ্বনিতাত্ত্বিক তফাত রয়েছে সেইটুকুন আছে বলেই সিলেটি একটি স্বতন্ত্র ভাষা বৈচিত্র্য,এবং মান অসমিয়া-বাংলা স্বতন্ত্র ভাষা।-টাইন̖,-তনে,-উকা,-ইয়ার̖,-রায়—এগুলো যে সামান্য পরিবর্তিত ধ্বনিরূপ সহ নোয়াখালি,চট্টগ্রামীতে আরো বিচিত্র ভাবে ব্যবহারে রয়েছে আমরা ইতিমধ্যে দেখিয়ে এসেছি।সুতরাং এগুলো সিলেটির একক সম্পদ নয়।বরং মান বাংলা ‘-√ছিল̖’-র জায়গাতে অসমিয়া,সিলেটি,নোয়াখালি,চট্টগ্রামীতে ‘√আছ̖’ ধাতুর দরকার পড়ছে এবং বক্তা পক্ষে শেষ ‘ব̖’ ধ্বনিটি ‘ম̖’ হয়ে যাচ্ছে।এই আত্মীয়তাটি অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক।
আমরা আপাতত অসমিয়ার সঙ্গে সাদৃশ্য আছে দাবি করে সিলেটি/কাছাড়ির যে নজিরগুলো দিয়েছেন সেগুলো উল্লেখ করে আমাদের মন্তব্য যথাসম্ভব সংক্ষেপে উপস্থিত করে যাচ্ছি।
১) “চিলেটীয়াত প্রথম পুরুষর ভবিষ্যৎ কালর রূপ –ইমু (যাইমু, করিমু/ করমু)—যিহর সাদৃশ্য অসমীয়া –ইম/-ম (যাম করিম) রূপর লগত বেছি;বাংলা –ইব (যাইব, করিব) রূপর লগত নহয়।”২৫২
নোয়া.করুম̖,চট্ট.কইর̖গম̖,২৫৩ঢাকা.কর̖মু,কর̖তে থাক̖মু,কইরা থাক̖মু২৫৪এগুলো দেখায় পূর্ববঙ্গীয় প্রতিবেশী ভাষাবৈচিত্র্যগুলোতেও ঘটনা একই রকম ঘটে।তদুপরি তিনি বাংলা বলে যে রূপগুলো দিয়েছেন সেগুলো স্পষ্টতই সাহিত্যের সাধু দৃষ্টান্ত।মান বাংলাতে শব্দ দু’টি হবে:যাবো,করবো।আমরা ইতিমধ্যে দেখিয়েছি বক্তাপক্ষে এই ‘-ম’ মান বাংলাতে একেবারেই নেই---তাও নয়।অন্যান্য ক্রিয়ারূপে বিশেষ করে অতীত কালে বহাল তবিয়তে রয়েছে---‘দেখ̖তাম̖,যেতাম̖, কর̖ছিলাম̖’ ইত্যাদি।
২) “সেই দরে চিলেটীয়াত দ্বিতীয় পুরুষ মান্যার্থর ভবিষ্যৎ কালর রূপ –ইবা/-বা (যাইবা,করিবা,করবা)—যিহর সাদৃশ্য অসমীয়া –ইবা/-বা (যাবা, করিবা) রূপর লগতহে বেছি; বাংলা –ইবে (যাইবে, করিবে) রূপর লগত নহয়।”২৫৫
এখানেও সাধুবাংলার নজিরই তিনি দিয়েছেন তাও সম্ভ্রমার্থে নয়।সিলেটিতে ‘যাইবা’ সম্ভ্রমার্থে ব্যবহৃত হয়। অসমিয়াতে সম্ভ্রমার্থে হবে ‘যাব’---আপুনি যাব।সাধুবাংলাতে সম্ভ্রমার্থে রূপগুলো হবে: যাইবেন̖,করিবেন̖।মান বাংলাতে---যাবেন̖,কর̖বেন̖।সাধু বাংলা ‘যাইবে,করিবে’ শ্রোতা পক্ষের সামান্য রূপ।সেরকম মান বাংলা—‘যাবে,কর̖বে’।অসমিয়া সামান্য রূপ ‘যাবা,কৰিবা’।সেগুলোর সিলেটি সামান্য রূপ হচ্ছে—‘যাইবায়,কর̖বায়’।এবারে ‘যাইবে,যাবে,যাইবায়,যাবা’ এই চার ক্রিয়াপদের কার সঙ্গে কার মিল কম কিংবা বেশি--- সেটি ঠিক হবে কীসে?তার উপরে আবার অনুজ্ঞাতে সাধু,মান এবং সিলেটি বাংলাতে বিকল্প নজির রয়েছে---‘যাইও,যেও,যাইও’।অসমিয়াতে সর্বাবস্থাতেই ‘যাবা’।এগুলো তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। তেমনি তিনি নজর দেননি নোয়াখালি রূপে: কইর̖বা,চট্টগ্রামী: করিবা,গরিবা২৫৬ ঢাকা: কর̖বা২৫৭।
৩) “চিলেটীয়াত তৃতীয় পুরুষর ভবিষ্যৎ কালর রূপ—ইব (যাইব,করিব) অসমীয়ার সৈতে হুবহু একে (যাব,করিব)। যিটো বাংলাত হয়—ইবে (যাইবে, করিবে)।”২৫৮
এখানেও সিলেটি ‘করিব’ রূপটি তিনি ভুল উল্লেখ করে অসমিয়ার সঙ্গে হুবহু এক করে ফেলেছেন।শব্দটি আসলে হবে ‘কর̖ব’।‘যাইব’-টি ঠিকই আছে।কিন্তু মান বাংলা রূপ হচ্ছে---যাবে,কর̖বে।বরং সাধু বাংলার অন্যপক্ষের ক্রিয়াপদ ‘করিবে’-র থেকে খুব দূরে নয় অসমিয়া ‘কৰিব’।কিন্তু প্রতিবেশী অন্য ভাষাবৈচিত্র্যও আর দূরে কই?এই যেমন---নোয়া. কইর̖বো,চট্ট.করিবো,গরিবো।২৫৯ বরং ঢাকাই ‘কর̖বো’ সিলেটির খুব কাছের শব্দ।তবে সিলেটি শুধু নয়,পুব বাংলার অন্যান্য ভাষাবৈচিত্র্যের সঙ্গে এই সাধারণ ভবিষ্যতের বা ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞার অন্যপক্ষের সামান্য রূপের সঙ্গে অসমিয়া রূপের একটি মিল অবশ্যই রয়েছে।এগুলোতে যেখানে শেষে ‘-ব,~ইব’–র পরে পরসর্গ ‘-অ,~ও’ জুড়ে (চিত্র -৬, ১০ এবং ১৪),মান বাংলা কিংবা সাধু বাংলাতে সেখানে শেষে পক্ষ বোঝাবার জন্যে আলাদা করে ‘-এ’ জুড়ে (চিত্র-২)।
৪) চিলেটীয়াত তৃতীয় পুরুষর বর্তমান অনুজ্ঞা রূপ --ওকা/উক (দিওকা,খাওকা,করোকা,করুক) –যিহর সাদৃশ্য অসমীয়া –অক/ওক (দিওক,খাওক,করক) রূপর লগতে বেছি;বাংলা –উন (দিউন,খাউন,করুন) রূপর লগত মুঠেই নহয়।”২৬০
মোটের উপরে সঠিক বললেও,তাঁর সিলেটি এবং বাংলা নজিরগুলো সঠিক বা যথেষ্ট নয়।সম্ভ্রমার্থে সিলেটি শ্রোতা এবং অন্য পক্ষের প্রতিরূপ হবে—দেউক্কা,খাউক্কা,করউক্কা।অন্য পক্ষে সামান্য রূপে মেলে—খাউক̖,করউক̖,দেউক̖ ইত্যাদি। করুক̖—সিলেটি নয়,বরং মান বাংলা রূপ।সম্ভ্রমার্থে এটিই দাঁড়ায় -- করুন̖। দিউন̖,খাউন̖ –সাধু বাংলাতেও ক্বচিৎ ব্যবহৃত হয়,শব্দগুলো হবে ----দিন̖,খান̖।কিন্তু সিলেটির কাছাকাছি এগুলোও তো রয়েছে--- নোয়া.করউক̖,চট্ট.করউক̖,গরউক̖।২৬১ স্পষ্টতই বোঝা যায় অপিনিহিতির ফলে মান বাংলা রূপটিই পালটে সিলেটি সহ এই সব ভাষাবৈচিত্র্যের নিজস্ব রূপগুলো এসছে।বরং ঢাকাইতে২৬২এবং চট্টগ্রামীতে বিকল্পরূপে এই ‘-উ’ লোপ পেয়ে হয় --‘করক̖’।এগুলো বরং অসমিয়ার অতি ঘনিষ্ঠ পদ।
৫) “চিলেটীয়ার তৃতীয় পুরুষর স্বরূপ পুরাঘটিত বর্তমান কালর –ইছে/-ছে রূপর সৈতে অসমীয়ার মিল বাংলাতকৈ বেছি।এই অর্থত বাংলাত –ই+আছে> ইয়াছে রূপরহে প্রয়োগ হয়।উদাহরণ: চিলেটীয়া হৈছে,করিছে;অসমীয়া হৈছে,করিছে;বাংলা হইয়াছে, করিয়াছে।”২৬৩
সিলেটি ‘করিছে’ শব্দটি ভুল।হবে --কর̖ছে।হৈছে,করছে মান বাংলাতে হয়-- হয়েছে,করেছে—এই মাত্র।তিনি স্পষ্টই সম্পন্ন বর্তমানে অন্য পক্ষে সাধুরূপের কথা লিখেছেন।অন্যদিকে Öকর̖ ধাতুতে নোয়াখালি রূপ: কইচ̖ছে,কর̖ৎেস, চট্ট.কইর̖ছে,কইর̖গে,কইজ̖জে,২৬৪ঢাকা.কর̖সে২৬৫।√কর̖ এবং √আছ̖ দুই ধাতু মিলে এগুলো জটিল একপদী শব্দ।যেগুলোকে অনেকেই যৌগিক কালরূপ বলেন।প্রথমাংশের অসমাপিকা রূপে সাধু বাংলাতে ‘-ইয়া’,মান বাংলাতে ‘-এ’,অসমিয়াতে ‘-ই’ যুক্ত হয়।সেদিক থেকে এগুলো বরং কাছাকাছি।অন্যদিকে,নোয়াখালির বিকল্প রূপে,ঢাকাইয়াতে এবং সিলেটিতে সেই অসমাপিকা সর্গটি লোপ পেয়ে যায়।
৬) “চিলেটীয়াত স্বরূপ ভূতকালর রূপর লগত অর্থাৎ প্রথম পুরুষর –ইলু/-লু দ্বিতীয় পুরুষর –ইলা/-লা,তৃতীয় পুরুষর –ইল/ইলেক ইত্যাদির লগত হনে/অনে পরসর্গ সংযোগ করি সম্ভাব্য ভূতকালর ক্রিয়াপদ গঠন হয়।অসমীয়াতো অনুরূপ ভাবে স্বরূপ ভূতকালর ক্রিয়ারূপর লগত (প্রথম পুরুষ-ইলোঁ/লোঁ দ্বিতীয় পুরুষ তুচ্ছ –ইলি/-লি,দ্বিতীয় পুরুষ সাধারণ –ইলা/-লা,দ্বিতীয় পুরুষ মান্য -ইলে/-লে) হেতেন পরসর্গর প্রয়োগ করিলে সম্ভাব্য ভূত কাল সূচায়।কিন্তু বাংলাত সিলেটিয়া আরু অসমীয়ার পরসর্গযুক্ত রূপর বিপরীতে অকল প্রথম পুরুষত –ইতাম,দ্বিতীয় পুরুষত -ইতে আরু তৃতীয় পুরুষত –ইত বিভক্তির প্রয়োগ করি সম্ভাব্য ভূতকাল সূচায়।
উদাহরণ:
চিলেটীয়া অসমীয়া বাংলা
প্রথম পুরুষ: পাইলুহনে পালোঁহেতে্ন পাইতাম,
করিলুহনে, করিলোঁহেতেন, করিতাম,
গেল হনে, গলোঁহেতেন, যাইতাম,
দ্বিতীয় পুরুষ: পাইলা অনে, পালাহেঁতেন, পাইতে,
করিলা হনে, করিলাহেতেন, করিতে,
গেলাহনে, গ’লাহেতেন, যাইতে,
তৃতীয় পুরুষ: পাইলঅনে, পালেহেতেন, পাইত,
করিলহনে, করিলহেতেন, করিত,
গেলহনে গ’লহেতেন , যাইত ”২৬৬
মান বাংলাতে সম্ভাব্য অতীত আর সম্পন্ন ভবিষ্যতের রূপ একই,আমরা দেখিয়ে এসেছি--- গিয়ে থাকবে,করে থাকবে,পেয়ে থাকবে ইত্যাদি।তিনি যে নজিরগুলো দিয়েছেন,সেগুলো নিত্যবৃত্ত অতীতের রূপ।তার উপরে এগুলো যথারীতি সাধু বাংলা রূপ।মান বাংলা রূপ গুলো হবে যথাক্রমে:পেতাম,করতাম,যেতাম,পেতে,করতে,যেতে,পেতো,করতো,যেতো।এগুলোতেও সম্ভাব্য অতীতের রূপ বোঝালে সে হবে নিত্যবৃত্তের তির্যক প্রয়োগ।অথবা ‘হয়ত,নাহয়’ ইত্যাদি অনুপদ জুড়ে দিতে হয়।অসমিয়াতে যেমন ‘চাগৈ’, ‘জানোচা’ ইত্যাদি জোড়া হয়।সিলেটি যে রূপগুলো তুলে দিয়েছেন সেখানেও ভুল আছে।--হনে,অনে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন।পরপদ কিংবা পরসর্গটি –‘হনে’-ই বটে,কিন্তু ‘হ’ লোপ পায় --- এই কথা কোথাও কোথাও তাঁরই ব্যবহৃত ‘অনে’ দেখাচ্ছে। আসলে শব্দগুলো হবে--পাইলাম অনে/পাইলামনে,করলাম অনে/করলামনে,গেলাম অনে/ গেলামনে,পাইলায় অনে/পাইলায়নে/পাইলানে/পাইলেনে,করলায় অনে/করলায়নে/করলানে/করলেনে,গেলা অনে/ গেলায়নে/গেলানে/গেলেনে,পাইল অনে/পাইলনে/পাইলানে/পাইলেনে,করল অনে/ করলনে/ করলানে/ করলেনে,গেল অনে/গেলনে/গেলানে/গেলেনে।এই শ্রোতা এবং অন্য পক্ষে চারটি করে রূপের উল্লেখের কারণ হচ্ছে আমরা সম্ভ্রমার্থে এবং তুচ্ছার্থে রূপগুলোকেও দেখালাম।আর শুধু ‘-অনে’ নয়,কখনোবা ‘-নে’ অনুপদ যুক্ত হয়ে পূর্বাংশের সঙ্গে মিশে গিয়ে বা না মিশে সিলেটিতেও সম্ভাব্য অতীতের রূপটি তৈরি হয়।এবং এই ক্ষেত্রে যে সিলেটির সঙ্গে অসমিয়ার মিল রয়েছে সে কথা আমরাও কাল প্রসঙ্গে উল্লেখ করে এসেছি।সঙ্গে আমরা একই অনুপদ ব্যবহৃত হয় বলে সিলেটিতে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ রূপও প্রস্তাব করে এসেছি।যেমন---যাইমুনে, করমুনে ইত্যাদি।
৭) “চিলেটীয়াত প্রচলিত তুমুনন্ত ক্রিয়া রূপর (-ইবাক,-ইবাব,-ইবাবে,ইবারু আদি) সৈতে প্রাচীন অসমীয়া বা কামরূপীত প্রচলিত (-ইবাব,-ইবার,-ইবা আদি) রূপর বিশেষ সাদৃশ্য মন করিব লগীয়া।ই স্বাভাবিকতে বাংলা –ইতে রূপর তুলনাত মান্য অসমীয়া –ইব + লৈ রূপর ওচর চপা।
উদাহরণ---
চিলেটীয়া অসমীয়া/কামৰূপী বাংলা
জানিবাৰ জানিবলৈ জানিতে
লৈবাৰ/লৈবাৰু ল’বলৈ/ ল’বা লইতে
কৰিবাৰে কৰিবলৈ/ কোৰবা কৰিতে”২৬৭
সিলেটি শব্দগুলো তিনি বীশ্বেশ্বর হাজরিকার ‘কাছারী ভাষা,আজির পটভূমিত কাছাড়’(১৯৮৮) বইতে পেয়েছেন।এবং যথারীতি ভুল উল্লেখ করেছেন।শব্দগুলো হওয়া উচিত-- জানবার,লইবার,করবার।মান বাংলা--- জানতে, নিতে,করতে।তাঁর উল্লেখিত শব্দগুলো সাধুবাংলার।তাছাড়া -ইবাক,-ইবাব,-ইবাবে,ইবারু আদি একটাও সিলেটি পরসর্গ নয়। তাঁর দেয়া সিলেটি শব্দগুলোতেও এগুলো তিনি বসিয়ে দেখাতে পারেন নি।ব্যতিক্রম ‘লৈবারু’।কিন্তু এটি সিলেটি বা মান বাংলা কোনোটারই ক্রিয়ারূপ নয়।মনে হয় ‘লইবারউ’ লিখতে চেয়েছিলেন।মান বাংলা এবং মান অসমিয়া ‘-ই’ -এর সমার্থক ‘-উ’ সিলেটি নিশ্চয়ার্থক।সিলেটি লইবারউ, খাইবারউ = মান বাংলা নেবারই,খাবারই=অসমিয়া ল’বৰেই,খাবৰেই।যেমন ---আমার ইঞ্জেকশন লইবারউ পইশা নাই,বেমার ক্যামনে বা’লা অইতো?এই ‘-উ’ শুধু ‘লইবার’ কেন,স্তম্ভের বাকি দুই অসমাপিকা ‘জানবার,করবার’ পরেও বসানো যেতো।
এই প্রসঙ্গটি নানা কারণে একটি জটিল উপস্থাপনা।এই প্রসঙ্গে কিছু কথা আমরা অসমিয়া ‘নিমিত্ত’ কারক প্রসঙ্গে এবং অসমিয়া-বাংলা অসমাপিকা ক্রিয়া প্রসঙ্গে আলোচনা করে এসেছি।তাতে এটুকুন শুরুতেই স্পষ্ট হবে যে সিলেটিতে পদগুলো অসম্পূর্ণ এবং এগুলোর সম্পূর্ণ রূপ মান কিংবা সাধু বাংলারই মতো।অসমিয়ার মতো বিকল্পরূপও রয়েছে,এবং সেই বিকল্পরূপগুলো নোয়াখালি,চট্টগ্রামীতেও প্রায় একই।চট্টগ্রামী বরং অসমিয়ার অনেক কাছাকাছি।সিলেটি রূপগুলো হবে—জানতে অথবা জানবার লাগি,লইতে অথবা লইবার লাগি/নিবার লাগি,করতে অথবা করবার লাগি।
বাকিটা স্পষ্ট করতে শুরুতেই --- ‘তুমুনন্ত ক্রিয়া রূপ’--- কথাটির একটি সহজ বাংলা দরকার বলে আমরা মনে করি।এখানে আসলে অসমাপিকা ক্রিয়ার কথা হচ্ছে।তাও সব নয়,নিমিত্তার্থক অসমাপিকা।যেখানে বিকল্পে অসমাপিকা ক্রিয়াপদে ষষ্ঠীর ‘-র̖,~এর̖’ পরসর্গ যোগ করে বাংলাতে পূর্ণ শব্দ ‘জন্য’,অসমিয়াতে ‘বাবে’,সিলেটিতে ‘লাগি’ পরপদ যোগ করা যেতে পারে।অসমিয়াতে কখনোবা সরাসরি ‘নিমিত্ত’ শব্দই ব্যবহৃত হয়।ব্যাকরণ কৌমুদিতে লেখা আছে,“যদি উভয় ক্রিয়ার এক কর্তা হয় তাহা হইলে উভয়ের মধ্যে নিমিত্ত-অর্থ-বোধক ধাতুর উত্তর তুমুন হয়, উ ন ইৎ,তুম থাকে।”২৬৮ যদিও তুমন হবার আরো একাধিক সর্ত আছে,যেমন একই গ্রন্থে সামান্য পরেই লেখা আছে,“সমার্থক শব্দের যোগে ধাতুর উত্তর তুমুন হয়।”২৬৯ যেমন-- বাংলাতে ‘যেতে যেতে’।সুকুমার সেন লিখেছেন,“পদান্ত (বা প্রত্যয়) ধরিলে বাঙ্গালায় অসমাপিকা চারটি...”২৭০ চতুর্থটি সম্পর্কে তিনি লিখছেন,“(ঘ) ‘-ইতে’ যুক্ত তুমর্থ বা উদ্দেশক অসমাপিকা (Infinitive)।”২৭১ তিনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন,“সংস্কৃতের মতো বাঙ্গালাতেও অসমাপিকা পদগুলি আসলে নামপদ।”২৭২ ঐতিহ্যানুগ ব্যাকরণে এগুলোকে তাই ক্রিয়া বিশেষ্যও বলা হয়ে থাকে।২৭৩ নামপদ বলেই “বাঙ্গালায় এগুলির প্রায় সবই তৃতীয়া –সপ্তম্যন্ত”,লিখেছেন সুকুমার সেন।২৭৪ অর্থাৎ শেষে ‘-তে’ যোগ করবার যুক্তি ব্যাখ্যা করছেন।
এগুলোর সঙ্গে ড০ উপেন রাভা হাকাচাম অসমিয়াতে ‘জানিবলৈ’ ব্যবহার করেছেন।এর সঙ্গে ‘জানিবার’ শব্দের তুলনা হতে পারে শুধু পরে ‘লাগি’ পূর্ণ শব্দ যোগ করলে।সিলেটি নয়,বরং সাধু বাংলাতে পুরো শব্দটি ‘জানিবার লাগি’, বিকল্পে ‘জানিবার নিমিত্তে’,‘জানিবার উদ্দেশ্যে’।‘জানিবার জন্য’-ও বসতে পারে।অসমিয়াতে প্রাক-ঔপনিবেশিক রূপে ‘লাগি’ শব্দটির ব্যবহার ছিল।এবং পূর্বাংশে সম্বন্ধের ‘-ক̖’ যোগ হত,যেভাবে এখন বাংলাতে হয় ‘-র̖’।যেমন,“কৃষ্ণৰ পাশক লাগি চলি গৈলা হৰ।”২৭৫বাণীকান্ত কাকতি অসমিয়া সম্প্রদান কারক বিভক্তির বিবর্তন বোঝাতে গিয়ে এই ‘লাগি’ পূর্ণ শব্দ থেকে ‘-লৈ’ বিভক্তি আসবার ইতিহাস ব্যাখ্যা করেছেন,এই রকম,“–ক+লৈ (লাগি) সর্গ সমষ্টিত দিশ,উদ্দেশ্য আদি বুজাবলৈ –ক ই কাম করিছে;যেনে কৃষ্ণৰ পাশক লাগি,যাতনাক লাগি,যাতনাৰ উদ্দেশ্যে,ইত্যাদি।(তু. ক., বং ৰামের লাগি)।আধুনিক অসমীয়াত –লৈ র আগত –ক লোপ করা হয়: ঘৰলৈ,ঘৰৰ দিশে;মোলৈ মৰম্,মোৰ উদ্দেশ্যে মৰম,ইত্যাদি।”২৭৬ বাণীকান্ত এখানে স্পষ্টই পুরোনো বাংলা ‘রামের লাগি’র সঙ্গে তুলনা করতে বলেছেন।অসমিয়াতে ‘লাগি’ > ‘-লৈ’ পরসর্গে পরিণত এই কথাও স্পষ্ট।বাংলা সাধুরূপে,এমন কি বাংলাদেশে লিখিত বাংলাতে,এমনকি সিলেটি ভিন্ন অন্য ভাষা বৈচিত্র্যেও ‘লাগি’র ব্যবহার এখনো আছে।যেমন-- রবীন্দ্রনাথের পঙক্তি “এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম,প্রেম মেলে না”।কুমিল্লার ভাষাতে“এর লাগি ত’র নানা বেপারীরে দুই চক্ষে দেখতে পারে ন!তুই যদি বড় হইয়া মর-মুরুব্বির হালু-গিরস্তি ছাইড়া দিয়া বেপারী হইয়া যাস তা হইলে ত’র নামা ত’রে চোর ডাক আর--”।২৭৭ সিলেটিতে আছে,“পস্তাইতাম কেনে।নিজর লাগিয়াউতো লইয়ার।”(সু.গা.পা.:কুড়ি) সিলেটের বাউলকবি শাহ আব্দুল করিমের গানে আছে,“আব্দুল করিম বলে,ইস্কুল গেলে/মাস্টর সাব মরবার লাগি দোয়া করিতাম।”‘লাগি’ বরং পূর্বপদে জুড়ে গিয়ে অসমিয়া ‘-লৈ’র কাছাকাছি এসে গেছে চট্টগ্রামীতে।“...’ই́তে ই́তার্ মার্ কথা/ খ̣তা মতন্ মুয়রে মিডা করি করিবাল্লাই /গরিবাল্লাই অগগোয়া ফ̣ইসার্ মিডা কিনি লইল্।”২৭৮ নোয়াখালিতে সামান্য তফাত রক্ষা করলেও ‘শব্দ’টি ‘লাই’ হয়ে গেছে,“ ...হ্যেতে হ্যেতার্ মার্ কতা মতন্ মুকেরে/মুয়রে মিডা করনের্ /কইবার লাই এগগা হইশার্ মিডাই/খাঁড়্ কিনি লইল।” ২৭৯
এই ‘লাগি’ এখন মান অসমিয়াতে ‘লেগে থাকা’ অর্থাৎ বিশেষ্যের বিশেষণ অর্থে প্রচলিত রয়েছে।যেমন--বিচনাখনত লাগি থকা বেৰখনৰ ঠিক মাজতে এটা এলান্ধুৰে ক’লা হৈ পৰা বাল্ব ...।২৮০বাণীকান্ত লিখেছেন,“আধুনিক অসমীয়াত –লৈ র আগত –ক লোপ করা হয়।”২৮১কিন্তু অসমিয়ারই অন্য ভাষাবৈচিত্র্যে ‘লাগি’ শব্দের সামান্য রূপান্তর সহ প্রাচীন ব্যবহারটি এখনো আছে।আছে,শব্দজোড়ের প্রথম পদের প্রত্যয় ‘-ক̖’-ও।‘খাবাক লেগি’ এই নজির ড০ উপেন রাভা হাকাচামই উল্লেখ করেছেন।২৮২আবার,‘-ক̖’ কিংবা এখনকার ‘-লৈ’ পরসর্গ বাদ দিয়েও যে অসমিয়া কিছু ভাষাবৈচিত্র্যে ‘নিমিত্তার্থ’ বোঝানো হয়,সেই নজির সঠিক ভাবেই দিয়েছেন তিনি উপরে যেখানে তিনি বিকল্পে ‘ল’বা,কোৰবা’-র উল্লেখ করেছেন।মান অসমিয়াতে ‘-ক̖’ পরসর্গটি কর্মে,সম্প্রদানে এখনো আছে।পুরোনো অসমিয়াতে একা এই ‘-ক̖’ পরসর্গই ‘লাগি’-র অর্থ কখনোবা প্রকাশ করত,এমন নজির বাণীকান্ত দিয়েছেন,“এতিক্ষণে আমি মৃগ মাৰিবাক যাইব”।২৮৩ বাংলাতেও কর্মের ‘-কে’ পরসর্গের উৎস একই।সুনীতিচট্টোপাধ্যায় লিখেছেন,“The «-ka» genitive of Bengali is used for the dative in OB.: e.g., Caryā 4«mantiē͂ thākura-ka parinibittā» the minister (= queen, in chess)has checked the king;…”২৮৪ আমরা চতুর্দশ শতকে সংকলিত ‘প্রাকৃতপৈঙ্গল’ –যার উত্তরাধিকার বাংলা অসমিয়া দুই ভাষাই দাবি করতে পারে – থেকে একটি বিখ্যাত নজির স্মরণ করাতে পারি যেখানে এই ‘-ক’ সম্বন্ধের অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে,“ওগ্গর ভত্তা রম্ভঅ পত্তা/গাইক ঘিত্তা...” এই ‘গাইক ঘিত্তা’র খুব কাছের রূপান্তর হিন্দিতে এখনো শোনা যাবে।‘গায় কা ঘী’ (गाय का घी)।এই ‘-ক’-এর উৎস বিবর্তন নিয়ে ওডিবিএল-এ সম্বন্ধ কারকের বিভক্তি আলোচনা করতে গিয়ে বিস্তৃতই লিখেছেন সুনীতি চট্টোপাধ্যায়।তাঁর যুক্তি মানতে গেলে এ সংস্কৃত পূর্ণ শব্দ ‘কার্য’র রূপান্তর।‘কৃত’ শব্দের বিবর্তন নিয়েও আলোচনা করেছেন তিনি,“Side by side with « kārya> kēra,kēla »,the words « kara,kāra » and «kŗta>kaa» were used in Māgadhi Prakrit and Apabhraṅśa to indicate the genitive.”২৮৫ এই ‘কারা’ থেকে ‘-র’ এসেছে,যা এখন বাংলা অসমিয়া দু’য়েতেই সম্বন্ধের পরসর্গ হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হয়।“It would seem that Māgadhi Ap.« kara » was used with the pronoun originally,and then was extended to the noun. Reduced to «-ara » -rå, -rⱥ » ,it occurs as the genitive affix in Assamese –Bengali and Oṛiyā,and also in Maithiliī and other Bihārī speeches in the genitive of the first and second personal pronouns.২৮৬ ‘-ক’ রূপটি এখনো ওড়িয়াতে আছে।‘-কার’ রূপটি আধুনিক বাংলাতেও আছে—সকালকার,সব্বাইকার।এর থেকেই যে সিলেটি ‘সকালকু’,‘বিকালকু’ অনুমান করতেই পারি। কিন্তু এই ‘-ক’ বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাবৈচিত্র্যে ‘in the absence or disuse of an affix distinguishing the two numbers’২৮৭ বহুবচনে ‘-গো’ অব্দি এগোবার কথা সুনীতি চট্টোপাধ্যায় নজির সহ উল্লেখ করেছেন।‘মোগো’,‘আমাগো’।তিনি ‘যাইবার̖ গ্যা’,‘খাইবার̖ গ্যা’ (+লাগ্যা) এমন অসমাপিকার কথা লেখেন নি,কিন্তু সেগুলোর অন্য কী উৎসই বা আশা করতে পারি?--গ্যা < গিয়া < √গ (√গম) +ইয়া? না-ও হতে পারে।-ক>গো> গ্যা হওয়াই সম্ভব বলে মনে হয়।হিন্দিতে ‘जाने के लिए, खाने के लिये’ ইত্যাদি অসমাপিকা মনে পড়লেই সুনীতিকুমার স্পষ্ট হবেন।সিলেটিতেও এমন গড়ন আছে ‘যাইবার̖ গি লাগি,খাইবার̖ গি লাগি’।কিন্তু অধিকাংশ সময় পর পর দুইবার ‘গ্যা’ উচ্চারণের হ্যাপা সামাল দিতে মাঝেরটি ছাড়াই ক্রিয়াবিশেষ্যটি হয় ‘খাওয়ার/খাইবার লাগি’,‘যাওয়ার/যাইবার লাগি’,‘জানার/জানবার লাগি’।অনুরূপ ‘লওয়ার/লইবার লাগি’,করার/করবার লাগি’।মান বাংলাতে ‘লাগি/লাগিয়া’ -ও নেই।ওখানে ‘জন্যে’ –জানার জন্যে,লওয়ার/নেওয়ার/নেবার জন্য,করার/করবার জন্য।সিলেটিতে সরাসরি ‘করি’ পরপদ যোগেও এমন অসমাপিকা হয়।জগন্নাথ চক্রবর্তী নজির দিয়েছেন,“হি চাউল নিতো করি আইছে।’২৮৮ অসমিয়ার মতো ‘কারণে’ অনুসর্গের ব্যবহার বরং সিলেটিতে আছে-- ‘বাপ মরার কারণে তার গিরস্তি গেল।’২৮৯ ‘জানিবার’ অসমাপিকার সঙ্গে মোটেও গঠনগত দিক থেকে ‘জানিতে’ বসে না।‘-ইতে’ প্রত্যয় যুক্ত হলে সিলেটিতেও শব্দগুলো হবে ‘জানতে/জানাত̖’,‘লইতে/নিতে/লওয়াত̖/নেওয়াত̖’,‘করতে/করাত̖’।জগন্নাথ চক্রবর্তী সিলেটিতে এমন তুমন্তকের কিছু নজির দিয়েছেন,‘কাইলকু তাইরে দেখাত যাইমু’,‘মামলত লইতে খেরো ফুত’।২৯০অসমিয়াতে প্রত্যয়টির--“ব্যবহার বর জনপ্রিয় আছিল যেন নেলাগে” লিখেছেন,বাণীকান্ত।২৯১ প্রাচীন অসমিয়াতে দুই একটি ব্যবহারের নজির দিয়েছেন এরকম---“বৈকুণ্ঠ যাইতে ভৈল কাছ পাৰ।” এসব দিলেও তিনি আরো লিখেছেন,“–ইত যুক্ত তুমন্তকে প্রিয় সাহিত্যিক বা ব্যবহাৰৰ জনপ্রিয় রূপ হিচাপে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করিব নোৱাৰিলে।”২৯২ড০ উপেন রাভা হাকাচাম তুলনা করতে গিয়ে অর্থ-সাম্যের কথা মনে রাখলেও,গঠনগত বিপর্যয় ঘটিয়েই শুধু এই তুমন্ত শব্দে সিলেটির সঙ্গে অসমিয়ার মিল দেখিয়েছেন।কৰিবলৈ’ শব্দটি ‘-লৈ’ অংশের জন্যে যদিও বা সিলেটির কাছাকাছি যায়,তাঁর নজিরে ‘করিবার’ অংশটিতো বিশুদ্ধ বাংলা সাধুই,সিলেটি ‘করার/ করবার’ অংশের সঙ্গে মান বাংলার লেখাতে কীই বা তফাত?উচ্চারণেই যেটুকুনি রয়েছে সামান্য।তার উপরে ‘করাত’ শব্দের সমগোত্রীয় কোনো অসমিয়া শব্দ নেই,এই কথা উপেন রাভা উল্লেখই করেন নি। বাণীকান্ত করেছেন,“অধিকরণৰ –ইতে রূপত ই বং.র প্রকৃত তুমন্তক হল।পুব বঙ্গীয় উপভাষাবোরর –ইত,-ইতাম যুক্ত তুম.গঠন করে”২৯৩ ‘কৰিলত,ক’লত,খালত’ এমন কিছু অসমিয়া নেই নয়।কিন্তু সেগুলো সর্তজ্ঞাপক সংযোজকের ভূমিকা পালন করে। যেমন---মাৰ খালত সি সঁচা কথাটো কৈ দিলে;পুলিচ আহিলত চোৰবোৰ পলাল।২৯৪
৮) “চিলেটিয়া/কাছারীত’ অসমাপিকা ক্রিয়ার রূপ –ই/-ইয়া যদিও যৌগিক ক্রিয়া গঠন করার বেলিকা ই সদায় অসমীয়ার দরে –ই হয়।উদাহরণ--- দেখি/দেখাই (দেখুৱাই দিয়া),বাছি লওয়া (বাছি লোৱা),উটি যাওয়া (উঠি যোৱা) ইত্যাদি।অৱশ্যে চিলেটীয়া রূপত অপিনিহিতির দ্বারা ইয়ার প্রয়োগ আছে।যেনে--- বাইচ্ছা লওয়া (বাছি লোৱা),উইট্যা যাওয়া (উঠি যোৱা) ইত্যাদি।”২৯৫
সিলেটি নজিরগুলো তিনি নিয়েছেন নিখিলেশ পুরকাইতের থেকে বলে উল্লেখ করলেও সেখানে কথাগুলো ভিন্নরকম লেখা আছে।সেখানে স্পষ্টই লিখেছেন নিখিলেশ “অসমাপিকা ক্রিয়ার রূপ সিলেটিতে চলিত ভাষার থেকে ভিন্ন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলা সাধু ভাষার অনুরূপ।যেমন,জাগিয়া,জাইগ্যা,জাগি”২৯৬এই তিনের প্রথমটি সাধুভাষার অনুরূপ এবং সিলেটিতে বহুল প্রচলিত।প্রতিবেশী বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিতেও রয়েছে এমন ‘-ইয়া’ অন্ত অসমাপিকা--সঙ হাজেয়া ঢং দেহেয়া/বাঙ বাকুতি চরেছে/খঙ দেখিয়া চঙ ফান্দিয়া/মুর নঙেয়া পড়েছে।।২৯৭এই নিয়ে প্রশ্ন নেই।দ্বিতীয়টি হবিগঞ্জি ভাষাবৈচিত্র্যেও আছে।এবং অবিভক্ত সিলেটের দক্ষিণে হবিগঞ্জ কুমিল্লা সীমান্তের হওয়াতে সেখান কার ভাষা বৈচিত্র্যে কুমিল্লার (ঔপনিবেশিক আমলের তিপেরা)ভাষার প্রভাব পড়েছে।সেখানে এই রূপটিই প্রধান।নিখিলেশের নমুনা বাক্য সিলেটিতে যখন এই ভাবে অনুদিত,“গীত জুগার করার লাগি/লাগিয়া/ লাইগ্যা এক ছাত্রবন্ধুরে লইয়া গাউও বারইছি।” কুমিল্লার ভাষা বৈচিত্রে এর অনুবাদ করেছেন এই ভাবে,“লোকগীত জুগাড়ের লাইগ্যা এক ছাত্রবন্ধুরে লইয়া বাইরইয়াছি পাড়াগ্রামে।”২৯৮ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা এবং উত্তর ত্রিপুরার সিলেটি এখন কুমিল্লার ভাষাবৈচিত্র্যে ব্যাপক ভাবেই প্রভাবিত।তাই এই সব এলাকাতে হবিগঞ্জ ভিন্ন সিলেটের অন্য ভাষাবৈচিত্র্যেও এই অপিনিহিতি রূপটি দেখা যায় বটে।কিন্তু এগুলো সিলেটির প্রধান স্রোত নয়।অন্যদিকে কাছাড়ি বিভাষাতে ‘লাগি’,‘জাগি’,‘দেখি’ –এগুলোই প্রধান।উপরের নমুনাটি কাছাড়িতে অনুবাদ করেছেন এই রকম,“গাওর গান জোগাড় করার লাগি এক ছাত্রবন্ধুরে লইয়া গাওত বারইছি।” জগন্নাথ চক্রবর্তী সম্ভবত তাই এই ‘-ই’-কে ‘খাঁটি বরাক বাংলা প্রত্যয়’ লিখেছেন।২৯৯ জগন্নাথের মন্তব্যে একে অসমের সামুহিক সম্পদ বলে মনে হতেই পারে।সম্ভবত তা অনেকটা সত্যও।এবং ড০ উপেন রাভা হাকাচাম যে এর সঙ্গে অসমিয়ার আত্মীয়তা দেখিয়েছেন তাও অস্বীকার করবার জো নেই।কিন্তু নোয়খালির ভাষাবৈচিত্র্যেও নিখিলেশ এর অস্তিত্ব দেখিয়েছেন।৩০০রবীন্দ্র কুমার দত্তও লিখেছেন,“বাংলা অসমাপিকা ‘ইয়া’-র স্থানে নোয়াখালি-চট্টগ্রামীতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাপিকা-বোধক ‘ই’ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।”৩০১যেমন- চট্ট.আঁ:́ই বা’ত খা̣ই বারিত̖ জা̣ইর̖,গারিত̖ করি বারিত̖ জা̣ইয়ম̖;নোয়া.আঁ:́ই বা’ত খা̣ই বারিত̖ জা̣ইয়ের̖,গাঁইত̖ করি বাঁইত̖ জামু। স্বাভাবিক ভাবেই এই দুই ভাষাবৈচিত্র্যেও সিলেটির মতো ‘-ইয়া’ পরসর্গ রয়েছে,এছাড়াও আছে ‘~ইয়ারে’।কিন্তু ‘-ই’-টি কেবল কাছাড়ি বিভাষা বা অসমিয়াতেই আছে--- এমনটা নয়,দেখা গেল।চর্যাপদেও এর নজির আছে,‘দুলি দুহি পিটা ধরণ ন জাই’(চর্যা:২) বা ‘তা দেখি কাহ্ন বিমন ভইলা’(চর্যা:৭)।কিন্তু চর্যাতে ‘–ই’-র রূপান্তরও আছে,‘নাড়ি শক্তি দিঢ় ধরিঅ খাটে’।সুকুমার সেন লিখেছেন,“...অর্বাচীন অপভ্রংশে ও প্রাচীন বাংলায় ‘-ই’ যুক্ত অসমাপিকার উৎপত্তি হইয়াছিল।... ‘-আ’ যুক্ত পদ ‘-ইঅ’ –যুক্ত পদেরই পুষ্ট রূপ।”৩০২তার মানে চর্যার ‘ধরিঅ’ জাতীয় শব্দই পরে আধুনিক বাংলাতে ‘ধরিয়া,ধইরা,ধরে’ রূপে পাল্টেছে।উপনিবেশপূর্ব বৈষ্ণব কবি জ্ঞানদাসের পদে আছে,“রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর। প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর।এমন আরো মেলে।কিন্তু,“আধুনিক বাঙ্গালায় ‘-ই’অন্ত অসমাপিকা কাব্যের ভাষার বাহিরে অচল।”৩০৩ লিখেছেন সুকুমার সেনও।সুতরাং আমরা শুধু এমন সিদ্ধান্তে যেতে পারি যে চর্যার সময়কার রূপটি মাগধী ভাষাগুচ্ছের পূর্বপ্রান্তে সজীব হয়ে আছে।তাই কাছাড়ি,অসমিয়াতেই নয় দূর দক্ষিণের নোয়াখালি, চট্টগ্রামীতেও সেটি টিকে আছে।মায়ানমারের ভাষা রোহিঙিয়াতেও রয়েছে।যেমন--–আঁরা রুইঙগ্যা অক্কলঅরে আচল বাচিন্দা বৌলি ১৯৬৫ চন ফইজজন্ত মানি লইল।এখনর হুকুমতে ইয়ান ন মানের।৩০৪অসমিয়ার সঙ্গে নৈকট্যের কারণ এই মাত্র। বাংলার সঙ্গে এতে সিলেটির অনাত্মীয়তা ঐতিহাসিক ভাবেই প্রমাণিত হয় না।প্রতিবেশী বাংলা ভাষা বৈচিত্র্যগুলোর সঙ্গেতো এখনো না।সুনীতিকুমার অবশ্য মাগধি ভাষাগুচ্ছের পশ্চিমা কিছু ভাষা যেমন বিহারি,ওড়িয়াতেও এই ‘-ই’ প্রত্যয় টিকে থাকার নজির দিয়েছেন।৩০৫
৯) “চিলেটীয়াত বহুবচন বুজোয়ার বহুল প্রচলিত ‘হকল’ রূপ অসমীয়া ‘সকল’ রূপর সৈতে একোতে ভিন্নতা নাই, যিটো সচরাচর বাংলাত অনুপস্থিত।”৩০৬
এই নিয়ে আমরা বচন প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা করে এসেছি।এখানে বিস্তৃত করছি।তিনি তাঁর কথার সূত্র উল্লেখ করেন নি।তবে কথাটি নিখিলেশ পুরকাইতের থেকে পেয়ে থাকবেন।নিখিলেশ পুরকাইত লিখেছেন,“শব্দরূপের ক্ষেত্রে বাংলা চলিত ভাষার সঙ্গে সিলেটীর পার্থক্য বেশ আছে।”৩০৭ এটিই উপেন রাভা হাকাচামকে ভাবিয়ে থাকতে পারে যে সিলেটি বাংলার থেকে ভিন্ন।কিন্তু নিখিলেশ সিলেটিতে ‘-টাইন’,এবং ষষ্ঠীর বহুবচনে ‘-রার’ ‘বিভক্তি’র কথাও উল্লেখ করেছেন। যেগুলো আবার অসমিয়াতে নেই।জগন্নাথ চক্রবর্তী ‘-গুইন’, ‘-তা’ বলে আরো দুই একটি বহুবচন পরসর্গ এবং তাদের রূপবৈচিত্র্যের উল্লেখ করেছেন।৩০৮এর মধ্যে ‘-গুইন’ আসলে বাংলা ‘গুলো/গুলির’ রূপবৈচিত্র্য –এ কথা আমরা লিখে এসেছি। অসমিয়ার কামরূপীতেও এরই রূপবৈচিত্র্য ‘গ্লা/ ‘গ্লাক’।এখন এই ‘-গুইন’,‘-তা’ বা ‘-টাইন’,‘-রা’ রূপিমগুলোর মুক্ত ব্যবহার নেই,‘হকল’ কথাটির রয়েছে।সুতরাং এটি অনুপদ কিনা এবং সিলেটি ভিন্ন বাংলার আর কোনো ভাষাবৈচিত্র্যে ব্যবহৃত হয় কিনা এই প্রশ্নের মীমাংসা আমাদের করতে হচ্ছে।একটি উদাহরণ দেখা যাক,“হিন্দু হক̖লর ই এক গুমগুমি। তারার হক্কল̖তা ভালা।মাও ভালা।কিতা ভাবছ বে,বাঙাল হকল̖ কিতা পাড়ার তলর বেঙনি।তোর হক্কল̖তাউ ভালা,গুও ভালা। এর লাগিউ অইছে পাকিস্তান।”(সু গা পা:এগারো) ‘হকল’ কথাটি যে মূলে ‘সকল’ এই নিয়ে সংশয় নেই।অসমিয়াতে বানানেও আছে ‘স’,উচ্চারণে /x/।এটি মূলত ধ্বনি পরিবর্তন।এবং এটি সিলেটিতে পরপদ হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে,পূর্বশব্দের সঙ্গে জুড়ে যায় নি।অসমিয়াতেও তাই হয়।যেমন এই বাক্যে-- “টাই আহোম সকলে দেশৰ শাসনভাৰ লোৱাৰ পিছত নিজৰ ভাষা-সংস্কৃতি এৰি আৰ্য ধৰ্ম আৰু সংস্কৃতি গ্ৰহণ কৰি ৰাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ কৰিছিল।”৩০৯এখন,উপরের সিলেটি উদাহরণে ‘হকল’ কথাটির তিনরকম ব্যবহার বৈচিত্র্য আছে।প্রথমটি ‘হক̖লর’-এ ‘ক’ ধ্বনির স্বরলোপ হচ্ছে,দ্বিতীয়টি ‘হক্কলতা’ -এ আরেকটি ‘ক’এর দ্বিত্ব হয়েছে বহুবচনে জোর দেবার জন্যে, এবং আরো জোর দিতে জগন্নাথ কথিত ‘তা’-কেও জুড়ে দেয়া হয়েছে।এই পরসর্গটির বিশুদ্ধ ব্যবহার মেলে ‘হরুতা’ এই রকম শব্দে।এর অর্থ ‘ছোটরা’।‘হকল’ শব্দের এমন ব্যবহার অসমিয়াতে নেই।সেখানে শব্দের বিশেষ্যের আগে বহুবচন বোঝাতে বসলে ‘-ও’ যুক্ত হয়ে হয় ‘সকলো’।আর তৃতীয় ‘হকল’ অনেকটাই অসমিয়ার মতো,‘ক’ ধ্বনির স্বরলোপ ঘটে নি। সত্য বটে সিলেটিতে ‘হকল’ অনুসর্গের ব্যবহার অনেকটাই অসমিয়ার মতো।প্রতিবেশী অন্য বাংলা ভাষাবৈচিত্র্যে এর একেবারেই দেখা মেলে না এমন নয়।সিলেটি ‘সকল’,‘-গুইন’-এর সামান্য রূপান্তর চট্টগ্রামীতেও রয়েছে।ওখানে মাঝের ‘-ক’ ধ্বনিটি লোপ পেয়ে পূর্ববর্তী ‘হ’-তে যুক্ত স্বরকে ক্ষতিপূরণ দীর্ঘিভবন সূত্রে দীর্ঘ করে ফেলে ‘হ:ল̖’ হয়।অথবা ‘হ’টিও লোপ পেয়ে যায়,‘অ’ থাকে।এই ‘অ’ কণ্ঠনালীয় স্পৃষ্ট ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়,তার সঙ্গে যুক্ত হয় ঊর্ধ্ব স্বরাঘাত।যেমন-- মানুশহঃল̖,মানুশ’অ¢ল̖।তাও কারকের পরসর্গ যুক্ত হলে সেগুলোর প্রভাবে ‘হল’,‘অ¢ল’ রূপবৈচিত্র্যেরও দেখা মেলে।যেমন-- সম্বন্ধের বহুবচনে,‘মানুশহলর’,‘মানুশঅ¢লর’।৩১০দুই ক্ষেত্রেই এগুলো পরপদরূপে আর অস্তিত্ব বজায় না রেখে পূর্বপদের সঙ্গে জুড়ে যায়।অসমিয়া বা সিলেটির সঙ্গে এইটুকুন মাত্র তফাত।নিখিলেশ পুরকাইতের চট্টগ্রামী সম্পর্কিত আলোচনা তত বিস্তৃত নয়,এবং বহুবচনের আলোচনাতে এই ‘হল’, ‘অ¢ল’ –এর উল্লেখ নেই বলেই হয়তো ড০ উপেন রাভা হাকাচাম এই সিদ্ধান্তটি নিয়ে থাকবেন আর লিখবেন,“...একোতে ভিন্নতা নাই,যিটো সচরাচর বাংলাত অনুপস্থিত।” অথচ সিলেটি ‘হক্কল’-র সঙ্গে দূর দক্ষিণের ‘রোহিঙিয়া’র আত্মীয়তা অসমিয়ার থেকে বেশি।আগেই তুলে দেয়া একটি বাক্যে যেমন রয়েছে--- আঁরা রুইঙগ্যা অক্কলঅরে আচল বাচিন্দা বৌলি ১৯৬৫ চন ফইজজন্ত মানি লইল। এখনর হুকুমতে ইয়ান ন মানের।
বহুবচন বোঝাতে ‘সকল’ কথাটির ব্যবহার বিশেষ্যের আগে এবং পরে দুইভাবেই চর্যাতেও ছিল। যেমন-- “সঅল সমাহিঅ কাহি করিঅই”(চর্যা: ১) এবং “ছড়গই সঅল সহাবে সূধ” (চর্যা:৯) রবীন্দ্রনাথ ‘বাংলা বহুবচন’ নিবন্ধে লিখেছেন, “‘সব’,‘সকল' ও "সমুদয়' শব্দ বিশেষ্য শব্দের পূর্বে বিশেষণরূপে প্রযুক্ত হইয়া বহুত্ব অর্থ প্রকাশ করে।কিন্তু বস্তুত এই বিশেষণগুলি সমষ্টিবাচক। ...লিখিত বাংলায়,‘সকল’ ও "সমুদয়' শব্দ বিশেষ্যপদের পরে বসে।কিন্তু কথিত বাংলায় কখনোই তা হয় না।সকল গোরু বলি,গোরু সকল বলি না।বাংলা ভাষার প্রকৃতিবিরুদ্ধ এইরূপ প্রয়োগ সম্ভবত আধুনিককালে গদ্যরচনা সৃষ্টির সময়ে প্রবর্তিত হইয়াছে।লিখিত ভাষায় "সকল' যখন কোনো শব্দের পরে বসে তখন তাহা তাহার মূল অর্থ ত্যাগ করিয়া শব্দটিকে বহুবচনের ভাব দান করে।লোকগুলি এবং লোকসকল একই অর্থে ব্যবহৃত হইতে পারে।প্রাচীন লিখিত ভাষায় "সব' শব্দ বিশেষ্যপদের পরে যুক্ত হইত।এখন সে রীতি উঠিয়া গেছে,এখন কেবল পূর্বেই তাহার ব্যবহার আছে। কেবল বর্তমান কাব্যসাহিত্যে এখনো ইহার প্রয়োগ দেখা যায়-- যথা,‘পাখি সব করে রব’।বর্তমানে বিশেষ্যপদের পরে "সব' শব্দ বসাইতে হইলে বিশেষ্য বহুবচন রূপ গ্রহণ করে।যথা,পাখিরা সব,ছেলেরা সব অথবা ছেলেরা সবাই।বলা বাহুল্য,জীববাচক শব্দ ব্যতীত অন্যত্র বহুবচনে এই "রা' ও "এরা' চিহ্ন বসে না।বানরগুলা সব,ঘোড়াগুলা সব,টেবিলগুলা সব,দোয়াতগুলা সব-- এইরূপ গুলাযোগে,সচেতন অচেতন সকল পদার্থ সম্বন্ধেই "সব' শব্দ ব্যবহৃত হইতে পারে।”৩১১
বিশেষ্যের পরে ‘সকল’ শব্দটির বাংলাতে ব্যবহার অস্বীকার করেন নি রবীন্দ্রনাথ,শুধু লিখেছেন,‘কথিত বাংলায় কখনোই তা হয় না।’ আর এই যে লিখেছেন,“"সব' শব্দ বসাইতে হইলে বিশেষ্য বহুবচন রূপ গ্রহণ করে।” এ অনেকটা ‘হক্কলতা’ বা ‘সকলতা’ শব্দে বহুবচনের অনুপদে জোর দেবার মতো ব্যাপার।মান বাংলাতে শুধু জোরটি আগেকার বিশেষ্য পদেই বসে। সেখানেও বহুবচন পরসর্গ ব্যবহৃত হয়।অথচ, ‘সব’ আগে বসলে তার দরকার পড়তো না।অসমিয়াতে এই আগে বসা বাংলা ‘সব’ শব্দের বদলে ‘সকলো’ বসে।
‘সকল’ যে লিখিত বাংলাতেও বিশেষ্যের পরে বসে এই কথা তো রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করলেন।উপেন্দ্র কিশোরের টুনটুনির বইতে আছে এমন প্রয়োগ,“তারপর শিয়াল ব্যাঙদের কাছে গিয়ে বললে, ‘ভাই সকল,আমার বন্ধুর বিয়ে,তোমাদের নিমন্ত্রণ। তোমরা গান গাইতে যাবে।”(বোকা জোলা আর শিয়ালের কথা)।রবীন্দ্রনাথ এর পরে যে লিখেছেন, “বাংলা ভাষার প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ এবং এগুলো “আধুনিককালে গদ্যরচনা সৃষ্টির সময়ে প্রবর্তিত হইয়াছে।” তাতে স্পষ্ট যে তিনি মান বাংলা ভাষার কথাই লিখছেন।তাঁর সময়ে ঔপভাষিক অনুসন্ধান সেরকম সবল ছিল না বলেই সিলেটি তো বটেই,চট্টগ্রামীও তাঁর নজর এড়িয়ে গেছে।
১০) “কর্তাকারকর -এ বিভক্তি বাংলার বিপরীতে অসমীয়ার দরে বাধ্যতামূলকভাবে সিলেটীয়া/কাছারীত প্রয়োগ আছে। যেনে,বাবুয়ে কইছে (বাবুই কইছে) তু. বাংলা: বাবু বলিয়াছে।”৩১২
এরও কোনো সূত্র উল্লেখ করেন নি ড০ উপেন রাভা হাকাচাম।তবে নিখিলেশ পুরকাইতের ‘বাংলা অসমীয়া ও ওড়িয়ার উপভাষার ভৌগোলিক জরিপ’ বইতে সিলেটি এবং কাছাড়ি দুই ভাষাবৈচিত্র্যেই প্রথমার একবচনে ‘-অ,~এ’ এই দুই পরসর্গের উল্লেখ আছে।কিন্তু নিখিলেশ পুরকাইত প্রতিটি ভাষা বৈচিত্র্যের আলোচনার শুরুতেই সেই ভাষাবৈচিত্র্যের স্বরচিত যে তিনটি নমুনা দিয়েছেন,সেখানে কাছাড়িতে “এক বেটী মানুষ বুট দিতা আইলা”, সিলেটিতে,“অ্যাক বদ্রমইলা বুট দিতা আইলা” রয়েছে।কর্তৃকারকে এখানে মান বাংলার মতোই শূন্য বিভক্তি।তার বিপরীতে কুমিল্লা,নোয়াখালি,ময়মনসিংহ এমন কি যশোর,ফরিদপুর,বরিশালের ভাষাতেও ‘-অ,~এ’ এই দুই পরসর্গেরই উল্লেখ করেছেন।বরং খুলনার আলোচনা করতে গিয়ে তিনি ‘-ই’ বিভক্তির অস্তিত্বের কথা লিখেছেন।৩১৩ড০ উপেন রাভা হাকাচাম ‘অসমীয়ার দরে বাধ্যতামূলকভাবে’ ব্যবহৃত ‘-এ’ বিভক্তির কথা লিখতে গিয়ে আসলে এই ‘-ই’-এর (বাবুই কইছে) নজির দিয়েছেন।‘-ই’ অবশ্য ‘-এ’-রই রূপবৈচিত্র্য। কিন্তুই এই পরিবর্তন যে অসমিয়ার মতো সিলেটিতে হচ্ছে না,সে তো তাঁর নজিরেই স্পষ্ট।আর সিলেটিতেও বিশুদ্ধ ‘-এ’-র নজির তিনি দেন নি,যা দিয়েছেন তা এর উপরূপ বা রূপবৈচিত্র্য ‘-য়ে’।শব্দের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে এই পরিবর্তনগুলো হয়। ব্যঞ্জনান্ত থাকলে বিশুদ্ধ ‘-এ’ হতো। যেমন ‘বাপে́’।আর বাবু বলিয়াছে---যথারীতি সাধু বাংলা।মান বাংলাতে বাক্যটি হবে,‘বাবু বলেছে/বলেছেন’। পুব বাংলার মুখের ভাষাতে বরং বাক্যটি ‘বাবু বল্যাছে’ হতে পারে।তার মানে তত্ত্বের সমর্থনে তিনি তথ্য দিতে পারেন নি ---এই ব্যাপারটি এখানেও তাঁর নজর এড়িয়ে গেছে।আর ‘বাধ্যতামূলক’ শব্দের ব্যবহারে মনে হবে বুঝিবা অসমিয়াতে প্রথমার শূন্য বিভক্তি নেই।শূন্য যে অসমিয়াতে রয়েছে,আমরা দেখিয়ে এসেছি।আমরা বাণীকান্ত কাকতির ‘গুরুত্বারোপন’ তত্ত্বের কথা লিখেছিলাম।এখানে তারই বিস্তার ঘটাচ্ছি।দীপ্তি ফুকন পাটগিরিও লিখেছেন,“কেতিয়াবা শূণ্য বিভক্তির প্রয়োগও কর্তা কারকর অন্যতম বৈশিষ্ট।উদাহরণ স্বরূপে---১।মানুহ মৰণশীল।”৩১৪বাণীকান্ত লিখেছেন, “...সকর্মক ক্রিয়ার কর্তাত সদায় শব্দরূপর লক্ষণযুক্ত –এ’ত করণকারকর প্রত্যয় –এঁ’,-এ’র প্রভাব আছে কারণে –এ’ক করণ-কর্তা বিভক্তি বুলি গণ্য করিব পারি।৩১৫এইখানে ‘বাধ্যবাধকতা’ কথাটির একটি ব্যাখ্যা মেলে।কিন্তু সিলেটিতে সেরকম নেই,যদিও ‘-এ’ বিভক্তির ব্যাপক ব্যবহার আছে।এবং সকর্মক অকর্মক ভেদবিবেচনা নেই।আমরা যে নজির দিলাম সেই বাক্যের ক্রিয়াটি সকর্মক হওয়া সত্ত্বেও ‘বেটী মানুষ’ বা ‘বদ্রমইলা’-তে কোনো পরসর্গ যুক্ত হয় নি।তেমনি ‘সুরমা গাঙর পানি’তে আছে,“রাম গিয়া উবাইলা তান ভক্তর সামনে...।”(সু.গা. পা:তিন)চর্যার সময় থেকেই ‘বাংলা-অসমীয়া’-তে ‘-এ’ পরসর্গ-সহ এবং পরসর্গ-শূন্য দুই রূপই ছিল,আমরা আগে দেখিয়ে এসেছি।আধুনিক বাংলার মূল প্রবণতা পরসর্গ শূন্যতার হলেও,সব কারকেই ‘-এ’ পরসর্গের তির্যক প্রয়োগও আছে।সুতরাং প্রথমাতেও ‘-এ’ আকছার যুক্ত হয়।সুকুমার সেন অবশ্য লিখেছেন,এখানেও নিয়ম হলো,“আধুনিক বাংলায় (সাধু ও চলিত ভাষায় কর্তৃকারকে [ -এ (-য়) ),-তে] বিভক্তির ব্যবহার হয় শুধু অনির্দিষ্ট কর্তা বুঝাইতে।”৩১৬ যেমন,‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’,‘বুলবুলিতে ধান খেয়েছে’।সিলেটিতে এই নিয়মেরও কোনো বাঁধন নেই।আর শুধু সিলেটিতেই নয়, সুকুমার সেন লিখেছেন,“বঙ্গালী-কামরূপীতে [-এ] নির্দিষ্ট কর্তায়ও চলে।”৩১৭এখানে এই ‘-তে’-নিয়ে কিছু কথা লেখা ভালো।আমরা দেখে এসেছি ‘-এ’,‘-তে’ বাংলাতে কেবল করণ কারকের বা তৃতীয়া বিভক্তিই নয়,অধিকরণের তথা সপ্তমীরও বটে।সিলেটিতে কিন্তু অসমিয়ার মতোই এই সপ্তমীর [-তে (ত̖) ] কর্তাতে ব্যবহৃত হয় না।এমন কি মান বাংলার সপ্তমীর ‘-এ’ সিলেটিতে ‘-ও’ হয়ে যায়। যেমন মা.বাং.ঘরে,শিলচরে।সিলেটি: ঘরো, শিলচরো।
১১) “কাছারিত সম্বন্ধ কারকর –অর/-র বিভক্তি বাংলার (-এর/-র) বিপরীতে অসমীয়ার (-অর/-র ) সৈতে হুবহু একে। যেনে---ঘরর,মর,কন্যার,রাইতর (ঘৰৰ,মোৰ,কইনাৰ,ৰাতিৰ) তু.বাংলা: ঘরের,আমার,রাতের,কনের ইত্যাদি।”৩১৮
কথাটা মোটের উপরে সত্য।মান এবং সাধু বাংলাতে ‘-র̖’ আছে।স্বরান্ত পূর্বাংশের পরে ‘-র̖’ যুক্ত হয়।সিলেটি অসমিয়াতেও তাই হয়।এই যুক্তিতে কি অসমিয়া বাংলা হবে? এই প্রশ্ন রেখেও,দেখা যাচ্ছে সিলেটি- অসমিয়ার কথা হতে পারে শুধু ‘-অর̖’ নিয়ে।‘কন্যা’ শব্দটি মান এবং সাধু দুই বাংলাতেই আছে,তার উপরে স্বরান্ত।তাই এর নজির এখানে বেমানান।তেমনি অসমিয়া ‘ৰাতি’ শব্দটিও স্বরান্ত।‘-র̖’ যুক্ত হয়েছে।যা কিনা মান বাংলাতেও হয়ে থাকে। যেমন--কনের̖।সিলেটিতে ‘কইন্যার̖’-ও হয়।মান বাংলা ‘-এর̖’ এবং অসমিয়া- সিলেটি ‘-অর̖’ যুক্ত হয় ব্যঞ্জনান্ত পূর্বাংশের পরেই। যেমন---ঘৰৰ̖,ঘরর̖।কিন্তু সেরকম নোয়াখালি,চট্টগ্রামীতেও হয়ে থাকে।যেমন-- মানুশর̖ (চট্টগ্রামী),মাইন̖শর̖ (নোয়াখালি)৩১৯ নিখিলেশ পুরকাইতের চট্টগ্রামী নমুনা বাক্যে আছে,“‘পোলিং অফিসার’র তুন ব্যালট কঅসসান লইয়ারে মইন্দে টেবিলর নিচে টুকি গেল̖গৈ।” এখন এই,‘গেল̖গৈ’ কিন্তু অসমিয়া ‘গল̖গৈ’র খুব কাছাকাছি।সিলেটিতে শব্দটি হবে ‘গেল̖গি’।
১২) “কাছারী/চিলেটিয়াত অধিকরণ কারকত অসমীয়ার দরে –অত/-ত (ব্যতিক্রম বাংলা –অতে/তে) বিভক্তির অবিকল প্রয়োগ আছে। যেনে –গলত তু.বাংলা গলে,গাউত (গাঁৱত) তু.বাংলা গ্রামে,বাড়ীত (ঘরত) তু.বাংলা বাড়ীতে ইত্যাদি।”৩২০
এই নিয়ে সামান্য আগেই কিছু লিখে এসেছি। কিন্তু এখানেও বেশ কিছু ভুল আছে।প্রথমত সিলেটিতে ‘-অত̖’ আর বাংলাতে ‘-অতে’ বলে কিছু নেই। অসমিয়া ‘-অত’-এর সঙ্গে জোর করে মেলানো হয়েছে। ‘গলত’ সিলেটি শব্দ নয়,শুদ্ধ শব্দটি হবে গলা+ত̖= গলাত̖।তার মানে পরসর্গটি ‘–ত̖’।স্বরান্ত শব্দের শেষে এই ‘-ত̖’ বসে।মান বাংলাতে শব্দটি হবে গলা+তে= গলাতে।তিনি যে ‘গলে’ শব্দটির উল্লেখ করেছেন সেটি গীতিকবিতার প্রয়োগ।আর এমন প্রয়োগ সিলেটি লোকগানে হতেও অসুবিধে নেই। তেমনি সিলেটি গাউত,অসমিয়া গাঁৱত শব্দের সঙ্গে মান বাংলা ‘গ্রামে’ বেমানান।মান বাংলা শব্দ গাঁ+এ= গাঁয় বা গাঁয়ে।বাংলা গানে আছে—‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’।(গাজী মাজহারুল আনোয়ার) মূল শব্দ স্বরান্ত হয়েও এখানে ‘-এ’ যুক্ত হয়েছে।কিন্তু বিকল্পে ‘-তে’-রও খুব ব্যবহার হয়,যেমন বনগাঁতে,চাঁটগাঁতে ইত্যাদি।‘গ্রাম’ শব্দটি সিলেটিতেও আছে।আর সেখানে -এ< -ও হয়ে যায় - ‘গ্রামো’। অসমিয়াতেও ‘গাঁও’ অর্থেই ‘গ্রাম’ শব্দের ব্যবহার থাকলেও তা ব্যাপক নয়।কিন্তু ওজন অর্থে তো আছেই।আর সেখানে এই ‘-ত’ যোগ হয়।যেমন--পদুম ফুলৰ প্রতি ১০০ গ্রামত ১৫ গ্রাম ভিটামিন চি পাবো। সিলেটিতে এই বাক্যটিই হবে: পদ্মফুলর প্রতি ১০০ গ্রামো ১৫ গ্রাম ভিটামিন সি পাইবা।অর্থাৎ গ্রামে,গ্রামো বরং কাছাকাছি ‘গ্রামত’ বহু দূর। তেমনি অর্থের বিচারে সিলেটি-বাংলা বাড়ি আর অসমিয়া ঘর একই হলেও গঠনগত বিচারে এই দুই শব্দ পাশাপাশি বসে না।অসমিয়া শব্দটি হওয়া উচিত ছিল ‘বাৰি’।এবং ‘–ত̖’ যোগ করে ‘বাৰিত̖’।সত্য বটে সিলেটি ‘বারিত̖/বাড়িত̖’,অসমিয়া ‘বাৰিত’ থেকে সামান্য তফাতে আছে মান বাংলা ‘বাড়িতে’ পদে,কিন্তু ওদিকে আবার অসমিয়া ‘ঘৰত’ শব্দের চাইতে সিলেটি ‘ঘরো’ দূরে গিয়ে মান বাংলা ‘ঘরে’-র কাছাকাছি অবস্থান করে ফেলে।কদাচিৎ অধিকরণে জোর দিতে সপ্তমীর বিভক্তির দ্বিত্ব হয়েই শুধু ‘ঘরত’ (< ঘরোত),‘তলত’ (< তলোত) ইত্যাদি শব্দ সিলেটি কাছাড়িতে ব্যবহৃত হয়।মান বাংলার প্রভাবে কখনো বা ‘-এ’-ও ব্যবহৃত হয়।নিখিলেশ পুরকায়েতের নমুনা বাক্যে আছে,“পুলিং অফিসাররার কাছ তাকিয়া/তনে/ তাইক্যা ব্যালট পেপারটাইন (অখল) লইয়া বুটিং কম্পার্টমেণ্টের টেবুলের তলে ডুকি পরলা/ গেলা।”৩২১ অসমিয়ার সঙ্গে আত্মীয়তারই যদি সন্ধান করতে হয় তবে এই ক্ষেত্রেও সুদূর চট্টগ্রামী আমাদের সাহায্য করতে পারে।নিখিলেশ পুরকায়েতের নমুনা বাক্যে আছে,“ ভারতত চোউত্তবার ভুট হনর সমত আঁই ‘প্রিসাইডিং অফিসারে’ আছিলাম।”৩২২ চট্টগ্রামী ‘ভারতত’ < অসমিয়া ‘ভাৰতত’। চট্টগ্রামী ‘সমত’ < অসমিয়া ‘সময়ত’।এই ‘-ত̖’ পরসর্গের ব্যবহার চর্যাতেও ছিল। যেমন “সাঙ্কমত চড়িলে দাহিণ বাম মা হোহি।” (চর্যা:৫) সেদিক থেকে অসমিয়া সহ পূর্বতম প্রান্তের আর্যভাষাগুচ্ছে পরিবর্তন কম হয়েছে এই টুকুন দাবি করা যেতে পারে। কিন্তু সেই দাবি শুধু অসমিয়া,সিলেটি বা চট্টগ্রামীই করতে পারে না।সুকুমার সেন লিখেছেন,“[-ত] বিভক্তি বরেন্দ্রী-কামরূপীতে চলিত আছে।”৩২৩এই কামরূপী বাংলার ভাষাবৈচিত্র্য তথা উপভাষাগুচ্ছের কথা বলা হচ্ছে।নিখিলেশ পুরকায়েতের মালদহের ভাষাবৈচিত্র্যের নমুনা বাক্যে আছে,“পোলিং অফিসার গুলারঠি ভোটের কাগজগুলো নিয়্যা ভোটের ঘরের টেবিলের তলত ঢুকি গেল।”৩২৪ এই নমুনা অবশ্য সেখানকার ‘পোলিয়া/রাজবংশী ভাষা’র থেকে নেয়া।এই ভাষাটিকে বাংলা এবং অসমিয়া দুই পক্ষই নিজের বলে দাবি করেন।রাজবংশীরা নিজেরা বলেন স্বতন্ত্র ভাষা।কিন্তু এখনকার বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার ভাষা বৈচিত্র্যে এই একই বাক্য দাঁড়াচ্ছে,“ছোট সায়েবেকেরে ঠ্যাক্যা যেডা কাগজ নিয়া যে ঘরত ভোট দিবে,ওঠি টেবলর তলত সাঁন্দায়া পল্ল।”৩২৫এর থেকে একটি ব্যাপার স্পষ্ট--গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের উত্তর থেকে শুরু করে দক্ষিণের পাহাড়ের তলদেশে বাংলা জুড়ে বেশকিছু ভাষাবৈচিত্র্যেই এই ‘-ত̖,~অত’ আছে।এ কেবল অসমিয়াতেই আছে এমন নয়।
১৩) “-এ প্রত্যয়ান্ত ক্রিয়া বিশেষণর বহুল প্রয়োগ চিলেটীয়া আৰু অসমীয়া উভয়তে বিদ্যমান। যেনে---লাহে লাহে, তলে,সুন্দরে (চিলেটীয়া) তু.সুন্দরকৈ (অসমীয়া) ।”৩২৬
সিলেটিতে ‘হ’ ধ্বনি লোপ পেয়ে যায়। ফলে,‘লাহে লাহে’ সেখানে আছে বটে,কিন্তু রূপান্তরিত হয়ে –‘লা’য় লা’য়’।৩২৭তেমনি ক্রিয়াবিশেষণ হিসেবে ‘তলে’ একক ব্যবহার কম,‘তলে তলে’ বা ‘তলেদি’ ব্যবহার বেশি।‘সুন্দরে’ সিলেটি শব্দ বলে আমরা কোথাও পেলাম না।মনে হলো এই ‘-এ’ প্রত্যয়ের ‘বহুল’ ব্যবহার দেখাতে গিয়ে তিনি শব্দটি তৈরি করলেন।অথচ,গঠনগত দিক থেকে অসমিয়ার ঘনিষ্ঠ শব্দটি হবে ‘সুন্দর করি’।‘করি’ অসমিয়াতে ‘কৈ’ হয়ে যায়।কিন্তু এই ‘-এ’-র যে খুব একটা ‘বহুল ব্যবহার’ অসমিয়াতেও হচ্ছে না সেতো ‘সুন্দরকৈ’ শব্দেই প্রমাণ।অন্য দিকে মান বাংলা নজির দিতে গেলেও তাঁর নজরে পড়তো ‘কর+এ=করে’-- ‘সুন্দর করে’।সত্যনাথ বরা ক্রিয়া বিশেষণের অন্য অনেক সূত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এক জায়গাতে খুব স্পষ্ট করেই লিখেছিলেন,“বিশেষণ শব্দত একাৰ যোগ দিলে, সি ক্রিয়া বিশেষণ হয়। যেনে---ভাল---ভালে আহিল,কুশল---কুশলে আছে,অকলশৰ---অকলশৰে নাযাবা।”৩২৮এই নিয়মটি অসমিয়ার নিজস্ব বলেই মনে হচ্ছে।সিলেটিতে এমন কোনো নিয়ম নেই।এই শব্দগুলো সিলেটিতে হবে,‘বা’লাউ’ আইলো’,‘বা’লা আছে’,‘এক̖লা যাইও না’।
১৪) “অসমীয়া অনা-/এনা- অব্যয়র সমতুল্য রূপ চিলেটীয়াত প্রয়োগ আছে (-আনা-) কিন্তু বাংলাত নাই (বিনা-) উদাহরণ--- চিলেটীয়া: আনা-কারণে তু.বাংলা বিনা কারণে কিন্তু অসমীয়া অনাহতক।”৩২৯
যদি মেনেও নিই,সিলেটি ‘আনা-’ আর অসমিয়া ‘অনা-’ পুরোসর্গ’ খুব কাছের,সিলেটি আর মান বাংলা পরপদতো একই ‘কারণে’।বরং পুরোসর্গটি মান বাংলাতেই অসমিয়ার মতো ‘অনা’-ই। সেটি আছে।এবং বহুল ব্যবহৃত।‘অনাময়’,‘অনাদ্য’,‘অনাবিষ্কৃত’,‘অনাদর’,‘অনাবিল’,‘অনাদি’,‘অনাবৃষ্টি’,‘অনাসৃষ্টি’ এই সব জনপ্রিয় বহুল ব্যবহৃত বাংলা শব্দগুলো রয়েছে। এই ‘অনা-’ সিলেটিতে কখনো বা ‘আনা’ হয়,সব সময় নয় এবং কখনো ‘না’ অর্থেও বাক্যে স্বতন্ত্র শব্দ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়।‘হে আনা খাইয়া গেল গি দেখো।’
১৫) “চিলেটীয়ার প্রশ্নবাচক নি অনুপদর লগত অসমীয়া নে অনুপদর বিশেষ মিল আছে,যিটো বাংলাত অনুপস্থিত (কি/নাকি)।যেনে---খাইতাই নি তু.অসঃ খাবিনে/বাংলা: খাবে কি/নাকি?”৩৩০
মোটের উপরে ঠিকই আছে,সিলেটি শব্দটি হবে –খাইতায় নি।‘-নি,~নে,~ না’ এখানে নঞর্থক অর্থ বোঝায় না, খাবার ইচ্ছে আছে কি নেই জানতে চাওয়া হচ্ছে।আর এগুলো অনুজ্ঞার ক্রিয়াপদের প্রশ্নবোধক রূপান্তর মাত্র।শব্দ বা বর্ণগুচ্ছটি ব্যবহার না করলেও হত।নিতান্তই শ্রুতি মাধুর্য এবং প্রশ্নকর্তার আগ্রহে জোর দেবার জন্যেই ব্যবহৃত হয়। আভিধানিক দিক থেকে অর্থহীন বললেও চলে।বাংলাতে এই ‘-নি,~নে,~ না’ কেমন বহুল ব্যবহৃত এবং কেন তার সমর্থনে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি তুলে দেয়া অসঙ্গত হবে না,“চলতি বাংলা ভঙ্গীপ্রধান ভাষা,তার একটা লক্ষণ ক্রিয়াপদের অনুজ্ঞায় অসংগত ভাবে ‘না’ শব্দের ব্যবহার।এর কাজ হচ্ছে আদেশ বা অনুরোধকে অনুনয়ে নরম করে আনা।‘হোক না’ ‘করোই না’ ক্রিয়াপদে ‘না’ শব্দে নির্বন্ধ প্রকাশ পায়,কোনো-এক পক্ষের অনিচ্ছাকে যেন ঠেলে দেওয়া।‘না’ শব্দের দ্বারা ‘হাঁ’ প্রকাশ করা আর প্রথমপুরুষ-বাচক ‘আপনি’কে মধ্যমপুরুষের অর্থে ব্যবহার একই মনস্তত্ত্বমূলক।যিনি উপস্থিত আছেন যেন তিনি উপস্থিত নেই,তাঁর সঙ্গে মোকাবিলায় কথা বলার স্পর্ধা বক্তার পক্ষে সম্ভব নয়,এই ভানের দ্বারাই তাঁর উপস্থিতির মূল্য যায় বেড়ে। তেমনি অনুরোধ জানানোর পরক্ষণেই ‘না’ বলে তার প্রতিবাদ করে অনুরোধের মধ্যে সম্মানের কাকুতি এনে দেওয়া হয়।‘না’ শব্দের ক্রিয়াপদের রূপ বাংলা ভাষার আর-একটি বিশেষত্ব,যথা: আমি নই,তুমি নও,সে নয়,তিনি নন,আমি নেই,তুমি নেই,সে নেই,তিনি নেই;হই নে,হও না,হয় না,হন না,হয় নি,হন নি।বাংলা ক্রিয়াপদে নানারকম শব্দ-যোজনায় নানারকম ভঙ্গী।তার কতকগুলি সার্থক,কতকগুলি নিরর্থক।ক্রিয়াপদে এতরকম ইশারা বোধ হয় আর-কোনো ভাষায় নেই।”৩৩১ আর কোনো ভাষাতে এমন ইশারা আছে কি নেই,সেই তর্কে এখন যাওয়া যাবে না। অসমিয়াতে তো আছেই।কিন্তু বাংলাতেও আছে সেটি স্পষ্ট।রবীন্দ্রনাথ অনুজ্ঞার কথা বলেছেন। সেরকম সিলেটি/মান বাংলা বাক্য হবে,‘খাও না।’ সেটিকেই প্রশ্নে পালটে ফেললে হয়,‘খাইতায় নি’। কিন্তু সিলেটিতে পদগুচ্ছটি মান বাংলার মতো এমনও হতে পারে –‘খাইতায় না কিতা?’।অসমিয়াতেও হতে পারে ‘অলপ শুবা নেকি?’।৩৩২ হ্যাঁ,তবে মান বাংলাতে ‘কি’ বাদ দিয়ে ‘খাবে না?’বললে পুরো অর্থই পালটে যাবে বটে।সিলেটি বা অসমিয়াতে সেটি হচ্ছে না। সেদিক থেকে মিল আছে বটে।কিন্তু এমন মিল বাংলার আরো ভাষাবৈচিত্র্যেও আছে।চট্টগ্রামীতে যেমন,“চুরি হইয়ে যে না? –হিতারে জানে বোয়াই দিয়ে যে না।” অর্থাৎ “চুরি হইয়াছে কি? তাহাকে সর্বস্বান্ত করিয়া দিয়াছে”।৩৩৩
১৬) “চিলেটীয়ার জোর বুজোয়া স্বার্থিক প্রত্যয় –গির সৈতে অসমীয়া গৈর বিশেষ সাদৃশ্য আছে।
উদাহরণ---গেল গি তু.অসমীয়াঃ গলগৈ”৩৩৪
এই কথার উল্লেখ আমরা আগেই করেছি।এবং নিখিলেশ পুরকাইতের নমুনা বাক্যের থেকে দেখিয়েছি অনুরূপ ব্যবহার চট্টগ্রামী ভাষাবৈচিত্র্যেও আছে এবং তা অসমিয়ার সঙ্গে হুবহু এক,“‘পোলিং অফিসার’র তুন ব্যালট কঅসসান লইয়ারে মইন্দে টেবিলর নিচে টুকি গেলগৈ।” কিন্তু এই ‘গি’ আর ‘গৈ’ যদি সদৃশ,তবে মান বাংলার ‘গে/ গিয়ে’ অসদৃশ কিসে?শরৎ উপন্যাসের একটি বাক্য থেকে নজির এরকম,“প্রত্যুত্তরে ভারতী শুধু কহিল,মরুক গে। কিছুই আমার ভাল লাগচে না।”(পথের দাবী:২৬)এই ‘মরুক গে’ নজির টেনেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,“পূর্বেই বলেছি বাংলা ভাষার প্রধান লক্ষণ,তার ভঙ্গীর প্রাবল্য।উপরোক্ত শ্রেণীর ক্রিয়াপদে একটা অনর্থক ‘গে’ শব্দের যোগে যে ইঙ্গিত প্রকাশ করা হয় সেটা সহজ শব্দের দ্বারা হয় না,যথা: হোকগে করুকগে মরুকগে।এতে ঔদাসীন্যে ও ক্ষোভে জড়িয়ে যে ভাবটা ব্যক্ত করে সেটা অন্য ভাষায় সহজে বলা যায় না।কেননা গে শব্দের কোনো অর্থ নেই,ওটা একটা মুদ্রা।‘হোকগে’ শব্দের ইংরেজি তর্জমা করতে হলে বলতে হয় : Let it happen,I don’t care।ওর সঙ্গে ‘তুমিও যেমন’ যদি যোগ করা যায় তা হলে ভঙ্গিমা আরও প্রবল হয়ে ওঠে।ইংরেজি বাক্যে হয়তো এর কাছাকাছি যায়:Oh let it be,don’t bother।মোটের উপর এই শব্দভঙ্গীর ভাবখানা এই যে,যা হচ্ছে বা করা হচ্ছে সেটা ভালো নয়,সেটা ক্ষতিকর,বা অপ্রিয়,কিন্তু তবু ওটাকে গ্রাহ্য করার দরকার নেই। ‘মরুকগে’ শব্দে এই ভাষাভঙ্গী খুবই স্পষ্ট হয়েছে।এই ছোট্ট বাংলা শব্দটির ইংরেজি প্রতিবাক্য : Hang it,let it go to the dogs।”৩৩৫ সব সময় ঔদাসীন্য বা ক্ষোভেই এই ‘গে’ যুক্ত হয় তাও নয়।বাক্য অনুসারে ভঙ্গিমার ভাবেরও বদল হয়। ‘ও এই কাজটা করুক গে,তুই বাজারে যা’ এইভাবে বললে কাজটা যাকে করতে বলা হচ্ছে তার প্রতি একটা স্নেহমিশ্রিত প্রশ্রয়ও প্রকাশ পাচ্ছে,সেই সঙ্গে সে যে অবিকল্প কর্তা এই নিশ্চয়তাও বোঝাচ্ছে।অসমিয়াতেও তাই বোঝাবে।সিলেটিতেও তাই,যদি লিখি,‘ হে ই কামটা করউক গি, তুই বাজারো যা’।
১৭) “সেই দরে কিবা (অনুমানবোধক),বোলে (পরোক্ষ উক্তি),বা (অনিশ্চিত) আদি অব্যয়র প্রয়োগ চিলেটীয়া আরু অসমীয়াত হুবহু একে।”৩৩৬
আমরা ‘সুরমা গাঙর পানি’ উপন্যাসের পুরো পাঠ অনুসন্ধান করলাম।যার প্রতিটি সংলাপ সিলেটিতে।অধ্যায় ত্রিশে একটি মাত্র বাক্যে এই ‘কিবা’ শব্দটি পেলাম,“গরিবের কিবা দেশ,কিবা বিদেশ।খাটতে খাটতে খাও,খাটনি নেই তো চলে যাও।”বাক্যটি লেখকের বিবরণ এবং মান বাংলাতে লেখা।টমাস মুরের একটি কবিতা রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করেছিলেন এই নামে ‘দামিনীর আঁখি কিবা।’ সিলেটিতে ‘বোলে’ শব্দটি নেই, স্বগোত্রীয় শব্দটি আসলে ‘বুলে’, --‘সোনাদানার বুচকি ফালাইয়া বেপারি থাকি ফকির অই গেল,ফকির অইয়া বেটার বুলে উবা ফাল।’ (সু.গা.পা.:একত্রিশ) মান বাংলা শব্দটি ‘বলে’,সাধু বাংলা ‘বলিয়া’।মূলে শব্দটি ‘বোল’,আরেক অর্থ ‘কথা’।প্রাকৃতে শব্দটি ছিল ‘বোল্ল’।আবিদ রাজা ‘বরাক উপত্যকার কথ্য বাংলার অভিধান’এ উল্লেখ করেছেন।৩৩৭ রবীন্দ্রনাথের আর কোথাও নয়,‘বাংলা ভাষা পরিচয়ে’ ২২নং অধ্যায়ে এই বাক্যটি আছে,“বাংলা বাক্যবিন্যাসে যদি স্বাধীনতা না থাকত তা হলে উপায় থাকত না।এই স্বাধীনতা আছে বটে, কিন্তু তাই বলে স্বৈরাচার নেই।” জ্ঞান দাসের বৈষ্ণব কবিতার বিখ্যাত পদে আছে ‘শীতল বলিয়া ও চাঁদ সেবিনু ভানুর কিরণ দেখি’ এই ‘বলে/বলিয়া’র বিকল্পে ‘কথা/কহা/কহিয়া’ বা ‘বোঝা’ও ব্যবহৃত হয়।কিন্তু অধিকাংশ সময় এর সবটাই রবীন্দ্র কথিত ‘ভঙ্গী’ মাত্র।নিরর্থক।তাই তিনি এই নজির এক টানে ব্যবহার করেছেন,“হল বুঝি,করল বুঝি,হল ব’লে,করল ব’লে :আসন্ন অপ্রিয়তার আশঙ্কা।...হোক না,করুক না,হোক্গে,করুক্গে,মরুক্গে : ঔদাসীন্য।হলই বা,করলই বা,নাই বা হল,না হয় হল : স্পর্ধার ভাষা।”৩৩৮ আমরা ‘হলই বা,করলই বা’ অব্দি উল্লেখ করলাম উপেন রাভার ‘বা’ শব্দটি নিয়ে কথা পাড়ব বলে।‘বা’-এর সিলেটিতেও বিচিত্র প্রয়োগ আছে,যেগুলো নিয়ে কথা না পাড়লে অসমিয়ার সঙ্গে প্রয়োগ ‘হুবহু একে’ কিনা কিচ্ছু বোঝা যাবে না।মান বাংলার ‘হলই বা,করলই বা’ জাতীয় শব্দের সোজা সিলেটি করা যাবে এভাবে,‘অইলউ বা,করলউ বা’।‘ওরে বা’,‘এরে বা’ এরকম প্রয়োগ সিলেটিতে সম্বোধনে আছে,যার সঙ্গে অসমিয়া ‘হেৰি,হেৰা,হঁয়েৰা’ ইত্যাদি সম্বোধন অব্যয়ের মিল আছে,তাই বলে সেখানে ‘বা’ শব্দটির কোনো ব্যবহার নেই।আর ‘অথবা’ অর্থে ‘বা’ যে মান বাংলার বহুল ব্যবহৃত অব্যয় এই কথা লেখাও আমাদের কাছে বাহুল্য বলে মনে হচ্ছে।
১৮) “অর্থহীন বা অর্থপূর্ণ সদৃশ শব্দর সংযোগত যুরীয়া শব্দৰ গঠন চিলেটীয়া আৰু অসমীয়া উভয়তে বিদ্যমান। যেনে ---
চা-চাকর (চাকৰ-বাকৰ)
বা-বাতাস (বা বতাহ)
মাত-বোল (মাত-বোল)
গিয়া-মেলি (গৈ-মেলি)”৩৩৯
এই বিষয়টি আসলে ‘শব্দতত্ত্বে’ আলোচনার কথা। তিনি এখানে করেছেন। আমরাও প্রাথমিক কিছু কথা লিখে রাখি। বাকি কথা পরে হবে।‘অর্থহীন বা অর্থপূর্ণ সদৃশ শব্দর সংযোগত যুরীয়া শব্দৰ গঠন’ ভারতীয় কোন ভাষাতে নেই-- আমাদের জানা নেই।হিন্দিতেই তো ‘বোলচাল’,‘চায়-বায়’ এমন অসংখ্য অনুকার শব্দের সঙ্গে আমাদের নিত্যদিন পরিচয় ঘটে। মান বাংলাতে এগুলো নেই কেন ভাবলেন ---সেটাই আমাদের অবাক করে।সুকুমার সেন এগুলোকে ‘অনুকার শব্দ’ বলে উল্লেখ করে বেশ কিছু শ্রেণিবিভাজনও আলোচনা করেছেন।‘চাকর-বাকর’,‘হাওয়া-বাতাস’,‘হাওয়া-টাওয়া’,‘কথা-বার্তা’, ‘গিয়ে-টিয়ে’ বিশুদ্ধ মান বাংলা অনুকার শব্দ।ড০ উপেন রাভা হাকাচামের উদাহরণগুলোরই আমরা মান বাংলা অনুবাদ করে নিলাম।এর প্রথম তিনটি সিলেটিতেও আকছার ব্যবহৃত হয়। শেষেরটি হতে পারে ‘গিয়া-টিয়া’।‘চা-চাকর’ আমরা শুনিনি।আর ‘মাতবোল’ নয়,জগন্নাথ চক্রবর্তীও অনুকার শব্দ নিয়ে লিখতে গিয়ে অন্য বহু শব্দের সঙ্গে ‘মাতকথা’র উল্লেখ করেছেন।৩৪০অনুরূপ ‘গিয়া-মেলি’ও সিলেটিতে অশ্রুত শব্দ।আমরা জগন্নাথের অভিধান ঘাটিয়েও ‘মাতকথা’ই পেলাম।সঙ্গে এই বাক্যটিও ‘সুনামইএ মোর বিআর মাতকথা চালাইতরা।’ ‘মাতউত’ আরেকটি সিলেটি অনুকার শব্দ বটে।এর একটি ব্যাখ্যা জগন্নাথ সঠিকভাবেই দিয়েছেন,“ ...বরাক বাংলায় প্রতিধ্বনিত্ব অধিকাংশ শব্দেই পাওয়া যায় না।বরাকে দ্বিতীয় অংশ শুরু হয় ঊর্ধ্ব সংবৃত পশ্চাৎ কণ্ঠ্যধ্বনি ‘উ’দিয়ে। যেমন => ভাতউত,রাইদউইদ,মাতউত...”৩৪১ ‘চাকর-উকর’,‘গিয়া-উয়া’,‘বাতাস-উতাস’, ‘হাওয়া –উয়া’ শব্দগুলো তাঁর অভিধানে নেই।কিন্তু সিলেটিতে একই যুক্তিতে এগুলোও প্রচলিত শব্দ --- এই কথা আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার থেকেই দাবি করতে পারি।অনুকার শব্দনির্মাণের এই নিয়ম কিন্তু অসমিয়াতে নেই।
১৯) “দুয়োটা ভাষাতে সর্বনাম আরু সর্বনামীয় রূপর সাদৃশ্য বহুখিনি বেছি। যেনে—মুই/মই।তু বাংলা: আমি,হে (সি) তু বাংলা: সে,হতাও হটাউ (সেইটো) তু বাংলা তাহাই,অত তু বাংলা: এত,কিওর( কিহর) তু বাংলা: কিসের,কুনদিন (কোনোদিনা,কেতিয়া) তু বাংলা: কখন,হৌ (সৌ )তু বাংলা: ঐ ইত্যাদি।”৩৪২
এর অধিকাংশই আসলে ধ্বনিতাত্ত্বিক রূপান্তর দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়।যেমন ‘স’ উচ্চারণে ‘হ’ প্রায় হয়ে যায় পুব বঙ্গীয় বহু ভাষাতে।তার উপরে হতাও-র বিকল্পে ‘হ’ লোপ পেয়ে অতাও,অটাও—শব্দগুলোও আছে।এর মধ্যে প্রথমটি বহুবচন।অসমিয়া শব্দ ‘কিহর’ তাই সিলেটিতে ‘কিঅর’—যে নজির তিনি নিজেও দিয়েছেন।তাছাড়া ‘তাহাই’ সাধুরূপ,মান বাংলা রূপ ‘তাই’।
এই ‘তাই’ আবার সিলেটি অসমিয়া ‘তাই’-র থেকে ভিন্ন।আমাদের যেটি অবাক করে মান বা সাধু বাংলার সঙ্গে সিলেটি সর্বনামের এতো বড় তফাত তাঁর নজর এড়িয়ে গেল কী করে! সিলেটি বা অসমিয়ার মতো মান বাংলাতে সর্বনামের কোনো লিঙ্গভেদ নেই।সিলেটি অসমিয়াতে লিঙ্গভেদে প্রথম পুরুষের স্পষ্টতই দুই ভিন্ন শব্দ রয়েছে—হে/ সি এবং তাই।কিন্তু তাই বলে সিলেটি অসমিয়াকে অভিন্ন ভাষা হয়ে যেতে গেলে বাকি প্রতিবেশী বাংলা ভাষাবৈচিত্র্যগুলোই বাদ যাবে কেন? নোয়াখালি,চট্টগ্রামীতে সব সময় আবার মূল শব্দটি ভিন্ন নয়।শুধু লিঙ্গ বোঝাবার পরসর্গগুলো ভিন্ন।যেমন,নোয়া.পুং--হেতে,হ্যেতে,ত্যে,হেইতে,তে;স্ত্রী—হেতি,হেইতি,হিতাই,হিতি এবং তাই।চট্ট.পুং—হিতে,তে,ই́তে (ই-র উপরে ঊর্ধ্ব স্বরাঘাত আছে) স্ত্রী—হিতি,হিতাই, ই́তি, তেই, এবং তাই।৩৪৩ ‘সে’-র সঙ্গে ‘তে’ কোত্থেকে এলো এই নিয়ে কিছু কথা আমরা আগে লিখেছি।‘হ’ লোপ পেয়ে প্রথমে ই́তি এবং পরে স্বর ব্যঞ্জনের স্থান বিপর্যয় হচ্ছে আর কেবল স্ত্রী লিঙ্গে ‘তাই’ শব্দ আসছে---এমন একটা অনুমানের কথাও আমরা উল্লেখ করেছিলাম।অর্থাৎ চট্টগ্রামী এবং নোয়াখালিতে প্রচলিত বিভিন্ন রূপের মধ্যে ‘তাই’ শব্দের উদ্ভবের ইতিবৃত্ত পাওয়া যাচ্ছে।সেই সঙ্গে এগুলো অসমিয়া শব্দ উৎসটিরও একটি ব্যাখ্যা দিচ্ছে।এটা দেখায় অসমিয়া ভাষা অধ্যয়নের জন্যেও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার পুব প্রান্তে চট্টগ্রাম অব্দি বাংলা ভাষা বৈচিত্র্যগুলো এবং অন্যান্য প্রতিবেশীভাষাগুলোর অধ্যয়ন কেন জরুরি।সেই সঙ্গে আমরা প্রাচীন ভারতীয় আর্য ‘ত্বয়া’র থেকে মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষাতেই ‘তাই’ এসেছে বলে সুনীতিকুমারের অনুমানেরও উল্লেখ করেছিলাম।জগন্নাথ চক্রবর্তীর এই কথাগুলোও ছিল,“... তবে এতে ঔপভাষিক স্ত্রীলিঙ্গ রূপ ‘তাই’ এবং আধুনিক বাংলার সম্ভ্রমাত্মক রূপ ‘তিনি’ এর প্রভাব থাকাও বিচিত্র নয়।’৩৪৪ ‘তাইন’ শব্দটি ক্ষয় পেয়েও ‘তাই’ হতে পারে।কিন্তু ‘তিনি’র উলটো গতির প্রভাবে ‘তাই’ হয়নি এটা নিশ্চিত হয়েই বলা যায়।‘তাই’ শব্দটি ঢাকাইয়ারও কিছু ভাষাবৈচিত্র্যে রয়েছে,আব্দুল হাই দেখিয়েছিলেন,সেখানে পুংলিঙ্গ শব্দটি ‘হ্যায়’।
তবে এরকম অনেক কিছুই উপেন রাভা হাকাচামের দৃষ্টির বাইরে থেকে যাবার প্রধান কারণ,আমরা অনুমান করতে পারি এই যে,তাঁর অধ্যয়নের বহু ভাষাবৈচিত্র্যের একটি ছিল সিলেটি।অসমের বর্তমান ভূখণ্ডের ভাষা এবং ভাষাবৈচিত্র্যগুলোকে নিয়েই তিনি যে বিশাল পরিসরে কাজ করেছেন সেরকম কোনো একক প্রয়াসে অধ্যয়ন অতি অল্প জনেই করেছেন।স্বাভাবিক ভাবেই একক কোনো ভাষাবৈচিত্র্যের সব দিকে তাঁর তাকানোও সম্ভব হবার কথা ছিল না,হয় নি। শুধু সিলেটি নয়,অসমের বহু ভাষাবৈচিত্র্য অধ্যয়নেই,মায় তাঁর মাতৃভাষা রাভার অধ্যয়নেও অসমের বর্তমান ভূখণ্ডের বাইরে তাকানো দরকার,সেটি যে কারণেই হোক তাঁর ভাবনাতে আসে নি।কিন্তু তারপরেও কিন্তু যেটুকু তাকিয়েছেন তার জন্যেই অসমের ভাষা তথা ভাষাবৈচিত্র্যগুলো নিয়ে অধ্যয়নে তাঁর গ্রন্থ একটি অমূল্য আকর গ্রন্থ বলে বিবেচিত হতে বাধ্য। আমরাও নানা ভাবে তাঁর সেই সব অধ্যয়ন থেকে উপকৃত হয়েছি, আর হব।সিলেটি সম্পর্কেও একই কথা।জগন্নাথ চক্রবর্তীর বইখানা বাদ দিলে বাংলাতে এর আগে সিলেটি নিয়ে এমন বিস্তৃত অধ্যয়ন অসমে অন্তত আমাদের নজরে পড়ে নি।অধ্যাপক নিখিলেশ পুরকাইত বা সুধাংশু শেখর তুঙ্গের বই দু’খানা যদিও বা আগেই বেরিয়েছে,সেগুলোও সিলেটি বা কাছাড়ি বিভাষার একক অধ্যয়ন ছিল না।সুতরাং সামগ্রিকতার একটি সমস্যা সেগুলোতেও আছে।জগন্নাথ চক্রবর্তীর বইখানাও সেই অর্থে সিলেটির সামগ্রিক অধ্যয়ন নয়।তবু বরাক উপত্যকার ভাষার একটা পরিচয় দেয়।এই বইখানা আগে বেরোলেও অসমের বাংলা বই বাঙালি পাঠকের কাছেই সহজে পৌঁছোয় না,তাঁর কাছেও পৌঁছোয় নি।বাংলাদেশে যা কিছু অধ্যয়ন হয়েছে,সেগুলোও হাতের কাছে পাওয়া আমাদের কাছেও একটা সমস্যা হিসেবেই থেকেছে।স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর আশ্রয় ছিল ইতিমধ্যে বেণুধর রাজখোয়া সহ অসমিয়া তাত্ত্বিকেরা যেটুকু অধ্যয়ন করেছেন সেগুলোই।এগুলো বাদ দিলে আসামে বাংলাতে যা কিছু আলোচনা হয়েছে সবই কিছু বাংলা ছোট কাগজে বা সংকলনে বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রকাশিত এবং স্বল্প পরিচিত।তার অতি সামান্যই তাঁর হাতে ছিল উল্লেখ পঞ্জি দেখে বোঝা যায়।কিন্তু অসম সাহিত্য সভার কিছু স্মরণিকার সাহায্য নিলেও যদি বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের প্রকাশিত বিভিন্ন স্মরণিকা বা পুস্তিকারও সন্ধান করতেন,মনে হয় তাঁর অধ্যয়নটি আরো পূর্ণাঙ্গতর হতে পারত।সুতরাং তিনি যেটুকু সিলেটির,বিশেষ করে সিলেটি এবং অসমিয়ার তুলনামূলক অধ্যয়ন করেছেন,আমাদের তার বহু প্রশ্নেই সহমত পোষণ করে এবং সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করেই,বহু প্রশ্নেই দ্বিমত পোষণ করে এগোনো ছাড়া উপায়ন্তর কিছু রইল না। আমাদের অধ্যয়নটিকে বলা যেতে পারে,সিলেটি এবং অসমিয়ার তুলনামূলক অধ্যয়নের যে প্রয়াস বেণুধর রাজখোয়াতে শুরু হয়ে অধ্যাপক উপেন রাভা হাকাচাম অব্দি অসমিয়া ভাষাতে হয়েছে বাংলা ভাষাতে তারই একটি সাম্প্রতিক বিস্তার কিংবা সম্প্রসারণ।যদিও আসামে বাংলা ভাষাতে আমাদের পূর্বসূরিও একেবারে দুর্লভ নন।তাঁদের মধ্যে অতি সাম্প্রতিক অধ্যাপক সুজিৎ চৌধুরীর কথা আমরা আগের অধ্যায়ে লিখে এসেছি। ব্রজদয়াল বিদ্যাবিনোদের কথা আমরা পরের অধ্যায়ে লিখব।
।। উল্লেখপঞ্জি।।
১) সুকুমার সেন: ব্যাকরণের প্রকার ও শাখা;তৃতীয় অধ্যায়;ভাষার ইতিবৃত্ত;আনন্দ পাবলিশার্স
প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা-৯;প্রথম আনন্দ সংস্করণ,তৃতীয় মুদ্রণ;নভেম্বর,১৯৯৪;প্রাগুক্ত;
পৃ: ৩১।
২) সুকুমার সেন: বাঙ্গালা রূপপ্রক্রিয়া;চতুর্দশ অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ:১৮৬।
৩) রামেশ্বর শ’ : রূপিম বা মূলরূপ ও রূপতত্ত্ব;সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা;পুস্তক
বিপণি,কলকাতা – ৯;অখণ্ড দ্বিতীয় সংস্করণ;৩০শে শ্রাবণ,১৩৯৯;পৃ: ৩৫৯।
৪) পবিত্র সরকার:বাংলা রূপতত্ত্বের ভূমিকা: বাংলা ব্যাকরণ প্রসঙ্গ;দে’জ পাবলিশিং,কলকাতা-৭৩;
প্রথম প্রকাশ-জানুয়ারি,২০০৬; পৃ: ১০৯।
৫) পবিত্র সরকার;প্রাগুক্ত;পৃ: ১১১।
৬) পবিত্র সরকার;প্রাগুক্ত;পৃ: ১১১।
৭) রামেশ্বর শ’: মূলরূপ বা রূপিমের শ্রেণীবিভাগ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৭৩।
৮) পবিত্র সরকার; প্রাগুক্ত;পৃ:১০৯।
৯) লীলাবতী শইকীয়া বরা শইকীয়া বরা: অসমীয়া ভাষার সর্গ, ইয়ার শ্রেণীবিভাগ আরু
প্রয়োগ;অসমীয়া ভাষার রূপতত্ত্ব;বনলতা গুয়াহাটি -০১ এবং ডিব্রুগড়-০১;দ্বিতীয় সংস্করণ-
অক্টোবর,২০১১; প্রাগুক্ত;পৃ: ১০।
১০) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ: ৮।
১১) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ:১২ ।
১২) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ:১৩।
১৩) পবিত্র সরকার;প্রাগুক্ত;পৃ:১১৪.।
১৪) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ:১২।
১৫) পবিত্র সরকার; প্রাগুক্ত;পৃ: ১০৯।
১৬) পবিত্র সরকার; প্রাগুক্ত;পৃ:১১০।
১৭) রামেশ্বর শ’: বাংলা রূপতত্ত্বের মূলসূত্র;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৭৭।
১৮) লীলাবতী শইকীয়া বরা:রূপতত্ত্ব এটি সাধারণ পরিচয়;প্রাগুক্ত;পৃ:৭।
১৯) সুকুমার সেন: বাঙ্গালা রূপপ্রক্রিয়া;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮৬।
২০) লীলাবতী শইকীয়া বরা: পদ,পদর শ্রেণীবিভাগ আরু সম্বন্ধবাচক শব্দ;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৮।
২১) ড০ বাণীকান্ত কাকতি কাকতি:রূপতত্ত্ব;অসমীয়া ভাষার গঠন আরু বিকাশ;বিশ্বেশ্বর হাজরিকার
অনুবাদ;ড০ বাণীকান্ত কাকতি জন্মশতবার্ষিকী উদ̖যাপন সমিতি,বরপেটা;অক্টোবর,১৯৯৬;
পৃ:২৬১।
২২) ড০ গোলক চন্দ্র গোস্বামী: শব্দর সাধন: (১): লিঙ্গ প্রকরণ;অসমীয়া ব্যাকরণ প্রবেশ; বীণা
লাইব্রেরী,গুয়াহাটি -০১; দ্বিতীয় সংস্করণ,২০০৩;পৃ: ১৮০।
২৩) লীলাবতী শইকীয়া বরা: নামপদর লিঙ্গ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬৫।
২৪) রবীন্দ্র কুমার দত্ত: নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের উপভাষার রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য; চতুর্থ অধ্যায়;
নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের উপভাষা—একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ;প্রগ্রেসিভ পাব্লিশার্স,কলকাতা-
৭৩;মার্চ,২০১২;পৃ:১৫১।
২৫) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: স্ত্রীলিঙ্গ; বাংলা শব্দতত্ত্ব;রবীন্দ্র রচনাবলী; ভাষাপ্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ,
কলকাতা পরিবেশিত বৈদ্যুতিন সংস্করণ;
http://www.rabindra-rachanabali.nltr.org/node/8633
২৬) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ:৬৭ ।
২৭) ড০ গোলক চন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:১৯২।
২৮) ড০ গোলক চন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:১৯৬
২৯) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ:৬৮।
৩০) জগন্নাথ চক্রবর্তী:রূপতত্ত্ব;বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান ও ভাষাতত্ত্ব;ভাষা-
সংস্কৃতি আকাদেমি অসম,হাফলং;প্রথম প্রকাশ- বৈশাখ,১৪২২বঙ্গাব্দ;পৃ: ৪৩৫।
৩১) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৩৬।
৩২) ড০ গোলক চন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:১৮২।
৩৩) ড০ গোলক চন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:১৮৩।
৩৪) ড০ গোলক চন্দ্র গোস্বামী: পদ প্রকরণ: নামপদ;প্রাগুক্ত;পৃ:২৪৬।
৩৫) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫৮।
৩৬) Suniti Kumar Chatterji:The Pronoun for the Third Person; The
Pronoun;Chapter IV; The Origin and Development of the Bengali
Language;Rupa & Co, Kolkata;1993;pg.: 825.
৩৭) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৫৪।
৩৮) নির্মল দাশ: পদপ্রকরণ;চতুর্দশ অধ্যায়;ভাষাবীথি; অরিয়েণ্টাল বুক কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড;
গুয়াহাটি-০১;প্রথম প্রকাশ-ফেব্রুয়ারি,২০০১;পৃ: ২২৪।
৩৯) ড০ গোলক চন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:২৩২।
৪০) ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর: শব্দরূপ;সমগ্র ব্যাকরণ কৌমুদী;সম্পাদক মহামহোপাধ্যায় দুর্গাচরণ
সাংখ্য –বেদান্ততীর্থ;দেব সাহিত্য কুটির প্রাইভেট লিমিটেড,কলকাতা -৯;এপ্রিল ১৯৯৪;
পৃ: ৯৯।
৪১) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ:২৫২।
৪২) লীলাবতী শইকীয়া বরা:নির্দিষ্টতাবাচক, অনির্দিষ্টতাবাচক, সম্বোধনাত্মক আরু অন্যান্য সর্গ;
প্রাগুক্ত;পৃ:৭৩।
৪৩) S.K. Chatterji: Post-positions; Declension of the Noun; Chapter II;
ibid.;pg.: 777.
৪৪) ড০ গোলক চন্দ্র গোস্বামী: শব্দর সাধন: (১): বচন প্রকরণ;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০৮।
৪৫) ড০ গোলক চন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০৯ এবং লীলাবতী শইকীয়া বরা: নামপদর বচন;
প্রাগুক্ত;পৃ:৫৭।
৪৬) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: বাংলা বহুবচন; বাংলা শব্দতত্ত্ব; ভাষাপ্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ, কলকাতা
পরিবেশিত বৈদ্যুতিন সংস্করণ;প্রাগুক্ত বৈদ্যুতিন ঠিকানা।
৪৭) S.K. Chatterji: Enclitic Definitives or Numaratives;ibid.; pg.: 779.
৪৮) ড০ বাণীকান্ত কাকতি কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ:২৬২।
৪৯) S.K. Chatterji: Number;ibid.;pg.: 737.
৫০) S.K. Chatterji:Post-positions; ibid.;pg.: 767.
৫১) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ:২৬৭।
৫২) সমিত কুমার সাহা: উত্তর দিনাজপুরের গুঁরি সম্প্রদায়ের ভাষাঃএকটি সমীক্ষা;উত্তর বঙ্গের
ভাষা;সম্পাদক রতন বিশ্বাস;বইওয়ালা,কলকাতা-৪৮;প্রথম প্রকাশ,দ্বিতীয় মুদ্রণ- অক্টোবর,
২০০৫;পৃ: ৫১৬।
৫৩) পরিতোষ চাকলাদার ও রতন বিশ্বাস: ধীমল ভাষা;উত্তর বঙ্গের ভাষা: সম্পাদক রতন
বিশ্বাস;প্রাগুক্ত;পৃ:৪৭২।
৫৪) দীপক কুমার রায়:বাংলা ভাষায় ভোটবর্মী উপাদান;উত্তর বঙ্গের ভাষা:সম্পাদক রতন বিশ্বাস;
প্রাগুক্ত;পৃ:৩৪৭।
৫৫) ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর: সুবন্ত-প্রকরণ;প্রাগুক্ত;পৃ:৭২।
৫৬) S.K. Chatterji: Number; ibid.;pg.: 725.
৫৭) Sudhāṃśu Śekhara Tuṅga: Noun and Pronoun;Bengali and Other
Related Dialects of South Assam;Mittal Publications,New Delhi-59;
first edition,1995;pg.: 191.
৫৮) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৩৮।
৫৯) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ:১৫৪।
৬০) S.K. Chatterji:Genetive; ibid.;pg.: 757.
৬১) অসীমকুমার সিংহ:অ’হিন্দু অরিজিন সম্পর্কে দ্বি-আক কথা,লগে আরতাউ য়ারি কতহান;
http://imarthar.blogspot.in/2010/11/blog-post_26.html ।
৬২) সঞ্জিতা সিংহ:বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা;অসমীয়া আরু অসমর ভাষা: সম্পাদক ড০ বিশ্বজিৎ দাস ,
ড০ ফুকন চন্দ্র বসুমাতারী;আঁক-বাক,গুয়াহাটি ৩;২০১০;পৃ: ৭০।
৬৩) S.S. Tuṅga;ibid. pg.: 178.
৬৪) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;৪৩৯ ।
৬৫) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ:২৬৫ ।
৬৬) ড০ গোলক চন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২১৮।
৬৭) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:বাংলা বহুবচন;শব্দতত্ত্ব;রবীন্দ্র-রচনাবলী;১২৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত
সুলভ সংস্করণ;বিশ্বভারতী;১৯৮৫;৬ষ্ঠ খণ্ড;পৃ: ৬৬১।
৬৮) S.K. Chatterji: Case Inflexions;ibid.;pg.:739 এবং ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;
পৃ: ২৬৩।
৬৯) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ:২৬৩।
৭০) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ:২৬৩।
৭১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: বাংলা বহুবচন; বাংলা শব্দতত্ত্ব; ভাষাপ্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ, কলকাতা
পরিবেশিত বৈদ্যুতিন সংস্করণ;প্রাগুক্ত বৈদ্যুতিন ঠিকানা।
৭২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: বাংলা বহুবচন;প্রাগুক্ত বৈদ্যুতিন ঠিকানা।
৭৩) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৩৭।
৭৪) আবিদ রাজা মজুমদার:বরাক উপত্যকার কথ্য বাংলার অভিধান;সৃজন, শিলচর -০১; প্রথম
প্রকাশ,২০১১;পৃ:১০২।
৭৫) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ: ৭৯
৭৬) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: বাংলা বহুবচন;প্রাগুক্ত বৈদ্যুতিন ঠিকানা।
৭৭) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ:৪৩৭।
৭৮) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:বাংলা বহুবচন;প্রাগুক্ত বৈদ্যুতিন ঠিকানা।
৭৯) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:বাংলা বহুবচন;প্রাগুক্ত বৈদ্যুতিন ঠিকানা।
৮০) ড০ গোলকচন্দ্র গোস্বামী; প্রাগুক্ত;পৃ: ২০৬।
৮১) লীলাবতী শইকীয়া বরা:নামপদর বচন;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫২।
৮২) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৩৭।
৮৩) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫৫।
৮৪) S.K. Chatterji: Number;ibid.; pg. 730.
৮৫) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:শব্দতত্ত্ব;পরিশিষ্টঃ ভাষাপ্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ,কলকাতা পরিবেশিত বৈদ্যুতিন
সংস্করণ;প্রাগুক্ত বৈদ্যুতিন ঠিকানা।আমাদের কাছে বিশ্বভারতীর দ্বারা ১৯৮৬তে প্রকাশিত
রবীন্দ্ররচনাবলীর যে সংস্করণটি আছে।সেখানে ‘শব্দতত্ত্বে’র সব প্রবন্ধগুলো নেই।নেই ‘বাংলা
শব্দতত্ত্ব’ বইটিও।এই কথা ৬ষ্ঠ খণ্ডের শেষে সম্পাদকেরা স্বীকারও করেছিলেন।(পৃ: ৮২৫)।ফলে
বৈদ্যুতিন সংস্করণের আশ্রয় নেয়া ছাড়া আমাদের উপায়ন্তর ছিল না।
৮৬) দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়:সম্প্রদান: ব্যাকরণ —রাজনীতি-অর্থনীতি;Pranab Chakroborty
ed.Interaction.(pp 4-1313) Nabadwip,Nadia.W.Bengal.
https://spbu.academia.edu/DEBAPRASADBANDYOPADHYAY
৮৭) সুকুমার সেন:বাঙ্গালা রূপপ্রক্রিয়া;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮৭।
৮৮) ড০ গোলকচন্দ্র গোস্বামী: বিভক্তি প্রকরণ;প্রাগুক্ত;পৃ:১৪৭।
৮৯) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ:২৬৯।
৯০) লীলাবতী শইকীয়া বরা : কারক আরু শব্দ-বিভক্তি;প্রাগুক্ত;পৃ:৯১।
৯১) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ:৯১।
৯২) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ:৯১।
৯৩) সুকুমার সেন : বাঙ্গালা রূপপ্রক্রিয়া;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯৫।
৯৪) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯৬।
৯৫) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯৬।
৯৬) S.K. Chatterji: Dative;Ibid.;pg.:761 এবং সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯৭।
৯৭) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯৫।
৯৮) S.K. Chatterji: Case Inflexions;Ibid.;pg.:740।
৯৯) সুকুমার সেন; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯৫।
১০০) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮৫।
১০১) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ:২৬৮।
১০২) নৈশব্দৰ লহৰত অনুভৱ; মিতালি বর্মণ; সত্তা..... এক অবিৰত যাত্ৰা…;
http://mbarman.blogspot.in/2011/03/blog- post_21.html
১০৩) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৭৫।
১০৪) গোলোক চন্দ্র;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪৮।
১০৫) ড০ নির্মল দাশ: কারক বিভক্তি; ঊনবিংশ অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৯৯।
১০৬) ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর: কারক;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫০০।
১০৭) ড০ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ : বাঙ্গালা ব্যাকরণ; মাওলা ব্রাদার্স; ঢাকা, বাংলাদেশ; প্রথম মাওলা
ব্রাদার্স সংস্করণ;আগস্ট,২০০৩;পৃ: ৬৫।
১০৮) ড০ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ : বাঙ্গালা ব্যাকরণ;মাওলা ব্রাদার্স;ঢাকা,বাংলাদেশ;প্রথম মাওলা
ব্রাদার্স সংস্করণ;আগস্ট, ২০০৩;পৃ: ৬৫।
১০৯) ড০ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ : বাঙ্গালা ব্যাকরণ; মাওলা ব্রাদার্স; ঢাকা, বাংলাদেশ; প্রথম মাওলা ব্রাদার্স
সংস্করণ;আগস্ট, ২০০৩;পৃ: ৬৬।
১১০) ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫০২।
১১১) নিখিলেশ পুরকাইত:অসমীয়া উপভাষা;ষষ্ঠ খণ্ড;বাংলা অসমীয়া ও ওড়িয়ার উপভাষার
ভৌগোলিক জরিপ;সুবর্ণ রেখা,কলকাতা-৯;প্রথম প্রকাশ,জুন,১৯৮৯;পৃ: ৩৪৩।
১১২) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৪৯ এবং ড০ উপেন রাভা হাকাচাম: ভাষা উপভাষার
তুলনামূলক আলোচনা;অধ্যায়: ৬;অসমীয়া আরু অসমর ভাষা উপভাষা;জ্যোতি প্রকাশন,
গুয়াহাটি;জুলাই ২০০৯;পৃ: ৩৪৬।
১১৩) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৮।
১১৪) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৭৩।
১১৫) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৬৯।
১১৬) S.K. Chatterji: Nominative ; Ibid.;pg.:744.
১১৭) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭০।
১১৮) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৭৭।
১১৯) নিখিলেশ পুরকাইত: বঙ্গ উপভাষাগুচ্ছ;তৃতীয় খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ২১৩।
১২০) মুহম্মদ আব্দুল হাই:ঢাকাই উপভাষা;বাঙলা ভাষা ২য় খণ্ড,স. হুমায়ুন আজাদ;আগামী
প্রকাশনী,ঢাকা ২০০৯;পৃ: ৩০১।
১২১) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৭৭।
১২২) নির্মল দাশ;প্রাগুক্ত;পৃ:৩০০।
১২৩) ড০ গোলক চন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫০।
১২৪) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭০।
১২৫) S.K. Chatterji:Locative and Oblique; Ibid.; pg.:750.
১২৬) S.K. Chatterji:Post-positions; Ibid.;pg. 770.
১২৭) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮৪।
১২৮) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৭৮।
১২৯) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯৯।
১৩০) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৭৯।
১৩১) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৬০।
১৩২) ড০ গোলক চন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪৪ ।
১৩৩) ড০ গোলক চন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫০।
১৩৪) ড০ গোলক চন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪৯।
১৩৫) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ: ৯৭।
১৩৬) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ: ৯৭।
১৩৭) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ:৩২৫।
১৩৮) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ: ৯৮।
১৩৯) লীলাবতী শইকীয়া বরা: অব্যয় আরু অনুপদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৬০।
১৪০) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ:১৭৫।
১৪১) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৭৪।
১৪২) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৭৮।
১৪৩) জগন্নাথ চক্রবর্তী; প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৬৪ ও ৩৬৫।
১৪৪) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৯।
১৪৫) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৬২ ।
১৪৬) রসরাজ শর্মা; অনথকপা খেলতাম আহাৎ উবা ইয়া -৩ ;ইমার ঠার;
http://imarthar.blogspot.in/2008/04/blog- post_2330.html
১৪৭) গোকুলানন্দ গীতিস্বামী;https://bpy.wikipedia.org/wiki/গোকুলানন্দ_গীতিস্বামী
১৪৮) S.S. Tunga; pg.: 175.
১৪৯) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৭৬।
১৫০) ড০ গোলক চন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:১৩৮।
১৫১) ড০ গোলক চন্দ্র গোস্বামী:প্রাগুক্ত;পৃ:১৩৯।
১৫২) S.K. Chatterji: Appendix A;Intriduction; ibid.;pg.: 165.
১৫৩) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৫৮।
১৫৪) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৬০।
১৫৫) George Abraham Grierson:Pronouns;Linguistic survey of India;
Vol.IV;Compiled and Edited by George Abraham Grierson;Calcutta :
Office of the Superintendent of Government Printing,India,1903-
1928;pg.: 43;
http://dsal.uchicago.edu/books/lsi/lsi.php?volume=5-
1&pages=463#page/55/mode/1up
১৫৬) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৮৭।
১৫৭) লীলাবতী শইকীয়া বরা:ক্রিয়াপদ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩২।
১৫৮) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৫।
১৫৯) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৫।
১৬০) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৫।
১৬১) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৫।
১৬২) ড০ আমিনুর রহমান সুলতান,নির্মল সরকার এবং মহম্মদ মামুন মিয়া:বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি;
ষষ্ঠশ্রেণি;সম্পাদনা- ড০ জীনাত ইমতিয়াজ আলী;জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড; ঢাকা;
২০১৩; পৃ: ৪৩।
১৬৩) পবিত্র সরকার: বাংলা ভাষা;প্রাগুক্ত;পৃ:1১৬।
১৬৪) ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর: তিঙন্ত-প্রকরণ;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৭৯।
১৬৫) Educationpedia of Bangladesh;বাংলা;পদপ্রকরণ;
http://www.edpdbd.org/uap/bangla/পদ-প্রকরণ
১৬৬) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০৪।
১৬৭) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ:১৩১।
১৬৮) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ:১৮৭।
১৬৯) জগন্নাথ চক্রবর্তী; প্রাগুক্ত;পৃ: ৪১৭।
১৭০) S.K.Chatterji: The Radical Tense; Ibid.; pg. 930.
১৭১) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২২৬।
১৭২) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৯৩।
১৭৩) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪০।
১৭৪) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪২।
১৭৫) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪৬।
১৭৬) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪০।
১৭৭) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৯৪।
১৭৮) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪১।
১৭৯) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ:২২৬।
১৮০) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৯৬।
১৮১) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪১৭।
১৮২) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪১ ।
১৮৩) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:বাংলাভাষা পরিচয়;অধ্যায় -১৯;রবীন্দ্র-রচনাবলী;১২৫তম জন্মজয়ন্তী
উপলক্ষে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ;বিশ্বভারতী;১৯৮৫;১৩শ খণ্ড; পৃ: ৬১৬।
১৮৪) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ:৩২০।
১৮৫) ড০ গোলক চন্দ্র গোস্বামী:ক্রিয়াপদ;প্রাগুক্ত;পৃ:২৮২।
১৮৬) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ:১৩৫।
১৮৭) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ:১৩৫।
১৮৮) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৭।
১৮৯) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৮।
১৯০) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ:১৩৮।
১৯১) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ:১৩৮।
১৯২) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ:১৩৮।
১৯৩) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৯।
১৯৪) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৯।
১৯৫) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪১।
১৯৬) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪১।
১৯৭) ড০ বিরাজ কুমার শৰ্মা:প্ৰকৃতির সৈতে আমার সম্পৰ্ক আরু ইয়ার ধ্বংসর কুফল;সাহিত্য ডট
অর্গ।
http://www.xahitya.org/2015/09/15/
১৯৮) আরহান ইনামূল:বিজ্ঞান বনাম ধৰ্ম;সাহিত্য ডট অর্গ;
http://www.xahitya.org/bigyan_dhormo_aarhan_inamul/
১৯৯) ড০ গোলোকচন্দ্র গোস্বামী; প্রাগুক্ত;পৃ:২৭৮।
২০০) বিকাশ কলিতা:ভূত,প্ৰেত আরু জিমি;সাহিত্য ডট অর্গ;
http://www.xahitya.org/2013/10/14/
২০১) ড০ গোলকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:২৯৫।
২০২) ড০ গোলকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:২৯৬।
২০৩) ড০ গোলকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:২৯৮।
২০৪) ড০ গোলকচন্দ্র গোস্বামী; প্রাগুক্ত;পৃ:২৮৪।
২০৫) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২১।
২০৬) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২১।
২০৭) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ:৩১৩ ।
২০৮) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ:৩১৩ ।
২০৯) ড০ গোলকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:৩০২।
২১০) সত্যনাথ বরা:দশম অধ্যায়;বহল ব্যাকরণ; বরুয়া এজেন্সি, গুয়াহাটি-১;সেপ্টেম্বর, ১৯৯২;
পৃ: ১৬৪।
২১১) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪১।
২১২) "পূৱ-নাগৰী’ বা "Eastern Nagari’;
http://asomiyatkothabotora.blogspot.in/2011/04/eastern-nagari.html
২১৩) লীলাবতী শইকীয়া বরা;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৯ ।
২১৪) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩১১।
২১৫) ড০ গোলকচন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ:২৯৩।
২১৬) ড০ গোলকচন্দ্র গোস্বামী:প্রাগুক্ত;পৃ:২৮১ ।
২১৭) লীলাবতী শইকীয়া বরা প্রাগুক্ত;পৃ: ১৩৬।
২১৮) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম: অসমীয়া ভাষার সমকালীন রূপঃ চল̖তি অসমীয়া;অধ্যায়: ৮;
প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৭৪।
২১৯) ড০ গোলক চন্দ্র গোস্বামী;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৮৬।
২২০) সুনীল অমিয়:ছাৰপ্রাইজ; অনুভব ডট অর্গ;
http://anubhabmarch.blogspot.in/2013/03/blog-post_8831.html
২২১) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ:৪১৭।
২২২) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৫৯।
২২৩) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪১৭।
২২৪) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪১৮।
২২৫) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৬৮।
২২৬) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৬৬।
২২৭) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৫৯।
২২৮) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৬৬।
২২৯) S.K. Chatterji: Verb Substansive, and Defective Verbs;Ibid.;pg.:1044.
২৩০) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০৫।
২৩১) সবজান্তা:বই এর নাম দিয়ে কৃতার্থ করুন;
http://www.sachalayatan.com/sobjanta/1670
২৩২) আমিরুল ইসলাম খান: গ্রাম্য অর্থনীতি;
http://www.amirulislamkhan.com/2011গ্ৰাম্য-অৰ্থনীতি- সবলীকৰণ/
২৩৩) S.K. Chatterji: Introduction; Ibid.;pg.:141.
২৩৪) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২২৬ ।
২৩৫) মহুয়া;পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা:সম্পাদনা দীনেশ চন্দ্র সেন; ১ম খণ্ড; প্রথম দে’জ সংস্করণ;জানুয়ারি,
২০০৯;পৃ:৫৩।
২৩৬) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮৬।
২৩৭) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৯৬।
২৩৮) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ:৪৩৫।
২৩৯) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯০।
২৪০) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৩৪।
২৪১) জগন্নাথ চক্রবর্তী: চর্যা ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের উত্তরাধিকার;প্রাগুক্ত;পৃ:৫৯৫।
২৪২) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৫৯৯।
২৪৩) রামেশ্বর শ’;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৯৯।
২৪৪) ড০ গোলক চন্দ্র গোস্বামী: বিভক্তি প্রকরণ;প্রাগুক্ত;পৃ:১৩৯
২৪৫) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৪৮।
২৪৬) সুকুমার সেন : বাঙ্গালা ভাষার লক্ষণ ও স্তরবিভাগ; একাদশ অধ্যায়; প্রাগুক্ত;পৃ: ১৪৯।
২৪৭) Añára Ruaínga ókkol óre asól bácinda bouli 1965 cón foijjonto mani
loóil. Ehón ór hókumot e yían no maner; Ruáinga hóde úun
honnún?;who are rohingya;
http://www.rohingyalanguage.com/2016/04/who-are-rohingya-
ruainga-hode- uunhonnun.html।
২৪৮) কুঙ্গ থাঙ:মাতৃভাষার মাসে শিখুন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী (প্রথম পাঠ);
http://www.somewhereinblog.net/blog/kungothangblog/28771374
২৪৯) ড০ গোলকচন্দ্র গোস্বামী: ক্রিয়াপদ;প্রাগুক্ত;পৃ:২৯১।
২৫০) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম: অসমীয়ার জাতিগত আরু সামাজিক শ্রেণীগত উপভাষা;অধ্যায়ঃ৫;
প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৮।
২৫১) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯৫।
২৫২) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম; প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৮।
২৫৩) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০০।
২৫৪) মুহম্মদ আব্দুল হাই: প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০২।
২৫৫) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম; প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৮।
২৫৬) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০০।
২৫৭) মুহম্মদ আব্দুল হাই;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০৩।
২৫৮) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম; প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৯।
২৫৯) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ:২০০।
২৬০) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৯।
২৬১) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ:২০৬।
২৬২) মুহম্মদ আব্দুল হাই প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০২।
২৬৩) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৯।
২৬৪) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ:১৯২।
২৬৫) মুহম্মদ আব্দুল হাই; প্রাগুক্ত;পৃ: ৩০২।
২৬৬) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৯।
২৬৭) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৭৯।
২৬৮) ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর:কৃৎ-প্রকরণ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪১৫।
২৬৯) ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪১৫।
২৭০) ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪১৫।
২৭১) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৫১।
২৭২) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৫১।
২৭৩) মুহম্মদ শহীদুল্লাহ;প্রাগুক্ত;পৃ: ৮০।
২৭৪) সুকুমার সেন; প্রাগুক্ত;পৃ: ২৫১।
২৭৫) পারিজাত হরণ;কুমর হরণ;অনন্ত কন্দলী;
https://as.wikisource.org/wiki/কুমৰ_হৰণ
২৭৬) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ:২৭১।
২৭৭) অদ্বৈত মল্লবর্মন:তিতাস একটি নদীর নাম;মাইতি বুক হাউস, কলকাতা ৭৩;প্রাগুক্ত;পৃ:১৯৮।
২৭৮) রবীন্দ্র কুমার দত্ত:পরিশিষ্ট ২;প্রাগুক্ত;পৃ:২৬২।
২৭৯) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ:২৬১।
২৮০) উদ্দীপ্ত কুমার ভট্টাচার্য:ফরিং;আখর;
http://www.aakhar.in/1-2016/foring.html
২৮১) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ:২৭১।
২৮২) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম:ভাষা-উপভাষার তুলনামূলক আলোচনা;অধ্যায়ঃ৬;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৪৯।
২৮৩) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২০।
২৮৪) S.K. Chatterji:Genetive;ibid.;pg.:759.
২৮৫) S.K. Chatterji;ibid.;pg.:755.
২৮৬) S.K. Chatterji;ibid.;pg.: 755.
২৮৭) S.K. Chatterji;ibid.;pg.: 757.
২৮৮) জগন্নাথ চক্রবর্তী:রূপতত্ত্ব;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৭১।
২৮৯) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৭১।
২৯০) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ:৪৬৭।
২৯১) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২০।
২৯২) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২০।
২৯৩) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩২০।
২৯৪) লীলাবতী শইকীয়া বরা; প্রাগুক্ত;পৃ:১৪৮।
২৯৫) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম:অসমীয়ার জাতিগত আরু সামাজিক শ্রেণীগত উপভাষা;অধ্যায়ঃ৫;
প্রাগুক্ত;পৃ:২৮০।
২৯৬) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯০,৯৬।
২৯৭) সুকুমার সিংহ বিমল: চঙা খুড়া;
http://imarthar.blogspot.in/search/label/কবিতা।
২৯৮) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯৭।
২৯৯) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ:৪৬৬।
৩০০) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২০৯।
৩০১) রবীন্দ্র কুমার দত্ত:নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের উপভাষার রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য; চতুর্থ অধ্যায়;প্রাগুক্ত;
পৃ:১৮১।
৩০২) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৫১।
৩০৩) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৫১।
৩০৪) who-are-rohingya; ibid.; http://www.rohingyalanguage.com
৩০৫) S.K. Chatterji:The Conjunctive;ibid.;pg.:1007.
৩০৬) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ:২৮০।
৩০৭) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮৬।
৩০৮) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৬।
৩০৯) মংগলসিং রংফার: অসমীয়াত্বর সংকট : কারণ, বিচার আরু প্ৰতিকার ;
http://www.xahitya.org/2015/06/15/oxomiyattor_xonkot_
mangalsingh_rongphar/
৩১০) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ:১৫৩।
৩১১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:বাংলা বহুবচন;প্রাগুক্ত বৈদ্যুতিন ঠিকানা।
৩১২) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ:২৮০।
৩১৩) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২২৬।
৩১৪) দীপ্তি ফুকন পাটগিরি;প্রাগুক্ত;পৃ: ৮৫।
৩১৫) ড০ বাণীকান্ত কাকতি;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৬৯।
৩১৬) সুকুমার সেন:বাঙ্গালা রূপপ্রক্রিয়া;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯৫।
৩১৭) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯৫।
৩১৮) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ:২৮০।
৩১৯) রবীন্দ্র কুমার দত্ত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৫৩-৫৪।
৩২০) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ:২৮০।
৩২১) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৮৪।
৩২২) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ: ২১০।
৩২৩) সুকুমার সেন;প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯৭।
৩২৪) নিখিলেশ পুরকাইত:বরেন্দ্র উপভাষাগুচ্ছ;চতুর্থ খণ্ড;প্রাগুক্ত;পৃ: ২৬৩।
৩২৫) নিখিলেশ পুরকাইত;প্রাগুক্ত;পৃ:২৬৯।
৩২৬) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ:২৮০।
৩২৭) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৯৩।
৩২৮) সত্যনাথ বরা:ষষ্ঠ অধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ:৮৮।
৩২৯) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ:২৮০।
৩৩০) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ:২৮০।
৩৩১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:বাংলাভাষা-পরিচয়;অধ্যায় ১৯;প্রাগুক্ত;পৃ:৬১৭।
৩৩২) দীপ জ্যোতি নাথ:জোলা আরু সাতটা ভূত; সাহিত্য ডট অর্গ; ডিচেম্বর, ১৫, ২০১৩;
http://www.xahitya.org/
৩৩৩) মুহম্মদ এনামূল হক:চট্টগ্রামী বাংলা;বাঙলা ভাষা:সম্পাদক হুমায়ুন আজাদ;প্রাগুক্ত;
পৃ: ২৭৮।
৩৩৪) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ:২৮০।
৩৩৫) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:বাংলাভাষা-পরিচয়;অধ্যায় ১৯;প্রাগুক্ত;পৃ:৬১৬।
৩৩৬) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ:২৮০।
৩৩৭) আবিদ রাজা মজুমদার;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৩১।
৩৩৮) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর;প্রাগুক্ত;পৃ:৬১৭।
৩৩৯) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ:২৮১।
৩৪০) জগন্নাথ চক্রবর্তী:ধ্বনিতত্ত্ব;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৪ ।
৩৪১) জগন্নাথ চক্রবর্তী;প্রাগুক্ত;পৃ: ৪০৩ ।
৩৪২) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম;প্রাগুক্ত;পৃ:২৮১।
৩৪৩) রবীন্দ্র কুমার দত্ত:প্রাগুক্ত;পৃ:১৫৮।
৩৪৪) জগন্নাথ চক্রবর্তী: রূপতত্ত্ব;প্রাগুক্ত;পৃ:৪৫৪।
~***~
Comments